তত্ত্ব ও ধারণার রাজনীতি
পরিচিতির রাজনীতি
উপস্থাপনের রাজনীতি
অনুভূতির রাজনীতি

লিঙ্গ-পরিচিতির রাজনীতির দিকে: (অ)পরতার একটি পাঠ – দেবরাজ দাশগুপ্ত

লিঙ্গ-পরিচিতির রাজনীতির দিকে (অ)পরতার একটি পাঠ – দেবরাজ দাশগুপ্ত

[এই লেখাটি নারীবাদের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত কয়েকটি জরুরি ধারণার পারস্পরিক সম্পর্কের বিন্যাসকে পাঠ করতে চাওয়ার একটি প্রয়াস। এই প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে আসলে ‘নারীবাদ’ থেকে ‘লিঙ্গ-পরিচিতির রাজনীতি’-র দিকে একটি যাত্রা পরোক্ষভাবে লিপিবদ্ধ রইল।]

‘If gender is not to be defined by sex, nor science by nature (i.e., by what is), how then are they to be defined? In the absence of an adequate answer to this question, the difficulties that both feminist and science scholars have encountered in maintaining yet containing their necessary distinctions (between sex and gender on the one hand, and between science and nature on the other) are as familiar as they have been insurmountable.’

—Evelyn Fox Keller (The Gender/Science System: Or, Is Sex To Gender As Nature Is To Science?)

কেলারের যে প্রবন্ধ থেকে এই উক্তিটি তুলে আনা হয়েছে, সেই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল নারীবাদ ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক। এক দিকে মহিলা বৈজ্ঞানিকদের পরিচিতি বিষয়ে ‘বিজ্ঞানের’ কাঠামোগত উদাসীনতা, কিন্তু কেবল সেটাই নয়, অন্য দিকে নারীবাদী-বিজ্ঞানের মধ্যে ধারণা হিসেবে নারীর লিঙ্গ (Sex) ও লিঙ্গ-পরিচিতি (Gender)-র মধ্যেকার এক অসম বিভাজন সদা ক্রিয়াশীল। আর কেলারের মতে এই বিভাজনের সঙ্গে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে সমগোত্রীয় হল বিজ্ঞানের নিজস্ব কাঠামোগত বিভাজন (যা বিজ্ঞানের বুনিয়াদও বটে)। সেই বিভাজন হল— প্রকৃতি (Nature) ও বিজ্ঞানের (Science) মধ্যবর্তী বিভাজন। এবং বিজ্ঞানের কাঠামোগত প্রেক্ষিত থেকে যেমন এই বিভাজন একটি প্রবাদের মতন কাজ করে (বিজ্ঞান প্রকৃতির দর্পণ) তেমনি সমান্তরালভাবে, প্রায় সম-সংগঠনের যুক্তিতে লিঙ্গ-পরিচিতির প্রেক্ষিতেও নারীকে কেন্দ্র করে সমধর্মী একটি প্রবাদ কাজ করে যে, যেকোনও মানুষই জন্ম থেকে নারী নয় বরং সে নারী হয়ে ওঠে। তাহলে জন্ম নেওয়া যে দেহ— তাকে কেবলমাত্র একটা ‘লিঙ্গ’ (প্রকৃষ্ট রূপে প্রাকৃতিক দেহ) হিসেবে চিহ্নিত করে, সমস্ত নারীত্বকে পৃথক করে নেওয়া হয় পরিচয়, সামাজিকতা ইত্যাদি বেড়ে ওঠা বা গড়ে ওঠার বৃত্তের মধ্যে। যেমন প্রকৃতিও এভাবেই একটা বৈপরীত্যের সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে বিজ্ঞানের সঙ্গে— কিন্তু অবশ্যই হুবহু একভাবে নয়, একই দ্বৈতবাদী কাঠামোর রকমফের হিসেবে। কারণ সেখানে প্রকৃতিকে অনুসরণ করা, প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করার একটা ঝোঁক বিজ্ঞানের থাকে। তাই সে জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিকাঠামোয় প্রকৃতির দর্পণ হতে চায়। কিন্তু, দু’টি প্রেক্ষিতের ক্ষেত্রেই প্রতিফলন বা হুবহু এক হয়ে ওঠা এবং পার্থক্য— এ দুয়ের অবকাশ থেকে যায়। এবং এই দ্বৈতের মধ্যে দিয়ে, বা আরও বিশেষভাবে বললে, অধিবিদ্যক দ্বৈতের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞান ও লিঙ্গপরিচয়কে চিন্তা করলে জমা হয় নানাবিধ প্রশ্ন। আদৌ কি এই বিভাজন সক্রিয়? অথবা আদৌ কি প্রতিফলন সম্ভব? কেলারের আলোচনার মধ্যে দিয়ে, আসলে প্রভেদ (Difference ) নামক তাত্ত্বিক পরিসর জটিলতর বহুমাত্রিকতায় উন্মোচিত হয়। কিন্তু আবার বলে নিই, এই প্রবন্ধে সেটা উন্মোচিত হয় প্রধানত বিজ্ঞান ও নারীবাদের আন্তঃসম্পর্কের প্রেক্ষিতে, নিরিখে। যদিও আলোচনার অনুষঙ্গে উঠে আসে, অ-বিজ্ঞানের (Non-Science) প্রশ্ন কিংবা সংস্কৃতি (Culture)-র প্রশ্ন। কিন্তু আপাতভাবে অন্তত সেগুলি কেলারের প্রধান আলোচনার বিষয় নয়।

নির্দিষ্ট তথ্যে, সমস্যাপটে একটু বেশি মাত্রায় আড়ষ্ট হলেও কেলার যে জটিল সম্পর্কের সমীকরণটিকে এনে হাজির করেন, সেটার মধ্যে ভাবনার একটি স্বরাট লীলাক্ষেত্র হয়ে ওঠার তীব্র সম্ভাবনা আছে। শুধুমাত্র সম্ভাবনার আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে কেলারের বিশ্লেষণকে কি আরও সম্ভাবনাময়ী করে তোলা যায়? আমাদের আলোচনায়, আমরা সেটাই চেষ্টা করব আপাতত। ভীষণ কাঠ কাঠ ভাবে ভাঙা আছে যে জোড়গুলি সেগুলিকে খানিক ঘেঁটে দেব। তারপর দেখব কোনও অন্য মাত্রা উদ্ধার হয় কি না।

বিষয়টা যদি শুরু করি, উপস্থাপনবাদ বা নির্মিতিবাদের তর্ক দিয়ে তাহলে প্রকৃতি ও লিঙ্গ এক দিকে থাকবে আর তার অপর দিকে থাকবে বিজ্ঞান ও লিঙ্গ-পরিচিতি। কারণটা আগেই বলেছি। কিন্তু দুটো মজার বিষয় আছে এখানে—

১. লিঙ্গ, যা কিনা প্রাকৃতিক, তা এই অর্থে ‘আসল’ বা ‘আদত’ যে, ওটা পরিচিতির বা অস্তিত্বের বস্তুগত ভিত্তি। বস্তুগত সত্য। সত্যের বা বস্তুত্বের প্রসঙ্গই যদি আসে তাহলে উঠে আসে অ-পরিপ্রেক্ষিত (A-perspective) বা অ-বৈষয়িক প্রমাণের/দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন, শর্ত। অর্থাৎ তা যে আদতেই বস্তুগত বা আদতেই আদত সেটার একটা প্রমাণ যেমন সে (প্রকৃতি বা লিঙ্গ) নিজেই, তেমনি অপর দিকে ‘আদতের’ আদতত্ব বিজ্ঞানের প্রমাণনির্ভর। হ্যাঁ, একেবারেই— এই ‘প্রমাণ’ কি নির্মিতিবাদের বাইরে? না, কখনওই না— বিজ্ঞানের এই প্রমাণধর্মিতাই প্রমাণ করে যে সে একটা পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে চলে। যাকে বস্তুবাদ বলা চলে। এবং এই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই প্রমাণের মাধ্যমে সে প্রকৃতির বস্তুত্বকে প্রমাণ করে, নিজেকে তার প্রতিবিম্ব হিসেবে বস্তুবাদী সাব্যস্ত করে।

কিন্তু, আবারও সেই প্রশ্ন, এর মধ্যে দিয়ে কি আমরা বলতে পারি যে বিজ্ঞান একটি নির্মাণ নয় বা এর মধ্যে দিয়ে কি এই কথাটা মিথ্যা হয়ে যায় যে, বিজ্ঞান কখনওই প্রকৃতির দর্পণ হতে পারে না। না, কখনওই হয়ে যায় না। কিন্তু বিজ্ঞান, যা আসলে একটি বিশ্লেষণপদ্ধতি, একটি নির্মাণ করা চর্চামণ্ডল, নানা কিছু শর্তের মধ্যে দিয়ে যে আদতকে, সত্যকে, বস্তুত্বকে নিরূপণ করার চেষ্টা করছে, তা নিজেই কখনও কখনও প্রকাণ্ড সত্য হয়ে দাঁড়ায় (উদাহরণ, গোঁড়া মার্কসবাদীদের মধ্যে একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল এবং এখনও আছে, ‘মার্কসবাদ সত্য, কারণ উহা বিজ্ঞান’)। সামাজিক নির্মিতির এমন একটা প্রাকৃতিকীকরণ ঘটে যে, সে নিজেই প্রকৃতির মতো অখণ্ডনীয় অটুট এক বাস্তবতার দাবি করে বসে। এবং এর পিছনে কাজ করে তার প্রমাণ নামক হাতিয়ার।

২. এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আমাদের আলোচনার চারটি নামপদ— প্রকৃতি, বিজ্ঞান, লিঙ্গ, লিঙ্গ-পরিচিতি–র আরেকটি সমীকরণের সম্ভাবনা চিন্তা করা যেতে পারে, যেখানে প্রকৃতি, বিজ্ঞান ও লিঙ্গ এক দিকে আর লিঙ্গ-পরিচিতি উলটো দিকে। অর্থাৎ একদিক থেকে মনে করা যেতে পারে যে, এদের মধ্যে একমাত্র লিঙ্গ-পরিচিতিই নির্মাণবাদের মধ্যে, সামাজিক নির্মিতির যথাযথ অংশে বিচরণ করে। কারণ লিঙ্গপরিচয় জন্মগত নয়, প্রাকৃতিক নয়, আবার বৈজ্ঞানিক প্রমাণের দৃঢ়তাও যেন তার নেই। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, সামাজিক নির্মিতির মধ্যে দিয়ে প্রায় যেন একটা ছদ্ম-বিজ্ঞানের মতো করেই লিঙ্গ-পরিচিতি ক্রিয়া করে। তাই সত্যতা বা বাস্তবতা বা প্রাকৃতিকীকরণ— মার্কসীয় পরিভাষায় একরকম যাকে রিইফিকেশন-ও বলতে পারি— লিঙ্গ-পরিচিতির মধ্যেও বিজ্ঞানের মতোই ক্রিয়াশীল। তথাপি কেলারের সমীকরণটিকে একেবারে মুছে ফেলা যায় কি? নির্মিতিবাদের মধ্যে এক রকমের প্রাকৃতিকীকরণের মাত্রা সবসময়ই থাকে, তাতে করে কি আমরা প্রকৃতির দর্পণ বলতে পারি বিজ্ঞানকে? অথবা, লিঙ্গ আর লিঙ্গ-পরিচিতিকে কি এক বলতে পারি? একরোখা কোনও উত্তর যে সম্ভব নয়, কেলারের সমগ্র আলোচনাই তার প্রমাণ।

কিন্তু এই বিভেদকে আমরা আরও কিছু মাত্রার মধ্যে রেখে পাঠ করার চেষ্টা করব। সম্ভাবনাগুলি আলোচনার, অনুমানের ক্ষেত্র হিসেবে আমরা বেছে নেব কমলকুমারের একটি গল্প যা প্রকৃতি, বিজ্ঞান, লিঙ্গ, লিঙ্গ-পরিচিতির রাজনীতির প্রশ্নগুলিকে সন্তর্পণে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে। কমলকুমারের গল্পে লিঙ্গ-পরিচিতির রাজনীতির কথা উঠলেই স্বাভাবিকভাবে মনে পড়তে পারে ‘মল্লিকা বাহার’ গল্পের কথা, কিন্তু আমরা বেছে নেব তাঁর অন্য আরেকটি গল্প— ‘আমোদ বোষ্টুমী’।

কমলকুমার মজুমদারের মৃত্যুর পর, ১৯৮৮ সালের দেশ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় ‘আমোদ বোষ্টুমী’ নামে তাঁর এই ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। ‘আমোদ বোষ্টুমী’ গল্পটি মূলত চারটি পর্যায়ে বিভক্ত— প্রথম পর্যায়ে আছে একটি ছোট্ট সংসার এবং তার ছোট্ট ঘরোয়া অতীতের বিবরণ ও একটি বাড়ির চিত্র। গোরাচাঁদ, গোরাচাঁদের ঠাকুমা এবং তাদের বাড়ির পরিচারিকা আমোদিনীর সংসার। গোরাচাঁদ পিতামাতৃহীন, বাড়ির গিন্নি-মা অর্থাৎ গোরাচাঁদের ঠাকুমা বৃদ্ধা, তাঁর মাথায় সংসারের দায়িত্ব। আর আমোদিনী, যে এই সংসারের হাল ধরে আছে, তার মা ছিল এই বাড়ির পরিচারিকা, তখন থেকেই আমোদিনী/আমোদ এই বাড়িতে, এই বাড়ির একজন হয়ে আছে। বাড়ির বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গেই কথক খবর দিয়ে যায় একটি সম্পর্কেরও— গোরা ও আমোদের সম্পর্ক। এই দুই জনের মধ্যেকার অকথিত, অস্বীকৃত, অনুদ্ঘাটিত, নামহীন ভালবাসার কথা বিশেষ বিশেষ করে দাগিয়ে দেয় কথক। দ্বিতীয় পর্যায়ে গল্পে আসে গোরাচাঁদের অন্যত্র বিবাহের প্রসঙ্গে কথাবার্তা এবং সেই সূত্রে বা তারই প্রতিক্রিয়ায়, আমোদিনীর মানসিক পরিবর্তনের প্রশ্ন। উদাসীন ও অবসাদে উন্মাদিনী হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ। তৃতীয় পর্যায়ে, আমোদিনীর উন্মাদনা জনসমক্ষে উন্মোচিত হতে থাকে; সকলে ভাবে আমোদিনীর বাতাস লেগেছে, তার ঝাড়ফুঁক প্রয়োজন, তাই আমোদিনীকে ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁক করানো হয় কিন্তু গোরাচাঁদের কাছে এসব কিছুই বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে না, আবার অবিশ্বাসও সে পুরোপুরি করতে পারে না। গোরার কাছে আমোদিনী কেবলই অপরিচিত হতে থাকে, দূরে সরে যেতে থাকে। ভালবাসার যে আগমনী চিহ্নগুলি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল গল্পের প্রথম অংশে, সেই চিহ্নগুলি গল্পের এই অংশে এসে সংকটের মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। সাহিত্যিক কারুকাজ ক্রমশ বাড়তে থাকে গল্পের চৌহদ্দি জুড়ে, আর নানা কিছু চিত্রকল্প ও নৈঃশব্দ্যের আড়ালে ধীরে ধীরে যেন কাহিনির রাগমোচনের দিকে ধেয়ে যেতে থাকে সন্তর্পণে। চতুর্থ পর্যায়ে এসে আমোদিনী যেন গোরার কাছে হঠাৎ অন্ধকারে কুহক হয়ে ওঠে, আমোদিনী গোরার কাছে স্বীকার করে যে সে ভালবাসে গোরাকে, আর কাহিনির এখানেই লয় হয়। কমলকুমারের সুসংহত করণকৌশল গল্পটির মধ্যে মধ্যে অসামান্য কিছু টুকরো টুকরো মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে আর সেইসঙ্গে এসেছে নজিরবিহীন অনেকগুলি উপমা।

গল্পে আমোদিনীর আগমন ঘটে একটি দেহ-বর্ণনার মধ্যে দিয়ে—

আমোদিনী অল্পবয়সী তবু সোমত্ত, স্ফীত, গর্বিত; দশাসই তার চেহারা। দুই হাত দিয়ে চুলগুলি ছড়িয়ে ছড়িয়ে আরাম অনুভব করে, ময়লাটে কাপড়ের পাথুরে ভাঁজে রোদ রেগে রেগে আছে, বুকের কাছে রোদ আরও বদরাগী, এ কারণে যে তার সুঠাম হাত দুটি ওঠানামা করে। মুখে একটা থিতু হাসির রেখা। মুখ কাত করে ঘাড়ের কাছে আঙুল চালায়, দুটো চুল হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলে। একবার সে চুলের থোক করে শুঁকলে আবার এলো করে দিলে।

যৌনতা এবং লিঙ্গ এই দুটি শব্দই ইংরেজি ‘Sex’ শব্দের তরজমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমোদের দেহ যখন গল্পে বর্ণিত হয়, তখন তার মধ্যে যৌনতার ইঙ্গিত যেমন এক দিকে লুকিয়ে থাকে তেমনি যৌনতা, যা যৌন-বিভাজনের ভিত্তিতে ধারণাযোগ্য হয়ে ওঠে— তা যেন অস্তিত্বের বা বলা চলে ‘থাকা’-র একটা আবশ্যিক অসচেতন শর্ত হিসেবে ফুটে উঠতে থাকে। কারণ গল্পে, আমোদিনীর দেহের প্রসঙ্গ নানা ছুতোয় ঘুরে ঘুরে আসে, এমনভাবে আসে যেন তা একটি চটি সাহিত্যের বয়ান কাঠামোকে কোথাও কোথাও নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে থাকে। এই বয়ান যে নিশ্চিতভাবে যৌনাঙ্গনির্দেশক তা নয়। চটি সাহিত্য বা পর্নোগ্রাফি সাহিত্যের বয়ানে পরিচিত কিছু উপমান ও উপমেয় দেহপ্রসঙ্গগুলিতে আসে আর মিলিয়ে যায়। কিন্তু সেরকম প্রসঙ্গ যদি কোনও সাহিত্যে আসে তাহলেই কি আমরা তাকে পর্নোগ্রাফির বয়ানকাঠামোর সঙ্গে তুলনা করতে পারি? আমার মনে হয়, না, কারণ একটা সাহিত্যের সেক্সিস্ট হওয়ার অনেক ধরনের অবকাশ থাকতে পারে, কিন্তু তা পর্নোগ্রাফি হয়ে ওঠার জন্য কিছু বিশেষত্ব আলাদা করে থাকা প্রয়োজন, যেটা সব যৌনকাহিনির মধ্যে থাকে না। তবু এই তুলনা চলতে পারে, সাহিত্যভাষার, সাহিত্যের করণকৌশলে পর্নোগ্রাফি সাহিত্যের কোনও ভূমিকা নেই— এ কথা একেবারেই বলা যায় না। এবং শুধুমাত্র কাহিনির কাঠামো দিয়ে এ দুইয়ের মধ্যে তুলনা করা চলে না। বাক্যের ভঙ্গিমায়, সাহিত্যিক আয়ুধের ব্যবহার, তার প্রেক্ষিত— এইসবের দিক দিয়েও তুলনার অবকাশ তৈরি হয়। যেমন একটি বাক্য—

ও মাসি কি গো দুধ গরম করিনি ও কপাল, বলেই গালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে ভঙ্গি সহকারে দাঁড়াল।

অথবা আমোদিনীর প্রসঙ্গে—

ছাইগাদার সামনে বসে হাঁটুটা বার করে আমোদ বাসুন মাজছে।

বাক্যগুলি কি কেবল চটি সাহিত্যের মতো যৌনাঙ্গনির্ভর উপমা বা বর্ণনার দিকে সরে গেছে? না। কাঠামোগতভাবে কি এখানে কোনও যৌনতার প্রচ্ছন্ন প্রেক্ষিত আছে? আলাদা করে নয়। তেমন প্রেক্ষিত বয়ানের আধিপত্যশীলতার মধ্যে এমনিতেই আছে। এই বাক্যগুলির ভিতর নতুন করে নেই। কিন্তু যৌনসাহিত্যের বা সাহিত্যে যৌনতার একটা ঐতিহাসিক উপাদানের কথা যদি আমরা মনে করি তাহলে আমাদের মনে পড়বে, নাটকীয়তা কিন্তু সাহিত্যে যৌনতাকে ফুটিয়ে তোলার অন্যতম মাধ্যম ছিল এবং বলা বাহুল্য বাংলা সাহিত্যে যৌনতার ও অশ্লীলতার বিরাট একটি ধারা উনিশ শতকের নাটক, প্রহসন প্রভৃতি উপস্থাপনামূলক (Performance অর্থে ) শিল্পচর্চার মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখানে আমোদের একটি নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়ানোর কথা বলা হচ্ছে, যেটাকে টুকরো করে ছিঁড়ে নিয়ে পড়লে আলাদা করে কোনও যৌনতার ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া হয়তো সম্ভবও না। কিন্তু গল্পের প্রেক্ষিতে যেখানে আমোদের চরিত্র/চিত্র-কে কথক বিন্দু বিন্দু ভঙ্গি, অবয়ব, ঝোঁক, শব্দ-নৈঃশব্দ্য দিয়ে গড়ছেন সেখানে এমন একটি নাটকীয় ভঙ্গিমার চিত্র নির্মাণ যেন একটি যৌন-ছোঁয়া এনে দিতে পারে— এমনভাবেই তাকে গড়া হয়েছে বলে মনে করা যায়। কিন্তু আগেই বললাম একটি দেহভঙ্গি ছাড়া, নাটকীয় একটি ভঙ্গিমা ছাড়া কৌশলগতভাবে এই বাক্যগুলিতে আর কিছুই রাখা হয়নি। দেহভঙ্গিমার ব্যঞ্জনায় আমোদ যেন একটি ব্যঙ্গ ছুড়ে দেয়। সাহিত্যের চৌহদ্দিতে, ভাষার চৌহদ্দিতে আদত দেহ কি পাওয়া সম্ভব? দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম পর পর বসিয়ে গেলেও একটি বাক্যে দেহের কিছুই ধরা যায় না, বোঝা যায় না। কারণ, ভাষার পরিসরের মধ্যে দিয়ে দেহ সর্বদাই বাঁকা পথে হারিয়ে যাওয়া এক উদ্বৃত্ত, বয়ানের সদর্থক অর্থপ্রক্রিয়াকে অকৃতকার্য না করে, ভাষা-বয়ান-সাহিত্যের মধ্যে থেকে দেহকে কীভাবে নির্দেশ করা সম্ভব? সম্ভব নয়, সাহিত্যের তামাম ‘বক্রোক্তি’ তাই বাঁকা পথে অর্থগামী পথগুলিকে হারিয়ে ফেলতে ফেলতেই অসম্ভাব্যতার দিকে ধেয়ে যায়। এবং এই সসম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটাই হয়তো ক্রিয়াশীল হতে পারে, বিশ্লেষণের সীমানাকে ঠেলতে ঠেলতে অথচ অপরিহার্য বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই। এ প্রসঙ্গে গল্প থেকে একটি অংশ তুলে ধরা যাক, কমলকুমারের লেখা নিয়ে আলোচনা করতে নামলে খুব স্বাভাবিকভাবেই জায়গায় জায়গায় কেবল তারিফ করে, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না, কিন্তু একইসঙ্গে যে-পঙ্‌ক্তি উদ্ধার করে আনব তা অবশ্যই গল্পের দেহদর্শনের বহুমাত্রিকতাকে প্রকট করে তুলেছে, যে-দর্শনের বিশ্লেষণ নিয়েই আমরা কথা বলছিলাম—

এমন কতবার হয়েছে সিঁড়ি উঠতে উঠতে হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে দেখে নিচে, বিরাট দেহের পিছনের অংশ পিঠে হাতের শেষে নেবুর কোয়ার মত পেশী, চমৎকার লম্বা ঘাড় সেখানে রোঁয়া পাক দেওয়া চুল কাঁধে নেমে এসেছে বেঁকে ছোট হাড়ে এসে শেষ সুন্দর পদদ্বয় উপর, গুরুনিতম্ব। ধনুকের মত বেঁকে উঠে গেছে মেরুদণ্ডের সোঁতা। বস্ত্রহরণে এমন ছবি সে দেখেছে, এই উলঙ্গ দেহটা যেন নগ্নতার আড়াল আবরণ, তবু পলকে দেখে সে চোখ ফিরিয়েছে।

নগ্নতা নিয়ে একটি অদ্ভুত বক্রোক্তি, উলটপুরাণ— উলঙ্গ দেহ যেন নগ্নতার আড়াল-আবরণ। কী করে? আর বস্ত্রহরণের প্রসঙ্গ আসার ফলে কি এখানে মহাভারতীয় কোনও অতিলৌকিক প্রসঙ্গ এসে একটি দার্শনিক মূল্য যোগ করতে চাইছে? থিয়োলজির সঙ্গে দর্শনের সম্পর্ক নিয়ে এখানে অনেকগুলি কথাই প্রশ্নাকারে উঠে আসতে পারে, কমলকুমারের লেখায় সেসব প্রশ্ন সবখানেই, কিন্তু এখানে বরং আরেকটি অন্য মাত্রা আছে। উলঙ্গ দেহ যা নিজেই নগ্নতার প্রতীক বা চিহ্ন, তা নিজেই যেন আবার নগ্নতার আবরণও বটে। নগ্নতা তাহলে কী? এমন কিছু যা দেহকে দেহ হিসেবে দেখার মধ্যে একেবারেই নেই, তা আছে দেহকে দেহ-অতিরিক্ত কিছু ভাবার মধ্যে, অর্থাৎ একরকমভাবে নগ্নতা আছে কামনার মধ্যে, উপস্থাপনার মধ্যে, নির্মাণের মধ্যে। বস্ত্রের সঙ্গে ফারাক না করলে নগ্নতা আসে না। উলঙ্গ দেহ নগ্ন নয়, নগ্নতার আবরণ মাত্র, সেই আবরণকে উন্মোচন করা সম্ভব একমাত্র সেই দেহকে কামনার দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে নির্মাণ করার মাধ্যমে। এই নির্মিতির মধ্যে আছে দেহ-অতিরিক্ত কিছু, এমন কিছু যা সম্পূর্ণ দেহের বাইরেও নয় আবার ‘দেহজ’— এ কথাও আমরা বলতে পারি না।

তাহলে, যৌনতা এবং দেহ— যা সর্বদাই লিঙ্গের সঙ্গে একটা সংযোগ রেখে চলেছে— তাদের মধ্যেকার এক রকমের সম্পর্ক-সমীকরণে আমোদিনী একটি চরিত্র হিসেবে, পরিচয় হিসেবে ফুটে উঠছে এবং গল্পের গতি ধরে একটু একটু করে এগিয়ে চলছে। পরিচয়ের প্রশ্নটা তাহলে সাহিত্যের ক্ষেত্রে বা যেকোনও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে (Representation অর্থে) সর্বদাই এক রকমের নির্মিতিবাদের কাঠামোর বা আরও পরিষ্কার করে বললে সামাজিক নির্মাণের সক্রিয় সংযোজনা থাকে। এই গল্পে যৌনতা, লিঙ্গের পাশাপাশি আসে প্রকৃতির ধারণাটি। যেন প্রায় একইসঙ্গে, একই পরিধির মধ্যে। এবং এখানে প্রকৃতির প্রসঙ্গ যেভাবে আসে, তাতে করে আবার একটি ধন্দ উপস্থিত হয়। কারণ এ গল্পে প্রকৃতির একটি উপমা এসেছে ‘বাতাস’ প্রসঙ্গে। বাতাস লাগা অর্থাৎ একরকম মানসিক ব্যাধি, কিংবা কামজাত অবসাদ, হীনমন্যতা, রাগ, অভিমান, বিষাদ। এই সকলই ‘বাতাস লাগা’ শব্দটার কাছে গিয়ে জমা হয়েছে। বাতাস কি আদৌ এখানে তেমন কোনও ‘আদত’, ‘প্রাকৃতিক’, ‘দেহজ’ কিছু? না বাতাস এখানে ‘মানসিক’? কিন্তু প্রকৃতির একটি উপমা যেন এখানে নির্মাণের অংশ হিসেবে ক্রিয়াশীল। অর্থাৎ বিজ্ঞান ও প্রকৃতির বিভাজনে আমরা যেখানে প্রকৃতিকে আবশ্যিকভাবে ভাবছিলাম আদত বস্তুর খোপের ভিতর, এক্ষেত্রে কিন্তু সে তেমন বস্তুসুলভ একেবারেই নয়। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজনীয়, কথাটা আমরা আগেও বলেছিলাম, সংস্কৃতি। কেলারের প্রবন্ধে প্রকৃতির বিপরীতে এসেছে বিজ্ঞান, কিন্তু সেখানে কি বিপরীত শব্দ হিসেবে সংস্কৃতির কোনও স্থান নেই? অর্থাৎ, এখানে জিনিসটা যদি কতকটা এরকম ভাবি যে— বিজ্ঞান যার নিজের চর্যা বস্তুবাদ, আর প্রকৃতি যা নিজেই বস্তু— তাদের বিপরীতে তো তাহলে সংস্কৃতিকে সবসময়েই রাখতে পারি, যা স্বভাবতই বিষয়ী-আশ্রয়ী। সেক্ষেত্রে আবার প্রকৃতি ও তার প্রতিবিম্বরূপী বিজ্ঞান একই খোপে ঢুকবে। কিন্তু যখনই প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের বৈপরীত্যের কথা আমরা ভাবছি (কেলারের মতো), তখনই যেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নির্মাণপ্রক্রিয়ার ভিতরের খোপেই ঢুকে আসছে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি, উভয়েরই যেন একপ্রকার গড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য আছে। সংস্কৃতির ভঙ্গি হয়তো পরিপ্রেক্ষিতনির্ভর আর বিজ্ঞানের হয়তো অ-পরিপ্রেক্ষিতনির্ভর। কিন্তু একইসঙ্গে মনে রাখা দরকার, বিজ্ঞানের অ-পরিপ্রেক্ষিতের ভঙ্গিমা একটি চর্চামণ্ডলীয় শর্ত, এটি আলাদা করে কোনও বৈজ্ঞানিক সত্যতা দাবি করতে পারে না, অর্থাৎ বিজ্ঞান কখনওই সম্পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিতহীন হতে পারে না। আবার গল্পের একটি অংশ যেখানে আমোদের অসুস্থতা জনসমক্ষে ধরা পড়েছে, সকলেই জেনেছে যে আমোদের বাতাস লেগেছে তাই আমোদ উন্মাদিনী, এমতাবস্থায় কথক আমোদ ও গোরার দিক থেকে ‘বাতাস’ নামক রোগটি কীভাবে গৃহীত হচ্ছে তার খবর দিচ্ছে—

বাতাস কথাটা আমোদকে বাঁচাল, সে নিজেই বুঝে পাচ্ছিল না সে এখন কি? এতদিনকার ঘনিয়ে ওঠা মনটা তার উপর থেকে যায়নি, সেটাও ছিল। এখন বাতাস কথাটা হল তার নিশ্চিন্ত আড়াল। তাকে আর কেউ অন্য চোখে দেখতে চাইবেনা।

গোরা যে কাকে একথা জিজ্ঞাসা করবে তা সে বুঝে উঠতে পারছিল না। শেষে ভেবে দেখলে অঙ্কের ছোকরা মাস্টার ব্রজবাবু— তার কথা পরিষ্কার যুক্তিযুক্ত।

“বাতাস বলে কিছু নেই…”

“তবে ওটা কি?”

“মনে হয় মানসিক ব্যাধি— ভাবতে ভাবতে যেমন লোকে পাগল হয়ে যায়।”

“পাগল হতে পারে?”

“নাও হতে পারে তবে কুসংস্কারে বিশ্বাস করো না, যে কথা সে বলতে পাচ্ছেনা, আমরাও জানতে চাইছিনা, ফলে একাই সে গুমরে মরছে… ওদিকে মন দিওনা তুমি, আর কটা দিন বাদেই এক্‌জামিন !’’

এখানেই আরেকটি পরিসর উন্মোচিত হল, যাকে আমরা বলতে পারি সংস্কার, যা সংস্কৃতিরই অঙ্গ এক দিকে, আবার অন্য দিকে অ-বিজ্ঞানও বটে। অ-বিজ্ঞান বা অ-বৈজ্ঞানিকের একটি প্রসঙ্গ যদিও কেলারের লেখাতেও এসেছে—

Another demarcation is also operative here— I would even say, primary: namely the demarcation between science and non-science, potentially at least as exclusionary as that between men and women.

নাপিতিনী তার লৌকিক বিজ্ঞান বা অ-বিজ্ঞানের সাহায্যে যে বাতাস-রোগের খবর নিয়ে এল, অঙ্কের ছোকরা মাস্টার ‘বিজ্ঞান’ দিয়ে সেটাকে মনের রোগ হিসেবে নির্দেশ করল। এখানে মজার একটা বিষয়, মনের রোগ বা মনোবিকলনের চৌহদ্দি কি আদৌ বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাশাস্ত্রের চৌহদ্দি? Pseudo-science বলে মনঃসমীক্ষণের একটি পুরনো কুখ্যাতি আছে। মনঃসমীক্ষণকে মোটামুটি বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাশাস্ত্রের এক রকমের সীমানা বলা চলে, যেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে আত্মনির্ভরশীল নয় আরও নানান তথাকথিত ‘অ-বৈজ্ঞানিক’ জিনিসের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সম্পর্ক তৈরি হয়ে থাকে। তাহলে, গল্পে ‘বাতাস’ যেমন এক দিক থেকে কু-সংস্কার, অ-বিজ্ঞান তেমনি অন্য দিকে বাতাস একটি রহস্যও বটে, (বি)জ্ঞানের সীমানায় যে রহস্য দোদুল্যমান। ‘বাতাস লাগা’র মধ্যে একটি নিতান্ত প্রাকৃতিক অবয়ব আছে— কিন্তু বাতাস একইসঙ্গে এখানে উপমাও বটে। আমোদের দেহটার একরকম প্রাকৃতিকীকরণ হয়ে যাচ্ছে ‘বাতাস লাগা’ নামক ঘটনাটির মধ্যে দিয়েই। কিন্তু এই প্রাকৃতিকীকরণ কি দেহের Ontological বা সত্তাগত যে প্রাকৃতিক অস্তিত্বের কথা ভাবা হয় তার সঙ্গে হুবহু এক? না, নয়। এই প্রাকৃতিক যেন একটা সাংস্কৃতিক বয়ান, একটা নির্মাণ। কিন্তু এই ‘বাতাস’ই আবার এমন এক উপমা যা আমোদের সমগ্র থাকাটাকেই রহস্যময় করে তুলছে। গোরার কাছে আমোদের দেহকে প্রকট রহস্যে নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে। কিন্তু সামাজিক নির্মিতির মধ্যে দিয়ে নারীর যে সর্বাঙ্গীণ থাকা, আধিপত্যশীল, প্রজননকেন্দ্রিক বিসমকামের নিয়ম-কানুনের মধ্যে পরিচিতির সংকটের মধ্যে টিকে থাকা— সেটা কি এইরকম কোনও রহস্যজনক উপমা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতে পারে? ডাইনিদের, ভূতে ভর করা নারীদের ধর্ম-কুসংস্কারের নামে যে নির্মম অত্যাচারের ইতিহাস, পুং-প্রতাপের ইতিহাস, তা কীভাবে নারীর লিঙ্গপরিচয়কে কেবলমাত্র একটি দুষ্ট আত্মায় এনে বন্দি করেছে, কীভাবে বাতিল হয়ে গেছে দেহের উপকথাগুলি, সেসব আমাদের অজানা নয়। সুতরাং ‘বাতাস লাগা’র মতো একটা সস্তা সংস্কারকে মারাত্মক উদার বা বৈপ্লবিক বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। সেদিক থেকে এ বিষয়ে আর নতুন কিছু বলারও নেই। কিন্তু আমি বলতে চাইছি একটি রহস্যের কথা, যা নারীসংক্রান্ত জ্ঞানকে একটা সীমানায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়। গল্পটির বয়ানের মধ্যেই, অসচেতনভাবেই তথাকথিত অ-বিজ্ঞান এমন একটি ভূমিকা পালন করে, যেখানে আমোদের দেহ ঘিরে গোরার কাছে একটা রহস্য তৈরি হয়, যে-রহস্য যেন-বা এক রকমের জ্ঞানের সীমানা। এবং মজার বিষয়, দেখা যায় যে, এখানে অ-বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান উভয়েরই প্রকৃতির সঙ্গে এক রকমের সম্পর্ক আছে; এক দিকে বিজ্ঞান, যে প্রাকৃতিক একটি দেহের হুবহু প্রতিবিম্ব নির্ণয়ের প্রচেষ্টা করছে, আদত জিনিসটাকে বুঝতে চাইছে, আর অন্য দিকে অ-বিজ্ঞান, প্রকৃতির প্রতিবিম্ব একেবারেই গড়তে দিতে চাইছে না, প্রকৃতিকে দুমড়ে-মুচড়ে উপমা বানিয়ে দিচ্ছে। চিহ্নের বাস্তবতা নির্মাণ করছে। এটাকেই উলটো করে বললে বলা যায় যে, প্রকৃতি যেন-বা এক দিকে একটি আদত মানসিক রোগের বয়ান দিচ্ছে, অন্য দিকে তান্ত্রিক অ-বিজ্ঞানের চেহারায় নিজেকে প্রকাশ করছে। এই দ্বিবিধ চরিত্র কি বিজ্ঞানের থাকবে? না, থাকতে পারে না, কিন্তু বিজ্ঞান আবার সমসময়েই মুক্ত একটি চর্চামণ্ডল। ভবিষ্যতে যে সে অ-বিজ্ঞানকেও নিজের মধ্যে আস্তে আস্তে নিজের মতো করে জায়গা করে দেবে না, সে কথা কে বলতে পারে? কিন্তু প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের সম্পর্কটা যে একেবারেই নিছক প্রতিবিম্ব কখনও হতে পারে না সেটা আমরা এর মধ্যে থেকেই বুঝতে পারি।

এবং অ-বিজ্ঞানের এই মাত্রাটির সঙ্গে গল্পে উঠে আসে আদিমতার প্রসঙ্গ। নারীর পরিচিতি নির্মাণের ক্ষেত্রে মূলত আদিমতার প্রসঙ্গ বার বার এসেছে ভীষণই আধিপত্যশীল বয়ানে, সেখানে নারী যেন কেবলই রহস্যময়ী, কারণ সে পুরুষের কামনার নানা রহস্যকে উদ্ঘাটন করে। কিন্তু পুরুষের কামনার মধ্যে দিয়েই কেন সেই রহস্য গড়ে উঠবে সেটা ভীষণ জরুরি এবং অপরিহার্য একটা প্রশ্ন। জ্ঞান, যা স্থির, নিশ্চিত ‘উপস্থিতি’র বিশ্বকে ধরে তার নিজের পরিধিকে মাপতে থাকে, তা যখন ‘অনুপস্থিতি’র সম্মুখে এসে দাঁড়ায়, তখন এই সংঘাত অবশ্যম্ভাবী এবং এই সংঘাত থেকেই যেন একরকম করে, বৈজ্ঞানিক আখ্যানের কাঠামোকে চিনে নেওয়া যায়। তথাপি এ কথা অনস্বীকার্য যে, জ্ঞেয় যুক্তি ভিন্ন বিশ্লেষণের কার্য অসমাপ্ত থেকে যায়।

এক অন্ধকার, যা মৃত্যুসম, যার পূর্ণ অনুপস্থিতি দেহজ্ঞানের পরিচিতির সীমানাকে, আপন সসীমতা সম্বন্ধে বারংবার সচেতন করতে থাকে। কিন্তু মৃত্যু নয়, দৈনন্দিন সময় থেকে যেন একটা আদিম অপরিচিত সময়ের মধ্যে গিয়ে পড়া। এমন মুহূর্ত, যেখানে দেহ বাসনার অতিরিক্ত কিছু, রমণের অতিরিক্ত কিছু, এমন এক সময়গ্রাসী অন্ধকার যা নারীদেহের মধ্যে দিয়ে যেন মৃত্যু-মধ্যস্থিত ‘না-থাকা’কে উদ্ঘাটন করতে চায়; গল্পের শেষের অংশে কমলকুমার এমনই একটি উন্মাদ মুহূর্তকে লেখেন। আমোদের ‘বাতাস লাগা’র বিকারকে পরিস্ফুট করে তোলেন বর্ণনায়—

এই তার নতুন রক্তের ঢল। তার বুকটা কঁকিয়ে উঠেছে, শলাকাবিদ্ধ শুয়োরের মত। ধোপাপাড়ার মাঠে দোসাদরা যখন শুয়োর মারত সে কি সারারাতভর তাদের অসম্ভব আর্তনাদ!… এ আর্তনাদকে আঁকড়ে সে বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি। কোথায় তার জোর, সে আরক্ত!… স্নানযাত্রার দিন। ট্রাঙ্ক রোডের উপর— চাপা-পড়া কুকুরের চাহনিও তার মনে আছে, আয়ত চোখে তার ওই ছোট চোখের কাতর চাহনি উপচে পড়েছিল। কিন্তু সে অন্ধকার থেকে যখন, গোরা নামক বস্তুর দিকে চেয়ে থাকে তখন নয়। কখন-কখন অন্যমনে যখন আলোর দিকে, নিরিবিলি দৃশ্যের দিকে চেয়ে থাকে… যে রমণী পাথরের অন্ধকার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে থাকে, হাড়-চিবোনোর লোভ যার, দাঁত নখ বড় করে সে কখন তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে… কাতর মেঘলায় চেয়ে থাকে কে সরষে-পোড়াটা দিয়ে কুলোর বাতাস দিয়ে ঝেঁটিয়ে যেন বার করে দিয়েছে— ছেঁড়া জুতো মুখে করে চলে যাচ্ছে সে… আমোদ শিউরে ওঠে… প্রিয়জনকে না পেলে যারা গলায় দড়ি দেয়, আগুনে পোড়ে, পুড়ে পুড়ে খণ্ডিত চুলে সিঁড়ি দিয়ে হাওয়ায় গড়াতে নামে যারা, তাদেরই অন্য পিঠ সে। অন্তরঙ্গতাকে লুটিয়ে দিয়েছে, দিয়ে বীরের মত দাঁড়িয়ে দম নিচ্ছে… ইদানীং তার পশু স্বাভাবিক রোমশ দেহটা কে যেন ক্রমাগত করকরে জিহ্বা দিয়ে লেহন করে অব্যক্ত দন্তহীন মাড়ি দিয়ে কামড়ায়। নিজেকে মনে হয় ডাইনীর মত। কোন ভয় নেই— ঝোপঝাড়ে অন্ধকারে রাতের এলো চুলে সে এটা ছেঁড়ে ওটা তোলে। গাছ পাতা লতা গ্রন্থের বাক্য হয়ে উঠতে চায়। কুম্ভক হলে যেমন বুকটা হয়ে থাকে, কাঁপে, তেমনি কেঁপেছিল অযথা কেন না, পাপ বিরাট ধুনীর মত নিজের রক্তকে ঘোলা করে, বোধশক্তিকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলে। চুল তার উড়ছে, শীত গ্রীষ্ম বোধ নেই, কাপড় এলোমেলো— শেষ নৈতিকতা খসে যেতে চায়, সে উলঙ্গ হয়ে যাক আদিম হয়ে যাক।

হ্যাঁ, আদিম সময়ের একটা সম্ভাব্য নৈতিকতা বা ‘নীতিবোধ’-হীনতাকে আধুনিক একটা মননের মধ্যে জাগিয়ে তোলা, সন্ধান করা— আধুনিকতাবাদের ধরন। আদিমতার সঙ্গে মনোবিকলনের যে কাঠামোগত সম্বন্ধ, যে মানুষের মনের বিকার, মানুষের নির্জ্ঞানকে যত বেশি উলঙ্গ করে নানাবিধ অস্বাভাবিকতার চিহ্ন আঁকে— তত বেশি করে মানুষের মধ্যে যেন তার আদিম, অকৃত্রিম সেই আসল মনটা জেগে ওঠে বা বলা চলে মনের উৎস জেগে ওঠে। হ্যাঁ, এই যুক্তির মধ্যে দিয়েই আদিমতা ও মনোবিকলন (মূলত ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন) পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে বারংবার। কোনওরকমভাবেই ফ্রয়েডীয় বলে দাগিয়ে দিতে চাই না, ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনসম্মত সাহিত্য বলে পৃথিবীতে কিছু আছে বলেও মানি না, একটা লেখা/গ্রন্থনা পাঠের মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ কিছু হয়ে ওঠে— সাহিত্যের এর চেয়ে সহজ কোনও চিত্র আমি পাইনি কোনওদিন। যাই হোক আদিমতার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুরঙ্গ উপন্যাসে জনপ্রিয় একটি অনুচ্ছেদের কথা এ প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে (তবে বলে রাখি, মনোবিকলন বিষয়ে চতুরঙ্গ উপন্যাসেরও একটা চোরা ব্যঙ্গ আছে: ‘… অভাবনীয় পরিহাসে মনোবিজ্ঞানকে ফাঁকি দিবার জন্যই মনের সৃষ্টি’)—

এক সময়ে সেই তন্দ্রাবেশের ঘোরে আমার পায়ের কাছে প্রথমে একটা ঘন নিশ্বাস অনুভব করিলাম। ভয়ে আমার শরীর হিম হইয়া গেল। সেই আদিম জন্তুটা!

তার পরে কিসে আমার পা জড়াইয়া ধরিল। প্রথমে ভাবিলাম কোনও একটা বুনো জন্তু। কিন্তু তাদের গায়ে তো রোঁয়া আছে— এর রোঁয়া নাই। আমার সমস্ত শরীর যেন কিঞ্চিৎ হইয়া উঠিল। মনে হইল একটা সাপের মতো জন্তু তাহাকে চিনি না। তার কি রকম মুণ্ড, কি রকম গা, কি রকম ল্যাজ কিছুই জানা নাই— তার গ্রাস করিবার প্রণালীটা কি ভাবিয়া পাইলাম না। সে এমন নরম বলিয়াই এমন বীভৎস, সেই ক্ষুধার পুঞ্জ!

ভয়ে ঘৃণায় আমার কণ্ঠ রোধ হইয়া গেল। আমি দুই পা দিয়ে তাহাকে ঠেলিতে লাগিলাম। মনে হইল সে আমার পায়ের উপর মুখ রাখিয়াছে— ঘন ঘন নিশ্বাস পড়িতেছে— সে যে কি রকম মুখ জানি না। আমি পা ছুঁড়িয়া লাথি মারিলাম।

আদিমতার সুস্পষ্ট উদাহরণ আরও বহু পাওয়া যাবে বাংলা সাহিত্যে— বিশ্ব সাহিত্যের তো কথাই নেই। এমনকী জগদীশ গুপ্তের কথা মাথায় রেখেও বলছি, আদিমতার উপাদান নিয়ে খুব কম বাংলা লেখকই আদিমতার উৎসকেন্দ্রিক বা গর্ভকেন্দ্রিক সন্দর্ভকে অতিক্রম করে দেহের দর্শন নিয়ে কথা বলতে পেরেছেন। কিন্তু তেমন উদাহরণ যে নেই তা-ও বলা যায় না, তেমন ধারার পাঠও বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে বিরল। কিন্তু জগদীশ গুপ্ত বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতন লেখকদের কলমে, আদিমতার প্রতি তথাকথিত সভ্য-চৈতন্য তেমন কোনও লাথি ছুড়ে দেয়নি। নৈতিক উদারতা যাকে আমরা বলি, বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের নানান ওঠা-পড়ার মধ্যে সেই উদারতা, ভাল-মন্দের দ্বন্দ্বকে সুস্পষ্টভাবে পেরিয়ে এসেছে। রবীন্দ্রনাথে যে-দ্বন্দ্ব ছিল একটি অস্তিত্বের সংকটতুল্য, প্রকাণ্ড একটি সংঘাত, পরবর্তীকালের তাবড় লেখকদের হাতে তা দৈনন্দিনের নৈতিকতার মধ্যে এসে ঢুকেছে। তাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার বিপরীতে ক্রমে বেড়েছে আদিমতা সুলভ ‘নষ্ট’-এর প্রতি একপ্রকার উদ্‌যাপনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। (প্রসঙ্গত আমরা ‘প্রাগৈতিহাসিক’-এর কথা মনে করতে পারি।)

কিন্তু আমরা যে গল্পটি নিয়ে আলোচনা করছি, বিষয়টি তো সেখানে কেবল আদিমতাই নয়, তার সঙ্গে সংযুক্ত ‘অপ’-র ধারণা (Evil)। এটা নিয়ে একটা বিরাট তর্ক আলাদা করে করা সম্ভব, কিন্তু এখানে আমরা এক বার ছুঁয়ে যেতে চাই, বাতাই-এর বোদলেয়ার সম্পর্কে একটি বক্তব্য: ‘The evil element is very apparent in Baudelaire’s work, but is it connected with the essential nature of poetry?’

সার্ত্রে-র বোদলেয়ার সম্পর্কিত লেখাকে পাঠ করতে গিয়ে বাতাই এই মন্তব্যটি করেন। এই মন্তব্যের নিজস্ব প্রেক্ষিত আছে, কিন্তু এখানে যে জিনিসটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল— ‘অপ’-কে কীভাবে আমরা কবিতার অপরিহার্য চরিত্রের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করতে পারি? কবিতা এক দিকে যেমন স্বভাবতই যেকোনও ‘Referent’-কে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। এক দিকে কবিতার মধ্যে স্বভাবতই যেমন উৎসহীনের প্রবহমানতা আছে তেমনি অন্য দিকে ‘অপ’ সেই উৎসহীনের প্রকৃতি/স্বভাব হিসেবেও আসতে পারে যেন। নিজেই যেন কবিতার উৎস হয়ে উঠতে পারে। কবিতার বিষয়ের মধ্যে ‘অপ’ আছে কি না সেটা জরুরি নয়, একটা শিকড়হীন ভাসমানতা যেমন তছনছ করে দিতে পারে স্থাণু সতর্ক জীবনপ্রবাহকে তেমনি উড়ো এক আগন্তুক এসে ভেঙে দিতে পারে চেনা-পরিচিতির মহলকে। এখানেই বোধহয় ‘অপ’-র সঙ্গে ‘অপর’ (Other)–এর একটা যোগসূত্র তৈরি হতে পারে।

আমোদ ক্রমে যা হয়ে ওঠে, যে-অপরিচিতের হানায় হানায় অস্থির হয়ে ওঠে তার পরিচিতি, সে তো তার অপর। সে কে? বা সে কী? আমোদের মধ্যে কোন সেই অজানা ডাক, যার জন্য আমোদ, গোরা, অঙ্কের মাস্টার, নাপিতিনি সকলেই আর বিশ্লেষণের তল খুঁজে পাচ্ছে না— কোনও-না-কোনও নামের নীচে অপরিচিতকে স্থান দিচ্ছে। কী মজার একটা শব্দজট, শব্দলীলা— অপ, অপর, অপরিচিত। কবিতার আপন অননুমেয় স্বভাবকেই হয়তো কেউ দাগিয়ে দিয়ে এরকমই ‘অপ’ হিসেবে পাঠ করতে পারে। কাব্যের তথাকথিত মঙ্গলময় জয়যাত্রার বিরুদ্ধে, কবিতার এই ‘অপ’বাদ হয়তো এখানে আমাদের কমলকুমারের লিখনে ‘অপ’-র সক্রিয়তা বিষয়ে কিছুটা সজাগ করে যেতে পারে। এই পুরো চক্করের মধ্যে আমোদ সবার কাছে এবং আমোদের কাছে আমোদের দেহ হয়ে উঠেছিল সেই ‘অপ’। কমলকুমার এক দিকে তাকে যেমন বার বার সংস্কার, রীতি, বিকার ইত্যাদি যৌক্তিকতায় বাঁধতে বদ্ধপরিকর হচ্ছেন, অন্য দিকে আমোদের পরিবর্তনকে, অপরিচিতিকে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে ততটাই অসচেতনভাবে খুলে দিচ্ছেন দেহরূপ অজানার সঙ্গে সাক্ষাতের পথ। যাকে ঘিরে আমোদ ক্রমশ অপকারের পথে পা বাড়াচ্ছে। ভেঙে ফেলতে চাইছে আপন পরিচিতির বৃত্তকে। আদিমতার আখ্যানকে বিপরীতে রেখে, কেবল মঙ্গলের নীতিকে প্রতিষ্ঠা করার যে চোরা টান আধুনিক সাহিত্যরচনার পথে পথে বিছানো থাকে, ‘অপ’-র দর্শনকে সামনে তুলে এনে কমলকুমার সত্যই সেসব টানকে অনেকটা ছেঁটে ফেলছেন। তার বদলে ক্রমশ দাগিয়ে গেছেন দেহের দর্শনকে, এবং আমোদের বিকার যেন গল্পের ভাঁজে ভাঁজে কবিতা হয়ে উঠেছে—

কারণ এতদিনকার অন্তরঙ্গতাকে ঠেলে কিছুতেই সে উঠতে পারছিল না। অন্তরঙ্গতার মূল্যে ছেলেমানুষটিকে সত্যই খেলিয়ে তোলা যায়— সে দম্ভও সে করতে পারে, কিন্তু অষ্টাদশী আমোদ চেয়েছিল আর এক হাতছানিতে তাকে ডেকে নেবে। অন্তরঙ্গতা উঠা বসা সব কিছু— সেই হাতছানিকে গ্রাস করে ফেলেছে। গোরা কোনোদিন তাকে প্রকৃতির মাধুর্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারবে না। রোদ, ফল, রঙ, চন্দ্রালোক, বহমান ধারাকে সে তাদের নিজস্ব নামেই নেবে।

এতকাল অন্তরঙ্গতা, স্নেহ মমতা রক্তের টান, তার কাছে অহংকার ছিল। এই তাস দেখিয়ে সে চায় গোরা তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখবে। আর সে অন্যপক্ষে তাকে আর এক নতুন গানে মুগ্ধ করে দেবে, সুতরাং অন্তরঙ্গতাকে সে মুচড়ে দুমড়ে ফেলে দিতে পারে এমন ক্ষমতা তার নেই, আছে বিজাতীয় ক্রোধ, দেহ তার স্ফীত হয়ে উঠে কণ্টকিত, নিজেই হাত বুলায় আর ক্ষেপে ক্ষেপে ওঠে। সে যেন লাল আলো।১০

গল্পের শেষে এসে দেখা যাচ্ছে প্রায় সমস্ত গল্পটাই আমোদের দেহের অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। গোরাচাঁদ যথারীতি বিজ্ঞানের পঙ্‌ক্তি আউড়ে চলেছে— ‘আমি বলছিরে বাতাস বলে কিছু নেই’ কিন্তু সে-উচ্চারণ ‘ভয়ে ভয়ে… বিজ্ঞানের যুগ থেকে বহুদূর নখর হুঙ্কার যুগে এলো বোধহয়’— এবং কমলকুমারের ‘তেইশ’ বা ‘তাহাদের কথা’ গল্পের চরিত্রদের মতোই এই গল্পেও গোরাচাঁদ চরিত্রটি অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ‘নিজের রক্তকে ঘোলা করে নৈতিকতাকে উদম করে… লতাপাতার বিষাক্ত তরলতা’ আমোদকে সফলতা এনে দিচ্ছে, ‘সত্যই সে ছোটবাবুকে এক অন্ধকার জগতে পৌঁছে দিতে পেরেছে যেখানে সে ছাড়া আর তার পাশে কেউ থাকবেনা’। এই কাতর সময়ে এক দিকে গোরা আমোদকে হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেতে বলে আর অন্য দিকে ভগবানের নাম জপতে বলে। এক দিকে সে বাতাসকে অস্বীকার করে আর অন্য দিকে বাতাসেই সে বিভোর হয়ে থাকে। আমোদের দেহান্ধকার, লিঙ্গ-পরিচিতির গণ্ডিবদ্ধ বয়ানকে আক্রমণ করে। কিন্তু এ এক অভেদ্য সংঘাতের মুহূর্ত যার উন্মোচনই যেন এক রহস্য থেকে যায়। এখানে যৌনতা, দেহসংগম হয় কি না সেটা একটা গৌণ প্রশ্ন— না, নৈতিক কোনও ছুঁতমার্গের জন্য গৌণ নয়। যৌনতার কোনও আখ্যান আমোদ ও গোরার এই অপরিচয়ের মুহূর্তকে গ্রাস করতে পারে না। নানা কিছুর আভাস দিয়েও সে অধরা হয়ে থাকে।

বাতাস পর্ব গেছে… ছোটবাবুকে সারাজীবন সে নিশ্চয়ই বইবে… পাথরে অন্ধকার ভেদ করে রমণীসক্ষম স্থির রসিকার ভঙ্গিতে এখন প্রতীয়মান হয় যে… ‘আমোদ বোষ্টুমী’!১১

এইখানে এসে গল্পটি একটি নির্দিষ্ট সম্ভাবনার দিকে ঢলে যায়। কিন্তু একইসঙ্গে আমোদকে আমূল পালটে দিয়ে যায়। নারীর লিঙ্গপরিচয়ের অন্য একটি মাত্রায় আমোদ সরে আসে। সম্পূর্ণ গল্পের প্রেক্ষিত আমাদের বক্তব্যের বিষয় নয় আমরা আগেই বলেছিলাম। তাই আপাতত আমরা যাব আরেকটি প্রসঙ্গে। জুডিথ বাটলারের বিখ্যাত প্রবন্ধ, ‘Sex and gender in Simone De Beauvoir’s Second Sex’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন: ‘Although we ‘‘become’’ our gender, the temporal movement of this becoming does not follow a linear progression.’১২

এখানে কেলারের তর্কের সুতোটা আবার আমাদের হাতে এল, এবং এল হয়ে ওঠার প্রশ্ন। সিমোন দে বোভেয়ারের বক্তব্য অনুসারে, নারীজন্ম বলে কিছু হয় না, নারীর কেবল হয়ে ওঠা আছে। একটা দেহ ক্রমে নারীর লিঙ্গপরিচয়প্রাপ্ত হয়। কিন্তু এই হয়ে ওঠার মুহূর্ত কোনটা? এটা কি কোনও ক্রমিক সরণ? জুডিথ বাটলার বলবেন, না। কারণ এখানেই প্রশ্নের মুখে আসবে বিশুদ্ধ দেহের অসম্ভাব্যতার প্রশ্ন। দেহ/লিঙ্গ এবং লিঙ্গ-পরিচিতিকে কি পৃথকভাবে পাওয়া সম্ভব? যখনই দেহ সন্দর্ভের চৌহদ্দিতে আসে তখনই সে সাংস্কৃতিকভাবে কোথাও একটা উত্থাপিত হয়: ‘If the pure body cannot be found, if what can be found is the situated body, a locus of cultural interpretations, then Simon De Beauvoir’s theory seems implicitly to ask whether sex was not gender all along.’১৩

লিঙ্গ-পরিচিতির পারফর্মেটিভ চরিত্রায়নের কথা জুডিথ বাটলারই প্রথম লিখবেন— দেহের অগণিত পার্থক্য যা ছড়িয়ে আছে তার মধ্যে বিশুদ্ধ দেহ কোথাও নেই। আছে কেবল প্রজননের জীবনমুখী কাঠামোর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কিছু নিয়ম। যে নিয়মের ভিত্তিতেই তৈরি হয় আধিপত্যশীল লিঙ্গ-পরিচিতির ধারণা। লিঙ্গ অন্তহীন বিভাজন সেই আধিপত্যের বিরুদ্ধেই একটি সংশয়, সংঘাত, যন্ত্রণা, Trouble; যেখানে পরিচিতি খুব সুস্থির কিছু নয়, নিয়ত বহমান, সরণশীল। আধিপত্যশীল লিঙ্গ-পরিচিতির সামাজিক নির্মাণ প্রক্রিয়ার এই জবড়জং আটক-ফাটকের মধ্যেই আভাসের আঘাতে দেহের লেশ ধরা পড়ে কোথাও কোথাও, উঠে আসে (অপর)-ইচিত হয়ে।

কেলারের প্রবন্ধটির থেকে প্রায় একটি কল্পনিরীক্ষার দিকে এগিয়ে গিয়ে আমরা প্রকৃতি, লিঙ্গ, বিজ্ঞান, লিঙ্গ-পরিচিতি কোনও ধারণারই বিশুদ্ধ কোনও ঠাঁই পেলাম না। তলিয়ে দেখলাম কীভাবে বয়ান-বিশ্বে নানান পরিসরে একে অন্যের সঙ্গে ঠাঁইবদল করে করে চলে। এমন পিচ্ছিল একটি চরাচরের মধ্যে লিঙ্গ-পরিচিতির রাজনীতি কি অসম্ভব? এর একটা উত্তর হবে— এই পিচ্ছিলতার উপর লিঙ্গ-পরিচিতির রাজনীতি অশান্ত, অসহায় হতে পারে তবু তা রাজনীতিহীন হতে পারে না, কারণ সে নিরলসভাবে জাগিয়ে রাখে এক অসম্ভবের রাজনীতিকে; হয়তো সে-রাজনীতি ‘অপর’-ইচিত ‘অপ’-র জন্য হাট করে খুলে রাখে ভবিষ্যতের একটি দুয়ার।

টীকা সূত্রনির্দেশ

. Evelyn Fox Keller, The Gender/Science System: Or, Is Sex To Gender As Nature Is To Science?, Indiana University Press Journals (Source text published on 1987), p. 38.

. কমলকুমার মজুমদার,গল্পসমগ্র (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯০), পৃ. ৩৭৭।

. তদেব, পৃ. ৩৭৭।

. তদেব, পৃ. ৩৮৭।

. তদেব, পৃ. ৩৯১-৯২।

. Evelyn Fox Keller, The Gender/Science System: Or, Is Sex To Gender As Nature Is To Science?, Indiana University Press Journals (Source text published on 1987), p. 45.

. কমলকুমার মজুমদার,গল্পসমগ্র (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯০), পৃ. ৩৯৬।

. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপন্যাস সমগ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) (কলকাতা: পুনশ্চ, ২০০২), পৃ. ১৮৫-৮৬।

. Georges Bataille, trans. Alastair Hamilton, Literature and Evil (Penguin, 2012), p. 27.

১০. কমলকুমার মজুমদার,গল্পসমগ্র (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯০), পৃ. ৩৯৩।

১১. তদেব, পৃ. ৩৯৩।

১২. Judith Butler, ‘Sex and Gender in Simone de Beauvoir’s Second Sex’ in Yale French Studies (Yale University Press, No 72, 1986), p. 39.

১৩. Ibid., p. 46.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *