লাল চুল – মনোজ বসু

লাল চুল – মনোজ বসু

ছ’মাস ধরিয়া বিয়ের দিন সাব্যস্ত হয় না৷ তারপর দিন ঠিক হইল তো বাধিল জায়গা লইয়া৷ মোটে তখন দিন পনেরো বাকি, হঠাৎ নীলমাধবের চিঠি আসিল—কাজিডাঙা অবধি যাওয়া কিছুতেই হইতে পারে না, তাঁহারা বড় জোর খুলনায় আসিয়া শুভকর্ম করিয়া যাইতে পারেন৷

বিয়ের ঘটক শীতলচন্দ্র বিশ্বাস চিঠি লইয়া সে-ই আসিয়াছিল৷ ভিড় সরিয়া গেলে আসল কারণটা সে শেষকালে ব্যক্ত করিল৷ প্রতিপক্ষ চৌধুরীদের সীমানা কাজিডাঙার ক্রোশ-তিনেকের মধ্যে৷ বলা তো যায় না, তিন ক্রোশ হইতে কয়েকশত লাঠিও যদি আচমকা বিয়ের নিমন্ত্রণে চলিয়া আসে! তাহারা বরাসন হইতে বর তুলিয়া রাত্রির অন্ধকারে গাঙ পাড়ি দিয়া বসিলে অজ পাড়াগাঁয়ে জলজঙ্গলের মধ্যে কেবল নিজেদের হাত কামড়ানো ছাড়া আর কিছু থাকিবে না৷

পাত্র জমিদারের ছেলে জমিদারের ছেলে ঐ একটি মাত্র৷ অতএব এই ছ’মাস ধরিয়া যে জমিদার-বাড়ি শুভকর্মের গুরুতর আয়োজন চলিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই৷ সেই আয়োজনের সত্যকারের চেহারাটা সহসা উপলব্ধি করিয়া আনন্দে মেয়ের বাপের হৃৎকম্প উপস্থিত হইল৷ অথচ মিনুর মা আড় হইয়া পড়িলেন৷—ঐ তেইশে মেয়ের বিয়ে আমি দেবই—বার বার এই রকম গোছগাছ করে শেষকালে যে—না-হয় তুমি সেই বি-এ ফেল ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ ঠিক করে ফেল…

কিন্তু অতবড় ঘর ও বরের লোভ ছাড়া সোজা কথা নয়৷ শেষ পর্যন্ত আবশ্যকও হইল না৷ শহরের প্রান্তসীমায় ভৈরব নদীর ধারে সেরেস্তাদারবাবু এক নূতন বাড়ি তুলিতেছিলেন৷ বাড়িটা তিনি কয়েকদিনের জন্য ছাড়িয়া দিতে রাজি হইলেন৷ সামনের ফাঁকা জমির ইটকাঠ সরাইয়া সেখানে সামিয়ানা খাটাইয়া বরযাত্রী বসিবার জায়গা হইল৷ পিছনে খাওয়ার জায়গা৷ যদি দৈবাৎ বৃষ্টি চাপিয়া পড়ে তাহা হইলে দোতালায় দরদালানে সত্তর আশীজন করিয়া বসাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে৷

বিকালে পাঁচখানা গরুরগাড়ি বোঝাই আরো অনেক আত্মীয়কুটুম্ব আসিয়া পড়িল৷ লগ্ন সাড়ে আটটায়৷

রানি বলিল—মাসিমা, হিরণের বিয়ের বেলায় আপনি বড় অন্যায় করেছিলেন৷ সবাইকে তাড়িয়ে দিয়ে আপনি যে জামাই নিয়ে খাওয়াতে বসবেন—সে হবে না কিন্তু!

মিনুর মা হাসিলেন৷

—না, সে হবে না, মাসিমা৷ আমরা সমস্ত রাত বাসর জাগব, কোনো কথা শুনব না, বলে দিচ্ছি৷ নয়ত বলুন, এক্ষুনি ফের গাড়িতে গিয়ে উঠে বসি৷

রসুইঘরের দিকে হঠাৎ তুমুল গণ্ডগোল৷ বেড়ার ওপর কে জ্বলন্ত কাঠ ঠেস দিয়া রাখিয়াছিল, একটা অগ্নিকাণ্ড হইতে হইতে বাঁচিয়া গিয়াছে৷

সকলের বিশ্বাস, কাজটা বামুনঠাকুরের তাই রাগ করিয়া কে তার গাঁজার কলিকা ভাঙিয়া দিয়াছে৷ পৈতা হাতে বারম্বার ব্রাহ্মণসন্তান দিব্য করিতেছিল—বিনা অপরাধে তাহার গুরুদণ্ড হইয়া গেল, অগ্নিকাণ্ডে কলিকার দোষ নাই৷ তিনদিনের মধ্যে সে কলিকা একেবারে হাতে লয় নাই৷

বেলা ডুবিয়া যাইতে শীতল ঘটক আসিয়া উঠানে দাঁড়াইল—খবর কি? খবর কি?

শীতল কহিল—খবর ভালো৷ বর, বরযাত্রী সব ওঁদের বাসাবাড়ি পৌঁছে গেছেন৷ জজবাবুর বড় মোটর এনে সাজানো হচ্ছে৷ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসে পড়বেন৷

তারপর হাসিয়া গলা খাটো করিয়া কহিতে লাগিল—একশ বরকন্দাজ গাঙের ঘাট আগলাচ্ছে৷ কি জানি, কিছু বলা যায় না! আমাদের কর্তাবাবু একবিন্দু খুঁত রেখে কাজ করেন না৷

মোটরের আওয়াজ উঠিতেই ধুপধাপ করিয়া আট-দশটা মেয়ে ছুটিল তেতলার ছাতে৷ সকলের পিছন হইতে নিরু বলিল—যাওয়া ভাই অনর্থক৷ ছাত থেকে কিচ্ছু দেখা যাবে না৷ তার চেয়ে গোলকুঠুরির জানলা দিয়ে—

কৌতূহল চোখমুখ দিয়া যেন ছিটকাইয়া পড়িতেছে ঠাট্টাতামাসা—ছুটাছুটি—মাঝে মাঝে হাসির তরঙ্গ তার মধ্যে যুক্তি-বিবেচনার কথা কে শুনিবে?

রানি সকলের আগেভাগে ঝুঁকিয়া পড়িয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে আঙুল দিয়া দেখাইল —ঐ, ঐ—বর—দেখ—

—মরবি যে এক্ষুনি পড়ে—ছাতের এখনো আলসে হয়নি, দেখেছিস? বলিয়া আর একটি মেয়ে রানিকে পিছে ঠেলিয়া নিজে আগে আসিল৷ যেন সে মোটেই পড়িতে পারে না৷ জিজ্ঞাসা করিল—কই? ও রানি, বর দেখলি কোন দিকে৷

—গলায় ফুলের মালা—ঐ যে৷ দেখতে পাও না—তুমি যেন কি রকম সেজদি!

সেজদি বলিল—মালা না তোর মুণ্ডু! ও যে এক বুড়ো—সাদা চাদর কাঁধে৷ থুত্থুড়ে মাগো, তিনকালের বুড়ো—ও বরের ঠাকুরদাদা৷ বর এতক্ষণে কোনকালে আসনে গিয়ে বসেছে—

ছাতের উপর হইতে বরাসন পর্যন্ত নজর চলে না, দেখা যায় কেবল সামিয়ানা৷ নিরু বলিল—বলেছি তো অনর্থক! তার চেয়ে নীচে গোলকুঠুরির জানলা দিয়ে দেখিগে চল!

—চল, চল৷

অন্ধকারে নদী মৃদুতম গানের সুর তুলিয়া যাইতেছে৷ ওপারেও যেন কিসের উৎসব—অনেকগুলো আলো, ঢাকের বাজনা…৷ সহসা এক ঝলক স্নিগ্ধ বাতাস উহাদের রঙিন শাড়ি, কেশ-বেশের সুগন্ধ, উচ্ছল কলহাস্যের টুকরাগুলি উড়াইয়া ছড়াইয়া বহিয়া গেল৷

—ঘুমিয়ে কে রে? মিনু? ওমা মাগো, যার বিয়ে তার মনে নেই, পালিয়ে এসে চিলেকোঠায় ঘুমোনো হচ্ছে!

রানি হাত ধরিয়া নাড়া দিতে মিনু একবার চাহিয়া চোখ বুজিল৷

নিরু বলিল—আহা, সারাদিন না খেয়ে নেতিয়ে পড়েছে৷ ঘুমোক না একটু—আমরা নীচে যাই—

সেজদি ঝঙ্কার দিয়া উঠিল—গিন্নীপনা রাখ দিকি৷ আমরাও না খেয়ে ছিলাম একদিন৷ ঘুমোনোর দফা শেষ আজকের দিন থেকে৷ কি বলিস রে রানি?

বিশেষ করিয়া রানিকেই জিজ্ঞাসা করিবার একটা অর্থ আছে৷ কথাটা গোপনীয়, কেবল সেজদি আড়ি দিতে গিয়া দৈবাৎ জানিয়া ফেলিয়াছিল৷ রানি মুখ টিপিয়া হাসিল৷ দুই হাতে ঘুমন্ত মিনুর গলা জড়াইয়া ধরিয়া চুমো খাইয়া বলিতে লাগিল—মিনু ভাই, জাগো—আজকে ঘুমোতে আছে? উঠে বর দেখতে এস৷ তারপর মিনুর এলোচুলে হাত পড়িতে যেন শিহরিয়া উঠিল—দেখেছ? সন্ধ্যাবেলায় আবার নেয়ে মরেছে হতভাগী! শুয়ে শুয়ে চুল শুকোনো হচ্ছে! ভিজে চুল নিয়ে এখন উপায়? এই রাশ বাঁধতে কি সময় লাগবে কম? নীচে উলুধ্বনি উঠিল৷ পিসিমা, নন্দরানি, শুভা ওদের সব গলা৷

—চল—চল—

—চুল বাঁধতে হবে—ওঠ মিনু, শীগগির উঠে আয়—বলিয়া মিনুর এলোচুল ধরিয়া জোরে এক টান দিয়া রানি ছুটিয়া দলে মিশিল৷ সিঁড়িতে আবার সমবেত পদধ্বনি৷

ধড়মড় করিয়া মিনু উঠিয়া বসিল৷ তখন রানিরা নামিয়া গিয়াছে, ছাতে কেহ নাই৷ ঘুমচোখে ভাবিল এটা যেন তাদের কাজিডাঙার বাড়ির দক্ষিণের চাতাল৷ আকাশ ভরিয়া তারা উঠিয়াছে ছাতে ঝাপসা ঝাপসা আলো, ওদিকে ভয়ানক গণ্ডগোল উঠিতেছে৷…সব কথা মিনুর মনে পড়িল—আজ তার বিয়ে, সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, সকলে ডাকাডাকি লাগাইয়াছে…৷ হঠাৎ নিচের দিকে কোথায় দপ করিয়া সুতীব্র আলো জ্বলিয়া অনেকখানি রশ্মি আসিয়া পড়িল ছাতের উপর৷ তাড়াতাড়ি আগাইয়া গিয়া সিঁড়ি ভাবিয়া যেই সে পা নামাইয়া দিয়াছে—

চারিদিকে তুমুল হই-হই পড়িয়া গেল৷ আসর ভাঙিয়া সকলে ছুটিল৷ হারমোনিয়াম বাজাইয়া গান চলিতেছিল, পায়ের আঘাতে আঘাতে সেটা যে কোথায় চলিয়া গেল তার ঠিকানা রহিল না৷ একেবারে একতলার বারান্দায় পড়িয়া মিনু নিশ্চেতন৷—জল, জল… মোটর আনো, ভিড় করবেন না মশাই, সরুন—ফাঁক করে দিন…আহা-হা কি করো, মোটরে তোল শীগগির৷ গামছা কাঁধে কোন দিক হইতে কন্যার বাপ ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া আছাড় খাইয়া পড়িলেন৷

জজবাবুর সেই মোটরে চড়িয়া মিনু হাসপাতালে চলিল৷ বড় রাস্তায় রশি দুই পথ গিয়া মোটর ফিরিয়া আসিল, আর যাইতে হইল না৷

রসুনচৌকি থামিয়া গিয়াছে৷ দরজার পুবদিকে ছোট লাল চাদরের নীচে চারিটা কলাগাছ পুঁতিয়া বিয়ের জায়গা হইয়াছিল৷ সেইখানে শব নামাইয়া রাখা হইল৷ কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং, তার উপর নূতন গহনা পরিয়া যেন রাজরাজেশ্বরী হইয়া শুইয়া আছে৷ কনে-চন্দন আঁকা শুভ্র কপাল ফাটিয়া চাপ চাপ জমা রক্ত লেপিয়া রহিয়াছে, নাক ও গালের পাশে রক্ত গড়াইয়াছে—মেঘের মতো খোলা চুলের রাশি, এখানে সেখানে রক্তের ছোপে ডগমগে লাল৷

ভিতরে-বাহিরে নিদারুণ স্তব্ধতা—বাড়িতে যেন একটা লোক নাই৷ শবের মাথার উপরে একটি খরজ্যোতি গ্যাস জ্বলিতেছে৷ বাড়ির মধ্যে স্তব্ধতা চিরিয়া হঠাৎ একবার আর্তনাদ আসিল—ওমা, ও মাগো আমার—ও আমার লক্ষ্মীমাণিক রাজরানি মা! নীলমাধব সকলের দিকে চাহিয়া ধমক দিয়া উঠিলেন—হাত-পা গুটিয়ে বসে আছ যে—

বরশয্যার প্রকাণ্ড মেহগনি-পালিশ খাট কজনে টানিয়া নামাইয়া আনিল৷

এতক্ষণ বেণুধরকে লক্ষ্য হয় নাই৷ এইবার ভিড় ঠেলিয়া আসিয়া শবের পায়ের কাছে খাটের বাজুতে ভর দিয়া সে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইল৷ হাতের মধ্যে কাজললতা তেমনি ধরা আছে৷ কাচের মতো স্বচ্ছ অচঞ্চল আধ-নিমীলিত দুটি দৃষ্টি, মৃত্যুর সেই স্তিমিত চোখ দুটির দিকে নিষ্পলক চাহিয়া চাহিয়া বেণুধর দাঁড়াইয়া রহিল৷

বাপ ঝুঁকিয়া পড়িয়া পাগলের মতো আর্তনাদ করে উঠলেন—একবার ভালো করে চা দিকি…চোখ তুলে চা—ও কী,…

নীলমাধব ছুটিয়া আসিয়া তাঁহার হাত ধরিয়া ফেলিলেন৷ কিন্তু তিনি থামিলেন না, সজল চোখে বার বার বলিতে লাগিলেন—ও বেয়াই, বিনি দোষে মাকে আমার কত গালমন্দ দিয়েছি—কোনো সম্বন্ধ এগুতে চায় না, তার সমস্ত অপরাধ দিনরাত মা ঘাড় পেতে নিয়েছে, একবার মুখ তুলে একটা কথাও কয়নি৷ ও খুকি, আর বকব না—চোখ তুলে চা একবার—

ভিড় জমিয়া গিয়াছিল৷ নীলমাধব ক্রুদ্ধ কণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিলেন—কতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে তোমরা? আটটা বেজে গেছে, রওনা হও!

সাড়ে আটটায় লগ্ন ছিল—বেণুধরের বুকের মধ্যে কাঁপিয়া উঠিল, যেন শুভলগ্নে তাহাদের শুভদৃষ্টি হইতেছে, লজ্জানত বালিকা চোখ তুলিয়া চাহিতে পারিতেছে না, বাপ তাই মেয়েকে সাহস দিতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন৷ …ফুল ও দেবদারু-পাতা দিয়া গেট হইয়াছিল, সমস্ত ফুল ছিঁড়িয়া আনিয়া সকলে শবের উপর ঢালিয়া দিল৷ বেণুধর গলার মালা ছিঁড়িয়া সেই ফুলের গাদায় ছুঁড়িয়া দ্রুতবেগে ভিড়ের মধ্য দিয়া পালাইয়া গেল৷

ছুটিতে ছুটিতে রাস্তা অবধি আসিল সর্বাঙ্গ দিয়া ঘামের ধারা বহিতেছে, পা টলিতেছে নিশ্বাস বন্ধ হইয়া যাইতেছে৷ মোটরের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া উন্মত্তের মতো সে বলিয়া উঠিল—চালাও এক্ষুনি—

গাড়ি চলিতে লাগিলে হুঁশ হইল, তখনো আগাগোড়া তাহার বরের সাজ, একবোঝা কোট-কামিজ, তার উপর শৌখিন ফুলকাটা চাদর—বিয়ের উপলক্ষে পছন্দ করিয়া সমস্ত কেনা৷ একটা একটা করিয়া খুলিয়া পাশে সমস্ত স্তূপাকার করিতে লাগিল৷ তবু কি অসহ্য গরম! বেণুর মনে হইল, সর্বদেহ ফুলিয়া ফাটিয়া এবার বুঝি ঘামের বদলে রক্ত বাহির হইবে৷ ক্রমাগত বলিতে লাগিল, চালাও—খুব জোরে চালাও গাড়ি—

সোফার জিজ্ঞাসা করিল—কোথায়?

—যেখানে খুশি! ফাঁকায়—গ্রামের দিকে—

তীরবেগে গাড়ি ছুটিল৷ চোখ বুজিয়া চেতনাহীনের মতো বেণুধর পড়িয়া রহিল৷

সুমুখে আঁধাররাত্রি, তার উপর মেঘ করিয়া আরো আঁধার জমিয়াছে৷ জনবিরল পথের উপর মিটমিটে কেরোসিনের আলো যেন প্রেতপুরীর পাহারাদার৷ একবার চোখ চাহিয়া বাহিরের দিকে তাকাইয়া বেণুধর শিহরিয়া উঠিল, এমন নিবিড় অন্ধকার সে জীবনে দেখে নাই৷ দু’ধারের বাড়িগুলির দরজা-জানালা বন্ধ, ছোট শহর ইতিমধ্যেই নিশুতি হইয়া উঠিয়াছে৷ মধ্যে আম-কাঁঠালের বড় বড় বাগিচা৷…সহসা কোথায় কোন দিক দিয়া উচ্ছল হাসির শব্দ ভাসিয়া আসিল, অতি মৃদু অস্পষ্ট কৌতুক-চঞ্চল অনেকগুলো কণ্ঠস্বর—বউ দেখিয়ে যাও, বউ দেখিয়ে যাও গো—

আশেপাশের সারি সারি ঘুমন্ত বাড়িগুলির ছাদের উপর, আমবাগিচার এখানে সেখানে, ল্যাম্পপোস্টের আবছায়ে নানা বয়সের কত মেয়ে কৌতূহল-ভরা-চোখে ভিড় করিয়া বউ দেখিতে দাঁড়াইয়া আছে৷

তারপর গাড়ির মধ্যে দৃষ্টি ফিরাইয়া এক পলকে যেন তাহার গায়ে কাঁটা দিয়া উঠিল৷ বধূ তাহার পাশে রহিয়াছে, সত্যই একটা বউমানুষ ঘোমটার মধ্যে জড়সড় হইয়া মাথা নোয়াইয়া একেবারে গদীর সঙ্গে মিশিয়া বসিয়া আছে, গায়ে ছোঁয়া লাগিলে যে সে লজ্জায় মরিয়া যাইবে৷ তারপর খেয়াল হইল, সে তার পরিত্যক্ত জামা-চাদরের বোঝা, মানবী নয়৷ এই গাড়িতেই মেয়েটিকে হাসপাতালে লইয়া চলিয়াছিল সে বসিয়া নাই, তার দেহের দু-এক ফোঁটা রক্ত হয়তো গাড়ির গদীতে লাগিয়া থাকিতে পারে৷

শহর ছাড়িয়া নদীর ধারে ধারে গাড়ি ক্রমে মাঠের মধ্যে আসিল৷ হেডলাইট জ্বালিয়া গাড়ি ছুটিতেছে চারিদিকে নিঃশব্দতাকে পিষিয়া ভাঙিয়া চুরিয়া খোয়া-তোলা রাস্তার উপর চাকার পেষণে কর্কশ সকরুণ আর্তনাদ উঠিতেছে৷ একটি পল্লীকিশোরীর এইদিনকার সকল সাধ-বাসনা বেণুধরের বুকের মধ্যে কাঁদিয়া বেড়াইতে লাগিল৷ চাকার সামনে সে যেন বুক পাতিয়া দিয়াছে৷ বাহিরে ঘন তিমিরাচ্ছন্ন রাত্রি—জনশূন্য মাঠ—কোনোদিকে আলোর কণিকা নাই৷ সৃষ্টির আদিযুগের অন্ধকারলিপ্ত নীহারিকামণ্ডলীর মধ্য দিয়া বেণুধর যেন বিদ্যুতের গতিতে ছুটিয়া বেড়াইতেছে, আর পাশে পাশে পাল্লা দিয়া ছুটিয়া মরিতেছে নিঃশব্দচারিণী মৃতরূপা তার বধূ৷ লাল বেনারসীতে রূপের রাশি মুড়িয়া লজ্জায় ভাঙিয়া শতখান হইয়া এখানে এক কোণে তার বসিবার স্থান ছিল, কিন্তু একটি মুহূর্তের ঘটনার পরে এখন তার স্থান হইয়াছে সীমাহীন আশ্রয়হীন বিপুল শূন্যতায়—রাত্রির অন্ধকার মথিত করিয়া বাতাসের বেগে ফরফর শব্দে তার পরনের কালো কাপড় উড়ে, পায়ের আঘাতে জোনাকী ছিটকাইয়া যায়, গতির বেগে সামনে ঝুঁকিয়া-পড়া ঘন চুলভরা মাথাটি—মাথার চারিপাশ দিয়া রক্তের ধারা গড়াইয়া গড়াইয়া বৃষ্টি বহিয়া যায়, এলোচুল উড়ে,—দিগন্তব্যাপী ডগমগে লাল চুল!

দুই হাতে মাথা টিপিয়া চোখ বুজিয়া বেণুধর পড়িয়া রহিল৷ গাড়ি চলিতে লাগিল৷ খানিকপরে পথের ধারে এক বটতলায় থামিয়া হাটুরে চালার মধ্যে বাঁশের মাচায় অনেকক্ষণ মুখ গুঁজিয়া পড়িয়া থাকিয়া অবশেষে মন কিছু শান্ত হইলে বাসাবাড়িতে ফিরিয়া আসিল৷

নীলমাধব প্রভৃতি অনেকক্ষণ আসিয়াছেন৷ বরযাত্রীর অনেকে মেল ট্রেন ধরিতে সোজা স্টেশনে গিয়াছে৷ কেবল কয়েকজন মাত্র—যাহারা খুব নিকটআত্মীয়—বৈঠকখানার পাশের ঘরে বালিশ কাঁথা পুঁটুলি বই যা হয় একটা কিছু মাথায় দিয়া যে যার মতো শুইয়া পড়িয়াছেন৷ অনেক রাত্রি৷ হেরিকেনের আলো মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছে৷ আলোর সামনে ঠিক মুখোমুখি নির্বাক নিস্তব্ধ গম্ভীর মুখে বসিয়া নীলমাধব ও শীতল ঘটক৷

বেণুকে দেখিয়া নীলমাধব উঠিয়া আসিলেন৷ বলিলেন—কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লে—মোটর নিয়ে গিয়েছ শুনে ভাবলাম, বাসাতেই এসেছ৷ এখানে এসে দেখি তাও নয়৷ ভারী ব্যস্ত হয়েছিলাম৷ জজবাবুর বাড়িতে বিজয় গিয়ে বসে আছে এখনো৷

বেণুধর বলিল—বড্ড মাথা ধরল, ফাঁকায় তাই খানিকটে ঘুরে এলাম—

—বলে যাওয়া উচিত ছিল—বলিয়া নীলমাধব চুপ করিলেন৷

ছেলে নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া পুনরায় বলিলেন—তোমার খাওয়া হয়নি৷ দক্ষিণের কোঠায় খাবার ঢাকা আছে, বিছানা করা আছে, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়—রাত জাগবার দরকার নেই৷

ঘরে গিয়া নীলমাধবের ভয়ে ঢাকা খুলিয়া খাবার খানিকটা সে নাড়াচাড়া করিল, মুখে তুলিতে পারিল না৷

দালানের পিছনে কোথায় কি ফুল ফুটিয়াছে, একটা উগ্র মিষ্টগন্ধের আমেজ৷ মিটমিটে আলোয় রহস্যাচ্ছন্ন আধো-অন্ধকারে চারিদিক চাহিয়া চাহিয়া মনে হইল, ঘর ভরিয়া কে একজন বসিয়া আছে, তাহাকে ধরিবার জো নাই—অথচ তাহার স্নিগ্ধ লাবণ্য বন্যার মতো ঘর ছাপাইয়া যাইতেছে কোণের দিকে দলিলপত্র-ভরা সেকেলে বড় ছাপ বাক্সের আবডালে নিবিড় কালো বড় বড় চোখদুটি অভুক্ত খাবারের দিকে বেদনাহতভাবে চাহিয়া নীরব দৃষ্টিতে তাহাকে সাধাসাধি করিতেছে৷ আলো নিভাইতেই সেই দেহাতীত ইন্দ্রিয়াতীত সৌন্দর্য অকস্মাৎ বেণুধরকে কঠিনভাবে বেষ্টন করিয়া ধরিল৷…

বাহিরের বৈঠকখানার কথাবার্তা আরম্ভ হইল৷ শীতল ঘটক নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠিল—পোড়াকপালী আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল!

তারপর চুপ৷ অনেকক্ষণ আর কথা নেই৷

শীতল আবার বলিতে লাগিল—বুদ্ধিশ্রী ছিল মেয়েটার৷ মনে আছে কর্তাবাবু, সেই পাকাদেখা দেখতে গিয়ে আপনি বল্লেন, আমার মা নেই, একজন মাকে খুঁজতে এসেছি৷ আপনার কথা শুনে মেয়েটি কেমন হেসে ঘাড় নীচু করে রইল—

নীলমাধব গম্ভীর কণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন—থামো শীতল৷

একেবারেই কথা বন্ধ হইল, দুজনে চুপচাপ৷ আলো জ্বালিতে লাগিল৷ আর ঘরের মধ্যে বেণুধরের দুই চক্ষু জলে ভরিয়া গেল জীবনকালের মধ্যে কোনোদিন যাহাকে দেখে নাই, মৃত্যুপথবর্তিনী সেই কিশোরী মেয়ের ছোট ছোট আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলি হঠাৎ যেন মাঠ বাড়ি বাগিচা ও এত রাস্তা পার হইয়া জানালা গলিয়া অন্ধকার ঘরখানির মধ্যে তাহার পদতলে মাথা খুঁড়িয়া মরিতে লাগিল৷

তারপর কখন বেণু ঘুমাইয়া পড়িয়াছে জানালা খোলা, শেষরাতে পূর্বদিগন্তে চাঁদ উঠিয়া ঘর জ্যোৎস্নায় প্লাবিত করিয়া দিয়াছে, দিগন্তবিস্তারী ভৈরব শান্ত জ্যোৎস্নার সমুদ্রে ডুবিয়া রহিয়াছে৷ হঠাৎ তাহার ঘুম ভাঙিল৷ সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল, কি একটা ভারি অন্যায় হইয়া যাইতেছে…হঠাৎ বড় ঘুম আসিয়া পড়িয়াছিল…কে আসিয়া কতবার ডাকাডাকি করিয়া বেড়াইতেছে৷ ঘুমের আলস্য তখনো বেণুধরের সর্বাঙ্গে জড়াইয়া আছে তাহার তন্দ্রা-বিবশ মনের কল্পনা ভাসিয়া চলিল—

ঠক-ঠক-ঠক—

খিল-আঁটা কাঠের কপাটের ওপাশে দাঁড়াইয়া চুপি চুপি এখনো যে ক্ষীণ আঘাত করিতেছে বেণুধর তাহাকে স্পষ্ট দেখিতে পায়৷

হাতের চুড়িগুলি গোছার দিকে টানিয়া আনা, চুড়ি বাজিতেছে না৷ শেষ প্রহর অবধি জাগিয়া জাগিয়া তাহার শ্রান্ত দেহ আর বশ মানে না৷ চোখের কোণে কান্না জমিয়াছে৷ একটু আবদারের কথা কহিলে, একবার নাম ধরিয়া ডাকিলে এখনি কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিবে৷ ফিস-ফিস করিয়া বধূ বলিতেছে—দুয়ার খুলে দাও গো, পায়ে পড়ি—

উঠিয়া তাহাকে ডাকিয়া আনার দরকার কিন্তু মনে যতই তাড়া, দেহ আর উঠিয়া গিয়া কিছুতেই কষ্টটুকু স্বীকার করিতে রাজি নয়৷ বেণুধর দেখিতে লাগিল, বাতাস লাগিয়া গাছের উপরের লতা যেমন পড়িয়া যায়, ঝুপ করিয়া তেমনি দোরগোড়ায় বধূ পড়িয়া গেল৷ সমস্ত পিঠ ঢাকিয়া পা অবধি তাহার নিবিড় তিমিরাবৃত চুলের রাশি এলাইয়া পড়িতেছে—বেণুধর দেখিতে লাগিল৷

ক্রমে ফর্সা হইয়া আসে৷ আমবাগানের ডালে ডালে সদ্য ঘুম ভাঙা পাখির কলরব…ও ঘর হইতে কে কাশিয়া কাশিয়া উঠিতেছে…৷ দিনের আলোর সঙ্গে মানুষের গতিবিধি স্পষ্ট ও প্রখর হইতে লাগিল৷ বেণুধর উঠিয়া পড়িল৷

সকালের দিকে সুবিধামতো একটা ট্রেন আছে৷ অথচ নীলমাধব নিশ্চিন্তে পরম গম্ভীরভাবে গড়গড়া টানিতেছিলেন—

বেণু গিয়া কহিল—সাতটা বাজে—

বিনাবাক্যে নীলমাধব দু’টা টাকা বাহির করিয়া দিলেন৷ বলিলেন—চা-টা তোমরা দোকান থেকে খেয়ে নাও—

—বাড়ি যাওয়া হবে না?

—না—বলিয়া তিনি গড়গড়ার নল রাখিয়া কি কাজে বাহিরে যাইবার উদ্যোগে উঠিয়া দাঁড়াইলেন৷

বেণুধর ব্যাকুল কণ্ঠে পিছন হইতে প্রশ্ন করিল—কবে যাওয়া হবে? এখানে কতদিন থাকতে হবে আমাদের?

মুখ ফিরাইয়া নীলমাধব ছেলের মুখের দিকে চাহিলেন৷ সে মুখে কি ছিল, তিনিই জানেন—ক্ষণকাল মুখ দিয়া তাঁহার কথা সরিল না৷ শেষে আস্তে আস্তে বলিলেন—শীতল ঘটক ফিরে না এলে সে তো বলা যাচ্ছে না৷

অনতিপরেই বৃত্তান্ত জানিতে বাকি রহিল না৷ শীতল ঘটক গিয়াছে তাহিরপুরে৷ গ্রামটা নদীর আরপারে ক্রোশ খানেকের মধ্যেই৷ ওখানে কিছুদিন একটা কথাবার্তা চলিয়াছিল৷ খুব বুনিয়াদী গৃহস্থঘরের মেয়ে কিন্তু ইদানীং কৌলীন্যটুকু ছাড়া সে পক্ষের বিশেষ কিছু সম্বল নাই৷ অতএব নীলমাধব নিজেই পিছাইয়া আসিয়াছিলেন৷

বিজয়কে আড়ালে ডাকিয়া সকল আক্রোশ বেণু তাহারই উপর মিটাইল৷ কহিল—কশাই তোমরা সব!

অথচ সে একেবারেই নিরপরাধ৷ কিন্তু সে-তর্ক না করিয়া বিজয় সান্ত্বনা দিয়া কহিল—ভয় নেই ভাই, ও কিছু হবে না৷ ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে, সে কি হয় কখনো? কাকার যেমন কাণ্ড—

একটু পরেই দেখা গেল, ঘটক হাসিমুখে হন-হন করিয়া ফিরিয়া আসিতেছে৷ সামনে পাইয়া সুসংবাদটা তাহাদিগকেই সর্বাগ্রে দিল—পাকাপাকি করে এলাম ছোটবাবু—

তবু বিজয় বিশ্বাস করিতে পারিল না৷ বলিল—পাকাপাকি করে এলে কি রকম? এই ঘণ্টা দুই তিন আগে বেরুলে—কোনো খবরাখবর দেওয়া নেই, এর মধ্যে ঠিক হয়ে গেল?

শীতল সগর্বে নিজের অস্থিসার বুকের উপর একটি থাবা মারিয়া কহিল—এর নাম শীতল ঘটক, বুঝলেন বিজয়বাবু, চল্লিশ বছরের পেশা এই আমার৷ কিছুতেই রাজী হয় না—হেনো-তেনো কত কি আপত্তি! ফুসমন্ত্রে সমস্ত করে এলাম৷ বলিয়া শূন্যে মুখ তুলিয়া ফুৎকার দিয়া মন্ত্রটার স্বরূপ বুঝাইয়া দিল৷

বেণুধর কহিল—আমি বিয়ে করব না৷

শীতল অবাক হইয়া গেল৷ সে কেবল অপর দিকের কথাটাই ভাবিয়া রাখিয়াছিল৷ একবার ভাবিল, বেণুধর পরিহাস করিতেছে৷ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া এদিক ওদিক বার-দুই ঘাড় নাড়িয়া সন্দিগ্ধ সুরে বলিতে লাগিল—তাই কখনো হয় ছোটবাবু, লক্ষ্মীঠাকরুণের মতো মেয়ে…ছবি নিয়ে এসেছি, মিলিয়ে দেখুন—কালকের ও মেয়ে এর দাসীবাঁদীর যুগ্যি ছিল না৷

বেণুধর কঠোর সুরে বলিয়া উঠিল—কিন্তু আমার যা বলার বলে দিয়েছি শীতল, তুমি বাবাকে আমার হয়ে বলো—

বলিয়া আর উত্তরের অপেক্ষা না রাখিয়া সে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল৷

ক্ষণপরে তাহার ডাক পড়িল৷

নীলমাধব বলিলেন—শুনলাম, বিয়েয় তুমি অনিচ্ছুক?

বেণু মাথা হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল৷

নীলমাধব বলিতে লাগিলেন—তাহলে আমায় আত্মহত্যা করতে বল?

কোনো প্রকারে মরিয়া হইয়া বেণুধর বলিয়া উঠিল—কালকের সর্বনেশে কাণ্ডে আমার কি রকম হয়ে গেছে বাবা, আমি পাগল হয়ে যাব৷ আর কিছুদিন সময় দিন আমায়—বলিতে বলিতে তাহার স্বর কাঁপিতে লাগিল৷ এক মুহূর্ত সামলাইয়া লইয়া বলিল—মরা মানুষ আমার পিছু নিয়েছে—

ভ্রূ বাঁকাইয়া নীলমাধব ছেলের দিকে চাহিলেন৷ একটুখানি নরম হইয়া বলিতে লাগিলেন—আর এদিকের সর্বনাশটা ভাব একবার! বাড়িসুদ্ধ কুটুম্ব গিসগিস করছে— সতের গ্রাম নেমন্তন্ন৷ বউ দেখবে বলে হাঁ করে বসে আছে৷ যেমন তেমন ব্যাপার নয়, এত বড় জেদাজেদীর বিয়ে—আর চৌধুরীদের সেজকর্তা আসবেন—

অপমানের ছবিগুলি চকিতে নীলমাধবের মনের মধ্যে খেলিয়া গেল৷ চৌধুরীদের সেজকর্তা অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি, তিলার্ধ দেরী না করিয়া জপের মালা হাতে লইয়াই খড়ম খটখট করিতে করিতে সমবেদনা জানাইতে আসিবেন—আসিয়া নিতান্ত নিরীহ মুখে উচ্চকণ্ঠে এক হাট লোকের মধ্যে বৃদ্ধ অতিগোপনে জিজ্ঞাসা করিবেন, বলি ও নীলমাধব, আসল কথাটা বল দিকি, বিয়ে এবারও ভাঙল—মেয়ের কি তারা অন্য জায়গায় বিয়ে দেবে?…

ভাবিতে ভাবিতে নীলমাধব ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিলেন৷ বলিলেন, না বেণুধর—বউ না নিয়ে বাড়ি ফেরা হবে না৷ পরশুর আগে দিন নেই৷ তুমি সময় চাচ্ছিলে—বেশ তো, মাঝে এই দুটো দিন থাকল৷ এর মধ্যে নিশ্চয় মন ভালো হয়ে যাবে৷…

বারোয়ারির মাঠে যাত্রা আসিয়াছে৷ বিকাল হইতে গাওনা শুরু৷ বেণুধর সমবয়সী জন দুই তিনকে পাকড়াইয়া বলিল—চল যাই৷

বিজয় বলিল—আমার যাওয়া হবে না তো৷ বিস্তর জিনিসপত্তোর বাঁধাছাঁদা করতে হবে৷ রাত্রে ফিরে যাচ্ছি৷

—কেন?

—গ্রামে গিয়ে খবর দিতে হবে, বউভাতের তারিখ দুটোদিন পিছিয়ে গেল৷ কাকা বললেন, তুমি যাও বিজয়৷

—গাড়ি সেই কোন রাতে—আমরা থাকব বড় জোর একঘণ্টা কি দেড়ঘণ্টা—চল চল—বেণুধর ছাড়িল না৷ সকলকে ধরিয়া লইয়া গেল৷

পথের মধ্যে বিজয়কে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল—বিয়ে পরশুদিন ঠিক হল?

—হ্যাঁ—

—পরশু রাত্রে?

—তাছাড়া কি—

চুপ করিয়া খানিক কি ভাবিয়া বেণুধর করুণভাবে হাসিয়া উঠিল৷ বলিল—রাত্রি আসছে, আর আমার ভয় হচ্ছে৷ তুমি বিশ্বাস করবে না বিজয়, ঐ অপঘাতে মরা মেয়েটা কাল সমস্ত রাত আমায় জ্বালাতন করেছে—

আবার একটু স্তব্ধ থাকিয়া উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে সে বলিতে লাগিল—মরা ব্যাপারটা আর আমি বিশ্বাস করছিনে—এত সাধ-আহ্লাদ ভালোবাসা পলক ফেলতে না ফেলতে উড়িয়ে পুরিয়ে চলে যাবে৷ সে কি হতে পারে? মিছে কথা৷ এ আমার অনুমানের কথা নয় বিজয়, কাল থেকে স্পষ্ট করে জেনেছি৷

বিজয় ব্যাকুল হইয়া বলিল—তুমি এসব কথা বলো না ভাই, আমাদেরও শুনলে ভয় করে৷

—ভয় করে? তবে বলব না৷ বলিয়া বেণু টিপি টিপি হাসিতে লাগিল৷ বলিল— কিন্তু যাই বল, এই শহরে পড়ে থাকা আমাদের উচিত হয়নি—দূরে পালানো উচিত ছিল৷ এই আধক্রোশের মধ্যেই কাণ্ডটা ঘটল!

যাত্রা দেখিয়া বেণু অতিরিক্ত রকম খুশি হইল৷ ফিরিবার পথে কথায় কথায় এমন হাসি রহস্য—যেন সে মাটি দিয়া পথ চলিতেছে না৷ তখন সন্ধ্যা গড়াইয়া গিয়াছে৷ পথের উপর অজস্র কামিনী ফুল ফুটিয়াছে৷ ডালপালাসুদ্ধ তাহার অনেক ডাল ভাঙিয়া লইল৷ বলিল—খাসা গন্ধ! বিছানায় ছড়িয়ে দেব—

একজন ঠাট্টা করিয়া বলিল—ফুলশয্যার দেরী আছে হে—

—কোথায়? বলিয়া বেণু প্রচুর হাসিতে লাগিল৷ বলিল—এ পক্ষের দিন রয়েছে তো কাল৷ আর তাহিরপুরেরটার—ও বিজয়, তোমাদের নতুন সম্বন্ধের ফুলশয্যের দিন করেছে কবে?

বিজয় রীতিমতো রাগিয়া উঠিল—ফের ঐ কথা? এ পক্ষ—ও পক্ষ—বিয়ে তোমার কটা হয়েছে শুনি?

—আপাতত একটা কাল যেটা হয়ে গেল—আর একটার আশায় আছি৷ বিজয়ের কাঁধ ধরিয়া ঝাঁকি দিয়া বেণু বলিতে লাগিল—ও বিজয়, ভয় পেলে নাকি? ভয় নেই, আজ সে আসবে না৷ আজকে কালরাত্রি—বউয়ের দেখা করবার নিয়ম নেই৷

খাওয়া-দাওয়ার পর বেশ প্রফুল্লভাবে বেণুধর শুইয়া পড়িল৷ কিন্তু ঘুম আসে না৷ আলো নিভাইয়া দিল কিছুতে ঘুম আসে না৷ পাশে কোনো বাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘড়ি বাজিয়া যাইতেছে৷ চারিদিক নিশুতি৷ অনেকক্ষণ ধরিয়া ঘুমের সাধনা, কাহার উপর বড় রাগ হইতে লাগিল৷ রাগ করিয়া গায়ের কম্বল ছুঁড়িয়া ফেলিয়া কাহাকে শুনাইয়া জোরে জোরে পায়চারি করিতে লাগিল৷ খণ্ড চাঁদ ক্রমশ আমবাগানের মাথায় আসিয়া ঠেকিয়াছে৷…আবার সে ঘরে ঢুকিল! বিছানার পাশে গিয়া মনে হইল, ফোঁস করিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কে যেন কোথায় পালাইয়া গেল৷ বাতাসে বাগিচার গাছপালা খস খস করিতেছে৷ বেণুধর ভাবিতে লাগিল, নতুন কোরা কাপড় পরিয়া খস খস করিতে করিতে এক অদৃশ্যচারিণী বনপথে বাতাসে বাতাসে দ্রুতবেগে মিলাইয়া গেল৷

পরদিন তাহিরপুরের পাত্রীপক্ষ আশীর্বাদ করিতে আসিলেন৷ হাসিমুখেই আঙটি সে হাত পাতিয়া লইল৷ মনে মনে বাপের বহুদর্শিতার কথা ভাবিল৷ নীলমাধব সত্যই বলিয়াছিলেন, এই দুটোদিন সময়ের মধ্যেই তাহার মন আশ্চর্যরকম ভালো হইয়া উঠিয়াছে৷ চুরি করিয়া এক ফাঁকে বাপের ঘর হইতে পাত্রীর ছবিটা দেখিয়া আসিল৷ মেয়ে সুন্দরী বটে৷ প্রতিমার মতো নিখুঁত নিটোল গড়ন৷

সেদিন একখানা বই পড়িতে পড়িতে অনেক রাত হইয়া গেল৷ শিয়রে তেপায়ার উপর ভাবী বধূর ছবিখানি৷ ম্লান দীপালোকিত চুনকাম-খসা উঁচু দেয়াল, গম্বুজের মতো খিলান করা সেকেলে ছাত, তাহারই মধ্যে মিলনোৎকণ্ঠিত নায়ক-নায়িকার সুখ-দুঃখের সহগামী হইয়া অনেক রাত্রি পর্যন্ত সে বই পড়িতে লাগিল…একবার কি রকমে মুখ ফিরাইয়া বেণুধর স্তম্ভিত হইয়া গেল, স্পষ্ট দেখিতে পাইল, একেবারে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ—জানালার মধ্যে দিয়া হাত গলাইয়া চাঁপার কলির মতো পাঁচটি আঙুল লীলায়িত ভঙ্গিতে হাতছানি দিয়া তাহাকে ডাকিতেছে৷ ভালো করিয়া তাকাইতেই বাহিরের নিকষকালো অন্ধকারে হাত ডুবিয়া গেল৷ সে উঠিয়া জানালায় আসিল৷ আর কিছুই নাই, নৈশ বাতাসে লতাপাতা দুলিতেছে৷ সজোরে সে জানালার খিল আঁটিয়া দিল৷

আলোর জোর বাড়াইয়া দিয়া বেণুধর পাশ ফিরিয়া শুইল৷ চটা-ওঠা দেওয়ালের ওপর কালের দেবতা কত কি নক্সা আঁকিয়া গিয়াছে৷ উল্টা করা তালের গাছ…একটা মুখের আধখানা…ঝুঁটিওয়ালা অদ্ভুত আকারের জানোয়ার আর একটা কিসের টুঁটি চাপিয়া ধরিয়া আছে…ঝুলকালি ও মাকড়সাজালের বন্দীশালায় কালো কালো শিকের আড়ালে কত লোক আটক হইয়া রহিয়াছে…

চোখ বুজিয়া দেখিতে লাগিল—

অনেকদূরে মাঠের ওপারে কালো কাপড় মুড়ি দেওয়া সারি সারি মানুষ চলিয়াছে— পিঁপড়ের মতো মানুষের অনন্ত শ্রেণী৷ লোকালয়ের সীমানায় আসিয়া কে-একজন হাত উঁচু করিয়া কি বলিল৷ মুহূর্তকাল সব স্থির৷ আবার কি সংকেত হইল৷ অমনি দল ভাঙিয়া নানাজনে নানাদিকে পথ-বিপথ ঝোপজঙ্গল আনাচকানাচ না মানিয়া ছুটিতে ছুটিতে অদৃশ্য হইয়া গেল৷

এই রাত্রে আঙিনার ধূলায় কোথায় এক পরম দুঃখিনী এলাইয়া পড়িয়া থাকিয়া থাকিয়া দাপাদাপি করিতেছে—

—ওমা—মাগো আমার—ও আমার লক্ষ্মীমানিক রাজরানি মা—

অন্ধকারের আবছায়ে ছোট ঘুলঘুলির পাশে তন্বী কিশোরীটি নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া আড়ি পাতিয়া বসিয়া আছে৷ শিয়রে নতূন বধূ চুপটি করিয়া বাসর জাগে৷ বর বুঝি ঘুমাইল৷…

বেণুধর উঠিয়া বসিয়া পরম স্নেহে স্মিতমুখে শিয়রে তেপায়ার উপরের ছবিখানির দিকে তাকাইল৷ কাল সারা রাত্রি তাহারা জাগিয়া কাটাইবে৷

রুদ্ধ জানালায় মৃদু মৃদু করাঘাত শুনিয়া চমকিয়া উঠিল৷ শুনিতে পাইল, ভয়ার্ত চাপা গলায় ডাকিয়া ডাকিয়া কে যেন কি বলিতেছে৷ একটি অসহায় প্রীতিমতী বালিকা বাপ মা ও চেনা-জানা সকল আত্মীয় পরিজন ছাড়িয়া আসিয়া জানালার বাহিরে পাগল হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে৷ আজ বেণুধর তিলার্ধ দেরী করিল না দুয়ার খুলিয়া দেখে, ইতিমধ্যে বাতাস বাড়িয়া ঝড় বহিতে শুরু হইয়াছে৷ সন সন করিয়া ঝড় দালানের গায়ে পাক খাইয়া যাইতেছে৷

—এসো—

—উঁহু—

—এসো—

—না৷

বাতাসে দড়াম করিয়া দরজা বন্ধ হইয়া গেল৷ বেণুধর নির্নিরীক্ষে অন্ধকারের মধ্যে পলায়নপরার পিছনে পিছনে ছুটিল৷ ঝোড়ো হাওয়ায় কথা না ফুটিতে কথা উড়াইয়া লইয়া যায় তবু সে যুক্তকরে বারম্বার এক অভিমানিনীর উদ্দেশে কহিতে লাগিল—মিছে কথা, আমি বিয়ে করব না আমি যাব না কাল৷ তুমি এসো—ফিরে এসো—

নিশীথ রাত্রি৷ মেঘভরা আকাশে বিদ্যুৎ চমকাইতেছে৷ ভৈরবের বুকেও যেন প্রলয়ের জোয়ার লাগিয়াছে৷ ডাক ছাড়িয়া কূল ছাপাইয়া জল ছুটিয়াছে৷ বেণুধর নদীর কূলে কূলে ডাকিয়া বেড়াইতে লাগিল৷ মৃত্যু ও জীবনের সীমারেখা এই পরম মুহূর্তে প্রলয়-তরঙ্গে লেপিয়া মুছিয়া গিয়াছে৷ পৃথিবীতে এই ক্ষণ প্রতিদিন আসিয়া থাকে৷ দিনের অবসানে সন্ধ্যা—তারপর রাত্রি—পলে পলে রাত্রির বক্ষস্পন্দন বাড়ে—তারপর অনেক— অনেকক্ষণ পরে মধ্য আকাশ হইতে একটি নক্ষত্র বিদ্যুৎগতিতে খসিয়া পড়ে, ঝনঝন করিয়া মৃত্যুপুরীর সিংহদ্বার খুলিয়া যায়, পৃথিবীর মানুষের শিয়রে ওপারের লোক দলে দলে আসিয়া বসে, ভালোবাসে, আদর করে, স্বপ্নের মধ্য দিয়া কত কথা কহিয়া যায়—

আজ স্বপ্নলোকের মধ্যে নয়, জাগ্রত দুই চক্ষু দিয়া মৃত্যুলোকবাসিনীকে সে দেখিতে পাইয়াছে৷ দুটি হাত নিবিড় করিয়া ধরিয়া তাহাকে ফিরাইয়া আনিবে৷ দিগন্তব্যাপ্ত মেঘবরণ চুলের উপর ডগমগে লাল কয়েকটি রক্তবিন্দু প্রলয়ান্ধকারের মধ্যে আলেয়ার মতো বেণুধরকে দূর হইতে দূরে ছুটাইয়া লইয়া চলিল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *