লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে এত বছর
৪৩ বছর আগে আমি যে পত্রিকায় গল্প লিখে স্বপ্ন দেখেছিলাম লিখব, হ্যাঁ লেখাই হবে সারাজীবনের সাধনা সেই “একাল” পত্রিকা বের হতো আমাদের বেলগাছিয়া থেকে। দুই সম্পাদক নকুল মৈত্র এবং ভরত সিংহ খুব সাধারণ চাকরি করতেন। সামান্য বেতন পেতেন। গাঁট গচ্চা দিয়েই পত্রিকা করতেন। বিজ্ঞাপন ছিল না পত্রিকায়। তাঁদের কাছ থেকেই আমি শিখেছিলাম সাহিত্যের জন্য ত্যাগ করতে হয়। সাহিত্য এক সাধনার ক্ষেত্র। ২৫০-৩০০ কপি ছাপা হতো একাল। কাগজের দাম দেওয়ার সামর্থ্য হতো না বলে এত কম ছাপা। কিন্তু একাল পত্রিকার গল্প সংখ্যার কথা এখনো মনে আছে। সেই সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল সুবিমল মিশ্রর গল্প “বাগানের ঘোড়া নিম গাছে দেখন চাচা থাকতেন”, আমার প্রিয় গল্প। সুবিমল মিশ্র প্রথা ভাঙা লেখক। যে পথে সকলে গমন করেন, সে পথে যাননি। বাংলা ছোট গল্পের ইতিহাসে তিনি উচ্চারিত হবেন। তিনি লিটল ম্যাগাজিনেই লিখেছেন এতটা জীবন। লিটল ম্যাগাজিনই বাংলা সাহিত্যের প্রাণ। কথাটা বাগাড়ম্বর মনে হতে পারে, কিন্তু সত্য। সত্য কীভাবে তা এত বছর ধরে দেখেছি, উচ্চারণেই শিহরণ হয়। কেউ কেউ ভাবেন লিটল ম্যাগাজিন হলো বিগ ম্যাগাজিন, বাণিজ্যিক পত্রিকায় প্রবেশের সিঁড়ি। তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে ঘটেনি তা নয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই? কতিপয় তরুণ একজোট হয়ে যে পত্রিকা বের করতে শুরু করলেন নিজেদের আত্মপ্রকাশের তাগিদে, সেই আত্মপ্রকাশে যে স্পর্ধা তা তাঁরা প্রকাশ করবেন কীভাবে? বাণিজ্যিক পত্রিকা কি স্পর্ধা দেখাবার জায়গা? সেই জায়গা তাঁরা দেবেন কেন? গত শতকের ষাটের দশকে যে দুই সাহিত্য আন্দোলন দেখেছি আমরা তা দুই লিটল ম্যাগাজিনকে ঘিরেই। একদল তরুণ ‘ক্ষুধার্ত’ নামের যে পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন, নিজেদের ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখক হিশেবে অভিহিত করেছিলেন, তাঁরা যে প্রথা বিরোধী গল্পের জন্ম দিয়েছিলেন, তা ওই পত্রিকা ব্যতীত হতে পারত না। এঁদের লেখক বাসুদেব দাশগুপ্ত তাঁর ‘রন্ধনশালা’ গল্পগ্রন্থের জন্য আমাদের সাহিত্যে চিহ্নিত এক জায়গা করে নিয়েছেন। সমালোচকরা উল্লেখ করেন কী করেন না, তা আলোচ্য নয়, আলোচ্য হলো রন্ধনশালা বইটির কথা এখনো নবীন প্রজন্ম লিখতে এসে শুনতে পায়। যে গল্প বাণিজ্যিক পত্রিকা ছাপতে চায় না পাঠক হারাতে হবে বলে, সেই গল্প লিটল ম্যাগাজিন ছাপে। সাহিত্যের যাবতীয় দায় ও ঝুঁকি গ্রহন করতে পারে লিটল ম্যাগাজিনই। তরুণ লেখকরা যে কথা বলতে পারবেন না বিগ ম্যাগাজিনে তা বলতেই লিটল ম্যাগাজিন করা। গত শতকের ষাটের দশকের আর এক সাহিত্যের আন্দোলন ছিল, শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন। তাঁরাও গল্পের চিরাচরিত লিখন পদ্ধতির বদল ঘটাতে চেয়েছিলেন। সেই তরুণরা এখন প্রবীণ, আমি রমানাথ রায়কে জিজ্ঞেস করছিলাম, আপনারা কেন শাস্ত্রবিরোধী সাহিত্য আন্দোলন করতে গিয়েছিলেন কেন? তিনি উত্তর দিলেন, নিজের কথা নিজের মতো করে বলবেন বলে, নিজের ভাষা খুঁজে পেতে। বিগ ম্যাগাজিন তাদের ভাষায় তাদের মতো করে কথা বলাই পছন্দ করে। সাহিত্যের যাবতীয় বিদ্রোহের কথা তো লিটল ম্যাগাজিনই উচ্চারণ করতে পারে। বিদ্রোহ কলমে। আমাদের ভাষার বড় গল্পলেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব কৃত্তিবাস পত্রিকায় ছাপা হতে সাহিত্যের চিরাচরিত পথ, যে পথ সহজসিদ্ধির (!) পথ সেখানে বড় ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন। বড় বড় স্তম্ভ বিরক্ত হয়েছিলেন। গত শতকের ষাটের দশকের কথা তা। সাহিত্যের ইতিহাস অনেকটাই আঙ্গিকের ইতিহাস। নতুন আঙ্গিক, নতুন ভাষা নিয়েই তো সাহিত্যের নবীন বরণ হয়। ষাটের দশকের অব্যবহিত আগে আমাদের ভাষার বড় মাপের গল্প-লেখক বিমল কর লিটিল ম্যাগাজিনেই সাহিত্যের “নতুন রীতি” এক সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন তরুণ দেবেশ রায়, সন্দীপন, বরেণ গঙ্গোপাধ্যায়, স্মরজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, যাশোদাজীবন ভট্টাচাযরা। এইসব সাহিত্য আন্দোলনের কথা বলা লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র নির্ধারণের কারণেই। সেই দেবেশ রায় এখনো এই আশী বছরে পা রেখে লিটল ম্যাগাজিনেই বছরের সেরা গল্পটি লেখেন (নদী ও শহরের যুগলগীতি — কথা সোপান)। এই বয়সেও তিনি লিটল ম্যাগাজিনে নিজের সেরা লেখাটি দিতে পারেন, তা তো এই সব সাহিত্যপত্রের উপর প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকে। সাহিত্য পত্রিকার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা থেকে। লিটল ম্যাগাজিন আসলে নামে লিটল কিন্তু চরিত্রে ব্যপ্ত। সিংহভাগ পাঠকের ধারণা সাহিত্যের যা কিছু সৃজনশীলতা তা হয় বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকায়। জানেন না, বাংলা সাহিত্যের সেরা প্রবন্ধমালা ধরণ করে লিটল ম্যাগাজিন। অশোক সেন, সৌরীন ভট্টাচায, অরিন্দম চক্রবর্তীর মতো বড় মাপের জীবন জিজ্ঞাসুরা অনুষ্টুপ, বারোমাস ইত্যাদি সাহিত্যপত্রের লেখক। এক্ষণ ছিল, এখন নেই। ছিল বারোমাস সাহিত্যপত্র, এখন নেই। শতভিষা, উত্তরসুরী নেই। অমৃতলোক নেই। নেইয়ের তালিকা অনেক বড়। কিন্তু আছে তো কম পত্রিকা নয়। অনুষ্টুপ, অনীক, বিভাব, আত্মপ্রকাশ, কবিতীর্থ, এবং মুশায়েরা, বিষয়মুখ, কোরক, পরিচয়, পরিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, নীললোহিত, আদম, আলোচনা চক্র, দেবভাষা, গুরুচন্ডালী, ইসক্রা, কথা সোপান, গ্রাফিত্তি, অতি ব্যতিক্রমী প্রবন্ধপত্র ১৮৭৮ কিংবা দূর উত্তরবঙ্গের মল্লার, মধ্যবর্তী, তিতির, আগরতলার মুখাবয়ব, শিলচরের দ্বিরালাপ, গুয়াহাটির পূবর্মেঘ কত কত। কিছু নাম করলাম। এর বাইরে কত যত্নশীল সম্পাদক আছেন। কত ভালোবাসা নিয়ে তাঁরা সেইসব পত্রিকা করেন। আমাদের বন্ধু সমীর চট্টোপাধ্যায় ১৯৭৫ নাগাদ একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন, সংক্রান্তি। সংক্রান্তি পত্রিকায় কত নিবিড় অভিনিবেশে সমীর অনুবাদ করেছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কির অন লিটারেচর বই থেকে তলস্তয়ের সঙ্গে গোর্কির কথোপকথনের এক অসামান্য অংশ। তলস্তয় যখন অসুস্থ, গোর্কি তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। দুই প্রতিভাধরের সেই সাক্ষাৎকার খুঁজে বের করেছিলেন সমীর। লিটল ম্যাগাজিনের কাজ এই। চার্লি চ্যাপলিনের “মাই অটোবায়োগ্রাফি” থেকে মসিয়ে ভেরদ্যুর উপরে অসাধারণ লেখাটিও অনূদিত হয়েছিল সংক্রান্তিতে। লিটল ম্যাগাজিনে যত্ন আর মেধা, দুইয়ের সম্মিলন হয়। সমীর পরবর্তী কালে আর একটি পত্রিকা করেন। সেই পত্রিকা “নতুন সময়” এ অনুদিত হয়েছিল জাঁ জেনের নাটক নিগ্রো। মূল ফরাসী থেকে অনূবাদ করেছিলেন নারায়ণ মুখোপাধ্যায়। বিরলকেশ গৌরবর্ণের সদাহাস্য নারায়ণ মুখোপাধ্যায় পরিচিত ছিলেন ফরাসী নারাণদা বলে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের দুই স্মরণীয় গল্প পুরকায়েতের আনন্দ ও বিষাদ এবং উর্বরাশক্তি নতুন সময়ে পড়েছিলাম। মনে পড়ে যাচ্ছে পবিত্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত কবিপত্র এবং প্রয়াত কবি তুষার চৌধুরীর কবিতা দর্পণ পত্রিকায় ফরাসী নারায়ণ মুখোপাধ্যায় অনুবাদ করেছিলেন ভিক্তর উগোর উপরে ব্যোদলেয়ারের প্রবন্ধ, এবং ব্যোদলেয়ারের কবিতা। কবিপত্র পত্রিকায় পিকাশোর লেখা একমাত্র নাটক অনুবাদ করেছিলেন নির্মল ঘোষ। কবিপত্র একটি শিল্প সংখ্যা করেছিল, ১৯৭৭ নাগাদ। সেই সংখ্যায় সোসাইটি অফ কনটেম্পোরারি আর্টিস্ট-গ্রুপ এর সকলেই লিখেছিলেন, মনে পড়ে যাচ্ছে রবীন মণ্ডল, কাঞ্চন দাশগুপ্ত, বিজন চৌধুরীরা কলম হাতে নিয়েছিলেন। অতিথি সম্পাদক ছিলেন সন্দীপ সরকার। লিটল ম্যাগাজিনই পারে এমন সৃষ্টিশীলতা আর মেধার সম্মিলন ঘটাতে। আমাদের জ্ঞান চর্চায় লিটল ম্যাগাজিনের খুব বড় ভূমিকা। ১৯৫৬ নাগাদ জলপাইগুড়ি নিবাসী সুরজিৎ বসু একটি প্রথা বিরোধী উপন্যাস লিখেছিলেন অবতামসী। সেই উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল এক স্থানীয় সাহিত্যপত্রে। সুরজিৎ বসুর অকাল প্রয়াণে উপন্যাসটি হারিয়ে যায়। কোচবিহারের মাথাভাঙা থেকে প্রকাশিত সঞ্জয় সাহা সম্পাদিত “তিতির” বহু বছর বাদে সেই উপন্যাস উদ্ধার করে সাহিত্য সংখ্যায় প্রকাশ করে। অবতামসী পড়ে আমি অবাক হয়েছি। এই উপন্যাস সাহিত্যের অনুরাগীদের না পড়ে থাকা উচিত নয়। অনেক বড় দিক খুলে যায় পাঠান্তে। লিটল ম্যাগাজিন এই কাজই করে। এঁর সম্পাদকদের বেশিরভাগই গল্প এবং কবিতা, কিছুই লেখেন না, অথচ প্রভিডেন্ট ফান্ডের সঞ্চয় থেকে ঋণ করে, লেখা সংগ্রহ করে, রাত জেগে প্রুফ দেখে, প্রেসে বসে থেকে তাঁরা কি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান? সাহিত্যের প্রতি প্রবল অনুরাগ থেকেই এই কাজ তাঁরা করে থাকেন। মেদিনীপুর শহরের সমীরণ মজুমদারের সঙ্গে আলাপ সেই ১৯৭৭ থেকে। সমীরণ কবিতা লিখত আর অমৃতলোক পত্রিকা বের করত। কবিতা লেখা হারিয়ে গেল, অমৃতলোক বড় হয়ে উঠতে লাগল। নিজে জানি অমৃতলোক পত্রিকার জন্য ও নানা ভাবে উৎপীড়িত হয়েছে। সঞ্চয় নিঃশেষ করেছে। প্রবল প্রতিকূলতা এসেছে আত্মজনের কাছ থেকে, কিন্তু সে তার জায়গা থেকে সরেনি। সমীরণ পত্রিকা করেছে সাহিত্য আর সমাজের উপর দায়বদ্ধতা থেকে। সে অমৃতলোক পত্রিকার নন্দীগ্রাম সংখ্যা বের করেছিল সেই আন্দোলনের সময়। সমীরণের পত্রিকায় অনেক লিখেছি। লিখে সম্মানিত বোধ করেছি। তার প্রয়াণে অমৃতলোক বন্ধ হয়ে গেছে। তাইই হয়। লিটল ম্যাগাজিন ব্যক্তির একক প্রয়াসেই জন্ম নেয়। তিনি চলে গেলে আর সেই পত্রিকা বাঁচিয়ে রাখা যায় না। এইভাবে বন্ধ হয়েছে এক্ষণ, বারোমাস, অনুক্ত, লাল নক্ষত্র, চিল, কবিতা দর্পণ, এমনি কত পত্রিকা। গুণমানে লিটল ম্যাগাজিনই বড় প্রতিষ্ঠানের প্রতিস্পর্ধী হতে পারে। মনে করুন, এক্ষণ সাহিত্যপত্রের কার্ল মার্ক্স সংখ্যা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরির প্রকাশ, অনুষ্টুপ পত্রিকার সমর সেন, শঙ্খ ঘোষ সংখ্যা, কোরক সাহিত্য পত্রের রামায়ণ সংখ্যা, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় পরিচয় পত্রিকার ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংখ্যা, গল্পসরণি পত্রিকার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সংখ্যা বা ইসক্রা পত্রিকার এশিয়ার গল্প অনুবাদ সংখ্যা…। এমনি কত সব অসামান্য সংখ্যার কথা যে ভুলতে পারিনি। বাংলার হাট, বাংলার পুকুর, বাংলার শ্মশান, কবরস্থান, রাস্তা এসব নিয়ে সমীক্ষা নির্ভর পত্রিকা বের করেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার প্রণব সরকার। কেউ বের করেন সুন্দরবনের জল-জঙ্গল নিয়ে বিশেষ সংখ্যা। মহাশ্বেতা দেবীর বর্তিকায় ছাপা হত গ্রাম সমীক্ষা, সাধারণ মানুষের, জেলে, কামার, কুমোর, চাষী, ক্ষেত মজুর, রিকশাচালকের আত্মকথা। বর্তিকাই প্রকাশ করেছিল ভারতের ভূমিদাস প্রথা নিয়ে এক অসামান্য সংখ্যা। বর্তিকা ছিল জমি মাটি আর মানুষের জন্য নিবেদিত পত্রিকা।
এক সাহিত্য সভায় এক তরুণ গল্প লেখক মন্তব্য করেছিলেন, বাণিজ্যিক এক পত্রিকা ব্যতীত ওই সব লিটল ম্যাগাজিনে যা ছাপা হয়, তা নাকি ভিজে ব্লটিং পেপারের মতো লাগে তাঁর কাছে। তিনি সাহিত্যের ইতিহাস জানেন না। গত তিরিশ বছরে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের সেরা গল্পগুলির বড় অংশ ধারণ করে আছে লিটল ম্যাগাজিনই। সমরেশ বসু, মহাশ্বেতা দেবী, দেবেশ রায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে অনেক বিখ্যাত লেখকের সেরা গল্পগুলি লিটল ম্যাগাজিনেই প্রকাশিত। তালিকা করে দেওয়া যায়। মহাশ্বেতার সেরা নভেল “অপারেশন বসাই টুডু” প্রকাশিত হয়েছিল কৃত্তিবাস পত্রিকায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় “মায়া কাননের ফুল” কৃত্তিবাসেই লেখেন। শ্যামল লেখেন, অগস্ত্যযাত্রা এবং “রূপোকুঠীর পরি” এই দুই উপন্যাস। নবারুণ ভট্টাচার্য’র হারবার্ট প্রকাশিত হয়েছিল প্রমা পত্রিকায়। বিমল কর শেষ জীবনে নিজে সারা দুপুর বসে প্রুফ দেখতেন তাঁর পত্রিকা গল্পপত্র-র। তিনিই সম্পাদক। ভুলতে পারি না সেইসব দিনগুলিকে। গল্পপত্র-এ কে না লিখেছেন, শ্যামল, দেবেশ, মহাশ্বেতা থেকে আমরা সবাই। এখন যাঁরা প্রবীণতার দিকে পা বাড়িয়েছেন, তাঁদের অনেকেই লিটল ম্যাগাজিনেই তাঁদের সেরা লেখাগুলি লিখেছেন যে তা তালিকা করে বলে দেওয়া যায়। তাই যে লেখক বলেন তিনি লিটল ম্যাগাজিনে লিখবেন না, বা লিটল ম্যাগাজিনে ভিজে ব্লটিং পেপারের মতো লেখা ছাপা হয়, তিনি সাহিত্যের ইতিহাস না জেনে কথা বলেন। আমি শুনে আহত হয়েছিলাম। আমি বিশ্বাস করি লিটল ম্যাগাজিনের বিস্ফোরক ক্ষমতায় সময়ের সংকট।
৫০ বছর আগে পাওয়া যেত না তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস। আমি কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে একটি পুরনো বই পেয়েছিলাম। সেই আমার প্রথম তিতাস পড়া। এখন তিনি স্বমহিমায় জ্বলজ্বল করছেন। কত প্রকাশক ছেপেছেন তিতাস। সতীনাথ ভাদুড়ীর বইও তখন অমিল ছিল। সময় বাঁচিয়ে তুলেছে তাঁকে। তখন তাঁকে পড়ত না বাঙালি পাঠক, এখন তাঁকে না পড়লে সাহিত্য ও জীবনের অনন্য সৌন্দর্য অনুভব করা থেকে বঞ্চিত হতে হবে। সময়ের এই সংকট থাকে। সময় অনেক সময় চিনতে পারে, অনেক সময় পারে না। যাঁকে পারে, তিনি ভাগ্যবান। যাঁকে পারে না, তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মহাযাত্রায় যান। কিন্তু এও পুরো সত্য নয়। মানিকের আলো চেনা গিয়েছিল। কিন্তু মানিককে বঙ্গবাসী বই কিনিয়ে পাঠককূল সেই ভাবে চেনেননি। জনতা পাঠকই বা চিনবেন কেন? মানিক যা লিখেছিলেন, তার পাঠক এবং রমা ও মোহনের পাঠক নিশ্চিত ভাবে এক নয়। সকলের জন্য নয়, তিনি লিখেছেন দীক্ষিত পাঠকের জন্য। সাহিত্য-শিল্প শুধু মাত্র বিনোদন নয়। কোনো শিল্প কর্মই তা নয়। আবার এখন বিনোদনের নানা মাধ্যম। তা সাহিত্যে থাবা মারছে। বইয়ের পাঠক কমছে। কিন্তু একটি কথা বলার থাকতে পারে টেলিভিশনের জন্য কি ভাল থিয়েটার সিনেমার দর্শক কমেছে? টিভি সিরিয়াল দেখা আর শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কুবেরের বিষয় আশয় পড়া এক ঘটনা নয়। এমনিতে পৃথিবী জুড়ে সিরিয়াস সাহিত্যের পাঠক কমেছে হয় তো। জনগণেশের সাহিত্য যাঁরা করেন, তাঁদের কন্ঠস্বর উচ্চ হয়েছে। চিরকাল তা উচ্চই ছিল, এখন আরো বেড়েছে।
সময়ের এই সংকট নিহিত আছে সমাজে। কোন সমাজ? যে সমাজ আমাদের লালন করছে। অথবা আমরা যে সমাজকে গড়ে তুলেছি আমাদের গ্রাম-শহরে। আমাদের প্রতিবেশি আমাদের স্বজন-পরিজন নিয়ে। সেই সমাজ অনুমোদন করে ক্ষমতাকে। ক্ষমতা কী ভাবে আসে? কী ভাবে ক্ষমতা গ্রাস করে সমস্ত কিছু তা অতি বিশদে বলার দরকার আছে কি?
এখন আমি বুঝে নিতে চাইছি, সময়ের সংকট আসলে কী? সমাজ ও সাহিত্যের সঙ্গে সে কী ভাবে অন্বিত হয়ে আছে। মনে হয় ক্ষমতার দিকে মানুষের অন্তহীন যাত্রাই সমস্ত সময়ের সংকট। সমাজ ও সাহিত্য এই ক্ষমতার দ্বারাই দূষিত হয়। ক্ষমতা কী করতে পারে? ক্ষমতা কাউকে লেখক করে দিতে পারে কিছুদিনের জন্য। তারপর আরেকজনকে ধরে। আরো এমন উঠে আসে। তার হয়ে বিদূষকরা চিৎকার করতে পারে। আমি আমার এই এতটা জীবনে তেমন দেখেছি কম নয়। ক্ষমতা কু-সাহিত্যকে সাহিত্য বলে চালিয়ে দিতে পারে। তার চাপে সৃজনশীল লেখক আড়ালে চলে যান। সতীনাথ ভাদুড়ী চিরজীবন অচেনা হয়েই থাকেন। কাহিনির পর কাহিনি, তার উপর যে গোদা কাহিনি তার ভার কম নয়। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর মতো লেখক অপ্রকাশিত হয়ে থাকেন দীর্ঘদিন। তাঁর শতবর্ষ চলে যায় নিঃশব্দে। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে, ক্ষমতার অধীশ্বরের ছায়ায় থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব হয়। না থাকলে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো নীরবে চলে যেতে হয়। হ্যাঁ, তরুণ লেখকরা তাঁকে ঘিরে ছিল সন্তানেরা যেমন থাকে পিতার প্রয়াণে। আমি মনে করি ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে লেখকের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়। তিনি তো ক্ষমতার বিরুদ্ধেই লেখেন। শুধু একটি কথা বলতে হয়, ক্ষমতা নিরংকুশ হয় না। ক্ষমতা যেখান থেকে আসে তাকে মনে রাখতে হয় অবৈধ ক্ষমতাকে ধারণ করার জন্যই তার আত্মনিবেদন। ক্ষমতার অবৈধ অর্জন কী? যা চলতি কথায় ফোকটে পাওয়া। ফোকটে পাওয়া ব্যাপারটা কী? অনুপার্জিত ধন অর্জন করা। অনুপার্জিত টাকা। আমি আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম, ভি-আই-পি রোড। সেই উপন্যাসে এক জমির দালাল ছিল। ফোকটে প্রচুর টাকা করেছিল সে। শুধু একটি রাস্তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার অর্থাগমের রাস্তা খুলে যায়। জমি কেনা-বেচা করে ক্রমশ ধনী হয়ে উঠতে থাকে সে। সেই টাকা তার অনুপারজিত অর্থ। আমাদের সমাজকে এই টাকাই শাসন করে। সমাজ শাসন করে অবৈধ ক্ষমতার অধিকারীরা। অবৈধ ক্ষমতা কী? যে ক্ষমতা আপনি অর্জন করেছেন ক্ষমতাধর হয়ে নন। কোনো না কোনো উপায়ে প্রভাব খাটিয়ে। আজকের পৃথিবী ‘সেই সব শেয়ালেরা’ শাসন করে।
যেই সব শেয়ালেরা জন্ম জন্ম শিকারের তরে
দিনের বিশ্রুত আলো নিভে গেলে পাহাড়ের বনের ভিতরে
নীরবে প্রবেশ করে-বার হয়—চেয়ে দ্যাখে বরফের রাশি…।
(সেই সব শেয়ালেরা )
যে জন্মায় শিকারের তরে তার হিংস্রতা বুঝলাম, কিন্তু মানুষ যখন শৃগালের স্বভাব অর্জন করে, তা হয়ে ওঠে সমাজের কাছে বিড়ম্বনাময়। আর তার ভিতর দিয়েই সমাজ-জীবন অতিবাহিত হয় সভ্যতার আদি থেকেই। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, মানুষের সঙ্গে তথাকথিত ইতর প্রাণীর তুলনায় বনের পশুকে ছোট করা হয়। কিন্তু আমাদের তা ছাড়া আর উপমেয় কিছু নেই, যা দিয়ে সহজ সত্যকে বোঝা যায়। বনের পশুর হিংস্রতা দেখায় সাঙ্ঘাতিক। তাই সে এমন ভাবে উপমিত হয়ে যায়। মানুষ যা তার মনের ভিতরে লুকিয়ে রাখে, সে আর কোন প্রাণী রাখতে পারে?
আকাশে জ্যোৎস্না—বনের পথে চিতা বাঘের গায়ের ঘ্রাণ
হৃদয় আমার হরিণ যেন;
রাত্রির এই নীরবতার ভিতরে কোনদিকে চলেছি?
জীবনানন্দকে আবার স্মরণ করতে হয়। নীরবতা নিশ্চয়। আমি চুপ করে আছি। আপনি চুপ করে আছেন। অথবা আপনি আমি বলছি, বলতে চাইছি। চতুর্দিকের অখন্ড নীরবতা তা গ্রাস করে নিচ্ছে। অথবা হা হা হা হাসি ঢেকে দিচ্ছে আপনার কন্ঠস্বর। কিন্তু আমাদের সেইসব কথা সমাজে, সাহিত্য-শিল্পে ছায়া তো ফেলবেই। গোপনে ফেলিতেছে ছায়া। একটা কথা ঠিক, এই পৃথিবী কখনো কোনো সময়ে কি সংকটমুক্ত হতে পেরেছে? আর একুশ শতকের দেড়টি দশক পার হয়ে গেলে আমরা দেখছি সংকট আরো ঘনীভূত। কী সেই সংকট? ক্ষমতাবানের লিপ্সা কিংবা ক্ষমতার বারান্দায় প্রবেশের নয়। এই অসুখ তো সভ্যতার জন্ম থেকে আছে। আলোর বিপরীতে অন্ধকার। এই একুশ শতক প্রযুক্তির শতক। প্রযুক্তির শীর্ষ বিন্দুতে আরোহন করছে মানুষ। নিত্য নতুন app’s, application-এর সফট ওয়্যার খুঁজে বের করছে বিশেষজ্ঞরা। তার ফলে মানুষের জীবনের গোপনীয়তা অন্তর্হিত হচ্ছে। টেকনোলজি এমন জায়গায় পৌছেছে যে কোনো কিছুই আর গোপন থাকছে না। এই ধরুন একটি app’s দিয়ে আপনি খুঁজে নিতে পারবেন, সে এখন কোথায়। কে? যে কেউ। তার গোপনীয়তা আর গোপন থাকবে না। সবই যদি হয়ে যায় প্রকাশ্য, জীবনের রহস্য থাকবে কী ভাবে? পৃথিবী এখন সেই দিকে যাচ্ছে, আপনার সমস্ত গোপনীয়তা রাষ্ট্রের কাছে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। আপনি রাষ্ট্রের নজরবন্দী হয়ে যাচ্ছেন কম্পিউটারে ইন্টারনেট নিয়ে বসে। ফেসবুকের সমস্ত আদানপ্রদানের রেকর্ড থেকে যাচ্ছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে। মহাশক্তিধরের নিকটে আপনার যাপিত জীবন খুলে যাচ্ছে। এই টেকনোলজি হিংসা ছড়ানোর জন্য অতি উপযুক্ত এক মাধ্যম। আবার এই প্রযুক্তি দূর কে নিকট করেছে। বন্ধু দিয়েছে কত। অজানাকে জানার পথ খুলে দিয়েছে কত! ভুবনগ্রাম হয়ে গেছে এই পৃথিবী, বন্ধুতার হাত প্রসারিত করেছে, নারীর মুক্তির একটি জায়গা হয়েছে, নারী তার কন্ঠস্বর খুঁজে পেয়েছে এখানে। এই একুশ শতকে মানুষ যেমন তার মেধার শীর্ষে পৌঁছেছে, তেমনি মানুষ মনে মনে ফিরেছে মধ্যযুগীয় হিংসা আর সাম্প্রদায়িকতায়। আমাদের দেশ এ থেকে মুক্ত নয়। মুক্ত ছিল না কখনো। এখন সাম্প্রদায়িক হিংসা ক্রমশ তার দাঁত-নখ বের করছে। সমাজে তার ছায়া ঘনাইছে ক্রমশ।
সাহিত্যে এর ছায়া তো পড়বেই। টেকনোলজি যে ছায়া ফেলছে, তার ছায়া। সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা, মধ্যযুগীয় নরহত্যা এখন নিত্য খবর। এই সংকট থেকে আমরা কি মুক্ত হতে পারব? উনিশ ও বিশ শতক ছিল স্বপ্নের শতক। স্বপ্ন দেখেছিল মানুষ। মুক্তির স্বপ্ন। অর্জন করেছিল অনেক অধিকার। সবচেয়ে বড় অধিকার ছিল আট ঘন্টার কাজের অধিকার। কর্পোরেট শাসিত এই পৃথিবী থেকে শ্রমিকের আটঘন্টার কাজের অধিকার সুকৌশলে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। স্বপ্ন দেখেছিল মানুষ যে মুক্তির, তা ভঙ্গ হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি তার ক্ষমতা থেকে সরে গেছে মানুষের কন্ঠস্বর রুদ্ধ করতে যাওয়ার জন্য। আর সবকিছু দখল করার প্রবণতায়। অনেক অধিকার লুন্ঠিত হচ্ছে। হ্যাঁ, সেজ নামক দেশের ভিতরে বিদেশ নির্মাণে কমিউনিস্ট চিন তো সবার আগে। সেই দেশ কেমন রাখে শ্রমিকের অধিকার তা আমাদের অজানা নয়। আমি বলছি আমাদের বাল্যকাল, কৈশোর, যৌবন যে স্বপ্ন নিয়ে কেটেছে, তা ক্রমশ মুছে যেতে লেগেছে বিশ শতকের শেষ দশক আর এই শতকের প্রথম দুই দশকে। আমরা যখন লিখতে আসি, আমাদের ভিতরে ছিল আদর্শ। আমি মানিকে অনুপ্রাণিত হয়েছি। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, চেখভ পড়েছি, প্রেমেন্দ্র মিত্র পড়েছি, তলস্তয় পড়েছি, দস্তয়েভস্কি পড়েছি, পুশকিন, গোগোল। রুশ সাহিত্য আমাকে শিখিয়েছে লিখতে। লিখতে শেখার সঙ্গে কী লিখতে হবে তাও শিখেছি। সেই শেখা সমস্তজীবন লালন করেছি। নিজ ধর্ম ত্যাগ করিনি। ধর্ম অর্থাৎ আদর্শ। কিন্তু সেই পৃথিবী তো নেই। আদর্শবাদ অলীক। ধীরে ধীরে সমস্ত মুক্তচিন্তার জায়গা ছোট হয়ে যাচ্ছে। আপনি ভেবে দেখুন আমাদের নদী, অরণ্য, পাহাড় দখল করে নিচ্ছে কর্পোরেট। আপনার দেশের উপর আপনার অধিকার হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
মনে করুন, সেই যে আরণ্যকের আদিবাসী রাজা দোবরু পান্না, রাজকন্যা ভানুমতী, তাদের ধনঝরি পাহাড়, তাদের বন… সমস্ত কিছু চলে গেছে রাসবিহারী সিং নামের রাজপুতের পৌত্রের দখলে। ঠিক তার নয়, সেই পাহাড়, অরণ্য লিজ নিয়েছে কর্পোরেট, রাসবিহারী সিং’এর নাতি তাদের এজেন্ট। আরণ্যক উপন্যাসে জঙ্গল মহলে নায়েব গিয়েছিল জমি বন্দোবস্ত দিতে। দরিদ্র ভারতবর্ষের এক চেহারা ফুটে উঠেছিল। কত অল্পতে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। বেঁচে থাকে। মানুষ কত প্রকৃতি মনস্ক। যুগলপ্রসাদ জঙ্গলে বৃক্ষ রোপণ করে। জমি বন্দোবস্ত দিয়ে ফিরে আসার সময় নায়েবের মনে হয়েছিল, সে নিজেই অরণ্য নিধনের সূত্রপাত ঘটিয়ে দিয়ে গেল। কিন্তু বহু বছর বাদে বিভূতিবাবুর দেশে কিন্তু সত্যই ধ্বংস যজ্ঞ আরম্ভ হয়েছে। আমি কী করতে পারি। আমার অসমর্থন রেখে যেতে পারি। কোথায়? আমার লেখায়। মনে করুন, সেই অরণ্যজীবী মানুষগুলিকে মেরে মাটিতে পুতে দিয়েছে রাসবিহারী সিং’এর নাতি। মনে করুন ভানুমতীর কন্যা রূপমতী (উপন্যাসে নেই)র স্বামী জেল থেকে মুক্তি পেল শুধু এই শর্তে, পরদিন তারা ছেড়ে যাবে ধনঝরি পাহাড়ের পাদদেশ। তাদের জন্য সিমেন্ট ফ্যাকটরির কুলি লাইনে ব্যবস্থা হয়েছে। আর ভানুমতীর নাতনি, রূপমতীর কন্যাটি বড় হয়েছে। তার জন্যই তাদের পাহাড় গোড়ায় রাসবিহারী সিং’এর নাতির মোটর সাইকেল বুকবুক করে। অরণ্য পাহাড় না ছাড়লে তাকে তুলে নিয়ে যাবে যে কোনোদিন। কী হয়েছিল তারপর? বহু বছর বাদে এক তৃণগুল্মহীন উষর ক্ষেত্রে চন্দ্রালোকিত রাত্রে একটি মানুষের ছায়া দেখা যায়। সে অনেক বছর আগে এসেছিল জঙ্গল মহলে জমি বন্দোবস্ত দিতে। তারপর কত বছর কেটে গেছে। জমি পড়ে আছে মরুভূমি হয়ে। কর্পোরেট নিয়েছিল। তার আগে জমি সাফ করা হয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম উচ্ছেদ করে। লতাপাতা, বৃক্ষাদি, পাখ-পাখালি, কীট পতঙ্গ সমস্ত কিছু শেষ করে মাটিতে পুতে দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে মানুষ। আদিবাসী রাজা দোবরু পান্নার বংশধরদের। মূল্যবান আকরিকের সন্ধান পেয়েই বহুজাতিক সংস্থা এসেছিল। কিন্তু জমি দখল করে যখন তারা আকরিক উত্তোলন করে, দ্যাখে উঠছে শুধু ক্যালসিয়াম কার্বনেট, মানুষের হাড় মাটির ভিতরে ওই চুনা পাথর হয়ে পড়ে আছে। ফিরে যায় বহুজাতিক। চন্দ্রালোকে অশ্রুপাত করেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দেশের জন্য।