লুল্লু – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
প্রথম অধ্যায়
চুরি
“লে লুল্লু,” আমীর শেখের মুখ দিয়া যখন এই কথা দুইটি নির্গত হইল, তখন তিনি জানিতেন না, ইহাতে কি বিপত্তি ঘটিবে। কথা দুইটি আমীরের অদৃষ্টে বজ্রাঘাতরূপে পতিত হইল। আমীরের বাটী দিল্লী শহরে, আমীর জাতিতে মুসলমান। একদিন অন্ধকার রাত্রিতে আমীরের বিবি একেলা বাহিরে গিয়াছিলেন। পরিহাস করিয়া, স্ত্রীকে ভয় দেখাইবার নিমিত্ত আমীর ভিতর হইতে বলিলেন, “লে লুল্লু।” অর্থাৎ কিনা, “লুল্লুসিলেন না। তখন তাঁহার মনে ভয়ের সঞ্চার হইল সিলেন না। তখন তাঁহার মনে ভয়ের সঞ্চার হইল ! তুই আমার স্ত্রীকে ধরিয়া লইয়া যা।” লুল্লু, কোনও দুরন্ত বাঘেরও নাম নয়, কিংবা ছুরিধারী কানকাটারও নাম নয়। “লুল্লু’’ একটি বাজে কথা, ইহার কোন মানে নাই, অভিধানে ইহা দেখিতে পাওয়া যায় না, পরিহাস করিয়া আমীর কেবল কথাটি যোড়-তাড় করিয়া বলিয়াছিলেন।
কিন্তু যখন বিপত্তি ঘটে, কোথা হইতে যেন উড়িয়া আসে। আশ্চর্যের কথা এই লুল্লু একটি ভূতের নাম ছিল। আবার, দৈবের কথা শুন, লুল্লু সেই রাত্রিতে, সেই মুহূর্তে আমীরের বাটীর ছাদের আলিসার উপর পা ঝুলাইয়া বসিয়াছিল। হঠাৎ কে তাহার নাম ধরিয়া ডাকিল। সে চমকিয়া উঠিয়া শুনিল, কে তাহাকে কি লইতে বলিতেছে; চাহিয়া দেখিল, সম্মুখে এক পরমাসুন্দরী নারী। তাহাকেই লইয়া যাইবার নিমিত্ত লুল্লুকে অনুরোধ করা হইতেছে। এরূপ সামগ্রী পাইলে দেবতারাও তদ্দণ্ডে নিকা করিয়া ফেলেন, তা ভূতের কথা ছাড়িয়া দিন। চকিতের ন্যায়, দুভার্গ রমণীকে লুল্লু আকাশপথে কোথায় যে উড়াইয়া লইয়া গেল, তার আর ঠিক নাই।
আমীর, ঘরের ভিতর থাকিয়া মনে করিতেছিলেন, স্ত্রী এই আসে। এই আসে, এই আসে করিয়া অনেকক্ষণ হইয়া গেল, তবুও তাঁহার স্ত্রী ফিরিয়া আসিলেন না। তখন তাঁহার মনে ভয়ের সঞ্চার হইল; তখন তিনি স্ত্রীকে ডাকিলেন, কিন্তু সাড়াশব্দ পাইলেন না। বাহিরে নিবিড় অন্ধকার, নিঃশব্দ। বাহিরে আসিয়া, এখানে-ওখানে চারিদিকে স্ত্রীকে খুঁজিলেন, কোথাও দেখিতে পাইলেন না। তবুও মনে এই আশা হইল, স্ত্রী বুঝি তামাসা করিয়া কোথাও লুকাইয়া আছে। তাই, পুনরায় প্রদীপ হাতে করিয়া আতি-পাতি করিয়া সমস্ত বাড়ি অনুসন্ধান করিলেন, বাড়ির ভিতর স্ত্রীর নাম-গন্ধও নাই। আবার আশ্চর্যের কথা এই যে, বাড়ির দ্বার বন্ধ। সন্ধ্যাকালে নিজে তিনি যেরূপ বন্ধ করিয়াছিলেন, সেইরূপ বন্ধই রহিয়াছে। তবে তাঁহার স্ত্রী কোথায় যাইলেন? পতিব্রতা সতীসাধ্বী আমীর-রমণী বাড়ির বাহিরে কখনই পদার্পণ করিবেন না। আর যদিও তাঁহার এরূপ কুমতি হয়, তাহা হইলে দ্বার খুলিয়া তো যাইতে হইবে! দ্বার তো আর ফুড়িয়া যাইতে পারেন না। দারুণ কাতর হইয়া আমীর এইসব চিন্তা করিতে লাগিলেন। আমীরের চক্ষু হইতে বুক বহিয়া অবিরত জল পড়িতে লাগিল। প্রিয়তমা গৃহলক্ষ্মীকে গৃহে না দেখিয়া গৃহ শূন্য, জগৎ শূন্য, হৃদয় শূন্য—আমীর সবই শূন্য দেখিতে লাগিলেন। কেবল শূন্য নয়, গ্রীষ্মকালের আতপতাপিত বালুকাময় মরুভূমির ন্যায় ধূ-ধূ করিয়া হৃদয় তাঁহার জ্বলিতে লাগিল। “আমি আমার অমূল্য নারী-রত্নকে আপন হাতেই বিলাইয়া দিলাম; আমার কথামত তাহাকে জিনেই লইয়া গেল, কি ভূতেই লইয়া গেল, কি স্বয়ং শয়তান আসিয়াই লইয়া গেল, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। হায়! হায়! কি হইল!” এইরূপে আমীর নানাপ্রকার খেদ করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। অবশেষে চক্ষু মুছিয়া, দ্বার খুলিয়া পাড়া-প্রতিবাসীকে ডাকিলেন। পাড়া-প্রতিবাসীরা সকলে দৌড়িয়া আসিল। সকলেই পুনরায় তন্ন তন্ন করিয়া আমীরের বাটী অন্বেষণ করিল। আমীরের বাটী দেখিবার পর, পাড়ার এ-ঘরে ও-ঘরে যথাবিধি অন্বেষণ হইল। গলি-খুঁজি সকল স্থানই দেখা হইল। খুঁজিতে আর কোথাও বাকি রহিল না, কিন্তু আমীরের স্ত্রীকে কেহই খুঁজিয়া পাইলেন না। প্রতিবাসীরা ক্রমে কানাকানি করিতে আরম্ভ করিল, নিশ্চয়ই আমীরের বিবি কোনও পুরুষের সঙ্গে বাহির হইয়া গিয়াছে। এরূপ সুন্দরী নবযৌবনা রমণী আফিমচীর ঘরে কতদিন থাকিতে পারে? আমীর একটু একটু পাকা-আফিম খাইতেন, তাঁহার এই দোষ। এক তো স্ত্রী গেল, তারপর যখন এই কলঙ্কের কথা আমীরের কানে উঠিল, আফিমচী হউন, তখন তাঁহার হৃদয়ে বড়ই ব্যথা লাগিল। তিনি ভাবিলেন, “দূর হউক, এ সংসারে আর থাকিব না, লোকের কাছে আর মুখ দেখাইব না, ফকিরী লইয়া দেশে দেশে বেড়াইব, যদি সে প্রিয়তমা লায়লারূপী সাধ্বীকে পুনরায় পাই, তবেই দেশে ফিরিয়া আসিব, না হইলে মজনুর মত এ ছার জীবন একান্তই বিসর্জন দিব।”
এইরূপ ভাবিয়া-চিন্তিয়া, ফকিরের বেশে আমীর ঘর হইতে বাহির হইলেন। সঙ্গে কিছুই লইলেন না; লইলেন কেবল একটি টিনের কৌটা, একটি বাঁশের নল, আর একটি লোহার টেকো। আমীর কিছু সৌখিন পুরুষ ছিলেন। টিনের কৌটার ঢাকনের উপর কাচ দেওয়া ছিল, আরসির মত তাহাতে মুখ দেখা যাইত। পান খাইয়া আমীর তাহাতে কখন কখন মুখ দেখিতেন, ঠোঁট লাল হইল কি না। বাঁশের নলটি তাঁহার বড়ই সাধের জিনিস ছিল। এক সাহেবের সঙ্গে খানসামা হইয়া একবার তিনি পাহাড়ে গিয়াছিলেন, সেইখানে এই শখের জিনিসটি ক্রয় করেন। ইহার গায়ে হিজি-বিজি কালো-কানো অনেক দাগ ছিল। আমীর মনে করিতেন, নলের সেগুলি অলঙ্কার, তাই সেই হিজি-বিজিগুলির বড়ই গৌরব করিতেন। বস্তুতঃ কিন্তু সেগুলি অলঙ্কার নহে, সেগুলি অক্ষর,—চীনভাষার অক্ষর। তাহাতে লেখা ছিল, “চীনদেশীয় মহাপ্রাচীরের সন্নিকট লিংটিং শহরের মোপিঙ নামক কারিগরের দ্বারা এই নলটি প্রস্তুত হইয়াছে। নল-নির্মাণ কাজে মেপিঙ অদ্বিতীয় কারিগর, জগৎ জুড়িয়া তাঁহার সুখ্যাতি। মূল্য চারি আনা। যাঁহার নলের আবশ্যক হইবে, তিনি তাঁহার নিকট হইতে যেন ক্রয় করেন, বাজে মেকরদিগের কাছে গিয়া যেন বৃথা অর্থ নষ্ট না করেন। মোপিঙের নল ক্রয় করিয়া যদি কাহারও মনোনীত না হয়, তাহা হইলে নল ফিরাইয়া দিলে, মোপিঙ তৎক্ষণাৎ মূল্য ফিরাইয়া দিবেন।” যাহা হউক, আমীর যে নলটি কিনিয়াছিলেন, মনের মত হইয়াছিল তাই রক্ষা। না হইলে, মূল্য ফেরত লইতে হইত। যুধিষ্ঠির যে পথ দিয়া স্বর্গে গিয়াছিলেন, সেই তুষারময় হিমগিরি অতিক্রম করিয়া, তিব্বতের পর্বতময় উপত্যকা পার হইয়া, তাতারের সহস্র ক্রোশ মরুভূমি চলিয়া চীনের উত্তরসীমায় লিংটিং শহরে আমীরকে যাইতে হইত, সেখানে যাইলে তবে মোপিঙের সহিত সাক্ষাৎ হইত, মোপিঙ সিকিটি ফিরাইয়া দিতেন। তাই বলি, ধর্মে রক্ষা করিয়াছে যে, নলটি আমীরের মনোনীত হইয়াছিল। এত মনোনীত হইয়াছিল যে, প্রতিদিন ইহাতে অতি যত্নে আমীর তৈল মাখাইতেন। তেল খাইয়া খাইয়া, পাকিয়া, ইহা ঈষৎ রক্তিমাবর্ণ হইয়াছিল। কৌটার ভিতর বড়ই সাধের ধন, আমীরের প্রস্তুত করা আফিম থাকিত, ইতর ভাষায় যাহাকে লোকে চণ্ডু বলে। বাঁশের নলটি দিয়া চণ্ডুর ধুম পান করিতেন। টেকো দ্বারা। কৌটা হইতে আফিম তুলিয়া নলের আগায় রাখিতেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়
রোজা
এই সকল সরঞ্জাম লইয়া আমীর গৃহ হইতে বাহির হইলেন। দিল্লী পার হইলেন, কত নদ-নদী গ্রাম-প্রান্তর অতিক্রম করিলেন। দিনের বেলায় ভিক্ষা করিয়া খান, সন্ধ্যা হইলে, গাছতলায় হউক, কি মাঠে হউক, পড়িয়া থাকেন। খোদা খোদা করিয়া কোনমতে রাত্রি কাটান। এইরূপে কতদিন অতিবাহিত হইয়া গেল। স্ত্রীকে পুনরায় পাইবার আশা আমীরের মন হইতে ক্রমেই অন্তর্হিত হইতে লাগিল। হয় ফকিরী করিয়া সমস্ত জীবন কাটাইতে হইবে, না হয় একটা বুড়োহাবড়া নিকা করিয়া পুনরায় ঘরকন্না করিতে হইবে, এই ভাবিয়া শোকে তিনি নিতান্তই আকুল হইয়া পড়িলেন। একদিন তিনি একটি গ্রামে গিয় উপস্থিত হইলেন। সেখানে একজনদের বাটীর সম্মুখে অনেকগুলি লোক বসিয়া আছে দেখিলেন। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন যে, সে গ্রামটি পশ্চিমের চক্ৰবেড়বিশেষ। যেখানে লোক বসিয়াছিল, সেটি জানের বাড়ি। গৃহস্বামী একজন প্রসিদ্ধ গণৎকার। ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সকলই প্রত্যক্ষ দেখিতে পান। সংসারে তাঁহার কাছে কিছুই গুপ্ত নাই। অদৃষ্টের লিখন তিনি জলের মত পড়িতে পারেন। সামুদ্রিকে হনুমানের চেয়ে ব্যুৎপত্তি। ললাটে কি হাতে, যে ভাষায় বিধাতা কেন আঁচড়-পিচড় পাড়িয়া থাকুন না, —ইংরেজীতে হউক, কি ফারসীতে হউক, দেবভাষায় হউক, কি দানব ভাষায় হউক—সকলই তিনি অবাধে পড়িতে পারেন। চুরি-জুয়াচুরি সকলই বলিয়া দিতে পারেন। অবোধ গবর্নমেন্ট যদিও তাঁহাকে একটিও পয়সা, কি একটিও টাইটেল দেন নাই সত্য, কিন্তু দূর-দূরান্তর হইতে তাঁহার নিকট লোক আসিয়া থাকে। পাঁচটি পয়সা আর পাঁচ ছটাক আটা দিয়া ভূত-ভবিষ্যৎ গণাইয়া লয়। আমীর বলিলেন, “আমিও জানের বাড়ি যাই, সে গণিয়া দিবে।” আমীর গিয়া জানের বাটীর সম্মুখে বসিলেন। অন্যান্য লোকের গণা-গাঁথা হইয়া যাইলে, অতি বিনীতভাবে গণৎকারের নিকট তিনি আপনার দুঃখের কথা আগাগোড়া বলিলেন। গণৎকার ক্ষণকালের নিমিত্ত গাঢ় চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। অবশেষে চারিখানি খাপ্রা হাতে লইলেন। মন্ত্র পড়িয়া সেই চারিখানি খাপ্রায় ফুঁ দিতে লাগিলেন। যখন মন্ত্র পড়া আর ফুঁ দেওয়া হইয়া গেল, তখন একখানি উত্তরদিকে, একখানি দক্ষিণে, একখানি পূর্বদিকে, আর একখানি পশ্চিমে ছুড়িয়া ফেলিলেন। তারপর কিয়ৎক্ষণের নিমিত্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, “ফকিরজী! আপনার স্ত্রীর সন্ধান পাইয়াছি। আপনার স্ত্রীকে ভূতে লইয়া গিয়াছে। কিন্তু করিব কি! আমি ভূতের রোজা নই। ভূতের উপর আমার কিছুমাত্র অধিকার নাই। যদি থাকিত, তাহা হইলে এতক্ষণ কোন্কালে আপনার স্ত্রীকে আনিয়া দিতাম। তবে আপনাকে সন্ধান বলিয়া দিলাম। আপনি এক্ষণে একটি ভাল রোজার অনুসন্ধান করুন। ভাল রোজ পাইলে নিশ্চয় আপনার স্ত্রীকে ভূতের হাত হইতে উদ্ধার করিতে পারিবেন।” এইরূপে আশ্বাস পাইয়া আমীরের মন কিঞ্চিৎ সুস্থ হইল। তাঁহার স্ত্রী যে কোনও দুষ্ট লম্পটের কুহকে পড়িয়া ঘর হইতে বাহির হয় নাই, এ দুঃখের সময় তাহাও শান্তির কারণ হইল।
এখন রোজা চাই। কিন্তু ইংরেজের প্রভাবে আমাদের সকল ব্যবসাই একরূপ লোপ পাইয়াছে। অন্য ব্যবসার কথা দূরে থাকুক, ভূতদিগের ভূতে পাওয়া ব্যবসাটি পর্যন্ত লোপ হইয়া গিয়াছে। এই হতভাগা দেশের লোকগুলো এমনই ইংরেজীভাবাপন্ন হইয়াছে যে, কাহাকেও ভূতে পাইলে কি ডাইনে খাইলে, বলে কি না হিস্টিরিয়া হইয়াছে! এ কথায় রক্তমাংসের শরীরে রাগ হয়, ভূতদেহে তো রাগ হইবেই। তাই ঘৃণায় ভূকুল একবাক্য হইয়া বলিল, “দূর হউক, আর কাহাকেও পাইব না।” ডাইনীকুল আজ তাই মৌনী ও স্রিয়মাণ। শ্মশান-মশান তাই আজ নীরব! রাত্রি দুই প্রহরের সময়, জনশূন্য মাঠের মাঝখানে, আকাশপানে পা তুলিয়া জিহ্বা লকলক করিয়া, চারিদিকে ঘুরিয়া-ঘুরিয়া সেকালে ডাইনীরা যে চাতর করিত, আজ আর সে চাতর নাই। মরি! মরি! ভারতের সক গৌরবই একে একে লোপ হইল। এ অবস্থায় আর রোজার ব্যবসা কি করিয়া চলিবে? তাহাও একপ্রকার লোপ হইয়াছে। নানা স্থানে কত শত গঙ্গা ময়রার ঘরে আজ অন্ন নাই। পায়ের উপর পা দিয়া, সোনাদানা পরিয়া, যাহারা সুখে-স্বচ্ছন্দে কাল কাটাইত, আজ তাহারা পথের ভিখারী। আমীর দেখিলেন, ভাল রোজা পাওয়া বড় সহজ কথা নয়। আমীর কিন্তু হতাশ হইবার ছেলে ছিলেন না। মনে করিলেন যে, “যদি আমাকে পৃথিবী উলট-পালট করিয়া ফেলিতে হয়, তাহাও আমি করিব, যেখানে পাই সেইখান থেকে ভাল রোজা নিশ্চয় বাহির করিব।” এই বলিয়া তিনি পুনরায় দেশপর্যটনে প্রবৃত্ত হইলেন। যেখানে যান, সেইখানেই সকলকে জিজ্ঞাসা করেন, “হাঁগা! তোমাদের এখানে ভাল ভূতের রোজা আছে?” ছোটখাটো অনেক রোজার সঙ্গে দেখাও হইল। অনেক মুসলমান আসিল, যাঁহারা তাবিজ লিখিয়া ভূত-প্রেত-দানা-দৈত্যকে দূর করেন, তাঁহাদেরও সহিত সাক্ষাৎ হইল। কিন্তু মনের মত কাহাকেও পাইলেন না; বুক ফুরিয়া কেহই বলিতে পারিল না যে, “ভূত মারিয়া আমি তোমার স্ত্রীকে আনিয়া দিব।” অবশেষে অনেক পথ, অনেক দূর যাইয়া আমীর একটি গ্রামে গিয়া পৌঁছিলেন। সেই গ্রামে প্রথমেই একটি বৃদ্ধার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। আমীর যথারীতি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাঁগা! তোমাদের এখানে ভাল রোজা আছে?” বৃদ্ধা উত্তর করিল, “ হাঁ বাছা, আছে। আমাদের গ্রামের মহাজনের কন্যাকে সম্প্রতি একটি দুর্দান্ত ভূতে পাইয়াছিল। মহাজনের টাকার আর অবধি নাই। সে যে কত ডাক্তার, কত বৈদ্য, কত হেকিম, কত রোজা আনিয়াছিল, তাহার আর কি বলিব, দু’ পা দিয়া জড় করিয়াছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নাই, কেহই সে ভূত ছাড়াইতে পারে নাই। অবশেষে এই গ্রামের একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ একটি মন্ত্র পড়িয়াই তাহাকে আরোগ্য করেন। ব্রাহ্মণ পূর্বে খাইতে পাইত না, ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীর উদরে অন্ন ছিল
না, অঙ্গে বন্ত্র ছিল না, এখন অন্ন-বস্ত্রের কথা দূরে থাকুক, দ্বারে হাতী ঘোড়া, উট বাঁধা।”
তৃতীয় অধ্যায়
তাঁতি
বলা বাহুল্য, আমীর এই কথা শুনিয়া অবিলম্বে ব্রাহ্মণের দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইলেন। ব্রাহ্মণের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, ঝুঁকে সেলাম করিয়া, তাঁহাকে আদ্যোপান্ত আপনার দুঃখের কাহিনী বলিলেন। ব্রাহ্মণ বলিলেন, “দেখ, ভূতে পাইলে আমি ছাড়াইতে পারি। ভূতে যদি কাহাকেও একেবারে উড়াইয়া লইয়া যায়, তাহার আমি কি করিতে পারি? পাহাড়ে লইয়া গিয়াছে, কি সমুদ্রের ভিতর লুকাইয়া রাখিয়াছে, তাহা আমি কি করিয়া জানিব? ফকির সাহেব! তোমার স্ত্রীকে আনিয়া দেওয়া আমার সাধ্যাতীত।” এই কথা শুনিয়া আমীর মাথা হেঁট করিয়া সেইখানেই বসিয়া পড়িলেন, চক্ষু দিয়া টপ্, টপ্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল। দুর্বাসা মুনির ভাতি! যেমন কঠিন, তেমনি কোমল! সেই জলেই ব্রাহ্মণের মন ভিজিয়া একেবারে গলিয়া গেল। ব্রাহ্মণ বলিলেন, “শুন ফকিরজী! তোমাকে মনের কথা বলি—প্রকাশ করিও না। তাহা হইলে রোজা বলিয়া আমার যা কিছু মান-সম্ভ্রম-প্রতিপত্তি হইয়াছে, সকলই যাইবে। তোমাকে সত্য করিয়া বলিতেছি, আমি প্রকৃত রোজা নই, ভূত ছাড়াইবার একটি মন্ত্রও জানি না। এমন কি, গায়ত্রী পর্যন্ত জানি না, আর লেখাপড়া বিষয়ে, ক-খ পর্যন্ত শিখি নাই। তবে এইমাত্র বলিতে পারি যে, আমি একজন পরম নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। চৌকায় বসিয়া খাই। আজকালের ইংরেজী-পড়া বাবুভায়াদিগের মত নই।” আমীর বলিলেন, “সে কি মহাশয়! তবে আপনি মহাজনকন্যার ভূত ছাড়াইলেন কি করিয়া?” ব্রাহ্মণ উত্তর করিলেন, “সে কথা তোমাকে আদ্যোপান্ত সমস্ত বলিতেছি। প্রকাশ করিও না, তাহা হইলে আমার বড়ই মন্দ হইবে।” আমীর বলিলেন, “আল্লার কসম্, আমার মুখ দিয়া একথা বাহির হইবে না।”
ব্রাহ্মণ বলিলেন, “এই গ্রামে একটি তাঁতি বাস করে। তাঁতি তাঁত বুনিয়া খায়, কোন ল্যাঠাই ছিল না। একদিন কি মতি হইল, সে তাঁত বুনিতে বুনিতে একটু গুন গুন স্বরে গান করিল। নিজের কানে সুরটি-স্বরটি বড়ই সুমধুর বলিয়া লাগিল। পুনর্বার আস্তে আস্তে গাইয়া দেখিল, বড়ই মিষ্ট বটে! তাঁতি মনে মনে ভাবিল, আমি একজন প্রকৃত গাইয়ে। এ গুণটি এতদিন প্রচ্ছন্ন অবস্থায় বৃথা নষ্ট হইতেছিল। জগতের দশাই এই, তা না হইলে হীরামণিমুক্তা উপরে চক্মক্ না করিয়া, মাটি কি জলের ভিতরে কেন বৃথা পড়িয়া থাকিবে? যাহা হউক, এখন হইতে গান গাইয়া আমি জগৎ মুগ্ধ করিব, মধুর তানে অবিরত জগতের কর্ণকুহরে সুধা ঢালিয়া দিব। আপাতত প্রতিবাসীদিগকে আমার গুণের কিঞ্চিৎ পরিচয় দিই।’ এই বলিয়া তাঁতি ক্রমে গলা ছাড়িয়া গান আরম্ভ করিল। একদিন যায়, দুই দিন যায়, গ্রামবাসীরা শশব্যস্ত। দুইচারি দিন পরে গ্রামের লোক অস্থির হইয়া পড়িল। প্রাণ লইয়া সকলের টানাটানি। সুতরাং আবালবৃদ্ধবনিতা সকলে গিয়া আঁতির দ্বারে উপস্থিত। তাঁতিকে ডাকিয়া বলিল, “বাপু হে! পুরুষানুক্রমে বহুদিন ধরিয়া আমরা এই গ্রামে বাস করিতেহি। তোমার গানের প্রভাবে আর আমরা এখানে তিষ্ঠিতে পারি না। বল তো ঘর-দ্বার ছাড়িয়া উঠিয়া যাই, আর না হয় চুপ কর, গানে ক্ষান্ত দাও। তাঁতি বলিল, ‘না মহাশয়! সে কি কথা? গ্রাম হইতে উঠিয়া যাইবেন কেন? সুরবোধ নাই বলিয়া যদি আমার গান আপনাদিগের কানে ভাল না লাগে, তাহা হইলে আপনাদিগকে আর বিরক্ত করিতে চাহি না। আজ হইতে মাঠে বসিয়া আমি গান করিব। যাহার বোধাবোধ আছে, তিনি মাঠে গিয়া আমার গান শুনিবেন, আর পারিতোষিকস্বরূপে একপণ করিয়া আমি তাঁহাকে কড়ি দিব।’ এইরূপ আশ্বস্ত হইয়া গ্রামের লোকে যে যাহার ঘরে চলিয়া গেল। তাঁতি গিয়া মাঠের মাঝখানে এক অশত্থগাছের নিচে তাঁত খাটাইল। সেখানে বসিয়া মনের সুখে গান করিতে লাগিল। তবে খেদের বিষয় এই, শুনিতে কেহ যায় না, জনপ্রাণী সেদিক মাড়ায় না। কাক-পক্ষী সেদিকে ভুলিয়াও উড়িয়া যায় না।
ব্রাহ্মণ বলিতেছেন, “ফকিরজী! আমি বড়ই দরিদ্র ছিলাম। এ গ্রামের ভিতর আমার মত দীনদুঃখী আর কেহ ছিল না। গৃহিণী ও আমি যে কত উপবাস করিয়াছি, তাহা বলিতে পারি না। নিজের যাহা হইক, ব্রাহ্মণীর শীর্ণ দেহ, মলিন মুখ দেখিয়া সততই আমার প্রাণ কাঁদিত। কি করিব, কোনও উপায় ছিল না, মনের আগুন মনেই নিবাইতাম, চক্ষের জল চক্ষেই শুকাইতাম। ব্রাহ্মণী একদিন আমাকে বলিলেন, ‘আজ ঘরে আটা নাই। তাঁতি বলিয়াছে, তাহার গান শুনিলে একপণ কড়ি দিবে। যাও না, একটুখানি কেন শুনিয়া এস না? একপণ কড়ি পাইলে ঘরে অন্ন হইবে, দুইজনে খাইয়া বাঁচিব।’ আমি বলিলাম, ‘দেখ ব্রাহ্মণী! ও কথাটি আমাকে বলিও না। শূলে যাইতে বল, তা যাইতে পারি, কিন্তু তাঁতির গান আমাকে শুনিতে বলিও না, তিলেকের নিমিত্তও সে দাগ্ধানি আমি সহ্য করিতে পারিব না।’ এই কথা লইয়া ব্রাহ্মণীর সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ বচসা হইল। ব্রাহ্মণী আমাকে ঘর হইতে ঠেলিয়া বাহির করিয়া দিলেন। বলিলেন, ‘যাও, একটুখানি তাঁতির গান শুনিয়া একপণ কড়ি লইয়া আইস।’ পথে বাহির হইয়া আমি মনে মনে ভাবিলাম, কি করিব? তাঁতির গান কি করিয়া শুনি? অথচ কড়ি না লইয়া আসিলে ব্রাহ্মণী আর রক্ষা রাখিবেন না। তাঁতির গান শুনার চেয়ে মরা ভাল। এ ছার জীবনে আর কাজ নাই। গলায় দড়ি দিয়াই মরি। এইরূপ মনে মনে স্থির করিয়া একজনদের বাটী হইতে একগাছি দড়ি চাহিয়া লইলাম। এ মাঠে তাঁতি গান করিতেছে, অন্যদিকে প্রায় দুই ক্রোশ দূরে একটি অশ্বথ গাছে দড়িটি খাটাইলাম, ফাঁসটি ঠিক করিয়া লইলাম। গলায় দিই আর কি, এমন সময় সেই গাছের ভিতর হইতে একটি ভূত বাহির হইল। ভূত আমাকে বলিল, ‘ওরে বামুন, তুই করিতেছি কি?’ আমি আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা তাহার নিকট বর্ণন করিলাম। ভূত বলিল, ‘আর ভাই! ও কথা বলিস্নে। যে গাছের তলায় এখন তাঁতি গান করিতেছে, যুগ-যুগান্তর হইতে ওই গাছে আমি বাস করিতেছিলাম। গাছটি আমার বড়ই প্রিয় ছিল। কিন্তু হইলে হইবে কি, যেদিন হইতে তাঁতি উহার তলায় গান আরম্ভ করিল, সেই দিন হইতেই আমাকে ও-গাছ ও-মাঠ ছড়িয়া পলাইতে হইল। দেখিতেছি, দুই জনেই আমরা বিপদে বিপন্ন। তা তোর আর ভাব নাই, তুই বাড়ি ফিরিয়া যা। তোদের গ্রামের মহাজনের কন্যাকে আমি গিয়া পাইব। কিছুতেই ছাড়িব না, কেবল তুই গিয়া যখন আমার কানে কানে বলিবি যে, আমি সেই দরিদ্র ব্রাহ্মণ আসিয়াছি, তখনই আমি ছাড়িয়া দিব। মহাজনের অনেক টাকা আছে, আর সেই একমাত্র কন্যা। অনেক ধন-দৌলত দিয়া তোকে বিদায় করিবে, তোর দুঃখ ঘুচিবে।’ ব্রাহ্মণ বলিলেন, “শেখজী! শুনিলে তো। আমি রোজা নই, আমি তন্ত্রমন্ত্র কিছুই জানি না। দৈবক্রমে আমার একটি ভূতের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তাহা হইতেই আমার এই যা-কিছু বল। মহাজনের কন্যার ভূত ছাড়িলে চারিদিকে আমার নাম বাহির হইল যে, আমার মত রোজা আর পৃথিবীতে নাই। ভূতে পাইলে সকলে আমাকে লইয়া যায়। আমাকে আর কিছু করিতে হয় না, কেবল আমি রোগীর কানে কানে গিয়া বলি, “শীঘ্র ছাড়িয়া যাইবে তো যাও, না হইলে এখানে তাঁতির গান দিব। তাঁতির নামে সকল ভূতই জড়-সড়, পলাইতে পথ পায় না।”
চতুর্থ অধ্যায়
উদ্যোগ
আমীর বলিলেন, “মহাশয়! তাহাই যদি সত্য, তবে চলুন না কেন? আপনার সেই ভূতটিকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া দেখি, তিনি যদি অনুগ্ৰহ করিয়া, আমার স্ত্রীকে উদ্ধার করিয়া দেন? কারণ, ভূতে ভূতে অবশ্যই আলাপ-পরিচয় আছে, নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণে, শাদি-বিয়াতে অবশ্যই সাক্ষাৎ হইয়া থাকিবে। আমার স্ত্রীকে যে ভূতে লইয়া গিয়াছে, তাহাকে যদি দুটো কথা বলিয়া দেন, তাহা হইলে আমার অনেক উপকার হইতে পারে। না হয়, স্ত্রীকে কি করিয়া পাই, তাহার একটা না একটা উপায়ও তিনি বলিয়া দিতে পারেন।” ব্রাহ্মণ বলিলেন, “এ পরামর্শ মন্দ নয়, তোমার দুঃখ দেখিয়া আমি বড়ই কাতর হইয়াছি, আচ্ছা চল যাই, দেখি কি হয়।” ব্রাহ্মণ দুর্গা বলিয়া আমীর বিস্মিল্লা বলিয়া, যাত্রা করিলেন। ক্রমে তাঁহারা যে মাঠে ভূত থাকে, সেই মাঠে গিয়া উপস্থিত হইলেন। যে গাছে ভূত থাকে, সেই গাছতলায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে দাঁড়াইয়া গাছের দিকে চাহিয়া ঊর্ধ্বমুখে দুই জনে স্তুতি-মিনতি করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণ বলিলেন, “হে ভূত! আশ্রিত সেই দরিদ্র ব্রাহ্মণ আজ পুনরায় তোমার নিকট আসিয়াছে। তোমার কৃপায় তাহার প্রাণ রক্ষা হইয়াছে। তোমার কৃপায় তাহার দরিদ্রতা মোচন হইয়াছে। পৃথিবীতে যত ভূত আছে, সবল ভূতের তুমি শ্রেষ্ঠ। ভূতের তুমি রাজা। কৃপা করিয়া দেখা দাও, আর একবার আবির্ভাব হও।” মুসলমান বলিল, “ভূতসাহেব! হুজুরের নাম শুনিয়া কদম-বোসী করিতে এখানে আসিয়াছি। আমার মনস্কামনা সিদ্ধ করুন। হুজুরের এই গাছতলায় কাঁচা-পাকা সিন্নি চড়াইব।” এই প্রকারে নানারূপ স্তব করিতে করিতে গাছটি দুলিতে লাগিল, ডালপালা সমুদয় মড়মড় করিতে লাগিল। তারপর গাছের ডগায়, একস্থানে সহসা অন্ধকারের আবির্ভাব হইল। দিন দুইপ্রহরে, চারিদিকে সূর্যের কিরণ, আর সকল স্থানেই আলো, কেবল সেই স্থানটুকুতেই অন্ধকার। ক্রমে সেই অন্ধকাররাশি জমিয়া গাঢ় হইতে গাঢ়তর হইতে লাগিল। অবশেষে তাহা এক ভীষণ প্রকাণ্ড নরমূর্তিতে পরিণত হইল। নরমূর্তি ধরিয়া ভূত গাছ হইতে নামিয়া আসিল, বৃক্ষের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল।
এখানে এখন একটি নতুন কথা উঠিল। বিজ্ঞানবেত্তারা—বিশেষত ভূততত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা—এ বিষয়টি অনুধাবন করিয়া দেখিবেন। এখানে স্থির হইল এই, যেমন জল জমিয়া বরফ হয়, অন্ধকার জমিয়া তেমনি ভূত হয়। জল জমাইয়া বরফ করিবার কল আছে, অন্ধকার জমাইয়া ভূত করিবার কল কি সাহেবেরা করিতে পারেন না? অন্ধকারের অভাব নাই। নিশাকালে বাহিরে তো অল্প-স্বল্প অন্ধকার থাকেই। তারপর মানুষের মনের ভিতর যে কত অন্ধকার আছে, তাহার সীমা নাই, অন্ত নাই। কোদাল দিয়া কাটিয়া কাটিয়া ঝুড়ি পূরিয়া এই অন্ধকার কলে ফেলিলেই প্রচুর পরিমাণে ভূত প্রস্তুত হইতে পারিবে। তাহা হইলে ভূত খুব সস্তা হয়। এক পয়সা, দুই পয়সা, বড় জোর চারি পয়সা করিয়া ভূতের সের হয়। সস্তা হইলে গরীব-দুঃখী সকলেই যার যেমন ক্ষমতা ভূত কিনিতে পারে।
গাছের পাশে দাঁড়াইয়া, কিছু রাগতভাবে ভূত বলিল, “বামুন! আজ আবার কেন আসিয়াছিস? তোর মত বিট্লে বামুন আমার অবধ্য নয়। ইচ্ছা হইলে এখুনি তোর ঘাড় মুচড়াইয়া দিতে পারি। আমার অবধ্য, সেই ইংরেজী-পড়া বাবুলোক। তাঁহাদের ভয়ও করি, ভক্তিও করি! ভয় করি, পাছে মহাপ্রভুরা গায়ে টলিয়া পড়েন, কি বমন করিয়া দেন। ভক্তি করি, কেননা, এটা-সেটা খাইয়া তাঁহাদের মর্ত্যলোকেই তাঁহারা সদাশিবত্ব প্রাপ্ত হন, অন্য লোকের মত তাঁহাদের মন জিলেপির পাকবিশিষ্ট নয়।” ব্রাহ্মণ বলিলেন, “প্রভু! আমি নিজের জন্য আপনার নিকট ভিক্ষা করিতে আসি নাই। আপনার প্রসাদে আমার আর কিছুরই অভাব নাই। এই লোকটি নিদারুণ সন্তাপিত হইয়াছে, ইহার নিমিত্তই আমি আপনার নিকট আসিয়াছি।”
এই কথায় ভূতের রাগ কিছু পড়িয়া আসিল। সে জিজ্ঞাসা করিল, “সঙ্গে তোমার ও লোকটি কে?” ব্রাহ্মণ তখন আমীরের সকল কথাই ভূতকে শুনাইলেন। শুনাইয়া বলিলেন, “মহাশয়! আপনাকে ইহার একটা উপায় করিতে হইবে, না করিলে এ লোকটি প্রাণে মরিবে। আপনি দয়ার্দ্রচিত্ত, আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছিলেন, ইহারও প্রাণরক্ষা করুন।” ভূত বলিল, “ইহার স্ত্রীকে নিশ্চয়ই লুল্লু লইয়া গিয়াছে। লল্লু সবে নূতন ভূতগিরি পাইয়াছে, ভূতগিরিতে তাহার নব অনুরাগ, সে বড়ই দুরন্ত।” ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “নূতন ভূতগিরি পাইয়াছে? মহাশয়। সে কি প্রকার কথা?” ভূত হাসিয়া বলিল, “একথা তোমরা কিছুই জান না। লোকে বলে, অমূক মানুষ মরিয়া ভূত হইয়াছে। ঠিক সেটি সত্য নয়। মানুষ নিজে মরিয়া নিজের ভূত হয় না। মানুষ মরিলে আমরা কেহ গিয়া তাহার ভূতগিরি করি। লক্ষ লক্ষ ভূত পৃথিবীতে অবস্থিতি করিতেছে। কেহ বা ভূতগিরি করিবার কর্ম , পাইয়াছে, কেহ বা ভূতগিরি করিবার উমেদারি করিতেছে, আবার কেহ বা বেকার বসিয়া আছে। আমাদের যিনি কর্তা, তিনিই ভূতদিগকে এই কার্যে নিযুক্ত করেন। ভূতকে তিনি বলেন, ‘যাও অমুক মানুষের সঙ্গে সঙ্গে থাক, সে মরিলে তাহার ভূত হইও, তাহার ভূতগিরি তোমাকে দিলাম।’ সেই দিন হইতে ভূতটি মানুষের সঙ্গে সঙ্গে থাকে। মানুষের মাথাটি ধরিলে তাহার আর আনন্দের পরিসীমা থাকে না; কেন না, মরিলেই তাহার ভূতগিরি করিতে পাইবে। এরূপ যে ঘটনা হয়, সে কেবল তোমাদের নিজ দোষে। দেশীয় সংবাদপত্রসকল তোমাদিগকে কত সুশিক্ষা দিয়া থাকে, যদি কায়মনচিত্তে পালন করিতে, তাহা হইলে তোমাদের এ দুর্দশা হইত না। এই দেখ, দেশ একেবারে নির্ধন হইয়া যাইতেছে, বিলাতী কাপড়ের দ্বারা বিদেশীয়েরা ধন লুটিতেছে! ভাল, কাপড় না পরিলেই তো হয়? যদি কাপড় না পর, তাহা হইলে তো আর তোমাদিগের ধন কেহ লুটিতে পারে না। রেল করিয়া বিদেশীয়েরা ধন লইয়া যাইতেছে। ভাল, রেলে না চড়িলেই তো হয়, পায়ে হাঁটিয়া কেন কাশী-বৃন্দাবন যাও না? তা যদি কর, তাহা হইলে বিদেশীয়েরা তোমাদিগের দেশে রেল করিতে কখনই আসিবে না, দেশের ধন দেশেই রহিয়া যাইবে। সেইরূপ আমরা তোমাদিগের ভূতগিরি করি। আমরা তোমাদিগের ভূতগিরি করিবার উমেদারিতে থাকি। ভাল, তোমরা যদি মরা ছাড়িয়া দাও, তাহা হইলে তো কেহ তোমাদের ভূতগিরি করিতে আসে না? তাই বলি, না মরিলেই তো সকল কথা ফুরাইয়া যায়। নিজে তোমরা মরিবে, আর যত দোষ আমাদের? অপরাধের মধ্যে এই যে, মরিলে আমরা তোমাদিগের ভূতগিরি করি।
“যাহা হউক, লুল্লু বহুদিন হইল, ভূতগিরি করিবার জন্য দরখাস্ত করিয়াছিল। তাহার কপালে ভাল ভূতগিরি কোথাও জুটে নাই। অবশেষে কর্তা তাহাকে দুখিরাম চণ্ডালের ভূতগিরির উমেদারিতে নিযুক্ত করেন। দুখিরাম যদিও বৃদ্ধ হইয়াছিল, তথাপি তাহার শক্তি-সামর্থ্য বিলক্ষণ ছিল। কিছুতেই মরিতে চায় না। বৃদ্ধের কুব্যবহারে লুল্লু বড়ই বিরক্ত হইয়াছিল। আজ অল্পদিন হইল, দুখিরামের মৃত্যু হইয়াছে, লুল্লু তাহার ভূতগিরি পাইয়াছে। লুল্লু একটি সভ্য ভব্য নব্য ভূত। সে যে এতদিন পরে এখন মনের সাধে ভূতগিরি করিতেছে, তোমাদের মুখে একথা শুনিয়া বড়ই সুখী হইলাম।” ব্রাহ্মণ বলিলেন, “সে কি কথা মহাশয়? দুরাচার লুল্লুর কার্যে আপনি সন্তুষ্ট! আমরা যে, আপনার নিকট তাহার নামে অভিযোগ করিতে আসিয়াছি। ইহার স্ত্রীকে আপনি উদ্ধার করিয়া দিবেন, সেই প্রার্থনায় যে, আপনার কাছে আসিয়াছি।” এইরূপ অনেক বাদানুবাদের পর ভূত বলিল, “দেখ, আমি এক্ষণে বৈরাগ্য-ধর্ম অবলম্বন করিয়াছি, সংসারের বাদবিসংবাদ, ভাল-মন্দ কিছুতেই থাকি না। আমি জানি না লুল্লু এখন কাহার স্ত্রীকে কোথায় রাখিয়াছে। অন্বেষণ করি, এরূপ অবকাশ আমার নাই। তোমরা এক কাজ কর; এখান হইতে দশ ক্রোশ দূরে মাঠের মাঝখানে একটি পুরাতন কূপ আছে, সে কূপে এখন জল নাই। তাহার ভিতর ঘ্যাঁঘোঁ বলিয়া একটি ভূত বাস করে। ঘ্যাঁঘোঁ সকল সংবাদ রাখিয়া থাকে। ভূতদিগের মধ্যে একরূপ গেজেট। তোমরা তাহার নিকট যাও, সে সকল সন্ধান বলিয়া দিবে। তবে কথা এই, আজ কিছুদিন হইল, ঘ্যাঁঘোঁ মনোদুঃখে জ্বর-জ্বর হইয়াছে। মনের খেদে বিরলে সে কূপের ভিতর বসিয়া আছে। কথা কহে না, ডাকিলে উত্তর দেয় না, তাহার দেখা পাওয়া ভার! চেষ্টা করিয়া দেখ।”
পঞ্চম অধ্যায়
ঘ্যাঁঘোঁ
ব্রাহ্মণ এবং আমীর, আর করেন কি? দুই জনে ঘ্যাঁঘোঁর অনুসন্ধানে চলিলেন। যাইতে যাইতে সেই মাঠে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কৃপের ধারে গিয়া ঘ্যাঁঘোঁকে ডাকিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণ ডাকিলেন, “ঘাঁঘে মহারাজ। ঘ্যাঁঘোঁবাবু! ঘরে আছেন?” মুসলমান ডাকিলেন, “ঘ্যাঁঘোঁসাহেব! বাড়ি আছেন?” ডাকিয়া ডাকিয়া দুই জনেরই গলা ভাঙিয়া গেল, তবুও ঘ্যাঁঘোঁ কূপ হইতে বাহির হইল না, উত্তর পর্যন্ত দিল না। দুই জনে তখন ভাবিলেন, এ তো বড়ই বিপদ! এর আবার উপায় কি করা যায়। ব্রাহ্মণ অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া বলিলেন, “চল, আমরা তাঁতির কাছে যাই।” বিরস-বদনে দুই জনে ফিরিলেন। পুনরায় গ্রামে আসিয়া দুই জনে তাঁতির নিকট যাইলেন। ব্রাহ্মণ তাঁতিকে বলিলেন, “ভায়া! তোমাকে একটি উপকার করিতে হইবে। ঘ্যাঁঘোঁ নামে একটি ভূত আছে। সে আমার পরম বন্ধু। তাহার কানের ভিতর অতিশয় পোকা হইয়াছে, সে পোকা কিছুতেই বাহির হইতেছে না। দারুণ ক্লেশে ঘ্যাঁঘোঁ এখন একটি কূপের ভিতর আশ্রয় লইয়াছে। আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া, তাহারই ভিতর অবস্থিতি করিতেছে। ডাকিলে উত্তর দেয় না, বাহিরেও আসে না। মনুষ্যের কানে পোকা হইলে অনেক কালোয়াতের গানে বাহির হইতে পারে, কিন্তু ভূতের কানের পোকা তোমার গান ভিন্ন কিছুতেই বাহির হইবে না। অতএব যদি তুমি একবার সেই কূপের ধারে বসিয়া একটু গান কর, তাহা হইলে বড়ই উপকৃত হইব।” এ পর্যন্ত ইচ্ছাসত্বে কেহ তাঁতির গান শুনে নাই। আজ তাহাকে গান গাওয়াইবার জন্য লোকে উৎসুক। এ অহঙ্কার রাখিবার কি আর স্থান আছে? আহ্লাদে আটখানা হইয়া তাঁতি বলিল, “আমি এইক্ষণেই যাইতেছি। কাপড় পরিয়া আসি।” তাঁতি কাপড় পরিয়া তৎক্ষণাৎ ঘর হইতে বাহির হইল। তিন জনে পুনরায় সেই কুপাভিমুখে চলিলেন। কূপের ধারে পৌঁছিয়া, তাঁতি আসন করিয়া গান আরম্ভ করিলেন; ব্রাহ্মণ ও আমীর কানে অঙ্গুলি দিয়া কিঞ্চিৎ দূরে গিয়া দাঁড়াইলেন। যখন তাঁতির গান কূপের ভিতর গিয়া প্রবেশ করিল, তখন ঘ্যাঁঘোঁ ভাবিল, “মনের খেদে জ্বর-জ্বর হইয়া বিরলে কূপের ভিতর বসিয়া আছি, এখানে আজ আবার এ কি ভীষণ ব্যাপার! সেকালে কবির চিতেন শুনিয়াও প্রাণ ধরিতে পারিয়াছিলাম, তাহাতেও প্রাণ বাহির হয় নাই; আজ যে দেখিতেছি, মহাপ্রাণী ধড়ফড় করিয়া বাহির হয়।” ঘ্যাঁঘোঁ তবুও কিন্তু সহজে কৃপ হইতে বাহির হয় নাই। যখন দেখিল, তাঁতির গানে নিতান্তই প্রাণ বাহির হইয়া যায়, তখন করে কি? কাজেই বাহির হইতে হইল। হামাগুড়ি দিয়া কূপ হইতে বাহির হইল। ঘ্যাঁঘো বেঁটে-খেঁটে, হাড়-ওঠা বুড়ো-সুড়ো ভূত। মনের খেদে দেহ তার এতই জ্বর-জ্বর হইয়াছিল যে, তাহার চক্ষু, মুখ, নাসিকা হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতেছিল।
কূপ হইতে বাহির হইয়া ভূত একদিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলাইবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময়ে ব্রাহ্মণ ও আমীর আসিয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইলেন। ব্রাহ্মণ তাহাকে বলিলেন, “ঘ্যাঁঘোঁ, তুমি পলাইও না, তোমার ভয় নাই, ওই দেখ তাঁতি ভায়া চুপ করিয়াছে। আর পলাইবে বা কোথা? যেখানে যাইবে, সেইখানে গিয়া তাঁতি ভায়া গান জুড়িয়া দিবেন। তার চেয়ে, তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি, সত্য সত্য উত্তর দাও, আমরা তাঁতি ভায়াকে লইয়া ঘরে ফিরিয়া যাই।” ঘ্যাঁঘো ব্রাহ্মণের মুখপানে চাহিল, আমীরের মুখপানে চাহিল, তাঁতির মুখপানে চাহিল। দেখিল, গলা পরিষ্কার করিয়া তাঁতি আর একটি গান আরম্ভ করিবার উদ্যোগ করিতেছে। তাহা দেখিয়াই ঘ্যাঁঘোঁর আত্মা-পুরুষ শুকাইয়া যাইল। সে বলিল, “আচ্ছা কি বলিবে বল, কি জিজ্ঞাসা করিবে?” ব্রাহ্মণ বলিল, “লুল্লু নামক তোমাদের যে ভূত আছে, সে এই আমীরের স্ত্রীকে লইয়া গিয়াছে। কোথায় রাখিয়াছে, তুমি বলিতে পার? আর কি করিয়াই তাহার উদ্ধার হয়?” ঘ্যাঁঘোঁ বলিল, “অনেকদিন ধরিয়া ঘোর দুঃখে জ্বর-জ্বর হইয়া আমি এই কূপের ভিতর বসিয়া আছি। সংসারের সংবাদ বড় কিছু রাখি নাই। তবে তাঁতির গান যদি আর না শুনাও, তাহা হইলে অনুসন্ধান করিয়া বলিতে পারি।”
ব্রাহ্মণ বলিলেন, “অনুসন্ধান করিতে যাই বলিয়া তুমি পলাইয়া যাইবে, শেষে আর তোমার দেখা পাইব না। আমরা তেমন বোকা নেই যে, তোমাকে ছাড়িয়া দিব।” ঘ্যাঁঘোঁ উত্তর করিল, “পলাইয়া আর কোথায় যাইব? যেখানে যাইব, সেইখানে গিয়া তোমরা তাঁতির গান জুড়িয়া দিবে। তাছাড়া আমীরের স্ত্রী কোথায়, অনুসন্ধান না করিয়াই আমি কি করিয়া বলি?” ব্রাহ্মণ বলিলেন, “সত্য কর যে, শীঘ্র ফিরিয়া আসিবে?” ঘ্যাঁঘোঁ বলিল, “আমি সত্য বলিতেছি, শীঘ্র ফিরিয়া আসিব।” তখন ব্রাহ্মণ বলিলেন, “আচ্ছা, তবে যাও, শীঘ্র আসিও, আমরা এখানে বসিয়া রহিলাম।” ঘ্যাঁঘোঁ বলিলেন, “রও, আমি আমার বড় নাগরা জুতা জোড়াটি পায়ে দিয়া আসি। সে জুতাটি পায়ে দিলে আমি বাতাসের উপর উত্তম চলিতে পারি। মুহূর্তের মধ্যে সমুদয় ভারতভূমি ভ্রমণ করিতে পারি।” এই বলিয়া ঘ্যাঁঘোঁ পুনরায় কূপের ভিতর যাইল, নাগরা জুতা পায়ে দিয়া বাহিরে আসিল, বাতাসের উপর উঠিয়া হনহন করিয়া অতি দ্রুতবেগে চলিতে লাগিল; শীঘ্রই অদৃশ্য হইয়া গেল। ব্রাহ্মণ, আমীর ও তাঁতি সেইখানে বসিয়া রহিলেন। ঘ্যাঁঘোঁ ফিরিয়া আসে কি না, এই কথা লইয়া আলোচনা করিতে লাগিলেন। সকলেই একদৃষ্টে আকাশপানে চাহিয়া রহিলেন। “কখন্ আসে—কখন্ আসে” এই কথা সকলেই মনে মনে করিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে আমীর বলিয়া উঠিলেন, “ওই আসিতেছে, ওই যেন উত্তরদিকে কালো দাগটির মত কি দেখা যাইতেছে।” নিকটবর্তী হইলে সকলেই বলিয়া উঠিলেন, “ঘ্যাঁঘোঁ বটে, নাগরা জুতা পরিয়া ঘ্যাঁঘোঁ আসিতেছে।” ঘ্যাঁঘোঁ নিকটে আসিলে সকলেই তাহার মহা সমাদর করিলেন। সকলেই বলিলেন, “ঘ্যাঁঘোঁ। তুমি সত্যবাদী বটে। মনোদুঃখে জ্বর-জ্বর হইয়াও তুমি আপনার সত্যরক্ষা করিয়াছ। এখন বল, সংবাদ মঙ্গল তো?” ঘ্যাঁঘোঁ বলিল, “সু-সমাচার বটে, আমীরের স্ত্রীর আমি সন্ধান পাইয়াছি।” সকলে বলিলেন, “তবে শীঘ্র বল, আমীরের স্ত্রী এক্ষণে কোথায়? সে ভাল আছে তো?”
ঘ্যাঁঘোঁ বলিল, “হিমালয়-প্রদেশে ভীমতাল নামক একটি হ্রদ আছে। হ্রদের ভিতর পাহাড়ের গায় লুল্লু একটি ঘর খুদিয়াছে। জলে ডুব দিয়া তবে সে ঘরের ভিতর যাইতে পারা যায়, অন্য পথ নাই। তাহার ভিতর লুল্লু আমীরের স্ত্রীকে লুকাইয়া রাখিয়াছে। সেই ‘সে’ বিহনে অশোকবনে সীতা যেরূপ কাঁদিয়াছিলেন, সেই ঘরের ভিতর একাকিনী বসিয়া আমীরের রমণীও সেইরূপ কাঁদিতেছে। কেন যে কাঁদিতেছেন, তা বলিতে পারি না। লুল্লু আমাদের একটি সভ্য ভব্য নব্য ভূত। সে লইয়া গিয়াছে, তার আবার কান্না কি? লুল্লু তাহাকে এক বৎসর কাল সময় দিয়াছে। এক বৎসরের মধ্যে যদি শাস্ত হইয়া তাহাকে নিকা না করে, তাহা হইলে তাহাকে মারিয়া ফেলিবে। কথা এই, মনুষ্যের সাধ্য নাই যে, হ্রদের ভিতর প্রবেশ করে, প্রবেশ করিয়া লুল্লুর ঘরের ভিতরে যায়। আমরা ভূত হইয়া ভূতের বিপক্ষতা করিতে পারি না; তাহা হইলে ভূতসমাজে আর মুখ দেখাইবার যো থাকিবে না। তবে এইমাত্র বলিয়া দিতে পারি যে, যদি তোমরা একটি হৃষ্টপুষ্ট ভূত ধরিয়া তাহার তেল বাহির করিতে পার, আর যদি সেই তেল মাখিয়া জলে প্রবেশ কর, তাহা হইলে লুল্লুর ঘরে পৌঁছিতে পারিবে। তারপর কৌশল করিয়া আমীরের স্ত্রীকে উদ্ধার করিও। তা বলিয়া যেন আমাকে ধরিয়া তেল বাহির করিও না। মনের খেদে জ্বর-জ্বর আছিই, তার উপর আবার তাঁতির গান শুনিয়া আমার শরীরে আর শরীর নাই, একবিন্দুও তেল বাহির হইবে না। তবে এক কাজ কর, এই মাঠের প্রান্তভাগে একটি গাছ আছে। সেই গাছে গোঁগোঁ নামে একটি গলায়-দড়ি ভূত বাস করে। নিকটে গ্রামের লোককে গলায় দড়ি দিয়া মরিতে সে প্রবৃত্তি দিয়া থাকে। যে কেহ তাহার প্রলোভনে পতিত হয়, সে এই গাছে আসিয়া গলায় দড়ি দিয়া মরে। শীঘ্র শীঘ্র মৃত্যু হইবে বলিয়া, এই ভূত তখন তাহাদের পা ধরিয়া ঝুলিয়া পড়ে। তোমরা যদি ভূতটিকে ধরিয়া তেল বাহির কর, তাহা হইলে আমি বড়ই সন্তোষলাভ করি। কারণ, সে দুরাচার আমার পরম শত্রু। আমার যেখানে বিবাহের সম্বন্ধ হয়, সে গিয়া ভাংচী দিয়া আসে। প্রেতিনী, শঙ্খচূর্ণী, চূড়েল প্রভৃতি নানাপ্রকার ভুতিনীদিগের সহিত আমার বিবাহের সম্বন্ধ হইয়াছিল। দুই-এক স্থানে কন্যাও দেখিতে গিয়াছিলাম, কন্যা দেখিয়া মনও মোহিত হইয়াছিল, কিন্তু এই দুরাচার গিয়া কন্যার পিতামাতার কাছে আমার নানারূপ কুৎসা করে। সে জন্য—দুঃখের কথা বলিব কি! ভূতগিরি করিতে করিতে বুড়া হইয়া যাইলাম, আজ পর্যন্ত আমার বিবাহ হয় নাই। সংসারে আমি আধখানা হইয়া আছি, পূরা ঘ্যাঁঘোঁ হইতে পারিলাম না। আর কত লোক দশটা-কুড়িটা বিবাহ করিয়া ষোল আনার চেয়ে বেশি হইয়া পড়ে। সে যাহা হউক, মনুষ্যের দ্বারা ভূত ধরা কিছু সহজ কথা নয়। সেকালের মত এখন আর রোজা নাই যে, ভূত ধরিয়া পাল্কির বেহারা করিবে, কি গাড়িতে যুতিয়া দিবে। কৌশল করিয়া ধরিও।”
“বিবাহের কথা মনে করিয়া আমার প্রাণ এখন বড়ই হু-হু করিতেছে। একটি পরম রূপবতী ভূতিনীর সঙ্গে আমার বিবাহের কথা হইয়াছিল। তাহার রূপের কথা আর বলিব কি? তাহার নাকটি দেখিয়াই আমার মন একেবারে মুগ্ধ হইয়াছিল। ও হো নাকেশ্বরি! তোমাকে না দেখিয়া প্রাণ যে আর ধরিতে পারি না! একবার তোমার ছবিখানি দেখিয়া প্রাণ শান্ত করি। আমিও দেখি, তোমরাও দেখ, দেখিয়া চক্ষু জুড়াও।
ষষ্ঠ অধ্যায়
ভূতের তেল
নাকেশ্বরীর ছবি দেখিয়া ঘ্যাঁঘোঁর প্রাণ কিঞ্চিৎ শান্ত হইল; সে একে একে সকলের করমর্দন করিয়া প্রস্থান করিল। তখন আমীর, ব্রাহ্মণ ও তাঁতিকে বলিলেন, “আপনাদিগকে আমি অনেক কষ্ট দিয়াছি। ঘর-সংসার ছাড়িয়া আপনারা আমার সঙ্গে ঘুরিতেছেন। আর আপনাদিগকে আমি ক্লেশ দিতে ইচ্ছা করি না। আপনারা বাটী ফিরিয়া যান, আমার কপালে যাহা আছে, তাহা হইবে।” কিন্তু ব্রাহ্মণ ও তাঁতি কিছুতেই আমীরকে একলা ফেলিয়া যাইতে চাহিলেন না। আমীরের অনেক অনুনয়-বিনয়ে শেষে স্বীকৃত হইয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইয়া, বিরস-বদনে দুই জনে গৃহাভিমুখে যাত্রা করিলেন। ইহারা চলিয়া গেলে ঘ্যাঁঘোঁর কূপের ধারে বসিয়া আমীর অনেকক্ষণ কাঁদিতে লাগিলেন। তারপর মনকে প্রবোধ দিয়া ভাবিলেন, “কাঁদিলে কি হইবে? এখন ভূত ধরিবার উপায় চিন্তা করি, তবে তো স্ত্রীর উদ্ধার হইবে।” অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া আমীর মাথা হইতে পাগড়ীটি খুলিলেন। পাগড়ীটি উত্তমরূপে পাকাইলেন, আর তাহার একপাশে একটি ফাঁস করিলেন। এইরূপে সুসজ্জ হইয়া, যে আমগাছে গোঁগোঁ নামক গলায়-দড়ি ভূত থাকে, সেইদিকে চলিলেন। গাছের নিকট উপস্থিত হইয়া গাছের উপর উঠিতে লাগিলেন। অনেকদূর উঠিয়া গাছের ডালে পাগড়ীর অপর পার্শ্ব বাঁধিয়া ফাঁসটি গলায় দিতে উদ্যত হইলেন। ফাঁসটি গলায় দেন আর কি, এমন সময় চাহিয়া দেখেন যে, সেই গলায়-দড়ি ভূত সহাস্যবদনে তাঁহার সম্মুখে আর একটি ডালে বসিয়া রহিয়াছে।
ভূত বলিল, “নে নে, শীঘ্র শীঘ্র গলায় ফাঁস পরিয়া ঝুলিয়া পড়, নিচে হইতে আমিও সেই সময় তোর পা ধরিয়া টানিব এখন, তা হইলে সত্বর তোর মৃত্যু হইবে, তাহা হইলে আমার বেকার নাতিজামাই তোর ভূতগিরি করিতে পাইবে।” আমীর কোনও কথা না কহিয়া আস্তে আস্তে জেব হইতে আফিমের কৌটাটি বাহির করিলেন। কৌটাটির ঢাকন ভূতের সম্মুখে ধরিলেন। ভূত তাহাতে উঁকি ঝুঁকি মারিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ওর ভিতর ও—কে?” আমীর বলিলেন, “একটি ভূত।” গোঁগোঁ বলিল, “ভূত! কৈ, ভাল করিয়া দেখি।” খুব ভাল করিয়া দেখিয়া গোঁগোর নিশ্চয় বিশ্বাস হইল যে, ভূত বটে। সে জিজ্ঞাসা করিল, “উহার ভিতর তুই ভূত ধরিয়া রাখিয়াছিস কেন।” আমীর বলিলেন, “আমি একখানি খবরের কাগজ খুলিবার বাসনা করিয়াছি; সম্পাদক ও সহকারী-সম্পাদকের প্রয়োজন। ডিবের ভিতর যে ভূতটি ধরিয়া রাখিয়াছি, তাহাকে সহকারী-সম্পাদক করিব। আর তোরে মনে করিয়াছি, সম্পাদক করিব।” গোঁগোঁ বলিল, “আমি যে লেখা-পড়া জানি না।” আমীর বলিলেন, “পাগল আর কি! লেখা-পড়া জানার আবশ্যক কি? গালি দিতে জানিস তো?” গোঁগোঁ বলিল, “ভূতদিগের মধ্যে যে-সকল গালি প্রচলিত আছে, তাহা আমি বিলক্ষণ জানি।” আমীর বলিলেন, “তবে আর কি! আবার চাই কি? এতদিন লোকে মানুষ ধরিয়া সম্পাদক করিতেছিল, কিন্তু মানুষে যা কিছু গালি জানে, মায় অশ্লীল ভাষা পর্যন্ত, সব খরচ হইয়া গিয়াছে; সব বাসি হইয়া গিয়াছে। এখন দেশশুদ্ধ লোককে ভূতের গালি দিব। আমার অনেক পয়সা হইবে।” ভূত বলিল, “তবে কি তুমি গলায় দিয়া মরিবে না? ঐ যে পাগড়ী? ঐ যে ফাঁস?” আমীর বলিলেন, “আমি তো আর ক্ষেপে নি যে, গলায় দড়ি দিয়া মরিব। পাগড়ী আর ফাঁস হইতেছে টোপ, ওরে বেটা! তোরে ধরিবার জন্য টোপ। যদি এ ফন্দি না করিতাম, তাহা হইলে তুই কি গাছের ভিতর হইতে বাহির হইতিস? এখন চল, ইহার ভিতর প্রবেশ কর।” এই বলিয়া আমীর তাহাকে চণ্ডুর নলটি দেখাইলেন। ভূত জিজ্ঞাসা করিল, “ও আবার কি?” আমীর বলিলেন, “ইহার নাম বাম্বু, নে, শীঘ্র ইহার ভিতর প্রবেশ কর।” ভূত ইতস্তত করিতেছে দেখিয়া আমীর টেকোটি বাহির করিয়া বলিলেন, “দেখিতেছিস?” ভূত জিজ্ঞাসা করিল, “ও আবার কি?” আমীর বলিলেন, “এর নাম আটখিল্লে। সাধুভাষায় ইহাকে থক্ বলে। নলের ভিতরে যদি না প্রবেশ করিস্, তাহা হইলে ইহা দিয়া তোর চক্ষু উপাড়িয়া লইব।” বাস্তবিক থক্টি তখন যেরূপ চক্চক্ করিতে লাগিল, তাহাতে বোধ হইল যেন সে আজন্মকাল ভূতের চক্ষু তুলিয়া আসিতেছে, যেন ভূতের চক্ষু না তুলিয়া থক্ কখনও জলগ্রহণ করে না। আর যেন আমীর যদি নাও উপড়ান্ তো থক্ নিজে গিয়া সেই মুহূর্তে ভূতের চক্ষু তুলিয়া ফেলিবে। টেকোর এই প্রকট মুর্তি দেখিয়া ভূত বড়ই ভয় পাইল, ভয়ে তাহার সর্বশরীর থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। মনে করিল, “কাজ নাই বাপু! পরের চাকর হইয়া, এডিটারি করিয়া না হয় খাইব, তা বলিয়া অন্ধ হইয়া থাকিতে পারিব না।” এই ভাবিয়া সে আপনার কলেবর হ্রাস করিল, আর সুড়সুড় করিয়া নলের ভিতর প্রবেশ করিল। নলের ছিদ্রে ভাল করিয়া সোলা আঁটিয়া দিয়া, আমীর গাছ হইতে নামিয়া আসিলেন।
আমীরের মনে এখন কিঞ্চিৎ স্ফূর্তির উদয় হইল। শিস দিতে দিতে তিনি গ্রামাভিমুখে চলিলেন, গ্রামে উপস্থিত হইয়া লোককে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমাদের এ গ্রামে কলুর বাড়ি আছে?” লোকে বলিল, “হাঁ আছে।” কলুর বাড়িতে উপস্থিত হইয়া আমীর কলুকে বলিলেন, “কলু ভায়া! আমার একটি বিশেষ উপকার করিতে হইবে। এই বাঁশের নলটির ভিতর আমি একটি ভূত ধরিয়া আনিয়াছি, যদি অনুগ্রহ করিয়া সেই ভূতটিকে ঘানিতে মাড়িয়া তেল বাহির করিয়া দেন, তাহা হইলে আমার বড়ই উপকার হয়।” কলু বলিল, “তার আটক কি! এখনই দিব। তিল সরিষা, তিসি, পোস্ত, কত কি পিষিয়া তেল বাহির করিলাম, আজ একটু ভূতের তেল বাহির করিয়া দিব, সে আর কি বড় কথা! কৈ, লইয়া এস।” দুই জনে ঘানিগাছের কাছে গেলেন। আমীর নল হইতে ভূতটিকে আস্তে-আস্তে বাহির করিয়া ঘানিগাছের ভিতর প্রবেশ করাইয়া দিলেন। কলু তৎক্ষণাৎ ঘানি চালাইয়া দিলেন। কলুর বলদ মৃদুমন্দ গতিতে ঘুরিতে লাগিল। ভূতের হাড় মড়মড় করিয়া ভাঙ্গিতে লাগিল। ভূত, “ত্রাহি মধুসূদন! ত্রাহি মধুসুদন!” বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিল। আর বলিতে লাগিল, “এই বুঝি তোমার এডিটারির পদ? এই বুঝি খবরের কাগজের সম্পাদকতা করা?” আমীর হাসিয়া বলিলেন, “জান না ভায়া! সম্পাদক হইতে আমি এইরূপেই প্রবন্ধ বাহির করিয়া থাকি। কেমন! উত্তম উত্তম গালি, ভাল ভাল প্রবন্ধ, এখন মনে উদয় হইতেছে তো? গোঁগোঁ ভায়া! সেকালের হরিণের গল্পটাও কি ছাই শুন নাই? যাহাতে কথা আছে, ‘ওহে ভাই শশধর! আগে এ দায়ে তো তর, তারপর কাজ কাম কর আর না কর।” ঘানি হইতে ক্রমে টপ্টপ্ করিয়া তেল পড়িতে লাগিল। প্রায় একশিশি তেল প্রস্তুত হইল। যখন ভূতের দেহ একবারে তেলশূন্য শুষ্ক হইয়া গেল, তখন বলদ থামিল, ঘানিগাছ আর ঘুরিল না। আমীর সেই ছোবড়ারূপ ভূতকে বাহির করিয়া ছাড়িয়া দিলেন। বলা বাহুল্য যে, ভূত না হইয়া যদি মানুষ হইত, তাহা হইলে কোন্কালে মরিয়া যাইত।
সপ্তম অধ্যায়
উদ্দেশ
তেলের শিশিটি পকেটে লইয়া আমীর পুনবার চলিলেন। যাইতে যাইতে কত পথ চলিয়া অবশেষে হিমালয়ের তলভাগে গিয়া উপস্থিত হইলেন। হিমালয়ের উপর উঠিয়া কত চড়াই-উতরাইয়ের পর ভীমতাল দেখিতে পাইলেন। ভীমতালের চারিদিকে ঘুরিয়া ঘ্যাঁঘোঁ যেরূপ নির্দেশ করিয়া দিয়াছিল, সেই স্থানটিতে গিয়া বসিলেন। জানিলেন, এই স্থানটিতে ডুব মারিতে হইবে ইহার নিচেতেই লল্লুর ঘর। সেই স্থানে বসিয়া, শিশিটি বাহির করিয়া উত্তমরূপে সর্বশরীরে ভূতের তেল মর্দন করিলেন। তেল মাখিয়া তাঁহার শরীরে যে কেবল আসুরিক বল হইল তাহা নহে, দেহ এত লঘু হইল, যেন তিনি পাখির মত উড়িতে পারেন। তেল মাখা হইলে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, আর ‘বিসমিল্লা’ বলিয়া জলে ঝাঁপ দিলেন। জলে ডুব মারিয়া ক্রমেই নিচে যাইতে লাগিলেন। পাতাল পর্যন্ত ততদূরে যাইতে হয় নাই, কিন্তু অনেক, অনেকদূরে গিয়া পাহাড়ের গায়ে একটি ছিদ্র দেখিতে পাইলেন। সেই ছিদ্রের ভিতর প্রবেশ করিতেই একেবারে শুষ্ক ভূমিতে পদার্পণ করিলেন। সেখানে আলোর অভাব ছিল না। উত্তম দিনের আলো ছিল। কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া বাসস্থানের মত পাহাড়ের গায়ে অনেকগুলি গর্ত দেখিতে পাইলেন, কিন্তু কি মনুষ্য, কি ভূত কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। মনে মনে ভাবিলেন, “এখনও দিন রহিয়াছে, এত প্রকাশ্যভাবে এখানে বিচরণ করা ভাল নয়। রাত্রি হইলে সকল সন্ধান লইব।” এই মনে করিয়া একটি ছোট গর্তে লুকাইয়া রহিলেন।
জলে ডুব দিয়া যে শুষ্ক ঘরের ভিতর প্রবেশ করা যায়, একথা শুনিয়া কেহ যেন অবাক হইবেন না। লোকে পাছে ভাবেন যে, আমি যাহা লিখিতেছি, তাহা অলীক গল্পকথা, সেজন্য আমাকে ঐতিহাসিক প্রমাণ দিতে হইল। আকবরের সময় একজন মিস্ত্রি লাহোরে এরূপ একটি ঘর নির্মাণ করিয়াছিল যে, নিকটস্থ একটি জলাশয়ের জলে ডুব না দিয়া সে ঘরে যাইবার আর অন্য পথ ছিল না। আগ্রাতে জাহাঙ্গীর বাদশাহও এইরূপ একটি ঘর দেখিয়াছিলেন। ওয়াকিয়াত-ই-জাহাঙ্গীরি নামক পুস্তকে জাহাঙ্গীর লিখিয়াছেন, “আমার পিতার সময় লাহোর নগরে যেরূপ একটি জলগৃহ নির্মিত হইয়াছিল, সেইরূপ একটি জলগৃহ দেখিতে রবিবার দিন হাকিম আলির বাটীতে গিয়াছিলাম। আমার সহিত কতকগুলি পারিষদও ছিল, যাহারা এরূপ গৃহ কখনও দেখে নাই। জলাশয়টি দীর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রায় ছয় গজ, ইহার পাশে একটি কামরা, যাহাতে উত্তমরূপে আলো ছিল, এবং যাহার ভিতর যাইতে হইলে এই জলের ভিতর দিয়া ভিন্ন অন্য পথ ছিল না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই কামরায় একবিন্দুও জল প্রবেশ করিতে পারে না। কামরায় দশ-বার জন লোক বসিতে পারে। ইহার ভিতর হাকিম আমাকে টাকা ও বহুমূল্য দ্রব্যাদি উপটৌকন দিলেন। কামরা দেখিয়া আমি বাটী ফিরিয়া আসিলাম। হাকিমকে পুরস্কারস্বরূপ দু’হাজারীর পদে নিযুক্ত করিলাম।” এক্ষণে ইতিহাস দ্বারা এ গল্পটি সত্য বলিয়া প্রমাণ হইল। পৃথিবীতে যে কত অদ্ভুত বিষয় আছে, তাহা শুনিলে অবাক হইতে হয়।
আমীর পাহাড়ের গর্তে লুকাইয়া রহিলেন। ক্ৰমে সন্ধ্যা হইল, যখন কতক রাত্রি গত হইয়া গেল, তখন সেই গিরিগহ্বরে সহসা তুমুল ঝড় উঠিল। কিয়ৎক্ষণ পরে জলের ভিতরও ভয়ানক শব্দ হইতে লাগিল। আমীর কান পাতিয়া শুনিলেন, কে যেন জল ফুঁড়িয়া উপরে যাইতেছে। ভাবিলেন, “রাত্রি হইয়াছে, এইবার ভূত বুঝি চরিতে যাইতেছে।” যখন পুনরায় সেস্থান নিঃশব্দ হইল, তখন আমীর আস্তে আস্তে গর্ত হইতে বাহির হইলেন। অতি সাবধানে, এ-ঘর সে-ঘর, অর্থাৎ কি না এ-গর্ত সে-গর্ত খুঁজিতে লাগিলেন। খুঁজিতে খুঁজিতে অতি দূরে একটি সামান্য আলো তাঁহার নয়ন-গোচর হইল। সেইদিক পানে গিয়া দেখিলেন, অপেক্ষাকৃত এক বৃহৎ ঘরের ভিতর একটি প্রদীপ মিট মিট করিয়া জ্বলিতেছে। সেই প্রদীপের কাছে গালে হাত দিয়া, মস্তক অবনত করিয়া, এক মলিন-বসনা বিরস-বদনা ললনা বসিয়া রহিয়াছেন। কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া আমীর চিনিতে পারিলেন যে, এই রমণী তাঁহারই স্ত্রী। স্ত্রীকে দেখিয়া তাঁহার বক্ষস্থলে যেন হাতুড়ির ঘা পড়িতে লাগিল। এমনি হৃদয়ের আবেগ উপস্থিত হইল যে, মনে করিলেন, এখনি দৌড়িয়া গিয়া ধরি, আর বলি, “প্রিয়তমে! জানি! আর ভয় নাই, আমি আসিয়াছি, আমি তোমার আমীর আসিয়াছি।” কিন্তু আপনাকে সংবরণ করিলেন, মনে করিলেন, “ভয় নাই কিসে? এখনও তো আমরা ভূতের হাতে! এখনও তো স্ত্রীকে উদ্ধার করিতে পারি নাই! স্ত্রীর দেখিতেছি, শীর্ণ দেহ, মলিন মুখ। বোধ হয়, আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়াছে। একেবারে দেখা দেওয়া হইবে না। আমি যে এখানে আসিয়াছি, ক্রমে জানিতে দিব।” এই ভাবিয়া কিছুক্ষণের নিমিত্ত আমীর একটু অন্তরালে দাঁড়াইয়া রহিলেন। আমীর-রমণী কাঁদিতেছিলেন। অবিরল ধারায় অশ্রুস্রোত তাঁহার নয়নযুগল হইতে বহিতেছিল। মাঝে মাঝে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিতেছিলেন, এক এবার চক্ষু মুছিতেছিলেন, কখনও কখনও অপরিস্ফুট ভাষায় খেদোক্তি করিতেছিলেন। বলিতেছিলেন, “হায়! আমার দশা কি হইল! শয়তানের হাতে পড়িয়া আমার জাতিকুল সকলি মজিতে বসিল। ধর্ম বিনা স্ত্রীলোকের আর পৃথিবীতে আছে কী? ভূতই হউক আর শয়তানই হউক, এ ধর্ম আমি তাহাকে কখনই বিনাশ করিতে দিব না। সে দুর্বৃত্ত অঙ্গীকার করিয়াছে, এক বৎসর কাল আমাকে কিছু বলিবে না। এই এক বৎসরের মধ্যে দুর্বলের বল, নিঃসহায়ের সহায়, ঈশ্বর কি আমায় পাপিষ্ঠের হাত হইতে মুক্ত করিবেন না? আমীর! আমীর!! একবার আসিয়া দেখ, আমার কি দশা হইয়াছে।” আমীর আস্তে আস্তে বলিলেন, “ভয় নাই, ঈশ্বর তোমার প্রতি কৃপা করিয়াছেন, আমি আসিয়াছি।” আমীর-রমণী চমকিত হইয়া মুখ তুলিলেন। চক্ষুর্দ্বয় তখন তাঁহার জলে প্লাবিত ছিল, কিছুই দেখিতে পাইলেন না। ভাবিলেন, মনের ভ্রান্তিবশতই তিনি এরূপ শব্দ শুনিলেন। তবুও মনে একটু আশার সঞ্চার হইয়াছিল। কিন্তু সহসা চক্ষু মুছিতে সাহস করিতেছিলেন না; পাছে সত্য সত্যই ভ্রান্তি হইয়া পড়ে, পাছে সে আশাকণাটুকুও উড়িয়া যায়। আমীর কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইলেন, বলিলেন, “চাহিয়া দেখ! সত্য সত্যই আমি আসিয়াছি। ভয় নাই, ঈশ্বরের কৃপায় নিশ্চয় এ ঘোর বিপদ হইতে আমরা মুক্ত হইব।” এই বলিয়া একেবারে স্ত্রীর নিকটে গিয়া তাঁহার গলা জড়াইয়া ধরিলেন, স্ত্রীও তাঁহার গলা ধরিলেন। এইভাবে বসিয়া দুই জনে অনেকক্ষণ নীরবে কাঁদিতে লাগিলেন।
তাহার পর আমীর চক্ষু মুছিয়া বলিলেন, “আর কাঁদিও না। এখন এখানকার সকল কথা আমাকে বল। প্রথম আমাকে বল, ভূত তোমাকে কি করিয়া ধরিয়া আনিল।” আমীর-রমণী বলিলেন, “তাহার আমি কিছুই জানি না। ঘরের ভিতর হইতে যেই বাহিরে আসিয়া পা দিলাম, তুমি কি ভিতর হইতে বলিলে, শুনিতে পাইলাম। তারপর যেন একটা ঝড় আসিয়া আমাকে একেবারে ভূমি হইতে উঠাইয়া লইল, একেবারে শূন্যে তুলিয়া ফেলিল, একেবারে উড়াইয়া লইয়া চলিল। আমি অজ্ঞান সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িলাম। কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম, বলিতে পারি না। যখন প্রভাত হইল, চক্ষু মেলিয়া দেখি, দিন হইয়াছে, সম্মুখে এক বিকটমূর্তি বিষমদেহ নরাকার রাক্ষস। তাহাকে দেখিয়া পুনর্বার অজ্ঞান হইয়া যাইলাম। তারপর পুনরায় যখন জ্ঞান হইল, তখন দেখিলাম, রাত্রি হইয়াছে, ঘরে আর কেহ নাই, একেলা পড়িয়া আছি। এই প্রদীপটি মিট মিট করিয়া জ্বলিতেছে, নানারূপ আহারীয় দ্রব্য ঘরে রহিয়াছে। আমি কিন্তু কিছুই খাইলাম না। মনে করিলাম, অনাহারে প্রাণত্যাগ করিব। তাহার পরদিবস প্রাতঃকালে সেই বিকটমূর্তি আবার আমার কাছে আসিল। এবার আমি তাহাকে দেখিয়া অজ্ঞান হই নাই। বড়ই ভয় হইয়াছিল সত্য, অজ্ঞান হইবার উপক্রমও হইয়াছিল সত্য, কিন্তু সাহস করিয়া বুক বাঁধিলাম। মনে করিলাম, শুনিতে হইবে সে কে, আর কেনই বা আমাকে এখানে লইয়া আসিয়াছে। সেই বিকটমূর্তি আমার নিকট আসিয়া বলিল, ‘সুন্দরি! এক্ষণে আর তুমি আমীরের রমণী নও, এক্ষণে তুমি আমার গৃহিণী। তোমার স্বামী নিজে তোমায় আমাকে দান করিয়াছে। এখন আমার সমুদয় ঘরকন্না তোমার। অনুমতি হইলেই এইক্ষণেই আমাদের কাজিকে ডাকিয়া আনি, তিনি আমার সহিত তোমার নিকা দিয়া দিবেন।’ সাহসের উপর ভর করিয়া আমি বলিলাম, ‘তুমি কে? স্বামী আমায় তোমাকে কি করিয়া দিলেন?’ সে বলিল, ‘আমি ভূত। আমার নাম লুল্লু। আমি সামান্য ভূত নই, আমি একজন সভ্য ভব্য নব্য ভূত। আর এই ধনসম্পত্তি, এই গিরিগহ্বর আমার; আমি দুখিরাম চন্ডালের ভূতগিরি করিতেছি। ভূত-সমাজে আমি অতি প্রবল-পরাক্রান্ত বলিয়া পরিচিত, আমার মান-মর্যাদা রাখিতে আর স্থান নাই।’ আমি বলিলাম, ‘স্বামী আমায় তোমাকে দিয়াছেন, একথা একেবারেই মিথ্যা। তারপর মানবী হইয়া ভূতের রমণী কবে কে হইয়াছে? দেখ, আমরা খোদাপরস্ত মুসলমান, ভূতপরস্তদিগের মত শয়তানের শাগ্রেদ নই। আমার প্রতি অত্যাচার করিলে খোদা তোমাকে দণ্ড করিবেন।’
“এইরূপ প্রতিদিন ভূতের সহিত বাদানুবাদ হয়। ভূত কিন্তু আমার গায়ে হাত দিতে সাহস করে নাই। প্রথম কয়েকদিন আমি আহার-নিদ্রা একেবারেই পরিত্যাগ করিয়াছিলাম। তারপর যখন দেখিলাম যে, আপাতত ভূত আমার প্রতি বিশেষ কোনরূপ অত্যাচার করিতে সাহস করিতেছে না, তখন আহার করিতে লাগিলাম। মনে ভাবিলাম, ভূত শাসন করিবার নিমিত্ত নানারূপ তাবিজ আছে। আমিলদিগের নিকট হইতে তাহা আনিয়া নিশ্চয় তুমি আমায় উদ্ধার করিবে। ভূত প্রতিদিন আসে আর বলে,—কেমন, আজ কাজি আনি? প্রতিদিন দেখিয়া দেখিয়া, এখন তাহাকে দেখিলে আর আমার বড় ভয় হয় না, পূর্বেকার চেয়ে মনে সাহসও অনেক হইয়াছে। নিকা করিবার কথা বলিলে, এখন তাহাকে একপ্রকার দূর দূর করিয়া দিই। একদিন কিন্তু সে ভয়ানক রাগিয়া গেল। শরীর ফুলিয়া দ্বিগুণ হইল, ভূত না হইলে হয়ত ফাটিয়া মরিয়া যাইত। সমুদয় শরীর হইতে অগ্নিকণা বাহির হইতে লাগিল। রাগে নিজের হাতটি খুলিয়া লইল, অপর হাত দিয়া ভোঁ-ভোঁ করিয়া ঘুরাইতে লাগিল। পা দুইটা খুলিয়া লইল আর সেইরূপ ঘুরাইল। দুইটি হাত, দুইটি পা ঘুরান হইলে, চক্ষু-কোটর হইতে চক্ষু দুইটি বাহির করিয়া লইল, আর যেরূপ লোকে ভাঁটা লুফিয়া থাকে, সেইরূপ দুই হাতে লুফিতে লাগিল। তারপর সমস্ত মুণ্ডটি খুলিয়া লইল, হাতে লইয়া বলিল, ‘সুন্দরি! যদি তুমি আমাকে বিবাহ না কর, তাহা হইলে তোমার সাক্ষাতে আমি এই আপনার মুণ্ডটি আপনি চিবাইয়া খাইব।’ কি করিয়া নিজের মুণ্ড নিজে খাইবে, তাহা কিন্তু আমি বুঝিতে পারিলাম না। সে যাহা হউক, আমি বলিলাম, ‘তুমি নিজের মুণ্ড নিজেই খাও, আর পরেই খাক, আমি কেন ভূতকে বিবাহ করিতে যাইব? ভাল চাও তো আমাকে ঘরে রাখিয়া এস।’ তখন সে বলিল, ‘আচ্ছা! আজ আমি তোমাকে কিছু বলিলাম না, আজ হইতে এক বৎসরকাল তোমাকে কিছু বলিব না। এক বৎসর পরে আমাকে নিকা কর ভালই, না কর তোমাকে প্রাণে মারিয়া ফেলিব। তোমার স্বামী তোমায় আমাকে দিয়াছে, আমি তোমাকে লইয়া যাহা ইচ্ছা করিব। মনে করিও না আর কখনও তোমার স্বামীকে তোমায় ফিরিয়া দিব।’ সেইদিন হইতে আর আমাকে বিরক্ত করে না। রাত্রি হইলে চরিতে যায়, সকাল হইলে বাড়ি আসে, পরে ঐ বড় গর্তটিতে শুইয়া সমস্তদিন নিদ্রা যায়। মেঘগর্জনের ন্যায় নাক ডাকার শব্দ শুনিতে পাই, আমার কাছে বড় আসে না। কেবল তিন-চার দিন অন্তর একবার আসিয়া আহারীয় সামগ্রী দিয়া যায়, আর জিজ্ঞাসা করে, ‘কেমন, এখন তোমার মন শান্ত হইয়াছে তো? কাজি আনিব কি?’ গতবার আসিয়া বলিল, ‘দেখ, এখন আমি সাবাং মাখিতে আরম্ভ করিয়াছি। রোজ সাবাং মাখি। রং অনেক ফরসা হইয়া আসিয়াছে। আর কিছুদিন পরে লোকে আমাকে আর চিনিতে পারিবে না। যেখানে যাইব, সকলে বলিবে, ‘এ লুল্লু নয়, এ সাহেব-ভূত; কোন লার্ডের ছেলে হইবে। তখন তুমি আর আমাকে বিবাহ না করিয়া থাকিতে পারিবে না। তখন তুমি বলিবে, ‘আমার লুল্লু কই? আমার লুল্লু কোথা গেল? তখন তুমি বলিবে, “আর বিলম্ব সহে না, শীঘ্ৰ কাজি ডাক, শীঘ্র আমাকে নিকা কর।’ কিন্তু তা আমি করিব না। তখন আমি নলপতঃ করিব। নিকা করিবার জন্য তুমি আমার সাধ্য-সাধনা করিবে, তা দেখিয়া আমি বড়ই সন্তোষলাভ করিব। মনে করি, এ আমাকে বড়ই ভালবাসে, আমি ইহার জীবনসর্বস্ব। সকল ভূতেই বলে যে, লুল্লু সভ্য ভব্য নব্য ভূত। আমি আর আমার গেঁটে দাদা, দুই জনেই সভ্য ভব্য নব্য। দেখিতে পাও তো, ভোর না হইলে কখনও বাড়ি আসি না। যাই, এখন সাবাং মাখিগে। এই কথা বলিয়া সে চলিয়া গিয়াছে। দু’-একদিনের মধ্যে আবার বোধ হয় আসিবে।”
আমীর জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহা কি ভূতের মেস্, না মুফলিসের বাড়ি? অর্থাৎ কিনা, এখানে অপরাপর ভূত থাকে, না লুল্লু একেলা থাকে?” আমীর-রমণী বলিলেন যে, “এখানে লুল্লু ভিন্ন আর কোন ভূতকে দেখি নাই! লুল্লু একেলা থাকে, এই আমার বিশ্বাস।” আমীর বলিলেন, “এখন সকল কথা বুঝিলাম, ঈশ্বর আমাদের প্রতি কৃপা করিবেন। কিন্তু কিরূপে যে বিপদ হইতে উদ্ধার হইব, তাহা জানি না। আপাতত আমার বড়ই ক্ষুধা পাইয়াছে। যদি কিছু খাবার থাকে তাহা হইলে আমাকে দাও।” আমীর-রমণী বলিলেন, “খাবারের এখানে কিছুমাত্র অভাব নাই। ভূত প্রচুর পরিমাণে সে সকল আনিয়া দেয়।” এই বলিয়া তিনি পোলাও, কালিয়া, কুর্মা, কোপ্তা, কাবাব, কারি আনিয়া স্বামীকে উত্তমরূপ আহার করাইলেন।
অষ্টম অধ্যায়
চণ্ডু -মাহাত্ম্য
আহারান্তে বিছানায় শুইয়া আমীর নল দ্বারা চণ্ডুধুম পান করিতে লাগিলেন, আর ভাবিতে লাগিলেন, “কি করিয়া স্ত্রীকে ভূতের হাত হইতে উদ্ধার করি।” ধূমপান করিতে করিতে স্ত্রীকে বলিলেন, “এ বিপদ হইতে উদ্ধার হইবার নিমিত্ত আমি এক উপায় স্থির করিয়াছি, তুমি কি বল? লুল্লু সভ্য ভব্য নব্য ভূত। ভূতের তেল মাখিয়া যদি আমার শরীরে ভূতের বল হইয়াছে, তথাপি তাহার সহিত বোধ হয় সম্মুখ-সংগ্রামে আমি জয়লাভ করিতে পারিব না। বিশেষত ঘ্যাঁঘোঁ আমাকে বলিয়া দিয়াছে, ‘কৌশল করিয়া স্ত্রীর উদ্ধার করিও।’ সেজন্য তুমি একটি কাজ কর। অল্প অল্প লুল্লুকে প্রশ্রয় দাও। দিনকতকাল তাহাকে চণ্ডুর ধূমপান করাও। তারপর কি হয় বুঝা যাইবে। গোকুলের বাঁকা কালাচাঁদের সহিত পরিণয় করিলে রক্ষা আছে, কিন্তু আফিম-কালাচাঁদের সহিত প্রেম করিলে আর রক্ষা নাই। চণ্ডুকে পরিণয়ে তুমি তাহাকে আবদ্ধ কর। আমার সমুদয় সরঞ্জাম তোমার নিকট রাখিয়া যাইব। দিনকতকাল কাঁচা আফিম খাইয়া না হয়, কষ্টে সৃষ্টে কাল কাটাইব।” আমীর-রমণী বলিলেন, “এ পরামর্শ মন্দ নয়।”
এইরূপ কথোপকথনে নিশা অবসান-প্ৰায় হইল। তখন আমীর-রমণী বলিলেন, “আর তুমি এখানে থাকিও না। ভূতের আসিবার সময় হইয়াছে। ভূত চরিতে গেলে, কাল আবার রাত্রিতে আসিও। চণ্ডুর আসবাব রাখিয়া যাও। দেখি কি করিতে পারি। কিছু খাবার-দাবার সঙ্গে লইয়া যাও, দিনের বেলায় খাইবে।” আমীর, স্ত্রীর নিকট বিদায় লইয়া পুনরায় সেই গর্তে গিয়া লুকাইয়া রহিলেন।
প্রাতঃকাল না হইতে হইতে ভূত বাটী ফিরিয়া আসিয়াই, প্রথমে আপনার গর্তে গিয়া শুইল। ঘোরতর নাক ডাকাইয়া অনেকক্ষণ নিদ্রা যাইল। তারপর উঠিয়া হ্রদের জলে স্নান করিতে যাইল। পাথর দিয়া, ঝামা দিয়া, বালি দিয়া, সাবাং দিয়া উত্তমরূপে গা মাজিল। শরীরের নানাস্থানে রক্ত ফাটিয়া পড়িতে লাগিল। আপনা আপনি বলিল, “ক্রমে এইবার দুধে-আলতার রং হইয়া আসিতেছে?” তারপর সাজগোজ করিয়া আমীর-রমণীর নিকট গমন করিল। বলিল, “কী সুন্দরি! দেখিতেছ? দিন দিন কি হইতেছি? দুধে-আলতার রং!” আমীর-রমণী বলিলেন, “তাই তো! তোমাকে যে আর চেনা যায় না।” ভূত বলিল, “পাথর, ঝামা, বালি, সাবাং!” আমীর-রমণী বলিলেন, “সত্য সত্যই তুমি সভ্য ভব্য নব্য ভূত।” ভূত বলিল, “তবে কাজি ডাকি?” আমীর-রমণী বলিলেন, “কাজি ডাকায় আমার কিছু আপত্তি নাই, তবে কি না জান, তুমি হইলে ভূত, আমি হইলাম মানুষ, দুই জনে মিলিবে কি করিয়া তাই ভাবিতেছি। মানুষের মত একটু-আধটু যদি তোমার ব্যবহার দেখি, তাহা হইলে বুঝি, হাঁ, দুই জনে পরিণয় হইতে পারিবে। এই দেখ, এত খাদ্যদ্রব্য তুমি আমাকে আনিয়া দাও, নিজে কিন্তু একদিনের জন্যেও একটু খুঁটিয়া মুখে দাও না। কি খাও, কি না খাও, তাহাও জানি না। সাপ খাও, কি ব্যাং খাও— কিছুই বলিতে পারি না। হয়তো কোন্দিন পচা মড়া খাইয়া আমার নিকট উপস্থিত হইবে। মুখের গন্ধে আমার প্রাণ বাহির হইবে। তারপর দেখ, মানুষে পান খায়, তামাক খায়, গ্যাঁজা খায়, আরও কত কি খায়। আহা! আমার স্বামী আমীর কেমন চণ্ডু খাইতেন! কাছে বসিয়া মনের সাধে কেমন তাঁহাকে আমি চণ্ডু খাওয়াইতাম। যখন চণ্ডুর ধূম আমার নাকে প্রবেশ করিত, তখন কেমন আমি স্বর্গসুখ লাভ করিতাম। তাঁহার চণ্ডুর আসবাবগুলি আমি আমার কাঁধের ঝুলি করিয়া রাখিয়াছিলাম। শয়নে উপবেশনে সর্বদাই আমার নিকট রাখিতাম। আহা! আজ পর্যন্ত সেই ঝুলিটি আমার কাঁধেই রহিয়াছে।” ভূত বলিল, “বটে! তা, আমিও চণ্ডু খাইব, নিয়ে এস, এখনি খাইব।” আমীর-রমণী বলিলেন, “তাহা যদি করিতে পার তো বড় ভালই হয়। ভূত-ভূতিনীদিগের কাছে তুমি সভ্য ভব্য নব্য ভূত বটে, কিন্তু আমাদের নাকে তোমাদের গায়ের একটু গন্ধ লাগে, একটু বোট্কা বোট্কা গন্ধ। রীতিমত চণ্ডুটি খাওয়া অভ্যাস করিতে পারিলে, আর তোমার গায়ে সে গন্ধ থাকিবে না, মানুষ-মানুষ গন্ধ হইবে।” ভূত বলিল, “তা দাও, খাইব।” আমীর-রমণী বলিলেন, “কাঁচা আফিম হউক, কি গুলি হউক, কি চণ্ডু হউক, অল্প অল্প করিয়া খাইতে অভ্যাস করিতে হয়। একেবারে অধিক খাইলে অসুখ করে। তোমার অসুখ করিলে প্রাণে আমি বড়ই ব্যথা পাইব। কারণ, তোমার প্রতি এখন আমার নব অনুরাগ বই তো নয়? যাহা হউক, চণ্ডু শুইয়া খাইতে হয়। মূর্খ লোকের বিশ্বাস এই যে, চণ্ডু একবার টানিলেই অচেতন হইয়া পড়ে বলিয়া, সকলে ইহা শুইয়া খায়। তাহা নহে, শুইয়া খাইতে বাগ হয় বলিয়া খায়।” এই বলিয়া আমীর-রমণী চণ্ডুর আসবাব বাহির করিয়া দিলেন। প্রদীপের নিকট ঘরের একপার্শ্বে মাটিতে শুইয়া তাহাকে ধুমপান করিতে বলিলেন। কি করিয়া খাইতে হয়, তাহাও বলিয়া দিলেন। সে অল্প অল্প ধূমপান করিলে, আমীর রমণী বলিলেন, “এখন আর নয়, চরিতে যাইবার পূর্বে পুনরায় ও-বেলা আসিয়া খাইও। কিছু কি টের পাইতেছ?” ভূত বলিল, “আর কিছু টের পাইতেছি না, কেবল গা চুলকাইতেছে, আর একটু বমিবমি করিতেছে।” আমীর-রমণী বলিল, ‘ঐটুকুই এর আয়েস, একেই নেশা বলে।” ভূত তখন চলিয়া গেল। পুনরায় সন্ধ্যাবেলা আসিয়া আর একবার চণ্ডু খাইল। রাত্রি হইলে যথানিয়মে চরিতে যাইল। তখন আমীর আসিয়া স্ত্রী র সহিত মিলিত হইলেন।
নবম অধ্যায়
উদ্ধার
ভূতের চণ্ডু খাওয়ার বিবরণ স্ত্রীর নিকট আদ্যোপান্ত শুনিয়া আমীর বড়ই আনন্দলাভ করিলেন। পূর্বেকার মত কথোপকথনে দুইজনে একত্রে রাত্রি কাটাইলেন। প্রভাত না হইতে হইতে আপনার গর্তে ফিরিয়া গেলেন। এইরূপ কিছুদিন চলিতে লাগিল। ভূত দিনে দুইবেলা আসিয়া চণ্ডু খায়। আমীর রাত্রিতে স্ত্রীর নিকট থাকেন। আমীর যখন দেখিলেন, চণ্ডু পানে ভূতের বিলক্ষণ অভ্যাস হইয়া গিয়াছে, আর ছাড়িবার যো নাই, তখন তিনি একদিন স্ত্রীকে বলিলেন, “কাল তুমি ভূতকে আর চণ্ডু দিও না; বলিও চণ্ডু ফুরাইয়া গিয়াছে, মনুষ্যালয় হইতে চণ্ডু আনিতে বলিবে।” তার পরদিন প্রাতঃকালে যখন ভূত চতু খাইতে আসিল, আমীর-রমণী তাহাকে বলিলেন, “দেখ, সঙ্গে করিয়া যাহা কিছু চণ্ডু আনিয়াছিলাম, সমস্ত ফুরাইয়া গিয়াছে, আজ তোমাকে খাইতে দিই এমন আর নাই, তুমি লোকালয় হইতে চণ্ডু লইয়া আইস।” এই কথা শুনিয়া ভূতের মন বড়ই উদাস হইয়া পড়িল। কিন্তু তখনও সে জানিতে পারে নাই, কি সর্বনাশের কথা সে শুনিল! বিরসবদনে আপনার ঘরে ফিরিয়া গেল। যত বেলা হইতে লাগিল, শরীরে ও মনে ততই ক্লেশ হইতে লাগিল। প্রথম আকর্ণ পুরিয়া হাই উঠিতে লাগিল, তারপর চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল, গা-ভাঙ্গিতে লাগিল। সর্বশরীরে ঘোর বেদনা হইল, প্রাণ আই-ঢাই করিতে লাগিল। সেদিন আর নিদ্রা হইল না। বৈকালবেলা খালি নলটি লইয়া প্রদীপের শীষের কাছে ধরিয়া একবার টানিল। কিন্তু তাহাতে কিছুমাত্র ক্লেশ দূর হইল না। একাস্তমনে সন্ধ্যার প্রতীক্ষা করিয়া রহিল, কখন সন্ধ্যা হইবে যে, লোকালয়ে যাইয়া চণ্ডু আনিয়া প্রাণরক্ষা করিবে। সেদিন যেই সন্ধ্যা হইল, অমনি ভূত ঘর হইতে বাহির হইল। ভীমতালের জল ভেদ করিয়া উপরে উঠিল। উপরে গিয়া আর সব চিন্তা ছাড়িয়া, কেবল চণ্ডুর অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইল। এ-গ্রাম সে-গ্রাম, এ-নগর সে-নগর, এ-দেশ সে-দেশ, সমস্ত ভারতভূমি ঘুরিল, চণ্ডু কোথাও পাইল না। আবকারির এমনই কড়া নিয়ম যে, সন্ধ্যা না হইতেই সকল দোকান বন্ধ হইয়া যায়। এদিকে চণ্ডু বিনা প্রাণ বাহির হয়। উদরেরও বিলক্ষণ গোলযোগ উপস্থিত হইল। শরীর আর বয় না, আর উড়িতে বা চলিতে পারে না। তখন ভাবিল, “বৃথা আর ঘুরিয়া কি হইবে? মরি তো ঘরে গিয়া মরি, প্রিয়তমার মুখ দেখিতে দেখিতে মরিব! তাহাকে বলিব, ‘দেখ, তোমার প্রেমের ভিখারী হইয়া আমি প্রাণ বিসর্জ্জন করিলাম।’ হয়তো আমাকে বাঁচাইবার জন্য ইহার একটা উপায়ও করিতে পারে। অতিশয় ম্রিয়মাণ হইয়া, ঘোরতর যাতনায় ব্যথিত হইয়া, ভূত সেদিন সকাল সকাল বাটী ফিরিয়া আসিল। আমীর জানিতেন, কি ঘটনা ঘটিবে, তাই তিনিও সেদিন স্ত্রীর নিকট হইতে সকাল সকাল বিদায় লইয়া আপনার ঘরে গিয়াছিলেন। ভূত কিন্তু আপনার ঘরে আসিয়াই সেইখানে শুইয়া পড়িল। শরীর এতই বিকল হইয়াছিল যে, সেখান হইতে নড়িতে আর তাহার প্রবৃত্তি হইল না। সেইখানে পড়িয়া ক্রমাগত উঃ আঃ করিতে লাগিল। ক্রমে সমস্ত শরীর হিমাঙ্গ হইয়া গেল। সমুদয় গ্রন্থি শিথিল হইতে লাগিল, লিগেমেন্ট সমস্ত আলগা হইল, শরীরের জয়েন সব একেবারে খুলিয়া গেল, হাড়ের সন্ধি সমুদয় একে একে খসিয়া গেল, যাবতীয় অস্থি পৃথক্ পৃথক্ হইয়া পড়িল। উত্থানশক্তি-রহিত। ঘোর বেদনায়, ঘোর যাতনায় লুল্লু পড়িয়া রহিল। প্রভাত হইলে, হাসিতে হাসিতে হাত ধরাধরি করিয়া, আমীর ও আমীর-রমণী আসিয়া সেইখানে উপস্থিত হইলেন। আমীর বলিলেন, “কি হে বাপু! সভ্য ভব্য নব্য ভূত! পুরাতন কথাটা কি কখনও শুন নাই?” ‘থোড়া থোড়া কর্কে খাও-মুঝে, ময় লগুঁ কড়ুয়া। আর জরু বেচো, গরু বেচো, মুঝকো লাও ভেড়ুয়া।’
ইহার অর্থ এই, আফিম বলিতেছেন, ‘অল্প অল্প করিয়া আমাকে প্রথম খাও; কেন না, আমি তিত লাগি। এখন ভেড়ুয়া। স্ত্রী বিক্রয় কর, কি গরু বিক্রয় কর, বিক্রয় করিয়া যেখান হইতে পাও আমাকে লইয়া আইস।’ ভূত চিঁচিঁ করিয়া বলিল, ‘এ বিপদের সময় মুখনাড়া দিচ্ছিস তুই আবার কে?” আমীর বলিলেন, “আমি আমীর, এই রমণীর স্বামী, যাহাকে তুই নিদারুণ ক্লেশ দিয়াছিস; তাই আজ তোর যাতনা দেখিয়া বড়ই প্রীতিলাভ করিতেছি।’ ভূত বলিল, ‘তোমার জরু তুমি ফিরিয়া লও, অমন জরুতে আমার কাজ নাই। বাবা! ও তো জরু নয়! সুখে-স্বচ্ছন্দে ভূতগিরি করিতেছিলাম, এ কি বাপু! ভূতের আবার চণ্ডু খাওয়া কি? ওই তো আমাকে মজাইল। এখন তোমার কাছে যদি আফিম কি চণ্ডু থাকে তো দিয়া আমার প্রাণরক্ষা কর। ধড়ে প্রাণ আসিলে তোমার স্ত্রীকে এবং তোমাকে ঘরে লইয়া যাইব। কেবল ঘরে রাখিয়া আসিব না, এখন দেখিতেছি আমাকে চিরকাল তোমার গোলামি করিতে হইবে। চণ্ডু না পাইলে তো আর বাঁচিব না; সুতরাং চণ্ডুর জন্য তোমার গোলামি করতে হইবে। দুইবেলা চণ্ডু দিও, যা বলিবে তাহা করিব, তোমার সংসারে ভূতের মত খাটিব।’ আফিমের মহিমা আমীর ভালরূপেই জানিতেন। তিনি বুঝিলেন, লুল্লু যাহা বলিতেছে, তাহা প্রকৃত কথা। প্রতারণা ইহাতে কিছুই নাই। পকেট হইতে বাহির করিয়া প্রথমে তাহাকে একটু কাঁচা আফিম খাইতে দিলেন। ইহাতে ভূতের শরীর কিঞ্চিৎ সুস্থ হইল; শরীরের অস্থি-সমুদয় পুনরায় যে যাহার স্থানে গিয়া যোড়া লাগিল। তখন সে উঠিয়া বসিল। তারপর আমীর তাহাকে চণ্ডুপান করিতে দিলেন। তাহাতে তাহার দেহে পুনরায় প্রাণ-সঞ্চার হইল, শরীর স্বচ্ছন্দতা লাভ করিল। লুল্লু তখন আমীরের পদতলে পড়িয়া বলিল, “মহাশয়! আপনার নিকট আমি ঘোর অপরাধে অপরাধী, বড়ই দোষ করিয়াছি, কৃপা করিয়া আমার অপরাধ মার্জনা করুন। বড়ই নিদারুণ ক্লেশ হইতে আপনি আপনাকে মুক্ত করিলেন। আপনার ঋণ কখনই পরিশোধ করিতে পারি না। চিরকাল দাসানুদাস হইয়া আপনার এবং এই বিবিজীর সেবা করিব। এখন সকাল সকাল আহারাদি করিয়া লউন। আজই রাত্রিতে আপনাদিগকে ঘরে লইয়া যাইব।” আমীর ও আমীরের রমণী তখন সেখান হইতে চলিয়া আসিলেন।
সন্ধ্যার পর ভূত আসিয়া দ্বারে উপস্থিত হইল। দুই জনে লুল্লুর পিঠে বসিলেন। জল হইতে বাহির হইয়া লুল্লু আকাশপথে উঠিল। তড়িত বেগে আকাশপথে চলিতে লাগিল। প্রায় রাত্রি দুই প্রহরের সময় সকলে দিল্লী নগরে আসিয়া পৌঁছিলেন। আমীরের ছাদে গিয়া ভূত ইহাদিগকে নামাইয়া দিল। আমীর ফকির-বেশে গৃহত্যাগ করিবার সময় ঘরে চাবি দিয়া গিয়াছিলেন। চাবি খুলিয়া স্ত্রী-পুরুষে ঘরে প্রবেশ করিলেন। লুল্লুর জন্য একটি ঘর নির্দেশ করিয়া বলিলেন, “লুল্লু! এই ঘরটি তোমার, তুমি এই ঘরে থাকিবে। আফিম কি চণ্ডু যাহা চাহিবে, তাহাই তোমাকে দিব।” লুল্লু বলিল, “হাঁ, এ জনমে আপনাদিগকে ছাড়িয়া কোথাও যাইব না। ছাড়িবার যোও নাই।” পরদিন প্রাতঃকালে আমীর প্রতিবাসীদিগকে ডাকিয়া আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা তাঁহাদিগকে শুনাইলেন। আমীর বাটী ফিরিয়া আসিয়াছেন দেখিয়া সকলে সুখী হইলেন।
দশম অধ্যায়
লুচি
যে যাহার ঘরে ফিরিয়া যাইলে, লুল্লু ও আমীর দুইজনে একসঙ্গে শুইয়া মনের সুখে অনেকক্ষণ ধরিয়া চণ্ডুপান করিলেন। এইরূপে ভূতে-মানুষে ক্ৰমে বড়ই ভাব হইল। একদিন চণ্ডু খাইতে খাইতে আমীর বলিলেন, “হে লুল্লু! হে চণ্ডুসেবক-কুল-তিলক! আমার বড় সাধ হইতেছে যে, পুনরায় বন্ধুদিগের সহিত একবার সাক্ষাৎ করি, যাঁহারা স্ত্রী-উদ্ধার বিষয়ে আমার বিশেষ সহায়তা করিয়াছিলেন। তখন তুমি আমার শত্রু ছিলে, এখন কিরূপ প্রাণের মিত্র হইয়াছ, তাহাও তাঁহারা একবার আসিয়া দেখুন। প্রথম হইতেছেন সেই জান, যিনি বলিয়া দিয়াছিলেন যে, তুমি আমার স্ত্রীকে লইয়া গিয়াছ। তারপর সেই ব্রাহ্মণ যাঁহার মত রোজা এ ধরাধামে কখনও হয় নাই, হবে না। তারপর আমাদের তাঁতিভায়া, যাঁর মত সঙ্গীত বিদ্যাবিশারদ পৃথিবীতে হয় নাই, হবে না। তারপর সেই কলুর পো, যাঁর মত তৈলনিপীড়ক জগতে হয় নাই, হবে না। আর যদি ভূতদিগকে আনিতে পার, তাহা হইলে তো বড়ই সন্তুষ্ট হই। সেই ভূততত্ত্ববিৎ মহাপণ্ডিত ব্রাহ্মণের ভূত, সেই অমানুষিক অভৌতিক প্রেমিক ঘ্যাঁঘোঁ, আর সেই ভাবি সম্পাদক তৈলপ্রদায়ক গোঁগাঁ! তোমার গেঁটে দাদার সহিত আলাপ পরিচয় করিতেও আমার বড়ই ইচ্ছা। আর একটি কথা—আহ! ঘ্যাঁঘোঁর বিবাহ হয় নাই, তাহার সেই নাকেশ্বরীকে আনিয়া যদি দুইজনে মিলন করিয়া দিতে পার, তাহা হইলে বড়ই সন্তুষ্ট হই।” লুল্লু বলিল, “আপনার সমুদয় আদেশ পালন করিতে আমি সমর্থ। আমি এই রাত্রিতেই সকলকে এখানে আনিতেছি।” সন্ধ্যার সময় ভূত ঘর হইতে বাহির হইল। রাত্রি একপ্রহরের মধ্যে জান, ব্রাহ্মণ, তাঁতি ও কলুকে লইয়া ফিরিয়া আসিল। আমীর সকলকে যথাবিধি অভ্যর্থনা করিলেন। তিনি আপনার বিবিকে পাইয়াছেন শুনিয়া সকলে পরম সুখী হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে লুল্লু পুনর্বার আকাশ-পথে যাত্রা করিয়া ব্রাহ্মণের ভূত, ঘ্যাঁঘো, গৌঁগাঁ ও সভ্য ভব্য নব্য গেঁটে দাদাকে লইয়া আসিল। ঘ্যাঁঘোঁর মনোহর নাক-ধারিণী বিশ্ববিমোহিনী সেই ভূতিনীকেও আনিয়া দিল। ভূতিনী অন্তঃপুরে আমীর-পত্নীর নিকট গমন করিলেন। পুরুষ-মানুষ ও পুরুষ-ভূত সকলে বহিবাটীতে উপবেশন করিলেন। পরস্পরে আলাপ-পরিচয় হইলে, আমীর অনুনয়-বিনয় করিয়া সকলকে বলিলেন, “মহোদয়গণ! আজ রাত্রিতে আমার এ গরীবখানাতে পদার্পণ করিয়া আপনারা বড়ই অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়াছেন। এক্ষণে আমার মনে একটি বাসনা বড়ই প্রবল হইয়াছে, আপনারা তাহা করেন। বড় ইচ্ছা, নাকেশ্বরীর সহিত ঘ্যাঁঘোঁর বিবাহকার্য আজ রাত্রিতেই সমাধা করি। গোঁগাঁ যে ঘ্যাঁঘোঁর নামে মিথ্যা কুৎসা করিয়াছিল, তাহা আমার পত্নী, নাকেশ্বরীর মাসীকে উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিয়াছেন। গোঁগাও একথা এখন স্বীকার করিতেছে। নাকেশ্বরীর মাসী বিবাহে সম্মতিদান করিয়াছেন, এখন আপনাদিগের কি মত?” সকলেই একবাক্য হইয়া বলিলেন, “তথাস্তু, শুভকার্যে বিলম্বে প্রয়োজন নাই।” তখন আমীর, লুল্লু প্রভৃতি ভূতদিগকে পৃথিবীর সমস্ত ভূত নিমন্ত্রণ করিয়া আনিতে বলিলেন। কিন্তু উপস্থিত ভূতগণ সকলেই মৌন হইয়া রহিল। আমীরের আদেশপালনে কেহই তৎপর হইল না। আমীর জিজ্ঞাসা করিলেন “আমি কি তোমাদিগকে কোন দুঃসাধ্য কার্য করিতে অনুরোধ করিয়াছি? পৃথিবীর সমস্ত ভূত নিমন্ত্রণ করা কি তোমাদের অভিপ্রেত নয়?” লুল্লু উত্তর করিল, “মহাশয়! আপনি যেরূপ সদাশয় লোক, তাহাতে আপনার সমস্ত আদেশই আমাদের শিরোধার্য। তবে কি না, আমরা ভারতীয় ভূত, ভারতের বাহিরে আমরা যাইতে পারি না। সমুদ্রের অপর পারে পদক্ষেপ করিলে আমরা জাতিকুল-ভ্রষ্ট হইব। আমাদের ধর্ম কিঞ্চিৎ কাঁচা। যেরূপ অপক্ব মৃত্তিকাভাণ্ড জলস্পর্শে গলিয়া যায়, সেইরূপ সমুদ্র-পারের বায়ু লাগিলেই আমাদের ধর্ম ফুস্ করিয়া গলিয়া যায়, তাহার আর চিহ্নমাত্র থাকে না, ধর্মের গন্ধটি পর্যন্ত আমাদের গায়ে লাগিয়া থাকে না। কেবল তাহা নহে, পরে আমাদের বাতাস যাঁহার গায়ে লাগিবে, দেবতা হউন কি ভূত হউন, নর হউন, কি বানর হউন, তিনিও জাতিভ্রষ্ট হইবেন। যার পক্ষে যেরূপ ব্যবস্থা,—দিবারাত্রি তাঁহাদিগকে পঞ্চামৃত খাইতে হইবে, কিংবা কল্মা পড়িতে হইবে, তবে তাঁহাদের ধর্ম টায়টোয়ে বজায় থাকিবে। আপনাকে সকল কথা খুলিয়া বলিলাম, এখন যেরূপ অনুমতি হয়।” আমীর বলিলেন, “তবে আর তত আড়ম্বরের আবশ্যক নাই। ভারতীয় ভূত-সমাজকেই কেবল নিমন্ত্রণ কর।”
নানাবিধ চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় পান-ভোজনের সামগ্রীরও আয়োজন হইল। মুহূর্তের মধ্যে ভূতেরা অনেক লুচি, অনেক সন্দেশ, অনেক দধি জমা করিয়া ফেলিল। নগরবাসী অনেক লোককে আমীর সেই রাত্রিতে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিলেন। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ সমাগত হইলে, আহারীয় দ্রব্যসামগ্রী সমুদয় আয়োজন হইলে, মহাসমারোহে নাকেশ্বরীর সহিত ঘ্যাঁঘোঁর বিবাহকার্য সমাধা হইল। আমীর নিজে কন্যাদান করিলেন, ব্রাহ্মণ পুরোহিত হইলেন। বিবাহের মন্ত্র তিনি জানিতেন না সত্য, কিন্তু একটি দীর্ঘ ফোঁটা কাটিয়া ওঁ-আং করিয়া কোন রকমে সে রাত্রির কার্য সারিলেন। পূর্ণযৌবনী ভূতকামিনী ঘ্যাঁঘোঁপত্নীর রূপমাধুরী দেখিয়া সকলেরই মন বিমোহিত হইল। একমনে অনিমেষনয়নে সকলে সেই রূপ দেখিতে লাগিলেন। যিনি যত দেখেন, দেখিয়া পিপাসা হৃদয়ে তাঁহার ততই প্রজ্বলিত হইল। বরকে সকলে বলিলেন, “ঘ্যাঁঘোঁ! তুমি অতি ভাগ্যবান্ পুরুষ যে, এরূপ অমূল্য কন্যারত্নকে লাভ করিলে।” ঘ্যাঁঘোঁ চক্ষু ঠারিয়া ঈষৎ হাসিলেন। বর কি না? অধিক কথা তো আর কহিতে পারেন না? তবে সেই ঠার, সেই হাসির অর্থ এই—“আমি পূর্বেই না বলিয়াছিলাম, ও রূপ দেখিয়া কার প্রাণ সুস্থির থাকিতে পারে? নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণের আহারাদি-ক্রিয়াও উত্তমরূপে সমাধা হইল। যিনি যত পারিলেন, লুচি ও সন্দেশ তুলিলেন, ও পুঁটলি বাঁধিয়া ঘরে লইয়া গেলেন। সভাস্থলেই বাসর-ঘর হইল। বাসর-ঘরে গান গাইবার নিমিত্ত সকলে একবাক্য হইয়া তাঁতিকে অনুরোধ করিলেন। পুলকে পুলকিত হইয়া, সহস্র সহস্র শ্রোতার সম্মুখে তাঁতি সেই রাত্রিতে মনের সুখে গান করিলেন। শ্রোতারা একদৃষ্টে তাঁহার মুখভঙ্গিমা দেখিয়াই আনন্দলাভ করিতে লাগিলেন। গানের কণামাত্র কাহারও কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল না। আমীরের অনুরোধে দিল্লীর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সে রাত্রিতে সাবধান হইয়াছিলেন। তূলা দিয়া সকলেই কান একেবারে বন্ধ করিয়াছিলেন। সে রাত্রিতে নৃত্যেরও অভাব হয় নাই, ভূত-ভূতিনীরা দলে দলে কতই যে নাচিল, তা আর কি বলিব। প্রভাত হইবার কিঞ্চিৎ পূর্বে মজলিস ভাঙিল। তখন লুল্লু—জান্, ব্রাহ্মণ, তাঁতি ও কলুকে ঘরে রাখিয়া আসিলেন। নগরবাসীরা যে যাহার ঘরে চলিয়া গেলেন।
একাদশ অধ্যায়
লেখকদল সাবধান
ভূত ও ভূতিনীসকল বিদায় হইবার পূর্বে আমীরকে তাহারা বলিল, “মহাশয়! আপনার সদাচারে আমরা বড়ই প্রীতিলাভ করিয়াছি। যদি কোন বিষয়ে আপনার উপকার করিতে পারি তো বলুন, আমরা বড়ই সুখী হইব।” আমীর বলিলেন, “আমার উপকার করিতে যদি নিতান্তই ইচ্ছা হইয়া থাকে, তাহা হইলে তোমাদের বাসনা আমি পূর্ণ করিব। এখান হইতে চারি ক্রোশ দূরে যমুনার কুলে আমার অনেক ভূমি ছিল; তাহার আয় হইতে পুরুষ-পুরুষানুক্রমে আমাদিগের রাজার হালে চলিত। সেই ভূমি এক্ষণে যমুনার জলপ্লাবনে একেবারে বালুকাময় হইয়া গিয়াছে। তাহা হইতে তোমরা যদি বালুকা সব তুলিয়া ফেলিতে পার, তাহা হইলে আমার বিশেষ উপকার হয়।” ভূতেরা বলিল, “যে আজ্ঞে, আমরা এই ক্ষণেই করিতেছি।” এই বলিয়া যত ভূত সেই মুহূর্তে ভূমির নিকট যাইল এবং অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই সমুদয় বালি উঠাইয়া ফেলিল। ভূমি পূর্বের মত উর্বর ও ফলশালী হইল। তখন আমীরের বাটীতে প্রত্যাগমন করিয়া বিদায় লইয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিল। আমীর কিন্তু গোঁগাঁকে যাইতে নিষেধ করিলেন। তাহাকে বলিলেন, “গোঁগাঁ! তুমি যাইও না। তোমার অস্থি-মজ্জা সমুদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গিয়াছে, তোমার শরীর একেবারে ভাঙিয়া গিয়াছে। আফিম আর দুধ, এই দুই বস্তু নিয়মিতরূপে ব্যবহার করিলে তোমার শরীর পুনর্গঠিত হইতে পারে। যে হেতু আফিম অতি অপূর্ব পদার্থ, ইহা সেবন করিলে মানুষ যে বয়সে খায়, সেই বয়সেই চিরকাল থাকে, শরীরের কোষ সমুদয় ধ্বংস হয় না, ম্যালেরিয়া বিষজনিত জ্বর ইহার নিকটে আসে না। কি মনুষ্যের, কি ভূতের, ইহা সেবন করিলে পরমায়ু বৃদ্ধি হয়। অতএব তুমি লুল্লুর নিকট অবস্থিতি কর। চণ্ডু পান করিতে অভ্যাস কর।” গোঁগাঁ তাহাই স্বীকার করিল। এইরূপে আমীর স্ত্রীকে লইয়া সুখে স্বচ্ছন্দে ঘরকন্না করিতে লাগিলেন।
অল্পদিনের মধ্যেই লুল্লু গণ্য-মান্য সকলের নিকট প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিলেন। একটু-আধটু যাঁহারা নেশা করিতেন, সকলেই তাঁহার প্রেমে মুগ্ধ হইলেন। স্ত্রীলোকে দেখিলে তিনি ‘মা’ বলিয়া ভিন্ন কথা কহিতেন না। চণ্ডুর মোহিনী শক্তি প্রভাবে তাঁহার বিকৃতি আকার ক্রমে সুকৃতি হইয়া উঠিল; নব্য না হউন, সত্য সত্যই তিনি একজন সভ্য-ভব্য ভূত হইলেন। চণ্ডুর সহিত দুধ-ঘি খাইয়া তাঁহার রং যথার্থই ফরসা হইয়া উঠিল। তবে তাঁহার দোষ এই, নেশাখোর ভিন্ন অপরের সহিত তিনি বাক্যালাপ করিতেন না। যাহা হউক, এত পোষ মানিয়াছিলেন যে, আমীর-রমণী তাঁহাকে দেখিয়া আর কিছুমাত্র লজ্জা বা ভয় করিতেন না। আমীরের অবস্থা ভাল হইলেও, লুল্লু তাঁহাকে গাড়ি করিতে দেন নাই। তাঁহার যেখানে যাইবার আবশ্যক হইত, তিনি পিঠে লইয়া যাইতেন। তাহার পিঠে চড়িয়া আমীর-রমণী কতবার বাপের বাড়ি গিয়াছিলেন। লুল্লুকে সর্বদা এখানে-সেখানেই যাইতে হইত বলিয়া তিনি স্বর্ণকারের দ্বারা দুইখানি পাখা গড়াইয়া লইয়াছিলেন। কোথাও যাইতে হইলে ঐ দুইখানি পাখা পরিয়া উড়িয়া যাইতেন, তাহাতে তাহাকে দেখাইত ভাল, আর তাহা পরিয়া অনেকদূর যাইলেও শ্রম হইত না। একবার সমুদ্র দেখিতে আমীর-রমণীর বড়ই সাধ হইয়াছিল। লুল্লু এ কথা শুনিয়া বলিলেন, “তার ভাবনা কি? আমার পিঠে চড়। আমার মাথাটি ভাল করিয়া ধর, আমি সমুদ্র দেখাইয়া আনিতেছি।” এই প্রকারে তিনি আমীর-রমণীকে সমুদ্র দেখাইয়া আনিলেন।
কিছুদিন পরে গোঁগাঁর শরীর পুনরায় সবল হইলে, আমীর তাহাকে বলিলেন, ‘গোঁগাঁ! আমি তোমার কাছে যাহা স্বীকার করিয়াছি, তাহা করিব। একখানি খবরের কাগজ খুলিব, তাহার সম্পাদক হইবে তুমি।” যথাসময়ে আমীর একখানি সংবাদপত্র বাহির করিলেন। একে ভূত সম্পাদক, তাতে আবার চণ্ডখোর ভূত,—গুলির চৌদ্দপুরুষ। সে সংবাদপত্রের সুখ্যাতি রাখিতে পৃথিবীতে আর স্থান রহিল না। সংবাদপত্রখানি উত্তমরূপে চলিতে লাগিল, তাহা হইতেও আমীরের বিলক্ষণ দুই পয়সা লাভ হইল।
গোঁগাঁ যে কেবল আপনার সংবাদপত্রটি লিখিয়া নিশ্চিন্ত থাকেন, তাহা নহে। সকল সংবাদপত্র আফিসেই তাঁর অদৃশ্যভাবে গতায়াত আছে। অন্যান্য কাগজের লেখকেরা যখন প্রবন্ধ লিখিতে বসেন, তখন ইচ্ছা হইলে কখনও কখনও গোঁগাঁ তাঁহাদিগের ঘাড়ে চাপেন। ভূতগ্রস্ত হইয়া লেখকেরা কত কি যে লিখিয়া ফেলেন, তাহার কথা আর কি বলিব। তাই বলি, লেখকদল! সাবধান!