অষ্টম পরিচ্ছেদ
[ সৌভাগ্যক্রমে লেখক অকস্মাৎ এমন একটা কিছু পেলেন যার সাহায্যে তিনি কিছু বিপদ কাটিয়ে ব্লেফুসকু ত্যাগ করে স্বদেশে নিরাপদে ফিরতে পেরেছিলেন।]
ব্লেফুসকু দ্বীপে আমি তিন দিন এসেছি। একদিন ঘুরতে ঘুরতে দ্বীপের উত্তর-পুব দিকে গেছি। দূরে সমুদ্রের দিকে চেয়ে দেখছি। আধ লিগ আন্দাজ দূরে কী যেন একটা চোখে পড়ল, একটা নৌকো যেন উলটে গেছে। অমনি তখনি আমার জুতো মোজা খুলে ফেললাম তারপর জল ভেঙে সেই উলটানো নৌকোর দিকে এগিয়ে চললাম, এখানে সমুদ্র অগভীর। প্রায় দুই তিনশ গজ যাবার পর মনে হল জোয়ারের টানে বস্তুটা বুঝি আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আরো কাছে আসতে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম ওটা সত্যিই একটা নৌকো। ওটা বোধহয় ঝড়ে কোনো জাহাজ থেকে ছিটকে সমুদ্রে পড়ে গেছে।
তারপর ভাসতে ভাসতে এদিকে চলে এসেছে। আমি তখনি শহরে ফিরে এলাম এবং রাজাবাহাদুরকে বললাম তাঁর নৌবহর বাজেয়াপ্ত হবার পরও যে সব জাহাজ আছে তাদের মধ্যে উচ্চতম কুড়িটি জাহাজ এবং ভাইস এ্যাডমিরালের অধীন তিন হাজার নাবিক যদি আমাকে দেন তো আমার উপকার হয়। রাজাবাহাদুরের আদেশ পেয়ে পাল তুলে জাহাজগুলো ছেড়ে দিল। আমি হাঁটাপথে দ্বীপের উত্তর-পুব দিকে সেখানে গেলাম যেখানে নৌকোটি দেখা গিয়েছিল। জোয়ার তখন অনেক এগিয়ে এসেছে। নাবিকদের কাছে আছে দড়ি। আমি আগেই ওদের সুতোর মতো দড়ি পাকিয়ে মোটা করে নিয়েছিলাম । দড়িগুলো বেশ মজবুত হয়েছিল। এদিকে জাহাজগুলো কাছে এসে পড়েছে, আমি জামা-কাপড় খুলে জলে নেমে পড়ে নৌকোটার দিকে এগিয়ে চললাম কিন্তু নৌকো যখন আর একশ গজ দূরে তখন আমাকে সাঁতার কাটতে হল কারণ ইতোমধ্যে জল বেড়েছে। যখন নৌকো আমার হাতের নাগালে তখন নাবিকরা আমার দিকে দড়ি ছুড়ে দিল। নৌকোতে একটা গর্তে আমি সেই দড়ি বাঁধলাম। আর অপর প্রান্ত একটা মনোয়ারি জাহাজের সঙ্গে বাঁধলাম কিন্তু আমার পরিশ্রম কোনো কাজে লাগল না । আমার পা জমিতে থাকলে যে জোর পেতাম এখন তো সে জোর পাচ্ছি না অতএব আমি নাবিকদের পুরো সাহায্য করতে পারছি না। তবুও আমি ঘুরে নৌকোর অপর দিকে চলে গেলাম এবং এক হাত দিয়ে নৌকোটাকে ডাঙার দিকে ঠেলতে লাগলাম। জোয়ারের কিছু সাহায্য পাচ্ছিলাম। খানিকটা এগিয়ে আসা গেল, জল আমার দাড়ি পর্যন্ত কিন্তু পায়ের নিচে মাটি পাওয়া গেল। দু’তিন মিনিট দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম, দম ফুরিয়ে গিয়েছিল তারপর নৌকোটাকে আবার ঠেলা মারতে লাগলাম। ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে আসছি, জল এখন আমার বুক পর্যন্ত। এবার খুব খাটুনির কাজ আরম্ভ হল। জাহাজে যে দড়িগুলো রাখা ছিল সেগুলো বার করে নৌকার সঙ্গে বাঁধলাম আর অপর প্রান্ত বাঁধলাম ন’টা জাহাজের সঙ্গে। বাতাস এখন জাহাজগুলোর পালের অনুকূলে আর আমিও নৌকাটাকে ঠেলা মারছি। এই রকম করে ডাঙার চল্লিশ গজের মধ্যে এসে গেলাম। ভাঁটা আরম্ভ হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমারও বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল।
তারপর নৌকোতে আরো দড়ি বেঁধে, দুহাজার নাবিকও ইঞ্জিনের সাহায্যে নৌকাটাকে সোজা করা গেল। পরীক্ষা করে দেখলাম নৌকোটার বিশেষ ক্ষতি হয় নি। এবার দরকার দাঁড়ের। দাঁড় তৈরি করবার জন্যে দশদিন ধরে আমাকে যে পরিশ্রম করতে হয়েছিল তার বিবরণ জানিয়ে আমি পাঠকদের বিরক্তি উৎপাদন করতে চাই না।
দাঁড় তৈরি করে নৌকোটাকে আমি ব্লেফুসকুর রাজবন্দরে নিয়ে গেলাম। এই অদ্ভুত জলযানটি দেখবার জন্যে সেখানে তখন হাজার হাজার নরনারী জমায়েত হয়েছে। আমি রাজাবাহাদুরকে বললাম যে সৌভাগ্যক্রমে নৌকোটি আমার দৃষ্টিপথে এসে গেছে। আমি এখন এই নৌকো ভাসিয়ে এমন কোনো জায়গায় যেতে পারব যেখান থেকে আমি আমার স্বদেশে ফিরে যেতে সক্ষম হব। আমি রাজাবাহাদুরের কাছে সাহায্য-ভিক্ষা করলাম যাতে আমি নৌকোটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে পারি। কারণ সমুদ্র যাত্রায় অনেক কিছু প্রয়োজন হবে। এছাড়া দেশ ছাড়বার জন্যে রাজাবাহাদুরের অনুমতিও চাইলাম। তিনি অনেক বাহানা করার পর সম্মতি দিলেন।
কিন্তু আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, এতদিন তো আমি এই দ্বীপে এসেছি কিন্তু লিলিপুট দ্বীপের সম্রাট ব্লেফুসকু দ্বীপের রাজাবাহাদুরের কাছে আমার জন্যে তো একবারও খোঁজ করলেন না? আমার ধারণা ঠিক নয়। পরে অন্য সূত্র থেকে আমি জানতে পারলাম যে লিলিপুট দ্বীপের সম্রাটের ধারণা যে আমার প্রতি তাঁরা যে শাস্তি প্রয়োগ করতে যাচ্ছেন তা আমি না জেনে এবং সম্রাটের মৌখিক সম্মতির বলে শুধু আমন্ত্রণ রক্ষার জন্যে ব্লেফুসকু দ্বীপে গেছি অতএব কয়েকদিন পর সেখানে ফিরে গেলেই আমার প্রতি পূর্ব নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। কিন্তু আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে তিন উদ্বিগ্ন হলেন। তখন তাঁর কোষাধ্যক্ষ ও পরামর্শদাতাদের মত নিয়ে আমাকে অভিযুক্ত করে যে অভিযোগ পত্র রচিত হয়েছিল সেইটি সমেত একজন দূত ব্লেফুসকু দরবারে প্রেরিত হল । সেই দূতকে ব্লেফুসকুর রাজাবাহাদুরকে বলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে আমার কোনো অপরাধের জন্যে লিলিপুট সম্রাট আমাকে খুব লঘু শাস্তিই দিয়েছেন, শুধু আমার চোখদুটি উপড়ে ফেলা হবে। আমি বিচার এড়াবার জন্যে পালিয়ে গেছি এবং যদি দুঘণ্টার মধ্যে ফিরে না যাই তাহলে আমাকে দেওয়া ‘নারডাক’ উপাধি কেড়ে নেওয়া হবে এবং আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলে ঘোষণা করা হবে। সেই দূত আরো বলল যে দুই দ্বীপের মধ্যে শান্তি ও প্রীতি রক্ষার জন্যে তাঁর প্রভু মহামান্য সম্রাট আশা করেন যে, তাঁর ভ্রাতা ব্লেফুসকুর রাজাবাহাদুর আমার বেঁধে আমাকে ফেরত পাঠাবেন যাতে বিশ্বাসঘাতককে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া যায় ।
লিলিপুটের সম্রাটকে উত্তর দেবার জন্যে ব্লেফুসকুর রাজাবাহাদুর তাঁর আমাত্যদের সঙ্গে তিন দিন ধরে পরামর্শ করলেন এবং কিছু অজুহাতে দেখিয়ে অনেক বিনয় প্রকাশ করে উত্তর দিলেন । তিনি লিখলেন ভ্রাতা জানেন যে লোকটির হাত পা বাঁধা অসম্ভব এবং পাঠানও এক সমস্যা। যদিও এই লোকটি তাঁর নৌবহর আটক করে নিয়ে গিয়েছিল তথাপি দুই দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে সে বড় একটা অংশগ্রহণ করেছিল সেজন্যে তার কাছে আমি ঋণী। তবে আমরা উভয়েই তার হাত থেকে শীঘ্রই অব্যাহতি পাব কারণ আমার দ্বীপের অনতিদূরে সে এমন একটি জলযান পেয়েছে যার সাহায্যে সে শীঘ্রই এই দ্বীপ ত্যাগ করবে। আমি অবশ্য জলযানটি সাগর পাড়ি দেবার উপযোগী করতে সাহায্য করেছি। এমন একটি মানুষকে ভরণপোষণ করা আমাদের উভয়ের পক্ষে অসম্ভব। যাহোক আমরা অচিরেই হাত থেকে মুক্তি পাব।
এই উত্তর নিয়ে রাষ্ট্রদূত লিলিপুটে ফিরে গেল। ব্লেফুসকুর রাজাবাহাদুর আমাকে সব জানালেন এবং আমাকে অতি গোপনে বললেন যে যতদিন আমি তাঁর কাছে থাকব ততদিন তিনি আমায় আশ্রয় দেবেন ও রক্ষা করবেন। আমি যদিও তাঁর আন্তরিকতায় বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু রাজা ও মন্ত্রীদের উপর আমার আর বিশ্বাস নেই । আমি এখন ওঁদের এড়িয়ে চলতে চাই। অতএব আমি তাঁর প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললাম, আমাকে ক্ষমা করবেন স্বদেশে ফেরবার জন্যে আমি এখন ব্যাকুল। সৌভাগ্য বশত আমি যখন একটা জলযান পেয়েই গেছি তখন ভালোই হোক আর মন্দই হোক আমি ঐ জলযান আশ্রয় করে সমুদ্রে ভেসে পড়তে চাই। আপনাদের মতো দুটি শক্তিশালী দেশের মধ্যে আমি আর বিবাদের কারণ হয়ে থাকতে চাই না। আমার কথা শুনে রাজাবাহাদুর অসন্তুষ্ট হলেন না বরঞ্চ আমার প্রস্তাব শুনে তিনি ও তাঁর মন্ত্রীরা আনন্দিতই হলেন।
রাজাবাহাদুর ও তাঁর মন্ত্রীদের সমর্থন লাভ করে আমি আমার যাত্রার দিন আরো এগিয়ে আনলাম। আমি লক্ষ করলাম যে যাতে আমি তাড়াতাড়ি যাত্রা করতে পারি সেজন্যে সভাসদরাও উদ্যোগী হয়েছে। নৌকোর একটা পাল তৈরি করবার জন্যে পাঁচশত কর্মী নিযুক্ত হল। তারা আমার নির্দেশ অনুসারে কাজ করতে লাগল । দ্বীপে প্রাপ্ত সবচেয়ে মজবুত কাপড় সংগ্রহ করে এবং সেগুলো বার তের ভাজ করে কাজচলা গোচের দুটো পাল তৈরি করা গেল। পাল খাটাবার জন্যে মোটা দড়ি দরকার । দশটা, কুড়িটা এমন কি তিরিশটা পর্যন্ত দড়ি পাকিয়ে মোটা ও যতদূর সম্ভব লম্বা দড়ি তৈরি করলাম।
দ্বীপে অনেক খোঁজাখুঁজি করে বড় একটা পাথর সংগ্রহ করলাম যেটা আমার নোঙরের কাজ করবে। নৌকোতে লাগাবার জন্যে এবং অন্য কাজের জন্যে আমাকে তিনশটি গরুর চর্বি যোগাড় করে দেওয়া হল। মাণ্ডুল ও দাঁড় তৈরি করতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল। বড় বড় গাছ কেটে তাও তৈরি করা হল। রাজাবাহাদুরের ছুতোর মিস্ত্রিরা সেগুলো মসৃণ করে দিয়েছিল।
সব আয়োজন সম্পূর্ণ করতে প্রায় এক মাস সময় লাগল এবং বিদায় নেবার জন্যে আমি রাজাবাহাদুরের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলাম। রাজাবাহাদুর এবং রাজপরিবারের সকলে রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন। রাজাবাহাদুরের হস্ত চুম্বন করবার জন্যে আমি মাটিতে শুয়ে পড়লাম। অনুগ্রহ করে তিনি ও পরে মহারানি ও রাজকুমাররাও তাদের হাত বাড়িয়ে দিলেন। রাজাবাহাদুর আমাকে পঞ্চাশটি থলি উপহার দিলেন। প্রতি থলিতে ছিল দুইশতটি স্প্রাগ মুদ্রা। তিনি তাঁর একটি পূর্ণাবয়ব ছবিও দিলেন। এগুলো আমি সযত্নে আমার একটি দস্তানার মধ্যে ভরে রাখলাম। বিদায় অনুষ্ঠানের দীর্ঘ বিবরণী পাঠকদের পীড়িত করতে পারে এজন্যে আমি বিরত হলাম ।
নৌকোতে আমি একশটি বলদ ও তিনশ ভেড়ার মৃতদেহ বোঝাই করলাম এবং অনুরূপ পরিমাণে রুটি ও সুরা এবং চারশ বাবুর্চি যত মাংস রান্না করে দিতে পারল তত পরিমাণ মাংস । আমি সঙ্গে নিলাম ছটি জীবন্ত গরু ও দুটি ষাঁড় এবং অতগুলো মাদী ও পুরুষ ভেড়া। দেশে যদি ফিরতে পারি তো ওদের বাচ্চা উৎপাদন করাব। ওদের খাওয়াবার জন্যে অনেক বোঝা খড় ও দানা নিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল বারজন স্থানীয় নরনারী সঙ্গে নিতে কিন্তু তাঁদের অনিচ্ছা দেখে আমি বিরত হলাম তথাপি রাজাবাহাদুরের লোকেরা আমার পকেটগুলো একবার দেখে নিল, কৌতুক করেও আমি কাউকে তুলে নিয়েছি কিনা দেখবার জন্যে।
এইভাবে প্রস্তুত হয়ে ১৭০১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের চব্বিশ তারিখে সকাল ছটায় আমি পাল তুলে দিলাম। উত্তর দিকে চার লিগ যাবার পর উত্তর-পুব দিক থেকে প্রবাহিত বাতাসে আমার নৌকোর পাল ফুলে উঠল এবং সন্ধ্যা ছটা নাগাদ উত্তর-পশ্চিম দিকে আধ লিগ আন্দাজ দূরে একটা ছোটো দ্বীপ দেখতে পেলাম। দ্বীপের দিকে এগিয়ে গেলাম এবং বাতাসের বিপরীত দিকে গিয়ে নোঙর ফেললাম। দ্বীপে নেমে বুঝলাম ওখানে মনুষ্যবাস নেই। কিছু আহার করে বিশ্রাম করতে লাগলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।
বোধহয় ছঘণ্টা ঘুমিয়েছিলাম কারণ আমি জেগে ওঠার আর দুঘণ্টা পরে ভোর হল। রাত্রিটা বেশ পরিষ্কার ছিল। সূর্য উঠার আগেই আমি ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিলাম। লক্ষ করলাম বাতাস অনুকূল অতএব নোঙর তুলে নৌকো ছেড়ে দিলাম। আগের দিন যে দিকে যাচ্ছিলাম সেই দিকেই চললাম। সঙ্গে একটা পকেট কম্পাস ছিল, সেই ছোট্ট কম্পাস আমায় দিক ঠিক করতে সাহায্য করছিল। আমার উদ্দেশ্য ছিল যে সম্ভব হলে এমন একটা দ্বীপে পৌঁছনো যেটা ভ্যান ডিমেনস দ্বীপের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত । আমার ধারণা এমন একটা দ্বীপ ওদিকে আছে। কিন্তু সারা দিনেও কোনো দ্বীপ আবিষ্কার করতে পারলাম না। পরদিন বেলা তিনটে নাগাদ আমি হিসেব করে দেখলাম যে ব্লেফুসকু দ্বীপ থেকে চব্বিশ লিগ পর্যন্ত এসেছি আর ঠিক সেই সময়ে আমি দক্ষিণ-পুব দিকে জাহাজের পাল দেখতে পেলাম। আমি তখন যাচ্ছিলাম পুব দিকে। আমি সেই জাহাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না। নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে জাহাজের দিকে যেতে লাগলাম। তখন বাতাসের বেগ কমে আসছে। তবুও আমি নানাভাবে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলাম। আধঘণ্টা বাদে আমার চেষ্টা সফল হল। ওরা আমাকে দেখতে পেল এবং তা জানিয়ে দেবার জন্যে একটা পতাকা তুলল আর সেই সঙ্গে করল কামানের আওয়াজ। তখন যে আমার কী আনন্দ হল তা কী বলব। আমি আবার স্বদেশে ফিরে যেত পারব, আবার আমার চেনামুখগুলো দেখতে পাব। জাহাজ তার গতি কমাল। তারিখটা আমার মনে আছে, ২৬ সেপ্টেম্বর। জাহাজের কাছে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে, পাঁচটা বেজে গেছে কিন্তু ছটা বাজে । পতাকা দেখে যখন চিনতে পারলাম যে জাহাজটা ব্রিটিশ তখন আনন্দে আমার হৃদয় নেচে উঠল । গরু ও ভেড়াগুলো আমার পকেটে নিলাম এবং খাদ্যদ্রব্য সমেত সমস্ত মালপত্তর জাহাজে তুললাম। জাহাজখানা ব্রিটিশ মালবাহী জাহাজ, উত্তর এবং দক্ষিণ সমুদ্র দিয়ে জাপান থেকে আসছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন মিঃ জন বিডেল ডেপ্টফোর্ডের মানুষ, অতি সজ্জন ব্যক্তি এবং জাহাজ চালনায় দক্ষ। আমরা এখন দক্ষিণে ৩০ ডিগ্রি অক্ষাংশে রয়েছি। জাহাজে প্রায় পঞ্চাশ জন এবং আমার একজন পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে দেখাও হয়ে গেল, তার নাম পিটার উইলিয়মস। পিটার আমাকে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় আমার কিছু গুণগান করল। ক্যাপ্টেন আমার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে লাগলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন আমি কোথা থেকে আসছি এবং কোথায় যেতে চাই ।
আমি যখন সংক্ষেপে সবকিছু বললাম তখন তাঁরা ভাবলেন আমি বাজে কথা বলছি কিংবা সমুদ্রে বিপদে পড়ার ফলে আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি পকেট থেকে যখন জীবন্ত গরু ভেড়াগুলো একে একে বার করে টেবিলের ওপর রাখলাম তখন তো তারা অবাক । তারা বুঝল আমি ওদের ধোঁকা দিই নি। ব্লেফুসকুর রাজাবাহাদুর আমাকে যে স্বর্ণমুদ্রাগুলো দিয়েছিলেন সেগুলো এবং রাজাবাহাদুরের পূর্ণাবয়ব ছবিটি এবং ঐ দুই দ্বীপের কিছু অদ্ভুত জিনিস ক্যাপ্টেনকে দেখালাম। একশত স্প্রাগ ভর্তি দুটি থলি আমি ক্যাপ্টেনকে উপহার দিলাম এবং বললাম যে ইংল্যান্ডে পৌছলে আমি তাঁকে বাচ্চা সমেত একটি গরু ও একটি ভেড়া উপহার দেব।
আমি এই সমুদ্রযাত্রার বিবরণী দিয়ে পাঠকদের বিরক্তি উৎপাদন করতে চাই না তবে বাকি যাত্রাপথ বেশ নির্বিঘ্নেই কেটেছিল। ১৭০২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল আমরা ইংল্যান্ডের ডাউনস-এ পৌঁছলাম। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ইঁদুর আমার একটি ভেড়া ধরে নিয়ে গিয়েছিল, হাড়গুলো একটা গর্তে পেয়েছিলাম, মাংস পরিষ্কার করে খেয়ে নিয়েছিল। বাকি পশুগুলো সবুজ ঘাস ভর্তি একটা মাঠে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার আশঙ্কা ছিল ওরা হয়তো এদেশে টিকবে না কিন্তু আমার সব আশঙ্কা দূর করে ওরা দিব্যি ঘাস খেয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। জাহাজেও তাদের হয়তো বাঁচিয়ে আনতে পারতাম না যদি নাকি ক্যাপ্টেন আমাকে তাঁর ভাঁড়ার থেকে কিছু বিস্কুট না দিতেন। এই বিস্কুট গুঁড়ো করে জলে গুলে আমি তাদের খাওয়াতাম। তাঁরপর আমি ইংল্যান্ডে যে কটা দিন ছিলাম আমি আমার ক্ষুদ্র পশুগুলো ইংল্যান্ডে নামীদামি ব্যক্তিদের দেখিয়ে বেশ দুপয়সা আয় করেছিলাম। আমি আমার দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রা আরম্ভ করবার পূর্বে পশুগুলো ছ’শো পাউন্ডে বেঁচে দিয়েছিলাম। পরের সমুদ্রযাত্রা থেকে ফিরে এসে খবর নিতে গিয়ে দেখলাম ভেড়াগুলো ছানা পোনা বিইয়ে সংখ্যায় অনেক বেড়েছে। ওদের কোমল পশমের নিশ্চয় খুব চাহিদা হবে। আমি আমার স্ত্রী ও পরিবারের সঙ্গে দুমাস থাকলাম কিন্তু আরো দূর দেশ দেখবার জন্যে আমার ভ্রমণ-পিয়াসী মন চঞ্চল হয়ে উঠল। নিশ্চিন্ত পারিবারিক জীবন আমাকে আটকে রাখতে পারল না। আমি আমার স্ত্রীর হাতে দেড় হাজার পাউন্ড দিলাম এবং তাকে রেডরিফ-এ একটি বাড়িতে থিতু করেছিলাম। যে টাকা বাকি রইল তা থেকে নগদ কিছু সঙ্গে রাখলাম, কিছু জিনিস কিনলাম। সেগুলো বিদেশে বেচে মোটা লাভ করতে পারব। এপিং-এর কাছে আমার বড় আংকল আমাকে খানিকটা জমি দিয়েছিলেন যা থেকে বার্ষিক প্রায় তিরিশ পাউন্ড পাওয়া যেত। এছাড়া ফেটার লেনে আমি ‘ব্ল্যাকবুল’ পানশালা দীর্ঘ মেয়াদী লিজে রেখেছিলাম। তা থেকেও ভালো আয় হত ।
অতএব আমি আমার পরিবারের ব্যবস্থা করেই যাচ্ছি। পরে ওদের অপরের দয়ায় নির্ভর করতে হবে না। আমার ছেলের নাম জনি, নামকরণ তার আংকলের নামানুসারে, এখন গ্রামের স্কুলে পড়ছে, শান্ত বালক। আমার মেয়ে বেটি (তার বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেপুলেও হয়েছে) সেলাই নিয়ে মেতে আছে। স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের কাছে বিদায় নিলাম। সকলের চোখেই জল। তারপর জাহাজে গিয়ে উঠলাম। জাহাজটির নাম ‘অ্যাডভেঞ্চার’, তিনশ টনের মালবাহী জাহাজ, ভারতবর্ষে সুরাট অভিমুখে যাবে। ক্যাপ্টেনের নাম জন নিকোলাস, লিভারপুলবাসী। আমার এই সমুদ্রযাত্রার বৃত্তান্ত আমার ভ্রমণকাহিনীর দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত হবে।
-প্রথম ভাগ সমাপ্ত-