ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

লিওয়েন হুক (১৬৩২–১৭৩৩) – মুদি দোকানদার থেকে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী

লিওয়েন হুক (১৬৩২–১৭৩৩) – মুদি দোকানদার থেকে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী

যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, আজকের দৃষ্টিতে সেটা আসলেই ছিল একটা অন্ধকারের যুগ। এই অন্ধকার আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সে-কালের জ্ঞানচর্চা, এমন কি জীবনগত আবরণের প্রতি অণুরন্ধ্রকে। ফলে সে যুগের মানুষেরা, এমনকি বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন যে, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে, আর তাতে করেই এই দিন ও রাতের খেলা।

শুধু দিনরাতের কথা কেন, রোগবালাই ও মৃত্যু—এসব নিয়েও সেকালে প্রচলিত ছিল নানা কুসংস্কার এবং মিথ্যে ধারণা। ধর্মের অনুশাসনের বিরুদ্ধে, সংস্কারের বিরুদ্ধে কারও কোন টু শব্দটি করার ক্ষমতা ছিল না।

তবু এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, এই অন্ধত্বের বিরুদ্ধে যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও জ্ঞানের আলোর শিখার প্রজ্বলন করতে সাহসী হয়েছিলেন তাঁদেরই একজন বিজ্ঞানী অ্যান্টনি লিওয়েন হুক। তাঁর জন্ম ১৬৩২ সালে হল্যান্ডের ডেলেট অঞ্চলে। সম্ভ্রান্ত অথচ এক গরিব ঘরের সন্তান ছিলেন তিনি।

জন্মের কিছুদিনের মধ্যে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। মায়ের আশা ছিল, ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবেন, যাতে লেখাপড়া শিখে একটা সরকরি চাকরি নিয়ে দু-চার পয়সা কামাই করতে পারে। কিন্তু হুকের লেখাপড়া করা হলো না। ভালো লাগল না ধরাবাঁধা ছকের বই পড়তে। ফলে ষোল বছর বয়সে পড়া শোনার পাট চুকিয়ে চাকরি নিলেন এক মুদির দোকানে আর সেইসাথে ঘরে আনলেন নতুন বউ।

এরপর তাঁর জীবন থেকে কেটে গেল প্রায় কুড়িটি বছর এবং সেই মুদির দোকানেই। জীবনে তাঁর কোনোই পরিবর্তন এল না কেবল বার কয়েক বিয়ে করা ছাড়া। এরপর তিনি দোকানদারি ছেড়ে চাকরি নিলেন স্থানীয় পৌরসভায়।

এই সময়ই তাঁকে একটি নতুন নেশায় পেয়ে বসে। কে যেন তাঁকে বলেছিল, কাচের লেন্সের মধ্য দিয়ে দেখলে সবকিছুই বড় দেখায়। আর সেই থেকে শুরু হলো তাঁর কাচ ঘষে ঘষে লেন্স তৈরি করা। শুরু হলো যারা চশমা তৈরি করে তাদের কাছে ঘোরাঘুরি করার পালা। তারপর কেমন করে কাচ ঘষে চশমা তৈরি করতে হয়, তার সবগুলো কৌশলই তিনি শিখে ফেললেন।

ক্ষুদ্র যে জিনিসটাকে খালি চোখে বলতে গেলে তিনি দেখতেই পান না, সেই জিনিসকেই এই লেন্সের মধ্য দিয়ে দেখলে বেশ বড় এবং স্পষ্ট দেখায়।

আরও মজার ব্যাপার হলো, এই কাচ যত উন্নত মানের হয়, কাচের নিচে রাখা জিনিসটাকেও তত বেশি স্পষ্ট এবং বড় দেখায়। তাই তিনি আরও উন্নত মানের কাচ জোগাড় করে আরও নিখুঁত লেন্স তৈরি করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

তিনি লক্ষ্য করলেন, এই দৃশ্যমান জগতের ভেতরেই আরও একটি অদৃশ্য জগৎ রয়েছে, সে জগৎ বড় বিচিত্র, সে জগৎ যেমন বিস্ময়কর, তেমনি বিশালও। সেই বিস্ময়কর জগৎকে তাঁর আবিষ্কার করতে হবে আর সেই জগতে প্রবেশের একমাত্র পথ হলো এই কাচের লেন্স।

কাচের লেন্স তৈরির খেলা এই সময় তাঁকে এমন নেশার মতো পেয়ে বসেছিল যে, তিনি এ ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারতেন না। তিনি যা কিছুই সামনে পেতেন, তা-ই এনে রাখতেন এই কাচের লেন্সের নিচে। আর তখনই সেই দৃশ্যমান জিনিসের ভেতর থেকে ভেসে উঠত আর একটি অদৃশ্য জগৎ। তাই দেখে তিনিও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতেন।

একটি ক্ষুদ্র মাছির মাথা কেটে তিনি লেন্সের নিচে রাখলেন। কী আশ্চর্য, তিনি দেখলেন, এই ক্ষুদ্র মাছির মাথার মধ্যেও ঘিলু আছে। অতি ক্ষুদ্র একটি পোকার হুল, একটি উকুনের পা, সাধারণ চোখে যা প্রায় দেখাই যায় না, তা-ই এই লেন্সের নিচে রেখে দেখলে কী বড় আর বিচিত্র দেখায়! কী বিস্ময়কর তাদের গঠন!

এরপর তিনি তাঁর এই লেন্স আবিষ্কারের কথা আর তাঁর এই অদৃশ্য জগতের খবর জানিয়ে ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির কাছে চিঠি লিখলেন। রয়্যাল সোসাইটির সদস্যারাও এই বিস্ময়কর জগতের সংবাদ শুনে অবাক হয়ে গেলেন। তাঁরা হুককে এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য জানানোর জন্য উৎসাহিত করে পাল্টা চিঠি লিখলেন।

এর কিছুদিন পরই লিওয়েন হুক আবিষ্কার করলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটি। তিনি একটু আগে যে গ্লাসের জল পান করেছিলেন, সেই আধ গ্লাস জল এনে রাখলেন লেন্সের নিচে। তিনি সবিস্ময়ে দেখলেন—সেই ঝকঝকে নির্মল জলের মধ্যে একঝাঁক বিচিত্র ধরনের পোকা কেমন কিলবিল করছে!

তা হলে তিনি কি এই পোকাশুদ্ধই জল খেয়েছেন? প্রতিদিনই খান? তাহলে কি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই প্রতিদিন জলের সাথে এই বিচিত্র পোকাগুলো উদরস্থ করে? আর পোকাগুলো এতই ক্ষুদ্র যে খালি চোখে দেখার কোনো উপায়ই নেই। অথচ ওরা আছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বিচিত্র প্রাণীগুলো এলো কোথা থেকে? কেমন করে এগুলোর জন্ম হলো? তিনি সঙ্গে সঙ্গে এই বিস্ময়কর জগতের বিচিত্র প্রাণীদের কথা লিখে চিঠি পাঠালেন রয়্যাল সোসাইটির কাছে। তাঁর পাঠানো বিশাল চিঠির পাতায় তিনি তাঁর দেখা এই বিস্ময়কর প্রাণিজগতের সমস্ত বিচিত্র কথা খুলে জানালেন।

রয়্যাল সোসাইটির বিজ্ঞানীরা কিন্তু লিওয়েন হুকের চিঠি পড়ে আরও অবাক হয়ে গেলেন। বলে কী লোকটা! এক ফোঁটা জলের মধ্যে হাজার হাজার পোকা? তা হলে ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রাণীদের মধ্যে এরাই কি ক্ষুদ্রতম প্রাণী? এ যে সত্যি অবিশ্বাস্য কথা!

তাঁরা আবার লিখলেন লিওয়েন হুকের কাছে, তুমি যে যন্ত্রের ভেতর দিয়ে দেখেছ অর্থাৎ তোমার কাচের লেন্স লাগানো যন্ত্রটা পূর্ণ বিবরণ এবং কেমন করে ওই যন্ত্র দিয়ে তুমি আজব প্রাণিজগতের সন্ধান পেলে, তার বিবরণ আমাদের দ্রুত লিখে পাঠাও।

এবার লিওয়েন লিখলেন, তাঁর এই ব্যাপার একান্ত বাস্তব ও সত্যি। প্রয়োজন মনে করলে তাঁরা সোসাইটির পক্ষ থেকে সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখতে পারেন। তবে তিনি কী পদ্ধতিতে তাঁর মাইক্রোস্কোপ যন্ত্রটা তৈরি করেছেন, তার ফরমুলা জানাবেন না। এটা তাঁর নিজের আবিষ্কার। এর রহস্য তিনি ফাঁস করতে রাজি নন।

তারপর সত্যি সত্যি রয়্যাল সোসাইটির পক্ষ থেকে দু জন বিজ্ঞানীকে পাঠানো হলো লিওয়েন হুকের যন্ত্রটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য। তাঁরা এসে সব দেখেশুনে বললেন, সত্যিই তো তাই! এ যে একটা বিস্ময়কর আবিষ্কার! তাঁরা নিজের চোখেই এক গ্লাস পরিষ্কার জলের মধ্যে সাঁতার কাটতে দেখলেন হাজার হাজার বিচিত্র পোকাকে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও লিওয়েন তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্রটি রয়্যাল সোসাইটির লোকজনদের খুলে দেখতে দিলেন না। তার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে পোকা দেখার সুযোগ দিলেন মাত্র।

এর পরই বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেলেন লিওয়েন হুক। রয়্যাল সোসাইটি তাঁকে সংস্থার সদস্য করে নিল। এই সম্মান পেয়ে তিনি ধন্য হলেন বটে, কিন্তু তাঁর আবিষ্কৃত মাইক্রোস্কোপ যন্ত্রটি হাতছাড়া করতে রাজি হলেন না কোনোমতেও।

রয়্যাল সোসাইটি প্রথমে রবার্ট হুক ও নথেমিয়া গ্রুককে এবং পরে পাঠালেন ডাক্তার মালিনেওকে। তাঁরা এসে লিওয়েন হুককে বললেন, আপনি যত ডলার চান দেওয়া হবে, আরেকটা মাইক্রোস্কোপ তৈরি করে সোসাইটির কাছে বিক্রি করুন। কিন্তু তবু তিনি নিজের আবিষ্কৃত যন্ত্রের ফরমুলা বা রহস্য জানাতে রাজি হলেন না।

ইতিমধ্যে লিওয়েন হুকের এই আজব মাইক্রোস্কোপ যন্ত্রের কথা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। একবার রাশিয়ার সম্রাট পিটার দি গ্রেট ইংল্যান্ড সফরে এসে নিজেই এসেছিলেন লিওয়েন হুকের এই আজব যন্ত্র দেখতে। এসেছিলেন ইংল্যান্ডের রানিও।

লিওয়েন হুকই প্রথম জীবাণু আবিষ্কার করেন এবং ১৭৩৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর এই যন্ত্রটি রয়্যাল সোসাইটির হস্তগত হয়। এরপর থেকে সারা বিশ্বে শুরু হয় এর ব্যাপক ব্যবহার।

লিওয়েন হুকের আবিষ্কৃত মাইক্রোস্কোপের আরও উন্নতি হয়েছে। যেসব ক্ষুদ্রতম জীবাণু সাধারণ মাইক্রোস্কোপে ধরা পড়ে না, সেগুলো দেখ যায় শক্তিশালী ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে। এমন কি এই মাইক্রোস্কোপে একটি জিনিসকে দশ পনেরো হাজার গুণ বড় করে দেখাও সম্ভব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *