লেখক বনধ
আমরা যাকে বলি হরতাল, কোলকাতায় তাকে বলে বনধ। কোলকাতা বনধ মানে সে শহর অচল। কাজকর্ম বন্ধ।
লেখক মাঝে মাঝে অচল হয়ে পড়েন। ইংরেজিতে একে বালে Writers block, আমি এর বাংলা করেছি—লেখক বনধ।
রাইটার্স ব্লক নিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প প্রচলিত আছে। Adger Alanpoe না কি রাইটার্স ব্লক হলে পকেটে পিস্তুল নিয়ে বের হয়ে পড়তেন। কাউকে খুন করলে ব্লক কাটবে এই আশায়। তাঁর নামে খুনের অভিযোগ অবশ্যি আছে। কে জানে রাইটার্স ব্লক কাটানোর জন্যে এই খুন করা হয়েছে কি না।
বিভূতিভূষণ রাইটার্স ব্লক হলে বনে জঙ্গলে হাঁটতেন। এতে বাংলা সাহিত্যের লাভই হয়েছে। বনভূমি নিয়ে অপূর্ব লেখা আমরা পেয়েছি।
“বাতাবি লেবুর ফুল নয়, ঘেঁটুফুল নয়, আম্রমুকুল নয়, কামিনী ফুল নয়, কী একটা নামগোত্রহীন রূপহীন নগণ্য জংলি কাটাগাছের ফুল। আমার কাছে কিন্তু তাহাই কাননভরা, বনভরা, কুসুমরাজির প্রতীক হইয়া দেখা দিল।… (আরণ্যক)
ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাঁর কখনো রাইটার্স ব্লক হয়েছে কি না। তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলেছেন, রাইটার্স ব্লক হবার সময় কোথায়? সময় পেলে না হবে। লিখে কূল পাচ্ছি না।
এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতামত জানতে পারলে ভালো হতো। আমি কোনো লেখায় কিছু পড়ি নি। কোলকাতার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একটি চিঠিতে পড়েছিলাম বেশ কিছুদিন হলো তিনি লিখতে পারছেন না। সেই না পারাটা শারীরিক কোনো অসুস্থতার কারণে কি না তা এখন আর মনে পড়ছে না।
কল্লোল যুগের লেখকদের কেউ কেউ নাকি ব্লক ছুটানোর জন্যে বিশেষ পল্লীতে যেতেন। সেই পল্লীতে তারা ব্লক ছাড়াও যেতেন বলেই ব্লক কাটানোর উপায় বিশেষ পল্লী হতে পারে না।
রাইটার্স ব্লক ব্যাপারটা সম্পর্কে একটু ব্যাখ্যা করে বলি। এটা এক ধরনের অসুখ। সাধারণ পর্যায়ে অসুখের লক্ষণ হচ্ছে–লিখতে ইচ্ছা না হওয়া। মাথায় গল্প আছে, কিন্তু লিখতে ইচ্ছা করছে না। সাধারণ এই অসুখ সর্দিজ্বরের মতো কোনোরকম চিকিৎসা ছাড়াই আরাম হয়। এই অসুখ সাতদিনের মধ্যেই সারে।
এখন বলি জটিল ধরনের রাইটার্স ব্লকের কথা। এই রোগে রোগী (অর্থাৎ লেখক) মারাও যান। নোবেল পুরস্কার পাওয়া জাপানি ঔপন্যাসিক কাওয়াবাতা হারিকিরি করে মারা গিয়েছিলেন। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে অনেকেই লিখতে না পারার কষ্টের কথা বলেছেন। যে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বিষয়ে একই কথা। যদিও তাঁর পরিবার থেকে বলা হয়েছে বন্দুকের নল পরিষ্কার করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু। অনেকেই বলেন, হঠাৎ লেখা বন্ধ হবার কষ্ট আত্মহনন।
রোগের কঠিন আক্রমণে লেখক দিশেহারা হয়ে যান। কী করবেন বুঝতে পারেন না। ঘণ্টার পর ঘন্টা লেখার টেবিলে বসে থাকেন। একটি শব্দও তার কলম দিয়ে বের হয় না। তার নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হয়। সেই রাগ তিনি পরিবারের সদস্যদের প্রতি ছড়িয়ে দেন। এক পর্যায়ে শারীরিকভাবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেঁচে থাকা তার কাছে অর্থহীন মনে হতে থাকে।
বহুকাল আগে আমি আমেরিকার lowa বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিভাগে গিয়েছিলাম আমন্ত্রিত লেখক হিসেবে। সেখানে পৃথিবীর নানান দেশের লেখক এসেছিলেন। গল্প, কবিতা পাঠ, সেমিনার এই ছিল প্রোগ্রাম। মোটামুটি হাস্যকর অবস্থা। এক কবিতা পাঠের আসরে দুই কবির মধ্যে মারামারি পর্যন্ত লেগে গেল। কবিরা যে বক্সিং-এ ওস্তাদ হন তা জানতাম না।
একটি সেমিনার ছিল রাইটার্স ব্লকের ওপর। লেখকরা বলেছেন নিজ নিজ অভিজ্ঞতার কথা। রাইটার্স ব্লক হলে তারা কী করে এর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করেন এইসব।
একজন বললেন, (তিনি কোন দেশের লেখক, কী নাম তা এখন আর মনে করতে পারছি না) আমি তখন আপেল খাই। সবুজ আপেল। এতে আমার রাইটার্স ব্লক কাটে। [আমি নিশ্চিত এটা একটা ফাজলামি। তার কোনোদিনই রাইটার্স ব্লক হয় নি। এই অসুখ গৌণ লেখকের হয় না।]
আরেকজন বললেন, আমি চলে যাই সমুদ্রের কাছে। সমুদ্রের ঢেউ কীভাবে আছড়ে পড়ে তা দেখি। ধারাবাহিক ঢেউ দেখতে দেখতে লেখার ধারাবাহিকতা ফিরে আসে। [আমি সেমিনারের শেষে আলাপ করে জেনেছি এই, লেখক থাকেনই সমুদ্রের পাড়ের এক বাংলোবাড়িতে।]
ইন্দোনেশিয়ার এক কবি বললেন, আমি তখন যোগব্যায়াম করি। এবং চোখ বন্ধ করে ফিবোনাচ্চি সিরিজ ভাবি। এতে আমার ব্লক কাটে। [ব্যায়ামের অংশটা ঠিক হতে পারে, তবে ফিবোনাচ্চি সিরিজের ব্যাপারটা পুরোটাই ভুয়া বলে আমার ধারণা। কারণ এই সিরিজ কিছুক্ষণের মধ্যেই যথেষ্ট জটিল হয়ে দাঁড়ায়। খাতাকলম ছাড়া সিরিজের সংখ্যা বের করা অসম্ভব ব্যাপার। যদি না তিনি রামানুজন বা ইউলারের মতো বড় কোনো ম্যাথমেটিশিয়ান না হন। ফিবোনাচ্চি সিরিয়েল হলো ১ ১ ২ ৩ ৫ ৮ ১৩ ২১…]
লেখকরা নিজেদের প্রসঙ্গে বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বলতে পছন্দ করেন। তারা সারাক্ষণ এক ধরনের ঘোরের মধ্যে থাকেন বলেই অন্যরা যে বানিয়ে বলা বিষয়টা ধরে ফেলেছে তা বুঝতে পারেন না।
এখন আমি আমার নিজের রাইটার্স ব্লক বিষয়ে বলি। না, এই জিনিস আমার হয় না। কাগজ-কলম নিয়ে লেখার টেবিলে বসলেই হলো। মনে করা যাক, হিমু নিয়ে একটা লেখা লিখছি। হঠাৎ লেখা আটকে গেল। তখন অন্য একটা খাতা টেনে নেই। লিখি মিসির আলি বা সায়েন্স ফিকশান। এ থেকে কী প্রমাণিত হয়? দুটি জিনিস প্রমাণিত হয়।
ক) আমি একজন গৌণ লেখক। কারণ শুধুমাত্র গৌণ লেখকরাই রাইটার্স ব্লক থেকে মুক্ত।
খ) আমি একজন শ্রমিক লেখক। শুধুমাত্র শ্রমিক লেখকরাই সারাক্ষণ লিখতে পারেন।
তবে আশার কথা এইসব নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত না। আমার এই লিখে যাওয়াতেই আনন্দ।
.
পাদটিকা
শাওন আমার এই লেখার প্রুফ দেখছিল। সে বলল, রাইটার্স ব্লক বিষয়ে নিজের সম্পর্কে যা লিখেছ তা ঠিক না। আমার পরিস্কার মনে আছে লীলাবতী উপন্যাস লেখার সময় হঠাৎ লেখা বন্ধ হয়ে গেল। রাতে ঘুমাতে পার না। সারারাত টিভি দেখ, হাটাহাটি কর। খাওয়া প্রায় বন্ধ হবার জোগার। তোমার ব্লক বিশদিনের মতো ছিল।
শাওনের কথায় যথেষ্ট আহ্লাদ বোধ করলাম। রাইটার্স ব্লক যেহেতু হচ্ছে মনে হয় আমি গৌণ লেখক না। হা হা হা। বেঁচে থাকুক রাইটার্স ব্লক।