লুঙ্গির বাহার
লুঙ্গির তুলনা লুঙ্গিই। এমন আরামের পরিধেয় আর নেই। লুঙ্গি ধরেছি হাফ প্যান্ট ছাড়ার পর। হাফ প্যান্ট ছেড়েছি পা দুখানি রোমশ হয়ে যাওয়ার পর। হাঁটুতে রোম, চোখের তলায় কালি, আর হাফ প্যান্ট মানায় না। শ্যামবাজারে পর পর লুঙ্গির দোকান। লুঙ্গি স্টোরই আছে কয়েকটা। শুধুই লুঙ্গি। মফস্বলের মানুষ আর.জি.কর. হাসপাতালে কাজ সেরে নতুন লুঙ্গি নিয়ে বাড়ি ফিরবে,তাই লুঙ্গির কত রঙ কত বাহার। টিউশনির টাকা পেয়ে সেখান থেকে লুঙ্গি কিনে এনে বেলা দশটা নাগাদ রোয়াকের আড্ডায় গেছি, বয়স ১৮-১৯, সবে ফার্স্ট ইয়ার। আয় করছি দুটি কিশোরকে পড়িয়ে। তো লুঙ্গি পরিহিত শ্রীমানকে দেখে বন্ধুরা অবাক। তাদের কেউ কেউ কেউ পায়জামা, কেউ কেউ হাফ প্যান্ট। আমিই লুঙ্গি। আমাদের হারুদা অনেক বছর অবধি হাফ প্যান্ট পরত। খুব কায়দাবাজ। চুলে টেরি, গালে পাতলা দাড়ি, রাজকুমার সিনেমা দেখে তার গল্প আরম্ভ করেছিল, কীভাবে চুমুর দৃশ্যে দুইটি টিয়া পাখিকে ব্যবহার করেছে পরিচালক। বলতে বলতে হারুদা আমাকে তিরস্কার করল, এসব পরে আড্ডায় আসবি না। আমি পরেছি তাতে হারুদার খুব অসুবিধে। তাকে আমি লুঙ্গি পরতে দেখিনি। অনেক দিন পরে পায়জামা। আমি তখন, সেই বেকারবেলায় লুঙ্গি পরে কয়েকদিন বাইরে গিয়ে বুঝেছিলাম এতে এলাকার কিশোরী কন্যাদের কাছে দাম কমে যাবে। হাসাহাসি করে সব। লুঙ্গি মানেই কর্তা। বুড়ো কর্তা। সুতরাং রাস্তায় লুঙ্গি পরা শেষ, কিন্তু বাড়িতে বন্ধ হয়নি। লুঙ্গির রকম আছে। চেক লুঙ্গি, প্লেন লুঙ্গি, সিল্কের লুঙ্গি, সিন্থেটিক সুতো মেশান লুঙ্গি, সরু পাড় দেওয়া লুঙ্গি…। কোনো লিনেনের লুঙ্গির গিট খুলে খুলে যায়, সে লুঙ্গিতে সিন্থেটিক সুতো মেশান। লুঙ্গির দাম কাপড়ের গুণমানে। আবার রঙে চেকে দামের হেরফের হয়। আমার এখন দুইখান লুঙ্গি বাটিকের ছাপওয়ালা। সে বেশ সুন্দর। একটি হলদে শাদা, অন্যট সবজে শাদা। আমার খুব পছন্দের। বাড়ির পোশাক ঐটি। গায়ে পাঞ্জাবি কিংবা সার্ট। হুঁ, লুঙ্গি সরল পোশাক। এত সরল আর হয় না। তার কোনো ডিজাইনের হেরফের নেই। লুঙ্গির পকেট নেই। জিপার নেই। শুধু বুক চিরে লম্বা একটা সেলাই আছে। লুঙ্গিকে অমন সেলাই করে একসূত্রে বাঁধা হয়। সেলাই না করে লুঙ্গি পরিধানও একটি স্টাইল। দক্ষিণ ভারতীয়রা পরেন। লুঙ্গি তাঁদের নিজস্ব পোশাক। লুঙ্গির উপরে শার্ট পরে মিটিঙে চলেছেন বড় সায়েব। লুঙ্গির উপরে শার্ট পরে চেম্বার আলো করে বসে আছেন বড় কর্তা। বর্মা (এখন মিয়ানামার) থেকে লুঙ্গি এসেছে এদেশে। যারা বলেন মুসলমান পুরুষের পরিধেয় এইটি, ঠিক বলেন না। বার্মিজ পরিধেয় এদেশে এলে বুদ্ধিমানের মতো বাঙালি মুসলমান তা নিয়ে নিল নিজের করে, আর মুসলমান নিল বলে হিন্দু নিল না। হিন্দু দাগিয়ে দিল লুঙ্গি মুসলমানের মুসলমানির এক চিহ্ন। কিন্তু এও তো সত্য, দরিদ্র মানুষের এত ভালো এবং নিশ্চিন্ত পরিধেয় আর হয় না। প্রয়োজনেই লুঙ্গি পরে হয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষ। একযোগে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের পরিধেয়। চাষা মজুর, যাঁরা কায়িক শ্রমে বাঁচেন, জমিতে খাটেন, তাঁদের লুঙ্গি ভরসা। সে চাষা হিন্দু হন আর মুসলমান হন। দুটি কি তিনটি লুঙ্গিতে তাঁদের বছর কেটে যায়। লুঙ্গি ঘরে, লুঙ্গি বাইরে। লুঙ্গি পরে ধান কাটা, লুঙ্গি পরে বেয়াই বাড়ি যাওয়া। জামাই আসছে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি গায়ে, শ্বশুর তাকে দামী লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি দিয়েছে ইদের বরাত। গাঁয়ের কথা এইটি, শহরের নয়। শহরের জামাই আলাদা। তার জিনস চাই, টি শার্ট চাই। সে জমিতে খাটে না যে লুঙ্গি মালাইচাকি অবধি ভাঁজ করে তুলে নিয়ে ছোট করে নিয়ে বর্ষা প্লাবিত জমিতে ধান্য রোপন করবে। কিংবা বৈঠা মেরে গাঙে ভেসে যাবে কাটা ধান নিয়ে। হ্যাঁ, শিখ ট্র্যাক ড্রাইভার লুঙ্গিতে স্বচ্ছন্দ। লুঙ্গি ভাসিয়ে ভাঙরা নাচেও সে স্বচ্ছন্দ।
দেশটায় ৯ মাস গরম, তিন মাস ঠান্ডা। গরমের দেশে লুঙ্গির মতো ভালো কী আর হয়। কতজনকে বোঝাতে চেয়েছি, লুঙ্গি হলো সন্ধ্যার খোলা জানালা, দখিনা হাওয়া বয় সেই জানালা দিয়ে। পা দুখানি, কোমর থেকে পায়ের পাতা অবধি খোলা- মেলা বাতাস খায় লুঙ্গিতে। দরকারে আধ ভাঁজ করে মালাইচাকি অবধি তুলে নাও। আরো আরাম। বাজারের ব্যাপারিরা লুঙ্গির নিচে হাফ প্যান্ট পরে, সেই প্যান্টে চোরা পকেট। সেই পকেটে টাকা রাখে। খুচরো-খাচরা রাখে ট্যাঁকে। ট্যাঁক হলো কোমর। কোমরে টাকা রাখা লুঙ্গিতেই সম্ভব। ট্যাঁকের জোর আছে কি নেই তা লুঙ্গিই বলবে।
লিনেনের লুঙ্গির আলাদা আরাম। তার ছোঁয়া খুব নরম। একসময় খুব পরেছি। এখন মেলে কি মেলে না খেয়াল করিনি। গেরুয়া লিনেনের লুঙ্গি কিনে সেই লুঙ্গি দিয়ে পাজামা বানিয়ে পরতে দেখেছি এক অগ্রজ কবিকে। তাঁকে দেখে আমিও সেই কাজ করলাম, তাতে কি হলো ডুলুং নদীর পাড়ের মানুষজন অবাক। এ কী কাণ্ড! লুঙ্গি তার কাপড়েই যায় চেনা। পাজামা বানাই শার্ট বানাই, লুঙ্গিকে লুকোতে পারবে না কেউ। লুঙ্গির পরিচয় কাপড়েই। লুঙ্গিতে নাক সিটকানো মানুষ কম নেই। বউ চায় না স্বামী লুঙ্গি পরুক। বরং হাফ প্যান্ট, বারমুডা, নাভির কাছ থেকে দড়ি ঝুলবে তলপেট অবধি। ইস, লুঙ্গি ভাঁজ করে মালাইচাকির উপর পর্যন্ত তুলেছ কেন ভূত! সভ্যতা নেই। হাফ প্যান্ট কি গোড়ালি অবধি নামে? বলবে কে? পাজামার দড়ি নিয়ে সমস্যা। দরকারের সময়ে দড়িতে গিট লাগবেই। আর লাগলে সে গিঁট ছাড়ায় কার সাধ্য? গিট মধ্যরাতে হতে পারে, সময়ে অসময়ে হতে পারে। সিনেমা হল বা কফি হাউসের টয়লেটে হতে পারে গিটের গিটকিরি। আর পাজামার দড়ি পোক্ত না হলে, ফট করে ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তাই বর্মার রাজা দর্জিকে ডেকে নতুন কিছু বানাতে বলতে লুঙ্গির আবির্ভাব। শোনা যায় পাজামার গিট না খুলতে পেরেই লুঙ্গির আবিষ্কার। বর্মার রাজার ইচ্ছাতে লুঙ্গির আবির্ভাব। লুঙ্গি আবিষ্কার নিয়ে আমাদের বন্ধু লম্বু নিমু এই লিখেছিল,
পাজামার গিটকিরি, সয় না সয় না,
সময়ে সে নিজের কাছে, রয় না, রয় না।
পাজামার গিটের গিটকিরি সয় না তাই লম্বু নিমু লুঙ্গি ধরল। বর্মার রাজার মতো তারও হয়েছিল পাজামার দড়ি নিয়ে কঠিন সমস্যা। রাজার হলে প্রজার হবে না কেন?
সেলাই ছাড়া লুঙ্গি আছে দক্ষিণ ভারতে। লুঙ্গি তাঁদের জাতীয় পোশাক। শাদা পরেন বেশি। লুঙ্গি নিয়ে লুঙ্গি ডান্সেও তাঁরা প্রাণবন্ত। চেন্নাই এক্সপ্রেস সিনেমায় দীপিকা পাড়ুকন এবং শাহরুখ খানের লুঙ্গি ডান্স লুঙ্গির প্রমোশন ঘটিয়েছে। দক্ষিণ বাদে বাকি ভারত সেলাই মারা লুঙ্গি নিয়ে খুশি। গোল হয়ে ঘিরে থাকে, ঝটকা মেরে পরে নাও। কোন ব্র্যান্ড পরবে, অফিসার, ইসমাইল? ইসমাইল ভালো অফিসার নয়। অফিসার ভালো ইসমাইল নয়। যার যেমন পছন্দ। লুঙ্গি বলে ফেলাঝেলা কিছু নয়, তার হরেক রকম ব্র্যান্ড আছে। সিল্কের দামী লুঙ্গি পরে আনন্দ উৎসবে এসেছেন মহাত্মন তাও দেখেছি। ইদানীং লুঙ্গি নারীর পোশাকও হয়েছে। কিন্তু তা সমস্ত বছরের, দিন রাত্রির নয়। সাড়ে তিন হাত চওড়া আর পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাত লম্বা হলেই লুঙ্গি সব মানুষের উপযোগী। ভারতের সব প্রদেশেই লুঙ্গি পরেন সাধারণ মানুষ, শুধু শীত প্রধান অঞ্চলগুলি বাদ দিয়ে। শুধু ভারত কেন, বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার (বর্মা) থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, জর্ডান, সোমালিয়া-সহজ পোশাক লুঙ্গি সব দেশেই প্রিয়। বললাম যে সময়ে সাহায্য করতে লুঙ্গির তুল্য কোনো পোশাক নেই। কোমরে গিট দেবেন সহজ, আর তা না হলে বেল্ট পরা যায়। ঘরে আমি বেল্ট পরিনি কোনোদিন। আর বাইরে লুঙ্গি পরতে সঙ্কোচ। কিন্তু আমারই বয়সী সুমেধার বাবাকে রোজই রংজ্বলা লুঙ্গি আর টি শার্ট পরে বাজারে আসতে দেখি। তিনি তো লুঙ্গিতেই সদানন্দ। ক্কচিৎ দেখি প্যান্ট সার্ট, তিনি জামাইবাড়ি চলেছেন। প্রতিবেশী শৈলেনবাবু ব্রাহ্মণ। লুঙ্গি পরে উপবীতধারী তিনি খালি গায়েই বাজার যেতেন সকাল সকাল। তবে, শীতের দিনে লুঙ্গি শীত ঠেকাতে পারে না সত্য। পা দুখানি জমে যায়। লুঙ্গি তো আসলে কাপড়ের নিচে উদলা করেই রেখে দেয় অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। তাই কঠিন শীতের সময় লুঙ্গির নিচে ইনার পরতেই হয়। হ্যাঁ, লুঙ্গির ঘুম অনেক সময়ই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ক্যানিঙের এক সস্তার হোটেলে অনেক রাতে আশ্রয় নিয়ে যে ঘরটিতে আমাকে থাকতে দেওয়া হলো এক রাত্রের জন্য, সেই ঘরে আর এক খাটে ধুমসো কালো এক মাছের ব্যাপারি উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছিলেন লুঙ্গি মাথায় তুলে। চোখ বোঁজা ব্যতীত উপায় ছিল না। সে ছিল ভাদ্র মাস। ঘরটিতে পাখা ছিল না। উফ, এখন যে চোখ বুঁজলেও দেখতে পাই।
মুসলমান পরিবারে বালকও লুঙ্গি পরে। ইদের দিন দেখি, নতুন চেক লুঙ্গি, শাদা পাঞ্জাবি আর ফেজ মাথায় পাঁচ বছরের বালক চলেছে বাবার হাত ধরে। আমার পুত্রটি যখন বালক ছিল, চেক লুঙ্গি এনে দিয়েছিলাম খুঁজে। দড়ি দিয়ে সেই লুঙ্গি কোমরে বেঁধে, হনুমানের মুখোস পরে, হাতে গদা নিয়ে সে ঘুরত। লুঙ্গি তার খুব পছন্দ হয়েছিল। গদাও। হনুমানের মুখোসও। হনুমান লুঙ্গি পরে ঘুরছে, হায়, তা যদি হতো তাহলে কত কিছুই না মিটে যেত। মিটত কারণ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু ঘরে লুঙ্গি পরলেও এখনো বিশ্বাস করে লুঙ্গি মুসলমানের পরিধেয়। সুতরাং বজরংওয়ালি তা পরেন কীভাবে, যতই তাতে বাহার খুলুক।