লিজিয়ার মৃত্যু
লেডি লিজিয়ার সঙ্গে কবে, কীভাবে, কোথায় আমার প্রথম পরিচয় ঘটেছিল, আমার কিছুই মনে নেই। তারপর অনেক বছর গেছে, অনেক কষ্ট পেয়েছি, স্মৃতি দুর্বল হয়ে এসেছে। অথবা লিজিয়ার দুৰ্জ্জেয় চরিত্রের সবটুকু আমি ধরতে পারিনি বলেই সব কথা মনে করতে অক্ষম।
লিজিয়া! লিজিয়া! লিজিয়া! শুধু এই নামটি মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করলেই মনের চোখে ভেসে উঠে অতুলনীয় একটি রূপ-ইহ লোকের মায়া যে অনেক আগেই ত্যাগ করেছে। লিজিয়া! লিখতে বসে মনে পড়ছে, সে এসেছিল আমার বান্ধবীরূপে, তারপর বাগদান করে সহায় হয়েছিল আমার পড়াশুনায়। সবশেষে বরণ করেছিল আমাকে স্বামীত্বে।
সব ভুলেছি, ভুলিনি কেবল লিজিয়ার অসামান্য রূপ। দীর্ঘাঙ্গী, কৃশকায়া। চলাফেরা করত হাল্কা চরণে। পড়ার ঘরে ঢুকত লঘুপায়ে ছায়ার মতো, টের পেতাম না। সঙ্গীতের মতো নরম মিষ্ট কণ্ঠে কথা বললে চমক ভাঙত, রোমাঞ্চিত হতাম কাঁধের ওপর মর্মর হাতের স্পর্শে।
লর্ড ভেরুলাম বলেছেন, প্রকৃত রূপ চিনেও চেনা যায় না। সে রূপের মধ্যে এমন অদ্ভুত কিছু থাকে, যা আমাদের অজ্ঞাত, ব্যাখ্যার অতীত। লিজিয়ার মধ্যে আমি এই অজানা বৈশিষ্ট লক্ষ্য করেছি, কিন্তু খুঁজে পাইনি কেন সে এত শ্রীমতী।
রূপ সম্বন্ধে আমাদের চিরকালের যে সংজ্ঞা, লিজিয়ার রূপ সেই বাঁধাধরা ফরমুলায় পড়ে না। তবুও সে অলোকসামান্য কেন? ললাট নিখুঁত, হাতির দাঁতের মতো সাদা গায়ের চামড়া, দাঁড়কাকের মতো কুচকুচে কালো একরাশ ঢেউ খেলানো চুল। নাকের গড়ন টিকোলো। হিব্র সুন্দরীদের হার মানা মিষ্টি মুখটি স্বর্গীয় সুধায় রমণীয়। ওষ্ঠের তুলনায় অধর ঈষৎ পুষ্ট, গালের টোল যেন নিজেই মুখর হতে চায়, হাসলেই দেবলোকের বিমল রশ্মিরেখায় যেন ঝলমল করে উঠে পরিপাটি দাঁতের সারি।
সবচেয়ে আশ্চর্য ওর চোখ। ইতিহাস-প্রসিদ্ধ ডাকসাইটে সুন্দরীদের নয়নের মতো নয়, কোনো তুলনাই চলে না। লর্ড ভেরুলাম সৌন্দর্য রহস্যের ব্যাখ্যা করতে যা বলেছেন, অজানা সেই রহস্য বুঝি বিধৃত ওর আকাশ সমান আঁখির মধ্যে। সাধারণ সুন্দরীদের চেয়ে বড়ো চোখ, উজ্জ্বল তারকার মতো প্রদীপ্ত। উত্তেজিত হলেই ভাস্বর হয়ে ওঠে তুলনাহীন এই প্রত্যঙ্গ দুটি। বিচ্ছুরিত হয় অপার্থিব সৌন্দর্য। তখন তা বন্য তাতার সুন্দরীদের চোখের মতোই দুস্তর ঝলমলে। চোখের মণি দুটোয় কালো হীরের দীপ্তি। বড়ো বড়ো চক্ষু পল্লব। বঙ্কিম ভুরু দুটিও কুচকুচে কালো। অদ্ভুত সৌন্দর্যটা কিন্তু চোখের রঙ, দীপ্তি বা গঠন সুষমায় নয়–এ রহস্য ওর চোখের চাহনিতে। কেন ওর চোখের ভাব এত এত রহস্যময়! এত মোহময়! কিছুতেই তল পাইনি নিতর। সেই চাহনির। আমার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দূর আকাশের যুগল নক্ষত্রর মতো অম্লান থেকেছে ওর সৌন্দর্যের আকর যুগল নয়ন। পূজা করেছি সেই নক্ষত্র দুটিকে, জ্যোতির্বিদের মতো অন্বেষণ করেছি নক্ষত্রের স্বরুপ-ব্যর্থ হয়েছি।
আশ্চর্যসুন্দর রহস্যময় এই নক্ষত্রসম চোখ দুটির দ্যুতিও কিন্তু ক্রমে ক্রমে ম্লান হয়ে এল। অসুস্থ হলো লিজিয়া। বন্যচোখ দুটিতে আর সে আভা ফুটল না, বিশীর্ণ আঙুলগুলি মোমের আঙুলের মতো রক্তহীন হয়ে এল। সামান্যতম আবেগেই স্পষ্ট হলো শুভ্র ললাটের নীল শিরা। বুঝতে পারছি, সময় ফুরিয়ে আসছে লিজিয়ার, আমি প্রাণপণে লড়তে লাগলাম মনের সঙ্গে। লড়তে লাগল লিজিয়াও। জীবনের প্রতি অসীম মায়া, জাগতিক সংসারের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ, বেঁচে থাকার তীব্র বাসনা বিমূর্ত হলো ওর মৃদু কণ্ঠস্বরে। ওর সেই অবস্থায় সান্ত্বনার কোনো ভাষা আমি পাইনি।
লিজিয়া আমায় ভালোবাসত। বুক দিয়ে ভালোবাসত। ওর ভালোবাসার গভীরতা সমস্ত অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছি ওর চিরবিদায়ের পর। মৃত্যুর আগে ধীর স্থির নয়নে আমার পানে চেয়ে মৃদুস্বরে ও আমাকে প্রেমের অমৃত বচনই শুনিয়েছিল। বলেছিল, সেই কবিতাটি আবৃত্তি করবে? আমি অবরুদ্ধ আবেগে শুনিয়েছিলাম ওর স্বরচিত কবিতা।
কবিতা শেষ হলো। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে সটান বিছানায় দাঁড়িয়ে উঠল লিজিয়া। মৃত্যুপথযাত্রীর এত আবেগ সইবে কেন? নিঃশেষিত হয়ে লুটিয়ে পড়ল শষ্যায়। শেষ নিশ্বাস যখন পড়ছে, তখন শুনলাম বাতাসের সুরে ওর আত্মা যেন বিড়বিড় করছে অধরোষ্ঠের ফাঁকে। কান পেতে শুনলাম গ্যানভিলের সেই অমর কথা-ইচ্ছার মৃত্যু নেই। ঈশ্বর স্বয়ং একটা মহান ইচ্ছা। মানুষ দেবলোকে যেতে চায় না-মরার পরেও না-আপন ইচ্ছাশক্তি যতক্ষণ না দুর্বল হচ্ছে।
এই তার শেষ কথা। মারা গেল লিজিয়া। শোকে দুঃখে মুষড়ে পড়লাম আমি। নিঃসঙ্গ পুরীতে থাকতে পারলাম না। ঐশ্বর্য বলতে যা বোঝায়, আমার তার অভাব ছিল না। নশ্বর মানুষ যে সম্পদ কল্পনাও করতে পারে না, আমার তা ছিল। সম্পত্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল লিজিয়াকে বিয়ে করার পর। তাই মাস কয়েক পরে ঘরছাড়া দিকহারা হয়ে দেশভ্রমণের পর একটা পুরোনো মঠ কিনলাম ইংল্যান্ডের মাটিতে। বিষাদাচ্ছন্ন মঠ। আসবাসপত্রে অনেক স্মৃতি, অনেক ব্যথা, অনেক ইতিহাস বিজড়িত। আমার নিঃসঙ্গ শোকবিধুর মনের উপযোগী পরিবেশ।
ভাঙা মঠের বাইরেটা ভাঙাই রইল, মেরামত করলাম না। কিন্তু ভেতরটা সাজালাম রুচিসুন্দরভাবে দামি দামি জিনিস দিয়ে। আমার তখন মাথার ঠিক নেই। ছেলেমানুষী উন্মাদনায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। মহার্ঘ আসবাসপত্র দিয়ে ঘরসজ্জা আমার চিরকালের বাতিক। নিরালা অঞ্চলের সেই ভাঙা মঠের অভ্যন্তরেও তাই নিয়ে এলাম স্বর্ণখচিত গালিচা, মিশরীয় কারুকার্য, জমকালো পর্দা। শোকাচ্ছন্ন হয়েও আফিমের ঘোরে আমি দিনকয়েক মত্ত রইলাম গৃহ সজ্জা নিয়ে। তারপর একদিন শুভ্রকেশী নীল নয়না লেডি রোয়েনাকে বধূবেশে নিয়ে এলাম সেই বাসভবনে অবিস্মরণীয় লিজিয়ার শূন্য সেই সিংহাসনে বসাতে।
কনে বউয়ের জন্যে যে ঘরটি সাজিয়ে ছিলাম, তার বর্ণনা দিচ্ছি এবার। ঘরটা মঠের শীর্ষদেশে, বুরুজের তলায়। পাঁচকোনা ঘর। দক্ষিণ দিকের দেওয়াল জোড়া একটা জানলা। ভেনিস থেকে আমদানি করা প্রকাণ্ড এক খানা রঙিন কাঁচ বসানো জানলায়। সূর্যলোক অথবা চন্দ্রকিরণ সেই কাঁচের মধ্য দিয়ে ভৌতিক প্রভা দিয়ে লুটিয়ে পড়ে ঘরের আসবাবপত্র। বিশাল জানালার ওপরে একটা প্রাচীন আঙুরলতা শ্যাওলা ধরা বুরুজ বেয়ে উঠে গেছে ওপরে। ওক কাঠের কড়িকাঠ অনেক উঁচু। খিলানের আকারে তৈরি। কাঠের গায়ে বহু পুরোনো কিম্ভুতকিমাকার আধা গথিক কারুকাজ। বিষণ্ণ কড়িকাঠের মাঝখানের খিলান থেকে সোনার চেনে ঝুলত একটা সোনার ধুনুচি। সারাসেনিক প্যাটার্নে তৈরি গন্ধ পাত্র। সর্পিল রেখায় অবিরাম বর্ণবিচিত্র অগ্নিশিখা লেলিহান রসনা মেলে ধরত কারুকার্য পরিবৃত রন্ধপথে।
বেশ কয়েকটি তুর্কী পালঙ্ক আর সোনালি শামদান সাজানো ঘরের নানা স্থানে। ভারতবর্ষ থেকে আনিয়েছিলাম নিরেট আবলুস কাঠে নির্মিত নতুন বউয়ের আরামকেদারা, মাথার ওপর ছত্রাকার চন্দ্রাতপ। পাঁচকোণে বসানো পাঁচটা সমাধি-সিন্দুক, ঘন কালো আগ্নেয়শিলা খুদে তৈরি। ডালার ওপর সুপ্রাচীন ভাস্কর্য, সিন্দুকগুলি সংগ্রহ করেছি রাজারাজড়ার সমাধি-মন্দির থেকে। সবচেয়ে জবর ফ্যানটাসি কিন্তু দেওয়াল জোড়া পর্দায়। দানবিক দেওয়ালের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত ঝুলছে মহার্ঘ বস্ত্রাবরণ, যা গালিচার মতো পুরু, তুর্কী পালঙ্কের চাদরের মতো চিত্র-বিচিত্র, জানালার পর্দার মতো জমকালো। সোনার কাপড় দিয়ে তৈরি এই বস্ত্রাবরণের দাম শুনলে স্মম্ভিত হতে হবে। কুচকুচে কালো কাপড়ের ওপর স্বর্ণচিত্র, ব্যাস এক ফুট, সমান ব্যবধানে আরব্য ইমারতের উদ্ভট নকশা।
ঘরে ঢুকলে প্রথমে নকশাগুলোকে আরব্যদেশীয় মনে হবে। আরো এগোলে নকশার চেহারা পালটে যাবে, যেন বিরাটকায় দানবদল কিম্ভুতকিমাকার ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। পায়ে পায়ে ঘরের মাঝে এলে দানবদলও অদৃশ্য হবে রোমাঞ্চকর পর্দার বুক থেকে। তখন ডানে বাঁয়ে সামনে পেছনে কেবল দুলবে কুসংস্কারের ছায়ামূর্তি। অন্তহীন বিদঘুঁটে মূর্তিগুলোকে মনে হবে মুখ ঢাকা সন্ন্যাসীর দল, নির্নিমেষে নিরীক্ষণ করছে। ঘরের প্রাণীদের। কৃত্রিম উপায়ে হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে পর্দার পেছনে। তাতে বৃদ্ধি পেয়েছে গা-শিউরোনো অনুভূতি। হাওয়ায় অবিরাম দুলতে থাকে ভারি পর্দা-অলীক কাহিনির বিচিত্র অপচ্ছায়ার মতো মঠবাসীদের কল্পিত আকারগুলিকে মনে হয় সজীব। গায়ে রোমাঞ্চ জাগে সেই দৃশ্য দেখলে, শিরশির করে শিড়দাঁড়া।
বিয়ের প্রথম মাসটা এহেন ঘরেই কাটল। খুব একটা অশান্তি হলো না। নতুন বউ আমার থমথমে মুখ দেখে ভয় পেত, আমার আত্মনিমগ্ন রূপ দেখে দূরে সরে যেত। আমাকে সে ভালোবাসতে পারেনি, তাতে আমি খুশিই হয়েছি। নিজের মনের অতলে ডুব দিয়ে দিবারাত্র ধ্যান করতাম লিজিয়াকে যে লিজিয়া আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।
চিরবিদায় নিয়েছে বলেই তার রূপ আমার মধ্যে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, তার প্রতি আমার আকর্ষণ আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমার আফিমের নেশা ছিল। নেশার ঘোরে স্বপন দেখতাম লিজিয়াকে। কল্পনা করতাম, আহারে, আবার যদি ওকে ফিরিয়ে আনা যেত এই মাটির পৃথিবীতে!
বিয়ের দ্বিতীয় মাসে হঠাৎ অসুস্থ হলো লেডী রোয়েনা। রোগমুক্তি ঘটতে সময় লাগল। ব্যাধির প্রকোপেই বোধ হয় প্রায়ই অনুযোগ করত ঘরের মধ্যে অদ্ভুত পদশব্দের। ছায়া নড়ছে, অদ্ভুত আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। চোখের ভুল কানের ভুল বলে উড়িয়ে দিতাম। স্নায়ু দুর্বল হলে এ-রকম ইন্দ্রজাল অনুভব করে অনেকেই।
বেশ কিছুদিন পরে আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠল রোয়ানা। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার শয্যাশায়ী হলো। এবার কিন্তু রোগ সারবার লক্ষণ দেখা গেল না। ভয় পেলাম ওর অবস্থা দেখে। শুকিয়ে যেতে লাগল দিনের পর দিন, যেন মিশে গেল বিছানার সাথে। ডাক্তাররাও ধরতে পারল না
অসুখটা। মাঝে মাঝে ছেড়ে যায়, আবার এসে তেড়ে ধরে। ক্রমশ কমে আসতে লাগল প্রাণশক্তি, বৃদ্ধি পেল স্মায়বিক বিকার। সেই অপচ্ছায়ার নড়াচড়া নাকি আবার দেখতে পাচ্ছে-শুনতে পাচ্ছে অদ্ভুত শব্দ। দেওয়ালজোড়া ফ্যানট্যাসটিক পর্দার আড়াল থেকেই এ শব্দ শোনা যায়, সৎ করে ছায়ামূর্তি মিলিয়ে যায় পর্দার বুকে।
একদিন রাতে ওর এই অস্বস্তির কথা নিয়ে আমাকে আরো চেপে ধরল রোয়ানা। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চমকে উঠছিল। আমি উদ্বিগ্ন চোখে দেখছিলাম বিশীর্ণ মুখের ভাবতরঙ্গ। পালঙ্কের পাশে রাখা আবলুস কাঠের কেদারায় বসেছিলাম আমি। ঘুম ভাঙল রোয়ানার। কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে বলল, শব্দটা নাকি আবার শোনা যাচ্ছে। আমি কিন্তু কিছু শুনলাম না। বলল, অপচ্ছায়াকে আবার দেখা যাচ্ছে, আমি কিন্তু কাউকে দেখলাম না। হাওয়ায় পর্দা দুলছিল। ভাবলাম, ওকে বুঝিয়ে বলি, প্রায় অশ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দ পর্দার খসখসানি ছাড়া কিছু নয়। পর্দার বিমঘুঁটে মূর্তিগুলো দুলে দুলে উঠছে বলে মনে হচ্ছে, কে যেন সরে যাচ্ছে পর্দার আড়ালে।
রোয়ানার মুখ কিন্তু নিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। মানুষ মরে গেলে মুখ যে রকম সাদা হয়ে যায়, রোয়ানার মুখের অবস্থা তখন তাই। মনে হলো, এই বুঝি জ্ঞান হারাবে। কাছাকাছি চাকর-বাকর নেই যে ডাকব। মনে পড়ল, হঠাৎ দরকারের জন্যে ঘরের মধ্যেই এক বোতল মদ রেখে গিয়েছিলেন ডাক্তার। তাই দৌড়ে গেলাম ঘরের অপর প্রান্তে সুরার আধার আনতে। মাথা ওপর ঝুলন্ত সোনার গন্ধপাত্রের তলা দিয়ে যাওয়ার সময়ে একই সময়ে দুটো বিচিত্র অনুভূতি সাড়া জাগিয়ে গেল আমার লোমকূপে।
স্পষ্ট মনে হলো কে যেন আলতো করে আমার গা ঘষটে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, ধুনুচির তলায় আলোকবলয়ের মধ্যে স্বর্গের পরীর মতো একটা আবছা অস্পষ্ট ছায়া। ছায়ার ছায়া যদি কিছু থাকে-দ্যুতিময় সেই ছায়াটা যেন তাই।
কিন্তু আমি নিজে তখন আফিমের ঘোরে, তাই এ সব কথা রোয়ানাকে না বলাই সমীচীন মনে করলাম। মদিরাপত্ৰ এনে পেয়ালায় ঢেলে তুলে ধরলাম ওর ঠোঁটের কাছে। তখন অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে রোয়ানা। মদিরার পেয়ালা আমার হাত থেকে নিয়ে ধরল ঠোঁটের কাছে।
আমি বসলাম আবলুস কাঠের আরামকেদারায়। চোখ রইল রোয়ানার ওপর। ঠিক এই সময়ে আমার সর্বসত্তা দিয়ে অনুভব করলাম আবার সেই মায়াস্পর্শ। স্পষ্ট শুনতে পেলাম, কে যেন লঘু চরণে হেঁটে এল কার্পেটের ওপর দিয়ে, এগিয়ে গেল কেদারার পাশ দিয়ে। ঠিক তখনি পেয়ালাটা উঁচু করে ধরেছে রোয়ানা। আমার চোখের ভুল কিনা জানি না, কিন্তু বেশ দেখলাম যেন শূন্যমার্গের কোন নিঝরিণী উৎস থেকে সহসা আর্বিভূত হলো চার-পাঁচটা টলটলে চূণীর মতো অত্যুজ্জ্বল তরল বিন্দু এবং টপটপ করে খসে পড়ল পেয়ালার সুরায়।
রোয়ানা কিছু দেখল না। এক চুমুকে পাত্র নিঃশেষ করে ফিরিয়ে দিল আমার হাতে। আমি ভাবলাম, দেখেছি তা আফিমের প্রভাবে দেখেছি। রাত্রি নিশীথে আতঙ্কিত স্ত্রীকে সামনে রেখে নিজেই ইন্দ্রজাল দর্শন করছি।
একটা ব্যাপার কিন্তু আমার মনের কাছে গোপন করতে পারলাম না। রুবীর ফোঁটা সুরার মধ্যে ঝড়ে পড়ার পর থেকেই আরো খারাপ হলো স্ত্রীর শরীর। তৃতীয়রাতে দাসীরা তাকে কবরে শোয়ার পোশাক পরিয়ে দিল। চতুর্থ রাতে তার চাদর ঢাকা প্রাণহীন দেহ সামনে নিয়ে পাথরের মতো বসে রইলাম।
অদ্ভুত সেই কক্ষে অনেক উদ্ভট দৃশ্য যেন আফিমের ঘোরে ছায়ার মতো কল্পনায় ভেসে গেল। ঘরের পাঁচ কোণে রাখা পাঁচটি শবাধারের পানে চাইলাম অশান্ত চোখে। দেখলাম, দুলন্ত পর্দার গায়ে কিম্ভুতকিমাকার মূর্তিগুলোর নড়াচড়া, মাথার ওপরে ধুনুচি ঘিরে সর্পিল আগুনের কুণ্ডুলী। সেখান থেকে দৃষ্টি নেমে এল তলায়, মেঝের ওপরে। দুরাত আগে যেখানে দেখেছিলাম অপার্থিব এক জ্যোতির্ময় ছায়ার অস্পষ্ট আদল। কিন্তু এখন সে স্থান শূন্য। এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে দেখছিলাম, এবার স্বচ্ছন্দ হয়ে এল শ্বাস-প্রশ্বাস।
সহজভাবে তাকালাম শয্যায় শায়িতা পাণ্ডুর আড়ষ্ট দেহের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে লিজিয়ার স্মৃতি ভিড় করে এল মনের মধ্যে। মনে পড়ল, এমনিভাবে আর এক রাতে তার প্রাণহীন দেহ সামনে নিয়ে নিথরভাবে বসে থেকেছি আমি। মনে পড়ল হাজার হাজার মিষ্টি মধুর বেদনাবিধুর ঘটনা। রাত বয়ে চলল। তিক্ত স্মৃতিভারে তন্ময় হয়ে গেলাম-লিজিয়ার ধ্যানে বিশ্বসংসার বিস্মৃত হলাম।
মাঝরাত নাগাদ একটা চাপা, হ্রস্ব, মধুর, কিন্তু স্পষ্ট ফোঁপানির শব্দে সম্বিত ফিরে এলো। সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করলাম, শব্দটা এসেছে আবলুস কেদারা থেকে। কুসংস্কারের আতঙ্ক পেয়ে বসল আমায়, উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। কিন্তু মৃত্যু কেদারা থেকে আর কেউ ফুঁপিয়ে উঠল না। আড়ষ্ট হয়ে চাইলাম নিষ্প্রাণ দেহের দিকে, কিন্তু নিস্পন্দ দেহে সামান্যতম চাঞ্চল্যও দেখতে পেলাম না।
কিন্তু আমার ভুল হয় নি। যতক্ষণই হোক না কেন, ফোঁপানির শব্দ আমি ঠিকই শুনেছি বলেই ধ্যান থেকে জেগে উঠেছি। তাই মনটা শক্ত করে নিমেষহীন চোখে চেয়ে রইলাম মৃত স্ত্রীর পানে।
অনেকগুলো মিনিট কাটল বিনা ঘটনায়। তারপর শুরু হলো আর এক। অলৌকিক রহস্যের খেলা। ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে এল দুই গাল। খুব আবছা হলেও রক্তাভা চোখ এড়ালো না আমার, সেই সঙ্গে দেখলাম রক্তের খেলা বসে যাওয়া চোখের পাতায়। হাত-পা অবশ হয়ে এল আমার সেই অসম্ভব দৃশ্য দেখে। মনে হলো, এই বুঝি স্তব্ধ হয়ে যাবে হৃৎপিণ্ড।
তীব্র কর্তব্যবোধ শেষ পর্যন্ত মাথা চাড়া দিল মনের মধ্যে। বেশ বুঝলাম, রোয়ানা মারা যায়নি। এখনো বেঁচে আছে। এখুনি কিছু উপাসনার দরকার। কিন্তু-চাকর-বাকরেরা থাকে মঠের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, আমার ডাক সেখানে পৌঁছোবে না। উঠে গিয়েও তাদের ডেকে আনতে সাহস পেলাম না।
তাই একাই সূক্ষ্মদেহী রোয়ানার আত্মাকে আহ্বান জানালাম, সে তো এখনো যায়নি, আছে আমার কাছেই, আকুল আহ্বান জানালাম দেহপিঞ্জরে ফের ফিরে আসতে। কিন্তু দেখতে দেখতে রক্তাভা মিলিয়ে গেল চোখের পাতা আর গালের চামড়া থেকে। আবার মৃত্যুর ভয়াবহতা প্রকট হলো চোখে মুখে। আবার মার্বেল-সাদা হয়ে গেল মুখখানা, দাঁতের ওপর চেপে বসল নিরক্ত অধরোষ্ঠ। তুহিনকঠিন দেহের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেঁপে উঠলাম থরথর করে, এলিয়ে পড়লাম কেদারায় এবং আবার তন্ময় হয়ে গেলাম লিজিয়ার কামনাতপ্ত স্মৃতি-জাগরণে।
এক ঘণ্টা পর আবার অস্পষ্ট শব্দ শুনলাম। শয্যার দিক থেকে এসেছে। শব্দটা। নিঃসীম আতঙ্কে উৎকর্ণ হয়ে রাইলাম। এবার আর ভুল হলো না। স্পষ্ট শুনলাম, কে যেন পাজর খালি করা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছুটে গেলাম মড়ার পাশে। দেখলাম-স্পষ্ট দেখলাম, ঠোঁটটা থিরথির করে কাঁপছে।
এক মিনিট পরেই কিন্তু শিথিল হয়ে গেল অধরোষ্ঠ, ফাঁক দিয়ে দেখা গেল মুক্তাদাঁতের ঝকঝকে সারি। এবার আতঙ্কে চোখ আমার ঝাপসা হয়ে এল। ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেল। অতি কষ্টে সামলে রাখলাম নিজেকে। কর্তব্য করতেই হবে-ভয় পেলে চলবে না।
এবার প্রাণের হালকা আভা প্রকাশ পেল ললাটে, গালে, গলায়। উষ্ণতায় আচ্ছন্ন হলো সারা দেহ। এমন কি মৃদু মৃদু স্পন্দিত হলো বক্ষদেশও।
বেঁচে আছে! বেঁচে আছে! লেডি বেঁচে আছে! দ্বিগুণ উৎসাহে ওকে পুরোপুরি সজীব করার জন্যে হাত-পা-রগ ঘষতে লাগলাম। ডাক্তারি জানি না, আনাড়ীর মতোই করে গেলাম। কিন্তু বৃথা হলো প্রচেষ্টা।
আচম্বিতে অদৃশ্য হলো রক্তিমাভা, স্তব্ধ হলো বক্ষস্পন্দন, দাঁতের ওপর আড়ষ্ট হয়ে গেল অধরোষ্ঠ। মুহূর্তের মধ্যে আবার মড়ার মতোই কঠিন, শীতল, বীভৎস হয়ে উঠল দেহের প্রতিটি রেখা, সমাধি মন্দিরে ছাড়া অন্যত্র যার স্থান নেই।
আবার নিমগ্ন হলাম লিজিয়ার ধ্যানে। আবার ফোঁপানি শুনলাম আবলুস শয্যার দিক থেকে।
রাত তখন ফুরিয়ে এসেছে। আগের চাইতেও স্পষ্টভাবে নড়ে উঠল নিষ্প্রাণ দেহটা। আমি কিন্তু নড়লাম না, উদাত আবেগের টুটি টিপে ধরে অতি কষ্টে বসে রইলাম কেদারায়। আগের মতোই রঙের ছোঁয়া লাগল কপোলে, কপালে। উষ্ণতায় চঞ্চল হলো সারা দেহ, স্পন্দিত হলো বক্ষদেশ, কম্পিত হলো চক্ষুপল্লব। তবুও আমি নড়লাম না।
রোয়ানার শরীরে তখনো কফিনের সাজ, ব্যান্ডেজ এবং অন্যান্য বস্ত্র। কফিন-সজ্জা না থাকলে রোয়েনাকে জীবন্তই বলা যেত। কিন্তু অচিরেই আমার মনের সব দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে এল দেহটা। খলিত চরণে টলতে টলতে দু হাত সামনে বাড়িয়ে যেন স্বপ্নের ঘোরে ঘরের ঠিক মাঝখানে এসে পৌঁছোলো চাদরমোড়া নারীমূর্তি। তবুও আমি নড়লাম না, শিউরে উঠলাম না। কারণ, অনেকগুলো অবর্ণনীয় কল্পনা যুগপৎ আছড়ে পড়ল আমার মস্তিষ্কে। চলমান মূর্তির চালচলন, দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা যেন অসাড় করে দিল আমার মগজ।
আমি পাথর হয়ে গেলাম। একচুলও না নড়ে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইলাম প্রেমূর্তির দিকে। কে এই শরীরী রহস্য? রোয়ানা? কিন্তু এ সন্দেহ কেন আসছে মাথার মধ্যে?
শুভ্রকেশী নীলনয়না রোয়ানা নয় আগুয়ান ঐ নারী মূর্তি, এমন উদ্ভট ধারণা কেন পীড়িত করছে আমার মস্তিষ্ক? মুখের ওপর ব্যান্ডেজের পটি আছে ঠিকই, কিন্তু সঘন নিঃশ্বাসে প্রাণময় ও-মুখ লেডী রোয়ানার না হয়ে অন্যের হতে যাবে কেন? রক্তিম ঐ কপোল তো রোয়ানারই, জীবনের মধ্যাহ্নে প্রাণ সূর্যের আলোক ছিল যেভাবে, ঠিক সেইভাবে গোলাপি ও গাল রোয়ানার ছাড়া আর কারো নয়। ঐ চিবুক, ঐ টোলও নিশ্চয় রোয়ানার। কিন্তু…কিন্তু…অসুখে ভুগে কি মাথায় লম্বা হয়ে গিয়েছে রোয়ানা? একি উন্মত্ত চিন্তা পেয়ে বসেছে আমাকে? ক্ষিপ্তের মতো ধেয়ে গেলাম, ছিটকে পড়লাম তার পায়ের ওপর।
আমার ছোঁয়া পেতেই মাথা থেকে কদর্য কফিন-সজ্জা খুলে ফেলে দিল সে, ব্যান্ডেজের আড়াল থেকে মেঘের মতো পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়ল একরাশ চুল, সে চুল মধ্যরাতের দাঁড়কাকের ডানার চেয়েও কুচকুচে কালো!
তারপর ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল শরীরী রহস্য।
বুকফাটা হাহাকার করে উঠলাম আমি–এবার চিনেছি…চিনেছি তোমায়…কৃষ্ণকালো বড়ো বড়ো এ চোখ যে আমার হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সী ..লেডি লিজিয়ার!