লাল পাগড়ি! (শেষ অংশ)
(অর্থাৎ লাল-পাগড়ি পরিহিতের অদ্ভুত রহস্য!)
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ
থানার দারোগা সম্মুখে কালে খাঁকে শকটারোহণে গমন করিতে দেখিয়া, তাঁহার নিকট অশ্ব হইতে অবতরণ করিলেন।
কালে খাঁ তাঁহাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এত প্রত্যূষে তুমি কোথায় গমন করিতেছ?
দারোগা। একটি অনুসন্ধান উপলক্ষে আমি এই দিকেই ছিলাম। রাত্রি প্রভাত হইবার অতি অল্পমাত্র পূর্ব্বেই একজন চৌকিদার আসিয়া আমাকে সংবাদ প্রদান করে যে, রাত্রিকালে রাস্তার উপর ডাকাইতি হইয়া গিয়াছে। কোন একটি ভদ্রলোক একখানি শকটারোহণে রাস্তা দিয়া গমন করিতেছিলেন, সেই সময় ডাকাইতগণ তাঁহাকে আক্রমণ করে ও তাঁহার যথাসর্ব্বস্ব গ্রহণ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। তাহাই দেখিবার নিমিত্ত গমন করিতেছি।
কালে খাঁ। চৌকিদার কিরূপে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইল?
দারোগা। সে যে কিরূপে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইল, তাহা আমি বলিতে পারি না, চৌকিদারই তাহা বলিতে পারে।
কালে খাঁ। সে চৌকিদার কোথায়?
দারোগা। আমার সমভিব্যাহারেই আছে; সে এই।
কালে খাঁ। রাত্রিতে কোথায় ডাকাইতি হইয়াছে?
চৌকিদার। এই রাস্তার উপর, কিন্তু এখান হইতে খানিক দূরে।
কালে খাঁ। তুই তাহা কি করিয়া জানিতে পারিলি?
চৌকিদার। আমি আমার কুটুম্ববাড়ী গিয়াছিলাম। সেই স্থান হইতে আসিবার সময় পথিমধ্যে রাত্রি হইয়া যায়, কোন গ্রামের মধ্যে গিয়া রাত্রি অতিবাহিত করিব, মনে মনে এই রূপ স্থির করিয়া আমি চলিয়া আসিতেছি। এরূপ সময় দেখিতে পাই, একখানি গরুরগাড়ি যাইতেছে ও উহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দুই জন লোকও গমন করিতেছে, ইহা দেখিয়া আমার সাহস হয়, আমিও তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে থাকি, কিন্তু রাত্রি আন্দাজ ১২টার সময় দেখিতে পাই, এক দল ডাকাইত আসিয়া ঐ গাড়ি আক্রমণ করে। ইহা দেখিয়াই আমার অতিশয় ভয় হয়, আমি দ্রুতপদে সেইস্থান হইতে পলায়ন করিয়া দারোগাবাবুর নিকট গমন করি ও তাঁহাকে এই সংবাদ প্রদান করি।
কালে খাঁ। ডাকাইতগণ যে গাড়ি আক্রমণ করিয়াছিল, সেই গাড়ি তুই চিনিস?
চৌকিদার। না।
কালে খাঁ। ঐ গাড়ির ভিতরে কে ছিল, জানিস?
চৌকিদার। না, তাহা আমি জানি না।
কালে খাঁ। তাহাকে তুই দেখিলে চিনিতে পারিবি?
চৌকিদার। না। আমি রাত্রিতে তাহাকে দেখিয়াছি; সুতরাং তাহাকে চিনিতে পারিব কি প্রকারে?
কালে খাঁ। যে দুই জন লোক গাড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছিল, তাহাদিগকে চিনিতে পারিবি?
চৌকিদার। আমি তাহাদিগের নিকট যাই নাই, সুতরাং তাহাদিগকে ভাল করিয়া দেখি নাই; কিন্তু আমার বোধ হইয়াছিল, উহারা পুলিসের প্রহরী।
কালে খাঁ। (দারোগার প্রতি) এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনাকে এখন গমন করিতে হইবে না।
দারোগা। কেন?
কালে খাঁ। উহার সমস্ত অবস্থা আমি অবগত আছি, আপনার থানায় গিয়া উহার সমস্ত অবস্থা আপনাকে বলিয়া ও পরামর্শ করিয়া স্থির করিব, এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করা আবশ্যক কি না।
দারোগা। তবে কি দস্যুগণ আপনার গাড়িই আক্রমণ করিয়াছিল?
কালে খাঁ। তোমার কি অনুমান হয়?
দারোগা। আমার তো এখন তাহাই অনুমান হইতেছে।
কালে খাঁ। তবে তাহাই, কিন্তু ইহার অনুসন্ধান করা কর্তব্য কি?
দারোগা। আমি যখন এইসংবাদ প্রাপ্ত হই ও যখন ইহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত বহির্গত হইয়া আসি, সেই সময় ঐ সংবাদ লিখিয়া থানায় পাঠাইয়া দিয়াছি ও এতক্ষণ বোধ হয় ঐ সংবাদ থানায় উপস্থিত হইয়াছে ও ডাইরি-ভুক্ত হইয়া গিয়াছে। এরূপ অবস্থায় অনুসন্ধান না করিলে তো কোন প্রকারেই আর চলিতে পারে না। তত্ত্ব্যতীত দেখিতেছি, আপনার যথাসর্বস্ব তাহারা অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে। সরকারি পোষাক ইত্যাদি কি কিছু আপনার সঙ্গে ছিল?
কালে খাঁ। ছিল বৈকি।
দারোগা। তাহা হইলে তাহাও তো উহারা অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে?
কালে খাঁ। তাহাও তো গিয়াছে।
দারোগা। এরূপ অবস্থায় এ মোদ্দমার অনুসন্ধান কোন রূপেই পরিত্যাগ করিতে পারা যায় না।
ঐ থানার এলাকার মধ্যে উপর্যুপরি এইরূপ কয়েকটি ডাকাইতি হইয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহার একটিরও কোনরূপ কিনারা না হওয়ায়, কালে খাঁ উহার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়া সেইস্থানে আগমন করিতেছিলেন। থানার দারোগা যে কার্য্য সম্পন্ন করিতে পারিলেন না, অপর একজন কৰ্ম্মচারী আসিয়া সেই কার্য্য সম্পন্ন করিয়া যাইবেন, ইহা সেই দারোগা কখনই চাহেন না। দারোগা কেন, কোন কৰ্ম্মচারীই এইরূপে অপদস্থ হইতে ইচ্ছা করেন না, সুতরাং কালে খাঁ যাহাতে অপদস্থ হন, দারোগা তাহাই ইচ্ছা করিয়া ঐ মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলেন। কারণ তিনি মনে মনে বেশ জানিতেন যে, যে ব্যক্তি যে সকল ডাকাইতগণকে ধরিবার নিমিত্ত জেলার উচ্চপদস্থ সাহেব কর্ম্মচারীগণ কর্তৃক নিযুক্ত হইয়াছেন, ডাকাইতগণ তাহাকেই আক্রমণ করিয়া তাহারই যথা সর্ব্বস্য অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, এ কথা সাহেবগণের কর্ণগোচর হইলে কালে খাঁ বিশেষরূপে অপদস্থ হইবেন, সুতরাং যাহাতে এই কথা ঐ সকল সাহেব কৰ্ম্মচারীগণের কর্ণগোচর হয়; তাহারই নিমিত্ত দারোগা সচেষ্ট হইয়া কালে খাঁকে অপদস্থ করিবার মানসে ঐ ডাকাইতি মোকদ্দমার অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন।
ডাকাইতি মোকদ্দমা রুজু হইল, উপরিতন কর্ম্মচারীগণ অবগত হইতে পারিলেন যে, কালে খাঁর যথাসৰ্ব্বস্ব ডাকাইতগণ কর্তৃক অপহৃত হইয়াছে এবং তিনিও তাহাদিগের হস্তে বিশেষরূপে লাঞ্ছিত হইয়াছেন। ইহা জানিতে পারিয়া তাঁহারা ঐ মোকদ্দমার অনুসন্ধানের সহায়তা করিতে ও আবশ্যক অনুযায়ী পরামর্শাদি প্রদান করিতে আর একজন ইনস্পেক্টরকে নিযুক্ত করিলেন।
যখন এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান হইতেছিল, সেই সময় ঐ ডাকাইত দলের কয়েকজন ধৃত হয়। তাহার মধ্যে সদার ওমরাও খাঁও একজন ছিলেন। উহারা যে অনুসন্ধানকারী পুলিস কর্ম্মচারীর কার্য্য-দক্ষতা গুণে ধৃত হইয়াছিল, তাহা নহে। পঞ্জাব দেশের কয়েক জন লোক রাত্রিকালে একখানি শকটে আরোহণ করিয়া সেই রাস্তা দিয়া গমনকালীন ঐ ডাকাইতদল তাহাদিগকে আক্রমণ করে। তাহারাও সহজে ছাড়িবার পাত্র ছিল না, সুতরাং তাহারাও তাহাদিগের সাধ্যানুসারে সেই ডাকাইত দলকে আক্রমণ করে ও তাহাদিগকে উত্তমরূপ প্রহার করে। ঐ প্রহারে ৩।৪ জন ডাকাইত তাহাদিগের সর্দ্দার ওমরাও খাঁর সহিত বিশেষরূপ জখম প্রাপ্ত হয় ও তাহাদিগের হস্তে বন্দী হয়। পুলিস এই সংবাদ অবগত হইতে পারিয়া দ্রুতপদে সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হন, ও ঐ সকল আহত ডাকাইতদিগকে লইয়া অনুসন্ধান করিতে থাকেন, কিন্তু ঐ কয় জন ব্যতীত তাহাদিগের দলের আর কাহার নাম প্রকাশই হয় না, বা অপর আর কেহ ধৃতও হয় না, এবং উহার পূর্ব্ব পূর্ব্ব ডাকাইতির কোন দ্রব্যও পাওয়া যায় না। সুতরাং ঐ কয় ব্যক্তিকেই জেলে প্রেরণ করিয়া পুলিস কর্ম্মচারীগণ তাহাদিগের ডাকাইতি মোকদ্দমার অনুসন্ধান শেষ করিয়া দেন।
যে তিন জন প্রধান ডাকাইতের কার্য্যকলাপ অবলম্বনে এই “লাল পাগড়ি” নামক প্রবন্ধের অবতারণা, তাহাদিগের সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত এই স্থানে বর্ণিত হইল। ইহাতেই পাঠকগণ অবগত হইতে পারিবেন, যে ঐ তিন জন ডাকাইত কর্তৃক এতদ্দেশের কি ভয়ানক সর্ব্বনাশ ঘটিয়াছিল।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
কলিকাতার বহির্ভাগে চতুৰ্দ্দিকে প্রায়ই ভয়ানক ডাকাইতি হইতে আরম্ভ হইল। এরূপ সপ্তাহ প্রায়ই যাইত না, যে সপ্তাহে একটি না একটি ডাকাইতির সংবাদ আসিয়া আমাদিগের নিকট উপস্থিত না হইত। বাঙ্গলা হাতার কথা দূরে থাকুক, উত্তর পশ্চিম অঞ্চলেও ভয়ানক ডাকাইতি আরম্ভ হইল। ডাকাইতগণের ভয়ে সমস্ত লোকের মনে ভয়ানক আতঙ্কের উদয় হইতে লাগিল। আজ কোন গ্রামের কোন ঘরে অগ্নি দিয়া ডাকাইতগণ গৃহস্বামীর যথা সৰ্ব্বস্ব লইয়া প্রস্থান করিয়াছে। কল্য কাহার বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইয়া বাড়ীর লোক জনদিগকে বন্ধন করিয়া রাখিয়া তাহাদিগকে সম্বলচ্যুত করিয়াছে। অপর দিবস কাহার বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া তাহার ধনভাণ্ডার কোথায়, তাহা জানিবার মানসে তাহাকে প্রহার করিতে করিতে তাহাকে হত্যা করিয়া ফেলিয়াছে। অপর দিবস সরকারী রাস্তার উপর একত্রিত হইয়া যে সকল গাড়িতে সরকারী বা মহাজনী অর্থ সকল পাঠান হয়, তাহা আক্রমণ করিয়া এ সমস্ত অর্থ আত্মসাৎ করিয়াছে। আর এক দিবস নৌকার উপর পতিত হইয়া ঐ নৌকায় যাহা কিছু ছিল, তাহা গ্রহণ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। এইরূপ নানাপ্রকার সংবাদ প্রায়ই আসিয়া আমাদিগের কর্ণে প্রবিষ্ট হইতে লাগিল। সংবাদপত্রগণ এই সকল সংবাদ আরও নানারূপে রঞ্জিত করিয়া সর্ব্বসাধারণের নিকট উপস্থিত করিতে আরম্ভ করিল। অনেক ধনশালী ব্যক্তি আপনাপন পল্লিবাস পরিত্যাগ করিয়া তাঁহাদিগের যথাসর্ব্বস্ব সঙ্গে লইয়া এই কলিকাতা সহরের মধ্যে আসিয়া তাঁহাদিগের বাসস্থান স্থাপিত করিতে লাগিলেন। সমস্ত জেলায় ভয়ানক হুলস্থূল পড়িয়া গেল, জেলার সমস্ত লোকই রাত্রিদিন ডাকাইতদিগের ভয়ে সশঙ্কিত থাকিতে লাগিলেন। যাহাতে এই ডাকাইতদল ধৃত হয়, জেলার কর্তৃপক্ষগণ তাহার পরামর্শ করিয়া বাছিয়া বাছিয়া কয়েকজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী বাহির করিলেন, ও ঐ সমস্ত ডাকাইত সর্দ্দারের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত বা যাহাতে ডাকাইতি বন্ধ হয়, তাহার বন্দোবস্ত করিবার নিমিত্ত তাঁহাদিগকে ঐ কার্য্যে নিযুক্ত করিলেন। কর্মচারীগণ নানাস্থানে পরিভ্রমণ করিয়া নানাস্থান হইতে সংবাদাদি গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিলেন, কিন্তু কোন দল কর্তৃক যে এই সকল ডাকাইতি হইতেছে, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। তবে তাঁহাদিগের বেশ অনুমান হইল যে, কলিকাতা বা অপর কোন প্রধান সহরের সহিত ঐ ডাকাইতদলের বিশেষরূপ সংস্রব আছে, নতুবা ঐ সকল অপহৃত দ্রব্য ডাকাইতগণ কোথায় লইয়া বিক্রয় করিয়া থাকে?
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, সেই সকল পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ ক্রমে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ঐ সকল কর্ম্মচারীগণের মধ্যে অনেকে ইতিপূর্ব্বে কলিকাতার ভিতর পদার্পণ করেন নাই, যাঁহাদিগের পদধূলি ইতিপূর্ব্বে এইস্থানে পড়িয়াছিল, তাঁহারাও রাস্তা চিনিয়া গমনাগমন করিতে অক্ষম। সুতরাং কলিকাতা পুলিসের সাহায্যগ্রহণ না করিলে এইস্থানে তাঁহাদিগের পদমাত্রও চলিবার উপায় ছিল না। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া তাঁহারা এইস্থানের পুলিসের সাহায্য পাইবার প্রত্যাশায়, এইস্থানের সর্ব্বপ্রধান পুলিস-কর্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন; তিনি তাঁহাদিগের নিকট আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইয়া, তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপ সাহায্য প্রদানে সম্মত হইলেন ও আমার উপরেই ঐ গুরুভার অর্পণ করিলেন। আমি এই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে প্রথমতঃ নানারূপ আপত্ত্য করিলাম, কিন্তু আমার সেই সকল আপত্ত্য কোনরূপেই রহিল না, আমার হস্তে অপরাপর যে সকল কাৰ্য্য ছিল, তাহা অপরের হস্তে অর্পণ করিয়া, আমাকে ঐ কার্য্যে নিযুক্ত হইতে হইল। যে সকল পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ ঐ কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তাঁহাদিগের সহিত আমি সাক্ষাৎ করিলাম, ও যে যে স্থানে যে যে রূপ ডাকাইতি হইয়াছি, তাহার আনুপূর্ব্বিক সমস্ত অবস্থা অবগত হইবার মানসে আমি তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, যে সকল ডাকাইতি হইয়া গিয়াছে, তাহা কি একই প্রকারে হইয়াছে বলিয়া অনুমান হয়?
দারোগা। একই প্রকারে কি রকম?
আমি। একই ধরণের?
দারোগা। তাহা নহে, প্রত্যেক ডাকাইতি আলাহিদা রকমের বলিয়া বোধ হয়।
আমি। তাহা হইলে সমস্ত ডাকাইতিই একদল ডাকাইতের কার্য্য, ইহা কিরূপ আপনারা অনুমান করেন?
দারোগা। আমরা সে অনুমান করি নাই।
আমি। তাহা হইলে আপনারা কি অনুমান করিয়াছেন?
দারোগা। আমরা তাহার কিছুই অনুমান করিয়া উঠিতে পারি নাই।
আমি। সমস্ত ডাকাইতির কাগজ পত্র আপনারা উত্তমরূপে পাঠ করিয়াছেন কি?
দারোগা। কোন কাগজ?
আমি। পুলিসের অনুসন্ধান সম্বন্ধীয় সমস্ত কাগজ, প্রথম এতলা, ডাইরি সাক্ষ্যগণের জবানবন্দী প্রভৃতি যে কোন বিষয় অনুসন্ধানকারী পুলিস-কর্ম্মচারী নথীভুক্ত করিয়াছেন?
দারোগা। পড়িয়াছি বটে, কিন্তু বিশেষ করিয়া দেখি নাই, ঐ সকল কাগজপত্র পড়িয়া বিশেষ কি ফল ফলিবার সম্ভাবনা?
আমি। কি হইতে যে কি ফল উৎপন্ন হয়, তাহা পরে জানিতে পারিবেন। ঐ সকল মোকদ্দমার নথিপত্র কোথায়?
দারোগা। তাহা আমাদিগের নিকট প্রেরিত হইয়াছে, ও আমাদিগের নিকটেই আছে।
আমি। আপনারা আমার নিকট হইতে কি সাহায্য প্রার্থনা করেন? ডাকাইতি হইল মফঃস্বলে, আর কলিকাতায় বসিয়া আমি আপনাদিগকে কি সাহায্য করিতে পারি?
দারোগা। আমাদিগের বিশ্বাস এই যে, ডাকাইতগণ ডাকাইতিলব্ধ অলঙ্কার পত্র এই কলিকাতা সহর ভিন্ন অপর কোনস্থানে বিক্রয় করিতে সমর্থ হয় না, সুতরাং ঐ সকল দ্রব্য কোথায় বিক্রয় হয়, তাহা যদি আপনি সন্ধান করিয়া দিতে পারেন, তাহা হইলেই ঐ সকল ডাকাইতির কিনারা হয়, আর কোনরূপ উপায় আমরা দেখিতেছি না।
আমি। ইহা সহজ কথা নহে? কাহারা ডাকাইতি করে, তাহার কিছু কি আপনারা অবগত হইতে পারিয়াছেন?
দারোগা। না।
আমি। তাহা হইলে দ্রব্যাদি কোথায় বিক্রয় হয়, তাহা কিরূপে জানিতে পারিবেন। লোক স্থির হইলে উহা জানিতে পারা যাইতে পারে; কারণ, কাহার সহিত তাহাদিগের আলাপ পরিচয়, কোন কোন স্থানে তাহাদিগের যাতায়াত, তাহার উপর একটু বিশেষরূপ লক্ষ্য রাখিয়া চলিতে পারিলেই, অনায়াসে জানা যাইতে পারা যায় যে, তাহারা কাহার নিকট অপহৃত দ্রব্যসকল বিক্রয় করিয়া থাকে। তখন চেষ্টা করিলে কোন কোন দ্রব্যের সন্ধান ও হয়তো হইতে পারে। কিন্তু যে পর্য্যন্ত আপনারা না জানিতে পারিবেন যে, ঐ সকল ডাকাইতি কোন্ কোন্ ব্যক্তির দ্বারা হইতেছে, সেই পর্যন্ত অপহৃত দ্রব্যের কোনরূপ সন্ধান পাওয়া সহজ নহে, তবে ঈশ্বর যদি তাহাদিগকে গহনাদির সহিত আমাদিগের হস্তে আনিয়া ফেলিয়া দেন, সে স্বতন্ত্ৰ কথা।
দারোগা। তাহা হইলে আপনি কি করিতে চাহেন?
আমি। যদি আমার পরামর্শ শুনিয়া কার্য্য করিতে প্রস্তুত হন, তাহা হইলে যখন আমি এই কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইয়াছি, তখন একবার প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া দেখি যে, ঐ সকল ডাকাইতি মোকদ্দমার কোনরূপ কিনারা করিতে পারা যায় কি না।
দারোগা। আপনার পরামর্শ কেন শুনিব না, আমরা আপনার নিকট আসিয়াছি ও আপনার সাহায্য পাইয়া আপনাদিগের অধিকারভুক্ত স্থানে কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তখন আপনার কথা না শুনিয়া আমরা কাহার কথা শুনিব? আপনি যেরূপ বলিবেন, আমরা সেইরূপই করিতে প্রস্তুত আছি।
আমি। তাহা হইলে সমস্ত নথিপত্রগুলি একবার উত্তমরূপে পড়িয়া দেখা আবশ্যক।
দারোগা। কতগুলি নথী?
আমি। ইদানিং যত ডাকাইতি হইয়াছে, তাহার সমস্ত গুলিন।
দারোগা। সমস্ত তো আমাদিগের নিকট নাই; কতকগুলি আছে।
আমি। যাহা নাই, তাহাও আনাইয়া লইতে হইবে।
দারোগা। আচ্ছা, তাহাই করিব।
এই বলিয়া সেই পুলিস কর্ম্মচারী তখন তাঁহাদিগের বিভাগের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর নিকট এক পত্র লিখিলেন। তাহার পর ক্রমশই পুরাতন নথী সকল আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। ঐ সকল নথী আমরা বিশেষ মনোযোগের সহিত পড়িয়া দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম, প্রায় ১০টি ডাকাইতিতে ঘরে অগ্নি প্রদান করা হইয়াছে; কিন্তু যে ঘরে তাহারা ডাকাইতি করিয়াছে, সেই ঘরে একটি ডাকাইতিতেও অগ্নি প্রদান করা হয় নাই; উহার নিকটবর্ত্তী ঘরে প্রায়ই অগ্নি প্রজ্বলিত হইয়াছে। পাঁচ সাতটি ডাকাইতিতে ডাকাইতগণের মস্তকে লাল পাগড়ি ছিল, এইরূপ কথা কোন কোন সাক্ষী বলিয়াছে। একটি ডাকাইতি হইয়াছিল একটি থানায়। ঐ থানার ডাকাইতিতে পুলিসের পোষাক অনেক অপহৃত হয়, তাহার মধ্যে লাল পাগড়িও বিস্তর ছিল। যে সকল ডাকাইতিতে ঘরে অগ্নি দেওয়া হইয়াছিল, তাহার একটি ডাকাইতির অনুসন্ধান কালে একজন সাক্ষী কহিয়াছিল, “তাহার বাড়ীর ছাদের উপর দাঁড়াইয়া সে ঐ ডাকাইতি করিবার সময় দেখিয়াছিল, উহাদিগের অনেকের মস্তকেই লাল পাগড়ি ছিল বলিয়া তাহার অনুমান হয়।”
ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের এই কয়টি ভিন্ন ভিন্ন নথী পড়িয়াই আমাদিগের মনে একরূপ ধারণা হইল যে, যে ডাকাইত দল থানায় ডাকাইতি করিয়া পুলিসের অনেক পোষাক ও অনেক লাল পাগড়ি লইয়া গিয়াছিল, সেই দলই লাল পাগড়ি পরিয়া স্থানে স্থানে ডাকাইতি করিতেছে; কারণ, ঐ সমস্ত ডাকাইতির তারিখ দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারা গেল যে, যে সকল ডাকাইতিতে লাল পাগড়ি ব্যবহৃত হইয়াছে, ঐ সমস্ত ডাকাইতিই থানায় ডাকাইতি করিয়া লাল পাগড়ি সকল অপহৃত হইবার পর হইয়াছে।
এই সকল নথীপত্র পাঠ করিয়া আমার মনে বেশ প্রতীতি জন্মিল যে, যে সকল ডাকাইত থানায় ডাকাইতি করিয়া পাগড়ি প্রভৃতি চুরি করিয়া আনিয়াছিল, এই সমস্ত ডাকাইতির অধিকাংশ ঐ সকল ব্যক্তিগণের দ্বারা হইতেছে; কিন্তু উহারা যে কাহারা, তাহার কিছুমাত্রই কোন নথীতে প্রকাশ নাই। উহারা যে কাহারা, তাহা কি উপায়ে স্থির করিতে সমর্থ হইব, মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিতেছি, এরূপ সময়ে সেই দারোগা আরও তিনটি মোকদ্দমার নথি আনিয়া আমার নিকট উপস্থিত করিলেন। ঐ সকল নথী কিছু পূর্ব্বেই তাঁহার হস্তগত হইয়াছিল। আমি ঐ নথী তিনটি উত্তমরূপে পাঠ করিলাম। উহার একটি নথী হইতে অবগত হইতে পারিলাম যে, যে সময় যে গ্রামে ঐ ডাকাইতি হইয়াছিল, সেই সময় সেই গ্রামে, সেই স্থানের দারোগা উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু যে বাড়ীতে ডাকাইতি হয়, তিনি সেই বাড়ীতে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই ডাকাইতগণ তাহাদিগের কার্য্য শেষ করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করে। দারোগাও সর্ব্বপ্রথমে অপর অনুসন্ধান হইতে বিরত হইয়া যে দিকে ডাকাইতগণ প্রস্তান করিয়াছিল, সেই দিকে গমন করিতে করিতে একটি রেলওয়ে ষ্টেসনে আসিয়া উপস্থিত হন, তিনি ষ্টেসনে আসিয়া উপস্থিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে ষ্টেসন হইতে গাড়ি ছাড়িয়া দেয়, সুতরাং ঐ গাড়ীতে যাহারা প্রস্থান করে, তাহাদিগকে তিনি দেখিতে পান না। দারোগাও যে সময় সেই ষ্টেসনে আসিয়া উপস্থিত হন, সেই সময় দ্রুতপদে আর এক ব্যক্তিও আসিয়া সেই ষ্টেসনে উপস্থিত হয়; ঐ ব্যক্তিও গাড়ীতে আরোহণ করিতে সমর্থ হয় না। ঐ ব্যক্তির উপর দারোগা সাহেবের একটু সন্দেহ হয়, ও তাহার সহিত যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, দারোগা সাহেব তাহার মধ্যে অনুসন্ধান করিয়া দেখেন। উহাতে পুলিসের একটি কোট ও একটি লাল পাগড়ি দেখিতে পান, কিন্তু চাপরাস দেখিতে না পাইয়া তাঁহার মনে কেমন একটু সন্দেহ হয়, তখন তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করেন,—“তুমি কে?”
আগন্তুক। আমি পুলিসের সিপাহি।
দারোগা। কোন থানার সিপাহি?
আগন্তুক। বাঙ্গালা দেশের মধ্যে কোন এক থানায় আমি কৰ্ম্ম করিয়া থাকি।
দারোগা। এখানে তুমি কোথায় আসিয়াছিলে?
আগন্তুক। আমি এখানে কোন স্থানে আসি নাই।
দারোগা। আস নাই কিরূপ, এইতো তুমি এখানে উপস্থিত আছ।
আগন্তুক। আমি দেশে গিয়াছিলাম, এখন আপন কার্য্যে যাইতেছি।
দারোগা। তোমার দেশ কোথায়?
আগন্তুক। কাণপুর জেলার মধ্যে কোন এক স্থানে।
দারোগা। তাহা হইলে তুমি এখানে আসিলে কি প্রকারে?
আগন্তুক। এই ষ্টেসনের পূর্ব্বে যে ষ্টেসন আছে, সেই ষ্টেসনে আমাদিগের দেশের একটি লোক কার্য্য করিত, তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে আমি সেই ষ্টেসনে আসিয়া অবতরণ করি, কিন্তু সেইস্থানে আসিয়া জানিতে পারি যে, সেই ব্যক্তি তাহার কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে; সুতরাং সেইস্থানে আমি আর অপেক্ষা না করিয়া এক ষ্টেসন হাঁটিয়া আসি। এখানে আসিয়া উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই রেলের গাড়ী ছাড়িয়া যায় বলিয়া, আমি আর তাহাতে উঠিতে পারি নাই।
দারোগা। তুমি ছুটীতে দেশে গিয়াছিলে, কিন্তু সরকারি কাপড় সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলে কেন? আর তোমার চাপরাসই বা কোথায়?
আগন্তুক। ছুটী লইয়া আসিবার সময় আমি আমার চাপরাস পোষাক জমা করিয়া আসিয়াছিলাম, কিন্তু একটি কোট ও পাগড়ি আমার অধিক ছিল, কারণ উহা খরিদ করিবার দাম আমাকে দিতে হইয়াছিল বলিয়া, আমি আর উহা জমা করিয়া দিই না, সঙ্গে করিয়া দেশে লইয়া গিয়াছিলাম, ও ফিরিয়া আসিবার সময় সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিতেছি।
দারোগা। আচ্ছা, তুমি এইস্থানে একটু অপেক্ষা কর, তোমাকে আরও দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিবার আমার প্রয়োজন আছে। আমি ষ্টেসন-মাষ্টার বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া এখনই আসিতেছি।
এই বলিয়া দারোগা সাহেব ঐ ব্যক্তিকে সেইস্থানে রাখিয়া ষ্টেসনমাষ্টার বাবুর নিকট গমন করিলেন, কারণ ঐ ব্যক্তির কথা শুনিয়া তাঁহার মনে কতকটা বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, সে যাহা বলিতেছে, তাহা প্রকৃত হইতে পারে। কিন্তু তাহার সহিত কথা কহিয়া সময় নষ্ট করা যুক্তিসঙ্গত নহে; কারণ, সেই ট্রেণে কোন অপরিচিত লোক গমন করিয়াছে, এই সংবাদ যদি ষ্টেসন মাষ্টারের নিকট হইতে অবগত হইতে পারেন, তাহা হইলে তাহাদিগের সম্বন্ধে অনুসন্ধানের চেষ্টা হইতে পারে। আর যদি কোন নূতন কথা অবগত হইতে না পারেন, তাহা হইলে পুনরায় আসিয়া তিনি ঐ ব্যক্তিকে আরও উত্তমরূপে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিবেন যে, তাহার উপর কোনরূপ সন্দেহ হইতে পারে কি না। সেই ষ্টেসনের ষ্টেসনমাষ্টার একজন বঙ্গদেশীয় লোক ছিলেন। দারোগা সাহেব তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “অল্পক্ষণ পূৰ্ব্বে যে ট্রেণখানি পূৰ্ব্বদিকে গমন করিল, তাহাতে এইস্থান হইতে কোন লোক গমন করিয়াছে কি?
ষ্টেসনমাষ্টার। হাঁ, কয়েকখানি টিকিট বিক্রয় হইয়াছে।
দারোগা। কতগুলি টিকিট?
ষ্টেসনমাষ্টার। অধিক নহে, বোধ হয় দশ বার খানি হইবে।
দারোগা। সমস্ত লোকগুলিই কি একস্থানে গমন করিবার নিমিত্ত একই ষ্টেসনের টিকিট খরিদ করিয়াছে?
ষ্টেসনমাষ্টার। না, পাঁচখানি এক ষ্টেসনের ও সাতখানি আর এক ষ্টেসনের।
দারোগা। আপনার মনে হয়, উহারা কি প্রকারের ও কোন দেশীয় লোক?
ষ্টেসনমাষ্টার। উহারা সমস্তই সরকারী লোক।
দারোগা। সরকারী লোক কিরূপ?
ষ্টেসনমাষ্টার। উহারা সকলেই পুলিসের কনষ্টেবল।
দারোগা। আপনি কিরূপে অবগত হইতে পারিলেন যে, উহারা পুলিসের কর্মচারী?
ষ্টেসনমাষ্টার। আমার যতদুর মনে হইতেছে, তাহাতে উহাদিগের সকলেরই পুলিসের পোষাক পরিহিত ছিল।
দারোগা। কিরূপ পোষাক?
ষ্টেসনমাষ্টার। লাল পাগড়ি সকলের মস্তকেই দেখিয়াছি, ও অঙ্গেও পুলিসের কোট আছে।
দারোগা। আচ্ছা, আমি আপনাকে একটি লোককে দেখাইতেছি। উহা দেখিলেই আপনি বেশ বুঝিতে পারিবেন যে, তাহাদিগের পোষাকও এইরূপ ছিল কি না।
এই বলিয়া দারোগা সাহেব, পুলিসের পোষাক পরিহিত যে লোকটিকে পূর্ব্বে দেখিয়া আসিয়াছিলেন, তাহাকে ষ্টেসনমাষ্টারের নিকট আনিবার নিমিত্ত বাহিরে গমন করিলেন, কিন্তু তাহাকে আর দেখিতে পাইলেন না। চারিদিকে তাহার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু কেহই বলিতে পারিল না যে, সেই ব্যক্তি কোথায় গমন করিয়াছে। যাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, সেই কহিল, পুলিসের পোষাক পরিধেয় কোন ব্যক্তিকে সেই সময় গমন করিতে কেহ দেখে নাই; কিন্তু কিছু পূর্ব্বে পুলিসের পোষাকধারী একজন লোককে ষ্টেসনের দিকে গমন করিতে দেখিয়াছিল বটে, কিন্তু সে যে কোথায় গিয়াছে, তাহা তাহারা কেহই বলিতে পারিল না।
এই অবস্থা দেখিয়া ও অপরের নিকট শুনিয়া দারোগা সাহেবের মনে নানারূপ সন্দেহ হইল, তখন তিনি মনে করিলেন, ঐ সকল ব্যক্তিগণই হয়তো পুলিসের পোষাক পরিধান করিয়া ডাকাইতি করিয়াছে, ও সেইস্থান হইতে সেইরূপ বেশেই প্রস্থান করিয়াছে। যে ব্যক্তির সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, সেও সেই দলের একজন। দারোগা সাহেব ষ্টেসন মাষ্টারের নিকট গমন করিবার পর, সে তাহার পরিহিত যে পুলিসের পোষাক আপন অঙ্গ হইতে উন্মোচন করিয়া কোন দিকে প্রস্থান করিয়াছে বলিয়াই, তাহার দিকে কাহার দৃষ্টি আকর্ষিত হয় নাই।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া দারোগা সাহেব পুনরায় স্টেসন মাষ্টারের নিকট গমন করিলেন ও তাঁহার সহিত পরামর্শ করিয়া তাহার পরই যে ষ্টেসনে ঐ গাড়ী পৌঁছিতে পারে সেই ষ্টেসনের পুলিসের নিকট টেলিগ্রাম করিলেন ও ষ্টেসনে ঐ সকল লোক অবতরণ করিবে, তাহাতেও টেলিগ্রাম যোগে ঐ সংবাদ প্রেরণ করিলেন। পূর্ব্বোক্ত ষ্টেসন হইতে অতি অল্পক্ষণ পরেই সংবাদ আসিল যে, রেলওয়ে পুলিস সমস্ত ট্রেণের লোকগুলিকে দেখিল, কিন্তু তাহার মধ্যে কোন পুলিস কর্ম্মচারীকে তাহারা দেখিতে পায় নাই। যে যে ষ্টেসনে অবতরণ করিবার নিমিত্ত ঐ সমস্ত লোক টিকিট খরিদ করিয়াছিল, সেইস্থান হইতেও পরিশেষে এই সংবাদ আসিয়াছিল যে ঐ সকল ষ্টেসনে ঐরূপ কোন লোক ঐ গাড়ি হইতে অবতরণ করে নাই।
দারোগা সাহেব ষ্টেসন হইতে পরিশেষে যেস্থানে ডাকাইতি হইয়াছিল, সেইস্থানে গমন করিয়া ঐ ডাকাইতির বিষয় অনুসন্ধান করিবার কালীন জানিতে পারিয়াছিলেন যে, যে সকল ব্যক্তির দ্বারা ঐ ডাকাইতি হয়, তাহাদিগের সমস্ত লোকের মস্তকেই লাল পাগড়ি ছিল, কিন্তু পুলিসের পোষাক কাহার পরিধানে ছিল, একথা কেহই বলিয়া উঠিতে পারিল না।
এই মোকদ্দমার নথি পড়িয়া আমার কতকটা অনুমান হইল যে, পূর্ব্বে থানায় ডাকাইতি করিয়া ডাকাইতগণ যে সকল সরকারী পোষাক অপহরণ করিয়াছে, অপর স্থানে ডাকাইতি করিয়া প্রস্থান করিবার পর তাহারা সেই সকল পোষাক পরিধান করিয়া গমন করিয়া থাকে; কারণ, পুলিসের পোষাক পরিধান করিয়া গমন করিতে দেখিলে কাহার মনে কোনরূপই সন্দেহ হইবার সম্ভাবনা থাকে না, যে উহারা ডাকাইত।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
সমস্ত নথীগুলি পাঠ করিয়া আমার মনে যে ভাবের উদয় হইয়াছিল, তাহা অপরাপর কর্মচারীগণকে কহিলাম, দেখিলাম, তাঁহারাও আমার মতের অনুমোদন করিলেন।
এই সময় আর একটি মোকদ্দমার নথী আসিয়া উপস্থিত হইল। এই ডাকাইতি অতি অল্পদিবস হইল, ২৪ পরগণার মধ্যে একটি স্থানে ঘটিয়াছিল। যে স্থানে ঐ ডাকাইতি হয়, তাহার সন্নিকটে কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে একজন বাঙ্গালী এসিসটেন্ট-সুপারিন্টেডেন্ট গমন করিয়াছিলেন, এই ডাকাইতি সংবাদ পাইয়া তিনি নিজেই গিয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন, ও নিজে সদাসৰ্ব্বদা উপস্থিত থাকিয়া অনুসন্ধানকারী পুলিসকর্ম্মচারীকে পরামর্শ প্রদান করেন। কাগজ কলমে না থাকিলেও প্রকারান্তরে তিনি নিজেই ঐ মোকদ্দমার অনুসন্ধান করেন। যে এসিসষ্টেন্ট-সুপারিন্টেন্ডেন্ট এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছিলেন, তিনি এখন পর্য্যন্ত বর্ত্তমান আছেন। ইনি এই পুলিস-বিভাগে প্রথম সামান্য কনষ্টেবল পদে নিযুক্ত হন, ও পরিশেষে তাঁহার পদোন্নতি হইয়া তিনি রাইটার কনষ্টেবল পদ প্রাপ্ত হন। ঐ পদ হইতে ক্রমে হেড কনষ্টেবল, সবইনস্পেক্টার, ইনস্পেক্টার, এসিসটেন্ট-সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও পরিশেষে সুপারিন্টেন্ডেন্টের উচ্চপদ পৰ্য্যন্ত প্রাপ্ত হন। পুলিসবিভাগে ইহার নাম যথেষ্ট আছে, ও কিরূপে মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে হয়, তাহা ইনি বেশ জানিতেন।
ঐ মোকদ্দমার ডাইরির একস্থানে দেখিতে পাইলাম, “যদিচ স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না, তথাপি গ্রামস্থ অনেক ভদ্রলোকের মনে ও আমাদিগের মনে বেশ সন্দেহ হইয়াছিল যে, ঐ গ্রামেই ভোলাই সেখ এই ডাকাইতির বিষয় কিছু না কিছু অবগত আছে। ডাকাইতদলের সহিত সে নিজে মিলিত থাকিয়া ডাকাইতি না করিলেও তাহারই সংবাদ অনুসারে যে এই ডাকাইতি হইয়াছে, ইহা বেশ অনুমান করিতে পারা যায়; কিন্তু প্রমাণ পাইবার এ পর্যন্ত কোনরূপ উপায় হয় নাই। কেবলমাত্র ঐরূপ সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া তাহার বাড়ীতেও খানাতল্লাসী করা হইয়াছিল, কিন্তু সন্দেহসূচক কোন দ্রব্য পাওয়া যায় নাই। একস্থানে এক টুকরা পোড়া কাগজ পড়িয়াছিল, উহা হাতে করিয়া উঠাইবার কোনরূপ উপায় ছিল না, হাতে করিলেই উহা চূর্ণ হইয়া যাইবে বলিয়া প্রথমতঃ উহা উঠাইবার কোনরূপ চেষ্টা না করিয়া, উহাতে যদি কিছু লেখা থাকে, প্রথমতঃ তাহাই পড়িবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু পাঠে কোন কথা বুঝিতে পারিলাম না। একপ্রান্ত দেখিয়া বোধ হইল, যেন ঐ স্থানে লেখা ছিল-
“ঘিরপাড়া জানের বাড়ী”
এই কয়টি কথা ভিন্ন আর কোন কথা আমরা বুঝিতে না পারিয়া, তাহার পর উহা হস্তে করিয়া উঠাইলাম, হস্তে উঠাইতে উঠাইতেই উহা চূর্ণ হইয়া আমাদিগের হাতেই কালি লাগিয়া গেল। যে সময় ঐ দগ্ধ কাগজখানি আমরা প্রথম দেখিতে পাই, অনুমান হয়, উহা তাহার অল্পক্ষণ পূর্ব্বেই পোড়াইয়া ফেলা হইয়াছে। ঐ কাগজখানির কথা ভোলাই সেখকে জিজ্ঞাসা করিলে সে কহিল, উহা যে কি কাগজ ছিল ও কেই বা উহা পুড়াইয়াছে, তাহা সে অবগত নহে; বোধ হয়, কোন কাগজ বালকেরা পুড়াইয়া খেলা করিয়াছে, কি তামাক খাইবার আগুন করিবার নিমিত্ত কেহ কোন কাগজ জ্বালাইয়া থাকিবে।
সে যাহা হউক, এ সম্বন্ধে আমরা একটু অনুসন্ধানও করিয়াছিলাম, কিন্তু ঘিরপাড়া যে কি, বা কোথায়, জানের বাড়ী শব্দের অর্থ কি, তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারি না। কিন্তু ঐ কাগজের যেরূপ স্থানে এই দুইটিমাত্র লেখা ছিল, তাহার বামপার্শ্বে আরও যেন কিছু লেখা ছিল বলিয়া অনুমান হয়, কিন্তু কথা যে কি, তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি না।
এই শেষ নথীটী পড়িয়াই আমার মনে অতিশয় আনন্দ হইল। কিন্তু আমার মনের ভাব সেই সময় বিশেষরূপ গোপন করিবার চেষ্টা করিলেও তাহা পারিলাম না। যে কর্মচারীগণ সেই সময় সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা সেই সময় আমার মুখের ভাব দেখিয়াই বেশ রুঝিতে পারিলেন, আমার মনে যেন কেমন একরূপ ভাবের উদয় হইয়াছে।
আমিও যেমন আমার মনের ভাব গোপন করিতে পারিলাম না, সেই কর্ম্মচারীগণও সেইরূপ তাঁহাদিগের মনের ভাব গোপন রাখিতে পারিলেন না, আমাকে তাঁহারা জিজ্ঞাসা করিলেন।
“এই নথীটী পড়িয়াই আপনার মনে বিশেষরূপ আনন্দ হইয়াছে দেখিতেছি, উহাতে কি এরূপ কোন বিষয় প্রাপ্ত হইয়াছেন যে, যাহাতে আপনি অনুমান করিতেছেন যে এখন আমাদিগের কার্য্য সিদ্ধি হইতে পারিবে?
আমি। কেন, আপনি কিরূপে এরূপ অনুমান করিতেছেন!
কর্ম্মচারী। আপনার মুখ দেখিয়া।
আমি। আমাকে তো আপনি বরাবরই দেখিতেছেন, এখন এরূপ কি দেখিলেন যে, যাহাতে আপনি বুঝিতে পারিলেন আমাদিগের কার্য্য সিদ্ধি হইবে।
কর্ম্মচারী। আপনি বলুন আর নাই বলুন, কিন্তু আমি বলিতে পারি, আপনি এমন কোন কথা এই নথির ভিতর পাইয়াছেন, যাহাতে আপনি বেশ বুঝিতে পারিয়াছেন যে এত দিবস পরে আমাদিগের এত পরিশ্রম ও চেষ্টার কতক পরিমাণে লাঘব হইবে।
আমি। আপনার অনুমান সম্পূর্ণ সত্য না হইলেও ইহার ভিতর কিছু সত্য আছে।
কর্ম্মচারী। কিরূপ!
আমি। আমার মনে একটি ভাবের উদয় হইয়াছে।
কর্ম্মচারী। কাহারা ডাকাইতি করিতেছে, তাহা কি আপনি কিছু অনুমান করিতে পারিয়াছেন?
আমি। না।
কর্ম্মচারী। তবে কি অনুমান করিয়াছেন?
আমি। ডাকাইতগণ যে বাড়ীতে বাস করে, বা যে বাড়ীর সহিত ঐ ডাকাইতগণের বা ডাকাইত দলপতির কোনরূপ সংশ্রব আছে, তাহা বোধ হয়, কিছু অনুমান করিতে পারিতেছি।
কর্ম্মচারী। সেই স্থান কোথায়? এই কলিকাতার ভিতর বা অপর কোন স্থানে?
আমি। এই কলিকাতার ভিতর বলিয়াই অনুমান হয়।
কর্ম্মচারী। কলিকাতার কোন্ স্থানে?
আমি। তাহাও কি আপনি এখনও জানিতে চাহেন?
কর্ম্মচারী। জানিবার সম্পূর্ণ ইচ্ছা, তবে যদি আপনি বলেন।
আমি। না বলিবার কোন কারণ নাই, কিন্তু আমার অনুমান যে সত্য, তাহাই বা এখন কিরূপে বলিতে পারি?
কর্ম্মচারী। অনুমানের উপরই সকল কার্য্য হইয়া থাকে, ডাকাইতগণ কোন স্থানে বাস করে অনুমান করিতেছেন?
আমি। কলিকাতার মেছুয়াবাজারে তাহাদিগের থাকিবার স্থান বলিয়া আমার অনুমান হয়।
কর্ম্মচারী। নিজ মেছুয়া বাজার?
আমি। মেছুয়া বাজারের সন্নিকটে।
কর্ম্মচারী। মেছয়া বাজারের নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে?
আমি। এখন এ বিষয় লইয়া গোলমাল করিবেন না, আমার বোধ হয়, দীঘির পাড়ায় ঐ সকল ডাকাইতগণের একটি আড্ডা আছে।
কর্ম্মচারী। দীঘির পাড়া শুনিয়াছি একটি বড় স্থান, তাহার মধ্যে কোন্ স্থানে তাহারা থাকে, তাহা আপনি কিরূপে অনুমান করিতেছেন?
আমি। অতিশয় বড় স্থান নহে, উহার মধ্যে যদি তাহারা থাকে, তাহা আমি অনায়াসেই বাহির করিতে পারিব। এতৎব্যতীত বোধ হয়, আমি ইহাও বুঝিতে পারিয়াছি যে, তাহাদিগের কোনবাড়ীর সহিত সংস্রব আছে, বা কোন্ বাড়ীতে তাহাদিগের কাহার গতিবিধি আছে।
কর্ম্মচারী। কাহার বাড়ী?
আমি। তাহাও আপনাকে এখনই বলিতে হইবে? আমি এখন নিশ্চয়রূপে কিছুমাত্র অবগত হইতে পারি নাই, কেবল মনে মনে একটি অনুমান করিতেছি মাত্র। আমার সেই অনুমানের কথা আপনার এখন জানিয়া লাভ কি?
কর্ম্মচারী। লাভ কিছুই নহে, কেবল কৌতূহল নিবারণমাত্র।
আমি। আপনার যদি এতই কৌতূহল জন্মিয়া থাকে, তাহা হইলে বলিতেছি, আপনি আপনার কৌতূহল নিবারণ করুন। আমার বোধ হয়, আলিজান, কি নবিজান, অথবা বিবিজান, কিম্বা এইরূপ কোন লোকের বাড়ী। কিন্তু আমার বিশেষ অনুমান হইতেছে, বিবিজানের বাড়ী; কারণ আমি জানি দীঘির পাড়ায় বিবিজান নাম্নী একটি বাড়ীওয়ালী থাকে, তাহার বাড়ীতে প্রায়ই চোরেরই আড্ডা, কারণ তাহার বাড়ীতে একটি “চণ্ডুর খনচা” আছে। উহাতে যত চোর ডাকাইতগণ আসিয়া চণ্ডু ইত্যাদি খাইয়া থাকে, বিশেষ যত চোর ব্যায়েসের সহিত ঐ বিবিজানের সংস্রব। এই নিমিত্তই আমার অনুমান হইতেছে, ঐ বিবিজানের বাড়ীতে ঐ সকল ডাকাইতগণের কেহ বাস করিয়া থাকে, অথবা ঐ বাড়ীর সহিত তাহাদিগের কোন না কোনরূপ সংস্রব আছে।
কর্ম্মচারী। যে নথী দেখিয়া আপনি এই কথা বলিতেছেন, সেই নথী আমিও উত্তমরূপে পড়িয়া দেখিয়াছি; কিন্তু তাহাতে তো এরূপ কোন কথা লেখা নাই, এরূপ অবস্থায় আপনি উহাদিগের বাসস্থান কোথায় পাইলেন।
আমি। ঐ নথীতে দেখিয়াই আমি ঐ অনুমান করিয়াছি।
কর্ম্মচারী। ঐ নথীর কোথায় কি লেখা আছে?
আমি। কেন আপনি দেখেন নাই যে, যে ব্যক্তি ডাকাইতদিগকে সংবাদ দিয়াছে বলিয়া সন্দেহ হয়, তাহার বাড়ীতে অনুসন্ধান করিবার সময় একখানি দগ্ধ কাগজ পাওয়া যায়। উহাতে যাহা লেখা ছিল, তাহার মধ্যে কেবল
এই মাত্র পড়িতে পারা যায় যে,
“ঘিরপাড়া
জানের বাড়ী”
অর্থাৎ দীঘির পাড় বিবিজানের বাড়ী। ইহাতে আমার অনুমান হইতেছে, যে ডাকাইতগণ ডাকাইতি করিয়াছিল, তাহাদিগকে ঐ ব্যক্তি সংবাদ প্রদান করে; কিন্তু তাহার অংশ বোধ হয় সে প্রাপ্ত হয় নাই বলিয়া ডাকাইতগণ তাহাকে তাহাদিগের ঠিকানা লিখিয়া দেয় যে, সেই স্থানে গমন করিলে, সে তাহার নিয়মিত অংশ প্রাপ্ত হইতে পারিবে। আমার এইরূপ অনুমান হইতেছে।
কর্ম্মচারী। আপনার অনুমান অসঙ্গত নহে, এই বিষয় লইয়া এখন আমাদিগের অনুসন্ধান করিলে হয় না?
আমি। অনুসন্ধান না করিলে চলিবে কি প্রকারে? অনুসন্ধান করিয়া দেখিতেই হইবে।
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
অনুসন্ধানের এই সামান্য সূত্র অবলম্বন করিয়া আমি দীঘির পাড়ে গিয়া উপস্থিত হইলাম। ঐ স্থানে আমার অনেক পরিচিত লোক ছিল, ও বিবিজান বাড়ীওয়ালীও আমাকে জানিত। প্রথমতঃ আমি আমার পরিচিত লোকদিগের দ্বারা সংবাদ গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিলাম যে, বিবিজানের বাড়ীতে আজ কাল কোন অপরিচিত লোক বাস করিতেছে কি না। কিন্তু জানিতে পারিলাম, আজ কাল তাহার বাড়ীতে অপর কোন লোক বাস করে না। পূর্ব্বে তাহার বাড়ীতে অনেক গুলি লোক বাস করিত বটে, কিন্তু আজ কাল সে তাহার বাড়ীতে কাহাকেও থাকিতে দেয় না। কিন্তু তাহার বাড়ীতে আফিমের খন্চা থাকা প্রযুক্ত নানা প্রকার লোক তাহার বাড়ীতে আসিয়া থাকে। যে সকল লোক তাহার বাড়ীতে আগমন করে, তাহাদিগের মধ্যে চোরের সংখ্যাই অধিক। বিবিজান সৰ্ব্বপ্রথমে একজন প্রসিদ্ধ চোরের দ্বারাই প্রতিপালিত হইত ও সেই চোরের সন্নিকটে সদা সর্ব্বদা চোরের যাতায়াত থাকাতে বিবিজান চোরের সংস্রবই সৰ্ব্বদা ভালবাসিত। পূর্ব্বে যে চোরের অন্নে বিবিজান প্রতিপালিতা হইয়াছিল, তাহার লোকান্তর হইলে সে অন্য চোরের আশ্রয় গ্রহণ করে, ও তাহার কারাবাস হইলে সে পুনরায় অপর চোরের ও তাহার অবর্তমানে অপর চোরের অশ্রয় গ্রহণ করিয়া এ পর্য্যন্ত দিন অতিবাহিত করিয়া আসিয়াছে। সে চোরের সংস্রব অতিশয় ভালবাসিয়া থাকে। বিবিজানের চরিত্রই যে কেবল এইরূপ, তাহা নহে; যে হতভাগিনী একবার চোরের সংস্রব করিয়াছে— সে অপরের সংস্রব প্রায়ই চাহে না, কারণ যে সকল ব্যক্তির পয়সায় কিছুমাত্র মায়া নাই, তাহারা অবলীলাক্রমে যেরূপ অর্থব্যয় করিতে পারে, সেরূপ অর্থ অপর আর কেহই ব্যয় করিতে সমর্থ হয় না। এরূপ দেখা গিয়াছে যে, চোর চুরি করিয়া এক রাত্রিতে সহস্র মুদ্রা প্রাপ্ত হইয়াছে, পর দিবস সেই সমস্ত অর্থ সে অনায়াসেই ব্যয় করিয়া ফেলিয়াছে। চোরের হাতে যতক্ষণ অর্থ থাকে, সে ততক্ষণ সেই অর্থ জলের ন্যায় ব্যয় করিতে পারে, অথচ যখন সে কপর্দকশূন্য হয়, তখন সে উপবাস করিয়াও দিনযাপন করে। অর্থাভাবে অতিশয় কষ্ট পাইবার পর তাহার হস্তে আবার যত অর্থ পতিত হয়, কল্য কি হইবে তাহা না ভাবিয়া সেই দিবসই সে সেই অর্থ অনায়াসেই ব্যয় করিয়া ফেলে। যাহারা এরূপ ভাবে অর্থব্যয় করিতে পারে, তাহাদিগের সংস্রবে যে বারবিলাসিনীগণ একবার আসিয়াছে, তাহারা কখনই সেই অর্থের লালসা পরিত্যাগ করিতে পারে না। এই নিমিত্তই বিবিজান সদাসর্ব্বদা চোরের সহিত সংস্রব রাখিয়া থাকে।
বিবিজানকে আমি পূর্ব্ব হইতেই উত্তমরূপে অবগত ছিলাম। আরও জানিতাম, আমরা যাহাদিগের অনুসন্ধান করিতেছি, তাহাদিগের সহিত যদি তাহার কোনরূপ সংস্রব থাকে, তাহা হইলে তাহার নিকট হইতে কোন কথাই আমরা প্রাপ্ত হইব না, অধিকন্তু আমাদিগের কার্য্যের কতকটা অনিষ্ট হইবারই সম্ভাবনা। এদিকে আবার ইহাও অবগত ছিলাম যে, তাহাদিগের সহিত বিবিজানের যদি কোনরূপ সংস্রব না থাকে, তাহা হইলে বিবিজান আমাদিগকে সম্পূর্ণরূপে সাহায্য করিয়া যাহাতে তাহাদিগকে ধরাইয়া দিতে পারে, প্রাণপণে তাহার চেষ্টা করিবে, ও আমাদিগের কার্য্য বিশেষরূপে সম্পন্ন করাইয়া দিবে।
বিবিজানের নিকট আমাদিগের মনের ভাব প্রকাশ করিবার পূর্ব্বে আমাদিগের জানা আবশ্যক যে, আমরা কোন্ সকল ব্যক্তির অনুসন্ধান করিতেছি, এবং ঐ সকল ব্যক্তির সহিত বিবিজানের কোনরূপ সংস্রব আছে কি না। মনে মনে এই সকল বিষয় উত্তমরূপ পর্যালোচনা করিয়া আমরা সেই সময় বিবিজানের নিকট গমন না করিয়া আমার পরিচিত আর একটি লোকের নিকট গমন করিলাম। ঐ ব্যক্তির সহিত চোরদিগের বিশেষ কোনরূপ সংস্রব না থাকিলেও সে বিবিজানের বাড়ীর সন্নিকটে বাস করিত, ও বিবিজানের বাড়ীর যে খচায় চোরগণ আসিত, তাহার অনেক সংবাদ সে রাখিত।
আমি তাহার নিকট গমন করিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, কিন্তু আমাদিগের মনের ভাব তাহার নিকট সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ না করিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, — আজ কাল বিবিজানের সংবাদ কি?
পরিচিত। কিরূপ সংবাদ?
আমি। তাহার চলিতেছে কিরূপে?
পরিচিত। চলিবে আর কি প্রকার? তাহার পূর্ব্বে যেরূপ চলিত, এখনও সেইরূপ চলিতেছে। কখনই ত উহার অর্থের অভাব হয় না।
আমি। কিছু সংস্থান করিতে পারিয়াছে কি?
পরিচিত। সংস্থান এক পয়সারও নাই; যাহা পায়, তাহা খরচ করে, কিন্তু খরচ পত্রের কখনই অনটন হয় না।
আমি। আজকাল উহার খরচপত্রের সংস্থান কে করিতেছে?
পরিচিত। উহাকে কি কখন একব্যক্তি সাহায্য করে, না সে কখন একব্যক্তির সাহায্য গ্রহণ করিয়া থাকে। ও নামে একজন চোরের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া থাকে, কিন্তু কার্য্যে অনেক চোর উহাকে প্রতিপালন করিয়া থাকে।
আমি। পূর্ব্বে ও যে ব্যক্তির আশ্রয়ে থাকিত, সে ব্যক্তি এখন কোথায়?
পরিচিত। সে এখন জেলে, তাহার পর একজন করিয়া কয়েকজনের আশ্রয় গ্রহণ করিল ও এক এক করিয়া কয়েকজন জেলে গেল। এখন সে প্রকাশ্যভাবে কাহার আশ্রয়ে নাই, কিন্তু অপ্রকাশ্যে সে অনেকেরই আশ্রিত।
আমি। আজকাল উহার খন্চায় লোকজনের কিরূপ যাতায়াত আছে?
পরিচিত। বিস্তর লোক আসিয়া থাকে।
আমি। উহাদিগের কাহাকেও আপনি চিনেন কি?
পরিচিত। দুই একজনকে চিনি, উহারা এই মেছুয়াবাজারের পুরাতন পাপী, কিন্তু তদ্ব্যতীত আজকাল আরও অনেক নূতন লোকের আমদানী হইয়া থাকে।
আমি। ঐ সকল নূতন লোক কাহারা?
পরিচিত। তাহাদিগকে চিনি না, দেখিতে পাই মাত্র।
আমি। থাকে কোথায়?
পরিচিত। তাহাও বলিতে পারি না।
আমি। তাহারা কোন্ দেশীয় লোক?
পরিচিত। পশ্চিমদেশীয় লোকই অধিক, বঙ্গদেশীয় লোকও আছে।
আমি। উহারা কি কাজ করিয়া থাকে?
পরিচিত। কাজ আর কি করিবে? চোর ডাকাইত ভিন্ন আর কোন্ ভদ্রলোক খন্চায় চণ্ডু খাইয়া থাকে?
আমি। ডাকাইতগণ ত প্রায়ই চণ্ডু খায় না শুনিতে পাওয়া যায়।
পরিচিত। খায় না, তাহা আমি বলিতে পারি না; তবে অধিক পরিমাণে খায় না, বা রাত্রি দিন চণ্ডুখানায় পড়িয়া থাকে না।
আমি। ঐ সকল ব্যক্তি কোন সময় বিবিজানের বাড়ীতে আসিয়া থাকে?
পরিচিত। দিনমানে প্রায়ই দেখিতে পাই না। উহারা প্রায় রাত্রিতেই ঐ স্থানে আসিয়া থাকে।
আমি। সকল দিন আসিয়া থাকে কি?
পরিচিত। সকল দিন নিয়মিতরূপ দেখিতে পাই না, মধ্যে মধ্যে আসে।
আমি। কোন্ সময় উহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ হইতে পারে?
পরিচিত। সন্ধ্যার পর আসিলে উহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ হইবার খুব সম্ভাবনা।
ঐ পরিচিত ব্যক্তির সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর আমরা সেই সময় সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। ও পরিশেষে সন্ধ্যার সময় আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইলাম। ইতিপূর্ব্বে আমরা যে পরিচিত ব্যক্তির সহিত কথা কহিয়া আসিয়াছিলাম, প্রথমতঃ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। আমাদিগকে দেখিয়াই তিনি কহিলেন, যে সকল ব্যক্তির কথা আমি পূৰ্ব্বে বলিয়াছিলাম, তাহাদিগের মধ্যে দুইজন লোক এখন বিবিজানের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
এই বলিয়া ঐ দুই ব্যক্তিকে তিনি আমাদিগকে দেখাইয়া দিলেন। আমরা তাহাদিগকে উত্তমরূপে দেখিয়া লইলাম। দেখিয়া অনুমান হইল, একজন মুসলমান ও আর একজন হিন্দু। আমরা উহাদিগকে দেখিলাম সত্য, কিন্তু প্রকাশ্যরূপে তাহাদিগকে কোন কথা কহিলাম না, দূরে থাকিয়া তাহাদিগের গতিবিধি লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। যে ব্যক্তি মুসলমান, সেই বোধ হইল দুই এক টান চণ্ডু পান করিল, যে ব্যক্তি হিন্দু, সে উহা পান করিল না; কিন্তু ঐ মুসলমান যতক্ষণ সেইস্থানে রহিল, ঐ হিন্দুও সেই পৰ্য্যন্ত সেইস্থানে রহিল। এইরূপে প্রায় অর্দ্ধঘণ্টাকাল তাহারা সেইস্থানে অতিবাহিত করিয়া বহির্গত হইল। যে সময় তাহারা সেইস্থান হইতে বহির্গত হইল, সেই সময় বিবিজানকে তাহারা তাহাদিগের সম্মুখে দেখিতে পাইয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত কি কথাবার্তা করিয়া পুনরায় সেইস্থান হইতে চলিল। আমরাও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম। তাহারা ক্রমে গমন করিয়া মেছুয়াবাজারের একটি কাফিখানার ভিতর প্রবেশ করিল ও যেস্থানে আরও চারি পাঁচ জন লোক বসিয়াছিল, সেইস্থানে গিয়া তাহাদিগের সন্নিকটে উপবেশন করিল। উহাদিগের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় জাতীয় লোক ছিল, তাহাদিগের মধ্যে কেহ বা কাফি পান করিল, কেহ বা পান না করিয়া নাচওয়ালীর নাচ দেখিতে লাগিল।
যাহার কাফিখানায় উহারা উপবেশন করিয়াছিল, সে আমাকে চিনিত। আমাকে কাফিখানার বাহিরে দেখিতে পাইয়া সে আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল, ও কহিল আপনি এখানে দাঁড়াইয়া কি করিতেছেন?
আমি। তোমারই সহিত সাক্ষাৎ করিব বলিয়া এই স্থানে দাঁড়াইয়া আছি।
কাফিখানার অধিকারী। এখানে কেন? ভিতরে আসুন না।
আমি। না আমি ভিতরে যাইতে চাহি না।
কা-অ। কেন
আমি। আমি যাহাদিগের কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি, তাহারা ভিতরে আছে, আমাকে সেখানে দেখিলে পাছে তাহারা কোনরূপ সন্দেহ করে, এই নিমিত্ত ভিতরে যাইতে চাহি না।
কা-অ। আপনি কাহার কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?
আমি। ঐ যে কয়েকজন একত্রে উপবেশন করিয়া নাচ দেখিতেছে, উহারা কাহারা?
কা-অ। উহারা যে কে, তাহা আমি জানি না, কিন্তু মধ্যে মধ্যে উহারা আমার এখানে আসিয়া থাকে।
আমি। উহাদিগের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় জাতীয় লোক আছে বলিয়া বোধ হয় না?
কা-অ। উভয় জাতিই আছে।
আমি। কাফি কি সকলেই পান করিয়া থাকে?
কা-অ। মুসলমানগণ সকলেই পান করিয়া থাকে, কিন্তু হিন্দুদিগের মধ্যে সকলে পান করে না, কেহ কেহ পান করে।
আমি। উহারা কোথায় থাকে?
কা-অ। তাহা আমি অবগত নহি, কিন্তু প্রয়োজন হয় তো তাহা আমি জানিয়া বলিয়া দিতে পারি।
আমি। কোথায় যে উহারা থাকে, তাহা আমাকে কেবল বলিয়া দিলে হইবে না, উহাদিগের নাম কি? ও উহারা কি কার্য্য করে, তাহাও আমি জানিতে চাহি।
কা-অ। কেন ইহাদিগের সমস্ত বিষয় অবগত হইবার প্রয়োজন?
আমি। আমি উহাদিগের কাহাকেও চিনি না, নূতন লোক বলিয়া বোধ হইতেছে; অথচ উহাদিগের চাল-চলন আমার নিকট ভাল বোধ হইতেছে না। এই নিমিত্তই উহারা যে কে, তাহা জানিবার নিমিত্ত ইচ্ছা করিতেছি।
কা-অ। আপনি এখানে দাঁড়াইবেন না, একটু দূরে গিয়া অপেক্ষা করুন। আমি যতদূর পারি, উহাদিগের বিষয় অবগত হইয়া আপনাকে বলিয়া দিতেছি।
গিয়া এই বলিয়া সেই কাফিখানার অধিকারী তাহার কাফিখানার ভিতর প্রবেশ করিল, আমরাও একটু দূরে তাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টা পরে, সে পুনরায় আমাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল,
“আমি সকলের নাম অবগত হইতে পারি নাই, দুই তিন জনের নাম অবগত হইতে পারিয়াছি। উহারা ভাল লোক বলিয়া আমার অনুমান হয় না, কিন্তু কলিকাতায় উহাদিগের একটি না একটি কার্য্য আছে, সেই সকল কাৰ্য্য উহারা অবলম্বন করিয়া আছে বটে, কিন্তু তাহা উহাদিগের জীবিকা নহে, উহা লোক দেখান ব্যবসা। আমার বোধ হয় উহারা সকলগুলিই চোর, চুরিই উহাদিগের প্রকৃত ব্যবসা।”
আমি। তাহাতো হইল, কিন্তু উহারা যে কোথায় থাকে, তাহা কিরূপে জানিতে পারিব?
কা-অ। তাহার উপায় আছে। আমার কাফিখানায় দুইটি বালক আছে। তাহারা উহাদিগের কাহার কাহার বাড়ী চিনে। মধ্যে মধ্যে ঐ বালক দুইটি উহাদিগের বাড়ীতে উহাদিগের সহিত গমন করিয়াও থাকে।
কাফিখানার অধিকারীর নিকট হইতে ইহা অবগত হইয়া আমরাও সেই অন্ধকারের ভিতরে আপনাদিগকে লুক্কায়িত করিয়া অপর আর একটি দরজা দিয়া সেই কাফিখানার মধ্যে প্রবিষ্ট হইলাম ও যেস্থানে তাহারা উপবেশন করিয়াছিল, তাহার সন্নিকটবর্ত্তী আর একস্থানে আমরা উপবেশন করিয়া। উহাদিগকে উত্তমরূপে দেখিলাম, ঐ বালক দুইটি যাহার যাহার বাসস্থান চিনে, তাহাদিগকেও উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিয়া আমরাও সেইস্থানে বসিয়া রহিলাম। আমরা সেই সময় তিন জন ছিলাম। আমাদিগের লক্ষ্য তিন জনের উপর রহিল; অর্থাৎ যাহাদিগের বাড়ী বালকদ্বয় অবগত ছিল না, তাহাদিগের মধ্যে হইতে তিন জনের উপর লক্ষ্য রাখিয়া আমরা সেইস্থানে উপবেশন করিয়া রহিলাম। আমাদিগের ইচ্ছা, ঐ তিন ব্যক্তির পশ্চাৎ পশ্চাৎ আমরা গমন করিয়া তাহারা কোথায় কোথায় গমন করে, তাহা দেখিব ও তাহাদিগের বাসস্থান দেখিয়া লইব। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া আমরা সেইস্থানে কিয়ৎক্ষণ উপবেশন করিবার পর, তাহারা একত্রে গাত্রোত্থান করিল, কিন্তু কাফিখানার বাহিরে আসিয়াই ক্রমে তাহারা পৃথক পৃথক হইয়া পড়িল। আমরাও আমাদিগের পরামর্শ মত তাহাদিগের অনুগমন করিতে আরম্ভ করিলাম।
আমি যাহার অনুগমন করিতেছিলাম, সে একটি মুসলমান। তাহার পরিধানে পাজামা ও একটি কাল কোট ছিল। মস্তকে একটি সাদা রঙ্গের গোল টুপি ছিল, এবং তাহার হস্তে একখানি গামছায় জড়ান একটি পুটুলি ছিল। ঐ ব্যক্তির পরিধানে যেরূপ পোষাক পরিহিত ছিল, তাহাতে তাহার উপর লক্ষ্য রাখিয়া তাহার অনুগমন করা নিতান্ত সহজ; সুতরাং আমি দূরে থাকিয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম। সহরের ভিতর নানা স্থানের নানা রাস্তা অবলম্বন করিয়া সে চলিতে লাগিল। এইরূপে কিছুদূর গমন করিবার পর, সে একটি মদ্য-বিক্রেতার দোকানের ভিতর প্রবেশ করিল। আমি ঐ দোকানের বাহিরে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে দেখিলাম, একটি লোক ঐ দোকানের ভিতর হইতে বাহিরে আসিল। উহার আকৃতি, আমি যাহার অনুসরণ করিতেছিলাম, ঠিক তাহার ন্যায়; কিন্তু তাহার পরিধানে যেরূপ পাজামা ছিল, সেইরূপ পাজামা থাকিলেও তাহার অঙ্গে যেরূপ কাল কোট ছিল, সেইরূপ কোট নাই। তাহার পরিবর্ত্তে একটি সবুজ রঙ্গের চাকপান, ও মস্তকে সাদা টুপির পরিবর্তে একটি লাল রঙ্গের পাগড়ি। হস্তে গামছায় বাঁধা সেই গাী নাই। এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনে হঠাৎ কেমন একরূপ সন্দেহ হইল, আমি ঐ শুঁড়িখানার ভিতর প্রবেশ করিলাম, আমি যাহার অনুগমন করিতেছিলাম, তাহাকে সেইস্থানে আর দেখিতে পাইলাম না। তখন আমার বেশ অনুমান হইল যে, আমি যাহার অনুসরণ করিতেছিলাম, সে তাহার বেশ পরিবর্ত্তন করিয়া ঐ স্থান হইতে বহির্গত হইয়াছে। আরও মনে হইল, ঐ ব্যক্তি কি আমাকে চিনিতে পারিয়াছে, ও আমি যে তাহার অনুসরণ করিতেছি, তাহাও কি সে অবগত হইতে পারিয়াছে? নতুবা হঠাৎ সে বেশ পরিবর্তন করিয়া গমন করিল কেন? মনে মনে এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে আমি দ্রুতপদে তাহার সন্নিকটবর্তী হইলাম, ও তাহার অনুসরণ করিয়া চলিতে লাগিলাম। ক্রমে সে সহর পরিত্যাগ করিয়া সহরতলীর ভিতর প্রবেশ করিল। সহরতলীর ভিতর তাহাকে গমন করিতে দেখিয়া আমার বেশ অনুমান হইল যে, সহরতলীর মধ্যে কোন না কোন স্থানে সে বাস করিয়া থাকে। কিন্তু পরে জানিতে পারিলাম, আমি যাহা অনুমান করিয়াছিলাম, সেই অনুমান প্রকৃত নহে। সেই ব্যক্তি ক্রমে গমন করিয়া একটি পাড়ার ভিতর প্রবশ করিল। ঐ স্থানে একটি পাকা বাড়ী ছিল, ক্রমে তাহার সন্নিকটে গিয়া সে উপস্থিত হইল। সম্মুখে একটি লোককে দেখিতে পাইয়া তাহাকে সে জিজ্ঞাসা করিল, “সীতারাম বাড়ীতে আছে?” উত্তরে সে কহিল, “আছে”। তখন সে সীতারামকে ডাকিয়া দিতে কহিল। ঐ ব্যক্তি বাড়ীর ভিতর গমন করিল, কিছুক্ষণ পরে একব্যক্তি ঐ বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া, আমি যাহার অনুসরণ করিতেছিলাম, তাহার সন্নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইল; ও দুই জনে দুই চারিটি কথা হইবার পরই, ঐ ব্যক্তি পুনরায় সেইস্থান হইতে প্রত্যাবৰ্ত্তন করিল। তাহাদিগের মধ্যে যে কি কথা হইল, তাহার কিছুই আমি শুনিতে পাইলাম না। ঐ ব্যক্তি যেমন পশ্চাৎপদ হইয়া অতি অল্পমাত্র গমন করিল, অমনি সেই ব্যক্তি অর্থাৎ যে ব্যক্তি বাড়ীর ভিতর হইতে বাহিরে আসিয়াছিল, সে পুনরায় ডাকিল “ওমরাও”। এই কথা শুনিয়া আমি যাহার অনুসরণ করিতেছিলাম, সে পুনরায় প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া ঐ ব্যক্তির নিকট গমন করিল। দুই জনে পুনরায় আস্তে আস্তে দুই চারিটি কথা কহিয়া পুনরায় প্রত্যাবর্তন করল। অপর ব্যক্তিও তাহার বাড়ীর ভিতর গমন করিল।
উহাদিগের কথা যতটুকু আমার কর্ণগোচর হইল, তাহাতে কেবলমাত্র আমার এই অনুমান হইল যে, যে ব্যক্তি বাড়ীর ভিতর হইতে বহির্গত হইয়া আসিয়াছিল, তাহার নাম সীতারাম; এবং আমি যে ব্যক্তির অনুসরণ করিতেছিলাম, তাহার নাম ওমরাও। আরও বুঝিতে পারিলাম, যে বাড়ী হইতে সীতারাম বহির্গত হইয়া আসিল, ঐ বাড়ীতেই সীতারাম বাস করিয়া থাকে।
আমি ওমরাও নামক ব্যক্তির অনুসরণ করিতেছিলাম, সে সহরতলী হইতে বহির্গত হইয়া পুনরায় সহরের মধ্যে প্রবেশ করিল, ও পুনরায় মেছুয়াবাজারে আসিয়া উপস্থিত হইল। দিঘিরপাড়ার অতি সন্নিকটে কলাবাগান নামক একটি স্থান আছে। ক্রমে সে সেইস্থানে আসিয়া একটি বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইল, কিন্তু অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত আর বহির্গত হইল না। অনুমান হইল, ঐ বাড়ীতেই সে বাস করিয়া থাকে। আমি অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাহার নিকটবর্ত্তী স্থানে অপেক্ষা করিয়া আপনার বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। আমি যখন সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম, তখন রাত্রি প্রায় ১টা হইয়াছিল।
অপরাপর কর্ম্মচারীগণ যাঁহারা অপরাপর লোকের অনুসরণ করিয়াছিলেন, পর দিবস প্রত্যূষে তাঁহাদিগের সকলেরই সহিত সাক্ষাৎ হইল; তাঁহারা সকলেই কহিলেন যে, তাঁহারা কেহই কাহার সম্পূর্ণরূপে অনুগমন করিতে সমর্থ হন নাই। রাস্তা হইতে সকলেই তাঁহাদিগের নয়নের অন্তরালে গিয়া পড়িয়াছিল। সুতরাং তাহরা যে কে, এবং কোথায়ই বা তাহাদের বাসস্থান, তাহার কেহই কিছুমাত্র অবগত হইতে সমর্থ হন নাই।
পরিশেষে নানারূপ অনুসন্ধানের পর আমরা কলাবাগান নামক পূৰ্ব্ব কথিত স্থানে আগমন করিলাম। পাঠকগণ অবগত আছেন, ঐ স্থানের একটি বাড়ীতে ওমরাও খাঁ প্রবেশ করিয়াছিলেন ও সেইস্থান হইতে তিনি আমার সম্মুখে আর বহির্গত হন না। আমি সেইস্থানে আসিয়া ওমরাও খাঁ সম্বন্ধে একটু গুপ্ত অনুসন্ধান করিলাম। জানিতে পারিলাম,
ঐ বাড়ীতেই তাহার বর্ত্তমান বাসস্থান। আরও অবগত হইতে পারিলাম যে, যে বাড়ীতে ওমরাও খাঁ বাস করে, সেই বাড়ীতে আরও কয়েকজন চোর ও বদমায়েসের বাসস্থান; তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই আমার নিকট পরিচিত। এই অবস্থা অবগত হইতে পারিয়া আমি আর সেইস্থানে গমন করিলাম না, কারণ আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। মনে করিলাম, যে বাড়ীতে চোর বদমায়েসগণের বাসস্থান, সেই বাড়ীতে ভাল লোক কখনই বাস করিতে সমর্থ হন না। ওমরাও যদি ভাল বা সম্ভ্রান্ত লোক হইবে, তাহা হইলে সে ঐ স্থানে বাস করিবে কেন? এদিকে ওমরাও যদি ঐ শ্রেণীর লোক হইবে, তাহা হইলেই বা সীতারামের ন্যায় জমীদার ও ভদ্রলোকের সহিত তাহার সংস্রবই বা থাকিবে কেন? যদি ওমরাও মন্দ লোক হয়, ও যদি সীতারামের সহিত তাহার প্রকৃতই মেশামেশি থাকে, তাহা হইলে হয় ওমরাও ভাল লোক, না হয় সীতারাম মন্দ লোক হইবে। আমি মনে মনে এইরূপ ভাবিলাম সত্য, কিন্তু কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
আমি যে পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণের সাহায্য করিতেছিলাম, তাঁহাদিগের সহিত পরামর্শ করিয়া পরিশেষে ইহাই স্থির করিলাম যে, তাঁহাদিগের মধ্যে যিনি সর্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারী, তিনি ও আমি একত্রে থাকিয়া ওমরাও নামক ব্যক্তির সর্ব্বদা অনুসরণ করিব। তাহা হইলেই আমরা অনেকটা অবগত হইতে পারিব যে, সে কে, কোথায় সে সৰ্ব্বদা গতিবিধি করিয়া থাকে, কোন্ কোন্ লোকের সহিত তাহার আলাপ পরিচয় ও মিশামিশি। এই সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে অবগত হইতে পারিলে আমরা বেশ জানিতে পারিব যে, যে সকল ডাকাইতি হইয়াছে, তাহার সহিত ওমরাও’র কোনরূপ সংস্রব আছে কি না?
এইরূপ পরামর্শ করিয়া আমরা উভয়েই প্রস্তুত হইলাম, অর্থাৎ আমাদিগের সাইত এরূপ পরিমাণে অর্থ সৰ্ব্বদাই রাখিতাম যে, যখন যেস্থানে গমন করিতে হইবে, বা যখন যে অর্থের প্রয়োজন হইবে, তাহা আমরা অনায়াসেই দিতে পারিব। তদ্ব্যতীত আমরা যদি কোনরূপ বিপদগ্রস্ত হই, তাহা হইলে যাহাতে উহা তৎক্ষণাৎ দূর করিতে পারি, তজ্জন্য একটি একটি ছয় নলা পিস্তল ও তদুপযুক্ত কারটিজ আমাদিগের সঙ্গে রাখিয়া আমরা ওমরাও’র অনুসরণ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। আর যে কয়েকজন কর্ম্মচারী আমাদিগের সহিত ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ আমাদিগের ন্যায় সীতারামের গতিবিধি দেখিতে প্রবৃত্ত হইলেন। অবশিষ্ট যাঁহারা থাকিলেন, তাহাদিগের কার্য্য রহিল বিবিজানের বাড়ীর উপর উত্তমরূপে দৃষ্টি রাখা, ও যে সকল ব্যক্তির অনুসরণ করিতে গিয়া তাঁহারা বিফল- মনোরথ হইয়া প্রত্যাবর্তন করেন, ঐ সকল লোককে যদি তাঁহারা পুনরায় বিবিজানের বাড়ীতে দেখিতে পান, ও যাহাদিগের বাড়ী পূৰ্ব্ব-কথিত বালকদ্বয় দেখাইয়া দিতে পারিবে, তাহাদিগের অনুসরণ করিয়া যাহাতে তাহাদিগের গতিবিধির স্থান প্রভৃতি দেখিয়া লইতে পারেন, তাহার চেষ্টা করা।
এইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া আমরা কার্য্য-ক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইলাম। ওমরাও যে বাড়ীতে থাকিত, সেই বাড়ীর সন্নিকটে আমরা একখানি ঘর ভাড়া করিয়া সেইস্থানে অবস্থিতি করিতে লাগিলাম। আমরা যে ঘরে থাকিতাম, ঐ ঘরটী এরূপ স্থানে ছিল যে, ওমরাও যে বাড়ীতে বাস করিত, সেই বাড়ী হইতে কোন ব্যক্তি বহির্গত হইলে বা সেই বাড়ীতে কোন ব্যক্তি প্রবেশ করিলে আমরা তাহা বেশ দেখিতে পাইতাম।
ঐ স্থানে আমাদিগকে কেবলমাত্র দুই দিবস ও একরাত্রি বাস করিতে হয়। উহার মধ্যে ওমরাও দুই তিন বার তাহার বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়াছিল, আমরাও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিয়াছিলাম। যাইবার মধ্যে সে এক একবার বিবিজানের বাড়ীতে গিয়া সময় সময় দুই এক টান চণ্ডু খাইত, ও দুই একবার কাফিখানায় গমন করিত, ঐ সকল স্থানে অনেক লোকের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইত ও কথাবাৰ্ত্তাও হইত। এই দুই স্থান ভিন্ন ওমরাও ঐ দুইদিবসের মধ্যে অপর কোন স্থানে গমন করে না। দ্বিতীয় দিবস সন্ধ্যার পর ওমরাও একাকী তাহার বাড়ী হইতে বহির্গত হইল। এবার কিন্তু সে যেরূপ পোষাক পরিচ্ছদ পরিয়া সর্ব্বদা বাহির হইত, সেইরূপ পোষাক তাহার পরিধানে নাই। প্রায় সৰ্ব্বদাই সে পা-জামা চাপকান পরিত, এবার পরিধানে মালকোঁচা মারা একখানি থানের মোটা ধুতি। পায়ে এক জোড়া জুতা, অঙ্গে একটি কোরতা ও মস্তকে একটি সাদা টুপি। হাতে একটি ঝোলা, উহার মধ্যে কোনরূপ কাপড় ইত্যাদি আছে বলিয়া অনুমান হইল। এইরূপ অবস্থায় উহাকে বাড়ী হইতে বহির্গত হইতে দেখিয়া মনে করিলাম, এ কোন দূরবর্তী স্থানে গমন করিতেছে। বলা বাহুল্য আমরা উভয় কৰ্ম্মচারীও দূরে দূরে তাহার অনুগমন করিলাম। ওমরাও পাড়ার ভিতর হইতে বহির্গত হইয়া ক্রমে মেছুয়াবাজারে আসিয়া উপস্থিত হইল। সেইস্থানে একটু দাঁড়াইয়া থাকিবার পরই দেখিলাম, আর দুই জন লোক একখানি গাড়ি করিয়া সেইস্থানে আগমন করিল। উহাদিগের এক জনকে আমি চিনিতে পারিলাম, উহার নাম সীতারাম। তাহার সঙ্গে আর এক ব্যক্তি ছিল, তাহাকে বঙ্গদেশবাসী বলিয়া অনুমান হইল, সেই সময় আমাদিগের যাহা অনুমান হইল, কার্য্যেও ঠিক তাহাই হইয়াছিল। উনি প্রকৃত একজন বাঙ্গালী, ইহা পরে জানিতে পারিয়াছিলাম, উহার নাম গোবিন্দ দাস। উহাদিগকে সেইস্থানে দেখিলাম, কিন্তু অপর কর্মচারীগণের কাহাকেও তাহাদিগের সহিত দেখিতে পাইলাম না। উহাদিগকে দেখিয়াই ওমরাও তাহাদিগের গাড়িতে উঠিল, উহা একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর ভাড়াটীয়া গাড়ি। আমি ঐ গাড়ির নম্বরটি দেখিয়া লইলাম। ওমরাও গাড়িতে উঠিবার পরই গাড়িখানি চলিতে লাগিল। অমরা কিছুদূর দ্রুতপদে গাড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে করিতে একখানি খালি গাড়ি দেখিতে পাইলাম। উহাতে উঠিয়া কোচমানকে পূৰ্ব্বকথিত গাড়িখানি দেখাইয়া দিয়া কহিলাম, ঐ গাড়িখানি যেখানে যাইবে, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ তুমি যাইবে, যে ভাড়া চাহিবে তাহাই আমরা দিব। এই বলিয়া প্রথমে একটি টাকা তাহার হস্তে প্রদান করিলাম। কোচমান গাড়ি লইয়া পূর্ব্বের গাড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। ক্রমে গাড়ি গিয়া হাওড়া পুলের নিকট পৌঁছিল, সেইস্থানে উহারা তাহাদিগের গাড়ি ছাড়িয়া দিয়া সেইস্থান হইতে আর একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহাতে উঠিল। আমরাও আমাদিগের গাড়ি ছাড়িয়া দিয়া দ্রুতগমন করিতে পারে এরূপ আর একখানি গাড়িতে উঠিলাম, এবং পূর্ব্বের ন্যায়, কোচমানকে উপদেশ দিলাম। আমার সহিত যে কর্ম্মচারী ছিলেন, তিনি গাড়ির ভিতর রছিলেন, আমি কোচবাক্সে কোচমানের সহিত উপবেশন করিলাম। নতুবা রাত্রিকালে পূর্ব্বকথিত গাড়িখানি আমাদিগের দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া যাইতে পারে।
ঐ গাড়িখানি ক্রমে বালির ষ্টেসনে গিয়া উপস্থিত হইলে, তাহারা সেইস্থানে অবতরণ করিয়া, একটি দোকানে গিয়া বসিল। সেইস্থানে আরও দুইটি লোক বসিয়াছিল। আমরাও এ দোকানের নিকটবর্ত্তী আর একটি দোকানে গিয়া উপবেশন করিলাম।
ট্রেণ আসিবার সময় একজন ষ্টেসনে গিয়া ৫ খানি টিকিট খরিদ করিল। কিন্তু তাহা এক ষ্টেসনের নহে, ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি ষ্টেসনের। উহারা দূরের যে ষ্টেসনের টিকিট খরিদ করিয়াছিল, আমরা সেই ষ্টেসনের দুইখানি টিকিট খরিদ করিলাম। গাড়ি আসিলে উহারা যে গাড়িতে উঠিল, আমরাও সেই গাড়ির অপর আর একটি প্রকোষ্ঠে উঠিলাম। গাড়ি চলিল। সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। পর দিবস সন্ধ্যার পর উহারা এক ষ্টেসনে অবতরণ করিল। যে ষ্টেসনে উহারা নামিল, সেই ষ্টেসনের টিকিট উহাদিগের কাহারও নিকট ছিল না, কেহ অবশিষ্ট দাম প্রদান করিল, কেহ বা আরও দূরের টিকিট দেখাইয়া ষ্টেসন হইতে বহির্গত হইয়া গেল। আমরাও সেইস্থানে অবতরণ করিলাম। আমরা যে গাড়িতে আসিয়াছিলাম, সেই গাড়িতে উহার ৫ জন ছিল। কিন্তু গাড়ি হইতে নামিবার পর দেখিলাম, উহারা ২৫/৩০ জন হইবে। অপরাপর ব্যক্তিগণ যে কোথা হইতে ঐ গাড়িতে উঠিয়াছিল, তাহা আমরা বলিতে পারি না। কিন্তু সকলে এক স্থানে অবস্থিতি করিল না, কেহ এ দোকানে, কেহ অপর দোকানে এইরূপ ভাবে অবস্থিতি করিতে লাগল, আমরাও একটি দোকানে বসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলাম।
এই সময় আমাদিগের মনে অতিশয় চিন্তা হইল। বেশ বুঝিতে পারিলাম, উহারাই ডাকাইত। ডাকাইতি করিবার নিমিত্তই উহারা ঐ স্থানে আগমন করিয়াছে। কিন্তু রাত্রিকালে এখন উহারা কোথায় যাইবে, ও আমরা কি রূপেই বা উহাদিগের অনুসরণ করিব, ও কেবলমাত্র দুই ব্যক্তির দ্বারাই বা কিরূপে উহাদিগকে ধৃত করিতে সমর্থ হইব, সেই চিন্তা আসিয়া মনে উদয় হইল। আরও ভাবিলাম, এখন উহাদিগের অনুসরণ করিবার কালীন যদি তাহাদিগের মনে কোনরূপ সন্দেহ হয়, যে আমরা তাহাদিগের অনুসরণ করিতেছি, তাহা হইলে আমাদিগের অদৃষ্টেই বা কি ঘটিবে? নিকটে কোন থানা ছিল না, যে সেইস্থানে গিয়া কোন রূপ সাহায্য গ্রহণ করি; সুতরাং বড়ই বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়িলাম। কিন্তু অদৃষ্টে যাহা হয় হইবে ভাবিয়া, ও প্রাণের আশা পরিত্যাগ করিয়া ইহাই স্থির করিলাম, আমাদিগের অদৃষ্টে যাহা হয় হউক, আমরা উহাদিগের অনুসরণ করিব। এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া ষ্টেসন হইতে দুইখানি টেলিগ্রাফ দুইস্থানে প্রেরণ করিলাম, একখানি কলিকাতার প্রধান পুলিস-কর্ম্মচারীর নামে, দ্বিতীয়খানি সেই জেলার সর্ব্বপ্রধান পুলিস-কৰ্ম্মচারীর নিকট। ঐ টেলিগ্রাফে কেবল এইমাত্র লিখিত হইল যে, এক দল ডাকাইত এইস্থানে গাড়ি হইতে নামিয়াছে।
ডাকাইতগণ সেইস্থানে অধিকক্ষণ অপেক্ষা না করিয়া সকলে পৃথক পৃথক রাস্তা অবলম্বন করিল। আমরা দুই জন একত্রে ওমরাওর অনুসরণ করিয়া চলিলাম। ক্রমে উহারা ৪।৫ ক্রোশ পথ গমন করিয়া রাত্রি আন্দাজ ১২টার সময় একটি গ্রামের নিকটবর্ত্তী একটি আম্রকাননে প্রবেশ করিল। আমরাও অন্ধকারের মধ্যে লুক্কায়িত হইয়া সেই আম্রকাননে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, পূর্ব্বকথিত সমস্ত লোকই ক্রমে আসিয়া সেইস্থানে একত্রিত হইল। সেইস্থানে উহারা দলবদ্ধ হইয়া পুলিসের কোট পরিয়া ও লাল পাগড়ি বাঁধিয়া বহির্গত হইল, এবং নিকটবর্তী গ্রামে প্রবেশ করিয়া একখানি গৃহে অগ্নি লাগাইয়া দিয়া তৎপার্শ্ববর্তী গৃহে ডাকাইতি করিতে আরম্ভ করিল। এই অবস্থা দৃষ্টে আর আমরা স্থির থাকিতে পারিলাম না, আমরাও দুইজনে তাহাদিগের নিকটবর্তী হইয়া উহাদিগের উপর গুলি মারিতে লাগিলাম। বলাবাহুল্য, উহারাও আমাদিগকে আক্রমণ করিল, কিন্তু আমাদিগের আগ্নেয় অস্ত্রের সম্মুখীন হইতে পারিল না। আমরা ১০ জনকে সেইস্থানে ধরাশায়ী করিলাম। তাহাদিগের মধ্যে ওমরাও খাঁ, সীতারাম সিং ও গোবিন্দ দাস নামক তিন জন দলপতিই পতিত ও ধৃত হইল। অবশিষ্ট ১৫/১৬ জন সেইস্থান হইতে পলায়ন করিল, কিন্তু পরিশেষে তাহারাও ধৃত হইয়াছিল। এই দল ধৃত হওয়ায় ও উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ায় কিছু দিবসের নিমিত্ত ডাকাইতি একেবারে বন্ধ হইয়া গেল।
[কাৰ্ত্তিক, ১৩০৮]