লুকোচুরি

লুকোচুরি 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

পশ্চিম গগনে শুকতারা উঠিয়াছে। রাত্রি প্রায় শেষ। প্রকৃতি নিস্তব্ধ— কেবল মলয়পবন প্রবাসীর দীর্ঘশ্বাসের ন্যায় থাকিয়া থাকিয়া শন্ শন্ শব্দে প্রবাহিত হইতেছে। জন-মানবের সাড়াশব্দ নাই; মধ্যে মধ্যে দুই একজন পুলিস-প্রহরীর ভয়ানক চীৎকার প্রকৃতির সেই গভীর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিতেছে। এমন সময় আমি একটা হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধান করিয়া থানায় ফিরিয়া আসিলাম। 

সমস্ত দিবস কঠোর পরিশ্রম করিয়া এবং সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া, আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম; থানায় ফিরিয়া একটি নিভৃতস্থানে বসিয়া বিশ্রাম লাভ করিতে লাগিলাম। 

ফুল্ল-ফুলবাস-স্নাত মৃদুমন্দ মলয়পবন ‘সেবন করিয়া আমার অবসাদ দূর হইল এবং অতি অল্পকালের মধ্যেই নিদ্রাকর্ষণ হইল। আমার বাহ্যজ্ঞান লোপ হইল, ক্রমে গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত হইয়া পড়িলাম। 

কতক্ষণ নিদ্রিত ছিলাম বলিতে পারি না। এক কনেষ্টবলের বিকট চীৎকারে আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল। চক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখি, থানার সম্মুখেই একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ি দাঁড়াইয়া রহিয়াছে এবং এক ভদ্র-যুবক সেই গাড়ি হইতে অবতরণ করিতেছেন। 

যুবককে আমার গৃহে লইয়া যাইতে বলিয়া আমি গাত্রোত্থান করিলাম। তখন ঊষার আলোকে চারিদিক উদ্ভাসিত হইয়াছিল, উচ্চবৃক্ষশিরে স্বর্ণাভ সূর্যরশ্মি প্রতিবিম্বিত হইয়া নবোদ্গত পত্রগুলিকে স্নেহময় করিয়াছিল। বিহঙ্গমুকুল আপন আপন কুলায় ত্যাগ করিয়া আহারান্বেষণে নিযুক্ত হইয়াছিল এবং রাখালগণ গোধন লইয়া ধীরে ধীরে মাঠের দিকে ধাবমান হইতেছিল। 

তখনই আমি প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া অফিস-ঘরে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, যুবকের বয়স প্রায় আটাইশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে শ্যামবর্ণ; হৃষ্টপুষ্ট, বলিষ্ঠ, নাতিদীর্ঘ ও নাতিখর্ব্ব। মুখশ্রী অতি সুন্দর, অঙ্গসৌষ্ঠব অতি চমৎকার। 

আমি গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিবামাত্র যুবক আসন ত্যাগ করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন এবং আমাকে অতি বিনীত ভাবে নমস্কার করিলেন। তাঁহাকে উপবেশন করিতে অনুরোধ করিয়া আমি তাঁহার সম্মুখস্থ একখানি চেয়ারে বসিয়া পড়িলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়ের নাম কি? কি অভিপ্রায়ে এমন সময়ে এখানে আসিয়াছেন?” 

যুবক বিনীত ভাবে উত্তর করিলেন “আমার নাম অনাথনাথ মুখোপাধ্যায়। বিষম বিপদে পড়িয়াই আপনার শরণ লইয়াছি।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “কি বিপদ স্পষ্ট করিয়া না বলিলে আপনার কোন উপকার করিতে পারিব না।” 

অনাথবাবু ঈষৎ লজ্জিত হইলেন। তিনি বলিলেন “যদি অনুগ্রহ করিয়া একবার আমাদের বাড়ীতে পদধূলি দেন, তাহা হইলে আমার স্ত্রীর মুখে সকল কথাই শুনিতে পাইবেন। কোথা হইতে একখানি পত্র পাইয়া তিনি ভয়ানক ভীতা হইয়াছেন।” 

আগন্তুকের অনুরোধ এড়াইতে পারিলাম না। আমি তখনই তাঁহার কথায় সম্মত হইলাম এবং যে গাড়ি করিয়া তিনি থানায় আসিয়াছিলেন, সেই গাড়িতে গিয়া উপবেশন করিলাম। 

শিয়ালদহ ষ্টেসন হইতে কিছুদূরে অনাথনাথের বাড়ী; অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যেই আমরা সেখানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। অনাথনাথের বাড়ীখানি দ্বিতল এবং নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে। বাড়ীখানি দ্বি-মহল। অনাথনাথ আমাকে প্রথম মহলের দ্বিতলস্থ বৈঠকখানায় লইয়া গেলেন এবং অতি যত্নের সহিত সেই স্থানে বসিতে বলিলেন। 

বৈঠকখানা ঘরটি দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দশ হাতের কম নহে। ঘরের ভিতর ঢালা বিছানা, – প্রথমে মাদুর, তাহার উপর সতরঞ্চ, তাহার উপর একখানি অতি শুভ্র চাদর। বিছানার চারিদিকে চারিটা তাকিয়া, মধ্যস্থলে দুইটা বৈঠকের উপর দুইটা রূপাবাঁধান হুকা। ঘরের দেওয়ালে কয়েকখানি হিন্দু-দেবদেবীর ছবি, মধ্যে মধ্যে এক একটি জোড়া দেওয়ালগিরি। 

আমাকে সেই ঘরে বসিতে বলিয়া অনাথনাথ অন্দরে গমন করিলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন “আমার স্ত্রী পার্শ্বের ঘরে আসিয়াছেন। দুইটি গৃহের মধ্যে যে দরজা আছে, সেইটি খুলিয়া দিতেছি। তাহা হইলে তিনি আমাদিগের কথাবার্তা শুনিতে পাইবেন এবং আবশ্যক হইলে সংশোধন করিতে পারিবেন।” 

আমি কোন কথা কহিলাম না। অনাথনাথ গৃহমধ্যস্থ একটি দ্বার খুলিয়া দিলেন এবং ঠিক তাহার নিকটে গিয়া উপবেশন করিলেন। পরে আমাকেও সেই স্থানে যাইতে অনুরোধ করিলেন। আমিও অগত্যা সেইখানে গিয়া বসিলাম। কিছুক্ষণ পরে অনাথনাথ একটি স্বর্ণ-নির্ম্মিত ক্ষুদ্র শূকর ও একখানি পত্র বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিয়া বলিলেন “এই সোনার শূকর ও এই কাগজে অঙ্কিত শূকরমূর্তি দেখিয়া আপনার মনে কি কোন সন্দেহ হয়? এই দুই পদার্থের মধ্যে কোনপ্রকার সংশ্রব আছে কি?” 

আমি দুইটি দ্রব্যই হাতে লইয়া উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিলাম। দেখিলাম, স্বর্ণ-নির্ম্মিত ক্ষুদ্র শূকরটি মস্তকের অলঙ্কাররূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। শূকরটিতে অন্ততঃ দুই ভরি বিশুদ্ধ স্বর্ণ আছে, এবং উহা কোন ইংরাজ কারিকরের দ্বারা গঠিত। দেশীয় কারিকর কর্তৃক প্রস্তুত করা হইলে শূকরমূর্ত্তি ওই প্রকার হইত না বলিয়াই আমার বিশ্বাস হইল। যে কাগজখানি পাইলাম, তাহাতেও অবিকল ওই প্রকার শূকরমূর্ত্তি অঙ্কিত ছিল। কিন্তু কাগজখানিতে অপর কতকগুলি লেখায় পরিপূর্ণ। লেখাগুলি কাগজে যেমন ছিল, নিম্নে সেইরূপ লিখিত হইল। 

বছিনি হুওয়া দিইম্ নপত্যু পত্রর রেপ্রজ সন্ধান্য নিম্ন ননিস্ত পাশাত ইনাহ য়াজাও।” 

আমি কিছুক্ষণ ওই কাগজখানি অতি মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলাম, কিন্তু দুঃখের বিষয় সহজে উহার কোন অর্থ উপলব্ধি করিতে পারিলাম না। 

আমাকে নিস্তব্ধ দেখিয়া অনাথনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু বুঝিতে পারিলেন? আমি ত যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও সফল হইতে পারি নাই। শুনিয়াছি, আপনি এইরূপ অনেক পত্র পাঠ করিয়াছেন, এই প্রকার অনেক কঠিন রহস্য ভেদ করিয়াছেন, সেই জন্যই আপনার সাহায্য প্রার্থনা করিতেছি। আপনি এখানকার এবং অন্যান্য অনেক স্থানের দুর্বৃত্ত লোকদিগকে জানেন, অনায়াসেই তাহাদিগকে গ্রেপ্তার করিতে পারেন, সহজে কেহ আপনার চক্ষে ধূলি দিতে পারিবে না। এখন বলুন, আমি কি করিব?” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “কাগজখানিতে যাহা লেখা আছে তাহা এখন বুঝিতে পারিলাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ চেষ্টা করিলে উহার মর্ম্ম ভেদ করিতে পারিব, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। এখন যদি আমার সাহায্য লওয়া আপনাদের অভিপ্রেত হয়, তাহা হইলে কোন বিষয় গোপন না করিয়া প্রথম হইতে সকল কথা বলুন। তাহা না হইলে আমি আপনাদের সাহায্য করিতে সক্ষম হইব না। প্রথমতঃ এই সোণার শূকর এবং এই কাগজখানি কোথায় পাইলেন, আর ইহার জন্যই বা আপনাদের এত ভয় কেন? সমস্ত কথা জানিতে পারিলে আমি প্রাণপণে আপনাদের সাহায্য করিব।” 

অনাথনাথ একবার গৃহ মধ্যে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন। পরে বলিলেন “এই বাড়ী আমার নহে, – আমার স্ত্রীর দূর-সম্পর্কীয় এক খুড়ীর বাড়ী। এ বাড়ীতে আমরা দুজন, তিনি, তাঁহার এক দিদি এবং দুইজন দাসী ও এক ভৃত্য, এই কয়জনে বাস করি। আমার বাড়ী পূর্ব্ববঙ্গে—কিন্তু আমি কলিকাতাতেই বহুদিন হইতে বাস করিতেছি। বিবাহের পর আমার স্ত্রীর অনুরোধে আমিও এখানে বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছি—” 

বাধা দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার স্ত্রী পূর্ব্বে কোথায় ছিলেন?” 

অ। তাঁহার পিতার সহিত পশ্চিমে ছিলেন। 

আ। পশ্চিমে কোথায়? 

অ। আজ্ঞা কানপুরে। তিনি কলিকাতার মিলিটারি ডিপার্টমেন্টে কর্ম্ম করিতেন। সহসা বদলি হইয়া কানপুরে গমন করেন। বিমলার তখন বিবাহ হয় নাই, সুতরাং সেও তাঁহার সহিত কানপুরে যান। 

আ। বিমলা কে? আপনার স্ত্রীর নাম কি বিমলা? 

অ। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। আপনার শ্বশুর পূর্ব্বে কোথায় থাকিতেন? 

অ। এই বাড়ীতে। 

আ। আপনার শ্বশুরকে দেখিয়াছেন? 

অ। আজ্ঞে না, তাঁহার মৃত্যুর পর বিমলা পুনরায় কলিকাতায় আগমন করিলে আমাদের বিবাহ হয়। 

আ। কতদিন বিবাহ হইয়াছে? 

অ। ছয় মাসের অধিক নহে। 

আ। সোণার শূকরটি কোথা হইতে পাইয়াছেন? 

অ। আমার শ্বশুর মহাশয়ের মৃত্যুর পর আমার স্ত্রীকে প্রায় তিন মাস কানপুরে থাকিতে হয়। শ্বশুর মহাশয় মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব্বে তাঁহার কয়েক জন বিশ্বাসী বন্ধুর হস্তে আপনার কন্যার লালন পালন ভার দিয়াছিলেন। তাঁহারাই উদ্যোগী হইয়া শ্বশুর মহাশয়ের বিষয়-সম্পত্তি বিক্রয় করতঃ নগদ টাকা করিয়া আমার স্ত্রীর নামে ব্যাঙ্কে জমা দিয়াছিলেন এবং একজন বিশ্বাসী বৃদ্ধা রমণীর সহিত কলিকাতায় পাঠাইয়া দেন। তাঁহারাই আমার স্ত্রীকে ওই শূকরটি দিয়াছিলেন। 

আ। তাঁহারা উহা পাইলেন কোথায়? 

অ। আমার শ্বশুরেরই জিনিষ-তাঁহার বাক্সে ছিল। তাঁহার বন্ধুগণ আর সমস্ত দ্রব্য বিক্রয় করিয়াছিলেন কিন্তু এই শুকরটি বিক্রয় করেন নাই। 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন? যদি সকল জিনিষই বিক্রয় করিয়া থাকেন, তবে এটি রাখলেন কেন?” 

অ। দেখিতে শূকরের আকৃতি হইলেও উহা মাথায় কাঁটার ন্যায় ব্যবহার করিতে পারা যায় দেখিয়া এবং আমার স্ত্রী উহা ব্যবহার করিতে পারিবেন জানিয়া তাঁহারা ওইটি বিক্রয় করেন নাই। 

আ। বেশ কথা। এখন বলুন, এই কাগজ দেখিয়া আপনার ও আপনার স্ত্রীর এত ভয় হইয়াছে কেন? আর কাগজখানিই বা কোথা হইতে পাইয়াছেন? 

অ। কাল বেলা দশটার সময় আমার স্ত্রী ও তাঁহার খুড়ীমা আহার করিতে বসিয়াছেন, এমন সময়ে ডাকপিয়ন কতকগুলি পত্ৰ দিয়া গেল। পত্র কয়খানির মধ্যে একখানি আমার স্ত্রীর নামে ছিল। অপর পত্রগুলি পাঠ করিয়া সকলের শেষে আমি সেই পত্রখানি খুলিয়া ফেলিলাম এবং ওই শূকর-মূর্ত্তি ও সেই সাঙ্কেতিক ভাষা উভয়ই আমার নয়ন গোচর হইল। আমার স্ত্রী তখনই আহার সমাপন করিয়া আমার নিকট আগমন করিলেন। আমিও তাহাকে পত্রখানি দেখাইলাম। তিনি উহা আমার হাত হইতে লইলেন এবং তখনই তাহার খুড়ীমার নিকট লইয়া গেলেন। আমারও এত কৌতূহল জন্মিয়াছিল যে, আমিও তাহার সহিত তাহার খুড়ীমার নিকট গমন করিলাম, কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, বৃদ্ধা যখনই ওই কাগজের দিকে দৃষ্টপাত করিলেন, তখনই তাঁহার মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করিল। তাঁহার মলিন মুখ দেখিয়া আমার বোধ হইল, তিনি অত্যন্ত ভীত হইয়াছেন। এত মনাযোগের সহিত তিনি কাগজখানি দেখিতেছিলেন যে, আমি সাহস করিয়া সে সময়ে তাঁহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না। কিছুক্ষণ পরে বৃদ্ধা কিয়ৎ পরিমাণে সুস্থ হইলেন। আমি তখন তাঁহার ভয়ের কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম। 

এই বলিয়া অনাথনাথ নিস্তব্ধ হইলেন। তাঁহার বাহ্যিক ভাব দেখিয়া বুঝিলাম, তিনিও ভীত হইয়াছেন। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “তিনি কি বলিলেন?” 

অ। তিনি যাহা বলিলেন, তাহা অতি ভয়ানক। শুনিলে হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। তিনি বলিলেন, আমার শ্বশুর মহাশয় বৰ্দ্ধমান জেলায় চাষবাস করিতেন। তাঁহার অধীনে প্রায় সহস্র বিঘা জমী ছিল, অনেক লোকজন তাঁহার বাড়ীতে প্রতিপালিত হইত। তাঁহার আয়ও যথেষ্ট ছিল। তাঁহার দোর্দণ্ড প্রতাপে স্বয়ং জমীদার পর্যন্ত ভীত হইতেন। কিন্তু সহসা একদিন সেই সমস্ত ত্যাগ করিয়া আমার স্ত্রী ও আর দুইটি পুত্রের সহিত কলিকাতায় চলিয়া আইসেন। 

আ। আপনার শ্যালক দুইজন কি এখন জীবিত আছেন? 

অ। আজ্ঞে না–তাহাদিগকে কলিকাতার এই বাড়ীতে রাখিয়া শ্বশুরমহাশয় কেবল বিমলাকে লইয়া স্বতন্ত্র একটি বাড়ী ভাড়া করেন এবং কমিশরিয়েটে একটি চাকরী যোগাড় করিয়া সেইখানেই কার্য্য করিতে থাকেন। কমিশরিয়েট মিলিটারি ডিপার্টমেন্টেরই অন্তর্গত, এখানে কার্য্য করিলে প্রায়ই বদলি হইতে হয়। দুই তিন মাস চাকরী করিবার পর, তিনি কানপুরে বদলি হন। বিমলাও তাঁহার সহিত তথায় গমন করেন। একবৎসর অতীত হইতে না হইতে পুত্র দুইটি যে কোথায় অদৃশ্য হইলেন, তাহা কেহই বলিত পারিল না কিন্তু তাঁহাদের আকস্মিক অন্তর্দ্বানের পূর্ব্বে তাঁহারাও এই প্রকার শূকর-মূর্ত্তি-সমন্বিত পত্র পাইয়াছিলেন। 

বাধা দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “কতদিন পূর্ব্বে আপনার শ্যালক দুইজন অদৃশ্য হইয়া গিয়াছেন?” অনাথনাথ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, “জ্যেষ্ঠ প্রসাদ দাস প্রায় দেড় বৎসর হইল, এবং কনিষ্ঠ বীরেন্দ্রনাথ প্রায় একবৎসর পূর্ব্বে অন্তৰ্দ্ধান হইয়াছেন।” 

আ। সে সময় এ সংবাদ পুলিসে পাঠান হইয়াছিল কি? 

অ। আজ্ঞে না। বিমলার খুড়ীমা বলিলেন, প্রথম শ্যালক প্রসাদদাস অদৃশ্য হইবার পর তিনি শ্বশুর মহাশয়কে সমস্ত ব্যাপার জানাইয়া একখানি পত্র লিখিয়াছিলেন। উত্তরে তিনি ওই বিষয়ে আর কোনপ্রকার গোলযোগ করিতে নিষেধ করিয়া দেন। সেই জন্যই তিনি থানায় সংবাদ দিতে পারেন নাই। 

আ। প্রথম শ্যালকের অন্তর্দ্ধানের ছয় মাস পরে দ্বিতীয় শ্যালক অদৃশ্য হন। সম্ভবতঃ তাঁহার অদৃশ্য হইবার ছয় মাস পরে আপনার শ্বশুর মহাশয়ও অন্তর্দ্ধান হন, কেমন?. 

অনাথনাথ সাগ্রহে উত্তর করিলেন “আপনি যথার্থই অনুমান করিয়াছেন। যদিও শ্বশুর মহাশয়ের বন্ধুগণ আমার স্ত্রীকে তাঁহার মৃত্যু-সংবাদ প্রদান করিয়াছিলেন, তত্রাপি যখন আমার স্ত্রী তাঁহাকে দেখিতে ইচ্ছা করেন, তখন তাঁহারা কৌশলে বিমলাকে সান্ত্বনা করিয়াছিলেন। আমার স্ত্রী বলেন, তিনি মারা পড়েন নাই—নিশ্চয়ই আমার শ্যালকদিগের মত অদৃশ্য হইয়াছেন। কিন্তু পাছে বিমলা ভীত হন, এই ভয়ে ও সকল কথা বলেন নাই। 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার স্ত্রীর তখন বয়স কত?” 

অ। প্রায় তের বৎসর। 

আ। তাঁহার পিতার মৃত্যু হইলে কি না তিনি সহজেই জানিতে পারিলেন। তিনি ত একাই তাঁহার পিতার নিকট থাকিতেন। 

অ। আজ্ঞে হাঁ, একাই থাকিতেন বটে, কিন্তু তখন কোন প্রতিবেশীর বিবাহ উপলক্ষে বিমলাকে কয়েক দিনের জন্য সেখানে যাইতে হইয়াছিল। যখন থানায় ফিরিয়া আসিতেছিলেন, সেই সময়ে তাঁহার পিতার মৃত্যু-সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন। 

আ। তাহা হইলে আপনার শ্বশুর ও দুইজন শ্যালক ওইরূপে অদৃশ্য হইয়াছেন। তাঁহাদের কি হইয়াছে অনুমান করিতে পারেন কি? 

অ। আজ্ঞে আমি ত সামান্য বুদ্ধির লোক, কেমন করিয়া বলিব? তবে যতদূর বুঝিতে পারা যায়, তাহাতে দেখিতেছি, তাঁহারা আর এ জগতে নাই। যদি থাকিতেন, তাহা হইলে এতদিন অতীত হইল তিনজনের কেহ কি ফিরিয়া আসিতে পারিতেন না? 

আ। আপনার স্ত্রী কি বলেন? 

অ। তিনি আর বলিবেন কি? যখন তাঁহার খুড়ীর মুখে ওই সকল কথা শুনিলেন, তখন তিনি চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। বলিলেন, এইবার তাঁহার পালা আসিয়াছে, এবং সেই অবধি নিতান্ত দুঃখিতভাবে কালযাপন করিতেছেন। এখন আপনি আমাদের ভরসা। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

অনাথনাথের মুখে সমস্ত কথা শুনিয়া আমি অত্যন্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। এতকাল পুলিসের চাকরী করিতেছি, কত গুরুতর কাণ্ড স্বচক্ষে দেখিয়াছি, কিন্তু কই, এমন অদ্ভুত কথা ত কখনও শুনি নাই? এত জন্তু থাকিতে শূকর-মূর্ত্তি কেন অঙ্কিত হইল, আর কেই বা অনাথবাবুর শ্বশুরকে ওই স্বর্ণনির্ম্মিত শূকরটি প্রদান করিল? কি জন্যই বা তাঁহাকে উহা প্রদত্ত হইল? 

এই প্রকার নানা প্রশ্ন আমার মনোমধ্যে উদয় হইল। আমি কিছুক্ষণ ওই বিষয় ভাবিলাম কিন্তু কোনপ্রকার উত্তর বাহির করিতে পারিলাম না। তখন অনাথনাথকে বলিলাম “আপনার মুখে যাহা শুনিলাম, তাহা বড়ই অদ্ভুত। আর কখনও এরূপ ব্যাপার আমার কর্ণ গোচর হয় নাই। কিন্তু সে যাহাই হউক, আমি এখন যেরূপ বুঝিতেছি, তাহাতে আমার বিশ্বাস যে, সম্প্রতি আপনার স্ত্রীর কোন বিপদের সম্ভাবনা নাই। আপনার নিজের ইহাতে কোন ভয়ের কারণ নাই। ব্যাপার অতি গুরুতর হইলেও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব এবং যাহাতে শীঘ্রই ইহার মর্ম্ম উপলব্ধি করিতে পারি, তাহার উপায় করিব। ইত্যবসরে আমার অনুরোধ এই যে, আপনি বা আপনার স্ত্রী একা যেন গৃহের বাহির না হন। যেখানে যাইবেন, অন্ততঃ একজন লোকও সঙ্গে লইবেন। গাড়িতে যান, পাল্কীতে যান কিম্বা নৌকাযোগেই যান, কোন সঙ্গী না লইয়া কোথাও যাইবেন না।” 

অনাথনাথের মুখ সহসা মলিন হইয়া গেল। তিনি ভীত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “আমিও একা বাহির হইতে পারিব না? এইমাত্র আপনি বলিলেন, আমার নিজের ভয়ের কোন কারণ নাই?” 

আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম “সাবধানের বিনাশ নাই। নতুবা এই শূকর ব্যাপারে সত্যই আপনার নিজের ভয়ের কোন কারণ নাই। যখন পত্রখানি কলিকাতা হইতেই প্রেরিত হইয়াছে, তখন পত্র-প্রেরক নিশ্চয়ই কলিকাতায় আছেন। আপনার সন্ধান পাইলেই আপনার স্ত্রীর সন্ধান পাইবে জানিয়া, তাহারা আপনার অনুসরণ করিতে পারে, সেই জন্যই সাবধান হইতে বলিয়াছি।” 

অনাথনাথ আমার কথায় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি কেমন করিয়া জানিলেন, পত্রখানি কলিকাতা হইতেই প্রেরিত?” 

আ। খামের উপর পোষ্টাফিসের মোহর দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন, পত্রখানি বড় ডাকঘরে ফেলা হইয়াছিল। অ। কতদিন আমাদিগকে এমন ভাবে থাকিতে হইবে? 

আ। পরশ্ব বেলা একটার পর আপনি থানায় যাইবেন। সেদিন যেমন বলিব, সেই মতই করিবেন। এখনও তত ভয়ের কারণ নাই। 

অ। কেন? উহাতে কি লেখা আছে, বুঝিতে পারিলাম না। 

আ। যাহাই লেখা থাকুক, পত্রখানিতে আপনার স্ত্রীকে সাবধান হইতে বলিতেছে। হয়ত উহার নিকট কোন দ্রব্য আছে, সেইটি পাইবার জন্যই পত্র-লেখক এইরূপে পত্র দিয়া ক্রমান্বয়ে তিনজনকে কোথায় সরাইয়া দিয়াছেন। নিশ্চয় করিয়া এখন কিছুই বলিতেছি না। যতক্ষণ না উহা পাঠ করিতেছি, ততক্ষণ উহার মর্ম্ম বুঝিতে পারিব না সত্য, কিন্তু সচরাচর তিনবার সাবধান না করিয়া লোকে কোন গুরুতর কার্য্যে হস্তক্ষেপ করে না। আপনার স্ত্রী যখন প্রথম সাবধান পত্র পাইয়াছেন, তখন খুব সম্ভব আরও দুইবার এই প্রকার পত্র পাইবেন। তাহার পর তাঁহার বিপদ সম্মুখীন হইবে, এই প্রকার অনুমান করিতেছি। আপাততঃ ভয়ের কোন কারণ নাই। 

অনাথনাথ আর কোন কথা বলিলেন না। আমিও তাঁহার নিকট বিদায় লইয়া গাত্রোত্থান করিতেছি, এমন সময়ে আমাকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া তিনি পার্শ্বের গৃহে প্রবেশ করিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া অনাথনাথ বলিলেন “তবে পরশু বেলা একটার সময় আমি আপনার নিকট যাইব?” আমি সম্মত হইলাম। 

তিনি তখন হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি কি সপরিবারে থানায় বাস করেন?” 

আমি তাঁহার প্রশ্নে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “ কেন? কি জন্য আপনি ওকথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?” অনাথনাথ ঈষৎ লজ্জিত হইয়া উত্তর করিলেন “বিমলা এত ব্যস্ত হইয়াছেন যে, তিনিও আমার সহিত যাইতে চাহিতেছেন। যদি আপনার বাধা না থাকে এবং সুবিধামত স্থান থাকে, তাহা হইলে তিনি যাইতে পারেন।” 

আমি সম্মত হইলাম। বলিলাম “তাহাই হইবে। আপনারা উভয়েই যাইবেন। আপনার স্ত্রী আমার অন্দরে গিয়া বসিবেন।” 

এই বলিয়া আমি বাহিরে আসিয়া গাড়িতে আরোহণ করিলাম। অনাথনাথ কোচম্যানকে পূৰ্ব্বেই ভাড়া দিয়া রাখিয়াছিলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

প্রাতঃকালে প্রকৃতির যে মনোহর মূর্তি দেখিয়াছিলাম, অনাথনাথের বাড়ী হইতে বাহির হইয়া ঠিক তাহার বিপরীত মূর্ত্তি অবলোকন করিলাম। প্রখর রৌদ্রজনিত ভয়ানক উত্তাপ, প্রজ্বলিত অগ্নি-শিখা-সহ উত্তপ্ত পবনের উচ্ছ্বাস, জীবগণের অসহ্য কষ্ট দেখিলে স্পষ্টই অনুভূত হয় যে, প্রকৃতি এই সময়ে রুদ্রমূর্তি ধারণ করিয়াছে,—জীব-সংহারে নিযুক্ত হইয়াছে। প্রকৃতির এই মূর্ত্তি জীবমাত্রেরই ভয়াবহ। 

যখন আমি থানায় আসিয়া পঁহুছিলাম, তখন বেলা প্রায় এগারটা। স্নানাহার শেষ করিয়া একত্র নিভৃত স্থানে বসিয়া সেই কাগজখানি দেখিতে লাগিলাম। কাগজখানির একটি কোণে “ওঁ” অতি ক্ষুদ্রাক্ষরে লেখা। তাহারই ঠিক বিপরীত দিকে সেই শূকর চিহ্ন। মধ্যে সেই লেখা। সম্ভবতঃ কাহারও স্বাক্ষর নাই। 

ওঁকার শব্দ কাগজখানির এককোণে লেখা রহিয়াছে দেখিয়া আমি ভাবিলাম, পত্র-লেখক নিশ্চয়ই হিন্দু কিন্তু শূকর হিন্দুদিগের অস্পৃশ্য জন্তু। হিন্দুগণ কাগজপত্রে শূকর-মূর্ত্তি অঙ্কিত করেন না। 

আমি বিষম ফাঁপরে পড়িলাম। ওঁকার দেখিয়া যেমন পত্র-লেখককে হিন্দু বলিয়া ভাবিয়াছিলাম, শুকর-মূর্তি দেখিয়া তেমনই তাহাকে অহিন্দু বলিয়া মনে হইল। পত্রপ্রেরক কোন্ ধর্ম্মাবলম্বী জানিবার জন্য আমার ভয়ানক কৌতূহল জন্মিল। আমি কাগজখানি আরও মনোযোগ সহকারে দেখিতে লাগিলাম। 

আরও আধঘণ্টা নিস্তব্ধভাবে লক্ষ্য করিবার পর কাগজখানির অপর এক কোণে “অহিংসা পরমোধৰ্ম্ম” এই কয়েকটি কথা অতি ক্ষুদ্রাক্ষরে লেখা রহিয়াছে দেখিতে পাইলাম। আমি তখনই বুঝিতে পারিলাম, পত্র-লেখক বৌদ্ধধৰ্ম্মাবলম্বী। তাহার পর ভাবিলাম, পত্রে যাহা লেখা আছে, তাহা পড়িতে না পারিলে কোন কাৰ্য্য হইবে না। যদিও আমি উহা না পড়িয়াই বুঝিয়াছিলাম যে, সেখানি সাবধান পত্র, তথাপি যতক্ষণ উহা পাঠ করিতে না পারিব, ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হইতে পারিব না। 

এই স্থির করিয়া আমি সেই কাগজখানিতে যাহা লেখা ছিল, সেইগুলি অপর একখানি কাগজে নকল করিয়া লইলাম। এই প্রকার সাঙ্কেতিক পত্র অনেক পাঠ করিয়াছি সুতরাং চেষ্টা করিলে যে ইহাও পাঠ করিতে সমর্থ হইব, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। 

লেখাগুলিকে যত প্রকারে সাজাইতে পারা যায় সেই সমস্ত উপায়েই সাজাইলাম, কিন্তু তাহাতেও উহার কোনরূপ মৰ্ম্মভেদ হইল না। কি করিয়া উহার অর্থ বুঝিব, কেমন করিয়া সাজাইলে উহার ঠিক অর্থ করিতে পারিব, এই প্রকার চিন্তা করিতেছি, এমন সময় দেখিলাম, পত্রের প্রত্যেক কথাই তিন অক্ষরের। আমার মনে এক নূতন উপায় উদ্ভাবিত হইল। আমি ভাবিলাম, লেখাগুলি তিন লাইন করিয়া সাজাইলে উহার অর্থবোধ হইতে পারে। 

এই প্রকার সাব্যস্ত করিয়া আমি প্রত্যেক কথায় তিনটি অক্ষর তিনটি লাইনে লিখিলাম। তাহার পরের কথাটির তিনটি অক্ষর ঠিক পূর্ব্বকথাটির মত অক্ষরের পার্শ্বেই লিখিলাম। এইরূপে সমস্ত কথাগুলি সাজান হইলে পাঠ করিলাম। 

“বহুদিন পরে সন্ধান পাইয়া 
ছি এই পত্ৰ প্ৰথম নিশানা জা 
নিয়া মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও” 

উল্লিখিত লেখাগুলি পত্রাকারে সাজাইলে “বহুদিন পরে সন্ধান পাইয়াছি। এই পত্ৰ প্ৰথম নিশানা জানিয়া মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।” 

পত্রের সাঙ্কেতিক ভাষা পাঠ করিয়া বড়ই সন্তুষ্ট হইলাম। যদিও না পড়িয়াই উহার মর্ম্ম অনুমানে বুঝিতে পারিয়াছিলাম, তত্রাপি এখন উহার প্রকৃত অর্থ বাহির করিতে সক্ষম হইয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইলাম। 

পত্রখানির মর্ম্মভেদ করিবার পর আমি ভাবিলাম, অনাথনাথের শ্বশুর মহাশয় নিশ্চয়ই হিন্দু। যখন তিনি বর্দ্ধমান জেলায় কৃষিকৰ্ম্ম করিয়া অর্থোপার্জ্জন করিতেছিলেন, সেই সময়ে আমার বিশ্বাস, তিনি কতকগুলি লোক রাখিয়া শূকরের ব্যবসায় আরম্ভ করেন। এরূপ শোনা গিয়াছে যে, বৌদ্ধ-পুরোহিতগণ এক সময়ে বাঙ্গালা পৰ্য্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন। যেখানে অনাথনাথের শ্বশুরের জমীদারী ছিল, হয় ত পূৰ্ব্বে সেই স্থানে কোন বৌদ্ধ মঠ ছিল। অনাথনাথ যখন সেই পবিত্র স্থানে অপবিত্র অপরিষ্কৃত ও ঘৃণিত জন্তুর ব্যবসায় আরম্ভ করিলেন, তখন বৌদ্ধগণ তাহা শুনিতে পারিয়া ভয়ানক ক্রুদ্ধ হইলেন কিন্তু ইংরাজ-রাজত্বে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তাঁহারা অনাথনাথের শ্বশুর মহাশয়ের কোন প্রকার অপকার করিতে সক্ষম না হইয়া গোপনে কার্য্য আরম্ভ করিলেন। এই কারণেই তিনি বর্দ্ধমান জেলা হইতে সহসা পলায়ন করিয়া কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। 

এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি আবার ভাবিলাম, যদি তাহাই হয়, তবে সোণার শূকরটি কোথা হইতে, কেমন করিয়া, অনাথবাবুর স্ত্রীর হস্তে পড়িল? শূকরটি নিশ্চয়ই তিনিই প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। উহা যে স্বর্ণে নিৰ্ম্মিত, তাহা দেখিয়া স্পষ্টই বোঝা যায় যে, উহা এইখানেই প্রস্তুত। কিন্তু যে আদর্শ দেখিয়া ওই মূৰ্ত্তি গঠিত হইয়াছে, তাহা এদেশের আদর্শ নহে। এ দেশের শূকরগুলি ওরূপ হৃষ্টপুষ্ট ও দেখিতে এত পরিষ্কার হয় না। এই সকল ব্যাপার চিন্তা করিয়া আমি মনে করিলাম, অনাথবাবুর শ্বশুর মহাশয় এই আদর্শমত শূকর প্রতিপালন করিতেন এবং সেই প্রকার শূকরের ব্যবসায় করিতে মনস্থ করিয়াছিলেন। 

এই প্রকার নানা চিন্তায় প্রায় সন্ধ্যা হইয়া গেল। আমি তখন কাগজখানি রাখিয়া দিয়া অফিসের কার্য্যে মনোনিবেশ করিলাম। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

সূর্য্যদেব পশ্চিম গগনে ঢলিয়া পড়িয়াছেন। তাঁহার আর সে তেজ- সে দম্ভ নাই। কিছুক্ষণ পূর্ব্বে যে সকল জীব-জন্তু প্রজ্বলিত অগ্নির ন্যায় তাঁহার কিরণজাল দেখিয়া ভয়ে ভয়ে কোন নিভৃতস্থানে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল, এখন তাঁহাকে হীনবল ও তেজোহীন দেখিয়া সাহস করিয়া তাঁহারই সম্মুখে বাহির হইল। পশ্চিম গগন নানা বর্ণে চিত্রিত হইয়া অপূর্ব শোভা ধারণ করিল। মৃদুমন্দ মলয়পবন সদ্যপ্রস্ফুটিত জাতি, যূথী, বেলা, মল্লিকাদি পুষ্পবাসে স্নাত হইয়া চারিদিকে ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। আমি অফিসের অপর কার্য্যগুলি শেষ করিয়া অনাথনাথের সহিত সাক্ষাৎ করিবার বাসনায় কোন নিভৃতস্থানে বসিয়া তাঁহার অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। 

বেলা দ্বিপ্রহরের পর অনাথনাথের সস্ত্রীক থানায় আসিবার কথা ছিল। বেলা প্রায় পাঁচটা বাজিতে চলিল, অথচ তাঁহাদের কাহারও দেখা নাই। সকল কার্য্য বন্ধ করিয়া আমি তাঁহাদের আশায় বসিয়াছিলাম, অথচ তাঁহারা আসিলেন না দেখিয়া, আমি মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইলাম এবং তখনই গাত্রোত্থান করিয়া গৃহের বাহিরে আসিয়া পায়চারি করিতে লাগিলাম। 

এমন সময়ে একখানি সেকেণ্ড ক্লাসের ভাড়াটীয়া গাড়ি থানার ভিতরে প্রবেশ করিল। গাড়ির কোচবাক্সে অনাথনাথকে দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম, তাঁহার স্ত্রী গাড়ির ভিতরে আছেন। 

গাড়িখানি স্থির হইলে অনাথনাথ অবতরণ করিলেন। আমি তখনই অন্দর হইতে একজন দাসীকে ডাকিয়া অনাথবাবুর স্ত্রীকে ভিতরে লইয়া যাইতে আদেশ করিলাম। 

সৌভাগ্যক্রমে তখন থানায় অপর কোন লোক ছিল না। আমার কথা শুনিয়া দাসী সেহ গাড়ির নিকটে গেল এবং অনাথবাবুর স্ত্রীর হাত ধরিয়া নামাইয়া বাড়ীর ভিতর লইয়া গেল। অনাথনাথ আমারই নিকটে দাঁড়াইয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁহারা শান্ত হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “এত বিলম্ব হইল কেন? কোন নূতন বিপদ উপস্থিত হইয়াছে কি?” 

অনাথনাথ লজ্জিত হইয়া উত্তর করিলেন “আজ্ঞে না–আপনার আশীর্বাদে আর কোন নূতন বিপদ ঘটে নাই। আমার ইচ্ছা ছিল, নিজের গাড়িতেই আসিব। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ গাড়িখানির স্প্রীং খারাপ হইয়া যাওয়ায়, এই ভাড়াগাড়ি করিয়া আসিতে বাধ্য হইয়াছি। আপনি সেই পত্রের কিছু করিতে পারিলেন? বিমলা বড়ই চঞ্চল ও ভীত হইয়া পড়িয়াছে। 

আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম “পত্রখানির মর্মভেদ করিয়াছি। ওখানি কেবল সাবধান পত্র মাত্র। আমি একে একে সকল কথাই বলিতেছি।” 

অ। এখানে কোন কথা বলিবেন না। যেখানে বলিলে বিমলা আপনার মুখের কথা শুনিতে পাইবেন, আপনাকে সেই স্থানে গিয়া বলিতে হইবে। তাহা হইলে বিমলা সুস্থ হইতে পারিবে। 

আ। বেশ কথা। এই ঘরের ভিতর ওই যে দরজা দেখিতেছেন, উহা খুলিলেই বাড়ীর অন্দর দেখিতে পাইবেন। যদি আপনার স্ত্রী ওই ঘরের ভিতর গিয়া বসেন, তাহা হইলে তিনি অনায়াসে আমাদের সকল কথাই শুনিতে পাইবেন। 

অ। ভাল, আপনি সেইরূপই বন্দোবস্ত করিয়া দিন। 

আমি তখন একজন দাসীকে ডাকিয়া সমস্ত কথা বলিয়া দিলাম। সেও অনাথবাবুর স্ত্রীকে লইয়া সেই গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিল এবং তাঁহাকে একস্থানে বসিতে বলিয়া নিজে তাঁহার নিকট দাঁড়াইয়া রহিল। 

ওই সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া আমি অনাথবাবুকে নিকটে বসিতে বলিলাম। তিনি সম্মুখে উপবেশন করিলে আমি বলিলাম “আপনার স্ত্রী এক ভয়ানক ষড়যন্ত্রের ভিতর পড়িয়াছেন। আজ হউক, কাল হউক বা দশ দিন পরেই হউক, ওই পত্র-লেখকগণ তাঁহারই উপর তাহাদের বহু দিনের আক্রোশ মিটাইবে। এ ষড়যন্ত্র সম্প্রতি হয় নাই, বহুদিনের ষড়যন্ত্র। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, যদি আপনার স্ত্রী কলিকাতায় থাকিতেন, তাহা হইলে বহুদিন পূর্ব্বে তিনিও অদৃশ্য হইয়া যাইতেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি এতদিন কানপুরে ছিলেন বলিয়াই এখনও তিনি জীবিত। 

অনাথনাথ কোন কথা বলিলেন না। তাঁহার স্ত্রী সর্ব্বাঙ্গ আবৃত করিয়া তাঁহাদিগের নিকট হইতে কিছুদূরে উপবেশন করিয়াছিলেন। আমার শেষ কথাগুলি শুনিয়া তিনি নীরবে রোদন করিতে লাগিলেন। তাঁহার চক্ষু দিয়া অনবরত অশ্রুপাত হইতে লাগিল দেখিয়া, আমি পুনরায় অনাথনাথের দিকে চাহিয়া বলিলাম “এখন আমার একটি জিজ্ঞাস্য আছে।” 

অনাথনাথ শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করিলেন “কি বলুন?” 

আ। প্রতিজ্ঞা করুন যে, আমি যাহা বলিব, ঠিক সেইমত কাৰ্য্য করিবেন। 

অ।নিশ্চয়ই। আমরা যখন আপনার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছি, তখন আপনার কথামতই কার্য্য করিব। আমাদের কি আর উদ্ধারের কোন উপায় নাই? 

আ। উপায় নাই এমন কথা বলিবেন না। তবে আমার পরামর্শমত কার্য্য করা চাই। এখন আমি যেরূপ বুঝিয়াছি, তাহা বলিতেছি। আপনার শ্বশুর মহাশয় বর্দ্ধমানে যেখানে কৃষিকার্য্য করিতেন, সেখানে বহুদিন পূর্ব্বে একটি বৌদ্ধ মঠ ছিল। আপনার স্ত্রী কখনও সেখানে গিয়াছিলেন? 

অনাথনাথ একবার বিমলার নিকটে গমন করিয়া ওই কথা জিজ্ঞাসা করিলেন এবং তখনই আবার আপনার স্থানে আসিয়া বলিলেন “আজ্ঞে হাঁ-বিমলা একবার সেখানে গিয়াছিলেন। তাঁহার মুখে শুনিলাম, আপনি যথার্থই অনুমান করিয়াছেন?” 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “তিনি কেমন করিয়া জানিলেন যে, সেখানে বৌদ্ধদিগের মঠ ছিল?” 

অ। বিমলা আমার শ্বশুর মহাশয়ের মুখেই শুনিয়াছিলেন। এমন কি, বৌদ্ধরা সেই জন্য যে তাঁহার উপর বিরক্ত হইয়াছিল, সে কথাও তিনি কন্যার নিকট বলিয়াছিলেন। 

আ। তবে ওই সকল কথা পূর্ব্বে বলেন নাই কেন, তাহা হইলে আমাকে এত কষ্ট পাইতে হইত না। 

অ। আমার অপরাধ নাই, আমি নিজেই জানিতাম না। আপনি ওই কথা না বলিলে হয় ত আমি আর কখনও উহা জানিতে পারিতাম না। 

আ। আর সে কথায় কাজ নাই। এখন যাহা বলিতেছি শুনুন। আপনার শ্বশুর মহাশয়ের উপর বৌদ্ধগণ বাস্তবিকই রাগান্বিত হইয়াছিল। কিন্তু কেন? তিনি যে ওই জমী খাজনা লইয়া বা ক্রয় করিয়া চাষ বাস করিতেছিলেন বলিয়া তাহারা ক্রুদ্ধ হইয়াছিল তাহা নহে, আপনার শ্বশুর আর একটি ভয়ানক অন্যায় কার্য্য করিয়াছিলেন। 

অ। কি অন্যায় কাৰ্য্য মহাশয়? 

আ। তিনি শূকরের ব্যবসায় করিতেন। 

অনাথনাথ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন?” 

আমি হাসিয়া বলিলাম “ যেরূপেই জানিতে পারি, আপনি বলুন, আমার অনুমান সত্য কি না?”

অ। আপনার অনুমান সম্পূর্ণ সত্য কিন্তু আমি আশ্চৰ্য্য হইয়াছি যে, আপনি কেমন করিয়া তাহা জানিতে পারিলেন। তিনি শূকরের ব্যবসায় করিতেন, এ কথা আমিও জানিতাম না। একদিন একখানা পত্র পাঠ করিয়া জানিতে পারিলাম যে, তিনি ওই প্রকার কার্য্য করিতেন। 

আ। সেই জন্যই তাঁহার পুত্রদ্বয় ও তিনি অদৃশ্য হইয়াছেন এবং কন্যাও কোনদিন অন্তর্দ্ধান হইবেন বলা যায় না। সোণার শুকরটি তিনি ইচ্ছা করিয়াই প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। 

আ। কারণ কি? বিমলাকে দিবার জন্য? 

আ। না-না; ওই প্রকার শূকর এ দেশে জন্মায় না। তাঁহার ইচ্ছা ছিল; ওই রকম শুকরের ব্যবসায় করেন। উহা এদেশে প্রস্তুত বটে কিন্তু কোন বিখ্যাত ইংরাজ-কারিগরের দ্বারা গঠিত। 

আ। পত্রখানির অর্থ কি? কেমন করিয়া উহার অর্থ বোধ হইল? 

আমি যেমন করিয়া সাজাইয়া উহার অর্থ উপলব্ধি করিয়াছিলাম, তাহা তাঁহাকে দেখাইয়া দিলাম। 

তিনি আমার কার্য্যে সন্তুষ্ট হইলেন। আমি বলিলাম, আরও দুইবার এই প্রকার পত্র পাইবেন। তাহার পর আপনার স্ত্রীর সমূহ বিপদ, এখন তত ভয়ের কারণ নাই। 

অনাথনাথ কিছুক্ষণ কোন কথা কহিলেন না। তাঁহাকে অত্যন্ত বিমর্ষ বলিয়া বোধ হইল। তাঁহার স্ত্রীও বিষণ্ণবদনে অবনতমস্তকে বসিয়া রহিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে অনাথনাথ বলিলেন, “কল্য আমাদিগকে একস্থানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে যাইতে হইবে। যদি অনুমতি হয়, যাইতে পারি। না যাইলে ভাল দেখায় না।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। পরদিন আমারও একটা নিমন্ত্রণ ছিল। শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করিলাম “কোথায় যাইতে হইবে?” 

অ। অনেক দূর–শ্যামবাজারে। 

আ। শ্যামবাজারে? কোথায়? সুশীল ভট্টাচার্য্যের বাড়ীতে কি? 

অনাথনাথ স্তম্ভিত হইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি কে? মানুষ না দেবতা?” 

আমি হাসিয়া বলিলাম, “না বাপু, আমি সামান্য মানুষ। তবে সেখানে আমারও কাল নিমন্ত্রণ আছে বলিয়াই ওই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছি। যদি সুশীলবাবুর বাড়ীতে হয়, আর যদি আপনি সঙ্গে থাকেন, তাহা হইলে উনি স্বচ্ছন্দে যাইতে পারেন। যখন আমি সেখানে যাইতেছি, আর আপনি যখন উহার সঙ্গে সঙ্গেই থাকিবেন, তখন ভয়ের বিশেষ কোন কারণ নাই।” 

আমার কথা শেষ হইলে অনাথনাথ গাত্রোত্থান করিলেন। তাঁহার স্ত্রীও সেই সময় দাসীর সহিত বাহিরে আসিয়া অগ্রেই গাড়িতে আরোহণ করিলেন। অনাথনাথ তাঁহার পরে গিয়া কোচবাক্সে উঠিলেন। 

কোচম্যান এতক্ষণ ঘোড়া দুইটিকে কতকগুলি ঘাস খাইতে দিয়াছিল। সে যখন দেখিল, আরোহীগণ গাড়িতে উঠিয়াছে, তখন অবশিষ্ট ঘাসগুলি তুলিয়া একটি থলিয়ার ভিতর রাখিল। 

ঘাসগুলি থলিয়ার ভিতর রাখিতে গিয়া একখানি কাগজে তাহার হস্ত স্পর্শ হইল। সে চমকিত হইয়া কাগজখানি বাহির করিল এবং সকলের সমক্ষে ফেলিয়া দিল। আমি নিকটেই ছিলাম, কাগজখানি তুলিয়া লইয়া দেখিলাম, সেই শূকর-মূর্ত্তি চিহ্নিত দ্বিতীয় সাবধান পত্র। কিন্তু সে পত্রে আর সাঙ্কেতিক কোন কথা ছিল না। পত্রখানি হস্তে লইয়া আমি অনাথনাথের নিকট গমন করিলাম এবং তাঁহার হস্তে প্রদান করিয়া বলিলাম “এই দ্বিতীয় সাবধানপত্র। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, কেমন করিয়া পুলিসের ভিতর ভাড়াটীয়া গাড়ির থলিয়ার মধ্যে পত্রখানি আসিল। আমি জানি, কোচম্যান নিকটে না থাকিলেও একজন কনেষ্টবল এই গাড়ির নিকটে দণ্ডায়মান ছিল।” 

অনাথনাথ তখন কোচম্যানকে ওই কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। সে ব্যক্তি স্তম্ভিত হইয়া বলিল “না মহাশয়, আমি এই কাগজের কথা কিছুই জানি না।” 

আমিও কনেষ্টবলকে জিজ্ঞাসা করিলাম। সে ঈষৎ হাসিল মাত্র, কিন্তু মুখে কোন কথা বলিল না। আমি সে হাসির মর্ম্ম বুঝিতে পারিলাম; তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। অনাথনাথ ও তাঁহার স্ত্রী পরস্পর পরস্পরের দিকে চাহিতে লাগিলেন কিন্তু সাহস করিয়া আমাকে কোন কথাই জিজ্ঞাসা করিতে পারিলেন না। 

আমি তখন তাঁহাদিগকে অতি সাবধানে গৃহে যাইতে আদেশ করিয়া বিদায় দিলাম। বলিলাম “কল্য সন্ধ্যার পর শ্যামবাজারে সুশীলবাবুর বাড়ীতে দেখা হইবে। তবে যদি তাহার পূর্ব্বে আর কোন পত্র পান, তাহা হইলে সে পত্র তখনই আমার নিকট পাঠাইয়া দিতে বিলম্ব করিবেন না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আপনাদের যেন আর কোন কষ্ট না হয়।” 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। পূৰ্ব্বগগনে পূর্ণচন্দ্ৰ উদিত হইয়াছে। মেঘমুক্ত সুনীল অম্বরে নিশানাথ রজত শুভ্র কোমল জ্যোৎস্নায় চারিদিক আলোকিত করিতেছে। মন্দ মন্দ মলয়পবন প্রস্ফুটিত কুসুম-সৌরভ বহন করিয়া জনগণের মনে বিপুল আনন্দ দান করিতেছে। 

আমি যখন সুশীল ভট্টাচার্য্যের বাড়ীতে পঁহুছিলাম, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। সুশীল আমার বাল্যবন্ধু, তাহার উপর আমার ভ্রাতুষ্পুত্রের শ্বশুর। তিনি বাটীর সদর দ্বারে দাণ্ডাইয়া নিমন্ত্রিত লোকগণের অভ্যর্থনা করিতেছিলেন। পৌত্রের অন্নপ্রাশন উপলক্ষে তিনি প্রচুর আয়োজন করিয়াছিলেন। 

বাড়ীতে লোকে লোকারণ্য। চারিদিকেই গোলযোগ। কোথাও নিমন্ত্রিতগণ আহার করিতে বসিয়াছেন, কোথাও বা আহারান্তে গাত্রোত্থান করিতেছেন, কোথাও আবার আহারের স্থান হইতেছে। এই প্রকার সকল স্থানেই গোলমাল। আমি একটি নিভৃতস্থান দেখিয়া বসিয়া পড়িলাম। 

মনে করিয়াছিলাম, বাড়ীতে পঁহুছিয়াই অনাথবাবুর সহিত দেখা হইবে; কিন্তু তাহা হইল না। আমি প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টাকাল চারিদিকে তাঁহার অন্বেষণের জন্য পায়চারি করিয়া বেড়াইলাম, কিন্তু তাহাতেও কোন ফল হইল না। ভাবিলাম, তাঁহারা হয় ত তখনও সেখানে উপস্থিত হন নাই। 

এই মনে করিয়া আমি সেই নিভৃতস্থানে গিয়া উপবেশন করিতেছি, এমন সময়ে অনাথবাবুকে অদূরে দেখিতে পাইলাম। আমি তখনই তাঁহার নিকট গমন করিয়া সংবাদ জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন, আর কোন পত্রাদি তখনও পান নাই। 

সে যাহা হউক, তৃতীয় পত্র না পাওয়ায় আমার মনে এক অভূতপূর্ব্ব আনন্দের উদয় হইল। আমি ভাবিলাম, এইবার তাহাদের ষড়যন্ত্র নিষ্ফল করিতে পারিব। এই স্থির করিয়া অনাথনাথকে লইয়া সেই স্থানে উপবেশন করিলাম। কিছুক্ষণ পরে সহসা এক দাসী আসিয়া অনাথনাথকে ডাকিল। সে বলিল “বাড়ীতে বুড়ীমার সাংঘাতিক অসুখ করিয়াছে। আপনাদিগকে এখনই যাইতে হইবে।” 

অনাথনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন “বাড়ীর ভিতর খবর দিয়াছ?” 

দাসী বলিল “আজ্ঞে হাঁ―তাঁহার খাওয়া হইয়া গিয়াছে। তিনি এখনই যাইবেন।” 

অনাথনাথ আমার মুখের দিকে চাহিলেন। আমি তাঁহার আন্তরিক অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলাম। বলিলাম “যদি এই দাসী আপনার স্ত্রীর সহিত যায়, তাহা হইলে আমার বিশেষ কোন আপত্তি নাই। ইহাকে বেশ চতুর বলিয়া বোধ হইতেছে। কিন্তু আপনার সঙ্গে যাওয়াই উচিত। দাসীটি কে?” 

অ। আমারই দাসী বটে; সম্প্রতি নিযুক্ত হইয়াছে। এখনও দুই মাস হয় নাই কিন্তু ইহারই মধ্যে বিমলার বড় প্রিয়পাত্রী হইয়া পড়িয়াছ। 

আ। যদি তাহা হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমার কোন আপত্তি নাই। 

এই সময়ে সুশীলবাবু তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি আমাকে ও অনাথবাবুকে আহার করিতে অনুরোধ করিলেন। আমি তখন দাসীকে আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে বলিয়া সুশীলবাবুর সহিত আহার করিতে যাইলাম। অনাথনাথও আমার সঙ্গে গেলেন। 

সত্বর আহার সমাপন করিয়া আমি বাহিরে আসিলাম। অনাথনাথ তখনও ভিতরে ছিলেন; সুশীলবাবুর সহিত কথা কহিতে ব্যস্ত ছিলেন। 

আমি বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইবার মাত্র এককানি ভাল বাড়ীর গাড়ি সুশীলবাবুর বাড়ীর দরজায় লাগিল। মুহূর্ত্ত মধ্যে একজন মহিলা তাহার ভিতরে আর একজন দাসী গাড়ির পশ্চাতে গিয়া বসিল। চক্ষের পলক পড়িতে না পড়িতে কোচমান অশ্বে কশাঘাত করিল। ঘোড়া দুইটি ভয়ানক তেজীয়ান ছিল—প্রহার খাইয়া প্রাণপণে ছুটিতে লাগিল এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই কোথায় অদৃশ্য হইয়া গেল। 

আমার ভয়ানক সন্দেহ হইল। দাসীকে দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম, সে অনাথনাথের বাড়ীর লোক। যিনি গাড়ির ভিতরে গিয়া বসিলেন, তিনি নিশ্চয়ই অনাথবাবুর স্ত্রী। যদি তাঁহার খুড়ীমার পীড়ার জন্যই ব্যস্ত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে যাঁহার জন্য তিনি এতক্ষণ বিলম্ব করিলেন, তাঁহাকে না লইয়াই বা গেলেন কেন? 

গাড়িখানি যেরূপ বেগে যাইতেছিল, তাহাতে আমার বড় ভাল বলিয়া বোধ হইল না। কিন্তু কি করিব, অনাথনাথের সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া কোন কার্য্য করিতে পারিতেছি না। 

কি করিব চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে অনাথনাথ দৌড়িয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “বিমলা কোথায় গেল?” আ। কেন, তিনি ত এইমাত্র বাড়ী গিয়াছেন। আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? 

অ। সুশীলবাবুর সহিত কথা কহিতেছিলাম। যাহা শুনিলাম, তাহাতে স্তম্ভিত হইয়াছি। 

আ। কি শুনিলেন? 

অ। তিনি বলিলেন, আমার শ্বশুর মহাশয় এখনও জীবিত আছেন! 

আ। তিনি কোথায় বাস করিতেছেন? 

অ। সে কথা তিনি নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারিলেন না। অনুমানে বলিলেন, ফরাসডাঙ্গায় আছেন। 

আ। এ সংবাদে আপনি এত অস্থির হইতেছেন কেন? 

অ। কেন? বিমলা বোধ হয় ভয়ে সেইখানেই গিয়াছে। 

আ। আপনার স্ত্রী কি জানিতেন যে, তাঁহার পিতা জীবিত আছেন? 

অ। আমি জানিতাম, সে জানিত না। কিন্তু এখন দেখিতেছি, আমার সমস্তই ভ্রম। 

আমি বলিলাম “এখন আর সময় নষ্ট করিবার প্রয়োজন নাই। আপনি হাওড়া ষ্টেসনে গমন করুন। রাত্রি সাড়ে নয়টা বা সাড়ে দশটার ট্রেন পাইতে পারেন। আমি অন্যপথ দেখিতে দেখিতে যাইতেছি। আপনার স্ত্রী যে ভাবে গমন করিলেন, তাহাতে তিনি যে, বাড়ী ফিরিয়া গেলেন এমন বোধ হয় না।” 

অনাথনাথ কাঁদিয়াই আকুল হইলেন। আমি অনেক কষ্টে সান্ত্বনা করিয়া একখানি দ্রুতগামী গাড়ি ভাড়া করিয়া দিলাম। তিনি হাবড়া চলিয়া গেলেন। পরে আমি একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া গঙ্গাতীরে যাইলাম এবং প্রত্যেক ঘাট লক্ষ্য করিতে করিতে অগ্রসর হইলাম। 

কিছুদূর অগ্রসর হইলে পর আমি যখন রথতলার ঘাটে উপস্থিত হইলাম, তখন দেখিলাম, সেই গাড়িখানি ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া বিপরীত দিকে যাইতেছে। ঘাটের দিকে চাহিয়া দেখি, একখানা নৌকার উপর দুইজন স্ত্রীলোক দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। আমি তখন গাড়ির পশ্চাতে না যাইয়া ঘাটে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দূর হইতে আমায় দেখিতে পাইয়া বিমলা চীৎকার করিয়া মাঝিকে নৌকা ছাড়িয়া দিতে আজ্ঞা করিলেন। 

আমি সে আদেশ অগ্রাহ্য করিয়া বজ্রগম্ভীরস্বরে মাঝিকে অপেক্ষা করিতে আদেশ করিলাম। সে আমার কথা অমান্য করিতে সাহাস করিল না। আমিও সত্বর তাহাদের নিকট যাইয়া দাসীকে লক্ষ্য করিয়া বলিলাম “ছি ছি! ভদ্রমহিলা হইয়া এমন নীচ ব্যবহার ভাল দেখায় না। তোমরা এখনই নৌকা ছাড়িয়া উপরে উঠ এবং ওই গাড়িতে আরোহণ করিয়া বাড়ীতে ফিরিয়া যাও। নচেৎ আমি এখনই তোমাদের উভয়কেই পুলিসে গ্রেপ্তার করাইয়া দিব।” 

আমার কথায় দাসী কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু বিমলা তাহার মুখ চাপিয়া ধরিলেন এবং তখনই তাহার হাত ধরিয়া সেই গাড়ির উপর গিয়া উপবেশন করিলেন। আমি কোচবাক্সে উঠিয়া তখনই শিয়ালদহ গমন করিলাম। 

পথে অনাথনাথের সহিত দেখা হইল। তিনি হাবড়া স্টেসন হইতে অন্বেষণ করিয়া ফিরিতেছিলেন। আমি তাঁহাকে তখন সকল কথাই প্রকাশ করিলাম। পরে তাঁহাকেও গাড়িতে তুলিয়া তাঁহাদের বাড়ীতে গমন করিলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

অনাথনাথের বাড়ীতে উপস্থিত হইলে আমি প্রথমেই অবতরণ করিলাম। পরে কাহাকেও কোন কথা না বলিয়া সেই দাসীকে লইয়া এক নিভৃতস্থানে গমন করিলাম। দাসী চতুরা হইলেও আমাকে পুলিস-কর্ম্মচারী জানিতে পারিয়া অত্যন্ত ভীত হইল এবং আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া ভয়ে থর থর কাঁপিতে লাগিল। 

আমি মিষ্ট কথায় তাহাকে সন্তুষ্ট করিলাম। বলিলাম, যদি সে আমার নিকট সমস্ত কথা প্রকাশ করে, তাহা হইলে আমি তাহাকে ছাড়িয়া দিব। আমার কথায় সম্মতা হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “কে তোমাকে এখানে পাঠাইয়াছেন?” 

দা। আজ্ঞে—অনাথবাবুর শ্বশুর 

আ। তিনি ত বহুদিন হইল মারা পড়িয়াছেন? 

দা। আজ্ঞে না—সে সংবাদ সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

আ। তুমি কতদিন তাঁহার নিকট কার্য্য করিতেছ? 

দা। আজ্ঞে প্রায় একবৎসর। 

আ। এতদিন বিমলাকে লইয়া যাইতে চেষ্টা কর নাই কেন? 

দা। আমি দাসী মাত্র— যেমন হুকুম পাইব তেমনই কার্য্য করিব। এতদিন তিনিও আমায় কোন কথা বলেন নাই, আমিও আসি নাই। 

আ। অনাথনাথের শ্বশুর মহাশয় কোথায় সম্প্রতি বাস করিতেছেন? 

দা। চন্দননগরে। 

আ। আমাকে লইয়া যাইতে পার? 

দাসী কোন উত্তর করিল না দেখিয়া আমি পুনরায় ওই প্রশ্ন করিলাম। দাসী বলিল “না মহাশয়! আজ তিনি এইখানেই আছেন, আমার মনে ছিল না।” 

আমি হাসিয়া উঠিলাম। পরে বলিলাম, “বেশ কথা, আমাকে তাঁহার নিকট লইয়া চল।” 

দা। তিনি সেই নৌকাতেই ছিলেন। যদি নৌকাখানি ঘাট ছাড়িয়া না গিয়া থাকে, তাহা হইলে তিনি এখনও তথায় আছেন। আপনার ইচ্ছা হয় চলুন–গাড়িখানি এখনও যায় নাই। 

দ্বিরুক্তি না করিয়া দাসীকে লইয়া আবার আমি সেই গাড়িতে উঠিলাম এবং অনাথনাথকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে বলিয়া কোচম্যানকে শকট চালনা করিতে আদেশ করিলাম। অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যেই আমরা ঘাটে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সৌভাগ্যক্রমে নৌকাখানি তখনও ঘাটে বাঁধা ছিল। আমি দাসীকে লইয়া একেবারে নৌকার ভিতরে গিয়া পড়িলাম। 

মাঝি মাল্লাগণ গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত ছিল। সুতরাং তাহারা আমাকে দেখিতে পাইল না। নৌকার ভিতরে অনাথবাবুর শ্বশুরও নিদ্রিত ছিলেন। দাসী তাঁহার নিকট গিয়া তাঁহাকে জাগ্রত করিয়া সকল কথা প্রকাশ করিল। 

দাসীর মুখে সকল কথা শুনিয়া তিনি স্তম্ভিত হইলেন এবং দাসীকে অজস্র গালি বর্ষণ করিতে লাগিলেন। আমি আর স্থির থাকিতে না পারিয়া তখনই তাঁহার নিকটে গমন করিলাম। পরে বলিলাম “দাসীকে গালি দিলে কোন ফল হইবে না। উহার কোন অপরাধ নাই, আমাদের সকলের চক্ষে ধূলি দিয়া বিমলাকে এখান হইতে লইয়া যাওয়া সামান্য দাসীর কর্ম্ম নহে। এখন আপনি বাহিরে আসুন এবং আমার সঙ্গে আপনার জামাতার নিকটে চলুন।” 

আমার কথায় তিনি ভয়ানক রাগান্বিত হইলেন। বলিলেন “আমি এমন কোন অন্যায় কার্য্য করি নাই, যাহাতে আপনার সঙ্গে যাইব।”

আমি হাসিয়া উঠিলাম। পরে বলিলাম “আপনি যে কার্য্য করিয়াছেন, তাহাতে আপনাকে তিন বৎসর কারাদণ্ড ভোগ করিতে হইবে।” 

বিমলার পিতা বলিলেন “আইন কানুন আমাদেরও জানা আছে। আমি অপর কোন বালিকাকে চুরি করি নাই, আমারই কন্যাকে আমার বাড়ীতে লইয়া যাইতেছিলাম।” 

আ। কাহারও অনুমতি লইয়াছিলেন? 

বি-পি। প্রয়োজন হয় নাই। 

আ। সে কি! বিমলার স্বামী বর্ত্তমান; তাঁহার অনুমতি ভিন্ন তাহাকে কোথাও লইয়া যাইতে পারেন না। তাহার উপর আপনাকে মৃত বলিয়া রাষ্ট্র করিয়াছেন, সে জন্য আপনাকে বিলক্ষণ শাস্তি পাইতে হইবে। আপনি এখন কাহার সহিত কথা বলিতেছেন তাহা জানেন? 

আমার কথা শুনিয়া বিমলার পিতা অনেকটা নরম হইলেন। তিনি সহসা কোন উত্তর করিলেন না। কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, “বড় সাধ করিয়া আসিয়াছিলাম আজ রাত্রে কন্যার মুখচন্দ্রিমা দর্শন করিব, কিন্তু আপনি যিনিই হউন–আমার সে সাধে বাদ সাধিলেন। এত ষড়যন্ত্র, এত পরামর্শ, এত কাণ্ড সমস্ত পণ্ড করিলেন। বলুন দেখি, আপনার কি অপকার করিয়াছি?” 

কথাগুলি কর্কশ হইলেও তিনি যে ভাবে বলিলেন, তাহাতে আমার বড় কষ্ট হইল, মনে কেমন দয়ার উদয় হইল। বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম “মহাশয়। কন্যার মুখ দেখিবার জন্য এত ব্যস্ত কেন? আপনার দুই পুত্র ত আপনারই সঙ্গে বাস করিতেছেন।” 

আমি অবশ্য না জানিয়াই ওই কথা বলিয়াছিলাম। তিনি আমার কথা শুনিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন “আজ্ঞে তাহা হইলে কি আজ আমার এমন দুর্দশা হয়! বৌদ্ধেরা তাহাদিগকে অনশনে রাখিয়া বোধ হয় হত্যা করিয়াছে। অনেক দিন হইল, তাহাদের মুখ দেখি নাই। এ জনমে আমার প্রাণের পুতলিগণকে কি আর দেখিতে পাইব? বোধহয় সে আশা নাই।” 

আমি নম্রস্বরে বলিলাম “এখন আমার সঙ্গে চলুন, অনাথনাথের বাড়ীতে যাইলেই আপনার কন্যাকে আবার দেখিতে পাইবেন।”

এবার বৃদ্ধ সম্মত হইলেন। একত্রে গাড়িতে উঠিয়া তখনই অনাথনাথের বাড়ীতে ফিরিয়া যাইলাম। অনাথনাথ ও বিমলা উভয়েই তাঁহাকে দেখিয়া পরম সন্তুষ্ট হইলেন। 

কিয়ৎক্ষণ পরে আমি বৃদ্ধকে কোন নিভৃতস্থানে লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “বৌদ্ধেরা কেন আপনার উপর উপদ্রব করিয়াছিল?” 

বৃদ্ধ প্রথমে আমার কথায় উত্তর দিতে ইচ্ছা করেন নাই। অবশেষে কিছুক্ষণ ভাবিয়া বলিলেন “তাঁহাদের মঠের জমীতে শূকর প্রতিপালন করিয়াছিলাম বলিয়াই আমার উপর তাঁহাদের জাতক্রোধ।” 

আ। যখন আপনি প্রথমে ওই কার্য্য আরম্ভ করেন, তখন কি তাঁহারা জানিতে পারেন নাই? 

বৃ। পারিয়াছিলেন বৈ কি! 

আ। তবে সে সময় কি তাঁহারা আপনাকে কোন কথা বলেন নাই? 

বৃ। আজ্ঞে হাঁ-উপর্যুপরি আটখানি পত্র লিখিয়া আমাকে বারম্বার নিষেধ করিয়াছিলেন। 

আ। আপনি গ্রাহ্য করেন নাই কেন? 

বৃ। তখন শূকরের ব্যবসায়ে আমার বিলক্ষণ লাভ হইতেছিল। বিমলার কাছে যে সেণার শূকর আছে, উহা এখানকার প্রস্তুত নহে—বিলাত হইতে আনীত। ওই নমুনা দেখিয়া আমি দুই জোড়া শূকর বাকিংহাম হইতে আনয়ন করি। তাহা হইতেই ক্রমে সহস্রাধিক শূকর হইয়াছিল। কাজেই বৌদ্ধদিগের কথায় কর্ণপাত করি নাই। 

আ। তাহার পর বৌদ্ধেরা কি করিলেন? 

বৃ। তাঁহারা লিখিলেন, যদি আমি ওই ব্যবসায় ত্যাগ না করি, তাহা হইলে আমার ও আমার বংশীয় যাবতীয় পুরুষের প্রাণসংহার করিবেন। আমি তখনও বিশেষ গ্রাহ্য করি নাই। কিন্তু ক্রমে বাড়াবাড়ি আরম্ভ হইল। কে যেন সদাই আমার পাছু পাছু ঘুরিতে লাগিল, কিন্তু আমি কোনরূপে ধরিতে পারিতাম না। ক্রমে উপদ্রব এত বাড়িয়া উঠিল যে, আমি এখান হইতে পশ্চিমে পলায়ন করি।” 

আ। আপনার পুত্র দুইটি কোথায় ছিল? 

বৃ। তাহারা আমার কাছে না; তখন মাতুলালয়ে ছিল। দুর্বৃত্তেরা বাছাদিগকে সেখান হইতে আমার নাম করিয়া ভুলাইয়া লইয়া যায়। সেই অবধি আর তাহাদিগকে দেখি নাই। এতদিন কি তাহারা আর জীবিত আছে? 

আ। সে কতদিনের কথা? 

বৃ। প্রায় বার তের বৎসর। 

আ। পশ্চিমে যাইবার সময় আপনার কন্যা কোথায় ছিলেন? 

বৃ। আমারই সঙ্গে। বৌদ্ধেরা ক্রমে সেখানেও আমার সন্ধান পাইল। সন্দেহ হইবামাত্র আমি পুনরায় চন্দননগরে আগমন করিলাম। কিন্তু সেখানে বাস করিলাম না। এলাহাবাদে আমার সম্পর্কে এক ভগ্নীর একখানি দ্বিতল অট্টালিকা আছে। সেই বাড়ীতেই অধিকাংশ সময় বাস করিয়া থাকি। কখনও তাঁহার সহিত তীর্থেও যাই, কিন্তু সর্বদাই সাবধানে থাকিতে হয়। 

আ। আপনি মারা গিয়াছেন বলিয়া সহরময় রাষ্ট্র করিলেন কেন? 

বৃ। নতুবা দস্যুগণের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাই না। আমার কয়েকজন বন্ধুই ষড়যন্ত্র করিয়া এ কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছিল। তাঁহারা এ কার্য্যের ভার না লইলে আমি কখনও পলাইতে পারিতাম না। তাঁহারা অগ্রে আমাকে রেলগাড়িতে তুলিয়া . দিলেন। পরে সেইদিন রাত্রেই একটা মিথ্যা জনরব রাষ্ট্র করিলেন, আমি মারা গিয়াছি। ক্রমে সেখানকার সকলেই আমার মৃত্যু সংবাদ জানিতে পারিল। বিমলার ক্রন্দনে এবং আমার সমস্ত বিষয় আশয় বিক্রয় হওয়াতেই সকলেই সে মৃত্যু-সংবাদ বিশ্বাস করিল; কাহারও অণুমাত্র সন্দেহ হইল না। 

প্রায় একমাস হইল সহসা একদিন ইচ্ছা হইল, যখন আমি জীবিত আছি, তখন বিমলাকে পত্র লিখিয়া সমস্ত কথা জানাই। এই ভাবিয়া তাহাই করিলাম। কন্যা আমার সংবাদ পাইয়া আমার নিকট আসিবার কথা বলিল। 

বাধা দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “পত্র দেখিয়াই বিমলা আপনাকে চিনিতে পারিল? তাহার এতদিনের বিশ্বাস একেবারে নষ্ট হইয়া গেল?” 

বৃদ্ধ হাসিলেন। তিনি বলিলেন “আপনারা পুলিসের লোক, জেরা ভিন্ন কাজ করেন না। কিন্তু এখানে তাহা চলিবে না। আমার হাতের লেখা অতি অদ্ভুত, দেখিতে পারসি অক্ষরের মত কিন্তু প্রকৃত বাঙ্গালা অক্ষর। বিমলা আমার হাতের লেখা বিশেষ চিনিত এবং পড়িতে পারিত। সকলে আমার লেখা পড়িতে পারে না। 

আ। আপনার কন্যা কেন আপনার নিকট যাইতে চাহিয়াছিল। দেখিবার সাধ থাকিলে আপনাকেই আসিতে লিখিতে পারিতেন? 

বৃ। কন্যার পত্রে জানিলাম, তাহার বিবাহ হইয়া গিয়াছে। তাহাব স্বামী তাহাকে মৌখিক ভালবাসা দেখায়, কি তাহার ভালবাসা প্রকৃত, তাহাই জানিবার জন্য সে আমাকে মৃত জানাইতে ইচ্ছা করিয়াছিল, কিন্তু আপনাদের কৌশলে সমস্তই ব্যর্থ হইল। 

আ। সাঙ্কেতিক পত্রাদিও কি আপনারই মস্তিষ্ক হইতে উদ্ভুত? 

বৃদ্ধ হাসিলেন। কোন কথা বলিলেন না দেখিয়া আমি তাঁহাকে লইয়া সকলের সমক্ষে গমন করিলাম এবং অনাথনাথকে বলিলাম “আপনার স্ত্রী সমস্তই মিথ্যা বলিয়াছিলেন। তিনিই এই চাতুরী করিয়া, এই প্রকার কৌশল করিয়া নিজের পিতার নিকট পলায়ন করিতেছিলেন।” 

অনাথনাথ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “কেন তিনি এমন কার্য্য করিলেন? আমি ত তাঁহার সহিত কোনপ্রকার অন্যায় ব্যবহার করি নাই?” 

আ। সে কথা তাঁহাকেই জিজ্ঞাসা করুন। কি অভিপ্রায়ে যে তিনি এত চাতুরী করিলেন, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু এ কথা বলিতে পারি যে, তিনি সম্প্রতি জানিতে পারিয়াছিলেন, তাঁহার পিতা এখনও জীবিত আছেন। 

অ। কেমন করিয়া জানিলেন? 

আ। আপনার শ্বশুর মহাশয়ের পত্র পাঠ করিয়া জানিয়াছেন। দাসীকে আপনার শ্বশুর মহাশয়ই এখানে পাঠাইয়া দিয়াছেন। 

অ। কেন? 

আ। কন্যাকে লইয়া যাইবার জন্য। 

অ। এখানে আসিয়া ত তিনি দেখিতে পারিতেন? 

আ। কেমন করিয়া পারিবেন? আপনারা সকলেই জানেন, তিনি মারা পড়িয়াছেন। এ সময়ে তাঁহাকে সশরীরে দেখিলে নিশ্চয়ই আপনাদের সকলের ভয় হইত। সেই জন্যই তিনি প্রথমে ওই লোককে পাঠাইয়া দিয়া নিজে নৌকার ভিতর লুকাইয়া ছিলেন। দাসীর মুখে ওই কথা শুনিয়া আমি পুনরায় ঘাটে গিয়াছিলাম। নতুবা আপনার শ্বশুর মহাশয়কে কি এখানে আনিতে পারিতাম? 

অ। বিমলা ত আমাকে সকল কথা বলিয়া যাইতে পারিত? তাহা হইলে আমিই তাহাকে সেখানে লইয়া যাইতে পারিতাম। এ চাতুরীর প্রয়োজন কি? সেই সাঙ্কেতিক পত্রখানিই বা কোথা হইতে আসিল? 

আ। সে সমস্তই আপনার শ্বশুরের স্বকপোলকল্পিত, কন্যার নিকট পত্রদ্বারা ব্যাখ্যাত। আপনার স্ত্রীর প্ররোচনায় তিনি ওই সকল ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন। 

অ। কি ভয়ানক! নিজে ওই সকল কাণ্ড করিয়া নিজেই কাঁদিত! এমন অদ্ভুত কথা ত আর কখনও শুনি নাই! আ। আপনিই তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করুন। 

অ। কিন্তু আপনি কেমন করিয়া জানিলেন যে, বিমলা পলায়ন করিতেছে। 

আ। সেদিন থানা হইতে ফিরিয়া যাইবার সময় যখন দ্বিতীয় পত্রখানি ঘাসের থলিয়ার ভিতর হইতে বাহির হয়, সেইদিন আমি স্বচক্ষে আপনার স্ত্রীর কার্য্য দেখিয়াছি। 

অ। কি? 

আ। পত্রখানি অগ্রে তিনি নিজেই সেই থলির ভিতর রাখিয়া দেন। কোচম্যান যখন ঘাস রাখিতে যায়, তখন বাহির করে। আমার কথা বিশ্বাস না হয় আপনার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। 

অনাথনাথকে আর জিজ্ঞাসা করিতে হইল না। বিমলা লজ্জা ত্যাগ করিয়া গললগ্নীকৃতবাসে আমার পদতলে আসিয়া পড়িলেন এবং সকল কথাই স্বীকার করিলেন। তাঁহার কথা শুনিয়া আমি বলিলাম “অনাথবাবু আপনাকে কোন কথা বলিবেন না, আপনার উপর কিছুতেই বিরক্ত হইবেন না, ঠিক পূর্ব্বের মতই সদ্ব্যবহার করিবেন। কিন্তু কেন আপনি এত চাতুরী করিলেন তাহা বলিতে হইবে।” 

বিমলা অনেকক্ষণ কোন উত্তর করিলেন না। পরে আমার নির্ব্বন্ধাতিশয় দর্শনে বলিলেন, “আজ আপনি আমার পিতার স্বরূপ, আপনার নিকট কোন কথা গোপন করিব না। আমার স্বামী আমাকে অত্যন্ত ভালবাসেন, তাঁহার সেই ভালবাসা মৌখিক কি আন্তরিক তাহাই জানিবার জন্য আমি এত কাণ্ড করিয়াছি। আমার অপরাধ হইয়াছে-আমায় ক্ষমা করুন, আমি আর কখনও এমন কার্য্য করিব না।” 

আমি হাসিতে লাগিলাম। পরে বলিলাম “নামা! তোমার কোন চিন্তা নাই। অনাথবাবু তোমাকে যেমন ভালবাসেন, এমন ভালবাসা অতি অল্প লোকেরই দেখিয়াছি। 

সম্পূর্ণ 

[ শ্রাবণ, ১৩১৬ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *