৩
মি. ফ্রেডারিক ফিলিপ, বহুদিন পর আমি অফিসের চেয়ারে বসলাম। শপথ নিয়েছিলাম, আমার অন্তর জুড়ে যে ভয়ানক ঘা আহমদ মুসা সৃষ্টি করেছে, সে ঘা নিয়ে আমি চেয়ারে বসব না। যদি কোনো দিন তাকে হাতের মুঠোয় আনতে পারি, তাহলেই শুধু আমি চেয়ারে ফিরে যাব।
গম্ভীর কণ্ঠে বলল ফ্রান্সিস বাইক। সে আর্মি অব ক্রাইস্ট অব ওয়েস্ট আফ্রিকা (AocoWA)-এর প্রধান এবং ফ্রান্সিস বাইক কথাগুলো যাকে উদ্দেশ্য করে বলল সেই ফ্রেডারিক ফিলিপ হলো কিংডোম অব ক্রাইস্ট (Koc) নামক পশ্চিম আফ্রিকীয় একটা সংগঠনের প্রধান।
ক্যামেরুনে আহমদ মুসার হাতে মারাত্মক বিপর্যয়ের পর A0COWA (আকোয়া) এবং KOC (কোক) তাদের সব অফিস ও ঘাঁটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল। ইয়াউন্ডির অল্প উত্তরে ৩নং ন্যাশনাল হাইওয়ের পাশে আকোয়ার এই অফিস নেয়া হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। কিন্তু এ অফিসেও বসেনি ফ্রান্সিস বাইক তার ঐ শপথের কারণে।
কোক প্রধান ফ্রেডারিক ফিলিপের ঠোঁটে এক টুকরো হাসি। বলল, আহমদ মুসা এখনো হাতের মুঠোয় তো আসেনি মি. ফ্রান্সিস।
দারুস সালাম থেকে খবর দিয়েছে, সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে হাতে পায়ে বেড়ি লাগিয়ে কফিনে ভরে বিমানে তুলেছে। এখন বিমান চলছে। লুসাকার পথে। লুসাকা বিমানবন্দরে সব ব্যবস্থা করাই আছে। ওখানে কোনো সমস্যা হবার ভয় নেই। অতএব এটা হাতের মুঠোয় আসার চেয়ে কম কি। বলল ফ্রান্সিস বাইক।
সে আহমদ মুসা না হলে এত ভয় হতো না। এ পর্যন্ত কোনো বন্দিখানাই আহমদ মুসাকে আটকাতে পারেনি। ফ্রেডারিক ফিলিপ বলল।
এদিক দিয়ে ঠিকই বলেছেন ফ্রেডারিক। মনে হয় ঈশ্বর তাকেই শুধু ফেভার করেন। বলল ফ্রান্সিস বাইক।
শুনেছি, আহমদ মুসার আচরণ নাকি খুবই মানবিক। শত্রু হলেও, অন্য ধর্মের লোক হলেও বন্দি বা পরাজিত শত্রুকে তিনি সম্মান দেখান। পরাজিত বা বন্দি কাউকে তিনি আঘাত করেন না। আহত ও পরাজিত শত্রুদের সাধ্যমত চিকিৎসা দেন। ফ্রেডারিক ফিলিপ বলল।
সংগে সংগেই কিছু বলল না ফ্রান্সিস বাইক। তার মুখ গম্ভীর।
চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলল, মি. ফিলিপ, আহমদ মুসার এটা কোনো নিজস্ব গুণ নয়। আমাদের বলতে কষ্ট হলেও এটাই সত্য যে, এই মানবিকতা তার ধর্মেরই একটা নীতি। বিভিন্ন যুদ্ধে ও বিচার-আচারে তাদের রাসুল এই দৃষ্টান্তই স্থাপন করে গেছেন। ভ্যাটিকানে আমাদের একজন সি-ি নয়ার কার্ডিনাল একদিন প্রসঙ্গক্রমে ইসলামের রাসুল মোহাম্মদ-এর একটি উক্তি উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ইসলামের রাসুল বলেন যে, অন্য ধর্মের লোকদের উপর অন্যায়-অবিচার করা হলে, শেষ বিচারের দিনে তিনি স্বয়ং মজলুম অন্যধর্মের লোকদের পক্ষে দাঁড়াবেন।
আর, বলেন না এসব কথা। এমনিতেই আমরা মুসলমানদের সাথে পারছি না। সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, কৌশলে বাধ্য করে খৃস্ট ধর্মের মধ্যে ওদের আনছি। কিন্তু সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করে ফিরে যাচ্ছে তাদের ধর্মে। রাজনৈতিক শক্তি বিভিন্ন দেশে আমাদের পক্ষে আছে বলেই নানা অজুহাতে ওদের বিদ্রোহের মাথা আমরা ভাঙতে পারছি। এই অবস্থায় ইসলামের সত্য রূপ যদি সবার সামনে আসে তাহলে আমাদের ভাত ওঠে যাবে। ফ্রেডারিক ফিলিপ বলল।
থাক এসব কথা। দেয়ালেরও কান আছে। ভয় করো না, বিশেষ করে মধ্য আফ্রিকার মুসলমানরা নিজেদের সম্পর্কেই জানে না। ফলে আত্মরক্ষার শক্তি ওদের দুর্বল। এটাই আমাদের জন্যে সুবিধার দ্বার খুলে দিয়েছে। বলল ফ্রান্সিস বাইক।
কথা শেষ করেই আবার বলে উঠল ফ্রান্সিস বাইক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, কলিন ক্রিস্টোফার তো কখনো এমন দেরি করে না। আসার সময় পার হয়ে গেছে আধা ঘণ্টা আগে।
কলিন ক্রিস্টোফার ব্ল্যাক ক্রসের নতুন প্রধান। আহমদ মুসার হাতে পিয়েরে পল নিহত হবার পর সে নতুন নিয়োগ পেয়েছে।
হঠাৎ কোথাও এনগেজড হয়ে যেতে পারে। আলফ্রেড ফিলিপ বলল।
হতে পারে। একটা বিষয় আলফ্রেড, ব্ল্যাক ক্রসের বিশ্বজোড়া তৎপরতা। আমাদের সকলের মাদার সংগঠন ওটা। কিন্তু তার কাজে আগের সেই স্পিড় নেই। বলল ফ্রান্সিস বাইক।
কিন্তু ফ্রান্সিস আবার সেই সময়ও এখন নেই। আফ্রিকার মুসলমানরা সব দিক থেকেই পিছিয়ে আছে। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার অনেক দেশে মুসলমানরা সুযোগ ও শক্তির ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। বিশেষ করে শক্তিশালী কয়েকটি মিডিয়া তাদের পক্ষে অমূল্য ভূমিকা পালন করছে। সবার চোখের আড়ালে আমরা যা ইচ্ছে তাই এক সময় করেছি। সে রকম কিছু করার সুযোগ ক্রমেই সংকীর্ণ হচ্ছে। আলফ্রেড ফিলিপ বলল
ক্যামেরুনে আপনি যা দেখেছেন, সেটা কিন্তু সব অঞ্চলের অবস্থা নয়। প্রায় গোটা মধ্য আফ্রিকায় আমরা অনেকদিন নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারব। বলল ফ্রান্সিস বাইক।
কথা শেষ করতেই মোবাইল বেজে উঠল ফ্রান্সিস বাইকের। ধরল মোবাইল সে।
ওপারের কথা শুনে কল অফ করে দিয়ে বলল, ওকে মি. ফ্রেডারিক, প্রটোকল অফিসারের টেলিফোন। মি. কলিন এসে গেছেন।
দরজায় নক হলো। ফ্রান্সিস বাইক গিয়ে দরজা খুলল। ফ্রেডারিক ফিলিপও উঠে দাঁড়িয়েছে।
ঘরে প্রবেশ করল কলিন ক্রিস্টোফার, ব্ল্যাক ক্রস-এর নতুন প্রধান। এটা খ্রিস্টান স্বার্থকে প্রমোট করার গোপন সন্ত্রাসী সংগঠন। এটা গোটা দুনিয়ায় কাজ করে। খ্রিস্টান দেশসমূহ ও খ্রিস্টান সংগঠনগুলো ব্ল্যাক ক্রস-এর প্রকাশ্যে সমালোচনা করলেও এদের কাজ বন্ধ করার জন্যে কার্যকর কিছুই করে না।
সবাই বসল।
স্যরি মি. ফ্রান্সিস ও ফ্রেডারিক, অস্বাভাবিক দেরি হয়ে গেল। ভূমি মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম। আশা ছিল দশ-বিশ মিনিটের বেশি দেরি হবে না। সুতরাং এখানে আমি সময়ের আগেই পৌঁছতে পারব। কিন্তু তা হলো না। ওখানে অনেক ঝামেলা। শেষ পর্যন্ত কাজ উদ্ধার হয়নি। বলল কলিন। ক্রিস্টোফার।
কি ঝামেলা? জিজ্ঞাসা ফ্রান্সিস বাইকের।
আর বলেন না। ক্যামেরুন সরকার খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। চার্চের হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রজেক্টের জন্যে ঐ জমি কেনার ব্যাপারটা…।
কলিন ক্রিস্টোফার কথা শেষ করার আগেই ফ্রান্সিস বাইক তার কথার মাঝখানে বলে উঠল, জমিটা রেজিস্ট্রি হয়নি?
না মি, ফ্রান্সিস। পারমিশনই এখনো পাওয়া যায়নি। সেটা নিয়েই তো ঝামেলা।
কি ধরনের ঝামেলা? ফ্রেডারিক ফিলিপ বলল।
কলিন ক্রিস্টোফার কথা বলার আগেই ফ্রান্সিস বাইক বলল, লোকাল কাউন্সিলের পারমিশন পাওয়া গেছে। জমির মালিকও নিজে এসে জমি রেজিস্ট্রি করে দেবে বলে জানি। তাহলে আবার ঝামেলা কেন?
এতটুকুতেই হবে না। মুসলিম সমিতির নো অবজেকশন সার্টিফিকেট লাগবে। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
কিন্তু অনেক কেনা-বেচা তো হচ্ছে, এ রকম সার্টিফিকেট তো লাগছে? বলল ফ্রান্সিস বাইক। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
খ্রিস্টানরা মুসলমানদের জমি কেনার ক্ষেত্রেই শুধু এই আইন হয়েছে। আর যেহেতু বেশি জমি সেজন্যে মুসলিম সমিতির সার্টিফিকেট অপরিহার্য করা হয়েছে।
কারণ কি? ফ্রান্সিস বলল।
আমিও এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলাম সংশ্লিষ্ট অফিসারকে। সে কোনো জবাব দিতে পারেনি। মন্ত্রীর সাথে দেখা হয়েছিল, তাকেও এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আগে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে এটা তারই প্রতিক্রিয়া। আর যাতে ভয় বা লোভ দেখিয়ে মুসলমানদের জমা-জমি, বাড়ি-ঘর খ্রিস্টানরা কজা করতে না পারে, সেটাই নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছে এই আইনের দ্বারা। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
চরম সাম্প্রদায়িক আইন এটা। ফ্রান্সিস বাইক বলল।
তা ঠিক মি. ফ্রান্সিস। কিন্তু পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে আমরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম এটা অস্বীকার করা যাবে না। এটা আমাদের ভুল ছিল। দেখুন, ওমর বায়ার দশ হাজার একর জমি দখলের জন্যে আমরা পাগল হয়ে উঠেছিলাম। এই একটা ঘটনাই পরিণতিতে আমাদের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
এ কথা এখন বুঝছি, তখন বুঝিনি। কারণ মুসলমানরা ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু করতে পারে, এর কোনো ছোটখাট দৃষ্টান্তও ছিল না। ওমর বায়ার জমি দখলের ক্ষেত্রেও কিছু হতো না যদি আহমদ মুসা দৃশ্যপটে না আসত। এই আহমদ মুসাই আমাদের সর্বনাশের মূল। এবার তাকে হাতের মুঠোয় পেয়েছি। যা সে আমাদের কাছ থেকে নিয়েছে তা কড়ায়গণ্ডায় আদায় করব। তারপর দুনিয়া থেকে তাকে বিদায় করব। ফ্রান্সিস বাইক বলল।
তাকে হাতে পাওয়া গেছে বলা যায়, কিন্তু তার কাছ থেকে হারানো কিছু আদায় করতে পারব, এ চিন্তা না করাই ভালো। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
কেন? আদায় করা যাবে না কেন? তাকে হাতের মুঠোয় আনা হয়েছে। তো এই কারণেই। ফ্রান্সিস বাইক বলল।
পুনর্বাসন ও ক্ষতিপুরণ আদায়ের ক্ষেত্রে আহমদ মুসা কতকগুলো সুবিধা পেয়েছিল, সেসব আমরা পাব না। আহমদ মুসা বিষয়টি বিশ্বমিডিয়ায় নিয়ে এসেছিল এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনসহ গোটা বিশ্বে বিরাট জনমত গড়ে উঠেছিল তাদের পক্ষে। তাছাড়া আহমদ মুসা শুধু আপনাকে নয় গোটা অফিসকে, প্রয়োজনীয় সব দলিল-দস্তাবেজ এমনকি চেকবই পর্যন্ত হাত করেছিল। সুতরাং আমাদেরকে বাধ্য করা তার জন্যে পানির মতো সহজ হয়েছিল। সে ধরনের কিছু করার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
সে রকম কিছু আমরা পারব না ঠিক। কিন্তু আমরা তো পারি তাকে স্যান্ডউইচ বানিয়ে আমাদের দেড় হাজার মিলিয়ন ডলার আদায় করতে। এটুকুও যদি আমরা না করি, তাহলে পয়সা খরচ করে ধরে এনে আমাদের। লাভ কি? ফ্রান্সিস বাইক বলল।
টাকা না মিললেও স্যান্ডউইচ বানানোর মধ্যে একটা লাভ আছে। তা। ছাড়াও আরো বড় লাভ আছে। সেটা হলো তার বুজুমবুরা যাওয়া বানচাল। করা। বুরুন্ডির বুজুমবুরা গোটা আফ্রিকার খ্রিস্টান স্বার্থের হৃদপিণ্ড। বুজুমবুরার পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটি শুধু ইউনিভার্সিটিই নয়, এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গোটা মধ্য আফ্রিকায় গোপন খ্রিস্টীয়করণ অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আহমদ মুসা এটা জানে বলেই ছোট দেশ বুরুন্ডির অখ্যাত বুজুমবুরায় যাবার উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে সে আমাদের জন্যে অকল্পনীয় কোনো বিপদ ডেকে আনতে পারে। খোদাও যিশুর দয়া যে, আমরা তাকে পথেই আটকাতে পেরেছি। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
ধন্যবাদ মি. কলিন, এদিকটা মোটেও আমি চিন্তা করিনি। সে বুজুমবুরা যাচ্ছিল নিশ্চয় বড় একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। পশ্চিম আফ্রিকায় আমাদের মাথায় বাড়ি দিয়ে পূর্ব আফ্রিকায় যাচ্ছিল কার মাথা ভাঙার জন্যে কে জানে! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, তার উদ্দেশ্য পূরণ হলো না। ফ্রান্সিস বাইক বলল।
মি. ফ্রান্সিস, লাভ আমাদের আরো আছে। আমাদের যে ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে সত্তরগুণ লাভ আমরা করতে পারি। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
ফ্রান্সিস বাইক ও আলফ্রেডের চোখ লোভে চকচক করে উঠল। বলল, কীভাবে? এ বিষয়ে তো কোনো আলোচনা করেননি?
আলোচনা কখন করব। এখানে আসার পাঁচ মিনিট আগে এই লাভের অফারটা পেলাম। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
কি অফার? কোত্থেকে? আলফ্রেড ও ফ্রান্সিস দুজনেই বলে উঠল।
আমেরিকা থেকে আমাদের ব্ল্যাক ক্রস-এর প্রধান আলেকজান্ডার উইলিয়াম জানিয়েছেন, সেখানকার একটা গোপন উদীয় ক্রিশ্চিয়ান সংগঠন আহমদ মুসাকে যদি জীবন্ত ওদের হাতে দেয়া যায় তাহলে দুই বিলিয়ন ডলার, আর তার লাশ দিলে এক বিলিয়ন ডলার দেবে। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
ফ্রান্সিস বাইক ও আলফ্রেড লোভাতুর ও বিস্মিত চোখে তাকাল কলিন ক্রিস্টোফারের দিকে। বলল, ধন্যবাদ মি. কলিন। এই দুর্দিনে সত্যি এটা আমাদের জন্যে একটা বড় খবর।
কিন্তু আমরা আহমদ মুসাকে এখনো আমাদের হাতে পাইনি। না পাওয়া পর্যন্ত এই সংবাদ আমাদের জন্যে বড় সংবাদ নয়। আহমদ মুসাকে আমাদের লোকরা বন্দি করেছে ঠিকই, কিন্তু ওদিকে তার লোকরাও এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এখানে আসার আগে এই খবর জানতে পারলাম যে, আহমদ মুসার কিডন্যাপ হওয়ার বিষয়টা ওয়ার্ল্ড মুসলিম সংগঠন রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামী এবং সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের কয়েকটি দেশ জানতে পেরেছে ইতিমধ্যেই। রাবেতা ও মুসলিম দেশগুলো যোগাযোগ করেছে তানজানিয়া ও জাম্বিয়া সরকারের সাথে। আহমদ মুসাকে কফিনে করে বিমানে যে লুসাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেটা তারা জানতে পেরেছে। নিশ্চয় তারা তানজানিয়া ও জাম্বিয়ায় লোক পাঠাবে। সবচেয়ে বড় খবর হলো, মার্কিন ও চীন সরকারও যোগাযোগ করেছে তানজানিয়া ও জাম্বিয়ার সাথে। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
ফ্রান্সিস বাইক ও আলফ্রেড দুজনেরই মুখ চুপসে গেল। বলল ফ্রান্সিস বাইক, তাহলে তো এখনি লুসাকায় ইভানজেলিস্ট ফর পাওয়ার (FEP)
এর প্রধান অসওয়াল্ড আলফ্রেডকে সাবধান করা দরকার। তিনি যেন বন্দিকে। আরো সাবধানে রাখেন।
অসওয়াল্ড এর মধ্যে কোনো টেলিফোন করেনি? বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
কফিন খোলার পরেই আমাকে জানিয়েছে। ফ্রান্সিস বাইক বলল।
কোথায় কীভাবে রেখেছে তা কি জানিয়েছে? জিজ্ঞাসা কলিন ক্রিস্টোফারের।
হাত-পায়ে বেড়ি লাগানো অবস্থাতেই বন্দিখানায় রাখা হয়েছে। যখন বন্দিখানায় তোলা হয় তখনও তার জ্ঞান ফিরে আসেনি। ফ্রান্সিস বাইক বলল।
ঠিক আছে, তাকে টেলিফোন করো। তাকে আরো সাবধান থাকতে বলা দরকার। সেই সাথে জানা দরকার, আহমদ মুসার পক্ষে যে তৎপরতা শুরু হয়েছে তার কোনো প্রভাব লুসাকায় পড়েছে কিনা। মার্কিন ও চীন সরকার যদি তৎপর হয় তাহলে সেটা আমাদের জন্যে বিপজ্জনক হবে। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। দারুস সালাম বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে আহমদ মুসাকে কিডন্যাপের কাজটা এতটাই গোপনে ও নিঃশব্দে হয়েছে যে, ইমিগ্রেশনের কয়েকজন অফিসার, বিমানবন্দর সিকিউরিটির প্রধান ও তার দুজন সহকারী ছাড়া আর কেউ জানে না। এদের সবাইকে টাকা দিয়ে কেনা। হয়েছে। এরা মুখ খুলতেই পারে না। তাহলে বিষয়টা লিক হলো কি করে? ফ্রান্সিস বাইক বলল।
সন্দেহ নেই মি, ফ্রান্সিস, ইমিগ্রেশনের কোনো অফিসার এ খরবটা সৌদি আরবের দূতাবাসকে কোনোভাবে জানিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে সৌদি সরকার জেনেছে। তারা সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। ইমিগ্রেশনের কয়েকজন অফিসার ছাড়া আর কারো জানার কথা নয় যে, কাকে কিডন্যাপ করে কফিনে তোলা হয়েছে। ইমিগ্রেশনে কোনো মুসলিম অফিসার ছিল কিনা? বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
ফ্রান্সিস বাইকের মুখের উপর ভাবনার কালো ছায়া নামল। বলল, দারুস সালাম বিমানবন্দরে যারা অপারেশন প্ল্যান করেছে তাদের তো মুসলিম অফিসার সম্পর্কে সাবধান করা হয়নি! মুসলিম অফিসার তো ইমিগ্রেশনে থাকতেই পারে।
এটা আমাদের একটা বড় ল্যাপস হয়েছে। বলল আলফ্রেড ফিলিপ।
যাক অতীত ভেবে লাভ নেই। আহমদ মুসার ব্যাপারে সাবধান হতে হবে এবং তাকে লুসাকা থেকে কত দ্রুত আমেরিকায় পৌঁছানো যায়, সেই চেষ্টা আমাদের করতে হবে। কলিন ক্রিস্টোফার বলল।
তাহলে আহমদ মুসাকে আমরা ইয়াউন্ডিতে আনছি না? বলল ফ্রান্সিস বাইক।
ঝুঁকির পরিধি বাড়িয়ে লাভ নেই। কলিন ক্রিস্টোফার বলল।
তাহলে আমাদের ক্ষতিপুরণ আদায়ের কি হবে? তাছাড়া আহমদ মুসাকে বন্দি করে রাখা এবং তাকে আমেরিকায় পাঠানো- এই গোটা কাজের জন্যে লুসাকার মানে অসওয়াল্ড আলফ্রেডের একার উপর নির্ভর করা যায় না। বলল ফ্রান্সিস বাইক।
ক্ষতিপুরণ মানে টাকা পাওয়া তো? সেটা তো আমরা পাচ্ছিই। আর অসওয়াল্ডের উপর আমরা নির্ভর করব কেন? আমাদের তিনজনকে প্রয়োজনীয় লোকজন নিয়ে অবশ্যই লুসাকায় যেতে হবে। কলিন ক্রিস্টোফার বলল।
ঠিক আছে আমরা আসছি, এটা তাহলে আমরা অসওয়াল্ডকে জানিয়ে দেই।
অবশ্যই জানাবেন। আরো জানাবেন, আমরা লোকজন নিয়ে যেখানে থাকব সেখানেই আহমদ মুসাকে আটক রাখার নিরাপদ কোনো ব্যবস্থা করতে হবে। কলিন ক্রিস্টোফার বলল।
ধন্যবাদ মি. কলিন। বলে ফ্রান্সিস বাইক তার নতুন অয়ারলেসের দিকে হাত বাড়াল।
.
সন্ধ্যা তখন ৭টা ৩০ মিনিট। আহমদ মুসাদের বন্দিখানা।
বন্দিখানার মুখে জনাচারেক প্রহরী এসে দাঁড়াল। সবার হাতেই স্টেনগান।
একজন তার স্টেনগান কাঁধে ঝুলিয়ে হাতের চাবি দিয়ে বন্দিখানার গ্রিলের দরজা খুলে দিল।
দরজা খুলে গেল।
বন্দিখানার দরজায় এসে দাঁড়াল FEP (ইভানজেলিক ফর পাওয়ার)-এর প্রধান অসওয়াল্ড আলফ্রেড এবং FEP-এর অপারেশন চিফ এরিক আমাজন।
প্রথমে প্রবেশ করল চার স্টেনগানধারী।
তারা গিয়ে ঘরের বিপরীত প্রান্তে মাকা এবং আহমদ মুসাকে সামনে রেখে স্টেনগান বাগিয়ে ধরে পাশাপাশি সারিবেঁধে দাঁড়াল।
তাদের স্টেনগান আহমদ মুসা ও মাকার দিকে বাগিয়ে ধরা কিন্তু তাদের চোখ সেদিকে নেই, বসদের দিকে নিবদ্ধ।
অসওয়াল্ড আলফ্রেড ঘরে ঢুকল। তার পেছনে পেছনে এরিক আমাজন।
অসওয়াল্ড আলফ্রেড ঘরে ঢুকেই কাত হয়ে পড়ে থাকা আহমদ মুসাকে পা দিয়ে ঠেলে চিৎ করে ফেলল। বলল, ঘুমিয়ে নে ভালো করে। পরে তো আর ঘুমাবার সময় হবে না। ফ্রান্সিস বাইক, কলিন ক্রিস্টোফাররা আসছে।
কথা শেষ করেই এরিক আমাজনের দিকে তাকিয়ে বলল, মাকার
কাহিনী তো এখনি শেষ হচ্ছে। এরপর এই বন্দি আহমদ মুসা ফ্রান্সিস। আসা পর্যন্ত এখানেই থাকবে। সেলের মুখে থাকবে চারজন প্রহরী সার্বক্ষণিকভাবে। এটা হবে ব্লকের গেট-প্রহরার বাড়তি ব্যবস্থা।
কিছু ঘটেছে নাকি স্যার? বলল এরিক আমাজন।
ফ্রান্সিস বাইক টেলিফোন করেছেন কিছুক্ষণ আগে। তারা বন্দির ব্যাপারে খুব উদ্বিগ্ন। তাকে নাকি কোথাও আটকে রাখা যায় না। তারা চেয়েছেন বন্দিকে আটকে রাখার নিচ্ছিদ্র ব্যবস্থা। অসওয়াল্ড আলফ্রেড বলল।
আমাদের ব্যবস্থা নিচ্ছিদ্রই স্যার। ব্লক গেটে চারজন স্টেনগানধারী প্রহরী আছে। তারা সর্বদা এ্যাটেনশন অবস্থায় থাকে। তারা পালাক্রমে সেল গেটের উপর নজর রাখে। উপরে গ্রাউন্ড ফ্লোরে উঠার সিঁড়ির মুখেও
হাফডজন প্রহরী রয়েছে। তাদেরও হাতে রয়েছে স্টেনগান। আর প্রধান গেট তো দূরনিয়ন্ত্রিত। গেট বক্সের প্রহরী ছাড়া এ গেট কেউই খুলতে পারবে না। বলল এরিক আমাজন।
এসব তারা শুনেছেন এরিক। তারা চান বন্দির উপর সার্বক্ষণিক চোখ রাখা হোক, যাতে সে নিজেকে মুক্ত করার কোনো কৌশল অবলম্বনের সুযোগ না পায়। অসওয়াল্ড আলফ্রেড বলল।
ঠিক আছে স্যার। যেমনটা বলেছেন, তেমনটাই করব। বলল এরিক আমাজন।
ধন্যবাদ এরিক বলেই অসওয়াল্ড তাকাল মাকার দিকে। কয়েকধাপ এগোলো তার দিকে। মাকার গালে টানা হাতের একটা থাপ্পড় কষে বলল, তুমি আমাদের লোকদের অনেক সময় নষ্ট করেছ আর তোমাকে আমি সময় দেব না। গুপ্তধন কোথায়? অসওয়াল্ড-এর কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল।
স্যার, আমি যা জানি না তা বলব কি করে!
বলল মাকা অনেকটা শান্ত সুরে। আহমদ মুসার সাথে কথা বলে তার সাহস বেড়েছে। এখন তার মনে হয়, আল্লাহর চোখের সামনেই সে রয়েছে।
তোমার এই কথা শোনার জন্যে আমরা আসিনি। আর একবার…। চিৎকার করে উঠা অসওয়াল্ডের কণ্ঠ হঠাৎ থেমে গেল। ভাবল যেন কি। বলল আবার ধীর কঠোর কণ্ঠে, তোমার একটা বোন আছে না, লুসাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েট। দেখতে শুনতে বেশ ভালো। তোমার ভাবীও তো তাই। ওদেরকে ধরে আনব?
চমকে উঠল মাকা। তার চোখ-মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বুকে কম্পন। শুরু হয়েছে। বোন, ভাবি এদের হাতে পড়বে এটা ভাবতেও পারে না সে। পরক্ষণেই আহমদ মুসার কথা তার মনে পড়ল, ওদের সর্বশক্তিমান মনে করো না, সর্বশক্তিমান একমাত্র আল্লাহ। বান্দার বিপদে আল্লাহর সাহায্য আসে। এটা মনে করতেই কোত্থেকে যেন তার বুক ভরে সাহস নামল। সে বলে উঠল, স্যার, আমি যা বলছি ওরাও তাই বলবে। কারণ এর বাইরে কোনো কথা আমাদের জানা নেই।
তোমার বোন, ভাবীদের উপর ক্ষুধার্ত মানুষরূপী নেকড়েদের ঝাঁপিয়ে পড়া দেখলেও কি তুমি এই কথাই বলবে? বলল অসওয়াল্ড।
আবার বুকটা কেঁপে উঠল মাকার। কিন্তু মুখে তার প্রকাশ না ঘটিয়ে মাকা বলল, আমি আর কি বলব। আমি কোনো গুপ্তধনের সন্ধান জানি না। বাপ-দাদাদের কাছেও কখনো শুনিনি।
চোখ দুটি জ্বলে উঠল অসওয়াল্ডের। বলল এরিকের দিকে চেয়ে, আমাদের সময় যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে, আর নয়। তোল একে। নিয়ে যাও বিদায় করে এসো দুনিয়া থেকে। দেখছি, এবার এর বোন, ভাবীসহ মা দাদীদের নিয়ে আসতে হবে।
অসওয়াল্ড ঘুরে দাঁড়াল ঘর থেকে বের হবার জন্যে।
এরিক আমাজন দুজন স্টেনগানধারীকে বলল, মাকাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নেয়ার জন্যে।
স্টেনগানধারী দুজন তাদের স্টেনগান কাঁধে ঝুলিয়ে দুহাত প্রসারিত করে ঝুঁকে পড়ল মাকার উপর। তাদের একজনের স্টেনগানের ব্যারেল আহমদ মুসার হাতের নাগালের মধ্যে। অন্য দুজন স্টেনগানধারী তাদের বাগানো স্টেনগানের ব্যারেল উপরে তুলে নিয়েছে।
আহমদ মুসা একবার চোখ মেলে তাকিয়ে সবটা দেখে শুয়ে থেকেই বা হাত দিয়ে একটানে একজনের কাঁধের স্টেনগান টেনে নিয়েই ডান হাতের। তর্জনি ট্রিগারে চেপে স্টেনগান ঘুরিয়ে নিল স্টেনগানধারীদের দিক থেকে শুরু করে বন্দিখানার গেটের দিকে গমনরত অসওয়াল্ড পর্যন্ত। অসওয়াল্ড কিছু জানা-বোঝার আগেই গুলি খেয়ে পড়ে গেল। শেষ মুহূর্তে বুঝতে পেরে এরিক পকেট থেকে রিভলভার বের করতে পেরেছিল, কিন্তু গুলি করার সময় পায়নি। আর স্টেনগানধারীরা কি ঘটছে দেখেছে, কিন্তু কিছু করার আগেই গুলিবৃষ্টির মুখে পড়েছে।
আহমদ মুসা গুলিবৃষ্টির রাউন্ড শেষ করেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। বিস্ময়ে-বিস্ফোরিত মাকার দিকে তাকিয়ে বলল, মাকা তুমি মেঝেতে শুয়ে পড়।
নির্দেশ দিয়েই আহমদ মুসা দৌড়ে বন্দিখানার ব্লক গেটের দিকে গিয়ে দেয়ালের সম্মুখ প্রান্তের আড়ালে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে স্থির হবার আগেই ব্লক গেটের চারজন প্রহরী ছুটে এলো। তাদের নজর বন্দিখানার ভেতরের রক্তাক্ত লাশের দিকে।
আহমদ মুসা এর সুযোগ গ্রহণ করল। তাদের দিকে তাক করা স্টেনগানের ট্রিগার চেপে ওদের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল।
ওদের চারজনের দেহ করিডোরেই আছড়ে পড়ল। গুলি করেই আহমদ মুসা ছুটে গেল গ্রিলের দরজার দিকে।
মাকার দিকে লক্ষ করে বলল, মাকা. এসো। কুইক। মাকা শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে এলো।
শোন মাকা, একদম আমার পেছনে থাকবে। আমি শুয়ে পড়লে তুমিও শুয়ে পড়বে, দৌড় দিলে তুমিও দৌড় দেবে। তুমি কি বন্দুক চালাতে জান?
উদ্বেগে-আতংকে আড়ষ্ট মাকা বলল, পিস্তল চালাতে পারি, কিন্তু বড় অস্ত্র কোনো দিন চালাইনি। ঠিক আছে। এসো।
বলেই বন্দিখানা থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসা ছুটল। আহমদ মুসা ধরে নিয়েছে, ব্লক গেটের চারজন প্রহরীই এদিকে ছুটে এসেছিল। সুতরাং ব্লক গেট খালি। আরো ভেবে নিয়েছে, ব্লক গেটের পরেই উপরে গ্রাউন্ড ফ্লোরে উঠার সিঁড়িটা হবে। সিঁড়িটার মুখে আরো হাফডজন প্রহরী রয়েছে। তারাও ব্রাশ ফায়ারের শব্দে ছুটে আসবে অবশ্যই।
আহমদ মুসা দৌড়াবার সময় করিডোরে লাশের পাশে পড়ে থাকা দুটি স্টেনগান তুলে নিয়ে কাঁধে ঝুলালো।
ব্লক গেটে এসে আহমদ মুসা উপরে উঠার সিঁড়ির গোড়া দেখতে পেল এবং সেই সাথে শুনতে পেল সিঁড়িতে দ্রুতপায়ের শব্দ।
ব্লক গেটে একটা গেট বক্স। তিন দিকে বন্ধ, সামনের দিকটা খোলা। গেট বক্সের এদিকের দেয়াল করিডোরের ভেতরে ঢুকে গেছে প্রায় দেড় ফুটের মতো।
আহমদ মুসা স্টেনগান বাগিয়ে গেট বক্সের আড়ালে দাঁড়াল। স্টেনগানের ট্রিগারে তর্জনি রেখে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা আহমদ মুসার। সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নেমে আসছে ওরা। গুলির লোকেশান তাদের স্পষ্ট ছিল। সিঁড়ি থেকে ফ্লোরে নেমে কাউকে না দেখে তারা করিডোরের দিকে ছুটল। করিডোরে ঢুকেই তারা চারটি লাশ এবং বন্দিখানার দরজা খোলা দেখতে পেল।
ছুটল বন্দিখানার দরজার দিকে।
ওরা সবে বন্দিখানার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পেরেছে, একটা আর্তকণ্ঠ ভেতর থেকে চিৎকার করে বলল, এদিকে কিছু নেই। দুই বন্দি পালিয়েছে। দেখ ওদের। পালাতে দেয়া যাবে না।
স্যার, আপনি সিরিয়াসলি আহত। ছয়জন প্রহরীর একজন বলল।
কথা বলো না, আমার সময় বেশি নেই। বন্দিকে দেখ। পালাতে দেয়া যাবে না। ভেতর থেকে সেই আর্তকণ্ঠ ধমকের সুরে বলল।
কণ্ঠটি শুনেই আহমদ মুসা বুঝতে পেরেছে, অসওয়াল্ড আলফ্রেড কথা বলছে। সে বেঁচে আছে, মারাত্মক আহত।
ধমক খেয়ে ওয়া ছয়জনই ঘুরে দাঁড়াল। এখনি ওদের নজরে পড়ে যাবে আহমদ মুসারা। স্টেনগান আগেই ঘুরিয়ে নিয়েছে আহমদ মুসা।
ঘুরে দাঁড়িয়েই ওরা ছয়জন আহমদ মুসাদের দেখতে পেয়েছে। উঠল ওদের ছয়টি স্টেনগানই উপরে। কিন্তু ট্রিগার চাপার সময় তারা পেল না। আহমদ মুসার স্টেনগান থেকে আসা গুলির বৃষ্টি ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঢলে পড়ল ছয়জনই করিডোরের উপর।
গুলি করেই আহমদ মুসা মাকাকে বলল, এসো। সিঁড়ি দিয়ে ছুটতে ছুটতেই আহমদ মুসা বলল, এখন প্রধান গেটটাই আমাদের বাইরে বেরুবার পথে বাধা।
মাকা কিছু বলল না, বলতে পারল না। উদ্বেগ-আতংকে সে রুদ্ধকণ্ঠ হয়ে গেছে। সে দৌড়াচ্ছে যন্ত্রচালিতের মতো। আহমদ মুসা তার কাছে এক অলৌকিক মানুষ।
সিঁড়ির মুখে একটা স্টিলের দরজা খোলা। স্টিলের দরজা দিয়ে বেরিয়েই দেখতে পেল একটা করিডোরের সোজা ওপ্রান্তে আধখোলা বড় একটা দরজা। এ দরজাও স্টিলের। আহমদ মুসা। বুঝল, অসওয়াল্ড আলফ্রেড ও এরিক আমাজন ভেতরে বন্দিদের কাছে। এসেছে এই জন্যেই সব দরজা এভাবে খোলা।
আহমদ মুসা আধখোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল একটা ছোট চত্বরের ওপারে প্রধান গেট ও গেট বক্স। গেটের দুজন স্টেনগানধারী প্রহরী অনেকটা বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এদিকে। আহমদ মুসা বুঝল গোলাগুলি নিয়েই তাদের চিন্তা।
আহমদ মুসা সময় নষ্ট করল না।
এক ঝটকায় দরজা খুলেই গুলিবৃষ্টি শুরু করল গেট বক্সের বাইরে দাঁড়ানো প্রহরী দুজনের লক্ষে।
গুলি করতে করতেই ছুটল আহমদ মুসা গেটের দিকে।
প্রহরী দুজন গুলি বৃষ্টির মুখে পড়ে ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিতে গেল গেট বক্সে। কিন্তু পারল না। গেট বক্সের মুখেই পড়ে গেল ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে।
ছুটে এসে আহমদ মুসা ঢুকে গেল গেট বক্সে। পেছনে মাকা। গেট বক্সে ঢুকেই আহমদ মুসা টেবিলে পেয়ে গেল রিমোট কনট্রোল। টেবিলে দেখতে পেল একটা টেলিফোন গাইড।
আহমদ মুসা মাকাকে লক্ষ করে বলল, মাকা টেলিফোন গাইডটা নিয়ে নাও। এদের টেলিফোন খুবই মূল্যবান।
মাকা যখন টেলিফোন তুলে নিচ্ছিল তখন আহমদ মুসা রিমোর্ট কনট্রোলে চোখ বুলাচ্ছিল। পেয়ে গেল রেড ও বু বাটন। আহমদ মুসা মনে মনে ভাবল ব্লু বাটন গেট খোলার জন্য আর রেডটা গেট বন্ধের। রেড ও বু বাটনের নিচেই আহমদ মুসা বিপরীতমুখী দুই অ্যারো চিহ্ন দেখতে পেল। ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার। খুব ছোট একটা ধাঁধা এটা। এর অর্থ রেড বাটন গেট খোলার আর ব্লু বাটন গেট বন্ধের জন্য।
আহমদ মুসা রেড বাটনে চাপ দিল।
সংগে সংগে গেট খুলে গেল।
আহমদ মুসা দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে চত্বরের ওপাশে পার্ক করা গাড়ির ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল এবং পাশের সিটে তুলে নিল মাকাকে।
গাড়িটা অসওয়াল্ডের তা দেখেই বুঝেছিল আহমদ মুসা। এই গাড়িতে করেই সে বন্দিখানায় এসেছিল।
গাড়ি বেরিয়ে এলো বন্দিখানা থেকে।
আহমদ মুসা মাকার দিকে তাকাল। বলল, মাকা আমরা শহর থেকে বেরিয়ে যাব। তুমি আমাকে রাস্তা দেখাও।
স্যার, আমরা আমাদের গ্রামের দিকে যেতে চাই। বলল মাকা। এখনো তার চোখে-মুখে আতংক। কণ্ঠ তার শুকনো।
ঠিক আছে মাকা। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, তাহলে আমাদের এখন পূর্ব দিকে যেতে হবে। গেটের সামনের এ রাস্তাটা পূর্ব দিকে অল্প এগিয়ে ডেমোক্রাসি এভিনিউতে পড়বে। এই এভেনিউ ধরে উত্তরে এগোলে আমরা ট্রান্সন্যাশনাল হাইওয়ে পেয়ে যাব। ঐ হাইওয়েতে আমাদের উঠতে হবে। এই হাইওয়েটাই আরো উত্তরে এগিয়ে
জাম্বিয়ার সীমান্ত পেরিয়ে তানজানিয়ায় প্রবেশ করেছে। মাকা বলল।
তোমাদের গ্রাম, মানে তোমাদের বাড়ি কোথায় যেন বলেছিলে, লোয়াংগ নদীর তীরে। সেটা কোথায়? বলল আহমদ মুসা।
হাইওয়েটার পাশেই স্যার। কংগোর একটা সরু অংশ পকেটের আকারে জাম্বিয়ার ভেতরে ঢুকে গেছে। এই কংগো বর্ডারের পাশে মোচিংগা পর্বতের উপত্যকা দিয়ে চলে গেছে হাইওয়ে এবং রেলওয়ে। এখান থেকে নদী পথে বা গিরিপথ দিয়ে সেরেনজি বাস ও রেলস্টেশন থেকে একটা সড়ক দক্ষিণে আমাদের গ্রাম হয়ে লোয়াংগ নদীর তীর পর্যন্ত চলে গেছে। দক্ষিণের উপত্যকার নিমাঞ্চলে লোয়াংগ নদীর প্রায় তীর ঘেষা চিসোমো গ্রামে আমাদের বাড়ি।
তাহলে তো তোমাকে ওখানে নামিয়ে দিলেই হবে। বলল আহমদ মুসা।
আর আপনি? মাকা বলল।
আমি সামনে এগোব। বলল আহমদ মুসা।
না স্যার। আপনাকে আমাদের বাড়িতে যেতে হবে দুই কারণে। এক. আমার ভয় করছে, ওরা আবার ধরতে আসে কিনা। দুই, আপনি আমাদের সম্পর্কে, পরিবার সম্পর্কে যা বলেছেন, তা আমাদের জন্যে নতুন ও বিস্ময়কর! আমাদের পরিবারের সবার আপনার কাছ থেকে সরাসরি এটা শুনতে হবে এবং আপনার কাছ থেকে আরো কিছু আমাদের জানতে হবে। মাকা বলল।
আহমদ মুসা চিন্তা করে বলল, স্যরি মাকা, তোমার প্রথম বিষয়টা নিয়ে চিন্তাই করিনি। ধন্যবাদ তোমাকে, তুমি বিষয়টা স্মরণ করিয়ে দিয়েছ। এ বিষয় নিয়ে কিছু করার আছে। ঠিক আছে তোমার সাথে আমি থাকছি। চিন্তা করো না।
ধন্যবাদ স্যার। মাকা বলল।
.
আহমদ মুসা এশার নামাজ পড়ে ঘুরে বসল। তার চোখ পড়ল পেছনে দাঁড়ানো মাকাদের উপর। ঘুরে বসতে গিয়ে জানালায় কিছু চোখ দেখতে পেল। আহমদ মুসা যে ঘরে নামাজ পড়ছিল সেটা বড় ঘর।
মোটামুটি সাজানো। একটা খাট। খাটের বিপরীত দিকের দেয়াল ঘেঁষে একটা আলমারি। খাটের পাশে একটা রিডিং টেবিল। ঘরে ঢুকেই ডান পাশে একটা সোফা সেট। প্রায় ঘরের মাঝখানে একটা পরিষ্কার চাদর বিছিয়ে নামাজ পড়েছে আহমদ মুসা।
নামাজ পড়ে ঘুরে বসতেই মাকা বলল, স্যার, আমার দাদী, মা এসেছেন। আপনার সাথে কথা বলতে, পরিচয়ও তো হয়নি। আপনি সোফায় এসে বসুন স্যার।
ঠিক আছে। বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। নামাজের চাদর তুলে নিল ভাঁজ করার জন্যে। মাকা তাড়াতাড়ি এসে আহমদ মুসার হাত থেকে চাদর নিয়ে ভাঁজ করে আলমারিতে রেখে দিল।
আহমদ মুসা সবাইকে সালাম দিয়ে একটা সিংগল সোফার পাশে এসে দাঁড়াল।
মাকা আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়াল। প্রথমে দাদী, তারপর মা, বোন, ভাবী সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। আহমদ মুসা সবাইকে একবার দেখে চোখ নামিয়ে নিল।
দাদী, মা, ভাবী বসলে আহমদ মুসা পাশের সিংগেল সোফায় বসল। মাকা, তার বোন ও ছেলেমেয়েরা সবাই দাঁড়িয়ে রইল।
আহমদ মুসা দাদীর দিকে চেয়ে বলল, আমাকে দুতিন মিনিট সময় দিন, একটা জরুরি টেলিফোন করতে হবে।
টেলিফোন করো ভাই, কোনো অসুবিধা নেই। বলল দাদী।
ধন্যবাদ দাদী। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা তাকাল মাকার দিকে। বলল, মাকা একটা মোবাইল লাগবে কয়েক মিনিটের জন্যে, তাতে তোমাকে বলা হয়নি।
তার বোন সুরিয়া নিয়ামওয়ালীর দিকে তাকাল মাকা।
তার বোন সুরিয়া সংগে সংগেই পকেট থেকে টেলিফোন বের করে তুলে দিল তার ভাইয়ের হাতে।
তার বোন সুরিয়া, ভাই মাকা তার মা-দাদীর মতোই মিশ্র বর্ণের। দেহের রং ও মুখ-চোখের আদলে আফ্রিকানদের চেয়ে এশীয় বৈশিষ্ট্যই বেশি। আর পোশাকে পুরোপুরি ইউরোপীয়। আধাটাইট প্যান্টের উপর সার্ট। তার উপর জ্যাকেট। উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারায় বুদ্ধির একটা দীপ্তি আছে।
মাকা মোবাইল তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
ধন্যবাদ দিয়ে টেলিফোন নিয়ে মাকাকে বলল, মাকা বেড থেকে টেলিফোন গাইড এনে দিতে পারবে?
এনে দিচ্ছি স্যার। বলে মাকা ছুটল খাটের দিকে। টেলিফোন গাইডটা আগেই দেখে রেখেছিল আহমদ মুসা।
মাকার হাত থেকে টেলিফোন গাইড হাতে নিয়ে প্রয়োজনীয় নাম্বার বের করল। নাম্বারটিতে কল করল আহমদ মুসা।
দ্বিতীয়বার রিং হতেই কলটা ওপেন হলো। ওপার থেকে একটা নারী কণ্ঠ কথা বলে উঠল, হ্যালো।
গুড ইভনিং। এটা মি. অসওয়াল্ডের টেলিফোন তো? আমি তাকে চাচ্ছিলাম। বলল আহমদ মুসা।
আমি তার মেয়ে বার্থা, রিটা বার্থা। আপনি কে বলছেন? মেয়ে কণ্ঠটি বলল।
চিনবে না বোন। দেবে কি টেলিফোনটা তাকে? বলল আহমদ মুসা।
স্যরি, তিনি নেই…। কান্নায় ভেঙে পড়ল বার্থার কণ্ঠ। বেদনার একটা ছায়া নেমে এলো আহমদ মুসার চোখে-মুখে।
স্যরি বার্থা, তোমাকে কষ্ট দিলাম। আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি? অবশ্যই স্যার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বার্থা বলল। কখন কীভাবে কি হলো? বলল আহমদ মুসা।
অফিসে সন্ত্রাসীদের হামলা হয়েছে, তাতেই তিনি আহত হয়ে মারা গেছেন। কান্নায় বার্থার কণ্ঠ আবার ভেঙে পড়ল।
ধৈর্য ধরো বোন। আসা-যাওয়াই তো সৃষ্টির অমোঘ নিয়ম। স্রষ্টা তার মংগল করুন। রাখছি বোন।
ধন্যবাদ স্যার। ওপার থেকে বলল বার্থা।
কল অফ করে দিয়ে আহমদ মুসা মোবাইলটি মাকার হাতে দিয়ে বলল, মাকা অসওয়াল্ড আলফ্রেডও মারা গেছেন।
মুহূর্তের জন্যে একটু থেমেই আবার বলে উঠল আহমদ মুসা, তার মেয়ে রিটা বার্থার কান্না শুনলাম। খুব খারাপ লাগছে। অথচ তাদের না মারলে তোমাকে মেরে ফেলতে যাচ্ছিল আজ রাতেই মামাকে তারা তুলে দিতে যাচ্ছিল আরো বড় শত্রু সন্ত্রাসীদের হাতে। ভারী কণ্ঠ আহমদ মুসার। থামল সে।
মাকার মুখে কোনো কথা নেই। সবাই নীরব। সবার মুখেই একটা ভাবান্তর।
আহমদ মুসাই কথা বলল আবার, এই দুঃখ একটা সুখবরও দিয়েছে। মাকা। তোমাদের উপর ওদের আক্রমণের ভয় থাকল না। অসওয়াল্ড আলফ্রেড বেঁচে থাকলে আজ রাতেই বা যে কোনো সময় তোমাদের বাড়িতে ওদের আক্রমণের ভয় ছিল এবং সে আক্রমণটা হতো ভয়াবহ। ওরা চেষ্টা করত তোমাকে হত্যা করে এবং বাড়ির অন্য সবাইকে ধরে নিয়ে যেতে।
ঈশ্বর রক্ষা করেছেন ভাই। তোমার নাম যেন কি? মাকাকে জিজ্ঞাসা করেও জানতে পারিনি। বলল দাদী।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, দাদী আমাকে বিপদে ফেললেন। আপনাকে সত্য বলতে পারছি না, আবার মিথ্যা বলাও কঠিন।
কেন সত্য নাম বলায় অসুবিধা কি? বলতে পারছ না কেন? দাদী বলল।
দেখুন দাদী, তানজানিয়ার দারুস সালাম বিমানবন্দরে নেমেছিলাম যে পাসপোর্ট নিয়ে, তাতে আমার আসল নাম ছিল না, ছদ্মনাম ছিল। এরপরও শত্রুরা আমাকে কি করে চিনে ফেলে এবং বিমান থেকে নামার পরেই ইমিগ্রেশনে আমাকে কিডন্যাপ করে। ছদ্মনাম নিয়ে এসেও এই অবস্থা, নিজের সত্যিকার নাম নিয়ে এলে কি হবে বলুন। এটাই আমার অসুবিধা। বলল আহমদ মুসা।
বাবা, দুনিয়ার যেখানেই যাও, সেখানেই এই ভয় আছে? মাকার মা বলল।
হ্যাঁ মা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ভয় আছে। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে তো ভাই, তোমার শত্রু অনেক! কেন তোমার এত শক্র? মাকার দাদী বলল।
যেমন আজ লুসাকায় FEP আমার নতুন শত্রু হলো। এরা আমার প্রত্যক্ষ শত্রু ছিল না। এভাবেই শত্রু আমার বেড়েছে। বলল আহমদ মুসা।
শত্রু হবে না কেন বাবা, আমি মাকার কাছে সব শুনেছি। তোমাকে ওরা হাত-পায়ে বেড়ি পরিয়ে রেখেছিল, তুমি সেটা অদ্ভুত কৌশলে খুলেছ। তারপর ওদের অস্ত্রে ওদের ১৬ জনকে হত্যা করে মাকাকে নিয়ে চলে আসতে পেরেছ, এটা অবিশ্বাস্য এক ঘটনা। শুনলাম ঐ সংস্থার প্রধান ও হেড কমান্ডার দুজনকেই তুমি মেরেছ। তুমি বলতে পারছ না, কিন্তু আমরা না জেনে তোঁ স্বস্তি পাচ্ছি না, তুমি কে? তুমি অসাধারণ কেউ নিশ্চয়। বাছা, কোনো দল বা সংগঠন আছে তোমার সাথে?
আমি পরিচালনা করি, এমন কোনো সংগঠন ও সংস্থা নেই আমার। বলল আহমদ।
নিজের শক্তিসহ সংগঠনের শক্তিতে কেউ শক্তিমান হয়ে ওঠে, ভীতিকর হয়ে ওঠে। তোমার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি। তুমি নিজের শক্তিতেই দুনিয়ার বহুজন বহু সংস্থার কাছে ভীতিকর হয়ে উঠেছ। সুতরাং…।
মাকার মার কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, না মা, আমার নিজের কোনো শক্তি নেই। আমার যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর দেয়া, আল্লাহ মালিক এই শক্তির। তাঁরই ইচ্ছায় এই শক্তি আমি ব্যবহার করি মাত্র।
মাকার মা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আনত দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে বিস্ময় ও ভাবনার স্ফুরণ। এক সময় বলল, বাবা, তুমি ঈশ্বর ভক্তিতেও অতুলনীয় একজন। নিজের সবকিছু উজাড় করে ঈশ্বরের হাতে তুলে দেয়ার মতো এমন মানুষ আমি দেখিনি। বাছা, তোমাকে ধন্যবাদ।
আহমদ মুসা মাকার মায়ের দিকে চোখ তুলল মুহূর্তের জন্যে। বলল, মা, আমার একটা কৌতূহল। আপনার কথার মধ্যে গভীর অন্তরদৃষ্টি আছে যা জাম্বিয়ার একটা দূর গ্রামে আমি আশা করিনি। কেন এটা, বলবেন কিছু কি মা?
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই মাকা কথা বলে উঠল, আমার মা লুসাকার কেন্দ্রীয় বাইবেল স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায়ের একজন শিক্ষিকা ছিলেন। আর মা লুসাকারই বাইবেল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন।
ধন্যবাদ মা, আপনারা আলোকিত একটা পরিবার। এখানে আপনাদের গোত্রের সব পরিবারেই কি শিক্ষার এমন প্রচলন আছে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
না বাবা সব পরিবারে নেই, দুএকটা পরিবারে আছে। তার মধ্যে আমাদের পরিবারে শিক্ষার প্রচলন বহুকাল আগে থেকে। আমার দাদা শ্বশুর এবং তারও আগে সবার মধ্যেই লেখাপড়ার চর্চা ছিল। বলল মাকার মা। ২ মাকার মা থামতেই তার দাদী বলে উঠল, বৌমা ঠিকই বলেছে। আমাদের মাকা বংশটাই শিক্ষিত। আমার দাদা শ্বশুর সাহেবের কাছে। শুনেছি, আমরা ইয়াও গোত্রের হলেও এর মধ্যে মাকা বংশের আলাদা একটা ধারা, আছে, যাদের অন্যদের চেয়ে কিছু ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে। তিনি বলতেন, আমাদের মাকা বংশ এসছে আমাদের এক বিরাট পূর্বপুরুষ থেকে যার দেশজোড়া নাম ছিল। থামল দাদী।
সেই পূর্বপুরুষের নাম তিনি বলেননি? বলল আহমদ মুসা।
না ভাই, নাম তিনি বলেননি। জানলে অবশ্যই বলতেন। তবে তিনি একটা কথা বলেছিলেন, আমাদের বংশের কিছু পুরনো কাগজপত্র আছে, তার মধ্যে নিশ্চয় আমাদের বংশের আরো পরিচয় পাওয়া যাবে। কিন্তু কাগজপত্রগুলো দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা। ভাষাটা আমাদের ইয়াও গোত্রের চিয়াও ভাষা নয় আবার গোটা পূর্ব আফ্রিকায় প্রচলিত সোহাইলি ভাষাও নয়। দাদী বলল।
সে কাগজপত্র কি এখনো আছে? বলল আহমদ মুসা।
থাকবে না কেন! ওগুলো তো বংশের সম্পত্তি। একে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আমার দাদা শ্বশুরও সে দিন এটা বলেছিলেন।
মুহূর্তের জন্যে দম নিল দাদী। তারপর আবার শুরু করল, বংশের নিয়ম অনুসারে বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান-এর মধ্যে জ্যেষ্ঠতম যিনি তার কাছেই পারিবারিক এই দলিল বা সম্পদ থাকবে সেই অনুসারে সম্পদটি এখন আমার কাছে।
একটু থেমেই আবারও বলে উঠল দাদী, মাকার কাছে শুনলাম, তুমি মুসলমান। মাকা বলল, তুমি নাকি বলেছ আমরাও সকলে মুসলমান। এটা সত্যি ভাই? নাম শুনেই নাকি তুমি এটা বলেছ। বিষয়টা কি বলো তো ভাই।
হ্যাঁ মা, নাম শুনে বলেছি বটে তবে আরো কিছু বিষয় বিবেচনা করেছি। আমার এই বিবেচনা যে সঠিক, দাদীর কথায় তার কিছু প্রমাণ মিলেছে। বলল আহমদ মুসা মাকার মাকে লক্ষ করে।
তোমার এ বিবেচনার কথা ভাবার বিষয় বাবা। তুমি আমাদের এমন পরিচয়ের কথা বলেছ যা শুনে আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি। এটা সত্য হলে আমার জীবন তো ওলটপালট হয়ে যাবে। প্রথমে বলো বাবা, আমাদের নামে তুমি কি পেলে।
মা, নাম খুব বড় জিনিস। গোটা দুনিয়াতেই মানুষের নাম তার ধর্ম ও ঐতিহ্য, সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। খ্রিস্টান, ইহুদি, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ প্রত্যেক ধর্মে নামের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। এক জায়গায় যদি দশজন লোক থাকে, শুধু তাদের নাম শুনেই বিভিন্ন ধর্মে তাদের ভাগ করা। যায়। ইহুদিদের নাম খ্রিস্টানরা নেয় না, মুসলমানরা অন্যদের কারো নাম নেয় না। অর্থাৎ এক ধর্মের মানুষ অন্যধর্মের নাম নেয় না। মাকা, মাকার বাবার, মাকার দাদার, এমনকি সুরিয়ার নামেও এমন শব্দ আছে যা মুসলিম নামের অংশ বা মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা আরবি শব্দ। যেমন মাকার নামের বারনাবা, তার বাবার নামের বাই বুরেহ, তার দাদার ফাতি এবং সুরিয়ার নামের সুরিয়া নিয়ামওয়ালী শব্দ হয় মুসলিম নামের অংশ অথবা মুসলমানদের ভাষা আরবি, ফার্সির শব্দ।
সুরিয়া আসলে সুরাইয়া, এটা মুসলিম মেয়েদের একটা জনপ্রিয় নাম। মাকার দাদার ফাতি শব্দ আসলে ফাতিহ। এটা আরবি শব্দ, এর অর্থ বিজয়ী। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মাকা, তার দাদা, বাবার নামের প্রথম মাকা শব্দটি মালাবী, মোজাম্বিক, জাম্বিয়া এককথায় জাম্বেসী নদীর অববাহিকা ও লেক নিয়া, লেক ট্যাঙ্গানিকা অঞ্চলের মুসলমানদের পরিচয়জ্ঞাপক শব্দ হিসেবে পরিচিত ছিল। মাকা শব্দটি প্রকৃতপক্ষে মক্কা শব্দের অপভ্রংশ। মক্কা সৌদি আরবের লোহিত সাগরের কাছাকাছি একটা স্থানের নাম। এখানে পৃথিবীর আদি প্রার্থনাগৃহ, যাকে মুসলমানরা কাবা বলে, সেটা অবস্থিত। মুসলমানদের প্রফেট হযরত মোহাম্মদ (সা.) এই মক্কা শহরেই জন্মগ্রহণ করেন। বিশ্বের মুসলমানরা এখানেই প্রতিবছর হজ্জ করতে যায়। মাকাদের নামের আগের এই মাকা শব্দও একটা প্রমাণ যে, আপনাদের পূর্বপুরুষরা মুসলমান ছিলেন। এছাড়া আপনাদের নামের এই মাকা শব্দটি একটা বড় ইতিহাস ও একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। সেদিক থেকেও প্রমাণিত হয় আপনাদের বংশের পূর্বপুরুষরা মুসলমান ছিলেন। থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামলেও কেউ কথা বলে উঠল না। সবাই নীরব। সবার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। সবার দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
নীরবতা ভাঙল দাদী। বলল, বিদেশী ভাই, তুমি কি কথা শোনালে! আমাদের পূর্বপুরুষরা সত্যিই মুসলমান ছিল?
হা দাদী, নামগুলো দেখে এবং মাকার আরো সব কথা শুনে আমার তাই মনে হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
বাবা, তুমি একটা বড় ইতিহাস ও একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সাথে আমাদের সম্পর্কিত করলে, সেটা কি? মাকার মা বলল।
মাকার কথা শুনে আরো কিছু বিষয় বিবেচনা করে যে কথা এর আগে বলেছি, এটা সেটাই। বলল আহমদ মুসা।
বাবা, এটা তো শুনতে হবে। আরো কোনো বড় বিষয় আমাদের সামনে আসতে পারে। আমাদের তা জানা দরকার। ইতিমধ্যেই তোমার কাছ থেকে যা শুনেছি, তা আমার ভেতরটাকে ভেঙে চুরে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আমার জায়গা থেকে তুমি আমাকে উপড়ে ফেলেছ। মাকার মা বলল।
উপড়ে পড়ার ফলে খুব কষ্ট হয়েছে মা? বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি।
হাসল মাকার মাও। বলল, সত্যিই কষ্ট হয়নি বাছা। একটা বিস্ময়ের ধাক্কা লেগেছে।
কষ্ট হবে না আমি জানি। বলল আহমদ মুসা।
কেমন করে জান? মাকার মা বলল।
শেকড় থাকলে কষ্ট হতো। শেকড়ের বাধন ছিল না। বলল আহমদ মুসা।
হতে পারে বাছা। কষ্ট তো হয়নি, মন কিছু খারাপ হবার কথা সেটাও হয়নি। এ প্রসংগ এখন থাক, তোমার কথায় তুমি ফিরে এসো। কোন্ বড় ইতিহাস, কোন্ ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সাথে আমাদের পরিবার সম্পর্কিত এবং কীভাবে? সেটা বলো। মাকার মা বলল।
আপনাদের পরিবারের গোপন ধনভাণ্ডার আছে। সেই ধনভাণ্ডার হাত করার জন্যেই তারা মাকাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। মাকার বক্তব্য ছিল তাদের পরিবারে কোনো গুপ্তধন নেই। গুপ্তধন আছে এমন কথা সে দাদা বা অন্য কারো কাছ থেকেই শোনেনি। অন্যদিকে তাদের কথা থেকে আমি বুঝেছি, তারা আপনাদের পরিবারের ইতিহাস খুঁজে পেয়েছে একজন বিখ্যাত ও সম্পদশালী রাজা বা শাসক সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে। তারা এটাও জেনেছে যে, সেই রাজা বা শাসক বিরাট পরিমাণের গুপ্তধন রেখে গেছেন। সেই গুপ্তধনের স্থান ও নক্সা তাদের পরিবার বংশানুক্রমিকভাবে রক্ষা করে চলেছে। এই তথ্যের সাথে আপনাদের পূর্বপুরুষ মুসলমান হওয়া এবং নামের আগে মাকা শব্দ যুক্ত থাকার বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমি নিশ্চিত হয়েছি সুলতান মাকানজিলা মাকাও-এর বংশধর আপনারা। সুলতান মাকানজিলা বিওয়ানালী ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ইয়াও সরদার এবং তিনি ছিলেন লেক ট্যাঙ্গানিকা থেকে জাম্বেসি নদী পর্যন্ত অঞ্চলের কোনো এক বড় ভূখণ্ডের শাসক। তার আদ্যাংশ মাকা থেকে তাঁর বংশ এবং তার অধীন ইয়াওদের নাম মাকা হতে পারে। আবার মুসলমানদের মাকা বলা হতো সে দিক থেকে তার বংশ ও অধীনস্তদের আরেকজন সুলতানের নাম মাকা হতে পারে। তার উত্তরসূরির নাম ছিল মাতাকা। সুলতান মাতাকা। ছিলেন খুব প্রভাবশালী ও সমৃদ্ধিশালী। ইসলামের প্রচার ও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের প্রতিরোধ তার জীবনের লক্ষ ছিল। সারা জীবন তিনি এই দুই কাজই করে গেছেন। তাঁর গোত্র ইয়াও ইসলামের বড় শক্তি। ইসলামের শিক্ষা, আদর্শ এবং ইয়াও গোত্র ও আফ্রিকানদের দেশীয় জীবন-সংস্কৃতি মিলে ইসলাম পূর্ব আফ্রিকায় একটা লোকজ রূপ পেয়েছিল। এই সুলতান মাতাকার পূর্বসূরি সুলতান মাকানজিলা ছিলেন আপনাদের বংশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম পূর্বপুরুষ। সুলতান মাকা, সুলতান মাতাকা, সুলতান জালাসি এবং সুলতান এমপোন্ডা এবং তাদের সারা জীবন ধরে প্রচার করা লোকজ রূপ পাওয়া ইসলামের আপনারা উত্তরসূরি। থামল আহমদ মুসা।
বিস্ময়বিমুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়েছি। মাকার মা, দাদী এবং সবাই। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
অনেকটাই দীর্ঘ এক নীরবতা ভেঙে কথা বলল মাকার মা, বাবা, তুমি আমার আশার চেয়েও বিস্তারিত উত্তর দিয়েছ, কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি, বংশের প্রতিষ্ঠাতা যারা, সবদিক দিয়েই গৌরবের যারা তাদেরকে বংশের অধঃস্তনরা এভাবে ভুলে গেল কেমন করে? এমন করেই ভুলে গেল যে, ধর্ম হারাল, ইতিহাস হারাল, এমনকি সে মহান পূর্বসূরিদের নামটাও পর্যন্ত হারিয়ে ফেলল? এটা কীভাবে ঘটল?
বহু বছরের নিষ্ঠুর ঝড়-ঝাঁপটা, বয়ে গেছে আপনাদের ধর্ম পরিচয়, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের উপর দিয়ে। ধর্ম পরিচয়ের বিষয়টা ধরা যাক। মুসলমানদের ধর্ম ইসলাম গতিমান ও অনুশীলনের ধর্ম। এই ধর্ম গতি হারিয়ে ফেললে তাকে অবক্ষয় এসে ঘিরে ধরে। ধীরে ধীরে অনুশীলন কমতে থাকে এবং তার অস্তিত্বও হারিয়ে যায়। আর অন্য ধর্ম-সংস্কৃতির আগ্রাসন যদি তার উপর আপতিত হয়, তাহলে গতিহীন ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের অবক্ষয় আরো দ্রুত হয় এবং অন্য ধর্মের তারা শিকারে পরিণত হয়ে যায়। ইয়াও গোত্রের মুসলমানদের ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে। বিশাল প্রভাব ও ক্ষমতার অধিকারী সুলতান মাকাও এবং উত্তরসূরি কয়েকজনের মৃত্যুর পর। ইয়াও গোত্রে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এক পক্ষ অন্য পক্ষের সংহারী রূপ। নিয়ে আবির্ভূত হয়। এই সময় ইয়াও-এর একটা অংশ শান্তি ও সুখের সন্ধানে বিভিন্ন দিকে চলে যায়। এই বিপদের মধ্যে ইয়াও মুসলমানদেরকে আরো বড় বিপদ এসে গ্রাস করে। পর্তুগীজ ঔপনিবেশিকরা ইয়াওদের রাজ্য দখল করে নেয়। তারা ইয়াও মুসলমানদের উপর নানা ধরনের কর আরোপ করে এবং মুসলমানদের বহু ক্ষেত্রে দাস শ্রমিকে পরিণত করে। এই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্যে এবং স্বাধীনতার সন্ধানে ইয়াও মুসলমানরা বিভিন্ন দিকে চলে যায়। বিরাট সংখ্যক লোক জাম্বেসি নদীর অববাহিকা এবং এর সংলগ্ন। দেশগুলোতে নতুন বসতি স্থাপন করে। এইভাবে তারা রাজ্য হারানোর মতো। ধর্ম ও ইতিহাসও হারিয়ে ফেলে এবং সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ইত্যাদি নানা কারণে তারা ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। যেমন আপনাদের পরিবার। থামল আহমদ মুসা।
মাকার মার চেহারা সহজ ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। দাদীর চেহারা তার চেয়ে বেশি উজ্জ্বল। মাকাও আর তার বোনের চোখে বিস্ময়। তাদের মনে জিজ্ঞাসা জাগছে, তাদের এই অতিথি ইতিহাস ও আফ্রিকার বংশধারার যাদুঘর নাকি!
মাকার মা-ই আবার নীরবতা ভেঙে ধীরে ধীর বলল, দুটি বিষয় আমার মনে জাগছে, ইয়াও গোত্রের মধ্যে আমাদের বংশধারা ঘিরেই কি ইসলামের বিস্তার সীমাবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয় বিষয়টা হলো একটা বড় বংশের অনেক শাখা প্রশাখা থাকে। তার মধ্যেই থাকে বংশের একটা মূল ধারা। তুমি কি মনে করো বাবা, আমরা কি সুলতান মাকা, সুলতানা মাতাকার বংশের মূল ধারা?
না মা, ইয়াও গোত্রের আপনাদের বংশধারার মধ্যেই শুধু ইসলামের বিস্তার সীমাবদ্ধ ছিল না। মুসলিম মিশনারী ও মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে গোটা আফ্রিকায় ইসলাম প্রবেশ করেছিল। অসংখ্য ট্রাইবাল সরদার ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের গোত্রের লোকসহ। তানজানিয়া, মালাবী, মুজাম্বিক, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে অঞ্চলে বিস্তৃত ইয়াও গোত্র বলা যায় গোটাটাই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। আপনাদের খুব কাছে মোজাম্বিকের কারো ডেলগাড়ো প্রদেশে ইয়াও ট্রাইবাল সর্দার আব্দুরাবের অধীনে বাংগুই সালতানাতের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এর পাশেই সুলতান আব্দুরারের ভাই ট্রাইবাল সর্দার মুসারকারের নেতৃত্বে আরেকটা সালতানাতের পত্তন হয়। ১৭৪৯ সালে। পশ্চিমী ঔপনিবেশিকদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হবার পর ইয়াও গোত্রের মাকা বংশের একটা অংশ যেমন জাম্বিয়ার লোয়াংগ নদী ও কংগো সীমান্তের লুউমরো জলাভূমির মধ্যবর্তী পাহাড়ের পাদদেশ অঞ্চলে এসে আশ্রয় নেয়, তেমনি মাকা বংশের মাখা জালামি শাখা আজকের জিম্বাবুয়ের ডাইক পর্বত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। এরাই জিম্বাবুয়েতে ইসলামের আলো প্রজ্জ্বলিত করে। উত্তরকালে এই গোত্র শক্তিশালী উজ্জ্বল হয়ে তারা এক সময় জার্মান ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে বিখ্যাত মিঝমিঝি বিদ্রোহ সংঘটিত করে। মা, আপনার দ্বিতীয় জিজ্ঞাসা আপনাদের এখানকার মাকা বংশধারা বংশের মূলধারা কিনা তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে FEP (ইভানজেলিস্ট ফর পাওয়ার)-এর অনুসন্ধানে বংশীয় গুপ্তধন আপনাদের কাছে আছে বলে চিহ্নিত করেছে আপনাদের নামের আদ্যাংশ হিসেবে মাকা শব্দ ব্যবহার করা থেকে। আমার নিশ্চিত মনে হয় আপনারাই সুলতান মাকা, মাতাকা বংশের মূলধারা। বলল আহমদ মুসা।
মাকার মা-সহ সকলের মুখেই আনন্দের স্ফুরণ।
প্রসন্ন মুখে মাকার মা বলল, তোমার সুন্দর ও বিস্তারিত উত্তরের জন্য ধন্যবাদ। বংশের মূলধারার ব্যাপারে তোমার যুক্তি ঠিক আছে, আমাদের কাছে গুপ্তধন আছে। কিন্তু আমরা তো জানি এটা সত্য নয়। সত্য যদি না হয়, তাহলে মূল ধারা হবার যুক্তি তো দুর্বল হয়ে পড়ে।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই মাকার দাদী বলে উঠল, এ বিষয়ে কোনো শেষ কথা বলার আগে আমার কাছে বংশের যে পুরনো কাগজপত্র আছে, সেগুলো একবার দেখা উচিত।
মাকার মার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, আপনার কথা ঠিক মা। কিন্তু কাগজপত্র তো দুর্বোধ্য।
আমাদের কাছে তো দুর্বোধ্য। আমাদের এই নাম না জানা ভাইকে দলিল-দস্তাবেজগুলো আমরা দেখাতে পারি। এতক্ষণ আফ্রিকা সম্পর্কে তার। কথা শুনে আমার মনে হয়েছে আফ্রিকা যেন তার নখদর্পণে। মনে হচ্ছে তার জানার শতভাগের এক ভাগও আমরা জানি না। দাদী বলল।
ঠিক মা। তাকে দেখানো হোক। বলল মাকার মা।
তাহলে এখনই দেখানো হোক দাদী। মাকা বলল। তার চোখে মুখে আনন্দ।
দাদী, স্যারকে তোমার ঘরেই নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। তাহলে তোমার গুপ্তধন কোনো বড় নড়া-চড়ায় পড়বে না। বলল মাকার বোন সুরিয়া।
মাকা-সুরিয়াদের দাদী বংশীয় গোপন দলিল-পত্ৰকে গুপ্তধনের মতো আগলে রাখে বলে ওগুলোকে সবাই দাদীর গুপ্তধন বলে।
সুরিয়ার কথার উত্তরে দাদী বলল, ভাই তো যাবেই সে ঘরে। কিন্তু তোদেরকে বলি, তোরা বংশীয় ঐ কাগজপত্রকে গুপ্তধন বলে বিদ্রূপ করিস। কিন্তু ওগুলোকে গুপ্তধনের চেয়েও দামী মনে করি আমি।
ঠিক মা, বংশীয় এই সম্পদ, যা-ই হোক, যেমনই হোক, কোনো টাকার অংকে তা মাপা যায় না। আপনার নাতি-নাতনিরাও তা, জানে। এ নিয়ে তারা যা করে তা দাদীর সাথে একটু মজা করা ছাড়া আর কিছু নয়। বলল মাকার মা।
আমি তা জানি মা। ওরা তো সোনার টুকরো।
মুহূর্তের জন্যে একটু থেমেই আবার বলে উঠল দাদী, চলো মা, ভাইকে নিয়ে চলো। আমি উঠছি।
দাদী উঠে দাঁড়াল।
দাদীর বয়স শত বছর পার হয়ে গেছে কয়েক বছর হলো। হাঁটতে তার কষ্ট হয়।
দাদী যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই সুরিয়া তার পাশে গিয়ে তার হাত ধরল। বলল মাকে লক্ষ করে, আমরা গিয়ে ওদিকে সব ঠিকঠাক করে নেই। পরে তোমরা স্যারকে নিয়ে এসো।
দাদীর ঘর। বেশ বড়।
ঘরের এক পাশে একটা খাট। দাদীর বিছানাপাতা। ঘরের অন্যপাশে বসার জন্যে সোফা পাতা। খাট ও সোফার মাঝখানের স্পেসে কার্পেট পাতা। কালো কার্পেট।
সোফার সামনে দুটো টি টেবিল এক সাথে বসিয়ে তার উপর সুন্দর টেবিল ক্লথ বিছানো হয়েছে। একপাশে একটা সিংগেল সোফা পাতা রয়েছে। অন্য দুপাশেও ছয়জনের বসার মতো সোফা বসানো রয়েছে। টেবিলের তিনদিক ঘিরেই বসার ব্যবস্থা রয়েছে। বড় সোফাটার মাঝখানে দাদী বসেছে। তার সামনে টেবিলের উপর নিকষ কালো কাঠের সুন্দর একটা ছোট বাক্স। দাদীর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সুরিয়া।
মাকার মা, আহমদ মুসা ও অন্যদের নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
ঘরে ঢুকেই মাকার চোখে পড়ল পশ্চিম দিকের দেয়ালে ক্রুশে আটকানো। যিশুর যে বিরাট মূর্তি সেটা একটা সাদা চাদরে ঢাকা।
স্বগতোক্তির মতো মাকার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, দাদী যিশুর মূর্তি ঢেকে রেখেছ কি স্যারের সম্মানে?
তোর স্যারের সম্মানে শুধু নয়, পূর্বপুরুষের কাগজপত্র খোলা উপলক্ষে তাঁদের সম্মানেও এটা করেছি। বলল দাদী।
ধন্যবাদ দাদী। বলল মাকা। সবাই বসল। মাকার মা বসল মাকার দাদীর পাশে। আহমদ মুসাকে বসানো হলো সিংগল সোফাটায়।
বৌমা, বাক্সটা তুলে আমার ভাইটির সামনে দাও তো। বলল মাকার দাদী।
সংগে সংগে মাকার মা বাক্সটি হাতে নিয়ে আহমদ মুসার সামনে রাখল।
দাদী বলে উঠল আহমদ মুসাকে লক্ষ করে, ভাই তুমি কাগজপত্র বাক্স থেকে বের করো।
না দাদী, আপনাদের বংশের ব্যাপার। বংশের বয়য়াজ্যেষ্ঠ হিসেবে এই কাজের হক আপনার। প্লিজ, আপনিই কাগজপত্র বের করুন।
বলে আহমদ মুসা বাক্সটি দাদীর দিকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিল।
দাদী হাত তুলে বাধা দিয়ে বলল, ভাই, সে হক আমি আমরা হারিয়েছি। খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার পর সে হক এখন আর আমাদের নেই। আমাদের এই পূর্বপুরুষরা যে ঔপনিবেশিক খ্রিস্টানদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে জীবনভর লড়াই করেছে, সেই খ্রিস্টান ধর্মই আমরা গ্রহণ করে আছি। আমাদের কোনো অধিকার নেই আমাদের পূর্বপুরুষদের কোনো কিছুতে হাত দেবার। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল দাদী।
দাদীর কান্নায় ভেঙে পড়া পরিবেশকে একদম পাল্টে দিল। সবার মুখ নিচু। কারোরই চোখ শুকনো নেই।
মাকার মা এক হাত দাদীর পিঠে রেখে সান্ত্বনা দিল। তার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে।
মুখ তুলল আহমদ মুসা। বলল, খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করা নিজেদের দোষ ভাবা ঠিক নয়। আপনারা তো জানতেন না, আপনাদের পূর্বপুরুষ মুসলমান ছিলেন। আর আপনারা তো খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেননি। আপনাদের নিকট অতীত পূর্বপুরুষদের জীবনে ইসলাম না থাকায় তারা ধীরে ধীরে অবস্থার চাপে খ্রিস্টান হয়ে গেছেন। এতে আপনাদের কোনো দোষ নেই।
মাকার মা চোখ মুছে বলল, আমাদের বেটা ঠিকই কথা বলেছেন মা।
আমরা তো নিজেরা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করিনি। সুতরাং আমরা নিজেদের দোষী ভাববো কেন? আপনার বাক্স খোলায় কোনো দোষ নেই-মা।
সুরিয়া টিস্যু বক্স থেকে একখণ্ড টিস্যু বের করে দাদীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, স্যার, মা ঠিক কথায় বলেছেন দাদী।সব সময় বাক্স
তো আপনিই খোলেন।
না বোন, আজ আমি পারব না। ওদিকে হাত বাড়ালেই আমার হাত কেঁপে উঠছে। প্রচণ্ড অপরাধবোধ এসে আমাকে জাপটে ধরছে। এজন্যেই আজ তোকে দিয়ে বাক্সটা এখানে আনালাম।
বলেই দাদী তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ভাই, মুসলমান কাকে বলে? কি করে মুসলমান হতে হয়? দাদীর কণ্ঠ ভারি।
মানুষকে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের পথ প্রদর্শনের জন্যে মানুষের স্রষ্টা মহান আল্লাহ মাঝে মাঝেই দুনিয়ায় নিজের পক্ষ থেকে বার্তাবাহী পাঠিয়েছেন। যেমন ইব্রারাহিম (আ.), ইসা (আ.) বা যিশু। তাদের সকলের পরে সর্বযুগের মানুষের জন্যে আল্লাহ সর্বশেষ একজন বার্তাবাহী পাঠিয়েছেন দুনিয়ায়। এই সর্বশেষ বার্তাবাহী হলেন মোহাম্মদ (সা.)। সর্বশেষ বার্তাবাহী বা রাসুল-এর মাধ্যমে দুনিয়ার জীবন পরিচালনার জন্যে যে আদেশ-নিষেধ আল্লাহ পাঠিয়েছেন, তা মুসলমানরা মেনে চলে। পাঁচটি কাজ মুসলমানদের জন্যে অপরিহার্য। প্রতিদিন পাঁচবার নামাজ বা প্রার্থনা করা, বছরে একবার রমজান মাসে ৩০ দিন রোজা রাখা, বছরে ব্যয়ের পর উদ্ধৃত্ত সম্পদের শতকরা আড়াইভাগ যাকাত দেয়া বা দরিদ্রদের দান করা, টাকায় কুলালে জীবনে অন্তত একবার মক্কায় গিয়ে হজ্জ সম্পাদন করা। মুখে কালেমা উচ্চারণ করা, বিশ্বাস করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা। এছাড়া মুসলমানদের একটা বড় কাজ হলো, ভালো কাজ করা, ভালো কাজ মানুষকে করতে বলা, মন্দ কাজ না করা এবং মন্দ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখতে চেষ্টা করা। সংক্ষেপে এই কাজগুলোই মুসলমানদেরকে করতে হয়। আর মুসলমান হওয়া খুবই সহজ। কালেমা শাহাদাৎ কোনো লোক মুখে উচ্চারণ ও বিশ্বাস করলেই সে মুসলমান হয়ে যায়। থামল আহমদ মুসা।
তোমার সব কথা আমি বিশ্বাস করলাম, মেনে নিলাম। তুমি কি মুসলমান করতে পারবে আমাকে? বলল দাদী।
হ্যাঁ, পারি দাদী। আহমদ মুসা বলল।
তাহলে আমাকে মুসলমান করো। বলল দাদী।
মা, আপনি একা মুসলমান হবেন কেন, আমাদের সবাইকে নিয়ে মুসলমান হন। বলল মাকার মা।
দাদীর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিছু বলতে যাচ্ছিল দাদী। কিন্তু, তার আগেই আহমদ মুসা বলে উঠল, আল-হামদুলিল্লাহ। আল্লাহ রাব্দুল আলামিনের বিশেষ রহমত আপনাদের সবার উপর বর্ষিত হোক। সুলতান মাকা, সুলতান মাতাকার ধর্ম ইসলামে ফিরে যাবার ইচ্ছা আল্লাহ পাক কবুল করুন। তবে আমার একটা প্রস্তাব, আপনাদের পূর্বপুরুষের কাগজপত্রে কি আছে সেটা আমরা দেখে নেই। তারপর সবার ইসলাম গ্রহণের অনুষ্ঠান আমরা করব।
আমি প্রস্তাবটি গ্রহণ করলাম। কিন্তু সেই সাথে বলতে চাই, পূর্ব পুরুষের কাগজপত্রে যাই থাক, আমার এই ভাইটি শেষ ধর্ম ইসলামের যে কথা বলেছে, সেই ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত আমার চূড়ান্ত। দাদী সোজা হয়ে বসতে চেষ্টা করে স্পষ্ট কণ্ঠে কথাগুলো বলল।
মা, আমাদেরও এটাই সিদ্ধান্ত।
বলে সবার দিকে তাকিয়ে মাকার মা বলল, সবাই আমার সাথে একমত?
সুরিয়া, মাকাসহ সবাই এক সাথে বলে উঠল, আমরা একমত।
আল-হামদুলিল্লাহ। এবার দাদী বাক্সটি খুলুন। বলে আহমদ মুসা বাক্সটি তার দিকে এগিয়ে দিল।
ঠিক আছে ভাই, এবার মনে খুব বল পেয়েছি। খুলছি বাক্সটি। বলল দাদী।
নিকষকালো বাক্সটি দাদী খুলল।
বাক্সের ভেতর থেকে বের করল মুখ বন্ধ চামড়ার একটা ফোল্ডার। চামড়ার ফোল্ডার থেকে বের হলো একটা কালো খাতা, ফোল্ডিং করা কয়েক খণ্ড কাগজ এবং হাতির দাঁতের তৈরি ছোট একটা কৌটা।
বৌমা, এগুলো ভাইয়ের সামনে দাও। বলল দাদী। মাকার মা জিনিসগুলো এগিয়ে দিল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা লুজ কাগজপত্রের দিকে মনোযোগ দিল। তিন খণ্ড কাগজ। কাগজগুলো একটু লম্বা ফোল্ড করা। আহমদ মুসা বিসমিল্লাহ বলে এক খণ্ড কাগজ খুলল।
কাগজের লেখার উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। সুন্দর হস্তাক্ষরে আরবি লেখা।
বাকি দুই কাগজ খণ্ডও খুলল আহমদ মুসা। একই ধরনের হস্তাক্ষর, একই ভাষা আরবি।
আহমদ মুসা তাকাল মাকার মায়ের দিকে। সব কাগজ খণ্ডই তার সামনে তুলে ধরে বলল, এগুলো তো আপনি দেখেছেন। কি ভাষা তা চিনতে পারেননি?
কাগজ, খাতা, কয়েন সবই দেখেছি, কিন্তু ভাষা চিনতে পারিনি। হাতের লেখা হওয়ার কারণে আরো দুর্বোধ্য মনে হয়েছে আমার কাছে। তুমি চিনতে পারছ বেটা? বলল মাকার মা।
জি, আমি চিনেছি। আপনার কাছে মোবাইল আছে? আহমদ মুসা বলল।
হ্যাঁ আছে। বলল মাকার মা।
ইন্টারনেট আছে? আহমদ মুসা বলল।
না, নেই। সুরিয়ার মোবাইলে ইন্টারনেট আছে। বলল মাকার মা।
মোবাইলের কথা শুনেই সুরিয়া তার মোবাইল তুলে ধরল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা ধন্যবাদ দিয়ে মোবাইলটি নিয়ে মাকার মার দিকে তুলে ধরে বলল, মা, এরাবিক স্ক্রিপ্ট লিখে সার্চ দিন প্লিজ।
ঠিক আছে বাবা।
বলে মোবাইলে কাজ শুরু করে দিল মাকার মা। এক মিনিট পরেই বলল, এরাবিক স্ক্রিপ্ট পেয়েছি বেটা।
আহমদ মুসা মোবাইলের স্ক্রিপ্টা একনজর দেখেই হাতের একটা কাগজ খণ্ড মাকার মার হাতে তুলে নিয়ে বলল, দেখুন তো কাগজের স্ক্রিপ্ট এবং মোবাইলের স্ক্রিপ্ট এক কিনা?
মাকার মা দুই স্ক্রিপ্টের দিকে এক নজর তাকিয়েই বলে উঠল, দুই স্ক্রিপ্ট একই ভাষার।
একটু থামল মাকার মা। পরক্ষণেই উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত কণ্ঠে বলে উঠল, মা এবং সবাই শোন, আমরা এতদিন যে ভাষা চিনতে পারিনি, আমাদের পূর্বপুরুষদের কাগজপত্র, খাতা, কয়েনের সে ভাষা হলো আরবি। আরবি মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরআনের ভাষা, বলা যায় তাদের ধর্মীয় ভাষা।
শুনেই দাদীর চোখে-মুখে অপার্থিব আনন্দের উজ্জ্বলতা নেমে এলো। মাকার মা সহ অন্য সবার চোখে-মুখে গভীর প্রসন্নতা।
নাম না জানা ভাই আমার, তুমি নিশ্চয় আরবি ভাষা জানো। পড়ে নিশ্চয় অর্থ করতে পারবে? বলল দাদী।
পারব দাদী। আহমদ মুসা বলল।
তাহলে আর দেরি নয়। শুরু করো ভাই। বলল দাদী।
আহমদ মুসা হাতের কাগজ খণ্ডগুলোর দিকে তাকাল। শিরোনামগুলো পড়ে নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে দাদীর দিকে চোখ নিবদ্ধ করে বলল, দাদী এখানে তিন সিট কাগজ আছে আর তিনটিতে তিনটি বিষয় রয়েছে। আমি বিষয় তিনটির শিরোনাম পড়ছি এবং তার অর্থও বলে দিচ্ছি।
আহমদ মুসা তিনটি কাগজের তিনটি বিষয়ের শিরোনাম আরবিতে পড়ল এবং তার অর্থ বলল। প্রথমটিতে ইয়াও গোত্রের মাকা বংশের বংশলতিকা লেখা রয়েছে। দ্বিতীয় কাগজে মাকা বংশের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ও শাখা সর্দারদের পরিচয়, অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর তৃতীয়টিতে মাকা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কাহিনী ও বড় প যুদ্ধ-বিগ্রহের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
তিনটি কাগজের বিষয়-শিরোনাম আরবিতে পড়ে তার অর্থ করার পর আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করল, সবটা পড়ব কিনা?
না ভাই, বিষয় তো জানাই হলো। বিস্তারিত পরে শোনা যাবে। এখন তুমি নোট বই, মানে খাতাটা দেখ। ওতে কি লেখা আছে বলো। বলল দাদী।
আহমদ মুসা খাতা মানে নোট বইটা তুলে নিল। কালো দামী চামড়ার বাঁধানো নোট বইটা। নোট বইয়ের কাগজগুলোও চামড়ার তৈরি, খুবই মূল্যবান। পাতা উল্টিয়ে টাইটেল পেজ বের করল। পড়ল শিরোনাম:
আমার কথা এবং আমার সম্পদের ব্যবস্থাপনা। আহমদ মুসা নোটবই-এর শিরোনাম আরবিতে পড়ল এবং তার অর্থ করল।
আমার কথা বলতে কার কথা বলা হয়েছে? বলল দাদী।
আহমদ মুসা লেখার প্রথম পাতার উপর নজর বুলাচ্ছিল। বলল, তিনি সুলতান মাকানজিলা বিওয়ানালী ওরফে সুলতান মাকা। মাকা বংশধারা এবং মাকা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তিনি।
আহমদ মুসা নোট বুকের শেষ দিকটা দেখছিল এবং কথা বলছিল।
মনে হচ্ছে আমাদের সম্মানিত পূর্বপুরুষ মাকানজিলা বিওয়ানালী ওরফে সুলতান মাকার কিছু আত্মকথা এটা। খুবই মূল্যবান আমাদের জন্যে এটা। কিন্তু সম্পদের ব্যবস্থাপনা বলতে কি বুঝানো হয়েছে? বলল মাকার মা।
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, তার লেখার একটা অংশে তার রেখে যাওয়া গুপ্তধনের কথা বলা হয়েছে।
গুপ্তধন? মাকার দাদী, মাকার মা এক সংগেই বলে উঠল। তাদের কণ্ঠে
বিস্ময়।
হ্যাঁ গুপ্তধন। বলল আহমদ মুসা।
কোথায় গুপ্তধন, কার কাছে সেই গুপ্তধন? দাদী বলল।
তাঁর কথা পড়লেই এটা জানা যাবে। বলল আহমদ মুসা।
তাঁর কথা এবং তাঁর গুপ্তধনের বিষয় সবই আমাদের সামনে আসা দরকার। দাদী বলল। তার কণ্ঠে খুশির চেয়ে বিব্রত ভাবই বেশি।
তার লেখা কত পাতা হবে বাবা? নোট খাতার একাংশেই শুধু লেখা দেখেছি। বলল মাকার মা।
পঁচিশ তিরিশ পাতার বেশি হবে না। আহমদ মুসা বলল।
তোমার পড়তে কি কষ্ট হবে? আমার মনে হয় তুমি টেক্সটা পড়। আমাদের পূর্বপুরুষের আরবি ভাষাও শোনা হবে এর মাধ্যমে। তার পর অর্থ করে দিও। বলল মাকার মা।
ঠিক আছে আমি পড়ছি মা। বলে আহমদ মুসা আরবি টেক্সট পড়া শুরু করল।
বিশ মিনিটেই পড়া শেষ হলো।
পড়া শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, তার নিজের সম্পর্কে কথা শেষ। এরপর রয়েছে গুপ্তধনের নক্সা এবং গোপন পথের বিবরণ।
ভাই তুমি এবার অর্থ করো তার কথার। সেই সাথে তুমি নক্সাটারও ব্যাখ্যা করবে। গুপ্তধনের ঝামেলা আমাদের উপর চাপলো কেন, বুঝতে পারছি না। এই গুপ্তধনকে কেন্দ্র করেই আমার মাল ভাই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। তুমি ফিরিয়ে নিয়ে এলে। বলল মাকার দাদী।
আমি নয়, আল্লাহ ফিরিয়ে এনেছেন দাদী। আর দাদী গুপ্তধনটিকে ঝামেলা বলবেন না। এই গুপ্তধনকে আল্লাহই আপনার হাতে তুলে দিতে যাচ্ছেন। সুলতান মাকা যে উদ্দেশ্যে গুপ্তধন রেখে গেছেন, সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের দায়িত্ব আল্লাহই আপনাদের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছেন। আপনাদের আনন্দের সাথে আল্লাহর দেয়া এ পবিত্র দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত। আহমদ মুসা বলল।
দুঃখিত ভাই কথাটা বলার জন্যে। কি করব, মাকা আমাদের সকলের চোখের মণি। বংশে ছেলেদের মধ্যে সেই মাত্র আছে এখন। তাকে ধরে নিয়ে যাবার পর আমরা অর্ধমৃত হয়ে পড়েছিলাম। বলল দাদী।
আল্লাহর উপর ভরসা করুন। তিনিই রক্ষাকর্তা, তিনিই সাহায্যদাতা। আহমদ মুসা বলল।
– এসব কিছুই আমাদের জানা নেই। ভুল তো পদে পদেই হবে। তুমি আমাদের কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে নাও বাবা। বলল মাকার মা।
কথাটা শেষ করেই মাকার মা বলল, তুমি যা পড়লে এবার তার অর্থ, বলো বেটা।
বলছি মা। বলে শুরু করল আহমদ মুসা।
শুরু করতে গিয়েই আবার থেমে গেল। বলল, মা, দাদী- আমি কিন্তু ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড অর্থ করছি না। চেষ্টা করছি, প্রতিটি বাক্যের মূল কথা তুলে ধরতে। সুলতান মাকানজিলা বিওয়ানালী ওরফে সুলতান মাকা লিখেছেন :
আমি আমার নবজন্মের কথা বলছি। আফ্রিকার হাজারো সরদারের মতো ইয়াও গোত্রের একটা শাখা গোত্রের আমি সরদার ছিলাম। অন্যসব সরদারের মতো অর্থবল, জনবল ও দেহের শক্তি সবই আমার ছিল। এসব থাকলেই শুধু মানুষের মাথার উপর চেপে বসা যায়, মানুষের উপর ছড়ি ঘোরানো যায়, যুদ্ধে জেতা যায়, মানুষের সবকিছু লুণ্ঠন করা যায়, মানুষকে দাস বানিয়ে পায়ের নিচে রাখা যায়। এসব দুরাচারিতা থেকে মুক্তি পেয়ে আমি নবজন্ম লাভ করেছি। আমি অন্ধকার থেকে আলোতে এসেছি, দুরাচার স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্তিলাভ করে আমি সদাচারী হয়েছি। অন্ধকারে হাতড়ে ফিরার পর আমি আমার স্রষ্টা, মালিক, প্রতিপালনকারী, রক্ষণকারী, জীবনদানকারী, মৃত্যু আনয়নকারী, পুনরুজ্জীবন দানকারী, জীবনের হিসাব গ্রহণকারী, ক্ষমাকারী, শাস্তি দানকারী, পুরস্কার দানকারী মাবুদ আল্লাহকে খুঁজে পেয়েছি। এই খুঁজে পাওয়ার মধ্যেও আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। আল্লাহ তাঁর এ বান্দাকে দয়া করে আলোর পথে টেনে নিয়েছেন।
সেটা এক পবিত্র রাতের কথা।
আমার সরদারী গ্রহণের তখন পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। আমার বাবা এক যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করলে ২৫ বছর বয়সেই আমাকে সরদারীর রাজদণ্ড গ্রহণ। করতে হয়। সরদারীর অহংকার ও শক্তির-দম্ভ, আমাকে পেয়ে বসেছিল। কিন্তু এর মধ্যেও মানুষকে আমি ভালোবাসতাম। যুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষের যারাই স্বজন হারাত, তাদের জন্যে আমার মনটা কাঁদত। গোপনে যতটা পারতাম আমি তাদের সাহায্য করতাম। ঈশ্বর সবার দুঃখ কেন দূর করে না, তা নিয়ে ভাবতাম।
সেই রাতের শেষ প্রহরে একটা স্বপ্ন দেখলাম।
আমি পথ চলছিলাম দিনের বেলা। কিন্তু দেখলাম দিনের আলোর বদলে যেন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে। সে অন্ধকার ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে উঠল। ক্রমে এমন হয়ে উঠল যে, চারদিকের নিকষকালো অন্ধকারের। দেওয়াল আমাকে ঘিরে ফেলল। আমাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না। অন্ধের মতো অন্ধকারে হাতড়ে পথ চলতে লাগলাম। এক সময় এভাবে চলাও অসম্ভব হলো। আমি পথ হারিয়ে ফেললাম। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমি পাগলের মতো অন্ধকারে পথ হাতড়াতে লাগলাম। আমার এই দুঃসময়ে একটু দূরে একটা আলোকমূর্তি আবির্ভূত হলো। সফেদ পোশাকে আবৃত, সফেদ চুল, সফেদ দাড়িতে মণ্ডিত পবিত্র চেহারার এক মানুষ তিনি। তাঁর দেহ থেকে প্রশান্ত এক আলোকছটা বিচ্ছুরিত হয়ে এক সরলরেখায় আমার। পাশ দিয়ে চলে গেল। সংগে সংগে তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, যারা সত্য সরল পথে চলতে চায়, তাদের জন্যেই এই আলোর পথ সিরাতুল। মোস্তাকিম। যারা শুনেছে, যারা দেখেছে এবং যারা আল্লাহর এই আলোর পথ পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছে, তারা কৃতজ্ঞ হলে এই পথে চলবে, আর অকৃতজ্ঞ হলে অন্ধকারের পথই হবে তাদের পথ, যা তাদেরকে নিয়ে যাবে জাহান্নামের অন্ধকার গহ্বরে।
থামল সেই সফেদ, পবিত্র মানুষের কণ্ঠ।
তার কথা আমার অন্তরে অপার্থিব এক প্রশান্তি ঢেলে দিল। মনে হলো কথাগুলো আমার জন্যে বলা হয়েছে এবং সেই আলোর পথটাও আমার জন্যেই। কারণ কৃতজ্ঞ হওয়াই আমার অভ্যেস। আমি পিতার কাছে কৃতজ্ঞ, কৃতজ্ঞ আমি আমার মায়ের কাছে, আর আমি সবার চেয়ে কৃতজ্ঞ আমার স্রষ্টার কাছে।
আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে আলোর পথে পা রাখলাম। চলা শুরু হলো আমার আলোর পথে।
এগোতে লাগলাম আমি, এগোতে লাগল সেই সফেদ পবিত্র বৃদ্ধও। আলোর পথও এগোতে লাগল সামনে।
আলোর পথে কতটা পথ চললাম আমি জানি না। হঠাৎ এক জায়গায়। এসে আলোর পথ নীল গম্বুজওয়ালা একটা গৃহকে আলোকিত করে তুলল। সেই আলোতে আমার নজরে পড়ল সেই আলোকিত বাড়ির পাশেই আমার দরবার গৃহ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দরবার গৃহের পাশে এমন আলোকিত বাড়ি! আমার বিস্ময়পীড়িত চোখ আবার ঘুরে এসে সেই আলোকিত বাড়ির উপর পড়ল। সন্ধান করল সেই পবিত্র বৃদ্ধের। সেই সফেদ, পবিত্র বৃদ্ধকে আর দেখা গেল না। তাহলে তিনি এই বাড়িতে প্রবেশ করেছেন? বাড়ির বিরাট ফটক দিয়ে আমিও প্রবেশ করলাম। ফটক থেকে লাল পাথরের সুন্দর পথ ধরে খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করলাম এক বিশাল ঘরে। মেঝেতে বিছানো সাদা কার্পেটের উপর সারি সারি সফেদ চাদর। ঘরটার চারদিকে একবার তাকিয়েই আমার মনে পড়ল এ রকম ঘর আমি দেখেছি জাঞ্জিবারে। আরো মনে পড়ল সেটা ছিল মুসলমানদের মসজিদ, তাদের প্রার্থনা গৃহ। আবার দেখার জন্যে আমি চোখ ফিরালাম আলোকিত ঘরের দিকে।
আমার ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠে বসলাম।
দেখলাম আমার ঘরে আমার বেডে আমি। মনটা আমার খারাপ হয়ে গেল। স্বপ্নটাকে স্বপ্ন বলে মেনে নিতে মন চাইল না।
আমি ঘর থেকে, বাড়ি থেকে বেরুলাম। দেখলাম পূর্ব আকাশে ভোরের তারা জ্বল জ্বল করছে। ছুটলাম আমার দরবার হলের দিকে।
দরবার হলের পাশের, পাকা চত্বরটাতেও গেলাম, যেখানে দৃষ্টিনন্দন। প্রার্থনাগৃহ আমি দেখেছিলাম, যেখানে আমার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়।
সেই সুন্দর প্রার্থনাগৃহ নেই, পড়ে আছে ফাঁকা চত্বর। কি যেন হারানোর বেদনা, অস্বস্তি আমার মনে। আমি ফাঁকা চত্বরটায় বসে পড়লাম। সেদিন ভাঙা হৃদয় নিয়েই আমার দিনের কাজ শুরু হয়। সকালেই আমার একটা গ্রাম পরিদর্শনে যাবার কথা।
আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর একটা গ্রুপকে রাতেই সেখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সকালেই সেনা কমান্ডারসহ কয়েকজন সৈনিক নিয়ে সেখানে যাবার কথা।
সকালে নাস্তার পরে আমরা বেরুলাম।
আমার ঘোড়া সবার আগে। আমার পেছনে সেনা কমান্ডার এবং তার। পেছনে কয়েকজন সেনা।
আমরা তখন বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছি। ঘোড়া হাঁটতে শুরু করেছে। হঠাৎ একটা হেষা রব করে মাথাটা সমান্তরালে এনে দাঁড়িয়ে গেল ঘোড়াটা।
আমি সামনে তাকালাম। চমকে উঠলাম আমি। দেখলাম সফেদ পোশাক, মাথাভরা সফেদ চুল এবং সফেদ দাঁড়ির সেই পবিত্র চেহারার পুরুষকে, যাকে আমি ভোর রাতে স্বপ্নে দেখেছিলাম।
দেখার সংগে সংগেই আমার দেহটা যেন আমার অজান্তেই, অবচেতন মনের কোনো এক নির্দেশে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। আমার স্থির দৃষ্টি পবিত্র পুরুষের দিকে নিবদ্ধ।
সেই পবিত্র বৃদ্ধের পেছনে ছিল আমাদের মহল্লারই ছেলে, বৃদ্ধ, যুবকসহ পনেরো-বিশজন লোক।
পেছন থেকে একজন যুবক ছুটে এলো আমার দিকে। যুবকটি আমাদের একজন রিজার্ভড গ্রুপ কমান্ডার।
যুবকটি আমার কিছুদূর সামনে এসে দাঁড়াল। একটা লম্বা বাও করে বলল, মহামান্য সরদার, এই নতুন মুসাফির আমাদের এবোনা মন্দিরের বারান্দায় কাপড় বিছিয়ে প্রার্থনা করছিল। তার অবয়ব আলোকিত করে তুলেছিল বারান্দাটিকে। ভোর হলে আমরা সেখানে যাই সবাই মিলে। আমরা তাকে বাও করে জিজ্ঞাসা করি, আপনি কে? তিনি বলেন আমাদের চিয়াও ভাষায়, আমি একজন পথের মানুষ। মানুষকে আলোর পথ দেখাই।
অন্ধকার জীবন থেকে মানুষকে আলোর পথে নিয়ে আসি।
আমরা অনুরোধ করেও তাকে আমাদের কারো বাড়িতে নিয়ে যেতে পারিনি খাওয়ানোর জন্যে। তিনি বলেছেন, আমার কাছে কিছু খাবার আছে, সেটা ফুরোলেই আপনাদের মেহমান হবো।
অবশেষে আমরা তাকে বলি, আমাদের একজন মহান সরদার আছেন, তিনিই আমাদের সব দেখাশোনা করেন। আপনি চাইলে আমরা তার কাছে আপনাকে নিয়ে যেতে পারি।
তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি তার সম্বন্ধে জেনেছি, তার দিল খুব নরম। তিনি মানুষকে দান করেন। তিনি ইয়াতিম, অসহায়দের কথা ভাবেন। আমরা তাকে বললাম, আপনি এসব জানলেন কি করে? তিনি তো এসব গোপনে করেন। তিনি বললেন, ফুলের গন্ধ নীরবে-নিভৃতে থাকে, কিন্তু তা ছড়িয়ে পড়ে মানুষ থেকে মানুষে।
তিনি রাজি হলে, আমরা তাঁকে আপনার কাছে নিয়ে যাচ্ছিলাম।
আমি কিছু বললাম না। আমি যুবকটিকে পাশ কাটিয়ে সেই পবিত্র পুরুষের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা দীর্ঘ বাও করে বললাম, হে পবিত্র পুরুষ, আপনাকে সুস্বাগতম, আমি মাকানজিলা বিওয়ানালী।
তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। বৎস, এই বাও করার কাজটা তুমি ভালো করনি। মানুষের মাথা একমাত্র তার স্রষ্টা ছাড়া আর কারো কাছে নত হয় না, নত করা যায় না।
যারা বিজ্ঞজন, যারা মহাজন, যারা মহৎপ্রাণ, তারা মানে ঈশ্বর স্রষ্টার প্রতিভূ।
স্রষ্টার প্রতিভূ বলে কোনো কিছু নেই। সব মানুষই স্রষ্টার সৃষ্টি। সব মানুষই সমান। স্রষ্টার হাতেই সব মানুষের জীবন। সব মানুষকেই স্রষ্টা অর্থাৎ মহান আল্লাহ পালন করেন, তাদের অভাব দূর করেন, তাদের প্রয়োজন পুরণ করেন, তাদের জীবন দান করেন, মৃত্যু ঘটান আবার তাদের জীবিত করবেন শেষ বিচারের দিন তারা যা করেছে তার হিসাব নেয়ার। জন্যে। তারপর আলোর পথে চলা, ভালো কাজ করা এবং মন্দ থেকে দূরে থাকা মানুষকে তিনি দান করবেন অনন্ত সুখের জান্নাত, আর অন্ধকারের পথে। চলা, অবিচার-অন্যায়ের মধ্যে ডুবে থাকা মানুষদের তিনি নিক্ষেপ করবেন। অনন্ত কষ্টের জাহান্নামে। এই স্রষ্টার কাছেই শুধু মানুষ তার মাথা নত করবে, শুধু তারই আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে।
আমি অভিভূত হয়ে পড়লাম আমার স্বপ্নকে আমার সামনে জীবন্ত ও সরবে উপস্থিত হতে দেখে। আমি সম্মোহিতের-মতো বললাম, হে পবিত্র পুরুষ, আমি আলোর পথে চলতে চাই। আপনার এমন ভালো কথাগুলো আরো শুনতে চাই। আমি চাই, আপনি আমাদের আলোর পথে পরিচালনা করুন। আমার হৃদয়ের সকল আন্তরিকতা দিয়ে আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি আমার বাড়িতে। আপনি দয়া করে আসুন।
বৎস সরদার, আমি তোমার বাড়িতেই যাচ্ছি। আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে হয় না। ভাঙা বেড়া, জীর্ণ পাতার পর্ণ কুটির থেকে ধনীর প্রাসাদ সবখানেই আল্লাহ আছেন। সব ঘরকেই আমি আমার ঘর বলে মনে করি। চলো তোমার বাড়িতে। বলল আমাকে সেই পবিত্র পুরুষ।
আমি তাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম। কথায় কথায় জানলাম তার বাড়ি আরবের তায়েফ নগরীতে। মানুষকে আলোর পথে ডাকার জন্যেই বাড়ি থেকে বের হয়েছেন কত বছর আগে তা তিনি হিসাব করে দেখেননি। তার সুখের সংসারে সবাইকে রেখে স্বামী-স্ত্রী বেরিয়ে পড়েছেন আল্লাহর পথে। তার স্ত্রী এখন থাকেন জাঞ্জিবারে।
পবিত্র পুরুষকে কেন্দ্র করে আমার বাড়িটা উৎসবমুখর হয়ে উঠল। আমি এবং আমার বংশের সকলেই এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এক সাথে আলোর পথে ফিরে এলাম, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলাম।
আমি স্বপ্নে আমার দরবার গৃহের পাশে যেখানে একটা সুন্দর মসজিদ দেখেছিলাম, সেখানে ঐ ধরনেরই একটা মসজিদ তৈরি করলাম পবিত্র পুরুষের অনুমতি নিয়ে।
দিন যায়। মাস যায়। বছর যায়।
একদিন ঐ সুন্দর মসজিদে এশার জামায়াত শেষে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তিনি আজ রাতে চলে যাচ্ছেন।
সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।
প্রথমে বেদনাদায়ক এক আকস্মিকতার আঘাতে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। তারপর ভেঙে পড়ল কান্নায়।
আমিও কাঁদলাম।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললাম, আমাদের নেতা, আমাদের উস্তাদ, আমাদের রাহবারকে আমরা ছাড়তে পারি না। আমরা অন্ধকারে ছিলাম তিনি আমাদের আলোতে নিয়ে এসেছেন। মানুষ হয়েও আমরা আচার-আচরণে অমানুষ ছিলাম, তিনি আমাদের মানুষ বানিয়েছেন। আমাদের কোনো প্রয়োজন তাঁর নেই, কিন্তু তাঁকে আমাদের প্রয়োজন। আমরা তাকে ছাড়তে পারি না। তিনি দয়া করে তার সিদ্ধান্ত বাতিল করুন।
কিন্তু আমাদের আবেদন-নিবেদন, অশ্রুপাত ও কান্না, তাঁর নতুন অনিশ্চিত যাত্রার পথ রোধ করতে পারল না। সবার অশ্রুর সামনে অঞরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বললেন, আমার প্রিয় ভাইয়েরা, তোমরা সকলেই আলোর পথে চলার মশাল-বরদার। এই মশাল বরদারের সেনাপতি হলেন সরদার মাকানজিলা বিওয়ানালী। তিনি আপনাদের মতো আলোর সৈনিকদের সঠিক পথে সঠিকভাবে পরিচালনার যোগ্যতা রাখেন। আমি তার জন্যে দোয়া করছি, আল্লাহ যেন তার দয়াকে অফুরন্ত ধারায় তার উপর বর্ষণ করেন। আল্লাহ, তাঁর রাসুল (সা.) এবং আল-কোরআন আলোর পথে চলার ক্ষেত্রে আপনাদের গাইড এবং এই তিনটিই আপনাদের সব শক্তির উৎস। যা কিছুই হোক এই তিনটাকে আপনারা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থাকবেন।
সকলকে কাঁদিয়ে তিনি বিদায় নিলেন।
যাবার সময় তাকে আল্লাহর পথে হাদিয়া হিসেবে কিছু টাকা দেয়া হলো। তিনি টাকা ফেরত দিয়ে বললেন, সামনের প্রয়োজন সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না, সুতরাং প্রয়োজন পূরণের টাকা আমি কীভাবে নেব? যে আল্লাহ আমার জন্যে প্রয়োজন সৃষ্টি করবেন, তিনিই টাকার ব্যবস্থা করবেন।
তিনি মাত্র কিছু শুকনো রুটি সাথে নিতে রাজি হয়েছিলেন।
পবিত্র পুরুষ চলে গেলেন, কিন্তু আমার জন্যে রেখে গেলেন সৌভাগ্য। অল্পদিনের মধ্যেই একুশ জন সর্দার ও রাজার রাজ্য আমার রাজ্যের সাথে যুক্ত হলো। আমার ছোট্ট সরদারী রাজ্য সম্রাজ্যে পরিণত হলো। আমি হয়ে গেলাম সরদার থেকে সুলতান সব রাজ্য আমাকে যুদ্ধ করেই দখল করতে হয়েছে। কিন্তু কোনো যুদ্ধই আমি শুরু করিনি, কোনো যুদ্ধের জন্যে আমি দায়ী ছিলাম না।
ইসলাম গ্রহণের পর শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সবার সাথে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সম্পর্ক সৃষ্টি করার দিকে আমার মনোযোগ ছিল বেশি। আশপাশের সরদার রাজাদের সাথে কোনো প্রকার বিরোধিতায় জড়িত না হওয়ার চেষ্টা ছিল আমার। কিন্তু আমার রাজ্যের পাশের সরদাররা এটাকে আমার দুর্বলতা ভাবল। মোজাম্বিকের বিখ্যাত সোংগা গোত্রের বড় একটা বংশের সরদার এনদাও আমার চারণভূমিতে ঢুকে আমাদের এক হাজারের মতো পশু ধরে নিয়ে গেল। আমি তিন সদস্যের একটা দল পাঠালাম সরদার এনদাও-এর কাছে আমাদের পশু ফেরত আনার জন্যে। সরদার এনদাও পশু তো ফেরত দিলই না, পশু আনতে যাওয়া আমাদের তিনজন লোককে তারা হত্যা করল। খবর শোনার পর আমি আমাদের এক হাজার পশু ফেরত পাওয়াসহ রক্তপণ হিসেবে তিন হাজার পশু দাবি করলাম। উত্তরে বিরাট এক সৈন্যদল নিয়ে সরদার এনদাও স্বয়ং আমার রাজ্য দখলের জন্যে এগিয়ে এলো। মানুষের এ রকম লোভ-লালসা ও স্বেচ্ছাচারিতায় আমার খুব দুঃখ হলো। আমার ঈমান বলল এ ধরনের দুবৃত্তপনার শাস্তি অবশ্যই হওয়া দরকার। আমি আমার কমান্ডারদের নির্দেশ দিলাম এনদাও-এর মাটিতেই যুদ্ধ হবে এবং সে মাটি আমাদেরই হবে ইনশাআল্লাহ। কমান্ডাররা আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে আমার আশাবাদের প্রতিধ্বনি করল।
যুদ্ধ হলো এনদাও-এর মাটিতেই এবং আল্লাহর রহমতে আমরা বিরাট জয় পেলাম। শোচনীয় পরাজয় ঘটল এনদাও-এর এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই সে নিহত হলো। আমরা তার রাজ্য-রাজধানী সবই দখল করে নিলাম। এনদাও ছিলেন লেক ট্যাঙ্গানিকা, লেক মালাবী সন্নিহিত রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম সম্পদশালী ধনী রাজ্যের সর্দার। বিরাট ধনভাণ্ডার আমরা পেয়ে গেলাম।
একটা রাজ্য আমার রাজ্যের সাথে যোগ হলো, আর্থিক ঐশ্বর্যও আমার কয়েকগুণ বেড়ে গেল। কিন্তু নতুন শত্রু সৃষ্টি হলো। আমার রাজ্যের উত্তরে সংগিয়া থেকে তনদরূ পর্যন্ত বিশাল রাজ্যের রাজা ছিলেন কিং গোগো। তিনি ছিলেন আমার সদ্য জয় করা এনদাও-এর মোরাপ্পা রাজ্যের আত্মীয়, এনদাও-এর স্ত্রীর বড় ভাই। তিনি বোনের জামাই হত্যা ও তার রাজ্য। দখলের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে যুদ্ধ যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হয়েছেন।
এই যুদ্ধ এড়ানোর কোনো উপায় ছিল না। আমি আমার কমান্ডারদের নির্দেশ দিলাম এ যুদ্ধও হবে কিং গোগোর মাটিতে। আমাদের উপর আপতিত এ যুদ্ধে ইনশাআল্লাহ জয় আমাদেরই হবে।
জয় আমাদেরই হলো। আমরা অপেক্ষাকৃত ছোট বাহিনী নিয়ে একটা বড় বাহিনীর উপর জয়লাভ করলাম। যুদ্ধের আগ মুহূর্তে আমি ঘোড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে সৈনিক ও কমান্ডারদের বলেছিলাম, আমরা অন্যায়ভাবে আক্রমণ করছি না। একটা অন্যায় যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, আমরা তার প্রতিরোধ করছি। জয় এবং পরাজয় দুটোই একমাত্র আল্লাহর হাতে। আমরা আল্লাহর কাছে জয় চাই। আল হামদুলিল্লাহ, তিনি আমাদের সাথে আছেন। আমাদের সৈন্যদল আল্লাহু আকবর বলে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঘোরতর যুদ্ধের পর কিং গোগো এবং তার সৈন্যবাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটল। কিং গোগো পালাতে গিয়ে পারলেন না। বিজয়ী সৈনিকদের হাতে তিনি নিহত হলেন। তাঁর রাজ্য, রাজধানী, রাজভাণ্ডার আমরা পেয়ে গেলাম। এভাবে এক অন্যায়ের মোকাবিলায় আরেক যুদ্ধে আমার রাজ্যের পশ্চিমে লেক মালাবীর কিছু অংশ পশ্চিমের রাজ্য লুন্ডাজীও আমার রাজ্যের সাথে যুক্ত হলো। এ আমার ইসলাম গ্রহণের এক বছরের মধ্যে আমার ছোট্ট রাজ্যের সীমা দশগুণ বৃদ্ধি পেয়ে বিশাল সালতানাতে পরিণত হলো। আল্লাহর হাজার শোকর সাম্রাজ্যের এই বৃদ্ধি কোনো অন্যায়-অবিচারের মাধ্যমে হয়নি। আমি ও আমার জনগণ মনে করি, আমরা খালেস নিয়তে ইসলাম গ্রহণ করেছি। এবং গ্রামে গ্রামে ইসলাম প্রচারের ব্যবস্থা এবং ইসলামের শিক্ষা প্রসারের জন্যে প্রতিটি গ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছি। এরই পুরস্কার হিসেবে মহান আল্লাহ তার অপার করুণা দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছেন। আমি আমার বর্তমান উত্তরাধিকারীদের বলেছি, তারা তাদের উত্তরাধিকারীদের বলবে এবং আমি আমার ভবিষ্যৎ বংশধরদের বলে যাচ্ছি, আমাদের মাকাও বংশসহ ইয়াও গোত্র যেন ইসলামের প্রচার ও প্রসারকে তাদের প্রধান লক্ষ হিসেবে সামনে রাখে। তাহলে দয়াময় আল্লাহর অপার করুণা আমরা লাভ করব এবং আফ্রিকার এ অঞ্চলের পথহারা মানুষও উপকৃত হবে।
এবার আমি আমার সম্পদ ব্যবস্থাপনার কথায় আসছি।
আল্লাহ যেমন আমাকে বিশাল রাজ্য দিয়েছেন, তেমনি দিয়েছেন বিপুল ধন-সম্পদ। এই ধনভাণ্ডারে আমার জানামতে হারাম কোনো অর্থ প্রবেশ করেনি। এখানে সম্পদ এসেছে দুই উৎস থেকে। এক. মালে গনিমত। কয়েকটা বড় যুদ্ধ থেকে আমি এটা পেয়েছি। মালে গনিমত থেকে সৈনিক ও কমান্ডারদের অংশ দেয়ার পর অবশিষ্টটা আমার ধন-ভাণ্ডারে এসেছে। যে দেশগুলো যুদ্ধের ফল হিসেবে আমার হাতে এসেছে, সে দেশসমূহের রাজকোষ থেকে যুদ্ধের ক্ষতিপুরণ নেয়া ছাড়া ঐ রাজকোষ আমি দখল করিনি। ঐ রাষ্ট্রের ব্যয় সংকুলানের জন্যে একটা অংশ রেখে অবশিষ্ট অংশ জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছি। দুই. আমার পৈতৃক সম্পদ থেকে আয়। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ২০ হাজার একরের মতো আমার পৈতৃক জমি, বাগান ও জলাশয় রয়েছে। এসবের আয় থেকে যাকাত আর ওশর ছাড়া কোনো বড় ধরনের খরচ আমার ধনভাণ্ডার থেকে হতো না। সুতরাং আমার ধনভাণ্ডার অবিরাম ফুলে-ফেঁপেই উঠেছে।
আমার ধনভাণ্ডারের একটা অংশই শুধু আমার উত্তরাধিকারীদের জন্যে রেখে যাব, সব তাদের দিয়ে যাব না। স্থাবর সম্পত্তি সবই তাদের জন্যে থাকছে, তার সাথে সাম্রাজ্যের আয়ের কিছু অংশ। সুতরাং রাজ্য পরিচালনা এবং ইসলামের প্রচার প্রসারের কাজের জন্যে তাদের অর্থের অভাব হবে না। দিন কারো সমান যায় না, আমার বংশেরও হয়তো যাবে না। সেই দুঃসময়েও আমার বংশের লোকরা যাতে ইসলামের প্রচার-প্রসারে কাজের সুযোগ পায়, সে জন্যেই আমার ধনভাণ্ডারের বৃহদাংশ তাদের জন্যে রেখে দিচ্ছি। আমার বংশের তারাই এ ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারবেন, যারা আরবি ভাষা জানবে এবং ইসলামের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত থাকবে।
এর দ্বারা আমি আশা করছি, আমার বংশের যারা এই ধনভাণ্ডার উদ্ধার করবেন, তারা মানব ধর্ম ইসলামকে ভালোবাসবেন এবং ধনভাণ্ডারের অর্থ নিজেদের জীবনধারণের প্রয়োজন মিটিয়ে ইসলামের প্রচার প্রসারে খরচ করবেন। আল্লাহ রাব্বল আলামিন আমার উদ্দেশ্য সফল করুন।
আমার ধনভাণ্ডারটি কোথায় রাখা সবচেয়ে নিরাপদ হবে, এ নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি। আমার রাজধানী লিচিংগায় রাখব না, এটা আমি আগেই চিন্তা করেছি। আমার কাছে পরিষ্কার যে, উত্তর মোজাম্বিকের এই লিচিংগা ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য পথের পাশে এবং লেক মালাবীর কাছাকাছি হওয়ায় এক সময় জনসমাগমের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। লিচিংগা থেকে কিছু উত্তরে নজে হাইল্যান্ডের মাউন্ট জেসির কথা আমি ভাবলাম। কিন্তু খুবই নগ্ন, খুবই উন্মুক্ত অঞ্চল ওটা, আমার ধনভাণ্ডারের জন্যে মোটেই নিরাপদ নয়। অবশেষে ভাবলাম মাউন্ট ইয়াও-এর কথা। মনটা খুশি হয়ে উঠল। আমাদের ইয়াও গোত্রের একটা আদি ভূমি ওটা। বেশি সুবিধার সন্ধানে ইয়াওরা বিভিন্ন দিকে মাইগ্রেট করলেও প্রচুর ইয়াও এখনো ইয়াও পাহাড়ের বনভূমিতে বাস করে। আমার গোপন ধনভাণ্ডারের জন্য মাউন্ট ইয়াও খুবই নিরাপদ হবে ইনশাআল্লাহ। পর্বতটা সবুজ বনভূমির দ্বারা বেষ্টিত। একদিকে নদী ও জলাভূমি, তিনদিকে বহু দূর বিস্তৃত বনাঞ্চল।
ইয়াও পর্বতেই আমার ধনভাণ্ডার ভবিষ্যতের কোনো এক সময়েয় জন্যে আল্লাহর নামে গচ্ছিত রাখলাম। গোপন ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করার জন্যে কোনো নকশা রেখে গেলাম না। কারণ নকশা অবাঞ্ছিত কারো হাতে পড়লে গোপন ধনভাণ্ডার বের করা তার জন্যে কিছুটা হলেও সহজ হবে। নকশার বিকল্প হিসেবে রেখে গেলাম কিছু সংকেত যা ইসলামী আদর্শ-ঐতিহ্যে বিশ্বাসী একজন বুদ্ধিমান মানুষের কাছে বোধগম্য হবে খুব সহজেই। আর। অবাঞ্ছিতদের জন্যে হবে দারুণ কঠিন। আমি দৃঢ় বিশ্বাসী যে, আল্লাহর দেয়া সম্পদ আল্লাহর পথে কাজের জন্যে আল্লাহর নাম নিয়ে আমি গচ্ছিত রাখলাম মাত্র। এর তকদির আল্লাহই নির্ধারণ করবেন। গচ্ছিত ধনভাণ্ডার সন্ধানের জন্যে নিচের সংকেতগুলো অনুসরণ করলেই ইনশাআল্লাহ। ধনভাণ্ডার খুঁজে পাওয়া যাবে।
সংকেত-১ : খুশি হও পর্বত যখন অবনত
সংকেত ২ : ঘোড়ায় আরোহন বিসমিল্লাহ বলে
সংকেত ৩ : গ্রানাইটের কলংকের কথা শোন।
আমি আনন্দিত এই দায়িত্ব পালন করতে পেরে। আল-হামদুলিল্লাহ, আমাকে দেয়া আল্লাহর সম্পদ আমি ভোগ করে এবং ভোগের জন্যে রেখেই আমার দায়িত্ব শেষ করিনি। বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে আল্লাহর দেয়া সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ করার একটা ব্যবস্থা করে যেতে পারলাম আল্লাহর রহমতে
হিসাব দেয়ার ভয়াবহ সেই দিনে আল্লাহ তাঁর এ বান্দার প্রতি দয়া করুন, দয়াময়ের প্রতি এই আকুল প্রার্থনা আমার। থামল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করে নোট বই বন্ধ করল আহমদ মুসা। পিনপতন নীরবতা। মাকার মা ও মাকার দাদীর মুখ নিচু। তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে।
মাকা, সুরিয়াসহ ছোটদের চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়।
নীরবতা ভাঙল আহমদ মুসা। মাকার মা ও দাদীদের লক্ষ করে আহমদ মুসা বলল, আপনাদের বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং আপনাদের মহান এক পূর্বসূরির কথা শুনে আনন্দের বদলে কাঁদছেন আপনারা?
আমাদের বংশের প্রতিষ্ঠাতা ও মহান এক পূর্বসূরির অপরূপ জীবন আমাদের বুক গর্বে ভরে দিয়েছে, কিন্তু মহান পূর্বসূরি তার উত্তরসূরিদের যেভাবে দেখতে চেয়েছেন তার ধারে কাছে আমরা নেই। তিনি যে আগ্রাসী ধর্মের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করেছেন, সেই ধর্মই তার উত্তসূরিরা গ্রহণ করে বসে আছে। নিজেদেরকে তার উত্তরসূরি বলার কোনো যোগ্যতা ও অধিকারই আমাদের নেই। বলল মাকার মা। শেষ কথায় এসে কান্নায় তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কথা শেষ করেই মুখ ঢেকেছিল সে। তার দুহাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। দাদীর দুচোখের অশ্রুর ধারা বেগবান হয়েছিল।
তার অশ্রুধোঁয়া মুখ উপরে তুলে বলল, হে নাম না জানা ভাই আমার, তুমি না এলে, তুমি না পড়লে আমরা তো কিছুই জানতে পারতাম না, যেমন এতদিন জানা হয়নি। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, সবচেয়ে বেশি প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা তোমার আল্লাহকে আমাদের আল্লাহকে। শত শত বছর পর আমাদের বংশ তোমার মতো এক দিশারীকে পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। দাদীর কণ্ঠও কান্নায় ভেঙে পড়ল।
দাদী, আপনাদের কান্না আর নয়, আরো বেশি বেশি শুকরিয়া আদায় করুন মহান আল্লাহর। অবশেষে আল্লাহর অপার করুণাধারা আপনাদের উপর বর্ষিত হয়েছে। অতীত নিয়ে আর অশ্রুপাত নয়। আপনাদের উপর যা ঘটেছে, তা ঘটেছে আফ্রিকার কোটি কোটি মানুষের উপরও। ইসলামের যে। প্রদীপ্ত আলোতে তাদের পূর্বপুরুষরা উদ্ভাসিত ছিল, সে আলো হারিয়ে তারা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল, এখনো নিমজ্জিতই আছে। ইসলামের রাজনৈতিক শক্তি ধ্বংস হবার পর ঔপনিবেশিকদের বাতিল ধর্ম তাদের গ্রাস করেছে ছলে বলে কৌশলে। উপনিবেশ এখন নেই, কিন্তু দুর্বল ও আধা সচেতন মুসলিম শাসক ও মুসলমানদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ছলে বলে কৌশল-এর আগ্রাসন এখনো চলছে। রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধার কূটকৌশলে পিষ্ট এই কোটি কোটি দুর্ভাগাদের একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ আপনারা। অতএব দুঃখের কিছু নেই।
তুমি ঠিক বলেছ বেটা, কিন্তু দুঃখ আমাদের পীড়িত করবেই। এ এক এমন ব্যর্থতা ও অযোগ্যতার কথা যা ভোলা সম্ভব নয়। বলল মাকার মা চোখ মুছে।
উজ্জ্বল বর্তমান দিয়েই শুধু অন্ধকার অতীতকে ঢেকে দেয়া সম্ভব। নাম না জানা ভাই শোন, আমাদের বর্তমানকে উজ্জ্বল করার ব্যবস্থা করো। আমরা ইসলামে ফিরে আসার আগে আর কোনো আলোচনা নয়। ইসলাম গ্রহণ করার পরই শুধু মুসলিম পূর্বপুরুষদের কথা নিয়ে আলোচনার যোগ্যতা আমরা অর্জন করতে পারি। দাদী বলল।
মা ঠিকই বলেছেন বেটা, এখন ইসলামে ফিরে আসাটাই আমাদের প্রথম কাজ। তুমি ব্যবস্থা করো, আমরা সকলে প্রস্তুত। বলল মাকার মা।
মুসলমান কীভাবে হতে হয়, তা আগেই বলেছি। সবাই অজু করে আসুন। কারো কাপড় পাক-সাফ না থাকলে কাপড় পাল্টে আসুন। আহমদ মুসা বলল।
অজু কীভাবে করতে হয়? আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই বলল সুরিয়া।
আহমদ মুসা অজু করার পদ্ধতি সবাইকে বলে দিল। অজু করে ফিরে এলো সবাই। সকলেরই পরনে নতুন কাপড়।
সবাই বসলে আহমদ মুসা কালেমায়ে শাহাদাৎ একবার আরবিতে পড়ে বলল, আমি কালেমার একটি করে অংশ উচ্চারণ করব, ভালো করে শুনে। আপনারাও তা উচ্চারণ করবেন। গোটা কালেমা পড়া শেষ হয়ে গেলে আমি অর্থ উচ্চারণ করব, আপনারও আমার সাথে সাথে অর্থ বলবেন।
কালেমা শাহাদাৎ পাঠ ও অর্থ পাঠ সবার হয়ে গেল।
ছেলেমেয়েরা খুশি হলো। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ
প্রকাশ করল। কিন্তু মাকার মা ও দাদী কালেমা পাঠের সময়ই কাঁদতে শুরু করেছিল। কালেমা পাঠ ও অর্থ পাঠ হয়ে গেলে তারা দুই হাত উপরে তুলে অঞরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, হে আল্লাহ! আমাদের মাফ করুন। আমরা মুসলমান, হয়েছি, আপনার ধর্মে ফিরে এসেছি, আমাদের মাফ করুন।
আহমদ মুসা সকলকে নামাজের পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে বলল, এই মুহূর্তের পর থেকে নামাজ বাদ দেয়া যাবে না। নামাজে যে দোয়া ও কোরআনের কিছু অংশ পড়তে হয়, সেগুলো শিখতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু নামাজ পড়তেই হবে। এই…।
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই সুরিয়া বলে উঠল, দোয়া ও কোরআনের কিছু অংশ শেখার আগে আমরা নামাজ কীভাবে পড়ব স্যার?
আল্লাহর প্রশংসা সূচক শব্দ দুচারটা যা কিছুই জানো, সব রাকাতে সে সব পড়েই নামাজ শেষ করতে হবে। নামাজের প্রতি রাকাতে কোরআন মজিদের যে সুরা পড়তে হয়, সেটা তোমাদেরকে সোহাইলি ভাষায় লিখে দেব। সুরাটি ছোট। আপাতত সেটা দিয়েই নামাজ পড়তে থাক এবং শিখার কাজ অব্যাহত রাখ। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা সবাইকে নিয়ে এশার নামাজটি পড়ে নিল। সকলেই খুশি। সবার চোখেই আনন্দাশ্রু।
.
রাত ১১টা।
দাদী আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে, আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ দিয়ে এবং সবাইকে ঘুমাতে যাবার জন্যে তাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ভাই, তুমি খুবই ক্লান্ত। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। এসেছিলাম তোমার পরিচয় জানার জন্যে, কিন্তু উদ্ধার হলো আমাদের পরিচয় এবং ঐতিহাসিক এক নতুন পরিচয়ে আমরা সমৃদ্ধ হলাম। আবারও অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি। আল্লাহর, তোমাকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আরেকটি বড় আলোচনা থেকে গেল। আসি ভাই আমরা।
কথাটা শেষ করেই মাকার দিকে তাকিয়ে বলল, সব দিকে খেয়াল রাখবে। আমার ভাইটির যেন কোনো অসুবিধা না হয়।
স্যারের সব সুবিধা কি আমরা দিতে পারব? মাকা বলল।
সেটা আমার ভাই জানে, তুমি ভেবো না। বলল দাদী। দাদী চলার জন্যে পা বাড়াল।
আসছি বাবা। বলে মাকার মাও দাদীর পেছনে পেছনে চলতে শুরু করল।
আস্সালামু আলাইকুম। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল আহমদ মুসা।
স্যরি ভাই, সালাম দেয়ার কথা আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। দোয়া করো সামনে আর যাতে ভুল না হয়। দাদী ফিরে দাঁড়িয়ে কথা কয়টি বলে আবার চলা শুরু করল।