লাল মারুতি
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। দীর্ঘ দুপুর শেষ হতে চলেছে। আর তিনটে মাস পরেই যে কমলালেবু, ভূটিয়া এবং ধোঁয়াশা সঙ্গে করে শীত এসে পাকাপাকিভাবে বসে যাবে, গ্রাম-গঞ্জের কোথাও তার কোনও চিহ্ন নেই। প্রচণ্ড তাতে দিল্লি রোড এবং তার পরবর্তী গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পিচ নরম। দুপাশের দৃশ্যপটের দিকে তাকালে মনে হয় একটা আগুনের শিখার আড়ালে যেন সব। দিনের বেলা বলেই শিখাটার অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না। গাছপালা, দোকানপাট, মাঠ, জলা, খাল, বিল, বাড়ি—সবই ঈষৎ কাঁপছে এবং ঘামছে। এ পথ দিয়ে যানবাহন চলাচলের বিরতি নেই। যদিও খুব ঘন নয় ট্র্যাফিক। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তরই আপাদমস্তক মাল বোঝাই ট্রাক ভারি কালো নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে পিচগলা রাস্তার বুকের নুনছাল তুলে চলে যাচ্ছে। দুপুরের আগুনে তাত যেন চতুর্গুণ বেড়ে যাচ্ছে তাতে। কত শ’ বছর ধরে এই রাস্তা সারা দেশের ভারি মাল আর পথচারীর দুর্ভাবনা বয়ে বয়ে আজ যেন একেবারে ক্লান্ত। বটগাছের ঝুরির মধ্যে প্রচ্ছন্ন ঘুঘুর ডাক পথের সেই গভীর, অনপনেয় ক্লান্তি আর অবসাদের শরিকানা ছড়িয়ে দিচ্ছে বয়স্ক দুপুরের বুকে। ট্রাক থামিয়ে হঠাৎ মোটা থাবায় মোবিল-লাগা ময়লা তোয়ালে তুলে নিচ্ছে ড্রাইভার। পার্শ্ববর্তী ধাবায় আধঘুমন্ত মালিককে টেনে তুলে বলছে—‘আরে ইয়ার, জরা পানি তো দো পহলে।’ বাতাসে আর্দ্রতা আশি থেকে পঁচাশি শতাংশ হলে এইরকম ঘর্মাক্ত দুপুর হয়।
সড়কের দুপাশ থেকে মেঠো পথের ডালপালা হুগলি, বর্ধমান, বীরভূমের গভীর থেকে গভীরে ছড়িয়ে গেছে। চিরুনির দাড়ার মতো এইসব পথের পাশে পাশে কাদা-থিকথিক ডোবায় পাঁক মেখে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে মহিষ, পাড়ের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে শুয়োরের পাল। লম্বাটে খালের ধাঁচের পুকুর চলেছে পথের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে বহুত দূর। কচুরি পানায় আপাদমস্তক ঠাসা। পানা-সবুজ পুকুরের জল ডোঙায় করে পাশের তৃষ্ণার্ত মাঠে ঢালছে মাথায় টোকা, কাঁধে গামছা, ক্ষয়াটে চেহারার বৃদ্ধ চাষী। খুব জনবিরল দুপুর।
বাঁ দিকে বেঁকে গেছে পথটা। একটু একটু করে ঢালু হয়েছে, আবার উঠেছে, তারপর উঁচু পাড়ের মতো সোজা, নাক বরাবর। ক্ষয়া ক্ষয়া পথ, লাল। বাঁক নিলেই হঠাৎ একটা আশ্চর্য দৃশ্য দেখা যায়। আর কোথাও নেই, শুধু এই পথটারই দুপাশে কাশ ফুটে ঘন হয়ে আছে। নিভৃত, নির্জন আড়াল দেখে একমাত্র এখানেই বুঝি প্রকৃতি তার মরশুমী সৃষ্টিকর্মে নিবিষ্ট ছিল। হঠাৎ এই খাঁ খাঁ দুপুরে দূর থেকে এদিকে তাকালে মনে হবে পৃথিবীর এই অংশ যেন এক বিষণ্ণ অগ্নিকন্যা। রুক্ষ, লাল জমিতে সাদা পাড়ের শাড়ি পরে কি এক ব্যর্থতার বিষাদে মগ্ন হয়ে পাশ ফিরে আছে। যুগধর্মের কোন রহস্যময় প্রয়োজন মেটাতে হঠাৎ-হঠাৎ জন্ম হয় এইসব আগুনের তৈরি মানুষীর, মানুষের। ইতিহাস এদের একবার মাত্র ব্যবহার করে ফেলে দেয়। উচ্ছিষ্ট যা পড়ে থাকে, বোমার বিস্ফোরণের পর নিবে-যাওয়া বারুদের কুচির মতো তা নেহাতই ভস্ম। আগুন থেকে ছাইয়ে পরিণত হবার প্রতিটি পর্যায় অমানুষিক যাতনা দিয়ে তৈরি। কিন্তু তার খবর রাখে না কেউ। যা ক্ষয়ে যায় তার তুলনায় যা পাওয়া যায় তা এতই অল্প যে এইসব বিস্ফোরণের শেষ অবধি না থাকে কোনও কৈফিয়ত, না থাকে কোনও সান্ত্বনা।
মাথা দোলাবার মতো বড় হয়নি কাশবন। শুধু সাদা এবং শিহরিত হয়ে আছে। ক্যালেন্ডার মিলিয়ে শরৎ এসে গেছে, কিন্তু বাস্তবে আসতে এখনও একটু দেরিই। তাই মনে হয় বর্ধমান-বীরভূমের মধ্যবর্তী এলাকার এই মেঠো পথে প্রান্তরে ওদের বোধহয় কেউ অকালবোধনে ডেকেছে। কোনও সর্বক্ষয়ী যুদ্ধের আগে শারদস্তুতির অকালবোধন। লালচে-মাটির কাঁচা রাস্তা সোজা চলে গেছে দিগন্ত পর্যন্ত। অনেক দূর এগিয়ে একটা বাঁক আছে। কিন্তু বেশ খানিকটা না এগোলে সে বাঁকেরও খোঁজ পাওয়া যাবে না। এদিকের শিল্পাঞ্চলে যাবার এটাই সংক্ষিপ্ত পথ। নিয়মিত যাত্রীরা জানে। জানলেও সবাই, বিশেষ করে মোটর-যাত্রীরা কাঁচা রাস্তা দিয়ে যাবার ঝুঁকি নেয় না। ফ্যাক্টরিগুলোর জিপ, ট্রাক, ভ্যান—সবই ঘুরে হাইওয়ে দিয়ে চলাচল করে। নিকটবর্তী গ্রামের মানুষ—মাথায় বোঝা, কাঁধে গামছা, বেসুরো চড়া গলায় গান গাইতে গাইতে এ পথ দিয়ে চলে যায়। গ্রাম কাছে হবে, হাটও। গরুর গাড়ি তো যায়ই। কাঁচা রাস্তায় আকণ্ঠ মাল বোঝাই গরুর গাড়ির চাকার গভীর দাগ পড়ে। আসার দাগ, যাওয়ার দাগ। কখনও মিলে যায়, কখনও পরস্পর কাটাকুটি করে মাটির রাস্তার ওপর বিচিত্র নকশা ফেলে। ঈষৎ কাঁকুরে মাটি বলে পরবর্তী বৃষ্টির দিন পর্যন্ত অনেক সময়ে টিকে থাকে এই বিচিত্র জ্যামিতি। মানুষের ক্রিয়াকলাপ দিয়ে গড়া ইতিহাসের জমিতেও যেমন কিছু কিছু নকশা টিকে থাকে কিছু কিছু দিন।
টকটকে লাল রঙের নতুন মারুতি গাড়িটা কিন্তু এদিকেই বাঁক নিল। ঝুঁকি নেবার মতো মজবুত করে এদের গড়া হয়নি। সুন্দর কিন্তু ভঙ্গুর। আকারে-প্রকারে ঘাতসহতার কোনও চিহ্ন নেই। উঁচু-নিচু পথে টাল সামলাতে না পেরে যদি একবার উঁচু পাড় থেকে মাঠের গর্তে পড়ে যায় দেশলাইয়ের বাক্সর মতো চৌচির হয়ে যাবে। যতদূর সম্ভব বাধা বিপত্তিহীন মসৃণ পথ, আশপাশের জোরালো গাড়িরা যেখানে একে পলকা এবং সুকুমার জেনে সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে যাবে, খুব নিখুঁতভাবে এমন একটা পথ পার হয়ে চমৎকার সাজানো গোলাপ আর মরশুমী ফুলের বেড-ছাওয়া, কাচ-মোড়া কোনও বাংলো-টাংলোর হাতায় গিয়ে রাজামশাইয়ের আদরের ছোটকুমারের মত দাঁড়ানোর গাড়ি এসব। গাড়ি ঢোকার মৃদু শ্বাস নেওয়ার মতো শব্দে বেয়ারা এসে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেবে। ভেতর থেকে বাছুর উঁচু ডবারম্যানের ভয়াবহ গলার ডাক নির্জন হলঘরে বন্দুকের গুলির মতো ঘা দিতে থাকবে। তারপর? ধবধবে তেয়ালে, মসৃণ মোজেইক, চুপচাপ চা।
চালকের আসনে অত্যন্ত সুপুরুষ ভদ্রলোকটি অনন্যমনে স্টিয়ারিংএ পাক দিচ্ছিলেন। সাদা-কালো ছিট-ছিট ট্রাউজার্স। সাদা ফুলহাতা শার্ট। নেভি-ব্লু-এর ওপর খড়-রং-এর তেরছা ডোরা-কাটা টাইয়ের নটটা আলগা। ডান হাতের আস্তিন একটু গুটোনো। ধবধবে ফর্সা। গোলাপির ছোঁয়াচ-লাগা কবজি দেখা যাচ্ছে। যথেষ্ট চওড়া বলেই মেয়েলি বলা গেল না। কবজি দেখে যদি মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ বর্তমান বলা যেত তাহলে মানুষটিকে অসামান্য মনোহর, শৌখীন, চরিত্রবান এবং আমরণ সুখ-শান্তি-সাফল্যের মালিক বলে অনায়াসেই রায় দেওয়া চলত। কিন্তু কবজি, কপাল, আঙুলের কর ইত্যাদি দেখে মানুষের চরিত্র এবং ভাগ্য নিরূপণ করবার লোক বৈজ্ঞানিক পৃথিবীতে ক্রমেই কমে আসছে। ভালোই হয়েছে তাতে। ভাতের হাঁড়ির একটা চাল টিপে ভাত সেদ্ধ হয়েছে কিনা বলা যায়, কিন্তু মানুষের মতো জটিল জীবের একটা প্রত্যঙ্গ দেখে তাকে বোঝা কোনও কাক-চরিত্র, কোনও মহাজ্যোতিষার্ণবেরই কর্ম হওয়ার কথা না। পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর ও প্রাণীর চরিত্র লক্ষণে যে অন্তঃসামঞ্জস্য দেখা যায়, মানুষের চরিত্র এবং ভাগ্যই বোধহয় তার একমাত্র ব্যতিক্রম।
সীটের পেছনে একটা মোটা হলুদ তোয়ালে ভাঁজ করা। মাঝে মাঝেই ভদ্রলোকের আয়তাকার পিঠের মৃদু ছাপ পড়ছিল তোয়ালেটায়। পরক্ষণেই আবার ঈষৎ সামনে ঝুঁকে পড়ছিলেন তিনি। রাস্তাটা ভালো না। কিন্তু তাড়াতাড়ি পৌঁছনো দরকার। হাইওয়ের একটা গারাজ থেকে জানা গেছে এটাই সংক্ষিপ্ত পথ। শর্ট কাট। এই শর্ট-কাটগুলোর ওপর কোনও কোনও মানুষের কেমন একটা অহৈতুকী ভক্তি থাকে। কেরিয়ারের শর্ট কার্ট, মানুষ গড়ার শর্ট-কাট, সমাজ-গড়ার শর্ট কাট।
স্টিয়ারিং-এর ওপর দুহাতের আঙুল ছড়িয়ে আছে এখন। তার মধ্যে বোধহয় সাড়ে দশ রতি ওজনের কি আরো বড় একটা গাঢ় মেরুন রঙের উৎকৃষ্ট আস্ত গোমেদ রুপোলি বলয়ের মধ্যে সহজেই চোখে পড়ে। এতো বড় গোমেদ সাধারণত দেখা যায় না। লোকে দুভাগ করে পরে। পাশেই হাল্কা সবুজ ক্যাট্স্-আই থেকে এক ধরনের গা ছমছমে আলো বেরোচ্ছে। সেটার আয়তনও নেহাত অবহেলার নয়।
পেছন থেকে একটা সাইকেল-রিকশা অধৈর্য হয়ে ঘন্টি বাজাল। রাস্তা বেশ সরু। উপরন্তু দুদিকেই খাড়াই ঢাল। মাঠের মধ্যে নেমে গেছে। এবড়ো-খেবড়ো মাঠ। এ রাস্তায় নামলে আশা করা যায় পথ-চলতি গ্রামের মানুষ ছাড়া আর কাউকে হর্ন শোনাতে হবে না। চালকের কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ল। ট্রেনে এলেই বোধহয় ঠিক হত। কিন্তু ট্রেন যাত্রা বড় বিরক্তিকর! আজ এই গাড়ি নিয়ে হয়েছে মহা মুশকিল। রাস্তা-ঘাট যেন নতুন মনে হচ্ছে। আবার হর্ন বাজাল রিকশা-অলা। খুবই তাড়া আছে বুঝতে হবে। এইভাবে হর্ন বাজাচ্ছে যখন। স্বাধীন দেশের নাগরিক এরা। চেহারায় না বোঝা গেলেও। মেজাজে বোঝা যায়। মোটর-টোটরকে খাতির-রেয়াত করে না। তা-ও মার্সিডিজ নয়, অ্যামবাসাডর নয়, ক্যাডিল্যাক নয়, নেহাতই ফঙবেনে মারুতি সুজুকি।
স্কুল-ফাইন্যাল পাশ-টাশ করেও রিকশা চালিয়ে অন্ন সংস্থান করতে হচ্ছে বলে কেমন একটা ক্ষিপ্ত অভিমান এদের। সুযোগ পেলেই চলতি মোটরের গায়ে খিস্তি ছুঁড়ে দেয়। বি এ পার্ট ওয়ান পাস রিকশাঅলাও আছে এখানে।
—‘পার্ট টু-টা দিয়ে নিলে না কেন?’
—‘রেজাল্ট বেরোতে বেরোতে চাকরির বয়স যে পার হয়ে যাবে স্যার। সার্টিফিকেট পেতে পেতে আরেক জন্ম ঘুরে আসতে হবে।’
—‘অবস্থা কি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে?’
—‘হবে না তো কি! কাজ না করেই সব শালা মাইনে পেয়ে যাচ্ছে। হাত বাড়ালেই বাঁ-হাতি মাল। কাজ করবে কেন?’
খুব জ্ঞানীগুণী হয় এইসব রিকশাঅলারা। কথা বাড়াতে ভয় করে। আসলে উপার্জনের ব্যাপারে এইসব ডিগ্রি-টিগ্রিগুলো বিশেষ কাজে আসে না।
আসবে না এমন অনেক আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। যখন প্রথম হৃদয়ঙ্গম হল ব্যাপারটা তখন চলতি শিক্ষায়তনের ওপর হামলা চলেছিল কয়েক বছর। সেই থেকে পুরনো ঐতিহ্যবাহী সব শিক্ষালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে। যেটুকুও বা দেবার ক্ষমতা ছিল সেটুকুও আর নেই। সেই সুযোগে চতুর্দিক থেকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ব্যবসায়ী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। বিশাল টাকা ডোনেশন বা ঘুষ, প্রস্তুতিপর্বের অমানুষিক মহড়া। তারপরেও টিকে থাকার সংগ্রামে কোচিং ক্লাস-এই বাবদ এ বঙ্গের উচ্চাকাঙ্ক্ষী মহল একটা সাঙ্ঘাতিক জালে জড়িয়েছেন। যে শিক্ষা-ব্যবস্থা সংক্রান্ত প্রতিবাদে একটা ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর পর্যন্ত নিহত হন ছাত্রদের হাতে, সেই শিক্ষা-ব্যবস্থাই তার সর্বাঙ্গীন ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে বুক ফুলিয়ে এখনও বহাল। সমান্তরাল দুটো ছাত্র-সম্প্রদায়। ব্যবসায়ী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বহু টাকা ব্যয় করে ডিগ্রি পাওয়া ছাত্র আর সরকারি সাহায্যে শিক্ষার খয়রাতি থেকে উৎপন্ন ছাত্র। দু জনের দৃষ্টিভঙ্গি, নাগরিকত্ববোধ কি এক হতে পারে?’
এক নজর দেখলে এ অঞ্চলের গ্রাম-ট্রাম বেশ বর্ধিষ্ণু মনে হয়। তেকসলী হয়েছে নাকি জমি। ব্যাঙ্ক থেকে দেদার টাকা ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। সার এবং উন্নত ধরনের বীজের বন্টনের ব্যবস্থা হয়েছে সরকার থেকে। এ সমৃদ্ধি কি এক সময়ে ভূমিহীন ক্ষেতমজুর কি ভাগচাষীর দখলে সত্যিই এসেছে? দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের আমলে নাকি তিন লাখ একর জমি বন্টন হয়েছিল। সেই বন্টনের সুবিধেটা ভোল পালটিয়ে এবং বেনামে জোতমালিকরাই ভোগ দখল করছে না তো? যে কোনও জনকল্যাণমূলক সরকারি নীতিরই গোড়ালি অপবিত্র থাকে, যার মধ্যে দিয়ে মূর্তিমান দুর্নীতি বিনা বাধায় ঢুকে পড়ে। নতুন একটা জিনিসই যোগ হয়েছে এই অর্থনীতিতে। প্রচুর ভোগ্যপণ্য এবং ভোক্তার সৃষ্টি হয়েছে। রিকশা চালিয়ে এই সব ছেলেরা যদি ক্রমে রিকশার ব্যবসা এবং সেই সূত্রে টেপ-রেকর্ডার, স্টিরিও-সিসটেম, টিভি, ভিসিআর প্রমুখ বেশ কিছু মন-ভোলানো স্টেটাস-সিম্বল যোগাড় করে ফেলতে পারে তো হিন্দি সিরিয়্যাল আর ব্লু ফিল্ম্ দেখতে দেখতে, গজল ও ইংরেজি পপ্ সং শুনতে শুনতে শুদ্ধ বাংলায় চিঠি লিখতে না পারার লজ্জাটা ওদের পুষিয়ে যাবে। একটা সময় ছিল যখন গরিব ঘরে বা তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর মধ্যেও লেখাপড়া শিখে যোগ্য হয়ে ওঠার একটা তাগিদ দেখা গিয়েছিল। এখন কাছা-কোঁচা খুলে সব কালো টাকার পেছনে ছুটছে। এ-ও এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব। একমাত্র অর্থনীতির হাত দিয়েই এসব বিপ্লব সম্ভব হয়।
একটু বাঁ দিকে কাত হয়ে গাড়ি দাঁড় করালেন ভদ্রলোক। তাড়া খুব নেই। রিকশাকে পথ ছেড়ে না দেবার মধ্যযুগীয় মনোবৃত্তিও না। বিশেষত যদি আধা-খ্যাঁচড়া বি এ পাশ কোনও রিকশা-অলা হয় তাহলে তাকে সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিতে তিনি প্রস্তুত। সূর্যাস্ত একটু পরেই হবে। ফিকে কমলা ওড়নায় আপাদমস্তক ঢাকা পড়েও পড়বে না দূরবিসর্পী মেঠো পথ, এবড়ো-খেবড়ো দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, চষাখেত, ছোট ছোট গ্রাম্য বাগান তাল, তেঁতুল, শিরীষ, নারকেল, বড় শিশু, ত্রিভঙ্গ খেজুর। সবই অনেক দূরে দূরে, যেন যে যার নিজের রাজ্যে স্বরাট। উদার, বিস্তৃত, গ্রাম্য প্রকৃতি একেবারে আদিম বলে মন হয় এ সব সময়। আদিম এবং স্পর্শকলুষহীন। কত কাল, কত কল্প, কল্পান্ত ধরে যেন ঠায় একা। মানুষের সঙ্গে খুব বেশি মাখামাখি করলে, মানুষের খণ্ড সমস্যার মধ্যে নিজেকে বহু দিন অন্তরীণ রাখলে প্রকৃতির এই বিশাল একাকিত্বময় আনন্দের রূপ দেখার চোখ নষ্ট হয়ে যায়। অনেক পণ্ডিত দাবি করেন ভারতীয়দের প্রকৃতি-প্রেম নাকি পশ্চিমীদের থেকে ধার করা। এঁর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বোধহয় সত্যিই তাই। কোন এক দূর অতীতে ইনিও গ্রামের ছেলেই ছিলেন, যেসব গ্রামের ছেলে উচ্চতার আশায় ক্রমেই শহর থেকে অতি শহরে ধাবিত হতে থাকে। গ্রামে থাকতে মানুষ যত দেখেছেন, তাদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে যতটা আলোড়িত হয়েছেন তার অর্ধেকও হননি গাছপালা নদী-জঙ্গল, আকাশ নিয়ে। যে নদীপারের গ্রাম্য প্রকৃতির মধ্যে কোনও কোনও লেখক স্বয়ং স্রষ্টার নিদ্রিত রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন, সেখানে ইনি শুধুই এলেবেলে, অসুবিধেজনক বুনো ঝোপঝাড় ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাননি কখনও। সত্যি বলতে কি ইংলন্ডের কেন্ট প্রদেশে গিয়ে সর্বত্র সুরক্ষিত সবুজ দেখে দেখে শান্ত হতে হতে প্রকৃতি-প্রণয়ের প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ এবং বোধোদয় পড়া হল। তারপর থেকে এরকম অরক্ষিত দেশি গাছপালা, ঝোপজঙ্গল, আকাশ মেঘ, রোদ-বৃষ্টি দেখলে মধ্যে মধ্যে আত্মবিস্মৃতি আসে, দাঁড়িয়ে যেতে হয়। ওরা যেন জোর করে দাঁড় করিয়ে দেয় ওরা যে আমাদের কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ভুলে যাওয়া প্রথম-প্রণয়িণীর মতো, এমন আত্মীয়স্বজনের তুল্য, যাদের নইলে চলে না, মানুষ প্রকৃতির যৌথ উদ্যোগ ভেঙে গেলে যে সমূহ বিপদ, এসব কথা এখন অনেকেই বুঝেছে। তাই-ই হয়ত অপার সৌন্দর্য, এক রকম নীরব বাঙ্ময়তা দিয়ে বরাবর ওরা মানুষকে আকৃষ্ট করবার চেষ্টা করে এসেছে।
রিকশাটা শন শন করে এগিয়ে আসছে। কেমন একটা ক্ষিপ্ত আক্রোশে প্যাড্ল্ মারছে রিকশা-অলা। লালচে-হয়ে-আসা আলোয় হুড-খোলা রিকশার ওপর হেলান-দিয়ে বসা আরোহিণীর কপাল থেকে শুকিয়ে-ওঠা কুচো চুল হাওয়ায় উড়ছিল। উড়ছিল হালকা বেগুনি রঙের আঁচলও। মহিলাও নয় আবার মেয়েও বলা যাবে না এমনই একটা বয়স এবং ব্যক্তিত্ব। পিঠের মাঝখান পর্যন্ত বেণী, চোখের দৃষ্টি অন্যমনস্ক। রিকশা-অলা চালাচ্ছে খুব জোরে, খানিকটা রোখের সঙ্গে, বুঝি দেখিয়ে দিতে চায়, পায়ের জোরে ও কলের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে অনায়াসেই। মুহূর্তে পার হয়ে গেল। কিন্তু চকিত দেখা এবং পরিমিত আলো সত্বেও মারুতির অন্দরে বসা ভদ্রলোক ভয়ঙ্করভাবে চমকে উঠলেন। সীটে ঈষৎ গা এলিয়ে দিয়েছিলেন। এখন দণ্ডের মতো উদ্যত হয়ে বসলেন। ফাঁকা রাস্তায় উল্কাগতিতে দিগন্ত পার হয়ে গেল রিকশা। মাঠ পার হয়ে একটা জেট প্লেনের মতো এখন আকাশে ডানা ছড়িয়ে দিয়েছে। এমন আকাশ ন যত্র সূর্যে ভাতি ন চ চন্দ্রতারকম্। অতীতের তিমির কিম্বা ভবিষ্যতের। ইতিহাস যেসব তিমির সাবধানে তার মহাফেজখানায় জমিয়ে রেখে দেয় সময়মতো ব্যবহার করবে বলে। সম্পূর্ণ জানা আর বিড়ম্বনাময় আধো-জানার অতি ভয়ানক তমস্।
মারুতির আরোহী দরজা খুলে আস্তে আস্তে নেমে দাঁড়ালেন। দরজাটা ভালো করে বন্ধ না করেই হাঁটতে হাঁটতে পেছন দিকে চলে গেলেন। ধুলোর পাতলা সর পড়েছে গাড়ির অঙ্গে। অন্য কিছু ভাবতে ভাবতে রুমাল বার করে মুছতে লাগলেন গাড়ির ধুলো। এটা একটা ব্যক্তিত্বনিরূপক অভ্যাস। অনেক মিলিটারি গোঁফওয়ালা মানুষ যেমন কথা বলতে বলতে থেকে থেকেই গোঁফ চুমরোন। গাড়িকে মালিন্যহীন রাখার এই স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যাস কি প্রতীকী? নিজেকেও অমলিন রাখার? যে কোনও মূল্যে?
গাড়ির পিঠে পিঠ রেখে তিনি সূর্যকে খোবলানো মাঠের ওধারে অস্ত যেতে দিলেন। দিগ্বিসারী সবুজ সাদার সমুদ্রে লাল ডানা মেলে সূর্য ক্রমে নেমে এলো একটা অতিকায় অনৈসর্গিক অ্যালব্যাট্রসের মতো। ভেতরের আকাশেও একটা আগুনের পিণ্ড মানসদিগন্তে একবার লাফিয়ে উঠে অদৃশ্য হল। রেখে গেল দীর্ঘ বিষের পুচ্ছ। ভেতরের এবং বাইরের সেই অদ্ভুত জ্বালাময় আলোয় মানুষটি নিজের ফর্সা, পুষ্ট আঙুলে বিশাল গোমেদ আর তার পাশের ভুতুড়ে আলোঅলা বৈদুর্যমণির আংটিদুটোর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। অনেকক্ষণ। যেন এই প্রথম দেখছেন ওদের। আগে কখনও নিজের আঙুলের ওপর ওদের অস্তিত্ব এবং তার তাৎপর্য সম্পর্কে যেন পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলেন না। কি বিচিত্র দেশ! মধ্যযুগ ও ভাবী কাল, আধুনিক প্রযুক্তি বিজ্ঞান এবং অন্ধ কুসংস্কার এখানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কিভাবে থাকে একই সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীতে? এমন কি একই চরিত্রে? এই মুহূর্তে তাঁর মনে হল তাঁর হাতের এই পাথরগুলোর মতো অদ্ভুত বিসদৃশ ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। রাহু এবং কেতু, যে নামে আদৌ কোনও গ্রহ, তারা এমন কি অ্যাস্টারয়েড পর্যন্ত মহাকাশের কোথাও নেই সেই গ্রহদ্বয়ের শান্তির জন্য সংস্কৃতের ট্রিপ্ল এম এ বেনারসী জ্যোতিষী বিধান দিলেন, পুলিসের প্রাক্তন ডিভিশনাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট অখণ্ড মনোযোগের চিহ্নস্বরূপ কপালে ভাঁজ ফেলে সে বিধান শুনলেন এবং বিদেশে শিক্ষাপ্রাপ্ত আধুনিক প্রযুক্তিবিদ নামকরা দোকান থেকে ওজন লক্ষণ মিলিয়ে সে রত্ন ‘ধারণ’ করলেন। যখনই স্টিয়ারিং-এর ওপর হাত পড়ে আঙুলগুলো বিছিয়ে গিয়ে ওরা প্রকট হয়, রত্নগুলো নিচু ভারি গলায় বক্তৃতা দিতে থাকে—‘তুমি নয় হে, তোমার অদৃষ্ট তোমায় চালাচ্ছে। তুমি নিমিত্তমাত্র। মৃন্ময় পুতুলের বেশি না। যে কোনও মুহূর্তে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামতে পারে, তখন নিঃশেষে গলে যেতে পারো। ধূলির ধন আবার ধূলিতে। তবে হ্যাঁ। আমরা জাগ্রত রইলাম। একেবারে প্রলয়মেঘকে আড়াল করা সম্ভব হবে না। তার চেয়ে ছোটখাটো ব্যাপার হলে উপেক্ষা করতে পারো।’
ছোট ছোট ঘরে গোপন রাজনৈতিক দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, যাঁরা সরীসৃপের মতো ভূগর্ভবাসী তাঁদের নিচু গলার ভীষণ আকর্ষণীয় স্বপ্নব্যাখ্যানের মতো উত্তেজক এই শব্দহীন ভাষণ।
বর্ধমান বীরভূম বর্ডারের সূর্যাস্ত আজ মোটেই ক্ষণগোধূলি রেখে যাচ্ছে না। বহুক্ষণ ধরে সূর্যের স্তিমিত চোখ আজ পৃথিবীকে দেখতেই থাকে, দেখতেই থাকে। যেন দীর্ঘ প্রবাসে যাবার আগে প্রিয়জনকে শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে। দেখে দেখে আশ মিটছে না।
অন্ধকারের জিভ নিঃশেষে সব কিছু চেটে নেবার ঠিক আগে মারুতি আবার চালু হল। এদিকে বিজলি নেই। সন্ধ্যা মানেই নিশুতি। থই থই অন্ধকারে মাঠ, পথ সব একাকার। গাড়ি ফিরে চলে গেল সেই অবসাদগ্রস্ত পুরনো পন্থায়। যেখানে আলো, যেখানে মানুষ, যেখানে গাড়ি আরো গাড়ি। সব যাত্রা শেষ গণনায় একেবারে ব্যর্থ জেনেও প্রাত্যহিকতার ব্রত পালনে নিযুক্ত ট্রাক ভ্যান, মোটরের শবযাত্রার মধ্যে বিন্দুর মতো প্রসরমাণ, খুব নিখুঁত সুন্দর, চিকণ, কিন্তু ছোট্ট, ভঙ্গুর লাল মারুতি। মর্মবিদ্ধ, অন্যমনস্ক, নিশুতির যাত্রী।
রাঢ়বাংলার বিরাট আকাশ নিঃশব্দে চিত হয়ে থাকে যেন নির্বাপিত এক কুশপুত্তলিকা। আঁচলের গিঁট খুলে ভলকে ভলকে ভস্ম ঝরে। মারুতির কপালে, সামনে বাড়ানো মসৃণ নাকের ওপর। ঊর্ধ্ব থেকে ভস্মের এই অবিরাম ক্ষরণ এড়াতে স্পীডোমিটারের কাঁটা লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। কিন্তু আরোহীর মনে হয় গতি যতই বাড়ান তিনি একই জায়গায় থেমে আছেন। স্বপ্নের দৌড়ের মতো। এবং ঘড়ির কাঁটা চললেও স্থির। এবং ক্যালেন্ডারের পাতা চঞ্চল হলেও সময়ের ঠিকানা বদলাচ্ছে না।