লিফট
স্মৃতি থেকে উদ্ধার করছি, এই পঙ্ক্তি দুটি হয়তো একটু এদিক-ওদিক হতে পারে তবে কবিতাটি নিশ্চয় কবি গোলাম মোস্তাফার,
দেখে শুনে বুঝিলাম করি তালিকা,
সবচেয়ে ভাল মোর ছোট শ্যালিকা।
আমার নিজের বিয়ে হয়েছে দুই দশকেরও আগে, প্রায় দুই যুগই বলা যায়। এতদিন পরে তালিকা প্রণয়ন করে ছোট্ট শ্যালিকাকে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘোষণা করার আমার আর কোনও প্রয়োজন নেই।
তবু লিফটের সূত্রে আমার ছোট শ্যালিকা সম্পর্কে দু’-একটা কথা লিখে রাখা চলে। তার প্রথমটি অপ্রাসঙ্গিক। আমার বিয়ের সময় আমার মাননীয়া স্ত্রী এবং তাঁর কনিষ্ঠা ভগিনী কিঞ্চিৎ পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আকারে-প্রকারে, আচার-আচরণে অনেকটা একরকম ছিলেন। যেমন হয়, মায়ের পেটের পিঠোপিঠি বোন বা ভাই হলে। আমার বিয়ের অব্যবহিত পরেই একদিন আমাদের বাড়িতে আমার শ্যালিকাকে দেখে আমার এক শুভানুধ্যায়ী বন্ধু আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কে তোমার স্ত্রী আর কে তোমার শ্যালিকা বুঝতে তোমার অসুবিধে হয় না ?’ আমি সোজাসুজি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘বোঝার খুব চেষ্টা করি না।’
এসব অনেককাল আগের কথা। সেদিনের সেই নবীনা শ্যালিকা, আজ ষড়ৈশ্বর্যময়ী রাশভারি সংসারিণী। কে তাকে দেখবে বলবে একদা তাকে নিয়েই আমি কবিতা লিখেছিলাম, ‘রোদে হাওয়ায় একটি গোলাপ, একটিই শেষ গোলাপ সখি !’ ‘দেশ’ পত্রিকার পৃষ্ঠাতেই।
এসব ব্যক্তিগত কথা আপাতত থাক। বরং সরাসরি এবারের মূল বিষয় লিফট প্রসঙ্গে চলে আসি। বলা বাহুল্য, ওই লিফট সূত্রেই শ্যালিকার কথা এসেছে। এইখানে অতি গোপনে ব্রাকেটে একটা কথা বলে রাখি, (এই বিশ্বে সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা হলেন আমার স্ত্রী, তবে তাঁর চেয়েও সুন্দরী তাঁর ছোট বোন।)
কলকাতার এক সরকারি অতিথিশালায় আমরা সবাই একত্রিত হয়েছিলাম। মধ্যাহ্নভোজনের পর আমি শ্যালিকাকে নিয়ে মিঠে পান কিনতে বেরলাম। আমার স্ত্রী-পুত্র এবং শ্যালিকার স্বামী পুত্রাদি অতিথিশালার উচ্চতম তলে চলে গেলেন শীতের রোদ পোহানোর জন্যে। পান কিনে ফেরার পথে ঘটল সেই অঘটন। লোডশেডিং, চারতলা এবং পাঁচতলার মধ্যে ঘচঘচাং করে লিফটটা আটকে গেল। এইরকম একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে শ্যালিকার উষ্ণ সান্নিধ্য, কিন্তু আমার কেমন দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। অন্যদিকে আমার শ্যালিকা প্রাণপণ চেঁচাতে লাগলেন, ‘বাঁচাও, বাঁচাও’। ওই অবস্থাতেও আমার মাথা ঠান্ডা ছিল। আমি যত তাকে বলি, ‘লোকে ভাববে আমি কোনও অশালীন আচরণ করছি, তুমি একটু কম চেঁচাও’, কে কার কথা শোনে।
বহু চেঁচামেচি, কাঁদাকাটি অনুনয় বিনয়ের পর সেদিন লোকেরা আমাদের উদ্ধার করেছিল প্রায় আধঘণ্টা পরে।।
লিফটের প্রাচীন গল্পটা এক গ্রামবৃদ্ধকে নিয়ে। সে বেচারি কলকাতায় এসে জীবনে প্রথম লিফট দেখে। দেখে যে এক বৃদ্ধা মহিলা লিফটের ভিতরে ঢুকে উপরে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল। দু’ মিনিট পরে লিফটটা উপর থেকে নেমে এল, ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক পরমাসুন্দরী যুবতী।
এই দৃশ্যটি দেখার পরে ওই পাড়াগেঁয়ে বুড়োটি নাকি কপালে চড় দিয়ে আক্ষেপ করেছিল, ‘হায়, আমার বুড়িকে কেন সঙ্গে করে নিয়ে এলাম না। সে তো আসতেই চেয়েছিল। আমিই রেখে এলাম। আমারই কপালের দোষ। আজ কলকাতা থেকে তাকে কেমন অল্পবয়সি ডাগরডোগর বানিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম।’
লিফটের ব্যাপারে অনেকদিন আগে কলকাতা শহরের পুরনো একটা হোটেলের একটা মজার ঘটনা বলার রয়েছে। তখন এই শহরে অনেক ইংরেজ ছিল। সাহেব-মেমদের জন্যে খাস বিলেত থেকে খাঁটি সাহেব জ্যোতিষীরা আসত। তারা কবে বিয়ে হবে, শাশুড়ি মারা যেতে পারে কি না, অদূর ভবিষ্যতে হোমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না, বিপ্লবীদের হাতে নিহত হওয়ার আশঙ্কা, এমনকী জন সাহেবের মেমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ার ব্যাপারটা জন সাহেব আঁচ করছেন কি না ইত্যাদি হাজারো ব্যাপারে হাত গুনে বা ক্রিস্টাল বল দেখে জানিয়ে দিতেন।
সাধারণত এই সব সাহেব (মেমসাহেব জ্যোতিষীও ছিল) যেদিন কলকাতায় আসতেন সেদিন কিছুটা প্রচারের আর কিছুটা গোছগাছের জন্যে সামান্য দু’-চারজনের হাত দেখতেন পয়সা না নিয়ে।
সেবার এসেছেন ক্যাপটেন বিলি ইনার আই। সাহেব মেমদের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান এঁর নখদর্পণে। লন্ডনে, নিউইয়র্কে হইচই ফেলে কলকাতায় এসেছেন। জাহাজ থেকে নেমেছেন বোম্বাইতে, সেখানে কয়েক সপ্তাহ ভবিষ্যতের ঝড় তুলে কলকাতায়। প্রথম দিন হোটেলের ঘরে বিশ্রাম, সেই সঙ্গে বিনামূল্যে ভাগ্যগণনা। হোটেলের স্থানীয় কর্মচারীরা কেউ কেউ আলাদা আলাদা বা দল বেঁধে এসে তাঁকে মুফতে হাত দেখিয়ে যাচ্ছে। তিনিও অল্পবিস্তর বলে যাচ্ছেন।
মাথায় কদমছাট চুল তার মধ্যে দীর্ঘ টিকি, পরনে খাকির পোশাক একটি লোক, হোটেলের কোনও কর্মচারী, সে হাত দেখাতে এসেছে। দু’-একজনের পরে ক্যাপ্টেন বিলি এরও হাত দেখলেন। একটা বড় আতসকাচ দিয়ে একবার ডান হাতের কররেখা আর একবার বাঁ হাতের কররেখা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন, তারপর লোকটিকে বললেন, ‘তোমার জীবনে অনেক আপস অ্যান্ড ডাউনস (ups anf down) অর্থাৎ ওঠানামা আছে।’ তিনি অবশ্য ইংরেজিতেই বললেন তবে পাশেই তাঁর দোভাষী বসে ছিল, সে কিছুটা সাদা বাংলায় কিছুটা ভাঙা হিন্দিতে ভবিষ্যৎ জিজ্ঞাসু উক্ত টিকিধারীকে তার জীবনের ওঠানামার কথা জানালেন।
ফল যা ফললো সেটা মারাত্মক। লোকটি এই কথা শুনে প্রচণ্ড আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, কারণ এর চেয়ে খাঁটি, এর চেয়ে সত্যি তার সম্পর্কে আর কিছুই হতে পারে না। কারণ সে হল লিফটম্যান। তার শুধুই ups and downs—সারাদিন কেবলই ওঠা আর নামা।
চাকরিতে সে নতুন ঢুকেছে, কাজটা পাকাপাকি থাকবে কি না সে বিষয়ে তার মনে সংশয় ছিল। এতটা যখন সাহেব বলতে পেরেছে, বাকিটুকুও নিশ্চয়ই পারবে। তাই সে আবার অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইল তার এই উত্থান-পতন, পুনরাবৃত্ত আপস অ্যান্ড ডাউনস কতদিন চলবে।
এই প্রশ্নের উত্তরে ক্যাপটেন বিলি যথারীতি চিরাচরিত জ্যোতিষীসুলভ উত্তর দিয়ে আশ্বস্ত করলেন, ‘না না, এই সামান্য মাস কয়েকের ব্যাপার। এই ইস্টারের পরেই আর আপস অ্যান্ড ডাউনস থাকবে না।’
সাধারণত এ ধরনের স্তোকবাক্যে সব ভাগ্য জিজ্ঞাসুরাই খুশি হয়। কিন্তু উত্থান-পতন, আপস অ্যান্ড ডাউনস থাকবে না জেনে এই টিকিধারী কেন এত মুষড়ে পড়লেন, গণৎকার সাহেবের সেটা কিছুতেই বোধগম্য হল না।
লিফট সংক্রান্ত শেষ গল্পটি আমার নয়, আমি শ্রীযুক্ত হিমানীশ গোস্বামীর কাছ থেকে চুরি করেছিলাম এবং তিনি এটা সদ্ব্যবহার করার আগেই আমার ডোডোতাতাই গল্পমালায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।
ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। দুটি শিশু অধীর প্রতীক্ষা করছে, সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে। তাদের বাবা আজ একটা লিফট নিয়ে আসবে। বাড়িতে কোথায় লিফট বসানো হবে, সে জায়গাটাও তারা ঠিক করে ফেলেছে।
কারণ আর কিছু নয়। আজ সকালে অফিস যাওয়ার সময় তাদের বাবা তাদের মাকে বলেছে, ‘আজ হয়তো একটু তাড়াতাড়ি আসব, বড়সাহেব বলেছেন আজকে আমাকে একটা লিফট দেবেন।‘
বলা বাহুল্য, তাদের বাবা যখন দিনের কাজের শেষে সন্ধ্যাবেলায় বড়সাহেবের গাড়ি থেকে শূন্য হস্তে নামল শিশু দুটি ছুটে গেল তাদের বাবার কাছে, ‘বাবা বড়সাহেব তোমাকে লিফট দেয়নি ?’
বাবা সরলচিত্তে জবাব দিলেন, ‘কেন দেবে না ? বড়সাহেবই তো নামিয়ে দিয়ে গেলেন।’ ছেলে দুটি বলল, ‘গাড়ি থেকে তুমি তো একা নামলে। বড়সাহেব তো লিফটটা নামিয়ে দেয়নি?’
হিমানীশের গল্পটা অবশ্য একটু অন্যরকম ছিল। একদিন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর গাড়িতে নামিয়ে দেবেন বলে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। আনন্দবাজার অফিসের সিঁড়ির পাশে লিফটের সামনে। হিমানীশ লিফটে করে উপরে উঠতে যাচ্ছিলেন, আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে আমি বললাম, ‘নীরেনদা লিফট দেবেন তাই দাঁড়িয়ে আছি।’ হিমানীশ দ্রুত লিফট থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘ঠিক আছে। তা হলে নিয়ে যান।’