লালবাজারে রাহাজানি
প্রথম প্রকাশ: আশ্বিন ১৩৯৯, সেপ্টেম্বর ১৯৯২
প্রকাশক: মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা ৭০০ ০০৯। পৃ. ৮ + ১২৮। মূল্য ২০.০০
প্রচ্ছদ: শ্রীগণেশ বসু
অলংকরণ: রুচিরা মজুমদার
উৎসর্গ: তমালী ও জয়া বসু / স্নেহাস্পদেষু
.
নিবেদন
১৯৬৫ সাল। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী তখন প্রফুল্লচন্দ্র সেন। কলকাতার পুলিশ কমিশনার পি. কে. সেন। আমি তখন সদ্য কিশোর। এইসময় কর্মসূত্রে আমাকে লালবাজারের সদর দপ্তরে খোদ কমিশনার সাহেবের চৌকাঠ পর্যন্ত সপ্তাহে দু’বার করে যেতেই হত। ওনার ভাই পি. কে. সেনগুপ্ত সাহেব ছিলেন আমার ঊর্ধ্বতন অফিসার। তিনিই পাঠাতেন। সন্তোষবাবু নামে একজন ড্রাইভার গাড়ি করে আমাকে পৌঁছে দিয়ে আবার নিয়ে আসত। আর সদাহাস্যময় বিজয় লাহিড়ী মহাশয় প্রথমদিন নিজে এসে আমাকে C. P-র ঘর চিনিয়ে দিয়ে গেলেন। সে আজ কত বছর আগেকার কথা।
প্রথম যেদিন লালবাজারের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করেছিলাম তখন সে কী ভয়। বড় বড় হোমরা চোমরা পুলিশ অফিসারদের দেখে বুক শুকিয়ে গিয়েছিল। লাহিড়ীদা বলেছিলেন, ভয় পাবার কিছু নেই। এই সাজ পোশাকের আড়ালে এঁরাও কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ। অনেকটা যাত্রায় সাজা রাবণের মতো ভূমিকা এঁদের। কেউ বাধা দিলে বলবে C.P-র ঘরে যাচ্ছি। দেখবে, যমেও তখন পথ ছেড়ে দেবে।
তবুও প্রথম প্রথম ভয় করত খুব। তারপর তো চেনা পরিচয় হয়ে গেল কতজনের সঙ্গে। C. P.-র দু’জন বডিগার্ডের একজন ছিলেন অত্যন্ত রূপবান পুরুষ। তাঁর দিকে তাকিয়ে ভাবতাম এই মানুষ চলচ্চিত্রের নায়ক না হয়ে পুলিশের চাকরিতে কেন? তাঁদের কথাবার্তা শুনেই বুঝতে পারলাম, পুলিশ হলেও এঁরা নিষ্ঠুর বা অত্যাচারী নন। এঁরা মিষ্টি করে হাসতে জানেন। সুখ দুঃখের কথা বলেন। চা খানা। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়েন। হেমন্তের সুর ভাঁজেন। উত্তম সুচিত্রার অভিনয়ের প্রশংসা করেন। করেন সংস্কৃতির চর্চা। তা হলে?
লালবাজার সম্বন্ধে, পুলিশ সম্বন্ধে ধারণাটাই তখন পালটে গেল। আমার তখন প্রচণ্ড কৌতূহল। তাই এখানে এলেই এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে দেখতাম। জানতে চাইতাম, এখানে কী হয়, ওখানে কী হয়! ছেলেমানুষ তো। তার ওপর সাহসে বুক বাঁধা। যা তা ব্যাপার নয়, একেবারে খোদ কমিশনার সাহেবের লোক। এইভাবেই ঘুরতে ঘুরতে একদিন পড়ে গেলাম এক বদমেজাজি অফিসারের পাল্লায়। অফিসারটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। কিন্তু কী দারুণ ব্যক্তিত্ব তাঁর। শক্ত করে আমার হাত ধরে ইংরেজিতে তেড়ে একটা ধমক। ছুটে এল অনেক পুলিশ। আটকে দেয় আর কী। কিন্তু ওই যে, লাহিড়ীদা বলেছিলেন, কেউ কিছু বললেই বলবে C.P.-র লোক। নির্ভয়ে বললাম। কিন্তু কাজ হল না তাতে। এলাকাটা খুবই নিষিদ্ধ তা জানতাম না। তাই সন্দেহ ওদের বেশি হল। অল্পবয়সি একটা ছেলে, বলে কিনা, C. P.-র লোক? সবাই চেপে ধরল আমাকে, চালাকি পেয়েছ? বলো তুমি কে? কে পাঠিয়েছে তোমাকে? C. P.-র ঘর কোনদিকে? আমি ভয়ে ভয়ে সব বললাম।
কেউ বিশ্বাস করল না! বলল, সহজে ছাড়া হবে না একে। মনে হচ্ছে আটঘাট জেনেই ভেতরে ঢুকেছে।
একজন বলল, আগে তো ঢুকিয়ে দাও। সাত-আট ঘণ্টা আটকে রাখলেই সব ফাঁস করে দেবে!
অ্যাংলো অফিসারটি বললেন, তার আগে যাচাই করে দ্যাখো ও যা বলছে তা ঠিক কি না।
সবাই তখন আমাকে নিয়ে চলল যাচাই করতে। কিন্তু মুশকিল হল C. P. র ঘরের দিকে যাবার সাহস আর কারও নেই। সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত গিয়েই থমকে দাঁড়াল সবাই! আমি যতই নির্ভয়ে ওপরে উঠে যেতে চাই ওরা ততই নিজেদের মধ্যে এই তুই যা। তুই যা না! সবার যাওয়া ঠিক নয়, যে কোনও একজন যা, করতে থাকে। এমন সময় ভাগ্যক্রমে C. P.-র বডিগার্ড হঠাৎ সেখানে এসে পড়েছিলেন তাই রক্ষে। আমার অবস্থা দেখেই বললেন, সর্বনাশ। কাকে ধরেছেন? ছাড়ুন আগে। এ যে আমাদেরই লোক। সবারই চোখ তখন কপালে। ভাবটা এই, না জেনে একে আটকে দিলেই হয়েছিল আর কী। আমি যে অন্য কেউ নই এই পরিচয় পেয়েই হাসিমুখে কেউ আমার গাল টিপে, কেউ পেট চাপড়ে বিদায় নিলেন। সেই মুহূর্তে বুঝে গেলাম পুলিশি মেজাজের আড়ালে এঁরাও কত সহৃদয়। এঁদেরও ভয় ডর আছে।
সেই কিশোর বয়স থেকেই লালবাজার আমার মনে প্রভাব ফেলেছিল। লালবাজারের ইউনিফর্ম পরা পুলিশদের ব্যস্ততা, কর্মতৎপরতা গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল আমার মনে। তখনই ঠিক করেছিলাম এই লালবাজারকে কেন্দ্র করেই মনের মতো একটা বই আমি লিখব। কিন্তু লিখিনি বা লিখতে পারিনি অনেকটা সঙ্গত কারণে। অথবা ধরা যেতে পারে লেখার ফর্ম খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলে। না হলে অভিজ্ঞতাও তো কম নয়, কনস্টেবল থেকে অনেক উঁচুমহলের অফিসারকেও দেখেছি এক সময়। আমার মনে সবাই তাঁরা রেখাপাত করেছেন। রেখাপাত করেছেন বিশাল বপু জে. এন. মজুমদার এবং ডি. সি. চন্দ্র সাহেবের মতো জাঁদরেল পুলিশ অফিসারও। চন্দ্র সাহেবের ফুলের মতো ফুটফুটে মেয়েটিকে দুর্বৃত্তরা তুলে নিয়ে গেল। শত তদন্তেও পাওয়া গেল না তাকে। আমার কিশোর মন গভীর বেদনায় কেঁদে উঠেছিল। প্রতিবাদী মন বলে উঠেছিল অপরাধ যদি করে থাকে কেউ তার ফল ওই শিশুটি কেন ভোগ করবে? হায়রে! কেউ যদি একটা পিস্তল কিংবা রিভলভার তুলে দিত আমার হাতে আর শিখিয়ে দিত কীভাবে এগুলোকে প্রয়োগ করতে হয় তা হলে দুষ্টের দমনে কলকাতার বুকে আর এক রবিনহুড হয়ে উঠতাম আমি। এর পরেও দেখেছি চন্দ্ৰ সাহেব কঠিন সংযমের মোড়কে নিজেকে আবৃত রেখে কী নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর নিজের কাজ করে গেছেন। কাউকে জানতেও দেননি তাঁর বুকের ভেতরট! কীভাবে কুরে কুরে খেয়ে গেছে বেদনার ঘুণপোকা। সেইসব মানুষরা আজ কোথায়?
তাই এত দিন পরে লালবাজারকে পটভূমি করে যে কাহিনি আমি লিখতে বসেছি তার সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল না থাকলেও একেবারেই অবাস্তব নয়। সেইসব চেনা মুখগুলি বারে বারে ছায়াপাত করেছে এর মধ্যে। সবেরই ভাল এবং খারাপ দিক আছে। আমি সেইসব ভালমানুষদের কথাই লিখেছি। ছাই ফেলতে যেমন ভাঙা কুলো তেমনি যত দোষ নন্দ ঘোষের। তাই সব দোষ পুলিশের ঘাড়ে চাপিয়েই বোঝা হালকা করতে চায় সবাই। অথচ পুলিশের চাকরি যারা করেন না তারা যে কী মারাত্মক সে কথা কিন্তু কেউ ভুলেও বলেন না। এই চাকরিতে আসার আগে অন্য চাকরি করতে গিয়ে তাদের ভয়াবহ রূপ আমি দেখেছি। আমি তখন শালিমারে চাকরি করতাম। একেবারে নীচের তলা থেকেই জীবন শুরু হয়েছিল। তাই অপরাধী এবং পুলিশ দুই সম্প্রদায়কেই কাছ থেকে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল। দেখেছিলাম রাতের শালিমারে বাংলার বুক থেকে যখন বাংলাকে কেড়ে নেওয়া হয় পুলিশ তখন কত অসহায়। আনামিয়া, তায়জু সারেং, গফুর গুন্ডা হেনা আলম মর্নের মধ্যে রেখাপাত করে। ১৯৬২, ৬৩, ৬৪ সাল। স্মৃতি কত বেদনার। কমলু নামের সেই নেপালি কিশোরী, পটুন ডেকে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকত, যাকে দেখেই প্রথম ভালবাসতে শিখেছিলাম। তারও করুণ পরিণতি একদিন দেখলাম। কমলুর ভয়াবহ পরিণতির জন্য সেদিন কিন্তু পুলিশ দায়ী ছিল না।
যাই হোক, এসব কথা অপ্রাসঙ্গিক। আমার কিশোর পাঠক-পাঠিকাদের হাতে এই বইটি তুলে দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। কেননা এ তো আমার বহুদিনের স্বপ্নের ফসল। সেই সঙ্গে বড়দেরও আমন্ত্রণ জানাচ্ছি তাঁদের অমূল্য সময় নষ্ট করে শুধুমাত্র চিত্ত বিনোদনের জন্য বইটির পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে নিতে। আশা করি খুব একটা খারাপ লাগবে না। ধন্যবাদ জানাচ্ছি প্রকাশককে। বইটি প্রকাশ করবার জন্য।
ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
জন্মাষ্টমী ১৩৯৯ সন