লীলা নাগের হীরক হার — ১৩১
পোড়োবাড়ির অন্ধকার মেঝেতে উবু হয়ে পড়ে আছে মিঃ বিশ্বাস। মোমের ক্ষীণালোকে তার দেহের পাশে গড়িয়ে পড়া তাজা লাল রক্ত চক্ চক্ করছে। অদ্ভুত সে দৃশ্য। যা মানুষ ভাবতে পারে না তেমনি এক পরিণাম।
রিজভী সাহেব একবার তাকিয়ে দেখলেন বন্ধু বিশ্বাসের শেষ পরিণতি। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা অনুভব করলেন তিনি। যারা মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি অন্যায় করে তাদের বুঝি এমনি শাস্তিই হয়। একদিন কতনা বিশ্বাস করেছিলেন তিনি ওকে। সমস্ত অন্তরের কথা মিঃ বিশ্বাসকে রিজভী সাহেব বলতেন, এমনকি তার ব্যবসার সব দায়িত্বভারও তিনি মিঃ বিশ্বাসকে বিশ্বাস করে অর্পণ করেছিলেন। সেই নরপিশাচ বিশ্বাস তার শুধু সর্বনাশই করেনি, তাকে রিক্ত নিঃস্ব করেছে, তাকে পথের ভিখারী করেও শান্তি পায়নি, রিজভীর একমাত্র আদরিণী কন্যাকে অপহরণ করেছে। নির্মমভাবে হত্যা করার জন্য রিজভীকে পোড়োবাড়ির অন্ধকারময় স্যাঁতস্যাঁতে কক্ষে বন্দী করে রেখেছিলো….।
অনেকগুলো চিন্তার জাল ছড়িয়ে পড়েছিলো জনাব রিজভীর মাথায়। বৃদ্ধবেশি বনহুর বুঝতে পারলো, মিঃ রিজভীর মনে এ দৃশ্য আঘাত হেনেছে। বেচারা সরল-সহজ মানুষ, বিশ্বাস তার চরম ক্ষতিই করেনি, তাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলো। ঠিক সময়মত কাজ করতে না পারলে মিঃ রিজভীকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। বনহুর বললো–কি ভাবছেন? চলে আসুন আমার সঙ্গে।
হ্যাঁ, আমি যাবো। এ মৃত্যুগহ্বরে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মিঃ রিজভী বনহুর আর শিখ ড্রাইভারবেশি রাণীর সঙ্গে বেরিয়ে এলেন।
গাড়ির দরজা খুলে ধরলো বনহুর, তখনও তার মুখে শুভ্র দাড়ি, মাথার চুল পাকা। চোখে চশমা এবং শরীরে সাদাসিধা পোশাক। অবশ্য বিশ্বাসকে গুলী বিদ্ধ করবার পূর্বে বনহুর নিজ মুখমন্ডল থেকে দাড়ি-গোঁফ খুলে নিয়েছিলো, তারপর আবার সে পরে নেয়, কারণ মিঃ রিজভীর বাসায় তাকে যেতে হবে। বেগম রিজভী তাকে যেভাবে দেখেছিলেন সেভাবেই বনহুর ঐ বাসায় যেতে চায়।
গাড়িতে উঠে বসলেন মিঃ রিজভী।
পাশে বনহুর, রাণী ড্রাইভ আসনে বসলো।
গাড়ি ছুটতে শুরু করলো।
বনহুর একবার পোড়োবাড়িখানার দিকে তাকিয়ে দেখলো, হয়তো বা তার মনে উদয় হলো সেই প্রাণহীন বিশ্বাসঘাতকের কথা।
গাড়ি আরাকানের রাজপথ বেয়ে ছুটছে।
দু’পাশে অট্টালিকা।
লাইট পোষ্টগুলো স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কুয়াশাচ্ছন্ন আবছা অন্ধকার পথ। মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে তাদের গাড়ির পাশ কেটে।
প্রথমে জনহীন পথ, তারপর জনমুখর পথ। এ পথে যানবাহন বেশি চলাচল করছে। লাইট পোষ্টগুলোকে বেশ সজীব মনে হচ্ছে যেন।
গাড়ির জানালাপথে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কি সব ভাবছিলেন মিঃ রিজভী। সদ্য মৃত্যুর মুখ থেকে তিনি রক্ষা পেলেন বটে কিন্তু তার একমাত্র কন্যা মাসুমা কোথায়? সে কি ফিরে এসেছে, শয়তান বিশ্বাস তাকে অপহরণ করেছে। না জানি তাকে তারা কেমন অবস্থায় রেখেছে……তাকে পেলে খুশি হবেন তার মা, খুশি হবেন নিজে কিন্তু সমাজ কি তাকে আশ্রয় দেবে? সমাজের কাছে মাসুমা প্রাণহীন, মৃত। না না, তাদের একমাত্র কন্যা, যতকিছু ঘটুক তবু তারা কন্যাকে বুকে তুলে নেবেন। জনসমাজ এ কারণে যদি তাকে ঘৃণা করে তবুও তিনি বিচলিত হবেন না। আরাকান ত্যাগ করে তিনি অন্য কোনো দেশে চলে যাবেন। যেখানে কেউই তাকে চিনবে না, জানবে না। তিনি মাসুমার জন্য তার সব সম্পত্তি, কল-কারখানা ত্যাগ করতে রাজি আছেন তবুও তিনি কন্যাকে ফিরে পেতে চান।
বাইরের লাইটপোষ্টের আলোগুলো থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি মাঝে মাঝে বনহুর আর মিঃ রিজভীর মুখে ও শরীরে এসে পড়ছিলো। তাদের মনে এবং শরীরে এ আলোর ঝলক এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করছিলো। লাইট পোষ্টগুলো যেন তাদের মনের কথাগুলো ব্যক্ত করছিলো, ইংগিত দিচ্ছিলো কোনো এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির। ভাবছিলেন মিঃ রিজভী-এরা কারা, এদের কি উদ্দেশ্য? কেমন করেই বা এলো এরা তার এই মৃত্যুভয়াল অন্ধকার কারাকক্ষে। মিঃ বিশ্বাসের সঙ্গেই বা এদের কি সম্পর্ক, তাকে হত্যা করে উদ্ধার করলো ওরা আমাকে, নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো কারণ আছে, কিন্তু কি সে কারণ?
মিঃ রিজভীর চিন্তাধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, পাশে উপবিষ্ট বনহুর বললো–মিঃ রিজভী, আজ কতদিন আপনি ঐ অন্ধকার কারাকক্ষে আবদ্ধ ছিলেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন মিঃ রিজভী-প্রায় দু’সপ্তাহের মত আমাকে ওরা ঐ অন্ধকার কারাকক্ষে বন্দী রেখেছে। ওরা আমার ওপর জঘন্য নির্যাতন চালিয়েছে। ক্ষুধা-পিপাসায় আমার কণ্ঠনালী শুকিয়ে গেছে তবুও আমাকে ওরা স্বচ্ছ পানি বা খাবার দেয়নি। তবে মাঝে মাঝে শুকনো পাউরুটি আর অর্ধ সিদ্ধ মাংস দিতে, যা আমার গলা দিয়ে নামতো না।
বনহুর একটি শব্দ করলো–হু।
ড্রাইভ আসন থেকে শিখ ড্রাইভারবেশি রাণী বললো–এর মধ্যে আপনার স্ত্রীর সংবাদ পেয়েছিলেন কি?
না। জানি না আমার স্ত্রীর খবর, মাসুমার শোকে জীবিত আছেন না মৃত্যুবরণ করেছেন কিছু জানি না।
বললো বনহুর তিনি সুস্থ আছেন। আপনি তাকে বাড়ি পৌঁছে দেখতে পাবেন।
সত্যি বলছেন আপনারা?
হ্যাঁ, সত্যি বলছি।
বেশ কিছু সময় পর বনহুর, রাণী ও মিঃ রিজভী তার বাড়িতে পৌঁছে গেলেন।
মিসেস রিজভী স্বামীকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হলেন। তিনি বললেন-ওগো এতোদিন কোথায় ছিলে? একি অবস্থা হয়েছে তোমার? বলো, বলো কোথায় ছিলে? আমার মাসুমা কোথায়? তাকে তুমি দেখেছো?
স্ত্রীর এতগুলো প্রশ্নের জবাব কি দেবেন মিঃ রিজভী, তার চোখেমুখে একটা ব্যথাাকাতর ফ্যাকাশে ভাব ফুটে উঠেছে। বললেন তিনি-আমার বন্ধু বিশ্বাস আমাকে একটি পোড়োবাড়ির অন্ধকার ঘরে আটকে রেখেছিলো। সে আমাকে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলো, আর এক মুহূর্ত দেরি হলে আমি বিশ্বাসের হাতে মৃত্যুবরণ করতাম। ভাগ্যিস এরা, এই মহৎ ব্যক্তিদ্বয় আমাকে রক্ষা করেছেন বেগম, ওঁদের বসতে দাও, ওদের বসতে দাও….
মিসেস রিজভী স্বামীর হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে ফিরে তাকালেন বনহুর আর রাণীর দিকে, বললেন-আপনারা বসুন। বৃদ্ধবেশি বনহুরকে লক্ষ্য করে বললেন তিনি ইনাকে আমি জানি, আরও দু’দিন ইনি এসেছিলেন। বিশ্বাসের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। ইনি আমাদের হিতাকাক্ষী।
ঠিক বলেছো বেগম। জানি না কে ইনারা, কি ইনাদের পরিচয়- তবুও আমি এদের যতটুকু জেনেছি তাতে বুঝতে পেরেছি ইনারা গোয়েন্দা বিভাগের লোক।
একটু হেসে বললো বনহুর–আপনার ধারণা সত্য। আমার সহকারী যাকে শিখ ড্রাইভাররূপে দেখছেন সে আমার সঙ্গী-সহকারিণীও বটে। বসো রাণী! রাণীকে বসতে বলে বনহুরও আসন গ্রহণ করলো।
মিসেস রিজভী বললেন-আগে আপনাদের জন্য চা আনতে বলি।
এবার রাণী বললো–চা লাগবে না, কিছু কথা আছে আপনাদের সঙ্গে, তাই বসেছি। আপনিও বসুন।
মিসেস রিজভী তবুও চলে গেলেন অন্তপুরে, যাবার সময় বললেন-এ বাড়ি থেকে কোনোদিন কোনো অতিথি শুধু মুখে ফিরে যাননি। আমি এক্ষুণি আসছি….
মিসেস রিজভী যাবার একটু পরই ফিরে এলেন এবং তাদের পাশে বসলেন।
মিঃ রিজভীর চোখেমুখে একটা ফ্যাকাশে করুণ ভাব, তিনি আজ যেন রিক্ত নিঃস্ব অসহায়। ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি উদ্ধারকারীদ্বয়ের মুখের দিকে।
বনহুর তার কোটের পকেট থেকে ছোট্ট ব্যাগ বের করে বাড়িয়ে ধরলো মিসেস রিজভীর দিকে-এই নিন, মিঃ বিশ্বাস আপনার নিকট হতে যে অলংকারগুলো মিথ্যা কথা বলে নিয়ে গিয়েছিলো তা ফেরত এনেছি। সে গয়নাগুলোসহ এই ছোট্ট ব্যাগটি তার গাড়ির ভেতরে রেখেছিলো। আমার সঙ্গী শিখবেশি ড্রাইভার তা উদ্ধার করেছিলো, এ জন্য সে ধন্যবাদের যোগ্য।
মিসেস রিজভী হাত বাড়িয়ে তার নিজের মূল্যবান অলংকারগুলো গ্রহণ করলেন এবং কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন রাণীর দিকে। তারপর বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন-আমার মাসুমা কোথায়? তাকে উদ্ধার করে আনুন। তাকে এনে দিন আপনারা।
বললো বনহুর–দেখুন, সব সময় সবকিছু পাওয়া যায় না। যা হারিয়ে গেছে তা সবই হয়তো পাবেন না। তবে ধৈর্যই হলো মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। মাসুমাকে কবে ফিরে পাবেন তা জানি না। তবে স্বামীকে ফিরে পেয়েছেন এটা আপনার শুধু নয়, আমাদেরও পরম সৌভাগ্য। এবার আমরা চলি মিসেস রিজভী।
উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিসেস রিজভী। তিনি বললেন-আপনারা চলে যাচ্ছেন কিন্তু আমার মা-আমার মাকে এনে দেবেন না? আমার মাসুমাকে ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না যে বাবা আপনারা আমার মা মণিকে এনে দিন…এনে দিন আমার মাকে
মিসেস রিজভীর কান্নাভরা কণ্ঠস্বর বনহুরের হৃদয়ে আঘাত করলো। তার চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে আসছিলো। রাণীর চোখেও অশ্রু ভরে আসছিলো, নিজকে সংযত করে বললো–আপনাদের ব্যথা আমরা হৃদয় দিয়ে অনুভব করছি। আবার আসবো আমরা
কথাগুলো বলে রাণী আর বনহুর উঠে দাঁড়ালো।
মিঃ রিজভী অসহায় করুণ চোখে তাদের বিদায় সম্ভাষণ জানালেন।
মিসেস রিজভী আঁচলে চোখ মুছতে লাগলেন।
*
বিশ্বাসের হত্যাকারী মিঃ রিজভীকে আমরা সমুচিত শাস্তি দেবো। তার সব আমরা হরণ করেছি শুধু আছে তাদের জীবন হাঃ হাঃ হাঃ, আমরা বিশ্বাসকে হারিয়েছি কিন্তু আমরা মরে যাইনি। দাঁতে দাঁত পিষে কথাগুলো বললো মিঃ বিশ্বাসের সহকারী বলহরি সিং। তার চোখেমুখে একটা হিংস্রভাব ফুটে উঠেছে।
আরাকানের ব্যবসা কেন্দ্রস্থল হংলিজ। হংলিজ-এর মধ্যস্থলে মিঃ বিশ্বাসের অফিসকক্ষ। কয়েকটি চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছে কয়েকটি লোক। তারা মিঃ বিশ্বাসের সহকারী-বিশ্বস্ত লোক। মিঃ বিশ্বাসের হত্যারহস্য নিয়েই তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে।
রাত তখন একটা।
ওদের কথাবার্তা ছিলো চাপা এবং রহস্যপূর্ণ।
এত রাতে বৈদ্যুতিক আলোকরশি জানালাপথে যেন বাইরের লোকজনের দৃষ্টি আকৃষ্ট না করে সে জন্য তারা অফিসকক্ষের জানালা ভালভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। বাইরের কোনো শব্দ যেন তাদের আলাপ-আলোচনায় ব্যাঘাত না ঘটায় সেদিকে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছে তারা।
বলহরি সিং-এর কথায় অপর একজন বলে উঠলো–মিঃ রিজভী আমাদের নেতাকে হত্যাই শুধু করেনি, তাকে হত্যা করে ভেগেছে। এবার সে সজাগ হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, আমাদের গোপন আড্ডাখানার গোপনতা ফাঁস হয়ে যাবে। আমি পূর্বেই বলেছিলাম তাকে আর জীবিত রাখা মোটেই সমীচীন নয়। কিন্তু মিঃ বিশ্বাস তাতে কান দেয়নি। তার ভাগ্য তাকে পরিহাস করেছে।
কিন্তু আমরা রেহাই দেবো না মিঃ রিজভীকে। তার সব সে হারিয়েছে কিন্তু এখনও জীবনে বেঁচে আছে। তার স্ত্রী-সংসার ফিরে পেয়েছে, হ্যাঁ এবার কন্যা মাসুমাকেও পাবে।
সেই প্রতীক্ষায় ছিলো মিঃ বিশ্বাস আর সে কারণেই আজও মিঃ রিজভীকে আমরা জীবিত রেখেছিলাম।
অপর একজন বলে উঠলো–তাকে জীবিত রেখেই আমরা চরম ভুল করেছি। আমরা তাকে হাতের মুঠায় পেয়েও হারালাম। আবার তাকে খাঁচায় ভরতে বেশ বেগ পেতে হবে।
কৌশলে কাজ করতে হবে। কথাটা গম্ভীর কণ্ঠে বললো বলহরি সিং। এবার মিঃ বিশ্বাসের লাশের ব্যাপারে চিন্তা করো। কালকের পত্রিকায় আমরা সংবাদ দিয়েছি, মিঃ বিশ্বাসকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার কোনো এক বন্ধুর সঙ্গে তিনি বাইরের কাজে গিয়েছিলেন কিন্তু ফিরে আসেননি। পুলিশমহলেও সংবাদটা জানাজানি হয়ে গেছে।
থামলো বলহরি সিং। তারপর আবার বললো–বিশ্বাসের লাশ কি ঐ বাড়িতেই আছে?
হ্যাঁ, সেখানেই পাশের কুঠুরীতে অন্ধকারে মাদুর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। একটু থেমে বললো লোকটা-স্যার, লাশটা শেষ পর্যন্ত কি ঐ অন্ধকার ঘরেই থাকবে?
না
তবে?
অপর একজন বলে উঠলো–লাশটা মিসেস বিশ্বাসের বাসভবনে পৌঁছে দেওয়াই সমীচীন বলে মনে করি।
আর একজন বললো–হা স্যার, তাই ভাল, কারণ মিসেস বিশ্বাস তার স্বামীর জন্য যেভাবে উতলা হয়ে উঠেছেন তাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। যেমন করে থোক তাকে জীবিত রাখতে হবে।
হ্যাঁ আমি জানি, কেমন করে তাকে জীবিত রাখতে হবে। মিঃ বিশ্বাসের লাশ পেলে আরও ভেঙে পড়বেন মিসেস বিশ্বাস। নিঃসন্তান মহিলা খেই হারিয়ে ফেলবেন। তার নামে যে সব ইন্ডাষ্ট্রি কলকারখানা আছে তা সব ভেসে যাবে তার চোখের পানিতে। হয়তো বা তিনি হার্টফেল করে বসবেন। কথাগুলো বললো বলহরি সিং। একটু হেসে বললো—এখন আমি তোমাদের মালিক।
একজন বলে উঠলো–সে কথা সত্য স্যার। আপনি যা বলবেন আমি ও আমাদের দলবল সবাই তা মেনে নেবো। তবে স্যার, মোটা অংক আমাদের জন্য রাখতে হবে। স্যার, আপনি এসেছিলেন সাগরে ভেসে মানে কোনো এক জাহাজের নাবিক হিসেবে, তারপর আমিই আপনাকে পথ দেখিয়ে আরাকান নগরীতে নিয়ে আসি এবং আমাদের মালিক মিঃ বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই
থাক, ওসব কথা নতুন করে বলে আমাকে
না স্যার, মাঝে মাঝে কথাটা বলতে আমি আনন্দ পাই আর সে আনন্দ প্রকাশ করি ঐভাবে। সেদিন কিন্তু আপনি সম্পূর্ণ রিক্ত হস্ত ছিলেন।
আবারও সেই পুরানো কথা। সমস্ত মানুষই তো একদিন রিক্ত আর নিঃস্ব হয়েই পৃথিবীর বুকে আসে। বলো তোমরা কেউ অস্বীকার করতে পারবে? তুমি আমি আমার তোমার বাপ দাদা সবাই এসেছে রিক্ত হস্তে। আমিও আরাকান এসেছিলাম রিক্ত হস্তে তবে বলহরি কোনোদিন ভুলবে না তোমার এ ঋণের কথা। সাম্স মোরিন, তুমি কি চাও বলো? এরা-তোমার সঙ্গী-সাথীরা সবাই সাক্ষী থাকবে তুমি যা চাইবে তাই পাবে আমার কাছে।
অফিসের মধ্যে কিছুক্ষণ একটা নীরবতা পরিলক্ষিত হয়। সবাই তাকায় সামস মোরিনের দিকে।
সামস মোরিনের মুখে একটা বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠলো, সে বললো–মিঃ বিশ্বাস আমাকে কথা দিয়েছিলেন লীলা নাগের কণ্ঠের হীরক হার তিনি আমাকে দেবেন। ঐ হারের প্রতি আমার মোহ বহুদিনের। স্যার, আপনি জানেন ঐ হীরক হার লীলা নাগের কণ্ঠে যাবার পূর্বে কার ছিলো।
তার মা মীনা নাগের। আমি সব জানি সামস মোরিন। আমি সব জানি। লীলা নাগের কণ্ঠে ঐ হার কে তুলে দিয়েছিলো তাও জানি। মিঃ বিশ্বাসের মুখে সে কাহিনী আমি শুনেছিলাম। অদ্ভুত সে কাহিনী
যদি বললে কোনো গোপনতা নষ্ট না হয় তাহলে বলুন স্যার? বললো সামস্ মোরিন।
অন্যান্য যারা উপস্থিত ছিলো তারা এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো।
বলহরি সিং বললো–এখন যে অবস্থায় আমরা এখানে বসে আলাপ করছি তা অত্যন্ত জটিলতাপূর্ণ পরিবেশ। মিঃ বিশ্বাসের লাশ এখনও সেই অন্ধকার ঘরে মাদুরের তলায় পঁচতে শুরু করেছে। হ্যাঁ, আমি তোমাকে বলেছি সব পাবে, তবে…
বলুন স্যার, থামলেন কেন?
আজ নয়।
স্যার, ঐ হারের পেছনে আমার বংশের একটা যোগাযোগ আছে। আর সে কারণেই আমি মিঃ বিশ্বাসের দলে যোগ দিয়েছি। নইলে আমার ইচ্ছা ছিলো না অসৎ কাজে যোগ দেই। লীলা নাগের হীরক হার আমাকে বাধ্য করেছে। কারণ আমার পিতামহ সামস গার্দানের সঙ্গে ভাব ছিলো লীলা নাগের জননী মীনা নাগের এবং ঐ হীরক হার আমার পিতামহ গার্দান তার সমস্ত ঐশ্বর্য বিক্রি করে মীনা নাগকে তৈরি করে দিয়ে মীনা নাগের বাসনা পূর্ণ করেছিলো। আমি জানতাম ঐ হার মিঃ বিশ্বাস আত্মসাৎ করার জন্য লীলা নাগের পরম বন্ধু সেজেছিলো….তারপর একদিন….
তুমি দেখছি সব জানো সামস মোরিন। বললো বলহরি সিং।
সামস মোরিন বললো–হা, আমিও সেই প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছি। মিঃ বিশ্বাস রতন লালকে বণিক মোহন লালের বেশে হোটেল লর্ড মার্গারেট-এ পাঠিয়েছিলো কৌশলে। রতন সফলকাম হয়েছিলো। সে মিস লীলা নাগকে হত্যা করে তার কণ্ঠ থেকে হীরক হার খুলে নিতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু তার সব চেষ্টা বিফল হয়েছিলো সেই ব্যক্তির দ্বারা, যে
ব্যক্তিটিকে মিঃ বিশ্বাস কোনো সময় দেখেছিলো আরাকান বিমান বন্দরে।
হ্যাঁ, ঐ কথা আমাকেও বলেছিলো মিঃ বিশ্বাস। যাক ও সব কথা। এবার আমাদের কাজের কথা থোক, সামস মোরিন, তুমি মিঃ বিশ্বাসের লাশকে আমাদের সেই পোতোবাড়ির চোরা কুঠরির মেঝেতে পুঁতে ফেলল। তোমাকে সাহায্য করবে মতিলাল, জাম্বু, আর শরিফ হামজা। বলহরি তাকালো এই তিনজনের মুখের দিকে।
তারা সবাই সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।
বলহরি বললো আবার-তোমরা সবাই আমাদের লোক। মিঃ বিশ্বাস আমাদের মালিক ছিলো বটে, কিন্তু তাকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে আমিই….
বলে উঠলো সামস্ মোরিন-হ্যাঁ, এ কথা আমরা সবাই জানি। স্যার, আপনার বুদ্ধিমত্তাই আমাদের কাজে বড় সহায়ক। এখন মিঃ বিশ্বাসের অবর্তমানে আপনিই আমাদের মালিক।
তাহলে আমি যা বলছি মানবে। কোনক্রমেই মিঃ বিশ্বাসের নিহত হবার সংবাদ কাউকে জানাবে না। আমাদের সঙ্গে যারা কারবার করছে তাদের কাউকে নয়। আমি জানি এ কথাটা জানাজানি হলে আমাদের ব্যবসা মাঠে মারা পড়বে। তার স্ত্রী আমাদের হাতে কোনো মালামাল বা চেক প্রদান করবেন না। কাজেই তোমরা বলবে, মিঃ বিশ্বাস কোন জরুরি কাজে দেশের বাইরে গেছে। কবে কখন ফিরবে তা তোমরা জানো না। তার স্ত্রীকেও এই একই কথা বলবে।
হ্যাঁ স্যার, আমরা প্রস্তুত আছি। প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলো সবাই।
বলহরি বললো–আরও অনেক কাজ বেড়ে গেলো। মিঃ বিশ্বাসের সই নকল করতে হবে যেন সূক্ষ্মভাবে সব কাজ সমাধা হয়! হ্যাঁ, সব কাজের পূর্বে মিঃ রিজভীকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে সরিয়ে ফেলতে হবে, নইলে তার সব ধন-সম্পত্তি যা কৌশলে আমরা হস্তগত করেছি তা আবার হারাবো।
এ কথা সত্য স্যার। আমাদের সব প্রচেষ্টা বিফল হবে। আমরা চাই না মিঃ বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের সব কিছু হারাই। কথাগুলো বললো মিঃ গুহো।
মিঃ গুহো মিঃ বিশ্বাসের একজন বিশ্বস্ত সহকর্মী। অত্যন্ত চালাক সে, তাই কথা কম বলে। যা বলে তা অতি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যক্ত করে। একটু থেমে বললো মিঃ গুহো–মিঃ বিশ্বাসের লাশ পুঁতে ফেলার পূর্বে আমাদের একবার দেখা দরকার। কারণ এতদিন যার সঙ্গে
কাজ করেছি তাকে একবার শেষ দেখা দেখতে চাই আমরা।
বলহরি বলে উঠলো—এ আব্দার তোমার সাজে না শুহো। তুমি তো জানো সে স্থানে কেউ সহজে যেতে পারে না।
বললো গুহো–কারণ?
বলহরি তেমনি বলিষ্ঠ গলায় বললো–ঐ বাড়ির অভ্যন্তরে আমাদের যথাসর্বস্ব লুকানো আছে তাকি তুমি জানো না? মাটির তলায় যে গুপ্ত কক্ষ আছে-সেখানে এখনও দু’শর অধিক ড্রাম মাদকদ্রব্য মজুত আছে। আমাদের মালামাল এখনও দ্বিতীয় জাহাজ সাংতুর জন্য অপেক্ষা করছে। ঐ মালামালের মূল্য কোটি কোটি টাকা। যা আমার, তোমার, আমাদের সকলের।
মিঃ গুহো বললো–শুধু ঐ মাদকদ্রব্যই কি আমাদের মজুত আছে? আরও যা আছে তার হিসাব সামান্য টাকা দিয়ে মাপা যায় না স্যার।
হ্যাঁ, গুহো, তুমি ঠিক বলছো। মাদকদ্রব্য ছাড়া যে মালামাল আছে তা—-শোন গুহো, সব কথা বলা ঠিক নয়, কারণ দেয়ালেরও কান আছে। আমরা সব সময় সবকিছু খোলাখুলি আলাপ করতে পারি না।
গুহোর দাঁড়িভরা মুখখানা একটু ম্লান হলো। চোখের কালো চশমাটা তুলে ঠিক করে নিলো।
হিরন্ময় সিং বলহরির চাচাতো ভাই, সেও এসেছিলো বলহরির সঙ্গে আরাকানে। লোকটা অত্যন্ত শক্তিশালী তাই মিঃ বিশ্বাস তাকে দলে নিয়েছিলো। লোকটার মন বলে কিছু ছিলো না। সে শুধু হুকুমের দাস, নির্দেশ পেলেই সে যাকে-তাকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করে না-সবই পারে সে। এবার বলহরি তাকালো ওপাশে বসা হিরন্ময় সিং-এর দিকে। বললো সে-হিরন্ময়, তোমার ওপর একটা গুরুদায়িত্ব দিলাম।
বল কি সে গুরুদায়িত্ব? বললো হিরন্ময় সিং।
বলহরি বললো–মিঃ রিজভী যেভাবে মিঃ বিশ্বাসকে হত্যা করেছে ঠিক সেভাবে তাকে হত্যা করার জন্য তোমার ওপর নির্দেশ দিলাম।
আচ্ছা আমি রাজি।
জানি তুমিই পারবে তাকে খতম করতে।
হ্যাঁ, আমিই তাকে নিঃশেষ করে দেবো। বিনিময়ে কি দেবে?
পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবে রিজভীর মাথার জন্য।
না, তা হবে না। আমাকে দিতে হবে এক লাখ টাকা।
আচ্ছা তাই হবে।
সত্যি দেবে তো বলহরি দাদা?
আমার কথার কোনোদিন নড়চড় হয়েছে? হয়নি। এবারও হবে না। যাও হিরন্ময়, তোমার কাজে যাও, কিন্তু খুব গোপনে। কেউ যেন টের না পায়।
কত লোককেই না এ হাতে খতম করলাম আর ঐ বুড়ো লোকটা-ছোঃ তুলে আনবো তাকে তার হলঘর থেকে। রুমালে ওষুধ মিশিয়ে নেবো-আর কিছু বলতে হবে না, সব আমার জানা আছে।
হ্যাঁ, খুব সাবধানে কাজ করবে। যেন কিছু ফাঁস হয়ে না যায়। ব্যাটা রিজভীকে খতম না করা পর্যন্ত আমাদের স্বস্তি নেই। ওকে জীবিত রাখলে সর্বনাশ হবে। মিঃ বিশ্বাসের সঙ্গে আমরা হারাবো আমাদের অনেক কিছু। যে ক্ষতির কোনো হিসাব নেই।
আরও কিছুক্ষণ ওদের মধ্যে গোপন আলাপ আলোচনা চললো, তারপর সেদিনের মত যে যার কাজে বেরিয়ে গেলো।
বলহরি বললো,-সামস মোরিন, তোমার ওপর দায়িত্ব রইলো লাশ পুঁতে ফেলার! তবে হ্যাঁ, আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, তারপর মিঃ রিজভীর প্রিয় বন্ধু ছিলো মিঃ বিশ্বাস। আমি চাই একই কবরে দু’বন্ধু ঘুমাবে চিরকালের জন্য।
*
মিঃ রিজভীর বাসভনের সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো। সম্পূর্ণ কালো রঙের গাড়ি। এক ভদ্রলোক নেমে এলো গাড়ি থেকে, অপর একজন বসে রইলো গাড়িতে। লোকটার হাতে একটা ব্যাগ। ব্যাগটা সে যত্ন সহকারে হাতের মুঠায় ধরে এগুলো মিঃ রিজভীর বাসভবনের দিকে।
দরজা খোলাই ছিলো।
গাড়ি থেকে যে লোকটা নেমে এলো সে দরজা ঠেলে কক্ষে প্রবেশ করলো। লোকটা কক্ষে প্রবেশ করতেই মিঃ রিজভী হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন এবং বললেন-জানতাম আপনি আসবেন। আমি প্রস্তুত মিঃ বলহরি সিং। চলুন কোথায় যেতে হবে?
বলহরি সিং এবার কথা বললো–সত্যি মিঃ বিশ্বাস আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন তা আমরা জানতাম না। আমি দুঃখিত এ ব্যাপারে। মিঃ বিশ্বাস আমাদের একজন বিশ্বাসী বন্ধু এবং সহকর্মী বলা যায়। মিঃ রিজভী, এখন মিঃ বিশ্বাস কোথায় আছেন?
মিঃ রিজভী বললেন-বসুন মিঃ বলহরি সিং, সব বলছি। আমি ভাবতেও পারিনি, বিশ্বাস আমার এমন সর্বনাশ করবে।
বলহরি সিং আসন গ্রহণ করে বললো–আমিও অবাক হয়েছি। বারবার তাকাচ্ছে সে হাতঘড়িটার দিকে। কথাটা আনমনাভাবে বললো সে।
মিঃ রিজভী বললেন-মাসুমা তাহলে জীবিত আছে? সত্যি আমি তার দেখা পাবো?
হ্যাঁ পাবেন, আর পাবেন বলেইত আপনাকে আমি এই রাত দুটোয় নিতে এসেছি।
আমি আমার মাকে তাহলে ফিরে পাবো?
পাবেন। আসুন আমার সঙ্গে। মিঃ বিশ্বাস আমাদের পাটনার, তাকে আমরা শ্রদ্ধা এবং সমীহ করি। কিন্তু সে আমাদের সবার চোখে ধূলো দিয়ে আপনার একমাত্র কন্যা মাসুমাকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেলো আর তাকে আপনার ঘরে ফিরিয়ে আনলো না। এ কারণে আমরা তার ওপর মোটেই সন্তুষ্ট নই।
হ্যাঁ, এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা সে করবে ভাবতে পারিনি মিঃ বলহরি। শুধু সে আমার কন্যাকে হরণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, আমাকে সে রিক্ত, নিঃস্ব করেছে।
জানি, সব জানি মিঃ রিজভী। আপনার সব সে আত্মসাৎ করেছে তা আমরা জানি। তবে আপনি সন্দেহ করে থাকবেন আমরাও তার সঙ্গে আছি বা ছিলাম। বিশ্বাস করুন মিঃ রিজভী, আমরা কোনোদিনই তার অসৎ চিন্তাধারার সঙ্গে সংযুক্ত ছিলাম না। আমরা একসঙ্গে ব্যবসা করতাম যেমন আপনিও তার একজন পার্টনার। কাজেই তাকে আমরা পূর্বে বিশ্বাস করলেও এখন করতে পারি না। একটু থেমে বললো বলহরি সিং-আজ কদিন হলো মিঃ বিশ্বাস গা ঢাকা দিয়ে কোথায় চলে গেছে আমরা জানি না। আবার সে কি মতলব নিয়ে আত্মগোপন করেছে সেই জানে।
মিঃ রিজভীর চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটি অন্ধকার কক্ষ, সম্মুখে মোমবাতি জ্বলছে, স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে উবু হয়ে পড়ে আছে মিঃ বিশ্বাস। রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে তার দেহের পাশে মেঝেটা….
কি ভাবছেন মিঃ রিজভী।
ভাবছি বিশ্বাসের বিশ্বাসঘাতকতার কথা। বলহরি সিং তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো মিঃ রিজভীর মুখের দিকে, চোখ দুটো তার জ্বলে উঠলো, দাঁতে দাঁত পিষে বললো আপন মনে, রিজভী, তুমি বিশ্বাসকে হত্যা করে জীবনে বেঁচে আছে। ভেবেছো কেউ জানবে না তোমার গোপন কথা। আমরাই বিশ্বাসের হত্যার প্রতিশোধ নেবো
মিঃ বলহরি, আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আপনি যা করলেন সে ঋণ আমি কোনোদিন পরিশোধ করতে পারবো না। আঃ, আমার মা মাসুমাকে কতদিন দেখিনি! সত্যি আমার মাসুমার সন্ধান আপনারা পেয়েছেন?
বললাম তো মিঃ রিজভী, আমি কোনোদিন মিথ্যা বলতে জানি না। সঠিক সন্ধান নিয়েই তবে এসেছি।
চলুন তাহলে বিলম্ব করা উচিত নয়। মাকে দেখার জন্য মন আমার বড় অস্থির হয়ে আছে।
তাহলে উঠে পড়ুন। বলে উঠে দাঁড়ালো বলহরি। আসন ত্যাগ করবার পূর্বে একবার ব্যাগটা খুলে দেখে নিলো। ব্যাগের ভেতরে চকচক করে উঠলো জমকালো রিভলভারখানা। একটু হাসলো বলহরি সিং।
মিঃ রিজভী অন্তপুরে গেলেন, স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বললেন-তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, আমি মাসুমাকে নিয়ে এক্ষুণি ফিরে আসবো।
বললেন মিসেস রিজভী-আমার কিন্তু কিছু ভাল লাগছে না। তোমার প্রিয় বন্ধু মিঃ বিশ্বাস তোমাকে একদিন এমনি করে নিয়ে গিয়েছিলো
না না, তুমি কিছু ভেবো না। বলহরি সিং সত্ব্যক্তি, তাকে অবিশ্বাসের কিছু নেই। সব আল্লাহ ভরসা বেগম, সব আল্লাহ ভরসা বেরিয়ে গেলেন মিঃ রিজভী।
কিছুক্ষণ পর গাড়ি ছাড়ার শব্দ হলো।
মিসেস রিজভী দুহাত তুলে বললেন-হে রাব্দুল আলামিন, তুমি হেফাজতকারী…
ড্রাইভারের আসনের পাশে বসলো বলহরি সিং।
পেছন আসনে মিঃ রিজভী।
গাড়িখানা দ্রুত বেরিয়ে গেলো মিঃ রিজভীর বাসভবন থেকে।
জনহীন রাজপথ।
আরাকান নগরী ঘুমিয়ে আছে।
সুউচ্চ দালানগুলো স্বপ্নপুরীর রাজপ্রাসাদের মত দাঁড়িয়ে আছে পথের দুপাশে। কোনো কোনো জানালাপথে বৈদ্যুতিক আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো। হয়তো বা কোনো পরীক্ষার্থী রাত জেগে পড়াশোনা করছে, অথবা কোনো গবেষক তার গবেষণাগারে গভীর রাতে গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত। এমনি কিছু না কিছু করছে কেউ না কেউ।
মিঃ রিজভী বললেন-আমার বড় আনন্দ লাগছে। মাসুমার মুখ দেখতে পাবো। বলহরি সিং, আমার মাসুমাকে আপনি দেখেছেন? সে সুস্থ আছে?
হ্যাঁ আছে। একটু পরই আপনি তাকে দেখতে পারবেন মিঃ রিজভী। শুনুন মিঃ রিজভী, আপনি বলেছিলেন মাসুমার সন্ধান যে দিতে পারবে আপনি তাকে আপনার হামান ইন্ডাষ্ট্রি উইল করে দেবেন।
ঐ একটি ইন্ডাষ্ট্রিই আমার আছে যা আমার ভরসা। হ্যাঁ, মাকে যদি ফিরে পাই তাহলে ওটা আমি তাকে উইল করে দিয়ে দেবো।
তাহলে চলুন, আপনার কন্যা মাসুমার কাছে যাবার পূর্বে আমার অফিসে চলুন।
অফিস! আপনার অফিস আবার কোথায়?
সংক্ষেপে জবাব দিলো বলহরি সিংহংলিজ-এ!
শুনেছি হংলিজের অফিস আপনি তুলে নিয়েছেন?
সেটা মিথ্যে সংবাদ। আমার শুধু নয়, মিঃ বিশ্বাসের অফিসও ছিলো ঐ হংলিজ-এ। আপনাকে কিছুক্ষণের জন্য হংলিজে নেবো, তারপর আপনার কন্যা মাসুমার কাছে। ড্রাইভার, তুমি সেভাবে গাড়ি চালিয়ে যাও। প্রথমে হংলিজ, তারপর সেই স্থান…. বুঝলে?
ড্রাইভার কোনো উত্তর দিলো না।
মিঃ রিজভী বলে উঠলেন না, আমি আপনার অফিসে যাবো না। আমাকে মাসুমার নিকটে নিয়ে চলুন। সেখানে বসেই আমি আমার হামান ইন্ডাষ্ট্রি উইল করে দেবো।
বেশ তাই হোক, ড্রাইভার, উনি হংলিজ-এ যেতে রাজি নন, ওনাকে তার কন্যা মামা। যেখানে আটক আছে সেখানে নিয়ে চলো ওখানে বসেই তিনি উইলে দস্তখত করবেন।
ড্রাইভার সম্মতিসূচক মাথা দোলালো। আবছা অন্ধকারে ড্রাইভারকে একটা মূর্তির মত লাগছে। যান্ত্রিক মানুষের মত গাড়ির হ্যান্ডেল চেপে ধরে বসে আসে যেন সে।
লাইট পোষ্টের আলোগুলো মাঝে মাঝে গাড়ির জানালাপথে ভেতরে প্রবেশ করছে, তবে ক্ষণিকের জন্য মাত্র। তারপর একটা আবছা অন্ধকারে সব ঢাকা পড়ছে।
মিঃ রিজভী তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। তার কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মিসেস রিজভীর কণ্ঠস্বর…আবার কোনো বিপদে পড়বে না তো। এমনি রাতের অন্ধকারে মিঃ বিশ্বাস তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলো….তবে কি বলহরি সিং তাকে তেমনি ফাঁকি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? সব কি মিথ্যা, থোকা? সবাইকে সরল মনে বিশ্বাস করার এই কি পরিণাম। লোকে বলে, যারা সৎ মহৎ আল্লাহতালা তার সহায়- মিঃ রিজভী আপন মনে ভাবছিলেন, জীবনে তিনি কারো অন্যায় করেননি, কোন অসৎ কাজে যোগ দেননি তবে কেন তার ভাগ্যে এমন অবস্থা এলো। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা তার সমস্ত মন জুড়ে খচ খচ্ করতে লাগলো। দৃঢ় চিত্তে আপন মনে বললেন, যত বিপদ আসুক ধৈৰ্য্যচ্যুত হবেন না তিনি। ধৈর্যধারীর সঙ্গে আল্লাহ আছেন।
নানা ধরনের চিন্তা এলোপাতাড়ি ঘুরপাক খাচ্ছিলো তার মাথার মধ্যে।
আবার সেই পোড়োবাড়ি।
মিঃ রিজভীর মুখমন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। তিনি এতক্ষণে স্পষ্ট বুঝতে পারলেন বলহরি সিংকে যতই বিশ্বাস করুন না কেন, সেও বিশ্বাসঘাতক। এখানে মাসুমা আছে?-না না, সব মিথ্যা। তাকে আবার ফুসলিয়ে আনা হয়েছে। আবার তার ওপর চলবে কঠিন নির্যাতন। স্ত্রীর কথাটা বারবার মনে আলোড়ন জাগাচ্ছে। তবুও তিনি নীরব রইলেন, গাড়ি থামতেই দু’জন এগিয়ে এলো।
মিঃ রিজভী চিনতে পারলেন-একজন মিঃ গুহো, অপরজন হিরন্ময় সিং।
গাড়ি থামতেই নেমে দাঁড়ালো বলহরি সিং, পেছন আসনের দরজা খুলে ধরে বললো–নেমে আসুন মিঃ রিজভী। কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার কন্যা মাসুমার সঙ্গে মিলিত হবেন।
বলহরি সিং-এর কথায় মিঃ রিজভীর মুখে কোনো আনন্দের আভাস ফুটে উঠলো না। বরং তাকে বেশি চিন্তিত মনে হলো। বিনা দ্বিধায় নামলেন তিনি। না নেমে তো কোনো উপায় নেই। বিশ্বাসের কথা মনে পড়লো, তাকে মিঃ রিজভী প্রাণের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করতেন অথচ সেই বিশ্বাস তার সর্বনাশ করেছে-তাকে হত্যা করতে গিয়েছিলো, ভাগ্যিস অজানা অচেনা দু’জন আগন্তুক এসে রক্ষা করেছিলো। এমনি করেই আল্লাহতায়ালা যাকে রক্ষা করবেন তাকে সহায়তা করে থাকেন। একটা বিপুল সাহস নিয়ে মিঃ রিজভী শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন।
বলহরি বললো–মিঃ গুহো, মিঃ রিজভীকে নিয়ে যান এবং যে উইলখানা প্রস্তুত করে রেখেছি তাতে দস্তখত করিয়ে নিন। আমি আর হিরন্ময় আসছি, বিলম্ব হবে না, বুঝলেন?
বললো মিঃ গুহো–হা, আমি সব জানি। তারপর মিঃ রিজভীর দিকে হাত বাড়িয়ে বললো–আমাদের চিনতে পারছেন না বুঝি? আর চিনবেনই বা কি করে, মিঃ বিশ্বাস আমাদের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা কম করেননি। চলুন।
হিরন্ময় বললো–মিঃ রিজভী আর মিঃ বিশ্বাসের ব্যবসায়ে আমরাইতো ইন্দন জুগিয়েছি। আমাদের সহযোগিতা ছাড়া তারা কি ব্যবসা চালাতে পারতেন? মিঃ গুহো যান; দারোয়ান লণ্ঠন নিয়ে প্রবেশপথে অপেক্ষা করছে।
মিঃ রিজভী তাকালেন মিঃ গুহোর মুখের দিকে। রাতের অন্ধকারে স্পষ্ট তার মুখ দেখা না গেলেও বেশ বোঝা গেলো। তার চোখে চশমা, মুখে একমুখ দাড়ি-গোফ। এরা মিঃ বিশ্বাসের পার্টনার হিসাবে মিঃ রিজভীর পরিচিত ব্যক্তি। ব্যবসার খাতিরে প্রায়ই এদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ঘটেছে তার। তবে গভীরতা ছিলো না তেমন করে, তাই মাঝে মাঝে অনেক সময় নামটাও ভুলে যেতেন মিঃ রিজভী। তখন হয়তো আবার স্মরণ করিয়ে দিতে মিঃ বিশ্বাস, এর নাম মিঃ গুহো, এর নাম বলহরি সিং ইত্যাদি। মিঃ রিজভী মিঃ গুহোকে পূর্বেও দেখেছেন, লোকটার মুখে দাড়ি, চোখে কালো চশমা কেমন যেন একটু অদ্ভুত ধরনের লোক। মিঃ রিজভী আরও জানতেন এই গুহোর মোটা অংকের অর্থ কাজ করছে মিঃ বিশ্বাসের ব্যবসায়ে। এজন্যই মিঃ বিশ্বাস তাকে বেশি সমীহ করতো। যেমন করতে সে মিঃ রিজভীকে, কারণ মিঃ রিজভীর কোটি কোটি টাকার শেয়ার ছিলো মিঃ বিশ্বাসের ব্যবসার সঙ্গে। যাদের দেখছেন মিঃ রিজভী তারা সবাই মিঃ বিশ্বাসের সহকর্মী হিসেবে তার সঙ্গে পরিচিত।
বলহরি সিং বললো–কি ভাবছেন মিঃ রিজভী? ভাবনার কোনো কারণ নেই। আপনি মিঃ গুহোর সঙ্গে ভেতরে যান। এ পথ আপনার পরিচিত। কারণ আর একবার এ পথ দিয়েই আপনি মিঃ বিশ্বাসের সঙ্গে এ বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন। তবে আফসোস, আপনি সেদিন আপনার কন্যা মিস মাসুমাকে দেখতে পাননি-কিন্তু এবার পাবেন।
সত্যি! সত্যি বলছেন বলহরি সিং? ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন মিঃ রিজভী।
হেসে উঠলো বলহরি সিং-এখনও অবিশ্বাস। মিঃ বিশ্বাস বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন বলে আমাকেও আপনিযাক ও সব কথা, আপনি চলে যান, সেখানে অপেক্ষা করছে আপনার মেয়ে।
আসুন মিঃ রিজভী! বললো মিঃ গুহো।
হিরন্ময় বাঁকা চোখে একবার তাকালো মিঃ রিজভীর দিকে। তার মুখে একটা হিংস্র ক্রুদ্ধ ভাব ফুটে উঠেছে। রাতের অন্ধকারে স্পষ্ট বোঝা গেলো না।
মিঃ গুহোর চোখের কালো চশমা রাতের অন্ধকারে চকচক করে উঠলো। মিঃ রিজভী ফ্যাকাশে করুণ মুখে তাকালেন মিঃ গুহোর চশমা ঢাকা মুখখানার দিকে।
ড্রাইভার নেমে দাঁড়াতেই বলহরি সিং কিছু ইংগিত করলো, ড্রাইভার যন্ত্রচালিত পুতুলের মত নিঃশব্দে চলে গেলো রাতের অন্ধকারে পোড়াবাড়িখানার মধ্যে।
মিঃ গুহো বললো–আসুন মিঃ রিজভী।
মিঃ গুহোর সঙ্গে মিঃ রিজভী অগ্রসর হলেন।
বলহরি গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে কারও প্রতীক্ষা করতে লাগলো। হিরন্ময় সিং দাঁড়িয়ে রইলো তার পাশে।
মিঃ রিজভী একবার ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, তার মনে তখন এলোপাতাড়ি চিন্তার ঝড় বইছে। সমস্ত শরীর তার ঘামে ভিজে চুপসে উঠেছে। চোখেমুখে একটা অসহায় করুণ ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে রাতের অন্ধকারে কেউ তা দেখতে পেলো না।
এবার মিঃ রিজভীসহ মিঃ গুহো এবং একজন লণ্ঠনধারী পোভড়াবাড়িখানার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো।
এ পথ মিঃ রিজভীর পরিচিত, আরও একবার তাকে এ পথ দিয়েই প্রবেশ করতে হয়েছিলো। সেদিন পরম বন্ধু মিঃ বিশ্বাস ছিলো তার সঙ্গে। এমনি করেই পথ দেখিয়ে তাকে নিয়ে এসেছিলো সে। কি ভয়ংকর সেই জমাট অন্ধকার ঘরটি। সেই ঘরের মধ্যে উবু হয়ে পড়ে আছে একজন,-সে ঐ শয়তান বিশ্বাস। বিশ্বাসঘাতকতার শেষ পরিণতি তার কত মর্মান্তিক…
সেই কক্ষের সামনে এসে থামলো মিঃ গুহো ও লণ্ঠনধারী। একপাশে লণ্ঠন রেখে দরজার তালা খুলে ফেললো।
মিঃ রিজভী বললেন-কোথায় আমার মাসুমা? বলহরি আমাকে নিয়ে এলো আমার কন্যা মাসুমাকে দেখাবে বলে। কোথায় মাসুমা?
হঠাৎ পেছনে বলহরির কণ্ঠস্বর-এখনও বিলম্ব আছে। আপনার দস্তখত বাকি আছে আর সেই কারণেই আপনাকে এখানে আনা হয়েছে। দস্তখত হলেই আপনার কন্যা মাসুমাকে দেখতে পাবেন। হিরন্ময়, তুমি প্রস্তুত আছো?
প্রস্তুত স্যার। হিরন্ময়ও এসে পড়েছে ইতিমধ্যে, সে কথাটা উচ্চারণ করলো।
বলহরি বললো–সামস মোরিন ও তার সঙ্গীদের যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা কতদূর হলো?
জবাব দিলো হিরন্ময়-পাশের কক্ষে ওরা এসে গেছে।
হ্যাঁ, সাবধানে কাজ করবে।বললো বলহরি।
ওদের ইংগিতপূর্ণ কথাবার্তায় মিঃ রিজভীর বুকটা ধক্ করছিলো। তিনি মাসুমার নাম শোনামাত্র ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং কিছু না ভেবে বলহরিকে বিশ্বাস করে বেরিয়ে এসেছিলেন। একমাত্র মেয়ে মাসুমা তাদের নয়নের মণি, মাসুমাকে ফিরে পাওয়ার আশা মিঃ রিজভী আর মিসেস রিজভীকে সম্বিৎহারা করে ফেলেছিলো। ক’দিন পূর্বেই মিঃ বিশ্বাসের বিশ্বাসঘাতকতার কথা ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। বলহরির মিথ্যা সাজানো কথাগুলোকে বিশ্বাস করেছিলেন। সন্তানহারা পিতামাতার অবস্থা বুঝি এমনি হয়।
পেছন হতে হিরনায় মিঃ রিজভীকে ঠেলে দিলো সেই কক্ষে। কদিন পূর্বে এ কক্ষেই তিনি বন্দী ছিলেন। এই সেই কক্ষ, যে কক্ষের মেঝেতে বিশ্বাসের মৃতদেহ পড়েছিলো উবু হয়ে। চাপ চাপ রক্ত পচে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। এ কক্ষের একটিমাত্র দরজা ছাড়া আর কোনো জানালা-দরজা ছিলো না। ঠান্ডা স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে মিঃ রিজভী আটক থাকাকালীন নরক যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন। আবার সেই কক্ষ…
লণ্ঠনের আলোতে পেছন ফিরে তাকালেন মিঃ রিজভী। মেঝেতে মিঃ বিশ্বাসের লাশটি এখন নেই। তবে রক্তগুলো জমাট বেঁধে আছে। যা থেকে উৎকট পচা গন্ধ বের হচ্ছিলো।
মিঃ গুহো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। কতকটা স্থবিরের মত।
বলহরি সিং বললো–আর বিলম্ব নয়, কাজ শুরু করুন।
হ্যাঁ, এবার কাজ শুরু করতেই হয়, বললো মিঃ গুহো। কালো চশমার নিচে চোখ দুটো ওর জ্বলছে যেন।
বলহরি বললো–মিঃ গুহো, দেখবেন সব যেন সঠিকভাবে সমাধা হয়। বলহরি তার ব্যাগটা লণ্ঠনের আলোতে মেঝের মাঝখানের টেবিলে রাখলো। ওরা সবাই কেমন যেন দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে মিঃ রিজভীর দিকে।
আর একটি দিনের কথা মনে পড়লো মিঃ রিজভীর-সেদিন মিঃ বিশ্বাস এমনি করে মোমের আলোতে তার সামনে মেলে ধরেছিলো একটি দলিল যে দলিলে তিনি স্বাক্ষর করার পূর্বেই বিশ্বাস প্রাণ হারিয়েছিলো। আবারও সেই আলো, সেই টেবিল, সেই দলিল-মুহূর্তে রিজভীর চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার বিশাল ঐশ্বর্য ইন্ডাষ্ট্রিগুলো, ধনসম্পদ-আজ এসবই তার কাল হয়েছে। অর্থ ঐশ্বর্য মানুষের বিপদের কারণ, সব অনাসৃষ্টির মূলেই হচ্ছে ধনসম্পদ। আজ যদি তার এত ঐশ্বর্য, এত অর্থ না থাকতো তাহলে কন্যা মাসুমার অবস্থা এমন হতো না, হারাতে হতো না তার পরম আদরের ধনকে। মনে পড়লো বন্ধুবর আলী সাহেবের কথা। ধনকুবের আলী সাহেবের ধনসম্পত্তি, ঐশ্বর্যের অভাব ছিলো না, এ কারণে তার হিতাকাক্ষী বন্ধুবান্ধবেরও অভাব ছিলো না। সব সময় বাড়িতে ফাংশন, পাটি নানা ধরনের উৎসব লেগেই থাকতো। বাড়ি গম গম করতে মানী ধনী ব্যক্তিগণে। তার এক ছেলে মাসুদ-পিতার ঐশ্বর্যের ফানুষ ছিলো। একটি নয়, বেশ কয়েকটি কার ছিলো, যখন যেটা খুশি চালিয়ে ঘুরে বেড়াতো। বন্ধু ও বান্ধবী ছিলো তার অগুণতি। ঐশ্বর্যের চাকচিক্যে আত্মহারা হয়ে বান্ধবীরা মাসুদের চারপাশে ভীড় জমাতে পঙ্গপালের মত। যেমন প্রদীপের পাশে পোকামাকড় ভীড় জমায়। বেশির ভাগ লোভী মেয়েই মাসুদের বান্ধবী সেজে ছলে-কৌশলে অর্থ এবং মূল্যবান সামগ্রী আত্মসাৎ করতো। নানা ধরনের প্রেমাভিনয় করতো, মাসুদ এসব দুষ্ট বন্ধু-বান্ধবীর পাল্লায় পড়ে লেখা-পড়ায় তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। ধনকুবের পিতামাতাও মনে করতেন একমাত্র ছেলে-বিশাল ঐশ্বর্যের অধিকারীইবা শিখলো লেখাপড়া, তেমন ডিগ্রিরই বা কি দরকার আছে? যা লেখাপড়া শিখেছে তাই ঢের। পিতার যে ঐশ্বর্য, ধনসম্পদ আছে তা চৌদ্দ পুরুষ বসে খেলেও ফুরাবে না। গাড়ি-বাড়ি-ঐশ্বর্য কল্পনাতীত। তা ছাড়া নামধামও কম নয়। আরাকানে এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে চেনে না আলী আসগর সাহেবকে। তারই সন্তান মাসুদ, একমাত্র ছেলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যান না আলী সাহেব এবং তার স্ত্রী। মদ জুয়া সবই চলতো। মাসুদের পিতামাতা জেনেও তেমন আপত্তি জানাননি কোনোদিন, ছেলে যদি মনে দুঃখ পায়। আলী সাহেব ছেলেকে সৎপথে আনার জন্য গদিতে বসালেন, সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্বভার দিলেন মাসুদের ওপর। কর্মচারীদের বলে দিলেন, এখন থেকে মাসুদ তাদের মালিক। মাসুদ যা বলবে তাই তাদের করতে হবে। বিরাট আশা-ভরসা নিয়ে আলী সাহেব নিশ্চিন্ত হলেন। স্ত্রী এবং বন্ধু-বান্ধবদের বললেন, এবার আমার ছুটি। আমার মাসুদ সব বুঝে নিয়েছে, এবার মাসুদ আমার লক্ষ্মী ছেলে বনে যাবে। হায়রে দুরাশা, আলী সাহেবের অফিসকক্ষ হলো জুয়ার আড্ডাঘর। সেখানেই বন্ধু-বান্ধবীরা ভীড় জমাতে শুরু করলো। পয়সার কোনো হিসাব নিকাশ ছিলো না-যখন যা দরকার, ম্যানেজার তার হুকুমের দাস। এসব কথা যে আলী সাহেবের কানে গেলো না তা নয়, তিনি সব শুনেও না শোনার না বোঝার ভান করতেন। এ সব নিয়ে সন্তানকে তিনি রাগাতে চান না, এ সব কথা বন্ধু-বান্ধবকেও বলেন না কারণ এতে তার সম্মানের হানি হবে। নাক কান বন্ধ করে নিশ্চুপ থাকাই সমীচীন মনে করলেন আলী সাহেব। তারপর একদিন হঠাৎ সংবাদ এলো-আলী সাহেবের অফিসকক্ষে তার একমাত্র সন্তান মাসুদ নিহত হয়েছে-তারপর, তারপর সেই আলী সাহেব আজ পাগল। তার বিশাল ঐশ্বর্য ও ধনসম্পদ সব কোথায় উবে গেলো কর্পূরের মত। আলী সাহেবের পরিণতি কত করুণ, তার এ অবস্থার জন্য দায়ী তার ধনসম্পদ, ঐশ্বর্য। আলী সাহেব তো মন্দ লোক ছিলেন না, তিনি একজন সৎ-মহৎ ব্যক্তি ছিলেন। আজ তার নিজের এ পরিণতির পেছনেও রয়েছে তার ধনসম্পদ-ঐশ্বর্য-অর্থ। সম্পদই আজ তাকে কন্যাহারা করেছে, বন্ধু-বান্ধব শত্রুতে পরিণত হয়েছে। চারদিকে অশান্তির বেড়াজাল, এখন জীবনমৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হচ্ছে। আজ যদি তিনি এমন ঐশ্বর্য, ইন্ডাষ্ট্রির মালিক না হতেন, যদি তিনি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেন, তাহলে কত সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারতেন। মাসুমাকে হারাতে হতো না, তার ধনসম্পদ নিয়ে এমন ছিনিমিনি চলতো না, এমনকি জীবন পর্যন্ত শেষ হতে চলেছে। এরা তাকে হত্যা করার পূর্বে তার সবকিছু উইল করে নেবে, তারই কৌশল চলেছে…এবার আর রক্ষা নেই, যদি আল্লাহ তাকে রক্ষা করেন তবেই তিনি ফিরে যেতে পারবেন। যদি ফিরে যাবার সৌভাগ্য হয় তবে সব তিনি অসহায় দীনহীন মানুষের কল্যাণে সব বিলিয়ে দেবেন। ও সবে আর কোনো প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না। মৃত্যুর পর তাকে সব ত্যাগ করতে হবে, না হয় জীবিত অবস্থায় সব উৎসর্গ করে দিলেন। আল্লাহ, তুমি আমার সহায়, আমি এমন ঐশ্বর্য চাই না যার জন্য মানুষ অমানুষে পরিণত হয়। যতটুকু প্রয়োজন তাই ভাল। প্রয়োজনের অধিক ধনসম্পদ অশান্তি বাড়ায়, সর্বক্ষণ একটা টেনশন নিয়ে কাটাতে হয়। লোভ লালসা গ্রাস করে, কেমন করে আরও অর্থ, ধনসম্পদ বাড়বে-এই নেশা অস্থির করে তোলে। যার এসব নেই, তার এমন টেনশন নেইকত সুখী ওরা, কত শান্তি ওদের…
একটি কর্কশ কণ্ঠস্বরে মিঃ রিজভীর সম্বিৎ ফিরে আসে-কি ভাবছেন মিঃ রিজভী? দস্তখত করুন।
মিঃ রিজভীর চিন্তাধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো, খেয়াল হলো তাকে এই মুহূর্তে উইলে দস্তখত করতে হবে। তার সব ধনসম্পদ হরণ করেও এরা ক্ষান্ত হয়নি। তার ইন্ডাষ্ট্রিগুলোও কৌশলে উইল করে নেবে, তারপর তাকে ওরা হত্যা করবে…কেউ জানবে না কোথায় গেছেন রিজভী সাহেব।
বলহরি বললো–বুঝতে পেরেছি আপনি কন্যার বিনিময়েও আপনার সম্পত্তি বিলিয়ে দিতে চান না। বেশ, তাহলে মাসুমাকেও আমরা হাজির করবো না আপনার সম্মুখে। একমাত্র কন্যার বিনিময়েও এটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে চান না?
মিঃ রিজভী টেবিলের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন। লণ্ঠনের আলোতে তার মুখমন্ডল ফ্যাকাশে করুণ বিবর্ণ দেখাচ্ছে। বেশ কয়েকজন তাকে ঘিরে রেখেছে, কিন্তু কেউ তার আপনজন নয়। সবাই শার্দুলের মত হিংস্র ও লোভাতুর দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে তার দিকে।
মিঃ রিজভীর হাতে কলম তুলে দিলো বলহরি সিং।
হিরন্ময় একটি ধারালো ছোরা জামার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে। প্রস্তুত হয়ে আছে সে, মিঃ রিজভীর দস্তখত হবার সঙ্গে সঙ্গে তার পিঠে ছোরা বিদ্ধ করবে সে, তারপর মিঃ বিশ্বাসের সঙ্গে একই গর্তে পুঁতে ফেলবে পাশের ঘরে জমাট অন্ধকারে। কন্যা মাসুমার সঙ্গে দেখা করার বাসনা চিরতরে মুছে যাবে, আর কোনোদিন মিঃ রিজভীর কণ্ঠে মাসুমা নাম উচ্চারিত হবে না। এই পোড়োবাড়ির অভ্যন্তরে আরও কত হত্যা সংঘটিত হয়েছে এবং তাদের প্রাণহীন দেহগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে তার হিসাব রয়েছে মিঃ বিশ্বাসের হত্যারহস্য। খাতায়। কি কারণে কাকে হত্যা করা হলো, কি তার নাম, কত তারিখে হত্যা সমাধা হলো। সব লেখা আছে। এসব নিহত ব্যক্তির নামের তালিকা এই পোড়াবাড়ির একটি ছোট্ট কক্ষে রক্ষিত আছে। পোভড়াবাড়ির অভ্যন্তরে আছে নানা রকম ব্যবসার মালামাল, গুদামজাত করা আছে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত ওষুধ এবং আরও অনেক বস্তু। পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে এদের কারবার। রাতের অন্ধকারে ট্রাক বোঝাই হয়ে এসব মাল চলে যায় আরাকান বন্দরে এবং জাহাজের খোলে মাল ভর্তি হয়ে সেগুলো জলপথে বিদেশে চালান হয়।
মিঃ বিশ্বাস ছিলো এ অসৎ ব্যবসার অধিনায়ক। বলহরি ও তার দলবল ছিলো এ ব্যবসার পার্টনার এবং সহকারী।
পোড়োবাড়িখানা ছিলো আরাকান শহরের এক নির্জন স্থানে। আশেপাশে বস্তি এলাকা এবং ঝোঁপঝাড়, ইটের ভূপ। পথের লাইট পোষ্টগুলোও তেমন দীপ্ত উজ্জ্বল নয়। অনেক পুরানো এ সব লাইটপোষ্ট, অনেকগুলো অকেজো-তাতে কোনো আলোই নেই। এহেন জায়গায় মিঃ বিশ্বাস তার আস্তানা গেড়েছিলো এবং শেষ পর্যন্ত তাকে সেই নরক সমতুল্য অন্ধকার ঘরে পঁচে মরতে হলো। এইতো অসৎ ব্যবসায়ীদের জীবনের শেষ পরিণতি।
পাশের কক্ষে মাদুর জড়ানো মিঃ বিশ্বাসের লাশ থেকে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। যারা সেই কক্ষে গর্ত খননকাজে লিপ্ত আছে তারা নাকে রুমাল বেঁধে কাজ করছে। সবার চোখেমুখে একটা ভয়ংকর হিংস্রতার ছাপ। লণ্ঠন জ্বলছে দু’তিনটে। এই পোড়োবাড়িতে ইলেকট্রিক ব্যবহার করা হয় না। লোকে জানে ঐ বাড়িতে কোন মানুষ বসবাস করে না। মিঃ বিশ্বাস ও তার সহ-ব্যবসায়ী ও কর্মীরা বহু দূরে পেছন দিক দিয়ে বাড়িটার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতো। তাই বস্তি এলাকার সাধারণ মানুষগুলোও টের পেতো না।
একবার এক ট্রাক ড্রাইভার কোনোক্রমে এই পোড়োবাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলো, জানতে পেরেছিলো অনেক কিছু। তাকে আর ফিরে আসতে হয়নি, এই পোড়োবাড়ির অভ্যন্তরেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো এবং মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিলো। এমনি করে কেউ যদি এ বাড়ির রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হয়েছে তাকে আর পৃথিবীর আলো দেখতে দেওয়া হয়নি।
বস্তি এলাকার কেউ কেউ যে এ বাড়ির রহস্য নিয়ে মাথা ঘামায়নি তা নয়। কিন্তু তাকে, বেশিদূর এগুতে দেওয়া হয়নি। চিরতরে তার কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আরাকান নগরীর সবচেয়ে ভয়াবহ স্থান এটা।
মিঃ রিজভী এই মুহূর্তে সেই পোড়োবাড়ির একজন শিকার। একটু পরেই তার প্রাণহীন দেহ মেঝেতে পড়ে থাকবে, কেউ জানবে না কোথায় গেছেন মিঃ রিজভী।
কি ভয়ংকর এ রাত।
চারদিকে থমথমে নিস্তব্ধতা।
ঝি ঝির অশান্ত আওয়াজ কেমন যেন ভয়াল মনে হচ্ছে। মাটির ভ্যাপসা বিদঘুঁটে গন্ধ, মাঝে মাঝে চাপা কর্কশ কণ্ঠস্বর। সব যেন মিঃ রিজভীর মনে ঝড় তুলছে-কেন তিনি বলহরি সিংকে বিশ্বাস করে বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন। কেন তিনি স্ত্রীর কথা শোনেননি। সরলতার সুযোগ নিয়ে তার বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তিগণ তার সর্বনাশ করেছে। রিজভী কলম হাতে নিয়ে উইলখানার দিকে হাত বাড়ালেন।
সরে এলো হিরন্ময়।
বলহরি সিং তাকালো হিরন্ময় সিং-এর মুখের দিকে। দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে হলো তাদের ইংগিতপূর্ণ কথাবার্তা।
পাশে দাঁড়িয়ে মিঃ গুহো। তার চোখ দুটো জ্বলছে কালো চশমার আড়ালে। লণ্ঠনধারী লণ্ঠনখানা টেবিলে রেখে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসব তার নিত্যদিনের কাজ। একটু পরেই মিঃ রিজভীর অবস্থা কেমন হবে, হয়তো সেই দৃশ্য ভাসছে তার চোখের সামনে। লোকটার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথার চুলে পাক ধরেছে; চোখে ঘোলাটে রং। গায়ের চামড়া ঠেলে রগগুলো ফুলে ফুলে উঠছে। লোকটার দেহে অসুরের শক্তি, তবুও কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ছে সে। এমন বহু দৃশ্য সে দেখেছে, কত হত্যাই না ঘটেছে তার সামনে। কত রক্ত তাকে পানি দিয়ে মুছে ফেলতে হয়েছে। মিঃ রিজভীর সঙ্গে ওর পরিচয় হয়েছিলো তাকে যেদিন এখানে এনে আটক করা হয়েছিলো সেদিন। মিঃ রিজভীর সৌম্যসুন্দর চেহারার মধ্যে দেখেছিলো সে এক মহৎ ব্যক্তির ছাপ। তার সঙ্গে কথাও বলেছিলো-একটা মধুর মোলায়েম কণ্ঠস্বর, আজও তার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এমন লোককে এরা হত্যা করবে
হঠাৎ লণ্ঠনধারীর চিন্তাধারা এলোমেলো হয়ে যায়। মিঃ গুহোর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর-মিঃ রিজভী, আপনার কন্যাকে না দেখা পর্যন্ত আপনি দস্তখত করতে পারবেন না।
অন্ধকার কক্ষের মধ্যে যতগুলো লোক ছিলো তারা সবাই যেন মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। তাকালো সবাই মিঃ গুহোর দিকে।
মিঃ গুহোর দু’চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে যেন। তার হাতের দিকে সবার দৃষ্টি পড়তেই শিউরে উঠলো, দক্ষিণ হাতে একটি জমকালো আগ্নেয় অস্ত্র। গুহো অস্ত্রখানা উদ্যত করে ধরে আছে। এমন জায়গায় সে দাঁড়িয়ে আছে যে, তার লক্ষ থেকে কেউ রেহাই পাবে না।
বলহরি সিং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মিঃ গুহোর মুখের দিকে। ঐ দাড়ি-গোঁফের অন্তরালে তবে কি মিঃ গুহোর বেশে অন্য কেউ। না মিঃ গুহোই তার স্বভাব পরিবর্তন করেছে। কিন্তু কণ্ঠস্বর সম্পূর্ণ আলাদা মনে হচ্ছে, তবে কি?
মিঃ গুহো বলে উঠলো–মিঃ রিজভীকে উইলে দস্তখত করতে দেব না। যতক্ষণ তার কন্যা মাসুমাকে এখানে হাজির করা না হয়েছে।
বলহরি সিং বললো–মাসুমা কোথায় আছে, জীবিত না মৃত তাও আমরা জানি না। মিঃ গুহহ, আপনি এসব কি বলছেন।
বলহরি, আমি মিঃ গুহো নই, আমি সেই ব্যক্তি যে ব্যক্তি মিঃ বিশ্বাসের বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করেছে।
হ্যাঁ কি বললেন, আপনি মিঃ গুহো নন?
না।
কক্ষে যেন বজ্রপাত হলো।
বলহরি এবং হিরন্ময় মুখ চাওয়া চাওয়ি করে নিলো।
কঠিন কণ্ঠে বললো–মিঃ গুহো-এক চুল নড়লে এই মুহূর্তে গুলী ছুড়বো। খবরদার, পালানোর চেষ্টা করবে না। মিঃ রিজভী কোনো কিছুতেই দস্তখত করবেন না। তার কন্যা মাসুমা কোথায় আছে তোমরাও জানো…
তার কথা শেষ হয় না, মিঃ রিজভীর ড্রাইভার তার সঙ্গে এক তরুণীসহ সেই অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করে। ড্রাইভার বলে উঠলো–মিঃ রিজভী, এই নিন আপনার কন্যা মাসুমাকে।
মিঃ গুহোই বেশি অবাক হলো, বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো–রাণী তুমি! তুমি মাসুমাকে কোথায় পেলে? সে কি জীবিত ছিলো?
ড্রাইভারবেশি রাণী বললো–হ্যাঁ, মাসুমা জীবিত। সে এক বিরাট কাহিনী। পরে বলবো, এখন মিঃ রিজভী ও তার কন্যাকে মিলিত হবার সুযোগ দাও।
ততক্ষণে অস্ত্র হাতে এক বিরাট পুলিশবাহিনী কক্ষে প্রবেশ করেছে। সবার হাতেই রাইফেল ও রিভলভার।
ড্রাইভারবেশি রাণী পুলিশ সুপারকে লক্ষ্য করে বললো–আপনি এই শয়তান বলহরি সিং ও তার দলবলকে এ্যারেষ্ট করার আদেশ দিন।
আরাকান পুলিশ সুপার মিঃ হারবার্ড তার সঙ্গীগণকে নির্দেশ দিলেন এদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দাও।
পুলিশ বাহিনীর উদ্যত অস্ত্রের মুখে সবাই হাত তুলে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিলো। এবার তাদের পাশে পুলিশগণ হাতকড়া নিয়ে হাজির হয়। একে একে পরিয়ে দেয় হাতকড়া সবার হাতে।
সেই মুহূর্তে মিঃ রিজভী তার কন্যা মাসুমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
ঠিক ঐ সময় বলহরি হঠাৎ যেন হাওয়ায় মিশে গেলো। কোথায় গেলো কেউ টের পেলো না। ক্ষণিকের জন্য মিঃ গুহোবেশি বনহুর অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো, পিতা-কন্যার অপূর্ব মিলন তাকে সামান্য সময়ের জন্য সম্বিহারা করে ফেলেছিলো। ঐ সময়টুকুর সুযোগ নিয়েছে বলহরি সিং। ঐ সময় সুচতুর বলহরি সিং আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে।
মিঃ রিজভী কন্যাকে বুকে নিয়ে প্রাণভরে আদর করলেন। অশ্রুতে সিক্ত হলো মাসুমার মাথার চুল। মাসুমা পিতার বুকে মুখ গুঁজে অনেক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো।
মিঃ গুহোবেশি বনহুর বললো–মিঃ হারবার্ড-আপনি এদের দলবলকে এ্যারেষ্ট করলেন বটে কিন্তু আসল শিকার পালিয়েছে। বলহরি সিং এদের দলপতি।
পুলিশ সুপার ললাটে হাত রাখলেন, বললেন-এত সাবধানতার মধ্যেও আমরা বিফল হলাম।
বনহুর বললো–সম্পূর্ণ বিফল না হলেও কিছু হয়েছি আমরা। তবে আসল ঘাঁটি এবং নরশয়তানদের চোরা কারবারের যে মালামাল রক্ষিত ছিলো তা আপনারা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। আসুন মিঃ হারবার্ড, আমি সব দেখিয়ে দিচ্ছি। তবে এ সবের চেয়ে বেশি আমি আশ্চর্য হয়েছি মিস মাসুমার ব্যাপারে। কারণ আমি জানতাম তাকে আর আমরা কোনদিন ফিরে পাবো না। কিন্তু কি করে এ অসম্ভব সম্ভব হলো জানার জন্য উদগ্রীব রয়েছি।
রাণী শুধু তাকালো আরাকান পুলিশ সুপার মিঃ হারবার্ডের মুখের দিকে।
মিঃ হারবার্ড বললেন-এর জবাব আমিই দেবো মিঃ গুহো।
হেসে বললো রাণী, মিঃ গুহো নয়-মিঃ চৌধুরী বলবেন। একটু থেমে বললো রাণী-মিঃ চৌধুরী, আমি পুলিশ সুপার মিঃ হারবার্ডের নিকটে আপনার এবং আমার পরিচয় জানিয়ে দিয়েছি। শুধু তাই নয়, আপনার কার্যক্রম সম্বন্ধে সব বিস্তারিত বলেছি, কাজেই
বনহুর একটু হাসলো, তারপর বললো–রহস্য উদঘাটন করতে এসে রহস্যের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়েছি। হ্যাঁ আসুন এবার। পুলিশ সুপার মিঃ হারবার্ডকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর। এই পোড়াবাড়ির অভ্যন্তরে শুধু কোটি কোটি টাকার চোরাই মালই নয়, এই রহস্যময় পুরীতে রয়েছে অগণিত মানুষের শেষ নিঃশ্বাসের প্রতিধ্বনি আর তাদের অস্থি পাজর।
হ্যাঁ, মিঃ চৌধুরী, আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া আমাদের পক্ষে এ রহস্যময় গুপ্তস্থান খুঁজে বের করা বড়ই কষ্টসাধ্য ছিলো। জানতে পারলাম, এই পোড়োবাড়িখানার অভ্যন্তরে রয়েছে আরাকানের স্বনামধন্য চোরাকারবারী মিঃ বিশ্বাসের গলিত লাশ।.
রাণী তুমি সবই
বলেছি ওনাদের কাছে। তবে আপনি আমাকে রাণী বলে ডাকেন বলে ওনারা রাণী বলে ডাকবেন না। আমার আসল নাম ক্যাথোলিন বলেই ডাকবেন সবাই।
একটু হেসে বললো বনহুর–তুমি তাহলে মিঃ হারবার্ডকে তোমার আসল পরিচয়ও জানিয়েছে।
হ্যাঁ, আমি একজন মহিলা ডিটেকটিভ-এ কথা জানাতে কোনো ত্রুটি করিনি। আসুন, আমরা পোড়োবাড়িখানার অভ্যন্তরের রহস্যগুলো উদঘাটন করি। মিঃ বার্ড, আপনি আপনার পুলিশ বাহিনীর প্রতি হুঁশিয়ারি প্রদান করুন। এই শয়তানদের একটিও যেন বলহরি সিং-এর মত পালাতে না পারে।
মিঃ হারবার্ড গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-নির্দেশ দেওয়া হয়ে গেছে মিসেস ক্যাথোলিন। ওদের পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে নাও। হ্যাঁ, খুব সাবধানে, কেউ যদি কোনো রকম বদমাইসি করে তাকে গুলী করে হত্যা করবে।
বনহুর বললো–মিঃ বার্ড, আপনি লণ্ঠনধারীকে মুক্ত করে দেওয়ার নির্দেশ দিন। ওই আমাদের সহযোগিতা করবে এবং আমরা ওর দ্বারা এই পোড়োবাড়ির রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হবো।
আপনার কথা সঠিক নাও হতে পারে মিঃ চৌধুরী, কারণ সে ওদের দলের লোক। আমাদের নতুন বিপদে ফেলতে পারে।
বনহুর লণ্ঠনধারীর দিকে তাকালো, তারপর বললো–দেখুন মিঃ বার্ড, অনেক সময় দেখা গেছে, পেটের দায়ে অথবা কোনো বিশেষ কারণে কেউ কেউ অসৎ কাজে লিপ্ত হয়েছে অথবা হচ্ছে। তার পেছনে অনুসন্ধান করে জানা গেছে সে একজন ন্যায়, নিষ্ঠাবান সৎ ব্যক্তি-কিন্তু কালচক্রে সে কুৎসিত কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। লণ্ঠনধারী ব্যক্তিটির চোখ আমাকে বলছে সে একজন সৎ ব্যক্তি তবে অসৎ ব্যক্তিদের সঙ্গে জড়িত তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বেশ তাই হোক। ওকে আমরা সঙ্গে নেবো তবে ওর হাতের হাতকড়া মুক্ত করা যাবে না। কথাগুলো বললেন মিঃ বার্ড।
লণ্ঠনধারীসহ অগ্রসর হলো বনহুর, রাণী এবং মিঃ হারবার্ড ও দু’জন ইন্সপেক্টর। সবার হাতেই রয়েছে আগ্নেয় অস্ত্র। ভারীবুটের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, ওরা পোড়োবাড়ির গুপ্ত কক্ষগুলোর মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
পাশের কক্ষে উৎকট গন্ধ।
মাদুরে জড়ানো মিঃ বিশ্বাসের মৃতদেহ পচে ফুলে উঠেছে। যারা দু’জন গর্ত খনন কাজে ব্যস্ত ছিলো তারা পালানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু সক্ষম হয়নি। রাণীর সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি বলে তাদেরকে আটক করা হয়েছে। তাদের হাতে হাতকড়া এবং পায়ে বেড়ি পরানো হয়েছে।
মেঝের গর্ত বেশ বড় করেই খনন করা হয়েছে। ঐ গর্তে মিঃ বিশ্বাসের লাশের সঙ্গে মিঃ রিজভীর লাশও পুঁতে ফেলা হবে, এ কারণে গর্তটার পরিসর বৃহৎ করা হয়েছে।
গর্তের পাশে মাদুর জড়ানো মিঃ বিশ্বাসের লাশ।
মিঃ হারবার্ড বললেন-কি ভীষণ দুর্গন্ধ। মাদুরের মধ্যে মিঃ বিশ্বাসের লাশ রয়েছে, পঁচে গেছে মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ স্যার। বললেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর।
মিঃ বার্ড বললেন-ভাল মানুষের মুখোদ পরে শয়তানগণ মানবসমাজে বিচরণ করে বেড়ায় কিন্তু তাদের শেষ পরিণতি কত ভয়ংকর তা কোনো সময় ভেবে দেখে না একবার।
বনহুর আর মিঃ বার্ড দলবল নিয়ে অগ্রসর হলো। পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো সেই লণ্ঠনধারী লোকটি। তার হাতে-পায়ে বেড়ি পরানো থাকায় চলতে কষ্ট হচ্ছে তবুও সে এই গুপ্তপুরীর সব গোপন রহস্য উদঘাটনে উৎসাহী।
সামনে একটি দরজা, লোকটি বললো–স্যার, এ কক্ষে বন্দীদের আটক করে রাখা হয় এবং তাদের নির্ধারিত দিনে হত্যা করা হয়। পাশে যে অন্ধকার কক্ষটি দেখতে পাচ্ছেন ঐ কক্ষে বন্দীদের হত্যা করা হয় এবং সেই কক্ষের মেঝেতে একটি কূপ আছে, ঐ কূপে নিহত ব্যক্তিদের লাশ নিক্ষেপ করা হয়। কি ভয়ংকর সে কূপ, স্যার ঐ কক্ষে আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না। কারণ ঐ কক্ষে মৃত ব্যক্তিদের আত্মা অহরহ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ আমি শুনেছি। তাদের চাপা কান্নার আওয়াজ আমার কানে ভেসে এসেছে।
বললো বনহুর–সব পরে শুনবো, মালখানার দরজা কোন্ দিকে বলো?
লোকটা তার বন্দী হাতের মুঠায় লণ্ঠনটা উঁচু করে বললো–ঐ ওদিকে যে বড় দরজা দেখছেন ওটা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে একটা সুরঙ্গপথ পাবেন। সেই লোকটার কথা শেষ হয় না, একটা গুলী কোথা থেকে এসে তার বুকে বিদ্ধ হয়।
লুটিয়ে পড়ে লোকটা। যন্ত্রণাদায়ক একটা শব্দ বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে। লণ্ঠনটা কাৎ হয়ে পড়ে নিভে যায়।
সঙ্গে সঙ্গে জমাট অন্ধকারে ভরে উঠলো পোড়োবাড়ির অভ্যন্তর।
বনহুর চিৎকার করে বলে উঠলো–মিঃ বার্ড, আপনারা মাটিতে উবু হয়ে শুয়ে পড়ুন।
সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লো।
তৎক্ষণাৎ পর পর কয়েকটা গুলী তাদের দেহের ওপর দিয়ে দেয়ালে গিয়ে বিদ্ধ হলো। বনহুর হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে, তারপর দরজার পাশে উঠে দাঁড়ালো।
তখনও গুলী আসছে।
বনহুর লক্ষ করলো কোন দিক থেকে গুলীগুলো ছুটে আসছে। যদিও অন্ধকারে চারদিক আচ্ছন্ন তবুও বনহুর বেশ বুঝতে পারলো এবং দেয়ালে পিঠ রেখে ধীরে ধীরে অগ্রসর হলো। হঠাৎ পায়ে একটা শক্ত কিছু স্পর্শ হলো। জুতো পায়ে থাকায় ঠিক বুঝতে পারলো না বস্তুটা কি। পা দিয়ে চাপ দিলো বস্তুটার ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে পাশে একটা দেয়াল ফাঁক হয়ে গেলো।
বনহুর বুঝতে পারলো পাশে কোনো গুপ্তকক্ষ আছে আর সেই কক্ষে আত্মগোপন করে আছে বলহরি সিং আর সেই স্থান হতে সে গুলী ছুড়ছে। বনহুর অন্ধকারে দেয়ালে পিঠ রেখে অতি সন্তর্পণে এগুতে লাগলো, হঠাৎ একটি হাত তার শরীর স্পর্শ করলো।
মুহূর্ত বিলম্ব না করে বনহুর চেপে ধরলো রিভলভারখানা সেই হাতখানার ওপরে, বললো বনহুর–খবরদার, নড়বে না।
চাপাকণ্ঠে জবাব ভেসে এলো-আমার মতই তুমিও লক্ষ করেছো এদিক থেকেই গুলী আসছে।
রাণী তুমি! তুমিও তাহলে
এবার গুলী চললো তাদের দিকে।
বনহুর রাণীকে লক্ষ করে বললো–শিগগির শুয়ে পড়ো। শুয়ে পড়ো রাণী-সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের রিভলভার গর্জে উঠলো।
ওদিকে পুলিশবাহিনীও শুয়ে শুয়ে গুলী ছুঁড়তে শুরু করলো। চললো গুলী বিনিময়, বলহরি সিং আর বনহুর ও তার দলবল অন্ধকারে এলোপাতাড়ি গুলী চালাতে লাগলো। বনহুরের লক্ষ্য ছিলো যে দিক থেকে গুলী আসছে ঐ দিকে তাক করে গুলী ছোঁড়া।
পুলিশ বাহিনী ততক্ষণে হিরন্ময় এবং তার প্রধান সহকারী জাফর আলী ও অন্যদের এ্যারেষ্ট করে পুলিশ ভ্যানে তুলে নিয়ে আরাকানা জেলের দিকে চলে যায়।
এদিকে সমস্ত রাত ধরে চলে তুমুল লড়াই।
বলহরি সিং শুধু নয়, আরও আছে তার সঙ্গী, নইলে এতক্ষণ সে গুলী ছুঁড়তে সক্ষম হতো না। জাফর আলীও আত্মগোপন করেছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেও গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ বাহিনীর একজন।
জাফর আলী ধরা পড়ে যায়। যখন পুলিশবাহিনী বলহরি সিংয়ের দলবলকে এ্যারেষ্ট করছিলো, সেই মুহূর্তে জাফর আলী এসেছিলো বাঁধা দিতে। দৈহিক শক্তিশালী বলে নামডাক ছিলো তার, আর সেই ভরসা নিয়েই সে এসেছিলো।
কিন্তু সেও এ্যারেষ্ট হয় পুলিশবাহিনীর হাতে।
সমস্ত রাত যুদ্ধ চললো।
একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর আহত হলেন। পুলিশ সুপার এবং আরও যারা তার সঙ্গে ছিলেন তারাও অতি সতর্কতার সঙ্গে গুলী চালিয়েছেন। বনহুর আর রাণীও নিশ্চুপ ছিলো না। তারা সেই চোরা কুঠরীর মধ্যে প্রবেশ করে অনেকদূর এগিয়ে গেছে।
ভোর হলে দেখা গেলো মিঃ চৌধুরী এবং মিসেস ক্যাথোলিন অদৃশ্য হয়েছে। কোথায় গেলো তারা ভেবে পাচ্ছেন না মিঃ হারবার্ড ও পুলিশ ইন্সপেক্টর মিঃ খান। লণ্ঠনধারীর রক্তাক্ত মৃতদেহটা উবু হয়ে পড়ে আছে।
মিঃ হারবার্ড বললেন-আশ্চর্য, তারা দুজন গেলেন কোথায়? তবে কি? তাদের অপহরণ করেছে? ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে আর গুলী আসছে না।
পুলিশ ইন্সপেক্টর যিনি আহত হয়েছিলেন তিনি যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়লেন। একটি গুলী তার বাঁ হাতের মাংসপেশীতে বিদ্ধ হয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। রক্তপাত হচ্ছে সেই হাত থেকে। এদিকে মিঃ চৌধুরী ও তার সঙ্গিনীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মিঃ হারবার্ড পুলিশ ইন্সপেক্টরটিকে হসপিটালে পাঠিয়ে দিলেন এবং ক্ষুদে ওয়্যারলেসে পুলিশ বাহিনীকে আসার জন্য নির্দেশ দিলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশবাহিনী চলে এলো।
চললো অনুসন্ধান।
মিঃ হারবার্ড নিজে এবং তার সঙ্গীগণ অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে সবগুলো জায়গা খুঁজে দেখতে লাগলেন। আরাকান একটি বৃহৎ শহর, এখানে জনসাধারণ অতীব সতর্ক এবং সৎ মহৎ। একজন অপরজনকে সাহায্য সহযোগিতা করতে ভালবাসে। পরহিতকর কাজ এদের পছন্দ অথচ এমন একটা দেশের অভ্যন্তরেও রয়েছে গভীর রহস্য। যেমন গোলাপের ভেতরেও বাস করে বিষকীট, হুলের মধ্যে রয়েছে ভয়ংকর এক অভিশাপ।
আরাকান পুলিশমহল সর্বক্ষণ নিষ্ঠা আর সতোর সঙ্গে কাজ করে থাকে। এ কারণে আরাকানে একটা শান্তি বিরাজ করতো সব সময়। পোড়োবাড়িখানার অভ্যন্তরে সন্ধান চালিয়ে বহু গোপন রহস্য উদঘাটিত হলো, কিন্তু বলহরি সিং এবং আর কাউকে পাওয়া গেলো না। এমনকি মিঃ চৌধুরী ও ক্যাথোলিনকেও খুঁজে পেলো না পুলিশবাহিনী। তারা পেলো গুদামভরা মালামাল, যা অসৎ উপায়ে রক্ষিত ছিলো পোড়োবাড়িটার গোপন কক্ষগুলোতে।
বাড়িখানা পুলিশ হেফাযতে রইলো। মিঃ হারবার্ড অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন মিঃ চৌধুরী ও ক্যাথোলিনকে না পেয়ে।
পুলিশমহল যাদের আটক করলেন তাদের মুখ দিয়েই সব রহস্য উদঘাটনে সচেষ্ট হলেন।
কিন্তু দেখা গেলো যাদের বন্দী করে আরাকান হাজতে রাখা হয়েছিলো তাদের সবাই মৃত্যুবরণ করেছে। একটিকেও পুলিশমহল জীবিত পেলো না।
কিভাবে সবাই মৃত্যুবরণ করেছে সে রহস্য জটিলতার অন্ধকারে রয়ে গেলো।
*
সত্যি আশ্চর্য বটে রাণী। চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বললো বনহুর।
রাণী চায়ের কাপটায় শেষ চুমুক দিয়ে বললো–হা, আশ্চর্য বটে। আমরা সেই পোড়োবাড়ির গোপন সুরঙ্গপথ ধরে কোথায় এসে পড়েছি। এটা কোন্ হোটেল বলতে পারো?
নিশ্চয়ই পারবো। কথাটা বলে বনহুর একটি বয়কে ডাকলো-এই শোন।
বয় তোয়ালে দিয়ে টেবিল পরিষ্কার করছিলো, এগিয়ে এলো-স্যার আমাকে ডাকছেন?
হ্যাঁ শোন।
বলুন?
আমরা অন্ধকারে ঠিকমত তোমাদের হোটেলের নামটা দেখতে পাইনি। কি নাম যেন এ হোটেলের?
বয় হাসলো, কেমন যেন ফ্যাকাশে হাসি।
বনহুর আর রাণী তাকিয়ে আছে বয়টার মুখের দিকে। বয় বললো–এ হোটেলের তেমন কোনো নাম নেই। তবে মালিকের নামেই চলে। আক্কাস মিয়ার হোটেল বললেই সবাই চিনবে। কথাটা বলে বয় চলে যাচ্ছিলো, এমন সময় একটি বিরাটবপু লোক ভেতরে প্রবেশ করলো। বয় আংগুল দিয়ে দেখিয়ে বললো–আমাদের হোটেলের মালিক।
রাণী বললো–ইনিই বুঝি আক্কাস মিয়া?
হ্যাঁ মেম সাহেব। কথাটা বলে চলে গেলো সে।
সত্যি কেমন অদ্ভুত লাগছে। এমন হোটেলও আছে আরাকান শহরে। এখানে সব গুন্ডা বদৃমাইশদের আখড়া বোঝা যাচ্ছে। কথাটা বললো রাণী।
বনহুর বললো—এ হোটেলের সঙ্গে যোগাযোগ আছে বলহরি সিংয়ের এবং তার এখানেই সন্ধান মিলবে। সুরঙ্গপথটা কেমন নিপুণভাবে তৈরি করা হয়েছে। কেউ বুঝবে না ওটা সুরঙ্গপথ। সুইচ টিপলাম আর একটি দরজা বেরিয়ে এলো। কেমন কৌশলে দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যায়। তারপর জমাট অন্ধকার।
ভাগ্যিস তুমি ক্ষুদে টর্চটা সঙ্গে রেখেছিলে বনহুর।
হ্যাঁ সব সময় ওটা আমি সঙ্গে রাখছি, অবশ্য আরাকান আসার পর। সুরঙ্গ পথটা কেমন নিখুঁতভাবে গভীর মাটির তলদেশ দিয়ে একেবারে বহুদূর চলে এসেছে। আমি ভেবেছিলাম বলহরিকে এই সুরঙ্গমধ্যেই পাবো এবং প্রস্তুত ছিলাম তার সঙ্গে মোকাবেলা করার জন্য। কিন্তু সে উদ্দেশ্য সফল হলো না। শয়তানটা ভেগেছে অন্য কোনো পথে। এ হোটেলের প্রাচীরের ধারে একটি কৃপের মধ্যে সুরঙ্গমুখ এসে শেষ হয়েছে, এটা আমি ভাবতে পারিনি।
আমিও বড় অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত একটি শুকনো কুপ। যা হোক কেউ দেখে ফেলেনি তাই অনেকটা নিশ্চিন্ত আছি। গরম চা খেয়ে শরীরটা কিছু হাল্কা হলো।
শোন রাণী, এখানে বিলম্ব করা উচিত হবে না।
তবে কোথায় যাবে ভাবছো?
আরাকানের একটি নিকৃষ্ট বস্তি এলাকা এটা। এ জায়গা আমাদের জন্য মোটেই শোভনীয় নয়, কারণ যে কোনো মুহূর্তে বলহরি সিংয়ের নজরে পড়ে যাবে এবং সে আমাদের বন্ধু হিসেবে পাশে এসে দাঁড়াবে। তার মানে বন্দী করবে যে কোনো উপায়ে। সেই পোড়োবাড়ির অভ্যন্তরে তার গোপন রহস্য ঘাঁটি আর সেই রহস্য ঘাটির মূল পথ হলো এ হোটেল সংলগ্ন কূপ। তবে এ হোটেলটাও তারই একটি অঙ্গ। রাণী?
বল বনহুর?
হোটেল লর্ড মার্গারেট হাউসেই আমরা অবস্থান করবো। তবে সাধারণভাবে নয়, বিদেশীর ছদ্মবেশে। আরাকান আমাকে হাত ছানি দিয়ে ডাকছে, এখানে আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ হলো মিঃ রিজভীকে শত্রুমুক্ত এবং তার কন্যা মাসুমা রিজভীর জীবনকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। আরও কিছু আমার জানার বা দেখার বাকি আছে আরাকানে, তা হলো হোটেল মার্গারেট হাউসের কিছু অবদান সম্বন্ধে, যা একান্তভাবে আমাদের জানা দরকার।
রাণী একটু হেসে বললো–তুমি তো জানো বনহুর, সে আমার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। যদিও সে জানে না আমি এখন কোথায় কি অবস্থায় আছিরাণী একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলো।
বনহুর টেবিলে চায়ের কাপটা নাড়াচাড়া করে বললো–হা, আহাদ চৌধুরী এক মহান ব্যক্তি বটে। তার প্রশংসা না করে পারি না। তুমি তাকে স্বামীরূপে পেয়ে অত্যন্ত সুখী হয়েছে রাণী, এমন লোক হয় না।
অবশ্য সে কথা মিথ্যা নয় বনহুর। আমি একজন দস্যুকন্যা আর সে এক শিক্ষিত জ্ঞানীগুণী স্বনামধন্য ডিটেকটিভ, তার সঙ্গে আমার তুলনা হয় না….
প্রথম পরিচয় যেদিন হলো তার সঙ্গে সেদিন আমি তাকে ভালভাবেই চিনেছিলাম রাণী। তখন শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে এসেছিলো। যদিও তিনি সেদিন বনহুরকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্য নিয়েই হাজির হয়েছিলেন তবুও তাকে আমি শত্রু ভাবতে পারিনি। তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ আমাকে আকৃষ্ট করেছিলো। আমি স্বেচ্ছায় তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলাম।
হ্যাঁ, এ কথা আমি আমার স্বামী আহাদ চৌধুরীর মুখে শুনেছি। সেও কিন্তু তোমাকে বন্ধু বলেই গ্রহণ করেছিলো, আজও করে।
আমি জানি এ কথা রাণী। আর জানি বলেই তোমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছি সর্বতোভাবে। তবে ঘটনাচক্রে মাঝে মধ্যে তোমার সঙ্গে আমার গরমিল হয়ে যায়….্যাক সে সব কথা, এবার বেরিয়ে পড়া যাক। তবে আবার এ হোটেলে আসবো নতুন বেশে। শোন রাণী, শুধু বলহরিই নয়, তার পেছনে অদৃশ্যে থেকে কাজ করছে এক নামকরা ব্যক্তি। আমি তার সন্ধান পাইনি, তবে জেনেছি। সেই ব্যক্তিই অগোচরে থেকে বলহরির দলকে দিয়ে এমন কি মিঃ বিশ্বাসকেও নাচের পুতুল বানিয়েছিলো। সে ব্যক্তিকে আরাকানের মহান ব্যক্তি বলা যায়….্যাক আর বেশিক্ষণ এখানে থাকতে চাই না। শোন রাণী, সেই ব্যক্তিই আরাকানের সর্বনাশ সাধনে বদ্ধপরিকর। লীলা নাগকে সে-ই কৌশলে হত্যা করিয়েছে এবং লীলা নাগের কণ্ঠের হীরক হার এখন তারই হাতের মুঠায়। কিন্তু পুলিশমহল জানে, সে হীরক হার এখনও আরাকান পুলিশের হেফাজতে আছে কথাটা বলে হাসে বনহুর।
রাণী অবাক হয়ে তাকালো তার মুখের দিকে।
বাইরে বেরিয়ে এলো বনহুর আর রাণী।
একটি ঘোড়ার গাড়ি অদূরে অপেক্ষা করছিলো, বনহুর আর রাণীকে দেখে কোচওয়ান এগিয়ে এলো গাড়ি নিয়ে।
বনহুর আর রাণী চেপে বসলো।
গাড়ি চলতে শুরু করলো।
শুকনো পাথুরে পথ। গাড়ির চাকার শব্দ ঘোড়ার খুঁজের প্রতিধ্বনির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেলো।
দু’পাশে সারি সারি পাইন আর দেবদারু গাছ। একদিন এ পথটা আরাকান শহরের বিশিষ্ট পথ ছিলো। আজ এ পথ বড় নির্জন, পথের ধারে স্থানে স্থানে সরাইখানা আর দু’একটা পুরানো রেস্তোরাঁ ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ে না। তবে পোড়োবাড়ি এবং ইট-পাথরের স্তূপের অন্ত নেই।
বেশ কিছুটা এগুনোর পর হঠাৎ ঘোড়ার গাড়িখানা থেমে পড়লো। বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে নেমে পড়লো এবং রাণীর হাত ধরে তাকেও নামিয়ে নিলো।
রাণী কিছুটা অবাক হয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলো।
বনহুর বললো–মুহূর্ত দেরী করোনা রাণী, ছুটতে থাকো।
ওরা প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলো। ছুটতে ছুটতে ফিরে তাকিয়ে দেখলো কোচওয়ান উবু হয়ে শুয়ে পড়েছে মাটিতে। তাকে আর দেখা যাচ্ছে না।
একটু পরেই ভীষণ শব্দ হলো।
বনহুর আর রাণী দেখলো ঘোড়াসহ গাড়িখানা তচনচু হয়ে গেছে। গাড়ির পাশেই ঘোড়ার মৃতদেহ নজরে পড়লো। গাড়ির ভগ্ন অংশ থেকে কালো ধূয়ারাশি বেরিয়ে আসছে।
বনহুর আর রাণী তখন অনেকটা দূরে পৌঁছে গেছে। রীতিমত হাঁপাচ্ছে রাণী ও বনহুর, কারণ খুব দ্রুত দৌড়ে আসতে হয়েছে। রাণী পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললো–বনহুর, তুমি কি করে জানলে ঐ গাড়িতে বোমা ছিলো?
কোচওয়ান গাড়ি রেখেই ছুটে পালাচ্ছিলো আমি তা লক্ষ্য করেছি এবং তখনই আমার ধারণা হয়েছে নিশ্চয় ঐ গাড়ির মধ্যে বোমা রাখা হয়েছে যা অল্পক্ষণেই বিস্ফোরিত হবে।
সত্যি তোমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না বনহুর। গাড়িখানা যে আমাদেরই জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বললো বনহুর–শত্রু পেছনে লেগে আছে সর্বক্ষণ, তারা বুঝতে পেরেছে আমাদের আসল উদ্দেশ্যটা।
*
হোটেল লর্ড মার্গারেটের দ্বিতল একটি কক্ষে পাশাপাশি দুটি সোফায় বসে কথা হচ্ছিলো। বনহুর আর রাণীর। রাত তখন নটা হবে।
হোটেলের কোনো এক কক্ষ হতে ভেসে আসছে আরবীয় মিউজিকের সুমিষ্ট সুর।
বনহুর তার হস্তস্থিত সিগারেট বাক্সটা খুলে একটি সিগারেট বের করে ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরলো, তারপর ম্যাচটা তুলে নিলো আলগোছে।
রাণী বলছে-বনহুর, আমরা আরাকানে অবস্থান করছি, এ কথা আমাদের শত্রুপক্ষ ভালভাবেই অনুধাবন করেছে। তাই তারা ছায়ার মত আমাদের অনুসরণ করছে।
সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করার পর বনহুর ম্যাচটা রেখে দিলো পকেটে, তারপর বললো–হা, সে কথা সত্য এবং তার প্রমাণ আমরা যথেষ্ট পেয়েছি। রাণী, আমি অনেকদূর অগ্রসর হয়েছি, জানি না সফলকাম হবো কিনা। এই সেই হোটেল মার্গারেট যার একটি কক্ষে লীলা নাগকে হত্যা করা হয়েছে। একটু থেমে বললো–চিত্রাভিনেত্রী লীলা নাগকে হত্যার পেছনে শুধু তার কণ্ঠের হীরক হারই ছিলো না, তাকে হত্যা করা হয়েছে যে কারণে, সে রহস্য আরও জটিল।
রাণী নিজের কপাল থেকে এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে বললো–সে রহস্য সম্বন্ধে আমার পূর্ণ ধারণা আছে বনহুর। হীরক হারটি শুধুমাত্র উপলক্ষ। কান্দাই সরকারকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে বিভ্রান্ত করাই হলো এ হত্যার মূল উদ্দেশ্য, আর লীলা নাগকে হত্যা করে সেই উদ্দেশ্যই সফল করার চেষ্টা
তোমার অনুমান সত্য। আরাকান সরকার জন বিস্ফোরণ লক্ষ্য করে বেকার সমস্যা দূরীভূত করার জন্যই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। লর্ড মার্গারেট হোটেলকে আরাকান সরকার বেছে নিয়েছিলেন এ সমস্যার সমাধান করার উদ্দেশ্যে।
তুমি যা ভেবেছে তা সত্য। এ হোটেলের আয় থেকেই চলছে আরাকানের কয়েকটি বৃহৎ ইন্ডাষ্ট্রি, কলকারখানা যেখানে কয়েক লক্ষ বেকার সমস্যার সমাধানের প্রচেষ্টা চলছে।
সত্য, আরাকান সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। এমন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিটি দেশের সরকার যদি ভাবতেন তাহলে দেশের এ বেকার সমস্যার অনেকটা সমাধান হতো। অন্যান্য দেশে পথে-ঘাটে-মাঠে অগণিত বেকার যুবক এবং বয়স্কগণ হা হা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কতকটা বেওয়ারিশ কুকুরের মত অবস্থা তাদের। রাণী, বড় দুঃখ হয় এরাও মানুষ অথচ এরা মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত। কোথাও যদি চাকরির সন্ধানে যায়, বিমুখ হয়ে ফিরে আসে। বাড়িতে বৃদ্ধ পিতামাতা ভাই-বোনের অথবা স্ত্রী পুত্র কন্যার ক্ষুধাতুর মুখের দিকে তাকিয়ে যে কোনো কাজ করতে চেষ্টা করে, কিন্তু সেখানেও পায় তিরস্কার। লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হয়। হাত পেতে ভিক্ষা করতে পারে না, কারণ ওটা সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ। একদিন ধুকে ধুকে হয়তো মৃত্যুবরণ করে একটু থেমে বলে বনহুর–এ বেকার সমস্যা যতদিন দূর না হয়েছে ততদিন জাতির উন্নতি হবে না।
আরাকান সরকার সে চেষ্টা নিয়েছেন এবং সাফল্য অর্জনও করেছেন বলা যায়। কদিন আমি আরাকানের বহু স্থান ঘুরেছি। এমন দেশ কমই নজরে পড়েছে। প্রায়ই বড় বড় ইন্ডাষ্ট্রি, কলকারখানা আমার নজরে পড়েছে। এ সব ইন্ডাষ্ট্রি, কলকারখানায় প্রতিদিন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি প্রস্তুত হচ্ছে। জনগণের চাহিদা মিটছে, বহু কোর লোক এসব ইন্ডাষ্ট্রি, কলকারখানায় কাজ করে অন্নের সংস্থান করে নিচ্ছে। এসব ইন্ডাষ্ট্রি, কলকারখানা সবই সরকার পরিচালিত।
রাণী তুমি এতসব খোঁজখবর এরই মধ্যে সংগ্রহ করে ফেলেছো, অবশ্য এটা তোমার কাছে অতি সামান্য ব্যাপার তা জানি।
কিন্তু তুমিও আমার চেয়ে অনেক বেশি জেনেছ আরাকান সম্বন্ধে তা ঠিক। কথাটা বলে একটু হাসলো রাণী।
বনহুর কি যেন ভাবলো আপন মনে, তারপর বললো–শুধু সরকারের প্রচেষ্টা নয়, আরাকান জনগণের সহযোগিতাও আছে। এসব ইন্ডাষ্ট্রি কলকারখানায় যারা কাজ করছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হতে শ্রমিকগণ সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। সবাই নিজ নিজ কর্তব্য পালনে ব্রতী। আমি দেখলাম যারা কর্মকর্তা তারা প্রত্যেকে ন্যায়নিষ্ঠা আর সতোর মনোভাব নিয়ে শ্রমিকদের কাজ দেখাশোনা করছে তারা কেউ কর্তব্যহীন নয়।
হ্যাঁ, আমিও সেটা লক্ষ করেছি। প্রতিটি ইন্ডাষ্ট্রির অভ্যন্তরে আমি প্রবেশ করার সুযোগ করে নিয়েছি এবং দেখেছি যে যার কাজে একান্তভাবে নিয়োজিত। কোথাও কেউ ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টায় নেই।
এ কথা সত্য। দেশের প্রতিটি মানুষ যদি ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে তাহলে দেশে এত সমস্যা থাকতো না। অবশ্য দেশের জনগণের ভাগ্য কতকটা নির্ভর করে দেশের সরকারের ওপর। সরকার যদি বেকার সমস্যা সমাধানে আগ্রহী হন তাহলে ব্যাপার অনেক সহজ হয়। যেমন আরাকানে এসে দেখছি এখানে সরকার নানা ধরনের ইন্ডাষ্ট্রি কলকারখানার মাধ্যমে বেকার সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছেন। এসব ইন্ডাষ্ট্রি কলকারখানায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রস্তুত হচ্ছে, এতে দেশ ও দেশের জনগণের মঙ্গল সাধন হচ্ছে এবং বেকার সমস্যার সমাধান হচ্ছে।
কিন্তু আমাদের কতগুলো দেশের কর্মকর্তাগণ গদি নিয়েই শুধু কামড়াকামড়ি করছেন। তারা জনগণের সমর্থন চান, নানা ধরনের বড় বড় বুলি আওড়িয়ে জনগণকে সন্তুষ্ট করতে চান। আসলে সবাই এরা স্বার্থপর, গদি পাবার পর নিজ নিজ ঐশ্বর্যের ইমারত কি করে গড়ে তুলবেন, কি করে নিজে স্বনামধন্য ব্যক্তি হবেন এটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।
হ্যাঁ, এ কথা সত্য। তবে আরাকানেও যে এমন ব্যক্তি নেই তা নয়। সাধুতার মুখোশের অন্তরালে আত্মগোপন করে সরকারের এ মহৎ উদ্দেশ্যকে বানচাল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ চক্রান্ত উদ্দেশ্যবিহীন নয় রাণী, এর পেছনে রয়েছে ভীষণ এক চক্রান্ত। কথাটা বলে থামলো বনহুর। পুনরায় একটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বললো–রাণী, যে ব্যক্তি আরাকানের জনগণকে ধোকা দিয়ে, এমনকি আরাকান সরকারের চোখে ধূলো দিয়ে নিজে সুউচ্চ আসনে উপবেশন করে গোপনে কাজ করে যাচ্ছে আমি তার সন্ধান পেয়েছি এবং তার কার্যকলাপ লক্ষ করছি।
বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো রাণী বনহুরের দিকে, বললো–তুমি তার সন্ধান পেয়েছো?
হ্যাঁ। আর সেই কুচক্রীর চক্রান্তেই লীলা নাগ নিহত হয়েছে। হোটেল লর্ড মার্গারেট এর আয় বিনষ্ট করাই হলো তার মূল উদ্দেশ্য। সেই মহান ব্যক্তির সুকৌশল বুদ্ধির যোগানদার ছিলো, মিঃ বিশ্বাস ও তার দলবল।
কে সেই মহান ব্যক্তি বলবে বনহুর?
বলবো না দেখাবো, চাক্ষুষ দেখবে সেই স্বনামধন্য ব্যক্তির পরিণাম। রাণী, আরাকান দেশটি আমার পরিচিত স্থান, তবে এ আরাকান সে আরাকান নয়। আমি সেই আরাকানে গিয়েছি এবং সেখানে আমাকে বেশ কিছুদিন অবস্থান করতে হয়েছিলো। আজও সেই দিনগুলোর কথা আমার মনে পড়ে। যাক, সে কথা, আমার জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করলো এই নতুন আবিষ্কার আরাকান। এখানে প্রচুর শান্তি আছে জনগণের মনে। এরা সবাই সাধ্যমত ঠিক নিয়মানুযায়ী চলে, তবে জানো তো, পুষ্পের আড়ালেই বাস করে বিষাক্ত কীট। তেমনি একদল ব্যক্তি গোপনে দেশের সর্বনাশ সাধনে চেষ্টা করছে?
পারবে বনহুর, তুমি পারবে আরাকানের এই বিষকীটকে সমূলে বিনষ্ট করতে।
ইনশাআল্লাহ পারবো।
সত্যি, তোমাকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। হ্যাঁ, একটা কথা যা তোমার কাছে গোপন করে গেছি তা বলবো।
জানি আরাকানই এক সময় ছিলো তোমার বিচরণভূমি। তবে এ আরাকান নয়, সে আরাকান পৃথিবীর উত্তরে আর এ আরাকান পৃথিবীর পূর্ব-দক্ষিণে। তুমি সেই আরাকান সম্বন্ধে কিছু বলতে চাও, সত্যি বলছিনা রাণী?
হ্যাঁ, সেই আরাকানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার জীবনের অনেক ঘটনা। একদিন সব জানাবো, যদিও তুমি অনেক কিছু জানো বনহুর।
অবশ্য রক্তে আঁকা ম্যাপখানা নিয়েই তোমার সঙ্গে আমার…যাক ওসব কথা আজ, পরে রক্তে আঁকা ম্যাপ নিয়ে আলাপ করবো। রাণী, তোমার সহযোগিতা পেলে আমি বাদশা হাকিমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করবে প্রতিটি শাসনকর্তাকে…
পারবে? পারবে বনহুর বাদশা হাকিমের সেই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত করতে দেশের নেতৃবৃন্দকে?
প্রতিটি নেতাকে না পারলেও দু’চার জনকেও যদি মহান নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তাহলেও নিজেকে সার্থক মনে করবো। সত্যি বাদশা হাকিম এক মহাপুরুষ। তিনি নিজে বাদশা হয়েও থাকেন পর্ণকুটিরে। সমস্ত দিন পর অতিথিসহ খানা খান। রাজ্যের বাইরে তিনি অবস্থান করেন অথচ তার কোনো প্রহরী নেই, দাসদাসী নেই। নিরাড়ম্বর জীবন। সত্যি, আমি অভিভূত হয়েছি তার সান্নিধ্য লাভ করে। বিচারে তাঁর অসীম দক্ষতা, ধনী-দরিদ্র সবাই তার কাছে সমান। অপূর্ব তার রাজ্যশাসন দক্ষতা
রাণী গভীরভাবে অনুধাবন করছিলো বনহুরের কথাগুলো। শান্তকণ্ঠে বললো–আমাদের দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ যদি স্বার্থত্যাগ করে বাদশা হাকিমের মত দেশের জনগণের জন্য আত্মত্যাগ করতেন তাহলে দেশ ও দেশের জনগণের এ অবস্থা হতো না। অবশ্য আরাকানে এসে আমরা অনেকটা তৃপ্ত। এখানের সরকার জনগণের জন্য শুধু ভাবছেনই না, তাদের জীবনকে কি করে পরিপূর্ণতায় ভরিয়ে তুলবেন সে চেষ্টা করছেন। শহরে বন্দরে এবং শহরতলিতে নানা ধরনের ইন্ডাষ্ট্রি-কলকারখানা গড়ে তুলে শিক্ষিত, আধা-শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত, এমনকি অশিক্ষিত সবাইকে তাদের যোগ্যতা হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন, তাতে দেশ ও দেশের জনগণ উপকৃত হচ্ছে। একটু থেমে বললো সে-দেশের জনসাধারণও তেমনি মহৎ চরিত্রের অধিকারী। সততা, ন্যায়নিষ্ঠা রয়েছে সবার মধ্যে। আমি লক্ষ্য করেছি, বিশেষ করে যুবসমাজ, অতি সচেতন। এদের মধ্যে আছে একতা ও ঐকান্তিক মনোভাব। নিষ্ঠার সঙ্গে এরা কাজ করে।
হ্যাঁ রাণী, সত্য কথা তুমি বলছো। যুবসমাজ দেশ ও দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি। আমাদের। দেশে সেই মহাশক্তির কোনো মূল্যই দেওয়া হয় না, বরং অবহেলিত তারা। যুবসমাজ যখন বেকারত্বের নির্মম কশাঘাতে নিষ্পেষিত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে তখন খরস্রোতা নদীর উচ্ছাসিত জলরাশির মত ধাবিত হয় এদিক সেদিক। কোন পথ তাদের জন্য বাঞ্ছিত তখন তারা অনুধাবনে সক্ষম হয় না, অনেকেই বিপথগামী হয়ে পড়ে। একটু থামলো বনহুর, তার আংগুলের ফাঁকে ধূমায়িত সিগারেট, বললো–এর জন্য দায়ী আমাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ। তারা নিজ নিজ স্বার্থে যুবসমাজকে ব্যবহার করে সামান্য কিছু অর্থের অথবা মিষ্টবাক্যের বিনিময়ে। নাচের পুতুলের মত নাচার যুবসমাজএরা যদি বুঝতে পারতো তাদের শক্তি ব্যবহার করে একশ্রেণীর মানুষনামী জীব তাদের আখের গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে তাহলে এরা এমন কাজে এগিয়ে যেতো না। যুবসমাজ চায় কাজ, তারা নিজীবের মত বসে থাকতে চায় না। কাজের মাধ্যমে তারা নিজেরা বাঁচতে চায়, অন্যকে বাঁচাতে চায়।
রাণী একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো–তোমার কথা খাঁটি সত্য, তার প্রমাণ অনেক আছে। আমার একটি তরুণ অনুচর ফরহাদ। বাবা-মার বড় ছেলে সে, মধ্যবর্তী ঘরে তার জন্ম। যা কিছু বিষয় আশয়-সম্পত্তি ছিলো তা বিক্রি করে লেখাপড়া শিখিয়েছিলো সন্তানকে। শিক্ষা লাভ করলে ছেলে ভাল চাকরি পাবে, অনেক অর্থ উপার্জন করবে, তখন সব দুঃখ কষ্ট-দৈন্য দূর হবে। আবার বিষয় আশয় হবে, আবার ধনসম্পদ আসবে, কিন্তু সব আশা বাসনা ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। ডিগ্রি লাভ করার পর সে অনেক বাসনা নিয়ে চাকরির সন্ধানে ছুটলো। অনেক স্থানে বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী দরখাস্ত-করলো, ইন্টারভিউ দিলো কিন্তু সব জায়গায় সে বিমুখ হলো। একদিন দু’দিন করে মাস গেলো, বছর গেলো তবুও চাকরি তার ভাগ্যে জুটলো না। পিতা-মাতার ক্ষুধাতুর মুখ সে সহ্য করতে পারতো না। ছোট ভাই-বোনের কান্না তাকে বিদগ্ধ করতো, সামান্য মজুরের কাজও সে করতে এগিয়ে গেছে। সেখানেও নিষ্পেষিত হয়েছে, কাজের উচিত মূল্যটুকুও পায়নি বরং পেয়েছে তিরস্কার ও সমাজ তাকে কিছুই দিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ফরহাদের বাবা-মা বিনা-চিকিৎসায় ধুকে ধুকে একদিন মরে গেলো। ছোট ভাইবোনরা ক্ষুধার জ্বালায় লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে পেট চালাতে চেষ্টা করলো। লোকের বাড়িতে নানা রকম নির্যাতন সহ্য করেও তারা জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করলো, এমনি করে একদিন সে কাহিনী আরও হৃদয়বিদারক…
বনহুর একাগ্রমনে শুনছিলো আর ভাবছিলো পৃথিবীর অসহায় মানুষগুলোর কথা। তার চোখের সামনে ভাসছিলো এমনি কত করুণ মুখ। সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছিলো সে।
রাণী বলে চলেছে-ফরহাদের বড় আদরের বোন রেহানা, যার বাড়িতে কাজ করতে সেই বাড়ির মালিক ছিলো দুশ্চরিত্র এক অসৎ ব্যক্তি। পিতার বয়সী এই সাধুবেশি ভদ্রলোক তরুণী রেহানার জীবনে কলংক লেপন করলো। অন্তঃসত্ত্বা হলো রেহানা। ফিরে এলো বাড়িতে, পাড়া-প্রতিবেশিরা নানাজনে নানা কথা বলতে শুরু করলো। কানে এলো ফরহাদের, মাথায় তার বাজ পড়লো। দিশেহারা ফরহাদ বোনের মুখে সব শুনলোথামলো রাণী।
বনহুর তীক্ষ্ণদৃষ্টি তুলে তাকালো রাণীর মুখের দিকে। দু’চোখ দিয়ে তার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছিলো। বললো সে-থামলে কেন, বলো তারপর?
ফরহাদ নিজেকে সামলাতে না পেরে পাশেই রাখা বটি দিয়ে বোনকে হত্যা করলো। তাতেও তার দেহের আগুন নিভলো না সেই বাড়িতে প্রবেশ করলো, হাতে তার রক্তমাখা বটিখানা। সন্ধ্যার অন্ধকারে প্রবেশ করলো বাড়ির ভেতরে। বৈঠকখানায় বসে ফুর্তি করছিলেন স্বনামধন্য ব্যক্তিটি। আরও বন্ধু-বান্ধব ছিল তার পাশে। কোনোদিকে খেয়াল না করে ধারালো বটিখানা দিয়ে কোপ বসিয়ে দিলো সেই মহাধনবান ব্যক্তির কাঁধে। পর পর কয়েকটি আঘাত; রক্তাক্ত অবস্থায় সোফায় ঢলে পড়লেন তিনি। তার বন্ধু-বান্ধব কিছু বুঝবার পূর্বেই ফরহাদ বেরিয়ে পড়লো, তারপর সে আত্মগোপন করে পালিয়ে বেড়াতে লাগলো। একটি বছর ধরে খেয়ে না খেয়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখ ঘোলাটে, পরিধের বস্ত্র ছিন্নভিন্ন ময়লা, পা ক্ষত-বিক্ষত। ইতিমধ্যে ছোট ভাইবোনগুলো কে কোথায় যে হারিয়ে গেলে তাদের সন্ধান পায়নি বা ইচ্ছে-করেই খোঁজ নেয়নি। দু’দুটো খুন করে ফরহাদ উম্মাদের মত হয়ে পড়েছে। একদিন আমার একজন অনুচর তাকে ধরে আনলো পিছমোড়া করে বেঁধে। পুলিশের গুপ্তচর মনে করে, আমি ভাল করে দেখলাম। মুখে ওর একটা ব্যথাকরুণ অথচ কঠিনতার ছাপ, চোখে হিংস্র দৃষ্টি যার কাছে আমার চোখ দুটো নত হয়ে গেলো। অনেক বলায় সে তার জীবনের করুণ কাহিনী বর্ণনা করলো, যা আজ তোমার কাছে ব্যক্ত করলাম। হ্যাঁ, আমি ওকে আমার একজন অনুচর হিসেবে গ্রহণ করেছি। সে আমার বিশ্বস্ত একজন সহচর।
তোমার ফরহাদের কাহিনী বাস্তব সত্য। চারদিকে তাকিয়ে দেখো প্রতিটি দরিদ্র মানুষের জীবন আজ এ ধরনের দুর্বিষহ অভিশাপে জর্জরিত। লেখাপড়া শিখেও অনেক যুবক আজ বেকার সমস্যায় ধুকে ধুকে মরছে। আর যারা অশিক্ষিত তাদের কথা তো আরও বর্ণনাতীত। সমাজের নির্মম কষাঘাতে তারা তিল তিল করে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সেদিক থেকে আরাকান আমার ভাল লেগেছে। এখানে বেকার সমস্যার সমাধানে সরকার বদ্ধপরিকর। নানা ধরনের কলকারখানা এবং গ্রামাঞ্চলের জন্য কৃষিকার্যের নানা পদ্ধতি সরকার করেছে, সত্যি আমি আনন্দিত রাণী, আমি বাদশা হাকিমের রাজ্যে পুনরায় যাবে এবং সেখানে কিছুদিন অবস্থান করবো। অনেক শিখবার আছে, অনেক কিছু জানবার আছে। তবে হ্যাঁ, আরাকান হতে যাবার পূর্বে আমি সেই বিষকীটকে সমূলে বিনষ্ট করবো…
ঠিক সেই মুহূর্তে ওপাশের কাঁচের শার্শীর পাশ থেকে একটি ছায়া সরে গেলো।
রাণী বললো–এবার ওঠা যাক, কারণ রাত অনেক হয়েছে।
বললো বনহুর–হ্যাঁ, বড্ড ঘুম পাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, একটা কথা শোনা হলো না, তুমি মাসুমাকে জীবিত অবস্থায় কোথায় পেলে?
বনহুরের দিকে তাকিয়ে ইংগিত করলো রাণী, চাপাকণ্ঠে বললো–মিঃ রিজভী এখনও সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত নয়। মাসুমার জীবনও বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তার উদ্ধার সম্বন্ধে পরে জানাবো। কেউ যেন ওপাশে শাশীর আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি লক্ষ্য করেছি।
বনহুর বললো–হা, আমি তার ছবি গ্রহণ করেছি। এই দেখো রাণী।
বনহুর তার মুভি ক্যামেরা থেকে দেয়ালে ছবি ফেললো।
রাণী বললো–আশ্চর্য, তুমি এত সজাগ ছিলে?
আমি অনেক পূর্বেই লক্ষ করেছিলাম, এবং তখন আমার ক্ষুদে মুভি ক্যামেরা প্রস্তুত করে নিয়েছিলাম।
সত্যি, তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তোমার ক্ষুদে মুভি ক্যামেরা ঐ সিগারেট বাক্সটা তা কিন্তু আমি জানতাম না। তবে লোকটা কে বলতে পারো?
হ্যাঁ, আমি ঐ ছায়া দেখেই বেশ বুঝতে পেরেছি। লোকটা যখন আলগোছে বারান্দার শাশীর পাশে এসে দাঁড়ালো তখনই তাকে চিনে ফেলেছি। যাক, এবার তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পারো রাণী, মাসুমাকে তুমি কি করে যমালয় থেকে মানে সলিল সমাধি থেকে তুলে আনতে পারলে?
তাহলে শুনবে?
শুনবো। আমার সিগারেট কেসে এখনও তিন তিনটে সিগারেট আছে, তা ছাড়া আছে একটি ফিলা যা আমাদের গভীর রহস্য উদঘাটনে সহায়তা করবে। বলো রাণী।
রাণী এবার সোফায় হেলান দিয়ে বসলো, তারপর বললো–মিঃ চৌধুরী আরাকান এসেছেন।
উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো বনহুর–তাই নাকি। মিঃ আহাদ চৌধুরী আরাকানে এসেছেন?
আর তিনি এ হোটেলেই এক ক্যাবিনে অবস্থান করছেন।
আশ্চর্য বটে। বললো বনহুর।
হ্যাঁ, তার সহযোগিতায় আমি মাসুমাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। বনহুর, আহাদ চৌধুরীর সহযোগিতায় আমি তোমার কাজে অনেকটা সাফল্য আনতে পেরেছি।
দীপ্তকণ্ঠে বললো বনহুর–রাণী, তুমি তার সঙ্গ ত্যাগ করে এখানে আমার পাশে এত রাত অবধি…
হেসে বললো রাণী-আহাদ প্রখ্যাত ডিটেকটিভ, সে জানে তার রাণী যেখানেই থাক হারিয়ে যাবে না কোনো সময়। কথাটা বলে তাকালো রাণী বনহুরের দীপ্ত হাস্যোজ্জ্বল মুখখানার দিকে। তারপর সে বলতে শুরু করলো-আমার ক্ষুদে ওয়্যারলেস যা আমার লকেটে বসানো আছে, তা দিয়ে আমি প্রতিদিন তার সঙ্গে কথা বিনিময় করতাম। তার মাধ্যমেই আমি মাসুমাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। এক জাহাজের নাবিক নাকি তাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় সাগরবক্ষ থেকে উদ্ধার করে। তারপর হিন্দোল হসপিটালে তার চিকিৎসা চলে, সংবাদপত্রে তার উদ্ধার বর্ণনাসহ ঘটনা ছাপা হয়। মিঃ আহাদ চৌধুরীকে আমি মাসুমার জীবন বৃত্তান্ত জানিয়ে তার সহায়তা কামনা করেছিলাম। মাসুমার ভাগ্য প্রসন্ন বলতে হয়, আহাদ চৌধুরী সেই সংবাদপত্র সম্বন্ধে আমাকে জানায়। আমি তখন তাকে আনার জন্য চলে যাই হিন্দোল। তুমি তখন অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলে বলহরির ব্যাপার নিয়ে।
তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো ভেবে পাচ্ছি না। মাসুমাকে আবার তার বাবা-মা ফিরে পাবেন এ যেন কল্পনাতীত। চলো রাণী, আহাদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসি। তবে হ্যাঁ, শত্রু কিন্তু আমাদের আশেপাশেই রয়েছে, তাদের গতিবিধি আমি ঠিকই লক্ষ করেছি। রাণী, আমি সন্ধান পেয়েছি আরাকানের এই সুন্দর সুষ্ঠু পরিকল্পনাকে যারা বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তারা কারা এবং তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে কে। কথাটা বলে বনহুর তাকালো নিজের আংগুলগুলোর দিকে। মুখমন্ডল কঠিন হয়ে উঠেছে তার। একটু থেমে বললো–চলো রাণী, তোমাকে মিঃ আহাদ চৌধুরীর ক্যাবিনে পৌঁছে দিয়ে আসি।
রাণী উঠে দাঁড়িয়ে বললো–তুমি ঘুমাও বনহুর, আমি যেতে পারবো। কাল তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে ওর।
বনহুরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেলো রাণী।
একটু হাসলো বনহুর। তারপর পুনরায় সে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে আর একটি সিগারেট বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করলো।
রাণী এগুতেই হঠাৎ তার পেছন থেকে কেউ তার মুখে রুমাল চেপে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে রাণী সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললো। জন লোক তাকে ধরে ফেললো এবং তুলে নিলো হাতের ওপর।
এগিয়ে গেলো লিফটের দিকে।
হোটেলের আলোগুলো ঠিক সেই মুহূর্তে নিভে গেলো।
লোক দু’জন রাণীর সংজ্ঞাহীন দেহটা নিয়ে লিফটে উঠে দাঁড়ালো। লিফটে উঠে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার আলো জ্বলে উঠলো।
লিফট নেমে গেলো নিচে।
রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে ছিলো একটি কালো রঙের মোটর কার। রাণীর সংজ্ঞাহীন দেহটা তুলে নিলো লোক দু’জন গাড়ির পেছন আসনে।
গাড়ি ছুটতে শুরু করলো।
*
পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে রাণীকে। তার হাতের বাধন বড় শক্ত হওয়ায় যন্ত্রণা বোধ করছিলো। কক্ষটি অন্ধকার, তবে ক্ষীণ একটা আলোকরশ্মি ভেসে আসছে কোনো পথ দিয়ে। রাণী চারদিকে তাকিয়ে দেখলো, ধীরে ধীরে স্মরণ হলো সব কথা। বনহুরের ক্যাবিনে বসে আলাপ আলোচনা হচ্ছিল, তারপর রাণী একাই বেরিয়েছিলো তার ক্যাবিনে যাওয়ার জন্য। কয়েক পা এগুতেই তার নাকে কে বা কারা একটা রুমাল চেপে ধরেছিলো। তারপর আর কিছু মনে নেই রাণীর। কারা তাকে এভাবে কৌশলে বন্দী করেছে। নিশ্চয়ই তারা তাদের শত্রুপক্ষ। মিঃ রিজভীর শত্রু ছিলো মিঃ বিশ্বাস কিন্তু আসলে তাকেও পরিচালিত করেছিলো কোনো এক ব্যক্তি বা তার দল, যা জানতে পেরেছে বনহুর। রাণীর মনে নানা চিন্তা বুদবুদের মত একটির পর একটি ভেসে উঠছে আর তলিয়ে যাচ্ছে। মাথাটা তার এখনও ঝিমঝিম্ করছে। কপালের দুপাশের রগগুলো টন্ টন্ করছে, চোখ ঝাপসা মনে হচ্ছে। হাত দু’খানা পিছমোড়া করে বাঁধা থাকায় খুব কষ্ট হচ্ছিলো।
রাণী উঠে বসতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না, তার হাত ও দেহটা শয্যার সঙ্গে মজবুত করে বাঁধা আছে। আবার রাণী তাকালো কক্ষের চারদিকে। সব এলোমেলো হয়ে আসছে, মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে যেন সবকিছু।
চোখ বন্ধ করলো রাণী। ভাবতে লাগলো, বনহুর বা আহাদ কি কিছু জানতে পারেনি? জানলে নিশ্চয়ই বাধা দিতো ওরা, এমন করে তাকে বন্দী করার সুযোগ এরা পেতো না। তবে কি আহাদ এবং বনহুর ওরাও আরাকানচক্রীর চক্রে বন্দী?
হঠাৎ একটা শব্দ হলো, দরজা খোলার শব্দ বলে মনে হলো রাণীর কাছে। তবে কি কেউ প্রবেশ করলো, নিশ্চয়ই তাই হবে। চুপ করে পড়ে রইলো রাণী বিছানায়।
ভারী জুতোর শব্দ এগিয়ে আসছে তার শয্যার দিকে।
বেশ কয়েকটি জুতোর শব্দ।
মার্জিত আর গম্ভীর কণ্ঠস্বর কানে আসছে রাণীর। যারা তার শয্যার পাশে এগিয়ে আসছে তারা যে সাধারণ ব্যক্তি নয় তা বেশ অনুধাবন করলো রাণী। নিশ্চয়ই কোনো স্বনামধন্য ব্যক্তিরা হবে, এবং তারাই যে তাকে আটক করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বনহুরের কথাগুলো কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হলো-তবে আরাকানেও যে এমন ব্যক্তি নেই তা নয়। সাধুতার মুখোশ পরে খোলসের অন্তরালে আত্মগোপন করে সরকারের এই মহৎ উদ্দেশ্যকে বানচাল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। উদ্দেশ্যবিহীন এ চক্রান্ত নয় রাণী, এর পেছনে রয়েছে ভীষণ এক রহস্য…তবে কি সেই চক্রান্তকারীর দল তার শয্যার পাশে এগিয়ে আসছে? রাণীর হাত দু’খানা বাঁধা থাকায় সে খুব যন্ত্রণা অনুভব করছিলো তবুও নিশ্চুপ রইলো অসীম ধৈর্যের সঙ্গে।
এবার সে বুঝতে পারলো ওরা ঠিক তার শয্যার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কারণ জুতোর শব্দ স্থির হলো। ভারী গম্ভীর গলা-এই সেই নায়িকা যার নাম দস্যুরাণী। একে গ্রেপ্তার করতে পারে এমন সাধ্য রায়হান পুলিশ বাহিনীর হয়নি স্যার।
অপর এক গলা-আমরা বেশ কয়েকদিন হলো ওর ওপরে সুতীক্ষ্ণ নজর রেখেছিলাম, তাই কৌশলে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছি।
এবার গম্ভীর গলা-মন্থনা দ্বীপে একবার দস্যুরাণীর সঙ্গে আমার মোকাবেলা হয়েছিলো। আমাকে সে নাকানি চুবানি খাইয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত মালামালসহ আমার জাহাজখানাকে নীল নদে ডুবিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। একটু থামলো, তারপর বললো–তোমরা জানোনা এতে আমার কি পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়েছিলো
নতুন একটি কণ্ঠ-স্যার, আমরা শুনেছি প্রায় পাঁচ কোটি টাকা আপনার ক্ষতি হয়েছিলো।
হ্যাঁ, তোমার কথা সত্য-আমার পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিলো তবে তা আমি পুষিয়ে নিতে পেরেছি পরের বার যখন রিলিফ এসেছিলো। তবুও সেই থেকে আমি ওকে সায়েস্তা করার জন্য খুঁজে বেড়িয়েছি। এবার হাতের মুঠোয় পেলাম
স্যার, আপনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন।
তা পারি, তবে আমার কাজে বাধা দেবার লোকের অভাব নেই।
স্যার, আপনি একজন মহান নেতা
তা বটে, তবে জনসাধারণ আমাকে অহেতুক কিছু দোষারোপ করে।
অমন একটু-আধটু দোষারোপ করবেই স্যার। আপনি আরাকান সরকারের একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহাপুরুষ।
থাক, আর প্রয়োজন নেই, এবার ওর সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করো। আমি আপাতত আড়ালে অবস্থান করছি। একটি ভারী জুতোর শব্দ ফিরে চললো বলে মনে হলো রাণীর।
কেউ তার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো।
অপর একজন বললো–কিছুক্ষণের মধ্যেই সংজ্ঞা ফিরে আসবে বলে ধারণা হচ্ছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
রাণীর হাত দু’খানা টন্ টন্ করছে। সে ধীরে অতি মৃদুস্বরে বললো–পানি, পানি দাও
হাসির শব্দ হলো, বেশ কয়েকজন হাসলো যেন একসঙ্গে। রাণী চোখ মেলে তাকালো।
ওদের একজন বললো–চেষ্টা করতে হলো না, এমনিতেই সংজ্ঞা ফিরে এসেছে।
আবার রাণী উচ্চারণ করলো-পানি-পানি
একজন অপরজনকে বললো–যাও আলী হোসেন, এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো।
লোকটা ঠাট্টা করে বললো–ঠান্ডা না গরম?
অন্য একটি কণ্ঠ-আধা ঠান্ডা আধা গরম
রাণী গলার স্বর কোমল করে ব্যথাকাতর কণ্ঠে বললো–তোমরা কারা ভাই। উঃ! পিপাসা, বড় পিপাসা বোধ করছি। এক গ্লাস পানি দাও।
একজন বললো–অপেক্ষা করো, একটু পর পানি পাবে।
সত্যিই একটু পর একজন এক গ্লাস পানি নিয়ে তার শয্যার পাশে এগিয়ে এলো।
রাণী উঠে বসার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না।
একজন তাকে বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেই রাণী বললো–আমি একাই বসতে পারবো। আমার হাতের বাঁধনটা খুলে দাওনা।
অন্য একজন বললো–খবরদার, ও কাজ করো না। মালিকের নিষেধ আছে। কোনোক্রমে ওর হাতের বাধন খুলে দেওয়া চলবে না।
প্রথম ব্যক্তি বললো–এই গুপ্ত গুহা থেকে পালাবে, কি যে বলো। তা ছাড়া আমরা এতগুলো লোক রয়েছিদাও খুলে দাও ওর হাতের বাঁধন। দেখছো না কেমন কষ্ট হচ্ছে ওর।
অন্য লোকটা বললো–দরদ দেখানো ভাল নয়। বহু কষ্ট করে তবেই না ওকে আটক করতে সক্ষম হয়েছি। তোমরা ওকে তুলে বসিয়ে দাও।
দু’জন ধরে বসিয়ে দিলো রাণীকে।
রাণীর শরীরে প্যান্ট এবং শার্ট পরা ছিলো। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। গলায় একটি রুমাল তিন ভাঁজ করে বাঁধা। হাত দু’খানা পেছন দিকে রশি দিয়ে বাঁধা। রাণী বললো–পানি দাও, খাবো।
খাবে, এই নাও। একজন পানির গ্লাস এগিয়ে ধরলো।
রাণী মুখ না বাড়িয়ে বললো–তোমরা আমার হাত খুলে দাও, আমি নিজের হাতে পানি পান করবো। বড় কষ্ট হচ্ছে, দাওনা খুলে?
প্রথম ব্যক্তি বললো–অস্ত্র প্রস্তুত রেখে ওর হাত দু’খানা খুলে দিতে পারো।
একজন তার কথায় সায় দিয়ে বললো–হা, তা ঠিক, ওর হাতের বাঁধন খুলে দেওয়াই সমীচীন। এমন দুর্গম স্থান হতে পালানোর সাধ্য নেই কারও। তাছাড়া আমরা রয়েছি…
কিছুক্ষণ ওদের মধ্যে চললো তর্কবিতর্ক।
তারপর রাণীর হাতের বাঁধন খুলে দেওয়াই সাব্যস্ত হলো।
পাশে যে দাঁড়িয়ে ছিলো সে তার পকেট হতে রিভলভার বের করে উদ্যত করে ধরলো। অন্য যারা ছিলো তারাও প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
রাণী কাতর গলায় বললো–বড় পানি পিপাসা, আমায় পানি দাও….পানি দাও….
একজন একটি ছুরি নিয়ে তার হাতের বাঁধন মুক্ত করে দিলো। এবার পানির গ্লাসটা সে তুলে দিলো রাণীর হাতে।
রাণী পানি পান করার জন্য গ্লাসটা হাতে নিলো এবং কেউ কিছু অনুধাবন করবার আগেই হঠাৎ গ্লাসের পানি ছুঁড়ে দিলো ওদের চোখেমুখে, তার পরক্ষণেই পাশে দাঁড়ানো লোকটিকে বললো–একদন্ড বিলম্ব করোনা আহাদকথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই অপর এক ব্যক্তির হাত থেকে উদ্যত রিভলভারখানা রাণী কেড়ে নিলো।
আহাদ চৌধুরী ড্রাইভারের বেশে প্রবেশ করেছিলেন। তিনিই রাণীর হাতের বাঁধন মুক্ত করে দেওয়ার জন্য শক্রদলের লোকজনদের উৎসাহী করেছিলেন। তার কথায় ওরা রাণীকে মুক্ত না করে পারেনি। আহাদ চৌধুরীই রিভলভার উদ্যত করে ধরেছিলেন রাণীর দিকে। এবার আহাদ চৌধুরী তার রিভলভারের মুখ ঘুরিয়ে দেন শত্রুপক্ষের লোকদের দিকে।
রাণীও অপর একজনের হাত থেকে আগ্নেয় অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। শুরু হলো ভীষণ লড়াই, গুলী বিনিময় চললো দুদিক থেকে।
কিছু সময়েই পরাজয় বরণ করলো শত্রুপক্ষ।
দু’জন প্রাণ হারানোর পর শত্রুপক্ষ হাওয়ায় মিশে গেলো যেন।
রাণী বললো–সেই মহান ব্যক্তিটি আশেপাশেই কোনো গোপন স্থানে আছে। আহাদ, চলো তাকে খুঁজে বের করি।
কিন্তু তোমার শরীর বড় দুর্বল, এখন চলল পরে দেখা যাবে।
রাণী খিল খিল করে হেসে উঠলো-তোমার রাণী এত সহজে দুর্বল হবার মেয়ে নয়। তারপর কঠিন কণ্ঠে বললো–আহাদ, তোমাকে ধন্যবাদ তবে পৌঁছতে বড় বিলম্ব করেছ। বহুক্ষণ পূর্বে আমি সংজ্ঞা ফিরে পেয়েছি কিন্তু সুযোগের অভাবে সংজ্ঞাহারার মত পড়েছিলাম
রাণী, চলো শত্রু এসে পড়লে…
কথা শেষ হয় না আহাদ চৌধুরীর। একটি জমকালো মুখোশ পরা তোক উদ্যত রিভলভার হাতে তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। চাপাকণ্ঠে বললো–এসে পড়বে নয়, এসে পড়েছি। কেন বাছা তোমরা আরাকানে এসেছিলে? জানো এখানে শুধু আমি অহেতুক তোমরা আমাকে আমার বিশ্বস্ত বন্ধু মিঃ বিশ্বাসকে হত্যা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছো। তোমরা আমার বন্দীশালায় বন্দী, এক পা নড়তে পারবে না। .
মিঃ আহাদ আর রাণী তাকিয়ে দেখলো তাদের চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছে কয়েকজন অস্ত্রধারী বলিষ্ঠ লোক। তাদের প্রত্যেকের মুখে এক ধরনের মুখোস। শুধু চোখ এবং কান দুটি নজরে পড়ছে। শরীরেও অসাধারণ ড্রেস।
রাণী আর আহাদ চৌধুরী তাকালো উভয়ে উভয়ের মুখের দিকে। বাধ্য হলো রাণী আর আহাদ চৌধুরী তাদের হস্তস্থিত অস্ত্র ফেলে দিতে।
রাণীর কাছে ঐ কণ্ঠস্বর পরিচিত লাগলো। কিছুক্ষণ পূর্বে রাণী যখন সংজ্ঞালাভ করেছিলো তখন সে ঐ কণ্ঠ শুনতে পেরেছিলো। তবে কি ঐ মুখোসের নিচে কোনো পরিচিত মুখ রয়েছে, কিন্তু কে সে?
ততক্ষণে তাদের হাত দু’খানা বেঁধে ফেলার জন্য এগিয়ে এলো দু’জন লোক।
রাণী ঐ মুহূর্তে তার বুট দিয়ে ভীষণ জোরে একজনের তলপেটে পদাঘাত করলো, সঙ্গে সঙ্গে লোকটা দু’হাতে পেট চেপে ধরে উবু হয়ে পড়ে গেলো।
পরক্ষণেই অপরজনের গায়ে আঘাত করলো রাণী।
আহাদ চৌধুরীও সেই মুহূর্তে অপর একজনের হাত থেকে আগ্নেয় অস্ত্রটি কেড়ে নিলেন। শুরু হলো আবার তুমুল লড়াই।
এলোপাতাড়ি যুদ্ধ চলছে, গুলী বিনিময় হচ্ছে।
আহাদ এবং রাণী নিজেদের বাঁচিয়ে যুদ্ধ করে চললো।
কক্ষের কাঁচের আলমারী এবং মূল্যবান সামগ্রী ভেঙে খান খান হতে লাগলো। আহাদ চৌধুরী প্রখ্যাত ডিটেকটিভ আর রাণী দস্যুরাণী-ওদের সঙ্গে পেরে ওঠা কম কথা নয়।
স্বনামধন্য ব্যক্তি দাঁড়িয়ে লক্ষ করছে, তার হাতে রিভলভার। সুযোগমত গুলী ছুঁড়বে সে, তাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিলো এবং অধর দংশন করছিলো। মুখোশের অন্তরালে মুখখানা তার প্রতিহিংসায় ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলো।
আহাদ এবং রাণীকে লক্ষ্য করে পরপর দুটি গুলী ছুড়লো লোকটা। একটি গুলী এসে বিদ্ধ হলো তার দলের একজনের পাঁজরে।
আর্তচিৎকার করে লুটিয়ে পড়লো লোকটা।
অপর একজন তাকে তুলে ধরতে গেলো, সেই মুহূর্তে রাণী সুতীক্ষ্ণধার ছোরাটা বসিয়ে দিলো তার পিঠে। ছোরাখানা পড়েছিলো একপাশে, তাই রাণী সেটা তুলে নিয়ে তার সদ্ব্যবহার করলো।
মিঃ আহাদ পেছন থেকে অপর আর একজনকে চেপে ধরলেন।
রাণী তার চোয়ালে একটা প্রচন্ড ঘুষি বসিয়ে দিলো। ঠিক ঐ মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করলেন আরাকান পুলিশ সুপার, তার সঙ্গে বনহুর স্বয়ং এবং কয়েকজন অস্ত্রধারী পুলিশ। সবাই ঘিরে ফেললো স্বনামধন্য ব্যক্তি ও তার দলবলকে।
আহাদ চৌধুরী আর রাণীর দু’চোখে বিস্ময়।
কারণ তারা ভাবতেও পারেনি বনহুরকে এ মুহূর্তে এমন অবস্থায় পাবে এবং সে একা নয়, তার সঙ্গে রয়েছে আরাকান পুলিশ সুপার এবং পুলিশবাহিনী। সবাই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। একচুল কেউ নড়তে সাহসী হলো না।
বনহুর বললো–মিঃ হারবার্ড, আপনি এদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেবার নির্দেশ দিন। আমি ওনার পাশে রয়েছি…….বনহুরের হাতে রিভলভার ছিলো। সে রিভলভার উদ্যত করে স্বনামধন্য ব্যক্তির পাশে এসে দাঁড়ালো।
রিভলভার তার পাঁজরে চেপে ধরলো।
সবার হাতে হাতকড়া পরানো হলো। প্রত্যেকের মুখে অদ্ভুত ধরনের মুখোস।
বনহুর বললো মিঃ হারবার্ড, আপনি ওদের মুখের মুখোস খুলে ফেলুন। স্বনামধন্য ব্যক্তির দলবল সবাই আজ একত্র হয়েছিলো মিসেস ক্যাথোলিনকে দেখার জন্য। আমরা এ ব্যাপারে সৌভাগ্যবান, কারণ আরাকান সরকারের মহৎ উদ্দেশ্যকে যে মহাশক্তি ধ্বংস করার চেষ্টা চালাচ্ছিলো তাদের মূল শিকড় আমরা উপড়ে ফেলতে সক্ষম হবো।
মিঃ হারবার্ড স্বয়ং এক এক জনের মুখোশ টেনে খুলে ফেলছেন এবং বিস্ময়ে হতবাক হচ্ছেন, এরা যে সবাই প্রায় তার পরিচিত। এরা আরাকানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। বনহুর এবার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মুখাবরণ উন্মোচন করলো।
সঙ্গে সঙ্গে কক্ষের সকলে আরষ্ট হয়ে গেলো। এ যে তাদের মহান নেতা জনাব রহমতুল্লাহ আল-কোরেশী যিনি আরাকান মন্ত্রণালয়ে গুরুদায়িত্বে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। যার আগমনে পুলিশ-বাহিনী হন্তদন্ত হয়ে থাকেন সদাসর্বদা। আরাকান সরকারের বিরাট দায়িত্ব যার ওপর ন্যস্ত রয়েছে, এমন ব্যক্তি আরাকান সরকারের মূল্যবান উদ্দেশ্যকে নস্যাৎ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আরাকানের সম্পদ তিনি পাচার করে যাচ্ছেন বিভিন্ন রাষ্ট্রে। উঃ! কি ভয়ংকর ষড়যন্ত্র। মুহূর্তে সবার মুখে কে যেন একরাশ কালিমা লেপন করে দেয়।
বনহুর অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
অবাক হয়ে তাকালেন মিঃ হারবার্ড, তিনি কোনোদিন এমন করে কাউকে হাসতে দেখেননি। শুধু পুলিশ সুপার নয়, পুলিশবাহিনী এবং অন্য সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বনহুরের দিকে।
বনহুর বললো–এইতো দুনিয়া; সাধুতার মুখোশ পরে নেতার আসনে বসে দেশ ও দেশের জনগণের সর্বনাশ সাধন করে চলেছে এই একশ্রেণীর মানুষ যাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না, প্রতিবাদ করলে তাকে হয় পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা চলে, নয় কারাকক্ষে নিক্ষেপ করা হয়। অন্ধকারে ধুকে ধুকে মরে সেই সব ব্যক্তি যারা স্বনামধন্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কথা বলে।
মিঃ হারবার্ড বললেন-আমরা কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি এমন ব্যক্তিগণ এমন কাজ করতে পারেন।
কতবড় হৃদয়হীন আর ভয়ংকর এরা-তা কল্পনাতীত, এরা গদিতে বসার পূর্বে নানা ধরনের মধুর বচন উচ্চারণ করে জনগণের মনে রেখাপাত করেন। এমন সাধু আর হয় না, তারপর যখন গদিলাভ করেন তখন তারা নরপশুর চেয়েও হিংস্র হয়ে পড়েন। আরও কথা আছে বলছি..এখানে যাদের মুখের আবরণ খুলে নেওয়া হয়েছে তাদের মুখে আরও একটি আবরণ আছে, আমি তা উন্মোচন করছি। কথাটা বলে বনহুর পাশে নতমুখে দন্ডায়মান এক ব্যক্তির মুখের দাড়ি একটানে খুলে ফেললো।
একি, এ যে বলহরি সিং। এও তাহলে এই দলে? বললেন পুলিশ সুপার মিঃ হারবার্ড।
বনহুর বললো–মিঃ বার্ড, স্বনামধন্য ব্যক্তি জনাব রহমতুল্লাহ আল কোরেশী শুধু বলহরি সিং এবং মিঃ বিশ্বাসের দলকেই হাত করেননি, তিনি এদের মত মহাপুরুষদেরকেও হাত করেছেন। এরা সবাই নেতৃস্থানীয় পদে সমাসীন রয়েছেন। বনহুর নতমুখে দন্ডায়মান। ব্যক্তিদের দিকে দেখিয়ে কথাটা বললো।
হারবার্ডের একজন সঙ্গী বললেন-দু’দিন পূর্বে এক অনুষ্ঠানে এদের মধ্যে কেউ কেউ উপস্থিত ছিলেন। তারা যে বক্তব্য রেখেছিলেন জনসাধারণের জন্য তা সত্যি প্রশংসনীয় ছিলো। আরাকান পত্রিকায় তাদের ছবিসহ বক্তব্যগুলো প্রকাশ পেয়েছিলো।
হ্যাঁ, সেই সাধুতার মুখোপরা শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিগণই এরা। যারা জনগণের রক্ত শুষে নিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে চলেছে, অথচ তারাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে গলাবাজি করে নিষ্ঠা আর সতোর বুলি আওড়ায়। আরাকান সরকার জনসাধারণের সমস্যা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবছেন এ কথা সত্য কিন্তু সরকারের একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। দেশের জনসাধারণের সহযোগিতার দরকার একান্তভাবে কাম্য। একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী এবং এক ধরনের নেতৃবৃন্দ রয়েছেন যাদের কুচক্রে দেশ আজ অধঃপতনে যাচ্ছে। তার প্রমাণ এই মহান নেতাগণ যারা আজ মুখোসের অন্তরালে আত্মগোপন করে থাকে। কথাগুলো বললো বনহুর। একটু থেমে বললো আবার সে-লর্ড মার্গারেট হোটেলের বৃহত্তর আয় বিনষ্ট করার চেষ্টা বেশ কিছুদিন হলো চলছিলো কিন্তু সার্থক হতে না পারায় চক্রান্তকারী দল আরাকানের শ্রেষ্ঠ নায়িকা লীলা নাগকে হত্যা করলো। উদ্দেশ্য লীলা নাগের কণ্ঠের হীরক হার হরণ করা নয়, উদ্দেশ্য দেশ ও দেশের আয় কমিয়ে দেশকে নিঃস্ব করা। তার মূলে রয়েছে এসব স্বনামধন্য নেতার মিল-কারখানায় আয় বাড়ানো। একশ্রেণীর মুনাফাঁকারী চায় না বেকার সমস্যার সমাধান হোক। তবে তাদের ইন্ডাষ্ট্রিগুলো শ্রমিকবিহীন হয়ে পড়বে, সরকার যদি বেকার জনগণকে সঠিক পথের সন্ধান দেন তাহলে ধনকুবের যারা অসহায় মানুষকে স্বল্পবেতনে অমানুষিক পরিশ্রম করিয়ে নিচ্ছে সেই স্বার্থের মূলে কুঠারাঘাত পড়বে। এরা চায় না দেশের মানুষ শিক্ষিত হোক, এরা চায় না দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হোক। এরা চায় দেশের মানুষ যেন চিরদিন তাদের গোলামি করে, সব সময় হাত জুড়ে স্যার স্যার বলে। নিষ্পেষিত নির্যাতিত হয়ে যেন স্বনামধন্য ব্যক্তিদের পা মাথায় তুলে রাখে। এই নরপশুর দল দেশ আর দেশের জনগণকে নিঃশেষ করে ছাড়ছে…মিঃ বার্ড, রহমতুল্লাহ আল কোরেশী এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাছাধন ভদ্রবেশি শয়তান। এর উপযুক্ত শাস্তি মৃত্যুদন্ড নয়, জীবন্ত চামড়া ছাড়িয়ে লবণ মাখিয়ে রৌদ্রে ঝুলিয়ে রাখা।
আহাদ চৌধুরী বনহুরের ক্রুদ্ধভাব লক্ষ করে কিছুটা বিচলিত হলেন।
এমন কি রাণীও।
উভয়ে প্রসঙ্গ অন্যদিকে মোড় ফেরানোর চেষ্টা করলো।
বললো রাণী-বিচারে এবার জনাব কোরেশী অনুধাবন করবেন। মিঃ বার্ড, আপনি এদের ভ্যানে উঠিয়ে নেবার নির্দেশ দিন। অন্য যাদেরকে আটক করা হয়েছে তাদের একজনও যেন পালাতে সক্ষম না হয়। এর পূর্বে বলহরি সিং অতি সহজে সবার চোখে ধূলো দিয়ে অন্তর্ধান হয়েছিলো, এবার যেন সে সুযোগ না পায়।
মিঃ আহাদ বললেন-আমার মনে হয় আরাকান ষড়যন্ত্র এবার সমূলে বিনষ্ট হলো।
মিঃ বার্ডের নির্দেশে স্বনামধন্য উচ্চপদস্থ নেতৃস্থানীয় এবং বরেণ্য জনাব রহমতুল্লাহ আল কোরেশী ও তার সহকারিগণকে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় পুলিশ ভ্যানে তুলে নেওয়া হলো।
আরাকান সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য যারা নস্যাৎ করার চেষ্টা চালিয়ে সফলকাম হবার পথে অগ্রসর হচ্ছিলো তারা সম্পূর্ণ বিফলকাম হলো।
বনহুর, রাণী ও আহাদ চৌধুরী আরাকান পুলিশপ্রধান এবং পুলিশবাহিনীর সহায়তায় আরাকান ষড়যন্ত্রের মূল শিকড় উৎপাটন করে ফেলতে সক্ষম হলো।
বিচারে প্রকাশ্য খোলা স্থানেই এই নরপশুদের ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হলো। আরাকানবাসীর মনে অভূতপূর্ব আনন্দ। কারণ তারা চায় দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা।
সরকার ঘোষণা করলেন যারা স্বনামধন্য মহান ব্যক্তি জনাব রহমতুল্লাহ আল কোরেশী ও বলহরি সিংয়ের মত মনোভাব নিয়ে দুর্নীতি, অনাচার, অনিয়ম এবং অসৎ কাজকর্মে নিয়োজিত থাকবে, তাদেরকে প্রকাশ্য রাজপথে ফাঁসি অথবা গুলী করে হত্যা করা হবে।
পথের মোড়ে মোড়ে এবং জনবহুল স্থানে স্থানে কথাগুলো বড় বড় অক্ষরে লিখে রাখা হলো। সবাই যেন এ কথাগুলো হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে পারে।
এ ঘোষণা জারি হবার পর আরাকান দুর্নীতিমুক্ত হলো। কদিন পর আরও একটি দলকে খুঁজে বের করা হলো, তাদেরকেও আরাকান সরকার প্রকাশ্য রাজপথে গুলী করে হত্যা করলেন। সরকারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রইলো এ ব্যাপারে। এরপর দুর্নীতি, অনাচার, অসৎ ব্যবসা এবং কাজকর্ম বন্ধ হলো। আরাকানে ফিরে এলো অনাবিল শান্তি।
*
কিন্তু লীলা নাগের হীরক হার যা পুলিশ মহলের তহবিলে জমা ছিলো তা আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ হার গেলো কোথায়। লীলা নাগকে যে ব্যক্তি হত্যা করেছিলো তার কবল থেকে বনহুরের সহযোগিতায় হীরকহারটি উদ্ধার করা সম্ভবপর হয়েছিলো। ঐ হার জমা ছিলো আরাকান সরকারের তহবিলে।
হঠাৎ একদিন প্রকাশ পেলো লীলা নাগের হীরক হার আরাকান সরকারের আয়রন সেলফ থেকে উধাও হয়েছে। এ হার কে নিলো আর কেমন করেই বা নিলো? হারটি যে স্থানে রাখা হয়েছিলো সে স্থানে আয়রন সেলফে তেমনি বন্ধু আছে বা ছিলো কিন্তু ভিতরে সেই হার নেই।
সারা পুলিশ মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হলো।
সংবাদপত্রে বড় বড় অক্ষরে ছাপা হলো : লীলা নাগের কণ্ঠের হীরক হার ভৌতিক উপায়ে উধাও হয়েছে। এ হারের মূল্য কয়েক কোটি টাকা। আরাকান সরকার ভীষণ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লো। গোয়েন্দা পুলিশ ছড়িয়ে পড়লো-লীলা নাগের হত্যা রহস্যের সঙ্গে এই মালা উধাওয়ের ব্যাপারে সংযোগ আছে কিনা এ নিয়ে চললো গবেষণা।
তল্লাশি চললো সন্দেহযুক্ত স্থানে। কে বা কারা লীলা নাগের সেই হীরক হার হরণ করেছে।
লীলা নাগের মৃত্যুর পর আরাকানে তার ভক্তকুলের মধ্যে নেমে এসেছিলো ভীষণ শোকের ছায়া। অনেকেই খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে পাগলের মত হন্যে হয়ে ঘুরাফেরা করছিলো। স্বনামধন্য ব্যক্তিগণের মধ্যে যেমন লীলা নাগ প্রিয় ছিলো, তেমনি শ্রমিক মজুরদের মধ্যেও অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্রী ছিলো সে, কারণ শুধু অভিনয়ে লীলা নাগ পারদর্শী ছিলো না, সে সবার হৃদয় জয় করেছিলো। গরিব অসহায় মানুষদের লীলা নাগ ভালবাসতে এবং তাদের মধ্যে দুহাত ভরে অর্থ দান করতো। আর সেজন্যই লীলা নাগ সবার প্রিয় ছিলো।
শ্রমিকনেতা রাজ ভালবাসতো লীলা নাগকে। হোটেল মার্গারেট-এর একটি ক্যাবিনে সেও অবস্থান করতো, প্রতিদিনের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে সে একটিবার তার সঙ্গে দেখা করতে। ক্ষণিকের সাক্ষালাভ তাকে সমস্ত দিন সজীব করে রাখতো। নতুন উদ্যমে কাজ করতো।
যেদিন লীলা নাগ নিহত হলো সেদিন রাজ কোথায় হারিয়ে গেলো আর তার দেখা কেউ পেলো না।
লীলা নাগের কণ্ঠের হীরক হার নিয়ে আরাকান পুলিশমহল ভীষণভাবে সন্ধান করে ফিরছে বনহুর এ কথা শুনলো, শ্রমিকনেতা রাজকে সেদিনের পর থেকে আর তাকে কেউ দেখতে পায়নি তাও জানলো সে।
সেদিন পুলিশ সুপার হারবার্ড ও আরও কয়েকজন পুলিশ প্রধানের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিলো বনহুর ও আহাদ চৌধুরীর। রাণীও ছিলো সেই আসরে। শ্রমিকনেতা রাজ সম্বন্ধে যখন আলাপ আলোচনা হচ্ছিলো তখন রাণী একটি ফটো বের করে মেলে ধরে বললো–মিঃ হারবার্ড, এই সেই রাজা যার সম্বন্ধে আলাপ হচ্ছে।
সবাই আগ্রহভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো রাণীর হাতের ফটোখানার দিকে। মিঃ হারবার্ড ফটোটা হাতে নিয়ে বললেন-একে আমি দেখেছি। শ্রমিকনেতা রাজদীপ্ত দুটি চোখ, মুখমন্ডল হাস্যোজ্জ্বল, বলিষ্ঠ চেহারা।
মিঃ হারবার্ড ফটোখানা এবার মিঃ আহাদের হাতে দিয়ে বললেন-শহরে একে অনেকেই চেনে। ব্যক্তি হিসেবে সৎ বলা যায়।
মিঃ আহাদ ফটোখানা ভালভাবে লক্ষ করে বললেন-রাণী, এ ছবি তুমি কোথায় পেলে?
রাণী বললো–লীলা নাগের ক্যাবিনে।
সবাই অবাক হলো।
একবার তাকালো সকলে রাণীর মুখের দিকে।
বললো রাণী-লীলা নাগ নিহত হবার পর যখন তার ক্যাবিন তল্লাশি করা হচ্ছিলো তখন সবার অগোচরে তার বালিশের নিচ হতে আমি এ ফটো উদ্ধার করি।
বনহুর একটা শব্দ করলো-হুঁ!।
তরুণ গোয়েন্দা যিনি সম্প্রতি বিদেশ থেকে এসেছেন লীলা নাগ হত্যারহস্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারে আরাকান সরকারকে সহায়তা করার জন্য, তিনি নিশ্চুপ সব শুনছিলেন, এবার তিনি ফটোখানা হাতে নিয়ে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন, কোনো কথা উচ্চারণ করলেন না।
পুলিশ সুপার মিঃ হারবার্ড বললেন-রাজকে আমরা সম্মান করতাম কারণ তার মধ্যে একটা প্রতিভা ছিলো, তার কথায় আরাকান শ্রমিকগণ সব কাজে এগিয়ে আসতো এবং যা বলতো তাই তারা করতো। বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বপূর্ণ তরুণ রাজ।
ঠিক সেই মুহূর্তে পথে শোনা গেলো হই হুল্লোড়।
একটি পাগল গাড়িচাপা পড়েছে।
একটু পরে দু’জন পুলিশ একটি পাগলকে ধরে নিয়ে এলো।
সবাই অবাক হয়ে তাকালেন, পাগলটির কপাল বেয়ে রক্ত ঝরছে, কে এই পাগল?
হঠাৎ বলে উঠলেন মিঃ হারবার্ডের সহচর মিঃ গিয়াস-স্যার এই পাগল সাধারণ পাগল নয়। কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি কারণ একে প্রথম প্রথম দেখা গেছে বড় বড় হোটেল এবং সিনেমা হলে। দু’হাতে টাকা বিলিয়ে দিয়েছে গরিব-দুঃখীর মধ্যে। পথের ধারে বসে খাবার ছড়িয়ে দিতে দেখা গেছে কুকুরগুলোর মুখে। এখন সে নিঃস্ব, ওর কিছু নেই, এমন কি খাবার জোটে না, কোনো ভিখারীর থালা থেকে খাবার কেড়ে খায়, অদ্ভুত পাগল…
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো বনহুর এবং অন্য সবাই পাগলটির মুখের দিকে। সমস্ত মুখে দাড়ি-গোঁফ, চুলগুলো কিছু লম্বাটে, কপালে, কাঁধে ছড়িয়ে আছে। তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে চুলের ভেতর থেকে। চোখ দুটো ঘোলাটে অসহায়।
মিঃ হারবার্ড টেবিলে রক্ষিত ফটোখানা হাতে তুলে নিয়ে ভালভাবে দেখলেন, তারপর সহকারীকে বললেন-যেভাবে ওর মাথা থেকে রক্তপাত হচ্ছে তাড়াতাড়ি হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।
পাগল মাতালের মত দুলছিলো, দু’জন পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
রাণী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পাগলটিকে লক্ষ করছিলো, ওকে নিয়ে পুলিশ বেরিয়ে যাবার পর রাণী বললো–আশ্চর্য বটে, পাগলটি এ্যাকসিডেন্ট করলো একেবারে পুলিশ অফিসের সম্মুখে। এবং তাকে হসৃপিটালে না নিয়ে পুলিশ অফিসে নিয়ে আসা হলো, ব্যাপার কেমন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছে।
বললো রাণী–হা রহস্যময় বটে।
মিঃ হারবার্ড বললেন-যাকে নিয়ে আমরা আলাপ আলোচনা করছিলাম একটু পূর্বে এ সেই ব্যক্তি শ্রমিকনেতা রাজ। দেখলেন তো চোখ দুটো ঠিক ঐ ছবির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।
তরুণ গোয়েন্দা মিঃ বশির র্যাফেল এবার কথা বললেন-শ্রমিকনেতা মিঃ রাজ আপনাদের মনে একটা সন্দেহ সৃষ্টি করেছে এবং সেই কারণেই একটি পাগলকেও আপনারা সেই রাজ বলে মনে করছেন। আসলে কি সত্যিই ঐ পাগল রাজ?
সম্ভবতঃ রাজই হবে। মিস লীলা নাগকে সে ভালবাসতো তার প্রমাণ তার ঐ ছবি যা লীলা নাগের বালিশের তলা থেকে পাওয়া গেছে। কথাগুলো বললেন পুলিশ অফিসার মিঃ গিয়াস।
মিঃ র্যাফেল বললেন-রাজ যদি ঐ পাগল হয় তাহলে তার মাথার চুল ও দাড়িগোঁফ তাকে অস্বীকার করবে। কারণ লীলা নাগের মৃত্যু পর্যন্ত সে স্বাভাবিক ছিলো এবং সে হোটেল মার্গারেটের একটি ক্যাবিনে অবস্থান করছিলো। তাছাড়া তার চুল ও দাড়ি-গোঁফ প্রমাণ করছে সে শ্রমিকনেতা রাজ নয়। কারণ লীলা নাগের শোকে সে কাতর হয়ে দাড়ি-গোঁফ চুল কাটার মত সম্বিৎ হারিয়ে যদি ফেলে থাকে তাহলে তার দাড়ি-গোঁফ এ সামান্য ক’দিনে এমন হতে পারে না। কাজেই আপনাদের ধারণা সত্য নাও হতে পারে।
মিঃ আহাদ বললেন-হা মিঃ র্যাফেল যা বলেছেন সত্য। কারণ পাগলটিই যে মিঃ রাজ তা ঠিক নয়। তবুও ওর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত।
এতক্ষণ বনহুর শুনছিলো, মিঃ র্যাফেলের দিকে তাকিয়ে বললো–আশা করি আপনার সতর্ক দৃষ্টি মিস লীলা নাগের হীরক হার হরণকারীকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হবে।
মিঃ র্যাফেল উঠে হ্যান্ডশেক করলো বনহুরের সাথে, তারপর সবার কাছে তখনকার মত বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
মিঃ হারবার্ড বললেন-তরুণ গোয়েন্দা র্যাফেল অত্যন্ত বুদ্ধিমান। নিশ্চয়ই সে মিস লীলা নাগের হত্যারহস্য এবং তার কণ্ঠের হীরক হার উদ্ধারে সক্ষম হবে।
রাণী একটু হেসে বললো–মিঃ র্যাফেল সুদীর্ঘ সময় গোয়েন্দা বিভাগে কাজ না করলেও তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটো প্রমাণ করে সে ভবিষ্যতে একজন দক্ষ ডিটেকটিভ হবে। তার প্রখ্যাত ডিটেকটিভ হবার আলামত তার দাড়ি-গোঁফ কালো চশমায় ঢাকা দুটি চোখ।
একটু হাসলো বনহুর।
আহাদ চৌধুরী উঠে দাঁড়ালেন-রাত অনেক হলো, এবার ফেরা যাক। মিঃ হারবার্ডও উঠে দাঁড়ালেন এবং সবাইকে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। তিনি বললেন-লীলা নাগ হত্যারহস্য উদঘাটন করবোই।
মিঃ বার্ড কিন্তু উঠলেন না বাসায় যেতে। হঠাৎ বনহুর মিঃ বার্ডের চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেলো, কিন্তু কেউ তা লক্ষ করলো না।
ঠিক সেই মুহূর্তে একটি ছায়ামূর্তি সরে গেলে পুলিশ অফিসের পেছন জানালার পাশ থেকে।
মিঃ আহাদ, রাণী এবং বনহুর তাদের নিজ নিজ গাড়ির দিকে এগুলেন।
পুলিশ সুপার তার অফিস রুমের সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন।
একজন পুলিশ অফিসার বললেন-স্যার, বাংলোয় ফিরতে বিলম্ব হবে কি?
হ্যাঁ, আপনারা যান।
স্যার, আপনি যাবেন না?
কিছুক্ষণ পর যাবো।
সবাই বিদায় গ্রহণ করলেন।
মিঃ হারবার্ড সবাইকে বিদায় দেবার পর পাহারাদারকে ডেকে বললেন-বয়কে বলল এখানে আমার খানা দিতে।
স্যার, বাসায় মেম সাহেব অপেক্ষা করবেন।
তাকে আমি টেলিফোনে সব জানিয়ে দেবো। যাও তুমি যা বললাম তাই করো।
পাহারাদার সেলুট করে বেরিয়ে গেলো।
মিঃ হারবার্ড চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিলেন ভাল করে। তারপর একটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলেন।
কিছুক্ষণ সিগারেট পান করে উঠে দাঁড়ালেন। তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ, কারণ পুলিশ হেফাজতে থেকে কি করে সেই মহামূল্যবান হীরক হার খোয়া গেলো। আরাকান কর্মকর্তা তাকে টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছেন, লীলা নাগের হীরক হার উদ্ধার না পেলে মিঃ হারবার্ডের চাকরিই শুধু যাবে না তাকে শাস্তি গ্রহণ করতে হবে। কত বড় লজ্জার কথা, মিঃ হারবার্ড কাউকে এ ব্যাপার জানাননি। লিখিত নির্দেশ এলে অবশ্যই পুলিশ মহলের সবাই জানাজানি হয়ে যেতো। এ কথা টেলিফোনে জানিয়ে আরাকান সরকারি মহল ভালই করেছেন। নইলে বৃদ্ধ বয়সে মিঃ বার্ড চরম অপমান বোধ করতেন। লৌহসিন্ধুকে প্রহরী পরিবেষ্টিত অবস্থায় এ হীরক হার রক্ষিত ছিলো। সেই হার কি করে উধাও হলো কেউ জানে না। সেই কক্ষের প্রহরী এবং যারা চার্জে ছিলেন তাদের সবাইকে সাসপেন্ড করে হাজতে রাখা হয়েছে। সবাইকে জেরা করা হচ্ছে নানাভাবে। পুলিশ মহলে এ ব্যাপারে ভীষণ তোলপাড় শুরু হয়েছে। তল্লাশি চলছে যেখানে সেখানে নানাভাবে।
বিদেশী ডিটেকটিভ মিঃ রশিদ র্যাফেল ছাড়াও আরও অনেক ডিটেকটিভ এসেছেন, তারা বহু উপায়ে এ হারের সন্ধান চালাচ্ছেন।
মিঃ হারবার্ডের আহার-নিদ্রা দূর হয়েছে। তিনি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এবং সংসার ভুলে গেছেন। মান-সম্মান রক্ষা পায় কিনা শেষ মুহূর্তে তাই তিনি ভাবছেন।
তিনি পায়চারী করছেন আর একটির পর একটি সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছেন। বাসা থেকে কয়েকবার ফোন এলো, বড় মেয়ে ফোন করেছে, আব্বা, তুমি না এলে আমরা খানা খাবো না। ব্যথায় টনটন করে উঠলো মিঃ হারবার্ডের মন, ওরা যদি জানতো তার মনের অবস্থা তাহলে এমন করে বলতে পারতো না। এরপর স্ত্রীর টেলিফোন এলো, তবুও তিনি নিশ্চুপ, শুধু বললেন-তোমরা বুঝবে না আমি কি অবস্থায় আছি। তোমরা খেয়ে নাও। ফোন রেখে দিলেন।
এমন সময় বয় খাবার নিয়ে এলো।
বললো–স্যার, আপনার খাবার।
অন্যমনস্কভাবে ভাবছিলেন মিঃ হারবার্ড, তিনি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললেন-টেবিলে রেখে
বয় টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখে বেরিয়ে গেলো।
*
রাণী!
বলো?
হোটেল মার্গারেট ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। সত্যি দ্বিতীয় আরাকানে এসে আমার অনেক কিছু নতুন জানবার এবং দেখার সৌভাগ্য হলো।
স্বামীর মুখে দৃষ্টি রেখে মৃদু হাসলো রাণী-দ্বিতীয় আরাকান-বাঃ! বেশ সুন্দর করে নতুন এক নামে ভূষিত করলে মাসুমা রিজভীর দেশটাকে।
মিথ্যা কথা নয় রাণী, এখানে আমার বেশ ভাল লাগছে। সত্যি, আরাকান সরকারকে প্রশংসা করতে হয়। আরাকান সরকার যেভাবে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন তা প্রশংসনীয়। সবচেয়ে লক্ষণীয় এখন বেকার সমস্যা প্রতিটি দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আরাকান সরকার তাই সেই বড় সমস্যা নিয়ে ভাবছেন।
অবশ্যই তোমার কথা সত্য আহাদ। প্রতিটি দেশের সরকার যদি বেকার সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেন তাহলে কিন্তু এই ভয়ংকর অভিশাপ থেকে দেশ ও দেশের জনগণকে মুক্ত করা যায়। দেশে যত অনাসৃষ্টি, চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি খুন-খারাবি এবং অন্যান্য যে সব অপকর্ম ঘটছে সবকিছুর মূলে বেকার সমস্যা। বিশেষ করে যুবসমাজ যখন সঠিকপথে চলার মত পথ পাচ্ছে না তখন তারা এ সব অপকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এদের যদি সঠিক পথে পরিচালিত করা যেতো, এরা যদি বেকার সমস্যায় না ভুগতো তাহলে দেশে এমন অরাজকতা সৃষ্টি হতো না। কাজেই দেশ ও দেশবাসীকে রক্ষা করতে হলে দরকার বেকার সমস্যার সমাধান।
মিঃ আহাদ চৌধুরী রাণীর মুখের দিকে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি ভাবছিলেন রাণী যা বলছে তা অতি সত্য, কারণ দেশের সরকার যদি সঠিক নেতৃত্ব দেন এবং জনগণ যদি তাতে সহযোগিতা করে তাহলে করুণাময়ের দয়ায় কোন সমস্যাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় না।
বললো রাণী–কি ভাবছো আহাদ?
তুমি যা বললে তা অতি সত্য কিন্তু একশ্রেণীর স্বার্থান্ধ মানুষ আছে যারা সরকার বা তোমার আমার মত দেশের সমস্যা নিয়ে ভাবছে তাদের সুন্দর চিন্তা ধারাকে নসাৎ করে দিচ্ছে। ঠিকভাবে সরকার এবং মহৎ ব্যক্তিদের সুন্দর উদ্দেশ্যগুলোকে সফল হতে দিচ্ছে না। এরা সৃষ্টি করছে নানা ধরনের সংকট সমস্যা, দূনীতি অন্যায় অনাচার, চোরা কারবার; অসৎ ব্যবসা ইত্যাদি
হ্যাঁ, তুমি যা বলছে তা বনহুরও বলেছে এবং আমি নিজেও জানি। আর সে কারণেই সরকারকে হতে হবে কঠিন, যখন যেখানে যে কোন দুর্নীতি ধরা পড়বে তখন তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে জনগণকে দেখাতে হবে, কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না, যত বড় স্বনামধন্য মান্যগণ্য ব্যক্তিই হোক না কেন। জ্যান্ত মাটিতে অর্ধেক পুঁতে তার মাথায় পাথর ছুঁড়ে আঘাতের পর আঘাত করে মারতে হবে। এত লোভ লালসা কোনো, ঐশ্বর্যের পাহাড়ে বসেও কি তাদের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় না
এমন সময় ফোন বেজে উঠলো।
রাণী রিসিভার তুলে নিলো হাতে; হ্যালো স্পিকিং মিসেস ক্যাথোলিন-কি বললেন মিঃ হারবার্ড নিহত-তার অফিসের কক্ষে-আসছি-হা আহাদ চৌধুরীসহ এক্ষুণি আসছি-রাণীর কথা শেষ হয় না, ওপাশে রিসিভার রাখার শব্দ হলো।
মিঃ আহাদ বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন কি-বললে রাণী? পুলিশ সুপার মিঃ হারবার্ড নিহত….
হ্যাঁ, তারই অফিসকক্ষে তিনি নিহত হয়েছেন। এক্ষুণি যিনি ফোন করলেন তিনি তরুণ গোয়েন্দা মিঃ রশিদ র্যাফেল। নাও শয্যা ত্যাগ করো, নতুন আর একটি রহস্য সৃষ্টি হলো।
মিঃ আহাদ এবং রাণীর মুখমন্ডলে একটা গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো। তারা ভাবতেও পারেনি ভোরে এমন একটা সংবাদ তারা শুনবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাবিন ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন আহাদ চৌধুরী এবং রাণী। দ্রুত বনহুরের ক্যাবিনে প্রবেশ করে দেখলো, সেও তৈরি হচ্ছে।
আহাদ এবং রাণীকে দেখে বললো বনহুর–আমি তৈরি চলুন, যাওয়া যাক।
রাণী বললো–সংবাদটা তাহলে
হ্যাঁ, আমার কাছেও র্যাফেল টেলিফোন করেছিলো। তরুণ ডিটেকটিভ হলেও বেশ অভিজ্ঞ-বুদ্ধি আছে বটে।
মিঃ আহাদ এবং রাণীসহ বেরিয়ে এলো বনহুর হোটেল মার্গারেটের বাইরে।
এবার একই গাড়িতে তারা আরাকান পুলিশ অফিসের দিকে রওয়ানা দিলেন।
গাড়িতে বসে তেমন কোনো কথা হলো না তবে মিঃ আহাদ একবার বললেন-মিঃ বার্ড নিহত হবেন তা আমি জানতাম। তবে গতরাতটাই যে তার জীবনে শেষ রাত তা জানতাম না।
বনহুর জবাব দিলো-মিঃ হারবার্ড নিজেও জানতেন এ কথা। আরও জানতেন যে কোনো মুহূর্তে তার জীবন বিপন্ন হতে পারে।
রাণী হেসে বললো–আমরাও জানি মৃত্যু আমাদের জন্য অবধারিত তবে কোন মুহূর্তে আমরা পরপারে যাত্রা করবো, এটা জানি না।
হ্যাঁ, এ কথা সত্য কিন্তু এমন কোনো মুহূর্ত আমাদের সম্মুখে এসে উপস্থিত হয় যখন আমরা বেশ উপলব্ধি করি আমাদের পরিস্থিতি সম্বন্ধে মিঃ আহাদ চৌধুরীর কথা শেষ হয় না, গাড়িখানা প্রবেশ করে আরাকান পুলিশ অফিস প্রাঙ্গনে।
অফিসের বাইরে বেশ কিছু লোকের ভীড় দৃষ্টিগোচর হয়।
বেশ কিছু গাড়িও নজরে পড়লো।
গাড়ি রেখে নেমে পড়লো মিঃ আহাদ চৌধুরী, বনহুর এবং রাণী।
অফিসকক্ষের বারান্দায় বেশ কিছু পুলিশপ্রধান ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটাছুটি করছেন।
কয়েকজন সাংবাদিক এবং ক্যামেরাম্যানকেও দেখা যাচ্ছে।
অফিসকক্ষে প্রবেশ করলেন মিঃ আহাদ ও তার সঙ্গী বনহুর ও রাণী। প্রথমেই নজরে পড়লো টেবিলে মাথা নুয়ে বসে আছেন পুলিশ প্রধান মিঃ হারবার্ড। তার সামনে টেবিলের উপরে খাদ্য সামগ্রী। একটি গ্লাসে পরিষ্কার সচ্ছ পানি। কিছুটা পানি তিনি পান করেছিলেন মনে হলো।
খাদ্যসামগ্রীর থালা একটু দূরে সরানো, তাতে মনে হচ্ছে মিঃ হারবার্ড খাওয়া শেষ করেছিলেন। পাশে ছোট্ট একটি ম্যাচ বক্স এবং একটি চুরুটের কৌটা। ভাল করে লক্ষ করতেই দেখতে পেলো মিঃ হারবার্ডের আংগুলের ফাঁকে একটি অর্ধদগ্ধ চুরুট।
বনহুর মিঃ আহাদকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখন হন্তদন্ত হয়ে একজন পুলিশ অফিসার সেখানে প্রবেশ করে বললেন-সেই পাগলটি হসপিটাল থেকে রাতে সবার অজ্ঞাতে পালিয়েছে। তাকে রাতে পুলিশ অফিসের সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে।
সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো সেই পুলিশ অফিসারের দিকে।
তরুণ ডিটেকটিভ মিঃ র্যাফেল বললেন-একথা এখনও পুলিশ রিপোর্টে লেখা হয়নি
এমন সময় একজন পুলিশ এসে বললো–স্যার, পাগলটি আবার এসেছে। ভীড় ঠেলে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। তার হাতে মাথায় এখনও ব্যান্ডেজ বাধা রয়েছে।
বললেন, পুলিশ ইন্সপেক্টর মিঃ গিয়াস-তাকে আটক করে হাজতে রাখো, যাও সে যেন ফসকে যেতে না পারে।
বেরিয়ে গেলো পুলিশটি।
মিঃ আহাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বনহুর বললো–খানা খাবার পর মিঃ হারবার্ডের মৃত্যু ঘটেছে এবং এই যে তার হাতের মুঠায় যে চুরুট দেখছেন তার দ্বারাই তার মৃত্যু হয়েছে।
কথাটা বলে বনহুর তুলে নিলো চুরুটটা হাতে এবং সে লক্ষ্য করে বললো–এই দেখুন আসলে এটা চুরুট নয়, এর ভেতরে ছিলো ক্ষুদে বুলেট। মুখে আগুন ধরানোর সঙ্গে সঙ্গে এটা তার কণ্ঠনালী ভেদ করে বেরিয়ে গেছে।
অন্যান্য পুলিশ অফিসার এবং পুলিশ কর্মকর্তা যারা ছিলেন তারা এবং আহাদ ও রাণী দেখলো মিঃ হারবার্ডের মাথার নিচের অংশে ঘাড় ভেদ করে একটা ছিদ্র, ক্ষতস্থানে কিছু রক্ত জমে আছে।
ঘাড়টা কোটের কলার দিয়ে ঢাকা ছিলো, তাই এতক্ষণ তা কেউ লক্ষ্য করেনি। এবার সবাই বিস্ময় নিয়ে দেখলো মিঃ হারবার্ডকে অত্যন্ত কৌশলে হত্যা করা হয়েছে।
বিস্ময়কর এ হত্যা।
কিন্তু কে বা কারা তাকে চুরুটের মাধ্যমে এভাবে হত্যা করলো। গতরাতে মিঃ হারবার্ড কেনই বা বাংলোয় ফিরে না গিয়ে অফিসে এতরাত পর্যন্ত কাটালেন এবং অফিসেই খানা খাবার ব্যবস্থা করলেন। এর পেছনে কি উদ্দেশ্য ছিলো কেউ ভেবে পাচ্ছেন না।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বললেন-নিশ্চয় ঐ পাগল শ্রমিকনেতাই রাজ এবং সে-ই হত্যা করেছে মিঃ হারবার্ডকে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আসলে সে পাগল নয়, পাগলের বেশে এ কাজ সমাধা করেছে এবং আজ সে দেখার জন্য পুনরায় এসেছে নিজকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য….
মিঃ হারবার্ডকে পাগলবেশি রাজই যদি হত্যা করে থাকে তবে সে আজ আবার আসবে কেন? তাকে যখন কেউ সন্দেহই করছে না তবে কেনই বা সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চায় আর সে কারণেই সে পুনরায় এখানে মানে পুলিশ অফিসে আসবে কেন? যা হোক মিঃ হারবার্ডকে সুকৌশলে হত্যা করা হয়েছে এবং কে বা কারা তাকে হত্যা করলো তা অচিরেই প্রকাশ পাবে বলে আশা করি। কথাগুলো বললেন মিঃ আহাদ চৌধুরী।
বনহুর বললো–হা মিঃ আহাদ, আপনার চিন্তাধারা সত্য। মিঃ গিয়াস, আপনি পুলিশ অফিসকক্ষের বাইরে এবং ভেতরে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করুন। একটি ব্যক্তিও যেন অফিসকক্ষে প্রবেশ না করে এবং একটি প্রাণীও যেন এ কক্ষের বাইরে যেতে না পারে।
পুলিশ সার্জেন্ট মিঃ মোরিস এতক্ষণ সব লক্ষ করছিলেন, তিনি বললেন-ইয়েস স্যার, আমি সব লক্ষ করছি একটি প্রাণীও বাইরে যাবে না এবং ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।
বনহুর মিঃ হারবার্ডের মাথাটা তুলে ধরে ভালভাবে লক্ষ করে দেখলো, তারপর যেমন ছিলো তেমনি করে টেবিলে রেখে পাশের ড্রয়ার খুলে ফেললো এবং বের করলো একটি ছোট টেপরেকর্ড মেসিন।
সবাই অবাক হলো মিঃ হারবার্ডের চেয়ারের পাশেই যে ড্রয়ারটি তারই মধ্যে ছিলো টেপরেকর্ড মেসিন। বনহুর বললো–আপনারা সবাই অবাক হচ্ছেন এখানে এটা কে রাখলো এবং কখন রাখলো। হ্যাঁ, আমিই রেখেছিলাম, যখন মিঃ হারবার্ড বাংলোয় যেতে চাইলেন না তখন আমি সকলের অলক্ষ্যে ক্ষুদে টেপরেকর্ড মেসিনটা ড্রয়ার খুলে রেখে দেই।
সবার চোখেমুখে বিস্ময়। পুলিশ সুপার হারবার্ডের নিহত হবার কারণ এবার বেরিয়ে পড়বে। কক্ষে একটা থম থমে ভাব বিরাজ করছে।
এগিয়ে এলো তরুণ গোয়েন্দা মিঃ র্যাফেল; বললো মিঃ হারবার্ডের নিহত হবার কারণ দেখছিনা। তবুও তিনি নিহত হলেন
হা মিঃ র্যাফেল একেই বলে অদৃষ্টের পরিহাস। বললো বনহুর। তার হাতখানা ক্ষুদে টেপকের্ড মেসিনটার উপরে রক্ষিত।
ক্ষুদে টেপরেকর্ড মেসিনটি তার কাজ সমাধা করে আপনা আপনি অফ হয়ে গিয়েছিলো। বনহুর তাকালো কক্ষে তারপর দৃষ্টি ফেললো ভাগ্যাহত মিঃ হারবার্ডের প্রাণহীন দেহটার দিকে। মুখমন্ডল গম্ভীর এবং কঠিন হয়ে উঠেছে বনহুরের বললো–মিঃ মোরিস, মিঃ গিয়াস এবং পুলিশ কর্মকর্তাগণ যারা এ কক্ষে রয়েছেন আপনারা একটু পরেই মিঃ হারবার্ডের হত্যাকারী এবং মিস লীলা নাগের হীরক হার হরণকারীর খোঁজ পাবেন। তিনি এ কক্ষেই রয়েছেন এবং আপনাদের মধ্যেই বিদ্যমান আছেন।
বনহুরের কথায় সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো, এমনকি মিঃ মোরিস নিজের দেহটার দিকে একবার ভাল করে তাকিয়ে দেখে নিলেন।
রাণী এবং আহাদ স্থিরদৃষ্টি মেলে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে।
এবার বনহুর টেপরেকর্ডারটির সুইচ টিপে অন করে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে জুতোর শব্দ, কেউ যেন পায়চারী করছে, তারপর চেয়ার টেনে নেয়ার শব্দ, বসলো কেউ, বেশ কিছুক্ষণ নীরব, শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ। আবার চেয়ার সরানোর শব্দ, সঙ্গে সঙ্গে ভারী জুতোর পায়চারীর শব্দ, এবার একটি কণ্ঠস্বর, স্যার খানা এনেছি, এটা বয়ের গলা সবাই বুঝতে পারলো, এসো, ভেতরে এসো, এ গলা মিঃ হারবার্ডের চেয়ার টেনে বসার শব্দ, মিঃ হারবার্ড বোধ হয় বসলেন। টেবিলে খান সাজিয়ে রাখার শব্দ হচ্ছে, খানা সাজিয়ে রাখছে বয়টা মনে হচ্ছে। হারবার্ডের গলা-তুমি যেতে পারো। বয়ের গলা-স্যার, কোনো দরকার হলে আমি পাশেই বারান্দায় আছি…হারবার্ডের গলা, আচ্ছা দরকার হলে ডাকবো..প্লেট এবং কাঁটা চামচের শব্দহারবার্ডের জীবনের শেষ খাওয়া এটা। কান পেতে সবাই শুনছে, কারও মুখে কোনো কথা নেই। শুধু কাঁটা চামচের শব্দ হচ্ছে, তারপর আপন মনে কিছু বললেন মিঃ হারবার্ড, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। খাওয়া শেষ হলো, কাঁটা চামচ-থালার উপরে রাখলেন কিন্তু বয়কে তিনি ডাকলেন না। কিছুক্ষণ নীরব, একটু কাশির শব্দ। এমন সময় একটি কণ্ঠস্বর ….মিঃ বার্ড আসতে পারি? হারবার্ডের কণ্ঠ …. আসুন, এতরাতে আপনি..অপর কণ্ঠস্বর…আপনি বাংলোয় যাননি শুনলাম তাই এখানেই বুঝি..হারবার্ডের কণ্ঠ। হ্যাঁ বাংলোয় যাওয়া হয়নি এ কারণে অপর কণ্ঠ….ভালই হলো কিছু সময় আলাপ আলোচনা করা যাবে। চেয়ার টেনে বসার শব্দসিগারেট কেস আর ম্যাচ টেবিলে রাখার শব্দ। হারবার্ডের গলায়, এসব নিয়ে যাও…অপর কণ্ঠ….ও বিদেয় হয়েছে, আর আসবে না….নিন, সিগারেট পান করুন। শুনেছি আপনি বিদেশী চুরুট পান করতে ভালবাসেন…মিঃ হারবার্ডের খুশীভরা কণ্ঠ….আছে। আপনার কাছে…অপর কণ্ঠ-হ্যাঁ, আপনার জন্য একটি কৌটা নিয়ে এসেছি তুলে নিন একটি…বোধ হয় মিঃ হারবার্ড কৌটা থেকে একটি চুরুট তুলে নিলেন-ম্যাচ জ্বালানোর শব্দ…অপর ব্যক্তির কণ্ঠ….অগ্নিসংযোগ করবো….দিন হারবার্ডের গলা। একটা হাসির শব্দ…আপনি লীলা নাগের হীরক হার সম্বন্ধে সব জানেন? হ্যাঁ, জানি ঐ ব্যক্তিই নিয়েছে সেই শ্রমিকনেতা রাজঅপরিচিত কণ্ঠ…আপনার চুরুট মুখে রাখুন, দেখছেন না ধূম্রকুন্ডলি বেরিয়ে আসছে বোধ হয় হারবার্ড চুরুটটি ঠোঁটে চেপে ধরলেন আর সেই মুহূর্তে বিস্ময়কর একটি আওয়াজ হলো….তারপরই চেয়ার সরিয়ে কেউ উঠে দাঁড়ালো বলে মনে হলো, তারপর জুতোর শব্দ কেউ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আরও কিছুক্ষণ টেপ চালু ছিলো বলে ধারণা হচ্ছে।
বনহুর অফ করে দিলো টেপরেকর্ডার ক্ষুদে মেসিনটা।
তারপর ফিরে তাকিয়ে বললো–এই নতুন আগন্তুকের গলা আপনারা চিনতে পেরেছেন।
সবাই ফিরে তাকালেন মিঃ র্যাফেলের দিকে। তরুণ ডিটেকটিভ র্যাফেল, তার দু’পাশে দু’জন রিভলভার পাঁজরে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে-তারা দু’জন মিঃ আহাদ আর রাণী। টেপ চালু করার সঙ্গে সঙ্গে কক্ষ ত্যাগ করার চেষ্টা করছিলো সে। ঐ মুহূর্তে মিঃ আহাদ এবং রাণী তার দু’পাশে গিয়ে রিভলভার চেপে ধরে তার পাঁজরে।
এবার কক্ষে একটা গুঞ্জন ধ্বনি শোনা যায়। পুলিশ প্রধানগণ হতবাক স্তম্ভিত। তারা ভাবতেও পারেননি; তরুণ ডিটেকটিভ মিঃ রশিদ র্যাফেলই মিঃ হারবার্ডের হত্যাকারী।
বনহুর সুকৌশলে টেপরেকর্ড ক্ষুদে মেসিনটা ঠিকভাবে টেবিলের ড্রয়ারে রাখতে পেরেছিলো বলেই এ হত্যারহস্য এত সহজে উদঘাটন করা সম্ভব হলো।
মিঃ মোরিস বনহুরের হ্যান্ডশেক করলেন।
বনহুর বললো–এখনও সম্পূর্ণ রহস্য উদঘাটন হয়নি। আরও বিস্ময়কর রহস্য চাপা আছে। মিঃ র্যাফেল বিদেশী ডিটেকটিভ নয়। সে কোনোদিন ডিটেকটিভের কাজে নিয়োজিত ছিলো না। এটা তার ছদ্মবেশ, এবং তার পরিচয় আপনারা জানেন না-শ্রমিকনেতা রাজই মিঃ রশিদ র্যাফেল।
কক্ষে সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। সবাই অবাক বিস্ময়ে তাকাচ্ছে রাজের মুখের দিকে।
মিঃ আহাদ র্যাফেলের নকল দাঁড়ি আর গোঁফ খুলে নিলেন। রাণী সতর্কভাবে রিভলভার চেপে ধরে আছে তার পাঁজরে, একচুল যেন নড়তে না পারে। মুখখানা তার কঠিন আর হিংস্র হয়ে উঠেছে।
বনহুর বললো–রশিদ র্যাফেল মিস লীলা নাগকে ভালবাসতো ঐ হীরক হারের জন্য। লীলা নাগ নিহত হলো কিন্তু হীরক হার তার ভাগ্যে জুটলো না। সুদীর্ঘ সময় ধরে এই তরুণ লীলা নাগের হীরক হার হস্তগত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে চলেছে, বহু অর্থও সে ব্যয় করেছে এমন কি হোটেল মার্গারেটেও সে স্থায়ী আস্তানা গেড়ে নিয়েছিলো শুধু ঐ কারণে। লীলা নাগের সঙ্গে কয়েকবার সে সাক্ষাৎ লাভ করেছিলো এবং নিজ ফটোসহ শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়েছিলো মার্জিতভাবে। তার সুদর্শন চেহারা কিছুটা মুগ্ধ করেছিলো লীলা নাগকে, তাই সে দু’একদিন সাক্ষাৎ দানও করেছিলো অনুগ্রহ করে। লীলা নাগ নিহত হলো, হীরক হার চলে গেলো পুলিশ হেফাজতে। সমূলে সব আশা-আকাঙ্ক্ষা তার বিনষ্ট হলো।
কক্ষে টেবিলে মাথা রেখে পড়ে আছে মিঃ হারবার্ডের নিষ্প্রাণ দেহটা। টেবিলের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন আরাকান পুলিশ প্রধানগণ। বনহুর, মিঃ আহাদ এবং রাণী-এ ছাড়া আছে তরুণ ডিটেকটিভ মিঃ র্যাফেলবেশি শ্রমিকনেতা রাজ এবং আরও দু’তিন জন সরকারি ডিটেকটিভ। কক্ষে সবার চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। এমন আশ্চর্যজনক ঘটনা কোনোদিন তারা দেখেননি বা শোনেননি। আর রয়েছে বনহুর, এখানে সেও একজন ডিটেকটিভ হিসেবে পরিচিত এবং মিঃ রিজভীর উদ্ধারের ব্যাপারে তার সহযোগিতা পুলিশমহলকে উপকৃত করেছে। মিঃ রিজভীকে উদ্ধার করতে গিয়ে আরাকান সরকার বিরোধী কার্যকলাপে অন্যায় অনাচার চোরাচালানী অসৎ ব্যবসায়ীদের মূল শিকড় উৎপাটন করতে সক্ষম হয়েছে আরাকান প্রশাসন বিভাগ।
বনহুর বলে চলেছে। সবাই একান্ত মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
বনহুর বললো–শ্রমিকনেতা রাজ জানে ঐ হীরক হার কোথায়। আপনারা জানেন হীরক হার পুলিশ হেফাজত থেকে উধাও হয়েছে এবং পুলিশমহল এ হার নিয়ে ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত আছে ও খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আসলে এ মহামূল্যবান হার মিঃ হারবার্ডের কাছেই রয়েছে। আর এ কথা জানতো শ্রমিকনেতা রাজ এবং সে কারণেই রাজ হাজির হয়েছিলো সবার অলক্ষ্যে মিঃ হারবার্ডের অফিসে…একটু থেমে বললো বনহুর– আসলে রাজ জানত না এ হার কোথায় রেখেছেন মিঃ হারবার্ড। সে চুরুটের মাধ্যমে মিঃ হারবার্ডকে হত্যা করে সন্ধান চালিয়েছিলো অফিসের মধ্যে যে স্থানে হীরক হারটি পাবে বলে তার ধারণা ছিলো। সেই লৌহ আলমারী তছনছ করে খুঁজেছে কিন্তু হীরক হার পায়নি রাজ।
রাজের চোখেমুখেও রাশিকৃত বিস্ময় ফুটে উঠেছে। লোকটা এতসব জানলো কি করে। দু’পাশে দু’জন রিভলভারধারী এবং কক্ষে পুলিশ প্রহরী, তাদের হাতেও উদ্যত রাইফেল। পুলিশ প্রধানগণ অত্যন্ত সতর্ক রয়েছেন, তারাও তাদের পিস্তল প্রস্তুত রেখেছেন, হত্যাকারী যেন পালাতে না পারে। টেবিলে মৃত মিঃ হারবার্ড, সমস্ত পরিবেশটা নির্মম নৃশংস, করুণ। কারও মুখে কোনও কথা নেই। সকলে একান্ত মনোযোগর সঙ্গে শুনে যাচ্ছেন বনহুরের কথাগুলো।
মিঃ হারবার্ড লীলা নাগের হীরক হারটির রক্ষক হয়ে ভক্ষক হয়েছিলেন। শ্রমিকনেতা রাজ তা জানতে পেরেই এসেছিলো এবং তাকে হত্যা করেছিলো কিন্তু হার সে হস্তগত করতে পারেনি। সে জানে না ঐ হার কোথায় রেখেছিলেন মিঃ হারবার্ড তবে আমি জানি সে হার কোথায় আছে
মিঃ মোরিস বললেন-আপনি জানেন! জানেন কোথায় সেই মহামূল্যবান হীরক হারটি আছে?
হ্যাঁ, আমাদের সামনেই সেই হার রয়েছে।
আমাদের সামনে-বলেন কি?
বনহুর মিঃ হারবার্ডের টেবিলে রক্ষিত বৃহৎ আলপিনকুশটা হাতে উঠিয়ে নিলো এবং চাপ দিয়ে নিচের অংশ খুলে ফেললো। আলপিনকুশটার তলদেশ খোলা যায় তা কেউ ভাবতেও পারেনি। উপরের অংশে আলপিন গোঁজা আর নিচে ঠিক একটি কৌটার মত। সেই কৌটার মধ্যে রয়েছে মহামূল্য হীরক হারটি। বনহুর হীরক হারটি বের করে মেলে ধরলো সবার চোখের সামনে।
বিস্ময়ে সবাই স্তম্ভিত হতবাক, যে হারের জন্য এত ঘটনা ঘটলো আর সেই হীরক হার একটি পিনকুশের মধ্যে ছিলো। তার চেয়ে বিস্ময় যিনি এ হার সম্বন্ধে জোর তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিলেন সেই অধিনায়ক মিঃ হারবার্ডই হারের হরণকারী। এ গভীর রহস্য উদঘাটন করলেন অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি-সে ব্যক্তিটি কে তা কেউ জানে না।
[পরবর্তী বই পিরামিডের অভ্যন্তরে]