লাল জোছনা – কাবেরী রায়চৌধুরী
—তাহলে কী ভাবতেছ?
—কী, আবার? এক সঙ্গে থাকবার ছাড়া আর কী? তুমি আর আমি। আমি আর তুমি! এতবড় একটা ঢাকা শহরে আমাদের দুইজনারই তো কেউ নাই! কাম শ্যাষ হইলে দুইজনাই একলা!’
আয়েশার হাতের ওপর আলতো চাপ দিল শেখ মিরাজ। সি.এন.জি অটো চালানো কড়াপড়া হাতের শক্ত আঙুল দিয়ে আয়েশার সেলাই মেশিন চালানো কড়া হাতের তালুতে হাত বোলাচ্ছে।
—সাঁতার দিতে মন চায়!
সম্মুখে বয়ে যাওয়া কালিগঙ্গা নদীর দিকে তাকিয়ে আবেগ ডুবিয়ে কথাটা বলল আয়েশা! ‘কাম আর কাম! দ্যাশে থাকতে রোজ সাঁতার দিতাম। কাল থেক্যে আবার ওবার টাইম! দুই শিপটে কাম হইব। তোমার সঙ্গে দেখা করবার সময় পাইব না।’
—তা বইল্যেই হবে? আমি আসব তোমার ফ্যাকটরির সামনে। টিফিন টাইমে আমি আসব বাসায় যাইবার আগে। তোমার মুখখানা দেখে বাসায় গিয়া পচা পান্তা সোনা মুখ করে খাইব এখন।
এই ভরা বর্ষায় কালিগঙ্গার বুকে ছলকে ছলকে উঠছে ঢেউ! আয়েশার আবেগও! মায়া লাগে মিরাজের কথা শুনে। মায়ায় পড়ে গেছে মানুষটার। খাওয়ার কষ্ট। হাত পুড়িয়ে রাঁধতে হয়। একদিন সেই রান্না খাইয়েছিল মিরাজ! ‘মা—গো—মা! সে অখাদ্য মুখে দেওয়া যায় না! বউ থাকতে বউ নাই! সে নাকি ঢাকা শহরে আসতে চায় না! শহরে নাকি তার দম বন্ধ হয়ে যায়। সে গ্রামে থাকতেই পছন্দ করে!’
তেতো আর খুব নুনে পোড়া তরকারির আস্বাদ নিতে নিতে তার মুখ যখন বিকৃত হয়ে গেছিল তখন তার গালে আঙুল দিয়ে টোকা মেরে মিরাজ বলেছিল, ‘আমার বউ হবে?’
বউ! তোমার তো দ্যাশে সুন্দরী বউ আছে মিঞা! কয়ডা করবা?
আচমকাই তাকে চমকে দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল মিরাজ। আরেব্বাস! কী লোহার মতো শক্ত হাত আর পেশি। রোগা কাঠির মতো লোক হলে কী হবে গায়ের জোর যে কী ভীষণ তা টের পেয়েছিল সেইদিনই।
জাপটে ধরে বলেছিল, এইবার বুঝো কয়ডা করতে পারি! সন্দেহ আছে কিছু?
শরীর কাঁপতে কাঁপতে দুর্বল হয়ে গেছে তখন তার। যেন একটা পাখির পালকের আঘাতেই মৃত্যু হবে!
কেমন ভেঙে পড়া গলায় বলেছিল, ছাড়ো মিঞা। ছাড়ো, ছাড়ো, আহ! ছাড়ো।
—ক্যান ছাড়ব? ধরসি এমনি এমনি?
সে তখন গলে যাচ্ছে। আনিসুজ্জমানের চেহারাটা কতদিন পরে মনে পড়ল! ঢাকা শহরে প্রথম আসার পর যে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ নিয়েছিল সে সেখানেই আনিসুজ্জমান ‘আয়রন ম্যান’ ছিল। তৈরি হওয়া পোশাক ইস্তিরি করার কাম করত! আর সে মাপ দেওয়া কাপড় কাটত। আলাপ হল। প্রেম হল। গর্ভবতীও হল খুব দ্রুত। গর্ভপাতও হল আনিসুজ্জমান বেঁকে বসায়।
মনে পড়ছে। মনে পড়ছিল সেইদিনের সবকিছু আবার। প্রেমের কথাগুলো সব কেমন একরকম। এক ভাষা বলে পুরুষ ও নারী।
আনিসুজ্জমানকে যখন সে জানাল গর্ভের কথা, সে আশ্চর্য হয়ে বলল, ও বাচ্চচা আমার তা কে কইল? তুই বেটি লুচ্চিচ মাইয়া মানুষ, কই কই যাস তা আমি কী জানি?
হতবাক সে। কাটা জিওল মাছের মতো শরীর কাঁপছে তার। গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না। সমস্ত কথাগুলো গলার কাছে দলা বেঁধে ইট হয়ে গেছে।
আনিসুজ্জমান বলে চলল, এক মাস আলাপ—পরিচয় হইতে না হইতে যে মাগি পেরায় অচেনা পুরুষের সঙ্গে শুইতে পারে তার চরিত্তির তখন বুঝছি। আর আমার বাসায় বউ আছে, বাচ্চচা আছে। আমি ক্যামনে বিয়া করব? তাছাড়া কার কার সঙ্গে কই কই শুইছিস বিলাই কুত্তার মতো তার খবর কে জানে? ও বাচ্চচা আমার নয়। তুমি পথ দেখো।’
প্রায় বেহুঁশ শরীরটাকে টানতে টানতে, তার ভার বইতে বইতে কীভাবে যে ছোট্ট ঘুপচি বাসায় ফিরে এসেছিল সে সেইদিন!
পাশের ঘরের হিন্দু বউটাকে নিয়ে পরদিন গর্ভপাত করে এসেছিল সে।
ভালোবাসার প্রথম আঘাত যে বড় যন্ত্রণার! তাই মাস পুরতে বেতন নিয়ে চলে এসেছিল সে কাজ ছেড়ে। আর ওই ফ্যাক্টরিমুখো হয়নি।
যাতায়াতের পথে গোল্ডেন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি চোখে পড়ে এখনও। ক্ষণিকের জন্য মন কেমন করে ওঠে! ব্যস, ওইটুকুই স্মৃতি। কখনও কখনও রাত বেরাতে হিসাব করে বাচ্চচাটা থাকলে কত বড় হত। তিন বছর! তিন বছরের বাচ্চচা! ছেলে না মেয়ে কী জানি? পায়ে পায়ে হাঁটত। কেউ একটা খুব নিজের হত! মন আবার কেমন যেন করে!
কিন্তু মন খারাপ করার আর সময় কোথায়? ঢাকা শহরে মন খারাপ করে ঘরে শুয়ে থাকার সময় বড়জোর চব্বিশ ঘণ্টা। প্রতিদিন বেঁচে থাকার যুদ্ধ।
মিরাজের আলিঙ্গন তিনটে বছর পর আনিসুজ্জমানকে মনে পড়িয়ে দিয়েছিল আবার! সেই শক্ত আষ্টেপৃষ্টে আলিঙ্গন।
—কী ভাবতেছ?
—কিছু না।
—তুমি কিন্তু এখনও আমার হইলে না! আইজ বাসায় যাইবা?
চলো না? শুধু রাস্তায় রাস্তায় নদীর ঘাটে ঘুরে বেড়াইতে ভালো লাগে? মিরাজের হাত তার কোমর ছুঁয়েছে এখন।
—না, বাসায় গিয়া কী হইব? বন্ধ ঘর। আলো—বাতাস ঢোকে না! কী করব বাসায় গিয়া?
—আমাকে কোলোজ করে পাইতে ইচ্ছা হয় না তোর? কী রে সোহাগি?
হেসে ফেলল আয়েশা। বলল, ‘সোহাগি!’ সেডা আবার কেডা হইল?
আশপাশ দেখে নিয়ে জাপটে ধরে এবার খান দুয়েক চুমু খেয়ে ফেলল মিরাজ তাকে। আদর ঘন গলায় বলল, তুই, তুই আমার সোহাগি। তুই এখনও দুই মাস হইয়া গেল বুঝস নাই আমারে।
তোর জন্য কী না করতে পারি আমি! বিয়া করি চল। দুই জনাই কামাই করি। আমি বাসা ভাড়া দিব। আর তুই বাজার খরচ। আর তোর লিপিস্টিক শাড়ি আমি দিব। কি? রাজি?
—আমার একখান বাচ্চচার সাধ বড়।
—তা তো হইবই। তবে আমরা এখন বাচ্চচা নিমু না। অনেক খরচা। যে বাবুটা আসবে তারে যদি বেবি ফুড, মাছটা—ডিমটা খাওয়াইতেই না পারি তাইলে বড় দুঃখ।
—তোমার তো বউ আছে। দুইডা বাচ্চচা। তোমার আর কী? দীর্ঘ নিঃশ্বাস পতন হল আয়েশার বুক ভেঙে।
মেঘ কালো আকাশ। কালিগঙ্গার আকাশ, জল আরও ঘন।
আরও কালো।
লোকজন বিশেষ নেই। কিছু নৌকা আর ছোট লঞ্চ, ভুটভুটি যাতায়াত করছে শুধু।
—নৌকা চড়বি? চল, কিছুটা দূর পর্যন্ত ঘুরন দিয়া আসি।
—না। কেমন যেন জেদ পেয়ে বসল। মাথা নাড়ল আয়েশা, না, চলো যে—যার বাসায় যাই গিয়া। কাইল থেকে আবার কোরবানি পর্যন্ত দুই শিপটে কাম!
—আমার বাসাটা কি আমাদের বাসা হইতে পারে না? তোমায় তো কত আলফাল লোক ডিস্টাব দেয়। ঢাকা শহরে একলা মাইয়া মানুষের জন্য নিরাপদ নয় গো দোস্ত। চলো একসঙ্গে থাকি দুই জনা। তোমার হাতে রান্না খাইয়া সকাল বেলায় গাড়ি ইস্ট্যাট দেবনে। আর রাতে দুই জনা দুই জনারে জড়াইয়া ঘুম দিব। আহ! শান্তি!
লোভ হয়। বড় লোভ হচ্ছে আয়েশার। বড় একলা লাগে! দিনভর কাম কাজ করার পর একলা বাসায় ফিরে এসে কথা বলার একটা লোক নেই পর্যন্ত।
আগে তার শরীর বোধও ছিল না। আনিসুজ্জমান তাকে তার নিজস্ব শরীরের খিদে তেষ্টা চিনিয়েছে প্রথম। এখন সেই নিজের শরীরটাও বিশ্বাসঘাতকতা করে তার সঙ্গে।
ঘাড় নাড়ল আয়েশা। বলল, বিয়া করব।
—বিয়া নয়। আমারে আরেকটু চিনো বউ। আরেকটু বুঝো। তারপর। আমি মানুষটা তো খারাপও হইতে পারি?
.
সেই দিন জোছনা হঠাৎই লাল হয়ে গেল মধ্যরাতের পর!
আঁশটে দুর্গন্ধময় খালের কালো জল যেটা এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখছিল, জোছনা মাখছিল শরীরে। সেই জলের রং লাল হয়ে গেল হঠাৎই!
চপার দিয়ে আয়েশার ক্ষত—বিক্ষত ধপধপে শরীরটা কালো পাঁক গোলা জলের মধ্যে আধ ডোবা পড়ে আছে, সেই রাতের আকাশ বাতাস জোছনা দেখল চেয়ে চেয়ে।
.
ফ্যালফ্যাল করে টেবিলে রাখা উদ্ধার হওয়া চপারটা দেখছে শেখ মিরাজ।
চপারটা তো নোংরা পচা গলা খলের জলে ফেলে দিয়েছিল সে আয়েশার সঙ্গে!
—আর পারতেছিলাম না স্যর! বড্ড বাড়াবাড়ি করতেছিল। বিয়া করো বিয়া করো বইল্যা মাথার পোকা বার কইরা দিচ্ছিল।
—তাই? তা বিয়া করতে অসুবিধা কী ছিল? দুইডা বউ হইত। ‘মন্দ কী?’ হাসছেন অফিসার নুরুল ইসলাম।
—আমার বউ অনেক সুন্দরী স্যর। আর সে আমার ছাড়া কিস্যু বুঝে না স্যর। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করে। আমার দুইডা বাচ্চচা, বুড়া মা—বাপ ঘরসংসার সামলায়। সে যদি জানতে পারে আমি বিয়া করছি তা হইলে বিষ খাইবে স্যর।
—বাব্বা! ধর্মের কথা শোনাইলি যে বাবা!
—স্যর, ফতেমাকে আমি কষ্ট দিতে পারুম না। হেইডা তো চুক্তির থাকা। দুইজনাই একলা। আমার বাসা ভাড়া, ওর বাজার খরচ, রান্না। বিনিময়ে দুই জনাই একটু ফুর্তিফার্তা কইরে থাকা। কিন্তু ও যে এমনভাবে সিরিয়াস হইয়া যাইবে এমনডা ভাবতে পারি নাই। মার দিছি কত। তাইতে বেটির আরও পেরেম!
.
—রান্না করিস নাই?
—না।
—ক্যান?
—এমনি, শরীল ভালো নাই।
—কী হইসে?
—দুই মাস হয় নাই।
—তাতে চিন্তার কী আছে? কাল আমার সঙ্গে যাবি হাসপাতালে। খালাস হইয়া আসবি।
—ক্যান? আমি তো তোমারে বুইঝ্যা লইসি। আমাদের দুইজনার দুই জনারে বুঝবার কথা হইছিল।
—তা হইছিল?
—আমি তোমারে ছাইড়া কারুর সঙ্গে আর বিয়া বসাইতে পারুম না জানো! আমি এক্কেবারে তোমার হইয়া গেছি!
—আমার বউ মানব না।
—বউ! বউ আর বউ। আমি বুঝি তোমার কেউ না? এই যে ঘরসংসার রান্নাবান্না করতেছি তোমার—! এই যে যত্ন আত্তি…। সেগুলো কিস্যু না?
তোমার শরীলটার ক্ষুধা মিটাইছি রাতভর—! আমি তোমার বউ নই এখনও?
—আমার বউ বিষ খাইব জানতে পারলে। ও খুব ভালো। বোরকা পইরা চক্ষু দুটি শুধু বাইর কইরা রাখে সে। অনেক সুন্দর। অনেক ভালো সে। তোর মতো খানকিবিত্তি করে না। বুঝলি মাগি? তুই বাইর হ এখনই। আমার বাসা থেকে বাইর হ।
—ক্যান যামু? আমারও অনেক খরচ হইছে। কুত্তারবাচ্চচা! তুই তো আমার পয়সাও চুইস্যা খাইছস। আমার টাকাপয়সা…ফিরত দে। যামু গিয়া। বউ দেখাইতেছে! নে! দেখ গা বোরকার তলে তলে কী করতেছে তোর বউ!
—তবে রে মাগি! গলা টিপে ধরেছে, মিরাজ আয়েশার! আর তারপরই হাতের পাশে থাকা চপারের কোপ নেমে এল আয়েশার গলায়, মুখে।
.
থমথমে রাত। শেখ কামাল নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ফতেমা বিবির ঘর থেকে। চাটাই দেওয়া জানলায় চোখ রেখে তাকিয়ে আছে ফতেমা। অস্পষ্ট উচ্চচারণ করল, খোদা হাফিজ।
.
মধ্যপিরের বাগের দুর্গন্ধময় খালের জলে ছুড়ে ফেলে দিল আয়েশার দেহ মিরাজ। বলল, আল্লা হাফিজ রাতটুকু সময়। ভোর না হতেই গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে।
.
—পাপ বাপকেও ছাড়ে না জানিস তো? বোকা! দিব্যি দুইডা বউ নিয়া সংসার করতে পারতিস! এখন জেলের ভাত খা।’ অফিসার নুরুল ইসলাম মুচকি হাসলেন।