লাল টিনের ছাদের বাড়ি

লাল টিনের ছাদের বাড়ি

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের দিকের ঘটনা; অকুস্থল ভারত-বর্মা সীমান্তের একেবারে উত্তরপূর্ব কোনা; জায়গাটার নামধাম নাই করলাম। আমার পলটুকাকা কনভয় নিয়ে সেখানে যখন পৌঁছলেন, নির্ধারিত সময়ের পর তখন পাঁচ ঘণ্টা কেটে গেছে, চারদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।

সাধারণ চোখ দিয়ে বিচার করতে গেলে জায়গাটার প্রচুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। একদিকে একটা অচেনা চেহারার পাথুরে ব্রহ্মপুত্র, সবেমাত্র পাহাড় থেকে ছাড়া পেয়ে আছড়ে আছড়ে চলেছে; অন্যদিকে সাদা জমাট হিমালয়। তার উপর চাঁদের আলোর বান ডেকেছে, চোখ ঝলসে যায়, কান ঝালাপালা হয়। কিন্তু কে না জানে যুদ্ধের সময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আদর নেই। ক্লান্ত শরীরটাকে কোনোমতে ট্রাক থেকে টেনে নামিয়ে রতন সিং বললেন, আঃ, কী বুদ্ধি তোমার পি. এস! একেবারে খোলা নদীর পাড়ে কনভয় থামালে!

পল্টুকাকা হেসে বললেন, কোনো নৌকোর কি সাঁতারুর কি কুমীরের এ নদী পার হওয়ার সাধ্যি নেই। রতন সিং বললেন, কিন্তু ফুটফুটে চাঁদের আলোয় বোমারুর অব্যর্থ টার্গেট! ওদের দুশো গজ এগিয়ে ওই তেঁতুল বনের আড়ালে থাকতে বল, ও-ও নদীরই ধারে বলতে গেলে। কিন্তু আলো জ্বালবে না, ঠাণ্ডা রসদ খাবে।

কনভয় এগিয়ে গেলে পল্টুকাকা একটু অপ্রস্তুতভাবে বললেন, এই জায়গাই তো, চিফ?

রতন সিং বিরক্ত হয়ে উঠলেন, বারবার ম্যাপ মিলিয়েছি, এই জায়গা না হয়ে যায় না। ওই দ্যাখ, নদীর ধারে লাল টিনের চাল দেওয়া দোতলা বাড়িও রয়েছে; অত কাঁচা কাজ আমি করি না।

কিন্তু তাহলে সেই যে, যার আমাদের মিট করবার কথা ছিল—অবশ্য পাঁচ ঘণ্টা দেরি করে আসা হয়েছে, এতক্ষণ ধরে তার অপেক্ষা করতে বয়ে গেছে; রাতে এখানে একা অপেক্ষা করাটা কি তার পক্ষে খুব নিরাপদ মনে করো নাকি?

পল্টুকাকা গলা নামিয়ে বললে, যে কাজ সে বেছে নিয়েছে, তাও কি খুব নিরাপদ কাজ?

চারদিকটা অস্বাভাবিক চুপচাপ, ব্রহ্মপুত্রের কলধ্বনিটাকে পর্যন্ত নীরবতার ভাষা বলে মনে হয়। পল্টুকাকা চারদিকে চেয়ে বললেন, গা ছমছম করে, যাই বলুন। তার ওপর ওই পেট্রল ডিপোতে যা বললে সে ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। সুর্য ডোবার পর এ জায়গার দশ মাইলের মধ্যে নাকি পারতপক্ষে কেউ আসে না, ঐ বাড়িটা ভুতের বাড়ি—

রতন সিং বাধা দিয়ে বললেন, ‘ঠিক সেই জন্যই তো এই জায়গা বেছে নেওয়া। এখানে নিরাপদে কনভয় নিয়ে দিন কাটানো যাবে। ওই মেয়ের নাম কুসুমকুমারী, সে এই দিককারই মেয়ে; তার পথ ভুল করবার কোনো সম্ভাবনাই নেই; তোমার ওসব ভয়ভাবনার উপরে থাকে সে; রাঁধেও নাকি খাসা। সাতদিন সাত রাতের পর, গরম রান্না খাবার খেয়ে, ছাদের নিচে, খাটের ওপর পাতা বিছানায় শুয়ে— ঘুমোনোর সঙ্গে সঙ্গে সুখের কি কোনো তফাৎ আছে মনে কর? চল।’ এখান থেকে কনভয়ের কোনো সাড়া শব্দই পাওয়া যায় না। রতন সিং পল্টুকাকার আগে আগে ইচ্ছা করেই যেন জোরে জোরে পা ফেলে, লাল টিনের ছাদের বাড়িটার দিকে এগোলেন। স্বাভাবিক স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘বুঝলে হে, কুসুমকুমারীর সঙ্গে দেখা হওয়াটা নিতান্তই দরকার। সে তো শুধু আমাদের রাঁধাবাড়া দেখাশুনো করবে না, তার জন্য আবার একটা বাইরের লোকের কোনো দরকার ছিল না, আসলে সে-ই হল এস ঘাঁটি। পল্টুকাকা হঠাৎ চমকে উঠলেন। রতন সিং কাষ্ঠ হেসে বলে চললেন, ‘এইখানে আমাদের গোপন ঘাঁটি করা চলবে কি না, শত্রুদের কতদূরে কোথায় অবস্থান, এ সব খবরই ওর নখাগ্রে। অথচ দেখলে মনে হবে যেন স্রেফ একটি সীমান্তের পাড়াগাঁর মেয়ে। ওর সঙ্গে কথা বলার সময় ভুলেও কিন্তু ওকে বুঝতে দিও না যে, ওর পরিচয়টা আমাদের জানা আছে। সি-ওর এই রকমই হুকুম। দুচ্ছেদ্য আবরণে এস ঘাঁটির পরিচয় মোড়া থাকবে, নেহাৎ আমি ক্লান্ত বলে, বলে ফেললাম।’

পল্টকাকা শুনে কাঠ। এস ঘাঁটির কীর্তিকলাপ তাঁর অজানা ছিল না, সে যে একজন মেয়ে হতে পারে, একথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। পল্টুকাকার মতে মেয়েদের শ্রেষ্ঠ স্থান হল রান্নাঘরে। বলতে বলতে ওঁরা লাল টিনের ছাদের বাড়িটার দোর গোড়ায় এসে পৌঁছেছেন। একেবারে নদীর ধার ঘেঁষে বাড়ি; অমন দুরন্ত নদীর পাড়ে কেউ যে বাড়ি করে একথা ভাবলেও আশ্চর্য লাগে। তবে মজবুত গাঁথুনি, আগাগোড়া পাথরের, নদীর পাড়ও উত্তরে দক্ষিণে অনেকদূর অবধি পাথর দিয়ে বাঁধানো, উঁচু পাড়িতে অনেক বিদেশি গাছের বাহার; চাঁদের আলোতেও বোঝা যাচ্ছে এখন তারা অযত্নে মলিন।

রতন সিং মুখে যাই বলুন ভেতরে ভেতরে নিশ্চয় একটু ভয় ঢুকেছিল, তাই প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “জায়গাটাতে এলে যে মন খারাপ হয়ে যায় সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, তাই বোধহয় ঐ সব গাঁজাখুরি ভূতের গল্পের সৃষ্টি হয়েছে। কুসুমকুমারী সম্ভবত এইখানেই আমাদের থাকার জায়গা ঠিক করেছে। ভূতের বাড়ির মতো নিরাপদ আস্তানা আর কোথায় পাবে?” রতন সিং জোর করে হাসতে চেষ্টা করলেন— দরজায় একটু ধাক্কা দিয়ে দেখা যাক, কী বল?’ ঠিক সেইসময় দরজাটা আপনা থেকেই খুলে গেল। পল্টুকাকার গায়ের রক্ত হিম হয়ে এল। ভাগ্যিস, দরজা খুলে কুসুমকুমারী এক গাল হেসে বেরিয়ে এল, নইলে হয়তো সত্যি সত্যি এলিয়েই পড়তেন, আর তা হলে রতন সিং ওঁকে পোস্টেজ বিভাগে চালান না করে ছাড়তেন না।

মন্দ ব্যবস্থা হল না মোটের ওপর; যদিও কুসুমকুমারীর ভাঙা ভাঙা হিন্দি থেকে বোঝা গেল সে ওঁদের আসার বিষয় সঠিক খবরই পায়নি। তবু ওঁদের সঙ্গে কিছু শুকনো সামগ্রী ছিল, আলু ছিল, চাল ছিল, মাখন ছিল, বাড়িতে এককালে মুর্গি ছিল, এখনো তাদের বুনো বংশধররা ডিম পাড়ে, লঙ্কা গাছে লঙ্কা ঝুলছিল। চাঁদের আলোয় সে সব সংগ্রহ করে, রাত ন’টার মধ্যে কুসুমকুমারী সুন্দর নকশা করা পুরোনো চিনেমাটির বাসনে তাঁদের যা খাওয়াল সে আর ভুলবার নয়।

বাস্তবিক যারা ওসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে তাদের পক্ষে এ-বাড়িটাকে ভূতের বাড়ি বলাটা কিছুই আশ্চর্য নয়। ঠিক মনে হয়, সময় এখানে কুড়ি বছর আগের একটা বিশেষ মুহূর্তে পৌঁছে চুপ করে থেমে রয়েছে। মেঝেতে ম্যাটিং পাতা, কাঠের সিঁড়িতেও ম্যাটিং। ওপরে পাশাপাশি তিনটি শোবার ঘর। লোহার খাট, তার পুরোনো নারকেল ছোবড়ার গদীর ওপর কুসুমকুমারী আলমারি থেকে কম্বল আর চাদর বের করে বিছানা পেতে দিল। বালিশে পরিষ্কার ওয়াড় পরিয়ে দিল।

সবই হল, শুধু আসল ব্যাপারটি ছাড়া। কুসুমকুমারী মুখ ফুটে কথা বলে না।

তা বলবেই বা কেন, রতন সিং আর পল্টুকাকাই যে ঠিক লোক, কুসুম তা জানবে কী করে? শেষ পর্যন্ত রতন সিং তাকে খোলাখুলি জিজ্ঞাসা করলেন শত্রুরা কোথায়, এখানে মাসখানেক নিরাপদে থাকা যায় কি না।

কুসুমকুমারীর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, সে শিউরে উঠল, তার মুখ খুলে গেল।— না, না, না, কাল ভোরেই চলে যাও, এ জায়গা ভালো নয়। কাল রাতেই তারা আসবে। কাউকে বাদ দেবে না। আর এক মুহূর্ত সে দাঁড়াল না, নিচে কিছু জিনিসপত্র নাড়াচাড়ার, দরজা জানলা বন্ধ হওয়ার শব্দ, তার পর সব চুপচাপ; শুধু কানের কাছে ব্রহ্মপুত্রের উত্তাল গর্জন।

পূর্বদিক ফর্সা হবার আগেই ওঁদের ঘুম ভেঙে গেল, পাঁচ মিনিটে সামান্য জিনিসপত্র বাঁধা সারা, ওঁরা তৈরি। বিছানার চাদর, কম্বল, বালিশের ওয়াড় সব যথাস্থানে তুলে রাখা হল, জানলা দরজা বন্ধ করা হল। তাকে আরেকবার দেখতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু এসব কাজে যারা জড়িয়ে পড়ে, কোনো রকম ব্যক্তিগত সম্পর্কের তারা ধার ধারে না, একথা দুজনারই জানা ছিল। তবু একতলার পরিচ্ছন্ন খাবার ঘর, রান্নাঘর দেখে যখন মনে হল না যে গতকাল রাতে এখানে একজন মেয়ের সেবার হাত পড়েছিল, দুজনারই মন ভারী হয়ে উঠেছিল।

বলা বাহুল্য, সূর্য ওঠার আগেই কনভয় রওনা হয়ে গিয়েছিল। তারপর মার্গারিটাতে রিপোর্ট করতে হল: পরদিন সত্যি সত্যি নদীর ধারের ঐ সব অঞ্চলে শত্রুদের বোমা পড়েছিল, লাল টিনের ছাদের বাড়িটার নাকি আর কোনো চিহ্ন থাকেনি। প্রায় মাস ছয় বাদে কলকাতায় একটা ক্লাবে সি-ওর সঙ্গে পল্টুকাকার দেখা। সি-ওর মহা আক্ষেপ, মিছিমিছি কনভয় নিয়ে ওঁদের অতদূরে পাঠানো হয়েছিল বলে, তার দশদিন আগেই যে এস ঘাঁটি এয়ার-রেডে নিখোঁজ, সেটা তাঁর জানা ছিল না। ওঁদের বোধ করি বড়ই কষ্ট হয়েছিল।

সেখানে সি-ওর বন্ধু কর্নেল লাহিড়ীও ছিলেন, ‘এটা আবার একটা কথা হল? দিল্লীতে আমার রতন সিং-এর সঙ্গে দেখা, সে কিন্তু বলল এস্ ঘাঁটি নিখোঁজ হয়ে গিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু কুসুমকুমারী বলে যে গ্রামের মেয়েটিকে আমরা এস্‌ ঘাঁটি বলে জানতাম, সে বেঁচেই আছে এবং তার কর্তব্যও ভোলেনি। সে-ই ওঁদের সঙ্গে দেখা করে সাবধান করে দিয়েছিল, তাই ওঁদের কনভয়টাও বেঁচে গেছিল। তা নিখোঁজই বল আর যাই বল। কী বলেন ক্যাপটেন, সেদিন কি খুব কষ্ট হয়েছিল?’

পল্টকাকা মাথা নাড়লেন, ‘না, না, কোনো কষ্টই হয়নি, বড় যত্ন পেয়েছিলাম। ও বাড়িতে কারো অযত্ন হয় না। ওখান থেকে একশো মাইল দূরে বটগাছের নিচে যে ছোট্ট পেট্রল ডিপো আছে, সেখানকার লোকদের জিজ্ঞাসা করলে, তারা বলে যে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ও বাড়ি থেকে কেউ অযত্ন পেয়ে ফেরেনি। এমনকী এই কুড়ি বছর ধরে যে বাড়িতে কোনো জনমানুষের বাস নেই, এখনো নয়। সেই ভয়েতেই কেউ ওদিক মাড়ায় না। যাক লাল টিনের ছাদের বাড়িটা এতদিন বাদে ব্রহ্মপুত্রের নিচে ডুবে গেল? ভয়ের মধ্যে অভয় দেবার আর কেউ রইল না তা হলে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *