লিভরে কওম

লিভরে-কওম

ইসমাইল সাহেব ক্ষণজন্মা পুরুষ।

স্কুল হইতে মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসা হইতে স্কুল, এইভাবে বত্সরের পর বৎসর বহু স্থান বদলাইয়াও যখন কোনমতেই তিনি শ্রেণীবিশেষের মায়াজাল ছিন্ন করিতে পারিলেন না, তখন মফস্বলের শিক্ষকদের অপক্ষপাত ন্যায়-বুদ্ধিতে সন্দিহান হইয়া পুত্রহীনা বিধবা ফুফুর একমাত্র দওলত ছাগলটা পাশের গ্রামের বাজারে বিক্রয় করিয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া সেই রাতেই কলিকাতার গাড়িতে চড়িয়া বসিলেন।

কলিকাতায় পৌঁছিয়া একটি মসজিদে আশ্রয় লইলেন।

মফস্বলের লোক তাহার কদর না বুঝিলেও কলিকাতার লোক তাহার প্রতিভার সম্মান করিল। গলার আওয়াজ মিষ্টি হওয়ায় প্রথমে সেই মসজিদের মোয়াজ্জিন ও পরে এমাম নিযুক্ত হইলেন।

মসজিদটি ছিল কলিকাতার অল্পসংখ্যক আহলে-হাদীস মসজিদের অন্যতম।

সুতরাং হানাফীদিগের নিন্দা-কুৎসাই ছিল এখানকার প্রধান আলোচ্য বিষয়। মসজিদের মোতাওয়াল্লি সওদাগর হাজি সাহেবকে যদি খোদা একদিনের জন্যও এ দেশের বাদশা বানাইয়া দিতেন, তবে তিনি দেশকে হানাফী শূন্য করিয়া ফেলিতেন। সেদিকে সুবিধা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আপাততঃ না থাকায় অগত্যা বাহাসের সভার আয়োজন করিয়া বেনারস ও অমৃতসর হইতে মওলানা আমদানি করিবার ব্যাপারে প্রচুর টাকা খরচ করিয়াই তিনি খোদার ঐ ভুলের প্রতিকার করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। ইসমাইল সাহেব হানাফীদের পরিচালিত মাদ্রাসা-স্কুলে হানাফী শিক্ষকদের নিকট পড়াশোনা করিয়া অনেকটা হানাফী-ভাবাপন্ন হইয়া পড়িলেও এখন হইতে তিনি অকস্মাৎ ভীষণ পাকা মোহাম্মদী বনিয়া গেলেন।

হানাফী-নিন্দায় অচিরকাল মধ্যে তিনি হাজি সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেন।

প্রথম প্রথম তিনি মসজিদে বসিয়া ও পরে ক্রমে সমবেত মুসল্লিদের সামনে দাঁড়াইয়া চক্ষু বড় করিয়া হাত পা ছুঁড়িয়া উদ্দেশ্যে হানাফীদিগকে গালি পাড়িতেন। এইভাবে বক্তৃতায় অভ্যস্ত হইয়া ক্রমে বাহাসের সভায় যোগ দিলেন এবং শুধু যোগ দিলেন না– নামও করিলেন।

হাজি সাহেব খুশি হইলেন। আদর করিয়া বাবা বলিয়া পিঠে হাত বুলাইলেন।

ইসমাইল সাহেব হাজি সাহেবের কদমবুচি করিলেন।

সেইদিন হইতে হাজি সাহেবের বাড়িতেই ইসমাইল সাহেবের থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত হইল।

.

দুই

হানাফী-মোহাম্মদীর বাহাস ক্রমে খুবই জনপ্রিয় হইয়া উঠিল।

দূরবর্তী স্থানসমূহ হইতেও বাহাসের দাওয়াৎ আসিতে লাগিল।

চতুর্দিকে একটা জাগরণের সাড়া পড়িয়া গেল।

ইসমাইল সাহেব হাজি সাহেবকে নানা যুক্তি-তর্কের দ্বারা বুঝাইলেন যে, একটা কাগজ বাহির না করিলে প্রচারকার্য চালাইবার পক্ষে সুবিধা হইবে না; শুধু বাহাসের মজুলিস করিয়া বিশেষ কোনও ফল পাওয়া যাইবে না; একটা কাগজ বাহির করিয়া তাতে মোহাম্মদী মযহাবের দলিলাদি পেশ করিয়া হানাফী মযহাবের অসারত্ব প্রমাণ করিয়া দিলে দলে দলে হানাফী মোহাম্মদী মত অবলম্বন করিবে। এই উপলক্ষ্যে খ্রিস্টান পাদ্রীদের ধর্ম প্রচারের পদ্ধতি সম্বন্ধে স্বীয় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তিনি হাজী সাহেবের নিকট খুব চটকদার করিয়া বর্ণনা করিলেন।

হাজি সাহেব সমস্ত শুনিয়া বলিলেন : সত্য নাকি বাবা?

ইসমাইল সাহেব খুব জোরের সঙ্গে বলিলেন : নিশ্চয়, হুজুর।

দশ হাজার টাকা খরচ করিয়া প্রেস কেনা হইল। হাজি সাহেবের প্রকাণ্ড বাড়ির এক অংশে প্রেস বসিল। আর এক কামরায় আফিস হইল।

‘আহলে-হাদিস-গুর্ষ’ নামক কাগজ বাহির হইল। ইসমাইল সাহেবই সম্পাদক হইলেন। তিনি নিজের সম্প্রদায়ের কল্যাণের জন্য বিনা-বেতনেই এই দায়িত্ব গ্রহণ করিলেন।

হাজি সাহেব বলিলেন : ইসমাইল মিয়া একটা মানুষ। খোদা একদিন তার এই ত্যাগের বদলা দিবেন।

‘আহলে-হাদিস-গুর্য’ চলিল। চলিল মানে বিলি-বিতরণ হইতে লাগিল। কাগজ কলমে হানাফী-নিন্দার ঝড় বহিতে লাগিল।

ক্রমে হানাফী নিন্দার সঙ্গে-সঙ্গে ইংরাজদের নিন্দাও কিছু কিছু হইতে লাগিল।

ইসমাইল সাহেব কিছুটা জাতীয়তাবাদী হইয়া পড়িলেন।

হাজি সাহেব শুনিতে পাইয়া একদিন বলিলেন : বাবা ইসমাইল; হানাফীদের সঙ্গেই আমাদের লড়াই, ইংরাজদের সঙ্গে ত আমাদের কোনও দুশমনি নেই।

ইসমাইল সাহেব বলিলেন : তা বটে, কিন্তু আজকালকার লোকেরা মতিগতি যে কি রকম হয়ে গেছে, ইংরাজকে গাল না দিয়ে কাগজ বিকায় না। গ্রাহক বেশি না হলে কাগজে যে কেবলই লোকসান হবে। আপনাকে আর কতকাল খরচান্ত করাব?

হাজি সাহেব সজোরে মাথা নাড়িয়া বলিলেন : না-না না হোক লোকসান। ইংরাজ রাজা, তাকে গাল দিয়ে শেষকালে কি একটা ফ্যাসাদে পড়ব? আমি লাভের জন্য কাগজ করি নাই; লোকসান হয় আমার হবে; খবরদার, তুমি ইংরাজদের বিরুদ্ধে কিছু লিখো না। পুলিশের হাঙ্গামার মধ্যে আমি নাই।

ইহার কিছুদিন পরে এক ভদ্রলোক হাজি সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে আসিলেন। গম্ভীর মুখে হাজি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলেন : আপনারা আহলে-হাদিস-গুর্য’ নামে কাগজ চালান?

–হাঁ, চালাই।

–এই কাগজের উপর সরকারের কুনজর পড়েছে।

–কেন, আমার কাগজে ত ইংরাজদের বিরুদ্ধে কোন কথা থাকে না।

–তা না থাক, সরকারের আরও গুরুতর সন্দেহ হয়েছে। আপনার কাগজের আফিস সীমান্তের ওহাবী কাফেলার শাখা।

হাজি সাহেব মাথায় হাত দিয়া কাঁদ কাঁদ স্বরে বলিলেন : কি হবে তবে, বাবা ইসমাইল।

ইসমাইল সাহেব আগন্তকের সহিত কটাক্ষ বিনিময় করিয়া বলিলেন : পুলিশে আমাদের ভয় কিসের? আমরা ত নির্দোষ।

আগন্তক বলিলেন : হোন নির্দোষ; কিন্তু পুলিশ খানাতল্লাশ না করে ছাড়বে না।

ইসমাইল সাহেব ক্রোধে হাত নাড়িয়া বলিলেন : খানাতল্লাশ করে পাবে কচু। আমরা এখানে ঢাল তলোয়ার বা বোমা লুকিয়ে রেখেছি, না?

আগন্তকও একটু উষ্ণ হইয়া বলিলেন : পাবে না কিছু মানলাম, কিন্তু ভদ্রলোকের বাড়িতে খানাতল্লাশ কত অপমানজনক, তা আপনি খেয়াল করছেন না।

ইসমাইল সাহেব ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন : মান অপমান আমরা বুঝব। কে আপনি যে আমাদের ভয় দেখাতে এসেছেন।

–আমি পুলিশেরই লোক। তবে আমিও মুসলমান, তাই মুসলমান ভদ্রলোকের ইয্যতের জন্য আগে থেকে সাবধান করতে এসেছিলাম, আপনাদের গাল শুনতে আসি নাই। চললাম।

হাজি সাহেব ইসমাইল সাহেবের দিকে চাহিয়া বলিলেন : কাজটা ভাল করলে না, বাবা। পুলিশের লোক চটিয়া দিলে? এখন কি হবে?

ইসমাইল সাহেব উপেক্ষার সঙ্গে বলিলেন : কি আর হবে? খানাতল্লাশ করে পাবে

পাক নাপাক তার কথা পরে। আমার বাড়িতে পুলিশ হানা দিবে এ অপমান আমি সহ্য করব?

–আপনি যা হয় আদেশ করুন। আমার মনে হয়, ভয়ের কোন কারণ নাই।

হাজি সাহেব কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন : ভয়ের কথা নয় বাবা, মান অপমানের কথা।

হাজি সাহেব সেইদিন বিকালে ইসমাইল সাহেবকে বলিলেন : অন্য কোথাও বাড়ি ভাড়া কর। সমস্ত প্রেস, আহলে-হাদিস-গুর্যের আফিস আমার বাড়ি থেকে সরাও। আমার বাড়িতে খানাতল্লাশ হতে দেব না। আর দেখ, প্রেস কিপারের স্থানে আমার নাম কেটে অন্য কারও নাম লিখিয়ে নাও। বুড়া বয়সে কোথায় আল্লাহ্-আল্লাহ করব, তা না করে ও-সব হাঙ্গামায় আমি কেন?

তাই হইল।

ইসলাম সাহেব অন্যলোক না পাইয়া নিজেই প্রেসের ‘কিপার’ হইলেন।

.

তিন

নূতন বাড়িতে ‘আহলে-হাদিস-গুর্যের’ আফিস প্রতিষ্ঠিত হইল।

ইসমাইল সাহেব সম্পাদকের স্থলে নিজের নামের পরিবর্তে স্বীয় নিতান্ত অনুগত শ্যালক-কেরানির নাম ছাপাইলেন এবং কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় শীর্ষদেশে বড় বড় অক্ষরে ছাপা হইল : মওলানা মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেব প্রতিষ্ঠিত।

কাগজের উদ্দেশ্যের স্থলে লেখা হইল : বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মুসলমানদের মধ্যে একতা ও সম্প্রীতি স্থাপন এবং তাহাদের সাহিত্যিক, রাজনীতিক, সমাজনীতিক ও বাণিজ্যনীতিক উন্নতিবিধান।

নূতন বাড়িতে ‘আহলে-হাদিস-গুর্য’ প্রতিষ্ঠিত হইবার পর প্রথম সংখ্যাতেই সম্পাদকীয় স্তম্ভে লেখা হইল : দয়াময় আল্লাহতালার অসীম কৃপায় ও সমাজের অকৃত্রিম হিতৈষী বঙ্গবিখ্যাত আলেম, মুসলিম বঙ্গের অবিসম্বাদিত নেতা মওলানা মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেবের অসাধারণ ত্যাগ স্বীকারের ফলে ‘আহলে-হাদিস-গুর্য’ আজ অষ্টম বর্ষে পদার্পণ করিল। গ্রাহক-অনুগ্রাহকগণের সহানুভূতি মাত্র সম্বল করিয়া মওলানা সাহেব এই দায়িত্বপূর্ণ কাজে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন। এ কাজে তিনি মুসলিম বঙ্গের আশাতীত সহায়তা পাইয়াছেন। তারই ফলে সামান্য মূলধন লইয়া মওলানা সাহেব এই কাজে হাত দিয়াও আজ ‘আহলে-হাদিস-গুর্য’কে নিজের পায়ে দাঁড় করাইতে সমর্থ হইয়াছেন। মওলানা সাহেবের বাড়ির অবস্থা স্বচ্ছল না হলেও তিনি এযাবৎ কাগজের তহবিল হইতে এক কপর্দকও গ্রহণ করেন নাই। বরং সংসার হইতে আহলে-হাদিস-গুর্যকে সাহায্য করিতে গিয়া তিনি ঋণগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছেন। ইহার জন্য মওলানা সাহেব বিন্দুমাত্র দুঃখিত নহেন। তাহার প্রাণের ধন সাধারণ বস্তু ‘আহলে-হাদিস-গুর্য’কে তিনি হৃদয়ের প্রতি শোণিতবিন্দু দিয়া জীবনের পথে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে পারিয়াছেন, তজ্জন্য তিনি সেই পরম করুণাময় আল্লাহতালার দরবারে শোকর গুজারি করিতেছেন।

এই ধরনের অন্যান্য কথার পর লেখা হইল : মওলানা সাহেব কেবল মাত্র আহলে হাদিস-সম্প্রদায়ের কল্যাণের জন্যই প্রথম ‘গুর্যের প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু যাহার কর্মশক্তির নেয়ামত খোদাতালা সমস্ত মুসলিম-বঙ্গের ভোগ্য বলিয়া বিধান করিয়া দিয়াছেন, তাঁহার সেই অসাধারণ কর্মশক্তি সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকিবে কেন? সমস্ত মুসলমানদের জন্যই খোদা যাহাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনি সাম্প্রদায়িক গণ্ডির মধ্যে নিজেকে লুকাইয়া রাখিয়া স্বীয় জ্ঞানের আলো হইতে অধঃপতিত মুসলমান সমাজকে বঞ্চিত করিয়া খোদার আদেশ অমান্য করিতে পারেন না। সমস্ত বাঙলার মুসলমান সম্প্রদায়ের অধঃপতিত অবস্থা দর্শন করিয়া মওলানা সাহেবের উদার প্রাণ হাহাকার করিয়া উঠিয়াছে। তাই তিনি সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সমস্ত মুসলমানের কল্যাণ সাধনের জন্য এহতেকাফে বসিয়াছেন। কি উপায় অবলম্বন করিলে মুসলিম-বঙ্গের সার্বজনীন কল্যাণ সাধন করা যায়, কি কর্মপন্থার দ্বারা খোদার প্রেম ইসলামকে দেশের মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যায়, গত দুই সপ্তাহ যাবৎ তিনি তজ্জন্য কঠোর ধ্যানে মগ্ন হইয়াছেন। শীঘ্রই ‘গুর্যের মারফত তার ফলাফল সাধারণ্যে ঘোষণা করা হইবে। মুসলিম-বঙ্গ প্রস্তুত হও।

অতঃপর ‘গুর্যে’র ভবিষ্যৎ ‘অসাম্প্রদায়িক’ নীতির কথা বর্ণনা করিয়া এইভাবে প্রবন্ধের উপসংহার করা হইল : ইসলাম ও মুসলিম-বঙ্গের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য আমাদের ধর্মীয় ও রাজনীতিক গুরু মওলানা সাহেব বিষয়ান্তরে মনোনিবেশ করায় ‘গুর্য’ পরিচালনের গুরু দায়িত্ব আমাদের দুর্বল ও অযোগ্য স্কন্ধে ন্যস্ত হইয়াছে। গুর্য পরিচালনে মওলানা সাহেবের জ্ঞানালোকে, অনুপ্রেরণা ও উপদেশই আমাদের পথ-নির্দেশ করিবে বটে তথাপি সমাজের হিতৈষী ব্যক্তিগণের ও জনসাধারণের আন্তরিক সহযোগিতাও কামনা করিয়া আমরা আজিকার এ জয়যাত্রা আরম্ভ করিলাম।

ইহার পর হইতে ‘গুর্যের’ সম্পাদকীয় স্তম্ভে মযহাবী ঝগড়া বিবাদের তীব্র নিন্দা করিয়া, প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের সহিত মুসলমান সম্প্রদায়ের দূরবস্থার তুলনা করিয়া এ বিষয়ে কোনও সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি দৃষ্টি দিতেছেন না বলিয়া আর-আর নেতৃবৃন্দের কার্যের নিন্দা করিয়া এবং যে একজন মাত্র লোক সমাজের জন্য শিবরাত্রির শলিতার মতো গোপনে বিন্দু বিন্দু করিয়া নিজের শোণিত দান করিতেছেন, তাঁহার দীর্ঘ জীবনের জন্য খোদার নিকট দোয়া করিতে সমস্ত পাঠক-পাঠিকাকে অনুরোধ করিয়া সপ্তাহের পর সপ্তাহ রাশি রাশি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ বাহির হইতে লাগিল।

বলাবাহুল্য, ইসমাইল সাহেবই নিজ হাতে ঐসব সম্পাদকীয় লিখিতেন এবং ধ্যান এহতেকাফ যা করিয়া সশরীরে ‘গুর্য-কার্যালয়ে অবস্থান করিয়াই সব করিতেন।

‘গুর্যে’র লেখা জনসাধারণের অধিকাংশের হৃদয় জয় করিল। সাম্প্রদায়িক কলহের অবসান-প্রাক্কালে এমন উদার বাণী অনেকের নিকটই নূতন ও মহান বোধ হইল।

দলে-দলে ‘গুর্যে’র গ্রাহক বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।

যথাসময়ে সব কথা হাজি সাহেবের কানে গেল। তিনি ইসমাইল সাহেবকে ডাকিয়া বলিলেন : বাবা অন্য সব যা লিখেছ, তার জন্য আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই না। তোমার ঈমানে যা নেয়, তাই করো? আমি ওথেকে লাভ করব বলে কাগজ বের করি নাই। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ত্যাগ করতে যাচ্ছ, তাতেই আমার আপত্তি।

ইসমাইল সাহেব হাজি সাহেবের সম্মুখে নত হইয়া তাঁর কদমবুসি করিলেন; তাঁর বাম হাতটি নিজের মাথায় লইয়া বিনীতভাবে বলিলেন : আপনি বরাবর আপনার এই অযোগ্য সন্তানের বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করে আসছেন। আশা করি, সে-বিশ্বাস আপনার এখনো টলে নাই। আপনি পিতৃতুল্য, আপনার কাছে গোপনীয় কিছু নাই। আহলে-হাদিস মত প্রচার করতে গিয়ে আমি বাজারের মামুলি পন্থা অবলম্বন করতে চাই নে। আপনি জানেন, আমি খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচার প্রণালী বহুদিন ধরে অধ্যয়ন করে আসছি। এ বিষয়ে আমি তাদের নীতিই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি। উদারতার ছদ্মবেশে সাম্প্রদায়িক মতবাদ প্রচারেই সাফল্যের আশা অধিক।

হাজি সাহেবের সন্দেহ অনেকটা দূর হইল। তিনি নিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন : আচ্ছা বাবা, যা হয় কর। আমি আর কি বলব? আমাদের উদ্দেশ্য যেন ভুলে যেয়ো না।

ইসমাইল সাহেব দৃঢ়তার হাসি হাসিয়া আবার মাথা ঝুকাইয়া বলিলেন : আপনি দোয়া করুন।

হাজি সাহেব খুশি হইলেন।

ইসমাইল সাহেব বিদায় হইলেন।

.

চার

‘গুর্যের’ পাঠক-পাঠিকার প্রাণ বহুদিন প্রতীক্ষার সূতায় লটকাইয়া রাখিবার পর ইসমাইল সাহেবের এতেকাফের ফল বাহির হইল।

একদিন সম্পাদকীয় স্তম্ভে এইরূপ লেখা হইল : অধঃপতিত বঙ্গ-মুসলিমের দুরবস্থা দর্শনে যে মহাপুরুষের প্রাণ কাঁদিয়া উঠিয়াছিল, যিনি সংগোপন লোক-লোচনের অন্তরালে সমাজের কল্যাণ কঠোর সাধনায় শিবরাত্রির শলিতার মতো নিজকে তিল তিল করিয়া বিসর্জন দিতেছিলেন, খোদার দরবারে হাজার শোকর, আমাদের সেই পূজনীয় নেতা হযরত মওলানা সাহেব তদীয় সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। তিনি দীর্ঘ একমাস এতেকাফে বসিয়া খোদার দরবার হইতে এল-হামের অনুপ্রেরণা পাইয়াছেন। সমস্ত মুসলিম বঙ্গ আজ সমস্বরে বল ও আল্লাহু আকবর।

এহতেকাফে বসিয়া হযরত মওলানা সাহেব কি এহলাম পাইয়াছেন, সমাজের কল্যাণের কি অনুপ্রেরণা তিনি লাভ করিয়াছেন, প্রবন্ধের বাকি অংশে সে-সমস্ত কথা বর্ণনা করা হইল। তার সারমর্ম এই মুসলিম বঙ্গের অদ্বিতীয় নেতা হযরত মওলানা সাহেব শিবরাত্রির শলিতার মতো তিলে তিলে আত্মবিসর্জন দিয়া আল্লাহ রাব্দুল-আলামিনের নিকট হইতে যে এহলাম পাইয়াছেন তা এই : ইসলামের রজ্জুকে শক্ত করিয়া না ধরার অপরাধেই মুসলিম বঙ্গ এই শাস্তি ভোগ করিতেছে। মুসলিম বঙ্গের উন্নতি করিতে হইলে বাংলায় ইসলামকে পুনর্জীবিত করিতে হইবে; খ্রিস্টান পাদ্রিদের ধোকায় পড়িয়া লক্ষ লক্ষ মুসলিম আজ মুরতে হইয়া যাইতেছে, ইহাদিগকে রক্ষা করিতে হইবে; ভিন্ন। ধর্মাবলম্বীদিগকে ইসলামের সুশীতল ক্রোড়ে স্থান দিতে হইবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

এইভাবে সমাজের দুরবস্থা ও তার প্রতিকারের উপায় বর্ণনা করিয়া উপসংহারে হযরত মওলানা সাহেবের এলহাম-প্রাপ্ত তরকিবের কথা বলা হইল। তা এই : এতদুদ্দেশ্যে হযরত মওলানা সাহেব আঞ্জুমনে-তবলিগুল ইসলাম নামক একটি আঞ্জুমন কায়েম করিয়াছেন। আপাততঃ কলিকাতার কতিপয় উৎসাহী ও দেশ বিখ্যাত আলেমকে সদস্য করিয়াই এই আঞ্জুমন গঠিত হইয়াছে। সদস্যগণের সনির্বন্ধ ও সর্বসম্মত অনুরোধে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও হযরত মওলানা সাহেব উক্ত আঞ্জুমনের সভাপতি সম্পাদক কোষাধ্যক্ষের বিরাট দায়িত্ব বহন করিতে রেযামন্দি ফরমাইয়াছেন। দীর্ঘকাল সমাজের খেদমতে রাতদিন অবিশ্রান্ত হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে হযরত মওলানা সাহেবের স্বাস্থ্যভঙ্গ হইবার উপক্রম হইয়াছে সেজন্য অন্য কোনও নবীন কর্মীর স্কন্ধে এই বিরাট দায়িত্ব অর্পিত হইলে আমরা সুখী হইতাম। কিন্তু সত্যের খাতিরে একথা আমরা স্বীকার করিতে বাধ্য যে, হযরত মওলানা সাহেব ব্যতীত এত বড় বিরাট দায়িত্ব বহন করার লোকও দেশে সুলভ নয়। কাজেই হযরত মওলানা সাহেবের সাস্থ্য সম্বন্ধে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও আমরা এই নির্বাচনে আঞ্জুমনের সদস্যগণের দূরদৃষ্টির প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারিতেছি না।

অতঃপর কি প্রণালীতে বিভিন্ন জিলায় এই আঞ্জুমনের শাখা প্রতিষ্ঠিত হইবে, প্রবন্ধের বাকি অংশে তাহা বর্ণনা করা হইল।

কমিশন, রাস্তা খরচ ও ভাতা বাদে প্রচারকের ত্রিশ টাকা করিয়া বেতন ধার্য করিয়া আপাততঃ কমপক্ষে প্রচারক পাঠাইত্তে কিভাবে অন্তত পঞ্চাশ হাজার টাকার দরকার, প্রবন্ধে তারও নির্ভুল হিসাব প্রদর্শিত হইল। তিন কোটি মুসলমান-অধ্যুষিত বাংলায় ইসলামের খেদমতের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা যে কিছু নয়, খুব উদ্দীপনাময়ী ভাষায় তা বলিয়া প্রবন্ধে উপসংহার করা হইল এবং বারান্তরে এ বিষয়ে আরও বলা হইবে বলিয়া পাঠকগণকে আশ্বাস দেওয়া হইল।

দেশময় হৈ চৈ পড়িয়া গেল।

কমিশন, রাস্তা খরচ ও ভাতা বাদে ত্রিশ টাকা মাহিয়ানার সম্ভাবনায় দেশের মাদ্রাসা পাশ মৌলবী সাহেবদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য পড়িয়া গেল।

বেকার গ্র্যাজুয়েটরা মৌলবী না হওয়ার জন্য অদৃষ্টকে ধিক্কার দিল এবং প্রচারকের যোগ্যতা অর্জনের উদ্দেশ্যে ইসলামের সৌন্দর্যে ওয়াকিফহাল হইবার জন্য আহমদিয়াদের প্রকাশিত ইংরাজী গ্রন্থাবলী সংগ্রহ করিয়া গভীর মনোযোগে অধ্যয়ন করিতে লাগিল। ‘গুর্য আফিসে চাঁদার মনিঅর্ডার এবং প্রচারক পদপ্রার্থীদের দরখাস্তের বন্যা প্রবাহিত হইল।

‘গুর্য’র সম্পাদকীয় স্তম্ভে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ভাষার বোমাবাজি হইতে লাগিল। হযরত মওলানা সাহেবের প্রশংসাসূচক কবিতা ছাপা হইতে লাগিল। বাঙলার মুসলমান বুঝিল, এতদিনের অধঃপতিত মুসলমানের সুদিন আবার ফিরিয়াছে। মফস্বলের বিভিন্ন স্থানে সভা সমিতি মজলিস-মহফিল, সম্মিলন কনফারেন্স হইতে লাগিল। বিভিন্ন স্থান হইতে হযরত মওলানা সাহেবের দাওয়াত তিনি রক্ষা করিতে লাগিলেন। যাহারা বড় বড় কনফারেন্স করিয়া হযরত মওলানা সাহেবের সম্বর্ধনা করিলেন এবং মালা ও অভিনন্দনপত্র ছাড়া যাহারা মোটা মোটা চাঁদা তুলিয়া দিল, ‘গুর্যে’ তাহাদের সম্বন্ধে প্রশংসাসূচক রিপোর্ট ও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হইতে লাগিল।

চাঁদা আদায় হইয়াছিল আশাতীত, সুতরাং ইসলাম প্রচারের কাজ নিশ্চয় আরম্ভ হইত, কিন্তু উপযুপরি নূতন-নূতন কতকগুলি দুর্ঘটনা ঘটায় ইসলাম প্রচারের কাজে বাধা পড়িল।……..

বেআক্কেলপুরে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হইল। হিন্দু প্রধান স্থান বলিয়া হিন্দুরা মুসলমানদিগকে বেদম মার দিল। ‘গুর্যে’ নির্যাতিত মুসলমানদের শোচনীয় অবস্থার মর্মভেদী বর্ণনা বাহির হইতে লাগিল। ‘গুর্য’ কার্যালয়ে হযরত মওলানা সাহেবকে সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ করিয়া এক রিলিফ ফাণ্ড খোলা হইল। স্বয়ং হযরত মওলানা সাহেব দিনরাত খাঁটিয়া অকুস্থানে গমন করিয়া রিলিফের কাজ করিতে লাগিলেন।

হযরত মওলানা সাহেবের অদৃষ্টেও বিশ্রাম ছিল না, বাঙলায় ইসলামেরও ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না।

তাই বেআক্কেলপুরের রিলিফ কার্য সমাধা করিয়া যেই হযরত মওলানা ইসলাম প্রচারের কাজে হাত দিবেন, অমনি দুর্ভাগ্যপুরে ভীষণ বন্যা হইল।

জনসেবক হযরত মওলানার প্রাণ আবার কাঁদিয়া উঠিল। বেআক্কেলপুবের মুসলমানদের জন্য কান্না রঙিন চোখে তিনি আবার দুর্ভাগ্যপুরের বন্যাপীড়িতদের জন্য অশ্রু বহাইতে লাগিলেন। আবার রিলিফ ফাণ্ড খোলা হইল। ‘গুর্যে’র পৃষ্ঠায় আবার উদ্দীপনার তুবড়ি ফুটিতে লাগিল।

টাকা আসিতে লাগিল।

রিলিফ চলিতে লাগিল।

সত্যিকার কর্মীদের জীবনে বিশ্রাম নাই। তাহাদের নিঃশ্বাস ফেলিবারও অবকাশ নাই। তাই দুর্ভাগ্যপুরের রিলিফ কার্য শেষ হইবার পূর্বেই দেশ খেলাফত আন্দোলনের বন্যায় ভাসিয়া গেল।

হযরত মওলানা মুসলিম-বঙ্গের সংকীর্ণ স্বার্থের জন্য বিশ্বমুসলিমের বিরাট স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারিলেন না। তিনি খেলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করিলেন। দেশ

তাঁহার বক্তৃতায় মাতিয়া উঠিল।

ইতিমধ্যে হযরত মওলানা উর্দু বয়ানও আয়ত্ত করিয়াছিলেন। সুতরাং বাঙলার বাহিরেও তিনি বক্তৃতা দিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।

‘গুর্যের’ সম্পাদকীয় স্তম্ভে তাঁহাকে বঙ্গ-গৌরব বলিয়া অভিনন্দিত করা হইল।

দেশময় সম্মিলন-কনফারেন্স হইতে লাগিল।

হাজি সাহেবের উদ্যোগে এই আহলে হাদিস কনফারেন্সের এক অধিবেশনের আয়োজন হইল।

হযরত মওলানাও নিমন্ত্রিত হইলেন। কিন্তু তিনি নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিলেন।

‘গুর্যে’ হযরত মওলানার এই অসম্প্রদায়িক স্পষ্টবাদিতার জন্য তাঁহার প্রশংসা করা হইল এবং ইসলামের এই দুর্দিনে যাহারা মযহাবী সভা-সমিতি করিয়া ইসলামের শক্তিকে শতধা বিভক্ত করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহাদের তীব্র নিন্দা করা হইল।

গোঁড়া আহলে হাদিস ব্যতীত আর সকলে হযরত মওলানা সাহেবকে সাধুবাদ দিতে লাগিল। ‘গুর্যের’ জনপ্রিয়তা বাড়িয়া গেল।

দেশ খেলাফতের বন্যায় ভাসিয়া গেল।

কংগ্রেসও খেলাফত আন্দোলনকে নিজের বলিয়া গ্রহণ করিল।

‘গুর্যে’ হিন্দু-মুসলিম একতার মহিমা কীর্তিত হইতে লাগিল।

হযরত মওলানা সাহেব দেশময় লাটিমের মতো ঘুরিয়া হিন্দু-মুসলিম একতা প্রচার করিতে লাগিলেন। পরাধীন জাতির কোনও ধর্ম নাই, কোরআন-হাদিস দ্বারা তিনি ইহা প্রমাণ করিতে লাগিলেন। ভারতে স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত না হইলে যে মুসলিম-দুনিয়ার আবাদি, এমন কি মক্কা-মদিনার হুরমত রক্ষা হইবে না, মাসের পর মাস ধরিয়া গুর্যের সম্পাদকীয় স্তম্ভে এই সত্য প্রচার চলিতে লাগিল।

যাহারা খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিল না শুধু তাহারাই এবং যাহারা কমিশন-রাস্তা খরচ-ও-ভাতা-বাদে ত্রিশ টাকা বেতনের চাকুরীর জন্য দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করিয়া এইরূপ অতীষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল, তাহারাই পত্র লিখিয়া ‘গুর্য’ অফিসে এবং সভা-সমিতিতে স্বয়ং হযরত মওলানার কাছে তবলিগের কি হইল জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল।

প্রথম-প্রথম ঐ সকল প্রশ্ন উপেক্ষা করা গেল। কিন্তু যখন প্রশ্ন-কর্তার সংখ্যাবৃদ্ধি হইতে লাগিল, তখন ‘গুর্যে’র সম্পাদকীয় স্তম্ভে এবং সভা-সমিতিতে স্বয়ং হযরত মওলানার বক্তৃতায় যে কৈফিয়ত দেওয়া হইল, তার সারমর্ম এই : ভারতে স্বরাজ সমস্যাই এখন ভারতবাসীর জীবনের সর্বাপেক্ষা বড় সমস্যা। এই স্বাধীনতার উপর কেবল যে ভারতীয় মুসলমানের জীবন মরণ নির্ভর করিতেছে তা নয়, উপরন্ত ইহার উপর মধ্য প্রাচ্যের সমস্ত মুসলিম রাজশক্তির স্বাধীনতা নির্ভর করিতেছে। এই স্বরাজ সাধনায় হিন্দু মুসলিম একতা অপরিহার্য। বর্তমান অবস্থায় তবলিগকার্যে হাত দিলে হিন্দু-মুসলিম একতায় বিঘ্ন উৎপন্ন হইবে। সুতরাং যাহারা দেশের সংকট অবস্থায় তবলিগ কার্যে হাত দিয়া হিন্দু-মুসলিম একতার মূলে কুঠারাঘাত করিতে চায়, তাহারা শুধু দেশের শত্রু নয়, ইসলামের শত্রু।

ইসলামের অনিষ্টের ভয়ে প্রতিবাদীদের অনেক চুপ করিয়া গেল; কিন্তু সকলে চুপ করিল না। কেহ কেহ বলিতে লাগিল : তবলিগকার্য যদি আজকাল স্থগিতই থাকে, তবে উহার তহবিলের একটা হিসাব প্রকাশ করিয়া কত টাকা আছে তা দেখান হউক।

কতিপয় দুষ্ট লোকের উদ্যোগে অস্বরাজী ও অখেলাফতী নেতৃবৃন্দের এক সভা আহুত হইল। হযরত মওলানাকে সে সভায় বিশেষভাবে দাওয়া করা হইল। তিনি অসুস্থ শরীরে সেই সভায় যোগদান করিলেন। সভায় তবলিগ ফাণ্ডের সঙ্গে খেলাফত রিলিফ ফাণ্ডাদির কথা উঠিল।

হযরত মওলানা রুগ্ন শরীর লইয়া দাঁড়াইয়া অশ্রুপূর্ণ লোচনে বলিলেন একটা প্রাণ তিনি কতদিকে দিতে পারেন! তবলিগ নয়ত রিলিফ, নয় ত খেলাফত-সবইত তাহার একার ঘাড়ে। তিনি আহার ন্দ্রিা ত্যাগ করিয়া শিবরাত্রির শলিতার মতো নীরবে লোক। লোচনের অন্তরালে তিল তিল করিয়া সমাজ, দেশ ও ধর্মের জন্য প্রাণ দিয়া শরীরের অবস্থা এই করিয়াছেন! অতগুলি তহবিল তাহার হাত দিয়া খরচ হওয়ায় তিনি যদি খরচাদির চুল চেরা হিসাব রাখিতে নাই পারিয়া থাকেন, তজ্জন্য কি তাহার দোষ দেওয়া যায়? সদস্যবৃন্দ কি তাঁহার সন্দেহ করেন? সত্যই যদি তিনি দেশবাসীর এবং সহকর্মী সুহৃদগণের বিশ্বাস হারাইয়া থাকেন, তবে তাহার আর বাঁচিয়া লাভ কি? তবে আর তিনি বাঙলায় মুখ দেখাইবেন না। তিনি বাঙলার নেতৃত্ব ফেলিয়া রাচি চলিয়া যাইবেন।

ইতিমধ্যে দেশের ‘তালুক-মূলক বিক্রয় করিয়া’ হযরত মওলানা রাচিতে একখানি কুটির’ কিনিয়াছেন বলিয়া লোকে বলাবলি করিত।

হযরত মওলানা রাচি চলিয়া গেলে মুসলিম-বঙ্গের গুরুতর অনিষ্ট হইবে নিশ্চিত বুঝিতে পারিয়া উপস্থিত সদস্যবৃন্দের অনেকে মওলানার নিকট ক্ষমতা চাহিলেন এবং যাহারা তাঁহার সততায় সন্দেহ করিয়াছে তাহাদের উদ্দেশ্যে গালাগালি করিয়া সভা ভঙ্গ করিলেন।

‘অকৃতজ্ঞ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে পর সপ্তাহে ‘গুর্য’ সন্দেহ-বাদীদিগকে খুব তেরেসে কষাঘাত করা হইল।

সন্দেহবাদীর সংখ্যা হ্রাস পাইল।

.

ছয়

হিসাব-পত্রের ফ্যাসাদ সম্বন্ধে এরূপ নিশ্চিন্ত হইয়া হযরত মওলানা আবার হিন্দু মুসলিম একতা এবং স্বরাজের আবশ্যকতা বর্ণনায় অনলবর্ষণ করিতে লাগিলেন। এই কার্যে তিনি অনেক হিন্দু চরমপন্থীকে লজ্জা দিতে লাগিলেন।

চাকুরি ব্যতীত অন্য সর্বত্র হিন্দুরা মুসলিম প্রতিভার সমাদর করে। তাহাদের নিকট হযরত মওলানার কদর ধাপে ধাপে বাড়িতে লাগিল। কংগ্রেস হইতে আরম্ভ করিয়া ব্ৰহ্ম মন্দির, অদ্বৈতবাদ সভা, থিওসফিক্যাল সোসাইটি, তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ সভা ইত্যাদি সকল সভ–সমিতিতেই মওলানা সাহেবের নাম সভাপতি রূপে বিজ্ঞাপিত হইতে লাগিল। হিন্দু বক্তা ও শ্রোতা সবাই স্বীকার করিলেন যে মুসলমানদের মধ্যে অত ভাল বাঙলা বক্তা আছে, হযরত মওলানা সাহেবের বক্তৃতা শুনিবার আগে একথা তাহারা বিশ্বাসই করিতেন না।

‘গুর্যে’র অনেক হিন্দু গ্রাহক হইয়া গেল।

একদিন হযরত মওলানা কেবল তবলিগ, আঞ্জুমান ও খেলাফতের নেতা ছিলেন, হিন্দুদের কদবদানিতে এইবার তিনি কংগ্রেসেরও অন্যতম প্রধান নেতায় উন্নতি হইলেন। বাঙলার মুসলমানদের মুখোজ্জ্বল হইল।

স্মাইলস সাহেব বলিয়াছেন : প্রতিভা কখনও চাপা থাকে না। হযরত মওলানা ইসমাইলের প্রতিভাও চাপা রহিল না। হযরত মওলানা প্রতিভা বলে আরও উন্নতি করিতেন, যদি না একটা বিষম বাধা সামনে পড়িল। এই বাধা আমলাতন্ত্র।

আমলাতন্ত্র কেবল নিজেদের দফতরেই মুসলমানকে দাবাইয়া রাখিয়া সন্তুষ্ট নহে, বাহিরে কোথাও মুসলমান উন্নতি করিবে, এটাও তাহারা সহ্য করিতে পারে না। হযরত মওলানা লোকচক্ষুর গোচরীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাঁহার পিছনে লাগিল।

দেশময় ধরপাকড় আরম্ভ হইল। হযরত মওলানার বিবি বিষম শয্যগেত কাতর থাকার দরুণ মওলানা সাহেব অনেক সভায় অনুপস্থিত থাকিতে বাধ্য হইতে লাগিলেন।

কিন্তু আমলাতন্ত্র হিংসুক। তাই তাহাদের পুলিশ হযবত মওলানার গ্রেফতারি পরওয়ানা লইয়া তাহার বাড়িতে উপস্থিত হইল।

নির্জন বাড়িতে কাপুরুষের মতো ধরা দিতে হযরত মাওলানা অপমান বোধ করিলেন এবং গ্রেফতারের সময় দেশবাসীকে অভয়বাণী দিয়া যাওয়া কর্তব্য বিবেচনা করিলেন। তাই তিনি পশ্চাৎদ্বার দিয়া এক পার্কে উপস্থিত হইয়া বক্তৃতা শুরু করিলেন। হযরত মওলানাকে প্রায় সবাই চিনিত। লোকের ভিড় হইল। পুলিশ সংবাদ সংগ্রহ করিয়া সেখানে পৌঁছিতে পার্ক জনাকীর্ণ হইয়া গেল।

তুমুল ‘বন্দেমাতরম্’ ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনির মধ্যে হযরত মওলানা গ্রেফতার হইলেন। কিন্তু মরণাপন্ন বিবি সাহেবের শুশ্রূষার জন্য জামিনে খালাস হইতে বাধ্য হইলেন।

‘গুর্যে’ ‘অশনিস্পাৎ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধ বাহির হইল। বাঙলা যে নেতৃত্বশূন্য হইল প্রবন্ধের গোড়ার দিকে সেজন্য দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে গভীর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করা হইল; হযরত মওলানার গ্রেফতারে স্বরাজ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা যে দ্বিগুণ বাড়িয়া গেল, প্রবন্ধর মধ্যভাগে তা বলা হইল এবং দেশবাসীর প্রাণ-পুলি অদ্বিতীয় নেতা যে কারা-প্রাচীরের অন্তরাল হইতেও তাঁহার আধ্যাত্মিক শক্তি বলে দেশবাসীর অন্তরে অনুপ্রেরণা যোগাইবেন, প্রবন্ধের উপসংহারে সে আশাও প্রকাশ করা হইল।

বিচারে হযরত মওলানার দুই বৎসর কারাদণ্ডের আদেশ হইল।

দেশের কাজে আহার দ্রিা পরিত্যাগ করিয়া শিবরাত্রির শলিতার মতো তিল তিল করিয়া আত্মদান করায় হযরত মওলানার স্বাস্থ্য ইতিপূর্বেই একরূপ নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। কারাবাসের কঠোরতায় তিনি একেবারে শয্যা লইলেন। তিন মাস কারাবাসের পর স্বাস্থ্যনাশের ভয়ে সরকার তাহাকে মুক্তি দিলেন।

হযরত মওলানা ভগ্নস্বাস্থ্য পুনঃলাভের জন্য রাচি চলিয়া গেলেন। আর ফিরিলেন না।

নেতার অভাবে আবার বাঙলা অন্ধকার হইল। ভক্তেরা তাঁহার পুনরাবির্ভাব সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে লাগিল। গুর্যের সম্পাদকীয় স্তম্ভে বাহির হইল।

বাংলায় ইসলামকে তার পূর্ণ গরিমায় প্রতিষ্ঠিত করাই হযরত মওলানার আজীবন সাধনা। তিনি আজিও আগের মতই এই সাধনায় শিবরাত্রির শলির মতো লোক লোচনের অন্তরালে নিজেকে তিল-তিল করিয়া বিসর্জন দিতেছেন। তবে স্বভাবতঃই তার সাধনার বাহ্যরূপের একটু পরিবর্তন হইয়াছে। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। হযরত মওলানাও জীবন-সায়াহ্নে উপস্থিত। এই সময়ে তিনি যদি দেশবাসীর মঙ্গলের জন্য একটা স্থায়ী দান রাখিয়া না যান,তবে হযরত মওলানার অবর্তমানে মুসলিম বাংলা চিরতরে অন্ধকারে নিমজ্জিত হইবে। অথচ রাজনৈতিক হৈ চৈ-এর মধ্যে সে আত্মিক সাধনা সম্ভব নহে। তাই তিনি সহকর্মীদের সনির্বন্ধ অনুরোধে স্থির করিয়াছেন? একদিন ইসলামের মহাপয়গম্বর। যেমন করিয়া সত্যের আলোকের জন্য হেরার নির্জন গহ্বরে আত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন, এই তের শত বৎসর পরে তাঁরই নগণ্য উম্মত হযরত মওলানা ইসলামের উন্নতি ও মুসলমানদের কল্যাণের জন্য রাঁচির শান্ত প্রকৃতির বুকে সাধনায় আত্মনিয়োগ করিবেন। তিনি বাকি জীবনে সেই কঠোর সাধনাতেই সমাহিত থাকিবেন। তাহার সাধনার ফল গ্রন্থাকারে বাহির হইবে। গুর্যের গ্রাহক-গ্রাহিকাদিগকে তাহা অর্ধমূল্যে দেওয়া হইবে।

প্রবন্ধের বাকি অংশ প্রকাশিতব্য গ্রন্থের সম্ভাব্য আকার, দাম ও অগ্রিম মূল্য প্রেরকদের বিশেষ সুবিধা বর্ণিত হইল। তারপর উপসংহারে বলা হইল। সশরীরে হযরত মওলানা সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে থাকিবে না বটে, কিন্তু তাহার প্রদর্শিত পথে। অগ্রসর হইলে মুসলিম-বঙ্গ তার অভীষ্ট লাভ করিতে পারিবে। সুতরাং কোনও ভয় নাই। মুসলমান সমাজ অগ্রসর হও। নসরুম মিনাল্লাহে ফহুন কবির।

1 Comment
Collapse Comments

বুঝলাম না। মৌলানা আকরাম খাঁ এবং আবুল মনসুর আহমেদের মধ্যে দ্বন্দ কেন ?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *