5 of 8

লুঙ্গি

লুঙ্গি

দশ দিনের জন্যে কলকাতার বাইরে ছিলাম। প্রয়াগ-কাশীতে তীর্থ করলাম। সেই সঙ্গে এলাহাবাদে ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’। সেই যাকে রথ দেখা আর কলা বেচা বলে, এক সঙ্গে তাই আর কী।

এই দশ দিনের মধ্যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে শহরে, তুচ্ছ লুঙ্গি নিয়ে।

একদা এক লুঙ্গির কথা আমি লিখেছিলাম ‘কাণ্ডজ্ঞানে’। সে অবশ্য সত্যি ঘটনা অবলম্বনে, খবরের কাগজের প্রতিবেদন অনুসরণ করে রম্য রচনা।

বছর দশেক আগের কথা। পূর্ব কলকাতার এক সরকারি ব্যাঙ্কের শাখা অফিসে ডাকাতি হয় প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে ব্যাঙ্কের খদ্দের, কর্মচারী, সশস্ত্র প্রহরী সবাইকে আটকিয়ে রেখে ব্যাঙ্কের সমস্ত টাকা ডাকাতেরা লুঠ করে। কিন্তু ডাকাতেরা বোধহয় টাকার পরিমাণ অনুমান করতে পারেনি। তাদের থলে কম পড়ে যায়, তখন তারা ব্যাঙ্কে উপস্থিত লুঙ্গি পরা এক খদ্দেরের লুঙ্গি কেড়ে নেয়। এবং বাড়তি টাকা সেই লুঙ্গিতে বেঁধে নিয়ে যায়।

লুঙ্গিহীন বা উলুঙ্গি সেই খদ্দেরের হতচকিত মানসিক অবস্থা, পুলিশ ও এর পরবর্তী ঘটনাবলি ছিল আমার সেই রম্যরচনার বিষয়।

এবারের বিষয় কিন্তু আরও বেশি জটিল। কে বা কারা রটিয়ে দিয়েছিলেন, রাস্তায় লুঙ্গি পরা লোক দেখলেই পুলিশ ধরছে। ভয়ানক গুজব, এই গুজবের রেশ বহুদূরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এলাহাবাদে ইংরেজি কাগজে পড়েছি, বেনারসে হিন্দি কাগজে।

অন্য আরও নানারকম গুজবের মতো এই গুজবের একটা ভুল ভিত্তি রয়েছে। মাননীয় বিদেশি অতিথিদের জন্যে শহর, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার পর ওই সব অঞ্চলের ভবঘুরেদের সরিয়ে দেওয়া হয়। গরিব ভবঘুরের পরনে আর কী থাকবে, বড়জোর লুঙ্গি। লোকে এটা দেখে ভাবে যে সব লুঙ্গি পরা লোককেই পুলিশ ধরছে।

গুজবের এই সরলীকৃত ব্যাখ্যাটা কতটা গ্রহণযোগ্য তা আমি জানি না। কিন্তু কলকাতায় এসে এই ব্যাখ্যাই শুনেছি।

আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বাড়িতে লুঙ্গি পরেন, খবরের কাগজের ছবিতে দেখেছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যেই লুঙ্গি পরেন, সাদা দক্ষিণী লুঙ্গি। প্রেমেন্দ্র মিত্রকে বাড়িতে লুঙ্গিপরা দেখেছি, শম্ভু মিত্রকেও দেখেছি। শিবনারায়ণ রায় লুঙ্গি পরে যত্রতত্র, সভাসমিতিতে যান। মধ্যে মহিলারা লুঙ্গি পরা আরম্ভ করেছিলেন, ফ্যাশন হিসেবে। সে ফ্যাশন অবশ্য টেকেনি।

আমাদের বাড়িতে আমিই একমাত্র লুঙ্গি পরি। আমার পূর্বপুরুষেরা কেউ লুঙ্গি পরেননি, বাসায়-বাইরে সব সময়েই ধুতি। আমার ছেলে বা ভাইয়েরা লুঙ্গি পরে না। আমার মেমসাহেব বউমা কী একটা পোশাক এনেছিলেন জাপান থেকে সেটা বরং অনেকটা লুঙ্গি জাতীয়।

নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাসে লুঙ্গির উল্লেখ পেলাম না। সুকুমার সেনের বঙ্গভূমিকাতেও লুঙ্গি নেই।

লুন্‌গ্গী শব্দটি বর্মি। এ ছাড়াও আমার ছেলেবেলায় তফন শুনেছি, যার মানে লুঙ্গি।

যতদূর মনে হয় এই বর্মা মুলুক থেকেই লুঙ্গি বাঙালি সমাজে এসেছে। আজকাল বাঙালি পুরুষ প্রায় সবাই লুঙ্গি পরে। পঞ্চাশ বছর আগে অভিজাত ব্যক্তিরা নৈশ বা ঘরোয়া পোশাক হিসেবে লুঙ্গি ব্যবহার করতেন আর খুব দরিদ্র ব্যক্তিরা পরতেন ধুতির বিলাসিতা করা সম্ভব ছিল না বলে।

এসব ঐতিহাসিক বিষয় থাক, এবার আমার নিজের সমস্যাটা বলি। তীর্থ ভ্রমণ শেষ করে কলকাতায় বাড়ি ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে লুঙ্গি পরব। কিন্তু কোথাও লুঙ্গি নেই। আলনা, রেলিং, খাটের বাজু, চেয়ারের হাতল সব জায়গায় খুঁজলাম। আমার ছোটভাই বিজন বাসায় ছিল না। সে এসে বলল, ‘লুঙ্গি? সে আমি সব সরিয়ে রেখেছি।’ এই বলে বাড়ির পাশের বাগানে গিয়ে একটা জবাগাছতলা খুঁড়ে মাটির নীচ থেকে আমার পুরনো লুঙ্গি দুটো প্লাস্টিকের মোড়কে জড়ানো অবস্থায় বার করে বলল, ‘পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে রেখেছিলাম। পুলিশ যদি বাড়ি সার্চ করে লুঙ্গি পায়। যা ভয় পেয়েছিলাম।’

হায় গুজব! হায় পুলিশ! হায় কলকাতা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *