লিম্বো
পায়জামা বেঁধে ডেকের উপর গিয়ে দাঁড়ায় মনসুর। তার পায়ের নিচে জলের নিঃশব্দ ঢেউ আর দরদর করে বয়ে চলা পটকা মাছের ঝাঁক। এই রকম ছিটাবৃষ্টির দিনে গ্রামদেশ হলে এমন করে ইলিশের পোনা বইত তীর ধরে। এইখানে ফিকা নীল পানি আর পানির স্বচ্ছ ঝিল্লির নিচ দিয়ে গভীর সমুদ্র পর্যন্ত টানা শাদা বালি। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে চোখের উপর হাতের ছায়া রেখে রোদ ঠেকায় মনসুর। মাজা-মাজা বাঁশের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে বেঁকা আলো ঘরের ভিতর আসছে। একটু আগে মনসুর এই রোদে পিঠ দিয়ে বিছানায় হাঁটু মুড়ে একই দিকে ঠ্যালা মেরে যাচ্ছিল। চোখ বুজে আসমা ওর নাক-কান-গলার টানেল বন্ধ করে দিয়েছিল। রিজর্টের বিছানায় ক্যাচক্যাচ শব্দ হয় না, তাও ময়ূরের আকারে ভাঁজ করা—মনে হয়, ইস্ত্রিও করা নিপাট শাদা বিছানার চাদরের উপর আসমার জামাই খুব কিন্তু-কিন্তুভাবে ওর উপর উপগত হয়। সমুদ্রের সাঁও-সাঁও আওয়াজ সবখানে, তাই এই সময়গুলিতে আসমা সহজে অন্যান্য নোংরা কথা ভাবতে পারে। করিডোরের উপর দিয়ে রুমবয়দের ট্রলি চলছিল ডিগ-ডিগ-ডিগ। আসমার চোখের সামনে দুলতে থাকা স্যুটকেস আর স্যুটকেস পার হয়ে টেবিলের উপর ঝুরি আলুভাজাগুলি দলে ঠান্ডা হয়ে ন্যাতাচ্ছিল আর আসমা উপুড় হয়ে। পিঠ বেয়ে পুরপুর করে একটা যান্ত্রিক পোকা জিপার খুলে নেমে গেছিল। পিঠে একটা বিচি উঠেছে আসমার—হোয়াইটহেড—আসমার জামাই দেখে চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল; আলপিনের মাথা মনে হয়, আঙুলের মাথা দিয়ে ছুঁলে। সাগরের জলের উপর উঁচু করে বাঁধা কটেজ। অবিকল একই রকম দেখতে আরও কয়েকশ কটেজের একটা বক্র, অভঙ্গুর সারির মধ্যে। দুই কটেজ পরে আসমার ছেলের সিঙ্গল কটেজ। কাচের ক্যাবিনেটের মধ্যে রাখা মিনিয়েচার শাদা হাতের মতো ওদের ঘর। সেই ঘরে যদিও মার্বেলের নয়, কাচের মেঝে। ছাউনি হলো বাঁশ আর খড়ের ময়দানবিক কারুশিল্প— গালার পাত দিয়ে বার্নিশ করা এক্সটেরিয়র; নখ দিয়ে খুঁটে দিতে ইচ্ছা করে আসমার। কাঠের পার্টিশনের পিছে লাগেজ ব্যাগ। কম্বিনেশন লকারের ভিতর হাতব্যাগ। হাতব্যাগের ভিতর মৃতা শাশুড়ির হাতের এক ডজন সোনার চুড়ি। তিন পাসপোর্টের মধ্যেখানে স্যান্ডউইচ হয়ে থাকা ফ্লাইটের টিকেটের প্রিন্ট-আউট। সবকিছুর মাঝে আসমা ও মনসুরের পুরানো বিবাহ একটা দিকশূন্য সরলরেখার মতো সেক্সে সুসম্পূর্ণ হচ্ছিল। তারপর ছাদের টারপলিনের উপর ইলশাগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ার শব্দ—শান্তসংক্ষুব্ধ, প্যাসিফায়িং। একটা ঢেউ—মানে দুইটা—বালিয়াড়ি পার হয়ে দূরের জঙ্গলের ভিতর থেকে নীল হয়ে উঠে গিয়ে তারপর আকাশে সবুজ হয়ে নেমে গেছে। কাচের মেঝের নিচে — আসমাদের শরীরের তল দিয়ে—বিছানার তল দিয়ে ফুলে-থাকা বিরাট অণ্ডকোষ ভেসে গেল বুঝি একটা। পটকা মাছ হবে। পটকা মাছ দেখে আসমার জামাই আসমার পিঠের মাংশ নরম হাতে খাবলে ধরে মেরুদণ্ড খাড়া করল; দুনিয়ার দেয়ালের গায়ে যেন মনসুর নিজের কান ঠেসে ধরেছে পাশের ঘরে কী হচ্ছে শোনার জন্য। তারপর ভয়ে, বিবমিষায় মনসুর বলে উঠল, “সামাহ, সামাহ। দেখ। ইসসস!” আসমার মাথার ভিতরে তখন আস্তে-আস্তে স্বর্ণমন্দিরের চূড়া অর্থাৎ পিছলা-হলুদ সূর্য উঠছে। বিরক্ত হয়ে আসমা জিজ্ঞেস করল, “আরে কী? আমি… হইছেটা কী?” – বলতে-বলতে আসমা “বাল” বলে হেসে ফেলল। কটেজের ব্যালকনি থেকে একটা বাতাস কেমন গন্ধ নিয়ে আসলো—আকাশভরা রোদের মধ্যে সামুদ্রিক বৃষ্টিপাতের গন্ধ। অযৌনসংসর্গসুখের মতো ঠেকল সেটা আসমার আর আসমার জামাইয়ের নাকে। বিছানার তল দিয়ে ঝাঁকে-ঝাঁকে পটকা মাছ ভেসে যাচ্ছিল। প্রত্যেকটা ক্ষিপ্ত এবং ফোলা। আসমার মনে কুডাক ডাকল—যখনই সুখের গন্ধ নাকে লেগেছে, তখনই… সংসারের কোন পাকঘরের কোন কর্নার থেকে যেন
মনসুর যখন ডেকের উপর, আসমা তখনো বিছানার উপর পড়ে আছে, টিভিতে একটা মা-গোসাপ বুকে হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ থেমে গেছে। মানে দৈব শাস্তি তার উপর নাজেল হয়ে গেছে। আমেরিকা থেকে হাফসা পিড়িং করে মেসেজ করেছে। “বুজি, চাইনিজ রকেট নাকি পড়তেছে তোমাদের ওই দিকে। ইয়া আল্লাহ মাফি। সাবধান থাইকো, আচ্ছা? আবরার ঠিক আছে?” আবরার ঠিক আছে কি না, আবরাররে জিজ্ঞেস কর না, হারামজাদি! আমার কাছে কী? ভাবটা এমন, যানি কিছুই হয় নাই—আসমা মনে-মনে ইড়িমিড়িকিড়ি করতে থাকে, কেননা হাফসার মতো মারকাট সরব জীবন সেও চেয়েছিল। আসমার বোন হাফসা। জামাইয়ের সাথে আমেরিকা ট্র্যাভেল করছে এই মুহূর্তে আর এয়ারবিএনবি না-পেয়ে আসমাদের ফিলাডেলফিয়ার খালি বাড়িতে উঠেছে। আসমার ফেসবুকের হোম পেজ বোঝাই হাফসার সেলফিতে। অ্যালবামের নাম দি ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকা। বোনের বাড়িতে আয়েশে মজে আছে, অথচ কোনো ছবিতে বোনের নামের একটা জিকরও নাই। ছবির হাফসার মুখভরতি একটা ঢলো ঢলো আলো। (“আর এই মুখ? আমার মুখ?”) মুখের যে পেশিগুলিতে নফস লুকানো ছিল হাফসার, কেউ যেন ডক্টরিং করে সেইগুলিকে বুজিয়ে দিয়েছে। “বুজি, বুজি” বলে পিছে-পিছে ঘুরত হাফসা; আসমার ছোটো হয়ে যাওয়া জামা পরে, যেটা আবার ওর শীর্ণ গায়ে ম্যাক্সির মতন ঝুলত। বুক ছিল না মোটে, তাই স্কুলের নাটকে ছেলের রোল করতো। “আমিই সেই মথুরার মন্দিরের তরুণ পূজারি” বলতে- বলতে গলা কম্পিত করতো। আর এখন? সেই হাফসা এখন কোথায়? হাফসা যখন আসমার ছেলে আবরারের সাথে শুয়েছে-কি-শোয়-নাই—কন্ট্রোভার্সিতে পড়ল, খোদারই কসম–আসমার চোখে শুধু বুজির ঢোলা জামা পরা, কুতকুতা চোখের অবজ্ঞেয় মেয়েশিশুটাই ভাসত রাতদিন। ছেলেই বা কী করে এই কাজ করল? ততদিনে তো ছেলে বেশভূষা বদলেছে— সিল্ক পরে না আর, তালিম থেকে ফিরে এসে মায়ের উচ্চারণ ঠিক করে দেয়; (কে জানত ‘হিদায়াহ’ আর ‘নিয়াহ’ হলো হেদায়েত আর নিয়ত? আর রোজাকে যে ‘সাওম’ বলে?) ব্যথা পেলে ছাগলছানার মতো “আম্মা… আল্লাহ গো” বলে ডাক ছাড়ে না, নিজেকে গুছিয়ে নেয় আর তারপর “আল্লাহ” বলে ওঠে একটা অতিমহাপ্রাণ ধ্বনির রেশ রেখে, যেন মরূদ্যানের উপর সোনার সাঁকো আছে ওর বাপের। সেই ছেলেই শেষমেশ নিজের খালাকে বিবিজান ডাকল। দিনরাত নিজেকে দুষেছিল আসমা তখন। ও কেমন মা? ছেলেকে গোমরাহির হাত থেকে বাঁচাতে পারল না! ফেসবুক ছাড়ার পরে শুধু হাফসার সাথেই রাতদিন কথা বলত ছেলে। আসমার জামাই বলতো, “ঠিকই তো। ভ্যালিডেশনের একটা সিঙ্গল সাপ্লাই পাইলে মানুষ ক্যান ফেসবুকে মানে দোরে দোরে ঘুরবে?” তবু মনসুর কেমন মানুষ যে, তার মনে হয় নাই, আসমাকে বলা দরকার এই রকমের কিছু—”তোমার কোনো দোষ নাই তো, সামাহ” কিম্বা “আমাদের কী করার ছিল? ঢাকায় কী না কী হইছে…” কিম্বা “বাদ দাও, বাদ দাও দেখি?” আসমা বাদ দেয় নাই; রাতদিন ছেলেকে নজরে রাখা আসমার দৈনিক রুটিন খেয়ে নিয়েছে। ফেসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকে মনসুরের বউ দুইটা জলজ্যান্ত ফেইক অ্যাকাউন্টসহ, জিজ্ঞেস করলে বলে, “সময়কে বুঝতে”; তা সময় দেখতে আসমার ছেলের মতোই হবে নিশ্চয়ই। সময়ের ভিতর বসে-বসে সময়কে দিনমান স্টেরিওটাইপিং করে যাচ্ছে ফরসা বেআক্কেল মেয়েলোক।
“সময়ের সাথে-সাথে দৌড়ানো। মানে আসলেই বহুত কষ্ট। বুঝলা?”, মনসুর ডেকের উপর থেকে বলে।
“হুঁ। নজর আসলেই লাগে।” আসমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল যে, মনসুর বুঝি বুড়া বয়সে হানিমুনে এসে অবশেষে বউয়ের থট রীড করতে পারছে।
তাও ভালো।
“অ্যাঁ? তেমন… কাদের?”
“অনেকেরই লাগে তো। মায়ের নজর বেশি লাগে—একটা কথা তো অনেকদিনের, মানে আগের দিনের…”
ফোন নিয়ে উপুড় হয় আসমা। ছেলেকে বুকে নিয়ে আসমার আর খেয়াল রয় না যে, ওর জামাই ওর কথাকে পাত্তা দিলো না। মনসুর ডেকের উপর দাঁড়িয়ে নিজের পাতলা ভুরুর উপরের ঝুলন্ত চামড়া ধরে টানাটানি করতে থাকে; চিন্তার সাগর সামনে। ওখানে ডুবে যেতে-যেতে আইসবার্গের মতো এক-নবমাংশ নিয়ে অনিচ্ছুক কর্ণপাতে আসমার দুনিয়ায় ভেসে থাকে মনসুর। বেলাভূমি এখানে নাই। পানির উপর খুঁটি-পোঁতা কটেজ মানে স্থলভাগ। চাইলেই সাঁতারের কাপড় পরে — বা কিচ্ছু না-পরে বারান্দা থেকে সাগরে নেমে যাওয়া যায়। ওইভাবে নেমে যেতে মনসুরের এত ভালো লাগে, মনে হয়, দুনিয়ার সবাই যার-যার কবরে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। চিতসাঁতার দিতে-দিতে মনসুর ভাবে, “খায়রান, খায়রান। খায়রান মানে গুডনেস। সকলই খায়রান।” আজকে তবু মনসুর সাগরের বুকে কীসের যেন গরহাজিরি দেখতে পায়, কী যেন নাই, আর সেই ‘নাই’টাই অনেক বড়ো হয়ে আছে আর বলছে, “খাই-খাই”; একটা বিরাট পায়াভারী ভ্যাকিউয়াম কোত্থেকে সাঁ সাঁ করতে-করতে একটা শোভাযাত্রার ভিতর দিয়ে নীল মক্ষী হয়ে, ভেলভেটের লম্বা কোট পরে হেঁটে এসে জুড়ে বসেছে।
ঘরে আসমা নিজের ফোনে ছেলের মেসেঞ্জার ঘাঁটতে থাকে পাকা হ্যাকারের মতো; হাফসাকে কোন মোগল আমলে মেসেজ করেছিল ছেলে লেডি গডাইভার সচিত্র কিংবদন্তি, তাই দেখতে থাকে আসমা, আটত্রিশ-কি-উনচল্লিশ বারের মতো। লেডি গডাইভা ঘোড়ার পিঠে, কিংখাবের ঝালর-দেওয়া নীল জিনের উপর ন্যাংটা হয়ে বসে আছে, চুলে তার বুক ঢাকা। গায়ে কোনো গয়না নাই— সমস্ত গয়না গলিয়ে সোনার মোহর বানিয়ে প্রজাদের মধ্যে বিলিয়েছে উন্মাদ বেটি। প্রজানিপীড়ক জালিম জামাইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তার মাথা নামে না, চোখ নামে না, বুকের বোঁটা নামে না। অনুগত প্রজার পাল ঘরের কপাট লাগিয়ে দিয়ে বসে আছে; লেডি যতই প্রজারঞ্জক হোন, রমণী তো বটেন, উনার ইজ্জত উনার শরীরে তো বটেক আর তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মান-অভিমানের ভিতর ঢুকতে নাই; শুধু পীপিং টম অর্থাৎ দরজি হারামজাদা সাহস করে দরজার ফুটায় চোখ লাগিয়ে লেডি গডাইভাকে দেখে ফেলেছে, (নরমাংশ দেবতার ভোগে গেলে নারীমাংশ কেন যাবে না গণদেবতার ভোগে?) সেই পাপে দরজি ব্যাটা তো শেষমেশ গজব পড়ে আন্ধাই হয়ে গেল— ছেলের প্রাইভেসি ঘাঁটায় পাপ তেমন হয় কি? আসমার বুক ধুকধুক করে। ডেকের গায়ে একটা নকল বাঁশপাতা হিংস্রভাবে নড়তে থাকে। পটকা মাছগুলি স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ঢেউয়ের সাথে ওঠে-নামে, ভেসে আসে। ডেকের উপর মনসুরের ভয় লাগে। মনসুর ডানে তাকায়, বাঁয়ে তাকায়, তারপর আবার ডানে-অনন্ত সাগরের মধ্যে এমনকি পারাপার সহজ করার জন্য কোনো এক্সট্রা বাতিও নাই। শুধু সূর্য আছে, যা সমস্তকিছুকে ঝেঁটিয়ে সমান করে রেখেছে। কটেজের সারিটা যেই বিন্দুতে গিয়ে S অক্ষরের মতো বেঁকে গেছে, দিগন্ত যেইখানে সাপের কোমর দিয়ে আড়াল করা, সেইখানে আরও আরও মানুষ মনসুরের মতো ডানে-বাঁয়ে তাকাচ্ছে। ওদের কারও চিৎকার যদি থাকেও, শোনা যাচ্ছে না।
*
দরজার বাইরে ধমাধম, চিৎকার। “বুজি, বুজি” করতে-করতে ওদের কটেজের দরজা ধাক্কাতে থাকে গিয়াসউদ্দিন, আসমা তাতে চমকে গিয়ে প্রায় বিবস্ত্র হয়েই “মনচিনি….. আমার মন” বলতে-বলতে দরজার দিকে ছুটে যেতে ধরে। মনসুর ডেক থেকে দৌড়ে ঘরের ভিতর এসে দাঁড়ায় আর আলুথালু-মতন আসমাকে ঊর্ধ্ববাহু দিয়ে ব্লক করে ধমক দিয়ে বলে, “আরে কী! ওইটা কি আবরার নাকি? রিজর্টের ওই পোলাটা, কী জানি নাম? বাথরুমে যাও। কী হইছে তোমার? হাতমুখ ধোও গিয়া, মানে কী একটা…।”
আসমা কাপড় সামলে নেয়, তবে বাথরুমে যায় না। চোখে উচ্চগ্রামের প্রশ্ন; গোঁয়ারের মতো বিছানার উপর বসে রয়, যেন দরজার কাছ থেকে একটা ইশারা পেলেই ছুটে যাবে। গতরাতে ঘুমাতে পারে নাই আসমা। রাত বারোটার দিকে আবরার এই রকম করেই দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল। ছেলের যেন খুব শীত। এমন অসহায় যেন রাত্রে ঘুমানোর একটা জায়গা—একটা জায়গা, আম্মা—একটা জায়গাই লাগবে তার। “বাবা, বাবা, কী হইছে?” মনসুর বিছানা থেকে নামতে নামতে পেঁচিয়ে যাওয়া পাপোশের উপর উসটা খেয়েছিল। “আব্বা, আব্বা, পানির উপর দিয়ে হেঁটে আসতেছিল। সামওয়ান। ঈসা আলায়েসসাল্লামের মতো।”
“আলাইহিস সালাম বলে, বাবা।”
“ইয়েস, হিম।” মুমিন, পাকা ছেলে স্বপ্ন দেখে ছোটোবেলার মতো হয়ে গেছিল– ভুল আর নিষ্পাপ। ছেলে নাকি দেখেছে যে, সে বাপের সাথে ওই দুই তক্তার ভেলার মতন ক্যাটামারান না কী যেন, তাই নিয়ে বের হয়েছে, মিমু আটোল পর্যন্ত গেছে আর কালা সমুদ্র ওদেরকে মুখের ভিতর নিয়ে এদিক-ওদিক ঝাঁকিয়ে গার্গল করছে আর তারপর… তারপর ফোয়ারার মতো উঁচুতে তুলে মুখ থেকে ফেলে দিচ্ছে। কাঁপছিল ছেলে। ঘুমের টিশার্টের ঢোলা গলার উপর দিয়ে পাঁজরের হাড় কাঁপুনির দমকে ভেসে-ভেসে উঠছিল। দুইটা চোখ যেন একজোড়া দুরবিনের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছিল—শিং-বাগানো, বিস্ফারিত। আসমা বিছানার পায়ের কাছে পড়ে থাকা কম্বল দিয়ে ছেলেকে জাপটে ধরেছিল। ব্যাকুল আর ম্লান মুখ করে হাত দিয়ে ছেলের মাথার চুল সমান করতে-করতে বলেছিল, “বাবা, বাবা, আম্মা আছি তো, মন। বেশি কষ্ট হইতেছে? স্বপ্ন তো স্বপ্নই, মন”, আর ছেলে বলেছিল, “নট স্বপ্ন। চমৎকার হো গয়া। আম্মা…।”
“কোনটা চমৎকার হইছে?”
“ভিশন। আই হ্যাড আ ভিশন। ইট ওয়জ…”, আর তারপর “আই, আই” করতে-করতে বাথরুমের দরজা খোলা রেখেই বাপ-মায়ের টয়লেটে গিয়ে বসেছিল ছেলে। কম্বলসহ। ছেলে ভুলে গেছিল, তাই আসমাও ভুলে গেছিল তার ছেলে আর ছোটো নাই; পুরু মোজার সাথে চপ্পল পরে শীতের দিনে ভেজা বাথরুমে যেত ছেলে আর পেশাব দিয়ে মোজা ভিজিয়ে একাকার করতো। অনেক করেও শেখানো যেত না ছেলেকে, কী করে না-ছিটিয়ে, না-ভিজিয়ে ভদ্রলোকের মতো বাথরুম করতে হয়।
“আমি ওর রুমে গিয়ে শুইতেছি, নাকি?” আসমার পিছন থেকে মনসুর বলেছিল, ঘুমে গলা-জড়ানো তাই আসমার মনে হচ্ছিল, ছেলেকে নিয়ে মনসুরের কোনো চিন্তাই নাই। বেডসাইড ল্যাম্পের আলো-ছায়ায় মাঝবয়সি মনসুরের ক্লান্ত-ঝুলন্ত বিচির আকার স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ফুলদানিতে সাজানো লম্বা ডাঁটির ফুলের ছায়া ব্যাঁকা আলোতে আরও লম্বা দেখাচ্ছিল। কটেজের চারিদিক শুনশান আর সমুদ্রের শোঁ শোঁ। পাশের কটেজ থেকে সিরামিকের প্লেটের উপরে স্টিলের চামচ পড়ার শব্দ ভেসে আসছিল স্পষ্ট বিরতিতে; কেউ গভীর রাতে রুম সার্ভিস থেকে খাবার অর্ডার দিয়েছিল নিশ্চয়ই। আসমার ছেলে বাঁচুক-মরুক, জগতের মানুষের খাওয়া- হাগা-লাগা-ঘুমের কোনো বিরাম নাই। আসমার মনের ভিতর একটা সিঙ্গল-মাদার পাখি ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করে উঠেছিল। পারলে জামাইকে ও ঘাড় ধরে খেদায়।
“তো সেইটা তো জিজ্ঞেস করার কিছু নাই আর। নাকি? যাও, ওর কটেজে যাও। চাবি আনে নাই, মনে হয়।”
“গিয়ে দেখি ঘর লক হয়ে গেছে কি না। তাইলে তো তোমার…”
“অ্যাঁ?”
“বলতেছি যে, তাইলে তো দেশিভাই, মানে তোমার ওই গিয়াসউদ্দিন, ও তো আছেই। ওরে ডাকবা।”
“সেইটা দরকার হবে ক্যান? রুম সার্ভিসরে সরাসরি কল করবা।”
“আচ্ছা। এই রুমে পানির বোতল দিতে বলব? এক্সট্রা পানির জন্য আবার চার্জ করে দেখলাম।”
“এখন আসছে পানির দাম নিয়া কথা…”, জামাইয়ের চেয়ে আসমার গলা একটু কম ফিসফিসা ছিল রাতের বেলা। এখন দিনের বেলা গিয়াস যখন দরজা ধাক্কাচ্ছে, মনসুরের মনে পড়ল চশমার কথা—বার-ফ্রিজের উপর এক ডান্ডা ভাঁজ করে রেখে দিয়েছিল মনসুর নিজেই, এখন খুঁজে পাচ্ছে না; বয়স্ক মনসুরের সমস্ত চেহারা ঝুলে গেছে। আসমা যেভাবে বসেছিল বিছানার কিনারে, সেভাবে বসে থাকার মধ্যে একটা উদ্বেগ আর তাচ্ছিল্য; একটা সমুদ্রহীন নিরুত্তাপ দিন হলেই হয়তো ওইসবকে বউয়ের মমতার মতন লাগতে পারতো। কিন্তু আজকে তেমন দিন নয়। মেঝের নিচ দিয়ে বইতে থাকা পটকা মাছের ধারা একই রকম ঘন, কিন্তু ক্রমশ শীর্ণ হতে থাকে। গিয়াস দরজার ওইপারে পশুর মতো গুঁতা দিতে থাকে, মাঝে একবার থামে, কার সাথে যেন বিড়বিড় করে কথা বলে, মোবাইল ফোনে না-হয় সামনাসামনি, তারপর আবার দরজায়— তবে এইবার “বুজি, বুজি”র বদলে “স্যার, স্যার” বলতে-বলতে — ধাক্কা দিতেই থাকে। আসমা মনসুরের দিকে এমন রোষের চোখে তাকায় যে, মনসুর “হ্যাঁ, দাঁড়াও… আসতেছি, এক মিনিট”-জাতীয় কিছু বলে গড়গড় করে। মনসুরের মনে হতে থাকে, বুঝি গিয়াস একা না, পুরা আইল্যান্ডের সমস্ত বাঙালি বয়-বেয়ারারা একযোগে ওদের দরজার উপর “খোলেন, খোলেন” করে হামলে পড়েছে। কে জানে কেন! “কে মরছে?”
আসমা বিছানা থেকে নড়ে না। দেখে দরজা খুলে মনসুর গিয়াসকে কী যেন বলছে–এমনভাবে যেন গিয়াসের কোনো একটা জৈবনিক সমস্যার সমাধান করবে মনসুর। জবাবে গিয়াস মনসুরের হাতে রিজর্টের এনভেলপে করে অবিকল সমস্যার মতো দেখতে কী যেন দেয়। আসমা দেখে মনসুরের রোদজ্বলা ফরসা টাখনুর হাড়ের পাশে টিবিয়া না-জানি ফিবুলা – নীল শিরাগুলি দপদপ করছে। মনসুরের পায়ে রাবারের চপ্পল, গিয়াসের পায়ে শু। আমেরিকায় যেমনই হোক, দেশে মনসুর এমনিতে সবাইকে একটা সমতল জায়গা দেওয়ার ভাণ ধরে রেখেছে—তার উপর সবাইকে সেইখান থেকে লীড করে যেন আরেকটা ভালো জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, এমন একটা কর্পোরেট উষ্ণতা আছে মনসুরের। আসমার মতো নয় মনসুর; আমি-তুমি — গানের ভিতর ঘুরবে না সে, আত্মবিশ্বাসের তোড়ে কোনো মাতাল যেমন ফেটে বের হয়, তেমন দুনিয়ার মৃদুমন্দ চক্কর থেকে বের হবে মনসুর আর তারপর পুরা দুনিয়াকে দার্শনিকের মতো জেনারালাইজ করবে। আসমার দেশিভাই, প্রবাসী হোটেলবয় গিয়াসের সাথে মনসুর দাঁড়িয়ে বন্ধুর মতো নিচু স্বরে কথা বলতে থাকে। গিয়াস নিজের চোখ নামিয়ে, একটা হাত কোমরের কাছে নিয়ে ইউনিফর্মের উপর দিয়ে প্যান্টের বোতাম ধরে টানতে থাকে আর দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মনসুরের কথার জবাব দিতে থাকে। আসমার নাকে আবার সমুদ্রের পচা গন্ধ লাগে। সর্বনাশের সুতা ঝুলছে আসমার নাকের সামনে আর ক্রমাগত প্রোভোক করছে সুতা বেয়ে ছাদে উঠে গিয়ে তারপর মাকড়সার দৃষ্টি দিয়ে ছেলেকে আঁতিপাতি খুঁজতে। মনসুরের ফোন থেকে ছেলেকে আরেকবার ফোন করে দেখে আসমা—বাপ-ছেলের ফোন রোমিং করা ছিল— আর ভাবে, এই বুঝি ছেলে কথা বলে উঠবে ওই পাশ থেকে- “ একটা জায়গা, আম্মা, একটা জায়গা”, “কই গেলি, আব্বা আমার, মনচিনি?”-আসমার বুকের মানিক হারিয়ে গেছে।
মনসুর মুখ কালো করে বসে বিছানার উপর। তারপর সে আসমার দিকে কোনোমতে তাকায়। বলে, “আবরার চেক আউট করছে আধা ঘণ্টা আগে। সী-প্লেন ধরছে।” ছেলে এসে গতরাতে পাশের বালিশে মাথা রাখার পর থেকে আসমা নিজের পেটের ভিতর একটা হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি টের পাচ্ছিল, ছেলে পেটে থাকার সময়ও পেত আর নার্স হাসতো; জন্মের সময় অনেক জ্বালিয়েছে ছেলে- ছেচল্লিশ ঘণ্টার লেবার পেইন। কিন্তু ওই ধুকপুকানিটার কথা মাথার একটা সান্দ্র স্তরে ভেসে থাকছিল, দেখে লেবার পেইন সয়ে গেছিল আসমার; আব্বা সিজারিয়ান করাতে চায় নাই, আমেরিকার ডাক্তার হলেও চাইত না নিশ্চয়ই। এখন সেই রকম দ্বিতীয় একটা ধুকপুকানি আসমার পেট থেকে বুকে, আবার বুক থেকে পেটে ভ্রমণ করছে। আসমা অপেক্ষা করছে, কখন সেটা বুকে এসে থেমে যায়, কিম্বা ফেটে পড়ে হাইজ্যাকড বিমান যেমনভাবে ফাটে। মনসুর দরজার বাইরে গিয়াসকে রেখে রিসেপশন লাউঞ্জের দিকে হাঁটা দেয়, প্যান্টের ভিতর শার্ট আর শার্টের পকেটে মোবাইল গুঁজতে গুঁজতে, আবরারের পাসপোর্টের ফটোকপি হাতে নিয়ে—”আমেরিকান হাইকমিশনে ফোন করব?” জিজ্ঞেস করে আসমাকে। আসমা জিয়ল মাছের মতো শুকনায় শরীর আছড়ায়, জামাইয়ের কথার জবাব দেয় না। সে কেন, কেন, কেন মরে গেল না ছেলে জন্মের দিনই! মনসুর চোখের সামনে থেকে দূর হয়; দরজার ওইপারে গিয়াস দেখে আসমার ভারী শরীরটা প্রায় ভাসতে ভাসতে ডেক পর্যন্ত যাচ্ছে আর তারপর পানির উপর শব্দ করে গড়িয়ে পড়ছে। এত ভোঁতা একটা মুভমেন্ট—আসমা নিজেও যেন ভাবতে পারে নাই, ও মেঝে থেকে সাগরে গিয়ে পড়বে। পানির নিচে ওজনহীনতার মতো একটা ব্যাপার, তার মাঝে আসমা জেলিফিশের মতো শুঁড়-কর্ষিকা ক্ষণে খুলে, ক্ষণে গুটিয়ে জামাকাপড়ের ঝুল নিয়ে এমন একটা মেস তৈরি করে—উঠবে কি উঠবে না ও পানি থেকে কখনো, সেটা বোঝা যায় না। যেখানে যেখানে কাঁটা-কাঁটা প্রবাল নাই, সেখানে সেখানে কেকের মতো চাপ-ধরা ভেজা বালি। হায়, হায়, হায় গো! কে ডেকে নিয়ে গেল? ডাকিনী, কুহকিনী, যোগিনী, নাগিনি, মায়াবিনী আর ওইসব মাগিরা ট্র্যাপে ফেলল আসমার ছেলেরে! অধম মায়ের সন্তান আজ কোথায় লুকাল?
*
প্রিয় ইলিচ দাদু
আমার নাম সাদেক মনসুর আলি। ডাকনাম মন্টি। আমি সিলেটের সন্তান। চা আর কমলালেবুর দেশ সিলেট। এইখানে অনেক মণিপুরি শাড়ি আর গোলা পায়রা-কবুতর পাওয়া যায়। আমার দাদি বলেছেন গোলা পায়রা হচ্ছে হারামাইনের পাখি, তাই খাওয়া হারাম। আমার দাদির খালাতো বোনের পুরা পরিবার গত বছর ফুটকরা মাছ খেয়ে মারা গেছে। ফুটকরা মাছকে সুরিটোলায় অনেকে পটকা মাছ বলে। সুরিটোলা ঢাকায় অবস্থিত। রাশিয়ায় ফুটকরা মাছকে কী বলে ডাকে?
স্কুলের লাইব্রেরিতে আমি তোমার জীবনী পড়েছি। আমি এই বৎসর স্কুলে প্রথম হয়েছি। চাচ্চু আমাকে একটি সাঁজোয়া গাড়ি (খেলনা) উপহার দিয়েছেন। আমি কয়েকদিন পরই বড়ো হয়ে যাব এবং তখন একটা সত্যিকারের সাঁজোয়া গাড়ি চালাব বলে আশা করি। আমি যুদ্ধও করতে চাই। আমাদের স্কুলে একটা গুজব ছড়ানো আছে যে, দস্যু প্যাপ নাকি আবার ফেরত আসবে। সে নাকি আমাদের গাড়ি আর জ্যামিতি বক্স কেড়ে নেবে, আমাদের বই, খাতা, পেন্সিল সব পুড়িয়ে দেবে, আমাদেরকে অনেক মারবে! শুধু তাই নয়, আমাদেরকে তার শুকরের খোঁয়ার দেখাশোনার কাজও করতে হবে, যদিও শুকর হারাম। আমি চাচ্চুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু তিনি আমাকে বলেছেন, “হাক, জিম আর তুমি আগে তাড়াতাড়ি বড়ো হও। এখন তোমাদের পড়াশোনার সময়। খুব শিগগিরই আমরা একটা নতুন, গোপন দুনিয়ার খোঁজ পাব, যেখানে পৃথিবীর সব দেশের সব হাক আর জিম রা সংকেতের ভাষায় একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। তখনই যুদ্ধের মূল পরিকল্পনা হবে। তুমি সেখানে তোমার সর্বস্ব নিয়ে ফাইট করতে পারবে।” আর বিশেষ কী? দাদু, তুমি মেহেরবানি করে চাচ্চুকে বলে দিও, আমিও রেড আর্মিতে জয়েন করতে চাই।
তোমার স্নেহের
সাদেক মনসুর আলি (মন্টি)
*
“…The only war here is a war
of silence between blue sky and sea,
and just one voice, the marching choir’s, is raised
to draft new conscripts of the ancient cry
of “Onward, Mohammedan Soldiers,” into pews
half-empty still, or like a glass, half-full.
Pinning itself to a cornice, a gull
hangs like a medal from the serge-blue sky.
Are these boats all? Is the blue water all?
The rocks surpliced with lace where they are moored,
dinghy, catamaran, and racing yawl,
nodding to the ground swell of “Praise the Lord?”
398 likes
<@AbrarMAli is ruminating with my local friend, philosopher and guide Muhammad Ghias Uddin at Kolhufushi Island >
View all 235 comments
*
কোলুফুশি লাইটহাউজ—তার পাশে পরিত্যক্ত মসজিদ। শহর থেকে দেড়শ কিলোমিটার দক্ষিণে ওরা। সুনামিতে মসজিদ ভেঙে পড়েছে। মিনারের পশ্চিমপ্রান্তের কাঠামোটা অটুট, পুবদিকের দেয়াল ফোকলা কিন্তু পশ্চিমে তাসের স্ট্যাকের মতো দগদগে ধারালো প্রান্ত। কয়েকটা ইট জড়ো করে উনুন বসিয়েছিল কেউ; তাতে কালিঝুলি আর আধপোড়া কাঠের চিহ্ন। ভাঙা খোঁড়া, জলকান্দা, প্লাস্টিকের ফোটোফ্রেম, মোবাইল ফোনের নষ্ট ব্যাটারি ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। কয়েক গজ দূরে বালির ঢিবি, এখানে-ওখানে ঘাসফুল আর আগাছা। আবরার সাবধানে জানতে চায়, এই দ্বীপ পর্যটকদের জন্য রেস্ট্রিকটেড কি না। গিয়াস ঘুরিয়ে উত্তর দেয়; আবরারের হিসাব আলাদা। “আপকা আব্বুজি শরাব নেহি পিতা”, গিয়াস সাবধানি কিন্তু দৃঢ়, পাক্কা ও আত্মসন্তুষ্ট—ঈমান এনেছে গিয়াস। গিয়াসের অন্তঃকরণ ঘোলা নয়, যে-কোনো জিনিস হাজারবার দেখে পুরানো করে ফেললেও তারপরেরবার দেখার সময় আবার নতুন চোখে দেখার ক্ষমতা রাখে সে—এমন নেক, খোলা, এলিপ্টিক্যাল মুখব্যাদানসহকারে তাকায় যে, তার সঙ্গী যদি কেউ থাকে, হাঁ করে তাকানোর ক্রিয়াটা সেই ব্যক্তিতেও সংক্রমিত হয়; আঙুল নেড়ে নেড়ে কিচ্ছু দেখানোর প্রয়োজন হয় না। আবরারের পায়ের নিচে রাবল মানে ইট-সুড়কি চুরমুর করে ভাঙছে; ওরা যত আগাচ্ছে, তত জোরে জোরে ভাঙছে। সামনে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিডের কংক্রিটকঙ্কালটা। সুনামির পর থেকে ওইটাকে প্রতিদিন নিয়ম করে কেউ আকাশ থেকে চাপ দিয়ে-দিয়ে চারকোনা বানিয়ে দিচ্ছে; ভাঙা মসজিদ আর ভাঙা লাইটহাউজ সমান-সমান হয়ে প্রায় পাশাপাশি বসে আছে। আবরারের সাথে হাঁটতে-হাঁটতে গিয়াস অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে— পুবদিকের বালিয়াড়িটা আগে অত চওড়া ছিল না, বাড়িতে ওর শ্বশুরের বড়ো বাথান আছে, গরু আর বন্যায় ভেসে যায় না আজকাল—একটা বুড়া গরুর নাম বদলে নাকি গিয়াসের সুপারিশে রাখা হয়েছিল গরিবে নেওয়াজ; বড়ো পয়া ছিল নামটা। বাড়িতে যাওয়া হয় নাই গিয়াসের গত কয়বছরে একবারও। শ্রীলঙ্কা হয়ে রাতের ট্রলারে করে এইখানে এসেছিল গিয়াসরা আঠারোজন; শহরে ব্যাংকের বিল্ডিংয়ে ক্লিনার ছিল ওরা পনেরোজন; রিজর্টের চাকরি পেল পরে ওরা পাঁচজন; সেই পাঁচজন আবার বাকিদের মধ্যে আটজনকে টেনে আনলো। সুনামি গেল। এর-ওর বাঁচা-মরা-নিরুদ্দেশ—ওইসবও গেল। এরপরে আবার গুজব রটল যে, নুহের দুই নম্বর প্লাবন নাকি আসছে আর দ্বীপ নাকি পানির তলে চলে যাচ্ছে- মহাবিপদ। এতে দুবাইয়ের শেখদের দ্বীপ কেনা আর রিজর্ট বানানোর তেল কমতে থাকল। গিয়াসদের সংখ্যাও কমতে লাগল; ডিটেনশন সেন্টারেও তো ছিল জনাকতক। কমতে কমতে ওদের দলের সাইজ এগারোতে নেমে আসলো আর ততদিনে গিয়াসরা দ্বীপে শিকড় নামিয়ে দিয়েছে। এখন কোলুফুশি ফুটবল টিমের হয়ে গিয়াসরা খেলে নাকি প্রত্যেক বছর, মানে গত বছর পর্যন্ত খেলেছে, শুধু একবার শহরের বি-টিমের কাছে হেরেছে নাকি ওরা। গিয়াস মুখ কালো করে বলে যে, এই বছর টিম অর্ধেকই হয়ে গেল, খেলা হবে না। অনেকে সিরিয়া চলে গেছে। কার কথা বলতে গিয়ে গিয়াসের চোখ জলে টসটস করে ওঠে, বারবার বলতে থাকে, “স্যরি চাইছি, আমি স্যরি চাইছি”-স্যরি চাইছে গিয়াস, তবু ওই মানুষটার ঝুলতে হলো। আবরারের মনটা খারাপ হয়; ও নিজেও যাচ্ছে তো; না গেলে হয়তো একটা নতুন জীবন কল্পনায়—মানে এইখানেই—বসাতে পারতো। ফুটবল হবে না হয়তো, ফিল্ড হকি বা রাগবি। কিন্তু খেলায় মজে থাকা কী কুৎসিত! তেমন থাকতে হলে দুনিয়ার সাধন-সম্ভাবনাকে যেভাবে ভুলে থাকতে হয়, সেই ধাপ পার হয়েই না ও এইখানে এসেছে! এখন আর থামার উপায় নাই। সর্বজনাব মালিকের কাছে একবারে ফাইনাল কমিটমেন্টে বাঁধা পড়ে গেছে আসমার ছেলেটা।
আবরারের চুলে বাতাস লাগে, নারিকেল গাছ নত হয়, কিন্তু গিয়াসের সিঁথিকাটা চুল জায়গা থেকে নড়ে না। ভিড়ানো চার্টার বোট—লোকালরা বলে হঢু, দ্বীপ-টু-দ্বীপান্তরে যাওয়ার বাহন—ব্যাকগ্রাউন্ডে রাখতে গেলে লাইটহাউজ পাওয়া যায় না; তাই আবরার একবার লাইটহাউজসহ, আরেকবার বোটসহ সেলফি তোলে; গিয়াস বলে, মোবাইল ফোনের টাওয়ারের নিচে গিয়ে দাঁড়ালেই ফেসবুক চালানো যাবে; আর তারপর তো ফোনের আওতা থেকে একদিন সবাইকে দূরে চলে যেতেই হবে; গিয়াসের তো নিজেরই বিশ্বাস হয় না যে, একদিন সে ভাবত, লোকে বুড়া হলেই শুধু ইবাদত করে। আবরার গিয়াসকে মাঝে-মাঝে সহ্য করতে পারে না—দিনদুনিয়ার চাতুরি ধরার বুদ্ধি নাই লোকটার, শুধু যেইসব চাতুরির কথা লোকে বলতে-বলতে মুখস্থ করে ফেলেছে, তেমন চাতুরির সাথে একটা বোঝাপড়া আছে, অংশগ্রহণ আছে, কিন্তু এদিকে আবার একটা নির্লিপ্তি দিয়ে ওই বুদ্ধিহীনতাকে স্বভাবে ব্যালেন্স করে রেখেছে সে। আবরার গিয়াসকে বলে যে, ও ফেসবুকে তেমন যায় না, তবে ইনস্টা আছে। এদিকে ক্যাপ্টেন মামুন আর শেফ গোপাল বোটের চাতালমতন জায়গাটায় ডুবি ধরিয়েছে, কর্মবিরতির সময়ে এই রকম ব্যত্যয় চলে; গিয়াস হাঁ-হাঁ, না-না করে উঠে ওদের বলেছে যে, ওর ভাইয়া ওইসব খাবে না। আবরার ভদ্রতা দেখিয়ে ইঙ্গিত করে যে, গিয়াস চাইলে ওদের সাথে বসতে পারে, কিন্তু গিয়াস তো প্রশিক্ষিত অনুচর-জিভ কেটে আর নাক-কান মলে নাটকীয় ভাবসাব করে আর তারপর এক পায়ের স্যান্ডেল খুলে টুথপাউডারের মতো দেখতে শাদা বালিতে গোড়ালি ঘোরাতে থাকে। শ্রমিক লোকেরা এইখানে জলবায়ুর মতো উষ্ণ, আর্দ্র— গায়ে জলার ধারের ঘাসপচা গন্ধ; ওরা ঘাসের মতোই মাটির কাছ দিয়ে জলের কাছ দিয়ে জিঘাংসায় হিসহিস করে বইতে চায়, কিন্তু গোড়া থেকে নড়তে পারে না, কোথাও যেতে পারে না — মূলাবদ্ধ হয়ে জীবনের ফন্দিফিকিরে ফেরে কেবল। গোপালের নাকি হাকুরা-হুরা দ্বীপে পরির মতো দেখতে এক মাশুকা আছে, রিজর্টের স্পাতে জুনিয়র মাসাজ থেরাপিস্ট, তার জয়েন্ট মাসাজ নাকি দখিন সাগরের এই দিকে জগদ্বিখ্যাত, চাহনেওয়ালাদের গা মটমট করে ভেঙে-গুঁড়িয়ে দেয় নাকি সে, আর ‘একবার মাসল মেঁ উৎসব রচ যায়ে তো…’ ওই ধস্ত পুরুষগুলি নতুন, ভিরাইল পুরুষ হয়ে বেরিয়ে আসে, যেমন বেরিয়ে এসেছে গোপাল নিজে, কাগজের পদ্মফুলের কোরকের ভিতর থেকে, মাছ মারার নৌকার জীবন, জেল-জরিমানা, ডিটেনশন সেন্টারের ট্রমা থেকে। আমেরিকান মক্তবে শেখা উর্দু দিয়ে আবরার ওদের সাবটেক্সটগুলির নাগাল পায় না, তাই ওদেরকে একটা চিহ্নে, একটা ‘শেআরে’ ছোটো করে আনা ছাড়া আবরারের আর কিছু করার থাকে না। ওরাও তা-ই করতে থাকে। আবরারের অতিউচ্চারিত ক-খ-গ-ঘ মন দিয়ে শুনেও ওরা না-শোনার ভাব করে। ক্যাপ্টেন মামুন স্বল্পভাষী, তার উপর বারান্দাওলা হ্যাট দিয়ে আধাটুক চোখমুখ ঢেকে রেখেছে, তার মধ্যেই তড়িচ্চুম্বকীয় আবেশ কাজ করে, অর্থাৎ আবরারকে মিরর করে মামুন—’ফাসেক’ বলে কাকে যেন। গোপাল আর গিয়াস কিছু না বুঝে হাসে। কথায়-কথায় গোপাল গিয়াসের উপর কী নিয়ে যেন খাপ্পা হয়; গিয়াস ‘ইন্ডিয়া-ইন্ডিয়া’ করতে থাকে—”হেহ, মলদ্বীপ ডাকে আবার কথা কয়… ভাবছে, মল মানে বুঝে না কেউ।” গোপাল রাগ করে আবরারের দিকে চেয়ে হাসে। আবরারকে বৃথা সাক্ষী মেনে বলতে থাকে, হারামিকা অওলাদ গিয়াস নাকি প্রতি জুম্মাবারে বোটের কিচেনে এসে বালতিভরে রসুনবাটা নিয়ে যায়—এমনই এক জুম্মাবারে ককটেল বানিয়ে খাওয়ানোর আবদার করেছিল আর তারপর মাতাল হয়ে শেঙ্কের বোতল ভেঙে একাকার নাকি…. কন্ট্রোর বোতল উপচে কাঠের মেঝে কমলা হয়ে গেছিল আর ক্যাপ্টেন মামুন একহাতে নাক চেপে ডানঘাড়ের পিছন দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে মেঝে ঘষে কমলা বমি পরিষ্কার করেছিল, “অ্যায়সে-অ্যায়সে করকে” বলে বোটের উপর চার হাত-পায়ে অভিনয় করে দেখায় গোপাল। গিয়াস লজ্জা পেয়ে চুপ করে যায়, কিন্তু মামুন হাসতে হাসতে পা তুলে এক লাথি দেয় গোপালকে; গোপাল পানির উপর পড়তে-পড়তে সামলে নেওয়ার অভিনয় করে; কবে নেশা করে কী করেছিল, তার স্মৃতিচারণ আরেকবার নেশা করে করলেই ভালো হয় বুঝি। মামুনের মেজাজ হালকা লাগে, বাতাসের সাথে এলোমেলো হয়ে গড়িয়ে যেতে থাকে। গাঁজায় টান দিয়ে মামুন মাথার ভিতর ক্রমে দুই জাহান দেখতে থাকে, দুনিয়ার সমস্ত টাইট কণিকার বাঁধুনি আলগা আর খোলাসা হয়ে আসে আর সে কথা কম, গান বেশি গাইতে থাকে ভুলভাল উর্দুতে- “সুরজ মেঁ লাগে ধাবরা, ফিরতকে কারিশমেসে—বুত হমকো কহে কাফির, পুছো তো কভি পি হ্যায়?” গোপাল ওর ফোন থেকে নতুন শেখা ককটেলের ছবি দেখায়—বিড়ালের মতো মোলায়েম সফেন হুইস্কি সাওয়ারের রেসিপি; মামুন আমোদিত চোখে নীরবে চেয়ে থাকে। আল্লামা শিহাবুদ্দিন সাহেবের ওয়াজ—সাইন্স বিষয়ে, তাই নিয়ে গিয়াস লম্বা-চওড়া কথা বলে, মিশিং লার্নিং নামে একটা নতুন আবিষ্কার নিয়ে উত্তেজিত থাকে; মামুন তাই নিয়ে ছিক করে হেসে ওকে শুধরে দিতে চায় আর পাছে নিজেও ভুল করে ফেলে, সেই ভয়ে টুপির নিচ দিয়ে আবরারের দিকে তাকায়। গোপাল বসা থেকে উঠে বেল্টের বাল খুলে নতুন করে বাঁধে। একটা মাগরুর বাতাস এর মধ্যে হুড়মুড় করে লাইটহাউজের দিকে যেতে ধরে, বোটটা দশ সেকেন্ড টলে উঠে তারপর সামলে নেয়। আবরার ওই বাতাসের আগা-মাথা বোঝে না, কিন্তু গিয়াস বোঝে। আবার বোঝেও না বুঝি। আবরার গিয়াসদেরকে বলে, সে নাকি পাঁচ মাসে তার মায়ের পেট থেকে বের হয়েছিল। নবি দেখছে রকমের চেহারা করে গোপাল আবরারের দিকে চায়, তারপর মুখ হাঁ করে গিয়াসকে কিছু বলতে চায়। গিয়াস অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে, কারণ নইলে হেঁ-হেঁ করতে-করতে স্বীকার করার নাটক করতে হবে যে, আবরার যেহেতু দারুণ ইস্পেশাল, সেহেতু ভ্রূণ-আবরার তিন মাসে বের হলেও অবাক হওয়ার কিছু নাই।
আবার বাতাস দেয়। এক ধাক্কা থেকে আরেক ধাক্কার মাঝের বিরতির সময় কমতে থাকে বুঝি। নারিকেলবাগানে ভূতের হাওয়া কোন শিশুকালে শুনেছিল কে, নাকি শোনে নাই—কানের কাছে বাতাস সেই সুরে “ ও ভাই, ও ভাই, ও ভাই” করে গান গায়, দুই পর্দার মাঝে ওঠে আর নামে। এই লোকগুলিকে টাইট করে জড়িয়ে ধরে আবরারের বলতে মন চায়, “ও ভাই, ও ভাই, ও ভাই।” আরেক পুরুষের উপর তীব্র সৌহার্দ্য আর অবিশ্বাস একসাথে আরোপ করে পুরুষ কেমনে চামারের মতো বিবর্তনের ধর্ম পালন করে, সেটা আবরারের আগে দেখা হয় নাই। চারিদিকে সমস্ত এত পুরুষালি; আবরারের আম্মা বা ঝামেলা খালা বুঝি দেখেছে এইসব। আবরারের বসুন্ধরা জননীই-নারীই-বিনুনির নকশার সাথে কলিজা বেঁধে রাখা, আত্মার সাইজ ছোট্ট-পেতিত-পারস্পরিক বিশ্বাস আর বেদনায় দ্বন্দ্বমুখর। এদিকে যেই না ক্যাপ্টেন উঠে গিয়ে চাবি দিয়ে স্টীলের আইস বাকেটের তালা খোলা শুরু করে, অমনি ধাতু ঘষটে যায় আবরারের কানে–ওর বাপ মনসুরের মাজা দাঁতের হাসি শিন-শিন করে ওঠে মনের মধ্যে; এমনিতে মনসুরের হাসি নিশ্চয়ই তেমন না, কিন্তু চেনা পুরুষ লাগবে আবরারের একজন— ধাতব দুনিয়ার সাথে একাত্ম হতে। তেমন ব্রাদারহুড কি আর সামান্যে পাওয়া যায়?
*
সুনামির সময় কেমন বাতাস উঠেছিল, গিয়াসরা ভোলে নাই। দালানের মতো বড়ো- বড়ো ঢেউ—দক্ষিণ সাগরের রান্নামারি দেও, যাকে পুরাকালে তাবরিজের পীরসাহেব বশ করে আবার সাগরতলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দেখে রাজারাজড়াসহ পুরা জনপদ মুসলমান হয়ে গেছিল, সেই দানো আবার ফিরে এসেছিল। টহলনৌকায় ছেয়ে গেছিল আইল্যান্ড রিজর্টের তটরেখা। হাইড্রলিক হর্নের শব্দ চারিদিকে। কেয়ামত এত তাড়াতাড়ি আসবে, গিয়াসরা তেমন ভাবে নাই। এমনকি কেয়ামত নিয়েও গিয়াস কোনোদিন ভাবে নাই; নিজের পাপ, নিজের পরিণতি, নিজের ঘামের গন্ধ ইত্যাদি নিয়ে কে কবে ভাবে? রিজর্টের ভিতর মৌচাকের অভ্যন্তরের ব্যস্ততা ছিল সেইদিন প্রতিদিনের মতো। গিয়াস সেই সময়ে খানা খাচ্ছিল—টিফিন বক্সের ভিতর থেকে টুকটুক করে তুলে, বক্সের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে। প্রথমে মাটি একটু দুলে উঠল—গিয়াস টের পেয়েছে কি পায় নাই, কোথা থেকে কে এসে দুনিয়ায় পাতা উলটিয়ে দিলো, বাতাসে ক্যাপ্টেন মামুনের টুপি উড়ে গেল। ঢেউটিন দিয়ে একটা গুমটিঘর বানানো হচ্ছিল—ম্যানেজার ডাকত শেড, তার চাল উড়ে গেল লম্বালম্বি গতিপথে। দুইটা পামগাছ কবে থেকে দুই সান্ত্রির বর্শার কায়দায় গুণচিহ্ন বাগিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল—তা সেই পোক্ত গুণচিহ্নও ছুটে গেল আর বিহ্বল গাছ দুইটা হুমুশুম করে মাটি কামড়ে উড়তে থাকল।
সেই রাতে গিয়াসের জ্বর উঠেছিল বুঝি। সাতাশি দ্বীপের সাতাশি রিজর্টের উপর দিয়ে আজাবের যেই রাত গেছিল, পানির মতো সেই রাতের ভিতর থেকে সাঁতরে গিয়াস তীরে উঠেছিল। স্বপ্নের ভিতর গিয়াস কোলুফুশির মসজিদের ভিতর ঘুমিয়েছিল। কী করে এই দ্বীপ পার হয়ে ওই দ্বীপে গেছিল, স্বপ্নে সেইসব দেখে নাই গিয়াস। শুনেছে শুধু সিঁউ-সিঁউ বাতাসের গর্জন আর তার ভিতরে ও ছুটেছে আলকুশি, বোতামফুল আর বিছুটির ঝোপ পার হয়ে। স্বপ্নে একটা কুকুরও—কুত্তি — মসজিদের ভিতর বিহ্বল চোখ করে ঘুরছিল। চোখের আন্দাজে কিছু ধরতে চেয়েছিল গিয়াস: কুকুরটার মাসিক হয়েছিল—ওই জায়গা দিয়ে টুপটাপ করে পাতলা রক্ত পড়ছিল, তাতেই না গিয়াস বুঝতে পারল যে কুকুরটা মেয়ে-কুকুর আর তাতেই না মায়া হলো গিয়াসের আর হারামের উপর হারাম জেনেও খেদাল না। এমনিতেও গিয়াসের জগতে সত্তরভাগ হারাম; প্রতি চার হাত মাটিতে তিন হাত পানি, প্রতি চারজন লোকের মধ্যে তিনজন অন্য দুনিয়া থেকে আসা ট্যুরিস্ট, সূর্যের নিচে কাপড় খুলে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা প্রতি চারটা মেয়েলোকের মধ্যে তিনজনের পিঠ শাদা, তাতে আবার লাল-লাল তিল। চারটার মধ্যে আরেকটা মেয়েলোকের জায়গা না হয় এই কুত্তিটাই নিল! মসজিদের সামনে গোছা-বাঁধা ঋজু নারিকেলগাছগুলি, যেগুলিকে সমুদ্রের ভিতর থেকে স্পীডবোটের উপর থেকে দেখলে প্রজ্জ্বলিত আগরবাতির মতো লাগতো, সেগুলি আর সরলরেখা ছিল না, নুয়ে-নুয়ে পড়ছিল স্বপ্নে। স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন দেখেছিল গিয়াস—স্বপ্নের ভিতরই ইমাম সাহেব ডেকে তুলেছিলেন তাকে। কী প্রসঙ্গে যানি একঘেয়ে সুরে বলছিলেন, “কোনটা চাই? বাতেনি জ্ঞান নাকি জাহিরি?” মানে প্রাণের ভয়ের মধ্যে যেটা প্রারম্ভিক ভয়, সেটা গিয়াসের মিটে গেছে ওই স্বপ্নেই আজীবনের মতো। গিয়াস ধড়মড় করে জেগে উঠেছিল, টের পেয়েছিল মণি খসেছে। গিয়াস কখনোই ভয় থেকে রোমাঞ্চ আলাদা করতে পারতো না, কে-ই বা পারে? মৃত্যুভয় আর পবিত্র একটা রুহুর সামনে দাঁড়ানোর ভয় এই রকম উত্তেজক। স্বপ্নে রজঃস্বলা কুত্তি দেখে উঠে গিয়াস টের পেল, ক্যাম্পে গাদাগাদি করে মানুষ ঘুমিয়ে আছে আর সে ঘুমিয়ে আছে তাদের মাঝখানে। খাটের নিচে পানি থইথই; কেশবতীর মাথার মতো দেখতে ভাসমান শেওলা। ঘাম আর প্রস্রাবের গন্ধ চারদিকে। জেটি গেছে, রিজর্ট গেছে, রিজর্ট গেছে, মসজিদ গেছে, চাকরিও কি গেছে? জানটা যায় নাই শুধু। আল্লাহ, আল্লাহ… শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু এই যে ভোররাতে ঘুম ভেঙে ওঠার একটা মুহূর্ত, যেই মুহূর্তে স্বপ্নে একটা মসজিদে একটা নোংরা কুকুরের সাথে শুয়ে থাকাকে বাস্তবে একদল মানুষের সাথে শুয়ে থাকার চেয়ে ভালো মনে হয়, গিয়াসকে শান্ত থাকতে দেয় নাই। বামহাতে প্যান্টের ওই নোংরা জায়গা ঢেকে রেখে গিয়াস ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। চোখ বন্ধ করে সে শুধু চোখে লবণপানির ঝাপটা টের পেয়েছিল। জলোচ্ছ্বাসের ভিতর একটা নারিকেলগাছের আগা ধরে যখন ভেসেছিল গিয়াস, থুতনির যেই বিন্দু পর্যন্ত পানি উঠে গেছিল, সেই বিন্দুতে এখন গিয়াসের এক মুঠি দাড়ি। সেই রাতের পর দীর্ঘদিন গিয়াস পানির দিকে তাকাতে পারতো না আর ওইজন্যই অপলক তাকিয়ে থাকত পানির দিকে। কী যেন টানতে থাকত তাকে পানির দিকে—ত্রাস, সর্বনাশ এইসবের দিকে, তাই সে রিজর্টের ওপেন-প্ল্যান বারের ময়লা গ্লাস-ডিশ ধুতে ধুতে খোলা আকাশের দিকে চেয়ে থাকত। সেই আকাশ দেখতে লাগতো পানির মতন; তখন গিয়াসের মনে হতো নারিকেলগাছ ধরে সেই যে সেইদিন গিয়াস ভেসেছিল পানির উপর, সেইদিন কেন সে পিড়িং করে আকাশে উড়ে গেল না! বড়ো করে একটা দম নিয়ে ফুসফুসটাকে গ্যাসবেলুনের মতো ফুলিয়ে সে কি পারতো না এইসব থুয়ে উড়ে যেতে? আকাশও পানির মতো টানতে থাকত তারপরে; তখন কিছু একটা তাকে করতে হতো সেই টান প্রশমন করতে। সেই সময়ে হাতের কাছে ছিল যা, তাই দিয়ে সেরেছিল। মণি খসানোর গুনাহ যখন তার অন্তরাত্মা সম্পূর্ণ কালো করে ফেলল, তখন ক্যাপ্টেন মামুন তাকে নেশা চেনাল। নেশার সময় গোপাল একটা খেলা চালু করল, যেখানে ওদের প্রত্যেককে সুনামির স্মৃতিরোমন্থন করতে হতো, কিন্তু সেইটা করতে হতো আগের বারের চেয়ে গল্পটা একটু বদলে নিয়ে আর নইলে এক গল্প শুনতে-শুনতে সেই গল্পের পুরানো ক্রাইসিসকে উচ্চতর আর তীব্রতর করতে-করতে গোপালের নাকি সুসাইড করতে মন চাইত। গিয়াস দমে দমে বিড়বিড় করে আল্লাহকে ডাকত। মালিকের সাথে সম্পর্ক যা, তা দিয়েই সুনামিকে বুঝতে আর বোঝাতে হতো গিয়াসের। প্রথম-প্রথম কৌটা খুলে তিন-চার গুলি হাজমোলা বের করে খেত ওরা। তারপর ডুবি। এই নাম ছাড়াও আরও নানান নামে নেশাকে ডাকত ট্যুরিস্টরা— যে সমুদ্র আরেকটু হলে গিয়াসকে মারতে যাচ্ছিল, সেই সমুদ্রে এসে ও-শালারা কেলি করে। শুরুতে বেদম রাগ উঠত গিয়াসের, পরে ওই রহমানুর রহিমের কথা ভেবে কী জানি হিসাব মেলাত, রাগ শান্ত করতো। এমনি করে নেশার মধ্যে দিয়ে বড়ো করে দম নিয়ে উড়ে যাওয়ার খিদা আর ওইসব ওইসব আগুন গিয়াস অন্তরে জুড়াল।
“না না। উস বান্দি-কা নাম আলম আমলুদ্দি।”
“না তো। আমাল আলামুদ্দিন।
“কামাল জামালুদ্দিন। “
“জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর।”
“কৌন?”
“ওই চুপ! জাজ কুলুনির বউ। সম্মান-কে সাথ বাত কর।”
“কিউ? ভাবি হ্যায় হমারা? কুলুনি কেয়া হমারা ভাই লাগতা হ্যায়?”
“শালা”, বিড়বিড় করে গিয়াস। আবরার কী বুঝল না-বুঝল ভেবে আবরারের দিকে চেয়ে বোকা-বোকা হাসে আবার। আবরারের আব্বা-আম্মা যেই কটেজে তশরিফ রেখেছেন, সেই কটেজেই নাকি জর্জ ক্লুনির বউ উঠেছিল। লোকটা নাকি আমেরিকার নায়ক; একটু বুড়া। বউ মুসলিম। মাথায় কাপড় দেয় না। উকিল। দেশ-বিদেশ ঘুরে ওকালতি করে। দ্বীপের ওই জোয়ান প্রেসিডেন্টের হয়ে ওকালতি করতে এসেছিল। ওই সময়ে বেটি নাকি টিভি চ্যানেলে বলেছে যে দ্বীপভরতি সবাই টেররিস্ট। রাগে গিয়াসের গলার কাছের রগ কাঁপে, মাথার পিছে পামগাছ নড়ে। রিজর্টে বেটির সাথে ছিল তার কুড়িয়ে পাওয়া কুত্তা—”নেহি, কুত্তি”, গিয়াস গোপালকে ঠিক করে দেয়— নাম বুঝি মিলি-না-ঝিলি। গিয়াস বলে গ্রামের বড়ো ভাইয়েরা যেসব রাতে গিয়াসকে ডেকে নিয়ে যেত, সেসব রাতের দস্তুরই ছিল এই যে, পাড়ায় পাড়ায় কুত্তা ঠেঙানো হবে, আধমরা হওয়া পর্যন্ত ঠেঙিয়ে তারপর ছেড়ে দেওয়া হবে প্রাণিগুলিকে। গিয়াসের কথা আবরারের কাছে বীভৎস লাগে, কিন্তু গিয়াস তার কথা থামায় না। আবরারের ধনিক ফ্যামিলি ওই কটেজ ভাড়া করতে পারে আর ওই ফ্যামিলির ছেলে সিরিয়া যেতে পারে—এর অর্থ গিয়াসের কাছে এইটুকুই যে এইবার শেষমেশ সেয়ানে সেয়ানে লাগিয়ে দিতে পেরেছে সে। আলাম-নাকি-আমালুদ্দিন–ওই বেটি কোথায় পালাবে এইবার? নয়া হুকুমত যখন আসবে, তখন কই যাবে? অন্যরা প্রসঙ্গ পালটায়-চাইনিজ রকেট পড়বে কাল; এখন নয়া হুকুমত নিয়ে কথা বলার সময় নাই। সনেভাফুশি দ্বীপের উঁচা-লম্বা টেলিস্কোপে নাকি দেখা গেছে দক্ষিণ-পশ্চিমদিক সই করে পড়বে ওই রকেট—সর্বাঙ্গে আগুন ধরা একখানা উল্কা কিম্বা মিসাইলের মতন দেখাবে ওটাকে। আমেরিকা নিন্দা জানিয়েছে, যদিও চল্লিশ-কি-পঞ্চাশ বছর আগে— গোপালের বাপ-মায়ের বিয়ের পরপর—আমেরিকার রকেটও এমন করে পৃথিবীর মাথার উপর পড়েছিল। ক্যাপ্টেন মামুন রগড় করে গোপালকে জিজ্ঞেস করে, গোপালের আব্বুজি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে ধমক দিয়েছিলেন, নাকি দেন নাই। গোপাল মামুনকে পাত্তা না দিয়ে আড্ডা গরম করে; অনির্দেশ্যভাবে জিজ্ঞেস করে, এক দেশের রকেট ভুলে আরেক দেশে গিয়ে পড়লে আর তাতে জানমালের ক্ষতি হলে, শাস্তি কী, তা দুনিয়ার আন্তর্জাতিক আইনে কোথাও লেখা আছে কি না। আবরার উত্তর দেয়— আছে; অর্থদণ্ড। সবাই বিরসমুখে চুপ হয়ে পড়ে। দুনিয়াবি আইন-কানুন এমনই। কেউ কিছু বলছে না দেখে আবার পুরানো কথা বলে ওঠে গিয়াস, “আপকা আব্বুজি শরাব নেহি পিতা”–যেন আবরারের উদ্দেশ্যে বলছে না, যেন একটা কবিতার লাইন মুখস্থ বলছে।
*
মেয়েটার জুলফির কাছে অধুনা সেরে-যাওয়া গভীর কাটা দাগ। “জামাইয়ে মারছে নি কিতা?” জন্মসূত্রে চেরা-ঠোঁট, সোয়ামিসোহাগিনি হাসি-হাসি। গভীর শাদা সিঁথি। কপালে বড়ো সিঁদুরের টিপ। মুখে একটা দাগ-ব্রণ-লোমকূপ নাই—এমন মসৃণ কী করে হলো? জামাই ঘষে সমান করে দিয়েছে বুঝি? মনসুর আসমার সামনেই ভাড়াটিয়ার বালিকাবধূটার সাথে ফ্লার্ট করে। বাড়ির ভিতরে কেউ গান শেখাচ্ছে, তিরের মতো কান বিদ্ধ করে এমন গলার একটা কমবয়সি ছেলেকে। ঋতু বসন্ত—প্রথম দুইটা শব্দ শুধু কানে শুনে বোঝা যাচ্ছে। শিক্ষকসাহেব সাবধানি, ওল্ড-ফ্যাশনড গলায় প্রশংসা করে বলছেন, “বাহ, গলা ঘুরে তো দেখি ভালোই… গা-মা-রে-সা-নি-সা হইব না, হইব না কিন্তু ওইটা”। শিক্ষক সিলেটের নন। উঠানে একটা শান্ত, ন্যাংটা বাচ্চা বসে কার যেন ফেলে দেওয়া একটা অ্যাবাকাস নিয়ে ওটার লাল-কালো পুঁতি বহু যত্নে ইধার উধার করছে। কোনদিক থেকে যানি আরেকটা বাচ্চার হুঁশিয়ার কান্না ভেসে আসছে; নিজের কান্নায় নিজেই ক্লান্ত হওয়ায় বুঝি থেমে গেছে একবার, তারপর ভূমিকায় থাকার জন্য কিম্বা স্বার্থ হাসিলের জন্যই বুঝি আবার গা-ঝাড়া দিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দেয় বাচ্চাটা আর দুইটা বেসুরা ধরার পর আবার কান্নায় পুরানো সুর লাগায়। কে যেন একটা মেয়ে, শাদা ওড়নাটা বাতাসে ধীরে ভাসছিল, এসে একটা শাদা রাজহাঁসকে দানা খেতে দিয়ে হাঁসটার মাথায় অসম্পূর্ণভাবে হাত বুলিয়ে উঠে চলে যায়, হাঁসটা মাথা তুলে কিন্তু-কিন্তু করে ওঠে, কিন্তু (হংসরাজজনোচিত, বলল মনসুর কয়েকবার, জিহ্বায় গিট্টু পেকে গেল) অহমে নাকি লজ্জায় মেয়েটার দিকে আর এগিয়ে যায় না। পরক্ষণেই হাঁসের রোস্ট চলে আসে মনসুরের সামনে—টসটসে আর ঝোলের কালিমায় লিপ্ত, হাঁসটার ব্যাকুল- কালা চোখের মতো—সত্যিই? নাকি মনসুরের মনের পাপ ওইসব দৃশ্য? পথে বৃষ্টিতে পড়েছিল মনসুর আর আসমা, মিষ্টি-ফিষ্টি কিনতে বাজারে থামতে গিয়ে এই বিপত্তি। আবরার ওর চাচার সাথে গাড়িতে এসেছে আর এসেই খেতে বসেছে। মনসুরের প্যান্ট এত ভিজে গেছে যে, অন্তর্বাসের কাপড় পাছার চামড়ায় মিলেমিশে কুটকুট করছে, যেন জলে নেমেছিল মনসুর শাপলা তুলতে, অথচ জলে তো সে নামে নাই মোটেও। জাপানি হানিসাকল—মধুমঞ্জরি, মনসুর বাংলা নামও জানে—তার দুইখানা জিহ্বা বের করে বাঁশের বেড়া বাইছে। ঋতু বসন্ত গাওয়া শেষ, এবার মেয়েলি গলার ছেলেটা রবীন্দ্রসংগীত গাইছে খানিকটা পল্লিগীতির মতো করে, তাই গানটা অনেক টানছে মনসুরকে। অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দমধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণি বাওয়া। মন্দ আর মধুরের মধ্যে দম নিচ্ছে ছেলেটা। দেখি আর নাই-এর মধ্যে দম নিচ্ছে। গানটাকে ভেঙেচুরে একদম নিজের বগলদাবা করে নিচ্ছে ছেলেটা। গোয়ালঘর থেকে ছোটো ছোটো গরুর হাম্বা, বড়ো-বড়ো গরুর নাদির গন্ধ, ভেজা খড়-বিচালি, রান্নাঘর থেকে কি জানি কী মাড়াইয়ের একটানা পাংশা-পাংশা শব্দ—সমস্ত কিছুর মধ্যে মনসুরের মনে হলো আসমাকে আজকেই বলে, “আজকেই গ্রামে জমি কিনলে কেমন হয়?” অথচ গ্রামে পা রাখার আগে এই মনসুরই তো আসমাকে বলেছে, “আম্মা চলে গেল। আর এইখানে কোনোদিন আসা হবে না, সামাহ। বুঝলা?”
মনসুর জানে—শুধু প্রাপ্তি আর সিদ্ধি আর ভক্তি আর ভোগ; এইসব বাদে আর কোনোভাবে কোনোকিছুকে ভালোবাসতে পারে না সে। সন্ধ্যায় গুব-গুব করে যখন কী জানি কী পাখি ডাকে, ভাড়াটিয়াদের বাড়িতে বৃহস্পতিবারের পাঁচালি পড়ে কেউ—
নারায়ণ কহে, ‘শুন বলি মুনিবর,
এই দোষ অলক্ষ্মী নারীদের ‘পর।
শ্বশুর-শাশুড়িগণে সেবা নাহি করে,
গোবরের ছিটা কভু দেয় নাকো দোরে।
বাবুগিরি নষ্ট হবে, এই ভাবে মনে।
অত্র গৃহে নরমুক্তি হৈবে কী কারণে?’
মনসুর জানলার কাছে বসে ক্রমশ নাই হয়ে যাওয়া আলোতে বসে ল্যাপটপে টুকটাক লেখে। গদ্যকবিতা। ফেসবুকে দেবে। বইও করবে, কথা চলছে; প্রকাশক বলেছে দুই লাখ টাকা দিলে বই করে দেবে। না, ঠিক ওইভাবে বলে নাই। বলেছে, “কয়েকশ কপি আপনি কিনে নেন, নাকি মনসুর ভাই?” মনসুর রাজি হয় নাই, ওর যশের দাম মাত্র দুই লাখ ধার্য করল লোকটা! আসমা এই লেখক মনসুরকে ভালোবেসেছিল বহু আগে। আজ আর নাই সেই ভালোবাসা।
অ্যাজটেক গান থেকে চুরি করে মনসুর লিখছে, “সূর্যমুখীর মতো নিজের জ্বলন্ত মাথা মৃত্যুর চোয়ালের ভিতর ঠেলে দাও, হে পাঞ্জেরি।” আবার গলা উঁচু করে আসমাকে শোনাচ্ছে। ‘পাঞ্জেরি’ পেল কোত্থেকে মনসুর?
Be indomitable, Oh my heart!
Love only the sunflower;
It is the flower of the Giver-of-Life!
What can my heart do?
Have we come, have we sojourned here on earth in vain?
As the flowers wither, I shall go.
Will there be nothing of my glory ever?
Will there be nothing of my fame on earth?
At most songs, at most flowers,
What can my heart do?
Have we come, have we sojourned on earth in vain?
চাতুরি, সমস্ত চাতুরি—বাজিকর হতে চায় মনসুর। ঐন্দ্রজালিক। মনসুর দিনমান লেখালেখির নামে, ক্যারিয়ারের নামে, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার নাম যেইসবের চর্চা করে—শক্তি, সৌন্দর্য, নৃশংসতা, কৌশল, ওইসবের মধ্যে মনসুর এমনকি ঠিকঠাক নিবেদিতও নয়। প্রতি দুই বছর অন্তর তার ওইসব চর্চার স্ফুরণ ঘটে, ক্রিয়েটিভ ইগো মাথা তুলে, প্যান্ট ছিঁড়ে-ফুঁড়ে জেগে ওঠে, আবার বছর দুইয়ের জন্য মিলিয়ে যায়। কায়রোতে নীলনদের উপর দিয়ে মরা ঘোড়া ভেসে যাচ্ছিল একদিন, স্যুয়ারেজের নোংরা পানি এসে নদের পানিতে মিশেছিল, সেই মিলনস্থানের চারিদিকে স্বপ্নের মতো শাদা-শাদা ফেনা। সংসারে নিজেকে নীলনদ মনে হয় আসমার; আবরারকে শাদা ফেনা আর মরা ঘোড়া মনসুর তো মরেছেই। বড়ো হওয়ার পর ছেলেকে শিখিয়েছে মনসুর, ক্রিয়েটিভ রাইটিং হতে হবে এমন, যাতে কালেকটিভ কনশাসের মধ্যে যে-কোনো একটা কিছু যত বড়ো, তার থেকেও বড়ো করে দেখানো যায়। যাতে মনের ভিতর একটা কিছু যত ছোটো, যত কালো-কুৎসিত, যত স্বচ্ছ টলটলা, তার চেয়ে বেশি- বেশি-বেশি করে দেখানো যায়। এইসবই নাকি ক্রাফ্ট। কই গেল মনসুরের কাঁচা-কাঁচা প্রেমের গল্প? এই নতুন লেখক মনসুর আর ছেলে আবরারকে আসমা ভয় পেত। চিকন ভয়। আসমার সাপেক্ষে পশুশাবকের মতো ছিল বাপ-ছেলে দুইজনই—আসমা আছে, তো এরা আছে; আসমা নাই, তো এরা নাই– আসমা এদের উভয়ের মা, ভগবান। তবু কেন আসমার এত ভয়? কারণ এরা ম্যাগনিফাই করবে দুনিয়ার ভোগান্তিকে; দুনিয়া যা-নয়-তা মর্মে বুঝ দেবে আসমার মতো হাবা জনগণকে। ফুল ফুটলে বলবে পটকা। হুল ফুটলে বলবে বোমা। এরা পাওয়ার বিষয়ে লিখবে, পলিটিক্স নিয়ে লিখবে, পলিটিকাল কিলিং নিয়ে লিখবে, জেনোসাইড নিয়ে লিখবে, লোকে সেইসব খাবে। ঘরে-বাইরে, রাস্তায় বন্দরে ছাগলের দল ভাববে, “আরে, আরে, তাই তো! এমন খেলাই তো চলছে আমাদের নিয়ে!” ওরা ভুলে যাবে যে, আসমার মতো এরাও কখনো না কখনো, কোথাও না কোথাও ভগবান। রাজা। কিম্বা মা। কিম্বা ছোয়াল। শুধু খুঁটি নয়। শুধু ক্রমিক সংখ্যা নয়। শুধু ন্যাশনাল আইডি কার্ড নয়। শুধু ভোটার রেজিস্ট্রেশন নম্বর নয়। শুধু অমুক জেলার তমুক থানার তমুক বাড়ির বড়ো ছেলে কিম্বা গলায় ফাঁস নেওয়া মেজো ছেলের বউ কিম্বা তিন কাজের ছুটা বুয়া নয়।
খেয়ে শুয়ে পড়ে আসমা একা; নাক পর্যন্ত কাঁথা টেনে নেয়। কালো গুড়ের মতো ঝুলে ঝুলে অন্ধকার নামে গ্রামে। কাঁথা-বিছানায় তিসির তেলের গন্ধ–ট্রাংকে পুরে রেখেছিল নিশ্চয়ই ওরা। মনসুর তখনও টেবিলে, ল্যাপটপের সামনে। দেশগ্রামের শীত বড়ো আরাম। ফিলাডেলফিয়ার মতো বরফের সাগর নাই এইখানে, বরফশীতল শাশুড়িও আর নাই। আমেরিকা থেকে শাশুড়ির শেষযাত্রার ভিডিও দেখেছে আসমা, দেখেছে শহরময় ইলেকট্রিকের তার ক্রিসক্রস হয়ে কারেন্ট জাল হয়ে বিছিয়ে আছে আর তার তল দিয়ে পটকা মাছ, ফাইস্যা মাছের মতো কিলবিল করে শবযাত্রীরা চলছে রাস্তা দিয়ে দ্রুতপায়ে, প্রায় দৌড়ে যাচ্ছে ওরা–ওদের হাতে কালো ব্যানার, তাতে লেখা ‘বিশিষ্ট শিল্পী ও সংগঠক রুবি আপার প্রয়াণে আমরা শোকস্তব্ধ’, ওরা বলাবলি করছে, ‘বাইরে গণ্ডগোল’; যদিও পায়ের ভারে শহরটাকে পয়মাল করছিল ওরা সবাই বাইরেই, ঘরে না। কীসের বাইরে, কোন বাইরের কথা বলল তাহলে ওরা? বুড়ি গেছে চিরশৈত্যের দেশে। আর আসমারা যাবে হানিমুনে — চিরবসন্তের দেশে, তাও আবার ছেলেকে নিয়ে। আসমার জামাই বিবাহ ভোলে, তবু বিবাহবার্ষিকী ভোলে না। মনসুরের কাজিনরা হাসাহাসি করেছে—এ কেমন বাঙ্গালপনা? দামড়া ছেলেকে কোলে নিয়ে হানিমুনে যাওয়া? আসমার তাতে ভাবান্তর হয় নাই; যেইখানে সে যাবে, সেইখানে আবরারও যাবে—এটাই নিয়ম। আবরারের বয়স আট কি দশ হওয়ার পর মনসুর আর আসমা বুঝে গেছে, ভবির নির্দেশে ওদের বিবাহ-ছেলে বড়ো করা ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য নাই এই যোগের। শুধু ঘুরতে গেলে— অন্যের বাসায়, এয়ারবিএনবিতে কিম্বা হোটেলে আসমার জামাই বিছানায় স্বামীধর্মপালন করতো। মনসুরের পরিবার মনসুরের ইংল্যান্ড না গিয়ে আমেরিকা যাওয়া কখনো মেনে নিতে পারে নাই, আসমার শাশুড়ি আবরারকে একবার কোলে পর্যন্ত নেন নাই। ওরা দেশে আসলে খাবার টেবিলে জাপানি গোমাংশের মার্বেলিং নিয়ে লম্বা-চওড়া কথা বলতেন উনি, অথচ কখনো জিজ্ঞেস করতেন না, আবরার কোরআন খতম দিয়েছে কি দেয় নাই। “কী যে ডিসিপ্লিন ওদের!” একবার জাপান আর একবার বিলাত ঘুরে আসার গর্বে মনসুরের মায়ের মুখে আলো পড়তো। ডিসিপ্লিন মানে পেনসিল স্কার্ট পরা মেয়েদের সার বেঁধে রাস্তা পার হওয়া, মধুচক্রের মতো ষড়ভুজ খোপ- খোপ অফিসঘরের প্যানোরামিক ভিউ। সপ্তাহে একদিন বাড়িতে হুজুর আসার নাম ডিসিপ্লিন না, ওইটার নাম কম্প্রোমাইজ। উনার জগতে মেয়েদের গুণবাচক নাম ছিল টুকটাক। রান্না, হাতের কাজ, ক্রস স্টিচ, উলের মোজা, শিশুপালন, টি-পট, জামাইয়ের অফিস থেকে ফোন আসলে ইংরেজিতে বাতচিত। ব্রিটিশদের থেকে শিখে এসেছিলেন রোদ উঠলে কী বলতে হয়, তাই মনসুরের ফুপু যেদিন কড়া রোদে বড়ি দিচ্ছিলেন, সেদিন রুবি-আম্মা সামলে দৌড় দিলেন আর দুই বাড়ির মাঝের ইট বসানো নালা ডিঙালেন আর ছাদে গেলেন আর হাঁপাতে হাঁপাতে বলে বসলেন, “হোয়াট আ লাভলি ডে আউটসাইড!” উনি মারা যাওয়ার পরও স্মৃতিচারণের ছলে হাফসার কাছে এইসব বলে হাসাহাসি করেছে আসমা। করবে না-ই বা কেন? নিজের জাতের আন্তরিক জেনোসাইড করতে-করতে যারা বিশিষ্ট সংগঠক হয়ে ওঠে, তাদের মিশন একদিন মৃত্যু এসে শেষ করে দেয়। এরপরে নিয্যশ তাদের নিয়ে হাসি-তামাশা করা যায়।
পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে ছেলে। আসমার মনে চায়, ওই ঘরে গিয়ে কাঁথাটা টেনে দেয়, কিম্বা জানালার পাল্লাটা টেনে দেয়, কিম্বা আর কোনো সার্থক মাতৃকর্ম সাধন করে। তার বদলে ফোনে ইন্টারনেট চেক করে শুধু আসমা ফেইক আইডি দিয়ে ঢোকে; কাঁথার নিচে লাইট জ্বলে। পাশের ঘরে ছেলে মেসেঞ্জারে দেখতে পায়, মায়ের নামের পাশে আর সবুজ বাতি নাই। মা ঘুমিয়েছে। ছেলের ঘুম আসে না। সব থুয়ে চলে গেলে একদিন যেই দুর্দিন আসবে— দয়া-মায়া-স্নেহহীন, সেই দুর্দিনের আশঙ্কায় আবরার ছটফট করতে থাকে। টানা বারান্দায় কার যেন ছায়া দেখা যায়। কেউ শব্দ করে চেয়ার টেনে বসে, পাতায়-পাতায় রাতের টুপটাপ শব্দ থেমে যায়। মনসুর। অর্ধ- উলঙ্গ হয়ে বসে আছে আবরারের বাপ; গরম লাগছে হয়তো। আবরার ভালো মতো দেখতে পায় না, তবে মনসুরের কোলের কাছে মেলে ধরা খবরের কাগজের মতো দেখতে কী যেন ওঠে আর নামে। এক পর্যায়ে থেমে যায়; মনসুর চেয়ারের হাতলে কনুই রাখে। মিনিটখানেক পরে উঠে দাঁড়ায়। গোড়ালির কাছে রঙিন চক্রা-বক্রা আন্ডারওয়্যার নেমে এসেছে আর পায়ের নলা বেড় দিয়ে ধরেছে, ওই অবস্থায় মনসুর হাঁসের মতো হেঁটে-হেঁটে গিয়ে দরজার পাল্লা ধরতে চায়, কারণ সে বাথরুমে যাবে। আবরার জানালার ফাঁকে চোখ রেখে মন দিয়ে মনসুরকে দেখে, ভাবে, মনসুর এমন একটা মানুষ, যার মধ্যে প্রত্যেকের— যার-যার মতো—অপছন্দ করার, ঘেন্না লাগার কিছু না কিছু আছে। মনসুরকে হাঁসের মতো চলতে দেখে আবরারের হাসি পায় আর ওই হাসিটাই আবরার ধরে রাখতে চায় কারণ আর কোনোভাবে মনসুরকে প্রশ্রয় দেওয়ার ভাষা তার নাই; ওই সময়ই নাই ছেলের, আবার ভাষা! যেই জগৎ আবরার চিরতরে পিছে ফেলে যাচ্ছে, যেই জগতের রাজা ওর মা আসমা, সেই জগতে ওর আব্বা একটি হারামজাদা।
*
অদ্ভুত প্লাবনের পরে লাগুনে কোনো ঢেউ নাই আর। সন্ধ্যা নামে। বালুতটে মরা পটকা মাছের স্তূপ—বড়ো, ছোটো, মেজো, সেজো পটকা মাছ ঘোলা, গলিত চোখ নিয়ে পড়ে আছে; জেলেদের কয়েক পরত জাল মেলে দিয়ে ঢেকে রাখা, কিন্তু গন্ধে কেউ বীচে নামছে না; যার যার কটেজ থেকে ঘেন্না আর রাগ-রাগ চোখে তাকিয়ে আছে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা। শুধু দুনিয়ার মাছি আর সীগাল মচ্ছব করছে চারিদিকে। জোয়ারের পানির কোনো ছেদ-ভেদ নাই—–সকাল-সন্ধ্যা দুই বেলা আসছে-যাচ্ছে ঢেউয়ে-ঢেউয়ে নির্বিকার— “আমি কী জানি? আমি কী জানি?” বলতে-বলতে। রিজর্ট কর্তৃপক্ষ সবাইকে ইমেইল করেছেন যে, এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিঘ্ন—’অ্যাক্ট অভ গড’ বিষয়ে তাদের কিছু করার ছিল না; আরও তেইশটা দ্বীপের মতো তাদের দ্বীপের অতিথিদেরকেও পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। ডিপার্টমেন্ট থেকে মরা মাছের স্যাম্পল সংগ্রহ করতে লোক পাঠানো হচ্ছে, সেইখান থেকে বেরিয়ে আসবে সংক্রমণের প্রকৃতি, বিষের ধরন ইত্যাদি, আরও বেরিয়ে আসবে এই নির্বিচার মৎস্যনিধনের পিছে কার বা কাদের হাত আছে, সেইসব তথ্য-উপাত্ত। ডাইভিং ভেসেল আর দ্বীপ-টু-দ্বীপান্তর যাওয়ার আইল্যান্ড হপিং ট্যুর বোট, সবই পুরানো রুটিন-মাফিক চলবে, অর্থাৎ কেউ যদি প্রতিবেশী দ্বীপে মরা মাছের শুমারি করতে আগ্রহী হয়, নির্দ্বিধায় যেতে পারে। যেসব ট্যুরিস্টের শহরে ফেরত গিয়ে যার-যার দেশের ফ্লাইট ধরতে হবে, তাদের জন্য স্পীড বোট ট্রান্সফারের বন্দোবস্ত রয়েছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য সী-প্লেন বন্ধ থাকবে; তিরিশ মিনিটের ট্রান্সফারের বদলে তিন ঘণ্টার ট্রান্সফার প্রস্তাব করতে হচ্ছে বিধায় কর্তৃপক্ষ যারপরনাই দুঃখিত।
পড়ন্ত দিনের বেলায় চাঁদ উঠেছে। মেরিন পুলিশের টহল এখন কমে এসেছে, তবু শেষ বিকালের শিফ্ট চলছে। মনসুর ডেকের উপর থেকে ওদের দিকে সহিংস দৃষ্টিতে তাকায় আর নিজের মনেই বলতে থাকে, “চেহারাটা দেখ! ব্লুলেস বাঞ্চোতের দল। ঘুষ খেয়ে ভুড়ি বাগাইছে কেমন।” আসমা গত দুইদিন বার-ফ্রিজে রাখা বাদাম আর জ্যুস ছাড়া কিছু খায় নাই। গিয়াস বার দুয়েক এসে দেখে গেছে, গিয়াসের সামনে বর্ণাশ্রম ভুলে মনসুরের বউ কান্নায় ভেঙে পড়েছে। গিয়াস ‘বুজি, বুজি’ করতে-করতে আসমার পায়ের কাছে বসে পড়েছে। আবার হাত দিয়ে ভেজা চোখ মেজেছে। ভাইয়া যে যেতে চায়, গিয়াসরা জানত, কিন্তু এইখান থেকেই রওনা করবে, তা কে জানতো? “কে কে জানতো? তুই? তুই? তুমি?” অন্যান্য বাদামি বয়-বেয়ারাদের ডেকে এনে প্যাসেজে দাঁড় করিয়ে গ্রাম-আদালত বসিয়েছে গিয়াস, যেন সে সামান্য হোটেলকর্মী নয়, খোদ কর্তা। পুলিশের ইন্টারোগেশন যদি বসে, তাতে এই গিয়াস আর তার সাঙ্গোপাঙ্গও শামিল হবে, মনসুর জানে। এদের তো এখন মুখ কালো করে ঘুরে বেড়ানোর দিন, তবু বুজির জন্য নিখাদ মমতা আর কনসার্ন ছাড়া এদের মুখে কোনো বাড়তি রেখা দেখে নাই মনসুর। কেন কে জানে! পোকার ফেইস ভালোই বানাতে জানে বাঞ্চোতের দল। জোয়ারের পানির মতো ‘আমি কী জানি?’ গান ধরবে শালারা; পানির সাথে থাকতে-থাকতে এই গান শিখেছে এরা। দেয়ালের গায়ে বিরাট টিভি চলছে, রিমোট পড়ে আছে বিছানার ওইপারে; নিউজ চলছে আর আসমা টিভির পর্দার দিকে ঘাড় উঁচু করে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে, যেন এই নিউজ, সেই নিউজের ফাঁকে, রিপোর্টারের মাথার পিছে, রাস্তার দর্শনার্থীদের ভিড়ের মাঝে ছেলেকে দেখতে পাবে আসমা। তেমন কিছু দেখাচ্ছে না টিভি। চাইনিজ রকেট ভারত মহাসাগরের বুকে নিরাপদে ল্যান্ড করেছে। অ্যাংকরের অতিনাটকীয় আবৃত্তি চলছে আর তার চেহারার নিচে ইংরেজি হরফের কনভেয়ার বেল্ট—মানে অতিচিৎকৃত স্কুল বয়ে চলেছে। সরকারের প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে বারবার বলা হচ্ছে, চাইনিজ রকেটের সাথে মরা মাছের ঢলের কোনো সম্পর্ক এখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নাই; জনতা যেন গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এইসব নিয়ে লেখালেখি করলে মাথার উপর অর্থদণ্ড বসবে–জনতা যেন এইসব মনে রাখে। সমুদ্রের অতিরহস্যাবৃত কোনো অঞ্চল থেকে ঠান্ডা জলের উচ্ছ্বাস উঠে কয়েকশ টন মাছ মেরে যেতে পারে-বিশেষজ্ঞরা টিভিতে বলাবলি করছেন এইসব; কিন্তু রকেট নিয়ে তাঁরা কোনো কথা বলছেন না। যেন রকেট নিয়ে কথা বলার ডিপার্টমেন্ট আলাদা আর মরা মাছ ডিপার্টমেন্টের সাথে তাদের কখনো দেখা হয় না। মনসুর শুনেছে গত এক দশক ধরে সৌদি আরবের পয়সায় আমদানি করা ছাগলপালার হিড়িক পড়েছে দ্বীপগুলিতে। বাপ-দাদা-চৌদ্দগুষ্টির মাছমারার জীবিকা — এমন পরিবারের ছেলেরা নৌকা, জাল, কোঁচ, আঁকড়া সমস্ত সেরদরে বেচে দিয়ে দাড়ি রেখে ছাগল-চরানো আর মরুবিজয়ের ফ্যান্টাসিতে ভোগা শুরু করেছে। এমন কি হতে পারে যে, সাগরের ইকোসিস্টেমে মাছের সংখ্যা এইভাবে অতিরিক্ত বেড়ে গেছে আর প্রকৃতি সেই সংখ্যা কমাতে নিজেই হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছেন? মনসুরের মাথা ধরে। ছেলে নিখোঁজ হওয়া নিয়ে মনসুর আর ভাবতে পারছে না বিধায় মাদার নেচারের দিকে মন ঘোরানোর চেষ্টা করে; আর কে না জানে, রিয়েলপলিটিকও মাদার নেচারেরই অংশ। ন্যায়নীতি, মানবতাবাদ, যুক্তিবোধ, শ্রেয়বোধ ইত্যাদি কৃত্রিমতার বাইরে এই বস্তু। ইহা ফোর্স ডি লা নেচার। রিয়েল গোলায়াথ। মনসুর এইবার আর বিড়বিড় করে না, তবু আসমা ওর মুখের দিকে তাকায়। ওষুধ খেয়েও আসমার নার্ভ শান্ত হয় নাই। টিভি আন্তর্জাতিক খবরে বলে চলেছে—ক্যাম্পিং করতে সাগরপাড়ে গেছে অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি সাথে ওদের মেয়ে-দেড় বছরের দুধের শিশু; সকালে ঘুম থেকে উঠে বাপ-মা দেখে, মেয়ে গায়েব, শোয়ার ছোট্ট কটটাও সাথে গায়েব। হায়, হায় গো, কে এমন সর্বনাশ করলো গো! আসমার বুক ভেঙে শ্বাস ওঠে, মুখ ফুটে মনসুরকে আর কিছু বলতে পারে না। মনসুর আসমার দীর্ঘশ্বাস টের পায় না। সে ভাবে আসমা সজাগ শিকারি বিড়ালের মতো উপোসি আর নিস্পন্দ। এত হুঁশিয়ার আসমা, তবু যে ছেলে তার ফসকে গেল হাত গলে–এ তার জন্য এক বিরাট পরাজয়। আসমার পাশে বসে মনসুরের অস্বস্তি লাগতে থাকে, বুঝি একটু ভয়ও। আসমার কান খাড়াভাবে, ফোন আসবে, কেউ কিছু জানাবে। হাফসাও গায়েব হয়ে গেছে। বুঝি বা হাফসারই ফোন আসবে; ফিলাডেলফিয়ায় ওদের নিজেদের রান্নাঘরে আলু ভাজতে ভাজতে আবরারের খবর পেয়ে চাপা চিৎকার করে উঠবে হাফসা, হাত থেকে কড়াই পড়ে যাবে আর মেঝের উপর কড়াইটা ডেগর-ডেগর শব্দ করে নিজ অক্ষের চারিদিকে ঘুরতে থাকবে। না। ফোন অফ করে রেখেছে মনসুর; মনসুর জানে ‘ওরা’ আড়ি পাতছে, বলে কয়েই পাতছে। আমেরিকার শুরুর দিনগুলির কথা মনে পড়ে মনসুরের—ওর আম্মা রুবিকে ও অনেকবার বলেছে এফবিআই নির্ঘাত ওর মতো আলি, মুহাম্মদ, ইসলাম, হকদের উপর নজরদারি করে। রুবি বিশ্বাস করেন নাই। আর এখন? যেই ফোনে মুখ রেখে আসমা ওর বোনের কাছে কানবে, সেই ফোন, সেই ফোনের এই প্রান্ত, ওই প্রান্ত, এই আগা, ওই ডগার ছোটো ছোটো রোঁয়া আর পশমসমেত সমস্তই নজরদারির দখলে গেছে। আগের দিন হলে সন্ত্রাসীর বাবা হয়ে দুনিয়া থেকে মুখ ঢেকে চলতে হতো মনসুরকে, কারণ দুনিয়া জানে এ বড়ো লজ্জার বিষয়। এখন ন্যাংটা হয়ে চলতে হবে, কারণ দুনিয়া তাকে লজ্জা দিতেও চায়, আবার তার লজ্জা ঢাকতেও চায়; আর দুইটাই দুনিয়া করতে চায় এক মেকানিজমে। তার নাম নিঃশর্ত এবং ফুল ডিসক্লোজার। তার নাম একটানে স্ক্রল করে-করে নিচে গিয়ে ক্লিক করা—আই এগ্রি। তার নাম কবুল। তার নাম—আম্মা, আই লাভ ইউ। তার নাম— কই গেলি, কই গেলি, বাবা? তার নাম – চিলিং ইন কোলুফুশি আইল্যান্ড। তার নাম—হ্যাশট্যাগ ট্রু ব্লু আমেরিকান। এরপরে কী? ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি হবে। কন্ট্রোলের ফাঁদপাতা ভুবনে ভুবনে। এইসব ক্লিশে লাইন ভাবে মনসুর-এই রকম ব্যক্তিগত ক্রাইসিসেই না জাত লেখক লেখেন, জাত গীতিকার গান ফাঁদেন; মনসুরেরই কেন এই ক্লিশে ফোবিয়া, ক্লিশে শঙ্কা, ক্লিশে অপত্যস্নেহ, ক্লিশে প্রান্তিকতা? ছেলে গেছে, যাক। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-কন্ট্রোল রুমের ওরা বলেছে, ভোট দিতে পারবে, মদও খেতে পারবে, বন্ধুর সাথে সেক্স করলে সেটা রেইপও হবে না— তো খেলাফত কেন আনতে পারবে না সে? তবু ছেলে গেল তো ভালো—বলে যেত! বিপ্লবী বেটার গর্বিত বাপ হতে পারতো কি মনসুর? সেই লোভ? ছি! নিজের অর্জিত-আনীত- হৃত-লুণ্ঠিত ব্যক্তিগত সম্মান, দক্ষ-পরিশ্রমী-মডেল প্রবাসীর অনার—এই সবকিছু নিজে নস্যাৎ করতে পারার শক্তি নিজের কখনো ছিল না বলেই আজ একদল ফ্যানাটিক উন্মাদের কথায় বয়ে যাওয়া ছেলের ঘাড়ে চড়ে, ওদের থেকে ধার করে বিপ্লব করতে হবে? লাগুনের দিক থেকে বাতাসের ঝাপটা আসে। মরা মাছের গন্ধ নাকে লাগে। সৈকতে কেউ নাই, শুধু একটা মেয়ে—লালমুখো শাদা মেয়ে, মাথার সিঁথিটা পর্যন্ত রোদে লাল হয়ে ফুটে আছে— পানির দিকে হেঁটে যায়। সাগরে যাওয়া মানা, মেয়েটা কি জানে না? মেয়েটা সাঁতার দিতে থাকে। সাঁতরাতে থাকা পাতলা শরীরটা প্রথমে একটা নরম বৃত্তচাপ তৈরি করে উত্তর দিকে চলে যায়, তারপর ক্রমে ছোটো হতে থাকা একটা হ্রস্ব-ই-কারের মতো সরে যেতে থাকে সমুদ্রের ভিতর। তারপর তাকে আর দেখা যায় না। আবরারের দুনিয়ায় এইসব দৃশ্যের জায়গা নাই। সেই দুনিয়ার ভাগী মনসুরও ছেলের একার কী দোষ? জরুরি নক্ষত্ররাজি এক সরলরেখায় এসে থামে নাই দেখে মনসুরদের বিপ্লব হয় নাই আর শুধু সেইজন্য মনসুরের মতো উদ্যমী মানুষেরা দারা- পুত্র-পরিবারসমেত এমন একটা রাজ্যের পত্তন করেছে, যেইখানে মানুষের জীবনের চরম মানগুলি ছাড়া আর কোনো বস্তু, বোধ কিম্বা স্মৃতির জায়গা নাই। মনসুর নিজের হাতের পাতার দিকে তাকায়। মাথার ভিতর ও যেই রিপাবলিকের বাসিন্দা, সেই রিপাবলিকের পতাকা হাতের রেখার ভিতর বসে গেছে। ঘেন্নায় ওর উলটি আসে।
মনসুর নিজেকে সিস্টেম্যাটিকালি স্মৃতিহীন করেছে। আসমা মনে করে, মনসুর খেয়ালই করে নাই—আবরার আজকে এইখানে কীভাবে কেমন করে এসে পড়েছে আর নিজের বাপ-মাকে এনে ফেলেছে। শাদা টিনেজারের সাথে কোনো ভেদ ছিল না ছেলের। মায়ের রান্না মজা হলে ছেলে বলে উঠত, “মানি!” খাবারের ছবি তুলে বলত, “এই যে দিলাম ইনস্টায়, মানি শট।” আরও বলত, “সিক!” ফোন রাখার আগে বন্ধুদের বলত, “বাই, কুইন”, বলত, “সিক, সিক, সিক!” লাল দাড়িওয়ালা খালুর ‘হেনা বিয়ার্ড’ নিয়ে হাসাহাসি করতো। তারপরের দৃশ্যেই নাজেল হলো সেই খালুর বউ – আবরারের ঝামেলা খালা, আসমার বোন হাফসা। ভ্যালেন্টাইন ডে-তে জায়নামাজ গিফ্ট পেল ছেলে। কে দিলো? কেন দিলো? পাড়ার প্লাম্বারের কাছ থেকে ডুবি কিনত যেই ছেলে, সেই ছেলে তার ঘরের যাবতীয় পোস্টার ছিঁড়ে ফেলল, গেইমের কনসোল দান করে দিলো বন্ধুদের, গায়ে একটা উলকি করা ছিল, “তাবুলা রাসা’ লেখা, টেক্সটের সামনে আবার একটা বর্গমূল চিহ্ন খোদানো, সেই উলকি আবার পয়সা দিয়ে মুছিয়ে আনলো। আসমার সাথে ছেলের ঠোকাঠুকি বাড়তে লাগল। পাড়ার ধর্মীয় ইস্কুলের চ্যারিটি ড্রাইভে শাদা-কালো সকলের সামনে ছেলেকে একদিন আসমা বলে বসল, “তোর ছাগলাদাড়িটা ভালো লাগতেছে না, বাবা।” নতুন কুল হওয়া কোনো জিনিসের প্রতি মনসুরের বউয়ের কোনো সিম্প্যাথি নাই, সিম্প্যাথি তো দূরের কথা, বিশ্বাসই নাই। যতদিন না নতুন জিনিস আসমার পাকাপাকি আয়ত্তের ভিতর আসে, ততদিন আসমার শান্তি নাই। অতএব আসমার মূর্খতা দিনদিন বেড়ে চলল। আবরারের নতুন জীবনকে কবজা করার জন্য আসমা পাগল হলো। বাসায় পুরাদস্তুর সারভেইল্যান্স বসল—ক্যামেরা, বাসার ওয়াইফাইতে প্যারেন্টাল কনট্রোল; ইন্টারনেট কনটেন্টে ট্রিগার-ওয়ার্ড সেট করা হলো— অস্ত্র, ড্রাগ, পর্ন, আইসিস; আবরারের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে ঢুকে হাফসাকে বারকয়েক ব্লক মারা হলো; এমনকি আবরারের ওসিলায় মনসুরও আসমার ত্রাসের রাজত্বের নিচে চলে আসলো। মির্জা গালিবের শের আবৃত্তি করতো কোনো একসময় মনসুর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে—”তুনে উলফৎ-কি কেয়া নজর ডালি, মেরি জিন্দেগি খারাব কর ডালি।” নিজের এক্সপেন্সে বলা হলেও এইসব শুনে আসমার বুক ভরে যেত। ততদিনে ওইসব মুগ্ধতা ফুরিয়েছে। মনসুর জানে ওর উর্দু উচ্চারণ অন-পয়েন্ট। আসমা তরুণী বয়সে ভাবত, মিষ্টি বেশি খেলে গলা মিষ্টি হয়—মনসুর যেমন—মিঠাস–বলতো মিষ্টি করে, সসস-টা অনাহত নাদ — চারিদিক ছেয়ে থাকত, কিন্তু ছেলে তো মনসুরের ভাষিক পেডাগজির ধারকাছ দিয়ে গেল না। ‘ওস্তাদ’ ধরল, নতুন-নতুন ম্যানারিজম ধরল। শরাব আর শবাবকে পোয়েট্রির দুনিয়া থেকে ঠেলেঠুলে জান্নাতের দিকে পাঠিয়ে দিলো। হাহ… পোয়েট্রি ছিল মনসুরের মঞ্জিল- এ-মকসদ; কিন্তু আবরার হয়ে গেল পোয়েট্রির অ্যান্টিথিসিস। মনসুর নিজের কাছে এই পরাজয়ের ব্যাখ্যা দিত: যা কিছু র্যাডিক্যাল, তার কাজই তো এইসব ঘিসা-পিটা মঞ্জিল ধ্বংস করে দেওয়া। ছেলের সাথে তর্ক করে পারা যেত না; সবকিছু সংঘাতের রূপ নিত। মনসুরের বিপ্লব সেই কবেই হার মেনে নিয়েছে, সেই কথা ছেলের কাছে স্বীকার করতেও লজ্জা হয় নাই মনসুরের—”বিপ্লব করে করবিটা কী? বিপ্লব মৃত্যু ছাড়া আর কিছু আনে না।” কোন বিশ্বাসে ভর করে মানুষ বিপ্লব করবে, বাবা? হয় বিশ্বাসের হাতে মরতে হবে, আর নইলে বিশ্বাসীর হাতে মরতে হবে। আবরার এইসব শুনবে না কিছুতেই। আমেরিকার ইস্কুলের রিডাকশনিস্ট কারিকুলাম ওর মগজটাকে সূক্ষ্মতার সাথে পরিচিত হতে দেয় নাই। “বাপ-দাদার ধর্ম নিয়ে এত প্রবলেম! তাইলে জানাজা পড়াইবা নাকি পড়াইবা না?” – এদের প্রশ্নগুলি আজকাল এই রকম। এরা এই সমস্ত এ-প্রায়োরিকে আশ্রয় করে প্রশ্নের নামে ভায়োলেন্স করে; জীবন্ত প্রাণীর হাত- পা-লেজ-শুঁড় কোপ-কোপ দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে তারপর কাটা টুকরাগুলিকে পদাঘাত করতে-করতে বলে, “দেখ, দেখ, এর কখনোই প্রাণ ছিল না। কত পাড়াইতেছি, তাও রাও কাড়ে না!” অথচ এই কথাও সত্যি: আবরার তো মনসুর নয়; সহিংস হওয়ার সাহস কয়জনের থাকে? আর আবরার তো শুধু সাহসেই নয়, ভালোবাসার ক্ষমতাতেও বাপের চেয়ে এগিয়ে। ছেলেকে নিয়ে দেশে বেড়াতে গিয়ে বোকার মতো মনসুর মনে করেছে যে, ছেলে বুঝি আবার ফিরে এসেছে মনসুরের কাছে, মানে মনসুর স্মৃতিহীন হলেও ছেলে বুঝি ঠিকই স্মৃতির সঙ্গে আছে। বাপ-ছেলে দেশি প্যারোডি গানের অনুষ্ঠান দেখেছে টিভিতে এইবার পাশাপাশি বসে—উজ্জ্বল পারিবারিক আবহ; ঢাকায় বাসরত বিদেশীরা লুঙ্গি পরে প্যারোডি গান গাইছে, আশেপাশে ট্রাম্পেট আর অ্যাকর্ডিয়ন বাজছে, কারণ ওইসবও নতুন কমেডির অনুষঙ্গ, এতে মনসুর এত নির্মল আনন্দ পেল-হরিণের মতো গলায় খেউ-খেউ আওয়াজ তুলে হাসল। মনসুর আবরারের দিকে তাকিয়ে মৃদু-মৃদু হেসেছে, হাসির দমক শেষ হয়ে যাওয়ার পরও। আবরারও সাথে-সাথে হেসেছে। কেন? বোধ হয় এইসব আনন্দ বাপ-ছেলের বরফে যে ক্র্যাক ধরিয়ে দিয়েছিল, আবরার শেষবারের মতো সেই ক্র্যাকের ভিতর ফাল হয়ে ঢুকে যাওয়ার সুযোগ ছাড়বে না বলে ঠিক করেছিল। এইসব মনে হয়ে মনসুরের বুকে আজ বিশ্বাসভঙ্গের ব্যথা লাগে।
আসমা খেতে চায় না, মুখ ত্রিবক্র করে। মুখের কাছে ধরা স্যুপের চামচ থেকে স্যুপ বেয়ে পড়ে; মনসুর রাগে চামচ চেপে ধরে আসমার ঠোঁটের কোনায়, যেন চামচের চাপে বউয়ের ঠোঁট কেটে বড়ো করে মুখের ভিতর স্যুপ ঢালবে। তারপর রাগ পড়লে আবার সেলাই করে দেবে। আসমার ছেলে খুব ভেবেছে, মনসুর একটা কাপুরুষ শয়তানের বাচ্চা; ওর মাকে এসে কেউ জিজ্ঞেস করুক, মনসুর নামর্দ কি না! হুঃ। মনসুরের মনের ভিতরে আরেকটা মন—তবু ধ্বস্ত আর নরম হয়েই থাকে। আবরার এখন কী খাচ্ছে, কোথায় ঘুমাচ্ছে কে জানে! টিভিতে চলন্ত নিউজ সাইকেল মনসুরের নরম মনকে আবার ধাতব অবস্থার কাছাকাছি একটা বহিস্ত্বক দিয়ে ঘিরে ফেলে। মনসুর হিসাব করে। এযাবৎকালের হিসাব এই রকম— পনেরোজন বিভিন্ন বয়সের আমেরিকান ছেলে-বুড়া সিরিয়া গেছে। আবরারকে হিসাবে ধরলে ষোলোজন। এদের মধ্যে অনেক খুঁজেও কোনো প্যাটার্ন, কোনো ছাঁচের সন্ধান পায় নাই মনসুর। কেউ ইউনিভার্সিটি পাশ, তো কেউ নিতান্ত শিশু বা কিশোর; কেউ কসমোপলিটান, শহুরে, সোশাল মিডিয়া জাংকি কিম্বা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার, কেউ বা নিতান্তই শহরতলির এঁদো গলিতে গরিব হয়ে বড়ো হয়েছে; বাপদাদার সূত্রে কেউ সোমালি, কেউ শাদা, কেউ বা ল্যাটিন আমেরিকান। কোথায় নিয়ে যায় ওদের? কোন শিবিরে রেখে ট্রেনিং দেয়? কোন সুরুয়ার সাথে কোন বড়ি মিশিয়ে খাইয়ে দিয়ে কোথায় কোন ভুট্টাখেতের মাঝখানে ঘুম পাড়িয়ে রাখে? মনসুর আর কাউকে না পেয়ে আসমাকেই এই কথা জিজ্ঞেস করে বসে। আসমা আবারও মুখ বেঁকায়, যেন আবার কাঁদবে, তবু টিভি থেকে চোখ সরায় না। টিভিতে কেন যানি স্ট্যালিনের ছবি দেখাচ্ছে—ওরা রাশিয়াকে ক্যারিকেচারে পর্যবসিত করে এনেছে; রাগ কিরওয়ানির স্কেলে রুশ পল্লিগীতি বাজছে ব্যাকগ্রাউন্ডে। কেন? যাতে রাশিয়া নিয়ে বাকি দুনিয়ার যেই একীভূত কল্পনা, দর্শক সেই কল্পনাকে মাথার ভিতরে সহজে নাগাল পেতে পারে। টিভির চিৎকৃত স্ক্রল বলছে: একটু পরে হবে টক-শো সালাফিদের পয়সায় চলন্ত এনজিওভিত্তিক ত্রাণকার্য নিয়ে সুবিস্তৃত আলোচনা চলবে। নাহ, মনসুরের মাথা আজকে আর নিতে পারবে না। বিছানায় বসা অবস্থায় শরীর মুচড়ে কাচের মেঝেতে পা দাবড়িয়ে মনসুর বলে ওঠে, “ঝড় হইছিল, সুনামি হইছিল, এখনো তাই নিয়া পইড়া আছে। ঝড়ের আলাপ উঠলে এত জোরে- জোরে ঘাউ-ঘাউ করে কথা কয়, যানি এখনো ঝড় হইতেছে আর তুফান উঠতেছে আর বাতাসের শব্দে মানুষের মুখের কথা কিছু শোনা যাইতেছে না। আর কিছু দেইখা, আর কোনো অ্যাক্সিডেন্ট, ধ্বংস, প্রলয়, মৃত্যু, দাগাবাজি, আনফেয়ারনেস, দুইনম্বরি, বাটপাড়ি—কিছু দেইখা ওদের মালিকের কথা মনে পড়ে না। শুধু ওই এক সুনামি সবাইরে মুসল্লি বানায়া দিলো। এমনে করবে বিপ্লব? ধর্মের ভিতর হাঁটু পর্যন্ত যারা নাইমা যায়, তাদের গিল্ট নামে কিছু থাকে মনে করছ, সামাহ? ওর মধ্যে গিল্ট আছে ওর খালার ঘটনাটা নিয়ে? নাই। একফোঁটা গিল্টের দেখা পাবা না ওর মধ্যে। কারণ এখন ও জানে, ওরে একজন মাফ করে দিবে… এখন ও জানে, কিতাবে গুনাহ নামে একটা জিনিস আছে, যেইটা ওর লিমিটলেস গিল্টরে ছোটো কইরা ছোট্ট-মিষ্টি একটা কনফেশন বানায়া দিবে, যেইটা আবার ওর মালিক মাফও কইরা দিবে—বা দিবে না। মালিকের নামে মানুষ মারলে তাও সই। এমনই জ্যৈষ্ঠমধুর মতো ওর মালিক।”
“যষ্টিমধু। সব গুনাহ মাফ হয় না, মনসুর।”
“আরে মাফ হয় কি হয় না, সেইটা তো বিষয় না। বিষয় হইল এই কনসেপ্টটা—একবার ভাইবা যদি…”
“মনসুর, আজকে না প্লিজ। আজকে না। আমার ছেলেটা… আমার একটাই…”
আসমা এর চেয়ে বেশি আর বলতে পারে না। ফুসফুস নিঃশেষ করে কাঁদে। এমন লাগে আসমার কান্না, যেন বিশ বছর ধরে সন্তানসম্ভবা হয়ে বাঁচার পর আজ তার গর্ভপাত হয়ে গেছে। যেন ছেলে তার ছিল পেটের ভিতর, যেন জরায়ুর অন্ধকারে কী ঘটছিল, কিছুই আসমা জানে না, অথচ সারা দিন তো ছেলের পিছে খোদকারি করতেই লেগে থাকত মেয়েলোক। মনসুর এইসব ভাবে আর নিজেও বেটাছেলের আকাট গলায় সুর তুলে আহাজারি করে কাঁদে। চারিদিকের কোনো কটেজে কোনো শব্দ নাই—সবাই জেনে গেছে, সবাই জেনে গেছে। একখানে একদল মানুষ, কাগজের মতো পাতলা দেয়াল দিয়ে বিভাজিত হয়ে পানির উপর থাকবে, খাবে, ঘুমাবে, আর কারও কথা চাপা থাকবে—তেমন কখনো হয় না। এই কথা আসমা জানে। মনসুর জানে। মনসুর আর কিছু করতে পারে না, তাই আসমার গায়ে কাঁথা টেনে দেয়।
*
বাংলা পাড়া। খালি এই গন্ধ, সেই গন্ধ। স্টেল ওয়াটারের গন্ধ। তারপর বিআরটিসি বাসে রোদবৃষ্টির দিনে মানুষের গাদার ভিতর থেকে অন্তর্বাসের যে বিশ্ৰী সোঁদা গন্ধ আসে, সেই গন্ধ। তারপর মুদিদোকানে বাংলা সাইন আর সেখানে গুদামঘরের গন্ধ-পোকায় কেটে চাল বুঝি সব সাফা করে দিলো। কে যেন “কদু বাত্তি হইছে নিকি, আঁ?” বলতে থাকে বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। মুখভরতি প্রৌঢ়ত্বের দাগটাগ; মনসুর হাতের পাতায় নিজের মুখ ঘষে। গলিতে-গলিতে লোকে পাছার ফাটলে হাত রেখে দলবেঁধে ইউটিউবে বাংলা নাচ-গান দেখে আর হইহই করে ওঠে। পাতাহীন খ্যাংড়া একটা গাছে একটা অপরিচিত অকুটুম্ব পাখি ডাকে। তার ডাকের মধ্যে কোনো কুক-কুক কিম্বা টিট্টিট ব্যঞ্জনা নাই, পাখিদের ডাকে যেমন থাকে; পাখার সুইচ অন- অফ করতে থাকলে মুক্তছন্দে যেমন টলট-টলট শব্দ হতে থাকে, তার তেমন ডাক। ট্যাক্সির সীটের নিচে কেউ চুয়িংগাম চিপকে রেখেছে। ট্যাক্সিতে বসে দুই সিন্ধুঘোটকের লড়াই দেখছিল মনসুর -শালাদের গোঁফের মতো ঝোলা-ঝুপো দাঁত, বসিয়ে দিয়েছিল একটা আরেকটার গায়ে। রক্তে ফোনের পানি লাল হয়ে গেছিল। ঘুরে-ঘুরে আবার সাইনবোর্ড-ট্যাক্সির কাচের বাইরে, ড্রাইভারের মাথা পার হয়ে—ইংরেজিতেই লেখা, কিন্তু এত ‘বাংলা’ কেন? OFF-এর ‘ও’ মুছে গেছে, শুধু দুইটা এফ পাশাপাশি জ্বলছে। এক-একটা মানুষের ছায়াও, সারা দিন ঘেঁটি নামিয়ে কাজ করতে থাকা অমানুষ— বেদনার মতো সুন্দর, নিবেদনে নমনীয়, জিঘাংসু ও নীরব। মনসুরও আর মাথা তোলে না। হসপিটালেও আবরার নাই; লবিতে কাজ করতে থাকা কালো ছেলেগুলি যেন ফিনাইল- পানি দিয়ে ফ্লোর ঘষতে ঘষতে আবরারকেই মুছে-টুছে গায়েব করে দিয়েছে। রেজিস্ট্রি খাতা খুলে হাঁকডাক চলল কিছুক্ষণ, একে-তাকে জিজ্ঞাসাবাদ: রোগীর বাকি সমস্ত রেকর্ড আছে, কিন্তু রিলিজের রেকর্ড কই? মনসুর ওদের কাছে পানি চাইলো, ওরা শোনে নাই; তাই পথে নেমে এসেছে সে। হসপিটালের যাবতীয় তরল বর্জ্য গিয়ে মিশছে সমুদ্রে — গন্ধ পায় না মনসুর, কিন্তু কলকল শব্দে তার একই সাথে তেষ্টা বাড়ে আর বমি পায়। সামনের ফুটপাথে শীতলপাটির প্যাটার্নে ইট বসানো— দেখেই মনে পড়ে, একবার নতুন-জামাইকালে আসমাকে বলেছিল মনসুর, “আমার দাদি আমসত্ত্বে গুড় দিত”, আর আসমার মুখটা কালো আমসি হয়ে গিয়েছিল, কেননা ও চিনি, টালা মরিচ আর বিটলবণ পর্যন্ত গিয়েছিল মনসুরের জন্য, কিন্তু পাটির উপর বিছিয়ে তো শুকাতে দিতে পারে নাই মাউন্ট ওয়াশিংটনের মেঘলা ছাদে; মনসুর একটি শুওরের বাচ্চা; সেই ফুটপাথটা কমিউনিটি আস্তাকুঁড় পর্যন্ত টানা চলে গেছে; কার্ডবোর্ডের ঠোঙ্গা, ফুলদানির শুকনা ঘেঁটিভাঙা ফুল, খেজুরের ট্রে, চিংড়ির খোলা, ঘাঁটলে বুঝি নরমাংশের অফ-কাটও খুঁজে পাওয়া যাবে। কী জানি কী গাছের সর্বাঙ্গ থেকে লম্বা-লম্বা ফিতার মতো বাকল খসে খসে পড়ছে রাস্তার ধারে। ঘামের একটা ফোঁটা জুলফি বেয়ে কানের বারান্দায় পড়তে থাকে। বাড়ির কথা ভেবে মনসুরের মন কেমন করে আর গুলিয়ে ওঠে, কারণ কোনো একভাবে এই হলো বাড়ি। বাড়ি শুধু ভায়োলেন্সের নাম, পা বড়ো করতে-করতে নিজে কই ছিলাম, কোথায় যাব, কই আছি— সেই বুদ্ধি হারিয়ে ফেলার নাম। আবরার আবার পালিয়েছে। মনসুরও যদি ছেলের মতো আরেকবার পালাতে পারতো…
রিজর্টে গিয়াস তার বাচাল, উদ্যমী, কর্মী রূপ হারিয়েছে। সকালবেলা সৈকতে মনসুরের পাশে-পাশে হাঁটতে গিয়ে গিয়াসের মনে হয়েছে, সে মনসুরেরই প্রতিবিম্ব- মাকে দেখে নাই কতদিন আর হয়তো দেখবেও না; অন্যের দেশে ভিক্ষাবৃত্তি করতে- করতে জীবন আর ভিক্ষার মধ্যে সংজ্ঞাগত যেই পার্থক্য ছিল, সেই পার্থক্যের বোধও সে হারিয়ে ফেলেছে। এইখানে ইনসাফও ভিক্ষা করে পেতে হয়। অজ্ঞাতবাস থেকে আবরারের ফোন পেয়ে ক্যাপ্টেন মামুনকে আর একে আর তাকে ডেকে তুলে, ব্যতিব্যস্ত করে, মনসুরের জন্য ওয়াটার ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিয়েছে সে; হোক মনসুরের ছেলে, গিয়াসও তো আজ সেই ছেলের কারণে হাফবেলা কামাই দিয়েছে, কারণ শিফট চলাকালীন অবস্থায় গেস্টদের সাথে মাখামাখি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। (অফ-ডিউটিও নিষিদ্ধ, কিন্তু গিয়াসের এইসব ম্যানেজ করে চলার এলেম আছে।) বার্ষিক ছুটি থেকে অর্ধেকটা দিন মার গেল তার, তাই না? উত্তরপাশের টানা সৈকত থেকে মরা মাছ সরিয়ে ফেলা হয়েছে, গিয়াসরা ঘুমে থাকতে-থাকতেই ক্রেনের গাড়ির নিচে দাঁতাল আঁকশি লাগিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে পটকা মাছের অবশেষ। গন্ধ এখনো সরে নাই। সী-প্লেনও চালু হয় নাই, আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব হবে, শেষ সী-প্লেনটাই ধরেছিল আবরার; কী ভাগ্য ছেলের! অথচ সেই ছেলেও যাত্রায় বাধা পেল। সিরিয়া যাবে কি, শহর থেকেই বের হতে পারবে না হয়তো! ভোরবেলা বেচারা ফোন দিয়ে বসল গিয়াসকে—বাপকে না, মাকে না, গিয়াসকেই। বলল, অ্যাক্সিডেন্ট করে সে নাকি হাসপাতালে ছিল–বলে কী ছেলে? ফোন হাতে নিয়ে গিয়াস খালি পায়ে পড়ি-মরি ছুট লাগিয়েছে রিজর্টের দিকে। পাশের বালিশে আজম স্বপ্ন দেখতে দেখতে বিড়বিড় করছিল। রিজর্টকর্মীদের মেসে নিরালায় একটা ফোন করার বা ধরার উপায় নাই কোথাও; একঘরে আটজন মানুষ, দুইটা প্লাস্টিকের- মোড়ক-না-খোলা ওয়াশিং মেশিন, নষ্ট জেনারেটরও ছিল একটা আগে—রিজর্টের নিয়ম: দুই নম্বর গুদামঘরই কর্মীদের শোবার ঘর, কেননা একটা দ্বীপে সব্বাইকে একটা করে প্রাইভেট বীচ দেওয়া হবে, অত জায়গা কই? কতবার একের ফোন-চার্জার অন্যে ব্যবহার করা নিয়ে কাজিয়া বেঁধেছে, একের নামাজের টাইমে অন্যে গান শোনা নিয়ে মারপিট লেগেছে, এক ঘরের রোদে দেওয়া তোশক থেকে অন্য ঘরে ছারপোকা গেছে দেখে ধুন্ধুমার হয়েছে! গিয়াসের ফোনের শব্দে আলমুতাক্লাবের যদি দৈবাৎ ঘুম ভাঙত, আজকে সকালেও মেসে নাস্তার বদলে কাজিয়া-ফ্যাসাদ পরিবেশন করা হতো। কপাল ভালো যে, ক্ষমতাহীন সিধা-সরল লোকের যতটুকু বুদ্ধি আর কাণ্ডজ্ঞান থাকা জরুরি, গিয়াসের ওই দুইটাই ভালো আছে। উপরমহলের সাথে গিয়াস সখ্য রাখে, মানে ডাবল- শেয়ার রুম যেইগুলি, যেইগুলিতে আটজনের বদলে দুইজন ঘুমায় – সেই রুমের ষণ্ডা লোকাল আবদুল্লাহ্ রাফিউর সাথে গিয়াসের বিরাট দহরম-মহরম। বাথরুমের টাইমিং নিয়ে রাফিউ যেইবার রুলনিশি জারি করেছিল, সেইবারই গিয়াসের আইডিয়া হয়ে গেছিল, ব্যাটা কী জিনিস। হেরোইনের বেচা-বিক্রির ভাগ নিয়ে ওই ব্যাটা নাকি আগের রিজর্টের এক বাটলারকে পিটিয়ে আধমরা করে দিয়েছিল। যা হোক, গিয়াস একাধারে উত্ত্যক্ত ও উত্তেজিত হয়ে দৌড় দিলো ভাইয়ার ফোন পেয়ে। মনসুরদের কটেজ পর্যন্ত যেতে-যেতে ফোন কেটে গেল গিয়াসের হাতে- আবরার তো পে-ফোনের বুথ থেকে ফোন করেছিল, নেটওয়ার্কও তো ভালো না এইখানে। আবরারের বাপ ঘুমচোখে জবুথুবু হয়ে গিয়াসকে জড়িয়ে ধরতে গেল প্রায়, তারপর দ্রুত সামলে নিল। ভাইয়ার মা, গিয়াসের বুজি গিয়াসের হাত খামচে ধরেছিল- “কী বলছে? ওয় কী বলছে?” অভাগিনি মা—একটামাত্র সন্তান; এই দুর্ভাগ্য যেন আল্লাহ শত্রুর মাকেও না দেন। আরও সন্তান থাকলে একটাকে কুরবানি দিলেও দেওয়া যায়। দেশি বোন আসমার দুঃখে গিয়াসের সকালের বিরক্তি দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়।
গিয়াসের মায়ের তো গিয়াস ছাড়াও আরেকটা ছেলে আছে। মাকে রাখে ভাই ইসহাক। ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ আজকাল ফিকা হয়ে গেছে গিয়াসের। মা যখন থাকবে না, তখন কী হবে, কে জানে! মা মরলে বাপ তালুই, আর এ তো ভাইমাত্র। গন্ধগোকুল ধরতে চুকা বেগুনের ক্ষেতে শুয়ে থাকত দুই ভাই, সে কতদিন আগের কথা! ইসহাকের শ্বশুরবাড়ি শালবনের ওইদিকে, আসমাদের আদি পৈতৃক ভিটা যেখানে, তার পাশের থানা। ইসহাকের বউয়ের দিকের অবস্থা ভালো। এক ভায়রা গাজিপুরে লিলি চাষ করছে, নাম বুঝি ওরিয়েন্টাল লিলি। বছরে পঞ্চাশ লাখ লাভ করছে ফুল বেচে সেই ভায়রা। শাইখ সিরাজ আসে ক্যামেরা নিয়ে তার খামারে, এসে জিজ্ঞেস করে—হাইব্রিড ফুলের পাপড়ি কয়টা আর ভায়রা ভিন্ন উত্তর দেয়, “স্যার, বাল্ব ইম্পোর্ট করে পোষায় না। পোর্টে কোয়ারান্টিনেই তো পার-পিস তিরিশ টাকা দণ্ডি দিতে পড়ে।” ইসহাক গিয়াসকে ইউটিউব দিয়ে দেখিয়েছে, গিয়াসও গোপালকে, ক্যাপ্টেন মামুনকে, পাশের বালিশের আজমকে আর ইদানিং আবরার, মনসুর আর আসমাকে সেই অনুষ্ঠান দেখিয়েছে। আসমারা বাংলাদেশ ঘুরেই তো সদ্য এসেছে, তবু যেন ওরা জানতই না যে, দেশ এত এগিয়ে গেছে। “দেশ কত আগায়া গেছে, বাহ”, বলেছে আসমা। “আর এই দেশের অবস্থা দেখ”, বলেছে মনসুর। বলেছে, “বাংলাদেশের একটা রেট্রোগ্রেশন দেখতে চাইলে এই দ্বীপদেশে আসা দরকার প্রত্যেকের।” দেশে থাকলেই গিয়াস যে ভালো থাকত, দ্বীপে উনমানুষের জীবন যে তার দরকার ছিল না, যেই বিছানায় সে ডেইলি চাদর পাতে, সেই বিছানায় শোয়ার সামর্থ্য কিম্বা অধিকার যে তার নাই, এইসব কি গিয়াস আগে জানত না? আসমা আর আসমার জামাইয়ের কঠিন বাতচিতের মধ্যে থেকে সেইসব জাগতিক দর্শন তার জোগাড় করতে হবে? অভিমানে জিভে কামড় পড়েছিল গিয়াসের। সেই রাতে মেসে ফেরত গিয়ে সামান্য কারণে পাশের বালিশের আজমকে লাথি কষিয়েছিল গিয়াস। এতে মনে হয়েছিল, যেন নিজের দেশেই ফিরে গেছে গিয়াস, ফিরে গিয়ে নিজের ভাষায় কথা বলছে। গালি আর মারামারি গিয়াসের মাতৃভাষাই—এমন কোনো অনুভূতি নাই, যা গালি আর মারামারির ভাষায় প্রকাশ পায় নাই গিয়াসের শিশুকালে। ইসহাক পেটে থাকতে গিয়াসের মায়ের পেটেও ওর বাপের লাথি কম পড়ে নাই। সেই ভাষা সে মায়ের পেট থেকেই বয়ে নিয়ে গেছে, প্রথমে গ্রাম থেকে নদীর ঘাটায়, সেখান থেকে সদরে মাখন কাকার দোকানে, সেখান থেকে সাভারের ফ্যাক্টরিতে, সেখান থেকে এই দেশে; ম্যানহোলের বহুমূল্য ঢাকনা চুরির দিন থেকে সাভারে মহাজনের ঘরের দেয়ালে ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট ঝোলানোর দিন হয়ে বিদেশের শ্রমের টাকায় গ্রামদেশের বাড়িতে ছিটের পর্দা ঝোলানোর দিন পর্যন্ত। আসমার জামাই যেইসব জীবনকে একটা অসম্পূর্ণ বৃত্ত বলে জানত, গিয়াস সেইসবকেই জানত একটা প্রায়-শৈল্পিক, সর্পিল চক্র হিসেবে, ক্রমাগত যা কেন্দ্রের দিকে ক্লকওয়াইজ ঘুরে যাচ্ছে।
“পাওয়ার তো শেয়ার করার বিষয়, প্রতিরোধ করার বিষয় না”, সৈকতে হাঁটতে– হাঁটতে গিয়াসকে বলেছে মনসুর। গিয়াস এইসব কথা আগে কখনো রিজর্টের কোনো গেস্টের মুখ থেকে শোনে নাই, তাই অনভ্যাসে হুঁ-হুঁ করে গেছে। ছেলে নিরুদ্দেশ হওয়ার পরে মনসুর আরও ছোটো, ক্ষীণকায় আর কুঁজা হয়ে গেছে—যেটা এখন আর সুন্দর, সহনীয়, কবিজনোচিত নাই। আসমা বুজি বলেছিল, তার জামাই নাকি আমেরিকায় বাংলা সাহিত্য করে; পাওয়ার নিয়ে নাকি তার অনেক জানাশোনা। যাদের পাওয়ার নাই, তাদের পাওয়ার না-থাকার বিষয়াদি নিয়েও তার গভীর গেয়ান। তো যাদের পাওয়ার নাই, তারা তা ভাগাভাগি করবে কী করে আর প্রতিরোধ না করলে আর কী করার থাকতে পারে তাদের? এইসব চিন্তাকে বাক্যের ভিতর স্পষ্ট করে জড়ো করতে পারে নাই গিয়াস, তার আগেই মনসুরের ওয়াটার ট্যাক্সি চলে এসেছে। মনসুর জানে, সিঙ্গাপুরের এক হোল্ডিং কম্পানি উত্তর সাগরে চারটা দ্বীপ লীজ নিয়েছে, তিনটা দ্বীপে আলিশান রিজর্ট হবে, যেমন হয় — আর চার নম্বর দ্বীপে ওই তিন দ্বীপের শ্রমিক আর কর্মচারীদের জন্য ক্যাম্পাস হবে। সেই ক্যাম্পাসে সাড়ে সাতশ লোকের থাকার ব্যবস্থা হবে; ষোলোখানা ফুটবল মাঠের সমান বিরাট জমি নাকি। গোপাল বলেছে, এমন তাজ্জব কথা কেউ কখনো শোনে নাই—”লাইব্রেরি বনেগি, রানিং ট্র্যাক হোগা, দুকান–মকান, বিউটি পার্লার, রেস্টুরেন্ট সবকুছ বনেগা”, কিন্তু ফুটবলের মাঠ বনেগা কি না, গোপালের তা জানা নাই। ফুটবল খেলার জায়গা থাকলে গিয়াস একদম পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতে পারতো দুনিয়াকে পাওয়ার শেয়ার করা কাকে বলে, কিন্তু শুধু ফুটবল খেলার সুযোগের জন্য চাকরি ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। ছেড়েই বা কোথায় যাবে? কাগজপাতি তো আর দেখাতে পারবে না আর আজকাল নতুন হোটেল চেইনগুলিতে এইসবের খুব কড়াকড়ি। ভালোমন্দের মধ্যে সবই ঠিক আছে এইখানে; বাড়িতে কথা বলার সময় শুধু একটু যদি আড়াল, একটু প্রাইভেসি পাওয়া যেত, মন্দ হতো না। পরিবার মাঝে-মাঝে ফোনের ওইপাশে গান করে—হিন্দি, বাংলা, গিয়াসের যদিও ভালো লাগে পুরানো দিনের গান। ফরমাইশ দিলে পরিবার কাঁটা হয়ে যায়, আর গায় না কিছু; উলটে ঝগড়া শুরু করে— নেশা করা নিয়ে, দেশে ফেরা নিয়ে, টাকা নিয়ে। এইসব শুরু হলে গিয়াস নিজেই গান ধরে- “বিষম নদীর পানি, ঢেউয়ে করে হানাহানি, আমার অকূলের কূল দয়াল আল্লাহর যদি দেখা পাই রে” আর সুনামির কথা ভেবে চোখের পানি ফেলে। মাঝেমাঝে এমন হয়, এক গান গাইতে ধরে, কিন্তু তাতে আরেক গান মিশে যায়। কী না কী গানের সাথে সেইদিন লেজ জুড়ে দিয়েছিল—”কার ফলন্ত গাছ উফাড়িলাম, কারে পুত্রশোকি গালি দিলাম গো” – মনসুরদের দেশের গান, গিয়াস এই গান পেল কোথায়, কে জানে! খুব সুরে গানের রফতার ধরে চলছিল গিয়াস, ক্যাপ্টেন মামুন তাল দিচ্ছিল, যদিও তালি-খালির আগামাথা নাই; রাত হয়েছিল সেইদিন, আলমুতাল্লাব বাতি জ্বালিয়ে ঘর থেকে খেঁকিয়ে ওঠায় রসভঙ্গ হলো। এই জীবনে শেয়ার করার জন্য কিছু পাওয়ার চাই গিয়াসের; খেলায় নাই সেই পাওয়ার, গানে নাই, ঘরে-বাইরে-জলে-আকাশে-পরিবারে কোথাও নাই। উপরওয়ালা বলেছেন, খুব বেশি হলে গিয়াসকে শান্তি দেবেন; পাওয়ার নয়।
বেলাভূমি আজকে পয়পরিষ্কার। সমুদ্রের জংলা শৈবালের গন্ধ আর পানির নোনা গন্ধ আর সৈকত থেকে সরিয়ে ফেলা মরা মাছের গন্ধ একটা আরেকটার সাথে বিভ্রান্তিকরভাবে জড়িয়ে গেছে, তাই গেস্টদের আজ আর খুব আপত্তি নাই জলে নামতে। এক বাপ তার বেশি বয়সে জন্মানো দুই ছেলেকে নিয়ে হাত ধরে সমুদ্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। বাপটার চুল লম্বা আর রুক্ষ, অনেকখানি পেকেও গেছে—নোনা জল লেগে চুলগুলি একটা ঘোমটার মতো মাথার তালুর উপর পড়ে আছে। একটা রাবণফল সাগরের ভিতর থেকে ভেসে এসে ছেলে দুইটার ঠিক সামনে ঢেউয়ের উপর দুলছে। ওদের বাবা হাসতে হাসতে শুকনা আঁটিটা হাতে তুলে নেয়-অশ্লীলদর্শন ফল একটা, উবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েলোকের বিশাল পিছনের মতো আকার; পাশের বালিশের আজম প্রথম যেইবার দেখেছিল, লজ্জায় প্যান্ট ভিজিয়েছিল ব্যাটা। এখন আর এই ফলের গাছ একটাও নাই এই দ্বীপে। পামগাছের জ্ঞাতিভাই বুঝি। মেয়েগাছে মেয়েলোকের সাউয়ার মতো ভজভজা ফল হয় আর ছেলেগাছে ব্যাটালোকের ওই জিনিসের মতো দেখতে ফুল হয় বলে সবাই এর নাম দিয়েছিল পাপগাছ। এই জান্নাতে ওইসব পাপ রাখা চলে না। সর্বশেষ যেই গাছটা ছিল, সেইটা ছিল মাথায় আর বহরে সমান-সমান। গিয়াসের মনে হয়, গাছটা কাটা গিয়ে ভালোই হয়েছে; মানুষের পাপেই দ্বীপ জরজর, গাছের পাপের জায়গা কই এইখানে?
হাউজকীপিংয়ের রস্টার বদলেছে আবার। বিকালের শিফটের জন্য গিয়াস তৈরি হতে থাকে। লকারের ভিতর মাড় দেওয়া শাদা ইউনিফর্ম, বুকের উপর দ্বীপের এমব্লেম- মনোগ্রাম সেলাই করা। রিসেপশনের পিছে দুই নম্বর স্টাফ টয়লেট—দুইহাত বাই দুইহাত মাপের টাট্টিঘর, ফ্লোর-স্টাইল পায়খানা — নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না দেখে প্লাইউডের একটা তক্তা বসিয়ে ঢেকে রাখা হয়, পানির কলে মরিচা ধরা, আধভাঙা একটা ধাতব হ্যান্ডেল থেকে একখানা পুরানো তোয়ালে ঝুলছে, যা খাস্তা বিস্কুটের মতন খরখরা। তাতে হাত মুছে ফোন ধরে গিয়াস। শহর থেকে মনসুরের ফোন এসেছে। আবরারকে পাওয়া যায় নাই। রক্তাক্ত হাতে গামছা চেপে ধরে পায়ে হেঁটে হসপিটালে গেছিল বুঝি দিন দুয়েক আগে, শুনে গিয়াস শিউরে ওঠে আর শক্ত তোয়ালেটা হাত থেকে ছেড়ে দেয়— ভেজা বাথরুমে পড়ে গিয়ে ভাঙা সাবানদানির কোপ লেগে হাতের চামড়া ফালা ফালা হয়ে গেছিল নাকি প্রায়, হাড়সহ নাকি দেখা যাচ্ছিল; সাত-আটটা সেলাই পড়েছে ছেলের। তো কোনো দুর্বল মুহূর্তই হবে, যখন ছেলের মনে হয়েছে, গিয়াসকে ফোন করলে ভালো হয়। মনসুর বলে, ডেলিরিয়াম — গিয়াস তার অর্থ বোঝে না। গিয়াস ভাবে, এর চেয়ে খারাপ কিছু হয় নাই, সেটাই কপাল। মোকামে পৌঁছানোর আগেই সিরামিকের ভাঙা সাবানদানি কিম্বা ভাঙা টাইলের ধারালো প্রান্তের উপর ছেলের যদি গলা পড়ত, তাকে কি শহিদ ডাকা হতো? গিয়াসের মনে অপত্যস্নেহের মতো করুণ কিছু ভাসে, আবার একই মনে আবরারের জন্য ভর্ৎসনা আর গালাগালি আসে। ভেজা বাথরুমে নিজেকে সামলাতে পারে না, সেই ছেলে নাকি খেলাফত আনবে, মানে এইকূল-ওইকূল সকল কুলের মুখে কালি দিয়ে, মায়ের-বাপের কওমের সব্বার বদদোয়া নিয়ে জান্নাতে দাখিল হওয়ার জন্য দস্তখত করবে।
তবু তো ছেলে পালাবে বলে নিয়ত–না, না, নিয়াহ করেছিল। তবু তো সে পালালই। একবারে না হোক, দুইবারে। এইবার? এইবার আসমা বুজির কী হবে?
*
লাগুনে কোনো ঢেউ নাই। ঢেউহীন নদী কিম্বা সমুদ্র—তার নিচে আবার চকচকা শাদা বালি— সে যত নীলই হোক, আসমার চোখে দুর্যোগের মতো মনে হয় এখন। শুরুতে এমন মনে হয় নাই যদিও; এই কটেজে প্রথমবার ঢুকে মনে হয়েছে, পুরা পৃথিবীটাই একটা বিলাসবহুল কৃত্রিম হ্রদ। আর এখন আসমার মনে হচ্ছে, নুহ নাই, নুহের প্লাবন নেমে এসেছে দুনিয়ায় আর দুই ভুবনে কেউ নাই, যে আসমাকে এই মহাপ্লাবন থেকে উদ্ধার করতে পারবে। আবরার নাই। মনসুর গেছে শহরে, আবরারকে খুঁজতে। বীচ তো পরিষ্কার হয়ে গেছে, অনায়াসে আসমাকে নিয়েই মনসুর চেক-আউট করতে পারতো; শহরে একটা হোটেলে একটা ডাবল রুম কি পাওয়া যেত না? কেন আসমা এইখানে পড়ে থাকবে? কিন্তু মনসুর একবার মনস্থির করে ফেললে আর তা থেকে নড়তে পারে না। রিজর্টভরতি গেস্ট, পেট্রন, শ্রমিক, কর্মচারী, শেফ, ক্লিনার, রুমবয় — সকলে জেনে গেছে আসমাদের কেলেঙ্কারির কথা। রুম থেকে আসমা না-পারতে বের হয় এখন। সমুদ্র এখন এক সীমাহীন সম্ভাবনাহীন ফ্ল্যাট অরগ্যানিজমের মতো নির্বিষ পড়ে থাকে আসমার সামনে। গভীর রাতে স্পায়ের দিকটায় গেছিল আসমা—আরাম করতে নয়, রিজর্টের ঘরের বাইরে কোনো বদ্ধ জায়গা খুঁজতে; আশা করেছিল, এত রাতে কেউ থাকবে না। স্পায়ের ভারী দরজা বন্ধ করে দিলেই ভিতরে মিঠা পানির পুল। ঢুকে দেখে, একজোড়া কপোতী টপলেস হয়ে ভালোবাসাবাসি করছে; বীচে সমকামিতা হারাম নয়, তবে ট্যাবু, তাই বুঝি, ওরা রাত করে স্পায়ের পুলে নেমেছিল। মেয়ে দুইজনের একজন আসমার দিকে পিছন ফিরেছিল, অন্য মেয়েটা ঠিক মেয়ে নয়, মহিলা—আসমার চেয়েও বয়স বেশি হবে। পর্দার ঝালরের মতো চুল পড়ে ছিল মুখের উপর, ভালো মতো দেখা যাচ্ছিল না, তবু আসমার কেন জানি ভালো করে দেখতেই হবে ওদেরকে! ওদেরই মতো লজ্জা থেকে পালাতে চাওয়ার কারণে আসমা সখীর মতো ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওরা পাত্তা দেয় নাই। ওদের আর আসমার মাঝে রঙিন ধোঁয়ার আবরণ। কী আক্কেলে বুরকিনি পরতে গেছিল আসমা! ঠিক আছে, ওদের থেকে দূরেই ভাসবে ও। পুলের পানির তলে মেশিন বসানো; ঈষদুষ্ণ পানি বিপুল বেগে টগবগ করছিল আর দুই মানবীর শরীরের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছিল। বাতাসে সেক্সের গন্ধ; ভূতের আরক বানানো হচ্ছিল ফুটন্ত পানির কড়াইতে আর নরবলির জন্য রেডি নারীরা হাসি-হাসি সেই আরকে সিদ্ধ হচ্ছিল। আসমাও পানিতে নামল। দেখল স্পায়ের ভেস্টিবিউলের ভিতর একটা নকল দিঘি, তার উপর প্লাস্টিকের পদ্মপাতা ভাসছে। দিঘির উপরের সিলিং আকাশের সমান উঁচু, সেই সিলিং থেকে সার্কাসের রিঙের মতো দেখতে বিশাল কী যেন কী ঝুলছে। দুলছে আর আসতে-যেতে পানির উপরিতলের সাথে গোত্তা খাচ্ছে। আসমা মুখ তুলে তাকাল আর তাকাতেই রিঙের মতো গোল জিনিসটা একটা খোলা ম্যানহোলের মুখ হয়ে গেল—নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে ম্যানহোলের মুখটা আর অনুভূমিক নাই, লম্বালম্বি ঝুলতে লাগল সিলিং থেকে। ছোটো একটা ছেলে চকিতে সেই ঝুলন্ত ম্যানহোলের ভিতর মুখ ঢুকিয়ে দিলো। দূরে কেউ কানছে, “একটা জায়গা আম্মা, একটা জায়গাই খালি” বলতে-বলতে। ম্যানহোল দিয়ে মুখ বের করা ছোটো ছেলেটাও ওই কান্নার সাথে সুর মিলিয়ে কানতে থাকল—দুই কান্না মিলে একটা দ্বৈত সংগীত চলল, তারপর ছেলেটা কানতে কানতে নিজের মাথা সম্মতির ভঙ্গিতে উপর-নিচ নাড়াতে থাকল, যেন নিজের ভিতর থেকেই কারও বকুনি শুনতে পেয়েছে ছেলেটা—কেউ তাকে হুকুম করছে দ্রুত কান্না থামাতে। ফোঁপানির সাথে ধীরে ধীরে কান্না থেমে গেল ওর। আসমা চোখের পাতা ফেলবে না, প্রাণপণে চোখ খুলে রাখল সে; চোখের পাতা ফেললেই সব কেমন পিক্সেল-পিক্সেল হয়ে ভেঙে যাচ্ছিল। ছোটো ছেলেটা এমন ফোর্সে ম্যানহোলের ভিতর ঢুকে গেল আর সাথে আসমাকেও নিয়ে গেল, যেন ম্যানহোলের ঝুলন্ত ঢাকনাটা একটা পোর্টাল আর ছেলেটা নিজে একটা কেটলির নলের মুখ থেকে উৎসারিত বাষ্পের ফোয়ারা। পোর্টালের ওই পারে একটা বিরাট বাগান, বাগান পেরিয়ে বন, বন পেরিয়ে মহাবন, তারপর সেই মহাবন গিয়ে একটা ঢালের সাথে নেমে গেছে মহাসমুদ্রে। সে বড়ো আশ্চর্য বাগান। শুরুতে খালি সারি-সারি পপলার-চিনার; যত ঢালে নামতে থাকল, তত বাদাবনের মতো দেখা যেতে লাগল সব কিছু। গাছে-গাছে কিম্ভূত ফল, বিড়ালের মোচড়ানো মুখের মতো বিশ্রী। চারিদিকে ঘুঙুর বাজছিল সেই বনে; প্রতিটা গাছের প্রতিটা ফুলে সোনা-রুপার ঘুঙুর বাঁধা। পাগলা বাতাসে গাছের কাণ্ডসহ দুলে উঠল আর ঘুঙুরগুলি দ্রুম-চুম করে বেজে উঠল। একটা কালকাসুন্দা গাছের পাশে আসমার বোন হাফসা দাঁড়িয়ে হাসতে-হাসতে নিজের ডায়ালগ নিজে নকল করে বলল, “আমিই সেই তরুণ পূজারি… হ্যাঁ, আমিই, আমিই।” ছোটো ছেলেটা, যে আসমার আগে-আগে চলছিল, দৌড়ে গিয়ে হাফসার হাত ধরল। আসমার দুই পায়ে বেড় দিয়ে-দিয়ে বাংলার চারের মতো প্যারাবলিক গতিপথ বানিয়ে একটা বিড়াল হাঁটছে ওর পায়ের কাফ-মাসল ঘেঁষটে। কোথায় হাফসা? ওই বেটি তো লেডি গডাইভা। ছোটো ছেলেটা আর ছোটো নাই—আবরারের মতন দেখতে, কিন্তু পুরাপুরি আবরারও না। লেডি গডাইভার হাতে শাদা দস্তানা, বরফের মতো শাদা অনামিকায় ফিরোজা পাথরের ইয়া বড়ো আংটি একখানি। হাতের থালায় মনক্কা-কিশমিশ। গলায় টেপাফলের তিনলহরি মালা খুঁটে- খুঁটে খাচ্ছে ওরা দুজনে ওর বুকের উপর থেকে। ওদের মাথার উপরে দালানের বীম আর তাতে ফুলের মাচা, দিকে-দিকে পাটল আর মাংশল ফুল ফুটে আছে। আসমা হাত বাড়িয়ে এক থোকা বাগানবিলাস ফুল পাড়ল—কয়েকটা পাপড়ি ঝরে পড়ল মাটিতে; এই বাগানের বাগানবিলাস ফুলে কাঁটা নাই যে! গিয়াস কোত্থেকে যানি এসে বহুত খাতির করে আসমাকে বলতে লাগল, “বুজি, দেখ গো, ভিমের থে ঝুলতে ঝুলতে মুখের উপ্রে ফুল আইসা পড়তেছে যানি।” তারপর ছেলেটা আর লেডি গডাইভা—আর ওদের মুখদুইটা ডাঁটো ফুলই হয়ে গেল একদম। তারপর দুইজনই বোঁটা থেকে খসে পড়ল—ওদের পাপড়িগুলি উড়ে গেল আউলাঝাউলা, ওদের গর্ভদণ্ডমুণ্ড-পরাগধানী সব একাকার হয়ে একটা ঢিল-খাওয়া পাখির মতন উড়ে গেল। আসমা টের পেল ওকে টেনে-শুষে নিচ্ছে কেউ। একটা পতঙ্গভুক মাংশাশী ফুল আসমাকে হাঁ করে খেয়ে নিয়ে তারপর পাপড়ি বুজিয়ে দিলো; এইবার আরেকটা পোর্টাল ধরে চলল আসমা-খালাসির মতো দেখতে একদল লোক কাশছে, হাই তুলছে, পেট চুলকাচ্ছে। ওদের মধ্যে একদল লোক গোলাগুলিতে ব্যস্ত; বালির বস্তার সারি এক ধারসে বিছানো আর তার পিছন থেকে স্নাইপারের দল অপারেশন চালাচ্ছে। ওদের মুখে তীব্র রোদ পড়ছে, ওদের চোখ খোলা রাখতে কষ্ট হচ্ছে। বালির বস্তার ওইপারে সূর্য, তার নিচে যুদ্ধবিমান উড়ছে, কিন্তু শাদা চোখে আসমা তা দেখতে পাচ্ছে না। বালির বস্তার দিকে পিঠ দিয়ে বসলেই শুধু শহরের দালানের সারির গায়ে বিমানের ছায়া দেখা যাচ্ছে—বিমানের ওই ছায়াগুলি উন্মাদের চোখের মণির মতো ঘুরছে, উঠছে, নামছে, বোমা ফেলছে; মহাদেয়ালের পর্দার উপর ছায়াছবি একদম। এই হলো লেডি গডাইভার দেশ—প্রমিস্ড ল্যান্ড। গডাইভার সৈন্যদের মুখ জাপানি কাবুকি নর্তকদের মুখোশের মতো বিবর্ণ শাদা, শুধু তাদের ঠোঁটে কালো বা লাল রঙে যোগ-বিয়োগ- গুণ-ভাগ-বন্ধনী-বর্গমূল চিহ্ন আঁকা। গুলিতে জখম হওয়া সহযোদ্ধাদের একটা স্তূপ বানানো হচ্ছে দুই লাইন বালির বস্তা দিয়ে তৈরি একটা সমকোণের খোপে। যেইমাত্র সেই স্তূপটা বালির বস্তার স্তূপের উচ্চতা স্পর্শ করছে, সেইমাত্র পেট চুলকাতে থাকা, বিশ্রম্ভালাপে ব্যস্ত লোকগুলি সিধা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে আসছে; ওদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে অস্ত্র—কারও হাতে মেঝেভাঙা টাইল, কারও হাতে খড়গের মতো করে ধরা সিরামিকের বাথটাবের শান-দেওয়া ভগ্নাংশ, কারও হাতে বিচ্ছিন্ন ধাতব শাওয়ারহেড কিম্বা কল, তোয়ালে ঝোলানোর ভারী রেলিং, ধারালো ঝিনুকের মতো সাবানদানি, কারও হাতে হ্যান্ডশাওয়ারের লেজ থেকে খুলে আনা হোসপাইপ। তাই দিয়ে পিটিয়ে, মেরে, পোঁচ দিয়ে, শ্বাসরুদ্ধ করে ওরা ওদের অর্ধমৃত কমরেডদেরকে চিরশান্তি দিচ্ছে। জখম হওয়া মানুষের স্তূপ থেকে একটু দূরে মরা মানুষের স্তূপের দেয়াল বানানো হচ্ছে। সেই দেয়ালের পিছনে আরেক দল স্নাইপার বসবে। পেট- চুলকানো মানুষগুলি এই কাজ সেরে আবার যার যার জায়গায় গিয়ে বসছে আর আড্ডা-গুলতানি ইত্যাদি করছে, যেন এতক্ষণ কিছুই হয় নাই, যেন শিফটের কাজ সেরে এতক্ষণে ওদের একটু অবসর মিলল। আসমার সমস্ত শরীর বিক্ষুব্ধ করে ভয়ের একটা ঘনিষ্ঠ মোশন উঠে আসতে চায়, যেন আসমা মারা যাচ্ছে দেহযন্ত্রের কোনো একটা কলকবজার ওভারড্রাইভে, যেন এক মুমূর্ষু মানুষ অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে মরার আগে শেষবারের মতো সমস্ত অন্ত্রথলি নিংড়ে বাহ্যি করছে। “বাহিরে গেছে, ভাইয়া বাহিরে গেছে”, ওই খুনে খালাসিদের জটলার ভিতর থেকে একজন আসমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে হাত-পা নেড়ে অ্যানিমেটেড কায়দায় বলতে লাগল বারবার। আসমা এই পর্যায়ে মরা মানুষের মতো নির্জীব হয়ে যায়; ওই দুই চ্যানেল ধরে সে আবার স্পায়ের মিঠা পানির পুলে ফিরে আসবে, সেই শক্তি তার মধ্যে আর নাই। কেউ পিছন থেকে আসমার দুই বগলের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিলো — জঘন্য ভায়োলেশন, কিন্তু আসমা শক্তিহীন, তাই নিজের নেতিয়ে-পড়া শরীর ওই দুই হাতের মধ্যে ছেড়ে দিলো। আর এমনিতেও তো সে মরেই গেছে, এখন আর ভায়োলেশনের, খুন-জখম-ধর্ষণের ভয় কীসের? আসমার মাথার পিছনটা কারও নরম বুকে গিয়ে ঠেকল; সেই স্পৰ্শ এত মানবিক—যত্ন আর উৎকণ্ঠায় নিবিড় যে, আসমা বুঝতে পারল যে, সে আসলে মরে নাই। রাতের ক্লিনার অর্থাৎ স্পা অ্যাটেন্ড্যান্ট শরণ রানি পানি থেকে আসমাকে ঝটিতি তুলে পুলের পাড়ে ফেলল। শরণ রানির চিৎকারে আর সেই চিৎকারের প্রতিধ্বনিতে স্পায়ের আকাশসমান উঁচু প্রকোষ্ঠ কাঁপতে থাকল।
আজকে আসমা সুস্থ। গিয়াসের বুদ্ধিতেই মনসুরকে জানানো হয় নাই যে, গতরাতে আসমা নরকদর্শন করে এসেছে। ডেকের আরামচেয়ারে বসে নাক ডেকে, মুখ হাঁ করে বহুক্ষণ ঘুমায় আসমা। জনম-জনম পর ঘুম এসেছে তার-স্বপ্নে এখনো লাল-নীল-ফিরোজা ফুল দেখতে পাচ্ছে আসমা, বোমার মতো ফুটছে ওইগুলি, তবে নিরাপদ একখানা কাচের আস্তরের পিছনে ঘটছে ওইসব, যেন ল্যাবরেটরিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে অতিনিরাপদ বোমা বানানো হচ্ছে আর আসমা সুশীলভাবে টিকেট কেটে ওই তামাশা দেখার জন্য লাইন দিয়েছে। এই রকম মামুলি দৃশ্য আকছার দেখা যায় স্বপ্নে ও বাস্তবে। এতে প্রাত্যহিক জীবনে কোনো বিঘ্ন ঘটে না। ঘুম ভেঙে গেলে আকাশের দিকে তাকায় আসমা – বিকালের আকাশ কেউ ব্লেন্ডারে ঘুঁটেছে। ছাইরঙা দই কালো রঙের ননি থেকে আলাদা হচ্ছে। কালো আকাশের নিচে লাগুনের রূপ এমন, যেন ফেরাউনের হারেমে বন্যা হয়েছে—”ঘরে-বাইরে হাঁটুসমান পানি থই-থই করতেছে। অনেক কষ্ট, বোইনা, অনেক কষ্ট।” বোন হাফসাকে লিখেছে আসমা; মেসেজ ডেলিভার্ড হয় নাই। আজকে চতুর্থ দিন—হাফসার কোনো সাড়া নাই। হাফসার জামাইকেও মেসেঞ্জারে কল করে পায় নাই আসমা। ফেসবুকে কোনো পোস্ট নাই। আসমার গাত্রদাহী দি ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকা অ্যালবাম সর্বশেষ আপডেট হয়েছে আবরার পালানোর আগের দিন। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ভাইবার, স্কাইপ—সবখান থেকে হাফসা গায়েব। টেলিগ্রাম নামে নাকি আরেকটা অ্যাপ আছে—জঙ্গিদের প্রথম পছন্দ, রাকা থেকে কিম্বা আলেপ্পো থেকে যাবতীয় নির্দেশনা নাকি ওখানেই প্রথমে আসে– মনসুর বলেছে, গুগল জানিয়েছে। স্বপ্নে যেমন লাশ আর ধ্বংস দেখল আসমা- হাফসা আর আবরার শেষমেশ ওইসব পাঁকের মধ্যে গিয়ে পড়েছে? আসমার সন্দেহ ঘন হতে হতে আজকে যদি সত্যে পরিণত হয়, তাহলে? ও আল্লাহ, তাহলে? আসমার যাবতীয় কনসিডারেশনের মধ্যবিন্দুতে এখন আবরার আর হাফসার যুগ্ম সহিংস ভবিষ্যতের কল্পনা টলটল করছে। গিয়াসকে আসমা এক ফাঁকে আলগোছে জিজ্ঞেস করেছে টেলিগ্রাম নামে কিছুর কথা সে জানে কি না। যেন নোংরা কিছুতে হাত লেগে গেছে, এমনভাবে গা ঝেড়ে গিয়াস বলেছে, “না, না, বুজি। ওইসব ক্যান আমি চালাব? বসনিয়া গ্যাং, বুরু গ্যাং—ওইসব গ্যাংয়ের পোলাপাইন চালায় ওইসব। আমি খালি ইমু দিয়া পরিবারের সাথে কথা বলি।” আসমার বিশ্বাস হয় নাই; গিয়াসের দিকে তাকিয়েছে বড়োলোকের বউয়ের গভীর সন্দেহ নিয়ে, যেন গিয়াসের মুখের যাবতীয় খুঁত আর কদর্যতার লিস্ট করছে সে এক-এক করে, যেন ওইগুলি পরে কোনো এক অবসরে সারাই করে দেবে সে। গিয়াস অস্বস্তিতে পানির দিকে তাকিয়েছিল।
মনসুর ছেলেকে খুঁজে পায় নাই। আসমা জানত পাবে না; অত সহজ নয়। শহরে মানুষ গায়ে গায়ে লেগে আছে—কার গা থেকে কার গা ছুটিয়ে, কোন ফুলের পাপড়ি থেকে কোন মাছির চোষক সরিয়ে মনসুর আবরারকে খুঁজে বের করবে? শহর তো আর রিজর্ট নয়–রীতিমতো ঘাম, ক্লেদ আর রক্তে নোনা। সী-প্লেনে করে এই দ্বীপে আসার আগে ওই শহরে মাত্র ছয় ঘণ্টা কাটিয়েছে আসমা, তবু রিজর্টের ঘরে বসেই প্রায় অদেখা একটা শহরের আসলিয়ৎ নিয়ে তার নিদারুণ কনফিডেন্স। “মনসুর, কনফিডেন্স আর স্পেকুলেশন ছাড়া আমার জগতে আর তো কিছু নাই।” আসমার ফরসা হাতে পলকির কাজ করা মোটা-মোটা সোনার চূড় টাইট হয়ে বসে আছে। মনে পড়ছে ছেলের টুকরা-টুকরা স্মৃতি, দুঃখের মাঝেও যেইসব প্রায় হাসাতে পারে। বিয়ের আগে মনসুরকে মনে-মনে ‘মনচেরি’ ডাকত আসমা— মনসুর উচ্চারণ ঠিক করে দেওয়ার আগে (‘শেরি’ হবে নাকি); আসমা তখনই জেদের ভাণ করে বলেছিল, ছেলে হলে নাম রাখবে মনচেরি। কম বয়সের ঢংগুলি, বোকামিগুলি, ভুলগুলি, ভুল উচ্চারণগুলি নিয়ে ভাবলে আসমার নিজেকে অদ্ভুত লাগতে শুরু করে। যা হোক, সেই মনচেরিই কালে-কালে মনচিনি হয়ে গেল আর মনসুরের মুখে আসমা তো বরাবরই সামাহ। উর্দু। আসমার মনচিনি মাটিতে দাগ কেটে মেয়েদের মতো এক্কাদোক্কা খেলছে, মায়ের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাচ্ছে, সুপারশপের ভিতরে অনেক ভিড় দেখে মায়ের হাত ধরে মেয়েদের অন্তর্বাসের সেকশনের ভিতর দিয়ে কোনাকুনি শর্টকাট নিচ্ছে (আর মা তার ছেলের উপস্থিত বুদ্ধি দেখে চমকিত হচ্ছে), খাবার টেবিলে বসে বাপের সাথে বেয়াদবি করছে, মায়ের জ্বর হলে রাত জাগছে, স্কুলের পরীক্ষায় লাড্ডু পেয়ে খাতার উপর মায়ের সই নকল করে ফেরত নিয়ে যাচ্ছে, মায়ের কাছে ঝামেলা খালাকে নিয়ে মিথ্যা কথা বলছে, মায়ের হাতে চড় খেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে, মাকে ইন্টারনেট শেখাচ্ছে, তবে রয়ে-সয়ে হাতে কিছু রেখে, যাতে মায়ের নজরদারির কোপে না পড়তে হয়—তবু তো পড়লই। আবরারের চলে যাওয়ার দায়ভার মনসুর নেয় নাই, আসমার উপরই ওটা পড়েছে। অথচ মনসুর এমনই হৃদয়হীন যে, আবরার চলে যাওয়ার পরদিনও অফিস নিয়ে, অফিসের প্রমোশন না পাওয়া নিয়ে ঘণ্টাখানেক গোস্সা হয়ে থেকেছে। আসমা এটাও জানে, অফিসের নতুন বস কল্পিত দেওধরকে হাত করার জন্য শাদা বাংলায় তাকে মেয়ে-সাপ্লাই দিয়েছিল মনসুর; কল্পিতের নামের উচ্চারণ ছিল কাল্পিৎ—অফিসের সবাই বলত কালপ্রিট। “সে ব্যাটা এই রকম, বুঝলা — দেখলেই বুঝা যায়, দুনিয়ার সবখানে সে একটাই পাসওয়ার্ড ইউজ করে। ইমেইল, ফেসবুক, অফিসের ডকুমেন্ট, ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট, তারপর ধরো বিদেশে যাওয়ায় সময় স্যুটকেসের লক কম্বিনেশন…” – এইসব হাবিজাবি বলেছে মনসুর। আবরার নাই, বাপকে সুদখোর প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা নিয়ে লজ্জা দেওয়ারও আর কেউ নাই, সেই সুযোগই নিয়েছে মনসুর। অল্প বয়সে আবরার ওর বাপের সাথে উদাসীনতা আর অবহেলার বন্ধনেই বাঁধা পড়েছিল। ছেলে বড়ো হওয়ার আগেই আমেরিকার ব্যাংকিং সেক্টরে ধস নামল, মনসুরের বীমা কম্পানির চাকরি গেল; সকলে জানল শাদা ম্যানেজারদের বলির পাঁঠা হয়েছে মনসুর; তো সেই সময়ে সারা ক্ষণ উদাস বসে থাকত আসমার জামাই, শুধু ছেলে দুষ্টুমি করলেই উদাস ভাব তুলে রেখে ছেলেকে সাঁই-সাঁই করে পেটাত রুলার দিয়ে। ফিফথ গ্রেডে পড়ার সময় স্কুলে যাওয়ার আগে আবরার প্রতিদিন কান্নাকাটি করতো, পেটের কাছে টাক-ইন করা পরিপাটি শার্ট টেনে-টেনে বের করতো, শরীরের চারদিকে ঢোলা করে রাখত, তখন আসমারা বোঝে নাই, স্কুলের কোনো শিক্ষক বা কোনো ছাত্র বা ছাত্রী ওই দশ বছরের আবরারকে শারীরিকভাবে হয়রানি করছে। মনসুরও বোঝে নাই, বুঝলে প্রতিদিন সকালে ছেলের উপর এত বেরহম হতো না। তবু সেই মনসুরই আবার বাড়ির পিছের ব্যাকইয়ার্ডে ছেলেকে সাথে নিয়ে বাগান করতো, বসন্তে বাপ মাটি কোপাত আর ছেলে আলু বুনত; গরমকালের সরস মাটি, তাই গাছগুলি খলবল করতো; ছেলেকে মনসুর শেখাত: ফুল শুধু পড়ে থাকলেই কুড়াতে হয়, কারণ নইলে নাকি গাছ ব্যথা পায়। ছেলে একদিন বাপের এই দয়াধর্ম আর ক্রুরতার ডুয়ালিটি ঠিকই বুঝতে পারল। তারপর গোঁ ধরে চুপ হয়ে গেল। মনসুর যদি একটু চুপ হতে জানতো, যদি একটু নিজের কণ্ঠ, নিজের শব্দ, নিজের লেখা, নিজের কাজ, নিজের দর্শন নিয়ে বাতাসের উপর চড়াও না হওয়ার শিক্ষা থাকত তার, ছেলেটা আজকে আসমার বুকেই থাকত। মনসুর এমনই এক মহাশয়তান-আলেপ্পো-সিরিয়া ওইসব ওইসব জায়গায় যে যুদ্ধ হচ্ছে, এই যে মায়ের বুক খালি হচ্ছে ডানে-বাঁয়ে, সে বলে এর কোনোকিছুই নাকি ‘ভুল’ না। যুদ্ধ হবে, সহিংসতা-লোকক্ষয়-রক্তক্ষয় হবে—এর মাঝে বেঠিক কিছু তো নাই। একমাত্র বেঠিক বিষয় নাকি শুধু এটাই, “এই যুদ্ধে আমরা জিতব না।” যেন শুধু জিতলেই এই যুদ্ধ শ্রেয় হতো, কারণ জিতলেই এই যুদ্ধ ঐতিহাসিকভাবে যৌক্তিক হতো। এই হলো আসমার জামাই, ঠান্ডা মাথার নিরাবেগ, খুনি বাপ। তার ছেলে ঠান্ডা মাথায় খুন করতে রওনা হয়েছে, এ আর আশ্চর্য কী? এই লোক আবার ইনিয়ে-বিনিয়ে কাব্যসাহিত্য করে : ‘জানো না কি পাঞ্জেরি? আমরা সকলেই শয়তান এই নিওলিবারাল বিশ্ববাস্তবতায়?’- মার্কা কবিতা ফলায়; মানে শয়তানির ইলজাম নিজের মাথার উপরে নিয়ে বাঁচার পৌরুষও নাই লোকটার, ওই কলঙ্কও সবার সাথে ভাগ-বাটোয়ারা করে হালকা করে নিতে হবে তার। কই, গৌরবের ভাগ তো কাউকে দেয় না সে! নির্মল কৃতিত্বের ভাগ, আয়-উপার্জনের ভাগ, যশের ভাগ, পাওয়ারের ভাগ? গালভারী-পায়াভারী কুকুতা শব্দ করে যখন অনর্গল “আমি, আমি” করতে থাকে, তখন সেই আমি-র মধ্যে তো কখনো তুমি আসে না! জাকাত দিতে হাতটান, খ্রিস্টান ছেলেমেয়েদেরকে চ্যারিটির দানবাক্স হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে টিপ্পনি, দেশগ্রামের গরিব আত্মীয়কে দানদক্ষিণা দিতে কিপটামি আর শুধু জিডিপি কপচানো, তাও সেই দেশের জিডিপি, যেই দেশে শুধু সে জন্মেছে—বাস করে নাই, যেই দেশের ধুলায় সে উস্টা খেয়ে পড়েছে আর তারপর উঠে গা ঝেড়ে বাড়ি গেছে, গায়ে মাখে নাই। ফেসবুকের হাজার চারেক দেশি ফ্যান, প্রত্যেকে এক-একটা গাধার বাচ্চা; মুখে থুতু তুলে এরা “মনসুর ভাই, মনসুর ভাই” করছে; মনসুর ভাইয়ের লেখনীর খোঁচায় শয়তান খেতাব পেয়ে ধন্য হয়ে গেছে এক-একটা কালো, বাটকুল, বেকার, অর্ধশিক্ষিত, ক্লাসলেস, বস্তির কীট। এই কীটগুলি জানেও না যে, তাদের নার্সিসিস্টিক মনসুর ভাইয়ের গণস্বীকৃতির ঘুঁটি এরা প্রত্যেকে। এদের মনসুর ভাই বাস্তবে কোনোদিন রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে এদের দিকে ফিরেও তাকাবেন না, বাসে-ট্রেনে এদের পাশে গিয়ে জীবনেও বসবেন না, এমনকি এদের পাশে বসতে হতে পারে এই ভয়ে বাসে-ট্রেনে উঠবেনই না; নিজের ছেলের বা বউয়ের হাতখরচা মেরে দিয়ে হলেও চার্টার প্লেন ভাড়া করবেন। হয়তো ওরা তা জানে, তবু সমস্ত জীবন পিঠে বেত আর পাছায় লাথি খেতে-খেতে এই আত্মনিগ্রহই ওদের বড়ো ভালো লাগে। ওরা ছোটোলোক আর ওদের এই বড়ো-ছোটোলোক ভাই মনসুর অন্তরে দরিদ্র, তাই সে বড়ো-বড়ো গ্র্যান্ড ভঙ্গি দেখিয়ে বেড়ায়। বড়ো-বড়ো জেশ্চার কেবল। টাকা পেলে গোটা শহর সোনায় মুড়িয়ে দেবে মনসুর (বিনিময়ে শুধু শহরের একটা রাস্তা তার নামে নামকরণ হতে হবে), তবু শীতে কুঁকড়ে যাওয়া একটা পশুর গায়ে কম্বল তুলে দেবে না। পৃথিবীর বিশাল দেনা আছে ওর কাছে; পৃথিবীকে অবশ্যই লিখে রাখতে হবে যে মনসুর একবিন্দু শিশির দিয়েছে কোনোদিন। অথচ মনসুর যে দুনিয়ার বাকি সকলের থেকে ধার-করা গরিমায় চলছে-ফিরছে-বুলি কপচাচ্ছে, তার জি কোথাও পাওয়া যাবে না। মনসুর ফ্যাসিবাদ আর লোকরঞ্জনবাদের দুই পরস্পরবিরোধী শক্তির টাইটরোপ সামলায় সার্কাসের পাকা, প্রশিক্ষিত জন্তুর মতো দেশে। আর বিদেশে? আমেরিকা মনসুরকে বদলাতে পারে নাই, তার মুখের কুশ্রী রেখাগুলিকে আরও ধারালো আর জাগ্রত করেছে। যেই জায়গায় মেধাতালিকা নাই, সেই জায়গাতে এই ভিখারি মনসুর নাই। নিজের পাওয়ারের বলয়ের মধ্যেই শুধু হাতখোলা, উদার মনসুরকে পাওয়া যায়, ওইখানেই শুধু সে জীবনের প্রসাদ বিতরণ করে। সেই বলয়ের ভিতর আসমা পড়ে না, এমনকি নিজের রক্ত যে ছেলে, সে-ও পড়ে না। সেইখানে পড়ে কাল্পিৎ দেওধর। অথচ এই কথাও তো ঠিক, মোহাম্মদ সাদেক মনসুর আলির সাথে তার আত্মজ আবরার মনসুর আলির এইটুকু তফাত আছে-বাপ অন্তত এইটুকু জানে যে, সে সাক্ষাৎ শয়তান। আর ছেলে? ছেলে আজ ফেরেশতা, মানে জঙ্গি হওয়ার পথে গেছে।
মনের ভিতর বিষের বমি করতে-করতে আসমার পেট খালি হয়ে যায়, খিদা-খিদা পায়। মাথায় অনেক আগের দিনের গানের একটা খুচরা কলি ঘোরে—”এই ফুলদায় হতে বাঁচাও আমায়”, কিন্তু অনেক ভেবেও গানটার প্রথম লাইন মনে করতে পারে না আসমা। গুগলে খোঁজে, ইউটিউবে খোঁজে—— গানটা আর পায় না। যাক, সব গেছে, গানও যাক, স্মৃতিও যাক। পাশের কটেজের ডেক থেকে কেউ সাগরে নামে, সেই শব্দ শুনতে পায় আসমা—সাঁতরাতে সাঁতরাতে শরীরটা ওদের ডেকের কাছে চলে আসছে। আসমার মনের ভিতরের একটা মন বলে ওঠে যে, এখনই তড়াক করে উঠে ঘরে চলে যাওয়া উচিত টেররিস্টের মায়ের, কিন্তু আরেকটা মন ওকে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতে বলে। আজকে আসমা আর মনসুরের বিয়ের অ্যানিভার্সারি, ওদের বেড়াতে আসার একমাত্র উপলক্ষ্য—ভুলে গেছে আসমা। মনসুরও। ভুলে না গেলে মনসুরকেও জোর করে বসিয়ে রাখত এইখানে আসমা, ঘরপোড়ানো গরু খুঁজতে শহরে পাঠাত না। মনসুর রাতে ফিরবে, যদি ফেরি পায়; সকালেই এইখান থেকে পাততাড়ি গোটাবে ওরা। বাড়ির রাস্তা ছেলের চেনা আছে; যদি কখনো ফেরে—জীবিত বা মৃত, সরাসরি ওইখানেই ফিরুক। আমেরিকা ওকে ফিরতে না দিলে বাংলাদেশে যাক। জাহান্নামে যাক নইলে। এখন আসমা পেট ভরে খাবে, কারণ তার পেট খালাস হয়ে গেছে; তারপর ব্যাগ গোছানো শুরু করবে। মেঝের উপর একটা লাগেজ ব্যাগ, মনসুর শহরে যাওয়ার আগে ক্লামজিভাবে ঘাঁটাঘাঁটি করে গেছে। আধখোলা স্যুটকেসের ভিতর জাঙিয়ার খোপের মধ্যে থেকে একটা কালো মোজা সাপের ফণার মতো মাথা বের করে আছে।
*
“বিকিনি বীচে হইছে ঘটনা। গোপাল যে আছে—বোটের শেফ, ও তো আমার খুব ভালো দোস্ত। ওর বান্ধবী যেই আইল্যান্ডে কাজ করে, ওই আইল্যান্ডে। অদের রিজর্টের বীচেই হইছে। শহর থেকা পনেরো মিনিট। রাশিয়ার মহিলা। মাথা ফাটছে, বুকের হাড্ডি ভাইঙ্গা দিছে। ঘুষি দিয়া চোয়াল এক্কেবারে…”
আসমা গিয়াসের কথা শেষ করতে দেয় না। রুমের ফোন দিয়ে কল করে রেস্টোর্যান্টে খাবার চায়। “কুসকুস কি আলাদা রান্না করা হয়? লো-সোডিয়াম ব্রথ দেওয়া যাবে?” সার্ভার আসমাকে হোল্ড করিয়ে রেখে শেফকে জিজ্ঞেস করতে যায়। ভিভালডির ফোর সীজনস বাজে ফোনের ভিতরে—আসমা এই মিউজিকের নাম জানে না, তবে চেনে ঠিকই; দুনিয়ার যাবতীয় দোকানপাট, হোটেল, রেস্টোর্যান্ট, ব্যাংক- বীমা, ট্যুর কম্পানি তাদের কাস্টমারদের ফোন ধরিয়ে রেখে যে মিউজিক শোনায়, ওই মিউজিক এইটাই, এইটাই হয়। ফোন কানে লাগিয়ে আসমা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে; ধর্ষণের রগরগে বর্ণনা দেওয়া থেকে গিয়াসকে আর কোনোভাবে নিরস্ত করা যাচ্ছে না। গিয়াস রুমে এসেছিল আসমার জন্য একটা হীট প্যাক নিয়ে; গতকাল স্পায়ের ঘটনার টানা-হিঁচড়ায় আসমার পিঠের ব্যথাটা বেড়েছে—পিঠের ডানার দুইদিক প্রায় অবশ, কালশিটাও পড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। আসমার সাথে কথা হলে গিয়াস শুধু দেশের কথাই বলে— ফেলে আসার আগে যেমন ছিল দেশ, তেমন আর আছে কি না, গ্রামে স্পিনিং মিলের পাশে যেই কলাবাগানটা ছিল, সেইখানটা এখন কেমন, শালবনে পাগলা শিয়াল ঘোরে কি না, চালাকচরের দাওয়াখানার কম্পাউন্ডার সাহেব এখনো দুই থানায় দুই পরিবার রাখেন কি না, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেইসবই জানতে চায়। কেন? জেনে-শুনে হতাশ হতে চায় গিয়াস; হতাশ হতে চাওয়ার তৃষ্ণাই থাকে তার চোখে-মুখে। আজকে কেন দেশ নিয়ে কথা না বলে বিকিনি বীচের ঘটনা নিয়ে এত কথা বলছে গিয়াস? আসমার নিজের ছেলে চিঠি লিখে ভেগেছে জঙ্গি হবে বলে। আসমার আপন বোন গায়েব, হয়তো ছেলের দুষ্কর্মের দোসর হয়েছে আবার। কোন না কোন রিজর্টের কে না কে রুমবয় ড্রাগ খেয়ে কোন শাদা মেয়ের উপর চড়াও হয়েছে, আসমার কি এই সময়ে এই গল্প শোনার কথা? অবশ্য আসমার কি এই সময়ে কুসকুসের ঝোলে কয় চামচ লবণ আছে, তাই নিয়ে মাথা ঘামানোরও কথা?
ফোনে হোল্ডে থাকতে হলে, তায় আবার খিদা পেটে, পাঁচ মিনিটকে মনে হয় পনেরো মিনিট। আসমার মেজাজ হঠাৎ চড়ে যায়। সামান্য একটা সোজাসাপটা প্রশ্ন—সেটার উত্তর শেফের কাছ থেকে জেনে আসতে সার্ভার ছেলেটার এতক্ষণ কেন লাগবে? “তোমাদের সার্ভিস কি সব সময়ই এমন বাজে?” ঝং করে হাত থেকে রিসিভার নামিয়ে রেখে উঠেই তৎক্ষণাৎ আসমার অনুতাপ হয়। গিয়াসের টান-টান অভিমান। আসমা গলা নরম করে গিয়াসকে বলে, “ভাইটি, আমরা কিন্তু চইলা যাচ্ছি। তোমার স্যার ফেরি না পাইলে আমি একাই কালকে চেক-আউট কইরা ফেলব।”
“বুজি, ভাইয়ার খবর তো আর… আপনারা এখন কী করবেন?”
আসমা গিয়াসের কথার উত্তর দেয় না। কৃতজ্ঞতার বাক্য গুছিয়ে আনে। “তুমি আমাদের অনেক সাহায্য করলা, গিয়াস। খুব ভালো মানুষ তুমি। তোমার কথা ভুলব না।” সাহায্য—কথাটা বলতে আসমার কেমন মুখে বাধে। এর চেয়ে যদি বলত, “অনেক সার্ভিস দিলা”, সেইটা বরং গিয়াসের কানে কম বাধত। গিয়াসের চোখ লাল হয়ে ওঠে। আসমা যদি না জানতো, ওদের এই মহাসংকটে গিয়াস কেমন পরিবারের মতো পাশে থেকেছে, ওই চোখ দেখে ভাবত, গিয়াস বুঝি কাঁদছে না, রাগে কাঁপছে। আসমা আসন্ন চেক-আউটের কথা মনে করে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। গিয়াসের লাল চোখকে পাত্তা দেয় না। এই পাত্তা না দেওয়ার নিরাসক্তি—এইটাই যথার্থ সম্মানজনক এখন গিয়াসের জন্য।
“বুজি, আমি ভাবিও নাই… এমন একটা কিছু এমন একটা দেশে; আমার কপালে আল্লাহ…”, বলতে-বলতে গিয়াসের নিজের জিভে কামড় পড়ে। জিভের ব্যথায় মুহ্যমান হয়ে আপনিই ওর চোখ জলে টসটস করতে থাকে। আসমা কথা খুঁজে পায় না। মন নরম হয়, কিন্তু চোখে আর পানি আসে না। কে যেন মার্গারেট থ্যাচারের চোখকে বলেছিল ক্যালিগুলার চোখ? যে-ই বলুক, সে নিশ্চয়ই ক্যালিগুলাকে দেখে নাই, আসমাকেও দেখে নাই, শুধু মার্বেল পাথরে খোদা মূর্তি দেখেছে।
“এই দেশের ছেলেরা, মানে যারা লোকাল, ওরা যায়। ওদের আর কীয়ের টান? এইখানে ওরা কী পায়? এইটা নাকি ধার্মিক দেশ। কইখে কী? ধর্ম দিব হইল গিয়া ইনসাফ। কই? কই সেই ইনসাফ? বালের ইনসাফ আমার…”, বলতে-বলতে লজ্জায় মুখে হাতচাপা দেয় গিয়াস। বুজি মহিলামানুষ, তায় সম্ভ্রান্ত— মুখ আলগা করার অভ্যাসটা তার গেল না।
“আর এই দেশের মায়েরা? তাদের ছেলেরা যে যায়, যুদ্ধ করে, মরে, মারে? নিষ্ঠুর হওয়ার ট্রেনিং নেয়? জুলুমের নতুন-নতুন সিস্টেম বাইর করে। এই মাগুলি কী করে?”
“জানি না, বুজি। আমি তো আর ওদের মাগো লগে কথা কই নাই।”
“তো ওই ছেলেগুলির সাথে বলছো?”
“না, তাও অবশ্য…”
“দিল্লির দরবারে, বুঝলা গিয়াস, লালকেল্লার বাইরে ঘণ্টি টাঙানো থাকত। কারও ঘরে চাউল বাড়ন্ত হইলে, কারও সাথে নাইনসাফি হইলে, কাউরে কেউ ক্ষতি করলে, কারও ঘরে রুগি থাকলে, সে গিয়া ওই ঘণ্টা বাজাইত। বাদশাহ নিজে ওই কেইসগুলা দেখতেন। এইটারেই তোমরা ইনসাফ ডাকো। তোমাদের প্রত্যেকের যদি বাদশাহর কাছে যাইতে হয়, তাইলে একদিন কেউ আর যাইবা না। নিজের তকলিফ নিজে একলা একলা হজম করবা। দিল্লিতেও আসলে শেষমেশ কেউ যাইত না মনে হয়। আরেকটা ব্যাপার দেখো, তোমাদের এইখানে ঘণ্টি বাজাইতে আর এই ফালতু ইনসাফ পাইতে কোনো মা কোনোদিন যায় না। বুঝলা?” মনসুরের থেকে শুনে-শুনে শেখা বুলি গিয়াসের উপরে চালিয়ে দেয় আসমা না-থেমে, না-ঠেকে।
গিয়াস একটু থতমত খেয়ে যায়। তারপর বলে, “আমার বাদশাহ একজনই। একজন মালিক আমার।” আসমা কিছু বলতে চায় এর উত্তরে—ওই কঠিনহৃদয় সর্বজনাব বাদশাহর ব্যাপারে কিছু আন্তরিক কুৎসার কথা, কিন্তু ওর বিশ্বাসী মন ওকে আটকায়।
‘গিয়াস, আমি এখন বের হব। রিসেপশনে গিয়ে চেক-আউটের কথা এইসব বলে রাখব। টাকাপয়সা সেটল করব। তারপর রাতের খানা অর্ডার করব। তুমি পারলে তোমার স্যাররে একবার ফোন দিও আজকে রাত্রে, নাকি?” আসমা পায়ে রিজর্টের চপ্পল পরে। চুলে রাবার ব্যান্ড বাঁধে উঁচু করে। গিয়াস দাঁড়িয়ে থাকে।
সমুদ্র থেকে–লাগুনের দিক থেকে নয় – স্রোতের ঠান্ডা শব্দ আসে। তবু সমুদ্র সব শব্দকে ধারণ করতে পারে না। যেমন এক মানুষসমান ঘাসের পিছনে লুকানো খরগোশের খসখস। ঝর্ণার জলের তুমুল ধারার কলকল। ওই জন্য দ্বীপ প্ৰয়োজন, তকতকা রিজর্ট প্রয়োজন—একটা ধুলার কণা নাই করিডোরে; ঘরের চপ্পল দিয়ে বরং আসমা করিডোর ময়লা করে দিচ্ছে। গিয়াস দূরে-দূরে, পাশে-পাশে হাঁটছে। গিয়াসের চোখ আবার লাল-লাল দেখা যায়, এইবার বোধ হয় কান্নায় নয়, রাগেই।
“আমাদের এই দেশের ধর্মমন্ত্রী, উনি খারাপ মেয়েমানুষ নিয়া ধরা খাইছেন। পোচুর ভিডিউ চালু হইছিল। কই যাবে মানুষ? নিজের কাছে, নিজের মালিকের কাছে পয়পরিষ্কার থাকার আর কোনো জায়গা নাই, বুজি। আছে খালি দুইটা জায়গা–এক. নিজের অন্তর। দুই. সিরিয়া। প্রথম যেইবার খবর আসলো বুজি, এই দেশের দুইটা পোলা সিরিয়ায় গিয়া মারা গেছে, প্রেসিডেন বলছেন, “বিরাট আফসোস! এত করে বলি দেশের মানুষরে—বিদেশ যাও, ভালো কথা, কিন্তু আচার-আচরণ ঠিকঠাক রাইখো। আইন-কানুন শ্রদ্ধা কইরো।” কীসের মধ্যে কী! কিন্তু… সেইরম একটা চালবাজি কিন্তু! আরও ছেলে যাবে, আরও ছেলে মরবে, এইটা জাইনাও এই যে…”
হুঁ। ঠিক। মরবে। আমার ছেলেও মরবে।”
“বুজি, আমি কিন্তু দেশে কাউরে জানাই নাই। হুঁশিয়ারপুরের ওইদিকে…. ওরা কীরম লোক সেইটা তো…”, আসমার ছেলে মরার ভবিষ্যদ্বাণী করে ফেলে গিয়াস তাড়াতাড়ি ক্রাইসিস কনট্রোল করতে চায়। হিতে-বিপরীত হয়। আসমা গম্ভীর হয়ে যায়। পাশ দিয়ে একটা গ্রুপ, কয়েকজন বিভিন্ন বয়সি পুরুষ হল্লা করতে করতে নিজেদের রুমের দিকে যেতে ধরে। স্পষ্ট মাতাল এরা। আসমার এইবার আর মনে হয় না, আবরারের ঘটনা এই অপরিচিত দলটাও জানে নাকি জানে না—উলটে ওদের দিকে বিচারের পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় সে। কাউকে মাতাল দেখার মতো কুৎসিত অভিজ্ঞতা আর কিছু হতে পারে না। মনসুর মদ খায় না। শুধু সিগারেট, তাও অনেক কম আজকাল। আসমার বাপ খেত —— মদও। করোনারি থ্রম্বোসিসে মরল শেষে। বউ পেটাত আকছার। আসমার মা-ও অবশ্য মুখে আগল কম দিত। বাপের বাড়িতে অভাব কাকে বলে জানত না আসমার মা। আসমার বাপের সংসারে এসে প্রথম দেখল রান্নাঘরে, খানাদানার ইন্তেজামে ‘নাই’ একটা সাধারণ, বাস্তব শব্দ। ইয়াল্লাহ, চাল-ডাল-পেঁয়াজ-নুন আবার নাই হয়ে যায় নাকি গো? চট্টগ্রামে ইটের ভাটা ছিল আসমার নানার। পাকিস্তান আমলে বস্তা ভরে মণখানেক টাকা চৌকির নিচে রেখে দিয়েছিল নানা; তারপর টাকা যখন কাগজ হয়ে গেল, তখন বাদাম-ব্যাপারির কাছে ওই টাকা সেরদরে বেচে দেওয়া হলো। অবস্থা পড়তির দিকে চলে গেলেও সেরদরে টাকা-বেচা মানুষ পাবলিকের কল্পনায় ডাকের বড়োলোক হয়েই থাকে। আসমার মা শুধু মুখরা নয়, কুসংস্কারীও ছিল। এক ফকিরের কাছ থেকে পানিপড়া আনতো, গাছের শিকড়-বাকড় বেটে খেতো, আসমাদেরকেও খাওয়াত। শরীর খারাপের ব্যথায় কি জানি কী পড়ে ফুঁ দিত। পাড়াভরতি মহিলারা আর বুড়ারা এসে ওইসব টোটকা আর টিকাটিপ্পনি নিয়ে যেত আসমার মায়ের কাছ থেকে। মা মারা যাওয়ার আগের দিন—আসমা তখন আমেরিকায়—আসমা স্বপ্নেই টের পেয়েছিল যে, ওর মায়ের কাছে ডাক এসেছে। স্বপ্নে আসমাদের বাড়ির দাওয়ায় নানান লোকে এসে বসে নানান জিনিস চাইছিল। শেষরাতের স্বপ্নে এক অশীতিপর বুড়া এসে থেমে-থেমে গান গাওয়ার মতো অনুযোগের সুরে বলে গেল, “কী জানি এক হাড়ের গুঁড়া দিবা গো… কইছিলা আমারে। ওইডা দিবা না? নাকি মনে হয়…?” তারপর করুণ অভিমানের ভরে কে যেন!—ওই বুড়াটাই– গান ধরল, “আমার ডাল যেন ভাঙে না, আমার ফুল যেন ভাঙে না, ফুলের ঘুম যেন ভাঙে না। যেও তুমি নীরবে চরণে রে ভ্রমরা”, অথচ গলাটা অভিমানে এত জরজর, ওই অভিমানের চাপেই ওর ডাল-ফুল- কুঁড়ি সমস্ত ভেঙে যাবে। স্বপ্নের ভিতরে কোথায় গিয়ে যে বুড়ার কথা আর কথা রইল না, গান হয়ে গেল, ঘ্যানঘ্যানা সুর হয়ে গেল, তা আর ঠাহর করতে পারল না আসমা। আম্মার অসুস্থতার সময় দেশে যেতে পারে নাই আসমা, ভিসা জটিলতা ছিল তখন। তাই নিজের মায়ের একটা বয়সি, থির, শান্ত মূর্তি, যেই মূর্তি শেষ পটে আঁকা থাকে মানুষের-আসমার বরাতে জোটে নাই।
“আপনার আম্মা মাশাল্লাহ ভাইগ্যবান। আপনার আব্বারে থুইয়া মরছেন, আপনারাও ততদিনে উপযুক্ত হইয়া গেছেন; দুই বইন, দুইজনই বিদেশে। মন ছোটো কইরেন না, বুজি।”
গিয়াস রিসেপশন এরিয়ার নীল রঙের কার্পেটের ওইপারে দাঁড়িয়ে যায়; আর আগায় না। আসমার সাথে গালগল্প করতে দেখলে ভেজাল হতে পারে; যদিও পুরানো কর্মচারী হিসেবে গিয়াসের যেরকম প্রতাপ, তাতে তেমন একটা ভেজাল হবে না আসলে—কার্পেটের ওই ধারে এই দাঁড়িয়ে পড়াটা একটা পারস্পরিক তেহজিবই হবে। আর কিছু না। আসমা বুঝতে পারে, আবার পারেও না। এই যে আসমা চেকআউট করে যাচ্ছে, রিসেপশনের বর্গাকার চোয়ালের লোকটাকে যে বলছে বিল রেডি করে রাখতে, এই যে আবরারের কটেজ নম্বর নিয়ে জেনেশুনেও কেউ কোনো কথা বলবে না, এই যে আসমাকে দেখামাত্র রিসেপশনের অর্ধবৃত্তাকার টেবিলের খাঁজমতন জায়গাটায় কারণে- অকারণে রিজর্ট-স্টাফরা হঠাৎই উবু হয়ে আসা-যাওয়া শুরু করেছে—এইসব পাবলিক পরিণতির সামনে আসমার নিজেকে মনে হচ্ছিল স্টেজ পারফর্মার। ওর গায়ের চামড়া যদি বাদামি না হতো, এই বাদামি বর্ণের শার্প ব্যবস্থাপনার সামনে ও কোনোরকম দায়ে পড়ত না। ওর চামড়াই ওর ইতিহাস; এরা প্রত্যেকে একান্তভাবে জানে, ওর রঙের একজন মা কী করলে ছেলেকে রাখতে পারে না আর ছেলে চলে গেলে পরে কী করে। রিসেপশনের ওরা আপসের প্রয়োজনেই বোকার ভাণ ধরে থাকে—সেই জিনিস যে বোঝে না, সে মূর্খ। মনসুরও একই জিনিস করে থাকে, আসমার মতো মেয়েলোকও তাই করে থাকে, এবারও তাই করবে। ডেস্কের চৌকোনা চোয়াল লোকটা আসমাকে আইএসডি কলের বিল দেখায়, চুরু-চুরু আওয়াজ করতে-করতে ওর পিছের প্রিন্টার থেকে এ-ফোর কাগজ বের হয়ে আসে। অস্বস্তির অপেক্ষা—একটা-একটা পিক্সেল, একটা-একটা লাইন, তাতে লেখা একটা-একটা ইন্টারন্যাশনাল ফোন নম্বর–আসমা আর মনসুর যেইসব নম্বরে পাগলের মতো ডায়াল করে কথা বলেছে, বের হয়ে আসতে থাকে, যেন ওদের পারিবারিক পাপের থলি থেকে একটা-একটা খেলনা বের হয়ে আসছে। ডেস্কের লোকটা মাজা প্রফেশনাল হাসি ধরে রাখে। আসমাও সেই চেষ্টা করে। রিসেপশন ডেস্কের উপরের তলটা এত তেলচিটে যে, আসমার কনুই আটকে যাচ্ছে। রিজর্টের শৈল্পিক পরিচ্ছন্ন ভাব মূলত ঘর থেকে শুরু হয়ে রিসেপশনের সামনে রাখা সোফা পর্যন্ত এসেই থেমে গেছে। একটা নরম গুঞ্জন—ভুউউউউউ চলছে যেন কোথায়। সম্ভবত পিছে যে রেস্টোর্যান্ট আছে, সেইখানে কেউ ব্লেন্ডার চালাচ্ছে। টেবিলে-টেবিলে মানুষের দল— খাচ্ছে, গিলছে, হল্লা করছে, বুম করে ওয়াইনের বোতলের কর্ক খুলছে। সিল্কে-লিনেনে মোড়ানো ওদের বুক পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, বাকিটা খাবারের স্তূপ, টেবিল আর ন্যাপকিনে ঢাকা। বাতাসে দুধপোড়া গন্ধ। টেবিলে-টেবিলে বড়ো-বড়ো থালা নিয়ে যাচ্ছে তিনজন শশব্যস্ত সার্ভার, রান্নাঘরের আগুনে তাদের মুখ আধাপোড়া, কালো। একজন হাসিমুখে টেবিলে গিয়ে-গিয়ে যেচে কথা বলছে— নিশ্চয়ই জানতে চাইছে, খাবার কেমন ছিল, সবকিছু ঠিকঠাক কি না। লোকটার লদলদা চেহারা, এই রকম চেহারার লোকদের নাম হয় প্রমোদ বাবু।
গিয়াস নীল কার্পেটের ধার বেয়ে বেয়ে প্রায় পোকার মতো নীরবে কিচেনের সার্ভিং কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কার সাথে যেন কথা বলছে চাপা স্বরে। সম্ভবত আসমার কুসকুস নতুন করে অর্ডার দিচ্ছে। গিয়াসের এই রকম সীতাভক্ত হনুমান-রকমের দাস্য আসমার সয়ে গেছে এখন। তার কখনো মনে হয় নাই, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আসমার উপর একরকম করুণাই করছে গিয়াস; আসমার অনেক ট্রান্সগ্রেশনকে ছাড় দিচ্ছে। রিজর্টের অ্যাকাউন্ট সেটল করে আসমা বড়ো করে শ্বাস ফেলে। ছাউনির বাইরে নীল সমুদ্র; এমন নীল যে—সে জীবনে কখনো দেখে নাই, সেই অনুভূতি আবার ফিরে আসে তার। আকাশভরতি নিচু মেঘ; সমুদ্রের কম সুশ্রী বোনের মতো মাথা নামিয়ে ছেয়ে আছে ধুসর-নীল। আকাশ মানে আসমান। আসমা। ছাউনির নিচে একটা টেবিলে আসমা গিয়ে চেয়ার টেনে বসে। কোন ফ্যামিলির যেন তিনটা বাচ্চা বালির উপর দড়িলাফ খেলছে। ছাউনি থেকে একটু দূরে ডান্ডামেলা প্যারাসল ছাতি বসানো কয়েকটা, তার নিচে গতরাতের লেসবিয়ান যুগল বসে আইস-টী খাচ্ছে। আসমাকে ওরা এইবারও দেখে না। বাতাস এসে আসমার চোখের সামনে চুল এনে ওড়ায়—মেন্যু ভালো পড়তে পারে না সে। গিয়াস একটা পানির বোতল আর দুইটা গ্লাস এনে টেবিলের উপর রাখে; সার্ভারের দায়িত্ব তার না, তাও সে প্রশিক্ষিত, পলিম্যাথ কর্মচারীর মতো ধুক করে বোতল নামিয়ে রেখে সটান দাঁড়ায়। “ম্যাম, আপনার কুছকুছ আর পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে আসবে।” বুজি-ফুজি ডাকা বাদ।
“প্যাকেট করে ঘরে নিয়ে যাওয়া যাবে? টেইক অ্যাওয়ে? স্প্রিং রোলও অর্ডার দেই।”
“বলে দেই তাইলে।”
“কিচেনে বেকিং সোডা আছে কি না, জিজ্ঞেস করবা? নাকি রুম সার্ভিসকে আলাদা করে বলতে হবে? কাপড় ধুব।”
“কী দরকার, ম্যাম? রুম সার্ভিসকে ডাক দিলে সকালের মধ্যে লন্ড্রি ফেরত পেয়ে যাবেন তো।”
আসমা ঠোঁট কামড়ায়। রুমের মিনিবার থেকে রেড ওয়াইন খেয়েছে গতরাতে, এমন তিতা—জামার উপর পড়েছে দুই ফোঁটা। রক্তের মতো, কিন্তু আরও জোলো, তরল। ওই লাল রঙের দাগসহ শাদা কাপড় এদের হাতে তুলে দিচ্ছে, ভেবে আসমার কেমন বিবমিষা হয়। আরেকটা অপশন: দাগসহই স্যুটকেসে ভরে ফেলা যায়, কিন্তু পরে মনসুর দেখলে দশকথা শোনাবে। আসমা নিজেকে উপলক্ষ্য করে জীবনে এমন কিছু করতে পারে নাই, যা নিয়ে মনসুর কী ভাববে, তা তার ভাবতে হয় নাই, যদিও মনসুর কোনোদিন এই কথা স্বীকার যাবে না। মনসুর আসমাকে ডাকে ডিকটেটর, যদিও এক ছেলেকে নিয়ে তৈরি বৃত্তের ভিতরেই শুধু আসমার স্বাধীন, স্বেচ্ছাচারী একটা উপজীবন ছিল, সেটাও মনসুরের অনুমোদন পায় নাই আর আজকে তো মনসুরের মূল্যায়নে সে পুরাদস্তুর ফেল।
গিয়াস আবার সার্ভিং কাউন্টারের জানলার মতো খোপটার সামনে দাঁড়িয়ে গুজগুজ করে কথা বলে। নিঃসন্দেহে শুধু খাবার বাক্সে ভরার ফরমাইশ দিতে কিম্বা বেকিং সোডার ইন্তেজাম করতে তার এত সময় লাগার কথা না। গিয়াস কি আসমাকে নিয়ে ওর ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে চুগলি করছে? আসমার মুখ শক্ত হয়। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায় সে। পেট ভরে খাবে আজকে আসমা, ঘষে ঘষে রক্তের মতো দেখতে ওয়াইনের দাগ তুলবে, কালকে সকালে দ্বীপ ছেড়ে চলে যাবে; আজকে আসমা আর কাউকে, কোনোকিছুকে পাত্তা দেবে না। সিল্কের-লিনেনের জামা পরিহিত গ্রুপগুলিকে টেবিল বাই টেবিল পার হয়ে গিয়ে আসমা একটা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। দরজার গায়ে লেখা—স্টাফ ওনলি; এইটাই কি ওদের কিচেন? আসমা দরজার নব ঘোরায়, তারপর দুইহাতে পাল্লা ধরে দাঁড়ায়। কলম্বাসের আমেরিকাকে নিউ ওয়ার্ল্ড বলে ডাকা হয়; কার চোখে নিউ, সেই প্রশ্ন যেমন কেউ করলে তার আর রক্ষা নাই; হয় এই শিবিরে, নয় ওই শিবিরে তাকে ঠেলে ঢোকানো হয়, তেমন একটা অবস্থানে আসমা থাকে। ভিতরে একটা প্যাসেজমতন জায়গা, ওখানে দুনিয়ার সয়াবিন আর অলিভ অয়েলের কনটেইনার ডাঁই করে রাখা, পাশে দইয়ের, দুধের, চিজের খালি বোতল আর বালতি। ক্রিম রঙের দেয়ালে কেমন কালিঝুলি। ভিতরে সার-সার চুলা ধরানো, তার আশেপাশে সমস্ত কিছু তেলচিটে আর ধাতব। আসমার ঠিক সামনের চুলার উপর গরম তাওয়ার উপর ছ্যাঁৎ করে সাম্বুকা ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো; আসমার বুকটা ধক করে ওঠে, অগ্নিকাণ্ডের জন্য আসমা ঠিক প্রস্তুত ছিল না। আগুন আর ধোঁয়ার পিছনে মুখগুলি ভাঙাচোরা, চামড়া আধপোড়া; কিচেনের সর্বাঙ্গ থেকে রাবার গাছের আঠার মতো গলে গলে পড়ছে তেলা ছাই। এগজস্ট ফ্যানের পাইপ চুলার উপরের ছাদ থেকে উঠে গিয়ে কিচেনের সিলিংয়ের কাছে কনুইয়ের মতো বেঁকে গেছে। পিঠালি মেখে বেগুনির মতো কী যেন একটা গরম তেলে ভাজা হচ্ছে, চুলার চারিদিকে নরম-আধানরম-শক্ত-পোড়াপোড়া বেসনের বিন্দু। সবজির লাচ্ছা কাট বড়ো গামলায় রাখা, শেফরা যেটাকে বলে জুলিয়েন কাট। একটা ট্রের উপরে এই আইটেম, সেই আইটেম দিয়ে সাজানো মিজ-অঁ-প্লা। যেই ছেলেগুলি কাজ করছে, তাদের চেহারা দেখে বোঝা যায়, এই কিচেনের বাইরে এইসব আয়োজন তারা কখনো করবে না। নিজের কিচেন হলে মাটিতে উবু হয়ে বসে এরা কচুঘেঁচুবাটা বাটত আর তারপরে পাটামোছা ভাত খেতো। সেই ভাত খেতে স্বাদ হলেও এরই নাম পভার্টি, ইংরেজিতে ভাবে আসমা। একটা ছেলে— হেড শেফের সাগরেদ হবে বুঝি ছেলেটা, পোড়া তেল একটা ফানেল দিয়ে ঢালছিল একটা ঢাউশ সাইজের বোতলের ভিতর। আগের কিস্তিতে ওই তেলে কী ভেজেছিল ওরা কে জানে; পোড়া ভাজাভুজির বড়ো একটা দানা ফানেলের কণ্ঠরোধ করে ফেলে; তেল আর ফানেল গলে নিচে পড়তে চায় না। ছেলেটা গ্লাসপরা আঙুল দিয়ে আটকে পড়া দানাটা সরাতে চায় -তেলের উপরিতলে ও কী ভাসছে? পোকা নাকি ময়লা? আবরার ছোটোকালে এই রকমভাবে দুধের সর সরিয়ে খেতো। বলত, “আম্মা, লুক। আই অ্যাম স্কিমিং।” আসমা বলত, “নো, ইউ আর স্কীমিং,” দীর্ঘ ঈ-কার লম্বা করে। ছেলেটার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে একটা বেঁটে লোক, তার মাথার চুল অনেকটা সময় নিয়ে কামানো। সে সার্ভিং কাউন্টারের জানালার ভিতর দিয়ে অর্ধেকটা শরীর গলিয়ে গিয়াসের সাথে কথা বলছে। গিয়াস জানালার বাইরে আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে, কিচেনের ভিতরের এই লোকগুলির এপিক শারীরিক মুভমেন্টের কারণে সে আসমাকে দেখতে পাচ্ছে না।
“ওই মহিলার বয়স হইব এই যেমন আমাদের আসমা বুজি, হ্যার মতনই। কীরম অত্যাচারটা করছে!”
“আমাদের বুজি আবার কী? তর বুজি। হ্যায় আমার কিছু লাগে না।”
“হুঁ, ভুইলা গেছিলাম আমাগো আজইম্মার বাড়িত মা-বইন নাই। হি হি…”
“ফালতু কথা…”
“আরে আজইম্মা, তর তো রাবণফল দেইখাও মাল খালাস হইয়া যায়। ভুল কী কইলাম?”
“ওই বেটির লগে এত মিশার কী হইল? মাল খালাস করার শখ হইছে?”
“ক্যান? কী সমস্যা?”
আজম কান চুলকায়। আজমের দিকে পিছন ফিরে তেল ঢালতে থাকা ছেলেটা হঠাৎ কিচেনে আসমাকে দেখতে পায়। ওর হাত কেঁপে যায়, ফানেল থেকে তেল চলকে কিচেন-বেঞ্চির উপরে পড়ে। আসমা পাত্তা দেয় না; মন দিয়ে গিয়াস আর ওর দোস্ত আজমের কথোপকথন শোনে। ওরা এইবারের রেইপ, এর আগেরবারের রেইপ, তারও আগেরবারের রেইপ নিয়ে কথা বলে। বলে অত্যাচার। বলে রেপ বিরাট আদার কন্দের মতো এক অরগানিজম সমুদ্রের বেলাভূমিতে উপুড় হয়ে শরীর বিছিয়েছিল; মেরিন পুলিশ আর দ্বীপবাসীরা কাছে গিয়ে দেখে ট্যুরিস্ট। ক্যাপ্টেন মামুন নাকি এর আগের চাকরিতে এমনই এক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল। বোট নিয়ে ডিউটিতে গেছিল, পরে বুকসমান আগাছার ঘন জঙ্গল পার হয়ে উদ্ধার করতে হয়েছিল ওই মেয়েটাকে। কেউ হ্যাঁচকা কোপে বুকদুটো কেটে রেখে গেছিল, পাশেই পড়ে ছিল ওগুলি—দেখতে লাগছিল কলসি ঢাকে যে, ওই মাটির সরার মতো।
“মামুনের চাপাবাজি। কাটলে পরে কেমনে মাটির সরার মতো লাগব?”
“যা হোউক। এইবারেরটা, বুঝলি? নরমাল না। জানে মারে নাই। অনেক পিটাইছে জেনা করার পরে।”
“জোর কইরা করলে জেনা কয় ওইটারে?”
“কী জানি। কইতে পারুম না। আমি কি আলমুতাল্লাবের মতো… মানে ফোন দিয়া সারা দিন শায়েখের লেকছার শুনি? আর জোর কইরাই যে করছে, তুই জানলি ক্যামনে? স্বইচ্ছায় করতে পারে।”
“ও। তাও পারে। ঠিক। তো তুই কি সেই আশাতেই আসমা বুজির লগে ঘেঁষাঘেঁষি করতেছস?”
গিয়াস আলগা বিরক্তি দেখায়, কিন্তু খুব প্রতিবাদও করে না। সে এখনো জানে না, আসমা ওদের সব কথা শুনতে পাচ্ছে; আসমার নাক-কান-গলা জ্বলতে থাকে। তেল-ঢালা ছেলেটা চকিতে সীন থেকে সরে গেছে; বাঙালি নয় ছেলেটা।
“এইবারের পার্টি দারুল খায়ের গ্রুপ। রাস্তার নরমাল গ্যাং না। ওই গ্রুপের নয়জন গতবছর রাকা গেছিল পরে মসজিদে রেইড করছিল পুলিশ, ভুইলা গেছস?”
ন্যাড়ামাথা আজম যেন ধাঁধার উত্তর মেলাতে পেরেছে, এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। কিচেনের অন্য আরেক কোনা থেকে ডিম ফেটানোর আওয়াজ আসে। আসমা নড়তে পারছে না, যেন নড়লেই কিচেনে একটা বোমা ফাটবে।
“একটারে নাকি এইবারের ঘটনায় গ্রেপ্তার করছে। লোকাল না।”
“কোন দেশি? সাউথ ইন্ডিয়ান?”
“জানি না। গোপাল কইল, ওয় নাকি শুনছে আমেরিকান।”
“কস কী? শাদা আমেরিকান?”
“আমেরিকান অনেক রকম হয়-শাদা আর কালা ছাড়াও। চাইনিজরাও আমেরিকান হয়, দেখস নাই এতদিনে?”
“এইখানের ওই আইটেম না তো? তর বুজির পোলা? হ্যারাও তো আমেরিকান। বুজির পোলা হইলে ভাইয়া ক্যামনে লাগে তর?”
“মনে হয় না। আবার কী জানি, হইলেও হইতে পারে। হ্যারা কালকে সকালে যায় গিয়া। হ্যাগোরটা হ্যারা বুঝুক। এমনি ফেমিলি ভালো। ব্যাটা এতবছর আমেরিকায় থাকছে—মদ-গাঁজা কিছুর দোষ নাই। দেশের উপ্রে অনেক টান। পোলাটা এইখান থেকা না পলাইলেও পারতো। ভালো খাতির হইছিল আমার সাতে।”
“দুইদিন এইখানে দেইখা তুই বুঝলি ক্যামনে ওরা ভালো? আজাইরা। গোপাল আর কী কয়? ওই রাশিয়ানের ঘটনায় এই একটারে ধরল ক্যামনে, বলছে কিছু? পুলিশ শহরে রেইড দিয়া পাইছে?”
“আরে না। ওইখানেই পাইছে, ধাওয়া দিয়া। এই একটারই দিলে রহম ছিল। মহিলা নাকি অত্যাচার আর মাইরপিটের পরে পানি-পানি কইরা কানতেছিল। বাকিগুলা ভাগছে, কিন্তু এই একটা নাকি রইয়া গেছিল। গিয়া বোতলে কইরা পানি আনছে। তারপর মহিলারে পানি খাওয়াইছেও। মেরিন পুলিশের বাঁশি শুনছে পরে নাকি পলাইতে ধরছিল। পারে নাই আর তারপরে তো কাহিনি…”
আসমা আর নিতে পারে না, ওর মনের ভিতরটা “আল্লাহ” বলে কেঁদে ওঠে। হয়তো মুখের ভিতর থেকেও ওই ডাক বেরিয়ে এসেছিল, নইলে তক্ষুনি ম্যানেজার এসে গেল কীভাবে? “ক্যান আই হেল্প ইউ, ম্যাম?” প্রমোদ বাবু অর্থাৎ লদলদা চেহারার লোকটা এসে দাঁড়াল। তেল-ঢালা ছেলেটা পিছনে দাঁড়ানো, সে-ই নিশ্চয়ই ডেকে এনেছে। বিনীত কাঠঠোকরার মতো চেহারা ছেলেটার ঢ্যাঙা আর কাঁধের কাছ থেকে বক্র।
“আই… আই। বেকিং সোডা প্লিজ। আই নীড মাই অর্ডার। নেভার মাইন্ড…’ বলে আসমা লোকটার প্রায় গা-ঘেঁষটে বের হয়ে যায়। সার্ভিং কাউন্টারের জানালার এই ধার-ওই ধারে গিয়াস আর আজম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওদের মুখ বিবর্ণ। ভয়ে ওদের মুখগহ্বর শুকিয়ে গেছে, জিহ্বা যেন কেউ টেনে ছিঁড়ে নিয়েছে। আসমা ছুটে বেরিয়ে গেলে ম্যানেজার ন্যাড়ামাথা আজমকে অশিষ্ট গালি দিয়ে ওঠে; কাজের সময় নষ্ট করে আড্ডা মারলে নিশ্চয়ই তাকে মাথায় করে নাচবে না।
*
“ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলছিল বুঝলা? ‘চাঁদের সামনে সমুদ্র তার বুকে খুলে দিছে।”
আসমা আর মনসুর হোটেলের চিপা ব্যালকনিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। শখের সিগারেট ধরিয়েছে মনসুর। এই দোতলা ব্যালকনি, ব্যালকনির নিচে নগরীর রাস্তার বাইক-ট্রাক-দূষণ, হোটেলের পিছের গলির একটা গুমটিমতন জায়গায় কিছু লোকাল লোকের তাস-জুয়া ইত্যাদি খেলার হট্টগোল, জাহাজঘাটার কাছ থেকে ভেসে আসা আলো, নয় নম্বর জেটির সামনে চকচক করতে থাকা ব্রোঞ্জের ঘোড়ার মূর্তি—এই সবকিছু যেন একটা ছোটো ঘরের মধ্যে অবস্থিত। রাজধানী শহর—দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে নাকি দেড় কিলোমিটার বাই দেড় কিলোমিটার; আমেরিকায় ওদের পাড়ার মর্নিং ওয়াকের পার্কের চেয়েও ছোটো। এর মাঝে দুই লক্ষ মানুষের বাস। প্রকৃতিকে এইখানে অগুরুত্বপূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে; মুগ্ধতাকে যে অন্যত্র একটা ফ্যাশনে নামিয়ে আনা হয়েছে, সেই বোধ এই শহরের কর্তাদের আছে। পর্যটকরা এই শহরে থাকে না, বিমানবন্দর থেকে ফেরি নিয়ে এসে কয়েক ঘণ্টার জন্য থামে, তারপর যার-যার উদ্দিষ্ট দ্বীপে চলে যায়। আবার দ্বীপ থেকে ফিরে আসে, কয়েক ঘণ্টার স্টপ-ওভার, তারপর আবার বাড়ির ফ্লাইট ধরে। আসমাদের আজ এই শহরে দ্বিতীয় রাত। সমুদ্র আর সুন্দর না—সামনেও বিছিয়ে নাই আর স্বর্গের রাস্তার মতো। চোখের কোনা দিয়ে দেখলে এক চিলতে দেখা যায়, আরেকটা হোটেলের ফাঁক দিয়ে। সমুদ্রের চেয়ে এইখানে আকাশ বরং বেশি উন্মুক্ত; এদের দুইজনের মধ্যে কেউ যদি বুক খুলে দিয়ে থাকে, সেইটা আকাশ—আসমান; সমুদ্র নয়। এরা দুইজন দুইটা দেশ, দুইটা রিপাবলিকের মতো—একজন শুধু উন্মুক্ত করে, আরেকজন শুধু গোপন করে, বালির উপরে আঁকা রেখা মুছে দেয়, তীব্র স্রোতের থাপ্পড়ে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়।
রাশিয়ান নারী-ধর্ষণের অভিযোগে যাকে পাকড়াও করা হয়েছে, সে আবরার নয়। তার নাম একটা লম্বা কিছু—আবু সামথিং আল মাগরুবি, যেমন হয় এদের নামগুলি, সত্য-মিথ্যা অসংখ্য নামের মধ্যেই একটা হবে। সে আমেরিকান — সেই গুজবের সত্য- মিথ্যা অবশ্য এখনো জানা যায় নাই। হাফসাদের এখনো কোনো খবর নাই। হোটেল থেকে বারকয়েক জ্যাম্পার স্ট্রিটের ওদের বুড়ি প্রতিবেশী ডেব্রাকে ফোন করেছে আসমা, হাফসারা ঠিক আছে কি না, সেই খবর নিতে। বাড়ি থেকে রওনা হওয়ার আগেও বুড়িকে একটু খোঁজখবর রাখতে অনুরোধ করে এসেছিল। বুড়ি কেন ফোন ধরলো না, আসমা নিশ্চিত না। ডেব্রার হোয়াটসঅ্যাপেও মেসেজ করেছে মনসুর আর আসমা দুইজনই। টু শব্দ নাই। মনসুরের আরেক দেশি বন্ধু আশরাফকে মনসুর অনুরোধ করেছে, ওদের বাড়িতে গিয়ে একটু দেখে আসতে। আশরাফ নিজে যায় নাই, আশরাফের বউ গিয়ে দেখে এসেছে, বাড়িতে কেউ নাই। হাফসা আর হাফসার জামাইয়ের নিউ ইয়র্ক যাওয়ার কথা, তারও আগে পেন স্টেট ইউনিভার্সিটি যাওয়ার কথা একটা প্রেজেন্টেশন দিতে, হয়তো সেখানেই গেছে ওরা। নিজেদের সফরের তাড়াহুড়ায় হাফসাদের কাছ থেকে ওদের ট্র্যাভেল প্ল্যানটা চেয়ে নেওয়া হয় নাই আর এখন আসমার সেই অবস্থাও নাই। আসমার মনের ভিতরটা সবকিছু তছনছ হয়ে যাওয়ার শক পেয়ে শাদা হয়ে গেছে। ফিলাডেলফিয়ায় দারুণ তুষারঝড় চলছে; গত পঞ্চাশ বছরে নাকি এমন ঝড় কেউ দেখে নাই। কে জানে, হাফসারা এই ঝড়ের মধ্যে এখন কোন শহরে ঘরবন্দি হয়ে আছে! নিশ্চয়ই ওদের বেড়ানোর সমস্ত প্ল্যান ভন্ডুল হয়েছে। ইন্টারনেটে আসমা দেখল, সিটি হলের সামনে LOVE ভাস্কর্য অর্ধেকটা বরফের নিচে তলিয়ে গেছে—LO-টা ভেসে আছে, VE-টা ডুবে গেছে বরফে। সিটি হলের চূড়ায় বসানো শহরের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম পেনের মূর্তি কয়েকশ মিটার উপরে থাকার কারণে বরফে ডোবে নাই, কিন্তু ব্যাটার বামহাতের পাকানো স্কুল-লিপির উপর বরফের আস্তর পড়েছে। ব্যাটা স্লেভ- ওউনার ছিল, কালো ক্রীতদাস ছিল তার কয়েকশ। মনসুর বলেছে, নব্বই বছর ধরে শহরে পেন সাহেবের হ্যাটের লেভেলের চেয়ে উঁচু কোনো বিল্ডিং বসানো নিষেধ ছিল; এখন যদিও কেউ সেই নিষেধ মানে না।
“রিজর্টের ওই গিয়াস আবার ফোন দিছিল আমারে। বুঝলা?”
“কী বলে?”— আসমা খুব নিরুত্তাপ গলায় জিজ্ঞেস করে। আসলে আসমা ভুলে যেতে পারে না, নিতান্ত শব্দে-শব্দে গিয়াস তাকে কোন সহিংসতার মুখোমুখি করেছে। “বুজি, ধরেন, কালো পতাকা কালো পাগড়ির দল এই রিজর্টে হামলা করল। হাতে নাঙ্গা তলোয়ার। তাদের একজন, ধরেন, আপনারে আলগি দিয়া তুলল। তাদের আরেকজন, ধরেন, আপনার শরমের বালাই রাখল না। ওই রাশিয়ান মহিলার যেমন হইছিল আর কী! তখন আপনি কী করবেন? মাথা ঠান্ডা কইরা আপনার ছেলের কথা, আমাদের ভাইয়ার কথা বলবেন। নাকি বলেন?” রিজর্টের কিচেনের ওই ঘটনার পরে গিয়াস আর আদব-লেহাজের পর্দা রাখে নাই, সজ্জন হওয়ার ভাণ ধরার আর দরকার অনুভব করে নাই। কিম্বা গিয়াস এমনই—তার মধ্যে কখনো ভাণ ছিল না; শুধু এই একবার আসমার পছন্দসই আচরণ করে নাই দেখে আসমা তাকে ভায়োলেন্ট বাক্যের দায় দিচ্ছে।
মনসুর বলে, “আবরারের কোনো খবর আছে কি না, জানতে চায়। বুজির কাছে মাফ চায়। বুজির ফোন নম্বর তার কাছে নাই দেখে আমারে ভায়া-মিডিয়া মানছে আর কী।”
“কী নিয়ে মাফ চায়?”
“সেইটা তুমি জানো। তোমার দেশি ভাই। “
“তুমিও ওরে ভালোই পাত্তা দিছিলা, মনসুর। আপন হয়েই গেছিল ও। আবরার ওর সাথে বন্ধুর মতো মিশছিল, ওই যে ওই ভোররাতে ওরে ফোনও দিছিল। ভোরের স্বপ্ন ওইদিন আমিও দেখছিলাম; দেখছি— ছেলে আমার বাথরুমের ভিতরে গান করতেছে আর আমি বাইরে থেকে ওর আওয়াজ শুনতে পাইতেছি। তখনই গিয়াস দরজা ধাক্কাইল ফোন হাতে নিয়ে। ওর সাথে যোগাযোগটা রাইখো, যদি আবার কিছু খবর পাওয়া যায়…”
মনসুর উত্তর দেয় না। আবরার চলে যাওয়ার পরের প্রত্যেকটা দিন মনসুর মনে আশা রেখেছে, সৈকতে দুর্যোগ, মরা মাছের ঢল, চাইনিজ রকেট নিয়ে হাউকাউ, ছোটো শহর, টাইট আইডেন্টিটি—আমেরিকান বাঙালি তরুণ পর্যটক, আদতে বাচ্চা ছেলে, এতসব সীমা ডিঙিয়ে কতদূর আর যাবে ও? প্রত্যেকটা সকাল একটা ছিমছাম গোটানো উলের বলের মতো শুরু হয়েছে আর প্রত্যেকটা রাত এই রকম ঘরময় খুলে পড়া সুতার আউলা-ঝাউলা পেঁচ আর গেরো ছোটাতে ছোটাতে শেষ হয়েছে। রাত হলেই আসমা বলা শুরু করে, আগের রাতে সে কী না কী স্বপ্ন দেখেছে— যেমন গতরাতে দেখেছে খান জাহান আলির মাজারের কুমির, সেই কুমিরের মুখের ভিতর থেকে নিজের শরীরটাকে ঠেলে বের করে নিয়ে আসছিল নাকি ছেলে, দুই হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রাণীটার দুইপাটি দাঁতের সার খুলে ফাঁক করে। এইসব স্বপ্নের কথা শুনে গভীর রাতে মনসুরের আশার সঞ্চার হওয়ার কথা—ছেলে বুঝি ফিরে আসবে, কিন্তু তেমন কিছুর সঞ্চার হয় না। মনসুরের ক্লান্ত লাগে। পরাজয়ের গ্লানি বোধ করে সে। কথার পৃষ্ঠে কথা, প্রশ্নের উত্তরে প্রতি-উত্তর—এইসব দিয়ে ওইসবের ক্লেশ মিটবে না। আসমা কেন রাত হলেই স্বপ্নের কথা বলে? ও কি ঘুমাতে ভয় পায় এখন? দুঃস্বপ্ন দেখতে হবে, এই শঙ্কায় থাকে? পাক গিয়ে ভয়; মনসুরের এইখানে কিছু করার নাই। স্বপ্ন থেকে কেউ কাউকে কীভাবে বাঁচাবে? আসমার মা ছিল সুপারস্টিশাস; মেয়েও তাই। দ্য অ্যাপেল ডাজনট ফল ফার ফ্রম দ্য ট্রি।
মনসুর বারান্দা থেকে হোটেলের ছোটো ঘরটায় আসে, ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসে। সাধারণত সে টেবিলে না বসে লেখালেখি করতে পারে না, কিন্তু এখন ল্যাপটপ নিয়ে টেবিলে বসলে আসমার কাছে মনে হবে, মনসুরের মতো বরফহৃদয় বাপ আর দুইটা নাই; টেবিলে ল্যাপটপ নিয়ে বসার মধ্যে এমনই এক শীতল, নৈর্ব্যক্তিক, সার্জিকাল বিষয় আছে। আজকে মনসুরের মন চাইলো দ্য ইউনাইটেড স্টেট্স ভার্সাস বিলি হলিডে সিনেমার বিষয়বস্তু যেই বিখ্যাত গানটা— স্ট্রেঞ্জ ফ্রুট, সেই গানের বাংলা অনুবাদ করতে।
Here is a fruit for the crows to pluck
For the rain to gather
For the wind to suck
For the sun to rot
For the tree to drop
Here is a strange and bitter crop
মনসুর ঠিক করে বিটার-এর বাংলা করবে তিতা; তেতো নয়। ক্রো হবে কাউয়া, রেইন হবে দেয়া, উইন্ড হবে বাও। নাকি বাওয়া? এমন কোনো শব্দ নাই? বাংলা অনুবাদ করার আগেই মনসুর জানে ফেসবুকে এই কবিতাটা কেমনভাবে পোস্ট করলে ভালো হয়। দ্বীপের বালিতে পড়ে থাকা মহিলাদের পাছার মতো দেখতে ওই পাকা রাবণফলের একটা ছবি থাকবে মেইন পোস্টে। তার সাথে টেক্সট হিসাবে বসবে এই অনুবাদ। পোস্ট থেকে আসমাকে রেস্ট্রিক্ট করে রাখতে হবে, নইলে অকারণে অশান্তি করবে। ফেসবুকে গেল মনসুর। বারো বছর আগের একটা ছবিতে নতুন করে পুরানো কোনো বন্ধু লাইক-লাভ দিয়েছে বুঝি; ফেসবুক নোটিফিকেশন দিচ্ছে। ব্যাংকের কনফারেন্সের ছবি—তাতে মনসুর, মনসুরের বস, মনসুরের টিমের সকলে, দেশ-বিদেশের ডিগনিটারিজ। সকলেই সন্ত্রস্ত, তেলচকচকে আর হাসি-হাসি মুখ করে একটা ব্যাংকিং অ্যাওয়ার্ডের ট্রোফি ধরে আছে—সর্বডানে মনসুর, আর সর্ববামে ওর পুরানো কলিগ হাশিম। সকলের মাঝে এই দুইজনের জন্যই সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে ট্রোফিটার নাগাল পাওয়া। হাত বাড়িয়ে হাতের তালু বাঁকা করে প্রায় নাৎসি স্যাল্যুটের মুদ্রায় ওরা ট্রোফিটাকে ছুঁয়ে আছে, কিম্বা ছোঁয় নাই—শুধু চেষ্টা করছে। ওরা দুইজনই প্রজেক্টটা লীড করেছিল, বাকিরা আলংকারিক সংযোজন-মনসুরদের মোটকা, গজগামী, কূটকৌশলী বসের বুদ্ধিতে। তখনো মনসুর ছন্দ মিলিয়ে পদ্য লিখত:
কেন এরা টাই হাঁকে
টাই দিয়া ভুঁড়ি ঢাকে
আঢাকা পড়িয়া থাকে থাই, মাই, টাই?
ব্যাংকের ডেকোরামের প্রতি মনসুরের গোপন অশ্রদ্ধা ছিল। এখন আর সেই অশ্রদ্ধা নাই। এখন জীবনে বিদ্রোহের বিউটিও আর নাই। কতবার মুখ পানসা করে আসমাকে বলেছে, “বিপ্লব আর হবে না, বুঝলা, সামাহ?” কিন্তু তখনও হয়তো বিপ্লবের ক্ষীণ দুরাশা ছিল মনসুরের মধ্যে। এত ধীরে মনসুর বদলেছে যে, এখন মনসুর মনেও করতে পারে না, কবে ওর মনের ভিতর থেকে বিপ্লবের ক্ষীণ দুরাশা ক্ষীণতর থেকে নাই হয়ে গেছে। কিশোরবয়সে সেনাবাহিনীর ওয়ার্ক এথিক, সততা আর আত্মপীড়নের যেই সংজ্ঞা দিয়ে মনসুর নিজের সিস্টেম একদা সাজিয়েছিল, সেই সংজ্ঞা ভবির মতো, অপরিবর্তনীয় গ্রহ-নক্ষত্রের মতো, অতি ধীরে বদলেছে। মনসুরের নৈতিক ও শৈল্পিক কম্পাসও দিক-পরিবর্তন করেছে। আধাখেঁচড়া ফিনিশের অসম্পূর্ণ কাজ দেখলেও মনসুরের আজকাল মনে হয়, তা পরিপূর্ণতার কাছেই আছে—ইনকমপ্লিট কিন্তু ফুলফিল্ড—এই রকমের একটা আর্টিস্টিক শর্ত পূরণ করছে যেন তা। মনসুর নিজেও আজকাল লঘু, অপ্রমিত সাহিত্য করে— ওইসব ক্ষুদ্র, অনুকরণীয় জিনিস। দশ লাইনের গল্প লেখে। তিন লাইনের কবিতা। যেইসব পরিবর্তন এত ধীরে, এত অলক্ষ্যে হয়, সেইসব পরিবর্তন চূড়ান্ত, অপরিবর্তনীয়; এই সত্য পাগলেও জানে। নিজের যুবাবয়সে প্রসবিত সংজ্ঞার প্রতি কমিটমেন্ট রাখার পরীক্ষা পৃথিবীর কঠিনতম পরীক্ষা। মানুষ এই পরীক্ষায় শর্টকাট মেরে পাশ করতে চায়, তাই নিজের হাত-পা ঝেড়ে সন্তানাদির ভিতরে সেইসব কমিটমেন্ট সঞ্চারিত করতে চায়। নিজের পুরাতন—প্রায় তামাদি শুদ্ধতার, দস্তুরের, ইন্টেগ্রিটির সংজ্ঞা চাপিয়ে এদেরকে মেরে ফেলতে চায়। মনসুর তার নিজের একমাত্র সন্তানকে সেইভাবে মেরে ফেলে নাই; সন্তান নিজেই নির্ধারণ করে নিয়েছে, সে কী পদ্ধতিতে নিজেকে মারবে। এতে মনসুরের নিজের উপর একটু কম ঘেন্না হয়; ফেসবুক মেমরিতে নিজের বারো বছর আগের হাস্যকর, আকাট, অর্বাচীন, প্রায় বয়ঃসন্ধিকালীন সারল্যের চেহারা দেখে নিজের উপর স্নেহই হয়।
বাইরে বুঝি বৃষ্টি হচ্ছে। খুব সামান্য ছিটার গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। মনসুর ল্যাপটপ রেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় আবার। আসমা তখনও ওখানে একা বসে আছে, কার্নিশের নিচে চেয়ারটাকে টেনে নিয়েছে, যাতে বৃষ্টির ছাঁট কম লাগে। রাস্তার ওইপারে কনস্ট্রাকশন সাইট, সেইখানে একটা কুকুর বালির ঢিবি থেকে অলস গতিতে নেমে যায়। অন্য হোটেলের অন্য রুমে টিভি চলছে, পর্দার ফাঁক দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কোনো একটা ব্যান্ড বিরাট একটা কনসার্ট ভেন্যুতে বাজাচ্ছে— প্রচণ্ড আলোকিত মঞ্চ; উৎকট। গিটারিস্ট এমনভাবে শরীর বাঁকাচ্ছে, যেন কনুই দিয়ে হাঁটু চুলকাতে চুলকাতে গিটার বাজানোর কসরত করতেই তাকে রাখা হয়েছে। হাজারে-হাজারে লোক উন্মাদের মতো হর্ষধ্বনি করছে। এইসবের মধ্যেও লাখে লাখে লোক মরছে—এইখানে, আবার ওইখানেও। বারান্দার চেয়ার ভিজছে। মনসুর সেইখানে— বৃষ্টির মধ্যেই—গিয়ে বসে। ভিন্টেজ চেয়ার। বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের খুঁটি আর চিবানো ডাঁটাশাকের মতো লম্বা-লম্বা দাঁড়া—-আঙুলে ছুঁলে আঁশ আর রং উঠে আসে। থাইপাতার গন্ধ লাগে নাকের কাছে আঙুল নিয়ে গেলে।
“কী ভাবো, সামাহ?”
“ওই যে গিয়াস, বুঝলা, আমারে বলছিল দেশগ্রামে কুকুর পিটাইতে নিয়ে যাইত ওদের বড়ো ভাইরা ওদেরকে। ওদের এইটাই কামিং অভ এইজ, প্যাসেজ অভ রাইট্স।”
“ইউ মীন রাইটস অভ প্যাসেজ?”
“হুঁ, ওই আর কী।”
“আমাদের ক্যাডেট কলেজেও ছিল। যেইগুলারে সুইট কইরা র্যাগিং বলি আমরা, ওইগুলা তো এই রকম নিষ্ঠুরতার পরীক্ষা ছিল—নিজের উপ্রে বা অন্য কারও উপ্রে নিষ্ঠুরতা। নিজের মায়ার জিনিসগুলার উপ্রে। বা নিজের বিবেক, নিজের কনশাইন্সের উপ্রে। ওই পরীক্ষায় পাশ করলা, তো তুমি সেইফ, তুমি ইন-গ্রুপ, তুমি তখন অন্যদের উপর এই জুলুম চালাইবা। তারপর ধরো…”
“সেইটা পয়েন্ট না। একবার ভাবো, হোয়াট ইফ…”
মনসুর কথার মাঝখানে বাধা পেয়ে বিরক্ত হয়, তবু আসমার কথা শিগগিরি শেষ হবে, সেই আকাঙ্ক্ষা ধরে রাখে।
“এমন কি হয়, হতে পারে, যে নতুন রিক্রুটদেরকে ওরা লোকাল অপারেশনে পাঠায়, ধরো, এই রকমের ছিঁচকা রেইপ, ছিঁচকা ডাকাতি, ছিঁচকা খুন, টহলনৌকায় ছিঁচকা আসন, পুলিশের উপর ছিঁচকা গুলি? হয়তো এইগুলি পরীক্ষায় পাশ করলেই ওরা পরের লেভেলের জন্য কোয়ালিফাই করে। এমন একটা….”
“সামাহ, এইগুলা আলাপ তো আমরা করে ফেলছি। এইটা হইতে পারে, জেনেই তো আমরা খোঁজ নিছি ওই রাশিয়ান রেইপ-কেইস নিয়ে। আর কত জায়গায় কথা বলব আমরা? আর কী কী করতে কও শুধু এই সম্ভাবনা এলিমিনেট করতে যে, আবরার ওইখানে, ওই গ্রুপে ছিল না? এইখানকার লোকাল গ্যাং কয়েকটার উপর পুলিশ যে জিরো-ইন করছে, সেইটাও তো এখন পাবলিক নলেজ…”
“লোকাল গ্যাংয়ের কোনো সিরিয়া কানেকশন নাই, সেইটা তোমারে কে আইসা বইলা গেছে?”
“সামাহ, তুমি একটা ওষুধ খায়া ঘুম দাও। মাথাটা না হইলে আবার চড়বে তোমার।”
“ঠিক আছে। অন্য আলাপ করি চলো। ফেসবুকে কী দেখলা?”
“তেমন কিছু না। ওয়াইফাইটা তত ভালোও না”, মনসুর কিন্তু কিন্তু করে বলে। আসমা ঠিক বুঝে গেছে যে, মনসুর ঘরে গিয়ে ফেসবুক করে এসেছে।
“ও। বাসার ওয়াইফাইয়ের বিল দিয়ে আসছিলা কি না মনে আছে? হাফসাদের ফোনে হয়তো ইন্টারনেট নাই, তাই মেসেজের রিপ্লাই দিতেছে না।”
আবারও হাফসা। মনসুর আর পারে না। এইবার কথা ঘোরানো জরুরি।
“আসলামকে মনে আছে তোমার?”
“কোন আসলাম? তোমাদের বাসার যে ড্রাইভার ছিল ঢাকায়?”
“আরে না। ঢাকায় থাকতাম যখন, তখন আমার এক কলিগ প্রায়ই মদের বোতল নিয়ে আড্ডায় আসতো না? আর খালি “খাও, খাও” বলে পীড়াপীড়ি করতো? তুমি যে একবার বিশাল ধমক দিছিলা?”
“ওহ্। ওই লোক। হারামজাদা একটা।”
“আসলাম মারা গেছে। রোড অ্যাক্সিডেন্টে। ফেসবুকে দেখলাম।”
আসমার মুখ কালো হয়ে যায়। আর একটা কথাও বলে না সে।
“কই যাইতেছিল জানো? টঙ্গি। বিশ্ব ইজতেমা। আখেরি মোনাজাত করতে। চিন্তা করতে পারো? মানুষ কত বদলাইতে পারে!”
“সবাই বদলায় মনসুর। বয়স হইলে হয়তো তুমিও হজ্ব করবা। যে ঘটনা হইল আমাদের, এরপরে এইসব কথা বলা আর মানায় না।”
“তুমি করবা? তুমি গেলে তোমার সাথে আমিও গেলাম না হয়।”
“মাফ তো চাইতে হবে একদিন মালিকের কাছে।”
“মাফ চাইলে সাফ হয়া যাবা?”
“সাফ হব। যদি উনি মাফ করেন। যদি উনি কবুল করেন। “
“ইজ দেয়ার ওয়ান সাচ থিং? ক্যান ইউ বিকাম পিওর এগেন? পিওর হয়ে গেলে, তারপরে কী হবে? তারপরে? তারও পরে? আবার ময়লা হয়ে যাবা না?”
“তাইলে আবার চাইব।’
“কী চাইবা?”
“থাক। বুঝবা না। বাদ দাও।”
মনসুরের রাগ হয় এইবার। বুঝবে না মানে কী? “অবশ্যই বাদ দিব, সামাহ। বাদ দিবা না শুধু তুমি। তোমার ছেলে অমানুষদের খাতায় নাম লেখাইল; তো যেই সময়গুলাতে সে অমানুষ হবে হবে করতেছিল, সেই সময়ে তুমি কী করতেছিলা? বাদ দিতেছিলা? দিতা না হয় একটু বাদ!”
আসমা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কয়েক সেকেন্ড লাগে তার বিশ্বাস করতে যে, মনসুর এই প্রতিকূল, ভাঙা সময়েও তার উপর চড়াও হতে পারে। তারপর সে-ও মুখ খোলে।
“তুই কী করতেছিলি, শুয়োরের বাচ্চা? তোর ছেলে তোর মতোই অমানুষ হইতেছে, বুঝস নাই?”
এই রকম ঝগড়া, এই রকম তুই-তোকারির অনুশীলন ওদের মধ্যে আগেও হয়েছে বহুবার। শুরুর দিকে ছেলেকে নিয়ে কম, মনসুরের প্রেমিকাদেরকে নিয়ে বেশি হতো। বিয়ের পর কত-কত মেয়ের সাথে শুয়েছে মনসুর, তার খতিয়ান কেউ চাইবে তো আসমার কাছে চাক। তো শুরুর দিকে প্রতিবারই এইসব উত্তুঙ্গ ঝগড়ার সুখী পরিণতি ঘটত জান্তব, বন্য-সুন্দর দাম্পত্য সেক্সে। সেই সময়ও আজ গেছে, চূড়ান্তভাবেই গেছে। স্মরণীয় যৌনতা তো আর বিশ্বস্ততা হতে পারে না, এমনকি বিশ্বস্ততার অভাবের সান্ত্বনাও হতে পারে না।
মনসুর আজ নিস্তেজ, তাই নিষ্ঠুর কথা বলে আসমাকে প্রোভোক করলেও মাথা ঠান্ডা আর স্বরগ্রাম নিচু থাকে তার। শুধু বলে আসমা নাকি ফ্যাং বের করে ফেলে ছেলের বিষয়ে উনিশ-বিশ বললে। বাকি সমস্ত কথা আসমাই বলে। আসমার দীর্ঘ প্রতিবাদের ভিতরকার প্রত্যেকটা শব্দ এক-এক করে আসমাকে আরও তাতিয়ে দিতে থাকে— তার বঞ্চনার যে অনুভূতি, যে বরফগলা বানের মতো ক্ষোভ, সেই মুহূর্তে প্রতিটি শব্দ এসে মধ্যস্থতা করে-করে সেইসবের সাথে আসমার সম্পর্ককে পাকাপোক্ত আর চিরস্থায়ী করে দিতে থাকে। কবে বরবটি রেঁধেছিল পরে মেহমানদের সামনেই মনসুর দৌড়ে গিয়ে ময়লার টিনের ঢাকনি খুলে মুখের আধখাওয়া বরবটি থু-থু করে ফেলে দিয়েছিল, কবে শ্বশুরের সামনে মনসুর আসমার গায়ে হাত তুলতে তুলতে থেমে গেছিল, কবে আবরারকে স্কুল থেকে আনতে ভুলে গেছিল, কবে অফিস ট্রিপের নাম করে কোন মেয়ের সাথে প্রমোদভ্রমণে গেছিল—সব একে-একে মনে করিয়ে দিতে থাকে আসমা। মনসুরের এক থাপ্পড়ে ছেলের দাঁত পড়ে গেছিল একবার — “নড়তেইছিল এমনিতে”, মনসুর অনেকবার বলেছে। আবরার চঞ্চল বাচ্চা ছিল। হাত-পাগুলি ছিল লম্বা-লম্বা। সোফার মাথা থেকে এক লাফে আলমারির উপর যখন উঠত, মনে হতো একটা বর্শা ছুঁড়ে মেরেছে কেউ। সবই জানে আসমা, তবু থামে না। আর তারপর—তারপর আসমার বাপ যখন বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, কোথায় ছিল মনসুর? বিড়ি খেতে নিচে ছিল নাকি। বক্ষব্যাধি হাসপাতালের করিডোর অনেক-অনেক লম্বা—ব্যথা নিয়ে হেঁটে গিয়ে করিডোর পার হয়ে একা-একা রক্ত দিয়ে এসেছিল আসমার আব্বা। হ্যাঁ। চিৎকার করতে-করতে আসমা হাঁপাতে থাকে, ছোটো ছোটো ছোটো-ছোটো নিঃশ্বাসে মনসুরকে গালি দিতে থাকে। বাপের শিয়রে বসে যেমন শুনেছিল, এতদিন পর তেমন মেট্রোনোমের আওয়াজ শুনতে থাকে কানে। তবু আসমার মনের ভিতরের মনটা জানে যে, এক আগুনে এক ঘর একবারই পোড়ে। এতকাল ও ভাষাকে, শব্দকে যতটা পাওয়ারফুল ভেবে এসেছে, তত পাওয়ার আসলে শব্দের নাই। বারবার এক কথা বলতে থাকলে সত্যের গা থেকে শব্দ আলগা হয়ে খুলে আসে। আর সত্য সেই মুহূর্তে আসমানি চূড়া থেকে আসমার দিকে তাকিয়ে আছে, মনসুরের মতো হাবাগোবা চোখ করে; মুখ ফুটে আসমাকে বলতে বাধছে যে, আসমা তো আসলে ছোয়ালখাগি মা। কাঁদতে-কাঁদতে এক সময়ে গিয়ে আসমা নিজেকে গালি দিতে শুরু করে।
আসমা নিজেকে গালি দিলে মনসুরের মনে হতে থাকে—-অসম্পর্কিত, অপরিচিত, রাস্তার লোক এসে তার বউকে গালিগালাজ করছে। মনসুর প্রথমে রুমের দরজা পর্যন্ত হেঁটে যায়, একবার বাইরের বৃষ্টির কথা ভাবে, তারপর বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে বের হয়ে যায়। শহরের হোটেলের নোংরা বাণিজ্যিক গন্ধ, দুনিয়ার বান্দা-বান্দিদের পায়ের ধুলায় ধূসরিত খ্যাৎ লাল কার্পেট, সেই কার্পেটে মোড়ানো সিঁড়ি—সবকিছুর মধ্যে দিয়ে সে ছোটো ছোটো লাফ দিয়ে দৌড়ে যায়। পায়ে হোটেলের ঘরের স্যান্ডেল, গায়ে ঘুমের গেঞ্জি, পিছে কার যেন দৌড়ে আসার শব্দ। আসমারই। রিসেপশনের ছেলেগুলি সাঁ-করে বেরিয়ে যাওয়া ভদ্রলোক আর তার পিছে আলুথালু দৌড়াতে থাকা মেয়েমানুষ—মাথায় কাপড় নাই, দেখে তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই শহরে এমন ঘটনা ঘটে না, পর্যটকরা এইসব সীন ক্রিয়েট করে না; সেইসবের জন্য লাক্সারি দ্বীপ তো আছেই কয়েকশ। তার উপর এই দম্পতির গায়ের রঙের কারণে তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, এই সীন এবং এই সীনের দর্শকের মাঝে কয় হাত তফাত থাকা বাঞ্ছনীয়। মনসুর হোটেলের মূল ফটক ঠেলে বের হয়ে টের পায়, পিছে আসমার প্রায় হাঁপানির টান উঠে গেছে। মনসুরের মনের মধ্যে একটা মন বলে, “আরে শালা, থাম, থাম”, কিন্তু মনসুর থামে না। বৃষ্টির তেজ কেউ হিসাব করে বাড়িয়ে দিয়েছে। হোটেলের মুখ থেকে সমুদ্রের ধার মাত্র কয়েক গজ, সেখানে গিয়ে মনসুর সোজা হয়ে দাঁড়াতে চায়। চিৎকার করে বারবার নিজেকে বলতে থাকে, “শান্ত হ, হারামজাদা। শান্ত হ, হারামজাদা। শুয়োরের বাচ্চা, মাথা ঠান্ডা কর।” সামুদ্রিক মারণবাতাসে ওর মুখের আরও আরও অশ্রাব্য শব্দ দিগন্তের দিকে উড়ে যেতে থাকে। ওর নিজের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। পিছে কি আসমা আছে? নাই হয়তো। মৃত্যুর যেরকম শক্তি থাকে, সেই রকম শক্তি নিয়ে বাতাস মনসুরের মুখে বালিচাপা দেয়। মনসুরের মুখ দিয়ে কেউ যেন মনসুরের মায়ের মতো গলা করে আরেকবার বলে, “চুপ! চুপ!” তাই মনসুর ক্রমে সামলে ওঠে। কান্না থেমে যায়, ওর শরীর আর কাঁপে না। অনন্তকাল পরে, হাতে তালি দিয়ে ভেজা বালি ঝাড়ে মনসুর, যেন মাত্রই বালিতে দেবে যাওয়া একটা চাকা টেনে উঠিয়েছে সে, এক্ষনি ড্রাইভিং সিটে বসে ক্যাজুয়ালি গাড়ি স্টার্ট দেবে।
*
ছেলের সাথে এতদিন পরে এই প্রথম ফোনে কথা হয় আসমার — ফজরের নামাজশেষে। ছেলেকে সে আর ফেরত চায় কি না, সেই বিষয়ে সে ধীরে সন্দিহান হয়েছে—কথা শেষ হওয়ার আগে আসমা টেরই পায় নাই। এ কী হয়ে গেল? “মনচিনি, তুই আয়। অথবা এক কাজ কর। আসিসই না, কেমন?” ফোনের ওই প্রান্তে ভোরের পাখির ডাক, যদিও সকাল হচ্ছে আসমার দিকে—মেঘের পিছে নিঃশব্দে সূর্য ভেসে উঠছে। ওই প্রান্তে আবরার চুন-খয়েরমাখা পাবলিক ফোন বুথে দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে-সাথে কাঁদে। “আম্মা, ক্যামনে আমি… ক্যামনে… হাউ কুড আই …”। আসমা বুঝে ওঠে না, ছেলে কী বোঝাতে চাইলো, কেমনে সে মাকে থুয়ে সিরিয়া রওনা হলো? নাকি কেমনে সে এখন আবার মায়ের কাছে ফিরে যাবে? তবু আসমার মন ঠিকই বোঝে। ছেলেও কি টের পায়, মা কী বুঝল আর না বুঝল?
আসমার দিকের সমুদ্র ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমাচ্ছে। পানি কিচ্ছু জানে না; আবারও ‘আমি কী জানি? আমি কী জানি?” শব্দ করছে। রাতের আকাশ আরও আরও মাছের লাশ থুথু দিয়ে ফেলে দিয়েছে—মুখগহ্বরের ভিতরে লালায় জড়ানো অর্ধভুক্ত খাবারের মতো মাছ সৈকতের সর্বত্র ছিটিয়ে আছে। সারা গায়ে সামুদ্রিক শৈবাল পেঁচিয়ে গেছে—মাছের মৃতদেহের শরীরে স্থিত একমাত্র জীবন্ত অরগানিজম। এখন থেকে দ্বীপবাসীর রুটিন সাপ্তাহিক দুর্যোগের নাম মৎস্যদূষণ, যা প্রতি বৃষ্টির দিনে ওদের চোখের সামনে ঘটবে, তবু যা আপামর দ্বীপবাসী অবহেলা করবে আর ভুলে থাকবে, মানুষের আদিম অভ্যাসেই। সূর্যোদয়ের লাল আলো পুঁজের মতো গলে-গলে সমুদ্রের উপরের আকাশ থেকে পানির উপরে নেমে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। আসমাকে বড়ো ঘরের বউদের মতো লাগছে। ওর কানে এক-পাথরের টপ ফরসা আলোয় ঝিকমিক করছে। কাছেই কোনো একটা ডালে পাখি ডাকছে, যেন কেউ কাউকে অনবরত চুমু খাচ্ছে। নীরবে আসমার পাশ দিয়ে হেঁটে যায় মনসুর। যে গাছ দৃশ্যমণ্ডলের কোথাও নাই, সেই গাছের রং বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে সাগরের উপর পড়েছে গতরাতে।
‘আম্মা, যদি জীবনে… ইফ এভার, ঝামেলা খালার সাথে কথা হয়, প্লিজ আস্ক হার টু ফরগিভ মি। আই নো, শি ওয়জ ওয়েইটিং। কিন্তু আমি আমার হোয়্যারঅ্যাবাউট্স আর জানাই নাই। আমার জার্নি—আই ওয়ান্ট টু ডু ইট অ্যালোন; স্যরি।”
বলে কী ছেলে? হাফসা ওর জন্য কোথায় অপেক্ষা করছে? দি ইউনাইটেড স্টেট্স অভ আমেরিকায়? দুইজন মিলে এক হওয়ার প্ল্যান করেছিল? ঘর করার প্ল্যান? নাকি সিরিয়া যাবে প্ল্যান করেছিল? এত সহজ? হাফসা নিশ্চয়ই সত্যি-সত্যি এই রকম পাগলামিতে অংশ নেবে না, কিন্তু এই রকম, এই রকমের সর্বনাশই তো আসমার কল্পনায় ছিল, তাও কেন আসমা চিৎকার করে ওঠে? কেন নতুন করে ওর মাথায় বাজ পড়ে? কেন মাথার ভিতর বারবার চর্চিত দুঃস্বপ্নকে বাস্তবে দেখে আসমা আর ঠিক- ভুল দিশা করতে পারে না? নাকি এই যে দেখছে, শুনছে—এটা স্বপ্নই এখনো? আসমা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে। “বল, বল” করতে থাকে। আবরার হাউ-হাউ করে কিছু বলতে চায়, কিন্তু আবরারের গলা ভেঙে যায়; দুই আঙুলে টিপতে থাকা কয়েন ঘেমে ওঠে, দৌড়ে সাগরের কাছে ছুটে যায় সে, প্রতিকূল হাওয়ায়— আসমার সৈকত থেকে তার সৈকত কত দূরে? নোংরা পানির অবহেলিত সাগর—এই হলো ভূস্বর্গের রাজধানী। সৈকতে জাপানিরা টেট্রাপড বসিয়েছে, কংক্রিট দিয়ে তৈরি চারমাথার শিবলিঙ্গ বধ্যভূমির লাশের মতো উপরে-নিচে গাদাগাদি করে শুয়ে আছে সাগরের জল ঠেকাতে। ভাটায় জল সরে যায় আর কংক্রিটের খাঁজে খাঁজে ছাইরঙের কাঁকড়া-কাছিম গুটকাতে থাকে; এই সৈকতে মরা মাছ ভেসে আসে নাই। আবরারের শরীরে হাঁসের জ্বালা। সর্বাঙ্গে করবীর কষ। পুঁজ কি পিচুটিতে বাম চোখের পাতা খুঁজে গেছে। সেইদিন মেরিন পুলিশ আসার আগেই দলের সাথে পালাতে পেরেছিল ও—মারগুব ইডিয়টটা শুধু পিছে রয়ে গেছিল— মেয়েটাকে পানি খাওয়াতে গিয়েই ধরা খেলো ডিমউইটটা। পালানোর পথে মরা গাছের ডালের ঘষা লেগে আবরারের হাঁটু ছড়ে গেছে; হাতে-পায়ে খড়ি উঠেছে—চামড়ার উপর নখের খোঁচা দিয়ে-দিয়ে কাটাকুটি খেলা যাবে। চোখের নিচের চামড়া লটকনের কোয়ার মতো স্ফীত। কেউ তাকে দেখছে না। রাস্তার পাশে বুকে হাঁটুচাপা দিয়ে বাহ্যি করার মতো ভঙ্গিমায় লোকেরা বসে আছে আর কম দামি মোবাইল ফোন গুঁতাচ্ছে। একটা জটলা বসেছে একটা আগুনকে ঘিরে—একই জায়গার কর্মী হয়তো ওরা, সবার গায়ে হাফ-হাতা ময়লা শাদা শার্ট। একটা ঘাড়ে-গর্দানে বয়ামের ভিতর পুরা হাত ঢুকিয়ে এক ড্যালা চিনি বের করে ওদের মধ্যে একজন। একটা রিঙে চাবির মতো গাঁথা তিনটা চামচ: তিন সাইজের—এক চা-চামচ, আধা চা-চামচ, পোয়া চা-চামচ; একটা আরেকটার সাথে ঠোকাঠুকি করতে করতে তিঙিলিঙ-তিঙিলিঙ শব্দ করতে থাকে। শস্তা মেলামাইনের মগে গুঁড়া দুধ দিয়ে চা খেতে থাকে ওরা। আগুনের ভিতর যেন একটা কলিজা আছে, ধুকধুক করে জ্বলছে আর কাঠ পোড়াচ্ছে। একটু দূরে সুমিতম কম্পানির ক্রেন পার্ক করে রাখা আবর্জনা তোলার কাজে। পশ্চিমদিকে গাছ ছিল, বুঝি ছোটোখাটো উদ্যানও — পাতায়-পাতায় পুরু ধুলার আস্তরপড়া, এখন যেখানে হাবিজাবি ফোন রিচার্জের দোকান, রেস্টোর্যান্ট, এটিএম বুথ, ফলের বাজার, ট্যুরিস্টদের জন্য গোটাকতক শস্তার ক্লাব—”বাইরে দেখি মুশকা বাউন্সারও দাঁড়ায়া থাকে।” মানুষের খায়েশ আবরারের আজব লাগে—অ্যাগ্রেশন দেখিয়ে মাটি অধিকার করে তারপর সেই মাটি ঘুঁটে তোলা পয়সা দিয়ে অ্যাগ্রেশন পরিতর্পণের দোকান বসিয়েছে, যার বাইরে আবার কন্ট্রোল সিস্টেমও মোতায়েন করেছে। আবরার এখন আর ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না যে, এইসবের শেষ হবে কোনোদিন; ওর আর মনে হয় না, নয়া কিছুর পত্তন হবে কখনো। নয়া শহর, নয়া মঞ্জিল, নয়া মোকাম, একটা নয়া পদ্মপাতার উপর ডাকতে থাকা একটা নয়া ব্যাঙ – সেইসবকে অনেক দূরের মনে হয়। একটা সমান্তরাল জগৎ পরিভ্রমণে কি যেতে পারবে মানুষ–এই মানুষগুলিই, এই সাগরের তীরে আগুন বানিয়ে চা খেতে বসা, ফোন টিপতে বসা, চায়ের চামচে জীবনের ধ্বনি তুলে ফেরা মানুষগুলিই আর তারপর সেই জগৎ থেকে হাজার পীড়াপীড়িতেও আর ফিরে আসতে চাইবে না এই জগতে? অলরেডি কি ওরা গেছে সেইখানে? রোজই কি তারা যায় সেইখানে?
মায়ের কথা পলকে আর মনে পড়ে না আবরারের। প্রথমে ফেরির শব্দ কানে আসে, তারপর পুলিশ ভ্যানের শব্দ আর ওর মগজের তীর থেকে এইসব চিন্তা পানির মতো গ্লাইড করে সরে যায়।