লুমবিনির ওঁরা কী বলেছিলেন?
রাজ্য সরকার লুমবিনি পারকের উন্মাদ নিকেতনের প্রশাসনিক ভার সম্প্রতি গ্রহণ করেছেন। এই সম্পর্কে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী খবরের কাগজকে জানান, এই উন্মাদ নিকেতনে প্রশাসন বলে কিছু ছিল না। এ অবস্থায় প্রশাসন ভার হাতে নেওয়া ছাড়া সরকারের কাছে অন্য কোনও দরজা খোলা ছিল না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী এত দ্রুত লুমবিনির উন্মাদ নিকেতন হাতে নিয়ে ফেলবেন, এটা সত্যিই কেউ আশা করেনি। এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ সরকার উন্মাদ নিকেতন রাষ্ট্রায়ত্ত করে ফেললেন।
এখন নানা মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সরকার এত দ্রুত লুমবিনি হাতে নিতে গেলেন কেন? এই ব্যাপারে শত্রু মিত্র নানা মহলে নানা কথা ছড়িয়ে পড়েছে। নানা গুজব রটনা করা হচ্ছে।
কিন্তু গুজবে কান দেবেন না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজের খেয়াল চরিতার্থ করার জন্য একাজ যে করেন নি, তার যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। এমনকি আমরা এও জানতে পেরেছি, লুম্বিনির প্রশাসন হাতে নেওয়া ছাড়া সরকারের সামনে যে আর কোনও দরজা খোলা নেই, স্বাস্থ্যমন্ত্রী তা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জানতে পারেন নি। তিনি লুমবিনির ব্যাপারে, সরকার সচরাচর যা করে থাকেন তাই করেছিলেন, অর্থাৎ লুমবিনির ব্যাপারে তদন্ত করে রিপোর্ট দেবার জন্য একটা এক সদস্য বিশিষ্ট কমিশন গঠন করেছিলেন, স্বাস্থ্য দফতরের এক দায়িত্বশীল ডেপুটি ডিরেকটারকে সেই কমিশনের একমেবাদ্বিতীয়ম্ সদস্যও নিযুক্ত করেছিলেন।
লুমবিনি তদন্ত কমিশনের সদস্য মহোদয় পশ্চিমবঙ্গ তদন্ত কমিশন আইনের বিধি মোতাবেক অত্যন্ত পরিশ্রম সহকারে লুমবিনি উন্মাদ নিকেতনের আবাসিকদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। অতঃপর রিপোরট প্রস্তুত করে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিবেচনার জন্য তাঁর কাছে সেই রিপোর্ট পেশ করার জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু লুমবিনি তদন্ত কমিশনের সদস্য মহোদয়ের হিতাকাঙ্ক্ষীরা উক্ত রিপোর্ট থোযথভাবে পেশ করতে নিষেধ করেন। কারণ তাঁদের মতে (১) লুমবিনি তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট অবিকৃতভাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে পেশ করলে যথেষ্ট ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে, (২) মন্ত্রিমণ্ডলী ওই রিপোর্ট ভালো চোখে নাও দেখতে পারেন, এবং (৩) সদস্য মহোদয়ের কেরিয়ারের বারটা বেজে যেতে পারে।
এই কথা শোনার পর এবং হিতৈষীদের উপদেশের সারবত্তা উপলব্ধির পর কমিশনের সদস্য মহোদয় তাঁদের পরামর্শ গ্রহণই শ্রেয় বলে মেনে নেন এবং এক সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট ঙ্গে করেন। মাত্র চার লাইনের ওই রিপোর্টে বলা হয় ‘আমি লুমবিনি উন্মাদ নিকেতনের আবাসিদের সঙ্গে কথা বলেছি। রোগীরা আমাকে বলেছে, তাঁরা সব ভালই আছেন। সুতরাং ভাবনার কছু নেই।’
বিশ্বের এই সংক্ষিপ্ততম রিপোর্টটি পড়েই মন্ত্রী মহোদয় বুঝতে পারেন তাঁকে কি! লুকোনো হচ্ছে। তিনি তৎক্ষণাৎ কমিশনের সদস্য মহোদয়কে তলব করেন। মন্ত্রীর হুমকিতে ভয় পেয়ে কমিশনের সদস্য মহোদয় বাধ্য হয়ে বিভিন্ন সাক্ষীর টেপ রেকর্ড করা বক্তব্য তাঁরে শোনান। প্রকাশ তারপরই স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর কাল বিলম্ব না করে লুম্বিনির ভার নিয়ে নেন।
ঐ সব টেপ রেকর্ডের কিছু অংশ এখানে দেওয়া গেল :
কমিশন : নমস্কার। আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে এলাম।
লুমবিনির আবাসিক : মহাশয়ের উদ্দেশ্য?
কমিশন : আপনাদের সম্পর্কে একটা রিপোরট তৈরি করব।
লুঃ আঃ : আপনি রিপোর্টার?
কমিশন : তা এক হিসেবে বলতে পারেন।
লুঃ আঃ : বটে। তাহলে বসুন। চীফকে খবর দিই। আজকাল ব্যক্তিগতভাবে আমরা আর রিপোরটারকে কিছু বলতে পারি নে। চীফের নিষেধ আছে। আমাদের যা কথা চীফই বেশ গুছিয়ে বলে দেবেন। ক্যামেরা এনেছেন?
কমিশন : ক্যামেরা। কেন?
লুঃ আঃ : তাহলে একটা দারুণ জিনিস পেয়ে যেতেন। চীফের প্রতি আমাদের আনুগত্য আছে বলে আমরা কাগজে সই করে দিয়েছি।
কমিশন : কেন, আপনাদের চীফের প্রতি আপনাদের আনুগত্য কি ছিল না, নাকি?
লুঃ আঃ : থাকবে না কেন? তবু চীফ বললেন কাগজে সই কর। ব্যাপারটা তাহলে পাকা হবে। হিন্দু মতে বিয়ে তো হয়েইছে। তবু রেজিষ্টারি কর। হোঁক্ হোঁক্ হোঁক্। ঐ স্বাক্ষর-মালার একটা ফটো-নকল কাগজে ছাপতে পারতেন। ওই যে চীফ আসছে। (গলা নামিয়ে) চীফ, বি কেয়ারফুল, এ শালা রিপোরটার।
কমিশন : নমস্কার চীফ। আপনাদের খবরাখবর নিতে এলাম।
চীফ : আমাদের খবর সব ভাল। সব ভালই আছি। সুতরাং ভাবনার কোনও কারণ নেই আমরা এক সুখী পরিবার।
কমিশন : আপনাদের এখানে কোনও বিষয়ে কোনও অসুবিধা?
চীফ : কোন বিষয়ে অসুবিধা?
কমিশন : এই ধরুন খাদ্য।
চীফ : খাদ্য। খাদ্যের অবস্থা দারুণ ভাল। কি হে, বল না।
লুমবিনি আবাসিক (ফিস ফিস করে) : কোনটা বলব চীফ? প্রকৃত অবস্থা না কেবিনেট সিদ্ধান্ত?
চীফ (তদ্রূপ) : সব সময় কেবিনেট সিদ্ধান্তই বলব।
লুঃ আঃ : আমাদের এখানে খাদ্যের অবস্থা সন্তোষজনক। আই মিন খুবই ভালো। উৎপাদন সংগ্রহ এবং বণ্টন ব্যবস্থায় এতই উন্নতি হয়েছে যে মাল এসে পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে তবু কেউ খালাস করতে যাচ্ছে না। আমরা এখন সারপ্লাস।
কমিশন : রোজ দুধ পান?
লুঃ আঃ : দুধের ব্যাপারটা, দুধের ব্যাপারটা…
চীফ : যারা দুগ্ধপোষ্য, এটা তাদের ব্যাপার। আমরা কী জানি?
কমিশন : চিকিৎসা ঠিক মত হয়? ওষুধ বিষুধ পাওয়া যাচ্ছে?
চীফ : কী জ্বালা। কেন আমাদের দেখে কি মনে হচ্ছে আমরা ম্যালেরিয়ার রোগী? কি হে, বাইসেপটা দেখাব নাকি?
কমিশন : থাক থাক। আচ্ছা ঘরে আলা টালো ঠিক মত জ্বলে?
চীফ : হ্যাঁ হ্যাঁ, সব রকম ব্যবস্থাই আছে। বিদ্যুৎ, কেরোসিন, মোমবাতি এমন কি রেড়ির তেলের প্রদীপও ঘরে ঘরে রেখেছি। খুশিমত জ্বালি। কোনও একটা বিশেষ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল না হওয়াটাই আমাদের পলিসি।
কমিশন : আবর্জনা টাবর্জনা ঠিক মতো পরিষ্কার হয়? না কি নোংরা জমে থাকে?
চীফ : নোংরামি আমরা পছন্দ করিনে। আমাদের মধ্যে কোনও নোংরামি নেই। আমাদের হচ্ছে ক্লিনেসট অ্যাডমিনিসট্রেশন। আমার সহকর্মীদের মধ্যে সহযোগিতা এবং শৃঙ্খলাবোধ আদর্শস্থানীয়।
লুঃ আঃ : হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা কাগজে সই করে দিইছি। একেবারে মিলিটারি ডিসিপ্লিন। কি বল চী একটাও বেফাঁস কথা বলিছি? হোঁক্ হোঁক্ হোঁক্
কমিশন : মেনটালি আপনারা কি খুব ডিসটারব্ বোধ করছেন? কোনওরকম মনোমালিন্য কি ওই জাতীয়…
লুঃ আঃ : (ফিসফিস করে) সাবধান চীফ ব্যাটা ঘরের খবর জেনে নিতে চাইছে। ব্যাটাকে একটা কাঁইচি মেরে দেব?
চীফ : (ফিসফিস করে) খবরদার! আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। যা বলবার আমি বলছি। চীফ : আমাদের মধ্যে কোনও মনোমালিন্য নেই। আমরা এক পরিবারের লোক। আমি বড় ভাই বড়দা আর সব আমার ছোট ভাই। আমার সহকর্মীরা আমার ছোট ভাই। আমার সহধর্মীরা আমার ছোট ভাই। আমার সহধর্মিণী আমার ছোট ভাই। এদের সবাইকে আমি ভালোবাসি।
লুঃ আঃ : হ্যাঁ ভালবাসে। কোনো মনো মালিন্নো নেই।
কমিশন : আচ্ছা এখানে করাপসন মানে দুর্নীতি কিছু আছে?
লুঃ আঃ : চীফ!
চীফ : শাট আপ! কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু নেই। ও সব ওয়াইল্ড এলিগেশন। সব কমিশনের কাছে পাঠিয়েছি। ভাবনার কিছু নেই।
আরও ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাকি এইখানেই মেসিন বন্ধ করে দেবার নির্দেশ দেন। এবং তৎক্ষণাৎ লুমবিনি নিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। রোটানডায় কোনও আড়ি পাতার কল বসানো হয়েছিল কি না, সেটাও বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখছেন।
৩ জুলাই ১৯৭৪