1 of 2

লাল চুল – মনোজ বসু

লাল চুল – মনোজ বসু

ছ’মাস ধরিয়া বিয়ের দিন সাব্যস্ত হয় না। তারপর দিন ঠিক হইল তো গোল বাধিল জায়গা লইয়া। মোটে তখন দিন পনেরো বাকি, হঠাৎ নীলমাধবের চিঠি আসিল—কাজিডাঙা অবধি যাওয়া কিছুতেই হইতে পারে না, তাঁহারা বড়জোর খুলনায় আসিয়া শুভকর্ম করিয়া যাইতে পারেন।

বিয়ের ঘটক শীতলচন্দ্র বিশ্বাস; চিঠি লইয়া সে-ই আসিয়াছিল। ভিড় সরিয়া গেলে আসল কারণটা সে শেষকালে ব্যক্ত করিল। প্রতিপক্ষ চৌধুরীদের সীমানা কাজিডাঙার ক্রোশ তিনেকের মধ্যে। বলা তো যায় না, তিন ক্রোশ দূর হইতে কয়েক শত লাঠিও যদি আচমকা বিয়ের নিমন্ত্রণে চলিয়া আসে! তাহারা বরাসন হইতে বর তুলিয়া রাত্রির অন্ধকারে গাঙ পাড়ি দিয়া বসিলে অজ পাড়াগাঁয়ে জলজঙ্গলের মধ্যে কেবল নিজেদের হাত কামড়ান ছাড়া আর কিছু থাকিবে না।

পাত্র জমিদারের ছেলে; জমিদারের ছেলে ওই একটি মাত্র। অতএব এই ছ’মাস ধরিয়া যে জমিদার-বাড়িতে শুভকর্মের গুরুতর আয়োজন চলিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। সেই আয়োজনের সত্যকার চেহারাটা সহসা উপলব্ধি করিয়া আনন্দে মেয়ের বাপের হৃদকম্প উপস্থিত হইল। অথচ মিনুর মা আড় হইয়া পড়িলেন। —ওই তেইশে মেয়ের বিয়ে আমি দেবই—বারবার এইরকম গোছগাছ করে শেষকালে যে—না হয় তুমি সেই বি-এ ফেল ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ ঠিক করে ফেল……

কিন্তু অতবড় ঘর ও বরের লোভ ছাড়া সোজা কথা নয়। শেষ পর্যন্ত আবশ্যকও হইল না। শহরের প্রান্ত সীমায় ভৈরব নদীর ধারে সেরেস্তাদারবাবুর এক নূতন বাড়ি তুলিতেছিলেন। বাড়িটা তিনি কয়েকদিনের জন্যে ছাড়িয়া দিতে রাজী হইলেন। সামনের ফাঁকা জমির ইট কাঠ সরাইয়া সেখানে সামিয়ানা খাটাইয়া বরযাত্ৰ বসিবার জায়গা হইল। পিছনে খাওয়ার জায়গা। যদি দৈবাৎ বৃষ্টি চাপিয়া পড়ে তাহা হইলে দোতলার দরদালানে সত্তর-আশিজন করিয়া বসাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে।

বিকালে পাঁচখানা গরুর গাড়ি বোঝাই আরও অনেক আত্মীয় কুটুম্ব আসিয়া পড়িল। লগ্ন সাড়ে আটটায়।

রানী বলিল, মাসিমা, হিরণের বিয়ের বেলায় আপনি বড় অন্যায় করেছিলেন। সবাইকে তাড়িয়ে দিয়ে আপনি যে জামাই নিয়ে খাওয়াতে বসবেন—সে হবে না কিন্তু—

মিনুর মা হাসিলেন।

না, সে হবে না, মাসিমা। আমরা সমস্ত রাত বাসর জাগব, কোন কথা শুনব না, বলে দিচ্ছি। নয় তো বলুন, এক্ষুনি ফের গাড়িতে গিয়ে উঠে বসি।

রসুই ঘরের দিকে হঠাৎ তুমুল গণ্ডগোল। বেড়ার ওপর কে জ্বলন্ত কাঠ ঠেক দিয়া রাখিয়াছিল, একটা অগ্নিকাণ্ড হইতে বাঁচিয়া গিয়াছে। সকলের বিশ্বাস, কাজটা বামুন ঠাকুরের; তাই রাগ করিয়া কে তার গাঁজার কলিকা ভাঙিয়া দিয়াছে। পৈতা হাতে বারম্বার ব্রাহ্মণ সন্তান দিব্য করিতেছিল—বিনা অপরাধে তাহার গুরুদণ্ড হইয়া গেল, অগ্নিকাণ্ডে কলিকার দোষ নাই। তিনদিনের মধ্যে সে কলিকা একেবারে হাতে লয় নাই।

বেলা ডুবিয়া যাইতে শীতল ঘটক আসিয়া উঠানে দাঁড়াইল, খবর কি? খবর কি?

শীতল কহিল, খবর ভাল। বর, বরযাত্রী সব ওদের বাসাবাড়ি পৌঁছে গেছেন। জজবাবুর বড় মোটর এনে সাজান হচ্ছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে এসে পড়বেন।

তারপর হাসিয়া গলা খাটো করিয়া কহিতে লাগিল, একশ’ বরকন্দাজ গাঙের ঘাট আগলাচ্ছে। কি জানি, কিছু বলা যায় না। আমাদের কর্তাবাবু একবিন্দু খুঁত রেখে কাজ করেন না।

মোটরের আওয়াজ উঠিতেই ধুপধাপ করিয়া আটদশটা মেয়ে ছুটিল তেতলার ছাতে। সকলের পিছন হইতে নিরু বলিল, যাওয়া ভাই, অনর্থক। ছাত থেকে কিচ্ছু দেখা যাবে না। তার চেয়ে গোলকুঠুরির জানলা দিয়ে—

কৌতূহল চোখমুখ দিয়া যেন ছিটকাইয়া পড়িতেছে; ঠাট্টাতামাসা—ছুটাছুটি—মাঝে মাঝে হাসির তরঙ্গ; তার মধ্যে যুক্তি বিবেচনার কথা কে শুনিবে?

রানী সকলের আগেভাগে ঝুঁকিয়া পড়িয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে আঙুল দিয়া দেখাইল, ওই, ওই—বর—দেখ—

মরবি যে এক্ষুনি পড়ে—হাতের এখনো আলসে হয়নি দেখেছিস? বলিয়া আর একটি মেয়ে রানীকে পিছে ঠেলিয়া নিজে আগে আসিল। যেন সে মোটেই পড়িতে পারে না। জিজ্ঞাসা করিল, কই? ও রানী, বর দেখলি কোন দিকে।

গলায় ফুলের মালা—ওই যে। দেখতে পাও না—তুমি যেন কি রকম সেজদি!

সেজদি বলিল—মালা না তোর মুণ্ডু। ও যে এক বুড়ো—সাদা চাদর কাঁধে। ত্থুত্থুরসে মাগো, তিন কালের বুড়ো—ও বরের ঠাকুরদাদা। বর এতক্ষণে কোনকালে আসনে গিয়ে বসেছে—

ছাতের উপর হইতে বরাসন নজর চলে না, দেখা যায় কেবল সামিয়ানা। নিরু বলিল, বলেছি তো অনর্থক। তার চেয়ে নিচে গোলকুঠরির জানলা দিয়ে দেখিগে চল।

চল, চল—

অন্ধকারে নদী মৃদুতম গানের সুর তুলিয়া বহিয়া যাইতেছে। ওপারেও যেন কিসের উৎসব—অনেকগুলো আলো, ঢাকের বাজনা…। সহসা এক ঝলক স্নিগ্ধ বাতাস উহাদের রঙিন শাড়ি, কেশ-বেশের সুগন্ধ উচ্ছল কলহাস্যের টুকরাগুলি উড়াইয়া ছড়াইয়া বহিয়া গেল।

ঘুমিয়ে কে রে? মিনু? ওমা মাগো, যার বিয়ে তার মনে নেই; পালিয়ে এসে চিলে কোঠায় ঘুমোনো হচ্ছে!

রানী হাত ধরিয়া নাড়া দিতে মিনু একবার চাহিয়া চোখ বুজিল।

নিরু বলিল, আহা, সারাদিন না খেয়ে নেতিয়ে পড়েছে। ঘুমোক না একটু—আমরা নিচে যাই—

সেজদি ঝঙ্কার দিয়া উঠিল, গিন্নীপনা রাখ দিকি। আমরাও না খেয়ে ছিলাম একদিন। ঘুমোনোর দফা শেষ আজকের দিন থেকে। কি বলিস রে রানী।

বিশেষ করিয়া রানীকেই জিজ্ঞাসা করিবার একটা অর্থ আছে। কথাটা গোপনীয়, কেবল সেজদি আড়ি দিতে গিয়া দৈবাৎ জানিয়া ফেলিয়াছিল। রানী মুখ টিপিয়া হাসিল। দুই হাতে ঘুমন্ত মিনুর গলা জড়াইয়া ধরিয়া চুমো খাইয়া বলিতে লাগিল, মিনু ভাই, জাগো—আজকে ঘুমোতে আছে? উঠে বর দেখবে এস। তারপর মিনুর এলো চুলে হাত পড়িতে যেন শিহরিয়া উঠিল, দেখেছ? সন্ধ্যাবেলায় আবার নেয়ে মরেছে হতভাগী। শুয়ে শুয়ে চুল শুকনো হচ্ছে। ভিজে চুল নিয়ে এখন উপায়? এই রাশ বাঁধতে কি সময় লাগবে কম? নিচে উলুধ্বনি উঠিল। পিসিমা, নন্দরাণী, শুভা ওদের সব গলা।

চল—চল—

চুল বাঁধতে হবে—ওঠ মিনু, শিগগির উঠে আয়। —বলিয়া মিনুর এলোচুল ধরিয়া জোরে একটান দিয়া রানী ছুটিয়া দলে মিশিল। সিঁড়িতে আবার সমবেত পদধ্বনি।

ধড়মড় করিয়া মিনু উঠিয়া বসিল। তখন রানীরা নামিয়া গিয়াছে, হাতে কেহ নাই। ঘুমচোখে ভাবিল এটা যেন তাদের কাজিডাঙার বাড়ির দক্ষিণের চাতাল। আকাশ ভরিয়া তারা উঠিয়াছে; ছাতে ঝাপসা ঝাপসা আলল, ওদিকে ভয়ানক গণ্ডগোল উঠিতেছে। …সব কথা মিনুর মনে পড়িল—আজ তার বিয়ে, সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, সকলে ডাকাডাকি লাগাইয়াছে…। হঠাৎ নিচের দিকে কোথায় দপ করিয়া সুতীব্র আলো জ্বলিয়া অনেকখানি রশ্মি আসিয়া পড়িল হাতের উপর। তাড়াতাড়ি আগাইয়া গিয়া সিঁড়ি ভাবিয়া যেই সে পা নামাইয়া দিয়াছে—

চারিদিকে তুমুল হৈ হৈ পড়িয়া গেল। আসর ভাঙিয়া সকলে ছুটিল। হারমোনিয়াম বাজাইয়া গান চলিতেছিল, পায়ের আঘাতে আঘাতে সেটা যে কোথায় চলিয়া গেল তার ঠিকানা রহিল না। একেবারে একতলার বারান্দায় পড়িয়া মিনু নিশ্চেতন। —জল, জল…মোটর আনো, ভিড় করবেন না মশাই, সরুন—ফাঁক করে দিন…আহা-হা কি কর, মোটরে তোল শিগগির। গামছা কাঁধে কোন দিকে হইতে কন্যার বাপ ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া আছাড় খাইয়া পড়িলেন।

জজবাবুর সেই মোটরে চড়িয়া মিনু হাসপাতালে চলিল। বড় রাস্তায় রশি দুই পথ গিয়া মোটর ফিরিয়া আসিল, আর যাইতে হইল না।

রসুন-চৌকি থামিয়া গিয়াছে। দরজার পুবদিকে ছোট লাল চাদরের নিচে চারিটা কলাগাছ পুঁতিয়া বিয়ের জায়গা হইয়াছিল। সেইখানে শব নামাইয়া রাখা হইল। কাঁচা হলুদের মত গায়ের রঙ, তার উপর নূতন গহনা পরিয়া যেন রাজরাজেশ্বরী হইয়া শুইয়া আছে। কনে-চন্দন আঁকা শুভ্র কপাল ফাটিয়া চাপ চাপ জমা রক্ত লেপিয়া রহিয়াছে, নাক ও গালের পাশে রক্ত গড়াইয়াছে—মেঘের মত খোলা চুলের রাশি এখানে সেখানে রক্তের ছোপে ডগমগে লাল।

ভিতরে-বাহিরে নিদারুণ স্তব্ধতা—বাড়িতে যেন একটা লোক নাই। শবের মাথার উপরে একটি থরজ্যোতি গ্যাস জ্বালিতেছে। বাড়ির মধ্যে স্তব্ধতা চিরিয়া হঠাৎ একবার আর্তনাদ আসিল—ওমা, ও মাগো আমার—ও আমার লক্ষ্মীমানিক রাজরানী মা—

নীলমাধব সকলের দিকে চাহিয়া ধমক দিয়া উঠিলেন, হাত পা গুটিয়ে বসে আছ যে—

বরশয্যার প্রকাণ্ড মেহাগ্নি-পালিশ খাট কজনে টানিয়া নামাইয়া আনিল।

এতক্ষণ বেণুধরকে লক্ষ্য হয় নাই। এইবার ভিড় ঠেলিয়া আসিয়া শবের পায়ের কাছে খাটের বাজুতে ভর দিয়া সে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইল। হাতের মধ্যে কাজললতা তেমনি ধরা আছে। কাচের মত স্বচ্ছ অচঞ্চল আধ-নিমীলিত দুটি দৃষ্টি, মৃতার সেই স্তিমিত চোখ দুটির দিকে নিপলক চাহিয়া চাহিয়া বেণুধর দাঁড়াইয়া রহিল।

বাপ ঝুঁকিয়া পড়িয়া পাগলের মত আর্তনাদ করিয়া উঠিলেন, একবার ভাল করে চা দিকি…চোখ তুলে চা—ও খুকী…

নীলমাধব ছুটিয়া আসিয়া তাঁহার হাত ধরিয়া ফেলিলেন। কিন্তু তিনি থামিলেন না, সজল চোখে বারবার বলিতে লাগিলেন, ও বেয়াই, বিনি দোষে মাকে আমার কত গালমন্দ দিয়েছি—কোন সম্বন্ধ এগুতে চায় না, তার সমস্ত অপরাধ দিনরাত মা ঘাড় পেতে নিয়েছে, একবার মুখ তুলে একটা কথাও কয়নি। ও খুকী, আর বকব না—চোখ তুলে চা’ একবার—

ভিড় জমিয়া গিয়াছিল। নীলমাধব ক্রুদ্ধকণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিলেন, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে তোমরা? আটটা বেজে গেছে রওনা হও।

সাড়ে আটটায় লগ্ন ছিল—বেণুধরের বুকের মধ্যে কাঁপিয়া উঠিল, যেন শুভ লগ্নে তাহাদের শুভদৃষ্টি হইতেছে, লজ্জানত বালিকা চোখ তুলিয়া চাহিতে পারিতেছে না, বাপ তাই মেয়েকে সাহস দিতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। …ফুল ও দেবদারু-পাতা দিয়া গেট হইয়াছিল, সমস্ত ফুল ছিঁড়িয়া আনিয়া সকলে শবের উপর ঢালিয়া দিল। বেণুধর গলার মালা ছিঁড়িয়া সেই ফুলের গাদায় ছুড়িয়া দ্রুতবেগে ভিড়ের মধ্য দিয়া পালাইয়া গেল।

ছুটিতে ছুটিতে রাস্তা অবধি আসিল; সর্বাঙ্গ দিয়া ঘামের ধারা বহিতেছে, পা টলিতেছে, নিশ্বাস বন্ধ হইয়া যাইতেছে। মোটরের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া উন্মত্তের মত সে বলিয়া উঠিল—চালাও এক্ষুনি—

গাড়ি চলিতে লাগিলে হুঁশ হইল, তখনো আগাগোড়া তাহার বরের সাজ, একবোঝ কোট কামিজ, তার উপর সৌখীন ফুলকাটা চাদর—বিয়ের উপলক্ষে পছন্দ করিয়া সমস্ত কেনা। একটা একটা করিয়া খুলিয়া পাশে সমস্ত স্তূপাকার করিতে লাগিল। তবু কি অসহ্য গরম। বেণুর মনে হইল, সর্বদেহ ফুলিয়া ফাটিয়া এবার বুঝি ঘামের বদলে রক্ত বাহির হইবে। ক্রমাগত বলিতে লাগিল, চালাও—খুব জোরে চালাও গাড়ি—

সোফার জিজ্ঞাসা করিল, কোথায়?

যেখানে খুশি। ফাঁকায়—গ্রামের দিকে—

তীর বেগে গাড়ি ছুটিঁল। চোখ বুজিয়া চেতনাহীনের মত বেণুধর পড়িয়া রহিল।

সুমুখ-আধাঁর রাত্রি, তার উপর মেঘ করিয়া আরও আঁধার জমিয়াছে। জনবিরল পথের উপর মিটমিটে কেরোসিনের আলো যেন প্রেতপুরীর পাহারাদার। একবার চোখ চাহিয়া বাহিরের দিকে তাকাইয়া বেণুধর শিহরিয়া উঠিল, এমন নিবিড় অন্ধকার সে জীবনে দেখে নাই। দুধারের বাড়িগুলির দরজা-জানলা বন্ধ, ছোট শহর ইতিমধ্যেই নিশুতি হইয়া উঠিয়াছে। মধ্যে আম কাঁঠালের বড় বড় বাগিচা। …সহসা কোথায় কোন দিক দিয়া উচ্ছ্বল হাসির শব্দ ভাসিয়া আসিল, অতি মৃদু অস্পষ্ট কৌতুক-চঞ্চল অনেকগুলো কণ্ঠস্বর—বউ দেখিয়ে যাও, বউ দেখিয়ে যাও গো—

আশপাশের সারি সারি ঘুমন্ত বাড়িগুলির ছাদের উপর, আমবাগিচার এখানে সেখানে, ল্যাম্পপোস্টের আবছায়ে নানা বয়সের কত মেয়ে কৌতূহল-ভরা চোখে ভিড় করিয়া বউ দেখিতে দাঁড়াইয়া আছে।

তারপর গাড়ির মধ্যে দৃষ্টি ফিরাইয়া এক পলকে যেন তাহার গায়ে কাঁটা দিয়া উঠিল। বধু তাহার পাশে রহিয়াছে, সত্যই একটা বউ মানুষ ঘোমটার মধ্যে জড়সড় হইয়া মাথা নোয়াইয়া একেবারে গদির সঙ্গে মিশিয়া বসিয়া আছে, গায়ে ছোঁয়া লাগিলে যেন সে লজ্জায় মরিয়া যাইবে। তারপর খেয়াল হইল, সে তার পরিত্যক্ত জামা-চাদরের বোঝা, মানবী নয়। এই গাড়িতেই মেয়েটিকে হাসপাতালে লইয়া চলিয়াছিল; সে বসিয়া নাই, তার দেহের দু-এক ফোঁটা রক্ত হয়তো গাড়ির গদিতে লাগিয়া থাকিতে পারে।

শহর ছাড়িয়া নদীর ধারে ধারে গাড়ি ক্রমে মাঠের মধ্যে আসিল। হেডলাইট জ্বালিয়া গাড়ি ছুটিতেছে; চারিদিকে নিঃশব্দতাকে পিষিয়া ভাঙিয়া চুরিয়া খোয়া-তোলা রাস্তার উপর চাকার পেষণে কর্কশ সুকরুণ আর্তনাদ উঠিতেছে। একটি পল্লীকিশোরীর এইদিনকার সকল সাধ-বাসনা বেণুধরের বুকের মধ্যে কাঁদিয়া বেড়াইতে লাগিল। চাকার সামনে সে যেন বুক পাতিয়া দিয়াছে। বাহিরে ঘন তিমিরাচ্ছন্ন রাত্রি—জনশূন্য মাঠ—কোনদিকে আলোর কণিকা নাই। সৃষ্টির আদি যুগের অন্ধকারলিপ্ত নীহারিকামণ্ডলীর মধ্য দিয়া বেণুধর যেন বিদ্যুতের গতিতে ছুটিয়া বেড়াইতেছে, আর পাশে পাশে পাল্লা দিয়া ছুটিয়া মরিতেছে নিঃশব্দচারিণী মৃতরূপা তার বধূ। লাল বেনারসীতে রূপের রাশি মুড়িয়া লজ্জায় ভাঙিয়া শতখান হইয়া এখানে এক কোণে তার বসিবার স্থান ছিল, কিন্তু একটি মুহূর্তের ঘটনার পরে এখন তার স্থান হইয়াছে সীমাহীন আশ্রয়হীন বিপুল শূন্যতায়—রাত্রির অন্ধকার মথিত করিয়া বাতাসের বেগে ফরফর শব্দে তার পরনের কালো কাপড় উড়ে, পায়ের আঘাতে জোনাকি ছিটকাইয়া যায়, গতির বেগে সামনে ঝুঁকিয়া-পড়া ঘন চুল ভরা মাথাটি—মাথার চারিপাশ দিয়া রক্তের ধারা গড়াইয়া গড়াইয়া বৃষ্টি বহিয়া যায়, এলো চুল উড়ে—দিগন্তব্যাপী ডগমগে লাল চুল।

দুই হাতে মাথা টিপিয়া চোখ বুজিয়া বেণুধর পড়িয়া রহিল। গাড়ি চলিতে লাগিল। খানিক পরে পথের ধারে এক বটতলায় থামিয়া হাটুরে চালার মধ্যে বাঁশের মাচায় অনেকক্ষণ মুখ গুঁজিয়া পড়িয়া থাকিয়া অবশেষে মন কিছু শান্ত হইলে বাসাবাড়িতে ফিরিয়া আসিল।

নীলমাধব প্রভৃতি অনেকক্ষণ আসিয়াছেন। বরযাত্রীর অনেকে মেল ট্রেন ধরিতে সোজা স্টেশনে গিয়াছে। কেবল কয়েকজন মাত্র—যাহারা খুব নিকট আত্মীয় বৈঠকখানার পাশের ঘরে বালিশ কাঁথা পুঁটুলি বই যা হয় একটা কিছু মাথায় দিয়া যে যার মত শুইয়া পড়িয়াছেন। অনেক রাত্রি। হেরিকেনের আলো মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছে। আলোর সামনে ঠিক মুখোমুখি নিবকি নিস্তব্ধ গম্ভীর মুখে বসিয়া নীলমাধব ও শীতল ঘটক।

বেণুকে দেখিয়া নীলমাধব উঠিয়া আসিলেন। বলিলেন, কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লে—মোটর নিয়ে গিয়েছ শুনে ভাবলাম, বাসাতেই এসেছ। এখানে এসে দেখি তাও নয়। ভারি ব্যস্ত হয়েছিলাম। জজ বাবু বাড়িতে বিজয় গিয়ে বসে আছে এখনো।

বেণুধর বলিল, বড্ড মাথা ধরল, ফাঁকায় তাই খানিকটে ঘুরে এলাম—

বলে যাওয়া উচিত ছিল—। বলিয়া নীলমাধব চুপ করিলেন।

ছেলে নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া পুনরায় বলিলেন, তোমার খাওয়া হয়নি। দক্ষিণের কোঠায় খাবার-ঢাকা আছে, বিছানা করা আছে, খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়—রাত জাগবার দরকার নেই।

ঘরে গিয়া নীলমাধবের ভয়ে ঢাকা খুলিয়া খাবার খানিকটা সে নাড়াচাড়া করিল; মুখে তুলিতে পারিল না।

দালানের পিছনে কোথায় কি ফুল ফুটিয়াছে, একটা উগ্র মিষ্টগন্ধের আমেজ। মিটমিটে আলোয় রহস্যাচ্ছন্ন আধ-অন্ধকারে চারিদিক চাহিয়া চাহিয়া মনে হইল, ঘর ভরিয়া কে একজন বসিয়া আছে, তাহাকে ধরিবার জো নাই—অথচ তাহার স্নিগ্ধ লাবণ্য বন্যার মত ঘর ছাপাইয়া যাইতেছে; কোণের দিকে দলিল-পত্র ভরা সেকেলে বড় ছাপবাক্সের আবডালে নিবিড় কালো বড় বড় চোখদুটি অভুক্ত খাবারের দিকে বেদনাহত ভাবে চাহিয়া নীরব দৃষ্টিতে তাহাকে সাধাসাধি করিতেছে। আলো নিভাইতেই সেই দেহাতীত ইন্দ্রিয়াতীত সৌন্দর্য তকস্মাৎ বেণুধরকে কঠিন ভাবে বেষ্টন করিয়া ধরিল।…

বাহিরের বৈঠকখানায় কথাবার্তা আরম্ভ হইল। শীতল ঘটক নিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠিল, পোড়াকপালী আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল।

তারপর চুপ। অনেকক্ষণ আর কথা নাই।

শীতল আবার বলিতে লাগিল, বুদ্ধি শ্রী ছিল মেয়েটার। মনে আছে কর্তাবাবু, সেই পাকা দেখা দেখতে গিয়ে আপনি বললেন, আমার মা নেই, একজন মাকে খুঁজতে এসেছি। আপনার কথা শুনে মেয়েটি কেমন হেসে ঘাড় নিচু করে রইল—

নীলমাধব গম্ভীর কণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, থামো শীতল!

একেবারেই কথা বন্ধ হইল, দুজনে চুপচাপ। আলো জ্বলিতে লাগিল। আর ঘরের মধ্যে বেণুধরের দুই চক্ষু জলে ভরিয়া গেল; জীবনকালের মধ্যে কোনদিন যাহাকে দেখে নাই, মৃত্যুপথবর্তিনী সেই কিশোরী মেয়ের ছোট ছোট আশা আকাঙ্ক্ষাগুলি হঠাৎ যেন মাঠ বাড়ি বাগিচা ও এত রাস্তা পার হইয়া জানালা গলিয়া অন্ধকার ঘরখানির মধ্যে তাহার পদতলে মাথা খুঁড়িয়া মরিতে লাগিল।

তারপর কখন বেণু ঘুমাইয়া পড়িয়াছে; জানালা খোলা, শেষরাতে পূর্বদিগন্তে চাঁদ উঠিয়া ঘর জ্যোৎস্নায় প্লাবিত করিয়া দিয়াছে, দিগন্তবিসারী ভৈরব শান্ত জ্যোৎস্নার সমুদ্রে ডুবিয়া রহিয়াছে। হঠাৎ তাহার ঘুম ভাঙিল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল, কি একটা ভারি অন্যায় হইয়া যাইতেছে…হঠাৎ বড় ঘুম আসিয়া পড়িয়াছিল…কে আসিয়া কতবার ডাকাডাকি করিয়া বেড়াইতেছে। ঘুমের আলস্য তখনও বেণুধরের সর্বাঙ্গে জড়াইয়া আছে; তাহার তন্দ্রা-বিবশ মনের কল্পনা ভাসিয়া চলিল—

ঠক-ঠক্‌-ঠক্—

খিল-আঁটা কাঠের কপাটের ওপাশে দাঁড়াইয়া চুপি চুপি এখনো যে ক্ষীণ আঘাত করিতেছে বেণুধর তাহাকে স্পষ্ট দেখিতে পায়।

হাতের চুড়িগুলি গোছার দিকে টানিয়া আনা, চুড়ি বাজিতেছে না। শেষ প্রহর অবধি জাগিয়া জাগিয়া তাহার শ্রান্ত দেহ আর বশ মানে না। চোখের কোণে কান্না জমিয়াছে। একটু আবদারের কথা কহিলে, একবার নাম ধরিয়া ডাকিলে এখনি কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিবে। ফিসফিস করিয়া বধূ বলিতেছে, দুয়ার খুলে দাও গো, পায়ে পড়ি—

উঠিয়া তাহাকে ডাকিয়া আনার দরকার; কিন্তু মনে যতই তাড়া, দেহ আর উঠিয়া গিয়া কিছুতেই কষ্টটুকু স্বীকার করিতে রাজী নয়। বেণুধর দেখিতে লাগিল, বাতাস লাগিয়া গাছের উপরের লতা যেমন পড়িয়া যায়, ঝুপ করিয়া তেমনি দোর গোড়ায় বধূ পড়িয়া গেল। সমস্ত পিঠ ঢাকিয়া পা অবধি তাহার নিবিড় তিমিরাবৃত চুলের রাশি এলাইয়া পড়িতেছে—বেণুধর দেখিতে লাগিল।

ক্রমে ফর্সা হইয়া আসে। আম বাগানের ডালে ডালে সদ্য ঘুম ভাঙা পাখির কলবর…ও ঘর হইতে কে কাশিয়া কাশিয়া উঠিতেছে…। দিনের আলোর সঙ্গে মানুষের গতিবিধি স্পষ্ট ও প্রখর হইতে লাগিল। বেণুধর উঠিয়া পড়িল।

সকালের দিকে সুবিধা মত একটা ট্রেন আছে। অথচ নীলমাধব নিশ্চিন্তে পরম গম্ভীরভাবে গড়গড়া টানিতেছিলেন।

বেণু গিয়া কহিল, সাতটা বাজে—

বিনাবাক্যে নীলমাধব দু’টা টাকা বাহির করিয়া দিলেন। বলিলেন, চা-টা তোমরা দোকান থেকে খেয়ে নাও—

বাড়ি যাওয়া হবে না?

না—। বলিয়া তিনি গড়গড়ার নল রাখিয়া কি কাজে বাহিরে যাইবার উদ্যোগে উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

বেণুধর ব্যাকুল কণ্ঠে পিছন হইতে প্রশ্ন করিল, কবে যাওয়া হবে? এখানে কতদিন থাকতে হবে আমাদের?

মুখ ফিরাইয়া নীলমাধব ছেলের মুখের দিকে চাহিলেন। সে মুখে কি ছিল, তিনিই জানেন—ক্ষণকাল মুখ দিয়া তাঁহার কথা সরিল না। শেষে আস্তে আস্তে বলিলেন, শীতল ঘটক ফিরে না এলে সে তো বলা যাচ্ছে না।

অনতি পরেই বৃত্তান্ত জানিতে বাকি রহিল না। শীতল ঘটক গিয়াছে তাহিরপুরে। গ্রামটা নদীর আর পারে ক্রোশ খানেকের মধ্যেই। ওখানে কিছুদিন একটা কথাবার্তা চলিয়াছিল। খুব বুনিয়াদী গৃহস্থ ঘরের মেয়ে; কিন্তু ইদানীং কৌলিন্যটুকু ছাড়া সে পক্ষের বিশেষ কিছু সম্বল নাই। অতএব নীলমাধব নিজেই পিছাইয়া আসিয়াছিলেন।

বিজয়কে আড়ালে ডাকিয়া সকল আক্রোশ বেণু অহারই উপর মিটাইল। কহিল, কশাই তোমরা সব!

অথচ সে একেবারেই নিরপরাধ। কিন্তু সে-তর্ক না করিয়া বিজয় সান্ত্বনা দিয়া কহিল, ভয় নেই ভাই, ও কিছু হবে না। ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে, সে কি হয় কখনো? কাকার যেমন কাণ্ড—

একটু পরেই দেখা গেল, ঘটক হাসিমুখে হনহন করিয়া ফিরিয়া আসিতেছে। সামনে পাইয়া সুসংবাদটা তাহাদিগকেই সর্বাগ্রে দিল, পাকাপাকি করে এলাম ছোটবাবু—

তবু বিজয় বিশ্বাস করিতে পারিল না। বলিল, পাকাপাকি করে এলে কি রকম? এই ঘন্টা দুই তিন আগে বেরুলে—কোন খবরাখবর দেওয়া নেই। এর মধ্যে ঠিক হয়ে গেল?

শীতল সগর্বে নিজের অস্থিসার বুকের উপর একটি থাবা মারিয়া কহিল, এর নাম শীতল ঘটক, বুঝলেন বিজয়বাবু, চল্লিশ বছরের পেশা এই আমার। কিছুতেই রাজী হয় না—হেনো তেনো কত কি আপত্তি। ফুসমন্ত্রে সমস্ত জল করে দিয়ে এলাম। —বলিয়া শূন্যে মুখ তুলিয়া ফুৎকার দিয়া মন্ত্রটার স্বরূপ বুঝাইয়া দিল।

বেণুধর কহিল, আমি বিয়ে করব না।

শীতল অবাক হইয়া গেল। সে কেবল অপর দিকের কথাটাই ভাবিয়া রাখিয়াছিল। একবার ভাবিল, বেণুধর পরিহাস করিতেছে। তাহার মুখের দিকে চাহিয়া এদিক ওদিক বার দুই ঘাড় নাড়িয়া সন্দিগ্ধ সুরে বলিতে লাগিল, তাই কখনো হয় ছোটবাবু, লক্ষ্মী ঠাকরুণের মত মেয়ে…ছবি নিয়ে এসেছি, মিলিয়ে দেখুন—কালকের ও মেয়ে এর দাসী বাঁদির যুগ্যি ছিল না।

বেণুধর কঠোর সুরে বলিয়া উঠিল, কিন্তু আমি যা বলার বলে দিয়েছি শীতল, তুমি বাবাকে আমার হয়ে বলো—

বলিয়া আর উত্তরের অপেক্ষা না রাখিয়া সে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল।

ক্ষণপরে তাহার ডাক পড়িল।

নীলমাধব বলিলেন, শুনলাম, বিয়েতে তুমি অনিচ্ছুক?

বেণু মাথা হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

নীলমাধব বলিতে লাগিলেন, তাহলে আমায় আত্মহত্যা করতে বল?

কোন প্রকারে মরিয়া হইয়া বেণুধর বলিয়া উঠিল, কালকের সর্বনেশে কাণ্ডে আমার মন কিরকম হয়ে গেছে বাবা, আমি পাগল হয়ে যাব। আর কিছু দিন সময় দিন আমায়—। বলিতে বলিতে তাহাব স্বর কাঁপিতে লাগিল। একমুহূর্ত সামলাইয়া লইয়া বলিল, মরা মানুষ আমার পিছু নিয়েছে—

ভ্রূ বাঁকাইয়া নীলমাধব ছেলের দিকে চাহিলেন। একটুখানি নরম হইয়া বলিতে লাগিলেন, আর এদিকের সর্বনাশটা ভাব একবার। বাড়িশুদ্ধ কুটুম্ব গিসগিস করছে, সতের গ্রাম নেমন্তন্ন। বউ দেখবে বলে সব হাঁ করে বসে আছে। যেমন তেমন ব্যাপার নয়, এত বড় জেদাজেদীর বিয়ে—আর চৌধুরীদের সেজকর্তা আসবেন—

অপমানের ছবিগুলি চকিতে নীলমাধবের মনের মধ্যে খেলিয়া গেল। চৌধুরীদের সেজকতা অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি, তিলার্ধ দেরি না করিয়া জপের মালা হাতে লইয়াই খড়ম খটখট করিতে করিতে সাবেদনা জানাইতে আসিবেন—আসিয়া নিতান্ত নিরীহ মুখে উচ্চ কণ্ঠে এক হাট লোকের মধ্যে বৃদ্ধ অতি গোপনে জিজ্ঞাসা করিবেন, বলি ও নীলমাধব, আসল কথাটা বল দিকি, বিয়ে এবারও ভাঙল—মেয়ে কি তারা অন্য জায়গায় বিয়ে দেবে?…

ভাবিতে ভাবিতে নীলমাধব ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, না বেণুধর, বউ না নিয়ে বাড়ি ফেবা হবে না। পরশুর আগে দিন নেই। তুমি সময় চাচ্ছিলে—বেশ তো, মাঝে এই দুটো দিন থাকল। এর মধ্যে নিশ্চয় মন ভাল হয়ে যাবে। …

বারোয়ারির মাঠে যাত্ৰা বসিয়াছে। বিকাল হইতে গাওনা শুরু। বেণুধর সমবয়সী জন দুই তিনকে পাকড়াইয়া বলিল, চল, যাই।

বিজয় বলিল, আমার যাওয়া হবে না তো। বিস্তর জিনিষপত্তর বাঁধাছাঁদা করতে হবে। রাত্রে ফিরে যাচ্ছি।

কেন?

গ্রামে গিয়ে খবর দিতে হবে বউভাতের তারিখ দুটোদিন পিছিয়ে গেল। কাকা বললেন, তুমি যাও বিজয়।

গাড়ি সেই কোন-রাতে—আমরা থাকব বড়জোর এক ঘন্টা কি দেড় ঘন্টা—চল, চল—। বেণুধর ছাড়িল না। সকলকে ধরিয়া লইয়া গেল।

পথের মধ্যে বিজয়কে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল, বিয়ে পরশু দিন ঠিক হল?

হ্যাঁ—

পরশু রাত্রে?

তাছাড়া কি—

চুপ করিয়া খানিক কি ভাবিয়া বেণুধর করুণ ভাবে হাসিয়া উঠিল। বলিল, রাত্রি আসছে, আর আমার ভয় হচ্ছে। তুমি বিশ্বাস করবে না বিজয়, অপঘাতে মরা মেয়েটা কাল সমস্ত রাত আমায় জ্বালাতন করেছে—

আবার একটু স্তব্ধ থাকিয়া উচ্ছ্বসিত কন্ঠে সে বলিতে লাগিল, মরা ব্যাপারটা আর আমি বিশ্বাস করছিনে—এত সাধ আহ্লাদ ভালবাসা পলক ফেলতে না ফেলতে উড়িয়ে পুরিয়ে চলে যাবে—সে কি হতে পারে? মিছে কথা। এ আমার অনুমানের কথা নয় বিজয়, কাল থেকে স্পষ্ট করে জেনেছি।

বিজয় ব্যাকুল হইয়া বলিল, তুমি এসব কথা আর বলো না ভাই, আমাদেরও শুনলে ভয় করে।

ভয় করে? তবে বলব না। —বলিয়া বেণু টিপি টিপি হাসিতে লাগিল। বলিল, কিন্তু যাই বল, এই শহরে পড়ে থাকা আমাদের উচিত হয়নি—দূরে পালানো উচিত ছিল। এই আধক্রোশের মধ্যেই কাণ্ডটা ঘটল।

যাত্রা দেখিয়া বেণু অতিরিক্ত রকম খুশি হইল। ফিরিবার পথে কথায় কথায় এমন হাসি রহস্য—যেন সে মাটি দিয়া পথ চলিতেছে না। তখন সন্ধ্যা গড়াইয়া গিয়াছে। পথের উপর অজস্র কামিনী ফুল ফুটিয়াছে। ডালপালাসুদ্ধ তাহার অনেক ডাল ভাঙিয়া লইল। বলিল, খাসা গন্ধ! বিছানায় ছড়িয়ে দেব।

একজন ঠাট্টা করিয়া বলিল, ফুলশয্যার দেরি আছে হে—

কোথায়?—বলিয়া বেণু প্রচুর হাসিতে লাগিল। বলিল, এ পক্ষের দিন রয়েছে তো কাল। আর তাহিরপুরেরটার—ও বিজয়, তোমাদের নতুন সম্বন্ধের ফুলশয্যার দিন করেছে কবে?

বিজয় রীতিমত রাগিয়া উঠিল, ফের ওই কথা? এ পক্ষ—ও পক্ষ—বিয়ে তোমার কটা হয়েছে শুনি?

আপাতত একটা; কাল যেটা হয়ে গেল—আর একটার আশায় আছি। বিজয়ের কাঁধ ধরিয়া ঝাঁকি দিয়া বেণু বলিতে লাগিল, ও বিজয়, ভয় পেলে নাকি? ভয় নেই, আজ সে আসবে না। আজকে কালরাত্রি—বউয়ের দেখা করবার নিয়ম নেই।

খাওয়া দাওয়ার পর বেশ প্রফুল্ল ভাবে বেণুধর শুইয়া পড়িল। কিন্তু ঘুম আসে না। আলো নিভাইয়া দিল; কিছুতে ঘুম আসে না। পাশে কোন বাড়িতে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘড়ি বাজিয়া যাইতেছে। চারিদিক নিশুতি। অনেকক্ষণ ধরিয়া ঘুমের সাধনা করিয়া কাহার উপর বড় রাগ হইতে লাগিল। রাগ করিয়া গায়ের কম্বল ছুঁড়িয়া ফেলিয়া কাহাকে শুনাইয়া জোরে জোরে পায়চারি করিতে লাগিল। খণ্ড চাঁদ ক্রমশ আম বাগানের মাথায় আসিয়া ঠেকিয়াছে। … আবার সে ঘরে ঢুকিল! বিছানার পাশে গিয়া মনে হইল, ফোঁস করিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কে যেন কোথায় পালাইয়া গেল। বাতাসে বাগিচার গাছপালা খসখস করিতেছে। বেণুধর ভাবিতে লাগিল, নতুন কোরা কাপড় পরিয়া খসখস করিতে করিতে এক অদৃশ্যচারিণী বনপথে বাতাসে বাতাসে দ্রুতবেগে মিলাইয়া গেল।

পরদিন তাহিরপুরের পাত্রীপক্ষ আশীর্বাদ করিতে আসিলেন। হাসিমুখেই আংটি সে হাত পাতিয়া লইল। মনে মনে বাপের বহুদর্শিতার কথা ভাবিল। নীলমাধব সত্যই বলিয়াছিলেন, এই দুটোদিন সময়ের মধ্যেই তাহার মন আশ্চর্যরকম ভাল হইয়া উঠিয়াছে। চুরি করিয়া এক ফাঁকে বাপের ঘর হইতে পাত্রীর ছবিটা দেখিয়া আসিল। মেয়ে সুন্দরী বটে। প্রতিমার মত নিখুঁত নিটোল গড়ন।

সেদিন একখানা বই পড়িতে পড়িতে অনেক রাত হইয়া গেল। শিয়রে তেপায়ার উপর ভাবী বধূর ছবিখানি। স্নান দীপালোকিত চুনকাম-খসা উঁচু দেয়াল, গম্বুজের মত খিলান করা সেকেলে ছাত, তাহারই মধ্যে মিলনোৎকণ্ঠিত নায়ক-নায়িকার সুখ-দুঃখের সহগামী হইয়া অনেক রাত্রি পর্যন্ত সে বই পড়িতে লাগিল…একবার কি রকমে মুখ ফিরাইয়া বেণুধর স্তম্ভিত হইয়া গেল, স্পষ্ট দেখিতে পাইল, একেবারে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ—তাহার মধ্যে দিয়া হাত গলাইয়া চাঁপার কলির মত পাঁচটি আঙুল লীলায়িত ভঙ্গিতে হাতছানি দিয়া তাহাকে ডাকিতেছে। ভাল করিয়া তাকাইতেই বাহিরের নিকষ কালো অন্ধকারে হাত ডুবিয়া গেল। সে উঠিয়া জানালায় আসিল। আর কিছুই নাই, নৈশ বাতাসে লতাপাতা দুলিতেছে। সজোরে সে জানালার খিল আঁটিয়া দিল।

আলোর জোর বাড়াইয়া দিয়া বেণুধর পাশ ফিরিয়া শুইল। চটা-ওঠা দেয়ালের ওপর কালের দেবতা কত কি নক্সা আঁকিয়া গিয়াছে। উল্টা-করা তালের গাছ…একটা মুখের আধখানা…ঝুঁটিওয়ালা অদ্ভুত আকারের জানোয়ার আর একটা কিসের টুঁটি চাপিয়া ধরিয়া আছে…ঝুল কালি ও মাকড়সা জালের বন্দীশালায় কালো কালো শিকের আড়ালে কত লোক আটক হইয়া রহিয়াছে…

চোখ বুজিয়া দেখিতে লাগিল—

অনেক দূরে মাঠের ওপারে কালো কাপড় মুড়ি দেওয়া সারি সারি মানুষ চলিয়াছে—পিঁপড়ার মত মানুষের অনন্ত শ্রেণী। লোকালয়ের সীমানায় আসিয়া কে-একজন হাত উঁচু করিয়া কি বলিল। মুহূর্তকাল সব স্থির। আবার কি সংকেত হইল। অমনি দল ভাঙিয়া নানাজনে নানাদিকে পথ-বিপথ ঝোপ জঙ্গল আনাচ কানাচ না মানিয়া ছুটিতে ছুটিতে অদৃশ্য হইয়া গেল।

এই রাত্রে আঙিনার ধূলায় কোথায় এক পরম দুঃখিনী এলাইয়া এলাইয়া পড়িয়া থাকিয়া থাকিয়া দাপাদাপি করিতেছে—

ওমা—মাগো আমার ও আমার লক্ষ্মীমানিক রাজরানী মা—

অন্ধকারের আবছায়ে ছোট ছোট ঘুলঘুলির পাশে তন্বী কিশোরীটি নিশ্বাস বন্ধ করিয়া আড়ি পাতিয়া বসিয়া আছে। শিয়রে নূতন বধু চুপটি করিয়া বাসর জাগে। বর বুঝি ঘুমাইল।…

বেণুধর উঠিয়া বসিয়া পরম স্নেহে স্মিতমুখে শিয়রে তেপায়ার উপরের ছবিখানির দিকে তাকাইল। কাল সারা রাত্রি তাহারা জাগিয়া কাটাইবে।

রুদ্ধ জানালায় সহসা মৃদু মৃদু করাঘাত শুনিয়া বেণুধর চমকিয়া উঠিল। শুনিতে পাইল, ভয়ার্ত চাপা গলায় ডাকিয়া ডাকিয়া কে যেন কি বলিতেছে। একটি অসহায় প্রীতিমতী বালিকা বাপ-মা ও চেনা-জানা সকল আত্মীয় পরিজন ছাড়িয়া আসিয়া ওই জানালার বাহিরে পাগল হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আজ বেণুধর তিলার্ধ দেরি করিল না; দুয়ার খুলিয়া দেখে, ইতিমধ্যে বাতাস বাড়িয়া ঝড় বহিতে শুরু হইয়াছে। সন সন করিয়া ঝড় দালানের গায়ে পাক খাইয়া যাইতেছে।

এসো—

উঁহু—

এসো—

না।

বাতাসে দড়াম করিয়া দরজা বন্ধ হইয়া গেল। বেণুধর নির্নিরীক্ষে অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য পলায়নপরার পিছনে পিছনে ছুটিল। ঝোড়ো হাওয়ায় কথা না বুটিতে কথা উড়াইয়া লইয়া যায়; তবু সে যুক্ত করে বারম্বার এক অভিমানিনীর উদ্দেশে কহিতে লাগিল, মিছে কথা, আমি বিয়ে করব না; আমি যাব না কাল। তুমি এসো—ফিরে এসো—

নিশীথ রাত্রি। মেঘভরা আকাশে বিদ্যুৎ চমকাইতেছে। ভৈরবের বুকেও যেন প্রলয়ের জোয়ার লাগিয়াছে। ডাক ছাড়িয়া কূল ছাপাইয়া জল ছুটিয়াছে। বেণুধর নদীর কূলে কূলে ডাকিয়া বেড়াইতে লাগিল। মৃত্যু ও জীবনের সীমারেখা এই পরম মুহূর্তে প্রলয়-তরঙ্গে লেপিয়া মুছিয়া গিয়াছে। পৃথিবীতে এই ক্ষণ প্রতিদিন আসিয়া থাকে। দিনের অবসানে সন্ধ্যা—তারপর রাত্রি—। পলে পলে রাত্রির বক্ষস্পন্দন বাড়ে—তারপর অনেক—অনেকক্ষণ পরে মধ্য আকাশ হইতে একটি নক্ষত্র বিদ্যুৎগতিতে খসিয়া পড়ে, ঝনঝন করিয়া মৃত্যুপুরীর সিংহদ্বার খুলিয়া যায়, পৃথিবীর মানুষের শিয়রে ওপারের লোক দলে দলে আসিয়া বসে, ভালবাসে, আদর করে, স্বপ্নের মধ্য দিয়া কত কথা কহিয়া যায়—

আজ স্বপ্নলোকের মধ্যে নয়, জাগ্রত দুই চক্ষু দিয়া মৃত্মলোক-বাসিনীকে সে দেখিতে পাইয়াছে। দুটি হাত নিবিড় করিয়া ধরিয়া তাহাকে ফিরাইয়া আনিবে। দিগন্তব্যাপী মেঘবরণ চুলের উপর ডগমগে লাল কয়েকটি রক্তবিন্দু প্রায়ান্ধকারের মধ্যে আলেয়ার মত বেণুধরকে দূর হইতে দূরে ছুটাইয়া লইয়া চলিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *