লিলি
শীতের মধ্যরাত৷ বাড়ির পাশের গাছগুলোর পাতার ভাঁজে ভাঁজে নিকষঠান্ডা অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে৷ ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দে এগিয়ে চলা ছাড়া বিশ্বচরাচরে যেন আর কোনো স্পন্দন নেই৷ জানলার কাচের মধ্য দিয়ে দূরের ল্যাম্পপোস্টের ধূসর আলো এসে পড়েছে ঘরের মধ্যে৷ সৃষ্টি করেছে কেমন এক মায়াবী পরিবেশের৷
এইরকম পরিবেশে প্রচণ্ড ঠান্ডায় লেপের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকলে সেই সুখানুভূতির জাল ছিন্ন করে কারুরই সহজে ঘুম ভাঙে না৷ পাতলা হতে হতেও ঘুম আবার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে শরীরটাকে৷ যদি না যথেষ্ট পরিমাণে তাকে উৎপীড়ন করা হয়৷
অদম্য পালেরও সেটাই হচ্ছিল৷ অনেকক্ষণ ধরে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, অবাঞ্ছিত কোনো স্পর্শে তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছিল৷ নিদ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেও তিনি বারবার সেই অস্বস্তিটাকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিলেন৷ সামান্য উশখুশ করে পাশ ফিরে আবার জড়িয়ে ধরছিলেন লেপের তলায় তাঁর একমাত্র সঙ্গী পাশবালিশটিকে৷
কিন্তু বেশ কয়েকবার এমন হওয়ার পর তাঁর ঘুমটা সত্যিই পুরোপুরি ভেঙে গেল৷ তিনি জেগে উঠলেন৷
আর জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বেশ আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলেন, লেপের তলায় তিনি যেন একা নন৷ পরিষ্কার অনুভব করতে পারলেন, তাঁর রাতপোশাকের মধ্যে কিলবিল করছে একজোড়া নরম হাত৷ বেপরোয়া পর্যটকের মতো সেই হাতদুটো বিচরণ করে চলেছে তাঁর শরীরের যত্রতত্র৷ নির্দ্বিধায় স্পর্শ করছে তাঁর বুক, পেট, নাভিমূল৷ আগ্রাসী নাবিকের মতো ক্রমশ যাত্রা করছে নীচের দিকে৷
গাঢ় ঘুম অসময়ে ভাঙলে কয়েক মুহূর্তের জন্য কেমন ঘোরের মধ্যে থাকে সবাই, বাস্তবে ফিরে আসতে সময় লাগে খানিকক্ষণ৷ অদম্য পালেরও সেটাই হচ্ছিল৷ ঘুম ভেঙে তিনি চুপচাপ শুয়েছিলেন৷ সাতপাঁচ না ভেবে চোখ বুজে উপভোগ করছিলেন লেপের তলার সেই উষ্ণ আদর৷
বহুদিন পর তাঁর মধ্যত্রিশের উপোসি শরীর যেন জেগে উঠছিল৷
নরম হাতদুটোর সঙ্গে একজোড়া নরম ঠোঁটেরও স্পর্শ পাচ্ছিলেন এবার তিনি৷ ঠোঁটদুটো তাঁর বুকে পাগলের মতো ঘষে চলেছিল পাপড়িদুটো, বুক থেকে ধীরে ধীরে সর্পিল গতিতে উঠে আসছিল তাঁর গলা বেয়ে৷ ঘাড়ের পেছনে কর্ণমূলের সামান্য নীচে ক্রমাগত ঘর্ষণে অদম্য পাল প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন৷
সুখানুভূতিতে একসময় নিজের অজান্তেই তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘‘আহ!’’
আর তাঁর আরাম শীৎকারেই বোধ হয় ঠোঁটদুটো আরো উৎসাহিত হয়ে পড়ল৷ সোজা এসে সে-দুটো চেপে বসল তাঁর ঠোঁটের ওপর, শুষে নিতে লাগল আশ্লেষে৷
আহ, কী মাদকতাময় একটা সুগন্ধ! প্রচণ্ড কর্ষণে নিজের ঠোঁটদুটো যেন ক্রমশই শুষ্ক হয়ে উঠছিল৷ তবু অদম্য চাইছিলেন এই অসম্ভব স্বর্গীয় মুহূর্ত যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়৷
ভেজা চুমুতে সুখসাগরে ভাসতে ভাসতে অদম্য কিছুক্ষণ পর চোখ খুললেন৷
আর তখনই তাঁর চটকাটা পুরোপুরি কেটে গেল৷ তাঁর মনে পড়ে গেল, ঘরে দ্বিতীয় ব্যক্তি কেউ নেই৷
থাকা সম্ভবও নয়৷ তাঁর এই তেরোতলার ফ্ল্যাটে তিনি একাই থাকেন৷
মনে হওয়ামাত্র তিনি বিস্ফারিত চোখে উঠে বসতে চেষ্টা করলেন৷ কিন্তু পারলেন না৷ ভেজা ঠোঁট আর দুটো হাত তখন তাঁর শরীরের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে৷
ঘরের মিশমিশে কালো অন্ধকারেও যেটুকু আবছা আলো বাইরে থেকে এসে পড়ছিল, সেই আলোয় শিহরিত অদম্য টান মেরে লেপটা সরিয়ে দিলেন গা থেকে৷ দেখলেন লেপের তলায় কেউ নেই৷ কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না তিনি৷
অথচ তিনি এখনো স্পষ্ট অনুভব করতে পারছেন এক নারীশরীর তাঁকে নিয়ে রতিক্রিয়ায় মগ্ন৷ পরিষ্কার বুঝতে পারছেন একজোড়া যৌবনপুষ্ট নরম মাংসপিণ্ড নিষ্পেষিত হচ্ছে তাঁর রোমশ বুকে৷
কিন্তু না৷ তিনি আর উপভোগ করতে পারছেন না৷ ইন্দ্রিয়সুখও লুপ্ত৷ বরং ভয়ে, অবিশ্বাসে তাঁর শরীরের রোমকূপগুলো এখন খাড়া হয়ে উঠছে৷
তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করছেন অদৃশ্য সেই শয্যাসঙ্গিনীর হাত থেকে রেহাই পেতে৷
কিন্তু পারছেন না৷
আতঙ্কে তাঁর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে৷ এই ঠান্ডাতেও কুলকুল করে ঘামতে ঘামতে তিনি অনুভব করলেন, কোনো নারীযোনিতে প্রবিষ্ট হচ্ছে তাঁর পুরুষাঙ্গ৷ সম্পূর্ণভাবে তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই৷
ওহ! কী হিমশীতল সেই গহ্বর৷ যেন হাজার বছর ধরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছে সেই মৃত্যুশীতল উপত্যকা৷
প্রবল আন্দোলনের মাঝে কাঁপতে কাঁপতে তিনি জ্ঞান হারালেন৷
* * * *
শিয়ালদা স্টেশনের বাইরের উড়ালপুলকে বাঁ হাতে রেখে কয়েক মিনিট এগোলে ডানদিকে যে বেসরকারি নার্সিংহোমটা পড়ে, তার নাম সঞ্জীবনী৷
সেটা যেমনই ঘুপচি, তেমনই টিমটিমে আলোয় ম্রিয়মাণ৷ রিসেপশনে বসে থাকেন একজন চল্লিশোর্ধ্ব পৃথুলা মহিলা৷ শরীরের মেদের সঙ্গে সমানুপাতে বর্ধমান তাঁর মেজাজ৷ তাঁর খিটখিটে স্বভাবের দায়সারা উত্তরে হাতেগোনা যে কটা রুগি আসে, তারাও মানে মানে কেটে পড়ে৷ রিসেপশনের হলদে নিবু নিবু আলোয় তেলচিটে অপরিচ্ছন্ন সোফাগুলো ফাঁকাই পড়ে থাকে৷
বোঝাই যায়, প্রায় কয়েক দশক আগে খোলা এই সঞ্জীবনী এখন ‘আউটডেটেড’৷
ব্যতিক্রম শুধু মাসের প্রথম শনিবার৷ এই একটা দিন সঞ্জীবনী নার্সিংহোমের সামনে ভিড় যেন উপচে পড়ে৷ রিসেপশনের দুটো সোফায় রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে জায়গা পাওয়ার; অগুনতি মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে অপেক্ষায়৷
দেশের প্রথম সারির মনোবিদ ডঃ সাম্য চট্টরাজ মাসের এই একটা দিন বসেন এখানে৷
ডঃ সাম্য চট্টরাজ এখন কর্মসূত্রে থাকেন মুম্বাইতে৷ সেখানে তাঁর প্রবল নামডাক৷ শোনা যায়, বলিউডের নামীদামি সব অভিনেতা তাঁর নিয়মিত পেশেন্ট৷ দেশের প্রতিটি শহরের অভিজাত সমস্ত হাসপাতাল মুখিয়ে থাকে তাঁর একটি চেম্বার পাওয়ার জন্য৷ সেখানে এত কিছুর পরে তিনি কলকাতায় রুগি দেখতে আসার জন্য এমন মুমূর্ষু একটি হাসপাতালকে কেন বেছেছেন, তা বড়ই আশ্চর্যের বিষয়৷
ডঃ চট্টরাজ মাসে এই একটি দিনই দুপুরের ফ্লাইটে কলকাতা আসেন, বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সঞ্জীবনীতে রুগি দেখেন, তারপর এখান থেকেই সোজা চলে যান বিমানবন্দর৷ কলকাতার বহু হাসপাতালের বারংবার অনুরোধে ও প্রলোভনেও তিনি অন্য কোথাও বসেন না৷
আজও মাসের প্রথম শনিবার৷ সন্ধে থেকে সেই বিপুল ভিড়ের চাপ অনভ্যস্ত হাতে সামলে রিসেপশনিস্ট ভদ্রমহিলা বেশ বিধ্বস্ত, তাঁর চোখমুখেই তা প্রতীয়মান৷
এখন রাত প্রায় সাড়ে ন’টা৷ রিসেপশন প্রায় ফাঁকা৷ তাই শেষ রুগির যখন ডাক এল, ভদ্রমহিলা ক্লান্ত কর্কশ সুরে ব্যাজার মুখে বললেন, ‘‘আপনিই একান্ন নম্বর তো? ভেতরে যান৷’’
বাইরে রিসেপশনিস্ট ক্লান্ত হলেও ভেতরে ডাক্তারবাবু একইরকম সতেজ, ঋজু হয়ে বসে আছেন টেবিলের সামনে৷ অদূরে তাঁর ছোকরা সেক্রেটারি কলম বাগিয়ে অপেক্ষা করছে নতুন কেসের ডিটেইল লেখার জন্য৷
সামনে এসে বসা দুই ভদ্রলোককে একঝলক মেপে নিলেন ডঃ সাম্য চট্টরাজ, তারপর স্মিতমুখে বললেন, ‘‘আপনাদের মধ্যে কোনজন অদম্য পাল?’’
‘‘আমি!’’ চশমা পরা ভদ্রলোকটি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন৷ তাঁর পরনে দামি স্যুট, চেহারা সামান্য ভারীর দিকে৷ উচ্চতা মাঝারি৷
‘‘নমস্কার৷’’ সাম্য চট্টরাজ তাকালেন দ্বিতীয় ভদ্রলোকের দিকে, ‘‘আর আপনি?’’
‘‘আমি ওর বন্ধু, ধীমান চক্রবর্তী৷’’
ডঃ সাম্য চট্টরাজের কাজের ভঙ্গিমা হল প্রথমেই তিনি সরাসরি রুগির সমস্যায় চলে যান না৷ এতো আর পেটের অসুখ নয় বা জ্বর সর্দি নয় যে ‘কী অসুবিধা’ বললেই রুগি হড়হড় করে বলতে শুরু করবে৷ মানুষের মনের ভেতর ঢুকতে গেলে আগে তার সঙ্গে সহজ হতে হবে৷ তার সংকোচ কাটাতে হবে৷ তাহলে রুগি নিজে থেকেই সমস্যাটা ডাক্তারের কাছে মেলে ধরতে কুণ্ঠাবোধ করবে না৷
এক্ষেত্রেও তাই হল৷ টুকটাক কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ডঃ চট্টরাজ জানতে পারলেন, এঁরা দুই বন্ধু৷ তাঁর রুগি ডঃ অদম্য পাল কেন্দ্রীয় সরকারি গবেষণা সংস্থায় কর্মরত এক জৈবরসায়নবিদ৷ থাকেন কলকাতাতেই৷ তাঁর বাল্যবন্ধু ধীমান চক্রবর্তী শিক্ষক, পড়ান শহরতলির এক স্কুলে৷
ধীমানই বেশি কথা বলছিলেন৷ অদম্য মিতবাক, টুকটাক হুঁ-হাঁ করছিলেন শুধু৷ চশমার লেন্সের মধ্য দিয়ে তাঁর কালো উজ্জ্বল চোখদুটো শুধু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল আশপাশ৷
ধীমান কথা বলতে বলতে বেশ গর্বিতমুখে বন্ধুর দিকে তাকালেন, ‘‘আপনি ওর নাম শুনেছেন কি না জানি না ডাক্তারবাবু, তবে অদম্য এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন৷ কয়েকবছর আগে ওর এক আবিষ্কারে সারা দেশজুড়ে খুব হইচই পড়ে গিয়েছিল৷ আপনি হয়তো কাগজে পড়ে থাকবেন৷ ও একধরনের মাশরুম ব্রিড করেছে, যা খুব দ্রুত প্লাস্টিক খেয়ে ফেলতে পারে৷ বুঝতেই পারছেন, পৃথিবী এখন যেভাবে প্লাস্টিকে ছেয়ে যাচ্ছে, দূষণ মাত্রা ছাড়াচ্ছে, তাতে ওর এই আবিষ্কার কতটা গুরুত্বপূর্ণ৷’’
‘‘প্লাস্টিক খেয়ে ফেলতে পারে?’’ শুনে রীতিমতো অবাক হলেন ডঃ চট্টরাজ৷
‘‘হ্যাঁ৷’’ ধীমানবাবু সোৎসাহে বললেন, ‘‘অদম্যর আবিষ্কার করা ওই ফাঙ্গাসটার নাম পেস্টাওলোটিঅপসিস মাইক্রোস্পোরা৷ ওই হাইব্রিড ফাঙ্গাস পলিইউরিথিন খায়৷ আপনি নিশ্চয়ই জানেন ডাক্তারবাবু, প্লাস্টিক স্বাভাবিকভাবে পচে প্রকৃতিতে ডিকম্পোজ হতে অনেক সময় লাগে৷ আমরা যে সাধারণ পলিব্যাগ ব্যবহার করি, সেটা ডিকম্পোজ হতে সময় নেয় মোটামুটি এক হাজার বছর৷ প্লাস্টিক বোতল প্রায় পাঁচশো বছর৷ এইজন্য গোটা পৃথিবীতে প্লাস্টিক বর্জ্য কমানোর জন্য অনেক গবেষণা চলছে৷ অদম্যর এই আবিষ্কারে তাই রাতারাতি খুব সাড়া পড়ে যায়৷ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ওকে তারপর অনেক সম্মাননাও দেওয়া হয়৷ আমি ছাপোষা মানুষ, বিয়ে-থাও করিনি, একটা স্কুলে ইংরেজি পড়াই৷ এমন বিখ্যাত বন্ধু পাওয়াই আমার কাছে গর্বের৷’’
‘‘বাহ! অসাধারণ!’’ ডঃ চট্টরাজ স্মিতমুখে তাকালেন ডঃ অদম্য পালের দিকে, ‘‘আপনি নিশ্চয়ই এটার পেটেন্ট নিয়েছেন?’’
এবারেও কথা বললেন ধীমান, ‘‘হ্যাঁ ডাক্তারবাবু৷ নানা আইনি জটিলতায় একটু দেরি হচ্ছিল৷ এখন সেসব মিটে গিয়েছে৷ আমেরিকার এক নামী কোম্পানি ওর থেকে পেটেন্ট কিনে নিচ্ছে৷ খুব শিগগিরই তারা কমার্শিয়ালি এই মাশরুম বাজারে ছাড়বে৷’’
‘‘খুব ভালো৷’’ কথা বলতে বলতে কোন সময় কীভাবে সমস্যার মধ্যে ঢুকে পড়তে হয়, সেই বিদ্যা ডঃ চট্টরাজের খুব ভালোভাবে আয়ত্ত৷ বললেন, ‘‘অদম্যবাবু, আপনার তাহলে এখন কোথায় অসুবিধা?’’
নিজের সম্পর্কে অনেকক্ষণ ধরে প্রশংসাভাষণ শুনতে শুনতে অদম্য পালের মুখচোখ বেশ আলোকিত হয়ে উঠেছিল৷ কিন্তু আচমকা ডাক্তারের এই প্রশ্নে তা অদৃশ্য হয়ে গেল৷ কীভাবে শুরু করবেন বুঝতে না পেরে তিনি একঝলক তাকালেন ধীমানের দিকে৷
‘‘ইয়ে মানে ডাক্তারবাবু…!’’ ধীমানের জোরালো কণ্ঠস্বর আচমকাই খাদে নেমে এল৷ তিনি একপলকের জন্য তাকিয়ে নিলেন ডাক্তারের সেক্রেটারির দিকে৷ তারপর ইতস্তত করে বললেন, ‘‘কয়েকদিন ধরে অদম্যর একটা অদ্ভুত সমস্যা হচ্ছে৷’’
‘‘সেটাই তো জানতে চাইছি৷ কী সমস্যা?’’
অদম্য ইঙ্গিতে ধীমানকে বললেন, ‘‘তুই-ই বল!’’
ধীমান একটু কেশে বললেন, ‘‘আসলে ইদানীং ও রাতে বিছানায় শুলেই একটু পরে ওর ঘুম ভেঙে যাচ্ছে৷ ও অনুভব করছে কোনো মেয়ে যেন ওর শরীরে ঘষাঘষি…ইয়ে মানে…বুঝতেই তো পারছেন কী বলতে চাইছি! ও কাউকে দেখতে পাচ্ছে না, এদিকে সবকিছু হয়ে যাচ্ছে৷’’
ডাক্তারের সেক্রেটারির মুখে ধীমানের কথা বলার ধরন বিশেষত ‘সবকিছু হয়ে যাচ্ছে’ শুনে একটা চাপা হাসি ফুটে উঠল৷
সেটা অদম্য পালের চোখ এড়াল না৷ লজ্জায় তিনি নতনেত্র হলেন৷
ডঃ চট্টরাজ প্রশ্ন করলেন, ‘‘আপনি কি বিবাহিত?’’ তারপর সঙ্গে জুড়লেন, ‘‘বন্ধু নয়, আপনি নিজে উত্তর দিন ডঃ পাল!’’
অদম্য কেমন যেন থতোমতো খেয়ে গেলেন৷ তারপর বললেন, ‘‘হ্যাঁ৷ কিন্তু বউ এখানে থাকে না৷ ছেলেকে নিয়ে তার বাপের বাড়িতে থাকে৷ বীরভূমের এক গ্রামে৷’’
‘‘কেন?’’
‘‘আমি অর্ধেক দিন কলকাতায় থাকি না৷ প্রায়ই এ-শহর ও-শহরে কনফারেন্স থাকে৷ বিদেশেও যেতে হয়৷ ও গ্রামের মেয়ে৷ একা একা এখানে থাকতে ঠিক ভরসা পায় না৷ তাই ওখানেই থাকে৷ তবে দু-এক মাস অন্তরই আসে৷ আমিও যাই৷’’
‘‘হুম৷ আপনি নিশ্চয়ই আমার কাছে সুরাহা পেতে এসেছেন৷ ঠিক কী হয়, কোনোরকম লজ্জা বা সংকোচ না করে আমাকে বলুন৷ একটুও কিছু গোপন করলে আমি ঠিকমতো ডায়াগনোসিস করতে পারব না৷’’
অদম্য পাল একটা ঢোঁক গিললেন৷ তারপর বন্ধুর দিকে তাকালেন একবার৷
ধীমান ইঙ্গিতে উৎসাহ দিতে কিছুটা থেমে, কিছুটা কেশে পুরো অভিজ্ঞতাটা বর্ণনা করলেন৷ বলতে বলতে তাঁর মুখ লাল হয়ে উঠছিল, সম্ভবত আতঙ্কে৷ ভরাট কণ্ঠস্বর নিজে থেকেই বসে গিয়ে কেমন ফ্যাঁসফেসে শোনাচ্ছিল৷
সেক্রেটারি ছেলেটি ঝড়ের গতিতে নোট নিচ্ছিল৷ ডঃ চট্টরাজ মন দিয়ে শুনছিলেন৷ শুনতে শুনতে তাঁর ভ্রূ দুটো ক্রমশই কুচকে যাচ্ছিল৷
অদম্য থামতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘‘আপনার এই সমস্যাটা কবে থেকে হচ্ছে?’’
‘‘তা ধরুন, তিন সপ্তাহ হল৷’’ ভেবে বললেন অদম্য, ‘‘প্রথম যেদিন হল, সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই দিল্লি থেকে ফিরেছিলাম৷ তারপর প্রায় ছয়-সাতটা রাতে…৷’’
‘‘শুধু কলকাতায় থাকলেই হয়েছে নাকি বাইরেও?’’
‘‘বাইরেও৷’’ দ্রুত বললেন অদম্য, ‘‘গত পরশু একদিনের জন্য হায়দরাবাদ গিয়েছিলাম৷ সেখানেও একই ব্যাপার…!’’
খুব গোপনীয় কোনো সমস্যা হলে রুগি তা প্রথমে ডাক্তারবাবুর সামনে মেলে ধরতে লজ্জা পায়৷ কিন্তু একবার তা প্রকাশিত হয়ে পড়লে সে অনেক বেশি সহজ হয়ে ওঠে৷ তখন সে আর নিজের যন্ত্রণার কথা বলতে দ্বিধাবোধ করে না৷ অসংকোচে সবকিছু উন্মুক্ত করে তুলে ধরে ডাক্তারের সামনে৷
অদম্য পালেরও সেটাই হল৷ তিনি কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, ‘‘আমি একজন সায়েন্টিস্ট ডাক্তারবাবু৷ অলৌকিক, ভূতপ্রেত এসবে বিশ্বাস করা আমার সাজে না৷ কিন্তু কী করব বলুন, চোখের সামনে রোজ যা ঘটছে, আমি মরে বেঁচে আছি৷ যখন ওসব কাজ করে, আমি ভয়ে চিৎকার করি, ঠেলে সরিয়ে দিতে চাই৷ কিন্তু বললে বিশ্বাস করবেন না, তখন তার উত্তেজনা আরো চরমে পৌঁছোয়৷ আমার শরীরটাকে নিয়ে সে ময়দার তালের মতো নোংরামি করতে থাকে৷ এ এমন এক লজ্জাজনক বিষয়, লোকে শুনলে হাসবে৷ অপবাদ দেবে৷ তাই কাউকে বলতেও পারছি না৷ নেহাত ধীমান আমার অনেক ছোটবেলার বন্ধু, তাই…! আপনি আমায় বাঁচান ডাক্তারবাবু! আমি কাজপাগল লোক৷ নিজের কাজ নিয়ে থাকতে ভালোবাসি৷ এইসব বিপদে আমার মাথা ঠিক রাখাই দায় হয়ে উঠছে! কেমন আনমনা হয়ে যাচ্ছি৷ হায়দরাবাদে গোটা রাত ওরকম দাপাদাপি চলার পর সকালে সেমিনারে কিছু বলতেই পারলাম না৷ একগাদা ছাত্রছাত্রী-অধ্যাপকদের সামনে বেইজ্জত হলাম৷’’
ডঃ চট্টরাজ ব্যথিত মুখে শুনছিলেন তাঁর আজকের শেষ রুগির কথা৷ অদম্য পাল থামতেই তিনি বললেন, ‘‘শান্ত হোন ডঃ পাল৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷ আপাতত আমি আপনাকে একটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি৷ এতে ঘুমও ভালো হবে, দুশ্চিন্তাও কমবে৷ রোজ রাতে শোবার আগে একটা করে খাবেন৷ সাতদিন খাওয়ার পর আপনি নিজেই দেখবেন অনেক বেটার ফিল করবেন৷ তার সঙ্গে আমি একজন সাইকোলজিস্টের কাছে আপনাকে কাউন্সেলিং করাতে পাঠাচ্ছি৷ তার কাছে আপনি সপ্তাহে একটা করে সেশান নিন৷ সামনের মাসের প্রথম শনিবারে আমি আবার দেখব৷ কেমন?’’
ধীমান ইঙ্গিতে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে কিছু ইশারা করলেন৷
অদম্য পালের মনে পড়ে গেল, আসার সময় ধীমান এই কথাই বলছিলেন, ‘‘দেখবি হয়তো আবার অন্য কোথাও রেফার করবে৷ ইদানীং এই এক ফ্যাশান হয়েছে৷ সায়কিয়াট্রিস্টের কাছে গেলে সে আবার পাঠাচ্ছে তারই চেনা কোনো সাইকোলজিস্টের কাছে৷ কাউন্সেলিং-এর সেশান নিতে৷ সব আসলে চেইন সিস্টেম৷ কিন্তু কিছু করার নেই৷ ডঃ সাম্য চট্টরাজের মতো পয়লা নম্বর মনোবিদ ছাড়া এই কেস সামলাতে সবাই পারবে না৷ বুঝলি তো! তাই রিস্ক নিয়ে লাভ নেই৷ বলা যায় না, প্রতিদিন ভূতের সঙ্গে সেক্স করছিস, ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে…!’’
‘‘আহ! কথাটা ঠিকভাবে বল৷’’ বিরক্তমুখে বলেছিলেন অদম্য, ‘‘আমি কি কিছু করছি নাকি? আমাকে করানো হচ্ছে৷’’
‘‘ওই একই হল বস!’’ ধীমান মাথা নেড়েছিলেন, ‘‘আমি সাদাসিধা লোক, তোদের মতো অত কথার খেলা খেলতে পারি না৷’’
৷৷দুই৷৷
অদম্য যখন বাড়ি ফিরলেন, তাঁর পাঁচ বছরের ছেলে ছুটোছুটি, হুটোপুটি করে গোটা বাড়ি মাথায় তুলেছে৷ চিন্তায় টেনশনে অদম্যর খেয়ালই ছিল না প্রায় আড়াই মাস হয়ে গেল স্ত্রী-পুত্র তাঁর কাছে আসেনি৷
বিব্রত মুখে ফ্ল্যাটে ঢুকে ড্রয়িংরুমে পৌঁছে দেখলেন, তাঁর শ্বশুরমশাই বহুমূল্য সোফার ওপর অপরিচ্ছন্ন পা দুটো তুলে বাবু হয়ে বসে চা খাচ্ছেন৷
অদম্যর বিরক্তিভাবটা আবার ফিরে এল৷ কথায় বলে বিয়ে করা উচিত সমানে সমানে৷ নিজের আর্থসামাজিক অবস্থানের চেয়ে অনেক নীচের কোনো পরিবারের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলে এইসব বিপত্তিতে পড়তে হবেই৷ কিন্তু কিছু করার নেই৷ অদম্যর পছন্দ ছিল একেবারে বাধ্য স্ত্রী৷ কোনোরকম দাবিদাওয়া না থাকা স্ত্রী৷ তা তিনি পেয়েছেন৷ কিছু পেতে গেলে কিছু ছাড়তে হবে৷ তাই অদম্য আফসোস করেন না৷
অদম্যর স্ত্রী আভা বীরভূমের এক গ্রামের মেয়ে৷ এইটুকু বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না৷ আভা যে গ্রামে বেড়ে উঠেছে, তা এমনই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় যে মাত্র বছরকয়েক হল সেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে৷ আভা একেবারে পাড়াগেঁয়ে মেয়ে, সাত চড়ে রা কাটে না৷ সে একান্তই বিশ্বাস করে ‘পতিরেকো গুরুঃ স্ত্রীণাং’, পতিই স্ত্রীলোকের পরম গুরু৷
আভা ক্লাস ফোর পর্যন্ত গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়েছিল৷ ব্যস, ওটুকুই৷ তার বাবার জমিজায়গা আছে, চাষবাসে সংসার চলে৷
অদম্য যখন নিজের চৌহদ্দির একেবারে বাইরে গিয়ে এই সম্বন্ধ ঠিক করেছিলেন, তাতে বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীরা তো বটেই, আত্মীয়স্বজনও আশ্চর্য হয়েছিল৷ একজন শহুরে ঝকঝকে তরুণ বিজ্ঞানী এমন বিসদৃশ বিয়ে করবে কেন?
বন্ধুরা বুঝিয়েছিল, ‘‘পাগল হলি নাকি? লাইফ পার্টনারের সঙ্গে নিজের কেরিয়ারের ওঠানামা, সাফল্য, ব্যর্থতা কিছু শেয়ার করতে পারবি? কিছুই তো বুঝবে না!’’
কেউ বলেছিল, ‘‘দেশেবিদেশে এত বড় বড় জায়গায় আমন্ত্রিত হোস, ওরকম মেয়ে তো ম্যানারিজম জানবে না৷ অপ্রস্তুতের একশেষ হবি! নিদেনপক্ষে কোনো রিসার্চ ফেলোকেও তো জোটাতে পারতিস!’’
অদম্য সে-সব কথার উত্তর দেননি, কর্ণপাতও করেননি৷ কিছু কথা মনের মধ্যেই রাখতে হয়৷ চাইলেও বলা যায় না যে যতই তিনি আধুনিক হোন, নারীস্বাধীনতার ব্যাপারে তিনি রক্ষণশীল৷
সেই রক্ষণশীলতার মাত্রা এতটাই বেশি যে তিনি চান বাধ্য বশীভূত স্ত্রী৷ ঘরের কাজ করবে, বাচ্চাকাচ্চা সামলাবে, আদেশ পালন করবে৷ কথায় কথায় তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা যাবে, খোঁটা দেওয়া যাবে, দরকার হলে চড়চাপড়ও মারা যাবে৷ সেই তৃপ্তি কি আর কোনো আধুনিক মেয়ে দিতে পারবে? তাদের মুখে কথায় কথায় সাম্যবাদের বুলি, এদিক-ওদিক হলে পুলিশি ঝামেলায় পড়ার ভয়ও আছে৷ চাকরিওয়ালা মেয়েরা তো বটেই, সামান্য শহুরে শিক্ষিত মেয়েদেরও আজকাল স্বামীর প্রতি অধীনতার বড়ই অভাব৷
কিন্তু এইসব কথা কাউকে বলা যায় না৷ বললেই অদম্য সবার কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে পড়বেন৷ তাঁর বিয়ে করার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না৷ মেয়েদের ঘ্যানঘ্যান বা বাচ্চাদের বায়নাক্কা সামলানোর কথা ভাবলেই তাঁর দমবন্ধ হয়ে আসে৷
কিন্তু কর্মব্যস্ত জীবনের ফাঁকে নিজের শরীরী চাহিদাটুকুও অস্বীকার করা যায় না৷ সেটাও অবশ্য কলকাতা শহরে পয়সা ফেললেই পাওয়া যায়, কিন্তু অদম্য বরাবরের বৈষয়িক৷ সামান্য খাইখরচ বাবদ যদি একান্ত পরাভূত মেয়ে পাওয়া যায়, তিনি সেই টাকাটাই বা খরচ করবেন কেন?
তাই তর্কবিতর্কে বিশেষ না গিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বছর-ছয়েক আগে আভাকে বিয়েটা সেরেই ফেলেছিলেন তিনি৷ তাঁর বাবা-মা আগেই গত হয়েছিলেন, তাই সেভাবে মতামত দেওয়ার কেউ ছিল না৷ ভীতু মেয়েটাকে বিয়ের পর রেখে এসেছিলেন তার বাপের বাড়িতে, প্রতিমাসে ভরণপোষণের টাকাটা মনে করে পাঠিয়ে দিতেন শ্বশুরমশাইকে৷
এখন ন-মাসে ছ-মাসে পায়ের ধুলো দেন, উচ্চশিক্ষিত জামাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে প্রচণ্ড কদর৷ শাশুড়ি তো পারলে জামাইয়ের পা জল দিয়ে ধুইয়ে দেয়৷
অদম্যও সচেতনভাবে বেশ চাপে রাখেন তাঁদের৷ কথায় কথায় উষ্মা প্রকাশ করেন, তারা তটস্থ হয়ে থাকে৷
অদম্য মিটিমিটি হাসেন আর ভাবেন তাঁর যে সব বন্ধুরা আধুনিক মেয়ে বিয়ে করেছে, তারা কেউ শ্বশুরগৃহে এমন আতিথেয়তা পায়? পায় না৷
এই যেমন এখন৷ অদম্য এগিয়ে গিয়ে কড়াগলায় বললেন, ‘‘আপনি এভাবে বসেছেন কেন? আমার সোফার অত দামি কভার?’’
শ্বশুরমশাইয়ের মুখ থেকে উল্লসিত ভাবটা উবে গেল৷ মুহূর্তে তিনি সংকুচিত হয়ে উঠে এলেন, ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে জড়সড় হয়ে বসে আমতা আমতা করলেন, ‘‘ইয়ে এই আর কি …. হে হে …. বুঝতে পারিনি বাবা৷’’
অদম্যকে বিরক্তমুখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরো প্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘‘বাচ্চাটা খুব বায়না ধরেছিল, তাই নিয়ে এলাম৷’’
অদম্য উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলেন৷ তাঁর কিছু ভালো লাগছে না৷ একে সামনে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার, রাতবিরেতে অমন ভৌতিক উপদ্রব, তার ওপরে বলা নেই কওয়া নেই, এরা সব এসে হাজির৷ আগে থেকে একটা খবর দেওয়ার ম্যানারিজম পর্যন্ত জানা নেই এদের৷
স্ত্রী আভা আড়ষ্টভাবে জলখাবার দিতে এল৷ তার বিশ্বখ্যাত গুণী স্বামীটিকে সে বেদম ভয় পায়৷ কথায় কথায় তার স্বামীর তাচ্ছিল্যের দৃষ্টির সামনে কেন্নোর মতো কুঁকড়ে যায়৷
ইদানীং বছরে চার-পাঁচবার শয্যায় স্বামীকে তৃপ্ত করা ছাড়া বিজ্ঞানী অদম্য পালের জীবনে তার কোনো ভূমিকা নেই৷ সেই ব্যাপারেও তার নিজের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই৷ যেদিন মন চায়, সেদিন তার স্বামী ঠিক গিয়ে হাজির হন গ্রামে, নিজের চাহিদাটুকু মিটিয়ে আবার ফেরত চলে আসেন তিনি৷
স্বামীর সামনে খাবারের প্লেট রাখতে রাখতে আভা বলল, ‘‘বুল্টুটা ওয়ানে ভর্তির পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে, তাই বায়না ধরল বাবার কাছে আসবে৷ তাই নিয়ে এলাম৷ কাল রোববার, ছুটি আছে৷ পরশু সকালেই চলে যাব৷’’
আভার গ্রাম্য টানে বলা কথাবার্তা শুনলেই মেজাজ খিঁচড়ে যায় অদম্যর৷ তিনি কোনো কথা না বলে খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন৷
আভা আবার ভয়ে ভয়ে বলল, ‘‘আপনি ওকে এট্টু উৎসাহ দেবেন? বুল্টুর মাথাটা বেশ পরিষ্কার৷ আমি ওকে সবসময় বলি, বড় হয়ে বাবার মতো হতে হবে৷’’
অদম্য খেতে খেতে থেমে গেলেন৷ মুখ তুলে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালেন আভার দিকে৷ তারপর শ্লেষমাখানো কণ্ঠে বললেন, ‘‘বাবার মতো? গাছ যদি পচা হয়, ফলও পচাই হবে৷ আমড়া গাছে আমড়া হয়, আম নয়৷ বুঝলে? নিজের তো ওই বিদ্যা, ক-অক্ষর গোমাংস!’’
আভা আর কোনো কথা বলল না৷ ফিরে গেল রান্নাঘরে৷ তার স্বামী এইরকমই৷ কথায় কথায় স্ত্রীকে অবজ্ঞা, খোঁটা না দিলে তাঁর ঠিক তৃপ্তি হয় না৷ আগে তার খুব কষ্ট হত৷ ভাবত, তাকে তো সব জেনেশুনেই বিয়ে করেছেন উনি, তা সত্ত্বেও এমন কেন?
কিন্তু ধীরে ধীরে এসব তার গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে৷ টিভিতে বা কাগজে যখন তার স্বামীর ছবি বেরোয়, গ্রামে সবাই তার সৌভাগ্য নিয়ে আলোচনা করে, গর্বে তার বুক ভরে ওঠে৷
কিন্তু একইসঙ্গে এটাও মনে হয়, যারা ওঁকে শ্রদ্ধা করে, তারা ক-জন জানে যে বিজ্ঞানী অদম্য পাল কতটা আত্মকেন্দ্রিক? ক-জন কল্পনা করতে পারে যে বিজ্ঞানী অদম্য পাল নিজের স্ত্রী তো দূর, নিজের ছেলেকেও ভালোবাসেন না? অসুস্থ পর্যায়ের স্বার্থপর স্বৈরাচারী একজন মানুষকে বিয়ে করে আভা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য পেয়েছে, সন্তান পেয়েছে৷ কিন্তু সুখ পায়নি৷ সম্মান পায়নি৷ ভালোবাসা পায়নি৷
আভা লেখাপড়া বেশিদূর শেখেনি, কিন্তু সে সবকিছুই বুঝতে পারে৷ অদম্য পাল কাজ করছেন প্লাস্টিকমুক্ত ভবিষ্যতের জন্য, কিন্তু মানসিকভাবে বসবাস করছেন একশো বছর অতীতে, যেখানে স্ত্রীরা স্বামীর সামনে মাথা নীচু করে থাকত, আপনি-আজ্ঞে করত৷ মেয়েদের পায়ের তলায় রাখতে তাঁর এক অদ্ভুত আনন্দ হয়৷
অদম্য নিজের ঘরের বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে বসে একটা জার্নাল পড়ছিলেন৷ তাঁর আবিষ্কৃত পেস্টাওলোটিঅপসিস মাইক্রোস্পোরা নামক যে মাশরুমটা গোটা বিশ্বে আলোড়ন ফেলেছে, তার প্রস্তুতপ্রণালী নিয়ে আবার কিছু প্রশ্ন তুলেছেন কয়েকজন বিজ্ঞানী৷
চাকরিবাকরি হোক বা গবেষণা, কোনো ক্ষেত্রেই পরশ্রীকাতর ঈর্ষান্বিত লোকের অভাব নেই৷ প্লাস্টিক নিয়ে ইদানীং কাজ হচ্ছিল সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিকে৷ বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছিলেন ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক থেকে গ্যাসিফিকেশন করে পেট্রোল বা ডিজেলের মতো জ্বালানি উৎপন্ন করতে৷ তাতে প্লাস্টিক বর্জ্যও কমল, আবার জ্বালানিও তৈরি করা গেল৷ কিন্তু সেই পদ্ধতি যেমনই জটিল, তেমনই ব্যয়বহুল৷ তাই অন্য কোনোভাবে প্লাস্টিক সমস্যার সমাধান খুঁজছিল সবাই৷
এমন অবস্থায় তৃতীয় বিশ্বের এক তরুণ বৈজ্ঞানিক যে সবার নাকের ডগা দিয়ে এত ফলদায়ী একটা পন্থা বের করে ফেলবে, সেটা সহ্য হচ্ছে না কারুর৷ তাই তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা নানারকম অজুহাতে প্রশ্ন তুলছেন আর এই করে দেরি হচ্ছে পেটেন্ট নেওয়ার কাজে৷
অদম্য তবু মনোযোগ দিয়ে সেই প্রশ্নগুলো পড়ছিলেন৷ যেগুলো যুক্তিসংগত, সেগুলো পেন দিয়ে দাগিয়ে রাখছিলেন৷ তাঁর অধীনে এখন একজনই পি এইচডি করছে৷ তার নাম সঞ্চয়ন৷ ছেলেটি খবই বুদ্ধিদীপ্ত৷ নিজের থিসিসের পাশাপাশি সে স্যারের কাজেও সহায়তা করে থাকে৷ এইসব প্রশ্নগুলো তার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে৷
গোটা ঘর অন্ধকার৷ শুধু বিছানার পাশের রিডিং ল্যাম্পটা জ্বলছে৷ আজকেও তাপমাত্রা বেশ কম৷ ঘরের এক কোণে রুম হিটার গরম হাওয়া বিকিরণ করে চলেছে নিঃশব্দে৷
ঘড়িতে সবে সন্ধ্যা সাতটা৷ বাইরের ড্রয়িংরুমে টিভি চলছে৷ সেখানে রয়েছে ছেলে আর শ্বশুর৷ আভা রান্নাঘরে৷ এখনো গোটা একটা দিন এই মাছের বাজার তাঁকে সহ্য করতে হবে৷
ভাবতে ভাবতে অদম্য জার্নালটার পৃষ্ঠা ওলটালেন৷ আর ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি উপলব্ধি করলেন তাঁর গরম পোশাকের ভেতর রোমকূপগুলো লম্ব অবস্থানে খাড়া হয়ে পড়ছে৷ তার কারণ, উষ্ণ একজোড়া হাত ব্রাউনীয় গতির মতো যথেচ্ছ বিচরণ করে বেড়াচ্ছে তাঁর নিম্নাঙ্গে৷
অদম্য শিহরিত হয়ে উঠলেন৷ এতদিন গভীর রাতে এই অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা হত৷ কিন্তু আজ এই ভর সন্ধেবেলাতেই এই ঘটনা!
ভয়ে-আতঙ্কে অদম্য চিৎকার করে ডাকতে চাইলেন ড্রয়িংরুমে বসে থাকা ছেলে বা শ্বশুরকে৷ কিংবা রান্নাঘরে থাকা স্ত্রীকে৷ কিন্তু গলার শির ফুলিয়ে অসংখ্যবার কাতর আর্তনাদেও কেউ এল না৷ কারণ তাঁর গলা দিয়ে একফোঁটা আওয়াজও বেরোচ্ছে না৷
অদম্য কুলকুল করে ঘামতে লাগলেন৷ এবার আর হাত নয়, একটা গোটা পূর্ণযৌবনা নারীদেহ তাঁর শরীরটাকে পিষে দিচ্ছে৷ তাঁর রোমশ বুকে পাগলের মতো ঘষা খাচ্ছে সেই অশরীরীর নরম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ৷ না চাইতেও জৈবিক ক্রিয়ায় অদম্য তাতে উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন৷ অসহায় ক্রীতদাসের মতো সমর্পণ করছেন নিজেকে!
প্রাণপণ অশ্রুত চিৎকারে তাঁর মুখচোখ লাল হয়ে যাচ্ছে, দম আটকে আসছে৷ তাঁর দেহ ও মন দুটি সম্পূর্ণ পৃথক গতিপথে বয়ে চলেছে৷ মন না চাইতেও শরীর সাড়া দিয়ে ফেলছে অসম রতিক্রিয়ায়৷
মনের মধ্যে ভয় আর শরীরে সঙ্গমের উত্তেজনা, দুই মিলিয়ে অদম্য বেশিক্ষণ মানসিক চাপ নিতে পারলেন না৷ বিছানাতে টলে পড়ে গেলেন৷
যখন জ্ঞান হল, তখন অস্পষ্ট চোখে অদম্য দেখতে পেলেন, আভা পাশে বসে চোখে-মুখে জলের ছিটে দিচ্ছে৷ পাশে জলের পাত্র নিয়ে দণ্ডায়মান আভার বাবা৷ উল্টোদিক থেকে হুমড়ি খেয়ে তাঁকে দেখছে ছেলে বুল্টু৷
আবছা শুনলেন ছেলে বলছে, ‘‘বাবা তুমি ঘুমোচ্ছ, এদিকে লিলিমাসি তোমার সঙ্গে আলাপ করবে বলে এতক্ষণ বসে বসে ফিরে চলে গেল!’’
আভা মৃদু ধমক দিল ছেলেকে, ‘‘আহ, এখন চুপ কর৷ দেখছিস না বাবার শরীরটা খারাপ হয়েছে?’’
সংবিৎ ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই ঠান্ডা জলের ছিটেতে অদম্য কেঁপে উঠলেন, বিরক্ত হয়ে মুখ ঘোরালেন, ‘‘আহ! ঠান্ডার মধ্যে জল ছেটাচ্ছ কেন? অশিক্ষিত কোথাকার!’’
আভা থতোমতো খেয়ে গেল৷ বলল, ‘‘খেতে ডাকতে এসে ভয় পেয়ে গেছিলাম৷ আপনি কিছুতেই সাড়া দিচ্ছিলেন না৷ ঘুমও ভাঙছে না৷ তাই বাবা বলল জলের ছিটে দিতে৷’’
অদম্য কোনোমতে উঠে বসে চোখমুখ মুছলেন৷ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, রাত সাড়ে ন-টা৷ মুহূর্তে অনুভব করলেন একটু আগের সঙ্গমে রতিরসে সিক্ত হয়ে ভিজে উঠেছে তাঁর অন্তর্বাস৷
আবারও তিনি পরাভূত হলেন এক অলৌকিক শক্তির কাছে৷ তাঁর শরীর আবারও ধরা দিয়েছে সেই অশরীরীর ছলাকলায়৷
পরক্ষণেই নিজের প্রতি প্রচণ্ড রাগ হল অদম্যর৷ ভূতপ্রেত, অশরীরী, অলৌকিক—একজন আগাগোড়া বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে, একজন যুক্তিবাদী মানুষ হয়ে তিনি এ-সব কী ভাবছেন? মানুষের একটাই জীবন, ইহকাল৷ মারা যাওয়ার পর সেই জীবনের কিছুই থাকে না৷
তাইজন্যই তো তিনি শুধুমাত্র নিজের জন্য বাঁচতে চান৷ এ জগতে সবই লৌকিক৷ অলৌকিক বলে কিছু নেই৷
কিন্তু তাঁর সঙ্গে যা ঘটে চলেছে, সেইগুলো তবে কী?
অদম্য মুখে বললেন, ‘‘আমি ঠিক আছি৷ আজ আর কিছু খাব না৷ তোমরা খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো৷’’
কথা বলতে বলতে তিনি বিছানার একপাশে পড়ে থাকা মোবাইল ফোনটা তুলে নিলেন৷ জার্নালে তাঁর পেপার নিয়ে লেখা সমালোচনার ছবিগুলো তুলে পাঠাতে হবে সঞ্চয়নকে৷ কয়েকটা প্রশ্নের যৌক্তিকতা নিয়ে তিনি দোলাচলে৷
বুল্টু, আভা এবং তার বাবা কখন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে৷ অদম্য ছবিটা তুললেন৷ তারপর সঞ্চয়নকে সেটা পাঠাতে গিয়ে ফোনের গ্যালারির শেষ ছবিটা দেখে থমকে গেলেন৷
ছবিটা তোলা হয়েছে আজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়৷ যে-সময় তিনি প্রাণপণে সহ্য করছিলেন লেপের তলায় ঘটে চলা সেই অদ্ভুতুড়ে দৌরাত্ম্য৷ ঘরে যে কেউ ছিল না সেই ব্যাপারে তিনি নিঃসন্দেহ৷ ছবিতে অদম্য চোখ বুজে আধশোয়া হয়ে বসে রয়েছেন৷ দূরত্ব একেবারেই কাছাকাছি৷ অর্থাৎ বিছানায় বসে ছবিটা কেউ তুললে যেমন হয়৷
অদম্যর অবসন্ন শরীরে আবার একটা বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেল৷
ছবিটা কে তুলল?
৷৷তিন৷৷
মেয়েটা তার কালো চশমার লেন্সের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘‘এই ব্যাপারটার ক্ল্যারিফিকেশন পাওয়া খুব কঠিন নয় ডঃ পাল৷ আপনার স্ত্রীই হয়তো ছবিটা তুলেছিলেন৷’’
অদম্য মাথা নাড়লেন, ‘‘ইমপসিবল৷ আমার স্ত্রী একেবারে গ্রাম্য৷ সে ছবি তোলা দূর, এইসব স্মার্টফোন অপারেটই করতে পারে না৷ আর আমার ফোনে বিনা অনুমতিতে হাত দেওয়ার সাহস তার নেই৷’’
‘‘আপনার ছেলে? আজকালকার বাচ্চারা খুব ইনটেলিজেন্ট হয়৷’’
অদম্যর গলার স্বরে শ্লেষ ঝরে পড়ল, ‘‘গাঁয়ের এঁদো স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে কলকাতার বাচ্চাদের গোলাবেন না৷ ওরা অত এক্সপার্ট নয় এসবে৷ তা ছাড়া আমার ফোনে পাসওয়ার্ড দেওয়া আছে৷ আর এমনিতেও আমার ছেলে পারতপক্ষে আমার কাছে ঘেঁষে না৷’’
মেয়েটা হয়তো ইচ্ছে করেই আর শ্বশুরমশাইয়ের সম্ভাবনাটা বলল না, গম্ভীর মুখে নিজের চেয়ারে হেলান দিল৷
ধীমান বললেন, ‘‘কী আশ্চর্য ব্যাপার বলুন তো ম্যাডাম!’’
অদম্য মুখ বেঁকালেন৷ মেয়েটার বয়স মেরেকেটে পঁচিশ-ছাব্বিশ৷ এ কীভাবে সাহায্য করতে পারবে তাঁকে?
এখন একঘণ্টা এই মেয়েটার সঙ্গে বসে বকবক করাটাই একটা বেকার কাজ৷ ডঃ সাম্য চট্টরাজ যে একজন মহিলার কাছে তাঁকে কাডন্সেলিং করতে পাঠাবেন, তা তিনি ভাবতেও পারেননি৷ চেম্বারে এসে নাম দেখেই তিনি ফেরত চলে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাগড়া দিলেন ধীমান৷
‘‘তোর এই মিসোগাইনিস্ট স্বভাব আর যাবে না অদম্য৷ মেয়ে তো কী! ডঃ চট্টরাজ যখন পাঠিয়েছেন, নিশ্চয়ই ভালো হবে৷’’
‘‘ধুৎ!’’ অদম্য তখনো অনমনীয় ছিলেন, ‘‘আমি যাব না৷ একটা মেয়ের সঙ্গে এই ব্যাপারে আলোচনা করাটাই অস্বস্তির৷’’
‘‘দ্যাখ৷ তোর জন্য আমি আজ স্কুল কামাই করে এসেছি৷’’ ধীমান তখন ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়েছিলেন, ‘‘যদি না যাস, আমি তোর আর কোনো ব্যাপারে নেই, বলে দিলাম৷’’
অগত্যা ইচ্ছে না থাকতেও অদম্যকে ভেতরে ঢুকতে হয়েছে৷
কী যেন নাম লেখা ছিল বাইরে? মিলি না কী যেন!
বেজার মুখে অদম্য রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন৷
মেয়েটা বলল, ‘‘আচ্ছা, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি৷ কিছু মনে করবেন না৷ আমাকে তো পুরোটা জানতে হবে৷ আপনি যে এইভাবে প্রায়দিন সেক্স করছেন বা আপনাকে করানো হচ্ছে, আপনার শরীরের যে যে পার্টসে তার স্পর্শ আপনি অনুভব করছেন, সবকিছু মেটার পর সেখানে কোনো দাগ দেখতে পাচ্ছেন? কোনো কামড়ানো বা আঁচড়ানোর দাগ?’’
কী প্রশ্নের ছিরি! লজ্জাশরম বলে কিছুই নেই৷ অদম্যর গা চিড়বিড় করে উঠল, কটমট করে তিনি ধীমানের দিকে তাকালেন৷ নির্ঘাত মেয়েটার এখনো কোনো সঙ্গমের অভিজ্ঞতা হয়নি৷ হলে বুঝতে পারত, নেহাত ধর্ষকামী না হলে কেউ ওসব কাজ করে না৷
যতসব ডেঁপো মেয়েছেলে!
মুখে বললেন, ‘‘না৷ সেরকম কিছু লক্ষ করিনি৷’’
‘‘হুম৷’’ মেয়েটা কিছুক্ষণ হাতে থাকা পেনটাকে হাতের সামনের খোলা কাগজের প্যাডের ওপর বোলাল৷ তারপর একটা আশ্চর্য কথা বলল৷
‘‘আপনি সাকিউবাসের নাম শুনেছেন?’’
অদম্য মাথা নাড়লেন, ‘‘না শুনিনি৷ সেটা আবার কী?’’
‘‘ইনকিউবাস? তাও শোনেননি?’’
‘‘না৷’’ অদম্যর বিরক্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল, ‘‘এগুলো কী? কোনো ওষুধের নাম?’’
‘‘না৷’’ মেয়েটা একনাগাড়ে পেনটা দিয়ে হিজিবিজি কেটে যাচ্ছিল প্যাডের ওপর৷ এবার সেটা থামিয়ে বলল, ‘‘সাকিউবাস হল একধরনের প্রেতিনী যারা জীবিত পুরুষের ঘুম বা ওই জাতীয় কোনো উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে তাকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করে, উত্তেজিত করে৷ তারপর তার সঙ্গে একরকম জোর করেই সঙ্গম করে৷ পুরুষটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও সেই অবস্থায় তার কিছু করার থাকে না৷ সাকিউবাসের মতোই ইনকিউবাস হল অশরীরী প্রেত যারা জীবিত নারীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ করে৷ আমার মনে হয়, আপনার ওপর কোনো সাকিউবাসের নজর পড়েছে৷’’
অদম্য হতবাক হয়ে ধীমানের দিকে তাকালেন৷ কী বলবেন ভেবে পেলেন না৷ এই মেয়েটা একজন মনোবিদ হয়ে এইসব গাঁজাখুরি শোনাচ্ছে?
হ্যাঁ, তিনিও কখনো কখনো ক্ষণিকের দুর্বলতায় যে এসব ভাবেননি তা নয়, কিন্তু একজন পেশাদার সাইকোলজিস্ট কী করে এসব আষাঢ়ে গল্প শোনাতে পারে?
সাধে কি অদম্য মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, মেয়েদের বুদ্ধি হাঁটুতে থাকে?
ধীমান কিন্তু খুব সিরিয়াস মুখে বললেন, ‘‘কী বলছেন ম্যাডাম! সাকিউবাস! এরা থাকে কোথায়? মানে এরা বেছে বেছে অদম্যকে ধরল কেন?’’
‘‘এরা নয়৷ এ৷ একবচন৷’’ মেয়েটা নির্বিকার মুখে বলল, ‘‘ওইভাবে বলা তো সম্ভব নয় ধীমানবাবু৷ খ্রিস্টানদের বাইবেল বা ইহুদিদের জোহারেও সাকিউবাস-ইনকিউবাসের উল্লেখ আছে৷ এরা মৃত্যুর পর কোনোরকম অতৃপ্তির কারণে এইসব করে৷ সাধারণত জীবিত পুরুষটি তার না-পাওয়া প্রেমিক হয়৷ সাকিউবাস চেনার সহজ নিয়ম হল, মিলনের সময় মনে হয় কোনো বরফঠান্ডা গহ্বরে প্রবেশ করানো হচ্ছে আপনার পুরুষাঙ্গকে৷’’
কথাটা শেষ করে মেয়েটা সোজা তাকাল অদম্যর দিকে, ‘‘আপনার কি আগে কোনো বিয়ে হয়েছিল? বা কোনো প্রেম? যাতে আপনি শারীরিক সংসর্গে রাজি হননি?’’
অদম্যর ইচ্ছা হল টেবিলে রাখা ফুলদানিটা তুলে মেয়েটার মাথায় দুম করে আছাড় মারতে৷ অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলেন তিনি৷
গম্ভীর মুখে বললেন, ‘‘শুনুন ম্যাডাম, মলিকিউলার বায়োকেমিস্ট্রির জগতে আমি একজন প্রথম সারির সায়েন্টিস্ট৷ দিনরাত রিসার্চেই আমার সময় কাটে৷ আপনার বয়স খুব অল্প, বুঝতে পারছি, যৌবনের ধর্ম মেনে আপনি এসব ব্যাপারে খুব আগ্রহী৷ কিন্তু আমি ওই ধরনের নই৷ দেশকে, সমাজকে, পৃথিবীকে আমার অনেক কিছু দেওয়ার আছে৷ এইসব সেক্স, প্রেম, ভালোবাসার মতো ছেঁদো ব্যাপারে মেয়েদের পেছনে সময় নষ্ট করার জন্য অদম্য পাল জন্মায়নি৷’’
কথাটা শেষ করেই উঠে দাঁড়ালেন অদম্য, ‘‘ধীমান, আমি বেরোচ্ছি৷ তুই এলে আয়৷’’
ধীমান কোনো দ্বিরুক্তি করলেন না৷ পেছন পেছন উঠে যন্ত্রচালিতের মতো বেরিয়ে এলেন৷ মেয়েটার মুখের অবস্থা কেমন হয়েছিল, তা দেখার জন্য অদম্যর উদগ্র কৌতূহল হলেও তিনি পেছন ফিরলেন না৷
ফেরার সময় গাড়িতে কেউ তেমন কোনো কথা বললেন না৷
নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে অদম্য আলমারি থেকে একটা বোতল বের করলেন৷ তা থেকে দুটো গ্লাসে অল্প করে পানীয় ঢেলে তাতে জল মিশিয়ে বন্ধুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন, ‘‘ধর৷ আগের মাসে স্পেন থেকে এই হুইস্কিটা এনেছি৷ দারুণ ভালো খেতে৷ সকাল থেকে তুই আমার কাজ নষ্ট করিয়ে যে বাঁশটা দিলি, তার জন্য এই প্রাইজ৷’’
ধীমান সবসময়েই অনেক কথা বলেন৷ কিন্তু অনেকক্ষণ তিনি মুখ খোলেননি৷ এখনো বিনাবাক্যব্যয়ে হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিলেন৷
অদম্য গ্লাসে চুমুক দিয়ে তাঁর খোলা টেরেসের চেয়ারে বসলেন৷ এখান থেকে শহরের অনেকটা জায়গা একসঙ্গে দেখা যায়৷
সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘ওহ! আজ ভোরে সব বিদায় হয়েছে, একটু শান্তিতে থাকতে পারব৷ দু-দিন যেন হইচইতে মাথা ধরে যাচ্ছিল!’’
ধীমান এবারেও কোনো কথা বললেন না৷ গ্লাসেও ঠোঁট ঠেকাননি৷ গভীর মনোযোগের সঙ্গে কী যেন চিন্তা করছেন তিনি৷
‘‘কীরে, কী ভাবছিস তুই?’’ অদম্য পেটে সামান্য তরল পড়লেই বেশ প্রগলভ হয়ে ওঠেন৷ হ্যা হ্যা করে বেশ অশ্লীলভাবে হেসে বললেন, ‘‘ওই শুঁটকে মেয়েটার কথা? নাকি ওই কী সাকু না কী বলছিল…হা হা!’’
‘‘অদম্য৷’’ খুব অনুচ্চস্বরে অনেক দূর থেকে যেন ডাকলেন ধীমান, ‘‘তোর লিলিকে মনে আছে?’’
অদম্য হাসতে হাসতে কেমন যেন থমকে গেলেন৷ আস্তে আস্তে গাঢ় হওয়া নেশার আমেজটা যেন হঠাৎ করেই কেটে গেল খানিকটা৷
গ্লাসটা শক্ত করে ধরে অদম্য বললেন, ‘‘হঠাৎ লিলির কথা?’’
‘‘না এমনি৷’’ ধীমান দূরের আকাশছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্টগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘মেয়েটা কিন্তু তোকে খুব ভালোবাসত৷’’
অদম্য অনেকটা তরল ঢকঢক করে গলায় ঢাললেন৷ তেতোমুখে বললেন, ‘‘তো?’’
‘‘তো কিছুই নয়৷’’ ধীমান মাথা নাড়লেন, ‘‘কেন জানি না, বহুদিন আগে পড়া একটা গল্প মনে পড়ে গেল৷’’
‘‘কী গল্প?’’
‘‘গল্প ঠিক নয়, বিদেশি উপকথা বলতে পারিস৷ আমার তো জানিসই নানা দেশের বইপত্র পড়ার শখ৷’’ ধীমান বললেন, ‘‘পুরাণ মতে পৃথিবীর প্রথম পুরুষ আর নারী কে জানিস?’’
‘‘ওই তো৷ ছোটবেলায় পড়েছিলাম৷’’ অদম্য বললেন, ‘‘আদম আর ইভ না কী যেন!’’
‘‘হ্যাঁ৷ ঈশ্বর পৃথিবীর মাটি দিয়ে আদমকে তৈরি করেন৷ তারপর আদমের পাঁজরার হাড় দিয়ে তৈরি করেন ইভকে৷ সেই অনুযায়ী আমরা সবাই আদম এবং ইভের বংশধর৷’’
‘‘হুম৷ মনে পড়েছে৷ ওই ইডেন বাগানে আপেল খেয়ে তাদের মধ্যে কামবোধ জেগেছিল৷’’ অদম্য ঘোলাটে চোখে মাথা দোলালেন৷
‘‘ঠিক৷’’ ধীমান বললেন, ‘‘কিন্তু তার মধ্যে আরেকটা ছোট ঘটনা ছিল৷ সেটা পরবর্তীকালে ক্যাথলিক চার্চগুলোর প্রতিবাদে বাইবেল থেকে বাদ দেওয়া হয়৷’’
‘‘কী ঘটনা?’’
‘‘ঈশ্বর প্রথমে শুধু আদমকেই তৈরি করেননি৷ একইসঙ্গে পৃথিবীর মাটি দিয়ে তৈরি করেছিলেন এক নারীকেও৷ তার নাম লিলিথ৷ সে-ই আদমের প্রথম স্ত্রী৷ লিলিথ ছিল খুবই স্বাধীনচেতা নারী৷ তার বুদ্ধি ও শক্তি দুই-ই ছিল আদমের চেয়ে বেশি৷ সে আদমের আদেশ মেনে চলতে অস্বীকার করল৷ দুজনের ঝগড়া লাগল৷ লিলিথ ঈশ্বরকে পরিষ্কার জানাল, আমি আর ও দুজনেই মাটি দিয়ে তৈরি৷ আমার বুদ্ধি ও শক্তি ওর চেয়ে বেশি৷ আমি কেন ওর কথা শুনে চলব? ও কেন আমার ওপর কর্তৃত্ব করবে? বিছানাতেই বা আমি কেন ওর নীচে থাকব? ওকে আমার নীচে থাকতে হবে৷
‘‘এদিকে ক্যাথলিক মতে, নারীর সবসময় পুরুষের আদেশ পালন করা উচিত এবং নারীর স্থান পুরুষের চেয়ে নীচুতে৷ তাই ঈশ্বর তখন লিলিথকে অভিশাপ দিলেন৷ লিলিথ তখন আদমকে ছেড়ে চলে গেল৷ এদিকে আদমের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করবে কে? তখন ঈশ্বর আদমের পাঁজরার হাড় থেকে তৈরি করলেন ইভকে৷ আদমেরই অংশে জন্ম নেওয়া ইভ প্রথম থেকেই হল স্বামীর আজ্ঞাবাহিনী, ঠিক যেমনটি আদম চেয়েছিল৷’’ ধীমান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘হিব্রু বাইবেলে এটার উল্লেখ আছে৷ অথচ সিংহভাগ মানুষই লিলিথকে চেনে না৷ লিলিথ যেন আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে একটা নিষিদ্ধ অধ্যায়৷’’
‘‘যত্তসব গালগল্প!’’ অদম্য আবার ঢকঢক করে অনেকটা পানীয় গলায় ঢাললেন, ‘‘ডারউইন শুনলে ভিরমি খেতেন৷’’
‘‘ভিরমি খেতেন কি না জানি না, কিন্তু…৷’’ ধীমান সোজা তাকালেন অদম্যর দিকে, ‘‘লিলিথ আর লিলি৷ আদম আর অদম্য৷ ইভ আর আভা৷ কী আশ্চর্য অদ্ভুত মিল৷ না?’’
সন্ধে নেমে এসেছে খানিকক্ষণ হল৷ অস্তাচলে ডুবে যাওয়ার সূর্যের লালচে আলো ফিকে হয়ে ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে অন্ধকার৷ সেই আলো-আঁধারিতে ধীমানের চোখগুলোর সামনে কেমন গুটিয়ে গেলেন অদম্য৷
তাচ্ছিল্য ও বিরক্তির অভিব্যক্তি ছাপিয়ে যেন তাঁর নেত্রবলয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠল অপরাধের ছায়া৷
আতঙ্ক যেন জাপটে ধরল তাঁকে৷
কয়েক মাইক্রোসেকেন্ড মাত্র৷ তারপরই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এলেন ডঃ অদম্য পাল৷ এখন তাঁর নেশা পুরোপুরি কেটে গিয়েছে৷ পরিষ্কার উচ্চারণে বললেন, ‘‘সন্ধে হয়েছে৷ বাড়ি যা৷ আমার ফেলো সঞ্চয়ন আসবে একটু পরে৷ আমাদের কিছু কাজ আছে৷ গুড নাইট৷’’
৷৷চার৷৷
প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করছিলেন অদম্য৷ আর্তনাদের প্রাবল্যে যেন মনে হচ্ছিল হূৎপিণ্ডটা গলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে বাইরে৷ উত্তেজনার তীব্রতায় মস্তিষ্কের শিরাগুলো বোধ হয় এখনই বিদ্রোহ ঘোষণা করবে৷ বিছানাজুড়ে তাঁর শরীরটাকে নিয়ে এক জান্তব দাপাদাপি শুরু হয়েছে৷
কিন্তু বরাবরের মতো এবারও বৃথা সেই আস্ফালন৷ একফোঁটা চিৎকারও শব্দ হয়ে বহির্জগতে বেরিয়ে আসছিল না৷ প্রতিবারের মতো অদম্য ভীরু প্রেমিকের মতো বিছানায় চিত হয়ে পড়েছিলেন৷ অপার্থিব সেই নারী ছিল অদম্যর ওপরে, সে একাই শাসন করছিল গোটা সঙ্গমশয্যাকে৷
বরাবরের মতো শৃঙ্গারশেষে ঝড় শান্ত হল৷ রতিক্লান্ত অদম্য তাঁর একা ফ্ল্যাটে মৃতদেহের মতো পড়ে রইলেন বিছানায়৷
তারপর ধীরে ধীরে তাঁর চোখ বেয়ে জল নেমে আসতে লাগল৷
এসব কী শুরু হয়েছে তাঁর সঙ্গে? সামনে তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, ততধিক উজ্জ্বল জীবনটাকে উপভোগ করার সুযোগ৷ কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞানী হিসেবে মোটা মাইনে, আগামী মাসেই পেটেন্টের স্বত্ব বিক্রিতে চূড়ান্ত স্বাক্ষর করতে উড়ে যাওয়ার কথা আমেরিকায়৷ তারপরেই প্লাস্টিকখেকো মাশরুম পেস্টাওলোটিঅপসিস মাইক্রোস্পোরা ছড়িয়ে পড়বে দেশ-বিদেশের প্রতিটি কোনায়৷ আবর্জনায় জমে যাওয়া নদী, প্লাস্টিকে ভরে ওঠা পুকুর, কিংবা সমুদ্রগর্ভে শুয়ে থাকা হাজার হাজার প্লাস্টিক৷
ডঃ পালের ম্যাজিক মাশরুম গিলে খাবে সব৷
ধীরে ধীরে উৎসাহী হবে সব দেশের সরকারও৷ তারা চুক্তি করবে আমেরিকান কোম্পানিটির সঙ্গে৷ দেশ থেকে রাজ্য, রাজ্য থেকে জেলা, পেস্টাওলোটিঅপসিস মাইক্রোস্পোরা সাফ করে দেবে সব প্লাস্টিক বর্জ্য৷
ধীরে ধীরে আগের মতো মালিন্যহীন হয়ে উঠবে পৃথিবী৷
আর ততই ফুলেফেঁপে উঠবে ভারতীয় বৈজ্ঞানিক ডঃ অদম্য পালের নাম৷ পকেট যত ভারী হবে, সুনামও ততই ছড়াবে৷ সবকিছু ঠিকমতো চললে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অদম্য দুটো কৃতিত্বের অধিকারী হবেন৷ এক, পৃথিবীর প্রথম সারির ধনীদের খাতায় নাম তোলা৷ দুই, পরিবেশরক্ষায় যুগান্তকারী অবদানের জন্য তাবড় তাবড় সমস্ত পুরস্কার৷ নোবেল পাওয়াও বিচিত্র নয়৷
সবকিছু পরের পর ছকে ফেলা আছে৷ কোথায় কীভাবে এগোতে হবে, কখন লাটাইয়ের সুতো কোথায় আলগা করতে হবে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোন লবি ধরতে হবে৷
ডঃ অদম্য পাল ব্যক্তিজীবনে স্বার্থপর? আত্মকেন্দ্রিক? নারীবিদ্বেষী? ওসব কেউ মনে রাখবে না৷ ইতিহাসের পাতায় অদম্য পালের নাম লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে, একজন অসাধারণ জনহিতৈষী বৈজ্ঞানিক হিসেবে৷
কিন্তু তার আগে এসব কী? প্রতিরাতের এই ঘটনায় তো ক্রমশ তাঁর মানসিক দৃঢ়তা হারিয়ে যেতে বসেছে৷ তিনি সবসময় অন্যমনস্ক থাকছেন, ভুলোমন হয়ে যাচ্ছেন৷ কথায় কথায় মেজাজ হারাচ্ছেন৷
সেদিন সঞ্চয়ন আসার পর যেভাবে একটা রাসায়নিক বিক্রিয়ার ভুল ব্যাখ্যা তিনি করে চলেছিলেন, তা একজন সাধারণ কলেজ ছাত্রও ধরতে পারবে৷ সঞ্চয়ন ইতস্তত করে ভুলটা ধরিয়ে দিতে তিনি নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন৷ এভাবে চললে তো দেশ-বিদেশের নানা কনফারেন্সে অপদস্থ হতে শুরু করবেন অদম্য!
সঞ্চয়ন অবশ্য বিশেষ কিছু বলেনি৷ শুধু একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেছিল, ‘‘স্যার, অনেকদিন ধরেই একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভাবছি৷ আপনি তো পাইরোলিসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি তৈরি করা নিয়ে রিসার্চ করছিলেন৷ যেহেতু গ্যাসিফিকেশনের চেয়ে পাইরোলিসিস অনেক কম জটিল আর সস্তা৷ হঠাৎ মাশরুমটা কীভাবে বের করলেন?’’
অদম্য বলেছিলেন, ‘‘পাইরোলিসিসটা ছিল আমার অফিশিয়াল পিএইচডির বিষয় সঞ্চয়ন৷ আমার থিসিস ছিল ওটা নিয়েই৷ আমি একা নই, আমাদের টিমে আরো কয়েকজন ছিল৷ আর মাশরুম ব্রিডিংটা ছিল আমার নিজস্ব রিসার্চ ইন্টারেস্ট৷ গাইডের কোনো সাহায্য না নিয়ে আমি একা ওটা নিয়ে কাজ করেছিলাম৷ সেজন্যই আমার ক্রেডিটটা এত বড়ভাবে দেখছে সবাই৷’’
‘‘একই সাথে সম্পূর্ণ দুটো আলাদা বিষয়ে গবেষণা!’’ সঞ্চয়ন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার গাইডের দিকে তাকিয়েছিল, ‘‘আপনি জিনিয়াস স্যার!’’
কিন্তু সত্যিই কি ডঃ অদম্য পালকে লোকে আর বেশিদিন জিনিয়াস বলে ভাববে?
শিশুর মতো হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে অদম্য নিজের খোলা টেরেসে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ এক মুহূর্তের জন্য তাঁর মনে হল, আভা এখানে থাকলে কি তার সঙ্গে নিজের সমস্যা আলোচনা করে তিনি একটুও হালকা হতেন না?
কথাটা মনে হওয়ামাত্র নস্যাৎ করে দিলেন সেই সম্ভাবনা৷ আভার মতো একটা অশিক্ষিত পাড়াগেঁয়ে মেয়ে এসবের কী বুঝবে? গরুর মতো নির্বোধ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকবে আর কান্না জুড়বে৷
ঠিক এইসময়েই তাঁর মনের ভেতর থেকে কেউ যেন স্পষ্ট বলে উঠল, ‘‘আর লিলি থাকলে?’’
লিলির নামটা মনে আসামাত্র অদম্য ছটফটিয়ে উঠলেন৷ নিজের অস্থির ভাবটা কাটাতে একটা সিগারেট ধরাতে গেলেন৷
অদ্ভুত ব্যাপার৷ নতুন লাইটারটা কিছুতেই জ্বলল না৷ দুবার তিনবার চারবার৷ ক্রোধে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে অদম্য সেটাকে ছুড়ে মারলেন টেরেস লাগোয়া কাচে৷ পলকের মধ্যে সেই বহুমূল্য কাচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল৷
নিজের মাথার চুলগুলো টেনে ধরলেন অদম্য৷ কী করছেন তিনি! নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ যে তিনি শত প্রতিকূলতাতেও হারান না৷
জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতি এসেছে৷ মাথা ঠান্ডা রেখে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন অদম্য৷
কিন্তু আজ?
প্রাণপণে না চাইতেও তাঁর মনে পড়ে গেল ধীমানের বলা সেদিনের কথাটা৷
‘‘লিলিথ আর লিলি৷ আদম আর অদম্য৷ ইভ আর আভা৷ কী অদ্ভুত মিল, তাই না!’’
অদম্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ তাঁর জীবনদর্শনের কয়েকটা সুনির্দিষ্ট নীতি আছে৷ তার মধ্যে একটা হল, জীবনের অন্ধকার প্রকোষ্ঠগুলোয় তিনি কখনোই উঁকি মারবেন না৷
কিন্তু আজ যেন তা পারছেন না৷ কিছুতেই পারছেন না বছর সতেরো আগে পিছিয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে৷
না চাইতেও মন দুর্বার স্রোতের মতো চলে যাচ্ছে কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ার সময় দেখা সেই ছোট কোঁকড়ানো চুলের শ্যামলা মেয়েটার দিকে৷
লিলি৷ লিলি মৈত্র৷ অদম্য এবং ধীমানের কলেজ সহপাঠিনী৷ ধীমানের যদিও বিষয় ইংরেজি৷ অদম্য আর লিলির বিষয় এক, কেমিস্ট্রি৷ নিজের আবাল্য নারীবিদ্বেষের কারণে গ্র্যাজুয়েশনের প্রথম বছরে লিলিকে ঠিক করে চিনতেনও না অদম্য৷ ওই মুখচেনা আর কী৷ মেয়েদের সঙ্গে আবার কী কথা বলবেন? কী জানে ওরা?
কিন্তু প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় কলেজ তো বটেই, গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কেমিস্ট্রি অনার্সে প্রথম হয়ে একবছরের মধ্যেই লিলি মৈত্র বিখ্যাত হয়ে উঠল৷
চিরজীবন স্কুলে প্রথম এবং চোখধাঁধানো রেজাল্ট করা ছাত্র অদম্যকে কলেজের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল৷
ফুঁসে উঠল অদম্যর পুরুষালি ইগো৷ কিন্তু আড্ডা, বিনোদন সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে দিনরাত এক করে গোটা বছরটা পড়েও পরের বার যথারীতি দ্বিতীয় স্থান৷ এবং লিলি আবার ইউনিভার্সিটির মধ্যে সেরা৷
আলাপটা হয়েছিল তৃতীয়বর্ষে উঠে৷ অদম্যই গিয়ে প্রথম কথা বলেছিলেন৷ হাসিখুশি, বাইরের কোনো মফস্সল থেকে শহরে পড়তে আসা লিলি স্বভাবসিদ্ধভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল বন্ধুত্বের হাত৷
তারপর কোথা থেকে কী হল, লিলি প্রেমে পড়ল অদম্যর৷
অদম্যও কি ভালোবেসেছিলেন লিলিকে?
রাতের মিটমিট করে জ্বলা তারাগুলো মুহূর্তে বলে উঠল, ‘‘না৷ বাসেনি৷ চেয়েছিল মেয়েটার পড়া ভণ্ডুল করতে৷’’
ঠিক তাই৷ অদম্য চেয়েছিলেন প্রেমের জালে ক্রমশ ফাঁসিয়ে লিলির রেজাল্ট খারাপ করাতে৷ যাতে চূড়ান্ত বর্ষের সেরা ছাত্র হিসেবে তাঁরই নাম থাকে৷
লিলি মেসে থাকত৷ সময়ে ক্লাস করত৷ সময়ে চলে যেত মেসের ঘরে৷ সেখানে নিজের জন্য রান্নাবান্না, কাচাকুচি সবই তাকে নিজের হাতে করতে হত৷ তাই একটুও সময় অপচয় করত না সে, প্রথম আলাপেই এ-কথা জানিয়েছিল অদম্যকে৷
অদম্য প্ল্যান করলেন, মেয়েটার মেসে ঢোকার সময়টাই এত দেরি করিয়ে দিতে হবে যে ঘরে ফিরে কাজকর্ম সামলে সে আর একটুও পড়ার সময় না পায়৷ অদম্যর কোনো অসুবিধা নেই, তাঁকে বাড়িতে জলের গ্লাসটা পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া হয়, পড়াশোনো ঠিক হয়ে যাবে৷
তেমনই হল৷ প্রতিদিনই ক্লাস শেষে অদম্য আর লিলি ঘুরে বেড়াতে লাগল শহরের এদিক থেকে ওদিকে৷ কোনোদিন ভিক্টোরিয়া, তো কোনোদিন প্রিন্সেপ ঘাট৷ সদ্যতরুণী লিলির মনে তখন প্রেমের রঙিন বুদ্বুদের ছোঁয়া৷ অদম্যর সামান্য প্রেম প্রেম চাহনি, আলগা হাত ধরাতেই সে কাত৷ প্রেমিকের পকেটে কোনোদিন গুঁজে দিচ্ছে নিজের স্কলারশিপের টাকা, কোনোদিন দিচ্ছে নিজের সযত্নে বানানো পড়ার নোট৷
এত কিছু করে অদম্য সফল হলেন ঠিকই, কিন্তু প্রায় কান ঘেঁষে বেরিয়ে এলেন৷ তিনি প্রথম হলেন, লিলি দ্বিতীয়৷ তাও মাত্র পাঁচ নম্বরের জন্য৷
লিলি সেদিন প্রেমিকের সাফল্যের আনন্দে আত্মহারা, কিন্তু অদম্য কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেন না৷ কী একটা পোকা যেন তাঁর ভেতরটাকে খুবলে খাচ্ছে৷
এইভাবেই শেষ হল এম.এসসি-রও দুটো বছর৷ সেখানে অদম্য প্রথম বছরে টেক্কা দিলেও পরের বছরে আবার লিলি শীর্ষস্থানে৷
দাঁতে দাঁত চেপেন অদম্য৷ শুধু নিজের বিষয় নয়, লিলির সব বিষয়েই দারুণ জ্ঞান৷ সে যেমন সহজভাবে মিশতে পারে মানুষের সঙ্গে, তেমনই ইতিহাস থেকে ভূগোল, রাজনীতি থেকে খেলা সব ব্যাপারেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করে যেতে পারে৷ সাংস্কৃতিক দিকেও সে পিছিয়ে নেই৷ কলেজে সে ছিল কালচারাল সেক্রেটারি, আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্টেও তাই৷
লিলি যেন একটা নক্ষত্র, তার আলোয় আলোকিত হয়ে মামুলি একটা গ্রহের মতো বিচরণ করেন অদম্য৷
এভাবেই সময় কাটে৷ এম.এসসি-র পর শুরু হল পিএইচডি৷ একই গাইডের অধীনে৷ একই টিমে৷
ততদিনে অদম্যর মুখোশ খসে পড়েছে, ছোটখাটো বিষয়ে তখন তীব্র কথার আঘাতে শ্লেষের বাণে জর্জরিত হতে হচ্ছে লিলিকে৷ লিলি আহত হচ্ছে, এতদিনের প্রেমিকের এমন ব্যবহারে রক্তাক্ত হচ্ছে সে৷ কিন্তু ফিনিক্স পাখির মতো উঠে এসে আবার আঁকড়ে ধরছে অদম্যকে৷ সে ছাড়া যে এই শহরে তার কেউ নেই!
লিলি যত ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে অপমান, অদম্য তত হিংস্রভাবে আক্রমণ করছেন তাকে৷ পাণ্ডিত্যে, বুদ্ধিতে লিলির নখের যোগ্য নন জেনেও প্রকাশ্যে বন্ধুমহলে বা যেখানে-সেখানে বিদ্রূপ করছেন তাকে, উপহাস করছেন মেয়েদের অপদার্থতা নিয়ে৷ ওদিকে আড়ালে নির্বিকারে ভাগ বসাচ্ছেন লিলির স্টাইপেন্ডের টাকায়, কিংবা বেমালুম নিয়ে নিচ্ছেন দামি সব বই৷
আজ এতবছর পর গোটা পর্যায়টার স্মৃতি রোমন্থন করে চমকে উঠলেন অদম্য৷
তাঁর মতো একজন নারীবিদ্বেষী পরশ্রীকাতরকে লিলি ভালোবেসেছিল কেন?
কে জানে কেন৷ প্রেমে তো লোকে কারণকার্য ছাড়াই পড়ে, অদম্যর মতো অঙ্ক কষে নয়৷
লিলি যেদিন আত্মহত্যা করেছিল, অদম্য সেদিন ব্যস্ত ছিলেন বন্ধুমহলে কলার ওড়াতে৷ তাঁর পেস্টাওলোটিঅপসিস মাইক্রোস্পোরা মাশরুমের আবিষ্কার সংক্রান্ত পেপারটা দু-দিন আগেই প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্বের প্রথম সারির এক রিসার্চ জার্নালে৷ যে জার্নালে তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের একটা পেপার ছাপা হলে হইচই পড়ে যায়, সেখানে একজন তরুণ গবেষকের এমন দুর্দান্ত আবিষ্কারের কথা ছাপা হতে উল্কার গতিতে হিরো বনে গিয়েছিলেন অদম্য৷
সাত বছর হতে চলল লিলি চলে গিয়েছে৷ এই সাত বছরে আমূল বদলে গিয়েছে অদম্যর জীবন৷ ওই গবেষণাপত্রের জোরে একরকম যেচে তাঁকে চাকরি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার অধীনস্থ গবেষণা সংস্থা৷ এই সাত বছরের প্রায় প্রতিটা দিন অদম্য ব্যস্ত থেকেছেন নিজের সন্তানসম সেই মাশরুমকে যতটা সম্ভব বেশিমূল্যে বিক্রির জন্য দর কষতে৷
সজোরে মোবাইল ফোন বেজে উঠতেই অদম্য চমকে উঠলেন৷ অতীত থেকে যেন মুহূর্তে ফিরে এলেন বাস্তবে৷ ঘরে গিয়ে ফোন রিসিভ করলেন৷
ওই প্রান্তে ধীমান৷
‘‘ঘুমোচ্ছিলি?’’
‘‘না৷ বল৷’’
‘‘আজকেও হয়েছে নাকি?’’
অদম্য একটু থামলেন৷ তারপর বললেন, ‘‘হয়েছে৷’’
ধীমান এবার চুপ করে গেলেন৷ কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘‘একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করে তোকে ফোন করছি৷’’
‘‘বল৷’’ ক্লান্তস্বরে বললেন অদম্য৷ তাঁর জীবনে অদ্ভুত ব্যাপার এখন এত ঘনঘন ঘটে চলেছে যে তিনি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ছেন৷
‘‘সেদিন সাইকোলজিস্ট মেয়েটা ইহুদিদের প্রাচীন গ্রন্থ জোহারে ইনকিউবাস, সাকিউবাসের কথা রয়েছে বলেছিল মনে আছে?’’
‘‘আছে৷’’
‘‘সেসব নিয়েই রাতের খাওয়া সেরে একটু নাড়াঘাঁটা করছিলাম৷ সেখানে কী ইন্টারেস্টিং জিনিস জানতে পারলাম জানিস?’’
‘‘কী?’’
‘‘পৃথিবীর প্রথম সাকিউবাস কে ছিল বল তো?’’ সাপের বাঁশির মতো ফিসফিস করে বলল ধীমান, ‘‘আদমের প্রথম বউ লিলিথ৷ ঈশ্বর তাকে নির্বাসিত করার পর সে সাকিউবাস হয়ে যায়৷’’
অদম্যর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল৷ মনে হল উল্টে পড়ে যাবেন মেঝেতে৷ কোনোক্রমে বললেন, ‘‘তো?’’
ধীমান আবার চাপা গলায় বললেন, ‘‘তোর চোখে পড়ছে না এতগুলো মিল?’’
ফোনটা কখন কেটে গিয়েছে বা আদৌ কেটেছে কিনা খেয়াল করেননি অদম্য৷ ততক্ষণে তিনি টলতে টলতে বসে পড়েছেন বিছানায়৷
মাথায় ঘুরছে ধীমানের কথাগুলো৷ লিলিথ, আদমের প্রথম স্ত্রীর বুদ্ধি ও শক্তি দুই-ই ছিল আদমের চেয়ে বেশি৷
লিলিও তো তাই ছিল!
লিলিথ দাবি করেছিল, বিছানাতেও সে থাকবে স্বামীর ওপরে৷
বিদ্যুৎচমকের মতো অদম্যর মনে হল, যে অদৃশ্য কুহকিনীর সঙ্গে তিনি ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাতের পর রাত যৌনাচারে লিপ্ত হচ্ছেন, একটি দিনের জন্যও সে অদম্যর নীচে থাকেনি৷ প্রতিবার রাশ রেখেছে নিজের হাতে, অদম্যকে ওঠবোস করিয়েছে নিজের ইচ্ছামতো৷
বিদ্যুৎচমকের মতো তাঁর মনে পড়ে গেল, কয়েকদিন আগের একটা কথা৷ যেদিন বাড়িতে আভারা এসেছিল৷ তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন, জ্ঞান ফিরে আসার মুহূর্তে শুনেছিলেন, ছেলে বুল্টু বলছে আরেকটু আগে তাঁর ঘুম ভাঙলে তিনি লিলিমাসির সঙ্গে আলাপ করাতে পারতেন৷ লিলিমাসি নাকি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গিয়েছে৷
অদম্য দরদর করে ঘামতে লাগলেন৷
কে এই লিলিমাসি? বুল্টু তো কলকাতায় সেভাবে কাউকে চেনে না!
অদম্য আবার চোখে অন্ধকার দেখছিলেন৷ বুঝতে পারছিলেন তিনি এখুনিই আবার অজ্ঞান হয়ে যাবেন৷
জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে তাঁর মনে হল, লিলি কি প্রতিশোধ নিচ্ছে? একদিকে সে সাকিউবাস হয়ে শেষ করছে অদম্যকে, অন্যদিকে কোনো এক অলৌকিক উপায়ে এসে হানা দিচ্ছে অদম্যর ফ্ল্যাটে?
এভাবেই তিলে তিলে অদম্যকে শেষ করে মেটাচ্ছে নিজের প্রতিহিংসা?
কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? লিলি তো মৃত!
৷৷পাঁচ৷৷
দু-দিন পরের এক ভোররাত৷ ধীমানের মোবাইল ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল৷ ঘুম-জড়ানো গলায় ফোনটা রিসিভ করলেন তিনি, ‘‘বলো মিলি৷ এত সকালে?’’
মিলি এক মুহূর্ত থেমে বলল, ‘‘ধীমানদা, ডঃ পাল কোথায় যেন চলে গেছেন৷’’
‘‘চলে গেছেন মানে?’’ ধীমানের ঘুম কেটে গেল, ‘‘কোথায়?’’
‘‘জানি না৷’’ মিলি বলল, ‘‘ভাইকে একটা বড় ইমেল করে গিয়েছেন৷ সেটা আপনাকে ফরোয়ার্ড করেছি৷ চেক করে আমাকে ফোন করুন৷’’
ধীমান উল্কার গতিতে ফোনে মেলবক্স খোলেন৷ আঙুল ঘষে বারবার রিফ্রেশ করতে থাকেন নতুন ইমেলের আগমন সংবাদ পেতে৷
অবশেষে মেলটা দেখতে পান তিনি৷
দ্রুত চোখ বোলাতে থাকেন সেখানে৷
‘‘প্রিয় সঞ্চয়ন,
তুমি ছাড়া সেভাবে কারুর সঙ্গে আমি দিনের এতটা সময় কাটাই না৷ তুমি ছাড়া আমার কাজের ক্ষেত্রটাও কেউ বিশদে বুঝবে না৷ তাই সবদিক বিবেচনা করে তোমাকেই লিখছি৷ আমার পদত্যাগপত্রটা আমি অফিসে ইমেল করে দিয়েছি৷ তুমি সেটা একটু দেখো, যাতে তাড়াতাড়ি প্রসেস হয়৷ তাহলে বকেয়া টাকাপয়সা আমার স্ত্রীর পেতে সুবিধা হবে৷
কোনো গৌরচন্দ্রিকা না করেই প্রথমে বলি, সাত বছর আগে আমি একটা চুরি করেছিলাম৷ আমাদের গবেষণার জগতে ইচ্ছে করে সাইটেশন এড়িয়ে যাওয়া বা ক্ষমতাবলে গাইডের নাম পেপারে ঢোকানোর মতো দুর্নীতি বিরল নয়৷ আকছার হয়ে থাকে৷
কিন্তু আমি যেটা করেছিলাম, সেটাকে চুরি না বলে একধরনের ডাকাতি বলা চলে৷ কারণ তাতে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিল এক অসাধারণ মেধাকে৷ জীবন শেষ করে দিতে বাধ্য করা হয়েছিল এক মেধাবী গবেষককে৷
যে বেঁচে থাকলে আজ হয়তো আমাদের দেশ এক অনন্যসাধারণ বৈজ্ঞানিক পেত৷
পেস্টাওলোটিঅপসিস মাইক্রোস্পোরা নামক যে প্লাস্টিকখেকো মাশরুমটির জন্য আমার এত খ্যাতি, সেটা আমি আবিষ্কার করিনি৷ করেছিল আমারই সহ-গবেষক লিলি মৈত্র৷
সে শুধুই আমার কো-রিসার্চার ছিল না, আমাদের মধ্যে বহুদিনের প্রেমের সম্পর্কও ছিল৷ কিন্তু সেই প্রেম ছিল একেবারেই একতরফা৷ লিলি আমাকে তার মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল৷ আর আমি অনেকরকম হিসেব কষে নিজের স্বার্থের জন্য তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছিলাম৷
আমাদের দীর্ঘ দশ বছরের প্রেমপর্বে আমি কতরকমভাবে তাকে ব্যবহার করেছি, তার থেকে অন্যায় সুবিধা নিয়েছি, ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে বিপদে ফেলেছি, অপদস্থ করেছি, তা বলতে গেলে একটা উপন্যাস হয়ে যাবে৷ তাই সেই বিশদে যাচ্ছি না৷ শেষের দিকে লিলি নিজেও বুঝতে পেরেছিল আমি তাকে কীভাবে সবদিক থেকে নিংড়ে নিচ্ছি; কিন্তু আমার প্রতি তার ভালোবাসা এতই তীব্র ছিল যে, সে আমার থেকে সরে যাওয়া তো দূর, কোনো প্রতিবাদও করতে পারত না৷
তার ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত মেধা৷ আমি কোনোভাবেই তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতাম না৷ আর ততই আমার মনে জাঁকিয়ে বসত রাগ, হিংসা৷
মেয়েদের আমি চিরকাল বড় নীচু চোখে দেখে এসেছি, বরাবর চেয়েছি আমার জীবনসঙ্গিনী থাকবে আমার পায়ের তলায়৷ কিন্তু ক্রমশই উলটপুরাণ হয়ে যাচ্ছিল৷ একটা মেয়ের কাছে ক্রমাগত পরাজয়ের গ্লানি আমি আর নিতে পারছিলাম না৷
তাই, আমাদের পিএইচডি-র বছরগুলোয় লিলি যখন সারা দিনরাত মুখ গুঁজে থাকত মাইক্রোস্কোপে, কোনোমতে মেসে গিয়ে নাওয়াখাওয়া করেই আবার চলে আসত ল্যাবে, আমার ততই কাজের প্রতি উৎসাহের থেকে বেশি হয়ে উঠছিল রাগ৷
তাই তার অমানুষিক পরিশ্রম শেষে পিএচডি-র ষষ্ঠ বছরে একদিন সে যখন আমাকে জানাল, সে এক আশ্চর্য মাশরুম সংকরায়ণের মাধ্যমে তৈরি করেছে, যা গিলে ফেলবে প্লাস্টিক, আমি মনে মনে লাফিয়ে উঠলাম৷
বুঝে ফেললাম, এই আমার সুবর্ণসুযোগ! এতদিন যাই হয়ে আসুক না কেন, গোটা বিশ্বের আলো আমার মুখে ফেলার সম্ভবত এই শেষ সুযোগ৷ একে হাতছাড়া করা কিছুতেই যাবে না৷ এই একটা জিনিস আমার গোটা জীবনটাকেই পাল্টে দেবে৷
বিদেশি এক বিখ্যাত জার্নালের জন্য সে যখন তার গবেষণাপত্রটা পুরো তৈরি করে ফেলেছে, পাঠানোটুকু বাকি, খুব স্বাভাবিকভাবে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পেপারটা একদিন পড়তে চাইলাম আমি৷ আমি তার প্রেমিক, সে খুব নিশ্চিন্ত মনে আমার হাতে তুলে দিল তার সেই অমূল্য সম্পদ৷ একফোঁটাও অবিশ্বাস জাগেনি তার মনে৷
আমি এক রাতের মধ্যে সেটাকে নকল করে নিজের নামে পাঠিয়ে দিলাম৷ সাধারণত এ-সমস্ত জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য রিসার্চ গাইডের রেকমেন্ডেশনের প্রয়োজন হয়৷ কিন্তু জানাজানির ভয়ে আমি সেসবের ধার ধারলাম না৷ কারণ আমি জানতাম, আবিষ্কারটি এতই যুগান্তকারী, রেকমেন্ডেশন না থাকলেও প্রকাশিত হবেই৷
লিলি অসাধারণ মেধাবিনী হলেও একটু অলস ছিল৷ গড়িমসি করে তার পেপারটা ডাকে পাঠানোর আগেই আমার নামে অবিকল ছাপা হয়ে গেল সেটা৷
ও প্রথমে গোটা ব্যাপারটা জানতে পেরে হতবুদ্ধি হয়ে গেল৷ দেড়বছর ধরে সে নর্মদা নদীর তীরের নানা অরণ্যে ঘুরে সংগ্রহ করেছিল বিভিন্ন ছত্রাক, যাদের সম্মিলিত পরীক্ষালব্ধ সংকরায়ণ ওই পেস্টাওলোটিঅপসিস মাইক্রোস্পোরা৷ এইজন্য সে কতদিন ঠিকমতো খায়নি, কোনো বিনোদনে যোগ দেয়নি৷
তার সেই অধ্যবসায়, পরিশ্রম এক লহমায় ধূলিসাৎ হয়ে গেল৷
নিজের প্রেমিকের থেকে এত বড় প্রবঞ্চনায় সে হতবাক হয়ে গিয়েছিল৷ ঘুণাক্ষরেও সে কল্পনা করতে পারেনি আমি এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি৷
কিন্তু সে আমাকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞাসা করল না৷ জিজ্ঞাসা করার মতো অবশিষ্টই বা কী ছিল!
আমি তখন নানা মিডিয়ায় নিজের কাজকে তুলে ধরতে ব্যস্ত৷ জার্নালে পেপারটা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই প্রচারমাধ্যমের আকর্ষণ হয়ে উঠেছি আমি৷
কয়েকদিন পর বন্ধুদের আড্ডায় ফলাও করে বলছি আমার দীর্ঘ পরিশ্রম ও কাজের কথা, আমার এক পুরোনো বন্ধু এসে খবর দিল, লিলি তার মেসের ঘরে আত্মহত্যা করেছে৷
আজ ভাবতে আশ্চর্য লাগছে, একজন মানুষের সঙ্গে অতগুলো বছর ঘনিষ্ঠভাবে মিশেও কথাটা শুনে আমার খুব একটা হেলদোল হল না৷ কিন্তু ভয় হল খুব৷ বলা যায় না, লিলি যদি সুইসাইড নোটে লিখে যায় আমার চুরির কথা? পুলিশি ঝামেলায় তো ফাঁসবই, নিমেষের মধ্যে আমাকে খ্যাতির চূড়া থেকে নীচে ছুড়ে ফেলে দেবে মানুষ৷
কিন্তু না৷ লিলি তার প্রেমিককে কোনোভাবে অপদস্থ করে যায়নি৷ ‘আমার মৃত্যুর জন্য আমি নিজেই দায়ী’ জাতীয় এক বাক্যের রুটিন নোট লিখে বাঁচিয়ে দিয়ে গিয়েছিল আমায়৷
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম৷ পথের কাঁটা দূর হতে নির্দ্বিধায় প্রচার করতে শুরু করেছিলাম নিজের কাজের৷
এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমার প্রতি তোমার ঘৃণা উথলে উঠছে৷ তাই না সঞ্চয়ন? ভাবছ, এত নীচ প্রকৃতির একজন মানুষ কি না তোমার পিএইচডি-র গাইড?
কী জানো, আমাদের সমাজকাঠামোয় বহুদিন বহুভাবে মেয়েদের দমিয়ে রাখা হয়েছিল৷ পড়াশোনো শিখলে অকালবৈধব্য, গৌরীদান এমন নানা কুসংস্কার৷ কত লক্ষ মেয়ে যে এইভাবে ঘরের অন্ধকারে শেষ করে দিয়েছে তাদের জীবন! তাদের মধ্যে কারুর হয়তো অসাধারণ মেধা ছিল, সে তা জানতেই পারেনি৷ কারুর হয়তো ছিল জন্মগত আঁকার হাত, সেই প্রতিভা স্ফুরিত হওয়ার সুযোগই পায়নি৷
এভাবেই কত প্রতিভাকে নষ্ট করেছে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ৷
আমাদের দেশের মেয়েরা ঠিকঠাক লেখাপড়া শিখতে শুরু করেছে বড়জোর একশো বছর হল৷ অথচ দেখো, এখনই সব ক্ষেত্রে তারা পাল্লা দিচ্ছে ছেলেদের সঙ্গে৷ সংসার সামলে, সন্তান সামলে তারা আজ কেউ ডাক্তার, কেউ পাইলট, কেউ অধ্যাপক৷
কিন্তু আমাদের মতো কিছু পুরুষ এখনো তা সহ্য করতে পারে না৷ নিজের ব্যর্থতা, নিজের অযোগ্যতার চেয়ে তাদের কাছে তখন বড় হয়ে ওঠে পুরুষ হওয়ার জাত্যাভিমান৷ একটা মেয়ে যে নিজেরই যোগ্যতায় আমার চেয়ে ওপরে, সেই সহজ সত্যটা হজম করতে কষ্ট হয় আমাদের৷ তখন নানা পথে টেনেহিঁচড়ে নীচে নামানোর চেষ্টা করা হয় মেয়েটিকে৷ কখনো ভালোবাসার দোহাই দিয়ে, কখনো অন্য ক্ষতি করে৷
সেই জঘন্য কাজের এতদিন পর লিলি আমায় চোখে আঙুল দিয়ে সেই শিক্ষা দিয়েছে৷ কীভাবে, তা আর নাই বা বললাম৷
আমার এই ইমেলটাকে আমি তোমার পাশাপাশি আমার উকিলকেও পাঠালাম৷ আমি সজ্ঞানে স্বীকার করে যাচ্ছি, পেস্টাওলোটিঅপসিস মাইক্রোস্পোরা আমার আবিষ্কার নয়, ওই মাশরুম আবিষ্কার করেছিল প্রয়াত গবেষক লিলি মৈত্র৷ গবেষণাপত্রটিও তারই লেখা৷ নিজের পি এইচ ডি ডিগ্রি পাওয়ার আগেই সে আত্মহত্যা করে৷
মাশরুমটার পেটেন্ট নেওয়ার জন্য আমেরিকার যে কোম্পানির সঙ্গে আমার চুক্তির কথা ছিল, তাও আমি প্রত্যাহার করছি৷ আমার উকিলকে অনুরোধ করব তিনি যেন উদ্যোগ নিয়ে লিলি মৈত্রর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন৷ তাঁরাই এই স্বত্বের প্রকৃত মালিক৷
আমি কোথায় যাচ্ছি, জানাতে চাই না৷ আমার খোঁজও কোরো না৷ আমার শরীরটা জীবন্ত থাকবে কি থাকবে না তা জানি না, তবে স্বার্থান্বেষী নারীবিদ্বেষী ডঃ অদম্য পাল আর ফিরবে না, সেই নিশ্চয়তা দিতে পারি৷
ভালো থেকো৷’’
ধীমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ তারপর ফোন করলেন মিলিকে৷
মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘‘পড়লাম৷’’
মিলি বলল, ‘‘উনি যে এইভাবে সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবেন, সেটা আন্দাজ করিনি ধীমানদা৷ ওঁর মতো স্বার্থপর মানুষ যে শেষমেশ সব স্বীকার করবেন…৷’’
‘‘স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে বলেই করেছে৷’’ ধীমান বললেন, ‘‘আমি অদম্যকে চিনি আজ কুড়ি বছরেরও বেশি৷ নিজেরটা ছাড়া সে কিছুই বোঝে না৷ লিলি যে কী ভালোবাসত ওকে, তা আমি কলেজ জীবন থেকে দেখছি৷’’
‘‘আমিও জানি সেটা৷’’ মিলি আস্তে করে বলল, ‘‘যদিও আমি তখন অনেক ছোট৷ ভাই তো সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে৷ কিন্তু মনে আছে৷ দিদি বাড়ি এসেও দুজনের জন্য অ্যাসাইনমেন্টগুলো করত৷ অদম্য পাল নিজের সব কাজ দিদিকে দিয়ে করাতেন৷’’
‘‘কী জানো মিলি, অদম্যর এই অসুস্থ স্বার্থপরতার জন্যই ওকে এই শিক্ষাটা দেওয়া দরকার ছিল৷ ওর মনে নিজের স্ত্রী-পুত্রের জন্য পর্যন্ত কোনো জায়গা নেই৷ বিয়েটাও ও করেছে হিসেব কষে৷ ওর শাস্তি পাওয়া খুবই জরুরি ছিল৷ আমার মনে এই নিয়ে রাগ তো ছিলই, তাই তুমি আর তোমার ভাই সঞ্চয়ন এসে যখন পুরো ব্যাপারটা বললে, আমি এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলাম৷’’
মিলির গলা ধরে আসছিল, ‘‘আপনি জানেন ধীমানদা, ভাই জানত যে ওর রিসার্চ গাইড কালিমালিপ্ত হলে সেটা পরে ওর কেরিয়ারেও প্রভাব ফেলবে৷ তবু ও আজকের দিনটা দেখার জন্য ডঃ পালের আন্ডারে পি এইচডি করতে ঢুকেছিল৷ ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল ডঃ পালের৷ যাতে সময়ে সময়ে সে যেতে পারে ফাঁকা ফ্ল্যাটে৷’’
‘‘হুম৷ দেখো, শীঘ্রই ওর উকিল তোমাদের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করবেন৷’’ ধীমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘‘কিন্তু এতদিন ধরে যে হ্যালুসিনেট করার ওষুধ ওকে খাওয়ানো হল, এতে ওর কোনো ক্ষতি হবে না তো?’’
‘‘না৷ সাম্যদা সেভাবেই বলেছিল৷ রোজ তো খাওয়ানো হয়নি, সব মিলিয়ে ছ-সাতবার৷’’
ধীমান বললেন, ‘‘আচ্ছা, ডঃ চট্টরাজ কি শুধু এই কারণেই সঞ্জীবনী নার্সিং হোমে বসেন, যে তিনি প্রথমজীবনে ওখানে নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন?’’
‘‘না৷’’ মিলি বলল, ‘‘দিদি তো ওই চত্বরেই মেসে থাকত৷ দড়ি কেটে নীচে নামানোর পরও সামান্য কিছুক্ষণ দেহে প্রাণ ছিল ওর৷ তখনো সঞ্জীবনীতেই তড়িঘড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওকে৷ তখন সাম্যদা সাধারণ এম বি বি এস, ওখানে রেসিডেন্ট ডাক্তার৷ ওর চোখের সামনেই দিদি মারা যায়৷ সেটা ও সহ্য করতে পারেনি৷’’
ধীমান ফোনটা রাখার পর কিছুক্ষণ দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে রইলেন৷ তিনি আজ আর স্কুলে যাবেন না৷ মনটা একেবারেই ভালো লাগছে না৷ কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে৷
অদম্য তাঁর ছোটবেলার বন্ধু৷ ক্লাস ফাইভ থেকে একসঙ্গে পড়েছেন দুজনে৷ অদম্য যত খারাপ মানুষই হোক, ধীমানকে সে বন্ধুই ভাবত৷
তিনি নিজে কি ঠিক করলেন?
মুহূর্তে মনের ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল, অদম্য যা করেছিল, তাতে ওর এই শাস্তি প্রাপ্য ছিল৷ লিলির কি দোষ ছিল যে ওকে হতাশার চূড়ায় উঠে অকালে চলে যেতে হল?
কিন্তু তবে ধীমানের মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি হচ্ছে কেন?
লিলি, মিলি আর সঞ্চয়ন তিন ভাইবোন৷ তাদের বাড়ি ছিল দূরের এক মফস্সলে৷ লিলি ছোট দুই ভাইবোনের চেয়ে ছিল বেশ খানিকটা বড়৷ নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে মেধার জোরে অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে উচ্চমাধ্যমিকের পর পড়তে এসেছিল কলকাতায়৷
গ্রামে লিলিদের প্রতিবেশী সাম্য ছিল লিলিরই সমবয়সি৷ ছোট থেকে একসাথে খেলাধুলো লেখাপড়ায় সাম্যর মনে কখন যে লিলির জন্য একটা বিশেষ স্থান তৈরি হয়েছিল, তা লিলি বুঝতেও পারেনি৷ সাম্য ডাক্তারি পড়তে চলে গিয়েছিল বর্ধমানে, আর লিলি এসেছিল কলকাতায়৷ সাময়িক হারিয়ে গিয়েছিল যোগসূত্র৷
কিন্তু সাম্য ভোলেনি তার ছোটবেলার প্রেমকে৷ লিলি যখন গবেষণা করছে, সাম্য তখন তরুণ ডাক্তার৷ অদম্যর ক্রমাগত দুর্ব্যবহারে অবসাদগ্রস্ত লিলির দেশের বাড়িতে গিয়ে নতুন করে বন্ধুত্ব হয়েছিল সাম্যর সঙ্গে৷ সাম্য শুনেছিল কীভাবে নিজের সবটুকু দিয়ে গবেষণায় ডুবে রয়েছে লিলি৷ জেনেছিল লিলির স্বপ্ন এমন এক মাশরুম ব্রিড করা, যার খাদ্যই হবে পলিইউরিথিন, পলিইথিলিন, পলিপ্রপিলিনের মতো প্লাস্টিক৷
জঞ্জালমুক্ত হবে বিশ্ব৷
লিলির হঠাৎ চলে যাওয়া আর একইসঙ্গে ওই বিষয়েই অদম্যর গবেষণায় খ্যাতিলাভ, দুইয়ে দুইয়ে চার করতে অসুবিধা হয়নি সাম্যর৷ প্রকৃত বন্ধুর মতো লিলির পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিল সে৷ ক্ষোভে রাগে প্রতিজ্ঞা করেছিল বদলা নেওয়ার৷ সঙ্গে নিয়েছিল লিলির ভাইবোন মিলি আর সঞ্চয়নকে৷ মিলির সাইকোলজি পড়া বা সঞ্চয়নের কেমিস্ট্রি সব তারই পরামর্শে৷ মিলিকে নিজের সহকারী সাইকোলজিস্ট করে নিয়ে ছকেছিল এক দুর্দান্ত প্ল্যান৷
এল এস ডি৷ পুরো নাম লিসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড৷ একধরনের ড্রাগ যা শরীরে প্রবেশের কয়েকঘণ্টার মধ্যে মানুষকে প্রবেশ করাবে এক স্বপ্নের জগতে৷ রুগি যৌনতাসর্বস্ব এক জগৎকে ঘুমের মধ্যেই হ্যালুসিনেট করবে৷ স্বপ্নের মধ্যেই পাবে যৌনসুখ৷ ষাটের দশকে এই ড্রাগ তোলপাড় ফেলেছিল পশ্চিমি দেশগুলোয়৷ হিপিদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, তারপর মার্কিন মুলুকে নিষিদ্ধ হয়ে যায় এল এস ডি৷ অধিকাংশ দেশে এই ড্রাগ নিষিদ্ধ হলেও পর্তুগাল, মেক্সিকোর মতো কিছু দেশে আজও একটু চেষ্টাচরিত্র করলেই পাওয়া যায় এই সর্বনাশা ড্রাগ৷
ডঃ সাম্য চট্টরাজের মতো দেশের প্রথম সারির সায়কিয়াট্রিস্টকে তাই সেটা জোগাড় করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি৷
অদম্য যে ডায়াবেটিসের রুগি, নিয়ম করে দিনে দু-বার ইনসুলিনের ইনজেকশন নিতে হয় তাঁকে, সেই তথ্য ধীমান বলার আগেই সঞ্চয়ন জেনে গিয়েছিল৷ তারপর নানা অজুহাতে স্যারের বাড়ি গিয়ে ইনসুলিনের অ্যাম্পিউলগুলোর মধ্যে কয়েকটা বদলে দেওয়াটা ওর কাছে তেমন কোনো ব্যাপার ছিল না৷
তবে অদম্যর আতঙ্ক বাড়ানোর জন্য তার ছেলেকে পাসওয়ার্ড বলে দিয়ে ঘুমন্ত বাবার ছবি তোলার কাজ কিংবা অদেখা লিলিমাসির কথা বলে বাবাকে ভয় পাইয়ে দিতে রাজি করানোর ভার নিতে হয়েছিল ধীমানকেই৷ বুল্টু বাবার মতোই বুদ্ধিমান, সুন্দরভাবে করেছিল দুটো কাজই৷ শুধু ধীমানকে খরচ করতে হয়েছিল অনেকগুলো চকোলেট৷
ধীমানকে পালন করতে হয়েছিল পৌরাণিক লিলিথের গল্প থেকে লিলির প্রসঙ্গ এনে অদম্যর মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটাও৷
অদম্য কোথায় চলে গেলেন, ধীমান তা জানেন না৷ তবে যদি সত্যিই তাঁর মধ্যে অনুশোচনাবোধ আসে, তাঁর চলে যাওয়া উচিত বীরভূমের সেই প্রত্যন্ত গ্রামে৷ যেখানে বিয়ের পর থেকে অপমানিত অবহেলিত জীবন কাটাচ্ছে তাঁর স্ত্রী৷ স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে ভালোবাসায় শুরু করা উচিত তাঁর নতুন জীবন৷
সবই তো হল, কিন্তু কোথাও যেন একটা খটকা থেকে যাচ্ছে৷ কী সেই সংশয় তা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না ধীমান৷
ছটফটিয়ে ওঠেন তিনি৷ অন্যমনস্ক হয়ে সামনে পড়ে থাকা বইটা খোলেন৷ সত্যি, শুধু ঘটনাক্রমেই নয়, প্রত্যেকের নামেও কী অদ্ভুত সমাপতন!
প্রকৃতি যেন ঠিক করেই রেখেছিল এভাবেই প্রতিশোধ নেবে সে৷ এভাবেই প্লাস্টিকখেকো মাশরুমের আবিষ্কারক হিসেবে বিজ্ঞানের ইতিহাসে গবেষক লিলি মৈত্রের নাম খোদাই করবে সে৷
বইয়ের পৃষ্ঠায় চোখ বোলাতে বোলাতে আর এক জায়গায় এসে চোখটা স্থির হয়ে যায় তাঁর৷
হিব্রু বাইবেলের সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্র লিলিথ আদমকে ছেড়ে সাকিউবাস হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তারপর চলে গিয়েছিল সামায়েলের কাছে৷
আর এখানে লিলি পায়নি তার সাম্যকে৷ হয়তো বেঁচে থাকলে সে সাম্যর সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করত৷ কিন্তু সেই সুযোগই আসেনি তার স্বল্পায়ু জীবনে৷
বিদ্যুৎচমকের মতো হঠাৎ একটা ছোট ঘটনা মনে পড়ে যায় ধীমানের৷ মনের মধ্যের অস্বস্তিটা মুহূর্তে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর চোখের সামনে৷
মিলি যেদিন চেম্বারে অদম্যকে জিজ্ঞেস করেছিল, তাঁর দেহে ওই বিদেহীর সঙ্গে সঙ্গমের জন্য কোনো আঁচড় বা দাগ আছে কি না, অদম্য একরকম দুর্ব্যবহার করে উঠে এসেছিলেন চেম্বার থেকে৷
কিন্তু গাড়িতে উঠে ঘাড়ের কাছে দেখিয়েছিলেন একজোড়া দাঁত ফোটানোর স্পষ্ট দাগ৷ চাপা গলায় বলেছিলেন, ‘‘ইচ্ছে করেই এটার কথা বললাম না৷ মেয়েটা আরো উলটোপালটা বকবে৷’’
তখন অতটা তলিয়ে ভাবেননি তিনি, কিন্তু আজ মনে পড়তেই গা-টা শিরশির করে উঠল ধীমানের৷
সাত বছর আগে আত্মহত্যা করা লিলিকে তো ফিরিয়ে আনার নাটক সাজিয়েছিলেন তিনি, মিলি, সঞ্চয়ন আর ডঃ সাম্য চট্টরাজ মিলে৷ রাতের সেই শরীরী সঙ্গমও অদম্যর হ্যালুসিনেশন৷ কিন্তু ওই দাগ? হ্যালুসিনেশনের চোটে যদি ধরেও নেন, অদম্যই তা নিজে করেছেন, নিজে ওই জায়গায় দাঁত বসানো কিছুতেই সম্ভব নয়৷
তবে?
মেরুদণ্ড দিয়ে একটা বরফস্রোত নেমে গেল ধীমানের৷ এল এস ডি যতই সাংঘাতিক হোক, অদম্য যে নিপুণভাবে সঙ্গমের বর্ণনা দিতেন, হ্যালুসিনেশনে কি সত্যিই অতটা বিশদ অভিজ্ঞতা হয়?
নাকি নিজের প্রতারক প্রেমিককে শাস্তি দিতে কি সত্যিই লিলি হাজির হয়েছিল সাকিউবাস হয়ে?
সবার সঙ্গে অলক্ষে হাত মিলিয়ে সেও কি ঘুঁটি সাজিয়েছিল অদম্যর স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য?
উত্তর পেলেন না ধীমান৷ কিন্তু শীতের সকালে একঝলক বরফঠান্ডা হাওয়ার দমক এসে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল তাঁর অন্তরাত্মাকে৷
—