লাসের অন্তর্দ্ধান

লাসের অন্তর্দ্ধান

প্রথম পরিচ্ছেদ 

ইংরাজী ১৮৭৯ সালের একদিবস প্রত্যূষে একখানি প্রসিদ্ধ দৈনিক পত্রে একটি প্রবন্ধ বাহির হয়। ওই সংবাদপত্রে যাহা লিখিত হইয়াছিল, তাহার সার মর্ম্ম এইরূপ:– “এই ঊনবিংশ শতাব্দীতে কতই যে নূতন নূতন ধরণের কাণ্ড কারখানা আমাদিগকে প্রচারিত করিতে হইতেছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। দিন দিন বিজ্ঞানের যেমন উন্নতি হইতেছে, পাশ্চাত্য শিক্ষায় যেমন দেশ ছাইয়া পড়িতেছে, ও সেই সঙ্গে সঙ্গে যেমন সকলের হৃদয়ে সভ্যতার অভিমান প্রবেশ করিতেছে, সেইরূপ নানা প্রকার নূতন নূতন দুষ্ক্রিয়া সকল আবির্ভূত হইয়া, দুষ্ক্রিয়াকারিগণের হৃদয়ে উহা প্রবেশ করতঃ নানাস্থানে নানারূপ ভাব ধারণ করিতেছে। এইরূপে কত দুষ্কর্ম্ম কতরূপে আবির্ভূত হইয়া কত লোকের সর্ব্বনাশ সাধন করিতেছে, তাহা বর্ণন করাও আজকাল এইরূপ কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। পূর্ব্বে দেখিতে পাইতাম, কোন ব্যক্তি কোনরূপ অপরাধ করিয়া ধৃত হইলে আর তাহা গোপন করিতে চেষ্টা করিত না। একজন অপরাধ করিলে অপর পাঁচজন একত্র হইয়া যাহাতে সেই অপরাধী ধৃত ও রাজদ্বারে দণ্ডিত হয়, তাহার নিমিত্ত সকলেই প্রাণপণে চেষ্টা করিত। এমন কি, পুত্র কোনরূপ অপরাধ করিলে পিতা তাহা গোপন করিবার নিমিত্ত কোনরূপ মিথ্যা কথা কহিতেন না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন সেই সকল দিন চলিয়া গিয়াছে। পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ লোকই প্রায় দুষ্ক্রিয়াকারী হইয়া উঠিতেছে। চুরি, ডাকাইতি প্রভৃতির সংখ্যা ক্রমেই বাড়িয়া যাইতেছে। খুনের কথা তো আজকাল প্রায়ই শুনিতে পাওয়া যায়। কিন্তু ওই সকল মোকদ্দমার অধিকাংশেরই কিনারা হয় না। প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়, যে সকল ব্যক্তি আজকাল কোনরূপ অপরাধ করিবার নিমত্ত অগ্রগামী হয়, তাহারা প্রায়ই পুলিস ও বিচারকের চক্ষে ধূলি প্রদান করিতে যাহাতে পারা যায়, এরূপ কোন না কোন উপায় অগ্রে বাহির করিয়া, পরিশেষে তাহাদিগের অভীপিত কার্য্যে হস্তক্ষেপ করে। তদ্ব্যতীত, কোন ব্যক্তিই প্রায় কাহাকেও পূর্ব্বের ন্যায় সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হয় না। এই সকল কারণেই আজকাল মোকদ্দমার প্রায়ই কিনারা হয় না। যদি কোন মোকদ্দমার কিনারাও হয়, বা অপরাধকারী ব্যক্তিগণ ধৃতও হয়, তাহা হইলেও অধিকাংশ মোকদ্দমার বিচার ফল প্রায় শোচনীয় অবস্থায় পরিণত হইয়া থাকে। যেরূপ প্রকৃতির বিচারকগণের হস্তে আজকাল বিচার ভার অর্পিত রহিয়াছে, পূর্ব্বে সেরূপ ছিল না। পূর্ব্বে উচ্চবংশসম্ভূত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণের মধ্য হইতে বিচারক নির্ব্বাচিত হইতেন। আজকাল বংশ-মর্যাদার দিকে কেহই প্রায় দৃষ্টি করেন না। দৃষ্টি পরীক্ষা-ফলের দিকে; সুতরাং, তিনি যে কোন বংশসম্ভূত হউন না কেন, পরীক্ষায় উচ্চস্থান অধিকার করিতে পারিলেই তিনি বিচারাসনে উপবেশন করিতে সমর্থ হইবেন। এই সকল বিচারকদিগের মধ্যে একটি অতিশয় প্রবল দোষ দেখিতে পাওয়া যায়। এই দোষের নিমিত্তই বিচার-ফল অতিশয় শোচনীয় হইয়া পড়ে। কেনো বিচারক বিচারাসনে উপবেশন করিবামাত্র তাঁহার মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়া যায়, প্রবল ক্রোধ আসিয়া তাঁহার হৃদয় অধিকার করিয়া বসে। তিনি নিজের হিতাহিত জ্ঞান বিস্মৃত হইয়া উকীল, মোক্তার, আসামী, সাক্ষী, পুলিস প্রভৃতির সহিত এরূপ অবমাননাসূচক কথাবার্তা কহিতে থাকেন, যে কেহই অপমানের ভয়ে তাঁহার সম্মুখে যাইতে চাহে না। যদি কেহ কর্তব্যকর্ম্মের বংশীভূত হইয়া তাঁহার সম্মুখে গমন করেন, তিনিও সহজে কোন কথা কহিতে চাহেন না; কারণ, কোন কথা বলিলেই হাকিম-প্রবরের বিকৃত মুখের ভাব দেখিয়া তিনি নিজের মান লইয়া সেইস্থানে স্থির ভাবে বসিয়া পড়েন। তিনি হাকিম; সুতরাং, তাঁহার বিশ্বাস যে কাহারও কথা তাঁহার শুনিবার প্রয়োজন নাই; তিনি নিজেই সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে বুঝিতে পারেন। এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া তিনি বিচারকার্য সম্পন্ন করিয়া থাকেন; সুতরাং, বিচারে যেরূপ সুফল ফলিয়া থাকে, তাহা সকলেই বিবেচনা করিয়া দেখুন। 

আর এক শ্রেণীর বিচারক আজকাল কার্যক্ষেত্রে বিচরণ করিতেছেন। তাঁহারা বিচারক কি পুলিস-কৰ্ম্মচারী, তাহা স্থির করিয়া লওয়া অসম্ভব; কারণ দেখিতে পাওয়া যায়, পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণ তাঁহাকে যাহা কহিয়া থাকেন, তিনি তাহাই বেদবাক্য বলিয়া বিশ্বাস করেন ও সেইরূপ কথার উপর নির্ভর করিয়া কার্য্য করিয়া থাকেন। 

আর এক শ্রেণীর হাকিম ঠিক ইহার বিপরীত। ভাল হউক মন্দ হউক, ন্যায় হউক অন্যায় হউক, তিনি কোন কথা শুনিবেন না। সকল কার্য্যেই পুলিসের দোষ ধরিবেন, পুলিসের প্রেরিত মোকদ্দমা মাত্রেতেই তিনি পুলিসের উপর কঠোর মন্তব্য প্রকাশ করিবেন। সুতরাং, পুলিসও সেই সকল বিচারকের নিকট কোন মোকদ্দমা প্রেরণ করিতে চাহেন না। কোন মোকদ্দমার কিনারা হইলে পাছে ওই সকল বিচারকের সম্মুখে গমন করিতে হয়, এই ভাবিয়া তাঁহারা প্রায় কোন মোকদ্দমার কিনারা করিতে চেষ্টিত হন না। 

সমস্ত বিচারকই যে এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত, তাহা নহে। ইহারা ব্যতীত, অপর এক শ্রেণীর বিচারক আছেন। তাঁহারা ফরিয়াদী, আসামী, সাক্ষী, উকীল, মোক্তার, পুলিস প্রভৃতি সকলের নিকট সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে শ্রবণ করিয়া বিচার করিয়া থাকেন। বিচারও প্রকৃতরূপ হইয়া থাকে। অবিচার প্রায়ই শুনিতে পাওয়া যায় না। এই শ্রেণীর বিচারকগণের নিমিত্তই “সুবিচার” এই কথাটি এখনও শুনিতে পাওয়া যায়। তাঁহাদিগের নিমিত্তই ইংরাজ-আইনের মাহাত্ম্য এখনও বর্ত্তমান আছে। সুবিচার হইবে বলিয়া পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণ এখনও তাঁহাদিগের নিমিত্তই বিশেষ পরিশ্রম করিয়া মোকদ্দমার কিনারা করিতে বিশেষরূপে চেষ্টিত হইয়া থাকেন। 

যে মোকদ্দমার কথা অদ্য এই স্থানে বিবৃত হইতে চলিল, ওই মোকদ্দমার কিনারা হইলে উহা কোন্ শ্রেণীর বিচারকের হস্তে বিচারার্থ অর্পিত হইবে, তাহা আমরা জানি না বলিয়াই, পুলিস কতদূর পরিশ্রম স্বীকার করিয়া ওই মোকদ্দমার কিনারা করিতে প্রবৃত্ত হইবেন, তাহা আমরা বলিতে পারিতেছি না। আপাততঃ, যাহা আমরা অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাই এই স্থানে বর্ণিত হইল। 

সহরতলীর কোন এক প্রশস্ত রাজবর্গের উপর গত কল্য সন্ধ্যার পর একটি মৃতদেহ পড়িয়া রহিয়াছে, ইহা দেখিতে পাওয়া যায়। এই সংবাদ ক্রমে থানায় গিয়া উপনীত হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারী এই সংবাদ অবগত হইয়া যেস্থানে মৃতদেহ দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল, সেই স্থানে আসিয়া উপনীত হন। দেখিতে পান, একখানি নূতন খাটিয়ার উপর ওই মৃতদেহটি স্থাপিত রহিয়াছে, ও খাট সমেত উহা রাজবর্গের উপর রক্ষিত আছে। একখানি নূতন বস্ত্র দ্বারা ওই মৃতদেহ আপাদমস্তক আবৃত রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া তিনি প্রথমেই মনে করেন, কোন ব্যক্তি স্বাভাবিক রোগে মরিয়া গিয়াছে; তাহার আত্মীয় স্বজন তাহার সৎকারকার্য সমাধা করিবার নিমিত্ত ওই খাটে করিয়া উহা লইয়া যাইতেছিল; কোন কারণে ওই স্থানে উহা রাখিয়া দিয়া কোন কার্য্যের নিমিত্ত কোন স্থানে গমন করিয়াছে, এখনই আসিয়া তাহারা উহা লইয়া যাইবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই কর্ম্মচারী সেই স্থানে অনেকক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করিলেন, কিন্তু যখন দেখিলেন, যে কোন ব্যক্তি ওই মৃতদেহ গ্রহণ করিবার মানসে আর সেইস্থানে আগমন করিল না, তখন অনন্যোপায় হইয়া তিনি একজন লোককে ডাকাইলেন, ও তাহার দ্বারা, ওই মৃতদেহ যে বস্ত্রের দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল, তাহা স্থানান্তরিত করিলেন। ওই বস্ত্র স্থানান্তরিত হইলে তিনি যাহা দেখিলেন তাহাতে তাঁহার মস্তক ঘুরিয়া গেল। মনে মনে যাহা ভাবিয়াছিলেন, হৃদয় হইতে তখন তাহা অন্তর্হিত হইল। দেখিলেন, উহার মস্তক একখানি বস্ত্রের দ্বারা আবদ্ধ রহিয়াছে। ওই বস্ত্রখানি এরূপ রক্তাক্ত হইয়া গিয়াছে যে, উহা যে শ্বেতবর্ণের বস্ত্র ছিল, তাহা সহজে কাহারও অনুমান করিবার উপায় নাই। কর্ম্মচারী ওই বস্ত্রখানি আস্তে আস্তে তাহার মস্তক হইতে খুলাইলেন। দেখিলেন, মস্তকে এরূপ আঘাত লাগিয়াছে যে, উহা একেবারে দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া গিয়াছে। মস্তক হইতে মস্তিষ্ক সকল বহির্গত হইয়া পড়িয়াছে। ওই মৃত ব্যক্তিকে দেখিলে অনুমান হয়, ওই ব্যক্তি পশ্চিমদেশবাসী নীচবংশ সম্ভূত জনৈক হিন্দু। বয়স আন্দাজ ৪০/৪৫ বৎসর হইবে। 

মৃতদেহের এই অবস্থা দেখিয়া কৰ্ম্মচারী বিশেষরূপ ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। ইহা স্বাভাবিক মৃত্যু নহে, হত্যা; তাহা তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন। তখন তাঁহার যাহা কিছু কৰ্ত্তব্য, তাহা তিনি করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। ওই মৃতদেহের উপর জনৈক প্রহরীকে পাহারায় নিযুক্ত করিয়া দিয়া, সর্ব্বপ্রথমে তাঁহার ঊর্দ্ধতন কর্মচারিগণকে সংবাদ প্রেরণ করিলেন, ও পরিশেষে যেস্থানে ওই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, তাহার নিকটবর্ত্তী পাড়ার ভিতর গমন করিয়া সময়োচিত অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলেন। পাড়ার লোকজনকে সংগ্রহ করিয়া তাহাদিগকে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করিতেছেন, এরূপ সময়ে এক ব্যক্তি দৌড়িতে দৌড়িতে তাহার নিকট আগমন করিল ও কহিল “মহাশয়! সৰ্ব্বনাশ হইয়া গিয়াছে। যে মৃতদেহ আপনি রাখিয়া আসিয়াছিলেন, সেই মৃতদেহ পাওয়া যাইতেছে না, চারিপায়া সমেত সেই মৃতদেহ অন্তর্হিত হইয়াছে।” এই সংবাদ শুনিবামাত্র কর্মচারী দ্রুতপদে সেই স্থানে আগমন করিলেন। দেখিলেন, বাস্তবিকই সেই মৃতদেহ চারিপায়ার সহিত সেই স্থানে নাই। যে প্রহরীকে সেই স্থনে পাহারায় রাখিয়া আসিয়াছিলেন, তাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। এই অবস্থা দেখিয়া কৰ্ম্মচারী কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না, যে কিরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে। তিনি যে মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, এখন সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধান বন্ধ করিয়া অন্তর্হিত লাসের অনুসন্ধানের নিমিত্ত তাঁহাকে অতিশয় ব্যস্ত হইয়া পড়িতে হইল। এই সংবাদ তখনই তিনি তাঁহার ঊর্দ্ধতন কর্মচারিগণকে প্রেরণ করিলেন। প্রধান প্রধান পুলিস-কর্ম্মচারিগণ এখন একত্র মিলিত হইয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। ডিটেক্‌টিভ কৰ্ম্মচারিগণও স্থিরভাবে বসিয়া নাই, সকলেই এখন একত্র মিলিত হইয়া ওই মৃতদেহ যে কোথায় গেল, বা কাহার দ্বারা স্থানান্তরিত হইল, এখন তাহারই অনুসন্ধানে নিযুক্ত আছেন। অনুসন্ধান-ফল ক্রমে পাঠকগণ অবগত হইতে পারিবেন।” 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

যে দিবস প্রত্যূষে এই সংবাদটি সংবাদপত্রে বাহির হয়, তাহার পূর্ব্বদিবস অর্থাৎ যে রাত্রিতে মৃতদেহ রাজবরে উপর পাওয়া যায়, বা রাজবর্গ হইতে যে রাত্রিতে ওই মৃতদেহ অপহৃত হয়, সেই রাত্রি হইতেই আমি ওই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলাম। এই ঘটনার সংবাদ পাইতে অতিশয় বিলম্ব হইয়াছিল বলিয়াই আমরা প্রথম অবস্থায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইতে পারি না। আজকাল প্রায় সমস্ত থানাতেই যেরূপ টেলিফোনের তার সংযোজিত হইয়াছে, সেই সময় সেইরূপ ছিল না। সেই সময় সহরের মধ্যে টেলিফোনের বহুল প্রচার হয় নাই, বা থানায় থানায় উহা সংযোজিত ছিল না। তখন কাজেই লোক মারফতে সংবাদ ইত্যাদি প্রেরণ করা হইত। সুতরাং, সুদূরবর্তী কর্ম্মচারিগণকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইতে প্রায়ই বিশেষ বিলম্ব হইয়া পড়িত। সহরতলীর অন্তর্গত একটি প্রশস্ত রাজবর্তের উপর বিশেষরূপ আঘাত-চিহ্ন-সমন্বিত একটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, এই সংবাদ আমরা প্রাপ্ত হইবামাত্রই আমাদিগের থানা হইতে বহির্গত হইয়া ঘটনাস্থলে আগমন করি। যে সময় আমরা ঘটনাস্থলে আসিয়া উপস্থিত হই, সেই সময় আমরা মৃতদেহ দেখিতে পাই না। শুনিতে পাই, সেই মৃতদেহ একখানি চারিপায়ার উপর স্থাপিত ছিল। ওই চারিপায়ার সহিত উহা সেই স্থান হইতে অপহৃত হইয়াছে। 

কিরূপে ওই মৃতদেহ সেইস্থানে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল, তাহা স্থানীয় পুলিসের সেই কর্ম্মচারীর নিকট হইতে অবগত হইতে পারিলাম। কিন্তু কিরূপ উপায়ে উহা অপহৃত হইয়াছে, তাহা বিশেষরূপ কিছুই জানিতে পারিলাম না। যে প্রহরীর জিম্মায় ওই মৃতদেহ রক্ষিত ছিল, সেই প্রহরীকেও প্রাপ্ত হইলাম না। সেই প্রহরী ওই মৃতদেহের সহিত গমন করিয়াছে, কি মৃতদেহ অপহৃত হইয়া গিয়াছে জানিতে পারিয়া, কাহাকেও কিছু না বলিয়া উহার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত গমন করিয়াছে, তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। তথাপি আমরা সকলে সেই মৃতদেহের অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলাম। কিরূপে উহা অপহৃত হইয়াছে, তাহা উত্তমরূপে অবগত হইতে না পারিলে, যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান হইয়া থাকে এই অনুসন্ধানও প্রথমে সেইরূপ ভাবে চলিতে লাগিল। লোকজন যতদূর সংগ্রহ হইতে পারে, তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া নিকটবর্ত্তী জঙ্গলের নানাস্থানে উহার অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম; কিন্তু কোন স্থানেই ওই মৃতদেহ দেখিতে পাইলাম না, না কেহ কোনরূপ সংবাদও প্রদান করিতে পারিল না, যে কাহারা উহা লইয়া কোনদিকে গমন করিয়াছে। 

এইরূপে, ক্রমাগত দুই তিন ঘণ্টাকাল অনুসন্ধান করিবার পর, যে পুলিস-প্রহরীর পাহারা হইতে ওই মৃতদেহ অপহৃত বা স্থানান্তরিত হইয়াছিল, সেই প্রহরীকে দেখিতে পাইলাম। তাহাকে দেখিয়া অনুমান হইল, তাহার যেন বুদ্ধি লোপ পাইয়া গিয়াছে। তাহাকে যাহা জিজ্ঞাসা করা হইল, সে তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিয়া উঠিতে পারিল না। কখনও বা সে আমাদিগের কথার উত্তর না দিয়া দূরে গিয়া উপবেশন করিতে লাগিল, কখনও বা বিস্তর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার পর অসংলগ্ন ভাবে তাহার দুই একটির উত্তর প্রদান করিতে লাগিল। তাহার নিকট হইতে অনেক কষ্টে যাহা অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহার সার মর্ম্ম এইরূপ। ওই প্রহরী কহিয়াছিল, “আমি যে সময় মৃতদেহের পাহারায় নিযুক্ত থাকিয়া রাস্তার উপর চারিপায়ার নিকট বসিয়াছিলাম, সেই সময় কে যেন বলিয়া উঠিল “তুই ভাল চাস ত এই স্থান হইতে চলিয়া যা” আমি মৃতদেহ লইয়া সেই সময় যেস্থানে বসিয়া ছিলাম, সেই সময় সেই স্থানে অপর কোন ব্যক্তি ছিল না; সুতরাং, ওইরূপ কথা শুনিয়া হঠাৎ আমার মনে কেমন একরূপ ভয়ের উদয় হইল। কে আমাকে সেই স্থানে হইতে চলিয়া যাইতে কহিতেছে, তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। চতুর্দিকে অনুসন্ধান করিলাম, কোন লোকজন দেখিতে পাইলাম না। মনুষ্যের শব্দ আমার কর্ণে প্রবেশ করিল, অথচ কোন মনুষ্য দেখিতে না পাইয়া আমার হৃদয়ে আরও ভয়ের উদ্রেক হইল। মনে করিলাম, সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া লোকালয়ে গমন করি, কিন্তু কর্তব্যকর্ম্মে ত্রুটি হইবার ভয়ে তাহাও করিতে পারিলাম না। সেই সময় মনুষ্য-কণ্ঠধ্বনি আমার কর্ণে পুনরায় প্রবেশ করিল। প্রথমতঃ ওই কণ্ঠ-ধ্বনি দূর হইতে আসিতেছে, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝিলাম, কেহ যেন আমার পশ্চাতে দণ্ডায়মান হইয়া আমাকে বলিতেছে, “তুই ব্রাহ্মণ, তাই পুনরায় বলিতেছি; নতুবা, এখনই তোকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করিতাম। আমার কথা শোন, এখনও তুই এই স্থান হইতে পলায়ন কর্।” এইরূপ শুনিয়া আমি আমার পশ্চাদ্দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলাম। কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না, অথচ কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। মনে কেমন একরূপ আতঙ্ক আসিয়া উপস্থিত হইল। সেই সময় আমার দক্ষিণপার্শ্বস্থিত জঙ্গলের দিক হইতে কেমন একরূপ বিকট হাস্য উত্থিত হইল; বোধ হইল, যেন একজন প্রথমতঃ সেই হাস্যরব উত্থিত করিল, ও আরও কয়েকজন বিকট শব্দে সেই হাস্যে যোগদান করিল। আমি সেই দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলাম, কিন্তু, কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। সেই ভয়ানক বিকট হাস্যরব বন্ধ হইলে সেই স্থান যেন নিৰ্জ্জন বোধ হইতে লাগিল। এবার, আর আমি সেই স্থানে বসিয়া থাকিতে পারিলাম না, উঠিয়া দাঁড়াইলাম। সেই সময় আমার যে কিরূপ অবস্থা হইয়াছিল, তাহা আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। আমার নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ আমি নিজেই শুনিতে লাগিলাম। আমি যেমন দণ্ডায়মান হইলাম, অমনি হো হো হাস্যধ্বনি চতুর্দ্দিকে বিকীর্ণ হইয়া পড়িল; সেইসঙ্গে আমারও অন্তরাত্মা শুখাইয়া গেল। আমি অজ্ঞানের ন্যায় সেই স্থানে পুনরায় বসিয়া পড়িলাম। আমি পূর্ব্বে ভাবিয়াছিলাম, কোন দুষ্ট লোক আমাকে ভয় প্রদর্শন করিবার মানসে ওইরূপ করিতেছে; কিন্তু আমার সেই বিশ্বাস তখনই অন্তর্হিত হইল। ভাবিলাম, আমি এবার মনুষ্যের হস্তে পতিত হই নাই, পৈশাচিক কাণ্ডের ভিতর পতিত হইয়াছি। যে ব্যক্তি হত হইয়াছে, সেই ব্যক্তি ভূতযোনী প্রাপ্ত হইয়া আমাকে এইরূপ ভয় প্রদর্শন করিতেছে। যেস্থানে একটিমাত্র জনমানব দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না, সেই স্থানে মনুষ্যের এইরূপ বিকট হাস্য ও ভয়ব্যঞ্জক বাক্যসমূহ কোথা হইতে আসিবে? আমি মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া পুনরায় সেই স্থানে বসিলাম সত্য, কিন্তু স্থির থাকিতে পারিলাম না; পুনরায় উঠিলাম। এবার ভাবিলাম, আমার কর্তব্যকর্ম্মের ত্রুটি হউক, মৃতদেহ এই স্থানে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলে আমি দণ্ডিত হই বা আমি আমার কর্ম্মচ্যুতই হই, আমি কিন্তু এই স্থানে আর বিন্দুমাত্রও অপেক্ষা করিব না, এখনই আমি এই স্থান পরিত্যাগ করিয়া লোকালয়ে গমন পূৰ্ব্বক আপন জীবনরক্ষা করিব। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার মানসে সেইস্থান পরিত্যাগ করিতে চাহিলাম। কিন্তু আমার পদদ্বয় আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইল, কিছুতেই উহাদিগকে অগ্রগামী করিতে সমর্থ হইলাম না। তখন অনন্যোপায় হইয়া আমি পুনরায় সেইস্থানে বসিলাম। বসিলাম সত্য, কিন্তু বসিবার পরই যে দৃশ্য আমার নয়নপথে পতিত হইল, যতদিবস বাঁচিব, তাহা আর আমি ভুলিব না। দেখিলাম, মৃতদেহ সহিত সেই চারিপায়া আপনা আপনিই ক্রমে মৃত্তিকা হইতে উত্থিত হইতে লাগিল। কিছুদূর উঠিয়াই উহা ঘুরিতে আরম্ভ করিল, ও বিঘূর্ণিত অবস্থায় ক্রমে সেই চারিপায়া ঊর্দ্ধদেশে উঠিয়া আমার দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইয়া পড়িল। ইহার পর যে কি হইল, তাহা আমি বলিতে পারি না। এই অবস্থা দেখিয়াই আমার চৈতন্য বিলোপ প্রাপ্ত হইয়াছিল। আমি কোথায় ছিলাম বা কি করিয়াছিলাম তাহার কিছুই বলিতে পারি না। আমার কিছুই মনে নাই। যখন আমার পুনরায় সংজ্ঞা হইল, তখন দেখিলাম, আপনারা সকলে মিলিয়া ওই মৃতদেহের অনুসন্ধান করিতেছেন। 

প্রহরী পশ্চিমদেশবাসী ব্রাহ্মণ, পাঁড়ে আখ্যায়ে অভিহিত হইয়া থাকে। বহু দিবসের পুরাতন চাকর। এই পুলিসে ২০/২৫ বৎসরকাল কায কৰ্ম্ম করিয়া পেন্‌সন লইবার সময় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। নিতান্ত নির্ব্বোধ বা অকৰ্ম্মণ্য লোক বলিয়া তাহার প্রধান কর্ম্মচারিগণের নিকট সে বিদিত নহে। অধিকন্তু বুদ্ধিমান কনেষ্টেবল বলিয়াই সকলে তাহাকে জানিত এবং একটি খোসনামী* চিহ্নও সে ধারণ করিত। 

[* যে কনেষ্টেবলকে খোসনামী চিহ্ন অর্থাৎ চাঁদীর বেল্লা প্রদত্ত হয়, সে উপযুক্ত ও কার্য্যক্ষম বলিয়া অভিহিত হয়। ওই খোসনামী চিহ্নের নিমিত্ত সে মাসে মাসে এক টাকা করিয়া অতিরিক্ত বেতন পাইয়া থাকে। ]

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

পাঁড়ের কথা শুনিয়া প্রকৃত কথা যে কি, তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। আমরা যে সকল কৰ্ম্মচারী এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, তাহার মধ্যে অনেক দেশীয় লোক ছিলেন, সাহেব ছিলেন, বাঙ্গালী ছিলেন, হিন্দুস্থানী ছিলেন ও মুসলমান ছিলেন। পাঁড়ের কথা শুনিয়া কেহ বা কহিলেন “পাঁড়ে যাহা কহিল, তাহা যে একেবারে হইতে পারে না, তাহা বলি কি প্রকারে? ওই মৃতব্যক্তি নিশ্চয়ই ভূতযোনী প্রাপ্ত হইয়াছে, ও পরিশেষে চারিপায়া সমেত নিজদেহ উঠাইয়া লইয়া গিয়াছে; নতুবা, মৃতদেহ কোথায় গমন করিল? কেই বা লইয়া গেল? মৃতদেহ এই স্থান হইতে স্থানান্তরিত করিবার কাহারও তো প্রয়োজন দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না। যদি কাহারও প্রয়োজনই থাকিত, তাহা হইলে এই স্থানে পুলিস আগমন করিবার পূর্ব্বেই সে অনায়াসে ওই মৃতদেহ স্থানান্তরিত করিতে পারিত। ইহা মনুষ্যের কার্য্য নহে, ইহা নিশ্চয়ই পৈশাচিক কাণ্ড।” 

এই কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া অপরাপর কর্ম্মচারিগণ বিস্মিত হইলেন। ইংরাজ কর্মচারিগণের মধ্যে একজন কহিলেন, “এ দেশে পূর্ব্বে অনেক ভূত প্রেত ছিল শুনিয়াছি। কিন্তু এই প্রদেশে ইংরাজ-রাজত্ব বিস্তীর্ণ হইবার সঙ্গে সঙ্গে সেই সকল ভূত প্রেত এ দেশ পরিত্যাগ করিয়া অন্য দেশে পলায়ন করিয়াছে ও এখন অপঘাতে বা অন্য কোনরূপে মৃত্যু হইলে আর ভূত হয় না। কনেষ্টবল যাহা বলিতেছে, তাহার একবর্ণও সত্য নহে; হয় ত সে পাহারার সময় নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছিল। তাহাকে জব্দ করিবার অভিপ্রায়ে বা তাহাকে কষ্ট দিবার নিমিত্ত তাহার কোন শত্রুপক্ষীয় লোক ওই মৃতদেহ স্থানান্তরিত করিয়া রাখিয়াছে। কনেষ্টবল নিজের দোষ স্বীকার করিতে সাহসী না হইয়া, এক অদ্ভুত মিথ্যা কথা কহিয়া তাহার নির্দোষিতা প্রমাণ করিতে বসিয়াছে। তাহার বিশ্বাস, যদি আমরা তাহার কথায় বিশ্বাস করি, তাহা হইলে আর তাহাকে কোনরূপ দণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে না। বিনা-দণ্ডে সে অনায়াসেই নিষ্কৃতিলাভ করিতে সমর্থ হইবে।” 

সাহেব কর্মচারীর কথা শুনিয়া অপর একজন দেশীয় কৰ্ম্মচারী কহিলেন “আমারও বিশ্বাস, পাঁড়ে যাহা কহিতেছে তাহার একবর্ণও সত্য নহে, সকলই মিথ্যা। কাহারও কর্তৃক বিশেষরূপ আঘাত প্রাপ্ত হইয়া ওই ব্যক্তির মৃত্যু হইয়াছে। এরূপ অবস্থায় ওই মৃতদেহ চারিপায়ার উপর প্রাপ্ত হইবার কোনরূর সম্ভাবনা নাই। উহার মৃত্যু হইবার পর ওই মৃতদেহ চারিপায়ার উপর উঠাইয়া ও নববস্ত্রে উহা আচ্ছাদিত করিয়া কোন ব্যক্তি কোনরূপ অভিসন্ধির নিমিত্ত কোন স্থানে লইয়া যাইতেছিল। এই অভিসন্ধির এক কারণ এই হইতে পারে, যে, যাহাদিগের দ্বারা এই ব্যক্তি হত হইয়াছে, তাহারা ওই মৃতদেহ অনায়াসেই স্থানান্তরিত করিতে পারে; কারণ, তাহাদিগের বিশেষরূপ অবগত থাকিবার কথা, যে যদি পুলিস ওই মৃতদেহ প্রাপ্ত না হয়, তাহা হইলে তাহাদিগের বিপদের সম্ভাবনা অতি অল্পই হইয়া পড়ে। এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া ওই মৃতদেহ চারিপায়ার উপর রাখিয়া নূতন বস্ত্রে উহা আচ্ছাদিত করিয়া উহা জ্বালাইয়া দিবার নিমিত্ত অথবা কোন স্থানে লুকাইয়া রাখিবার নিমিত্ত লইয়া যাইতেছিল। এই স্থানে আসিয়া উপনীত হইলে উহারা কোনরূপ প্রতিবন্ধক প্রাপ্ত হয়, ও এই স্থানে চারিপায়া সমেত মৃতদেহ রাখিয়া আপনাপন প্রাণ বাঁচাইবার আশায় স্থানান্তরে গমন করে বা ইহার নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে লুক্কায়িতভাবে থাকে। ক্রমে পুলিস আসিয়া উপস্থিত হয়; সুতরাং, তাহারা ওই মৃতদেহ আর স্থানান্তরিত করিতে সমর্থ হয় না। পরে যখন দেখিতে পায়, যে ওই মৃতদেহ কেবলমাত্র একজন পুলিস-প্রহরীর পাহারায় রহিয়াছে, তখন হয় কোন গতিকে তাহাকে বশীভূত করিয়া, না হয় তাহার অনবধানতা বশতঃ কোনরূপ সুযোগ পাইয়া, পরিশেষে ওই চারিপায়া-সমেত ওই মৃতদেহ লইয়া তাহারা প্রস্থান করিয়াছে। কনেষ্টবল যাহা কহিতেছে, তাহার সমস্ত মিথ্যা, উহা একেবারেই অসম্ভব।” 

ইহার কথা শুনিয়া আর একজন কহিলেন “ইহা কি হইতে পারে না? আপনি যেরূপ কহিলেন, সেইরূপ ভাবে ওই মৃতদেহ ওই স্থানে আনীত হয় ও কোনরূপ প্রতিবন্ধক প্রাপ্ত হইয়া উহারা নিকটবর্তী জঙ্গলের ভিতর লুকাইয়া থাকে। পরিশেষে যখন কেবলমাত্র প্রহরীকে সেই স্থানে একাকী দেখিতে পায়, সেই সময় তাহারা ওই প্রহরীকে ভয় প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত জঙ্গলের ভিতর হইতে কথা কহিয়া বা হাসিয়া ওই প্রহরীকে ভয় দেখাইবার চেষ্টা করে। রাত্রিকালে মৃতদেহ লইয়া ওই মূর্খ কনেষ্টবল একাকী সেই স্থানে ছিল; সুতরাং, সে অনায়াসেই অতিশয় ভীত হইয়া পড়ে ও আপন জীবন রক্ষা করিবার মানসে মৃতদেহ পরিত্যাগ পূর্ব্বক সেই স্থান হইতে স্থানান্তরে প্রস্থান করে। এই সুযোগে সেই লুক্কায়িত ব্যক্তিগণ লুক্কায়িত স্থান হইতে বহির্গত হইয়া ওই মৃতদেহ সহ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। নতুবা সেই মৃতদেহ ওই স্থান হইতে অপহৃত হইবার পর যখন অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারিগণ সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন, তখন সেই কনেষ্টবলকে দেখিতে পাওয়া যায় না। এমন কি দুই তিনঘণ্টাকাল সেই কনেষ্টবল সেই স্থানে পুনরায় আগমন করে না। ওই মৃতদেহ চারিপায়ার সহিত ঘুরিতে ঘুরিতে কোথায় চলিয়া গেল, প্রভৃতি যে সকল কথা কনেষ্টবল কহিতেছে, তাহার একবর্ণও প্রকৃত নহে, সমস্তই মিথ্যা; কিন্তু মনুষ্যের কথা ও হাস্যকরা প্রভৃতির কথা, সে যাহা কহিতেছে, তাহা আমি একেবারে অবিশ্বাস করিতে পারিতেছি না।” 

এইরূপে কৰ্ম্মচারিগণের মধ্যে যাহার মনে যাহা আসিয়া উপস্থিত হইল, তিনি সেইরূপ কহিলেন; কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে যে কি অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহা সেই সময় কেহই কিছুই অনুমান করিয়া উঠিতে পারিলেন না। যাহা হউক, সকলেই এখন ওই মৃতদেহের অনুসন্ধানের নিমিত্ত মন সংযোগ করিয়া যে সে স্থানে গমন করিতে লাগিলেন। নানাস্থানে সংবাদ সকল প্রেরিত হইতে লাগিল। নিকটবর্তী স্থান সকলে ও শব দাহ ও শব প্রোথিত করিবার স্থানে তখনই সংবাদ প্রেরণ করা হইল। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

কর্ম্মচারী মাত্রেই ওই মৃতদেহের অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন সত্য, কিন্তু সমস্ত রাত্রির মধ্যে কেহই কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলেন না। এইরূপে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজন কর্ম্মচারী ওই মৃতদেহের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আসিয়া উপস্থিত হইলেন। 

যেস্থানে ওই মৃতদেহ সৰ্ব্বপ্রথম দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল, তাহার সন্নিকটে একটি পুরাতন বাগানের মধ্যে কতকগুলি লোকের বাসস্থান। স্থানীয় পুলিস-কর্ম্মচারী সেই স্থানেই অনুসন্ধান করিবার সময় মৃতদেহ অন্তর্হিত হইয়াছিল। যে রাস্তার উপর ওই মৃতদেহ পাওয়া যায়, তাহার পূর্ব্বদিকে ওই বাগান। এই বাগানের পূর্ব্বে একাদিক্রমে আরও কতকগুলি বাগান আছে। তাহার কতকগুলির অবস্থা উত্তম; উহাতে বাসোপযোগী বাড়ী আছে এবং ওই সকল বাগানের মধ্যে মালিকগণ বাস করিয়া থাকে। অপর কয়েকটি বাগানের অবস্থা খুব ভাল না হইলেও উহার অবস্থা একেবারে হীন নহে। বাগানের মধ্যে বাড়ী আছে; উহা পুরাতন। কোন বাগান খালি থাকে, কোন বাগানে বা কেহ বাস করে। এই সকল বাগান ব্যতীত আরও দুই তিনটি বাগান আছে। উহার অবস্থা অতিশয় শোচনীয়। উত্তম উত্তম ফুল পুষ্পের বৃক্ষাদি লোপ পাইয়া গিয়াছে। তাহার পরিবর্তে কতকগুলি জঙ্গলী বৃক্ষ উৎপন্ন হইয়া ওই স্থানকে একেবারে জঙ্গলে পরিণত করিয়াছে। পুষ্করিণীতে এরূপ ভাবে দাম ও শৈবাল উৎপন্ন হইয়াছে, যে উহার জল কাহারও নয়ন গোচর হয় না। 

সুর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ওই সকল বাগানের ভিতর প্রবেশ করিলাম। ওইস্থানে যতগুলি বাগান ছিল, তাহার প্রত্যেকটির ভিতর প্রবেশ করিয়া উত্তমরূপে দেখিতে লাগিলাম। এইরূপে এক বাগান দেখিয়া অপর বাগানে, সেই বাগান দেখিয়া পুনরায় আর এক বাগানে, প্রবেশ করিতে লাগিলাম। এইরূপে অন্যূন প্রায় এক মাইল গমন করিবার পর, পরিশেষে একটি জঙ্গলময় বহু পুরাতন বাগানের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। ওই বাগানের অবস্থা দেখিয়া অনুমান হইল, দিবাভাগে যদি কেহ এই স্থানে হত্যা বা অপর কোন দুরূহ কার্য্য সমাপন করে, তাহা হইলেও ইহা অপরের জানিবার সম্ভাবনা নিতান্ত অল্প। ওই স্থান একে জনশূন্য, তাহাতে এরূপ জঙ্গলে পূর্ণ, যে তাহার মধ্যে দিবাভাগে দুই একজন প্রবেশ করিলে মনে মনে বিশেষরূপে ভয়ের সঞ্চার হয়। 

ওই বাগানের ভিতর আমরা একেবারে ৮/১০ জন প্রবেশ করিয়াছিলাম; সুতরাং, ভীত হইবার কারণ আমাদিগের অতি অল্পই ছিল। সেই বাগানের ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিতে করিতে দেখিতে পাইলাম, একটি নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে একখানি নূতন চারিপায়া পড়িয়া রহিয়াছে ও তাঁহার সন্নিকটে একটি কবর কতকগুলি লতা পাতায় আচ্ছাদিত রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া আমাদিগের মনে বিশেষ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। মনে করিলাম, আমরা যে মৃতদেহের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি, সেই মৃতদেহ এই স্থানে প্রোথিত আছে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমরা তখনই সেইস্থান খনন করিতে আরম্ভ করিলাম। প্রায় দুই হস্ত পরিমিত মৃত্তিকা খোদিত হইলে দেখিতে পাওয়া গেল, যে উহার মধ্যে একটি মৃতদেহ রহিয়াছে। ওই স্থান কবর স্থান নহে, অপর কোন মৃতদেহ সেই স্থানে প্রোথিত হয় না; সুতরাং, কবরের মধ্যে যে মৃতদেহ দেখিতে পাওয়া গেল, তাহা আমরা সেই স্থান হইতে উঠাইলাম। দেখিলাম, উহা পশ্চিমদেশীয় নীচবংশ সম্ভূত কোন এক হিন্দুর মৃতদেহ। উহার মস্তকে অতিশয় জখমও আছে। স্থানীয় পুলিস-কৰ্ম্মচারী, যিনি অন্তর্হিত মৃতদেহ পূর্ব্বে দর্শন করিয়াছিলেন, তিনি এই মৃতদেহ দেখিবামাত্র কহিলেন, “যে মৃতদেহ অপহৃত হইয়াছে, ইহাই সেই মৃতদেহ।” 

যে অনুসন্ধানে আমরা এতগুলি লোক নিযুক্ত হইয়াছিলাম, তাহার এক অধ্যায় এই স্থানেই শেষ হইয়া গেল। এখন অনুসন্ধানের যাহা প্রধান কাৰ্য্য, তাহাই বাকী রহিল। এখন আমাদিগকে এই কয়েকটি বিষয় অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে। 

১। ওই মৃতদেহ কাহার? 

২। উহার মস্তক কাহার দ্বারা বিচূর্ণ হইল? 

৩। কাহারা উহাকে আনিয়া রাস্তার উপর রাখিয়া দিয়াছিল? 

৪। ওই রাস্তা হইতে চারিপায়া সহিত ওই মৃতদেহ কে স্থানান্তরিত করিল? 

৫। কেইবা উহা বহন করিয়া এই জঙ্গলময় বাগানের মধ্যে আনিল? ও কেইবা কবর কাটিয়া উহাকে প্রোথিত করিল? 

এই পাঁচটি বিষয় আমাদিগকে অনুসন্ধান করিতে হইবে সত্য, কিন্তু কি উপায় অবলম্বন করিলে আমরা ওই সকল বিষয়ের রহস্য উৎঘাটন করিতে সমর্থ হইব, ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কোন ব্যক্তি যে ইহাকে হত্যা করিয়াছে, সে বিষয়ের আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই, কিন্তু ইহাকে হত্যা করিবার কারণ কি? আর যদি কোন ব্যক্তি হত্যার্থে ইহাকে হত্যা করিল, তাহা হইলে ওই মৃতদেহ চারিপায়ার উপর স্থাপিত ও নববস্ত্রে আচ্ছাদিত করিয়া হত্যাস্থান হইতে স্থানান্তরিত করিবার প্রয়োজনই বা কি? কোন অজানিত কারণে যদি ওই মৃতদেহ স্থানান্তরিত হইতেছিল তাহা হইলে রাজবর্গের মধ্যস্থানে ওই মৃতদেহ পরিত্যাগ করিয়া বাহকগণ প্রস্থান করিল কেন? কেনই বা পরিশেষে পুলিস-প্রহরীর চক্ষে ধূলি প্রদান করিয়া পুনরায় উহা স্থানান্তরিত ও এই নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে প্রোথিত করিয়া রাখিয়া দিল? 

এই মৃতদেহ কাহার, তাহা যদি জানিতে পারা যায়, তাহা হইলে এই রহস্যের কিয়দংশ বোধ হয় সহজেই উৎঘাটিত হইতে পারে। মনে মনে ইহা স্থির করিয়া ওই মৃতদেহটি পুনরায় সেই চারিপায়ার উপর স্থাপিত করিলাম ও সেই বাগান হইতে উহা বাহির করিয়া আনিয়া যেস্থানে উহা সৰ্ব্বপ্রথম দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল, সেই স্থানে উন্মুক্ত অবস্থায় রাখিয়া দিলাম। নিকটবৰ্ত্তী লোক সমবেত হইয়া ওই মৃতদেহ দর্শন করিতে লাগিল। পথিকগণ কিয়ৎক্ষণ স্থিরভাবে দণ্ডায়মান হইয়া উহা উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিয়া চলিয়া যাইতে লাগিল। কিন্তু ওই মৃতদেহ যে কাহার, তাহা কেহই বলিয়া উঠিতে পারিল না। এইরূপ অবস্থায় ওই মৃতদেহ ওই স্থানে কিছুক্ষণ রাখিয়া পুনরায় উহা অন্যস্থানে লইয়া গেলাম। সেই স্থানে পুনরায় উহা ওই রূপে স্থাপিত করিয়া অনেককে দেখাইতে লাগিলাম। যখন দেখিলাম, ওই স্থানেও কোন ব্যক্তি উহাকে চনিতে পারিল না। তখন ওই মৃতদেহ পুনরায় অপর স্থানে লইয়া গেলাম। এইরূপে প্রায় দুই ক্রোশের মধ্যে পাড়ায় পাড়ায় রাস্তায় রাস্তায়, ওই মৃতদেহ স্থাপিত করিয়া সকলকে দেখাইতে দেখাইতে প্রায় সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। কিন্তু কেহই ওই মৃতদেহ চিনিয়া উঠিতে পারিল না। তখন যে স্থানে মৃতদেহ সৰ্ব্বপ্রথম দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল, নিতান্ত ভগ্নহৃদয়ে সেই স্থানে প্রত্যাগমন করিতে লাগিলাম। প্রত্যাবর্তন করিবার কালীন দেখিলাম, রাস্তার একপার্শ্বে কতকগুলি পশ্চিমদেশীয় লোক তাড়িপূর্ণ ভাঁড় লইয়া বসিয়া রহিয়াছে। ওই স্থানে মৃতদেহটি একবার নামাইলাম, ও সেই তাড়ি-বিক্রেতাগণকে কহিলাম, “দেখ দেখি, তোমরা ইহাকে কোন স্থানে দেখিয়াছ কি?” 

আমার কথা শুনিয়া উহারা আপনাপন তাড়ির ভাঁড় আপনাপন স্কন্ধে উঠাইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার উদ্যোগ করিল। আমি বুঝিলাম, তাহারা একটু ভীত হইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার উদ্যোগ করিতেছে। 

আমি তাহাদিগকে নিবারণ করিয়া পুনরায় কহিলাম “তোমাদিগের কোন ভয় নাই, এই মৃতদেহটি একবার দেখ দেখি, ইহাকে তোমরা আর কোন স্থানে দেখিয়াছ, বা এই ব্যক্তি তোমাদিগের পরিচিত কি না?” 

আমার কথা শুনিয়া তাহারা কি জানি কি ভাবিয়া তাহাদিগের তাড়ির ভাঁড় সেই স্থানে নামাইল ও ধীরে ধীরে সেই মৃতদেহের নিকট গমন করিয়া উহাকে উত্তমরূপে দেখিতে লাগিল। ওই মৃতদেহ অনেকক্ষণ পর্যন্ত দেখিয়া তাহাদিগের মধ্য হইতে একব্যক্তি কহিল “এ কৈলেশ্বর নহে?” 

২য় ব্যক্তি। সেইরূপই ত বোধ হইতেছে। 

৩য় ব্যক্তি। না, কৈলেশ্বর নহে; কিন্তু ইহার আকৃতি অনেকটা সেইরূপ বোধ হইতেছে। 

১ম ব্যক্তি। আমার বেশ বোধ হইতেছে, এ কৈলেশ্বর। 

আমি। কৈলেশ্বর কে? 

১ম ব্যক্তি। কৈলেশ্বর পাসি। 

আমি। সে কি করিত? 

১ম ব্যক্তি। পাখীর ব্যবসা করিত, গাছ কাটিত, তাড়ি প্রস্তুত করিত ও আমাদিগের ন্যায় তাড়ি লইয়া গিয়া বিক্রয় করিয়া আসিত। 

আমি। এ থাকিত কোথায়? 

১ম ব্যক্তি। চৌধুরী বাগানে। 

আমি। গাছ কাটত কোথায়? 

১ম ব্যক্তি। সেই ঘোষের বাগানে। ওই বাগানের যত তালগাছ ইহার জমা আছে। 

আমি। সেই ঘোষের বাগান এখান হইতে কতদূর? 

১ম ব্যক্তি। অনেক দূর নহে, এক ক্রোশের অধিক হইবে না। 

আমি। তোমরা বেশ চিনিতে পারিতেছ, যে ইহা ঘোষের বাগানের সেই কৈলেশ্বর পাসির মৃতদেহ? 

১ম ব্যক্তি। ইহাই ত আমাদিগের অনুমান হইতেছে? 

তাড়িওয়ালাদিগের নিকট হইতে এই কয়েকটি কথা অবগত হইতে পারিয়া আমাদিগের একটু সাহস হইল। তখন মনে করিলাম, ইহারা যাহা বলিতেছে তাহা যদি প্রকৃত হয়, ইহা যদি কৈলেশ্বরের মৃতদেহ, তাহা হইলে এই মোকদ্দমার কিনারা হইলেও হইতে পারিবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমরা ওই মৃতদেহ সমভিব্যাহারে তখনই সেই ঘোষের বাগান অভিমুখে গমন করিতে লাগিলাম। যে তাড়িওয়ালাগণের নিকট হইতে আমরা এই সংবাদ অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহাদিগকেও আমাদিগের সহিত যাইতে কহিলাম; কিন্তু, তাহারা প্রথমত আমাদিগের কথায় সম্মত হইল না। বলা বাহুল্য, তাহাদিগের সেই আপত্তি কোনরূপেই রহিল না। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাহাদিগকে আমাদিগের সহিত গমন করিতে হইল। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

আমরা যখন সেই ঘোষের বাগানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন আর অধিক বেলা ছিল না। সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, উহা একটি পুরাতন ও সুবৃহৎ বাগান। বৃক্ষাদি উহাতে বিস্তর আছে। দুইটি বৃহৎ পুষ্করিণী; কিন্তু বাগানের অবস্থা অতিশয় শোচনীয়। ওই বাগানে ইষ্টক-প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত হইলেও নানাস্থানে উহা পড়িয়া গিয়াছে। উহার কোন স্থান বাঁশ প্রভৃতির দ্বারা আবদ্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে, কোন স্থান একেবারে আবরণ শূন্য হইয়া রহিয়াছে। বাগানের সদর দরজা প্রায়ই বন্ধ থাকে, উহা খুলিবার প্রায়ই প্রয়োজন হয় না। নানাস্থানের প্রাচীর ভগ্ন হইয়া যাওয়ায় প্রায় চতুৰ্দ্দিক হইতেই ওই বাগানের ভিতর প্রবেশ করা যায়। ওই বাগানের নিকটবর্ত্তী কোন কোন স্থানে দুই চারি ঘর লোকের বাস আছে। তাহাদিগের বিচরণস্থল ওই বাগান। কোন দ্রব্যের প্রয়োজন হইলে তাহারা বিনা বাধায় ওই বাগানের ভিতর প্রবেশ করে ও নিজের ইচ্ছামত ফল মূলাদি লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। উহার মধ্যস্থিত পুষ্করিণীর জল তাহারা সর্ব্বদাই লইয়া যায়। ওই বাগানের ভিতর প্রবেশ করিবার সময় নিষেধ করিবার কোন লোক সেই স্থানে থাকে না। ওই বাগানের মধ্যে একটি অট্টালিকা আছে, উহা দেখিয়া অনুমান হয়, উহার অবস্থা পূৰ্ব্বে অতিশয় ভালই ছিল; কিন্তু এখন উহার অবস্থা নিতান্ত শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছে। উহার কোন স্থানের চূণ বালি খসিয়া পড়িয়াছে, কোন স্থান দিয়া অনবরত বৃষ্টিধারা বহির্গত হইয়া ঘরের ভিতরকার নানাস্থান দাগী ও ময়লা হইয়া গিয়াছে, এবং দুই এক স্থান একেবারে খসিয়াও পড়িয়াছে। যতগুলি ঘর আছে, তাহার সমস্তগুলিই প্রায় অব্যবহার্য্য হইয়া পড়িয়াছে। কেবলমাত্র একটি ঘরের অবস্থা দেখিয়া অনুমান হয়, কিছু দিবস পূর্ব্বে কেবলমাত্র ওই ঘরটি একবার মেরামত হইয়াছিল, ও বোধ হয়, এখনও উহা মধ্যে মধে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ওই বাগানের মধ্যে যেমন আম্ৰ লিচু প্রভৃতির বৃক্ষ অনেক আছে, সেইরূপ অনেকগুলি তাল বৃক্ষও তাহার ভিতর দেখিতে পাইলাম। ওই তাল বৃক্ষের অবস্থা দেখিয়া উত্তমরূপে বোধগম্য হইল, যে ওই সকল গাছ এখনও কাটা হইয়া থাকে, ও উহার রস হইতে তাড়ি প্রস্তুত করা হয়। 

আমরা ওই বাগানের ভিতর প্রবিষ্ট হইলে আমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ কতকগুলি বালক ও স্ত্রীলোক তাহার ভিতর প্রবেশ করিল। উহাদিগের মধ্যে কেহই ওই স্থান-বাসী নহে, উহারা অনেক দূর হইতে আমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিয়াছিল। আমাদিগকে ও সেই সকল লোকদিগকে ওই বাগানের মধ্যে প্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া, ওই স্থানের ও নিকটবর্ত্তী স্থানসমূহ হইতে অনেক বালক-বালিকা ও স্ত্রী পুরুষ ক্রমে ক্রমে আসিয়া আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইতে লাগিল। যে মৃতদেহ আমরা সঙ্গে লইয়া সেই স্থানে আগমন করিয়াছিলাম, তাহার আচ্ছাদনবস্ত্র উন্মোচিত করিয়া চারিপায়ার সহিত, উহা সেই স্থানে স্থাপিত করিলাম। ওই মৃতদেহ দেখিয়া অনেকেই চিনিতে পারিল। অনেকেই কহিল “এ ত কৈলেশ্বর।” 

আমার সেই স্থানে উপস্থিত হইবার বোধ হয় ২০ মিনিট বা অৰ্দ্ধঘণ্টা পরেই একটি স্ত্রীলোক কাঁদিতে কাঁদিতে আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। তাহার সহিত আরও এক ব্যক্তি আগমন করিল। জানিলাম, ওই স্ত্রীলোকটি কৈলেশ্বেরের স্ত্রী, ও তাহার সহিত যে ব্যক্তি আসিয়াছিল-সে তাহার পুত্র; উহার বয়ঃক্রম ২০ বৎসরের কম হইবে না। উহার নাম দুবলাল। 

দুবলাল ও তাহার মাতার অবস্থা দেখিয়া প্রথমে তাহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না, বা জিজ্ঞাসা করিয়াও তাহাদিগের নিকট হইতে সেই সময় কোনরূপ উত্তরও প্রাপ্ত হইলাম না। তাহারা শোকাচ্ছন্ন হইয়া কেবল উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। এইরূপে আরও অর্দ্ধঘণ্টা কাল সেই স্থানে অতিবাহিত হইয়া গেল। 

অর্দ্ধঘণ্টা পরে দেখিলাম, দুবলালের ক্রন্দন একটু কমিয়া আসিল। তখন তাহাকে সঙ্গে লইয়া একটু দূরে গমন করিলাম ও তাহাকে অনেকরূপ বুঝাইয়া বলায়, সে একটু নিরস্ত হইল। তখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম দুবলাল?” 

দুবলাল। আজ্ঞা হাঁ, আমার নাম দুবলাল। 

আমি। কৈলেশ্বর তোমার কে হয়? 

দুবলাল। আমার পিতা। 

আমি। তোমার পিতার এরূপ অবস্থা কে ঘটাইল? 

দুবলাল। তাহা ত আমি বলিতে পারি না। তবে শুনিয়াছি, তাড়ি লইয়া এই বাগানে কি গোলযোগ ঘটিয়াছিল।

আমি। তাড়ি লইয়া গোলযোগ, তোমার পিতা তাড়ি পাইতেন কোথায়? 

দুবলাল। এই বাগানে যতগুলি তালগাছ আছে, তাহা আমার পিতার জমার মধ্যে। এই সমস্ত গাছেই তাড়ি হইয়া থাকে। ওই তাড়ি হইতেই আমবা জীবন ধারণ করি। 

আমি। এই বাগান হইতে যে সকল তাড়ি উৎপন্ন হইয়া থাকে, তাহা তোমরা কোথায় লইয়া গিয়া বিক্রয় করিয়া থাক? তোমাদিগের তাড়ির দোকান আছে কি? 

দুবলাল। না মহাশয়, আমাদিগের তাড়ির দোকান নাই। এই বাগান হইতে যে তাড়ি উৎপন্ন হইয়া থাকে, তাহা আমরা অপরের তাড়িখানায় লইয়া বিক্রয় করিয়া থাকি। 

আমি। তুমি বলিলে তাড়ি লইয়া তোমার পিতার সহিত কি গোলযোগ হইয়াছিল। কাহার সহিত গোলযোগ হইয়াছিল? 

দুবলাল। কাহার সহিত যে গোলযোগ হইয়াছিল, তাহা আমি দেখি নাই। 

আমি। তাহা হইলে গোলযোগ হইয়াছিল, একথা তুমি বলিলে কি প্রকারে? 

দুবলাল। আমি যাহা শুনিয়াছি, তাহাই বলিতেছি। 

আমি। কি শুনিয়াছ? 

দুবলাল। এই শুনিয়াছি, যে আমার পিতার সহিত তাড়ি লইয়া কি গোলযোগ হয় ও মারপিট হয়। 

আমি। কাহার সহিত গোলযোগ ও মারপিট হয়? 

দুবলাল। তাহা আমি জানিনা; তবে শুনিতেছিলাম, এই বাগানে কাহারা আসিয়াছিল; তাহাদিগের সহিত গোলযোগ ও মারপিট হইয়াছিল। 

আমি। তুমি এ কথা কাহার নিকট হইতে শুনিয়াছিলে? 

দুবলাল। এই বাগানের নিকটবর্তী স্থানে যে সকল লোকজন বাস করে, তাহাদিগের স্ত্রীলোকগণ বলাবলি করিতেছিল, তাহাই আমি শুনিয়াছি। 

আমি। তুমি যে সকল স্ত্রীলোকের নিকট হইতে ওই কথা শুনিয়াছ, তাহাদিগের কাহাকেও চিন?

দুবলাল। চিনি, কিন্তু নাম জানি না। তাহাদিগকে দেখাইয়া দিতে পারি। 

দুবলালের নিকট হইতে এই কথা শুনিয়া সেইস্থানে আর কালবিলম্ব না করিয়া তাহাকে সঙ্গে লইয়া তৎক্ষণাৎ সেই বাগানের সন্নিকটবর্ত্তী যে স্থানে মনুষ্যের বসবাস আছে, সেই স্থানে প্রবেশ করিলাম। দুবলাল আমাদিগকে দুইটি স্ত্রীলোককে দেখাইয়া দিয়া কহিল “আমি যে সকল স্ত্রীলোকদিগের নিকট হইতে ওই কথা শুনিয়াছিলাম, তাহার মধ্যে ইহারা দুইজনও ছিল।” 

আমি সেই স্ত্রীলোকদিগকে জিজ্ঞাসা করায় তাহারা সমস্ত কথা অস্বীকার করিল। তাহাদিগকে অনেক করিয়া বুঝাইয়া বলায়, পরিশেষে অপর দুইটি স্ত্রীলোকের নাম করিয়া কহিল “আমরা কিছু অবগত নহি, আমরা ওই দুইটি স্ত্রীলোকের নিকট হইতে শুনিয়াছিলাম মাত্র।” 

শেষোক্ত স্ত্রীলোক দুইটির নাম চাঁপা ও সুকদেইয়া। একটি বঙ্গদেশীয়া ও অপরটি পশ্চিমদেশীয়া স্ত্রীলোক। উহাদিগকে আমি অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু প্রথমতঃ তাহারা কোন কথা স্বীকার করিল না; কিন্তু তাহাদিগের ভাবগতিক দেখিয়া আমার বেশ অনুমান হইল, যে উহারা এই ঘটনার অনেক কথা অবগত আছে। যখন দেখিলাম, উহারা কোন কথা কহিল না, তখন সুকদেইয়াকে অপর একজন কর্ম্মচারীর হস্তে প্রদান করিলাম। তিনি তাহাকে লইয়া দূরে গমন করিলেন ও তাহার সহিত কথোপকথন আরম্ভ করিলেন। আমি চাঁপাকে লইয়া অপর একস্থানে গমন করিয়া একটি বৃক্ষমূলে উপবেশন করিলাম, ও তাহাকে বিস্তর রূপে বুঝাইতে লাগিলাম। তাহাকে অনেক করিয়া বলিতে বলিতে, পরিশেষে দেখিলাম, যে তাহার মনের কথা বলিতে সমর্থ হইল। তখন আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম 

‘তুমি এই বাগানে কি নিমিত্ত আসিয়াছিলে?” 

চাঁপা। জল লইবার নিমিত্ত। 

আমি। তোমার সহিত আর কে আসিয়াছিল? 

চাঁপা। সুকদেইয়া আসিয়াছিল, আমরা উভয়েই একস্থানে থাকি, ও জল লইবার নিমিত্ত আমরা উভয়েই এক সময় এই পুষ্করিণীর নিকট আগমন করিয়াছিলাম। 

আমি। তোমরা যখন বাগানের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলে, সেই সময় কৈলেশ্বর কোথায় ছিল? 

চাঁপা। তাহাকে আমরা প্রথমে দেখিতে পাই না, কিন্তু যখন তাহার সহিত গোলযোগ আরম্ভ হয়, তখন আমরা 

বাগানের উত্তর ধারের একটি তাল বৃক্ষের নিকট দেখিতে পাই। 

আমি। কাহার সহিত তাহার গোলযোগ হইতেছিল? 

চাঁপা। সেই বাবুটি। 

আমি। কোন্ বাবুটি? 

চাঁপা। যে বাবুটি উহাকে মারিয়াছিল?

আমি। সে বাবুটি কে? 

চাঁপা। তাহার নাম জানি না। 

আমি। তাহাকে আর কখনও দেখিয়াছ? 

চাঁপা। অনেক বার দেখিয়াছি। 

আমি। তিনি থাকেন কোথায়? 

চাঁপা। তাহাও আমি জানি না, কিন্তু তিনি প্রায়ই এই বাগানে আসিয়া থাকেন; আমার বোধ হয়, এই বাগানটি তাঁহারই। 

আমি। তাহাকে দেখিলে তুমি চিনিতে পারিবে? 

চাঁপা। তা আর পারিব না! তাঁহাকে আমি অনেকবার দেখিয়াছি। 

আমি। বাবুটি দেখিতে কেমন? 

চাঁপা। দেখিতে বেশ, খুব ফরসা, বয়সও অধিক নহে; বোধ হয় ২০/২২ বৎসরের অধিক হইবে না। 

আমি। সেই বাবুটি কি একাকী আসিয়াছিলেন? 

চাঁপা। না, তাঁহার সহিত আরও কয়েকজন ছিল। 

আমি। তাহারা বাঙ্গালী না অপর জাতি? 

চাঁপা। বাঙ্গালী বলিয়া বোধ হয় না। সকলের মাথাতেই সাদা টুপি ছিল। 

আমি। সেই বাবুর মাথাতেও কি টুপি ছিল? 

চাঁপা। হাঁ, তাহার মাথাতেও টুপি ছিল। 

আমি। সেই বাবুর সহিত কৈলেশ্বরের কি অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহা তুমি যতদূর নিজ চক্ষে দেখিয়াছ, তাহা বল দেখি। 

চাঁপা। আমরা যখন জল লইবার নিমিত্ত এই বাগানের মধ্যে প্রবেশ করি, সেই সময় কৈলেশ্বর যে কোথায় ছিল, তাহা আমরা দেখিতে পাই না। কিন্তু সেই সময় সেই বাবুটি ও সমভিব্যাহারী কয়েকজন ব্যক্তি বাগানের মধ্যে বেড়াইতেছিলেন। কিছুক্ষণ পরেই “না, আমি বেচিব না” এইরূপ একটি কথা শুনিতে পাইলাম; কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইলাম না। কারণ সেই সময় আমরা পুষ্করিণীর মধ্যে অবতরণ করিয়াছিলাম; সেই স্থান হইতে উপরে কিছুই দেখা যায় না। আমরা জল লইয়া যখন উপরে উঠিলাম, তখন দেখিলাম, কৈলেশ্বরের হস্তে এক ভাঁড় তাড়ি রহিয়াছে। ওই বাবুর সহিত অপর যাহারা ছিল, তাহাদিগের মধ্যে এক ব্যক্তি ওই তাড়ি কৈলেশ্বরের হাত হইতে লইবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু কৈলেশ্বর তাহা কিছুতেই ছাড়িতেছে না। কৈলেশ্বরের ব্যবহার দেখিয়া ও তাহার কথা শুনিয়া বাবুটি অতিশয় রাগিয়া উঠিলেন ও কহিলেন “পয়সা লইয়াও যদি ও তাড়ি না দেয়, তাহা হইলে উহাকে মার।” এই কথা বলিতে বলিতে তিনি দ্রুতগতি কৈলেশ্বরের দিকে দৌড়িয়া আসিলেন। সেই স্থানে অস্ত্র ধার দেওয়া একখানি কাষ্ঠ পড়িয়াছিল। বোধ হয়, উহা কৈলেশ্বরই সেইস্থানে রাখিয়াছিল। ওই বাবুটি সেই কাষ্ঠখণ্ড আপন হস্তে উঠাইয়া লইয়া কৈলেশ্বরের মস্তকে সজোরে এক আঘাত করিলেন। ওই আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে কৈলেশ্বর সেই স্থানে পড়িয়া গেল; আর তাহাকে নড়িতে চড়িতে দেখিলাম না। ইহা দেখিয়া আমাদের মনে অতিশয় ভয় হইল। আমরা দ্রুতপদে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া আপনাপন বাড়ীতে চলিয়া গেলাম। যে সময় আমরা বাগান হইতে চলিয়া যাই, সেই সময় বাগানের দরজার সম্মুখে বাবুর গাড়ি ঘোড়া ছিল। বাড়ীতে যাইয়া এই কথা আমরা দুই একজনকে কহিলাম, ও কি হইয়াছে তাহা দেখিবার নিমিত্ত পাড়ার সাত জন স্ত্রীলোক একত্রিত হইয়া সেই স্থানে আগমন করিলাম। সেই সময় সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল। বাগানে আসিয়া বাবুদিগের কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না, কৈলেশ্বরও সেই স্থানে ছিল না, বাবুর গাড়ি ঘোড়াও সেই স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছিল। তখন ভাবিলাম, কৈলেশ্বর হয়ত তাহার বাড়ীতে চলিয়া গিয়াছে, বাবুরাও বাগান হইতে প্রস্থান করিয়াছ। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমরাও আপনাপন বাড়ীতে গমন করিলাম। কৈলেশ্বর যে মরিয়া গিয়াছে, তাহার মৃতদেহ যে এই স্থান হইতে স্থানান্তরিত হইয়াছে, তাহা কিন্তু আমরা একবারের নিমিত্তও ভাবিয়াছিলাম না। কিন্তু এখন বুঝিতে পারিতেছি, ওই আঘাতেই কৈলেশ্বর ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। 

চাঁপার এই কথা শুনিয়া ঠিক যে কি অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহা বেশ বুঝিতে পারিলাম। সেই সময় যে কর্ম্মচারীর নিকট সুকদেইয়া ছিল, তিনি আসিয়া আমাকে কহিলেন “সুকদেইয়া সমস্ত কথা বলিয়াছে।” সুকদেইয়া যে কি বলিয়াছে, তাহাও তিনি আমাকে কহিলেন। দেখিলাম, চাঁপার কথার সহিত তাহার সমস্ত কথা মিলিয়া গিয়াছে। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

চাঁপা ও সুকদেইয়ার নিকট হইতে আমরা সেই সময় যাহা কিছু জানিতে পারিলাম, তাহাতেই আমাদিগের বেশ অনুমান হইল, যে এই মোকদ্দমার কিনারা হইতে আর বিশেষ বিলম্ব হইবে না; কারণ তাহাদিগের কথায় ইহা একরূপ প্রমাণ হইয়া গিয়াছে, যে এই বাগানে যে বাবুটি আগমন করিয়াছিলেন, তাঁহারই হস্তে কৈলেশ্বর হত হইয়াছে। তিনি উহার মস্তকে সজোরে যে আঘাত করিয়াছিলেন, সেই আঘাতেই উহার মস্তক বিচূর্ণ হইয়া যায় ও সেই স্থানেই সে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়। আরও জানিতে পারিলাম, সেই সময় তাহার সহিত আরও কয়েকজন অনুচর ও গাড়ি ঘোড়া, সহিস-কোচম্যান প্রভৃতি ছিল। আরও জানিতে পারা যাইতেছে যে, এই গোলমালের কিয়ৎক্ষণ পরেই আর তাহাদিগকে দেখিতে পাওয়া যায় নাই। এরূপ অবস্থায় সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে, যে ওই মৃতদেহ তাহাদিগের দ্বারাই স্থানান্তরিত হইয়াছিল। এ সকল লোকজন দ্বারা উহা স্থানান্তরিত না হইয়া অপর লোকজন সংগ্রহ করিয়া এত অল্প সময়ের মধ্যে ওই মৃতদেহ কোনরূপেই স্থানান্তরিত করা যাইতে পারে না। 

এখন আমাদিগের প্রধান কার্য্য, যে বাবুটির দ্বারা ওই ব্যক্তি হত হইয়াছে তিনি কে, ও তাঁহার সহিত যাহারা এই বাগানে আগমন করিয়াছিল, তাহারাই বা কে ও সকলে থাকে বা কোথায়? ইহা যদি এখন জানিতে পারা যায়, তাহা হইলে তাহাদিগকে ধৃত করিতে পারিলেই এই মোকদ্দমার কিনারা হইয়া যাইব ও প্রকৃত কথা যে কি, তাহা অনায়াসেই বাহির হইয়া পড়িবে। 

মনে মনে এইরূপ বিবেচনা করিয়া আমি সেই বাগান হইতে বহির্গত হইয়া, উহার পার্শ্বে যে আর একখানি বাগান ছিল, তাহার ভিতর প্রবেশ করিলাম। যে বাগান হইতে আমরা বহির্গত হইলাম, সেই বাগানের অবস্থা যেরূপ শোচনীয়, যে বাগানের মধ্যে প্রবেশ করিলাম, তাহার অবস্থা ততদূর শোচনীয় নহে। ওই বাগানের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলাম, উহাতে দুই তিনজন উড়িয়া মালি রহিয়াছে। তাহাদিগকে ডাকাইলে তাহারা আমার সম্মুখে আসিল। যে বাগানে গোলযোগ ঘটিয়াছিল, সেই বাগান কাহার, তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করায়, তাহারা কিছুই বলিতে পারিল না। তাহারা কহিল “আমরা নূতন লোক, কেবল তিন মাস হইল দেশ হইতে আসিয়াছি; সুতরাং, এখানকার কাহাকেও চিনি না, বা কোন্ বাগান কাহার, তাহাও কিছু জানি না। আমাদিগের সর্দ্দার মালি আজ দশ দিবস হইল দেশে গমন করিয়াছে। সে এই বাগানে অনেক দিন ছিল। সে থাকিলে সমস্তই বলিতে পারিত।” 

যে সময় আমি মালিদিগকে জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম ও তাহারা আমার কথার উত্তর প্রদান করিতেছিল, সেই সময় দুই একজন করিয়া ক্রমে চারি পাঁচ জন লোক সেই স্থানে সমবেত হইয়া পড়িয়াছিল। আমার ও মালির কথা শ্রবণ করিয়া তাহার মধ্য হইতে একজন কহিল, “আপনি যে বাগানের কথা জানিতে চাহিতেছেন, সেই বাগানে শম্ভু নামক একজন মালি অনেক দিবস ছিল; এখন কিন্তু সে আর সেই বাগানে থাকে না। ওই বাগানের অপর পার্শ্বে যে একটি বাগান আছে, সে এখন সেই বাগানে থাকে। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেই ওই বাগান যে কাহার, তাহা সে অনায়াসেই বলিয়া দিতে পারিবে, ও মনে করিলে সে আপনাদিগকে তাহার বাড়ীও দেখাইয়া দিতে পারিবে। কারণ যে সময়ে সে সেই বাগানে কর্ম্ম করিত, সেই সময় সে যে অনেক বার তাহার মনিবের বাড়ীতে গমন করিয়াছিল, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

ওই ব্যক্তির কথা শুনিয়া আমি আর সেই স্থানে তিলার্দ্ধও দণ্ডায়মান হইলাম না। যে বাগানে শম্ভু মালি থাকে, সেই বাগানের উদ্দেশে চলিলাম। সেই বাগানে গিয়া শম্ভুর অনুসন্ধান করিবামাত্র তাহাকে দেখিতে পাইলাম। বাগানের ফটকের পশ্চাদ্বর্ত্তী একটি গুদাম ঘরে সেই সময় সে তাহার আহারীয় প্রস্তুত করিতেছিল। 

ডাকিবামাত্র শম্ভু আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি তাহার নিকট গমন করিয়াছিলাম, তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, “প্রায় তিন বৎসর হইল, আমি ওই বাগান পরিত্যাগ করিয়াছি; সুতরাং, এই তিন বৎসরের কোন সংবাদ আমি বলিতে পারি না। তিন বৎসর পূর্ব্বে অর্থাৎ যে সময় আমি ওই বাগানে কর্ম্ম করিতাম, সেই সময় ওই বাগান বড়বাজারের একজন ক্ষেত্রির ছিল। প্রায় চারি বৎসর হইল, তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। তাঁহার মৃত্যুর এক বৎসর পর পর্যন্তও আমি বাগানে ছিলাম। এক বৎসর পরে আমার জবাব হয়। তাহার পর হইতেই আমি এই বাগানে কার্য্য করিতেছি।” 

আমি। যে সময় তোমার পুরাতন মনিবের মৃত্যু হয়, সেই সময় তাঁহার আর কে ছিল? 

শম্ভু। তাঁহার স্ত্রী ও দুইটি পুত্র ছিল। 

আমি। পুত্র দুইটি কত বড়? 

শম্ভু। দুইটিই ছোট ছিল, নাবালক ছিল। 

আমি। সেই সময় তাহাদিগের বয়ঃক্রম কত ছিল বলিয়া অনুমান হয়? 

শম্ভু। একটির বয়ঃক্রম বোধ হয় ১০/১২ বৎসর হইবে, অপরটি তাহা অপেক্ষা দুই এক বৎসরের বড় হইবে।

আমি। তোমার জবাব হয় কেন? 

শম্ভু। কর্তা মরিয়া যাওয়ায় উহাদিগের অবস্থা একটু হীন হইয়া পড়ে। তথাপি আমাদিগকে এক বৎসর রাখে, ও পরিশেষে আমাদিগকে জবাব দেয়। সেই সময় শুনিয়াছিলাম, তাহারা সুযোগ পাইলে ওই বাগান বিক্রয় করিয়া ফেলিবে। 

আমি। বিক্রয় করিয়াছিল কি না বলিতে পার? 

শম্ভু। না, তাহা আমি বলিতে পারি না। 

আমি। যে সময় তুমি ওই বাগানে কর্ম্ম করিতে, সেই সময় তোমার মনিবের বাড়ীতে তুমি যাইতে কি? 

শম্ভু। যাইব না কেন? প্রায় প্রত্যহই গমন করিতাম। বাগানের উৎপন্ন তরি তরকারী লইয়া প্রায়ই আমাকে গমন করিতে হইত। 

আমি। তোমার জবাব হইবার পর সেই বাড়ীতে আর কখনও গমন করিয়াছিলে? 

শম্ভু। একবার কি দুইবার গিয়াছিলাম; কিন্তু দুই বৎসরের মধ্যে আমি সেদিকে আর গমন করি নাই। 

আমি। তোমার জবাব হইবার পর তোমার মনিবের পুত্রদিগের সহিত আর দেখা হইয়াছিল কি? 

শম্ভু। ছোটবাবুর সহিত বড় দেখা শুনা হইত না, কিন্তু বড়বাবুর সহিত প্রায়ই দেখা হইয়া থাকে।

আমি। বড়বাবুর সহিত তোমার কোথায় দেখা হইয়া থাকে? 

শম্ভু। তিনি প্রায়ই বাগানে আসিয়া থাকেন। সুতরাং, মধ্যে মধ্যে কখনও কখনও আমার সহিত দেখাও হইয়া যায়। 

আমি। তিনি কোন্ বাগানে আসিয়া থাকেন? যে বাগানে তুমি এখন কৰ্ম্ম করিতেছ সেই বাগানে, না তাঁহার নিজের বাগানে? 

শম্ভু। এ বাগানে তিনি কখনও আগমন করেন না। মধ্যে মধ্যে তাঁহাকে তাঁহার পিতার বাগানে আসিতে দেখিয়াছি।

আমি। তুমি তাঁহাকে শেষ কবে দেখিয়াছ? 

শম্ভু। ৮/১০ দিন হইবে। 

আমি। ৮/১০ দিন পূর্ব্বে যখন তুমি তাঁহাকে দেখিয়াছিলেন, তখন তিনি কি একাকী আসিয়াছিলেন? 

শম্ভু। তাঁহাকে একাকী আসিতে প্রায়ই দেখি নাই। যখনই তাঁহাকে দেখিয়াছি, তখনই তাঁহার সহিত ৩/৪ জন লোক থাকে। 

আমি। ওই সকল লোক কাহারা? 

শম্ভু। তাহা আমি জানি না। উহাদিগকে আমি চিনি না। উহারা যে কোথায় থাকে, তাহাও আমি জানি না। সময় সময় উহাদিগের সহিত দুই একটি স্ত্রীলোককেও আসিতে দেখিয়াছি। 

আমি। বড়বাবু এখন কত বড় হইয়াছেন? 

শম্ভু। এখন খুব বড় হইয়াছেন। জোয়ান মদ্দ হইয়া দাঁড়াইয়াছেন। 

শম্ভুর নিকট এই সকল অবগত হইয়া, পরিশেষে তাহাকে আমাদিগের সঙ্গে লইয়া তাহার ভূতপূর্ব্ব মনিবের বাড়ী আমাদিগকে দেখাইয়া দিতে কহিলাম। সে প্রথমতঃ আমাদিগের কথায় অসম্মত হইল; কিন্তু, তাহাকে অনেক করিয়া বলায় ও অনেকরূপ ভয় ও প্রলোভন দেখাইতে দেখাইতে, পরিশেষে সে আমাদিগের কথায় সম্মত হইল ও আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া সে তাহার ভূতপূর্ব্ব মনিবের বাড়ীতে গমন করিল। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

শম্ভু মালি আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া বড়বাজারের ভিতর প্রবেশ করিল, ও একটি বাড়ী আমাদিগকে দেখাইয়া দিয়া কহিল “আমি ইতিপূর্ব্বে ইহাদিগেরই বাগানে কর্ম্ম করিতাম।” 

শম্ভু আমাদিগকে যে বাড়ী দেখাইয়া দিল, সেই বাড়ী আমি পূৰ্ব্ব হইতেই চিনিতাম। উহা যাহার বাড়ী তাহার সহিত আমার একটু পরিচয়ও ছিল। তিনি সওদাগর আফিসে কাপড়ের দালালী করিতেন ও একজন বড় দালালের মধ্যে পরিগণিত ছিলেন। তাঁহার আফিসে অনেকগুলি ছোট ছোট দালালও ছিল। সওদাগর সাহেবদিগের মধ্যে অনেকেই তাঁহাকে একটু খাতির করিতেন ও অনেক কার্য্য তাঁহারা তাঁহার হস্তে প্রদান করিতেন; সুতরাং, তিনি বেশ দশ টাকা উপার্জ্জনও করিতেন। এক সময়ে একজন জুয়াচোর কতকগুলি কাপড় লইয়া তাঁহার সহিত জুয়াচুরি করিয়াছিল। সেই মোকদ্দমা অনুসন্ধান করিবার কালীন তাঁহার সহিত আমার আলাপ পরিচয় হয় ও পরিশেষে দুই একবার আমি তাঁহার বাড়ীতেও গমন করি। তাঁহার মৃত্যু হইবার পর আর আমি তাঁহাদিগের বাড়ীতে যাই না; সুতরাং, তাঁহার পুত্রগণের এখন কিরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহাও আমি অবগত নহি। কিন্তু তাঁহার যে দুইটি পুত্র ছিল, তাহা আমি জানিতাম ও তাহারাও আমাকে চিনিত। 

আমি তাহাদিগের বাড়ীতে গমন করিয়া দেখিলাম, ছোট পুত্রটি বাহিরের ঘরে বসিয়া আছে। আমাকে দেখিয়াই সে চিনিতে পারিল, ও আমাকে বসিবার স্থান প্রদান করিয়া জিজ্ঞাসা করিল “বহুকাল পরে আপনি কি মনে করিয়া আসিয়াছেন?” উত্তরে আমি কহিলাম “বড়বাবুর নিকট একটু বিশেষ প্রয়োজন আছে। তাঁহার সহিত একবার দেখা করিবার নিমিত্ত এখানে আসিয়াছি। 

আমার কথা শুনিয়া সে বাড়ীর ভিতর গমন করিল ও তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে ডাকিয়া আমার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। দেখিলাম তিনিও আমাকে চিনিতে পারিলেন। তখন বড়বাবু (ইহার নাম আমরা এই স্থানে প্রকাশ না করিয়া ‘বড়বাবু’ বলিয়াই অভিহিত করিব) আমাকে কহিলেন, “আপনি আমাকে ডাকিয়াছেন?” 

আমি। হাঁ। 

বড়বাবু। কেন? 

আমি। বিশেষ প্রয়োজন আছে। তোমাকে দুই চারিটি কথা আমি নির্জ্জনে জিজ্ঞাসা করিতে চাই, তাই আমি তোমার নিকট আসিয়াছি। 

আমার কথা শুনিয়া তাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা, যে সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, সে সেই স্থান হইতে উঠিয়া স্থানান্তরে গমন করিল। সেই সময় সেই ঘরের মধ্যে বড়বাবু ও আমি ব্যতীত আর কেহই থাকিল না। আমি তখন বড়বাবুকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম “দেখ বড়বাবু, তুমি গত কল্য তোমার বাগানে গিয়া যে কার্য্য করিয়াছ, তাহার পরিণাম যে কি হইবে, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি না। কারণ, তোমার উপর যেরূপ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, তাহা যদি ঠিক হয় ও আদালতে তাহারা যদি সেইরূপ বলে, তাহা হইলে চরমদণ্ড হইতে তোমাকে নিষ্কৃতি প্রদান করিতে কেহই বোধ হয় সমর্থ হইবেন না। রাগের বশীভূত হইয়া তুমি কেন এরূপ কার্য্য করিলে, ও যাহা হইয়া গিয়াছে, তাহার নিমিত্ত তুমি এখন কিরূপ বন্দোবস্ত করিতেছ?” 

বড়বাবু। আমি কিছুই বুঝি না। বন্দোবস্ত আর কি করিব? রাগের বশীভূত হইয়া এক কাৰ্য্য হইয়া গিয়াছে। আপনি আমার পিতার বন্ধু, তিনি আপনাকে যেরূপ মান্য করিতেন, তাহা আমি জানি, ও আপনিও তাঁহার সহিত সহোদরের ন্যায় ব্যবহার করিতেন। তিনি এখন নাই। এখন আপনিই আমাদিগের পিতৃস্থানীয়, যাহা ভাল বিবেচনা হয়, তাহাই করুন। বুঝিতে না পারিয়া এক কার্য্য করিয়া ফেলিয়াছি, এখন যাহাতে সেই বিপদ হইতে উদ্ধার হইতে পারি, তাহা আপনাকেই করিতে হইবে; কারণ, আমার পক্ষ হইয়া দুই কথা কহিতে পারে, বা আমাকে এই বিপদ হইতে উদ্ধার করিতে পারে, এরূপ কেহই আমার নাই। 

আমি। বাঁচিবার কি উপায় আছে, তাহা পরে বিবেচনা করা যাইবে। প্রকৃত কি ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাহা আমাকে বল দেখি; তাহা হইলে আমি বুঝিতে পারিব, তোমার বিপক্ষে যাহারা সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, তাহারা প্রকৃত কথা কহিতেছে, কি মিথ্যা কহিতেছে। 

বড়বাবু। আমি আপনার নিকট কোন কথা গোপন করিব না। যাহা প্রকৃত প্রস্তাবে ঘটিয়াছে, তাহার সমস্তই আমি আপনার নিকট প্রকাশ করিতেছি। পিতার মৃত্যু হওয়ার পর, আমি প্রচুর অর্থের অধিকারী হইয়াছি ভাবিয়া অনেকেই আমার সহিত আসিয়া মিলিত হয়। তাহার মধ্যে প্রায় সকলেই বিশেষ বন্ধুত্বের ভাণ করিয়া আমার নিকট হইতে কিছু কিছু গ্রহণ করিতে সমর্থ হয়। তাহাদিগের পরামর্শে আমার চরিত্র ক্রমে কলুষিত হইয়া পড়ায়, আমি আমার জাতীয় ধর্ম্মে জলাঞ্জলি প্রদান করিয়া, তাহাদিগের পরামর্শমত তাঁহাদিগের নির্দ্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করিতে আরম্ভ করি। ক্রমে নীচ স্থানে গমন ও নীচ সংসর্গে মিলিত হইতে আরম্ভ করি। এইরূপে আজ কয়েক বৎসর চলিয়া যাইতেছে। আমাদিগের যে বাগান আছে, তথায় সময় সময় আমি সেই সকল বন্ধু-নামধারী ব্যক্তিগণের সহিত গমন করিতাম। সেইস্থানে কিছুক্ষণ অবস্থিতি করিয়া আমোদ আহ্লাদ ও পানাদি করিয়া পরিশেষে আপন স্থানে চলিয়া আসিতাম। যে দিবসের কথা বলিতেছেন, সেইদিবসও ঠিক তাহাই ঘটিয়াছিল। সেই দিবস অপরাহ্ণে আমরা সেই বাগানে গমন করি। অনেকক্ষণ সেই স্থানে থাকিয়া আমোদ আহ্লাদ করিবার পর, দেখিতে পাই, ওই বাগানের মধ্যে একজন পাসি তালগাছ হইতে তাড়ির ভাঁড় সকল নামাইয়া আনিতেছে। ওই পাসিকে আমি পূৰ্ব্ব হইতে চিনিতাম। আমাদিগের বাগানে যতগুলি তালগাছ আছে, সে তাহা জমা রাখিত। তালগাছ হইতে তাড়ি নামাইবার নিমিত্ত তাহাকে তালগাছে উঠিতে দেখিয়া আমাদিগের মধ্যে একজন কহিল, “টাট্‌কা তাড়ি পান করিতে যেমন সুমধুর, অমন আর কিছুই নহে; অথচ ইহাতে বেশ মনোরম নেশা আসিয়া উপস্থিত হয়।” এই কথা শুনিয়া আমাদিগের মধ্যে কেমন ইচ্ছা হইল, যে ওই পাসি যে তাড়ি গাছ হইতে নামাইতেছে, তাহা পান করিতে হইবে। এই ভাবিয়া আমরা সকলে মিলিত হইয়া সেই তালগাছের সন্নিকটে গমন করিলাম। সেই সময় ওই ব্যক্তি তাড়ির ভাঁড় লইয়া তালগাছ হইতে অবতরণ করিতেছিল। আমাদিগকে সেই তাল বৃক্ষের নিকট গমন করিতে দেখিয়া সে কি ভাবিল। তাড়ির যে ভাঁড় লইয়া অবতরণ করিতেছিল, সেই ভাঁড় সহ সে আর অবতরণ না করিয়া পুনরায় সে ঊর্দ্ধে উত্থিত হইল, ও যেস্থানে সেই তাড়ির ভাঁড় বাঁধা হয়, সেই স্থানে উহা পুনরায় বাঁধিয়া রাখিয়া নিজে বৃক্ষ হইতে অবতরণ করিল। ওই তাড়ি গাছ হইতে নিম্নে আনিবার নিমিত্ত তাহাকে বার বার কহিলাম। কিন্তু সে কিছুতেই আমাদিগের কথায় সম্মত হইল না। তাহাকে উহার যথাযথ মূল্য দিতে চাহিলাম; তাহাতেও সে আমাদিগের প্রস্তাবে সম্মত হইল না। উহার অবস্থা দেখিয়া আমার অতিশয় ক্রোধের উদ্রেক হইল। আমি তাহাকে গালি প্রদান করিলাম। সেও আমায় নিতান্ত অকথ্য ভাষায় প্রতি উত্তর দিতে লাগিল। সেই নীচ পাসি-বংশ সম্ভূত নিতান্ত সামান্য ব্যক্তির মুখ হইতে অকথ্য ভাষায় গালি শুনিয়া, হঠাৎ আমার ভয়ানক ক্রোধের উদয় হইল। আমি কোনরূপেই সেই ক্রোধ সংবরণ করিতে পারিলাম না। সেই বৃক্ষের নিকটে উহাদিগের অস্ত্র ধার দেওয়া একখানি কাষ্ঠ পড়িয়াছিল। ওই কাষ্ঠ খণ্ড উঠাইয়া লইয়া আমি উহার মস্তকে সজোরে এক আঘাত করিলাম। ওই আঘাত সহ্য করিতে না পারিয়া সে সেই স্থানে পড়িয়া গেল। তখন দেখিলাম, উহার মস্তক একেবারে চূর্ণ হইয়া গিয়াছে। সেও মৃত্যুশয্যায় শয়ন করিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া আমি হিতাহিত জ্ঞান হারাইলাম। সেই সময় আমার কি করা কর্ত্তব্য, তাহা কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে না পারায়, আমি একটু দূরে গিয়া উপবেশন করিলাম। আমার যে সকল বন্ধু বান্ধব ছিল, তাহারা এই অবস্থা দেখিয়া আমাকে সেই স্থানে পরিত্যাগ করিয়া একে একে সকলেই প্রস্থান করিল। তাহারা যে কোথায়, তাহা আমি জানি না। এ পর্যন্ত তাহাদিগের কাহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় নাই। এই বিপদের সময় আমার বন্ধুনামধারী সকলেই আমাকে সেই স্থানে পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিল। কেবল একজন আমাকে পরিত্যাগ করিল না। সে আমার বন্ধু বান্ধবের মধ্যে নহে, আমার পিতার পরিচারক। পিতার মৃত্যুর পর আমাদিগের সমস্ত পরিচারকই একে একে আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছিল; কিন্তু, এক ব্যক্তি আমাদিগকে পরিত্যাগ করে নাই। পিতার মৃত্যুর পর হইতেই সে সর্ব্বদা আমার নিকটেই থাকিত। আমার বন্ধুবান্ধবগণ আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবার পর, ওই পরিচারক কাহাকেও কিছু না বলিয়া তাহার নিজের চাদর দ্বারা উহার মস্তক উত্তমরূপে বাঁধিয়া দিল। আমার গাড়ি বাগানের বাহিরে ছিল। সেই গাড়ি সেই স্থানে আনাইয়া ওই মৃতদেহ ওই গাড়ির ভিতর স্থাপিত করিল, ও নিজেও তাহার ভিতর উঠিল, আমাকেও উঠাইয়া লইল, ও গাড়ির দরজা বন্ধ করিয়া তখনই সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। যাইবার সময় সে কোচম্যানকে কি বলিয়া দিল, তাহা আমি ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। গাড়ি চলিতে লাগিল। পরিশেষে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই মৃতদেহ লইয়া তুমি কোথায় গমন করিতেছ?” উত্তরে সে কহিল “এই মৃতদেহ যদি বাগানের মধ্যে পড়িয়া থাকে, তাহা হইলে এ কথা এখনই প্রকাশিত হইয়া পড়িবে; তাহা হইলে আপনার জীবন রক্ষা হইবার উপায় থাকিবে না। যদি কোন গতিকে এই মৃতদেহ লুকাইতে পারি, অর্থাৎ পুলিস যদি কোন গতিকে এর সন্ধান না পায়, তাহা হইলে আমাদিগের বিপদের আর কোন সম্ভাবনা নাই। নতুবা আমাদিগের সকলের অদৃষ্টে যে কি ঘটিবে, তাহা এখন অনুমান করাও সহজ নহে। এ সম্বন্ধে আপনার কোন কথা বলিবার প্রয়োজন নাই। আমি যাহা ভাল বিবেচনা করি, তাহাই করিব।” 

উহার কথায় আমি আর কোনরূপ উত্তর প্রদান করিলাম না। চুপ করিয়া সেই গাড়ির মধ্যে বসিয়া রহিলাম। সন্ধ্যার পর ওই গাড়ি আসিয়া একস্থানে উপনীত হইল। সেই স্থানে ওই পরিচারক গাড়ি হইতে অবতরণ করিল, ও অপর একটি লোককে ডাকিয়া আনিল। সে যে কে, তাহা আমি জানি না। উহারা উভয়ে ওই মৃতদেহ গাড়ি হইতে বহির্গত করিয়া একটি বৃক্ষের অন্তরালে রাখিয়া দিল। ও আমাকে কহিল “আপনি এখন বাড়ীতে গমন করুন।” আমি কোন কথা না বলিয়া, সেই গাড়ির মধ্যে স্থির ভাবে বসিয়া রহিলাম। ক্রমে গাড়ি আসিয়া আমার বাড়ীতে উপস্থিত হইল। ইহার পর যে কি হইয়াছিল, তাহা আর আমি বলিতে পারি না। সেই রাত্রিতে আমার সেই পরিচারককে আর দেখিতে পাইলাম না। পর দিবস প্রত্যূষে তাহাকে দেখিতে পাইয়াছিলাম। তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, এখন কোন কথা আপনার জানিবার প্রয়োজন নাই; যাহা হইয়াছে, তাহা আমি আপনাকে পরে বলিব। যাহা আমি অবগত আছি, তাহার সমস্ত অবস্থা আমি আপনাকে কহিলাম; এখন আপনার যাহা কর্তব্য, তাহা আপনি করিতে পারেন। 

বড়বাবুর কথা শুনিয়া আমি বুঝিলাম, তিনি একটি কথাও মিথ্যা কহেন নাই; যাহা প্রকৃত তাহা কহিয়াছেন। যে পরিচারক সেই মৃতদেহ লইয়া গিয়াছিল, সে সেই সময় বাড়ীতেই ছিল। সে কিরূপ উপায়ে ওই মৃতদেহ প্রোথিত করিল, তাহা জানিবার নিমিত্ত তখন কৌতূহল জন্মিল। বড়বাবুকে কহিলাম “আপনার সেই পরিচারককে একবার ডাকুন। সে ওই মৃতদেহ কিরূপে প্রোথিত করিল, তাহাও একবার জানিয়া লই।” আমার কথা শুনিয়া তিনি তাঁহার পরিচারককে ডাকাইলেন। দেখিলাম, সেও আমার পরিচিত; বড়বাবুর পিতার সহিত তাহাকে অনেকবার আমি দেখিয়াছি। সেও আমাকে দেখিবামাত্র চিনিতে পারিল, ও প্রণাম পূর্ব্বক আমার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। 

কিরূপ উপায়ে সে ওই মৃতদেহ স্থানান্তরিত করিতে সমর্থ হইয়াছিল, তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করায়, প্রথমত সে কোন কথা বলিতে সম্মত হইল না; কিন্তু পরিশেষে তাহাকে অনেক বুঝাইয়া বলায়, সে আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল ও কহিল, “যে স্থানে আমি মৃতদেহটি গাড়ি হইতে নামাইয়া লইয়াছিলাম, উহা সহরতলীর অন্তর্গত জঙ্গলময় একটি স্থান। ওই স্থানে আমার জনৈক বন্ধু বাস করিয়া থাকে। এই কার্য সম্পন্ন করিতে আমার সেই বন্ধুই আমাকে বিশেষরূপ সাহায্য করিয়াছিল। তাহাকেও আমি প্রথমে আসল কথা বলিয়াছিলাম না। মিথ্যা কথা কহিয়া তাহাকে একরূপ বুঝাইয়া দিয়াছিলাম, ও তাহারই সাহায্যে আমি ওই মৃতদেহ স্থানান্তরিত ও লুক্কায়িত করিতে পারিয়াছিলাম।” 

আমি। তোমার বন্ধুকে তুমি কি বলিয়াছিলে ও তাহার সাহায্যে কিরূপে তুমি ওই মৃতদেহ স্থানান্তরিত ও লুক্কায়িত করিতে সমর্থ হইয়াছিলে? 

পরিচারক। ওই মৃতদেহ গাড়ি হইতে নামাইয়া লইয়া, আমি আমার মনিবকে সেই গাড়িতেই বাড়ী যাইতে কহি। তিনি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর, আমি আমার সেই বন্ধুকে সেই স্থানে ডাকিয়া আনি ও তাহাকে কহি, 

‘এই ব্যক্তির সহিত আমার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। এ আমার মনিবের বাড়ীতে আমার সহিত চাকরী করিত। হঠাৎ আমার মনিবের বাড়ীর ছাদ হইতে পড়িয়া ইহার মস্তক চূর্ণ হইয়া গিয়াছে ও তাহাতেই এ ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। আমার মনিবের বাড়ীতে এই ঘটনা ঘটিয়াছে, একথা যদি পুলিস জানিতে পারে, তাহা হইলে তাঁহার বিশেষরূপ বিপদ ঘটিবার সম্ভাবনা। এই নিমিত্ত এই মৃতদেহ আমি এখানে আনিয়াছি ও ইচ্ছা করিয়াছি, কোন একটি বাগানে ইহা প্রোথিত করিয়া রাখিব। কারণ, তাহা হইলে পুলিস ইহার কিছুই অবগত হইতে পারিবে না ও আমার মনিবেরও কোনরূপ বিপদ ঘটিবার সম্ভাবনা থাকিবে না। কিন্তু ভাই, তুমি এই বিষয়ে আমাকে সাহায্য না করিলে আমি একাকী কোন রূপেই এই কার্য্য সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইব না। কারণ, মৃতদেহ আমি একাকী কিরূপে এই স্থান হইতে উঠাইয়া লইয়া যাইতে পারি? অধিকন্তু, আমাকে সাহায্য করিলে তোমার যে কেবলমাত্র বন্ধুর কার্য সম্পন্ন করা হইবে, তাহা নহে; তোমার পরিশ্রমের নিমিত্ত বিশেষ কিছু পারিতোষিক তুমি প্রাপ্ত হইবে।” আমার কথা শুনিয়া আমার বন্ধু প্রথমত আমার প্রস্তাবে অসম্মত হইল; কিন্তু, পরিশেষে সে কিছুতেই আমার অনুরোধ রক্ষা না করিয়া থাকিতে পারিল না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরিশেষে সে আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল। 

তাহারই সাহায্যে আমি একখানি চারিপায়া ও একখানি নববস্ত্র সংগ্রহ করিয়া ওই মৃতদেহ সেই চারিপায়ার উপর স্থাপিত করিলাম ও নববস্ত্রের দ্বারা উহা আচ্ছাদিত করিয়া, আমরা উভয়ে ওই চারিপায়া সমেত সেই মৃতদেহ বহন করিয়া চলিয়া যাইতে লাগিলাম। কিছু দূর গমন করিবার পর, আমার মনে হইল, আমরা মৃতদেহ লইয়া যাইতেছি সত্য, কিন্তু মৃত্তিকা খনন করিবার উপযোগী কোন অস্ত্রাদি ত আমরা লইয়া আসি নাই। এই ভাবিয়া রাস্তার এক পার্শ্বে চারিপায়ার সহিত ওই মৃতদেহটি স্থাপিত করিয়া আমার বন্ধুকে একখানি কোদালী আনিবার নিমিত্ত প্রেরণ করিলাম। আমি ওই মৃতদেহের একটু দূরে উপবেশন করিয়া আমার বন্ধুর অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। সেই সময় রাত্রি হইয়া গিয়াছিল। আমার বন্ধু কোদালী লইয়া প্রত্যাগমন করিবার পূর্ব্বেই কি জানি, কিরূপে সংবাদ পাইয়া পুলিস আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। অনুমানে বোধ হইল, যে সকল পুলিস সেই সময় সেই স্থানে আগমন করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে একজন প্রধান কর্ম্মচারী ছিলেন। তিনি সেই স্থানে আগমন করিবার পরই ওই মৃতদেহটি উত্তমরূপে দেখিলেন ও কি ভাবিয়া যেরূপ অবস্থায় উহা সেই স্থানে ছিল, সেইরূপ অবস্থাতেই তাহা সেই স্থানে রাখিয়া তিনি অপর কয়েকজন প্রহরীর সহিত সেই স্থান হইতে কোথায় গমন করিলেন। কেবলমাত্র একজন প্রহরীকে সেই লাসের উপর পাহারায় রাখিয়া গেলেন। ইহার কিছুক্ষণ পরেই আমার বন্ধু একখানি কোদালী ও একটি সাবোল লইয়া সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। যে সময় আমার বন্ধু সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, সেই সময় ওই রাস্তা একেবারে জনশূন্য হইয়া পড়িয়াছিল। রাত্রির সঙ্গে সঙ্গে ওই বড়-রাস্তার নিকটবর্ত্তী বৃক্ষ সকলের শোঁ শোঁ শব্দ ভিন্ন আর বিশেষ কিছু কর্ণগোচর হইতেছিল না। কেবলমাত্র শিবা সকলের অশিব রব মধ্যে মধ্যে সেই বৃক্ষাবলীর শোঁ শোঁ শব্দ ভেদ করিতেছিল। আমরা যে স্থানে বসিয়াছিলাম, তাহা ওই স্থান হইতে একটু দূরে ও একটি বৃক্ষের অন্তরালে; সুতরাং, আমাদিগকে সহজে দেখিতে পাইবার বিশেষ সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু আমরা সেই স্থান হইতে উঠিয়া, প্রহরী যে কি করিতেছিল, তাহা মধ্যে মধ্যে দেখিতেছিলাম। সেই সময় প্রহরীর অবস্থা দেখিয়া আমাদিগের বেশ অনুমান হইল যে, সে অতিশয় ভীত হইয়াছে। প্রহরীর এই অবস্থা দেখিয়া আমাদিগের কার্য্য সহজে কিরূপে উদ্ধার করিতে পারি, তাহার চেষ্টা দেখিতে প্রবৃত্ত হইলাম। প্রহরী আরও ভীত হয় কি না, তাহাই দেখিবার নিমিত্ত আমরা উভয়ে মিলিয়া একবার বিকটস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিলাম। দেখিলাম, আমাদিগের চীৎকার শব্দে সেই প্রহরী এরূপ ভীত হইয়া পড়িয়াছে যে, তাহার সংজ্ঞা আছে বলিয়া অনুমান হইতেছে না; একেবারে অচৈতন্য অবস্থায় সে সেই স্থানে পড়িয়া গিয়াছে। 

প্রহরীর এই অবস্থা দেখিয়া আমরা আর কালবিলম্ব করিলাম না। দুই জনে চারিপায়া সমেত ওই মৃতদেহ উঠাইয়া লইয়া সেইস্থান হইতে দ্রুতপদে গমন করিতে লাগিলাম। কিছুদূর গমন করিয়া আমরা একটি নিতান্ত পুরাতন বাগানের মধ্যে উপস্থিত হইলাম। ওই বাগানের অবস্থা আমি পূৰ্ব্ব হইতেই অবগত ছিলাম। সেইস্থানে ওই মৃতদেহ স্থাপিত করিয়া আমরা উভয়ে একটি কবর প্রস্তুত করিয়া তাহার মধ্যে ওই মৃতদেহ প্রোথিত করতঃ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। এই কার্য্য সমাপন করিয়া যে সময় আমরা আপনাপন স্থানে প্রত্যাগমন করিলাম, সেহ সময় রাত্রি আর অধিক ছিল না। ইহার পর যে আর কি হইয়াছে, তাহা আমি অবগত নহি। 

বড়বাবু ও তাঁহার পরিচারকের কথা শুনিয়া আমাদিগের আর কোন কথা জানিতে বাকী রহিল না। বড়বাবুর সহিত যে সকল লোক বাগানে গমন করিয়াছিল ও সেই পরিচারকের যে বন্ধুর সাহায্যে ওই মৃতদেহ প্রোথিত হইয়াছিল, তাহাদিগের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমার সহিত অপর যে সকল কর্ম্মচারী আগমন করিয়াছিলেন, ও যাঁহারা সেই বাড়ীর বহির্ভাগে আমার অপেক্ষায় বসিয়াছিলেন, তাঁহাদিগকে প্রেরণ করিলাম। তাঁহারা সকলেই সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। থাকিবার মধ্যে কেবল আমি সেইস্থানে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। 

বড়বাবুর ছোট ভাই যাঁহার সহিত আমার সর্ব্বপ্রথমেই সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তিনি আমাদিগকে সেই স্থানে রাখিয়া গমন করিলেন; ও কিয়ৎক্ষণ পরে ফৌজদারী মোকদ্দমায় বেশ পারদর্শী একজন বিচক্ষণ উকীলকে সঙ্গে লইয়া সেই স্থানে প্রত্যাগমন করিলেন। যে পর্য্যন্ত তাঁহার ছোট ভাই বা উকীল প্রত্যাগমন করিলেন না, সেই পৰ্য্যন্ত আমিও সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম না। উকীলবাবু আগমন করিলে তাঁহার সহিত দুই চারিটি কথা কহিয়া আমি সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। বলা বাহুল্য, আমি বড়বাবুকে ও তাঁহার পরিচারককে আমার সঙ্গে লইয়া যাইতে ভুলিলাম না। সেই উকীলও অপর একখানি গাড়িতে আমাদিগের সঙ্গে গমন করিলেন, ও যে পর্য্যন্ত এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান হইতে লাগিল, সেই পর্যন্ত পুলিসের সঙ্গ পরিত্যাগ করিলেন না। বড়বাবু ও তাঁহার পরিচারক আমার নিকট যে সকল কথা বলিয়াছিলেন, তাহা অপর কাহারও নিকট স্বীকার করিলেন না। তাঁহার সহিত যে সকল ব্যক্তি বাগানে গমন করিয়াছিল ও যে ব্যক্তির সাহায্যে ওই মৃতদেহ প্রোথিত হইয়াছিল, তাহারা পুলিসের নিকট প্রথম অবস্থার দুই এক কথা স্বীকার করিলেও পরিশেষে কিন্তু সমস্ত কথা অস্বীকার করিল। 

মোকদ্দমার পরিণাম যাহাই হউক, পুলিসের কাৰ্য্য শেষ হইয়া গেল। এই মোকদ্দমার প্রকৃত কথা যে আমরা অবগত হইতে পারিব, সে ভরসা আমাদিগের ছিল না। কিন্তু ঘটনা-চক্রে পড়িয়া প্রকৃত কথা সমস্তই বাহির হইয়া পড়িল; মোকদ্দমারও কিনারা হইয়া গেল। এই মোকদ্দমায় বড়বাবু ও তাঁহার পরিচারককে আসামী না করিয়া আর আমরা থাকিতে পারিলাম না। তাঁহারা আসামী-শ্রেণীভুক্ত হইয়া বিচারার্থ ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরিত হইলেন। 

মাজিষ্ট্রেট-কোর্টে সাক্ষীগণের জবানবন্দী দস্তুরমত হইতে লাগিল। আসামীপক্ষে একজন ব্যারিস্টার নিযুক্ত হইয়া উহা মনোযোগ পূৰ্ব্বক শুনিতে লাগিলেন। স্থানীয় পুলিস-কৰ্ম্মচারী প্রথমে কিরূপে লাসের সংবাদ পাইয়াছিলেন, তাহা বর্ণন করিলেন। যে কনেষ্টবলের পাহারা হইতে মৃতদেহ অন্তর্হিত হয়, সে পূর্ব্বে যেরূপ বলিয়াছিল, তাহার অধিকাংশ এখন গোপন করিল। আমি যেরূপে মৃতদেহ সন্ধান করিয়া কবর হইতে উহা উঠাইয়া আনিয়াছিলাম, ও যেরূপে ওই মৃতদেহ সনাক্ত ও যেরূপে আসামীগণের অনুসন্ধান ও তাহাদিগকে ধৃত করিয়াছিলাম, তাহার সমস্তই বর্ণন করিলাম। ডাক্তারের পরীক্ষায় সাব্যস্ত হইল যে, কিরূপ আঘাতে এই হত্যা ঘটিয়াছে। আসামীর বন্ধু-বান্ধবগণ ও যাহার সাহায্যে ওই মৃতদেহ স্থানান্তরিতও প্রোথিত হইয়াছিল, তাহারা সমস্ত কথা অস্বীকার করিল ও কহিল “আমরা কিছুই অবগত নহি, ও পুলিসকেও কোন কথা কহি নাই।” উপরোক্ত সাক্ষীগণের জবানবন্দী গ্রহণ করিবার পূৰ্ব্ব হইতে যে দুইটি স্ত্রীলোকের সম্মুখে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়াছিল, তাহাদিগের অনুসন্ধান হইতে লাগিল; কিন্তু তাহাদিগকে আর কেহই দেখিতে পাইলেন না। এই মোকদ্দমার প্রধান সাক্ষী ওই দুইটি স্ত্রীলোক; উহাদিগের সাক্ষী ভিন্ন এই মোকদ্দমার কিছুই হইতে পারে না; সুতরাং, তাহাদিগকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিবার নিমিত্ত পুলিস বিধিমতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। তাহারা হঠাৎ যে কোথায় গেল, তাহার কোন সন্ধান কেহ বলিতে পারিল না। মোকদ্দমা ক্রমেই মুলতুবি হইতে লাগিল। আসামীগণ প্রথম প্রথম কিছুদিবস হাজতে থাকিয়া পরিশেষে জামিনে রহিলেন। এ দিকে পুলিস ওই স্ত্রীলোকদ্বয়ের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। এইরূপে ছয় মাস অতীত হইয়া গেল। যখন কোন রূপেই সাক্ষীগণকে পাওয়া গেল না, তখন মাজিষ্ট্রেট সাহেব আসামীগণকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন। 

এই মোকদ্দমায় সকলেই আমার উপর দোষারোপ করিয়া কহিয়াছিলেন যে, আসামীর পিতার সহিত আমার বন্ধুত্ব থাকায় ও আসামী আমাকে সমস্ত কথা বলিয়া অনুগ্রহ প্রার্থনা করায়, আমারই পরামর্শমত ওই স্ত্রীলোকগণকে কিছু অর্থ প্রদান করিয়া তাহাদিগকে স্থানান্তরিত করা হয়, ও আমার উপর তাহাদিগের অনুসন্ধানের ভার ন্যস্ত হইলেও আমি বিশেষ যত্ন করিয়া তাহাদিগকে সন্ধান করিয়া বাহির করি নাই বলিয়াই, আসামীগণ এই মোকদ্দমা হইতে অব্যাহতি পায়। কিন্তু এই দোষে আমি যে কতদূর দোষী ছিলাম, তাহা বলিতে পারি না। 

সম্পূর্ণ 

[ ফাল্গুন, ১৩০৭ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *