লীলাবতীর মৃত্যু
হুমায়ূন আহমেদ
একটি পুকুরের মধ্যস্থলে একটি জলপদ্ম ফুটিয়াছে। জলপদ্মটি পানির পৃষ্ঠদেশ হইতে এক ফুট উপরে। এমন সময় দমকা বাতাস আসিল, ফুলটি তিন ফুট দূরে সরিয়া জল স্পর্শ করিল। পুকুরের গভীরতা নির্ণয় করো। (লীলাবতী)
এ ধরনের প্রচুর অঙ্ক আমি আমার শৈশবে পাটিগণিতের বইয়ে দেখেছি। অঙ্কের শেষে ‘লীলাবতী’ নাম লেখা। ব্যাপারটা কী? লীলাবতী মেয়েটা কে? তার সঙ্গে জটিল এই সব অঙ্কের সম্পর্ক কী?
যা জানলাম, তা হচ্ছে_সপ্তম শতকের বিখ্যাত ভারতীয় গণিতজ্ঞ শংকরাচার্যের একমাত্র কন্যার নাম লীলাবতী। মেয়েটির কপালে বৈধব্যযোগ আছে, এই অজুহাতে কন্যা সম্প্রদানের আগে আগে বরপক্ষ মেয়েটির বিয়ে ভেঙে দেয়। লীলাবতী যখন গভীর দুঃখে কাঁদছিল তখন শংকরাচার্য বললেন, ‘মাগো, তোমার জন্যে কিছু করার সামর্থ্য আমার নেই। তবে পৃথিবীর মানুষ যেন বহু যুগ তোমাকে মনে রাখে, আমি সেই ব্যবস্থা করে যাব।’ তিনি গণিতের একটা বই লেখেন। বইটির নাম দেন কন্যার নামে_’লীলাবতী’।
গল্পটি আমাকে এতই অভিভূত করে যে এক রাতে লীলাবতীকে আমি স্বপ্নেও দেখি। গোলগাল মুখ। দীর্ঘ পল্লবের বড় বড় চোখ। দৃষ্টিতে অভিমান। মাথাভর্তি লম্বা কোঁকড়ানো চুল।
গায়ের বর্ণ শঙ্খের মতো সাদা।
খুব ইচ্ছা হলো স্বপ্নের মেয়েটিকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার। শংকরাচার্যের গণিতের বইয়ের নামের মতো উপন্যাসের নামও হবে ‘লীলাবতী’।
উপন্যাস শেষ পর্যন্ত লিখেছি। উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। কোনো লেখা ছাপা হয়ে বের হওয়ার পর লেখার বিষয়ে আমার কোনো উৎসাহ থাকে না। বইয়ের কাহিনী, পাত্র-পাত্রীদের নাম এবং অনেক সময় বইয়ের নাম পর্যন্ত ভুলে যাই। ‘লীলাবতী’র ক্ষেত্রে ভিন্ন ঘটনা ঘটল, নামটা ভুললাম না। প্রায়ই মনে হতো আমার তিনটা পরীর মতো মেয়ে, তাদের কারোর জন্যে এই সুন্দর নামটা মাথায় এলো না কেন?
আমি আমার তিন কন্যার নাম হেলাফেলা করে রেখেছি। ভেবেচিন্তে রাখা হয়নি। বড় মেয়েটির নাম নোভা। কার্ল সেগান আমেরিকার টিভিতে ‘কসমস’ নামে একটি অনুষ্ঠান করতেন। সেখানে নোভা, সুপারনোভা নিয়ে নানান কথা থাকত। নোভা নামটি এসেছে সেখান থেকে। শীলা নামটা নিয়েছি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প ‘শৈলজ শীলা’ থেকে। সবচেয়ে ছোট মেয়ে বিপাশার নাম তারাশংকরের ‘বিপাশা’ নামের উপন্যাস থেকে নেওয়া।
অন্য লেখকদের গল্প-উপন্যাস থেকে নাম নিয়েছি, অথচ নিজের কোনো উপন্যাস থেকে নাম নিলাম না, এটা কেমন কথা?
এই ভেবে সান্ত্বনা পেলাম যে লীলাবতী নাম রাখার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়নি। আমার মেয়েদের বিয়ে হবে। ছেলেমেয়ে হবে। তারা নিশ্চয়ই লেখক বাবার কাছে পুত্র-কন্যাদের নামের জন্যে আসবে, তখন একজনের নাম দিয়ে দেব লীলাবতী। ঘটনা সেভাবে ঘটল না। হঠাৎ করেই আমি আমার ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়লাম। কারণ আমি গায়িকা এবং অভিনেত্রী শাওনকে বিয়ে করে ফেলেছি।
কী প্রচণ্ড ঝড়ই না উঠল। পত্রপত্রিকায় কত না কুৎসিত লেখা। যার যা ইচ্ছা লিখছে। যেমন ইচ্ছা গল্প ফাঁদছে। আমার মা-ভাইবোনরা আমাকে ত্যাগ করল। আত্মীয়স্বজনরা ত্যাগ করল। একই ঘটনা ঘটল শাওনের ক্ষেত্রে। সেও বাড়ি থেকে বিতাড়িত। শাওনের বিবাহিত জীবন শুরু হলো চোখের জলে। এই বয়সের মেয়ের বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন থাকে। হৈচৈ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শাড়ি-গয়না, পারলারে সাজ। তার কপালে কিছুই নেই। সে একা একা পারলারে সাজতে গেল। একা একাই নিউ মার্কেটে ঘুরতে লাগল, বিয়ে উপলক্ষে এক জোড়া স্যান্ডেল কিনবে।
আমার ভাইবোনরা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। সমাজে প্রতিষ্ঠিতরা সমাজপতির ভূমিকায় অভিনয় করতে পছন্দ করেন। তারা সবাই সমাজপতি। শাওনকে বিয়ে করার আগে আমি দীর্ঘ চার বছর একা একা কাটিয়েছি। উত্তরায় একটি বাড়ি ভাড়া করে প্রায় এক বছর থেকেছি, পরে উঠে এসেছি ‘দখিন হাওয়া’য়। আমার একা থাকার ব্যবস্থাও সমাজপতিরা মিটিং করে করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ দুষ্ট মানুষ। সে পরিবারে থাকবে না। আলাদা থেকে সংশোধিত হবে। যখন হবে তখন ফিরতে পারবে সংসারে।
আলাদা বাস করছি। উত্তরার একটা বিশাল বাড়িতে একা থাকি। রাতে সব ক’টা বাতি জ্বালিয়ে রাখি। চেষ্টা করি রাতে না ঘুমাতে, কারণ ঘুমের মধ্যে আমাকে ‘বোবায়’ ধরে। এটা একধরনের রোগ। রোগের লক্ষণ_ঘুমের মধ্যে মনে হবে কেউ বুকের উপর বসে গলা চেপে ধরে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। ভয়ংকর কষ্টের ব্যাপার।
মানসিক এই অবস্থায় খবর পেলাম আমার ভাইবোনরা মাকে সঙ্গে নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনের ব্যবস্থা করছে। সেই সংবাদ সম্মেলনে আমার অনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করা হবে। মূল পরিবারের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক নেই, তা বলা হবে। এবং সাংবাদিকদের বলা হবে, আমার কোনো বিষয় নিয়ে যেন তাদেরকে এবং আমার ছেলেমেয়ে ও তাদের মাকে বিরক্ত বা বিব্রত না করা হয়।
খবরটা শুনে মনে কষ্ট পেলাম। ছুটে গেলাম মা’র কাছে। জানতে চাইলাম, এটা কি সত্যি? তিনি স্বীকার করলেন, সত্যি।
আপনি নিজে কি থাকবেন সংবাদ সম্মেলনে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ, থাকব।
আমি হতভম্ব হয়ে মা’র দিকে তাকিয়ে আছি।
সেদিন মাকে আমি কী কথা বলেছিলাম আজ আর তা মনে নেই। শুধু মনে আছে, মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলাম। মা শেষপর্যন্ত সংবাদ সম্মেলনটি তাঁর ছেলেমেয়েদের করতে দেননি। হয়তো পুত্রস্নেহের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
আমাদের বিয়ের তিন মাসের মাথায় শাওনের মা তাঁর কন্যাকে হয়তো বা ক্ষমা করলেন। তিনিও কন্যাস্নেহের কাছে পরাজিত হলেন। শাওন তাঁর অতি আদরের ধন। তাঁর কাছে সমস্ত পৃথিবী একদিকে আর শাওন আরেক দিকে। এই অন্ধ ভালোবাসার কারণ আমি জানি। তবে এই লেখায় সেই কারণ ব্যাখ্যার সুযোগ নেই। কন্যাকে ক্ষমা করার লক্ষণ হিসেবে তিনি তাঁর পুত্রবধূর হাতে শাওনের জন্যে এক সেট গয়না পাঠালেন। শাওন তার বিয়ের একমাত্র উপহার পেয়ে কেঁদেকেটে অস্থির। রাতে সে মায়ের দেওয়া প্রতিটি গয়না পরে বসে থাকল এবং কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলল। শাওনের বাবা কঠিন অবস্থানে গেলেন। তিনি বললেন, শাওন বিয়ে করে ফেলেছে ভালো কথা, তার যেন সন্তান না হয়। তাকে আমি অবশ্যই আবার বিয়ে দেব। ছেলেমেয়ে হলে বিয়ে দিতে সমস্যা হবে।
হায় রে কপাল! শাওন কনসিভ করে ফেলল। তার কী যে আনন্দ! সন্তানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সে সারা রাত পাগলের মতো আচরণ করল। এই কাঁদছে, এই হাসছে। আমি অবাক হয়ে তাকে দেখছি। একসময় সে আমাকে বলল, এই, আমার ছেলে হবে, না মেয়ে? আমি বললাম, তোমার মেয়ে হবে। মেয়ের নাম_লীলাবতী।
দিন কাটে, আমি অবাক হয়ে শাওনকে দেখি। সন্তান নিয়ে তার এত আনন্দ! এত অস্থিরতা! এত উত্তেজনা! প্রায় রাতেই কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে দেখি, সে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি অবাক হয়ে জানতে চাই, কাঁদছ কেন? সে বলে, আনন্দে কাঁদছি। একটি শিশু আমাকে মা ডাকবে, এই আনন্দ।
আমার আগের চারটি সন্তান আছে। তাদের মা’র মধ্যে মা হওয়ার আনন্দের এত তীব্রতা দেখিনি। কিংবা হয়তো ছিল, আমি লক্ষ করিনি। অভাব-অনটনে আমি তখন পর্যুদস্ত। গর্ভবতী মাকে ভালো খাবার খাওয়াতে হয়, ফলমূল খাওয়াতে হয়। আমার সেই সামর্থ্য নেই। আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির লেকচারার। অতি সামান্য বেতন। সব ভাইবোন নিয়ে একসঙ্গে থাকি। বাবর রোডে বাসা। ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরি হেঁটে। রিকশায় করে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। বাসে ঠেলাঠেলি করে উঠতে পারি না। বাসায় ফেরার পথে নিউ মার্কেট থেকে দুটো পেয়ারা কিনি। গর্ভবতী মায়ের ফল এই পেয়ারাতে সীমাবদ্ধ।
শীলার জন্ম আমেরিকায় হয়েছে। তখন তার মা’র খাওয়া খাদ্যের অভাব হয়নি। দেশে ফিরে আবার অভাবে পড়লাম। বিপাশা তখন মায়ের পেটে। তখনো একান্নবর্তী সংসার। বিপাশার জন্ম হলো সরকারি হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে খরচ কম বলেই এই ব্যবস্থা। আমি অস্থির, জীবনযাপনের চিন্তায়।
এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। জীবনধারণের অস্থিরতায় এখন আমি অস্থির নই। দীর্ঘপথ হাঁটতে হয় না। ফলমূল কেনার টাকা আছে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন আমার হাতে সময় আছে সন্তানসম্ভবা একটি মায়ের মানসিকতার পরিবর্তন আগ্রহ নিয়ে দেখার। আমি আগ্রহ নিয়ে দেখি। বড় মায়া লাগে।
একজন নর্তকী যখন মাথায় জলের ঘড়া নিয়ে নাচে তখন সে নাচের ভঙ্গিমায় হাত-পা নাড়লেও তার চেতনা থাকে জলের ঘড়ায় কেন্দ্রীভূত, যেন মাথার ঘড়াটা ঠিক থাকে। শাওন এ রকম হয়ে গেল। তার ভুবন হলো লীলাবতীময়। সেখানে অন্য কারো স্থান নেই।
লীলাবতীর জন্ম হবে গরমে। তখন সে মোটা কাপড় পরতে পারবে না। কাজেই ইংল্যান্ড এবং কানাডায় টেলিফোন করে করে সে পাতলা সুতির কাপড়ের ব্যবস্থা করল।
কার কাছে যেন শুনল ডায়াপার পরালে বাচ্চাদের র্যাশ হয়। কাজেই সে কাঁথা বানাতে বসল। সারা রাত জেগে নিজে কাঁথা বানায়। সেই সব কাঁথাও সহজ কাঁথা নয়। জসীমউদ্দীনের নকশিকাঁথা। পাখি, ফুল, লতাপাতার বিপুল সমারোহ।
এর মধ্যে ৪উ আলট্রাসনোগ্রাফি বলে এক যন্ত্র বাজারে চলে এসেছে। এই যন্ত্রে পেটের সন্তানের চেহারা স্পষ্ট দেখা যায়। সেই যন্ত্রে বাচ্চার চেহারা দেখার পর তার একটাই কথা_’আমার মেয়ে এত সুন্দর কেন?’ আহলাদি মায়ের এই প্রশ্নের আমি কী জবাব দেব?
ঘর ভর্তি হয়ে গেল ৪উ আলট্রাসনোগ্রাফিতে পাওয়া লীলাবতীর ছবিতে। শাওন অষ্টম মাসে পড়ল। আর মাত্র এক মাস। তার পরেই সে তার কন্যা কোলে নেবে।
আমি নুহাশপল্লীতে। নাটকের শুটিং করছি। শাওন তার মা’র কাছে গুলশানে। হঠাৎ শাওন টেলিফোন করল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাচ্চা নড়াচড়া করছে না। আমার খুব ভয় লাগছে।
আমি বললাম, এক্ষুনি ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করো।
যোগাযোগ করতে পারছি না। উনি টেলিফোন ধরছেন না। রাত দশটায় তিনি শুয়ে পড়েন। টেলিফোন রিসিভ করেন না। তুমি চিন্তা করবে না। আমার এক ভাই আছেন ডাক্তার। উনাকে খবর দেওয়া হয়েছে। উনি চলে আসছেন।
Murphys law বলে একটি Law আছে। এই Law বলে-ওভ a thing can go wrong, it will go wrong. ঘটনা সে রকম ঘটল। শাওনের ডাক্তার ভাই এলেন না। আমি যতবারই টেলিফোন করি, ততবারই শুনি_এই উনি আসছেন। তারপর শুনলাম, শাওনদের বাসায় গাড়ি আছে কিন্তু ড্রাইভার নেই।
গাজীপুর থেকে আমি ঢাকার দিকে রওনা হলাম। গাড়ি চলছে ঝড়ের মতো। মাজহার গাড়ি চালাচ্ছে। একই সঙ্গে টেলিফোনে শাওনের ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে।
শাওনের ডাক্তারের নাম…। আচ্ছা, নাম না-ই বললাম। জনসেবার মোড়কে তিনি যে ব্যবসা করছেন আমার লেখায় সেই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তা চাই না। ব্যবসা একটা মহৎ পেশা, স্বয়ং নবীজি (সা.) বলে গেছেন।
এই ডাক্তার একজন নামি ডাক্তার। রোগী দেখে কূল পান না। তখনো আমি জানি না এই ডাক্তারের নামে কয়েকটি মামলা আছে। তাঁর অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। রোগীর আত্মীয়স্বজনরা মামলা করেছেন।
এই মহান চিকিৎসকের ক্লিনিক একসময় টেলিফোন ধরল এবং জানালো_রোগীকে ক্লিনিকে নিয়ে আসুন।
আমি বললাম, ক্লিনিকে রোগী পাঠাতে পারি, তবে ডাক্তার সাহবে কি এসে তাকে দেখবেন?
উনি ভোরে আসবেন।
আমি অনুনয় করে বললাম, উনি কি আমার সঙ্গে পাঁচটি মিনিট কথা বলবেন? আমি বাংলাদেশের লেখক হুমায়ূন আহমেদ। উনি আমাকে চেনেন।
ক্লিনিক থেকে বলা হলো, উনি কথা বলবেন না।
আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। ডাক্তারি পেশা এই ডাক্তার নিজের ইচ্ছায় বেছে নিয়েছেন। আমরা তাঁকে হাতেপায়ে ধরে ডাক্তারি পড়াতে রাজি করাইনি। বরং হতদরিদ্র একটি দেশ তাঁর পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে তাঁকে ডাক্তার বানিয়েছে। এই পেশার দায়দায়িত্ব অবশ্যই তাঁকে নিতে হবে। একজন কেউ যখন সৈনিকের পেশা বেছে নেন, তখন যুদ্ধকালীন সময়ে জীবন দেওয়ার জন্যে তাঁকে তৈরি থাকতে হয়।
একজন ডাক্তারি পেশা বেছে নেবেন অথচ অতি দুঃসময়ে রোগীর কথা শুনবেন না, তার পাশে দাঁড়াবেন না, তা কী করে হয়?
ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে আমি শাওনকে বললাম, সে যেন এক্ষুনি অ্যাপোলো হাসপাতালে চলে যায়। এক মুহূর্তও যেন দেরি না করে।
আমি হাসপাতালে পৌঁছলাম রাত একটায়। ডাক্তার বললেন, আপনার বাচ্চাটা হাসপাতালে আসার আগেই মারা গেছে। আমরা এই দুঃসংবাদ আপনার স্ত্রীকে দিইনি। আপনি খবরটা দেবেন।
আমার হাত-পা জমে গেল।
শাওনকে একটা ঘরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। পাশে তার মা। আমাকে দেখেই শাওন ভরসা ফিরে পাওয়া গলায় বলল, এই, আমাদের বাচ্চাটার হার্ট বিট নাকি কম। তুমি দোয়া করো। তুমি দোয়া করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি তাকিয়ে আছি তার দিকে। এমন একটা ভয়ংকর খবর তাকে কিভাবে দেব? আমি তার হাত ধরলাম। সে বলল, জীবনের বিনিময়ে জীবন চাওয়া যায়। আমি আমার মায়ের জীবনের বিনিময়ে লীলাবতীর জীবন আল্লাহর কাছে চেয়েছি। আমার নিজের জীবনের বিনিময়ে চাইনি। আমি আমার বাচ্চাটাকে দেখব না? আর তোমার জীবনের বিনিময়েও চাইতে পারিনি।
শাওনের মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তোমার সন্তানের জীবনের বিনিময়ে আমি যেকোনো সময় আমার জীবন দিতে প্রস্তুত আছি গো মা।
এই মেয়েকে আমি কী বলব? কী বোঝাব?
দু’দিন দু’রাত মৃত বাচ্চা পেটে নিয়ে সে শুয়ে রইল। কী কষ্ট, কী কষ্ট। শারীরিক কষ্টের কাছে মানসিক কষ্ট গৌণ হয়ে দাঁড়াল। আমাকে জানানো হলো, তার জীবন সংশয়। তার কষ্ট আমার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। আমি তাকে ফেলে বাসায় চলে এলাম। আমার অতি দুঃসময়ে মা এসে পাশে দাঁড়ালেন, ছুটে গেলেন হাসপাতালে।
এক গভীর রাতে আমাকে জানানো হলো, শাওন মৃত সন্তান প্রসব করেছে।
হাসপাতালে তার ঘরে ঢুকলাম। হাসিখুশি ভাব দেখিয়ে বললাম, হ্যালো।
সেও ক্লান্ত গলায় বলল, হ্যালো।
খুব চেষ্টা করছি কোনো একটা রসিকতা করে তাকে হাসিয়ে দিতে। কিছুই মনে পড়ছে না। শেষপর্যন্ত হাসপাতাল নিয়ে একটা রসিকতা করলাম। সে হেসে ফেলল। সে হাসছে, একই সঙ্গে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। অদ্ভুত দৃশ্য।
ঘরের এক কোনায় সবুজ টাওয়েলে মুড়ে কী যেন রাখা। অনেকেই সেখানে যাচ্ছেন। ফিরে আসছেন। শাওনের দৃষ্টি ওই দিকে। সে হঠাৎ বলল, ওইখানে আমাদের লীলাবতী। যাও, দেখে এসো।
হাসপাতালের সবুজ টাওয়েলের ভেতর লীলাবতী শুয়ে আছে। মেয়েটি মৃত, আমার মনে রইল না। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম। কী সুন্দর! কী সুন্দর! পৃথিবীর সব রূপ নিয়ে সে রাজকন্যাদের মতো ঘুমিয়ে আছে।
আমার প্রথম পুত্রও হাসপাতালে মারা গিয়েছিল। সেও এসেছিল পৃথিবীর সব রূপ নিয়ে। পরিষ্কার মনে আছে, আমার মা সেই শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন এবং মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন_তোমরা সবাই দেখ, আমার কোলে পদ্মফুল ফুটে আছে।
লীলাবতীর কবরের ব্যবস্থা হলো বনানী গোরস্তানে। হঠাৎ মনে হলো, বিরাট ভুল হচ্ছে। লীলাবতীর কবর হবে আজিমপুর গোরস্তানে। সেখানে তার বড় ভাই আছে। বোন খেলবে ভাইয়ের হাত ধরে। পিতৃ-মাতৃস্নেহ বঞ্চিত এই দেবশিশু আর নিঃসঙ্গ বোধ করবে না।
আমি প্রায়ই আজিমপুর গোরস্তানে যাই। আমি আমার পুত্র-কন্যার জন্যে কোনো প্রার্থনা করি না। কেন প্রার্থনা করব? তারা তো ভুল করার বা অন্যায় করার কোনো সুযোগই পায়নি। তাদের প্রার্থনার প্রয়োজন নেই, আমি কবরস্থানে ঢুকেই বলি_এই, তোমরা কোথায়? তোমাদের মজা হচ্ছে তো? ভাই-বোন হাত ধরাধরি করে খুব খেলা হচ্ছে?
নিতান্তই ব্যক্তিগত কাহিনী লিখে ফেললাম। লেখকদের কাজই তো ব্যক্তিগত দুঃখবোধ ছড়িয়ে দেওয়া। এই লেখার মাধ্যমেই যাঁরা আমাদের প্রবল দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদেরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। শাওনের বাবা ও মাকে। কন্যার শোকে পাথর হয়ে যাওয়া জনক-জননীর করুণ ছবি এখনো চোখে ভাসছে। শাওনের মা হাসপাতালের মেঝেতে গড়াগড়ি করে কাঁদছিলেন। আহারে! আহারে!
অ্যাপোলো হাসপাতালের একজন নার্স লীলাবতীর দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছিল। অপরিচিত সেই নার্স মেয়েটিকেও ধন্যবাদ। তার চোখের জলের মূল্য দেওয়ার সাধ্য আমার নেই, থাকলে দিতাম।
রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যাই। তিনি লিখেছেন—
শিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা
শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, পীতগন্ধ-ভরা;
বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়,
আমি যতকাল থাকি তুমিও থাকিয়ো
আমাদের লীলাবতী পৃথিবীর সৌন্দর্য এক পলকের জন্যেও দেখতে পেল না,— এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি?