লালুমিঞার মাঠ
লম্বায় ছ’ ফুটেরও বেশি। চওড়াতেও তদুপযুক্ত। শক্তসমর্থ বলিষ্ঠ চেহারা। কপালের একপাশে বীভৎস রকমের একটা দাগ আছে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। চুলগুলি কপালের ওপর লুটিয়ে থাকে সবসময়। বুনো শুয়োরের মতো কুতকুতে চোখে যার দিকে তাকায় তার বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। ওর নাম লালুমিঞা।
হিংস্র জন্তুর চেয়েও মারাত্মক ওই মানুষটির ভয়ে অঞ্চলের লোকেরা সদাই তটস্থ। অনেকের ধারণা, ভিনগাঁয়ে লালুমিঞার ডাকাতের দল আছে। সচরাচর কারও ক্ষতি সে করে না। তবে রাগলে কিন্তু রক্ষে নেই। তাই লালুমিঞার শারীরিক শক্তির সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে তারা ওকে ঘাঁটায় না।
একদিন দুপুরবেলা লালু তার ছোট ছেলেটিকে নিয়ে দাওয়ায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল, এমন সময় জমিদারের পাইক এসে হাজির।
পাইক বাবাজি লালুকে হাড়ে হাড়ে চেনে। একবার সদরঘাটে দামোদরের জাত-এ (মেলা) লালু এমন ধাতানি দিয়েছিল ওকে যে, সে-কথা আজও ভোলেনি সে। অথচ জমিদারের হুকুম লালুকে ধরে নিয়ে যেতেই হবে। তাই সে ভয়ে ভয়ে এসে ডাকল, “লালুমিঞা আছ নাকি? ও লালুভাই?”
পাইকের ডাকে ঘুম ভাঙল লালুর। সে অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে পাইককে পত্নীর ভাই সম্বোধন করে মুখিয়ে উঠল, “কেন রে শা—?”
“বড়কর্তা তোমাকে একবার হুকুম করেছেন গো।”
“তাই নাকি? তোদের বড়কর্তাকে বোলগে যা লালুমিঞা কারও বাপের চাকর নয় যে, ডাকলেই যাবে।”
পাইক বলল, “আঃ চটছ কেন লালুভাই? এই তোমার এক দোষ। আমাকে হুকুম করেছেন, আমি হুকুমনামা নিয়ে এসেছি। একবার চলো না ভাই কাছারিতে।”
লালু ভেংচে বলল, “এই ভরদুপুরে লালুমিঞা যাবে জমিদারের কাছারিতে? আস্পর্ধা তো কম নয়! যা ভাগ এখান থেকে। নাহলে আস্ত একটা কাঁচা বাঁশ তোর পিঠে আমি ভাঙব।”
পাইক আর কী করে? ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কোনওরকমে পালিয়ে এল সেখান থেকে। তারপর ফিরে এসে বড়কর্তাকে বলল, “ওকে ধরে আনতে পারলাম না হুজুর।”
বড়কর্তা গম্ভীরভাবে বললেন, “এল না তা হলে?”
“না হুজুর। মিঞাসাহেব বলে ডাকতেই তেড়ে যেন মারতে এল। বাবাঃ। কী তম্বি তার। ওকে ধরে আনা আমার কম্ম নয়।”
“একটু বুঝিয়েসুঝিয়ে বলেছিলি?”
“হ্যাঁ কৰ্তা।”
বড়কর্তা আরও একটু গম্ভীর হয়ে কী যেন ভাবতে লাগলেন।
গাঁয়ে ষোলোআনার সকলেই মান্য করেন বড়কর্তাকে। একে রাশভারী লোক, তায় জমিদার। প্রজাদের ওপর খুব যে একটা অত্যাচার করেন তা নয়, তবে কোনওমতেই কারও ঔদ্ধত্য সহ্য করেন না। রেগে গেলেই তাঁর জমিদারি রক্ত টগবগিয়ে ফোটে। কড়া মেজাজে কাজ করে যান। লালুর বেয়াদবি অনেক সহ্য করেছেন তিনি। আর নয়!
এদিকে লালুরও জেদ, জমিদারই হোক বা রাজা-মহারাজাই হোক, একদম ওপরওয়ালা ছাড়া আর কাউকেই মানবে না সে। লালু বলে, “তোদের বড়কর্তা তোদের কাছেই থাক। ওকে আবার মানব কী রে? তোরা ব্যাটারা যেমন চাষা। তেল মাখানো তোদের স্বভাব, তেল মাখাগে যা। আমার কাছে বড়কর্তা দ্যাখাতে আসিস না, বুঝলি? যত্তসব।”
পাইকের মুখে সব শুনে তাই মনে মনে খেপে ব্যোম হয়ে উঠলেন বড়কর্তা। বর্ধমানের এই ছোট্ট গ্রামখানির জমিদার তিনি। প্রতিটি প্রজা তাঁকে মান্য করে। একমাত্র লালু ছাড়া। লালুমিঞা সামান্য একজন প্রজা। তার এই মাত্রাছাড়া ঔদ্ধত্যে কার না রাগ হবে? তাই নিষ্ফল আক্রোশে অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই তিনি বললেন, “ওর ব্যবস্থা আমি করছি।”
সন্ধের সময় বড়কর্তা কয়েকজন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে মজলিসে বসেছিলেন। এই সময়টায় একটু জোর আড্ডা হয়। গ্রামের বিশিষ্ট কয়েকজন তোষামুদে লোক বসে বসে তাঁর চাটুকারি করে মন জোগায়। কোনওদিন গানবাজনাও হয়। আজকের মজলিসটা অবশ্য অন্য ধরনের হচ্ছিল। বিষয় লালুমিঞা।
লালুমিঞা কারও ক্ষতি না করলেও তার হাতে দু’-একটা চড়-চাপড় খায়নি এমন লোক এ গাঁয়ে খুব কমই আছে। কাজেই লালুর বেপরোয়া স্বভাবের জন্য অনেক দুষ্ট লোকেরই রাগ ছিল তার ওপর। কুচক্রী সুদখোর ও মহাজনরা তো প্রায়ই হেনস্থা ভোগ করত লালুর হাতে। সেইসব অভিযোগ শুনতে শুনতেও বড়কর্তার মন বিষিয়ে ছিল লালুর ওপর। যাই হোক, লালুমিঞাকে নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে তেমন সময় হঠাৎই অপ্রত্যাশিতভাবে লালুমিঞার আবির্ভাব হল সেখানে।
লালু এসে বুক ফুলিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল সকলের সামনে।
অন্যান্য প্রজারা এসে নমস্কার করে সসম্ভ্রমে ভয়ে ভয়ে কথা বলে। লালু কিন্তু ওসবের ধার ধারে না। বেশ রাগত গলায় বলল, “অমন দিনদুপুরে আমাকে ডাকতে পাঠিয়েছিলেন কেন? জানেন না সে সময় মানুষ একটু বিশ্রাম করে?”
বড়কর্তা লালুর আপাদমস্তক একবার নিরীক্ষণ করে বললেন, “গলার স্বরটা একটু নামিয়ে আর মাথাটা অল্প হেঁট করে কথা বলো। মনে রেখো তুমি হলে আমার সামান্য একজন প্রজা, আর আমি হলাম এ গাঁয়ের জমিদার।”
লালু বলল, “তাতে কী হয়েছে? সেই গরমে আপনি যখন-তখন ডাকবেন আর আমাকে ভয়ে ভয়ে ছুটে আসতে হবে নাকি?”
“সবাই তো তাই আসে।”
“সবাই-এর কথা ছেড়ে দিন। আমার নাম লালুমিঞা। আমি রাজা-উজিরও মানি না, জমিদারেরও পরোয়া করি না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পেটের ভাত জোটাই, ধামায় করে কেউ আমার ঘরে ক্ষুধার খাদ্য ধরে দিয়ে যায় না। অতএব—।”
“এত ঔদ্ধত্য তোমার?”
“এতে ঔদ্ধত্যের কী দেখলেন? থাক, ওইসব বাজে কথা রেখে এখন বলুন কেন ডেকেছেন?”
“তুমি বছরের পর বছর খাজনা দিচ্ছ না, তাই ডেকেছি।”
“খাজনা! কীসের খাজনা?”
“জমির খাজনা। আমার গ্রামে বাস করছ, জমি চষে ফসল ফলাচ্ছ, তার খাজনা।
“খাজনা আমি দেব না, বুঝেছেন? লালুমিঞার কোনও খাজনা নেই। তার খাজনা খোদাতালার কাছে, জমিদারের কাছে নয়। দুনিয়ার মাটি খোদার দান। খোদার সম্পত্তি সবার সম্পত্তি। কাজেই খোদার সম্পত্তির কোনও জমিদারও নেই, খাজনাও নেই।”
বড়কর্তার সমস্ত মুখখানি রাগে লাল হয়ে উঠল। কুটিলতায় ভরে উঠল যেন। প্রচণ্ড ধমকের সুরে দাবড়ে উঠলেন, “লালুমিঞা!”
লালু হেসে বলল, “ওতে কোনও লাভ হবে না কতামশাই। যতই চ্যাঁচান, খাজনা আমি দিচ্ছি না।”
বড়কর্তা সিংহনাদ করে উঠলেন, “এই কে আছিস?”
সঙ্গে সঙ্গে আশপাশ থেকে জনাকয়েক শক্তিমান লোক অতর্কিতে ঘিরে ফেলল লালুমিঞাকে।
“বেঁধে ফ্যাল ব্যাটাকে। চাবকে ওর পিঠের চামড়া আমি ছাড়িয়ে নেব। আমার চাবুকটা কোথায় গেল?” বলেই দেওয়ালের হুকে ঝোলানো শঙ্কর মাছের চাবুকটা পেড়ে আনলেন বড়কর্তা।
এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য লালু একটুও প্রস্তুত ছিল না। তাকে লেঠেল দিয়ে আটক করিয়ে বেঁধে ফেলার ব্যবস্থা হয়েছে জানলে আসতই না সে। তবুও লালুমিঞা বোধ হয় আসুরিক শক্তির অধীশ্বর ছিল। তাই ‘হাঃ হাঃ’ করে একবার ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠেই সহসা তিন হাত লাফিয়ে দাপটের সঙ্গে দু’জনের পেটে প্রবল বেগে দু’ পায়ে লাথি মেরে এবং দু’ বাহুর প্রচণ্ড ঘুর্ণিতে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিমেষে উধাও হয়ে গেল উল্কার মতো।
ঘটনাটা যে কী ঘটল তা টের পেতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। লাথি খাওয়া লোক দুটি দু’হাতে পেট ধরে গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। সকলে মিলে ধরাধরি করে তাদের শুশ্রূষার জন্য নিয়ে গেল।
চাবুকটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বড়কর্তা গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর সাপের চোখের মতো ক্রুদ্ধ ও তীক্ষ্ণ চোখে লালুর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ডাকলেন, “নায়েবমশাই?”
শয়তান নায়েব সশব্যস্ত হয়ে আদেশ প্রার্থনা করলেন, “বলুন হুজুর।”
“আমার সমস্ত লেঠেলদের গোপনে তৈরি হতে বলুন। লালুমিঞা খেপে গেছে। নিশ্চয়ই একটা ভয়ানক কাণ্ড কিছু করে বসবে সে। যেমন করেই হোক এর একটা বিহিত করতেই হবে।”
“কী বিহিত করবেন?”
বড়কর্তা নায়েবমশাইয়ের কানে ফিসফিস করে কী যেন বললেন। শুনে নায়েব মশাইয়ের হিংস্ৰ মুখ কুটিল আনন্দে ভরে উঠল।
গভীর রাত। কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী। চারদিক আবিল অন্ধকারে ঢাকা।
বড়কর্তা লেঠেলদের নিয়ে সেই ঘন অন্ধকারেই পা টিপে টিপে এসে উপস্থিত হলেন লালুমিঞার বাসায়। লাঠি, সড়কি, ভোজালি, তীর, কাঁড়, সবরকম অস্ত্রই সঙ্গে ছিল ওদের। গরমের দিন। লালু নিশ্চয়ই দাওয়াতেই শুয়ে থাকবে। কাজেই এক কোপে ওর মাথাটা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে একটুও সময় লাগবে না। কিন্তু কোথায় লালু? শূন্য দাওয়ায় একটা কুকুর শুয়ে ছিল। ওদের দেখেই পালাল।
নায়েবমশাই তবুও দাওয়ায় উঠে ঘরের ভেতর উঁকি মারতেই দেখলেন লালুমিঞা তার বউ ও ছেলেকে নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘরের ভেতর শুয়ে আছে। ঘরের কোণে টিমটিম করে একটি রেড়ির তেলের পিদিম জ্বলছে। মাথার কাছে একটি দা রাখা আছে। সম্ভবত আকস্মিক কোনও বিপদের ভয়েই লালুর সাবধানতা।
নায়েবের ইশারায় বড়কর্তা উঠে এলেন দাওয়ায়। জানলার ফাঁক দিয়ে একবার ঘুমন্ত লালুকে দেখলেন। তারপর চাপা গলায় লেঠেলদের আদেশ দিলেন বাড়িটা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে। একজনকে তীর কাঁড় নিয়ে এগিয়ে আসতে বললেন। নিজে সরে এলেন জানলার ধার থেকে।
বড়কর্তার আদেশে তীর কাঁড় নিয়ে এগিয়ে এল একজন। এসে একবার বেশ ভাল করে দেখে নিল তার লক্ষ্যবস্তুকে। তারপর দরজায় শিকল তুলে দিয়েই অব্যর্থ লক্ষ্যভেদে তীরনিক্ষেপ করল লালুর বুকে।
যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল লালু। ওর বউ এবং ছেলেটিও ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। তাদের কাতর কান্নায় সাড়া দিতে এগিয়ে এল না কেউই।
এতেও ক্ষান্ত হল না জমিদারের লোকরা। বড়কর্তার নির্দেশেই ফিরে আসবার সময় শুধু একটি দেশলাই কাঠি ধরিয়ে দিয়ে এল লালুমিঞার ঘরের চালায়। রাতের অন্ধকারে লালু ও তার বউ-ছেলের একই সঙ্গে আসমান ও জমিন এক হয়ে গেল।
বড়কর্তার একমাত্র ছেলে বিমল কলকাতায় হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করত। ছেলে বড় হয়েছে। তাই তার বিয়ে দিয়ে তাকে সংসারী করে জমিদারিতে বসাবেন মনে করে বড়কর্তা চিঠি পাঠালেন ছেলের কাছে। চিঠিতে এও লিখে দিলেন, “সামনের মাসে অমুক তারিখে বাবাজীবনের বিয়ের ঠিক হয়েছে। অতএব কোনওরকমেই যেন গ্রামে আসতে বিলম্ব না হয়।”
বিমল চিঠি পেয়ে খুবই আনন্দিত হল। পত্রপাঠ কলেজে মাসখানেকের ছুটি নিয়ে দেশে ফিরল সে। তবে আসবার আগে নির্দিষ্ট দিনক্ষণের কথা কিছু না জানিয়ে আসায় বড়কর্তা ছেলের জন্য গাড়িঘোড়া পাঠাবার কোনও ব্যবস্থাই করেননি।
রাত খুব বেশি নয়। সেয়ারাবাজারে এসে মাঠে মাঠে মাইল তিনেক যেতে পারলেই গ্রামে পৌঁছনো যাবে। পথে চোর-ডাকাতের ভয় আছে। কেননা যে সময়কার কথা বলছি তখন এতদঞ্চলে দুর্ধর্ষ সব ডাকাতরা বাস করত। এইসব ডাকাতদের মোকাবিলা করতে কালঘাম ছুটে যেত ইংরেজ সরকারের। বিমল তাই সতর্ক হয়েই গ্রাম অভিমুখে রওনা হল।
আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে। একটু পরেই বৃষ্টি নামবে হয়তো। তা নামুক। ভালয় ভালয় বাড়ি পৌঁছতে পারলে হয়! বিমলের হাতে টর্চ ছিল। তবু সে পাছে চোর-ডাকাতের হাতে পড়ে, এই ভয়ে চর্ট জ্বালল না। বিমল নিজেও খুব শক্তিমান ছিল, তাই সে সাহস করে খুব সতর্কতার সঙ্গে অন্ধকারে সাবধানে পথ চলতে লাগল।
আকাশে বর্ষার মেঘ ঘন হচ্ছিল অনেকক্ষণ থেকেই। বিমল কিছুটা পথ আসার পরই সেই মেঘের পরিণতি দেখতে পেল। সে কী প্রচণ্ড বৃষ্টি। সঙ্গে ঝড়। প্রবল বর্ষণে দুর্যোগ যেন ঘনতর হয়ে উঠল। একটি গাছতলায় দাঁড়িয়ে একা বিমল বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপতে লাগল ঠকঠক করে। এই ঝড়বৃষ্টিতে বিমলের এমনি অসুবিধে হলেও অনেকটা নির্ভয় হল এই ভেবে যে, এই দুর্যোগে আর যাই হোক, চোর-ডাকাতের হাতে পড়তে হবে না। কারণ তারাও এবার আশ্রয় খুঁজবে।
বৃষ্টির দাপট একটু কমলে আবার চলা শুরু করল বিমল। একটা মাঠ পার হয়ে আর এক মাঠে এসে পড়ল সে। এমন সময় সে দেখতে পেল হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা অতিকায় চেহারার তেজি ষাঁড় রণং দেহি মূর্তিতে পথরোধ করে দাঁড়াল ওর। সামনের দু’ পায়ের খুরের সাহায্যে কাদামাটি আঁচড়াতে আঁচড়াতে ঘন ঘন শিং নাড়া দিতে লাগল।
বিমল দেখল মহাবিপদ। ষাঁড়টা এমনভাবে পথ আটকেছে যে, পাশ কাটাবার উপায় পর্যন্ত নেই।
কিন্তু এ কী! এ কী ভয়ানক কাণ্ড! ষাঁড়টা যে ক্রমশ বড় হচ্ছে। বড় হতে হতে ষাঁড়টা ক্রমশ পর্বতাকার ধারণ করল।
বিমল জমিদারের ছেলে। ভাল খেয়ে মেখে নিয়মিত ব্যায়াম করে সেও কম বলিষ্ঠ ছিল না। এই অলৌকিক দৃশ্যে তাই রীতিমতো ভীত হয়েও সে ভাব চেপে রেখে সে বলল, “কে তুমি? কেন এমন জাদু দ্যাখাচ্ছো?”
ষাঁড়টা তার ককুধ ঝাঁকিয়ে ‘হোগ ঘোঁৎ’ করে একটা শব্দ করল।
বিমল বলল, “তুমি তো ষাঁড় নও। তুমি কোনও অলৌকিক শক্তির ধারক। বলো তুমি কে?”
ষাঁড়টি এবার পর্বতাকার ছেড়ে আস্তে আস্তে ছোট হতে লাগল। তারপর হঠাৎ মাঠময় প্রচণ্ড দাপাদাপি করে আবার ওর সামনে এসে দাঁড়াল।
প্রবল বর্ষণ থেমে গেলেও টিপটিপ করে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে
মাঝে মাঝে।
সেই আলোয় বিমল দেখতে পেল বৃষ্টির জল ষাঁড়ের গায়ে লাগছে না। ষাঁড়টা একবার থমকে দাঁড়াল। তারপর আবার বড় হতে লাগল একটু একটু করে।
বিমল বলল, “কেন তুমি আমাকে পথ চলতে দিচ্ছ না?”
বিমল আবার বলল, “আমি তো তোমার কোনও ক্ষতি করিনি। তবে কেন তুমি এইভাবে পথরোধ করছ আমার?”
প্রত্যুত্তরে বিশাল ষাঁড় ঘন ঘন শিং নাড়ল।
ষাঁড় মানুষের গলায় বলল, “তুই না করলেও তোর বাবা করেছে।”
“আমার বাবা কী ক্ষতি করেছে তোমার? তুমি কে?”
একটি প্রচণ্ড অট্টহাসির সঙ্গে উত্তর এল, “আমি তোর যম। আমার নাম লালুমিঞাচমকে উঠল বিমল। লালুমিঞা! পত্র মারফত সে জেনেছিল লালুর মৃত্যুর খবর। কিন্তু কে, কেন এবং কীভাবে তাকে মেরেছিল তা সে জানত না। তাই বলল, “তোমার মৃত্যু সংবাদ আমি পেয়েছি। তবে তোমার ব্যাপারে কিছুমাত্র আমি জানি না। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। অতএব আমাকে ভয় না দেখিয়ে পথ ছাড়ো।” এসেছি। আমি।”
“আমি তোকে ভয় দ্যাখাতে আসিনি রে নির্বোধ। তোকে মারতে প্রতিশোধ নিতে চাই।”
“আমার অপরাধ?
“তোর অপরাধ তুই ওই নিষ্ঠুর জমিদারের ছেলে। তোর বাবা নৃশংসভাবে কাপুরুষের মতো হত্যা করেছে আমাকে। শুধু আমাকে নয়, আমার নিরপরাধ বউ, আমার বড় আদরের সন্তান হাসানকেও রেহাই দেয়নি সে। আমার বুকের মানিক আমার চোখের সামনে ঝলসে গেল। রাতের অন্ধকারে আমার সুখের ঘরে আগুন দিয়ে সবাইকে পুড়িয়ে মারল তোর বাবা। ওই দ্যাখ সেই আগুন। এই আগুনে তোকেও পুড়িয়ে মারব বলে আমি বড় আশায় দিন গুনছিলুম।”
বিমলের চোখের সামনে হঠাৎ মাঠের মাঝখানে এক জায়গায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। সেই আগুনে একটা কুঁড়েঘর পুড়ছে। আর ঘরের মধ্যে প্রাণান্ত চিৎকার করে অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে তিনটি মানুষ। কী ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য। মানুষগুলো বাঁচবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। একটি পুরুষ, একটি নারী ও একটি শিশু দগ্ধ হচ্ছে সেই আগুনে। বিমল জ্ঞান হারাল।
একটু পরেই আবার জোর বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টির জল চোখেমুখে যেতেই সংবিৎ ফিরে পেয়ে আবার উঠে বসল বিমল।
চারদিক সেই ঘন অন্ধকারেই ঢাকা।
একটু আগের দ্যাখা ঘটনার দৃশ্যটা ওর দুঃস্বপ্ন বলেই মনে হল। আবার পূর্ণ উদ্যমে এগিয়ে চলল সে গ্রামের দিকে। এই মাঠ পেরোলে আর একটি মাঠ। তারপরই ওদের গ্রাম। কিন্তু না। কিছু পথ যাওয়ার পর আবার সেই ভয়ঙ্কর ষাঁড় এসে পথরোধ করে দাঁড়াল ওর। রক্তচক্ষুতে বলল, “যাবি কোথায় বাছাধন? মৃত্যুর জন্য তৈরি হ।”
বিমল বলল, “বেশ, হলাম। তবে একটা কথা, তুমি বলছ আমার বাবা তোমাকে এবং তোমার বউ-ছেলেকে কাপুরুষের মতো হত্যা করেছে। কিন্তু তুমি নিজেও কি আজ সেই কাজ করছ না?”
“না। আমি তো অতর্কিত আক্রমণে হত্যা করতে চাইছি না। তোকে জানিয়েই এই কাজ করছি।”
“মানলাম। কিন্তু সত্যিই যদি তুমি নিজেকে কাপুরুষ প্রমাণ করতে না চাও তা হলে অমন সাংঘাতিক রূপ ধারণ না করে সমমূর্তিতে দ্যাখা দিয়ে আমার মোকাবিলা করো।”
“তাতে লাভ? আমি অসুরের শক্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। এখন প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয়ে আরও অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী হয়েছি।’
“ওসব বাজে কথা রেখে তুমি তোমার আসল রূপ ধরো।”
বলার সঙ্গে-সঙ্গেই যেন ভোজবাজি হয়ে গেল। লালুমিঞা পূর্ব রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হল বিমলের সামনে। মানুষের কলেবরে অর্থাৎ আগে যেমন দেখতে ছিল ঠিক তেমনই চেহারায় দেখা গেল তাকে।
এর পর শুরু হল ভূতে-মানুষে তুমুল লড়াই।
সারারাত ধরে দু’জনে ভীষণ লড়াই করতে লাগল। সে এক রোমাঞ্চকর দৃশ্য ! এইভাবেই ভোর হয়ে এল। আকাশে শুকতারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল ক্রমশ।
এই অশরীরী অলৌকিক শক্তির সঙ্গে লড়াই করে বিমল ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বেশিক্ষণ বুঝতে পারল না সে। অবসন্ন দেহে মাটিতে পড়ে গেল। লালুমিঞা ভয়ঙ্কর রূপ ধরে দু’হাতে তুলে নিল তাকে।
বিমল কাতর গলায় বলল, “না না, আমাকে মেরো না। আমাকে ক্ষমা করো লালুভাই।” লালুমিঞা বলল, “অনেক আগেই তোকে শেষ করে দিতাম, শুধুমাত্র তোকে আমি তিল তিল করে মারব প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বলেই লড়াই করার ছলে অনেকক্ষণ বেঁচে থাকবার সুযোগ করে দিয়েছিলাম। এখন ভোর হয়ে আসছে। দিনের আলো ফুটে উঠলে আমার শক্তি আর কাজ করবে না। তাই তোকে শেষ করেই আমি বিদায় নেব এবার।” বলে বিমলের বুক চিরে চোঁ-চোঁ করে ওর সমস্ত রক্তটুকু শুষে নিয়ে ওকে ওর বাড়ির দেউড়িতে শুইয়ে দিয়ে এল।
সকালবেলা চাকর ও দরোয়ানের চিৎকারে ছুটে এল সবাই। বড়কর্তা, বিমলের মা, ছেলেকে বুকে নিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন। গ্রামের লোকজনও ছুটে এল। রক্তাক্ত ও কর্দমাক্ত বিমলের চোখেমুখে জল দিয়ে পাখার বাতাস করতে লাগল সকলে।
কেউ ভেবেই পেল না বিমলের এইরকম দশা কী করে হল।
একটু পরে জ্ঞান ফিরল বিমলের। তবে কিনা ওর প্রাণবায়ু শেষ হয়ে আসছে তখন। তবুও অতিকষ্টে গতরাতের ঘটনাটা সকলকে বলে মা-বাবার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়ল সে।
সারা বাড়িতে কান্নার রোল উঠল।
বিমলের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই নিভে গেল এই বংশের শেষ প্রদীপটি।
এই গল্পের এখানেই শেষ। ঘটনাকাল পুরনো হলেও যে মাঠে লালুমিঞার সঙ্গে বিমলের ওই রোমহর্ষক ব্যাপারটি ঘটেছিল, সেই মাঠকে আজও লোকেরা লালুমিঞার মাঠ বলে। অনেকে বলে, কালোমতো একটা ষাঁড় নাকি এখনও মাঝেমধ্যে গভীর রাতে ওই মাঠের মাটিতে ধুলোর ঝড় উড়িয়ে উন্মাদের মতো ছুটোছুটি করে। তাই হাজার কাজ থাকলেও রাতভিতে ওই মাঠের ধারেকাছে যায় না কেউ।