লীসিস
চরিত্রাবলি
সক্রেটিস- কথক
মেনেক্সেনাস
হিপোথ্যালিস
লীসিস
সিসিপাস
স্থান
এথেন্সের প্রাচীরের বহির্ভাগে নব-নির্মিত ক্রীড়াগার।
.
একাডেমী পরিত্যাগ করে আমি সোজা শিক্ষাগারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। প্রাচীর সংলগ্ন বহির্ভাগের রাস্তায় এসে ওঠাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। শহরের খিড়কিদ্বার অবধি যখন পৌঁছেছি তখন আমার সম্মুখে হিরোনিমাসের পুত্র হিপোথ্যালিস এবং পিনীয়বাসী সিসিপাসকে আমি দেখতে পেলাম। তাদের দুজনকে ঘিরে তখন একদল যুবকও রাস্তার উপর দাঁড়িয়েছিল। আমাকে অগ্রসর হতে দেখে হিপোথ্যালিস জানতে চাইল আমি কোথা হতে আসছি এবং কোথায় যেতে চাচ্ছি।
আমি বললাম : একাডেমী থেকে সোজা শিক্ষাগারের দিকেই আমি যেতে চাচ্ছি। আমার কথা শুনে হিপোথ্যালিস বলল : তার চেয়ে বরঞ্চ আপনি আমাদের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য অপেক্ষা করুন।
আমি বললাম : তুমি কে? এবং কোথায়ই বা আমি যাব।
সে আমাকে একটি প্রচীরঘেরা স্থান এবং তার দেওয়ালে স্থাপিত একটি প্রবেশদ্বার দেখিয়ে বলল; আমরা এই দালানটিতেই সাধারণত সমবেত হই। আপনি আসুন। আপনি অবশ্যই একটি সৎসঙ্গের সাক্ষাৎ পাবেন।
আমি বললাম; কিন্তু এটি কিসের বাড়ি? এবং তোমরা কি আমোদ-প্রমোদেই সময় ব্যয় কর?
আমার প্রশ্নের জবাবে যুবক হিপোথ্যালিস বলল : এটি হচ্ছে নবনির্মিত কুস্তিশালা। আমাদের আমোদ-প্রমোদ সাধারণত তর্কবিতর্কে সীমাবদ্ধ থাকে। আপনি এ আলোচনাতে যোগদান করলে আমরা বিশেষ সুখী হবো।
আমি বললাম; তোমার কথা শুনে আমি খুশি হলাম। আশা করি তোমাদের জন্য একজন শিক্ষকও রয়েছেন।
সে বলল : হ্যাঁ, আমাদের শিক্ষাদাতা হচ্ছেন আপনারই গুণমুগ্ধ মিকাস।
আমি বললাম : এ তো অত্যন্ত ভালো কথা। মিকাস অবশ্যই একজন প্রখ্যাত অধ্যাপক।
আপনি তা হলে আমাদের সঙ্গে আসুন। সবার সাথেই আপনার সাক্ষাৎ হবে।
বেশ চল, আমি যাচ্ছি। কিন্তু প্রথমে আমাকে বল, সেখানে গিয়ে আমাকে কী করতে হবে এবং তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়ই বা কে?
প্রাজ্ঞ সক্রেটিস, আমাদের সবার কোনো একজনই মাত্র প্রিয় নয়। কিছু সংখ্যকের হয়তো একজন প্রিয়। অপর কিছু সংখ্যকের প্রিয় হচ্ছে অপর কোনো জন।
বেশ, বেশ! আচ্ছা হিপোথ্যালিস, তোমার প্রিয় পাত্রটি কে?
আমার প্রশ্ন শুনে যুবক হিপোথ্যালিস লজ্জায় রক্তরাঙা হয়ে উঠল। তাকে লজ্জা থেকে বাঁচাবার জন্য আমি বললাম; হিরোনামাসের পুত্র হিপোথ্যালিস। থাক, আর নাম বলে তোমায় জবাব দিতে হবে না। তোমার রক্তিম গণ্ডদ্বয়ই আমায় বলে দিচ্ছে তুমি শুধু প্রেমেই পড় নি প্রিয়র জন্য তোমার প্রেম সুগভীরও বটে। সাদামাটা মূর্খ মানুষ আমি। তথাপি বিধাতা আমাকে অন্তত তোমাদের মায়ামমতাকে অনুভব করার ক্ষমতা দিয়েছেন।
আমার একথায় তরুণের মুখমণ্ডল অধিকতর রক্তরাঙা হয়ে উঠল। এমন সময়ে সিসিপাস বলে উঠল; হিপোথ্যালিস, তোমার লজ্জারুণ গণ্ড এবং তোমার প্রিয়পাত্রটির নাম উচ্চারণে ইতস্ততা দেখতে আমার খুবই ভালো লাগে। অথচ সক্রেটিসের নিকট তুমি যে নামটি উচ্চারণ করতে আরক্ত হয়ে উঠছ তাকে মুহূর্তের জন্য কাছে পেলে অর্থহীন প্রেমের কথায় তাকে উদ্ব্যস্ত করে তুলতে।
তৎপর আমাকে লক্ষ্য করে সিসিপাস বলল : বস্তুত সক্রেটিস, সে তার লীসিসের গুণকীর্তন করে করে আমাদের কান প্রায় বধির করে এনেছে। এবং এই গতিতে অগ্রসর হলে আমাদের নিদ্রাও হয়তো ‘লীসিস’ আর্তধ্বনিতে টুটে যাবে। হিপোথ্যালিসের আবেগ প্রকাশের ভাষারও তুলনা নেই। তার গদ্যই সহ্য করা দায়। কিন্তু তার কবিতার নিকট সে গদ্য দাঁড়াতেই পারে না। তার সেই সমস্ত আবেগের প্রকাশ ও কবিতার ঝড় যখন আমাদের উপর আঘাত হানতে থাকে, তখন আর পালাবার পথ পাইনে। কিন্তু সবার বাড়া হচ্ছে হিপোথ্যালিসের প্রেমসঙ্গীত। আর তার কণ্ঠের জোর? সে দুর্বিরোধ্য, ভয়ঙ্কর। আর এখন তার অবস্থা দেখ, সক্রেটিস। তোমার একটি প্রশ্নে বীর প্রেমিক কিরূপ লজ্জারাঙা হয়ে উঠেছে।
আমি বললাম : কিন্তু লীসিস কে? নিশ্চয় সে বয়সে বেশ তরুণ। কারণ আমার স্মরণে তো এমন কোনো নাম খুঁজে পাচ্ছিনে।
সিসিপাস বলল : হ্যাঁ, সে বয়সে তরুণ নিশ্চয়। এ নাম তার পৈতৃক নাম। তার পিতা একজন প্রখ্যাত নাগরিক। কিন্তু লীসিস এখনও নিজের নামে পরিচিত হয়ে উঠে নি। তুমি তাকে নামে না চিনলেও নিশ্চয়ই তাকে দেখে থাকবে। কেননা অপর কিছু না হলেও তর মুখমণ্ডলের বৈশিষ্ট্য তাকে সবার মধ্যে বিশিষ্ট করে তোলে।
আমি বললাম : কিন্তু কার পুত্র সে?
ডিমোক্রাটিসের জ্যেষ্ঠপুত্র সে।
আমি বললাম : আহা! তরুণ হিপোথ্যালিস। তুমি সত্যই এক মহৎ এবং সুন্দর প্রেমিকের সাক্ষাৎ পেয়েছ। এবার নিশ্চয় তুমি তোমার আরাধ্যকে একবার দেখাবে। তা হলেই আমি সম্যকভাবে বুঝতে সক্ষম হবো, তরুণ প্রেমিক নিজের নিকট বা অপর সবার নিকট আপন প্রেমাস্পদ সম্পর্কে সংগতভাবে মনের কী ভাব প্রকাশ করতে পারে।
এবার হিপোথ্যালিস নিজে বলল : পণ্ডিত সক্রেটিস! আপনি নিশ্চয়ই সিসিপাসের ভাষণকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করবেন না।
আমি বললাম : কিন্তু তরুণ, তুমি কি তা হলে চাও যে সিসিপাসের উল্লিখিত ব্যক্তিকে তুমি ভালবাস না?
সে বলল : না তা নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি অমনিভাবে তার উদ্দেশে কোনো গদ্য বা কাব্যকলা তৈরি করিনে।
দুষ্ট সিসিপাস বাধা দিয়ে বলল : না সক্রেটিস, একে বিশ্বাস কর না। ও বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। ও জানে না ও কী বলছে।
আমি বললাম : তরুণ হিপোথ্যালিস, তুমি সঙ্কোচ কর না। তোমার প্রিয়পাত্রের উদ্দেশে যদি তুমি কখনো বা কাব্য-গাথা রচনা করে থাক, আমি তা শুনতে চাইনে! তুমি আমাকে শুধু সেই রচনাসমূহের মূল কথাটি বল! তা হলেই তোমার প্রিয়পাত্রের প্রতি তোমার দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি সম্যকভাবে বুঝতে সক্ষম হবো।
এবার তরুণ হিপোথ্যালিস সিসিপাসকে আক্রমণ করে বলল : সিসিপাসের কানে যদি আমার কাব্যকলা রাত্রি-দিন গর্জনই করতে থাকে তা হলে সিসিপাসই অপনাকে তার মর্মার্থ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হবে।
অদম্য সিসিপাস বলে উঠল : অবশ্যই। আমি অতি উত্তমরূপেই হিপোথ্যালিসের কাব্য-গাথাকে জানি। আর সে জানার কাহিনীও খুব হাস্যস্পদ। কারণ, হিপপাথ্যালিস একজন প্রেমিক এবং একনিষ্ঠ প্রেমিকই বটে। কিন্তু তার প্রিয়পুত্রের নিকট শিশুর কাকলি ব্যতীত অপর কিছুই আর বলার থাকে না। হিপোথ্যালিস তার প্রেমাস্পদের কানে কেবল গুনগুনিয়ে তার পিতা ডিমোক্রাটিসের নগরখ্যাত ধন-সম্পদের কথা এবং পিতামহ লীসিস এবং অপরাপর পিতৃপুরুষদের গুণাবলির কথা বলতে থাকে। আর বলে তাদের পালের অশ্বের কথা। পিথিয়া, ইজমাস বা নিমিয়া প্রতিযোগিতায় তাদের জয়লাভের কাহিনী নিয়ে সে কাব্যরচনা করে তার প্রেমাস্পদকে উপহার দেয়। এর চেয়ে হাস্যোদ্দীপক আর কি হতে পারে? তথাপি এর চেয়েও শিশুসুলভ প্রগলভতা তার প্রকাশ পেয়েছে গত পরশুদিন। সেদিন সে তাদের বংশের সঙ্গে সম্পর্কিত হিরাক্লিসের বন্দনা নামে এক কবিতা রচনা করেছে। এই কবিতায় সে প্রকাশ করেছে, কীভাবে এই সম্পর্কের জন্যই লীসিসের জনৈক পিতপুরুষ দ্বারা সে অভ্যর্থিত হয়েছিল। এই পিতৃপুরুষ নাকি ছিলেন দেবরাজ জিউস-জাত। স্ত্রীসুলভ এই কাহিনীই হিপোথ্যালিস ‘গানের সুরে এবং কবিতার আবৃত্তিতে আমাদের কর্ণকুহরে ঢেলে দেয় এবং তাই আমাদের শ্রবণ করতে হয়। কী সৌভাগ্য।
আমি বললাম : বৎস হিপোথ্যালিস! বিজয়লাভের পূর্বেই বিজয়ের আত্মপ্রসাদের স্তবগান কি সঙ্গত?
হিপোথ্যালিস বলল : কিন্তু প্রাজ্ঞ, আমার কবিতা বা গান তো আত্মপ্রশংসার গীত নয়।
তুমি তা মনে কর না?
না, অবশ্যই নয়। কিন্তু এ তো আমার অভিমত। আপনি কী অভিমত পোষণ করেন? আমি কিন্তু তাই মনে করি হিপোথ্যালিস। এসব গানই তোমার আত্মপ্রশংসার গীত। কেননা তুমি যদি তোমার সুন্দরকে লাভ করতে পারে, তা হলে এ-গান তোমার আপন গৌরব-গাথা বলেই বিবেচিত হবে। সবাই বলবে, এ তো বিজয়ীর সম্মানে গীত সংগীত। অপরদিকে তোমার সুন্দর যদি তোমার নিকট ধরা না দেয় এবং যদি তুমি তার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হও তা হলে তোমার প্রেমাস্পদকে উদ্দেশ করে গীত সংগীত তা তোমাকেই অধিকতর হাস্যাস্পদ করে তুলবে। এজন্যই জ্ঞানী প্রেমিক প্রেমাস্পদকে লাভ করার পূর্বে তার প্রশংসায় মুখর হয়ে ওঠে না। কেননা আপন অন্তরে হারাবার আশঙ্কায় সে ভীত। অপর একটি বিপদের কথাও চিন্তা করে দেখ : তুমি যদি তোমার সুন্দরকে প্রশংসার চূড়ায় স্থাপন কর তা হলে অহঙ্কার ও দম্ভ তার আত্মাকে বিনষ্ট করে দেবে। একথা কি স্বীকার কর না?
হ্যাঁ একথা সত্য।
এবং যত সে দম্ভী হয়ে উঠবে তত সে তোমার আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে।
আমি তাই বিশ্বাস করি।
তাই যদি হয়, তা হলে যে শিকারি তার শিকারকে ভীতসন্ত্রস্ত করে আপন মৃগয়াকেই অসাধ্য করে তোলে তার সম্বন্ধে তুমি কি বলবে?
সে অবশ্যই ব্যর্থ শিকারি।
ঠিক তাই। এবং সে যদি সংগীত ও শব্দের মহড়া দ্বারা শিকারকে উত্তেজিত করে। তোলে নিশ্চয় তুমি তাকে বুদ্ধিহীন বলেই আখ্যায়িত করবে। তাই নয় কি?
হ্যাঁ, তাই বটে।
হিপোথ্যালিস, এবার তা হলে চিন্তা করে দেখ, তোমার-কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে এরূপ কোনো ত্রুটি ঘটেছে। কেননা, যে কবি কাব্যচর্চার দ্বারা নিজেরই অনিষ্ট সাধন করে, তাকে নিশ্চয়ই তুমি উঁচুদরের কবি বলে স্বীকার করবে না।
সে তো নিশ্চয়ই। প্রাজ্ঞ সক্রেটিস। এরূপ কবি বুদ্ধিহীন বলেই বিবেচিত হবে। এবং আপনার এরূপ উপদেশের জন্যই আমি আপনাকে সব কথা খুলে বলতে চাই। আপনি আমায় অপর যে-কোনো উপদেশ দিবেন আমি তাইও আনন্দের সাথে গ্রহণ করব। আপনি আমাকে দয়া করে বলুন কিরূপ প্রকাশ বা কার্য দ্বারা আমি আমার প্রিয়পাত্রের নিকট প্রিয় হয়ে উঠতে পারি।
এ বড় কঠিন কাজ বৎস। তথাপি তুমি যদি তোমার প্রেমাস্পদকে আমার নিকট নিয়ে আসতে পারে এবং আমাকে যদি তার সঙ্গে আলাপ করতে দাও তা হলে আমি তোমাকে বলে দিতে পারব, তোমার এই সংগীতালাপ বা কাব্যচর্চার বদলে কীভাবে তোমার প্রিয়পাত্রের সহিত বাক্যালাপ করা সংগত।
আমার কথার জবাবে হিপোথ্যালিস বলল : আপনি দয়া করে যদি সিসিপাসের সঙ্গে এসে ক্রীড়ামঞ্চে আমাদের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য আসন গ্রহণ করেন এবং কিছু আলোচনা করেন তা হলে আর ওকে সেখানে নিয়ে আসাতে অসুবিধা হবে না। তা হলে সে নিজেই চলে আসবে। আলোচনা শুনতে সে বিশেষ পছন্দও করে। তা ছাড়া এখন হারমিয়া উৎসব চলছে। এই উৎসবকালে যুবক ও তরুণগণ পরস্পর একসঙ্গেই থাকে। সাধারণত তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয় না। সুতরাং সে নিশ্চয়ই এখানে আসবে। কিন্তু যদি সে আলোচনা-সভাতে নাও আসে তা হলেও সিসিপাসের সঙ্গে তার যেরূপ পরিচয় এবং সিসিপাস যখন মেনেক্সেনাসের আত্মীয়, তখন সিসিপাস ডেকে পাঠালে অবশ্যই আসবে।
আমি বললাম; বেশ বেশ, তাই হবে।
একথা বলে আমি সিসিপাসকে নিয়ে ক্রীড়ামঞ্চের দিকে অগ্রসর হলাম। অপর সঙ্গীগণও আমাদের অনুসরণ করল।
উৎসবভূমিতে উপস্থিত হয়ে দেখলাম, ছেলেরা বলিদানের অনুষ্ঠান প্রায় সমাপ্ত করে এনেছে। শুভ্র পরিচ্ছদে ভূষিত হয়ে তারা তখন অক্ষক্রীড়ায় রত হয়েছে। সমবেত তরুণদের অধিকাংশই বহিরাঙ্গনে আনন্দ বিনোদনে ব্যস্ত ছিল। আর কিছু সংখ্যক সভাকক্ষের এককোণে খুঁটি দিয়ে জোড়-বেজোড় খেলছিল। অনেকে আবার দর্শক হয়ে উপভোগ করছিল। এদের মধ্যে লীসিস দাঁড়িয়েছিল। তার মাথায় একটি মুকুট ছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সে একটি অপূর্ব সুন্দর ছায়া বিশেষ। তাকে দেখে একথা বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, সে তার অপর গুণাবলি ব্যতীত সৌন্দর্যের জন্যও কম প্রশংসার যোগ্য নয়। এদের অতিক্রম করে আমরা কক্ষের অপর পার্শ্বে শান্ত কোণে গিয়ে আসন নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ শুরু করলাম। এর ফলে লীসিসের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। সে বারংবার ঘাড় ফিরিয়ে আমাদের মধ্যে চলে আসতে চাচ্ছে। তথাপি সে ইতস্তত করল এবং সাহস সঞ্চয় করে আমাদের দিকে এগুতে পারল না। কিন্তু এবার দেখলাম মেনেক্সেনাস তার খেলা পরিত্যাগ করে বহিরাঙ্গন থেকে কুস্তিমঞ্চে এসে প্রবশে করল। সে আমাকে ও সিসিপাসকে দেখতে পেয়ে আমাদের পার্শ্বে এসে আসন গ্রহণ করার উদ্যোগ করল। এবার লীসিস মেনেক্সেনাসকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে তার পাশে বসে পড়ল। ক্রমান্বয়ে অপর সব ছেলে এসেও আমাদের সাথে যোগ দিল। আমি লক্ষ করলাম, হিপোথ্যালিস এদের সবাইকে দেখে ভিড়ের পেছনে আশ্রয় নিল। পাছে লীসিস তাকে দেখতে পায় এবং তার উপর বিরূপ হয় এই ভয়ে সে সবার পেছনে দাঁড়িয়ে আমাদের আলোচনা শুনতে লাগল।
আমি মেনেক্সেনাসের দিকে ফিরে তাকে লক্ষ্য করে বললাম : মেনেক্সেনাস, তোমাদের দুজনের মধ্যে কে বড়?
মেনেক্সেনাস বলল : সেটিই বিতর্কের বিষয়।
বেশ! কিন্তু দুজনার মধ্যে কে মহত্তর? এটিও কি বিতর্কের বিষয়?
এটি তো অধিকতর বিতর্কের বিষয়।
তা হলে কে বেশি সুন্দর এটি নিশ্চয়ই বিতর্কের তৃতীয় বিষয়? আমার কথা শুনে তরুণ দুটি এবার হেসে উঠল।
আমি বললাম : তোমাদের দুজনার মধ্যে কে অধিকতর ধনবান সে প্রশ্ন আমি করব না। কেননা, তোমরা নিশ্চিয়ই পরস্পরের বন্ধু।
অবশ্যই। তারা সমস্বরে জবাব দিল।
এবং একথা তো ঠিক যে, যারা প্রকৃত বন্ধু তাদের একে অপরের চেয়ে ধনবান হতে পারে না। কেননা, তাদের একের সম্পদই অপরের সম্পদ, তাই নয় কি?
আমার কথায় তারা সম্মতি জানাল। আমি প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, তাদের মধ্যে অধিকতর ন্যায়পরায়ণ কে এবং কে অধিকতর জ্ঞানী। কিন্তু এই সময়ে কে একজন এসে মেনেক্সেনাসকে সঙ্গে নিয়ে গেল, কেননা ক্রীড়াশিক্ষক তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমার মনে হলো তাকেও হয়তো বলিদানের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হবে। এবার আমি লীসিসকে আরো কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম। আমি বললাম : আমার বিশ্বাস, লীসিস, তোমার পিতামাতা নিশ্চয়ই তোমাকে খুবই ভালবাসেন?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
তারা নিশ্চয়ই তোমার সুখ কামনা করেন?
আজ্ঞে।
কিন্তু ধরা যাক, একজন দাসত্বের অবস্থায় রয়েছে, আপন ইচ্ছামতো সে কিছুই করতে সক্ষম নয়। তাকে কি তুমি সুখী বলবে?
লীসিস বলল, আমার বিবেচনায় সে নিশ্চয়ই সুখী নয়।
এবং তোমার পিতামাতা যদি তোমাকে ভালবাসেন এবং তোমার সুখ কামনা করেন, তা হলে নিঃসন্দেহে তোমার সুখ লাভেরই সব ব্যবস্থা করবেন।
নিশ্চয়ই।
তা হলে তারা কি তোমাকে তোমার আপন ইচ্ছামতো সব কাজ করতে দেন? কোনো কাজের জন্য তারা কি তোমাকে কটুবাক্য বলেন এবং কোনো কাজে বাধা প্রদান করেন?
প্রাজ্ঞ সক্রেটিস, আপনি যথার্থই বলেছেন। তারা আমার অনেক কাজেই বাধা প্রদান করেন।
এ কি বলছ? তারা তোমাকে সুখী দেখতে চান, তথাপি তোমার কাজে তারা বাধা প্রদান করেন? যেমন ধর, তুমি যদি তোমার পিতার কোনো রথে আরোহণ করতে চাও এবং প্রতিযোগিতার সময়ে রথের রশি গ্রহণ করতে চাও তা হলে তিনি কি তোমাকে সে কাজ করতে অনুমতি দিবেন, না তিনি তোমার কাজে বাধা প্রদান করবেন?
তাঁরা আমাকে কিছুতেই ও কাজ করতে দেবেন না।
রথ চালনার জন্য পিতার একজন বেতনভুক্ত সারথি রয়েছে।
তা হলে তোমার চেয়ে একটি ভূত্যের উপর তাঁরা অধিকতর আস্থা স্থাপন করেন? সে ভত্যকে এজন্যই তিনি পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন?
আজ্ঞে তাই।
কিন্তু নিশ্চয়ই তুমি অশ্বেতর জীবের শকটটা-কে চাবুক দ্বারা আপন ইচ্ছামতো যে কোনো দিকে পরিচালনা করতে পার? আমার বিশ্বাস তারা তোমাকে এ কাজে নিশ্চয়ই অনুমতি দিয়ে থাকেন।
আমাকে অনুমতি দিবেন না, তারা কিছুতেই আমাকে তা করতে দিবেন না।
কিন্তু কেউ কি অশ্বেতর জীবের উপর চাবুক চালনা করে না?
তা করে, কিন্তু সে তো অশ্বেতর জীবের চালক।
কিন্তু সে চালক কি দাস, না স্বাধীন নাগরিক?
সে একটি দাস।
তা হলে তুমি যে তাদের পুত্র তার চেয়ে তাদের নিকট একজন দাসের সম্মান অধিক? তোমার পিতামাতা তাদের বিষয়াদির ভার তোমার উপর ন্যস্ত না করে তার উপর ন্যস্ত করেন? এ ব্যাপারে যখন তার যে-কোনো কিছু করার অধিকার থাকে তখন তোমাকে তাঁর কোনো কিছু করা থেকেই নিবৃত্ত করেন। তা হলে বৎস। এবার তুমি বল তুমি নিজে তোমার প্রভু না, এ বিষয়েও তোমার কোনো অধিকার নেই?
না, প্রাজ্ঞ এতেও আমার কোনো অধিকার নেই। তারা আমায় এরূপ কোনো অনুমতি দেন না।
তা হলে তোমার অপর কোনো প্রভু রয়েছে?
হ্যাঁ, তিনি আমার শিক্ষক।
বেশ। কিন্তু সেও কি একজন দাস?
হ্যাঁ, সেও একজন দাস।
এটি তে বিস্ময়ের বিষয় যে, একজন স্বাধীন নাগরিক একজন দাস দ্বারা শাসিত হবে। তোমার ব্যাপারে এ দাসের কী করণীয়?
সে আমাকে আমার শিক্ষকমণ্ডলীর নিকট পৌঁছে দেয়।
আরো প্রভু? তুমি নিশ্চয় একথা বলছ না যে, শিক্ষকমণ্ডলীও তোমার উপর শাসন করেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ, তারাও আমাকে অবশ্যই শাসন করেন।
তা হলে দেখা যাচ্ছে, তোমার পিতা তোমার উপর শুধু একজন নয়–একাধিক প্রভুকে চাপিয়ে দিয়েছেন। সে থাক, কিন্তু তুমি যখন বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরে যাও তখন তোমার জননী নিশ্চয়ই তোমার সুখ ভোগে বাধা প্রদান করেন না? তিনি অবশ্যই তোমাকে তোমার ইচ্ছানুযায়ী সব কাজ করতে দেন। নিশ্চয়ই তার সূচীকর্মের জন্য রাখা উল বা বস্ত্রের খণ্ড তোমার হেফাজতে দিতে তিনি আপত্তি করেন না। এবং তার চিরুনি বা অপর কোনো বয়ন বস্তুকে নাড়াচাড়া করা থেকেও তোমাকে নিবৃত্ত করেন না?
লীসিস হেসে বলল : না, প্রাজ্ঞ সক্রেটিস, তিনি যে শুধু আপনার উল্লিখিত কোনো কিছুই আমাকে স্পর্শ করতে দেবেন না তাই নয়। তার কোনো দ্রব্যকে আমি স্পর্শ করলে তিনি আমাকে রীতিমতো প্রহার করবেন।
আমি বললাম : কী বলছ লীসিস? এ তো আশ্চর্যের কথা। তুমি কি তা হলে কখনো তোমার পিতামাতার প্রতি অসংগত ব্যবহার করেছ?
না, তা আমি করিনে।
তা হলে কেন তারা তোমাকে তোমার ইচ্ছানুরূপ কাজ করতে এত তীব্র উদ্বেগের সাথে বাধা প্রদান করেন এবং কেন তোমার সমস্ত সুখ থেকে তোমাকে বঞ্চিত রাখেন? বস্তুতপক্ষে এমন অবস্থায় তুমি তো সমগ্র দিনব্যাপী অপরের অধীনে শাসিত হও, ইচ্ছানুযায়ী কোনো কিছু করার অধিকারই তোমার নেই। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে তাঁদের সম্পদ তোমার নিকট মূল্যহীন। তাদের বিষয়াদি তোমার চেয়ে অপর কোনো ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন। তুমি তোমার প্রিয়কে নিয়ে কোনো কিছু করতে সমর্থ নও। তোমার প্রিয়পাত্রের পরিচর্যা করার অধিকার অপর কোনো ব্যক্তির–তোমার নয়। কাজে কাজেই লীসিস, তুমি দেখতে পাচ্ছ যে, তুমি নিজে কারও প্রভু নও এবং তোমার কোনোকিছু করার অধিকার নেই।
কিন্তু প্রাজ্ঞ, আমার তো সে বয়স হয় নি।
আমি বললাম : বয়সের প্রশ্নও সত্যকার কারণ বলে আমার বোধ হচ্ছে না। কারণ তোমার বয়সের অপেক্ষা না করেও নিশ্চয়ই তোমার পিতামাতা তোমাকে অনেক কাজ করার অধিকারও দিচ্ছেন : যেমন, যদি তাদের কোনো কিছু লিখবার বা পাঠ করাবার আবশ্যক হয়, তা হলে আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই তারা বাড়ির মধ্যে তোমাকেই সবার প্রথমে ডেকে পাঠান–তাই নয় কি?
আজ্ঞে, একথা সত্য।
তুমি নিশ্চয় তাঁদের পত্রাবলিকে যে-কোনো ধারায় পড়তে বা লিখতে পার; তুমি অবশ্যই বীণাটি তুলি নিয়ে তাতে সুর যোজনা করতে পার; কিংবা তোমার অঙ্গুলি দ্বারা গজদন্তের মেজরাপটি দিয়ে তারের মধ্যে ঝঙ্কার তুলতে পার–ও-সব ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তোমার জনক বা জননী কোনো বাধার সৃষ্টি করবেন না!
একথাও সত্য।
তা হলে লীসিস, আমাকে বুঝিয়ে বল, কেন তারা তোমাকে এক প্রকার কাজ করার অধিকার দিচ্ছেন, কিন্তু অন্য প্রকার কাজ করা থেকে তোমাকে নিবৃত্ত করছেন?
লীসিস বলল : আমার মনে হচ্ছে, আমি হয়তো এক প্রকার কাজ জানি, কিন্তু অন্য প্রকার কাজ আমি জানি না।
একথা ঠিক বৎস! কারণ তোমার বয়সের অল্পতা নয়, কারণ তোমার জ্ঞানের অল্পতা। সেজন্য যখনি তোমার পিতার বিবেচনায় তুমি তার চেয়ে অধিক জ্ঞানসম্পন্ন হবে, তখনি তিনি নিজের এবং সমস্ত সম্পদের ভার তোমার উপরই ন্যস্ত করবেন।
আমার তাই মনে হয়।
হ্যাঁ, তাই। এবং তোমার প্রতিবেশী সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য নয় কি? তিনি যদি মনে করেন যে গৃহাদি রক্ষণাবেক্ষণে তুমি অধিকতর পারদর্শী তা হলে তিনি নিজে তত্ত্বাবধান না করে তোমার ওপরই সে তত্ত্বাবধানের ভার ন্যস্ত করবেন–তাই নয় কি?
হ্যাঁ, আমার মনে হয় তিনি আমার উপরই সে ভার ন্যস্ত করবেন।
এবং এথেন্সবাসীগণও যখন দেখবে যে তাদের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করার মতো যথেষ্ট জ্ঞান তুমি অর্জন করেছ তখন তারা তাদের সব ব্যবস্থার ভারও তোমার উপরই অর্পণ করবে। নয় কি?
আজ্ঞে, হ্যাঁ।
বেশ, আমি একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। ধর, এক মহাপ্রতাপশালী সম্রাটের কথা। তার জ্যেষ্ঠপুত্রও রয়েছে। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র এশিয়ার রাজকুমার। মনে কর তুমি এবং আমি দুজনে গিয়ে সেই রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে প্রমাণ করলাম যে, আমরা রাজকুমারের চেয়ে রন্ধনশিল্পে অধিক পারদর্শী। তা হলে তিনি কি এশিয়ার রাজকুমারের পরিবর্তে আমাদের উপরই তার আহারাদি প্রস্তুতের অধিকার অর্পণ করবেন না এবং উনুনের উপর ফুটন্ত অবস্থায়ও পাত্ৰাদি নিয়ে আমাদের ইচ্ছামতো কাজ করতে দিবেন না?
স্পষ্টতই আমাদের উপর তিনি এ-ভার ন্যস্ত করবেন।
এবং সুপের মধ্যে আমরা মুঠো মুঠো লবণ দিলেও তিনি কিছু বলবেন না; কিন্তু তার পুত্র অঙ্গুলি পরিমাণ লবণ দিতে গেলেও তাকে সে কাজে বাধা দেওয়া হবে।
হ্যাঁ, অবশ্যই।
অথবা ধর, পুত্রের চক্ষু খারাপ হয়েছে। তা হলে সম্রাট যদি মনে করেন যে, তার পুত্রের ভেষজ-শাস্ত্রের কোনো জ্ঞান নেই, তিনি কি তাকে তার চক্ষুতে হাত লাগাতে দিবেন?
না, তিনি তাকে হাত লাগাতে দিবেন না।
কিন্তু সম্রাট যদি মনে করেন যে ভেষজ-শাস্ত্র সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান রয়েছে, তা হলে রাজকুমারের চোখ নিয়ে আমাদের যা ইচ্ছা তা করারই অনুমতি দিবেন। ইচ্ছা হলে আমরা তার চোখ খুলে ভস্মও ছিটিয়ে দিতে পারব। কেননা তিনি মনে করেন যে আমরা জানি, এক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থা উত্তম।
একথাও ঠিক।
অর্থাৎ যে-কোনো বিষয়ে তিনি তার নিজের চেয়ে বা তার পুত্রের চেয়ে আমাদের জ্ঞান অধিক মনে করবেন, সে কাজের ভার আমাদের উপরই তিনি ন্যস্ত করবেন।
প্রাজ্ঞ সক্রেটিস, এ অনুমান অবশ্যই সত্য।
তা হলে বৎস লীসিস, তুমি দেখতে পাচ্ছ, যে বিষয়ে আমাদের জ্ঞান আছে, যা আমরা জানি, সে বিষয়ে সবাই আমাদিগকে বিশ্বাস করবে। আমরা তাদের বিষয় নিয়ে ইচ্ছানুযায়ী কার্য সাধন করতে পারব, কেউ আমাদের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না–আমরা নিজেরা স্বাধীন হবে এবং অপরের প্রভু হতে পারব। …কিন্তু যে-বিষয়ে আমাদের জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে কেউ আমাদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে না স্বদেশী বা বিদেশী, এমনকি জনক বা জননী এবং প্রিয় বন্ধু পর্যন্ত সে বিষয়ে আমাদের হস্তক্ষেপে যথাশক্তি প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করবে এবং আমরা অপরের অধীনস্থই হলো।
…ঠিক নয় কি?
লীসিস আমার এ প্রস্তাবনায় সম্মতি জানাল।
আমরা যদি অপরের নিকট অকর্মণ্য বা অপদার্থ হই, তা হলেও অপর কেউ কি আমাদের বন্ধু বলে পরিগণিত হতে চাইবে; কিংবা আমাদের কি কেউ প্রিয় বলে গ্রহণ করবে?
না, তা তো নয়ই।
এমন ক্ষেত্রে তোমার পিতামাতাও তোমাকে ভালবাসতে পারেন না। বস্তুত অকর্মণ্য বলে বিবেচিত হলে কেউই অপর কাউকে ভালবাসতে পারে না, নয় কি?
না, তা পারে না।
তা হলে প্রিয় বৎস! তুমি যদি জ্ঞানী হও, তা হলে সবাই তোমার বন্ধু এবং আত্মীয় হয়ে উঠবে। কারণ, তখন তাদের নিকট তুমি ভালো এবং প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু তুমি জ্ঞানী না হলে, পিতামাতা বা আত্মীয়-স্বজন কেউ তোমার বন্ধু হতে চাইবে না। আর যে-বিষয়ে তোমার এখনো জ্ঞান নেই, সে-বিষয়ে তুমি কি কোনো অহমিকার ভাব প্রকাশ করতে পার?
না, সে তো অসম্ভব।
এবং একথাও ঠিক যে তোমার যদি একজন শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা থাকে, তা হলে বুঝতে হবে যে, তুমি এখনো জ্ঞান অর্জন কর নি।
ঠিকই।
এবং যেহেতু অহমিকা প্রকাশের ন্যায় কোনো জ্ঞান তোমার নেই, সেজন্য অহমিকার ভাবও তুমি প্রকাশ করতে পার না?
প্রাজ্ঞ সক্রেটিস, আমি তাই মনে করি।
লীসিসের এই স্বীকৃতি শুনে আমি হিপোথ্যালিসের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম এবং একটি গুরুতর ভুল করার উপক্রম করলাম। কেননা, আমার মনে তখন প্রায় এসে পড়েছিল : হিপোথ্যালিস, তোমার প্রিয়পাত্রের সঙ্গে এমনিভাবেই তোমার কথা বলা কর্তব্য, যেন তোমার আলাপে সে বিনয়ী হয়ে ওঠে, যেন তার মস্তক অবনত হয়ে আসে। প্রশংসার অর্থে তাকে ফাঁপিয়ে তোলা এবং তার চরিত্রে অহমিকা বোধের সৃষ্টি করা উচিত নয়। আমার সৌভাগ্য যে একথা মনে ভাবলেও আমি মুখে উচ্চারণ করি নি। আমি দেখলাম, লীসিসের সঙ্গে আমার কথোপকথন শুনে হিপোথ্যালিস উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। আরও লক্ষ করলাম যে, হিপোথ্যালিস আমাদের নিকটবর্তী থেকে আলোচনা শুনলেও, লীসিস তাকে দেখতে পাক এটি যেন তার ইচ্ছা নয়। এজন্যই আমি চিন্তা করে একথা বলা থেকে বিরত রইলাম।
ইতোমধ্যে মেনেক্সেনাস ফিরে এসে লীসিসের পার্শ্বে আসন গ্রহণ করল। লীসিস আমার দিকে ঝুঁকে শিশুর ন্যায় আবদার করে আমার কানে কানে বলল যেন মেনেক্সেনাস শুনতে না পায় : প্রাজ্ঞ, আমাকে যেরূপ বলেছেন, মেনেক্সেনাকেও সেরূপ একটু বলুন না? আমি বললাম : তুমি তো বেশ মনোযোগ সহকারেই আমার কথা শুনেছ। তা হলে তুমিই কেন মেনেক্সেনাসকে সে কথা বল না?
লীসিস বলল; আচ্ছা, তাই বলব।
আমি আস্তে আস্তে বললাম; তা হলে কথাগুলি তুমি স্মরণ করে নাও। ওকে বলার সময়ে সব কথা যথাযথভাবে বলার চেষ্টা কর। যদি কিছু বিস্মৃত হয়ে থাক তা হলে আমার সঙ্গে পরবর্তী সাক্ষাতে তা জিজ্ঞেস করে নিয়ো।
দার্শনিক বর, আপনি যেরূপ বলেছেন আমি অবশ্যই তেমনি করব। কিন্তু এখন আপনি না থেমে আরো কিছু নতুন কথা বলুন, যেন আমি যতক্ষণ থাকার অনুমতি পাই ততক্ষণ আপনার বাণী শ্রবণ করতে পারি।
বৎস, তুমি যখন বলছ, তখন তোমাকে আমি বঞ্চিত করতে পারিনে। কিন্তু তুমি তো জান, মেনেক্সেনাস বড় কলহ প্রিয়। ও যদি আমায় বিপদে ফেলতে চায় তুমি যেন আমায় সাহায্য করার চেষ্টা কর।
আপনি যথার্থই বলেছেন। ও বড় একগুঁয়ে তার্কিক। সেজন্যই আমি নিজে ভরসা পাচ্ছিনে। আপনাকেই ওর সঙ্গে একটু তর্ক করতে বলছি।
যেন ও আমাকে তর্কে হারিয়ে বোকা বানিয়ে দিতে পারে।
লীসিস সলজ্জভাবে বলল; না তা নয়। আমার ইচ্ছা আপনি ওকে একটু আচ্ছা করে শিখিয়ে দিন।
আমি বললাম : সে কাজ বড় সহজ নয়। ও বড় সাংঘাতিক ছেলে। সিসিপাসের শিক্ষায় ও শিক্ষিত। আর স্বয়ং সিসিপাসও এই মজলিসে উপস্থিত রয়েছেন, দেখতেই পাচ্ছ।
তাতে কি? তবু আপনি ওর সঙ্গে একটু আলাপ করুন।
তুমি যখন এত করে বলছ, আমাকে শুরু আবার করতেই হবে।
এবার সিসিপাস অভিযোগ করে উঠল, আমরা দুজনে কেন এমনভাবে গোপন আলোচনায় রত রয়েছি এবং তার সব রস থেকে তাদের বঞ্চিত করে রাখছি?
আমি বললাম; তোমাদের সঙ্গে রসকে ভাগ করে ভোগ করতেই আমার আনন্দ। লীসিসকে আমি কয়েকটি কথা বলছিলাম। সে তার অর্থ উপলব্ধি করতে পারছে না। মেননক্সেনাস এ সমস্ত বিষয় ভালোই জানে। তার ইচ্ছা আমি মেনেক্সেনাসকেই এ সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন করি।
সিসিপাস বলল : উত্তম কথা। তা হলে তুমি তাকে কেন জিজ্ঞেস করছ না?
বেশ আমি জিজ্ঞেস করছি, মেনেক্সেনাস তুমি উত্তর দাও। কিন্তু তার পূর্বে একথা আমার বলা আবশ্যক যে, শিশুকাল থেকেই আমি একটা বিশেষ কিছু লক্ষ্য করে অগ্রসর হয়েছি। অনেকের অনেক খেয়াল থাকে। কেউ বা অশ্বপালন করে। কেউ বা কুকুর পোষে, আবার কেউ বা স্বর্ণ জমিয়ে রাখে, কেউ সম্মান অর্জনের চেষ্টা করে। আমার এরূপ কোনো কিছুর উপর তীব্র কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। কিন্তু বন্ধু সংগ্রহের প্রতি আমার একটি প্রবল আগ্রহ রয়েছে। তুমি যদি আমায় জগতের সেরা তিতির পাখি বা কুকুট এনে দাও, তা হলেও তার বদলে আমি একটি উত্তম বন্ধুকে পছন্দ করব। বরঞ্চ আরো এক পা অগ্রসর হয়ে বলছি : বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অশ্ব বা সারমেয় যদি আমাকে দাও তা হলেও তার বদলে আমি একটি উত্তম বন্ধু চাইব। মিসরীয় সারমেয়র নামে তাই আমি শপথ করে বলছি; বন্ধু-সঙ্গ আমার এত প্রিয় যে, সম্রাট দারায়ুসের সমগ্র স্বর্ণভাণ্ডার বা স্বয়ং সম্রাট দারায়ুসের বিনিময়ে আমি একজন সত্যকার বন্ধু পেতে চাইব। এজন্যই যখন আমি দেখি যে তোমাদের ন্যায় তরুণ বয়সেই মেনেক্সেনাস তুমি এবং লীসিস দুজন পরস্পরের অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়েছে, এত অল্প বয়সে তোমরা বন্ধুত্বের মূল্যবান সম্পদকে অর্জন করতে পেরেছ, তখন তোমাদের নিকট হতে বহুদূর পড়ে থাকা এই বৃদ্ধও তোমাদের অর্জিত সম্পদ দেখে বিস্মিত না হয়ে পারে না। কিন্তু তোমাদের নিকট আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই। এক্ষেত্রে তোমাদের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় ঘটেছে। তোমরাই আমাকে সঠিকভাবে বলতে পারবে : বন্ধুত্ব অর্থাৎ এক ব্যক্তি যখন দ্বিতীয় ব্যক্তিকে ভালবাসে তখন ‘বন্ধু’ কে? যে ভালবাসে, কিংবা যাকে ভালবাসা হয় অথবা উভয়েই ‘বন্ধু’ বলে বিবেচিত হতে পারে?
আমার মনে হয় দুজনের যে-কোনো ব্যক্তিই অপরজনার বন্ধু।
তোমার কথার তাৎপর্য কি এই যে, দুজনার মধ্যে যদি শুধু একজন অপরজনকে ভালবাসে তা হলেও দুজনে পরস্পর বন্ধু বলে আখ্যায়িত হবে?
হ্যাঁ আমি তাই বলতে চেয়েছি।
কিন্তু ধর, একের ভালবাসার প্রতিদানে অপরজন ভালবাসে না এবং এরূপ হ্যাঁ খুবই সম্ভব, তা হলে কি বলবে?
হ্যাঁ এরূপ হওয়া সম্ভব।
আবার এমন হতে পারে, যে ভালবাসলে প্রতিদানে সে অপরের নিকট থেকে ঘৃণা ফিরে পাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এমন ঘটে যে, প্রেমিকদ্বয় পরস্পর সম্পর্কে এরূপ কল্পনা করে মনে করে যে, প্রেমের প্রতিদানে সে প্রেম নয়, ঘৃণা লাভ করেছে। এরূপ কি ঘটে না?
মেনেক্সেনাস বলল; হ্যাঁ এরূপ ঘটে।
এরূপ ক্ষেত্রে তা হলে একতরফাভাবে একজন ভালবাসে এবং অপরজন কেবল ‘ভালবাসিত’ হয়।
হ্যাঁ সেরূপই বটে।
তা হলে কাকে কার বন্ধু বলব? যে প্রেমিক সে কি তার প্রেমপাত্রের বন্ধু? তার প্রেমাস্পদ তাকে ভালবাসুক বা ঘৃণাই করুক, তবু কি সে তার বন্ধু বলে বিবেচিত হবে? অথবা বলব, দুজনের উভয় উভয়কে ভাল না বাসলে কোনো বন্ধুত্বই সৃষ্টি হতে পারে না?
আজ্ঞে হ্যাঁ, এমন ক্ষেত্রে কোনো বন্ধুত্বই গড়ে উঠতে পারে না।
তা হলে আমাদের এ ধারণাটি পূর্বের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে না। একটু পূর্বেই আমরা বলেছি, শুধু একজন ভালবাসলেও দুজনই বন্ধু। কিন্তু এখন বলছি উভয় উভয়কে ভাল না বাসলে কোনো বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে না।
কিন্তু এ ধারণাই তো সত্য বলে বোধ হয়।
তা হলে প্রতিদানহীন ভালবাসা প্রেমিকের ভালবাসা নয়?
আমি তাই মনে করি।
তা হলে আমরা তাকে অশ্ব-প্রেমিক বলতে পারিনে যার অশ্ব ভালবাসার প্রতিদানে চালককে ভালবাসে না। একথা তিতির পাখি, সারমেয়, সুরা, দৈহিক ক্রীড়ানুষ্ঠান সব কিছু সম্পর্কেই বলা চলে। কেননা এর কোনো ক্ষেত্রেই ভালবাসার প্রতিদান ভালবাসাতেই ঘটে না। জ্ঞানের ক্ষেত্রেও জ্ঞানকে আমরা বন্ধু বলতে পারিনে, যদি প্রতিদানে জ্ঞানও আমাদের ভাল না বাসে। অথবা কথাটি কি আমরা এভাবে বলব যে, তারা প্রতিদানহীনভাবেই ভালবাসে। তাই কবি গেয়ে ওঠেন;
“শিশু আর অশ্ব, শিকারি, সারমেয় এবং বিদেশী পথিক যার প্রিয়, সুখী এ জগতে তিনিই।”
কবি ভুল বলেছেন বলে তো মনে হয় না।
তুমি তার বক্তব্যকে সঠিক বিবেচনা কর?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমি বললাম; তা হলে মেনেক্সেনাস, আমাদের সিদ্ধান্ত দাঁড়ায়, যে প্রিয় সে প্রতিদানে তোমাকে ভালবাসুক কিংবা ঘৃণা করুক সে অবশ্যই প্রিয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, খুব ছোট্ট শিশুকে পিতামাতা খুব ভালবাসেন, প্রতিদানে ছোট্ট শিশুর ভালবাসা জানাবার বয়স হয় নি। বরঞ্চ জনকজননী যখন ছোট্ট শিশুকে শাস্তি দেন, তখন সে পিতামাতাকে ঘৃণাই করে। তথাপি পিতামাতার নিকট তাদের শিশু সেই সময়টিতেই সবচেয়ে প্রিয় বলে বোধ হয়।
আপনি যা বলছেন তাকেই সঠিক বলে মনে হচ্ছে।
তাই যদি হয় তা হলে যে ভালবাসে সে প্রিয় নয়, প্রিয় বা বন্ধু হচ্ছে যাকে ভালবাসা হয় সে?
হ্যাঁ।
এবং এই প্রসঙ্গেই বুঝতে হবে যে, শত্রু বলা হবে তাকে যে ঘৃণিত, যে ঘৃণা করে তাকে নয়।
স্পষ্টতই।
তা হলে দাঁড়ায় যে, অনেককে তাদের শত্রুরাই ভালবাসে এবং তারা বন্ধুদের দ্বারাই ঘৃণিত হয়। অর্থাৎ তারা তাদের শত্রুর বন্ধু এবং বন্ধুর শত্রু। অথচ দেখ, অবস্থাটি কিরূপ পরস্পর বিরোধী হয়ে দাঁড়িয়েছে : তুমি তোমার শত্রুর বন্ধু এবং বন্ধুর শত্রু হয়েছ।
আশ্চর্য! প্রাজ্ঞ, আপনি যা বলেছেন আমি তা স্বীকার করছি।
অবস্থাটি যদি পূর্বোক্তভাবে গ্রহণ করা হয়, তা হলে বলা চলে, প্রেমিক প্রেমাস্পদেরই। বন্ধু।
অবশ্যই।
এবং ঘৃণাকারীও ঘৃণিত বস্তুরই শত্রু।
সে কথা সত্য।
কিন্তু পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একথাও বলতে হয়, যে-আমার বন্ধু নয়, আমি তারও বন্ধু হতে পারি; অর্থাৎ আমার শত্রুই আমার বন্ধু। কেননা আমি যাকে ভালবাসি সে হয়তো প্রতিদানে আমাকে ঘৃণা করে। আমার যে-শত্রু নয় এমনকি বন্ধু তারও আমি শত্রু হতে পারি, কেননা আমি হয়তো একজনকে ঘৃণা করি কিন্তু সে আমাকে ভালবাসে।
এটাও তো সত্য বলে বোধ হচ্ছে।
কি যে ভালবাসে এবং যাকে ভালবাসা হয় তারা যদি একে অপরের বন্ধু না হয় তা হলে কাকে আমরা বন্ধু বলে অভিহিত করতে পারি? অপর কেউ কি এ ব্যাপারে অবশিষ্ট থাকে?
দার্শনিক সক্রেটিস, আমি তো কাউকে দেখিনে।
কিন্তু মেনেক্সেনাস, চিন্তা করে দেখ, এরূপ সিদ্ধান্ত আমাদের ভ্রান্তও তো হতে পারে?
এতক্ষণে লীসিস কথা বলল : প্রাজ্ঞ সক্রেটিস, আমরা নিশ্চয়ই ভুল করেছি।’ এই সলজ্জ উক্তিতে তার মুখমণ্ডলেও লজ্জার আভা এসে পড়ছিল। সে যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথাগুলি বলছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যুক্তির প্রবাহে সে নিমগ্ন ছিল। সে যখন আমাদের আলোচনা শ্রবণ করছিল তখনি তার মনোযোগের ভাবটি চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছিল।
এই আলোচনায় লীসিসের আগ্রহটি আমার নিকট ভালো লাগছিল। তা ছাড়া মেনেক্সেনাসকে একটু রেহাই দেবার জন্যও লীসিসকে উদ্দেশ করে আমি বললাম : লীসিস তুমি যা বলেছ, তা ঠিকই। কেননা আমরা সঠিক হলে ভ্রান্ত পথে এতদূর অগ্রসর হতাম না। এখন সম্মুখের পথকে অধিকতর জটিল বোধ হচ্ছে। বরঞ্চ এস আমরা এ পথ পরিত্যাগ করে আমাদের প্রথম সড়ক ধরেই অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করি। কবিরা আমাদের নিকট জ্ঞানের পিতা বলেই গণ্য। তারা নিশ্চয়ই সখ্য সম্পর্কে হাল্কা খেলোভাবে কোনো মত প্রকাশ করবেন না। তাদের মতামত আমার যেরূপ স্মরণ হচ্ছে সে হচ্ছে এই :
‘বিশ্বস্রষ্টার নিয়মই হচ্ছে সদৃশকে সদৃশের প্রতি আকর্ষিত এবং পরিচিত করে তোলা। আমার বিশ্বাস তুমি এ বাণী নিশ্চয়ই শুনেছ।
হ্যাঁ আমি এ বাণী শুনেছি।
তা হলে তুমি নিশ্চয়ই প্রকৃতি এবং বিশ্বরহস্য নিয়ে আলোচনাকারী দার্শনিকের এই তত্ত্বও শুনে থাকবে যে, সদৃশ চরিত্রই সদৃশ চরিত্রকে ভালবাসে।
হ্যাঁ, আমি এ তত্ত্বের কথাও শুনেছি।
বেশ, দার্শনিকগণ এ বিষয়ে কি সঠিক?
তারা সঠিক হতে পারেন।
হ্যাঁ, অবশ্যই তারা সঠিক হতে পারেন; তারা অর্ধসত্য বা পূর্ণ সত্যও প্রকাশ করতে পারেন।…সদৃশের প্রসঙ্গে দেখা যায়, একটি খারাপ লোক অপর একটি খারাপ লোকের সঙ্গে যত মিশে, যত তার সংস্পর্শে আসে তত সে তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। কেননা খারাপ ব্যক্তির নিকট থেকে খারাপ ব্যক্তিও খারাপ অর্থাৎ আঘাত ব্যতিরেকে আর কি পেতে পারে? তা হলে এই ক্ষতিকারক এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরস্পরের বন্ধু হতে পারে না। একথা কি সত্য নয়?
হ্যাঁ একথা সত্য।
তা হলে কবিদের সদৃশের তত্ত্ব অর্ধেক অসত্য। কেননা কোনো দুষ্ট চরিত্র তার তুল্য দুষ্ট চরিত্রের বন্ধু হতে পারে না।
একথা তো ঠিকই।
কিন্তু কবিদের সদৃশ তত্ত্বের যথাযথ অর্থ বোধ হয় এই যে, মহত্যা একই চরিত্রসম্পন্ন এবং তারা পরস্পরের বন্ধু। কিন্তু অসৎ অপরের সঙ্গে, এমনকি নিজের সঙ্গেও সংঘাতবিহীন থাকতে পারে না। কেননা, যে অসৎ সে অস্থির এবং রিপুসম্পন্ন। সুতরাং যে চরিত্র নিজের সঙ্গেও সংঘাত বা শত্রুতাবিহীন থাকতে পারে না, সে-চরিত্র অপর কোনো সত্তার সঙ্গেও একতার ভিত্তিতে মিলিত হতে পারে না। একথা কি তুমি স্বীকার কর?
হ্যাঁ, আপনার একথা আমি স্বীকার করি।
তা হলে প্রিয় বন্ধু, সদৃশ তত্ত্বের কথা যারা বলেন, তাঁদের অভিমত আমি যতদূর অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছি, সে হচ্ছে এই যে, কেবলমাত্র উত্তমই উত্তমের সঙ্গে মিলিত হতে পারে। কিন্তু যে অধম বা অসৎ, সে অধম বা উত্তম কারো সঙ্গেই সত্যকার মিত্রতা স্থাপন করতে পারে না। তুমি কি আমার এ ব্যাখ্যাকে স্বীকার কর?
লীসিস মাথা নেড়ে তার সম্মতি জানাল।
তা হলে কারা পরস্পরের বন্ধু হতে পারে, সে প্রশ্নের জবাব আমরা এখানেই পাই। কেননা এই যুক্তি অনুসারে কেবলমাত্র উত্তমই উত্তমের বন্ধু হতে পারে।’
হ্যাঁ একথা সত্য।
সত্যই বটে। তবে এ জবাবও আমার নিকট পরিপূর্ণরূপে সন্তোষজনক বলে বোধ হয় না। আমার মনের সন্দেহটি তোমার নিকট প্রকাশ করে বলছি : ধর সদৃশই পরস্পরের বন্ধু এবং উভয়ই উভয়ের নিকট উপকারী এবং মূল্যবান। কথাটিকে আমি বরঞ্চ এভাবে বলি : সদৃশ নিজের যে-ক্ষতি সাধন করবে না, সে-ক্ষতিকে কি সে সদৃশের নিকট থেকে গ্রহণ করতে পারে? পারে না। আবার এরূপ সদৃশের একে যদি অপরের কোনো উপকার সাধন করতে না পারে, তা হলে কি তারা দুজন পরস্পরকে ভালবাসতে পারে?
না, তাও পারে না।
কিন্তু যাকে ভালবাসা হলো, সে কি যে ভালবাসল না তার বন্ধু হতে পারে?
অবশ্যই তা পারে না।
তা হলে তোমাকে বলতে হয় যে, সদৃশ ‘সদৃশ হিসাবে সদৃশের হতে পারে না। অপরদিকে একথাও স্বীকার করতে হয় যে, উত্তম উত্তম হিসাবে উত্তমের বন্ধু হতে পারে।
ঠিকই।
কিন্তু যে উত্তম সে উত্তম হিসাবে কি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়? অবশ্যই সে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এবং যে স্বয়ংসম্পূর্ণ’ তার অপরের নিকট থেকে কোনো কিছু পাওয়ার প্রয়োজন থাকে না। এ অর্থটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কথাটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
হ্যাঁ, অবশ্যই তার লাভ করার কোনো প্রয়োজন থাকে না।
এবং যার প্রয়োজন নেই, তার যাচনাও নেই।
হ্যাঁ, তার যাচনাও নেই।
এবং যাকে সে যাচনা করে না, তাকে সে ভালবাসতেও পারে না।
না, তা পারে না।
কিন্তু যে আদৌ ভালবাসে না, সে অবশ্যই কোনো প্রেমিক বা বন্ধু বলেও বিবেচিত হতে পারে না।
স্পষ্টতই তেমনি মনে হচ্ছে।
তা হলে বন্ধুত্বের অস্তিত্ব কোথায়? কেননা, উত্তমের বন্ধুর প্রয়োজন হয় না। কারণ, বন্ধু ব্যতিরেকেই উত্তম স্বয়ংসম্পূর্ণ। আবার বন্ধুত্বে উত্তমের কোনো উপকার সাধিত হয় না–যেহেতু তার কোনো উপকারের আবশ্যকতা নেই। তা হলে এরূপ সদৃশকে ভালবাসতে প্রবৃত্ত করা কি প্রকারে সম্ভব?
না, তা সম্ভব নয়।
কেননা, পরস্পরের মূল্যবোধ ব্যতীত পরস্পর বন্ধু হতে পারে না।
খুবই সত্য কথা।
তা হলে সঠিক জবাব কোথায়? লীসিস, আমরা কেবল বিভ্রান্তই হচ্ছি না। আমরা কি সবটাতেই ভুল বলে প্রমাণিত হই নি?
এবার লীসিস বিস্ময়ের সাথে বলে উঠল : কী করে?
কেননা, এইমাত্র আমার কোনো একজনের কথা স্মরণ হচ্ছে, যিনি বলেছেন যে, সদৃশই সদৃশের চরম শত্রু, উত্তমই উত্তমের নিধনকারী। তিনি হিসিয়ডের বাণী উদ্ধৃত করেছেন :
“কুম্ভকার কুম্ভকারের সঙ্গে, কবি কবির সঙ্গে এবং
ভিক্ষুক ভিক্ষুকের সঙ্গে কলহে প্রবৃত্ত হয়।”
অন্যান্য সদৃশ সম্পর্কেও তিনি একইভাবে বলেছেন : “প্রয়োজনের দাবিতে যারা সবচাইতে বেশি সদৃশ তারই ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব এবং ঘৃণায় পূর্ণ এবং সবচাইতে অধিক মিত্রতায় পূর্ণ। কেননা, যে নির্ধন সে প্রয়োজনের দাবিতে ধনবানের বন্ধু হতে বাধ্য হয়, দুর্বলকে সবলের, রোগীকে চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হয়; যে অজ্ঞানী তাকে জ্ঞানীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়।” বস্তুত এভাবে অগ্রসর হয়ে অধিকতর জোরের সঙ্গে তিনি বলেছেন : “সদৃশের মিত্রতা তত্ত্বে কোনো সত্য নেই–বরঞ্চ তার বিরোধী তত্ত্বই হচ্ছে সত্য। অর্থাৎ যারা চরম বিরোধী তারাই পরম মিত্র। কারণ, কোনো বস্তু সদৃশের প্রতি আকৃষ্ট হয় না, আকৃষ্ট হয় বিসদৃশের প্রতি : যেমন যা শুষ্ক তা আর্দ্রকে, যা শীতল তা উষ্ণকে, যা তিক্ত তা সুস্বাদুকে, যা তীক্ষ্ণ তা স্থূলকে এবং যা শূন্য তা পূর্ণকে আকৃষ্ট করে। অপর সমস্ত বৈপরীত্যের ক্ষেত্রেও একথা সত্য। কেননা বৈপরীত্যেই বিপরীতের লক্ষ্য। সদৃশ সদৃশের নিকট থেকে আপন প্রয়োজনের কিছুই লাভ করে না।” যিনি এই কথাকে এমন করে বলেছেন তিনি বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তোমরা সবাই কি বল?
মেনেক্সেনাস বলল : এই বক্তার কথা শুনে আমার তো তাকে সঠিক বলেই বোধ। হচ্ছে।
তা হলে আমরা কি এই বলব যে, পরম বন্ধু চরম বিরোধের মধ্যেই সম্ভব?
হ্যাঁ ঠিক তাই।
কিন্তু মেনেক্সেনাস, তেমন জবাব কি অত্যদ্ভুত বলে বোধ হবে না? আর সে জবাব শুনে পণ্ডিতম্মন্য তার্কিকের দল আমাদের উপর বিজয়ের উল্লাসে আঁপিয়ে পড়ে বলবে না, তা হলে প্রেমকে ঘৃণার চরম বৈপরীত্য বলা হবে কি না? তখন তো তাদের কথাকেই সত্য বলে আমাদের মেনে নিতে হবে-নয় কি?
হ্যাঁ, তা তো বটেই।
তখন তারা আর এক পা অগ্রসর হয়ে বলবে : তা হলে শত্রু হচ্ছে বন্ধুর বন্ধু, অথবা বন্ধু হচ্ছে শত্রুর বন্ধু?
না, এর কোনোটিই নয়।
বেশ! কিন্তু যে ন্যায়পরায়ণ সে কার বন্ধু? সে কি অন্যায়ের বন্ধু? কিংবা সংযমী কি অসংযমীর বন্ধু অথবা সৎ কি অসৎ-এর বন্ধু?
না, তা কী করে হয়।
কিন্তু আমরা পূর্বে যেরূপ বলেছি সেরূপ বৈপরীত্যেই যদি বন্ধুত্ব হয়, তা হলে বিপরীত অবশ্যই পরস্পরের বন্ধু।
হ্যাঁ, আমাদের কথানুযায়ী তা তো অবশ্যই।
তা হলে সব মিলিয়ে দাঁড়াল যে, সদৃশ বা বিসদৃশ কেউই পরস্পরের বন্ধু হতে পারে না।
এবার তাই মনে হচ্ছে।
মেনেক্সেনাস, এ বিষয়ে আরো ভাববার রয়েছে। এমন তো হতে পারে, সখ্যের এই সমগ্র ধারণাটিই আমাদের ভ্রান্ত। যে বস্তু বা ব্যক্তি ভালোও নয়, মন্দও নয়, সেও অনেকক্ষেত্রে ভালো বা সৎ-এর বন্ধু বলে পরিগণিত হতে পারে?
আপনি কি বুঝাতে চাইছেন?
প্রকৃতপক্ষে বৎস! আমি নিজেই বুঝতে পারছিনে। তোমাদের এই তর্কের বিষয় নিয়ে আমার মস্তিষ্ক এখন উদ্ভ্রান্ত। আমি তাই একটি আন্দাজ করে বলতে চাই : হয়তো ভালো কিংবা মন্দ নয়, সুন্দরই বন্ধু। যা সুন্দর তা বন্ধু’ বলে একটি প্রাচীন প্রবাদও আছে। বস্তুত ভালো-মন্দ বা সৎ-অসৎ-এর চেয়ে সৌন্দর্য বেশ মোলায়েম বিষয়। বলা চলে বিষয়টি পিচ্ছিলও বটে। আমাদের আত্মাকে সৌন্দর্য সহজই ছেয়ে ফেলতে পারে। আমি তাই বলতে চাই যা সুন্দর, তাই সৎ। তুমি কি আমার সঙ্গে একমত হবে?
হ্যাঁ, আপনার কথাকে মেনে নেওয়া যায়।
একটি ধারণার উপর ভিত্তি করে আমি একথা বলছি যে, যা সৎ বা অসৎ নয়, তাই সুন্দর এবং ভালো বা সৎ-এর বন্ধু। আমার ধারণার ভিত্তি হচ্ছে এই যে, নীতি হচ্ছে তিনটি, যথা : ভালো, মন্দ এবং যা ভালোও নয়, মন্দও নয়। আশা করি একথাও তুমি স্বীকার করবে।
হ্যাঁ, আপনার একথা আমি স্বীকার করি।
আমাদের পূর্বালোচিত যুক্তিতে এটি প্রতিপন্ন হয়েছে যে, ভালো ভালোর বা মন্দ মন্দর কিংবা ভালো মন্দর বন্ধু নয়। সুতরাং প্রেম বা বন্ধুত্ব বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব যদি আমরা স্বীকার করি, তা হলে আমাদের অবশ্যই সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, যা ভালোও নয়, মন্দও নয় সে বস্তু বা ব্যক্তিই মাত্র ভালোর বা বলা চলে ভালোও নয়, মন্দও নয় এমন বস্তু বা ব্যক্তির বন্ধু হতে পারে। কোনো কিছুই খারাপ বা অসৎ-এর বন্ধু হতে পারে না, সে কথা আমরা পূর্বেই বলেছি।
হ্যাঁ তা ঠিক।
আবার সদৃশও পরস্পরের বন্ধু হতে পারে না, তাও আমরা এইমাত্র বলেছি।
অবশ্যই।
ফলত যা ভালোও নয়, মন্দও নয় তার এমন কোনো বন্ধু হতে পারে না, যে ভালোও নয়, মন্দও নয়।
এটি এবার নিশ্চিত বলে বোধ হচ্ছে।
এবার যেন আমরা সঠিক পথে এসেছি তাই নয় কি? ভেবে দেখ, যে শরীর সুস্থ তার নিশ্চয়ই ঔষধাদি বা অপর কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয় না এবং স্বাস্থ্যবান মানুষও নিশ্চয়ই চিকিৎসকের জন্য তেমন প্রেম অনুভব করে না।
হ্যাঁ চিকিৎসার জন্য তার কোনো প্রেমানুভূতি নেই।
কিন্তু যে অসুস্থ, চিকিৎসককে সে ভালবাসে। কেননা সে অসুস্থ, তাই নয় কি?
হ্যাঁ অবশ্যই।
অসুস্থতা নিশ্চয়ই খারাপ এবং নিরাময় কৌশল ভালো?
তা তো বটেই।
কিন্তু মনুষ্যদেহকে শুধু ‘দেহ’ হিসাবে বিচার করলে সে ভালোও নয়, মন্দও নয়। তাই নয় কি?
একথা ঠিক।
দেহ কেবল অসুস্থতা নিবন্ধনই নিরাময় কৌশলের সাহায্য প্রার্থনা করে এবং তার বন্ধুত্ব কামনা করতে বাধ্য হয়। নয় কি?
আজ্ঞে, হ্যাঁ।
তা হলে অসৎ-এর অসুস্থতার অস্তিত্বের জন্যই যা ভালোও নয়, মন্দও নয়–অর্থাৎ দেহ ভালো বা নিরাময় কৌশলের বন্ধু হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের সে রকমই অনুমান করতে হয়।
এবং স্পষ্টত এ অবস্থায় অস্তিত্ব থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত অসৎ এসে সৎও নয়, অসৎও নয় যে বস্তু বা ব্যক্তি, তাকে অসৎ করে না দেয়। কেননা বস্তু বা ব্যক্তি নিজেই যদি অসৎ হয়ে যায় তা হলে সে আর সৎকে কামনা করতে পারে না। কেননা আমরা বলেছি অসৎ সৎ-এর বন্ধু হতে পারে না।
না, তা পারে না।
অপর একটি বিষয়ও আমাদের লক্ষ্য করা আবশ্যক। এমন অনেক বস্তু আছে যা অপর বস্তুর উপস্থিতিতে তার সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। কিন্তু এমন বস্তুও রয়েছে যা এভাবে দ্বিতীয় বস্তুর সঙ্গে একীভূত হয়ে যায় না। যেমন ধর, প্রলেপ বা রঙের দৃষ্টান্ত।
বেশ তাই ধরা যাক।
কোনো বস্তুর উপর যদি প্রলেপ রঙ মাখানো হয় তা হলে সে বস্তু এবং বস্তুর উপর মাখানো প্রলেপ বা রঙ কি অভিন্ন থাকে?
দার্শনিক সক্রেটিস, আমি ঠিক বুঝতে পারছিনে, আপনি কী বুঝাতে চাইছেন?
বৎস! আমি বলতে চাচ্ছি : ধর, তোমার রক্তাভ কেশ গুচ্ছের উপর শুভ্র সীসা লাগিয়ে দিলুম, তা হলে তোমার কেশ কি সত্যই শুভ্র হয়ে যাবে অথবা কেবলমাত্র শুভ্র বলে
প্রতীয়মান হবে?
না, তারা শুধুমাত্র শুভ্র বলে প্রতীয়মান হবে।
তা হলেও তোমার কেশসমূহে শুভ্রতার অস্তিত্ব থাকবে?
হ্যাঁ, শুভ্রতার অস্তিত্বও থাকবে।
তথাপি এজন্য তো তোমার কেশসমূহ কিঞ্চিৎ মাত্রও সত্যিকারভাবে শুভ্র হয়ে উঠবে না। তোমার কেশ যেমন কাল নয়, তেমনি এই প্রলেপের জন্য শুভ্রও হবে না।
না, তা হবে না।
কিন্তু বার্ধক্য যখন তোমার কেশের মধ্যে শুভ্রতা এনে দেয়, সে শুভ্রতা তোমার কেশের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায় এবং তখন শুভ্রতার উপস্থিতির জন্যই তোমার কেশ শুভ্র হবে।
তা তো অবশ্যই।
এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে : একটি বস্তুর উপস্থিতিতে অপর বস্তু তার সঙ্গে একীভূত হয়ে যায় কি না? অথবা একটি বিশেষ প্রকারের উপস্থিতিই মাত্র একীভবনের কাজটি সাধন করে।
বিশেষ উপস্থিতি নিশ্চয়।
তা হলে যে সৎ নয়, অসৎও নয়–অর্থাৎ ভালো নয়, মন্দও নয় সে অসৎ-এর মধ্যে অসৎ হিসাবে একীভূত না হয়েও অবস্থান করতে পারে এবং এরূপ ঘটনা পূর্বেও ঘটেছে।
হ্যাঁ।
তা হলে অসৎ-এর মধ্যে অবস্থান করেও যে অসৎ নয় সৎ-এর সাক্ষাতে তার মধ্যে সৎ-এর বাসনা অবশ্যই জাগরিত হবে। কিন্তু অসৎ যেখানে অপর বস্তুকেও অসৎ করে ফেলে সেখানে সৎ-এর বন্ধুত্বের কামনাকেও বিনষ্ট করে দেয়। কেননা যে এককালে সৎ এবং অসৎ দুই-ই ছিল, সে এখন অসৎ বই অপর কিছু নয়।…
না, কিছুই নয়। আর এ জন্য আমরা মনে করি যে, দেবতা বা মানুষ যারা ইতোমধ্যেই জ্ঞানী হয়েছেন তারা আর জ্ঞানের সখা নন। আবার যারা অসৎ হওয়ার পথে তারাও জ্ঞানের সখা হতে পারে না। এদের ব্যতীত অবশিষ্ট থাকে সেই হতভাগ্য অজ্ঞানীগণ যারা এখনও অজ্ঞানতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠে নি এবং অজ্ঞানতার অহমিকায় যা জানে না তাকেও জানে বলে অহঙ্কার প্রকাশ করতে শুরু করে নি। কাজেই যারা জ্ঞানের প্রেমিক তারা এখন সৎও নয়, অসৎও নয়-ভালোও নয়, মন্দও নয়। কিন্তু আমরা দেখেছি যে সৎ বা অসৎ কেউই জ্ঞানের প্রেমিক নয়। কেননা সদৃশ বা বিসদৃশ কেউই পরস্পরের বন্ধু নয়। একথা নিশ্চয়ই তোমাদের স্মরণ হচ্ছে?
তারা উভয়েই বলল : হ্যাঁ নিশ্চয়ই।
তা হলে লীসিস এবং মেনেঝেনাস, আমরা সখ্য বা বন্ধুত্বের প্রকৃতি এতক্ষণে নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছি, এ সম্পর্কে এবার আর কোনো সন্দেহ নেই। আমরা বলতে পারি : সখ্য হচ্ছে প্রেম যাকে অসৎ-এর অস্তিত্বের জন্য আমরা ভালো কিংবা মন্দ, দেহ কিংবা আত্মা কোথাও নির্দিষ্ট করে খুঁজে পাইনে।
আমার এ সংজ্ঞায় তারা উভয়ই সম্মতি জানাল। তাদের সম্মতিতে আমার মনেও আনন্দের সঞ্চার হলো। তারা উভয়েই এতক্ষণে আমার যুক্তির বাধ্য হয়েছে। তারা দুজনেই এখন আমার মুঠোর মধ্যে–শিকারিসুলভ এই মনোভাব আমাকে বেশ উৎফুল্ল করে তুলল। কিন্তু পরমুহূর্তেই একটি অহেতুক সন্দেহ আমার মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলল। আমার মনে হলো, এ সিদ্ধান্ত আমাদের ভ্রান্ত। আমি বললাম : কিন্তু লীসিস ও মেনেক্সেনাস, আফসোসের বিষয় যে, আমার মনে হচ্ছে আমরা হয়তো কেবল একটা ছায়াকেই লাভ করেছি–বন্ধুত্বের কায়াকে আমরা পাই নি।
বিস্মিতভাবে মেনেক্সেনাস বলল : একথা আপনি কেন বলছেন?
কারণ, আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে বন্ধুত্বের সমগ্র যুক্তিটাই অসার। মানুষের ক্ষেত্রে যা সত্য, যুক্তি ক্ষেত্রেও তাই। যুক্তিও আমাদের প্রবঞ্চনা করতে পারে।
কেমন করে?
বেশ, বিষয়টিকে এভাবে দেখ : যাকে আমরা বন্ধু বলি, সে নিশ্চয়ই দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির বন্ধু–তাই নয় কি?
অবশ্যই।
কেউ যখন অপর কারো বন্ধু হয় তখন কি তার বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য থাকে।
বেশ, এই উদ্দশ্যটি কি তার নিকট প্রিয় কিংবা প্রিয় বা অপ্রিয় কিছুই নয়?
দার্শনিক, আমি অনুধাবন করতে পারছিনে।
বিষয়টি দুর্বোধ্য মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বরঞ্চ কথাটিকে আমি যদি অন্যভাবে প্রকাশ করি, তা হলে হয়তো তুমি বুঝতে সক্ষম হবে এবং আমার নিজের মনের কথা নিজের নিকটও অধিকতর স্পষ্ট হবে। যে অসুস্থ বা রোগী সে তো চিকিৎসকের বন্ধু তাই নয় কি? কথাটি আমি অল্পক্ষণ পূর্বেও বলেছি।
হ্যাঁ, তাই।
কিন্তু রোগী চিকিৎসকের বন্ধু তার রোগের জন্য এবং স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য?
হ্যাঁ, তাই।
রোগ নিশ্চয়ই ভালো বা কাম্য নয়। রোগ খারাপ।
অবশ্যই।
কিন্তু সুস্থতা কী? সুস্থতা কি ভালো কিংবা মন্দ অথবা ভালো-মন্দ কোনোটিই নয়?
সুস্থতা বা স্বাস্থ্য অবশ্যই ভালো।
তা হলে এবার দেহের উপমাটি বিচার করা যাক। আমরা পূর্বেই বলেছি, ‘দেহ হিসাবে ভালো বা মন্দ, সৎ বা অসৎ কিছুই নয়। অসুস্থতার জন্যই অর্থাৎ অসুস্থতা
অসৎ বলেই ঔষধের বন্ধু। ঔষধ নিজে ভালো বা সৎ। কিন্তু তারও দেহের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্বাস্থ্যেরই জন্য এবং স্বাস্থ্য অবশ্যই সৎ।
আপনার এ অভিমত ঠিক।
বেশ, কিন্তু স্বাস্থ্য বা সুস্থতা নিজে বন্ধু নয়?
স্বাস্থ্য অবশ্যই বন্ধু।
এবং রোগ বা অসুস্থতা নিশ্চয়ই শত্রু?
হ্যাঁ।
তা হলে বিষয়টি দাঁড়াল এরূপ : যে বস্তু সৎ কিংবা অসৎ নয়-অর্থাৎ দেহ, অসৎ এর কারণে এবং সৎ-এর জন্যই সৎ-এর বন্ধু হয়েছে?
স্পষ্টতই।
তা হলে বন্ধু বন্ধুর জন্য এবং শত্রুর কারণে বন্ধু হয়?
সে অনুমানই অনিবার্য।
বৎসগণ! যুক্তির ক্রান্তিকালে প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে সতর্ক হয়ে। সদৃশ্যের তত্ত্ব আমরা জানি। তার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন : ‘বন্ধু’ বন্ধুর বন্ধু কিংবা সদৃশ সদৃশের বন্ধু বলে যে তত্ত্ব তাকে আমরা অসম্ভব বলে নাকচ করেছি। কিন্তু আমাদের নতুন যুক্তিও যাতে আমাদের প্রবঞ্চনা করতে না পারে সেজন্য অপর একটি বিষয় ভালোভাবে বিবেচনা করা আবশ্যক। আমরা বলেছি : ঔষধ স্বাস্থ্যের কারণেই আমাদের নিকট প্রিয়। তাই নয় কি?
হ্যাঁ।
স্বাস্থ্যও আমাদের প্রিয় বস্তু?
অবশ্যই।
কিন্তু স্বাস্থ্য যদি প্রিয় হয় তা হলে কোনো কিছুর জন্য তো সে প্রিয়?
হ্যাঁ তাই।
এবং যে বস্তুর জন্য স্বাস্থ্য প্রিয়, সে বস্তুও অবশ্যই আমাদের নিকট প্রিয়। একথাও আমাদের স্বীকৃতি থেকেই পরিষ্কার।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কিন্তু সেই অপর বস্তুও অপর কোনো প্রিয় বস্তুর সঙ্গে জড়িত–নয় কি?
হ্যাঁ।
এভাবে প্রিয় থেকে প্রিয়তে যদি আমরা অগ্রসর হতে থাকি, তা হলে আমরা নিশ্চয়ই এক আদি এবং পরমপ্রিয় বস্তুর সাক্ষাৎ পাব যে প্রিয় অপর কোনো প্রিয় বস্তুর উপর তার প্রিয় হওয়ার জন্য নির্ভরশীল নয় এবং যে প্রিয় বস্তুর কারণেই অপর সব প্রিয় বস্তু প্রিয়। এখানে পৌঁছুতে পারলে আমাদের আর অগ্রসর হতে হবে না। এখানেই আমরা এ চলার বিরতি টানতে পারব। তাই নয় কি?
তাই মনে হচ্ছে।
আমার আশঙ্কা হচ্ছে, যে আদি প্রিয়ের কথা আমরা উল্লেখ করেছি সে আদি প্রিয় ব্যতীত অপর যে সমস্ত প্রিয় হতে পারে না, সে সমস্ত প্রিয় ভ্রান্তিমাত্র। প্রকৃতপক্ষে আদি প্রিয়ই হচ্ছে একমাত্র এবং প্রিয়। কথাটি আমি অন্যভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করছি : ধন-সম্পদের কথা ধর এবং এই ধন-সম্পদের যিনি মালিক তাঁর পুত্রের কথা চিন্তা কর। যে পিতার নিকট তাঁর পুত্র প্রিয়, তিনি অবশ্যই তার সব সম্পদকে ভালবাসেন তার সন্তানের জন্য। এমন যদি হয় যে পুত্র বিষপান করেছে এবং সুরা দ্বারাই সে বিষ নিষ্ক্রান্ত করা সম্ভব তা হলে এই ধনবানের নিকট সুরা অবশ্যই মূল্যবান বোধ হবে। নয় কি?
হ্যাঁ, তিনি নিশ্চয়ই সুরাকে মূল্যবান বোধ করবেন।
এবং এজন্যই সুরাপাত্রটি তাঁর নিকট মূল্যবান বোধ হবে?
অবশ্যই।
কিন্তু তাই বলে, ধনবান পিতা কি সুরা কিংবা সুরার পাত্রটিকে তাঁর পুত্রের সমান মূল্যবান বিবেচনা করেন? বরঞ্চ এইটিই কি প্রকৃত পরিস্থিতি নয় যে, পিতার সমগ্র উদ্বেগ এবং আশঙ্কা একটি বিশেষ বিষয়কে নিয়ে এবং সে বিষয় হচ্ছে তার পুত্র এবং তার আরোগ্যলাভ। পিতার আশঙ্কা বা দৃষ্টি পুত্রের আরোগ্য লাভের উপায় অর্থাৎ সুরা কিংবা সুরাপাত্রের প্রতি নিবন্ধ নয়। তেমনিভাবে আমরা যদিও সাধারণ স্বর্ণ এবং রৌপ্যকে খুবই মূল্যবান পদার্থ বলে আখ্যায়িত করি, সেটি প্রকৃত সত্য নয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, অপর কোনো বস্তু রয়েছে, সে বস্তুর প্রকৃতি যাই হোক এবং সে বস্তুর জন্যই আমরা স্বর্ণ-রৌপ্য এবং অপর সমস্ত অর্থ-সম্পদকে আহরণ করে থাকি। তাই নয় কি?
আপনার এ অভিমত খুবই সত্য।
বন্ধু সম্পর্কেও কি একথা প্রযোজ্য নয়? যে বস্তু বা ব্যক্তিকে আমরা দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর জন্য প্রিয় মনে করি সে বস্তু ব্যক্তিকে সত্যিকারভাবে প্রিয় বলা চলে না। একমাত্র সত্যিকার প্রিয় বস্তু হচ্ছে সেই সত্তা যে সত্তায় সমস্ত তথাকথিত প্রিয় চরম পরিণতি লাভ করে। একথা কি যথার্থ নয়?
একথা তো যথার্থ বলেই বোধ হয়।
এবং আমরা পূর্বেই বলেছি, পরম যে প্রিয় সে অপর কোনো প্রিয়তম বস্তুর জন্য প্রিয় নয়। অবশ্যই।
সুতরাং বন্ধুত্বের অপর কোনো উদ্দেশ্য থাকার বিষয়টি নিয়ে অধিক আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এবার কি আমরা একথা বলতে পারি যে সই হচ্ছে বন্ধু?
হ্যাঁ আমিও সেরূপ মনে করি।
এবং সৎকে আমরা ভালবাসি অসৎ-এর কারণে? আচ্ছা বিষয়টিকে অন্যভাবে প্রকাশ করা যাক : ধর সৎ, অসৎ এবং নিরপেক্ষ অর্থাৎ তৃতীয়টি সৎও নয়, অসৎও নয়। এই তিনটি শক্তির মধ্যে অসৎকে আমরা দূর করে দিলাম। ফলে অসৎ তার উপস্থিতি দ্বারা সৎ এবং নিরপেক্ষকে অথবা দেহ, আত্মা কিংবা অনুরূপ যে সমস্ত বিষয়কে আমরা নিরপেক্ষ বুলি সে সমস্ত বিষয়কে দূষিত করতে সক্ষম নয়। এরূপ অবস্থায় যে শক্তি সৎ সে কি আমাদের কোনো উপকারে আসবে? অথবা বলব, সৎ বা ভালো অপ্রয়োজনীয় বই আর কিছুই নয়? কেননা সৎ-এর প্রয়োজন যখন অসৎ-এর প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং আমাদের কল্পিত অবস্থায় অসৎ যখন বিতাড়িত এবং কোনো ক্ষতি সাধনে অক্ষম, তখন আমাদের নিকট সৎ-এর আর আবশ্যকতা কি? এ থেকে স্পষ্টতই দেখা যায় যে, সৎকে আমরা কামনা করি এবং প্রিয় মনে করি অসৎ-এর কারণেই এবং অসঞ্জপ অসুস্থতা হতে আরোগ্য লাভের জন্য। কিন্তু যদি কোনো অসুস্থতা বা রোগ না থাকে তা হলে কোনো নিরাময় কৌশলেরও প্রয়োজন থাকে না। তা হলে কি সৎ-এর প্রকৃতি এই নয় যে, সৎ এবং অসৎ-এর মধ্যস্থলে আমরা অবস্থান করি বলেই সৎকে আমরা ভালবাসি। বস্তুত অসৎ-এর অস্তিত্বই সৎকে ভালবাসার কারণ। অসৎ-এর অস্তিত্বহীন অবস্থায় কেবলমাত্র সৎ-এর জন্যই আমরা সৎকে প্রিয় মনে করিনে–সৎ-এর নিজস্ব কোনো মূল্য বা প্রয়োজন নেই।
তা নেই।
তা হলে দেখা যাচ্ছে, সমস্ত সখ্য বা বন্ধুত্বই আপেক্ষিক–-অর্থাৎ যে সখ্য চরম সখ্যে পরিণতি লাভ করে তার প্রকৃতি অবশ্যই আপেক্ষিক সখ্য থেকে পৃথক; কেননা যাকে আমরা আপেক্ষিকভাবে প্রিয় বলি সে অপর কোনো কারণেই প্রিয়–নিজ কারণে নয়। সে অপ্রিয়ের কারণেই প্রিয় এবং অপ্রিয়ের অনস্তিত্বে তারও অনস্তিত্ব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে বন্ধু বা প্রিয় তার কথা ভিন্ন।
আমাদের বর্তমান অভিমত ঠিক হলে এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই সত্য।
হা হতোহস্মি! তা হলে তুমি বল, অসৎ-এর যদি অস্তিত্ব না থাকে আমরা কি আর ক্ষুধা বা তৃষ্ণা বা অনুরূপ কোনো অভাবকে বোধ করব? অথবা অবস্থাটি কি এই যে, জীবন ও জীবের অস্তিত্ব যতদিন থাকবে ক্ষুধা তৃষ্ণার অস্তিত্বও ততদিন থাকবে। কিন্তু তারা ক্ষতিকর আকারে থাকবে না। কেননা অভাবকে ক্ষতিকর শক্তিতে পরিণত করার শক্তি যে অসৎ সে বিলুপ্ত হয়েছে। অথবা আমরা কি এই সিদ্ধান্ত করব যে, অসৎ-এর বিলুপ্তির পরে কি হবে বা হবে না এরূপ প্রশ্ন করাই নিরর্থক। কেননা সে কথা কে বলতে পারে? যা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি সে হচ্ছে এই যে, আমাদের বর্তমান অবস্থায় ক্ষুধা তৃষ্ণার অস্তিত্ব রয়েছে এবং এই ক্ষুধাতৃষ্ণা যেমন আমাদের উপকার করতে পারে, তেমন অপকার সাধনও করতে পারে। ঠিক নয় কি?
হ্যাঁ, অবশ্যই।
অনুরূপভাবে অন্য যে-কোনো অভাব বা প্রয়োজন সম্পর্কে একথা বলা চলে যে তৃষ্ণা বা ক্ষুধার মতো তারাও আমাদের কোনো সময়ে উপকার বা অপকার কোনোটিই সাধন করতে পারে না।
ঠিক নয় কি?
অবশ্যই ঠিক।
কিন্তু এমন কোনো কারণ কি আছে, যার জন্য আমরা বলতে পারি যে অসৎ লোপ, পেলে যা অসৎ নয়, তাও লুপ্ত হয়ে যাবে?
না, এমন কোনো কারণ নেই।
তা হলে অসৎ ধ্বংস হয়ে গেলেও যে সমস্ত অভাব নিরপেক্ষ অর্থাৎ সৎও নয়, অসৎও নয় তাদের অস্তিত্ব থাকবে?
হ্যাঁ, অবশ্যই তারা থাকবে।
কিন্তু যাকে কামনা করি নিশ্চয়ই তাকে ভালও বাসতে হয়?
হ্যাঁ, ভালবাসতে হয়।
তা হলে অসৎ-এর বিলুপ্তির পরেও প্রেম, ভালবাসা বা বন্ধুত্ব প্রভৃতির অস্তিত্ব থাকবে?
হ্যাঁ থাকবে।
কিন্তু অসৎ যদি সখ্যের কারণ স্বরূপই হয়, তা হলে নিশ্চয়ই অসৎ-এর বিলুপ্তির পরে সখ্য বা বন্ধুত্বের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। অসৎ-এর বিলুপ্তির পরে কোনো কিছুই অপর কোনো কিছুর বন্ধু হতে পারে না। কেননা, কারণ না থাকলে কার্যও থাকতে পারে না।
তা তো বটেই।
আমরা পূর্বে বলেছি, বন্ধু যখন কাউকে ভালবাসে, সে কারণ ব্যতীত ভালবাসে না। কিন্তু একথা বলার সময়ে আমরা মনে করেছি যে, সৎ বা অসৎ কেউই অসৎ-এর কারণে
কোনো কিছু ভালবাসে না। তাই নয় কি?
হ্যাঁ তাই।
কিন্তু আমরা এইমাত্র যেমন বলছিলাম সেরূপ তো হতে পারে যে, সখ্য বা বন্ধুত্বের মূল কারণ হচ্ছে আকাঙ্ক্ষা বা কামনা। কেননা আকাঙ্ক্ষিত বস্তুকে যে আকাঙ্ক্ষা করে সে আকাঙ্ক্ষার কালে তাকে প্রিয় বলেও মনে করে। এ যদি সত্য হয় তা হলে অপর যে তত্ত্বটি নিয়ে আমরা বহু সময় কাটিয়েছি সেটি আসলে কিছুই নয়। তাই নয় কি?
সেরূপই তো হওয়া সম্ভব।
কিন্তু একথাও সত্য যে, কেউ যদি কোনো বস্তুর আকাঙ্ক্ষা করে তা হলে বুঝতে হবে সে বস্তুর অভাব সে বোধ করছে?
তা ঠিক।
এবং যেটি তার অভাব সেটি তার প্রিয়?
হ্যাঁ তাই।
এবং যা তার অভাব তা থেকে সে বঞ্চিত?
অবশ্যই বঞ্চিত।
তা হলে প্রেম, ভালবাসা, কামনা, আকাক্ষা, বন্ধুত্ব সবই এক পর্যায়ভুক্ত। তাই নয় কি লীসিস ও মেনেক্সেনাস?
তারা উভয়েই বলে উঠল : অবশ্যই।
তা হলে বৎসগণ! আমি বলতে চাই যে, কেউ যদি কাউকে ভালবাসে তা হলে তারা উভয়েই আত্মার দিক দিয়ে চরিত্র ও গঠনে এবং আচার-আচরণে সমপ্ৰকৃতিসম্পন্ন?
মেনেক্সেনাস বলে উঠল : “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।’ কিন্তু আমি দেখলাম লীসিস নীরব হয়ে রয়েছে।
তা হলে সাধারণভাবে বলা চলে যে, একমাত্র সমপ্রকৃতি সম্পন্নকেই ভালবাসা আবশ্যক।
পূর্বের অভিমত অনুসারে তাই দাঁড়ায়।
তা হলে যে প্রেমিক সত্যিকার প্রেমিক, কপট কিংবা কৃত্রিম নয় তাকে তার ভালবাসার পাত্রও অবশ্য ভালবাসবে।
আমার কথা লীসিস এবং মেনেক্সনাস একটুমাত্র ক্ষীণ সম্মতির আভাস জানাল। কিন্তু দেখলাম, হিপোথ্যালিস আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠেছে-তার মুখমণ্ডলে নানা রঙের আভাস খেলে যাচ্ছে।
আমার যুক্তিটিকে পুনঃপরীক্ষার উদ্দেশ্যে আমি বললাম : লীসিস ও মেননক্সেনাস, সমপ্রকৃতি এবং সদৃশের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য নির্ধারণ করা চলে? যদি তা সম্ভব হয় তা হলেই মাত্র সখ্যের উপর এই বিতর্কের একটি সার্থকতা আছে বলা চলে। কিন্তু ‘সপ্রকৃতি’ যদি পার্থক্যহীনভাবে সদৃশ হয় তা হলে অপর যে যুক্তিতে আমরা বলেছি ‘সদৃশই সদৃশের শত্রু’ তার মীমাংসা কী করে ঘটবে? কেননা যদি বলা হয় যা শত্ৰু ৰা। অর্থহীন তাই প্রিয়, তা হলে কথাটি অসংগত হয়ে দাঁড়াবে। তা হলে এস, বরঞ্চ আমরা ‘সমপ্রকৃতি’ ও ‘সদৃশের’ মধ্যে একটি পার্থক্য নির্ধারণের চেষ্টা করি। আমাদের যুক্তি বর্তমান প্রবলতায় এটি করা অসম্ভব নয়।
হ্যাঁ সে কথা ঠিক।
বেশ তা হলে আমরা কি একথাও বলতে পারি, সৎ সবার নিকট গ্রহণযোগ্য এবং অসৎ গ্রহণের অযোগ্য; অথবা অসৎ-এর নিকট এবং সৎ-এর নিকট গ্রহণযোগ্য? কিন্তু যে সৎ এবং অসৎ কোনোটিই নয় সে অনুরূপভাবে যে সৎ কিংবা অসৎ কোনোটি নয় তার নিকটই গ্রহণযোগ্য?
তারা উভয়েই আমার দ্বিতীয় বিকল্পকে গ্রহণ করার পক্ষে সম্মতি জানাল।
তা হলে বৎসগণ! আমরা কি আমাদের পরিত্যক্ত ভ্রান্তির আবর্তেই আবদ্ধ হয়ে পড়ছি না? অর্থাৎ তখন আবার অন্যায় অন্যায়ের, অসৎ অসৎ-এর এবং সৎ সৎ-এর বন্ধু বলে পরিগণিত হবে না?
হ্যাঁ তাই তো!
কিন্তু আবার যদি ‘সমপ্রকৃতিকে’ আমরা সৎ-এর সঙ্গে অভিন্ন বিবেচনা করি তা হলে সৎ এবং সমপ্ৰকৃতিই মাত্র সৎ-এর বন্ধু হতে পারবে?
হ্যাঁ তাই।
কিন্তু তোমরা স্মরণ করলে দেখবে যে, এ অভিমতটিকেও আমরা খণ্ডন করেছি।
হ্যাঁ আমাদের স্মরণ হচ্ছে।
তা হলে এবার আমাদের করণীয় কী? অথবা আদৌ করণীয় কি কিছু রয়েছে? বিচারকক্ষে জ্ঞানী আইনজ্ঞদের ন্যায় আমি শুধুমাত্র সমস্ত যুক্তির একটি সারমর্মই পেশ করতে পারি : যদি প্রিয় প্রেমাস্পদের, সদৃশ সদৃশের কিংবা সদৃশ বিসদৃশের বা সমপ্রকৃতি সমপ্রকৃতির এবং অনুরূপ অপরাপর বস্তু বা ব্যক্তি কেউ কারো বন্ধু না হয় তা হলে এ বিষয় নিয়ে বলার মতো কিছুই কি অবশিষ্ট থাকে?
যুক্তির এই সংকট সময়ে আমি বয়োবৃদ্ধের সাহায্যের জন্য আবেদন করতে যাচ্ছিলাম, এমন সময়ে লীসিস এবং মেনেক্সেনাসের শিক্ষক তাদের ভ্রাতা সমভিব্যাহারে এসে উভয়কে রাত্রি অধিক হওয়ার কারণে গৃহে ফিরে যাওয়ার আদেশ করল। যুবকেরা চলে যেতেই হারমিয়া উৎসবে সুরাপানে মত্ত জনতার ভিড় দুর্বোধ্য ভাষায় পশ্চাৎ থেকে চিৎকার শুরু করে দিল। আমরা প্রথমে তাদের চলে যেতে বললাম। কিন্তু আমাদের কথায় কর্ণপাত না করায় পথিপার্শ্বস্থ নাগরিকদের নিয়ে আমরা তাদের ছত্রভঙ্গ করলাম এবং প্রস্থানের সময়ে তরুণদ্বয়কে উদ্দেশ করে আমি বললাম : বৎস লীসিস ও মেনেক্সেনাস, তোমাদের ন্যায় তরুণদের সঙ্গে আমার ন্যায় বৃদ্ধের এই বন্ধুত্ব দেখে পথিকগণ হয়তো ভাববে, কী হাস্যকর এই বন্ধুত্ব। এই নিয়ে তারা হয়তো অনেক কথা বলবে। অথচ আমরা কিন্তু এই দীর্ঘ আলোচনা শেষে এখনো অনুধাবন করতে সক্ষম হলাম না, বন্ধুত্ব বস্তুটি প্রকৃতপক্ষে কী?