লাল বই নীল বই

লাল বই নীল বই

বাবিন মাঠ থেকে ফিরছিল। সন্ধে হয়ে গেছে। একটা ছেলে তাকে ডাকে, তোমার নাম বাবিন ?

হ্যাঁ আমার নাম বাবিন,কিন্তু ইস্কুলের নাম অভিষেক, দুটো নামই আমার ভালো লাগে।

আমার ভালো লাগে তোমাকে,রোজ দেখি ফুটবল খেলো। ছেলেটি বলল।

এখানে আবছা অন্ধকার। কদম গাছের নিচে তো। ছেলেটার হাফ প্যান্ট আর গোল গলা টি শার্ট। ছেলেটা তারই মাথায় মাথায়,৪ ফুট দশ ইঞ্চি হবে। সে ক্লাস সিক্স। এও নিশ্চয় ক্লাস সিক্স? তুমি ক্লাস সিক্সে পড়?

সে মাথা নাড়ল।

পড় না? বাবিন জিজ্ঞেস করে।

পড়ি, আমি নিজেই পড়ি।

কী পড়? বাবিন খোঁজ নেয় যেন।

সে বলল, বই পড়ি।

বই বললে হলো, কী বই?

লাল বই, নীল বই, হলুদ বই, সবুজ বই…।

ইস, এমনি হয় নাকি? বাবিন অবাক। এমন বইয়ের কথা তো সে জীবনে শোনেনি।

হয়, আমার কাছে কত রঙের কত বই আছে, আমি পড়ি।

কে দিয়েছে অমন বই? বাবিন জিজ্ঞেস করে।

সে হেসে বলল, কে জানি কে দিয়েছে।

বাবিন বলল, আমি তোমার বই দেখতে যাব।

এস একদিন, আমি তোমাকে নিয়ে যাব।

বাবিন বাড়ি ফিরল।তার কত বই?ইংরেজি,বাংলা, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান…। উফ,পড়া আর পড়া।তার ভালো লাগে না এত পড়তে। তার চেয়ে খেলায় কত আনন্দ। কিন্তু পড়তে হবে। না পড়লে মূর্খ হয়ে থাকতে হবে। সে মায়ের কাছে পড়ে। বাবা থাকেন বাইরে। বাবিন বাড়ির সামনের মাঠে খেলে। ইস্কুল থেকে এসেই ছুট। পরেরদিন আবার দেখা। সে দাঁড়িয়ে আছে গাছতলার অন্ধকারে। বাবিনকে হাতছানি দিয়ে ডাকল, ও বাবিন।

বাবিন জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম?

আমি অবিন।

তুমি অবিন। হিহি করে হাসে বাবিন, তোমার বই কই?

দেখাব, হ্যাঁ গো তোমার ইস্কুলে আজ কী হয়েছে?

কিছু না তো, কী হবে?

সে জিজ্ঞেস করল, ক্লাস টেস্ট হয়নি?

হয়েছে।

তুমি দুটো অঙ্ক ভুল করেছ। সে বলে।

বাবিন বলল,ভুল তো হতেই পারে,আগেরবারে পাঁচটাই ঠিক করেছিলাম।

তখন অবিন বলল, আমার কোনো ভুল হয় না।

বললে হবে ভুল হয় না, ভুল সকলের হয়।

অবিন বলল, আমার ইস্কুলে ভুল নেই।

ভুল নেই মানে ? বাবিন অবাক, তাই কি কখনো হয়?

ভুল হয় না কখনো? অবিন বলল।

বাবিন বাড়ি ফিরে এল। ক্লাস টেস্টের খাতা দেখল মা। ইস, বিয়োগে ভুল না হলে একটা ঠিক হয়ে যেত। আর একটা অঙ্ক লিখতে ভুল। মা বলল, বাবিন এমনি করে পরীক্ষা দিলে হবে?

বাবিন বলল, আসলে আমার ভালো লাগছিল না মা।

কী ভালো লাগছিল না?

পরীক্ষা দিতে। বাবিন নিচু গলায় বলল।

কেন, কী হয়েছিল, পরীক্ষা দিতে ভালো লাগছিল না কেন?

বাবিন বলল, না, বলল না। বলতে গিয়ে থেমে গেল। তার ক্লাস রুমের জানালা দিয়ে কী সুন্দর আকাশ দেখা যায়। আজ আকাশ ছিল ঘন নীল। আকাশে দুটো ঘুড়ি, লাল ঘুড়ি তার ভিতরে শাদা বল, নীল ঘুড়ি, তার ভিতরে হলুদ মোমবাতি একে অন্যকে ছুঁয়ে দেখতে চাইছিল। পারছিল না। ইস একটা লাটাই যদি তার হাতে থাকত, অন্যটি অবিনের হাতে। সে নীল হলুদ, অবিন লাল শাদা। অবিনের সঙ্গে তার দুদিনের পরিচয়, এর ভিতরেই অবিন তাকে টানছে সব সময়। অবিন বলেছে, তার ইস্কুলে সব রঙিন বই পড়ায়, কত রকম বই, কত রকম চক পেন্সিল, কত রকম খাতা…। ঠিক দুপুরবেলা, বনে বনে, পাহাড়ের দিকে হাঁটো, প্রজাপতির দিকে ছোট, তাদের ইস্কুল এমন করতে দেয় ? দেয় না। শুধু পরীক্ষা নেয়। ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক, ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান…। বাংলা বইয়ে রয়েছে ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে…’। ছোট নদী দেখেছ তুমি বাবিন?

বাবিন জিজ্ঞেস করল, মা তুমি ছোট নদী দেখেছ?

বলল, দেখেছি কোন ছোটবেলায়।

আমি কি দেখেছি? বাবিনের কৌতুহল হয়। মা বলে ছেলেবেলায় তাকে কোলে নিয়ে বিমানে করে দিল্লি গিয়েছিল। বাবিনের কিছুই মনে নেই। সে কখনো বিমানে ওঠেনি।

দেখবি, দেখার সময় কি পেরিয়ে যাচ্ছে ? মা বলল।

বাবিনরা থাকে যে ভালো গঞ্জে সেখান থেকে বহুদূরে নীল পাহাড় দেখা যায় বিকেলের দিকে। পাহাড়ের দিকে নাকি ছোট একটা নদী আছে।বাবিন বলল, মা, আমরা একদিন যাই, দেখে আসি।

তোর বাবা আসুক।

বাবা থাকে অনেক দূরে চাকরিতে। মাসে একবার আসে। আবার আসেও না। আসতে পারে না। কাজের খুব চাপ। আবার সে জায়গায় ভালো ইস্কুল নেই যে বাবিনকে নিয়ে যাবে। বাবা চেষ্টা করছে খুব। বদলি হয়ে আবার ফিরে আসবে এখানে,তাদের ভালো গঞ্জের পাশের শহরে। বাবিন চুপ করে থাকে। শীত চলে গেল। বসন্ত চলছে। গাছে গাছে ফুল ফুটেছে। দূরে শিমুল গাছে ফুল ফুটেছে কত। বাতাসে শিমুল তুলো উড়ছে। মাদার গাছে টকটকে লাল ফুল।পলাশের বন আগুন হয়ে গেছে। বাবিনের বন্ধু যে অবিন সে থাকে কোন দিকে কে জানে? সেদিন বিকেল শেষ হলে গোধূলিবেলায় আবার তাকে হাতছানি দিল, আমার বই দেখবি না?

কখন দেখি, সকালে পড়া, তারপর ইস্কুল,তারপর এইটুকু খেলা, তারপর বাড়ি, সন্ধের পর বাড়ির বাইরে থাকা বারণ, মা একা থাকে, খুব চিন্তা হবে।

হুঁ। অবিন বলল, তাহলে আর কী করে দেখবি তুই।

সত্যি তোমার বই নীল, লাল, হলদে, সবুজ, বেগনে, গোলাপী, কমলা? বাবিন জিজ্ঞেস করে।

হুঁ, শাদা রঙ ফাটিয়ে দিলে যত রঙ হয়, ততো রঙের বই আমার।

বইয়ের ভিতর কী আছে? বাবিন জিজ্ঞেস করল।

পড়া আছে। অবিন বলল।

পড়া? বাবিন আবার জিজ্ঞেস করে।

সব পড়া, তুই যা পড়িস, তাই পড়া। অবিন বলল।

সন্ধে হয়ে গেল। বাবিন বাড়ি ফিরে এল। ফিরে এসে মাকে বলল, নীল লাল, হলদে সবুজ বই হয় মা?

মা অবাক, হলদে সবুজ বই, ছবির বই?

রঙের বই। বাবিন বলল।

মা চুপ করে থাকল। তারপর বলল, তোর বাবা ফোন করেছিল, এই মাসে আসবে না, মন দিয়ে পড়তে বলেছে।

বাবিন বলল, মন কেমন করে মা।

কেন রে কী হলো?

বাবা কতদিন আসেনি মা।

আসবে,নতুন নতুন বই নিয়ে আসবে।মা বলল, বই কিনেছে, অলিভার টুইস্ট, এ টেল অফ টু সিটিজ, আর হেমেন্দ্রকুমার রায়ের যখের ধন।

বাবিনের মন ভালো হয়ে গেল। বাবিনের অনেক বই। পড়ার বই আর গল্পের বই। কত বই পড়েছে সে। চাঁদের পাহাড়, মিসমিদের কবচ, বুড়ো আংলা, ক্ষীরের পুতুল, পদি পিসির বর্মি বাক্স,গ্যালিভার’স ট্রাভেল, টাইম মেসিন, হ্যাঞ্চ ব্যাক অফ নোতরদম, এ কানেক্টিকাট ইয়াঙ্কি ইন কিং আর্থোজ কোর্ট…। বাবা বই আনলে সে অবিনকে একদিন নিয়ে আসবে। অবিনকে দেখাবে তার বই। তারা দুজনে একটা লাইব্রেরি করবে। কী ভালো না হবে। অবিনের সঙ্গে দুদিন বাদে আবার দেখা। ঝাঁকড়া চুল ময়লা রঙ শীর্ণকায় অবিন বলল, এক কাজ করবি, একদিন ফুটবল না খেলে হলুদ বই সবুজ বই দেখতে যাবি।

হ্যাঁ যাব। বাবিন বলল, তার খুব ইচ্ছে করে রঙের বই দেখতে। দেখে এসে বাবাকে ফোনে বলে দেবে লাল নীল সবুজ বই নিয়ে আসতে। বুঝিয়ে দেবে কেমন বই ? বাবা নিজে খুব বই পড়ে, বাবা চায় বাবিনও অনেক বই পড়ুক। মা তো অবসর সময়ে বই মুখেই বসে থাকে। মা নিজেও জানে না লাল নীল বই আছে।

অবিন বলল, তুই সাইকেল আনিস, সাইকেল ছাড়া যেতে পারবি না।

তোর বাড়ি অনেকদূর?

অবিন বলল, হ্যাঁরে, অনেক দূর।

তোর সাইকেল কই?

আমি তো ছুটে যাই। অবিন বলে।

ছুটে যাস মানে?

ছুটেই যাই,প্রত্যেক দিন ছুটে যাই ছুটে আসি।অবিন কথাটা বলে হাসে।

তোর বাড়ি কোন দিকে?

অবিন বলে, সব দিক দিয়ে যেতে পারবি, সব দিকে।

হাসল বাবিন, তুই না কেমন যেন কথা বলিস।

কেমন? অবিন হেসে জিজ্ঞেস করে।

বাবিন বলল, সব দিক দিয়ে এক দিকে যাওয়া যায় ?

অবিন বলল, আগে চ, দেখবি যাওয়া যায় কি না।

সাইকেল নিয়ে পরদিন এল বাবিন। অবিন বল, চ, আমার বাড়ি।

তুই সাইকেলের পিছনে বস।

না আমি ছুটে যাই, আমি আমার মতো যাই, তুই তোর মতো আয়।

বাবিন বলে,আমি আমার মতো যাব কী করে, আমি কি তোর বাড়ি চিনি?

চিনে যাবি, দেখবি ‘আমার বাড়ি’ লেখা একটা বাড়ি। বলে অবিন ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে ছুটতে কতদূর! সাইকেল নিয়ে তার পিছনে ছুটতে লাগল বাবিনও। কিন্তু কোথায় সে। কোথায় অবিন? মিলিয়ে গেছে বাতাসে। তাহলে বাবিন কি যাবে সামনে? না কি ফিরে আসবে? বাবিন ফিরবে না। বাবিন কোনোদিন একা একা আসেনি এই পথে। এই পথে আসেইনি। সে শুধু ইস্কুলে যায় আর ফিরে আসে। আর ফুটবল মাঠে যায়, ফিরে আসে। বাবিন ছুটছে সাইকেল নিয়ে। কতদিন ভেবেছে এই পথে আসবে? তার মনে পড়ল ক্লাসের বইয়ের কবিতাটি, কত দিন ভাবে ফুল উড়ে যাবো কবে …

কত দিন ভাবে ফুল উড়ে যাবো কবে

যেথা খুশি সেথা যাবো ভারী মজা হবে।

তাই ফুল একদিন মেলি দিল ডানা

প্রজাপতি হলো, তারে কে করিবে মানা!

কী সুন্দর ‘আমার বাড়ি’র পথ। ঢেউ খেলানো পথ, লাল মাটির পথ। দূরে দেখা যায় নীল পাহাড়, সবুজ বন। ওইদিকে এক নদী আছে, নদীর নাম, ‘ছোট নদী’। আমাদের ‘ছোট নদী’ নেমেছে ওই নীল পাহাড়ের ঝর্না থেকে। উফ, কী সুন্দর! কত ফুল আর কত ফুল! লাল নীল, সবুজ, হলুদ, গোলাপী, কমলা, বেগনে…। বাবিন দেখতে পাছে সব। দেখতে পাচ্ছে পথের ধারে ফুটে আছে অচেনা ফুলের ঝাড়। কী ফুল গো এইটা। সাইকেল থামিয়ে সে জিজ্ঞেস করল এক বুড়োকে। বুড়ো হেঁটে যাচ্ছে পাহাড়ের দিকে একা একা। মাথায় তার নীল পাগড়ি, গায়ে তার হলদে জামা, পরণে নীল ধুতি। বলল, এইটা তো ভাট ফুল।

ওম্মা, এই তাহলে ভাট ফুল? বইয়ে পড়েছে ভাটফুলের কথা। সে অবাক হয়ে দেখছে যখন সামনের একটা নিম গাছের ডালে পাখি এসে বসল। ধূসর আর শাদায় মেশানো, লেজটা উঁচু করা ছোট্ট পাখি। কী পাখি গো? বুড়ো হেসে বলল, দোয়েল পাখি, তুমি চেন না?

না গো, এই সেই দোয়েল, শিস দেয় তো?

নাচে গান গায়, শিস দেয়, আমার বাড়ির পাখি। বুড়ো বলল।

তুমি যাচ্ছ কোথায়? জিজ্ঞেস করে বাবিন।

বুড়ো বলল, আমার বাড়ি, তুমি?

বাবিন বলল, আমিও আমার বাড়ি।

কোন দিকে?

বাবিন বলল, সব দিকে।

বুড়ো হেসে বলল, আমার বাড়িও সব দিকে।

তোমার নাম কী গো?

বুড়ো বলল, অবিন, অবিন গো।

ধ্যাত, অবিন হবে কেন? বাবিন বলল, অবিন আমার বন্ধু, আমার মতো বয়স।

বুড়ো বলল,আমার বাড়ির দেশে সবাই অবিন, সবাই বাবিন, যাই আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, সামনে কত কাজ?

কী কাজ তোমার? বাবিন জিজ্ঞেস করে।

ভালো করে সব দেখা,পাহাড়তলীতে কোন ফুল ফুটল, কোন ফুল ঝরে গেল, কোন ফুল ফুটবে, কোনটা ফুটল না, কোন পাখিটা এল, কোন পাখিটা এল না, শিস দিল আর শিস দিলো না, সব হিশেব রাখতে হবে আমাকে, খাতায় তুলতে হয় তবে না নম্বর হবে।

নম্বর, সে কি গো নম্বর দিয়ে তুমি কী করবে?

বুড়ো হেসে বলল, লাল বই নীল বইয়ে আঁকা আছে সব, নম্বর নিয়ে কাউকে দিয়ে দেব, তুমি নেবে?

বাবিন হেসে বলল, আমি নিয়ে কী করব?

বুড়ো হেসে বলল, তাও তো বটে, তুমি কী করবে, তাইলে নম্বর বাদ, নেবই না।

বাবিন জিজ্ঞেস করল, তোমার বাড়ি কতদূর?

অনেক দূর বলা যায়, আবার কাছেও বলা যায়, তুমি ‘আমার বাড়ি’ চলো, লাল বই নীল বই, ভাট ফুল, দোয়েল, শ্যামা, ছোট নদী…। বলতে বলতে বুড়ো হাঁটতে লাগল সামনের দিকে। বাবিন সাইকেল ঘুরিয়ে নিল। লাল বই, নীল বই, ছোট নদী, নীল পাহাড়, ‘আমার বাড়ি’ যে সব দিকে। সব দিকে রয়েছে জেগে। লাল নীল পাগড়ির বুড়োর পিছু পিছু যেতে হবে কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *