লাহোর প্রস্তাবের রচয়িতা কে?

লাহোর প্রস্তাবের রচয়িতা কে?

উপরিউক্ত আলোচনা মনে রাখলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হবে—কি পরিবেশে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। প্রশ্ন হল : এই প্রস্তাবের রচয়িতা কি ফজলুল হক ছিলেন? এ, এস, এম, আবদুর রব ফজলুল হকের যে জীবনী লিখেছেন তাতে তিনি ফজলুল হককে এই প্রস্তাবের রচয়িতা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ফজলুল হকের লেখা একটি চিঠি উদ্ধৃত করেছেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৩ অক্টোবর কলকাতা থেকে ফজলুল হক আলিগড়ের মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ক্লাশের ছাত্র মহম্মদ শাহাজাহানের নিকট একটি চিঠিতে লেখেন যে, তিনি এই প্রস্তাবের খসড়া রচনা করেন। তাঁর চিঠি থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল:

As regards Pakistan, I stand by the Resolution whose wording I drafted and which I moved in the Lahore session of the Muslim League and which is now the basis of the Pakistan demand.

ফজলুল হকের যেসব ব্যক্তিগত পত্রালী ও পারিবারিক কাগজপত্র আমি দেখেছি তা থেকে এই তথ্য গ্রহণ কষ্টকর। মনে রাখা দরকার, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হক সাহেব একবারও কিন্তু দাবি করেননি যে তিনি এই প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করেছেন। এমনকী তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদেরও এই কথা বলেননি। কাজেই কি অবস্থায় ফজলুল হক এই পত্র লেখেন তা আরও ভালোভাবে জানা দরকার। হক-জিন্না বিরোধের শেষ পর্যায়ে মুসলিম লিগে যোগদানের জন্য অনেকেই ফজলুল হককে অনুরোধ করেন। অনেক সময় তাঁর উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। এই অবস্থায় ফজলুল হক নিজের অবস্থা ব্যাখ্যা করে বলতেন, জিন্নার প্রতিশোধমূলক মনোভাবের জন্য তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তাই তাঁদের উচিত জিন্নার নিকট পত্র প্রেরণ করে তাঁর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা। তখন ফজলুল হক জিন্নার সমালোচনা করতে গিয়ে অনেক সময় বলতেন, তিনি মুসলমান সমাজের মঙ্গলের জন্য অনেক কিছু করেছেন। এই মনোভাব থেকেই ফজলুল হক দাবি করেন, তিনি শুধু পাকিস্তান প্রস্তাবের উত্থাপক ছিলেন না, তিনি এই প্রস্তাবের খসড়াও রচনা করেন। অর্থাৎ এই প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে মুসলিম স্বার্থ রক্ষার প্রধান কৃতিত্ব তাঁরই, জিন্নার নয়। এমন একটা সময়ে ফজলুল হক এই উক্তি করেন যখন মুসলিম লিগ পাকিস্তান নামক পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে মুসলমানদের সংঘবদ্ধ করে। এই সাফল্যে তাঁরও যে এক-বিশেষ ভূমিকা আছে সেকথাই তিনি স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলেন।

পাকিস্তানের প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী সৈয়দ শরিফুদ্দিন পীরজাদা লেখেন, এই প্রস্তাবের খসড়া রচনায় ফজলুল হকের কোনই অবদান ছিল না। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ লাহোরে সারাভারত মুসলিম লিগের অধিবেশন বসবার পূর্বে লিগ ওয়ার্কিং কমিটি এই বিষয়ে একটি প্রস্তাব রচনার জন্য জিন্না ও স্যার সিকন্দর হায়াৎ খানকে সদস্য করে একটি কমিটি গঠন করে। স্যার আবদুল্লা হারুণ দাবি করেন, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি একটি খসড়া রচনা করে জিন্নার হাতে দেন এবং তাঁর রচনা ভিত্তি করেই এই খসড়া প্রস্তাবটি রচিত হয়। অন্যদিকে স্যার সিকন্দর দাবি করেন, তিনিই এই খসড়া প্রস্তুত করেন এবং অনেক সংশোধন করে লিগ ওয়ার্কিং কমিটি একটি প্রস্তাব রচনা করে। স্যার সিকন্দর লেখেন:

I have no hesitation in admitting that I was responsible for drafting the original resolution. But let me make it clear that the resolution which I drafted was radically amended by the Working Committee, and there is a wide divergence in the resolution I drafted and the one that was finally passed. The main difference between the two resolution is the latter part of my resolution which related to the centre and co-ordination of the activities of the various units, was eliminated.

২২ মার্চ রাত আটটায় লিয়াকৎ আলি ওয়ার্কিং কমিটিতে সংশোধিত খসড়া প্রস্তাবটিকে চূড়ান্ত রূপ দেবার জন্য সাবজেকটস কমিটির সভায় পেশ করেন। আলোচনার সুবিধার জন্য ইংরেজি ভাষায় রচিত খসড়া প্রস্তাবটি উর্দু ভাষায় অনুবাদ করেন মৌলানা জাফর আলি খান। আর ভেবে আসবার জন্য সদস্যদের সময় দেওয়া হয়। তাই ২২ মার্চ সভার কাজ বেশিক্ষণ চলেনি। পুনরায় ২৩ মার্চ বেলা এগারোটায় সাবজেকটস কমিটির সভায় এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সামান্য সংশোধনের পর প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। যখন এই খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলে তখন ফজলুল হক কলকাতা থেকে লাহোরে পৌঁছোন। তাই ফজলুল হককে এই প্রস্তাবের রচয়িতা কি করে বলা সম্ভব? পীরজাদা এই অভিমত ব্যক্ত করেন।

প্রশ্ন হল, ফজলুল হক কি এই সাবজেকটস কমিটির সভায় উপস্থিত ছিলেন? আলোচনার শেষের দিকে এসে পৌঁছুলেও তিনি কি মতামত ব্যক্ত করেছিলেন? এই বিষয়ে কোন সঠিক তথ্য মুসলিম লীগ কার্যবিবরণীতে পাওয়া যায় না। হয়তো ফজলুল হক এই সাবজেকটস কমিটির সভায় শেষ মুহূর্তে এসে মূল প্রস্তাবের দু-একটি শব্দ পরিবর্তন করে তা সামান্য সংশোধন করে প্রস্তাবটিকে চূড়ান্ত রূপ দেবার বিষয়ে সাহায্য করেন। সম্ভবত এই কারণেই পরবর্তীকালে তিনি নিজেকে লাহোর প্রস্তাবের রচয়িতা হিসাবে উল্লেখ করেন। অবশ্য এই বিষয়ে মুসলিম লিগ কার্যবিবরণীতে কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে একটি ধারণা করা যায়। মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় অধিবেশনে কোন প্রস্তাব জিন্নার অনুমোদন ছাড়া পেশ করা যেত না। তাছাড়া এই প্রস্তাবের খসড়া প্রস্তুত করবার কমিটিতে জিন্না ছিলেন এবং তিনি সক্রিয়ভাবে এই খসড়া রচনায় অংশ গ্রহণ করেন। জিন্নার পরামর্শ ও অনুমোদন নিয়েই এই প্রস্তাবের চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলাদেশে, নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করা এবং পাকিস্তান দাবির সমর্থনে এই অঞ্চলের মুসলমানদের উদবুদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে, জিন্না ফজলুল হকের মত একজন প্রভাবশালী বাঙালী নেতার দ্বারা এই প্রস্তাব উত্থাপন করা যুক্তিযুক্ত মনে করেন। সাদাসিধে ফজলুল হল তখন জিন্নার এই চাতুরি ধরতে পারেননি। তাই কলকাতা থেকে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে লাহোর অধিবেশনে এই প্রস্তাব উত্থাপন করার পর তিনি যে-ভাষণ দেন তার সঙ্গে জিন্নার বত্তৃতার কোনোই সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। আর-একটি কথাও মনে রাখা দরকার। পাকিস্তান দাবির সপক্ষে যাঁরা নানা পরিকল্পনা রচনা করেন তাঁদের মধ্যে সবাই ছিলেন ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল, উত্তর প্রদেশ, হায়দ্রাবাদ প্রভৃতি স্থানের অধিবাসী। কোনো সময়ে তাঁরা কেউ এই নিয়ে কোনো তাত্ত্বিক আলোচনা ফজলুল হকের সঙ্গে করেননি। অথবা ফজলুল হকও নিজে উদ্যোগী হয়ে কোন স্কিম রচনা করেননি। ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের মুসলিম লিগ প্রথম এই বিষয়ে সক্রিয় হয়। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে সিন্ধু প্রদেশের মুসলিম লিগ একটি প্রস্তাবে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য পৃথক রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানায় এবং ঘোষণা করে যে, ভারতবর্ষ একটি দেশ নয়, একটি Sub-continent.১০ এইসব তথ্য থেকে বোঝা যায় প্রথম দিকে পাকিস্তান দাবি নিয়ে তত্ত্বগত আলোচনায় যাঁরা রত থাকেন তাঁদের মধ্যে যেমন আমরা ফজলুল হককে দেখতে পাই না, তেমনি অন্য কোনো বাঙালি মুসলমানও ছিলেন না। অবশ্য পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণের পর বাংলাদেশের মুসলিম লিগ খুবই উদ্যোগী হয় এবং এই দাবির সপক্ষে প্রচার শুরু করে।

তথ্যসূত্র

Abdur Rab, A.S.M., A. K. Fazlul Huq, p. 101.

Ibid, pp. 159–161.

Ibid, p. 161.

Ibid, pp. 159–161.

Pirzada, Pakistan Resolution, p. 13.

Ibid.

Ibid, pp. 13–15.

Interview with Khan Bahadur A. H. M, Wazir Ali, I. A. S. (Retired) and Late Khan Bahadur A. N. M. Yusuf Ali, Ex-Registrar of Assurance, Government of West Bengal.

Ibid.

১০ Ahmad, Islamic Modernism, p. 170.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *