লালমোহনের বিপদ
লালমোহন পাল
লালমোহনের কোনওদিন কিছু হবে, এমন কেউই আশা করেনি।
সবাই ধরে নিয়েছিল, লালমোহনের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, বিশেষ করে সে যখন মাধ্যমিক পরীক্ষায় অঙ্কে ব্যাক পেল।
অবশ্য লালমোহনের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার সেটা ভাববার কারণ ওই শুধু ব্যাক পাওয়া নয়। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই আঠারো-উনিশ বছর বয়েসের মধ্যে তার নানাবিধ গুণ দেখা গিয়েছিল। মারামারি, ভীতি প্রদর্শন, ইভটিজিং, ছিনতাই ইত্যাদি ছোটখাটো গোলমালে পড়ে থানার রাফলিস্টে তার নাম উঠে গিয়েছিল। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর সে স্থানীয় সাট্টা পেনসিলার রূপে জীবিকা অর্জন শুরু করে।
.
ছোটখাটো অপরাধ করে লালমোহন অনায়াসেই পার পেয়ে যেত। তার প্রধান সহায় ছিলেন তার বাবা ভুবনমোহন পাল।
ভুবনবাবু ফৌজদারি আদালতের মুহুরি ছিলেন। স্থানীয় থানার টাউট এবং খুজিলদার হিসেবেও পার্টটাইম কাজ করতেন। পুলিশ ও দুষ্কৃতীরা এদের যথাক্রমে সোর্স এবং খেচর বলে।
সুতরাং সাট্টা পেনসিলার তথা স্থানীয় মাস্তান রূপে জীবিকা অর্জন করতে লালমোহনের কোনও অসুবিধে হয়নি। সদর কলকাতা থেকে অল্প কিছুটা দূরত্বে আধা মফসসল শহরতলিতে তার কারবার, বাপের দৌলতে ভালই চলছিল।
কিন্তু কলকাতায় বউবাজারে প্রাতঃস্মরণীয় রশিদ খানের বোমা-বিপর্যয়ের পরে যখন চারদিকে খানাতল্লাসি, গ্রেফতারি ইত্যাদি হল সেই সময় ভুবনমোহনের পুত্র লালমোহনকেও আত্মগোপন করতে হয়।
তবে বেশি দূরে যেতে হয়নি। ভুবনবাবুর বাড়ি রথতলায়, পাশের এলাকাই থানা পাড়া। থানার ছোটবাবুর বাড়িতে লালমোহন আশ্রয় গ্রহণ করে। ভালই চলে সেখানে কিন্তু অসতর্কতাবশত ছোটবাবুর শ্যালিকা গর্ভবতী হয়ে পড়ায় লালমোহনকে সেখান থেকে চলে আসতে হয়।
ভুবনবাবু পাকা লোক। তিনি এরকম যোগ্য পুত্রের জন্য সুব্যবস্থা করেছিলেন। দুটি কাজ তিনি করেছিলেন, অঙ্কের সেই পরীক্ষা এবং পুলিশের চাকরি। দুটোতেই পার পেয়েছিল লালমোহন, তবে তাকে উপস্থিত হতে হয়নি। সব ব্যবস্থা নির্ভুল করেছিলেন, কোনও পরীক্ষাই তাকে দিতে হয়নি, এমনকী তার উচ্চতা যে পুলিশের চাকরির প্রয়োজনীয় উচ্চতার চেয়ে এক ইঞ্চি কম, সেটাও কোনও বাধা হয়নি, তার হয়ে অন্য এক যুবক শারীরিক পরীক্ষা দিয়েছিল। বলাবাহুল্য, উক্ত যুবকটি ছিল ভুবনবাবুর মক্কেল। ডাকাতি মামলার জামিন প্রাপ্ত আসামি।
আমাদের এই গল্প আরম্ভ হচ্ছে এসবের চার বছর পরে। তখন লালমোহন একজন অভিজ্ঞ পুলিশ কনস্টেবল। পোস্টিং মেদিনীপুর অঞ্চলের উড়িষ্যা এবং বিহার সন্নিহিত একটি থানায়।
হারাধন সারকেল
সেদিন সকালবেলা খাঁটি সরষের তেল দিয়ে বড়বাবুকে ম্যাসাজ করছিল লালমোহন, এটাই তার প্রাত্যহিক মর্নিং ডিউটি। ঘণ্টাখানেক দলাই-মলাই না করলে বড়বাবু উঠে দাঁড়াতে পারেন না।
বড়বাবুর নাম হারাধন সারকেল। বড়বাবুর বয়েস পঞ্চান্ন হয়েছে। কৃষ্ণবর্ণ, নাদুসনুদুস, মাথায় টাক, চমৎকার নেয়াপাঁতি ভুড়ি। হারাধনবাবু একদম বাংলা সিনেমার দারোগাবাবুর মতো দেখতে। হারাধন নিজেও সে কথা জানেন। মধ্যে মধ্যে কথায় কথায় অহংকার করেন, লোকে দারোগা দেখে চিনতে না পারলে হবে? তার জন্যে সবসময় উর্দি পরে থাকতে হবে নাকি। এই বলে হুম বলে একটা শব্দ করেন, যেমন করতেন সুন্দরবাবু পুরাকালের হেমেন রায়ের সেইসব গোয়েন্দা কাহিনিগুলোর দারোগা চরিত্রে।
হয়তো হারাধন কিশোর বয়েসে অন্যান্যদের মতো হেমেন্দ্রকুমারের ভক্ত ছিলেন, পরে দারোগাজীবনে হুম শব্দটা রপ্ত করে নিয়েছেন।
এবং, এ কথা অনস্বীকার্য যে হুম শব্দটি বহুবার্থক (বহু + অর্থক) এবং একজন উঁদরেল। দারোগা অর্ধেক কথা না বলে শুধু হুম করেই বাক্যালাপ সারতে পারেন।
ইংরেজিতে হোম সিক (Home Sick) বলে একটা কথা আছে, যার মানে হল বাড়ির জন্যে মন। খারাপ। শীতের দিনে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়লে কলকাতার সেকালের ইংরেজরা বলতেন হোম ওয়েদার, তারা হোম সিক হয়ে পড়তেন।
হারাধন সারকে বর্তমান থানায় বড়বাবু হয়ে যোগদান করার পরে অল্প কিছুদিনের মধ্যে স্থানীয় ফৌজদারি আদালতে একটা কথা চালু হয়েছে, লোকটা হুম সিক হয়েছে।
আদতে ব্যাপারটা হল, আরও বিস্তর সহকর্মীর মতো হারাধন আসামিদের পেটাতে ভালবাসেন। এদিকে ইতিমধ্যে তাঁর হুম কুখ্যাত হয়ে গেছে। আদালতে হারাধন প্রহৃত আসামিদের সেই জন্যে হুম সিক নামকরণ হয়েছে।
সে যা হোক, বহুকাল আগে, স্বাধীনতার দ্বিতীয় দশকে হারাধন পুলিশের কাজে ঢুকেছিলেন। কাজটা ছিল লিটারেট কনেস্টেবলের। তখন বলা হত এল.সি.। অর্থাৎ শিক্ষিত সেপাই। সেখান থেকে তিনি ধীরে সুস্থে ছোট দারোগা, বড় দারোগা হয়েছেন।
.
হারাধনবাবুর বিশ্বাস রিটায়ার করার আগে তিনি সার্কেল ইন্সপেক্টর হবেন। সেই কবে প্রথম যখন চাকরিতে ঢুকেছিলেন এক বাটপাড়ির মামলায় নামজাদা এক জ্যোতিষীকে জেরা করেছিলেন। সেই সময়ে জ্যোতিষী তার হাত ও কপাল দেখে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বলেছিলেন, আপনার সারকেল উপাধি বৃথা যাবে না। ভবিষ্যৎবাণী করছি, আপনি একদিন অবশ্যই সার্কেল ইন্সপেক্টরও হবেন।
সেই আজ থেকে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে সার্কেল ইন্সপেক্টর সোজা ব্যাপার ছিল না। তখনও দেশে এত আই জি, ডি আই জি গিজগিজ করত না। ডিজি-টিজি বলে কিছু ছিল না।
হারাধনবাবু যেমন নিশ্চিত যে রিটায়ার করার আগে তিনি সার্কেল ইন্সপেক্টর হবেনই, তেমনিই মনের মধ্যে একটা চিন্তা আছে যে দারোগার ওপরে উঠে গেলে এখন যেমন আসামিদের, সন্দেহভাজনদের পিটিয়ে লাথিয়ে হাতের সুখ পায়ের সুখ করেন তখন তা করা যাবে না।
যা তোক ভবিষ্যতের জন্যে ভেবে লাভ নেই। এখন হারাধন সারকেল ভালই আছেন। এই রতনপুর থানায় তার তিন বছর হতে চলল।
রতনপুর থানাটি ন্যাশনাল হাইওয়ের একপাশে। হাইওয়ে দিয়ে রাতদিন বাস-ট্রাক, প্রাইভেট গাড়ি, ট্রেকার, অটো যাতায়াত করে, করিৎকর্মা পুলিশের পক্ষে একেবারে যাকে বলে চলন্ত সোনার খনি. অথবা জীবন্ত টাকশাল।
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা এ তিন রাজ্যের মধ্যে বেআইনি অস্ত্র, দাগি আসামি, নিষিদ্ধ মাদক এই সব নিয়ে হাইওয়ে পথে গাড়ির যাতায়াত। প্রত্যেকের নির্দিষ্ট ভোলা আছে। যথাসময়ে থানা থেকে ডাকবাবু যথাস্থানে গিয়ে এটা সংগ্রহ করে আনেন।
আদায়পত্র ভালই হয়। কিন্তু নীচে-উপরে অন্য অনেকের সঙ্গে ভাগেজোকে টাকাটা খেতে হয়, সেটাই নিরাপদ।
.
হারাধনবাবুর খাঁই বড় বেশি। এতে তাঁর পোষায় না। তার তারকেশ্বরে একটা আলুর কোল্ড স্টোরেজ আছে, জি টি রোডে একটা সিনেমা হল আছে। বিশ্বস্ত শালারা সেসব দেখাশোনা করে। এতদূরে মেদিনীপুর জেলার শেষ সীমা থেকে তিনি নিজে খুব বেশি খোঁজখবর রাখতে পারেন না।
তবে ওই হাইওয়ের তোলা আদায় ছাড়াও তিনি স্থানীয়ভাবে একটু উপরি-আয়ের বন্দোবস্ত করেছেন।
থানা থেকে পঞ্চাশ গজ এগিয়েই পুরনো বটতলা। হাইওয়ের দূরপাল্লার বাসও ওখানে দাঁড়ায়। দুয়েকটা হোটেল, চায়ের দোকান, মুদির দোকান, একটা হোমিওপ্যাথি ডাক্তারখানা। সকাল সন্ধ্যায় কিছু লোক রাস্তার ওপরে ছোটখাটো কুচো মাছ, তরি-তরকারি, ঋতু বিশেষে মহুয়ার ফুল নিয়ে বসে। একটা হাড়িয়া মানে ধেনোপানীয়ের দোকানও কাছেই আছে।
সেই হাড়িয়ার আড্ডার অনতিদূরে হাইওয়ে থেকে একটু নাবালে কয়েকটা একচালা ঘর। তার সামনে সকাল-সন্ধ্যা কয়েকজন পথবণিতা সস্তার পাউডার আর ফুলেল তেল মেখে দয়িতের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।
এটা সম্পূর্ণ হারাধন সারকেলের কীর্তি। আড়ালে-আবডালে হয়তো চলত, কিন্তু প্রকাশ্যে মেয়েদের এই ব্যবসাটা এখানে চালু ছিল না। হারাধনই চালু করেছেন। মেদিনীপুর সদর থেকে এক বৃদ্ধা কুটনিকে এনে তারই মাধ্যমে ব্যবসা চালাচ্ছেন তিনি। বৃদ্ধা দিন দিন হারাধনের ভাগের টাকা মিটিয়ে দেন।
হারাধনবাবু এই একচালা ঘরের মেয়েদের প্রায় নিজের হারেমের রমণীর মতো ব্যবহার করেন। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ওপরওলা বা ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে ভেট দেন। নিজেকেও বঞ্চিত করেন না।
হারাধন ও লালমোহন
সন্ধ্যার পর হারাধন ঘণ্টা দুয়েক নিভৃতে দুয়েকজন অন্তরঙ্গ বন্ধু বা সাকরেদদের সঙ্গে বেশ কিছু পরিমাণ ভারতে উৎপন্ন বিলাতি মদ্য (I.M.F.L.) পান করেন তারপর স্নান-খাওয়া। অবশেষে মধ্যরাত নাগাদ রোঁদে বেরোন।
দু-চারজন লোককে ভাল করে না পেটালে তার রাতে ঘুম হয় না। লাঠি বা চাবুক নয়, স্রেফ খালি হাতে ঘুষি, চড়; কখনও বুটসুদ্ধ পায়ে সজোরে লাথি; শারীরিক ব্যায়াম ভালই হয়। এ বয়েসে এটুকু ব্যায়াম স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যে প্রয়োজন।
.
এর পরে যেদিন শরীর চায়, প্রমীলাসঙ্গ করতে যান। প্রমীলাসঙ্গ মানে সেটাকে তিনি সরকারি ডিউটির মধ্যে ফেলেন। রীতিমতো ধড়াচূড়া পড়ে, হুইসিল নিয়ে সঙ্গে একজন বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে তার নিজেরই একচালা হারেম রেইড করতে যান। দু-চারটে এ পাড়া ও পাড়ার ভদ্রলোক, আধা ভদ্রলোক ধরা পড়ে। তবে তিনি তাদের কিছু বলেন না, ছেড়ে দেন। না হলে, ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাবে।
এরপরে তিনি পড়েন মেয়েদের নিয়ে। যে মেয়ে যত নতুন আমদানি, তার তত বেশি ঝামেলা। তারা কী আর করবে, ভালবাসার অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে।
তা সহ্য করলে কী হবে গতকাল রাতের ধকল হারাধনবাবুর পক্ষে একটু বেশি হয়েছে। দুদিনের। বাজারে একাধিক আনকোরা মেয়ে এসে গেছে তাই এই বিপত্তি।
এদিকে দুদিন আগে একটা অন্য গোলমাল হয়েছে। একটা ট্রাকের ক্লিনার, অল্পবয়েসি যুবক, সে নাকি বি.এ. পাশ ছিল, অন্য কোনও কাজ জোগাড় করতে না পেরে ট্রাকে কাজ নিয়েছিল। সে ভয়ংকর তাঁদড়, কিছুতেই তোলা দেবে না, বলে কিনা, শুধু শুধু পুলিশকে ঘুষ দেব কেন?
সেই যুবকটি ধর্মদাস চক্রবর্তী তাকে ট্রাক থেকে লালমোহন থানায় নিয়ে এসেছিল। থানায় এসেও ধর্মদাসের তড়পানি কমেনি। তার ওপরে সে বারবার বহুস্বীকৃত এবং ন্যায়সঙ্গত তোলা আদায়কে ঘুষ বলায় হারাধনের মাথায় রক্ত উঠে যায়। হারাধন দৌড়ে এসে প্রায় হঠাৎ ধর্মদাসের বুকে সজোরে লাথি মারেন।
.
দুঃখের বিষয় ধর্মদাস যুবকটি বড়ই কমজোরি ছিল। হতদরিদ্র টুলোপণ্ডিতের বাড়ির ছেলে, টিউশনি করে গ্র্যাজুয়েট, তারপরে চার বছর বেকার, গায়ে গতরে অতীব দুর্বল।
লাথি খাওয়ার পরে সেই যে একবার ক করে চোখ উলটিয়ে থানার মেঝেতে পড়ে গেল ধর্মদাস আর উঠল না। লালমোহন চেঁচিয়ে উঠল সর্বনাশ! কী করলেন স্যার?
ব্যাপারটা এর পরে বেশি দূর গড়ানোর কথা নয়। ঘটনা ঘটেছিল সন্ধ্যার মুখে। আর ঘণ্টাখানেক পরে ডেডবডিটা তুলে নিয়ে বুনোপাড়ার ভাগাড়ে ফেলে দিলেই রাতের মধ্যে শেয়ালেরা আপাদমস্তক সাবাড় করে দিত। এদিকে শেয়ালের সাইজ একেকটা অ্যালসেসিয়ান কুকুরের মতো।
হারাধনবাবুর হাতে বা পায়ে মৃত্যু হয়েছে এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু এবারে একটু গোলমাল হয়ে গেল।
ধর্মদাসের ট্রাকের বোকা ড্রাইভারটা ঘটনার সময় থানায়, বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। সে এই দৃশ্য দেখে দৌড়ে ট্রাকে উঠে দ্রুত চালিয়ে সদরে পৌঁছে যায়। তবে সেই ড্রাইভারও বুঝতে পারেনি যে ধর্মদাস মরে গেছে।
তার পরের দিন, মানে গতকাল সকাল থেকে ট্রাক চালক এবং ক্লিনার সমিতি থানায় এসে হল্লা করেছে, ধর্মদাস কোথায়? লেখাপড়া জানা, নম্র ধর্মদাসকে অনেকেই ভালবাসত।
কিন্তু হারাধন বোকা লোক নন। তিনি ড্রাইভার সদরে চলে যাওয়ার খবর পেতেই ধর্মদাসের লাশ স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চালান করেছিলেন। বিশ্বাস ছিল, একটা হার্টফেলের ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করতে পারবেন। প্রথমে লালমোহন এবং তারপরে হারাধন যথেষ্ট চেষ্টা করলেন। কিন্তু সম্ভব হল না। হেলথ সেন্টারের দায়িত্বে রয়েছেন নতুন ডাক্তার দিদিমণি স্বর্ণকুন্তলা। অনুরোধ, উপরোধ, প্রলোভন, ভয় কিছুতেই কিছু হল না দিদিমণি বললেন, অস্বাভাবিক মৃত্যু। পোস্টমর্টেম করাতে হবে।
এদিকে ব্যাপারটা অনেকদূর পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে। কাল ট্রাক ধর্মঘট হয়ে গেছে। ধর্মদাসের মৃত্যুর ঘটনাটা সদরে পার্টিওয়ালারা জেনে গেছে। তিনটে রাজনৈতিক দলের লোক দাবি করছে ধর্মদাস তাদের দলের লোক।
মানবাধিকারের নেতারাও খবর পেয়েছেন। আজ সকালেই হয়তো তারা থানায় আসবেন।
হারাধনের বুদ্ধি
কিন্তু হারাধন ঠান্ডা মাথার লোক।
আজ সকালে বিশ্বস্ত অনুচর লালমোহনের দলাই-মালাই উপভোগ করতে করতে নানারকম ফন্দিফিকির করতে লাগলেন।
এরকম অবস্থায় মানুষ প্রথমে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কথা ভাবে। ঠিক তাই হল, দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললেন, ওই ডাক্তারনি মেয়েছেলেটাকে আমি একচালা ঘরে ঢোকাব। লালমোহন চুপ করে রইল, হারাধন দারোগার যতই ক্ষমতা থাক, এ কাজটা মোটেই সহজ হবে না। কিন্তু হারাধন দারোগার আত্মবিশ্বাস খুব। খঙ্গাপুরে ছোট দারোগা থাকার সময়ে এক উকিলের বউকে তিনি লাইনের বস্তিতে তুলেছিলেন, সে অহংকার আজও করেন।
সে যা হোক, কিছুটা দাঁত কিড়মিড় করার পর আসল কথাটা পাড়লেন, লালমোহন তোকে আজ সাসপেন্ড হতে হবে।
লালমোহন আর্তকণ্ঠে বলল, কেন স্যার?
হারাধন বললেন, ধর্মদাসের মৃত্যুর জন্যে।
দলাই-মালাই থামিয়ে দিয়ে লালমোহন বলল, কিন্তু আমি তো কিছু করিনি স্যার। রোগাভোগা লোকটার বুকে হঠাৎ দুম করে লাথিটাতো আপনিই মারলেন স্যার। আমি তো।…।
লালমোহনকে থামিয়ে দিয়ে হারাধন বললেন, সে তো তুইও জানিস, আমিও জানি কিন্তু একজনকে অন্তত সাসপেন্ড হতে হবে।
লালমোহন বিস্মিত হয়ে দারোগাবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল, তার মুখ দিয়ে বাক্যস্ফুরণ হচ্ছে না।
লালমোহনকে ব্যাপারটা হজম করার সময় দিয়ে হারাধন বললেন, আমি সাসপেন্ড হতে পারি। কিন্তু তাতে তোরা সবাই যে ধনেপ্রাণে মারা পড়বি। তোদের কে দেখবে?
এতক্ষণে লালমোহন বলল, কিন্তু স্যার সাসপেন্ড হলে খাব কী?
.
এই দুঃখের মধ্যেও হো হো করে হেসে উঠলেন হারাধন সারকেল। লালমোহনকে বললেন, এই বিদ্যা নিয়ে পুলিশের চাকরি করিস। সাসপেন্ড হওয়াই তো সরকারি চাকরির মজা। কোনও কাজ করতে হবে না। মাসে কোনও কাটছাট না করে পুরো মাইনের অর্ধেক হাতে পাবি। তা ছাড়া তুই সাসপেন্ড হলে আমি তোকে দেখতে পারব, আমি সাসপেন্ড হলে সবাই মিলে ভরাডুবি হবে।
তবু লালমোহনের সংশয় যায় না।
হারাধন তাকে বোঝান। সাসপেন্ড হওয়া পুলিশের চাকরিতে ছেলেখেলা। নিজের অতীত জীবনের কথা উল্লেখ করেন তিনি। গোহাটায় গোলমাল হচ্ছিল, এদিকে তোলাও ভাল উঠছিল না। সে বছর সদর থানায় থাকার সময় দলবলসহ এক গোরুর পাইকারকে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন। তখন কি জানতেন যে ওই লোকটি বিহারের এক এম পি। প্রচুর বেকায়দা হয়েছিল সেবার।
এরকম তিন-চারটে ঘটনা হারাধন লালমোহনকে বললেন। তারপর বললেন, সাসপেন্ড হলেও তোর ব্যবস্থা সব ঠিকই থাকছে। তবে থানার মধ্যে বা কাছাকাছি থাকলে বিপদ হবে, একটু দূরে দূরে থেকে কাজ চালাতে হবে।
কাজটা কী সেটাও হারাধন লালমোহনকে বুঝিয়ে দিলেন। হাইওয়ের পাশে বদরপুরের বিশাল মাঠ। থানা থেকে জায়গাটা পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরে। কাছাকাছি জনবসতি নেই। একপাশে জঙ্গল। মাঠের ওপাশেও ঘন জঙ্গল।
এখানে লালমোহনকে বিশেষ কেউ চিনবে না। চিনলেও সে যে সাসপেন্ড হয়েছে সেটা জানার কথা নয়। সাসপেন্ড হওয়ার পরে এই বদরপুর লালমোহনকে দেওয়া হবে। বাস-ট্রাক-গাড়ি থেকে তোলা যা উঠবে সব তার, কোনও ভাগ দিতে হবে না। সাদা পোশাকে হাতে একটা বেতের লাঠি নিয়ে লালমোহন এখান থেকে টাকা আদায় করবে।
হারাধন সারকেল বললেন, বছর দুয়েকের মাথায় সাসপেনশন উঠে যাবে। তখন দেখবি মনে হবে যে সাসপেন্ড হয়েই তো ভাল ছিলাম।
লালমোহন রাজি হতে সেদিন বিকেলেই সাসপেন্ড হয়ে গেল।
লালমোহনের বিপদ
এবার শীত খুব জমজমাট পড়েছে।
যথারীতি লালমোহন বদরপুরের মাঠে ডিউটিরত। এই এলাকাটা এমনিতেই চরম আবহাওয়ার। যেমন গরম, তেমন ঝড়-বৃষ্টি, তার চেয়েও বেশি শীত।
বিকেলের দিকে জঙ্গলের মধ্যে থেকে একটা উত্তুরে হাওয়া এসে হাড় কাঁপিয়ে দেয়। তা ছাড়া আজ এই মাঘের বিকেলে ঘন মেঘ জমেছে। আকাশের চেহারা সুবিধের নয়।
সেই ঘটনার পর দেড় বছর চলে গেছে।
লালমোহনের সেই সাসপেনশনের কেসের এসপার-ওসপার কিছু হয়নি। ফাইল সদরে কোথায় কোনও ওপরওলার দেরাজে ফিতে বন্দি হয়ে পড়ে আছে। গ্র্যাজুয়েট ক্লিনার ধর্মদাস চক্রবর্তীর পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে কিছুদিন হইচই হয়েছিল। তারপর সবাই ভুলে গেছে, এরকম কত হয়।
জ্যোতিষীর বাণী সফল করে হারাধন সারকেল কিন্তু প্রমোশন পেয়ে সার্কেল অফিসার হয়ে গেছেন, সেও প্রায় এক বছর হতে চলল।
হারাধন অকৃতজ্ঞ লোক নন। তিনি লালমোহনকে ভোলেননি। তবে এখন আর নিয়মিত খোঁজখবর নিতে পারেন না। সার্কেল অফিসার হওয়ার পর সদরে পোস্টিং হয়েছে তার।
আজ বিকেলে হারাধনবাবু এই জেলায় নবনিযুক্ত এস পি সাহেবকে নিয়ে সফরে বেরিয়েছেন। জেলার বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যে এই সফর। যেহেতু হারাধনবাবু এই অঞ্চলে আগে দারোগা ছিলেন তাই এস পি সাহেব তাকে সঙ্গে নিয়েছেন।
বিকেলের দিকে তখনও বৃষ্টি নামেনি, হারাধনবাবু লালমোহনকে বদরপুরের মাঠের ধারে লাঠি হাতে ডিউটি করতে অর্থাৎ তোলা আদায় করতে দেখে গেছেন।
পুলিশের গাড়ি দেখে লালমোহন তাঁদের গাড়িটা এড়িয়ে গিয়ে রাস্তার ওপাশে চলে গেছে, অবলা লালমোহন এটা বুঝতে পারেনি যে এ গাড়িতে হারাধন সারকেলও রয়েছে।
সন্ধে হতে না হতে প্রচণ্ড বৃষ্টি নামল। সেই সঙ্গে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া।
কাছাকাছি মাথা গোঁজার একটা জায়গা নেই। গাছতলায় একটু সাময়িক আচ্ছাদন পাওয়া গেল। কিছু পরে জলের তোড়ে গাছের পাতা ছুঁড়ে বৃষ্টি পড়তে লাগল, যে সে বৃষ্টি নয়, বরফ জলের ধারাস্রোত।
.
গাছের নীচে থেকে ফঁকা রাস্তার ধারে এসে দাঁড়াল লালমোহন, অতিরিক্ত ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে, দাঁতকপাটি লেগে যাচ্ছে।
সামনে যে গাড়ি আসছে ট্রাক হোক, বাস হোক, প্রাইভেট বা অটো বারবার ছুটে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে লাগল লালমোহন, কোনওরকমে একটু উঠে আস্তানায় ফিরে যাওয়া।
কিন্তু বৃথা চেষ্টা। একটি গাড়িও দাঁড়াল না। যথারীতি তারা লালমোহনের প্রসারিত হাতে একটি করে পাঁচ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে দ্রুত চলে গেছে। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে, ঝোড়ো হাওয়ায় তার কাতর অনুরোধ কোনও গাড়িচালকের কানে পৌঁছয়নি।
উদ্ধার করলেন হারাধন সারকেল। সাহেবকে এলাকা দেখিয়ে ফেরার পথে হারাধন দেখেন যে বদরপুরের মাঠের পাশে লালমোহন তখনও দাঁড়িয়ে।
লালমোহন তখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। হাইওয়ের ওপর খোলা আকাশের নীচে অঝোর বৃষ্টিতে অসহায়ের মতো ভিজছে।
স্যার, আমাদের একটি ছেলে এই দুর্যোগে এখানে ডিউটি করছে, ওকে তুলে নিয়ে যাই। বড়সাহেবকে এ কথা বলে হারাধন ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন লালমোহনের পাশে গাড়ি দাঁড় করাতে।
দরজা খুলে ডাকতে লালমোহন আচ্ছন্নের মতো গাড়িতে উঠে এল, সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসল। তার শরীরের আর জামাকাপড়ের জলে গাড়ির সামনের সিটটা ভিজে গেল।
.
পেছনের সিটে বড়সাহেবকে সে লক্ষ করেনি। নতুন বড়সাহেবকে চেনেও না। গাড়ি চলতে শুরু করলে হারাধনবাবু কিঞ্চিৎ স্নেহময় গঞ্জনার সুরে লালমোহনকে বললেন, ডবল নিমুনিয়া হয়ে যাবে। তোমার উচিত ছিল বৃষ্টি আসামাত্র একটা গাড়ি ধরে বাড়ি ফিরে যাওয়া।
বড়সাহেব বললেন, এই দুর্যোগেও লোকটি ডিউটি করছিল, এরকম কর্তব্যপরায়ণতা আজকাল বিরল।তারপর একটু থেমে হারাধনকে বললেন, সি আই সাহেব, কাল অফিসে এর নামটা আমাকে একটু মনে করিয়ে দেবেন।
কিন্তু তখনই হারাধন কোনও রকম বাধা দেওয়ার আগেই লালমোহন বললেন, আমি কি বাড়ি ফেরার কম চেষ্টা করেছি। কিন্তু যেই গাড়ি থামাতে হাত বাড়াই, হাতের মধ্যে একটা পাঁচ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে গাড়ি ভেগে যায়। দেখুন না অবস্থা, প্যান্ট ও শার্টের পকেট থেকে বের করে ভেঁড়া, ময়লা পাঁচ টাকার শতশত ভেজা নোট লালমোহন গাড়ির সামনের সিটে রাখতে লাগল।
বড়সাহেব বললেন, এ তো দেখছি সৎও খুব, ঘুষের টাকা নিজে থেকে বের করে দিচ্ছে।
সুযোগ বুঝে হারাধন বললেন, স্যার, এর একটা কেস আপনার টেবিলে আছে।
বড়সাহেব বললেন, কাল অফিসে মনে করিয়ে দেবেন।
সামনের সিটে বসে লালমোহন তখনও শীতে-ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে।