লালন ফকির : জীবন

লালন ফকির : জীবন

এক

নিশান্তিকার মায়াবী আলোর ওড়না ঢাকা শেষ তারাটি এবার বোধহয় বিদায়ের প্রস্তুতি শুরু করেছে।

এখনও প্রভাত সূর্যের আগমনবার্তা ধ্বনিত হয়নি। পাখিরা সবেমাত্র ডাকাডাকি করেছে। এক অলৌকিক সকালের জন্ম হচ্ছে এই বিস্তৃত বিপন্ন জলরাশির ওপর।

ঘুম অথবা ঘুম-ঘুম আচ্ছন্নতা জড়িয়ে রেখেছিল লালনকে। এইমাত্র অতিকষ্টে চোখ মেলে তাকাল সে। পরিব্যাপ্ত পরিমণ্ডলের অনুপম নিসর্গ শোভা তাকে বিন্দুমাত্র আলোড়িত করতে পারল না। পারবে কী করে? সে বড়ো ক্লান্ত, উজান বেয়ে অনেকটা পথ পার হয়েছে। বাঁশের তৈরি ভেলায়। কী আশ্চর্য! কী বিপুল তার প্রাণশক্তি। ঈশ্বরের অনুগ্রহে অথবা আল্লার দোয়ায় এখনও বেঁচে আছে সে!

অথচ এমনটি হবার কথা ছিল না। চোখ বন্ধ করল লালন। অস্ফূট আর্তনাদের মতো কয়েকটি শব্দ বেরিয়ে এল তার শুকনো ঠোঁটের কোণ থেকে—মা, বড়ো খিদে।

কেউ কি ছিল সেখানে? কোনো এক স্নেহময়ী জননী? যার অন্তরের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করেছিল এই অস্ফূট আর্তধ্বনি। ছুটে এসেছিল সে। সে কোন জাতের, আমরা জানি না। তার ধর্ম পরিচয় কী, আমাদের অজানা। আমরা জানি সে এক মাতৃস্বরূপিনী। তার চোখে ভাসছে অনাগত ভবিষ্যতের ছায়া। সে জানে না এই নামগোত্রহীন মানুষটিকে নিয়ে সে কী করবে!

তার নাম আমিনা। মধ্যবয়সিনী/বন্ধ্যা বলে সংসারের সকলে তার দিকে অভিশাপের আঙুল তোলে। বেচারী আমিনা, সন্তানবতী হওয়ার স্বপ্ন তার অনেকদিনের। সে কবেকার কথা। কৈশোর সমাগত সেই দিনগুলি-তে আপন মনে পুতুল খেলায় অংশ নিত সে। দারিদ্রের সংসার। তাতে কী? মনের খুশি কেউ কি কাড়তে পারে? নিদারুণ দুঃখকষ্টের চাবুক মেরে কেউ কি দমিয়ে রাখতে পারে উচ্ছাস উদ্দীপনা?

সেই আমিনা, গফুর জোলার স্ত্রী, ভাগ্য ভালো, সতীন নিয়ে ঘর করতে হয় না তাকে। গফুর জোলা সৎ চরিত্রের মানুষ। ধর্মে মতি আছে। রোজ নিয়ম করে নামাজ পাঠ করে। গফুর জানে এই জগৎ-সংসারের সবকিছু আল্লাহর অবদান।

রোজ সকালে পানি আনতে যাওয়া আমিনার অনেকদিনের অভ্যেস। নিজের হাতে ঘরদুয়ার পরিষ্কার করে সে। উঠোন নিকোয়। বারান্দায় নতুন করে কাদামাটি লেপে দেয়। সংসারের সকলের প্রতি তার অসীম ভালোবাসা। সে আর গফুর জোলা—এছাড়া আছে একপাল হাঁস, ভোর না হতেই তাদের প্যাঁক প্যাঁকানি শুরু হয়ে যায়। দুটি দুবেলা গাই এবং কী আশ্চর্য, একটা লেজকাটা নেড়ি কুকুর। আদর করে আমিনা তার নাম রেখেছে ভোলা। এদের নিয়েই ভরভরন্ত সংসার গফুর আর আমিনা বিবির।

দিন আনি দিন খাই অবস্থা। গ্রাম বাংলার সামান্য জোলা, তাঁত বুনে কি আর সংসার চালানো যায়? তবু কী আশ্চর্য, অবাধ খুশির ঝলক তাদের ঠোঁটের কোণে। কেউ কখনো গফুর আর আমিনাকে ঝগড়া করতে দেখেনি। সত্যি সে এক অবাক করা ব্যাপার!

ধীরে ধীরে সূর্যের আলো পরিব্যাপ্ত করল চারপাশ। কুয়াশার যেটুকু অন্ধকার ছিল, সবকিছু কেটে গেল। তখন হেমন্তকাল। শীতের কামড় শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টিবিহীন নীল আকাশ। উজ্জ্বল রৌদ্রালোক। গ্রামবাংলা অপরূপা সাজে সাজিয়েছে নিজেকে।

ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেছে। গাঙের ধারে আমিনা বিবি করছে কী? প্রত্যেক গ্রামে কিছু মানুষ থাকে—ঘরের খেয়ে পরের মোষ চরানো যাদের একমাত্র কাজ, তারাই এগিয়ে এল। ষণ্ডা মার্কা দু-একজন বারণ করল তাকে। জাত-কূল জানা নেই, হিঁদুর ঘরের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে, তাকে নিয়ে এত আদিখ্যেতার কী আছে?

গফুর জোলা ভালো মানুষ। সাতে পাঁচে থাকে না, নিজের কাজে ব্যস্ত। নেশাভাঙ করে না বেচারী, কী করে রুখে দাঁড়াবে এই সব অব্যবস্থার বিরুদ্ধে? সে-ও ভাবল পরের ঘরের একটা ছেলেকে নিয়ে এত সব হ্যাপা পোহানোর কী দরকার? একেই তো মাথায় হাজার সমস্যার পাহাড়। নতুন করে একটা সমস্যা ডেকে না আনলে কি চলছিল না?

লালন চোখ বন্ধ করল। আবার সেই ঘুম-ঘুম আঁধার। অবচেতনার অন্ধকার। চারপাশ থেকে ভেসে এলো অসংখ্য মুখের মিছিল। আমি কে? চিরন্তন প্রশ্ন। আমি কোথায় এসেছি? কেন এসেছি? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথার মধ্যে। কী অবাক! এসব প্রশ্নের উত্তর সে জানে না। তার কেবলই মনে হচ্ছে অনাদি অনন্তকাল সে এভাবেই এক অচেনা অজানা মায়ের কোলে শুয়ে আছে। ওই বিরাট গাঙের জল তাকে পরিতুষ্ট করেছে। আকাশ থেকে ঝরে পড়েছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। বসন্ত বাতাস তার মনকে করেছে উতলা। তবু মনে পরে দূর্গা-প্রতিমার মতো একটি মুখ, টানা টানা দুটি চোখ, কপালে সিঁদুরের টিপ, পরণে নেহাত আটপৌড়ে শাড়ি, পায়ে ঝুমুর ঝুমুর মল বেজে যায়। রথের মেলায় শখ করে কিনেছিল লালন। পয়সা ছিল না, টিনের পাত দিয়ে মোড়া। সব ছবি আসে আর চলে যায়। লালনের সমস্ত শরীরে এক অদ্ভুত ছটফটানি। কী যেন বলার চেষ্টা করে সে, পারে না, বেচারী আবার তলিয়ে যায় নিদ্রার অতল জলে।

রুখে দাঁড়াল আমিনা। সে জানে, তার মতো এক দরিদ্র নারীর মনের ভেতর একটুকরো আগুন আছে! সে বলল—জাত-কূল আমি মানি না। হিঁদু কী ঘেরেস্তান জানি না। একটা মানুষ মরতে বসেছে, সারা গায়ে মায়ের দয়া, আর তাকে আমি এভাবে ফেলে যাব? না, তা আমি পারব না। তোমরা যতই আমাকে বকাঝকা করো, একঘরে করো, অন্নজল বন্ধ করো, আমি এই ছেলেটাকে আমার কাছে রাখব। তোমরা কেউ রুখতে পারাবে না।

পিছিয়ে গেল মোল্লা মৌলবীদের দল। এতকাল তারা আল্লাহর নামে শুধুই অত্যাচার করেছে, সাধারণ মানুষের বুকে পা তুলে দাঁড়িয়েছে, তাদের কন্ঠ রোধ করেছে। কী এক অদ্ভুত সাহস লুকিয়ে ছিল আমিনার আপাত নিরীহ কন্ঠস্বরে। শব্দগুলো যেন তীক্ষ্নবাণ হয়ে ঝরে পড়ছিল। তবুও কেউ কেউ সহজে হার মানবে না, এমন একগুঁয়ে মনোভাবের, গফুরকে বলল—শোন গফুর, তোর বিবির বড় বাড় বেড়েছে। এমনটি করলে, কিন্তু এ পাড়ায় অন্ন-জল উঠবে, বলে দিচ্ছি। আমি সামসুদ্দীন গাজী, আমার কথায় সকলে ওঠবোস করে, আর তোর বিবি কিনা….

কথাগুলো শেষ করেনি সামসুদ্দীন গাজী। পিক লাগানো হলদে কুতকুতে দাঁতের সারি, পিরিচ করে খানিকটা পিক ফেলে দিল পথের ওপর। তারপর কটমট চোখে তাকাল আমিনা আর গফুরের দিকে। সবাই জানে সামসুদ্দীন একটা শয়তান। তবু তার মুখের ওপর কথা বলে এমন বুকের পাটা কার আছে? আছে হয়তো ছিল হয়তো আমিনার। আপাতত জিতে গেছে সে এই লড়াইতে। ঠিক হয়েছে অন্তত কয়েকদিন এই জাত-কুলহীন ছেলেটাকে নিজের ঘরেই রাখবে আমিনা। তারপর? তারপর কী হবে, আমিনা জানে না।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে সন্ধ্যে নামে। আসে রাতের ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। আশ্চর্য, পিদিম জ্বেলে তাঁতঘরের পাশে শুয়ে থাকা লালনের শিয়রে বসে আছে আমিনা। সমস্ত রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না সে। স্বামী গফুর অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার স্ত্রী আমিনার দিকে। কত কথাই মনে পড়ে যায় তার। কত বছর হয়ে গেল, সেই নিকাহ করার মুহূর্ত, তখন আমিনার বয়স কতই না হবে? নয় পার হয়ে সবেমাত্র দশে পা রেখেছে। নেহাতই এক বালিকা। তারপর? দেখতে দেখতে কতগুলো বছর কেটে গেল। সেই আমিনা আজ মধ্যবয়সিনী। মা হবার বড়ো শখ ছিল তার। বাঁজা মেয়েছেলে বলে গ্রামবাসীরা কটু মন্তব্য করে। তার ছায়া মাড়ালে নাকি পাপ হয়— এমন কত কথাই বলে। আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেছে গফুর, পীর সাহেবের মাজারে গিয়ে বাতি জ্বালিয়েছে, মৌলবীর পায়ে মাথা রেখেছে—না, কিছুতেই কিছু হয়নি। সেই আমিনার মধ্যে এমন একটা মাতৃশক্তি লুকিয়ে ছিল—আড়াল থেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে গফুর। তার শুকনো চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে। কিন্তু গফুরের মনের ভেতর সংশয়ের আগুন ধিকিধিকি জ্বলে উঠছে। গ্রামবাসীরা ক্ষেপে গেছে। আর বেশি দিন ওরা এসব অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করবে না। তাহলে আমিনার কী হবে? আমিনা যে একেবারে প্রাণমন সঁপে দিয়ে ছেলেটার সেবা করছে, তার বুক থেকে ছেলেটাকে কেড়ে নেওয়া ঠিক হবে কি?

অসহায় আর্তনাদ করে ওঠে গফুর মিঞা। খোদার উদ্দেশ্যে মিনতি জানায়। বলে—হে ঈশ্বর, দেখো, আমার বউটা চিরদুখিনী। তুমি তার বুক খালি করে দিও না।

আমরা জানি না, বিশ্ব চরাচরের কোথায় আল্লাহর অবস্থান। আমরা জানি, সর্বত্র তিনি বিদ্যমান। স্থলে-জলে-অন্তরীক্ষে। গফুর মিঞার বুক ফাটা আর্তনাদ কি তাঁর কানে পৌঁছেছে? নাকি তিনি সবকিছুর দিকে তাকিয়ে আছেন এক নির্মোহ দৃষ্টিতে? এই জগতে ঘটে যাওয়া ঘটনার ওপর বিন্দুমাত্রা প্রভাব ফেলতে চান না তিনি হয়তো।

চোখ মেলল লালন, তখন মধ্যরাত, সুসুপ্তির আঁধার ঢাকা পৃথিবী। গাঙের জলে ঢেউ লেগেছে—ছল্-ছল্-ছল্-ছলাৎ শব্দ শোনা যাচ্ছে। আকাশের এক কোণে মরা চাঁদ। আজ কী তিথি, লালন জানে না। আবার সেই স্মৃতির উচাটন, পরিচিত প্রিয় মুখ, নথপরা ভাসা ভাসা দুটি চোখ, ডাগর চোখের তারা, কী যেন বলতে চায়, অথচ বলতে পারে না। আবার অন্ধকার, তারপর অমানিশা—মা, বড়ো তেষ্টা, একটু জল দেবে?

এই প্রথম জল শব্দটা শুনে চমকে উঠল আমিনা। তার মানে? সামসুদ্দীন গাজী কি ঠিকই বলেছে? হিঁদুর ঘরের ছেলে? তার মানে? আমি তো একে আটকে রাখতে পারব না আমার তাঁত ঘরের পাশে? একে তো একদিন ছেড়ে দিতেই হবে। অচিন পাখি হঠাৎ এসেছে আমার ঘরে। এবার বোধহয় তার যাবার সময় হল।

মুখের ওপর আঁচল চাপা দিয়ে পানি আনতে যায় আমিনা। তৃষ্ণার্ত চোখে নতুন মায়ের দিকে তাকায় লালন। জলটুকু খেয়ে ফেলে, আবার নিদ্রা, আবার অন্ধকার, আবার সেই বিস্মৃতির আহ্বান!

চোখ খুলেছে লালন। সূর্য হাসছে। সাতসকালে পৃথিবীর কোথাও একটুকরো দুঃখ নেই। এই যে জোলাপাড়া, এখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দাই মুসলমান। তাতে কী? জাতের বড়াই লালন করে না কখনো। একেবারে ছোটবেলা থেকে। যদিও ছোটবেলার সেসব কথা এখন বেমালুম ভুলে গেছে সে। হয়তো বা স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গেছে। হয়তো ইচ্ছে করেই সে তার পূর্ব পরিচয় প্রকাশ করতে চাইছে না।

আমিনা বার বার বলছে—বলো, বলো বাপধন আমার, কোথায় তোমার গ্রাম? মা-বাবার নাম কী? আমি জিগাচ্ছি তুমি উত্তর দিচ্ছ না কেন? বুঝতেই তো পারছ বাপ আমার, তোমাকে আমি চিরদিন কি এখানে ধরে রাখতে পারব?

লালন তাকাল আমিনার দিকে, কী এক অদ্ভুত চাউনি ঝরে পড়ছে তার দুটি চোখ থেকে। সেখানে আছে নির্লিপ্ততা, আছে নিদারুণ প্রশান্তি। সে বলল—মা, আমি এখানে আছি, তোমার কি খুব অসুবিধা হচ্ছে?

আমিনার বুকের ভেতর আবার সেই হাহাকার। তোকে কেমন করে বোঝাই, তুই আমার নাড়ি ছেঁড়া ধন হয়তো নোস কিন্তু এই কদিনে তোকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। তোর সমস্ত শরীরের মধ্যে কী একট অদ্ভুত অসহায়তা লুকিয়ে আছে। তোর চোখের তারায় আছে নিঃসীম বেদনার চিহ্ন। ওরে আমার ইচ্ছে জীবনের বাকি দিনগুলো তোকে এখানেই রাখি। একটা ভালো মেয়ে দেখে তোর নিকাহর ব্যবস্থা করি। নাতি পুতি হোক। কিন্তু ওরা, ওই সামসুদ্দীন গাজীর দল, ওরা তা হতে দেবে না। ওরা এক দরিদ্র জোলাবউয়ের স্বপ্ন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা খেলবে। বিদ্রুপের হাসিতে হেসে উঠবে হো হো করে। লালন, বাপ আমার, বল, কোথায় তোর গাঁ? আমি তোকে তোর আসল মায়ের কাছে পৌঁছে দেব!

হয়তো একদিন স্মৃতি ফিরে পেত লালন, হয়তো সে আবার ফিরে যেত তার আপন গাঁয়ে। কিন্তু আমরা জানি না, বিধাতা কার জন্য কোথায় আসন নির্দিষ্ট করে দেয়। তা না হলে হঠাৎ কেন দমকা হাওয়ার মতো এক মাঝদুপুরে সিরাজ সাঁই তার দলবল নিয়ে হাজির হবে এই জোলাপাড়ায়? এতদিন সে ছিল যশোরের ফুলবাড়িতে। তার অশেষ দয়া, আবার পথ ভুলে সে এখানে এসেছে।

সিরাজ সাঁই? কে সে? তাকে আমরা দরবেশ বা ফকির—যে কোনো নামে ডাকতে পারি। দশাসই চেহারা, বজ্রগম্ভীর কন্ঠস্বর, একতারা বাজিয়ে যখন সে গান ধরে তখন মনে হয় সারা পৃথিবীতে বুঝি কাঁপন জেগেছে, ধুম লেগেছে হৃৎকমলে।

এই সিরাজ সাঁই আমিনা এবং গফুর মিঞার বিশেষ পরিচিত। যখন জোলাপাড়ায় আসে, অন্তত একদিন এই তাঁতঘরের উঠোনে ফকিরি গানের আসর বসায়, আর সেখানেই, সেখানেই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। টিমটিম করে জ্বলছিল প্রদীপের আলো। ভিড় জমিয়েছিল কিছু কচি কাঁচার দল। সিরাজ সাঁইকে দেখামাত্র লালনের সমস্ত শরীরে একটা অদ্ভুত শিহরণ। চোখ বন্ধ করল সে। হাজার সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল চারপাশ। সহসা লালনের মনে হল, এই মুখখানি সে যেন কবে দেখেছে। কবে? ঠিক মনে নেই। এ বুঝি কো জন্ম-জন্মান্তরের কাহিনি। কিন্তু এই মানুষটির সঙ্গ তার ভালোলাগে। এই মানুষটি বুঝি দেবদূত। সে এসেছে লালনের হৃদয়ের সমস্ত অন্ধকার দূর করতে। হাজার হাজার আলোকশিখা সেখানে জ্বেলে দিতে।

সিরাজ তাকাল লালনের মুখের দিকে। বয়স হয়েছে। বার্ধক্যের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে সে। আজ বাদে কাল তাকে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে। এটাই খোদা তালাহর নিয়ম। সেই কবে, যৌবনের প্রথম দিনে কীসের টানে ঘর ছেড়েছিল সিরাজ, কেউ জানে না। তারপর? দেখতে দেখতে আজ কতগুলো বছর হয়ে গেল। নিজস্ব আখড়া আছে সিরাজের। ফকিরি গানের দল আছে। মুখে মুখে গান বাঁধতে পারে সে। সেই গানে সুর বসায়, সেই গানের মধ্যে কখনো শোনা যায় বৃষ্টির কলতান। কখনো উল্কার অগ্নিবাণের শব্দ। আবার কখনো বুক ফাটা আর্তনাদ, হয়তো কোনো অসহায় মায়ের।

সেই সুর আমাদের বড়ো আপন। হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে দোলা জাগায়। তাইতো লালনকে দেখে সহসা কী যেন মনে হল সিরাজের। ভাবল সে ক্ষণকাল চোখ বুজে, হায় ভগবান, এই মুখখানি কি এতদিন ধরা ছিল আমার হৃদয়ের স্মৃতিপটে? কিন্তু এ কে? দেখে তো মনে হয় হিঁদুঘরের ছেলে। একে কি আমি আমার শিষ্য করব? যে কদিন পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছি, একেই লালন পালন করব পরম স্নেহ যত্নে ভালবাসায়? তাই বা কেমন করে হবে? আমিনার ভাগ্য বিপর্যয়ের সব কাহিনি সিরাজের জানা। সিরাজ জানে এই ছেলেটি আমিনার একমাত্র অবলম্বন। তাকে এইভাবে জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়া কি উচিত হবে আমার?

সিরাজ গাইছে—বল খোদা বল খোদা বল, জলের ওপর পানি নাকি পানির ওপর জল… শিষ্যরা ধুয়া তুলেছে—একতারার শব্দ। মনের ভেতর কেমন এক উচাটন। লালনের কেবলই মনে হচ্ছে সে বোধহয় আর এই শক্ত বাঁধনের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতে পারবে না। হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কোন সে পাগল মানুষ বাজিয়ে দিয়েছে দোতারা? বলছে—লালন, ওঠো, জাগো, অনেক হয়েছে, তুমি এই পৃথিবীতে কারো সন্তান হয়ে আসোনি। কেউ তোমার বউ নয়। এসব দুদিনের খেলা। তোমাকে ডাক দিয়েছে ওই মহাকাশ। একবার তাকিয়ে দেখ নিঃসীম নীল আকাশের দিকে। নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশ কি তোমার কানে কানে অকথিত গল্প শোনাতে চাইছে না? তোমার বুকে হাত রেখে কি বলছে না, এসো লালন, জন্ম-জন্মান্তরের এই বাধা অতিক্রম করো? অনেক পরিশ্রমে তুমি মানব জন্ম পেয়েছ। এসো আজ বিশ্ব বিধাতার সাথে নৈকট্য বোধ করো। মনে রেখো তুমি তাদেরই সন্তান….

শেষ হয়ে গেছে সঙ্গীত—আসর। সামান্য কিছু আয়োজন। খিচুরি আর পাঁপড়ভাজা। সকলে এমন তৃপ্তি করে খেতে বসেছে। লালনও বসে আছে এককোণে। এই প্রথম লালনকে ভালোভাবে দেখল সিরাজ। তারপর সুধাল—কী মনে পড়ে সব কথা?

সিরাজের কন্ঠস্বরের ভেতর কী এক আশ্চর্য জাদু মেশানো আছে। লালনের মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায় সবকিছু। ভাতের পাতা ফেলে উঠে যায় সে। চলে যায় তার ছোট্ট ঘরটিতে। সে উপুড় হয়ে কাঁদে। আমিনা ছুটে যায়। আহাবাছারে—বাধা দেয় সিরাজ—বলে, যেও না আমিনা, ওকে এখন কাঁদতে দাও। কান্নার মধ্যে দিয়ে ও শুদ্ধ হয়ে উঠবে। অনেক পাপ, অনেক অত্যাচার, অনেক অবিচার, ওকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এই কান্নাই হবে ওর দুঃখ জ্বালা-যন্ত্রণার একমাত্র উপশম।

দুই

মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে দুটি শরীর। শুরু হয়েছে চিরন্তন প্রেমখেলা। বুঝি চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে। একজন নারী পরম আশ্লেষে তার পরম প্রিয় পুরুষকে জড়িয়ে ধরেছে। নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে প্রতি অঙ্গের জন্য প্রতি অঙ্গের আর্তনাদ।

কে ওরা? লালন আর চম্পা। সদ্য বিবাহিত। আজই ওদের ফুলশয্যার রাত। না, সানাই বাজেনি, হয়তো কোথাও বেজেছে মঙ্গলশাঁখ। তাতে কী? হৃদয়ের আতিশয্য যেখানে আছে, বাহ্যিক উপকরণের কোনো প্রয়োজন পড়ে কি?

চম্পার বয়স কতই বা হবে? তেরো পার হয়ে চোদ্দোতে পা রেখেছে। আর লালন সবে মাত্র ষোলো বসন্ত কাটিয়েছে এই পৃথিবীর বুকে। এমনটিই তো হয়ে থাকে গ্রামবাংলায়। অন্তত সে যুগে হত কিশোর দিনে পা রাখার সাথে সাথে এক পুরুষকে সাত পাকের বাঁধনরেখায় বেঁধে ফেলা হত। কিশোরী কন্যাকে বলা হত আজ থেকে তুমি হবে এক সতী। স্বামীর চিন্তায় মগ্ন থাকবে সারাক্ষণ। দেখো, কখনো যেন এই পথ থেকে বিচ্যূত হয়ো না।

নারী কী? কী তার আকর্ষণ? পথভোলা বাউল লালন সেসব খবর রাখত না। সঙ্গীসাথীদের সাথে যোগ দিত না অশ্লীল আলোচনায়। তাকে ডাকতো নীল আকাশ, ডাকে ওই পদ্মভরা ঝিল। মাঝদুপুরে চারপাশ কেমন নিথর হয়ে আছে। কোথা থেকে ডাহুকের ডাক শোনা যায়। কুব-কুব শব্দ করতে করতে উড়ে যায় কী একটা অচেনা পাখি। লালন তখন তার একতারাতে সুর তোলে। ঈশ্বরদত্ত গলা আছে তার। মুখে মুখে গান বাঁধতে পারে। তখন তন্ময় হয়ে গায়— মধুর দিলদরিয়ায় যে জন ডুবেছে সে না সব খবরের জবর জেনেছে।

লালন লেখাপড়া শেখেনি। শিখবে কী করে? ছোটোবেলায় বাপ মরেছে, মা পদ্মাবতী একাহাতে কত কিছু সামলাবে? তবু লালনের মনে হয় কে যেন তার মুখে শব্দ জুগিয়ে যায়। সে কি মা সরস্বতী? সুর-দরিয়ায় চান করে সে। ভেসে যায় অজানা স্রোতে।

আর ভাসবে নাই বা কেন? চারপাশে আছে গৌরী, কেউ বলে গড়াই। পদ্মা এখানে গৌরী নামে নিজেকে সাজিয়েছে। নদীর সাথে গ্রামবাসীদের ভালোবাসার সম্পর্ক। অবশ্য বর্ষার দিনে পদ্মা উগ্রমূর্তি ধারণ করে। দু-কূল ছাপিয়ে মানুষের আশাকে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যায়।

এই নদীর দক্ষিণে বনরজি নীলা সমন্বিত ভান্ডারিয়া। মুখে মুখে ভান্ডারিয়া আজ হয়েছে ভাঁড়ারা। ভাঁড়ারা আর চাপড়া পাশাপাশি গ্রাম। এই দুটি গ্রামেই বাউলধর্ম প্রচলিত। এখানে অনেকগুলো আখড়া আছে, গ্রামের মুরুব্বিরা আখড়ার বাউলদের খাতির করে। আছে দাসেদের পাড়া। যেখানকার বাউলগানের স্রোত বিখ্যাত। এই ভাঁড়ারা গ্রামের এককোণে ছোট্ট কুটিরে বাস করে পদ্মাবতী। ইচ্ছে ছিল তার, ছেলে লালনের বিয়ে দেবে। কিন্তু মেয়ে কোথায় পাবে? লালন তো কিছুই করে না। চাল নেই চুলো নেই, সারাদিন ঘুরে ঘুরে গান বাঁধে, গান গায়, হ্যাঁ গাঁয়ের লোকেরা বলে—পদ্মা, অনেক পুণ্য করে তুই একটা ছেলে পেয়েছিস। কী গানের গলা। আহা! মনটা বুঝি জুড়িয়ে যায়।

তাতে কী? লালন কি চাষ করতে পারে? মাছ ধরতে পারে? কাপড় কাচতে পারে? ধান ভানতে পারে? বীজ রুইতে পারে? না, ভগবান তাকে এসব কোনো গুণই দেয়নি। তাহলে? শেষপর্যন্ত পাওয়া গেল চম্পাকে, প্রথম দেখাতেই চমকে উঠেছিল পদ্মাবতী, এত রূপ? দিনদরিদ্র মজুরের ঘরে? কী করে হল? বাপটা মরেছে ওলাওঠায়, মা-টাও যক্ষ্মারোগে যখন তখন মরতে পারে। এইসময় চম্পাকে বিয়ে না দিলেই নয়। তাই তো চালচুলোহীন লালনের জীবনসঙ্গিনী হয়ে গেল সে। হাতে হাত এবং চোখে চোখ। শুকনো মালা, কেউ বাজাল শাঁখ, কেউ দিল উলুধ্বনি, ভারি স্বপ্ন-স্বপ্নময় মুহূর্ত।

চোখ বন্ধ করলে সব কিছু স্পষ্ট মনে পড়ে যায় লালনের। আর আজ, এই ফুলশয্যার রাত। না, সে জানে না কীভাবে চম্পাকে আদর করবে। অথচ চম্পা, ইতিমধ্যেই সে যথেষ্ট রসবতী। স্বামীকে আঁকড়ে রাখতে হবে। ভগবান এই শরীর দিয়েছে, যৌবনের এমন ঘাত-উপঘাত, চরাই-উৎরাই, তা দিয়ে আমি আমার বোকা সোকা বরটাকে আঁচলে গিঁট দিয়ে বাঁধতে পারব না?

চমকে উঠল লালন, এত আনন্দ লুকিয়ে আছে নারী শরীরে? চম্পার বুকের মাঝে মুখ গুঁজে দিল সে। কিন্তু কী আশ্চর্য, এই গতকাল পর্যন্ত সে রাতের অন্ধকারে মাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকত। গুটিসুটি মেরে। মার শরীর থেকে উঠে আসা একটা অদ্ভুত গন্ধ তার সমস্ত মনকে আচ্ছন্ন করত। আজ এক লহমায় পরিবেশ পালটে গেছে। মনের মাঝে একটুখানি বিষণ্ণতার বোধ। এ জীবনে আর কখনো মাকে জড়িয়ে ধরে শোওয়া হবে না তার। কিন্তু কী অবাক, সম্পূর্ণ অজানা অচেনা এই কিশোরী কন্যাকে আদর করতে করতে বারবার মায়ের কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে লালনের। তার মানে? পৃথিবীর সব পুরুষ শেষ অব্দি মাতৃ অভিসারী হয়ে ওঠে? সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর চোখের তারায় সে তার মায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে বেড়ায়? এ বড়ো কঠিন প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর আমরাই জানি না, আর লালন জানবে? তা তো হতেই পারে না।

চম্পা কি চেয়েছিল লালন তাকে আর একটু বেশি আদর দিক? উন্মত্ত পুরুষের মতো তার সবকিছু লুট করে নিক? হেসে উঠুক অত্যাচারী হাসির হো হো উল্লাসে? রাত কেটে গেল। লালন ঘুমিয়ে পড়েছে, আহা, তার নিদ্রিত মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হল চম্পার। পৃথিবীর সব মেয়েরাই বোধহয় মায়াবী মোহিনী। এমনভাবে মায়ার কুহকজালে নিজেকে ঢেকে রাখে। চম্পা ভাবল, এই ছেলেটিকে শেখাতে হবে ভালোবাসার অ-আ-ক-খ। আজ বাদে কাল সে ভালোবাসার এক উন্মাদ উন্মত্ত সম্রাট হয়ে উঠবে। চম্পা হাসল, দুর্জ্ঞেয় হাসি। সে হাসির অন্তরালে কী লেখা আছে আমরা জানি না।

শুধু আমরা তাকে দেখে বুঝতে পারলাম এক রাতে সেও অনেকটা পালটে গেছে। কিশোরী কন্যা আজ এক পরিপূর্ণা যুবতী হয়ে উঠেছে—!

সাতদিন সাতরাত সপ্তসিন্ধুর খেলা। অবশেষে সত্যি সত্যি লালন যুবক হল। প্রথম পরিপূর্ণ মিলনের শিহরণ। খুশিয়াল মন। তবুও কোথায় কে যেন বেসুরো একতারাতে বাজায় বিরহের সুর। এত সুখের মধ্যে বিষণ্ণতার বেদনা কেন? এ গূঢ় প্রশ্নের উত্তর লালনের জানা নেই।

মাঝদুপুরে পথে-ঘাটে বনে-প্রান্তরে একা একা ঘুরে বেড়ায়। গৌরীর সঙ্গে তার ভাব-ভালোবাসা সেই ছোট্টবেলা থেকেই। মাঝে মাঝে নিঝুম মধ্যদিনে আকাশের প্রেক্ষাপটে, গাছের নীচে চুপটি করে বসে থাকে লালন। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে স্রোতস্বিনী গৌরীর দিকে। গালে হাত দিয়ে ভাবে, চম্পা কি গৌরীর সতীন হল নাকি? কী আশ্চর্য! তটিনীর সাথে রমণীর এত মিল? সবই কি বিশ্ব বিধাতার সৃষ্টি?

আর তখনই, সেই বিষণ্ণ দুপুরে কে যেন লালনের কন্ঠে এনে দেয় সুর। গুনগুনিয়ে ওঠে সে। কদিন ধরেই একটা গান রপ্ত করার চেষ্টায় ছিল। আজ এই মধ্যদিনে হঠাৎ প্রাণ খুলে গাইতে থাকে সে—

এমন মানব জনম আর কি হবে? যা কর মন ত্বরায় কর এই ভবে।

তিন

কোনো এক দরবেশ বুঝি আপন মনে আলপথ দিয়ে হাঁটছিল। দিগন্ত প্রসারিত মাঠের দিকে দৃষ্টি ছিল তার। চারপাশ নীরবতার আবরণে ভরা। কে এখন এই মধ্যদিনে উদাস সুরে গাইছে গান? পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে। দুটি চোখ থেকে ঝরে পড়ছে বিস্ময়মাখা কৌতূহল। এ কী? এক অল্পবয়সী ছেলে, তাকে এখনও কিশোর বলা যায় হয়তো। খালি গা, জীর্ণ বুক পাঁজর গোনা যায়। এক মাথা ঝাঁকড়া চুল। মুখখানায় অসহায়তা মাখা। চোখের দুটি তারায় এক অবাক বিস্ময় খেলা করছে।

দরবেশকে দেখে গান থেমে গেল লালনের। উঠে দাঁড়াল সে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। দীর্ঘদেহী ওই মানুষটির সামনে শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে ইচ্ছে হল তার। এগিয়ে গেল, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে বলে। সরে গেল সেই দরবেশ। তার কন্ঠ থেকে ঝরছে সুমিষ্ট সুর। সে বলল—কে তুমি? এমন গান বাঁধছ কী করে? তুমি কি পড়াশোনা করেছ?

লজ্জায় নত হল লালনের মুখখানি। এই একটি জায়গায় বড় ঠকে গেছে সে। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায় যে সংসারে, সেখানে পড়াশোনা তো বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ লালন পড়তে চায়, বড়ো বড়ো পুঁথি, কী করবে, ভাগ্য খারাপ, তা না হলে…

দরবেশ বুঝতে পেরেছে, না বুঝে সে লালনের মনের এক কোমল জায়গায় আঘাত করেছে। সুস্মিত হাসিতে মুখখানি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার। লালনের আর একটু কাছে এগিয়ে আসে সে। বলে, ঈশ্বর যাকে এত গুণ দিয়েছে, সামান্য লেখাপড়া শিখে সে কী করবে? এ তোর ভালোই হয়েছে। পাঠশালার চার দেওয়ালের গন্ডীর মধ্যে নিজেকে আটকে রাখিসনি। তুই এক মুক্ত বিহঙ্গ। নীল আকাশে তোর ডানা দুটি মেলে দিয়েছিস।

সত্যিই কি তাই? ওই দরবেশের কন্ঠে এত জাদুমাখা। লালনের মনে হল সে যদি সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে ওই দরবেশের সঙ্গী হতে পারে, তাহলে কেমন হয়? আলপথ দিয়ে দূরের গাঁয়ে চলে যাবে। নিত্য নতুন জায়গা, কত মানুষের সাথে ভাব-ভালোবাসার সম্পর্ক, ক্ষণিকের বিরতি। তারপর আবার কাঁধে ঝুলিয়ে নেবে একখানা ঝোলা। হাতে থাকবে একতারা। উদাসী কন্ঠ থেকে ঝরে পড়বে ভালোবাসার গান। বিরহের গান। কাছে আসার আকুতি। আর দূরে চলে যাওয়ার বেদনা।

মনের ভাব কি লেখা থাকে চোখের তারায়? দরবেশ হেসে বলল—বুঝতে পারছি, আমার সঙ্গী হবি তো? তোকে দেখে কেবলই আমার মনে হচ্ছে, আজ বাদে কাল তুই আমার শিষ্য হবি। জানি না কেন একথা মনে হল আমার। আজ চলি, অনেকটা পথ পার হতে হবে।

তারপর…. তারপর বজ্রগম্ভীর কন্ঠস্বরে সেই দরবেশ গান ধরল—

দেখ না মন ঝকমারী।

এই দুনিয়াদারী।

পরিয়ে কোপনি ধ্বজা—

হায় কি মজা উড়ালে

ফকিরী।

লালন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। ওই তো, আলপথের আড়ালে চোখের বাইরে চলে গেল সে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে ফেলল লালন। আর তখনই, কার খিল্লিহাসি? এ কী, চম্পা, তুই? কেন এখানে এসেছিস? আমাকে একটু একা থাকতে দিবি না?

কী একটা কথা বলার জন্য এসেছিল চম্পা। স্বামীর এ হেন আচরণে দুঃখ পেল সে। চোখের কোণে জল এল। কী আশ্চর্য, এই কদিনে লালন যেন অনেকখানি পালটে গেছে। অথচ এমনটি তো হবার কথা নয়। সবেমাত্র দাম্পত্য জীবনযাপন করছে তারা। দুটি তৃষিত শরীর। সোহাগের শিহরণ, আর সেই লালন কিনা…

তখন মধ্যরাত, ঘুম আসছে না লালনের। গুমোট পড়েছে চারপাশে। আকাশ থেকে উধাও হয়ে গেছে বৃষ্টিমাখা মেঘের দল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে বুঝি। অনেকক্ষণ হাতপাখা দিয়ে বাতাস খাচ্ছিল লালন। চম্পা ঘুমিয়ে পড়েছে। পলতেটা একটু উসকে দিল সে। নাহ, এত রাতে আগুন জ্বেলে কী লাভ। চম্পা বোধহয় নেভাতে ভুলে গেছে। এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিল সেটা। চাঁদের আলোর একটুখানি আভা। একরাশ কালো চুলের বন্যা আছে চম্পার। সুগঠিত দেহ, নিঃশ্বাসে ফুলে ওঠা বুক। চকিতে লালন তাকাল একবার। কামনার সাপ দংশন করল তাকে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল সে। ইদানিং এই মধ্যরাতে একা একা সে যেন কোথায় চলে যায়। কেন যায়? সে যায় জমিদারদের আস্তাবলে। সেখানে এক প্রিয় ঘোড়া আছে তার। ইচ্ছে করেই তার নাম রেখেছে সে পক্ষীরাজ।

ধবধবে সাদা এই ঘোড়াটি। সহজেই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে চেনা যায়। ঘোড়ায় চড়ার শখ লালনের বহুদিনের। এতকাল মনে মনেই স্বপ্ন দেখেছে। তারপর একদিন সাহসে ভর রেখে পৌঁছে গিয়েছিল জমিদার কালীকিঙ্কর দত্তের আস্তাবলে। সারবন্দী ঘোড়ার দল। মাঝে-মধ্যে লেজ নাড়ছে। মশার কামড় খাচ্ছে বোধহয়। যে লোকটা পাহারা দেয়, তার চোখে ঘুম নেমেছে। আহা বেচারী, আর তখনই টপ করে পক্ষীরাজের পিঠে চড়ে বসেছিল লালন। কী আশ্চর্য, পোষা ঘোড়া, অজানা অচেনা কেউ পিঠে চাপলে চিঁহি চিঁহি শব্দে সকলের ঘুম ভাঙায়, অথচ পক্ষীরাজ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করল না।

আর লালন? তখন তাকে পায় কে? অতি দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এল সে। ঘোড়ার খুরের শব্দ—টগবগ টগবগ লালনের মন তখন আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছে। এমন একটি নৈশ-ভ্রমণ, তার কতদিনের স্বপ্ন। না, বেশিক্ষণ ঘোড়াটা নিয়ে ঘোরেনি সে। মনের মধ্যে ভয় ছিল। লোকমুখে শুনেছে কালীকিঙ্কর দত্ত এক নির্মম মানুষ। পাষণ্ড বললেও বোধহয় কম বলা হয়। নিজের হাতে দোষীর শাস্তি দেন। শূলে চড়ান, গুম ঘরে ফেলে দেন। আর লালন কিনা? এত বড়ো বুকের পাটা তার?

সেই শুরু হল এই নিষিদ্ধ অভিসারের। এখন আর চম্পা তাকে বেঁধে রাখতে পারে না। এবার একটু অন্যতর অভিযানে বেরোতে হবে। আর তাইতো, লালন অপেক্ষায় থাকে, কখন সকলের চোখে ঘুম নামবে, কখন মা পদ্মাবতী ঘুমিয়ে পড়বে। বেচারী চম্পা, সকাল থেকে কত কাজ তাকে একাহাতে করতে হয়। ইদানিং অভিমান এসে জমা হয়েছে তার মনের মধ্যে। স্বামী সোহাগে বঞ্চিতা সে, কার কাছে খুলে বলবে মনের কথা? গরীব ঘরের মেয়ে, বাপের বাড়ির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। আর তাই বোধহয় লালন….

পাগলি মেয়ে, সে যদি জানত লালন কোথায় যায়, তাহলে হয়তো মনকে প্রবোধ দিতে পারত সে। সত্যিই তো লালন তো অন্য কোনো নারীর কাছে যায় না। কোনো বদ নেশা নেই তার। ইয়ার-দোস্তদের সে এড়িয়ে চলতেই ভালোবাসে। সে শুধু ভালোবাসে ঘোড়ার পিঠে চড়ে এক গাঁ থেকে অন্য গাঁয়ে যেতে। রণপায়ে চড়ে আকাশ ছুঁতে। মাঝদুপুরে হঠাৎ কী খেয়ালে গান লিখতে আর তাকিয়ে থাকতে স্রোতস্বিনী গৌরীর দিকে। মাঝির মুখ থেকে ছুটে আসা এক একটা শব্দ সাজিয়ে রাখতে মনের স্মৃতিখাতায়। একদিন নয়, দুদিন নয়, তিনদিন। পরপর তিনদিন তিন রাত সে এইভাবে পক্ষীরাজের সওয়ার হয়েছে। কিন্তু কথায় বলে, কোনো পাপ কখনো চাপা থাকে না। অবশ্য এটাকে যদি আমরা পাপ বলি, তাহলে!

সেদিন ধরা পড়ে গেল, পক্ষীরাজের পিঠে উঠছিল সে, গুনগুনিয়ে গান গাইছিল আপন মনে। মাঝরাত। চারপাশ নিঃঝুম অন্ধকারে ঢাকা। আস্তাবলে ঢোকার সময় বুকের ভেতর ধুকপুকানি। এ কী? যে লোকটা পাহারা দেয়, ইয়া মস্তবড়ো মোছ আছে তার। সে এখনও জেগে আছে কেন? তাহলে? আমি কি ধরা পড়ে গেছি?

ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল লালন। লোকটা কোনো কথা বলল না। শুধু কটমট করে তাকাল লালনের দিকে। লালন বুঝতে পারল, সূর্য উঠলেই তার বিচার হবে। বাবু কালীকিঙ্কর দত্ত ডাক দেবেন। সেই ডাকে তাকে সাড়া দিতেই হবে। কিন্তু? ঘোড়ার পিঠে চড়ার জন্য কী শাস্তি দেবেন তিনি? একমাত্র ভগবান হয়তো বা বলতে পারেন।

যেমনটি ভেবেছিল, তেমনটি হল। ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে পাইক ছুটল লালনের বাড়িতে। তখনও লালনের চোখে ঘুম লেগে ছিল। অনেক দিন বাদে চম্পাকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরেছিল সে। হয়তো এই হঠাৎ জাগা ভয়টাকে দূর আকাশে উড়িয়ে দেবার জন্য। চম্পা ভাবতে পারেনি, আবার স্বামী সোহাগে শিহরিতা হবে সে। কপাল মন্দ বলে নিজেকে অভিশাপ দিত চম্পা। আজ বুঝতে পারল, এ সবই তার বোঝার ভুল। তার স্বামী উন্মাদ, পাগল, আহা, কখন কী বলে কী করে বসে, কে তার খবর রাখে?

অনেক দিন বাদে আবার একটি আমন্ত্রিত মিলন। অভিসার ফুরিয়ে গেছে, তবু থেকে গেছে তার রেশ। শরীরের কোষ থেকে কোষান্তরে। আর এখনই কিনা, এই সাতসকালে কে বাজখাঁই গলায় ডাক দিয়েছে? কে ফিরিস্তি দিচ্ছে অপরাধের?

লালন বুঝতে পারল তার কপাল পুড়েছে। পদ্মাবতী শেষরাতেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন। একরাশ কাজ তাঁকে সারতে হয়। ঠাকুরঘর পরিষ্কার করা, রাধার মালা গাঁথা, গোরুর জাবনা দেওয়া, আরও কত কী। বাড়িতে পেয়াদা দেখে অবাক হয়ে গেছেন পদ্মা—একী? লালন কী দোষ করেছে? যার জন্য বড়ো কর্তা একেবারে পাইক পাঠিয়ে দিয়েছেন?

বলা হল, আধ ঘন্টার মধ্যে তাকে জমিদারির কাছারিবাড়িতে যেতে হবে। যদি লালন এই নির্দেশ না শোনে, তাহলে সর্বনাশ।

অবশেষে লালনকে আসতে হল একেবারে খালি গায়ে। মাথাভরতি উসকো খুসকো চুল। কী আশ্চর্য, তখনও তার চোখের তারায় মায়াবী তন্ময়তা লেগে আছে।

জমিদার বসে আছেন বারান্দায়। চারপাশে তোষামোদদের দল। চিকের আড়াল থেকে কে যেন দেখছে লালনকে। লালনের বড় অস্বস্তি হচ্ছে। কে ও, সেটা সে বুঝতে পারছে না।

সে হল মোহিনী, এ তল্লাটের এক ডাকসাইটের সুন্দরী। লোকে বলে মোহিনীর চাউনিতে নাকি এক আশ্চর্য নেশা আছে। পুরুষ বধের মন্ত্র সে নাকি শিখেছে সংগোপনে। অথচ, তার মন্দ কপাল। বিয়ে হয়েছিল এক বয়স্ক পুরুষের সঙ্গে। কুলীন ব্রাহ্মণ। বছর না ঘুরতেই বরটা মরল ওলাওঠায়। আর বেচারী মোহিনী, এই ঢলঢল যৌবন দিনে তাকে সাজতে হল বিধবার শুভ্রবেশে। প্রসাধনের চিহ্ন একে একে মুছে ফেলল সে। এখন পুরুষমানুষ দেখলে এক গলা ঘোমটা টানতে হয় মোহিনীকে। অথচ সে এক ভরাট যুবতী। বাসনা কামনার আর্তনাদ। কীভাবে যৌবনদিনে একা একা থাকবে?

তাছাড়া মোহিনী একটু বে-পরোয়া। সামাজিক অনুশাসন মানতে তার তীব্র অনীহা। রান্নাঘরের আড়াল থেকে সে তাকিয়ে ছিল লালনের দিকে। বয়েসে তার থেকে ছোটোই হবে হয়তো, কিন্তু কী আশ্চর্য, এই ছেলেটিকে দেখে প্রাণের মাঝে একটুকরো উচাটন। কিন্তু কেন? মোহিনী তার খবর রাখে না।

একে শাস্তি দেওয়া হবে? মোহিনী ভাবতেই পারছে না। যদি সুযোগ থাকত, তাহলে এখনি সে বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের পায়ে মাথা খুঁড়ত। হাতজোড় করে বলত—বাবু, এবারটির মতো ছেড়ে দাও, আমি দেখেছি ও ঠিকসময়ে ঘোড়াটা ফিরিয়ে দেয়। ওকে তুমি কিছু বলো না।

মোহিনীকে সাক্ষী দিতে হল। মোহিনী দেখেছে রাতে লালন আসে, পায়ে পায়ে আস্তাবলে ঢুকে যায়। পক্ষীরাজের বাঁধন খোলে, তার পিঠে চেপে বাইরে চলে যায়। তারপর? ভোর হবার আগে আবার তাকে আস্তাবলে ফিরিয়ে দিয়ে যায় লালন।

স্পষ্ট উচ্চাারণ, আপোষের চিহ্ন নেই, সাত্যিকে মিথ্যে বলে চালান করার অভিসন্ধি—না, মোহিনী এসব ছলাকলা কোনোদিন রপ্ত করতে পারেনি। পারেনি বলেই বোধহয় আজ তাকে আশ্রিতার মতো জীবন কাটাতে হচ্ছে এই বিরাট জমিদারবাড়িতে। লতায় পাতায় কোনো সম্পর্ক নেই কালীকিঙ্কর দত্তের সঙ্গে। আজ তার একটাই মাত্র পরিচয়—সে হল রাঁধুনি বামনি। কী আশ্চর্য, এক লহমায় জীবন-নাটক এভাবে পালটে যায় কেন?

তামাকে ভুরুক-ভুরুক টান দিচ্ছেন বাবু কালীকিঙ্কর দত্ত। মেজাজী মৌতাত এসে গেছে তাঁর। অথচ অকারণে তিনি এখানে এভাবে শাস্তির আসর বসাননি। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুবই খেপে গেছেন। এমনটি হবারই তো কথা। লালন কাউকে কিছু না বলে আস্তাবলে ঢুকে পড়ে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে এখান থেকে সেখানে চলে যায়। না, ঘোড়া চুরি সে করেনি বটে, কিন্তু তার এই অভিসন্ধির অন্তরালে কী আছে? আজ বাদে কাল কি সে ঘোড়াটাকে পটিয়ে নিয়ে পালিয়ে যেত? এমনটি আশঙ্কা করেছেন কালীকিঙ্কর দত্তের নায়েব মশাই। মূলত তাঁর কথাতেই আজ সাতসকালে কালীকিঙ্কর বাবুকে এমন এক বিচারসভার আসর বসাতে হয়েছে।

সেখানে একে একে অনেকগুলি প্রশ্ন করা হল বেচারী লালনকে। হাত জোড় করে সাধ্যমতো জবাব দিল লালন। এবার জমিদারের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। কী আর করা যায়? পায়ে পায়ে সে হাজির হল জমিদারের কাছে। জমিদার তীব্র অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে লালনের সব কিছু দেখার চেষ্টা করলেন। এই দৃষ্টি আছে বলেই তো তিনি আজ দন্ডমুন্ডের কর্তা হতে পেরেছেন। এত বড়ো একটা অঞ্চলের একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি জানেন, তাঁর আদেশের সামনে সকলকে মাথা নীচু করে থাকতে হয়। কেউ টুঁ শব্দটি করার সাহস পায় না।

তিনি বলতেন—ঠিক আছে, এবারটির মতো তোকে ছেড়ে দিলাম। তবে ছেড়ে দিলাম বললে ভুল হবে, তোকে একটা শাস্তি আমি দেবই।

পিনপতন নীরবতার মধ্যে লালন জানতে চাইল—কী শাস্তি? আমি তো সবকিছু কবুল করেছি। আপনি আমাদের কর্তা। লাঠি আপনার হাতে। পাইক-বরকন্দাজ আপনার পায়ের তলার পোষা কুকুর। বলুন, আপনি আমাকে কী শাস্তি দেবেন। আমি কথা দিচ্ছি মাথা নীচু করে মুখ বুজে সব শাস্তি আমি গ্রহণ করব।

জমিদার হাসলেন, সেই হাসির মধ্যে কি ষড়যন্ত্রের লেশ আছে? কোনো দুরভিসন্ধি? লালন বুঝতে পারল না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের মুখের দিকে। পকেটে পয়সা হলে বোধহয় মুখের ভাব একেবারে পালটে যায়। আবার ভুরুক ভুরুক তামাকুর গন্ধ।

একটু বাদে জমিদার তাঁর বিচার ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন—শোনো লালন, অন্য কেউ হলে আমি তার গর্দান নিতুম, কিন্তু তুমি তো আমার ঘোড়ার কোনো ক্ষতি করোনি। বরং তার উপকারই করেছ—আর একটা কথা, কী জানো, এই প্রথম আমি এমন একজনকে দেখলাম, যে সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়েও ঘোড়ার পিঠে উঠতে পেরেছে। ভারি খেয়ালি ঘোড়া এই সাদাটা। কখন তার কী ইচ্ছে হয়, কে জানে!

একটু থামলেন তিনি। দেখলেন, উৎসূক চোখগুলি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রূপোর থালা থেকে তবক মোড়া দুটি পান ফেলে দিলেন মুখের মধ্যে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চিবোলেন। পিক ফেললেন রূপোর পিকদানিতে। তারপর বললেন—আজ থেকে তুই আমার সাদা ঘোড়ার দেখাশোনা করবি, তার দায়দায়িত্ব আমি স্বেচ্ছায় তোর ওপর বর্তালাম। দেখিস বাবা, আমার ঘোড়ার দেখভালের কোনো ত্রুটি না হয়! ও আমার বড্ড প্রিয় রে….

লালন ভাবতেই পারেনি, এইভাবে তাকে পুরস্কৃত করা হতে পারে। সে নেহাতই এক গ্রাম্য যুবক। দিন আনা দিন খাই অবস্থা। রাজানুগ্রহে খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠল লালন। এগিয়ে গেল। কালীকিঙ্কর দত্তর থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে প্রণাম ঠুকল। উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে গেছে। কালীকিঙ্করের হল কী? তাহলে উনি কি আর আগের মতো দোর্দন্ডপ্রতাপ জমিদার নন? তারা কেউ বুঝতে পারল না, প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন একটা মুহূর্ত আসে, যখন অকারণে কটু কথা বলা যায় না। অন্যায় আচরণ করতে গেলে বুকের মাঝে একটুখানি বেদনবোধ। আজ বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের জীবনে তেমনই একটা মুহূর্ত এসেছে। অসহায় লালনকে দেখে তার কেবলই মনে হচ্ছে, এই পৃথিবী সত্যি একটা মায়ার সংসার। সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি আমরা যা করে চলেছি, তার অন্তরালে আছে মায়া নামের এক আশ্চর্য চেতনা।

তাইতো আজও পৃথিবীতে মানুষ মানুষকে ভালোবাসে। ভালোবাসার কবিতা লেখা হয়। আজও পৃথিবী থেকে ভালোবাসা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি।

শুরু হল লালনের নতুন কাজ। এখন ফুরসত পেলেই সে পক্ষীরাজের কাছে এসে বসে। শরীরটা তার দলাই মলাই করে। বাছাই করা ঘাস খেতে দেয়, তার পিঠে চড়ে দু-চারটে চক্কর দেয়। এমনভাবেই একদিন সে দূরের অরণ্যে পৌঁছে গিয়েছে। অনেক কষ্টে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। মনে মনে শপথ করেছে, না, এমন কাজ সে আর কখনো করবে না। তাহলে জমিদার বাবু হয়তো রাগ করতে পারেন। ঈশ্বরের অসীম অনুগ্রহে চাকরিটা পেয়েছে সে। ভালো লাগে পক্ষীরাজের পিঠে সওয়ার হয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে। সত্যিই তো লালন যে অন্য জাতের মানুষ। কোদাল চালানো, জমিতে বীজ বোনা মোটেই ভালো লাগে না তার। তার কেবলই মনে হয়, এই যে নিরন্তর ছুটে চলা, এর মধ্যে একটা আলাদা রহস্য আছে।

কী আশ্চর্য, চোখ বন্ধ করলে হঠাৎ সেই দীর্ঘদেহী মানুষটির ছবি ফুটে ওঠে। কী এক আকর্ষণ আছে তার সমস্ত ব্যক্তিত্বে। লালনের কেবলই মনে হয়, জীবনের চলার পথে কোনো একদিন সে ওই দরবেশের সন্ধান পাবে। আর তখনই সে কি তার প্রিয় গ্রামটি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে? এমন এক দেশ, যেখানে কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই। জ্বালা-যন্ত্রণা নেই। নেই নিরন্তর দরিদ্রতার ছোবল। কিন্তু, চম্পা কি তার সঙ্গে যাবে? চম্পার কথা ভাবলে বুকের মাঝে একটুখানি মোচড়। নীরব অশ্রুপাত। চম্পা আমাকে এত ভালোবাসে কেন? কতবার নিজেকে এই প্রশ্ন করেছে লালন। উত্তর খুঁজে পায়নি। ইদানিং চম্পার প্রতি কেমন একটা মায়া জন্মেছে লালনের মনের মধ্যে। লালন অনুভব করেছে ভালোবাসা যখন সত্যি সত্যি আমাদের সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে, তখন শুধু দেহ থাকে না, দেহের বাইরে অন্য কিছু একটা চলে আসে। তাকে কি আমরা মন বলতে পারি?

খুশি হয়েছেন পদ্মাবতী। এতদিনে তাঁর মনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। দু-বেলা ইষ্টদেবতা রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তির সামনে বসে পুজো করেন তিনি। সংসারের সকলের সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করেন। আহা, ছেলেটা বড্ড আত্মভোলা। সাতে পাঁচে থাকতে ভালোবাসে না, সহজ সরল, আজ বাদে কাল আমি চোখ বুজলে ওর কী দশা হবে? হে কৃষ্ণ, তুমি তো জগৎ পালক। তোমারই দয়ায় এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। তুমি এই ছেলেটাকে একটু দেখো!

এমনভাবেই দিন কাটছিল। কেউ জানে না, কখন হঠাৎ ঈশান কোণে মেঘের ইশারা। দুরন্ত ঝড়ে পৃথিবীর সবকিছু ওলোট-পালট হয়ে যাবে, এমন এক সর্বনাশা সংকেত। কথায় কথায় জমিদার কালীকিঙ্কর দত্ত বললেন—লালন, তোর তাগদ দেখে আমি বড়ো খুশি হয়েছি রে। না, খাজাঞ্চিমশাই বলছিল, তুই নাকি ঘোড়াটার নাম রেখেছিস পক্ষীরাজ। বড্ড বেশি ভালোবাসিস। মাঝে মাঝে তার পিঠে সওয়ার হয়ে কোথায় যেন চলে যাস।

লালন একটু দূরে বসেছিল। আহা, জমিদারবাবুর কথাগুলো বড্ড ভালো লাগছে তার। তবে যে লোকে ওনাকে নির্মম পাষণ্ড বলে থাকে। না, ওরা সব মিথ্যে কথা বলে, ওই নিবারণ উদাস বাউলের দল। ওরা বানিয়ে বানিয়ে এসব গুজব ছড়ায়, কই জমিদার তো আমার প্রতি কোনো খারাপ ব্যবহার করেননি।

হঠাৎ পালটে গেল বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের কন্ঠস্বর। তিনি আদেশ দেবার ভঙ্গিতে বললেন—শোন লালন, আমাদের ইচ্ছে হয়েছে, আমরা গঙ্গাস্নানে যাব। অনেকটা পথ যেতে হবে। গঙ্গা কি এখানে? সেই বহরমপুরের ঘাটে। আমার ইচ্ছে, পক্ষীরাজের পিঠে চড়ে তুইও আমাদের সঙ্গে যাবি। বেশিদিন লাগবে না। মাসখানেকের মধ্যেই ফিরে আসব। কেমন?

খুশিতে আনন্দে ভরে ওঠে লালনের মন। সত্যিই তো, জন্ম থেকে ভাঁড়ারা ছাড়া আর কোথাও যাবার সৌভাগ্য হয়নি তার। হবে কী করে? দু-বেলা দু-মুঠো অন্নের সংস্থান করতে যাদের জিভ বেরিয়ে যায়, তারা কি এসব বিলাসী ভ্রমণে অংশ নিতে পারে? লালনের মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ যেখানে জন্মায় সেখানেই মরে যায়, গ্রামের বাইরের পৃথিবীটা কেমন, তা জানার সৌভাগ্য হয় না তাদের।

ছুটে গিয়ে খবরটা পৌঁছে দিল চম্পাবতীর কানে। কিন্তু একী? খবর শুনে চম্পাবতী এমন ডুকরে কেঁদে উঠল কেন? মুখের ওপর ঘোমটা টেনে চলে গেল পাশের ঘরে। এ কী কথা শোনালে তুমি? সবেমাত্র আমাদের বিয়ে হয়েছে। তিনমাসও কাটেনি, আর এখনই….

সহসা লালন বুঝতে পারল সত্যিই তো মা আর বউকে ছেড়ে সে থাকবে কী করে? একমাস কি কমদিন? এখন কী হবে? বাবু হুকুম করেছেন, হুকুম তামিল তো তাকে করতেই হবে। কার এতবড়ো বুকের পাটা যে বাবু কালী কিঙ্কর দত্তের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারণ করবে? খবরটা পৌঁছল মা পদ্মাবতীর কানে। পদ্মাবতী তখন পুজোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। খবর শুনে আর্তনাদ করলেন তিনি। রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তির সামনে পড়ে গেলেন। চিৎকার করে বললেন—হে গৃহদেবতা, আমি কি গত জন্মে কোনো পাপ করেছিলাম, যার ফলে এই জন্মে আমাকে এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে? স্বামীকে খেয়েছ, এবার আমার ছেলেকেও খেয়ে নিতে চাও? না না, তুমি একটা বিহিত করো।

পাথরের প্রতিমার মুখে ভাষা নেই। চোখের তারা থেকে ঝরে পড়ছে এক অদ্ভুত করুণা। পদ্মাবতীর মতো লক্ষ লক্ষ অসহায়া নারী এভাবেই প্রার্থনা করেন। তাঁরা জানেন না, এই প্রার্থনা কোনোদিন পূর্ণ হবে না। অবশেষে এসে গেল সেই অভিশপ্ত সকাল। তার আগে? তার আগের রাত, লালন আর চম্পা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল। কী আশ্চর্য, তুষারে বরফে পাশাপাশি। কিন্তু কোথাও তো জাগেনি বজ্রপাত। কেউ তো আঙুলে আঙুল রেখে বলেনি, এসো, তোমাকে আর একটু আদর করি। অদ্ভুত এক প্রশান্তি জমা হয়েছিল লালনের তনুবাহারে। নির্লিপ্ততা জেগেছিল চম্পার চোখের তারায়। তারা হয়তো অনুভব করেছিল, এই রাত তোমার আমার—জীবনে এমন রাত আর কখনও ফিরবে না।

তবুও কী এক উচাটন। লালন সেই রহস্যের সন্ধানে মগ্ন। সে বোঝে না, যে নারীর সাথে তার আগে কখনো দেখা হয়নি, এখন সেই মেয়েটিকে কেন আত্মার আত্মীয়া বলে মনে হয়। এই যে মায়া, বিশ্ব চরাচরব্যাপী, দিগন্ত প্রসারিত, তার অন্তরালে কে আছে? আছে কি ওই উদার নীল আকাশ? আছে কি স্রোতস্বিনী গৌরী? নাকি এমন এক সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যার দেখা আমরা কখনো পাবনা?

এ এক অদ্ভুত মিলন, বিরহের বেহালায় বেজে উঠেছে করুণ রাগিনীর সুর। সবকিছু ফুরিয়ে যাবে, তার আগে এসো প্রিয়তম, যেটুকু সময় হাতে আছে আমরা আনন্দ সাগরে অবগাহন করি, আমরা একে অন্যের শরীর থেকে শেষতম উষ্ণতাটুকু সংগ্রহ করি। তুলে রাখি চন্দন কাঠের বাক্সে।

অবশেষে সেই মহার্ঘ্য রাত ফুরিয়ে গেল। পাখির কূজন বয়ে আনল এক অভিশপ্ত সকালের বার্তা। শেষবারের মতো ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল লালন আর চম্পা। মনে হল এ চুম্বন বুঝি শেষ হবে না। স্ফুরিত ওষ্ঠ থেকে ঝরে পড়ল ভালোবাসার আকুল আকুতি। তখনই, আর তখনই হঠাৎ বাঁধভাঙা বন্যার মতো অনন্ত জলরাশি ছুটে এল চম্পার দুচোখের তারা থেকে। কাঁদল সে অসহায়া হয়ে অনেকক্ষণ। তারদিকে তাকিয়ে থাকল লালন। তার চোখ ভাষাহীন। বুকের খাঁচা থেকে উড়ে গেছে অচিন পাখি। এই মুহূর্তে একটা গান গাইতে ইচ্ছে করছিল তার। কিন্তু পরিবেশ ও বাতাবরণ প্রতিকুল। এখন কি কেউ সুর করে গান গাইতে পারে? চারপাশে বিরাজ করছে থমথমে নীরবতা।

অথচ সূর্য জাগছে। কর্ম চঞ্চল মানুষজন দৈনন্দিন কাজে বের হবার জন্য তৈরি হচ্ছে। এখনই তো ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হয়। কিন্তু লালন? কী প্রার্থনা করবে সে? অনেক কষ্টে চোখ বন্ধ করল। ভাবল, যদি বলে, ভগবান, আমি যেন একমাস বাদে আমার স্ত্রী ও মায়ের কাছে ফিরে আসতে পারি, তুমি শুধু আমাকে এই আশীর্বাদ দাও!

সমস্ত রাত জেগেছিলেন পদ্মাবতী। কেঁদে কেঁদে চোখ দুটি ফুলে গেছে তাঁর। অন্তরের আকুল আহ্বান পাঠিয়ে ছিলেন রাধাকৃষ্ণের কাছে। তিনি জানেন না, এই ডাক ঠাকুর শুনেছেন কিনা। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে সময়। একটু বাদেই লালনকে তৈরি হতে হবে। কী বা তার সঙ্গে দেবেন পদ্মাবতী? কী বা আছে তাঁর দেবার মতো? সামান্য কিছু জামাকাপড়, চিঁড়ে, আর গুড়ের টুকরো, দু-চারটে বাতাসা, একখানি গামছা।

পরিপাটি করে আসন পেরেছেন তিনি। আহা আর কতদিন বাদে ছেলে এসে আবার এইভাবে খাওয়ার জন্য আবদার করবে। লালনের ছোট্টবেলার দিনগুলির কথা চকিতে মনে পড়ে গেল তাঁর। বাঁ চোখের পাতায় মৃদু কম্পন কেন? তার মানে? ভয়ংকর একটা সর্বনাশ কি ধেয়ে আসছে? পৃথিবী আলোড়িত হবে। মানুষজন ভীত সন্ত্রস্ত হবে। আর অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কিছুই করতে পারবেন না পদ্মাবতী!

শীর্ণ একটা শরীর ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে। ক্রন্দসী দুটি হৃদয়—একটি থেকে ঝরে পড়ছে বাৎসল্য, অন্যটি থেকে নিদারুণ প্রেম এবং সখ্যতা। শেষবারের মতো জীর্ণ কুটিরের দিকে তাকাল লালন। বুকের মাঝে হাহাশ্বাস। একটুকরো নিভন্ত আগুন। সহসা তার মনে হল এই পর্ণকুটিরে সে আর কখনও ফিরে আসতে পারবেনা। কেন এমন হল? কত মানুষই তো তীর্থভ্রমণে যায়। নিবারণ কাকা ঘুরে এসেছে পুরী। গল্প করেছে সাগরের অতলতলে। উদাস বাউল তো মাঝে মধ্যেই এ গ্রাম ও গ্রামে চলে যায়। কত জায়গায়, আখড়া আছে তার। ফিরে এসে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করে। বুড়ো শিমূলতলায় বসে লালন অবাক হয়ে শোনে সেই গল্পকথা। আজ শেষ পর্যন্ত তার স্বপ্ন সফল হচ্ছে। কিন্তু এত জ্বালা যন্ত্রণা কেন? কেন থরথর আশঙ্কার কালো মেঘ ছুটে বেড়াচ্ছে তার মন-আকাশে?

সে এক এলাহি আয়োজন। অবাক চোখে সবকিছু দেখছে লালন। প্রাচুর্যের হুহুঙ্কার। অর্থের অহংকার। কতজন সঙ্গে যাবে? পাইক, বরকন্দাজ, খানসামা, মনসবরদার, রাঁধুনি, পাচকের দল। এমন কি পালোয়ানরাও সঙ্গে আছে। সবার আগে সুন্দর সাজানো ঘোড়ার পিঠে স্বয়ং জমিদার বাবু কালী কিঙ্কর দত্ত। পরপর পালকিতে পর্দানসীনা রমণীরা। তারপর, একে একে আরও অনেকে। কী আশ্চর্য, কালী কিঙ্করের আদেশে সাদা পক্ষীরাজকে রাখা হয়েছে একেবারে প্রথমদিকে। ধ্বজা উড়ছে, লেখা আছে অহংকারের নাম। পক্ষীরাজের পিঠে সওয়ার হয়ে বসেছে লালন। নিজের এই জীর্ণ শীর্ণ পোশাক, ভারি লজ্জা করে তার। ওদের পরনে কী সুন্দর জামাকাপড়, দু’চোখ ভরে তাকিয়ে দেখে লালন।

তারপর বেজে ওঠে বিউগল। ভেরীর তুর্যনিনাদ শোনা যায়। শুরু হয়ে গেছে শোভাযাত্রা। আশেপাশের মানুষ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে। বাবু চলেছেন তীর্থ দর্শনে, আনন্দে উৎফুল্ল সবার মন। ভেরীর আওয়াজ বিউগলের শব্দ—কেমন এক উৎসব উৎসব পরিবেশ।

শেষবারের মতো ভাঁড়ারা গ্রামের দিকে তাকাল লালন। এই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের সাথে তার আবাল্য সখ্যতা। গৌরী নদীটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে, বুঝি অভিমানিনী কিশোরী কন্যা। কত নিদাঘ তপ্ত দুপুরে সে এই নদীর জলে ঝাঁপাই জুড়েছে। আনমনে ভাসিয়ে দিয়েছে তার মনের পানসি। আজ সব কি দূর অতীত হয়ে গেল?

তবুও সেদিকে মন দেবার মতো সময় কোথায় লালনের? টগবগ টগবগ করে এগিয়ে চলেছে পক্ষীরাজ। তাকে বাগে রাখতে হবে। এ কি কম কথা নাকি? সকলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কেমনভাবে ঘোড়াটিকে চালনা করে, সেটা দেখতে চাইছে, সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি হলে স্বয়ংবাবু কালীকিঙ্কর দত্ত রেগে যাবেন। তাহলে? না, আপাতত মনের ক্যানভাস থেকে এইসব ছোটো ছোটো জলছবিগুলি দূরে সরিয়ে রাখে লালন। এখন তার সামনে বাস্তবতার ধু ধু প্রান্তর। যেখানে একটিও আকাশ ছোঁয়া গাছ নেই আশ্রয় দেবার জন্য। তাকে এখন প্রখর সূর্যালোকের তলায় দাঁড়িয়ে একা একাই বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করতে হবে। পৌঁরুষে নির্ভর করতে হবে। তাই তো লালন সবকিছু ভুলে যায়। কঠিন হয়ে ওঠে তার মুখমণ্ডল। চোখের তারায় দৃঢ় প্রত্যয়ের চাউনি। তবুও, গুনগুন করে কী একটা গান যেন গাইতে চায় সে। সবাই শুনে ফেলবে, তাতে কী? লালন যে স্বভাব কবি, একথা কি কারো অজানা আছে? অতএব, পক্ষীরাজের পিঠে সওয়ার হয়ে সে চিৎকার করে গেয়ে ওঠে—

আছে যার মনের মানুষ আপন মনে।

সে কি আর জপে মালা নির্জনে।

সে বসে বসে দেখছে খেলা।

চার

দুটি পর্দার মাঝখানে এই একটুখানি ফাঁক। তার ওপর চিকের আড়াল। তারই মধ্যে দিয়ে চারপাশের সবকিছু দেখছিল মোহিনী। দেখছিল আর অবাক হয়ে ভাবছিল, কী বিরাট এই পৃথিবী। কী করবে, ভাঁড়ারার বাইরে যে একটা জগত আছে, এ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তার। সে নেহাতই এক গরীব ব্রাহ্মণের কন্যা। তিন-তিনটি মেয়ের মধ্যে সবার বড়ো। তাই তো আটবছর বয়সেই তাকে তুলে দেওয়া হল এক বুড়ো থুত্থুরে পাত্রের হাতে। তাঁর নাম দয়াল ভট্টাচার্য। তিনিও পুরুতগিরি করে থাকেন। অশক্ত শরীর। বন্ধুনীদের মুখে বিয়ের কত রসাল কথা শুনেছিল মোহিনী। ভেবেছিল, আহা, তার বোধহয় এক তাগড়াই স্বামী জুটবে। কিন্তু চার চোখে মিলন মুহূর্তে মনের ভেতর আর্তনাদের ঢেউ। এ কোন বরের অঙ্কশায়িনী হতে চলেছে সে? ভাগ্যিস বয়েস ছিল তার কম। যে বয়েসে মেয়েরা এক্কাদোক্কা খেলায় মেতে ওঠে, গোল্লাছুটের আসরে যোগ দেয়, কাঠ বেড়ালির সাথে ভাব ভালোবাসার সম্পর্ক পাতায়, সেই বয়েসেই তাকে সম্প্রদান করা হচ্ছে বুড়ো বরের হাতে। অন্য কেউ হলে হয়তো সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যেত। কিন্তু বেচারী মোহিনী, এসব ব্যাপার বুঝতে পারেনি সে।

ভুল ভাঙল ফুলশয্যার রাতে। সাজিয়ে গুজিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হল এক চিলতে ঘরের মধ্যে। তক্তাপোসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মচমচ শব্দে প্রতিবাদ। তাতে কী? বুড়ো বর তো তৈরি হয়েই আছে। উন্মত্ত পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে মোহিনীর অশক্ত শরীরের ওপর। বেচারী মোহিনী, তখনও যুবতী হবার স্বপ্ন সফল হয়নি। চোখ বুজে সহ্য করেছিল এই অত্যাচার। তারপর? তীব্র ঘৃণা এবং ক্লিন্নতা বেরিয়ে এসেছিল তার মানের খাঁচা থেকে। ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। বাকি রাতটুকু ঘুমের অতলেই কাটিয়ে দিয়ে ছিল। পরদিন সকালবেলা দেখল, বুড়োবরটা ভোঁসভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। হাড়জিরজিরে বুক, গাল তুবড়ে গেছে, মাথায় একরাশ সাদা চুল। এই লোকটার সাথে সারাজীবন তাকে কাটাতে হবে? হাসিহাসি মুখে সংসারের সব কাজ করতে হবে? ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগেনি তার।

হয়তো ভগবান সদয় ছিল মোহিনীর প্রতি। না হলে বছর না ঘুরতেই বরটা মরে যাবে কেন? ওলা ওঠায়। আর শেষ পর্যন্ত মোহিনীকে বালবিধবাদের দলে নাম লেখাতে হবে। ইতি উতি ঘুরে শেষ অব্দি ঐ কালীকিঙ্করের রন্ধনশালা। দত্তগিন্নির মনটা ভালো, যথেষ্ট স্নেহ করেন মোহিনীকে। মোহিনীর দুঃখে মাঝে মধ্যে জিভের ডগায় চুকচুক শব্দ করেন। মোহিনী মেয়ের মতোই স্থান পেয়েছে। সেখানে তার ভাগ্য ভালো। কোনো পুরুষের লোলুপ চোখ তাকে বিন্দুমাত্র লেহন করতে পারে না। মোটামুটি নিরাপত্তার আশ্রয় পেয়েছে সে।

অথচ মাঝদুপুরে যখন পৃথিবীটা কেমন যেন হয়ে যায়, মানুষজন ঘুমের সন্ধানে এখানে ওখানে শুয়ে পড়ে, তখন মোহিনীর ভেতর জেগে ওঠে এক দ্বিতীয় সত্তা। মোহিনী এখন পরিপূর্ণা যুবতী, মনের ভেতর সব সময় এক অদ্ভুত উচাটন। কে তাকে ডাক দিয়েছে নিশিরাতে বাঁশরীর সুরে? তুমি কে গো? তুমি কি চিরন্তন প্রেমিক কৃষ্ণ? এভাবে আমার মন মজাতে এসেছো? নাকি তুমি এক নব্য যুবক?

কী অবাক, যে দুজন মোহিনীর মন-অরণ্যে ঢুকে পড়ার ছাড়পত্র পেয়েছে, তারা দুজনেই বিধর্মী। একজন আনোয়ার, অন্যজন কাশিম। প্রথম জন ঘরামি, এবং দ্বিতীয়জন ঘোড়ার আস্তাবলেন দেখনদার।

প্রথমজন বেঁটে খাটো, মাথায় ছিট আছে, হঠাৎ রেগে গেলে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারায়। পাগলের মতো আচরণ করতে থাকে। আর দ্বিতীয় জন প্রাজ্ঞ, লম্বা চোখের তারায় অদ্ভুত নির্ভরতা। সকল থেকে রাত অব্দি ঘোড়াদের দলাইমলাই করে। চানা বিচালি এগিয়ে দেয়। রাতের বেলা আস্তাবলেই শুয়ে থাকে।

কীভাবে এই দুজনের সাথে পরিচয় হল মোহিনীর? সে এক অদ্ভুত গল্পকথা। আমরা কি জানি, প্রেমের ফাঁদ কোথায় পাতা থাকে মস্ত বড়ো এই ভুবনে? মানুষ জেনে অথবা না জেনে ওই ফাঁদে পা দেয়।

চোখ বন্ধ করলে অতীত দিনের অনেক কথাই মনে পড়ে যায় মোহিনীর। বালবিধবা বলে হয়তো তার ওপর নিরাপত্তার বজ্র-আঁটুনি খুব একটা ছিল না। দেখতে দেখতে সে সকলের কাছে চোখ-সওয়া হয়ে গেল। আর তখনই ফাঁক ফোকর পেলে মোহিনী বেরিয়ে পড়ত খিড়কি দরজা খুলে। বিরাট একটা মাঠ, তারপর ধানখেত। মাঠের একধারে ঘোড়াদের ওই আস্তাবল। সেখানেই দেখা হয়ে গিয়েছিল কাশিমের সঙ্গে। কী অবাক। হিন্দু ঘরের বামনী সে, অথচ স্পষ্টভাষায় কথা বলেছে কাশিমের সাথে। আনোয়ারা ছোঁক ছোঁক করেছে তার চারপাশে। মোহিনী প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছে। এই যৌবন, এই দহন, সব কিছু কি জলাঞ্জলি যাবে নাকি? বরের সাথে সহবাস—সেই অর্থে কখনো হয়নি তার। তাহলে? আমি কি স্বৈরিণী? পারদ ওঠা আয়নাতে নিজের মুখ দেখতে দেখতে প্রশ্ন করেছে মোহিনী। এই প্রশ্নের উত্তর বড়ো জটিল, মানুষের মন এক অসীম রহস্যের আধার। সেখানে কখন কোন ভাবনার উদয় হয়, কোন চেতনা নিঃশেষে ঝরে যায় চৈত্র শেষের ঝরা পাতা হয়ে, তার খবর রাখা কি সহজ কাজ?

অথচ সবকিছু ওলোটপালোট হয়ে গেল লালনকে দেখে। লালনের চেহারার মধ্যে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। তীব্র মায়া লুকিয়ে আছে তার ক্লান্ত দুটি চোখের তারায়। ভীষণ ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল মোহিনীর ওই ঝাঁকড়া চুলে আঙুলের চিরুনি চালিয়ে দিতে। এলোমেলো করে দিতে সব কিছু। তারপর? ভাঙনের গান গাইতে গাইতে উজানটানে বাইতে বাইতে লালনকে কাছে টেনে নিতে। কিন্তু এ বড়ো বিষম সম্পর্ক। কোথায় মোহিনী? অন্তঃপুরবাসিনী এক বাল বিধবা। আর কোথায় লালন! পক্ষীরাজের পিঠের সওয়ার। মাথা বাড়িয়ে মোহিনী দেখার চেষ্টা করছিল লালনের ঘোড়াটা আর তখনই সৌদামিনীর চাপা কণ্ঠস্বর—মোহিনী, তুই না বিধবা। এভাবে পরপুরুষের সামনে মুখ দেখাচ্ছিস কেন? তোর জন্য আমরা কি একঘরে হব?

সঙ্গে সঙ্গে চিকটা ঠেলে সরিয়ে দিল মোহিনী। এই অন্ধকারের আবর্তে ঢুকে পড়তে বাধ্য হল সে। বাইরে আলোর উৎসব, অথচ এখানে ঘুটঘুটি অন্ধকারের রুদ্ধকারা। ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের বেয়াদবি আলো ঢুকে পড়ার চেষ্টার করছে। সৌদামিনী আর একটা তবক ভরা পান মুখের ভেতর ফেলে দিলেন। পান খাওয়া তাঁর অনেক দিনের স্বভাব। মোহিনী সুন্দরীর হাত ভারি ভালো। মোহিনী জানে, কতটা সুপারির সাথে কতটা খয়ের দিলে মিশেলটা চমৎকার হবে। আহা, এই না হলে মোহিনী, সৌদামিনী ভাবলেন।

পালকি এগিয়ে চলেছে, হুমনা হুমমা তালে। ঠিক দুপুর বেলা পালকি এসে থামল এক গঞ্জের ধারে। এখানে সামান্য বিশ্রামের আয়োজন। আহার্য কিছু সংগ্রহ করতে হবে। কাছাকাছি হাট থেকে। তারপর আবার শুরু হবে ওই পালকিদের পথচলা।

দিন কেটে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে, রাত নামবে, ঝিঁঝি পোকার কান্না শোনা যাবে। দূর থেকে শিয়ালের চিৎকার শোনা যাবে—মানুষের উপস্থিতি তারা টের পেয়েছে। কিন্তু কী বা করবে?

এইভাবে অনেকদিন কেটে খাবার পর একদিন সত্যি সত্যি পূণ্য সলিলা গঙ্গার কলধ্বনি শোনা গেল। সেই সকালে ওই গঙ্গাকে দূর থেকে দেখে সকলে দুহাত তুলে নমস্কার করল। হিন্দুশাস্ত্রানুসারে পতিত পাবনী গঙ্গা স্বর্গের নদী, এই নদীতে স্নান করলে জীবনের সমস্ত পাপ কোথায় চলে যায়। পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠে জীবন।

শুরু হয়ে গেল তীব্র প্রতিযোগিতা। কে আগে স্নান করতে পারে তারই এক নীরব লড়াই। ছাউনি ফেলা হয়েছে বহরমপুর ঘাটের পাশে। বেশ কদিন এখানেই থাকতে হবে। এলাহি আয়োজন। পাচকরা রান্নার কাজে ব্যস্ত আছে। পালোয়ানরা কুস্তি কসরতের খেলা দেখাচ্ছে। বাদকদের বাদ্যযন্ত্র বেজে উঠেছে। গাইয়েরা শোনাচ্ছে নানা রাগরাগিনীর গান। বাবু সৌখিন মানুষ। বেশ কিছু মোসাহেবকে সঙ্গে এনেছেন তিনি। সন্ধ্যা সমাগমে চোখ বন্ধ করে শুনছেন কৃষ্ণভজনা আর তারই ফাঁকে মাঝে মধ্যে ডাক পড়ে লালনের। লালন এখন মহাফূর্তিতে আছে। বাবুর অনুরোধে মুখে মুখে গান বাঁধছে সে। সুর বসাচ্ছে, উদাত্ত কণ্ঠস্বরে গাইছে। বাবু বুঝতে পারছেন লালনের মধ্যে একটা অন্য সত্তা লুকিয়ে আছে। এভাবে তাকে হত্যা করে কী লাভ? না, তিনি শারীরিক হত্যার কথা ভাবছেন না। মানসিক হত্যাও তো মানুষকে অনেক সময় পঙ্গু করে দেয়। লালনের মতো এক স্বভাব কবিকে কি ঘোড়ার পরিচালক করা উচিত? বারবার প্রশ্নটা জাগছে কালী কিঙ্কর বাবুর মনে। এ প্রশ্নের উত্তর তিনি কোথায় পাবেন? লালন আর কীই বা করবে? কেউ কেউ বলছে, সে যদি পাচকদের সাহায্য করে? ব্যাপারটা কেমন যেন ঠেকল বাবুর কাছে। লালনের মতো এক স্বভাব কবি শেষ অব্দি রান্নাঘরের সাহায্যকারী হবে? তার থেকে এই তো বেশ ভালো আছে সে। কালীকিঙ্কর জানেন। ওই ঘোড়াটাকে লালন ভীষণ ভালোবাসে। তারই দেখভাল করছে যত্নের সঙ্গে। এখনই তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে কী লাভ?

ঘটনাটা ঘটল মাঝ রাতে। হু হু জ্বর। সমস্ত শরীরে যন্ত্রণা। ভোর হবার আগেই গুটিগুটি ফোসকা বেরিয়ে গেল সর্বত্র। লালন মাথা এপাশ ওপাশ করতে পারছে না। মাঝে মধ্যে কাতর অস্ফুট আর্তনাদে মা-মা বলে ডাকছে। কিন্তু মা এখানে কোথায়? তিনি তো ব্যস্ত আছেন ভাঁড়ারা গ্রামে। ছেলে যাবার পর অন্নজল গ্রহণ করেননি। শরীর অত্যন্ত শীর্ণ। বউ কত বোঝাচ্ছে, মা তবু কিছুই খাবেন না। মিষ্টি পরে আছে, কলা পরে আছে কোনো দিকে মায়ের হুঁশ নেই।

আর লালন? সারা শরীরে ব্যথা এবং যন্ত্রণা নিয়ে সে এখন ছটফট করছে। খবরটা পৌঁছে গেছে মোহিনীর কানে। মোহিনীর ইচ্ছে সে নিজে এসে লালনের সেবা শুশ্রূষা করবে। কিন্তু বাবু কালীকিঙ্কর দত্ত কি তা হবে দেবেন?

একদিন গেল, দুদিন গেল, লালন এবার ভুল বকছে। লালন চোখ বন্ধ করলে ঘাটের পর ঘাটের ছবি দেখতে পাচ্ছে। আহ, এমন সুন্দর গ্রাম ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। মানুষজন ভারি ভালো। তাদের অনুরোধে লালন গলা ছেড়ে গান গেয়েছে। প্রকৃতিকে ভালোবাসার গান। মানব-মানবীর চিরন্তন কাছে আসার গান। তীব্র দার্শনিক অনুভূতির গান। আজ তার কন্ঠ মূক হয়ে গেছে। চোখ দুটি খোলা, কিন্তু ভাষাহীন। শেষ পর্যন্ত মোহিনীর ডাক পড়ল। সমস্ত রাত লালনের শিয়রে বসে থাকতে হবে। তাকে সেবা করতে হবে। তীর্থ যাত্রায় এসে ছেলেটা কি বেঘোরে প্রাণ দেবে? তাহলে তার মায়ের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না বাবু কালীকিঙ্কর। সৌদামিনী আবেগ-পরায়ণ। তাঁর মনের ভেতর করুণার আবেশ আছে। তিনি ভাবছেন, আহা, ছেলেটি বারবার মা-মা বলে আর্তনাদ করছে, আর আমি তার শুশ্রূষার ব্যবস্থা করতে পারব না?

অতএব মোহিনীকে ডাকা হল। মোহিনী যেন এই ডাকটির জন্য বসে ছিল উৎকর্ণ হয়ে। সমস্ত রাত সেবা করে চলেছে সে। জলপট্টি লাগিয়ে দিচ্ছে। গা মুছিয়ে দিচ্ছে। আহা, এই ছেলেটির প্রতি এক অদ্ভুত অনুরাগ জেগেছে মোহিনীর মনে। না, কামনা বাসনার অনুরণন নেয়। এছাড়াও যে ভালোবাসার আর একটা ছবি আছে নিষ্পাপ অকলঙ্ক, এখন সে ছবি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে মোহিনী, তার কেবলই মনে হচ্ছে, শরীর জেগে ওঠে এবং মরে যায়, থেকে যায় স্মৃতির অনুবর্তন। এই যে আমি নিঃস্বার্থভাবে একটি যুবককে সেবা করে চলেছি, সমস্ত রাত তার মাথার কাছে বসে থাকছি, এর অন্তরালে কী আছে? শুধুই কি তীব্র শারীরিক আকুতি? না, মোহিনী জানে, এর অন্তরালে এমন একটা অনুভূতি লুকিয়ে আছে, ভাষা দিয়ে যাকে আমরা বর্ণনা করতে পারি না। তাকেই হয়তো সত্যিকারের নিষ্কাম প্রেম বলে।

লালনের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। এই দলে দু-একজন বৃদ্ধ কবিরাজ ছিলেন। তাঁরা নাড়ি টিপে পরীক্ষা করলেন। মাথা নাড়লেন ঘন ঘন। বোঝা গেল তাঁরাও লালনের বাঁচার আশা ত্যাগ করেছেন। গুটিগুলোতে পুঁজ ধরেছে, মাছি উড়ছে, সে এক নারকীয় দৃশ্য। তবুও একমনে সেবা করে চলেছে মোহিনী। তার কেবলই মনে হচ্ছে, এই যে সে এক সম্পূর্ণ অপরিচিত যুবককে সেবা করছে, এর অন্তরালে হয়তো ঈশ্বরের কোনো ইঙ্গিত আছে। ঈশ্বর হয়তো চাইছেন, এইভাবে মোহিনী আর লালন পরসুরের কাছকাছি আসুক। কিন্তু লালন তো এখন সব অনুভূতির বাইরে। অত্যন্ত ক্ষীণ তার শ্বাস। হাতে হাত দিলে নাড়ির স্পন্দন অনুভূত হয় না। তার মানে? বিদেশ বিভুঁইতে এসে লালন কি প্রাণ হারাবে নাকি?

সমস্ত রাত নিস্পন্দ শরীরটা শোয়ানো ছিল। অন্য কেউ হলে হয়তো এখানে আসতে ভয় পেত। কিন্তু মোহিনী বোধ হয় অন্য জগতের বাসিন্দা। আসলে এই পৃথিবীর লোভ লালসাকে সে এত কাছ থেকে দেখেছে যে, এখন নিস্পৃহ হয়ে গেছে। মোহিনী জানে, মানুষের উচিত তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব ঠিকমতো করা। তারপর না হয় সে ঈশ্বরকে ডাকবে।

অবশেষে একটা নিদারুণ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হল বাবু কালীকিঙ্কর দত্তকে। না, এইভাবে এক মুমূর্ষু রোগীকে সঙ্গে নিয়ে তো আর গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘোরা যাবে না। কতদিন বাদে তিনি তীর্থ ভ্রমণে এসেছেন। এ কী উটকো আপদ? পরক্ষণেই তাঁর মনে হল, না, তিনিই তো জোর করে ছেলেটিকে এখানে নিয়ে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত পণ্ডিতরা শাস্ত্র মেনে বিধান দিলেন—মৃতপ্রায় এই মানুষটিকে বাঁশের ভেলায় ভাসিয়ে দাও। শাস্ত্রে নাকি এমন কথা বলা আছে। একে হয়তো আমরা এক অন্তর্জলী যাত্রা বলতে পারি। যদি কপালে থাকে, তাহলে মা জাহ্নবীর কৃপায় প্রাণ ফিরে পাবে। আর যদি মৃত্যুর ঠিকানা লেখা থাকে, তাহলে টুক করে বাঁশের ভেলা থেকে তলিয়ে যাবে গঙ্গার অতল তলে। আহা, কত জন্মের সৌভাগ্যের ফল হল এইভাবে গঙ্গা লাভ।

মোহিনী বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। ক্ষীণকণ্ঠে প্রতিবাদের ভাষা শুনিয়ে ছিল সৌদামিনীকে। সৌদামিনী হয় তো বুঝতে পেরেছিলেন, এভাবে এক মৃতপ্রায় ছেলেকে হত্যা করা উচিত নয়। কিন্তু তিনি কী—করবেন? তিনি তো পর্দানসীনা সামান্য রমণী। স্বামীর ছায়ার তলায় থাকতে হবে তাঁকে। অতএব প্রতিবাদের কোনো আগুন জ্বলল না। পন্ডিতেরা শাস্ত্র থেকে উচ্চারণ করলেন মহান শ্লোক। বেজে উঠল ঢাকঢোল। লালন বুঝি এক পুরুষ সতী হতে চলেছে। বাঁশের তৈরি ভেলা। অনন্ত জলরাশির মধ্যে টলমল করছে। এক কলসী জল কিছুটা চিঁড়ে আর গুড় দেওয়া হল। লালনের মৃতপ্রায় শরীরটা শোয়ানো হল সেই ভেলার ওপর। দু-একজন ভুল করে হরিধ্বনি দিয়ে ফেলেছিল, চিৎকার করলেন বাবু কালীকিঙ্কর দত্ত। এ কীরে? তোরা কি ছেলেটাকে লাশ বলে মনে করছিস নাকি? এখনই হরিধ্বনি দিতে হবে না।

চিকের আড়াল থেকে মোহিনী দেখল এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। তার কেবলই মনে হল, এখনই ছুটে যাবে সে। সামাজিক সংস্কারের আগল খুলে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওই মৃতপ্রায় মানুষটির ওপর। আহা, কয়েকরাত ধরে সে তো শিয়রে জাগিয়ে রেখেছিল আশার প্রদীপ। আজ এক ফুঁয়ে সবকিছু নিভে গেল। কী করবে মোহিনী? অসহায়া এক বাল বিধবা। দুটি চোখের কোন থেকে গড়িয়ে এল অশ্রুধারা। শোক তাকে পাথর করে দিয়েছে। বিষণ্ণতার পাষাণ প্রতিমা হয়ে গেছে সে। চোখ বন্ধ করল। না, এখানে থেমে থাকলে চলবে না। বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের হুকুম, আজ বিকেলেই ছাউনি গোটাতে হবে। সাজসাজ রব পড়ে গেছে। কেউ জানল না, কেউ বুঝল না, অস্তাচলের সূর্য সাক্ষী থাকল একটি বিয়োগাত্মক নাটকের, অনন্ত জলরাশির মধ্যে ভেসে গেল বাঁশের তৈরি ভেলা।

আর তখনই সন্ধ্যারতির সময় হঠাৎ হাত থেকে প্রদীপদানখানা পড়ে গেল পদ্মাবতীর। একী হল? আমার লালন কোথায়? লালন লালন শব্দ করতে করতে বাইরে ছুটে এলেন তিনি। আকাশের দিকে তাকালেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল লালন বুঝি নীলাকাশে একটি তারা হয়ে গেছে।

এবং চম্পা, লালন চলে যাবার পর কোনোভাবে কায়ক্লেশে দিন কাটছে তার। তাকে দেখে মনে হয় সে বুঝি এক সন্ন্যাসিনী। চিকন তনুবাহারের লাবণ্য কোথায় হারিয়ে গেছে। এখন খাবার ঘরে আর যেতেই চায় না সে। নেহাত শরীরটাকে রাখতে হবে তাই সামান্য কিছু খেয়ে নেয়। চোখের কোণে শীর্ণতা, গাল তুবড়ে গেছে। তাকে দেখে কে বলবে সে এক ষোড়শী কিশোরী কন্যা? সেই আধো সন্ধ্যার অন্ধকারে হঠাৎ মনের ভেতর একটুখানি ভয়ের কাঁপুনি—লালন-লালন, তুমি কোথায়? কার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর পাবে সে? একাকিনী উন্মাদিনী চম্পা ভাবল, যদি লালনের কিছু হয়, তাহলে আমি আত্মঘাতিনী হব। এই পৃথিবীতে আমি থাকব, আর লালন থাকবে না, সূর্য উঠবে, চাঁদ হাসবে, বসন্ত বাতাস ছুটবে, না, তা কখনোই হবে না!

—কী রে, কপালে কার সস্নেহে হাতের পরশ। ধড়মড় করে উঠে বসল লালন। চোখদুটি লাল, এ কী? স্মৃতির ভেলার ভাসতে ভাসতে সে কোথায় পৌঁছে গিয়েছিল? বিগত দিন তাকে বুঝি এক অবুঝ আকর্ষণে ডাক দিয়েছিল। এখন আবার কঠিন কঠোর বাস্তবে ফিরে আসতে বাধ্য হল সে। একী? গুরুদেব, আপনি? সিরাজ সাঁই এসে তার পাশে বসেছে। স্নেহ ঝরে পড়ছে তার দুটি চোখ থেকে।

সে বলল—কীরে, ফেলে আসা দিন যাপনের সবকথা মনে পড়েছে তো? আমাকে চিনতে পারছিস?

বুকের মাঝে একটু আগুন, কোষে কোষান্তরে বজ্রপাত। এই মুখ আমার বড়ো চেনা। লালনের সহসা মনে পড়ে গেল, কত দিন আগে বিলের ধারে এক মাঝ দুপুরে সিরাজ সাঁইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল তার। লালন ভাবতেই পারেনি, ওই মহান দরবেশের সাথে আবার দেখা হবে তার। সে কত ভাগ্যবান। তার জন্য এমন আয়োজন? সে তা গ্রহণ করবে কী করে?

সিরাজ বলল—শোন লালন, আমি জানি, তুই কোন গাঁ থেকে এসেছিস। তুই আবার সেই গাঁয়ে ফিরে যা। মা বউয়ের কাছে। তোর সাথে ওই গাঁয়ের নাড়ির টান। আমি সব বুঝতে পারছি রে।

লালন কেমন যেন হয়ে যায়। সত্যিই তো, মায়ের কথা মনে পড়ে গেছে তার। বউয়ের মুখখানি ভেসে উঠেছে মনের পর্দায়। এখনও সে কেন এই বিদেশ বিভুঁইতে পড়ে আছে? কার জন্য? সহসা আমিনার মুখখানি ভেসে উঠল তার মনের ক্যানভাসে। আহা, আমিনার তো কোনো দোষ নেই। আমিনা না থাকলে আজ আমি কোথয় হারিয়ে যেতাম কে জানে? তীব্র উচাটন। দ্বন্দ্বমূলক আবেশ। একদিকে জন্মদাত্রী মা, অন্যদিকে পালিকা জননী। কোথায় যাবে সে? কার কাছে? আর মধ্যিখানে প্রশ্ন চিহ্নের মতো ঝুলছে সিরাজ সাঁই। সিরাজের কথা, সিরাজের অভিব্যক্তি, সিরাজের গান, সবকিছু লালনকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। তার কেবলই মনে হয়, এই জীবনের সব কিছু সে নিঃশেষে সিরাজ সাঁইকে সমর্পণ করবে। এতবড়ো এক দরবেশের মন্ত্রশিষ্য হবে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াবে।

আর তখনই, তখনই তীব্র প্রতিবন্ধকতার মতো চম্পার শরীর, চম্পার সোহাগ, চম্পার আদর এবং শৃঙ্গার এসে চোখের সামনে দাঁড়ায়। লালন ছটফট করে, শান্ত হবার চেষ্টা করে, সিরাজ সাঁই তার সমস্ত শরীরে হাত বুলিয়ে দেয়। লালনের মনে হয়। এ বুঝি বিদ্যুতের চমক। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে সে। এমন ঘুম, যা ভাঙতে ভাঙতে পরদিন বেলা দশটা।

একী? সিরাজ সাঁই কোথায়? তার দলবল? আমিনা স্মিত হাসি হেসে বলল—লালন, উনি দরবেশ, মহান ফকির, উনি কি এক জায়গায় বেশি দিন থাকতে পারেন? গাঁয়ে গাঁয়ে ওনার আখড়া। সেখানে কত শিষ্য শিষ্যারা ওনার জন্য অপেক্ষা করে। উনি চলে গেছেন, বলে গেছেন, আবার এলে আমাদের এই ঘরে পা রাখবেন। অন্তত একদিন—একবেলা…

লালন ভাবতে পারছে না, এখন সে কী করবে। কোথায় থিতু হয়ে বসবে। মনের ভেতর নানা প্রশ্নের ভিড়। সিরাজ সাঁই চলে গেলেন, অথচ আমায় কিছু বললেন না কেন? ভীষণ—ভীষণ অভিমান হল লালনের, সে ভাবল, এই জীবনে আর কখনো ওই দরবেশের সঙ্গে দেখা করবে না। নিজে নিজের মতো বাঁচবে। পরক্ষণেই তার মনে হল, না, এই জীবনটা সে সিরাজ সাঁইকে দান করেছে। এখন ছু^ূটতে হবে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, দেখতে হবে, সত্যি কোথায় উনি নতুন আখড়া খুলেছেন। কোথায় যন্ত্র নিয়ে গাইছেন—

 মনের মানুষ তালাশ

 কর রে মন—

 তবে পাবে সেই

 রূপ দরশন।

 মনের মধ্যে আর এক মন আছে

 সেই মনের গঠন আছে

 এই মনের সাথে।

 ও ফুলের আগা কাটা,

 মাদরী ছাটা

 মধ্যে আছে মহাজন,

 মনের মানুষ তালাশ

 কর রে মন।

পাঁচ

মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল লালনের। উঠে বসল সে। এ কী, ঘামে সমস্ত শরীরটা ভিজে গেছে। ছোট্ট জানলাপথে বাইরের দিকে তাকাল। নিকষ কালো রাতের অন্ধকার বুঝি একটা ডানামেলা পাখি হয়ে উড়ে আসছে তার দিকে। বিশ্ব চরাচর জুড়ে বিরাজ করছে কী অদ্ভুত নীরবতা। লালনের মনে হল, সে বুঝি চোখের সামনে ওই মহান গুরুকে দেখতে পাচ্ছে—একটা অদ্ভুত জ্যোতির্বলয় ধীরে ধীরে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। তার মানে? এতক্ষণ সে স্বপ্নের জগতে বিচরণ করেছে? এবার নেমে এল মাটির পৃথিবীতে!

স্বপ্নে দেখা দিয়েছিল সিরাজ সাঁই। কী কথা বলেছিল তার কানে কানে! তাকে কি বলেছিল, শোন লালন, এই পৃথিবী মায়া প্রপঞ্চময়। মায়া বড়ো কঠিন জিনিস, মায়ার বাঁধন ছিন্ন করতে না পারলে আমরা কেউ দরবেশ সাধক হতে পারব না। আমি বলি কী, তুই একবার ভাড়া রাতে যা, তোর বউ আর মায়ের সঙ্গে দেখা কর। আহা, তোকে না পেয়ে তারা কত কষ্টে আছে। তারপর যদি দেখিস মায়ার বাঁধন ছিন্ন করার ক্ষমতা তুই পেয়েছিস, তা হলে আসিস আমার কাছে।

…কীরে লালন, অমন গোমরা মুখ করে বসে আছিস কেন? আমি ঠিক তোর সন্ধান করে নেব।

এটা কি গুরুর নির্দেশ? লালনের সমস্ত শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ। কোষে কোষান্তরে প্রবাহিত হচ্ছে রহস্যময় চিকন প্রবাহ। আমি আবার ভেসে যাব স্রোতের টানে? ভাঁড়ারা গ্রামে পা রাখব? আহা, বড়ো প্রিয় নদীটি আমার। তার সাথে দুদন্ড অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় মেতে উঠব? শিমূল তলায় বসে থাকব, আগে যেমন থাকতাম। রাখালিয়া বাঁশীর সুরে সুরে কোন সে বাউল আমার মনের একতারাতে বাজাবে চির-বৈরাগ্যের সুর? নাহ, গুরুর আদেশ যখন পেয়েছি, তখন তা সিদ্ধ আমায় করতেই হবে।

অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদটা বিষধর সাপের ছোবল হয়ে আঘাত করল বেচারী আমিনাকে। মধ্য বয়সিনী এই দরিদ্র জোলারমণী, তার হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত মাতৃত্বের স্নেহসুধায় লালনকে পরিপ্লাবিত করতে চেয়েছিল। ভেবেছিল লালনকে সে তার গচ্ছিত ধন করেই রেখে দেবে। বড়ো মহার্ঘ্য এই সম্পদ। এমন ডাগর ডাগর টানা দুটি চোখ। মাথায় একরাশ এলোমেলো চুলের বন্যা। সুঠাম তনু, একটু কৃশ, এই যা। কিন্তু সেই লালন এখন তার গর্ভধারিণী মায়ের কাছে যেতে চাইছে, আমিনা জানে এ যাওয়াই তার শেষ যাওয়া। কিন্তু কী করে বাধা দেবে সে? সে তো এক বন্ধ্যা রমণী। আল্লাহ তার কোল আলো করে একটি সন্তান উপহার দেয়নি। সকলের অভিশপ্ত দৃষ্টি বারবার তার প্রতি নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তাকে সমাজ চ্যূতা হবার আদেশ ঘোষণা করা হয়েছে।

বেচারী আমিনা, সে জানে, লালনের এই কঠিন কঠোর সংকল্পের সামনে তার বাধার প্রাচীর কাঁচের টুকরো হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে। বেদনা, একরাশ বেদনা শুধু জেগে থাকবে নিঃসঙ্গ সন্ধ্যাতারার মতো।

তবুও কি মায়ের মন মানে? নিজের হাতে তৈরি করা তিলের নাড়ু লালনের থলের মধ্যে ভরে দিল আমিনা। গামছা দিয়ে সমস্ত শরীর মুছিয়ে দিল তার। যাবার আগে কপালে একে দিল স্নেহ আর ভালোবাসার চুম্বনচিহ্ন। বলল—লালন, আমি জানি, তুই আর কখনো এখানে আসবি না। যেখানে থাকিস বাবা, ভালো থাকিস। শরীরটার যত্ন নিস। আর, আর যদি কখনো এই মাকে মনে পরে তাহলে বাকি কথাটুকু আর শেষ করতে পারল না আমিনা—পারবে কী করে? কালবৈশাখী ঝড়ের উথালপাথাল আর্তনাদ তখন চারপাশে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। মাথার ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঘোমটাটা মুখের ওপর টেনে দিল আমিনা। না, লালনের যাত্রাপথ সে চোখের জলে সিক্ত করতে চায় না।

পথ ভোলা এক পথিক হয়ে লালন এগিয়ে চলেছে। কিছুটা পায়ে হেঁটে, কিছুটা নৌকার যাত্রী হয়ে। এই অনাবিল উদার আকাশ তাকে পথ দেখিয়েছে। কালপুরুষ পাহারা দিয়েছে। শুকতারা এসে শুনিয়েছে ভালোবাসার গল্পকথা। কী আশ্চর্য, অশক্ত শরীর নিয়েও লালন এতটা পথ লার হল কী করে? অবশেষে একদিন সবেমাত্র সূর্য হেসেছে, এমন সকালে সে পৌঁছে গেল তার প্রিয় গ্রাম ভাঁড়ারাতে। ওই তো দেখা যাচ্ছে শিমূল তলা। তার নীচে ভগ্নপ্রায় একটি শিবমন্দির। লালনের শৈশবের লীলাভূমি। কত নিস্তব্ধ দুপুরে ওই শিমূলতলায় বসে লালন গান বেঁধেছে। সুর দিয়েছে, গুনগুনিয়ে গেয়েছে। আজ যে আবার সেই প্রিয় শিমূলতলায় এসে বসতে পারবে, এ ছিল তার কল্পনার অতীত। চোখ বন্ধ করে লালন বিশ্ববিধাতাকে স্মরণ করল। তারপর? তারপর এগিয়ে গেল সামনের দিকে। স্মৃতির উচাটন, শৈশবের হাতছানি। এই মেঠো পথ দিয়ে সে কতবার যাওয়া আসা করেছে। ওই তো দেখা যাচ্ছে গৌরী নদীটিকে। চঞ্চলা কিশোরীর মতো আপন খেয়ালে কলকল করে বয়ে চলেছে। কিন্তু এ কী? ঘাটের কাছে সাদা থান পরে কে বসে আছে? লালনের বুকের মাঝে একটুখানি কাঁপন।

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে। মাথা ঝাঁকরা একটা অশ্বত্থ গাছ। আলো আঁধারির রূপরেখা। আর তখনই, আর তখনই গুবগুব শব্দ শুনতে পেল সে। মাটির কলসীতে কে যেন জল ভরছে। চকিতে কে তাকাল তার মুখের দিকে?

এবং তখনই বুকের মাঝে একটুকরো আগুন। অকারণে বজ্রপাত। হু হু করে ছুটে আসা অবুঝ মাতাল বাসন্তী বাতাস। স্মৃতির সমুদ্রে উতরোল। লালন অনিমিখ তাকিয়ে থাকল ওই সদ্য বিধবা মেয়েটির বিশীর্ণ মুখের দিকে। চোখের তারায় কী নিদারুণ ক্লান্তি জমাট পাথর হয়ে গেছে।

চার চোখে মিলন ঘটে গেল। সহসা লালনের মনে পড়ে গেল শুভ দৃষ্টির সেই শুভ মুহুর্তটির কথা। কাঁপা কাঁপা হাতে কে যেন শাঁখ বাজিয়েছিল। সলাজ একটি চাউনি, সদ্য কিশোরী। আর তখন? দুটি চোখ থেকে ঝরে পড়ছে শোকার্ত নিদারুণ নির্লিপ্ততা।

লালন অবাক হয়ে গেল এই সজ্জায় তার বিবাহিতা স্ত্রীকে দেখে। ভাসিয়ে দিল সে তার মায়াবী কণ্ঠস্বর ভোরের বাতাসে—চম্পা, একটু থামল, উচ্চকিত আঘাত—চম্পা—এবার একটু জোরে।

কেমন যেন হয়ে গেছে তরুণী বিধবা বধূটি। একটু আগে আপন মনে জল ভরছিল সে। সহসা চোখের সামনে কাকে দেখতে পেল? এ কী? মানুষ, নাকি অশরীরী কোনো আত্মা? মৃত স্বামী কীভাবে আবার সামনে এসেছে? প্রচণ্ড ভয় এসে আক্রমণ করল তাকে। বেচারী চম্পা, এত বড়ো একটা আঘাত কোনোক্রমে সহ্য করেছে সে। এখন, এই ভোরবেলা, এই নির্জন নদী ঘাটে দাঁড়িয়ে কোন দৃশ্য দেখল সে? হাতের কলসী হাত থেকে পড়ে গেল। মাটির টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল চারপাশে। তারপর? মুখের ওপর ঘোমটা টেনে অতি দ্রুত সে চোখের সামনে থেকে ছুটে গেল। ছুটতে ছুটতে একবার পেছন ফিরে তাকাল। সত্যিই কি লালন? নাকি অন্য কেউ? কোনো এক পাষণ্ড পুরুষ? তার সতীত্ব নাশের চেষ্টা করছে?

পদ্মাবতী ধ্যানে বসেছিলেন। ছেলের মৃত্যুর পর তিনি আরও বেশি নির্লিপ্ত হয়ে গেছেন। সব সময় রাধাকৃষ্ণের পদতলে বসে থাকতে ভালোবাসেন। তখনই উন্মাদ আর্তনাদের মতো চিৎকার শোনা গেল। ছুটতে ছুটতে এসেছে চম্পা। ধ্যান ভেঙে গেলে পদ্মাবতীর। কী হয়েছে? জানতে চাইলেন তিনি।

ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। চম্পা অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে বলল—মা-মা, আপনার ছেলে…

বাকি কথাটুকু শেষ করতে পারল না সে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় বাকরোধ হয়ে গেছে তার!

দুটি শব্দ যথেষ্ট ছিল—পদ্মাবতীকে জাগিয়ে দেবার জন্য। এক তন্ময়তার জগতের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। ভগবত প্রেমে মগ্না। কিন্তু এখন? ছেলের নাম শুনে ছুটে এলেন। আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে দুলছে তাঁর হৃদয়। ছেলে তো মারা গেছে। তাহলে? এ কী কথা বলতে চাইছে চম্পা?

একটু শান্ত হবার পর চম্পা সবিস্তারে পুরো ঘটনাবর্ণনা করে। আঁতকে ওঠেন পদ্মাবতী। তার মানে? শ্রাদ্ধশান্তিতে নিশ্চয়ই কোনো ত্রুটি ছিল। না হলে মৃত ছেলে আবার জীবন্ত হয়ে উঠবে কেমন করে? এখন কী হবে? প্রেতাত্মার উপদ্রব হবে নাকি? কার কছে যাবেন তিনি? সহায় সম্বলহীনা এক বিধবা মহিলা। দরিদ্রতার বেত্রাঘাতে জর্জরিতা। গনৎকারের কাছে গেলে অনেক টাকা লাগবে। শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবেচিন্তে পদ্মাবতী ঠিক করলেন, তিনি বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের শরণাপন্ন হবেন। এই গ্রামে উনিই তো আসল রাজা। তাঁর কাছে গিয়ে খুলে সব কথা বলবেন।

তার আর ফুরসত পেলেন কই? পায়ে পায়ে কখন যে লালন খিড়কি দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে তিনি টেরটি পর্যন্ত পাননি? লালন ভেবেছিল, পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে দারুণ চমকে দেবে। হারানো দিনগুলিতে যেমন করত। উদভ্রান্ত চিৎকারে পদ্মাবতী ঘর আর বাইরে করছেন। হঠাৎ কোথা থেকে দমকা বাতাসের মতো ছুটে আসত লালন। সমস্ত গায়ে ধূলিধূসরিত আলপনা। পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরত। চুমুতে চুমুতে অস্থির করে দিত। আজ আবার সেই ছেলে মানুষি খেলা খেলবার সাধ হল লালনের। মাকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ এনে বলল— মা, এই দেখ আমি এসে গেছি।

কিন্তু সে জানত না, তার এই চকিত আক্রমণের ভেতর এতটা ভয় আর শঙ্কা শিহরণ মিশে আছে। তার বাঁধন থেকে নিজেকে নিমেষে মুক্ত করলেন পদ্মাবতী। চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। বললেন—কে কোথায় আছো, এসো, লালনের ভূত আমার ঘাড়ে চেপেছে। তোমরা আমাকে বাঁচাও!

তখনও সবকিছু পরিষ্কার হয়নি লালনের কাছে। এতদিন বাদে সে ফিরে এসেছে মায়ের সাথে দেখা করবে বলে, আর মা তাকে দেখে ভয়ে ছুটে পালাচ্ছে কেন? একটু পরেই পুরো ব্যাপারটা বোধগম্য হয়ে গেল। চম্পার সাদা থান, মায়ের এই ভয় চকিত ব্যবহার এসবের অন্তরালে কী আছে। তার মানে ওদের চোখে আমি এক মৃত সত্তা?

পদ্মাবতীর ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে এসেছে গ্রামের মাতব্বররা। তারা সকলে ভালোভাবে দেখছে লালনকে। অনেকে মত দিয়েছে, না, এ লালন নয়, লালনের ছদ্মবেশে কোনো দুরাত্মা যুবতী চম্পার সতীত্ব নাশ করতে এসেছে।

কেউ কেউ বলেছে—না, হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এ তো লালন। মুখে বসন্তের গুটি চিহ্ন, চিকন চেহারা মলিন হয়েছে অনেকখানি খানি। তাতে কী? আমরা কি লালনকে চিনি না?

সমবেত জনতার মধ্যে ছোটোবেলার বন্ধু সনাতন, রূপাই, উদাস বাউলকে দেখতে পেল লালন। বড়ো আস্থা আর প্রত্যয় নিয়ে শুধাল—কী রে সনাতন? তুই কি আমাকে চিনতে পারছিস না? এই দেখ—

একথা বলে কবজিটা ঘুরিয়ে দেখাল সে। দগদগে একটা কাটা চিহ্ন, গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিল দুজন একসঙ্গে। গলগলিয়ে রক্ত ছুটেছিল। পট্টি বাঁধতে হয়েছিল।

সনাতন সবই বুঝতে পারে। কিন্তু কী করবে? জনস্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটা কি সম্ভব তার পক্ষে? হতদরিদ্র এক দিনমজুর। দিন আনে, দিন খায়। সে নতমুখে বসে থাকল।

শেষ পর্যন্ত ঠিক হল বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের দরবারে বিচার সভা বসবে। বিচারসভায় ডাকা হবে পণ্ডিতদের। তাঁরা বিচার বিবেচনা করবেন। বোঝা গেল লালন যবনের ঘরে ভাত খেয়েছে। বিধর্মী হয়েছে সে। তাকে কি আর ঘরে নেওয়া সম্ভব? তা ছাড়া হিন্দু শাস্ত্রমতে তার শ্রাদ্ধ শান্তি হয়ে গেছে। সে এখন পরলোকের বাসিন্দা। সে যদি এই ভাবে গাঁয়ের ভেতর ঢুকে পড়ে তা হলে সাধারণ মানুষের জীবনে অশান্তির অন্ধকার নেমে আসবে। ভূতপ্রেতেরা দিনের বেলা ভয় দেখাতে শুরু করবে।

আজ রাতে লালন থাকবে কোথায়? একটি রাতের জন্য তাকে ঘরের দাওয়াতে রাখতে চেয়েছিলেন পদ্মাবতী। হাজার হোক, তিনি তো লালনের মা। মাতৃসত্তায় শিহরণ, কিন্তু গ্রামবাসীরা রুখে দাঁড়িয়েছে। আগে বিচারসভার সিদ্ধান্ত হোক, তারপর লালনকে ঘরে ঠাঁই দেবে। আজ যদি সে এই গাঁয়ে থাকতে চায়, তাহলে তাকে শিমূলতলায় থাকতে হবে। আহা, সমস্ত রাত শিমূলতলায় বসে থাকবে লালন? হিম পড়বে। হিমেল হাওয়ার হাতছানি। কিন্তু এটাই তো শাস্ত্রের বিধান। এ বিধান নড়চড় হবার জো নেই।

অতএব ব্যথার্ত লালনকে চলে যেতে হয় শিমূলতলায়। দুটি চোখে জলের ইশারা। ভীষণ ক্ষুধার্ত সে। শেষ কখন দুগালে দুমুঠো মুড়ি পুরে দিয়েছিল, মনে পড়ে না। আর তখনই কী অবাক, পালিতা মা আমিনার জন্য মনটা হু হু করে ওঠে তার। নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার দেয়। কী দরকার ছিল অমন সুখের আশ্রয় ছেড়ে এখানে আসার? লালন বুঝতে পেরেছে, এই সমাজের সঙ্গে তার মিলন আর হবে না। সত্যি সত্যি সে এখন অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছে। তবু কী আশ্চর্য, একী অসীম মায়া? মা আর বউকে চোখের দেখা দেখতে বড়ো সাধ হয়েছিল তার। লালন চোখ বন্ধ করল। খিদেটাকে নিবারণ করার চেষ্টা করল। হু হু করে ছুটে আসছে শীতালী বাতাস। সময়টা শেষ অগ্রহায়ণ। গ্রাম-বাংলায় শীত একটু আগেই আসে। লালন বুঝতে পারল, সমস্ত রাত তাকে নির্ঘুম চোখে বসে থাকতে হবে।

চোখ বন্ধ করে তার ধ্যান করছিল সে। মনের মধ্যে শুধু সিরাজ সাঁইয়ের ছবি ঘোরাফেরা করছে। হঠাৎ কার পদশব্দে চমকে উঠল। সূর্য সবে মাত্র অস্তাচলে গেছে। পাখিরা কুলায় ফিরছে। অথচ আমার কোনো ঘর নেই কেন? তখনই গুনগুনিয়ে একটা গান গেয়ে ওঠে লালন। একতারাটা সঙ্গে থাকলে বোধহয় ভালো হত। না হলে গুবগুবা যন্ত্রটা—

 আজ আমার কর্মদোষে বেড়াই ভেসে

 ডুবতে নারীর প্রেমসাগরে।

 হ’ল না গুরুর প্রতি নিষ্ঠা

 রতি গিত হবে গো মোর কেমন করে?

 বৃথা এ ভবে এলাম কাজ হারালাম

 পড়িলাম চিড়ার চাইল ফেরে।

 পড়ে এই মায়ার জালে হাতে গলে

 বন্দী হলেম একেবারে।

 কি দিয়ে করবো ভজন? দেহ শোধন

 হল না গুরুর দরবারে।

 আমার এই জীবনের ধিক্ হয়ে ঠিক

 ভুলেছে ঠিকের ঘরে।

তন্ময় হয়ে গান শুনছিল চম্পা। এর আগে কতবার চম্পার অনুরোধে লালন গান গেয়েছে। ভালো বাসার গান, তীব্র শারীরিক আশ্লেষের গান। কিন্তু এখন হবো হবো সন্ধ্যা এ কী গান গাইছে লালন? সমস্ত শরীরে কাঁটা দেয় তার। সে নেহাতই এক দরিদ্র ঘরের কন্যা। কদিনই বা স্বামী সান্নিধ্য ভোগ করেছে? শাশুড়ির আদেশ, এই ভাতের থালা আর জলের ঘটি রেখে আসতে হবে লালনের কাছে। শাশুড়ি পইপই করে মানা করেছেন—দেখিস বউ, লালনের ছায়া যেন তোর গায়ে না লাগে।

শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেছে চম্পা। একী কথা বলছেন উনি? নিজের ছেলে সম্পর্কে এমন কথা কেউ কি বলতে পারে? পরক্ষণেই সে বুঝতে পেরেছে, তাকেও তো ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতে হবে। সে হিন্দুঘরের নিষ্ঠাবতী বিধবা। এক যবন মানুষের সংস্পর্শে আসবে কেমন করে? এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। স্বামী জীবন্ত, অথচ তাকে আমি নিজের করে পাব না কেন? শাস্ত্র আমাকে কেন এতবড়ো শাস্তি দেবে? লালন তো ইচ্ছে করে যবন ঘরের জল খায়নি। মুমূর্ষু মানুষটিকে বাঁচিয়েছে এক মুসলমান জননী। তাতেই কি তার জাত গেছে?

গান শেষ হয়ে গেছে, প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে লালনের মন। ইদানিং লালন একটা অদ্ভুত তত্ত্ব আবিষ্কার করেছে। ক্ষুধাতৃষ্ণা সব কিছুকে নিবারণ করতে পারে সংগীত-লহরী। সংগীত সুধায় মেতে উঠলে কোনো চিন্তাই তোমার মনকে আচ্ছন্ন করতে পারবো না। মনে হবে, তুমি বোধহয় বিশাল মহাসমুদ্রের একা একা ভাসছ। দুরন্ত জলরাশি তোমার চারপাশে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। চেতনার ঐ স্তরে না পৌঁছোতে পারলে সঠিক উপলব্ধি হবে না।

কার পায়ের শব্দে সম্বিত ফিরে পেল লালন। চোখে খুলল লালন—একী চম্পা, তুই? আয় পাশে বোস। কতদিন বাদে তোর সঙ্গে দেখা হল।

লালনের কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়ছে প্রেমসিক্ত আকুতি। চম্পা তার ছায়া বাঁচিয়ে একটু দূরে বসল। মাথায় ঘোমটা টেনে দিল। ভাতের থালা আর ঘটিটা এগিয়ে দিল। ক্ষুধার্ত লালন সবকিছু খেয়ে নিল। মায়ের হাতের রান্না। কতদিন পরে। তারপর শুধাল—কী রে চম্পা, আমার দেখে ভয় করছে নাকি? আমি কি ভূত? তোর ঘাড় মটকে দেব?

নিজের এই রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল সে। শান্ত স্বরে বলল— একী, চম্পা, তুই এমন থমথমে মুখে বসে আছিস কেন? আমি তো ফিরে এসেছি, এই দেখ, আমাকে চিমটি কেটে। আমি কিন্তু ভূত নই, আমি তোর ভালোবাসার লালন। কীরে, আগের মতো আমাকে আদরে আদরে অস্থির করে তুলবি না?

লালনের মুখ থেকে ছিটকে আসা প্রতিটি শব্দ চম্পাকে আঘাত করছে। বেচারী চম্পা, তার মন চাইছে লালনকে জড়িয়ে ধরতে। তার শুকনো ঠোঁটের কোণে চুমুর রেখা আঁকতে। কিন্তু তার সংস্কার তাকে বাধা দিচ্ছে। চোখ রাঙিয়ে কে যেন বলছে তুমি হিঁদু ঘরের বিধবা। পরপুরুষের সামনে ঢলানি করতে যেও না। এতে তোমার চরিত্র অভিশপ্ত হবে। এমন কলঙ্কের দাগ আঁকা হবে তোমার কপালে, যা কেউ কোনো দিন তুলতে পারবে না!

এ কী দ্বন্দ্ব? এ কী দ্বিধা? শেষ পর্যন্ত সাহস আর শক্তি সঞ্চয় করে চম্পা তাকাল লালনের মুখে দিকে। বীভৎস ক্ষতচিহ্ন অমন সুন্দর মুখটাকে বিকৃত করে দিয়েছে। তার মানে মায়ের দয়া হয়েছিল লালনের। কিন্তু এই রহস্যের সমাধান সে কিছুতেই পাচ্ছে না। মরা মানুষটা জ্যান্ত হয়ে বেঁচে উঠল কী করে? তবে যে ওরা বলেছে, লালনকে ওরা পুড়িয়ে দিয়েছে। সব মিথ্যে?

বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে বসেছিল চম্পা। এবার তাকে যেতে হবে। না হলে শাশুড়ি ঠাকরুণ রাগ করবেন। শুধু কী তাই? পথচলতি কোনো মানুষ যদি তার এই অভিসার দেখে ফেলে তাহলে কী হবে? তা হলে হয়তো তাকে পতিতা বলে ঘোষণা করা হবে। গাঁয়ের পাট তুলতে হবে। তখন চম্পা বিধবা শাশুড়িকে নিয়ে যাবে কোথায়?

চম্পা চলে গেল, লালন তাকিয়ে থাকল তার দিকে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লালন বুঝতে পারল, সিরাজ সাঁইয়ের কথাই ঠিক। এখনও সে মায়ার বাঁধন ছিন্ন করতে পারেনি। এখন যদি সে ফকিরি সাধনায় নিমগ্ন থাকে, তাহলে সেটা হবে চরম অন্যায়, মনের দিক থেকে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত হতে না পারলে ফকিরি সাধনায় সিদ্ধিলাভ করা যায় না। লালন ভাবল, আমি কি এই জীবনে কখনো মা আর বউকে বিস্মৃতির অতলে ফেলে দিতে পারব? সমস্ত জীবন ধরে আমাকে এমনই এক দ্বন্দ্ব আর সংশয়ের মধ্যে থাকতে হবে। না, এ জীবনে বোধহয় ফকির হওয়ার স্বপ্ন সফল হবে না আমার।

ছয়

বিচারসভা বসেছে জমিদার বাড়ির প্রশস্ত অঙ্গনে। উৎসাহী মানুষের ভিড় জমেছে চারপাশে। ভুরুক ভুরুক তামাক সেবনের শব্দ। মৌতাতে বাতাস ভরপুর। পণ্ডিতরা শাস্ত্র আলোচনা করছেন। একটু দূরে নতমুখে লালন বসে আছে। চিকের আড়ালে তার বউ আর মা। স্বয়ং জমিদার কালীকিঙ্কর দত্ত এই বিচারসভায় হাজির হয়েছেন। তিনি জানেন, এবার তাঁকে কয়েকটা অপ্রিয় প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হবে। সত্যিই কি তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, মৃত লালনকে পুড়িয়ে ফেলতে? তা তো বলেননি, তিনি বলেছিলেন, লীলনের মৃতপ্রায় শরীরটিকে যেন বাঁশের ভেলায় শুইয়ে দেওয়া হয়। যাকে অন্তর্জলী যাত্রা বলে। কী জবাব দেবেন তিনি? নিজের বিবেকের কাছে? বিশেষ করে সৌদামিনী বুঝি রাইবাঘিনী। কোনো অন্যয় অত্যচার সহ্য করতে পারেন না। কালীকিঙ্কর দত্ত জানেন, সৌদামিনী তাঁর অনেক কাজ মানতে পারে না। কিন্তু স্বামী বলে মুখ ফুটে কিছু বলতে চায় না।

পণ্ডিতপ্রবর মুরারীমোহন প্রশ্ন করলেন—বলুন জমিদারবাবু, লালনের শবদেহের অন্ত্যেষ্টি ঠিকমতো হয়েছিল তো?

এই প্রশ্ন শুনে কালীকিঙ্করের সফরসঙ্গীরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে। আমতা আমতা করে বাবু কালীকিঙ্কর আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন—হ্যাঁ, পণ্ডিত মশাই, আমার তো তেমনই নির্দেশ ছিল…

কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি, এতক্ষোভ জমেছিল শীর্ণ লালনের তনুবাহারে? দাঁড়াল সে। থরথর করে কাঁপছে তার সমস্ত শরীর। সে আঙুল উঁচিয়ে বলল—জমিদারবাবু, আপনি মিথ্যে কথা বলছেন।

সকলে অবাক হয়ে গেল তার এই উদ্ধত আচরণ দেখে। চিৎকার করে উঠলেন পদ্মাবতী। চিকের অড়াল থেকে অস্ফুটে বললেন—লালন, তুই কার সাথে এভাবে কথা বলছিস? জানিস না উনি আমাদের দণ্ডমুন্ডের কর্তা?

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল লালন। যে আসল কর্তার সন্ধান পেয়েছে, সে এই দু পেয়ে জন্তুটাকে পৃথিবীকে অধীশ্বর বলে মানবে কেন? দুরন্ত সাহস ভর করেছে তার মাথার ওপর। সে বলল—না জমিদার মশাই, যদি সৎ সাহস থাকে, তা হলে সর্বসমক্ষে চিৎকার করে বলুন, আপনি আমাকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, ঈশ্বরের অনুগ্রহে আমি বেঁচে গেছি। আপনি কখনোই আমার মৃতদেহ পোড়ানোর আদেশ দেননি।

নতমুখে বসে আছেন বাবু কালীকিঙ্কর দত্ত। মুরারী মোহন পণ্ডিত মানুষ, সঠিক কী ঘটনা ঘটেছে, তা বুঝতে পারলেন। কিন্তু লালনকে এখানে ফিরিয়ে নেওয়া তো সম্ভব নয়। শাস্ত্রমতে যার শ্রাদ্ধ শান্তি হয়ে গেছে সে এখন মৃত। লালনকে এই গাঁ থেকে চলে যেতে হবে। এটাই হল শাস্ত্রের বিধান।

মুরারীমোহন কেটে কেটে উচ্চারণ করলেন তাঁর আদেশ। বলা হল লালনকে পদ্মাবতী আর ঘরে তুলতে পারবেন না। এখনই তাকে গ্রাম থেকে বিদায় দিতে হবে। না হলে গ্রামের সকলের অমঙ্গল।

ডুকরে কেঁদে উঠেছেন পদ্মাবতী, আহা, নিজের ছেলে ফিরে এসেছে আর তাকে তিনি আপন করতে পারবেন না? এ কেমন বিধির বিধান?

সভা শেষ হয়ে গেছে। নিঃস্ব রিক্ত লালন ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তার প্রিয় শিমূল গাছটির দিকে। সে জানে, আজ বাদে কাল এই গ্রামের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন হবে তার। হয়তো কোনো একদিন পরিণত বয়সে দরবেশের ছদ্মবেশে সে ফিরে আসবে এখানে। মায়ের সাথে হয়তো আর দেখা হবে না। চম্পা তখন এক মধ্যবয়সিনী। কিশোরী সুলভ প্রগলভতা কোথায় হারিয়ে গেছে। সময় এঁকেছে ক্ষতচিহ্ন সমস্ত শরীরে। তবু কী অবাক, চোখের সেই দ্যূতি আগের মতো এখনও অম্লান। চোখ বন্ধ করে লালন আসন্ন ভবিষ্যতের সেই ভয়ংকর ছবিটা দেখতে পেল। অনেক কষ্টে আজ রাতটুকু শিমূলতলায় থাকার ছাড়পত্র পেয়েছে সে। কাল সকাল হতে না হতে তাকে ভাড়ারা গ্রাম ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে যেতে হবে।

আর তাই তো, সাহসে ভর করে, কাউকে কিছু না বলে, পায়ে পায়ে শিমূলতলার দিকে এগিয়ে এসেছে চম্পা। সে চাইছে লালনের সাধনসঙ্গিনী হতে। ভাসাতে ভেলা দূর গাঙের জলে। ভাসতে ভাসতে দুজন কোথায় চলে যাবে, কে জানে। কিন্তু পারছে না, সংস্কার শাড়ির মতো পেঁচিয়ে ধরেছে তাকে। পৃথিবীর সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। সে কীভাবে মৃত স্বামীর অনুগামিনী হয়ে কুলটা নারী হবে? তবুও, তবুও বড়ো সাধ জাগে, স্বামীকে একবার চোখের দেখা দেখতে। তাইতো এইভাবে খিড়কির দরজা খুলে পালিয়ে এসেছে চম্পা। হাতে তার সময় বড্ড কম। কোঁচরে কী আছে? সামান্য কিছু মুড়ি আর বাতাসা। লালনের প্রিয় খাবার। কতদিন স্ত্রীর কাছে আবদার করত সে, আহা, সেই দিনগুলো কি আর কখনও ফিরবেনা?

লালন জানত, চম্পা অন্তত একবার তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। লালন জানে, এই শেষ দেখার স্মৃতিটি মনের ভেতর বাঁধিয়ে রেখে তাকে পথ চলতে হবে। চোখ বন্ধ করলেই সে চম্পাকে দেখতে পাবে। এ হয়তো ভালোই হল, চম্পার শরীরে সময় তার রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন আঁকতে পারবেনা। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর বাদে লালন এক থুত্থুরে বুড়োতে পরিণত হবে। শরীর থেকে হারিয়ে যাবে সজীবতা। চামড়া কুঁচকে যাবে। মাথায় একরাশ সাদা চুল। অথচ চোখ বন্ধ করলে সে, চিরদিনের তরুণী চম্পাকে দেখতে পাবে। এটাই বোধহয় তার এই জীবনের সবথেকে বড়ো প্রাপ্তি।

চম্পা ছায়া বাঁচিয়ে বসল একটু দূরে। লালনের দিকে তাকাল আবেশ ভরা চোখে। এখন সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে এই লালনই তার হারানো স্বামী, তার সাথে একদা যার বিয়ে হয়েছিল। এ লালনের ভূত নয়।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল এইভাবে শব্দহীনতার মধ্যে। তারপর লালন বলল—চম্পা, আমি জীবনপুরের পথিক হব, তুই কি আমার সঙ্গে যাবি?

কী এক আশ্চর্য আবেশ মিশে ছিল এই কণ্ঠস্বরে। চম্পা কিছু বলতে গেল। বলতে পারল কই? বউয়ের মতিগতি ভালো ঠেকছিল না পদ্মাবতীর কাছে। তিনি জানতেন, অন্তত একবার স্বামীর সাথে দেখা করতে বউ শিমূলতলায় যাবে। তাই তিনি নিঃশব্দে বউকে অনুসরণ করে সেখানে পৌঁছে গেছেন। কিছুক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেখা যাক, ওরা দুজন কী করে। শালীনতার সীমা ছাড়ালে তিনি সহ্য করবেন না। পদ্মাবতী বুঝতে পারলেন, এবার চম্পা তার সম্মতি দেবে। তাহলে? তা হলে সমাজের কাছে একঘরে হতে হবে পদ্মাবতীকে। নিষ্ঠাবান হিন্দু বিধবা হিসাবে তিনি অনেক নিয়ম নীতি মেনে চলেছেন এতকাল। জীবনের উপান্তে দাঁড়িয়ে এখন আর নিয়মচ্যূত হতে পারবেন না।

তিনি চিৎকার করে উচ্চারণ করলেন—চম্পা, চম্পা, তুমি এখনই এখান থেকে চলে যাও। তুমি হিন্দু ঘরের বিধবা, তোমার স্বামীর শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেছে। চোখের সমনে যে বসে আছে, তাকে লালন বলে ভুল করো না।

তবুও চম্পা যাবে না, বিদ্রোহিনী হয়ে উঠতে চায় সে। প্রতিবাদের ভাষা শোনাবে সকলকে। কিন্তু সে ভুলে গেছে, সে গ্রামবাংলার এক সাধারণ নারী। একটু বাদে পদ্মাবতী আরও কাছে এলেন। বললেন বউ, এটাই আমার আদেশ, এখনই তুমি এখান থেকে চলে যাও। না হলে অনর্থ ঘটাব আমি…

পদ্মাবতীর কণ্ঠস্বরে কী এক কঠিন দৃঢ়তা মেশানো ছিল। শেষবারের মতো লালনের মুখের দিকে তাকাল চম্পা। তারপর কাঁদতে কঁদতে বলল—এই জীবনে আর তোমার চলার পথের সঙ্গিনী হতে পারলাম না আমি। আমাকে তুমি ক্ষমা করো…

আর কিছু না বলে ছুটে গেল, নিমেষের ভেতর চোখের সামনে থেকে কোথায় চলে গেল সে।

আর তখনই মাথায় রক্ত চড়ে উঠল লালনের। সে বলল—মা, তুমি তোমার জাতের অহংকার নিয়ে থাকো। আমি আর কখনো এই গাঁয়ে আসব না। এই আমি কথা দিচ্ছি…

কথা রেখেছিল লালন। সেই যে চলে গেল শিমূলতলা থেকে আর কখনো ফিরে আসেনি। মাঝে মধ্যে কোনো এক বিষণ্ণ দুপুরে সেখানে এসে বসতচম্পা। লালনের শেখানো গান গুনগুনিয়ে গাইত। গালে হাত দিয়ে ভাবত, আমার লালন আজ কোথায় হারিয়ে গেছে?

এবং পদ্মাবতী তিনি জানেন, তাঁর নিষেধের ফলেই আজ চম্পা এক সন্ন্যাসিনীর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছে। নিজের বিবেককে মাঝেমধ্যে তিনি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করান। শক্ত শক্ত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। বিবেক নিশ্চুপ থাকে। পদ্মাবতী বুঝতে পারেন হয়তো একটু বেশি শাসন করা হয়ে গিয়েছিল বউকে। না হলে! না হলে বউ হয়তো সত্যি সত্যি লালনের সাধনসঙ্গিনী হত। ব্যাপারটা কি খুবই দূষণীয় হত? নিন্দার যোগ্য? স্বামী তার স্ত্রীকে কাছে চাইছে, স্ত্রীকি সেই ডাকে সাড়া দেবে না? নাহ, আজন্ম লালিত একটা সংস্কার তখনও পদ্মাবতীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। হিন্দুধর্মের কঠিন কঠোর নিয়মনীতিগুলো মেনে চলার পক্ষপাতী তিনি। এ হয়তো ভালোই হয়েছে। কী লাভ হয় এই জীবনের সকল কামনা-বাসনা ভোগ করে? কিছুটা তো তুলে রাখতে হয় ভবিষ্যতের জন্যে। তবুও—চম্পার শীর্ণা দেহখানির দিকে চোখ পড়ে যায় পদ্মাবতীর, আহা, সকাল থেকে রাত অব্দি মেয়েটা একা হাতে কত কাজ করে, স্বামীসুখ বঞ্চিতা—তখন নিজেকে দোষী বলে ভাবতে চান তিনি। যদি একবার ঈশ্বর ক্ষমা করেন তাকে, যদি একবার লালনকে এনে দেন এখানে। তাহলে তিনি সমাজপতিদের সঙ্গে লড়াই করবেন? কোলের ছেলেকে আর কখনো চোখ হারা হতে দেবেন না?

সাত

কোনোরকমে দিন কাটছে আমিনার। মাঝের কটা দিন বুঝি এক অদ্ভুত স্বপ্ন সুখ। সে বন্ধ্যা, মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছিল আকস্মিক। কিন্তু যার ওপর তার নাড়ির টান নেই, সেই ছেলেকে সে বুকের মাঝে ধরে রাখবে কেমন করে? তবুও কী অবাক; সকাল সন্ধ্যে চোখ খুলতেই লাললের মুখখানি ভেসে ওঠে। লালন হিন্দু ঘরের ছেলে, এ পরিচয় জানার পরেও আমিনার মন থেকে তার স্মৃতি কেন কোথাও উড়ে যাচ্ছে না?

দিন আসে, দিন চলে যায়। গরীব জোলা পরিবার। গায়ে গতরে খেটে তবেই দুবেলা দুটো অন্নের সংস্থান করতে হবে। আমিনা জানে, আর কোনোদিন লালন এই গাঁয়ে ফিরবে না। ফিরবে কেন? নিজের মায়ের কাছে ফিরে গেছে। আল্লাহর কাছে মোনাজাত করে আমিনা, যেখানেই লালন থাকুক না কেন, যেন ভালো থাকে।

তবুও, চোখের জল কি এসব কথা মানতে চায়? অবুঝ অশ্রুরেখা কখন গড়িয়ে আসে। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করে বেচারী আমিনা।

অগ্রহায়ণ অবসানে শীতের হাতছানি। পাতাঝরার পালা শুরু হয়ে গেছে। রুক্ষ ন্যাড়া গাছ বুঝি চরম বিষণ্ণতার প্রতীক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। সহসা সেদিকে চোখ চলে যায় আমিনার। গোরুর জাবনা তৈরি করতে হবে। মাঠ পরিষ্কার করতে হবে। হাজার কাজের বোঝা তার মাথার ওপর।

সেদিন একই ভাবে হাতের কাজ সারছিল আমিনা। সকাল থেকে মনটা তার বিশেষ ভালো নেই। হঠাৎ মনে পড়ে যাচ্ছে, কীভাবে গাঙের জলের ধারে মৃতপ্রায় লালনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার। সমস্ত শরীরে গুটিবসন্তের আক্রমণ। দগদগে ঘা, কীভাবে সলতের ফোঁটায় দুধ আর জল মিশিয়ে খাওয়াত লালনকে। যেভাবে জন্মদাত্রী মা কোলের ছেলেকে মানুষ করে, সেভাবেই সে লালনকে লালন পালন করেছে। মৃত্যুর সাথে লড়াইতে জিতে গেছে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু শেষ অব্দি লালনকে বাঁধতে পারল কই?

মন বলছে, আজ একটা অঘটন ঘটে যাবে। এমন এক ঘটনা যার রেশ থেকে যাবে তার বাকি জীবনের ওপর। সত্যি কি লালন ফিরে আসবে? এই আশাটা এখন আর করে না সে। কেন লালন ফিরবে? বিধর্মী এক মুসলমান মায়ের কাছে? নিজের ঘর সংসার ছেড়ে? এ আমি কী চিন্তা করছি? আমি তো মা, আমি তো চাইব আমার ছেলে সুখে শান্তিতে ঘর সংসার করুক। তা না আমি কিনা এমন চিন্তা করছি?

চিন্তাজালে আচ্ছন্ন ছিল আমিনা। হঠাৎ কার পায়ের শব্দ শুনে সচকিতা হয়ে ওঠে সে। এ শব্দ তার বড়ো পরিচিত। কে যেন ঘষটে ঘষটে মাটির ওপর দিয়ে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে আসছে।

লালন এলি? উদভ্রান্তের মতো ছুটে যায় আমিনা।

গফুর একমনে তাঁত বুনছিল। স্ত্রীর এ হেন আচরণ দেখে কষ্ট পায়। কোথা থেকে কী যেন হয়ে গেল। হিঁদু ঘরের ছেলেটা এসে সব কিছু তছনছ করে দিল। গফুর শান্তিপ্রিয়, স্ত্রীর কোনো কাজে বাধা দেয় না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বোধহয় একটু শাসন করতে হবে। না হলে বউটা একেবারে উন্মাদিনী হয়ে যাবে। এই বয়েসে এমন একটা আঘাত সহ্য করা কি চাট্টিখানি কথা?

অবশেষে লালন এল। তার উদভ্রান্ত চেহারা, উসকোখুসকো চুল, চোখের নীচে কালি, বিশীর্ণ মুখ দেখে অভিজ্ঞ আমিনা বুঝতে পারল সর্বনাশ হয়ে গেছে। হয়তো সমাজপতিরা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। যেমনটি আশঙ্কা করছিল সে। সে জানে হিন্দুদের কাছে ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটা কী ভয়ংকর। যবন ঘরের ভাত খেয়েছে লালন। তাই তো হিন্দুসমাজ তার মুখের ওপর সপাটে দরজা বন্ধ করে দেবে। কিন্তু জন্মদাত্রী মা? তিনি কী বললেন? তিনি কি নিজের সন্তানকে কোলে তুলতে পারলেন না? সমাজপতিরা সেখানেও লাল চোখের নিষেধ রেখা তৈরি করেছিল নাকি?

এবং চম্পা? লালনের মুখে বউয়ের নাম শুনেছে আমিনা। সেই যুবতী মেয়েটি? সেকি প্রতিবাদ করতে পেরেছে? পারবে কেমন করে? সে তো হিঁদু ঘরের বিধবা—সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল আমিনার কাছে। কতটা ব্যথার্ত হয়ে লালন ফিরে এসেছে এই মুসলমান সমাজে। এত দুঃখের মধ্যেও কোথায় যেন খুশির সানাই বেজে উঠেছে, রাগটা কী? মেঘমল্লার, নাকি হংসধ্বনি? আমিনা ঠিক বুঝতে পারছে না। আমিনা কি এটাই মোনাজাত করেছিল পরম করুণাঘন আল্লাহর কাছে? একজনের ঘর ভেঙে যায়, অন্যজনের ঘর গড়ে ওঠে। নদীর একুল ওকুলের মতো।

আমিনা ছেলেকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল। সস্নেহ চুম্বনবৃষ্টি নেমে এল আকাশ থেকে। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। একটু আশ্বস্ত হবার পর লালন বলল—মা, আমি কিন্তু কথা রেখেছি। ভীষণ খিদে পেয়েছে, আমাকে তাড়াতাড়ি ভাত দাও।

আহা এই ডাকটি শোনবার জন্যই বোধহয় উন্মুখ প্রহর কাটিয়েছে আমিনা। আল্লাহর অশেষ করুণায় লালনকে সে আবার বুকের মাঝে ফিরে পেয়েছে। এই সাতরাজার ধন এক মানিককে সে আর কোথাও যেতে দেবে না। কেউ যদি জোর করে কেড়ে নিতে চায়, তা হলে বুক চিতিয়ে সামনে দাঁড়াবে। লড়াকু মেজাজের মেয়ে বলে যথেষ্ট খ্যাতি আছে আমিনার। এক হাতে রুখে দেবে দুর্বৃত্তদের ওই ষড়যন্ত্র। লালন তুই আয় আমার কোলে মাথা রেখে একটুখানি ঘুমো। আমি তোর মাথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে গল্প শোনাব, বেহেস্তের গল্প, নূরদের গল্প, পরীদের রূপকথা!

ঘুমিয়ে পড়েছিল লালন। যথেষ্ট ধকল গেছে তার—শরীর এবং মনে। শরীরের ধকল সে সহ্য করতে পারে হাসতে হাসতে। কিন্তু মন যখন রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত হয় তখন কী দিয়ে তার উপশম করবে? লালেন ভাবতে পারেনি, এভাবে তাকে সমাজচ্যূত হতে হবে। লালন ভাবতে পারেনি, সকলের চোখে সে এখন এক মৃত মানুষ। তার শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে গেছে। তবুও কী আশ্চর্য, মাকে সে দোষী সাব্যস্ত করতে পারছে না কেন? চম্পার চোখ থেকে ঝরে পড়া অসহায়তা বারবার তার মনকে আচ্ছন্ন করছে। চোখ বন্ধ করে আকুল আহ্বান সে পাঠিয়ে দিল সিরাজ সাঁইয়ের দরবারে। বলল—গুরুজী, তুমিই বলে দাও, কীভাবে আমি এই মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হব? কীভাবে আমি এক অচিন পাখি হয়ে ডানা মেলে দেব নীল আকাশে? তুমি তো বলেছিলে, ঠিক সময়ে তুমি আমাকে ডাক দেবে। বলো, বলো গুরু সেই সময় কি এখনও আসেনি? আর কতদিন আমাকে এইভাবে যন্ত্রণার মধ্যে ছটফট করতে হবে? আর কতদিন স্মৃতির উচাটনে আমি রক্তাক্ত আর দগ্ধ হব? দহন ক্লান্ত মধ্যদিনে আমার হৃদয় ছটফট করবে। হে সাঁই, কবে তোমার দেখা পাব?

মনের কথা খুলে বলতে বাধ্য হল লালন। এক নিস্তব্ধ মধ্যদিনে, মায়ের কাছে। হাতের কাজ সেরে মা আর ছেলে তখন খেতে বসেছে। আহা, মায়ের হাতের রান্না অমৃত বলে মনে হচ্ছে লালনের কাছে। সামান্য আয়োজন, মমতামাখানো। খেতে খেতে হঠাৎ লালন বলল—মা, মাগো, একটা আবদার করব, রাখবে তো?

বুকের মাঝে একটুখানি কাঁপন। ধুকপুকানি শব্দ শুনতে পেল আমিনা। আমি বুঝতে পেরেছে, এখন লালন কী আবদার করবে। ছেলের আবদার তাকে তো রাখতেই হবে।

আমিনা শুধাল—বল, কী বলবি?

লালন কিছুক্ষণ নত মুখে বসে থাকে। নিজের মনকে প্রস্তুত করে। এতবড়ো একটা শোক সংবাদ সে শোনাবে কেমন করে? তারপর বলে—মা, তুমি আমাকে অনুমতি দাও, আমি সিরাজ সাঁইয়ের কাছে নাড়া বাঁধব। তার চেলা হয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। আশা করি তুমি আপত্তি করবে না।

ঘরের মাঝে বজ্রপাত হলেও বোধহয় এতখানি চমকে যেত না আমিনা। ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা সে সহ্য করত ঠোঁটের কোণে নিস্পৃহ হাসি এনে। কিন্তু একী কথা শুনল? এক লহমায় তার স্বপ্নের তাসের ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। এটাই কি বাস্তব জীবন? এটাই কি চরম সত্যি? হায় আল্লা, তুমি একী কঠিন পরীক্ষার সামনে এনে ফেললে? তুমি কেন আমার লালনকে বিবাগী সংসারত্যাগী করে তুলতে চাইছ? আমার বড়ো শখ আমি তার নিকাহর বন্দোবস্ত করব। মেয়ে পছন্দ করব। নাতিপুতিরা চারপাশে ছুটোছুটি করবে। খেলবে, হাসবে, আর আমি দুচোখ ভরে তা দেখব—এটা কি বড্ড বেশি চাওয়া? তুমি আমার কোলে সন্তান দাওনি, তোমার অনুগ্রহে এক সন্তানকে যখন আমি পেলাম, তাকে নিয়ে আমার স্বপ্ন যখন আকাশসঞ্চারী তখন তুমি কেন অসময়ে বাজিয়ে দিয়েছ শোকের বেহালা? বলো, এ তোমার কেমন খেলা?

নিজেকে প্রস্তুত করতে সময় নিল আমিনা। মনের সঙ্গে লড়াই করল। আমিনা জানে, সে যদি বাধা দেয় তাহলে লালন কখনোই তার স্বপ্ন সফল করতে পারবে না। কিন্তু লালন তো কোনো অন্যায় আবদার করেনি। বাড়ি গাড়ি টাকাপয়সা—কোনো কিছু চায়নি। সে চেয়েছে পরিশুদ্ধ জীবন। সে চেয়েছে দার্শনিক অভীক্ষা। শেষ অব্দি তাই আমিনাকে রাজী হতেই হল।

আমিনা বলল—বাবা, আমি জানি, তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি। তোকে আমি এই সংসারের খাঁচার ভেতর বন্দী রাখতে পারব না। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যাবি কেন? আর কটা দিন এখানে থাক। মায়ের আদর খেয়ে নে। তুই জানিস না লালন, জীবন কত দুঃখ-কষ্টের। রাতের পর রাত গাছতলায় পড়ে থাকতে হবে। হিংস্র জন্তুরা আক্রমণ করবে। মশার কামড় খেতে হবে। বিষাক্ত কীটের ভয়ংকর অত্যাচার। পেটে একফোটা দানাপানি পড়বে না। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। বাবা লালন, মা হয়ে আমি কি তোকে এই কৃচ্ছসাধনের কথা বলতে পারি? তুই একবার আমার অসহায় অবস্থার কথা ভেবে দেখ।

লালন বুদ্ধিমান, লালন জানে সে না থাকলে আমিনাকে কতখানি কষ্ট সহ্য করতে হবে। শুধু কি তাই? সমাজপতিরা আবার হানা দেবে এই দরিদ্র জোলা পরিবারে। হিঁদুর ছেলেকে এতদিন ঘরে রাখার অপরাধে হয়তো অর্থদণ্ড দিতে হবে আমিনাকে। সমাজটাকে হাড়ে হাড়ে চিনে ফেলেছে লালন। ধর্মের মুখোশ পরে মানুষ কত অধর্মের কাজ করে। ভগবান অথবা আল্লাহর ভয় দেখিয়ে অসহায় মানুষের বুকের ওপর পা দিয়ে দাঁড়ায়। কবে এই অন্যায় অত্যাচারের শেষ হবে? লালেন তা জানে না। তবু চেষ্টা তো সে করবেই। তার সাধ্যমতো এবং সীমিত ক্ষমতায়।

লালন বলল—মা, মাগো, মনে যখন ডাক এসেছে, সেই ডাকে তো আমাকে সাড়া দিতেই হবে। তুমি ভেবো না, দূরে চলে যাচ্ছি বলে। তোমাকে আমি ভুলে যাব। কথা দিয়েছিলাম বলে ভাঁড়ারা গ্রাম থেকে এখানে ফিরে এসেছি। আবার কথা দিচ্ছি, এই কাজে সিদ্ধিলাভ করলে অন্তত একবার তোমার কাছে আসব। তোমার পায়ের তলায় বসব। সেদিন তুমি আমায় চিনতে পারবে তো?

আট

সিরাজ সাঁইয়ের আখড়া। ধুনিতে আগুন জ্বলছে। সিরাজ সাঁই-এর উদাত্ত কণ্ঠস্বর রাতের আকাশ ফুঁড়ে কোথায় পৌঁছে যাচ্ছে। শিষ্য-শিষ্যারা ভাবাবেশে উন্মাদ। সিরাজ সাঁই গান ধরেছে। গানের সুরটি ভারি চেনা। চোখ বন্ধ করে তন্ময় হয়ে বসে আছে লালন। তার কেবল মনে হচ্ছে, তার হৃদজগতে আলোড়ন জেগেছে। অদ্ভুত এক ঐশ্বী শক্তির মায়ায় কাঁপছে তার সমস্ত শরীর। শিহরণ জেগেছে রক্তের কল্লোলে। সে যেন মহা প্লাবনের সংকেত শুনতে পাচ্ছে। এ আমার তুমি কী করলে সিরাজ সাঁই? আমি তো বেশ ছিলাম। পথভোলা এক গ্রাম্য যুবক। আমার ঘর ছিল, সংসার ছিল। মায়ের অপরিমাপ্য আদর এবং স্ত্রীর ভালোবাসা। তুমি কেন আমাকে ডাক দিলে মধ্যরাতে? মাদল বাজিয়ে দিলে চৈত্র দিনে? কেন আমার কানের কাছে মুখ এনে বললে—লালন, ওঠে, জাগো, চারপাশে তাকিয়ে দেখ। এই জীবনটাই জীবন নয়, এর আড়ালে আর একটা জীবন আছে। এসো, আমি তোমাকে সেই জীবনের মন্ত্রমালা শেখাব। তুমি চাঁদের পাহাড়ে পৌঁছে যাবে। মহাসমুদ্রের সাথে মিতালি পাতাবে। গভীর অরণ্যের বুকে পাতবে তোমার কাঁটাভরা শয্যা। এ স্ত্রী সম্ভোগ তোমার জীবনের কাম্য হবে না। আমি জানি, লালন মাঝেমধ্যে বীভৎস এক শয়তান এসে বাসা বাঁধবে তোমার মনের জঙ্গলে। নারীসঙ্গ লোভে অস্থির হয়ে উঠবে তুমি। সাধনসঙ্গিনীর সাথে মেতে উঠবে রমণ খেলায়। এভাবেই সাধনার এক একটি স্তর বা সোপান পার হবে তুমি। অবশেষে পৌঁছে যাবে নির্বিকল্প সমাধি ক্ষেত্রে। সেখানে গিয়ে দেখবে তোমার চিত্তে আর কোনো জাগরণ ঘটছে না। তুমি শান্ত স্থির হয়ে গিয়েছ।

সিরাজ সাঁই গাইছে—

 মন তোর দেহের ভাবনা কেন?

 গুরুর নাম লয়ে

 তুই বসে ধেয়ানে,

 গাঁটের টাকা খরচ করে

 কেন গেলি তুই গঙ্গাস্নানে?

শিষ্যরা ধুয়া তুলেছে। সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। রাতের বয়স বাড়ছে। নদী পার ভাঙছে। নারী-পুরুষ রমণে অংশ নিচ্ছে। ক্রন্দসী কাঁদছে। শ্বাপদ শয়তানের চোখ জ্বলছে। আকাশ থেকে খসে পড়ছে তারা। নিশান্তিকার আলোয় উদ্ভাস হচ্ছে পৃথিবী। সূর্য মুখ দেখাবার চেষ্টা করছে। তখনও কী আশ্চর্য, রাতজাগা সিরাজ সাঁইয়ের চোখের তারায় এতটুকু ক্লান্তির কালিমা নেই। লালনকে নতুন শিষ্য হিসাবে পেয়ে সে বুঝি আরও খুশি হয়েছে। গুরু পরম্পরায় শেখা এই কঠিন ফকিরি তত্ব কাকে দান করবে? কার কানে কানে মুখ রেখে শেখাবে গহন গহিন মন্ত্রমালা? এসো লালন, এসো, পবিত্র অগ্নিকে সাক্ষী রেখে আমি তোমাকে আমার শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করি। এই তসবি হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করো, এ জীবনে কোনো কিছুর টান রাখবে না। সন্তানের জন্ম দেবে না। বীর্য ধারণ করবে। নারীকে বাহন হিসাবে প্রয়োগ করবে। আর একটা কথা মনে রেখো, লালন, ফকির কিন্তু কখনো মনের কারবারি হয় না। কোনো নারীকে কখনো মন দেবে না। যদি দাও, তাহলে স্খলন হবে তোমার। রাতের অন্ধকার আবর্তে মুখ লুকিয়ে সমস্ত জীবন—কাঁদতে হবে তোমাকে। আমি জানি মায়ার বাঁধন এখনও পুরো ছিন্ন হয়নি তোমার। এখনও রাতের অন্ধকারে ঘুম ভেঙে গেলে তুমি চম্পার মুখখানা ধ্যান করো। না লালন, এই মায়া তোমাকে ছিন্ন করতেই হবে। তুমি আমার চোখের দিকে তাকাও। আমারও ঘর ছিল, সংসার ছিল, আজ আমি সব কিছু ভুলে গিয়েছি। আমার হাতে হাত রাখো, আমি তোমাকে এক নতুন জীবনের সন্ধান দেব।

হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল। সিরাজ সাঁইয়ের হাতে হাত রাখা মাত্র লালনের সমস্ত কোষে কোষান্তরে প্রবাহিত হল এক অদ্ভুত বিদ্যুৎশিখা। চমকে উঠল সে, মুহূর্ত মধ্যে অচেতন হয়ে গোল তার সমস্ত সত্তা। মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করতে থাকল সে। শিষ্য-শিষ্যারা জানে এখন তাকে সাবধানে শুইয়ে রাখতে হবে। হাত পা ছুঁড়বে লালন, চলে যাব প্রথম শৈশবে। ভগবানের সাথে দেয়ালা করবে। শেষ বন্ধন ছিন্ন করবে। তারপর? তারপর যখন তার ঘুম ভাঙবে, তখন শেষ হবে এই তন্দ্রা তন্দ্রা আচ্ছন্নতা। তখন তার চোখের তারায় আগুন নাচ। তার শরীরে আসুরিক শক্তি। সে নিজেকে নির্মম নির্মোহ পুরুষ হিসাবে ঘোষণা করবে। মুঠিবদ্ধ দুটি হাত আকাশের দিকে তুলে দিয়ে ঘোষণা করবে—আমিই শয়তান, আমিই ভগবান, এই পৃথিবীতে আমিই আসল রাজা!

নয়

—এ বড়ো কঠিন জীবন, তুই কি সব সহ্য করতে পারবি? পথশ্রমে ক্লান্ত লালন। শান্ত সন্ধ্যা নেমেছে। আজ দু’জনের আশ্রয় এক গাছতলায়। শীতল শিহরিত বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। ধুনি জ্বলছে। আজ অন্য আর কেউ সিরাজ সাঁইয়ের সঙ্গে নেই। আজ মনে হচ্ছে সিরাজ বোধহয় লালনকে কিছু একটা উপদেশ দেবে। এমন আদেশ, যা লালন অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে বাধ্য হবে। আজ সিরাজকে দেখে মনে হচ্ছে বংশ পরম্পরার গুরু ঐতিহ্য ভর করেছে তার ওপর। লালন অবাক চোখে সিরাজের চোখের দিকে তাকাল। চোখে চোখে কী যেন কথা হয়ে গেল চকিতে। ইতিমধ্যেই লালনকে দেখে এক নবীন সন্ন্যাসী বলে মনে হয়। মুখমণ্ডল বসন্তের গুটি চিহ্নে আবৃত হয়েছিল। এখন সেখানে দাড়ির প্রলেপ। বড়ো মায়াময় দুটি চোখ। কতদিন চুলে চিরুণীর প্রলেপ পড়েনি। তেলবিহীন ধুলিধূসরিত লম্বা চুল তার। কী আশ্চর্য, এখনও জেগে আছ এক অপূর্ব প্রাণসত্তা। তার ওপর অসহায় নির্মোহতার আবরণ পড়েছে।

আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে লালন মাঝসন্ধ্যার বাতাসে ভাসিয়ে দিল তার সুরেলা কণ্ঠস্বর—গুরুজী, আপনি বললে আমি সব কৃচ্ছ্রসাধন হাসতে হাসতে করতে পারব। আপনি বলুন, আমাকে কী করতে হবে।

কোথায় যেন রাত জাগা পাখি ডাকল চকচক শব্দে। লালন আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল। মেঘবিহীন নীল আকাশ। চাঁদের ঈষৎ জোছনধারা। এই সময় প্রকৃতিকে বড়ো মায়াময় বলে মনে হয়। স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

সিরাজ সাঁই চোখ বন্ধ করল। কিছু একটা ভাববার চেষ্টা করল। তারপর বলল—শোন লালন, ফকিরি বিদ্যার অনেক নিয়ম কানুন আছে। আজ আমি তোকে সব কথা শোনাব। শুনতে শুনতে হয় তো রাত কাবার হয়ে ভোর হবে। তবুও তোকে এসব কথা জানতে হবে। আজ মনে হচ্ছে আধার তৈরি হয়েছে। এবার সেখানে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা দরকার।

আরও একবার লালনের সর্বশরীরে আদ্ভুত শিহরণ। এভাবেই তো হাজার হাজার বছর আগে গুরুরা শিষ্যদের দীক্ষা দিত। কঠিন কঠোর ব্রহ্মচর্য পালনের পর তাদের সেই সাধনা শেষ হত। আজ আবার এই পল্লী গ্রামে এমনই একটি দীক্ষানুষ্ঠানের শুভ উৎসব। না, এখানে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ নিষেধ। সারা জীবন ধরে কঠোর সাধনার মাধ্যমে যা শিখেছে সিরাজ, আজ সবটুকু উজাড় করে দেবে সে। সিরাজ বোধহয় বুঝতে পারছে, তার জীবনের প্রহর সংক্ষিপ্ত। আর বেশিদিন এই পৃথিবীর আলোবাতাসের মধ্যে থাকতে পারবে না সে। যে কোনো মুহূর্তে ডাক আসবে, সেই ডাকে তাকে সাড়া দিতেই হবে।

সিরাজ সাঁই বলল—শোন লালন, আমরা ফকির সম্প্রদায়, আমাদের ধর্ম একেবারে আলাদা। আমরা না মুসলমান, না হিন্দু। আমাদের নবী সাঁই। আমরা যার ভক্ত, তারা এক বিশেষ নিয়মে ভেক ধারণ করি। আমাদের সৃষ্টি নেই, বিবাহ নেই, সন্তান জন্ম নেই। আমাদের গুরুই হলেন আসল রসুল।

…আমাদের দর্শনে সৃষ্টিতত্ত্বের কথা আছে। আছে জীবনতত্ত্বের গল্প। আর আছে নারীতত্ত্বের রহস্য। এই তিন তত্ত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। লালন, একটা কথা মনে রাখবি, নারীসাগরে অবগাহন করবি, কিন্তু পাঁক গায়ে মাখবি না। এই সাধনায় রমণীরমণ অনিবার্য। তবে দেখিস, তুই যেন ইন্দ্রিয়ের দাস না হয়ে যাস।

এভাবেই কেটে গেল সমস্ত রাত। একটি রাতের অবসানে লালনের মনে হল, সে বোধহয় তৃতীয় চোখের অধিকারী হয়েছে। যতটকু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, আজ তার অবসান হয়ে গেছে। সংশয়বিহীন মুক্ত মনের অধিকারী হয়েছে সে। কিন্তু একী? ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে সিরাজ সাঁই উঠে দাঁড়াল। লালনের হাতে হাত রেখে বলল—এবার আমাকে যেতে হবে। আজ থেকে তুই বাউল হয়েছিস, লালন। এখন থেকে পথই হবে তোর আসল জায়গা। পর্ণকুটিরে নতুন জীবন। হয়তো আর কোনো দিন তোর সঙ্গে আমার দেখা হবে না। তার জন্য দুঃখ করিস না। জীবন এক বহমানা তটিনীর মতো। স্রোতের পরে স্রোত আসে। জীবন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। যা কিছু পেছনে পড়ে রইল তার জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলিস না। তাহলে তোর সাধনপথ অকারণে বিস্মিত হবে।

লালন ভাবতেই পারেনি, এত তাড়াতাড়ি বিচ্ছেদ ঘটে যাবে। মনটাকে প্রস্তুত করার বিন্দুমাত্র সময় পায়নি সে। কিন্তু কী আশ্চর্য! সে বিন্দুমাত্র অসহায় আর্তনাদ করল না। গত রাত তাকে একেবারে পালটে দিয়েছে। আবেগ আর অনুভূতির মৃত্যু ঘটে গেছে হয়তো। লালন জানে, এভাবেই দুঃখের পর দুঃখের স্রোত এসে আছড়ে পড়বে তার ওপর। তারই মধ্যে একক কালপুরুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে লালনকে। দীপনির্দেশক হয়ে সিরাজ চলে যাচ্ছে, লালন শেষ বারের মতো তাকাল তার দেবতার দিকে। দূর থেকে শ্রদ্ধাবিনম্র প্রণাম ছুঁড়ে দিল। তারপর? তারপর গায়ে নিল আলখাল্লা। কাঁধে নিল ঝোলা। হাতে নিল একতারা। রাতের আকাশ থেকে শেষ তারাটি তখন সবেমাত্র বিদায় নিয়েছে। সাত ঘোড়ার রথে চেপে দিবাকর এসেছে পৃথিবীকে অলক্তক রাগে রঞ্জিত করবে বলে। লালনের কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। লালন গান ধরল—

 চেয়ে দেখনা রে মন! দিব্যনজরে

 চারি চাঁদ দিচ্ছে ঝলক

 মণিকোঠার ঘরে।

 হ’লে সে চাঁদের সাধন

 অধর চাঁদ হয় দরশন,

 আবার চাঁদেতে চাঁদের আসন

 রেখেছে ফিকিরে।

 চাঁদে চাঁদ ঢাকা দেওয়া

 চাঁদে দেয় চাঁদের খেওয়া

 জমিনে ফলিছে মেওয়া

 চাঁদের সুধা ঝরে।

 নয়ন চাঁদ প্রসন্ন যার

 সফল চাঁদ দৃষ্ট হয় তার

 লালন কয় বিপদ আমার

 গুরু চাঁদ ভুলে রে।

দশ

পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে লালন ফকির। মাঝে মধ্যে একদল চেলা জুটে যাচ্ছে। এখানে সেখানে রাত্রি যাপন। অবশেষে কুষ্টিয়ার কালীগঙ্গার ধারে ছেঁউরিয়া গ্রামে পৌঁছোল সে। প্রকাণ্ড বটগাছের মূলে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল। নিজেকে বড্ড বেশি ক্লান্ত শ্রান্ত নিঃসঙ্গ বলে মনে হচ্ছে। চকিত চমকের মতো ফেলে আসা দিনযাপনের স্মৃতির উচাটন। সাঁইজীর কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করার পরও সে সম্পূর্ণ উদাসীন হতে পারছে না কেন? কেন প্রবহমান জীবনস্রোত বার বার তাকে আক্রান্ত করছে? ঘনছায়া আচ্ছাদিত বটগাছের তলায় বসে এসব কথাই ভাবছিল সে। এমনি করে কত দিন যে কেটে গেল তপস্যামগ্ন অবস্থায়!

অবশেষে একদিন নতুন করে চোখ মেলল লালন। নাহ, এখানে নয়, ঘন অরণ্যের নিভৃত নিরালায় তাকে চলে যেতে হবে। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে হবে বেশ কিছুকাল। কিন্তু কীভাবে? গ্রাসাচ্ছেদনের ব্যবস্থা করতে হবে। ভাবতে ভাবতে পায়ে চলা পথ ধরে গভীর অরণ্যের ভেতরে পৌঁছে গেল লালন। সেখানে আর একটি মাথা ঝাঁকড়া অশ্বত্থ গাছের তলায় বসল কিছুক্ষণ। হঠাৎ সচকিত হল সে। কীসের শব্দ? মুহূর্ত মধ্যে একটি মানুষ লাফিয়ে পড়েছে তার চোখের সামনে। জীর্ণশীর্ণ চেহারা, পরনে কৌপীন। হাতে একটি কাঠারি। চোখ দুটো বনবন করে ঘুরছে। টকটকে লাল। একী? লোকটিকে বড়ো চেনা চেনা বলে মনে হল লালনের। কে? একটু পরেই বুঝতে পারল সে এতো আনোয়ার। একদা তার সাথে চকিতে দেখা হয়েছিল কি লালনের? ঠিক মনে পড়ছে না। মনে হল এ বোধহয় বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের কাছে কাজ করত।

আনোয়ার কিন্তু লালনকে চিনতে পারেনি। তুমুল হুজ্জুতি শুরু করে দিয়েছে সে। বনবন করে ঘোরাচ্ছে ওই কাঠারিটা। তার আচরণে পাগলামির ছাপ রয়েছে।

লালন শুধাল—কী হয়েছে আনোয়ার? এই জঙ্গলের মধ্যে এলে কেমন করে?

লালনের কণ্ঠস্বরে কী এক অদ্ভুত জাদু মেশানো ছিল। আনোয়ার চুপ করে গেল। হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। বলল—দরবেশ তুমি আমাকে রক্ষা করো। ওরা সবাই আমায় পাগল বলে। তাইতো তো আমি সংসারে থাকতে পারলাম না। ওই দেখ, ওই ওখানে আমার গাঁ, ওখান থেকে ওরা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কী করব বলো। মাঝেমধ্যে মাথার ভেতর কেমন যেন হয়ে যায়। হাজার পোকা কুটকুট করে। তখন আমি আর থাকতে পারি না। এই কাঠারি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। যাকে তাকে আঘাত করি। দরবেশ, আমার এমন অবস্থা কেন হয়েছে বলো তো?

আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে সহসা কেমন যেন হয়ে গেল লালন। এই পৃথিবীতে কত না মানুষের আনাগোনা। ঈশ্বর কি তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধি দিতে পারে না? মানুষের এত কষ্ট কেন?

লালন স্নেহমিশ্রিত কণ্ঠস্বরে বলল—আনোয়ার, তুমি কি আমার সঙ্গে থাকবে?

মাথার ভেতর বিদ্যুৎ চমক। আনোয়ার বলল—সত্যি বলছ? কী অবাক। সকলের কাছ থেকে সে পেয়েছে অপরিমাপ্য ঘৃণা এবং অপমান। কেউ যে তার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতে পারে, এটা আনোয়ার বিশ্বাসই করতে পারছে না এখন। দ্বিধা বিজড়িত পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে। লালনের হাতে হাত রাখল। পরখ করে দেখল, এই ভালোবাসা কতখানি খাঁটি। যখন বুঝল লালন আন্তরিকভাবেই প্রস্তাবটা ছুঁড়ে দিয়েছে তখন আনন্দের আতিশয্যে হা হা করে হেসে উঠল সে। বড়ো সহজ সরল মানুষ এই আনোয়ার। এককালে ঘরামির কাজ করত। প্রকৃতির রুদ্র রোষের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাবার জন্য খড় দিয়ে ছোটো ছোটো ঘর তৈরি করত। তারপর কী বিপন্ন আক্রোশে সেই খড়ের চালায় আগুন ধরিয়ে দিত। একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে নাচত। তাকে দেখে তার এই অপ্রকৃতিস্থ আচরণ, মানুষ ছুটে যেত দূর থেকে আরও দূরে। আনোয়ারকে কি পোষ মানাতে পারবে লালন?

আবার নতুন করে ঘর বাঁধার খেলা। না, এখানে কোনো সংসার শয্যা রচিত হবে না। এখানে লালন নিভৃত নিরালায় বসে সাধনায় মগ্ন থাকবে। আর আনোয়ার? সেও হয়তো এক পবিত্র জীবনের পরশ পাবে। বিপরীতধর্মী দুটি মানুষ এখন হাতে হাত রেখেছে। একসঙ্গে গাইছে জীবনের জয়গান!

কী নিপুণ নৈপুণ্যে বাঁশ দিয়ে একটি কাঁচাবাড়ি বানিয়ে ফেলল আনোয়ার। সেখানেই তাদের শয়নের ব্যবস্থা। সারাদিন পথেঘাটে ঘুরে ঘুরে ফলমূল এটা সেটা সংগ্রহ করা। তারপর রাতের অন্ধকার নেমে এলে লালন আপন মনে একতারা বাজিয়ে গান গায়। শ্রোতা বলতে ওই আনোয়ার। অবাক চোখে সে তাকিয়ে থাকে লালনের মুখের দিকে। আর ভাবে এ কেমন দরবেশ? চিনি চিনি বলে মনে হয়, কিন্তু ঠিক চিনতে তো পারি না?

এভাবেই কেটে যায় এক নিস্তরঙ্গ জীবন। সূর্য ওঠে এবং সূর্য অস্ত যায়। মধ্যদিনে গাছের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। প্রচণ্ড শীত পড়েছে গ্রামবাংলায়। পাতা ঝরে গেছে। বৃক্ষ প্রকৃতি বুঝি বসন্ত বন্দনায় মগ্ন। লালনের চোখে ভারি অবাক লাগে প্রকৃতির এই লীলাখেলা। একেবারে ছোট্টবেলা থেকেই প্রকৃতির কোলে মানুষ সে। সে জানে কখন গ্রীষ্মের দহন দগ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়। কখন বর্ষার বৃষ্টির নূপুর নিক্কণে চারপাশে এক অদ্ভুত শব্দবতী মুহূর্তের জন্ম হয়। কখন শরৎ আসে, কখন হেমন্ত অবসানে শুদ্ধাশ্রুর মুক্তোমালা গলাতে দিয়ে প্রকৃতি মাতা হয়ে ওঠে বিষণ্ণবতী। শীতের আগমনে চারপাশে রুক্ষতার ছায়া। আবার আসে বসন্ত, ফলে ফুলে নব কিশলয়—নবীন যৌবনের আহ্বান!

মানুষের জীবনের সাথে প্রকৃতির এক নিদারুণ সখ্যতা আছে। শৈশব থেকে যৌবন পার হয়ে বার্ধক্য—মৃত্যু এবং জন্মের এক চির অভিসার। প্রকৃতিও বুঝি তেমন করে নিজেকে সাজায়। কখনো রঙিন ফুলে, কখনো রিক্ত শাখায়। হে ঈশ্বর একী তোমার অলৌকিক খেলা?

কেউ জানত না, সেই মধ্য-দুপুর তাদের জন্য কী সর্বনাশ সংকেত বয়ে আনছে। দু’জনে গিয়েছে কাঠ কাটতে ঘন অরণ্যের অভ্যন্তরে। সেখানে একী দৃশ্য দেখল তারা? এক নারী আর এক পুরুষ—পথ পরিশ্রমে শ্রান্ত। শরীরটাকে আর টানতে পারছে না। চিৎকার করছে সাহায্যের জন্য। কে সাহায্য করবে?

আনোয়ার বলল—গুরুজী, এসব দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। আমাদের সাধনার বিঘ্ন হবে। চলো, আমরা সামনে এগিয়ে যাই।

যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হল লালন। দূর থেকে দেখতে পেল ছেঁড়া শাড়ি পরা এক মহিলাকে। চিনি চিনি বলে মনে হচ্ছে। নারীর শরীর থেকে কী এক অদ্ভুত সুঘ্রাণ নির্গত হয়? যেখানে লেখা থাকে তার ঠিকানা। সে কে? নাহ, এই অবস্থায় এই দুটি নারী পুরুষকে এখানে রেখে যাওয়া উচিত হবে না? অরণ্য অভ্যন্তরে যে কোনো সময় ঘোর বিপদের সম্ভাবনা। হিংস্র জন্তুর আক্রমণ।

লালন বলল—না আনোয়ার, আমরা ফকির হতে পারি, কিন্তু আগে আমরা মানুষ। দু’জন মানুষ সাহায্য প্রার্থনা করছে, এক মহিলা সম্ভ্রম বাঁচাবার চেষ্টা করছে, আর আমরা দুই সক্ষম পুরুষ সেই ডাকে সাড়া দেব না, তাহলে নরকেও আমাদের স্থান হবে না।

লালনের কথার মধ্যে যুক্তি আছে, আনোয়ার বুঝতে পারে। পায়ে পায়ে দু’জনে এগিয়ে যায়। একী? হঠাৎ মাথার মধ্যে বজ্রপাত। এই মুখখানি আমার বড্ড চেনা। হঠাৎ মনে হয় লালনের, কোনো এক ঘোর আচ্ছন্ন অবস্থায় সে এই মুখে দেখে ছিল মায়ের হাসি। সারা রাত জেগে জেগে এই মোহিনীই তো তাকে সেবা শুশ্রূষা করেছে। অবশ্য তখন লালন অচেতনতার অন্ধকারে পৌঁছে গিয়ে ছিল। কিন্তু কী অবাক, জেগেছিল তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। সেই ইন্দ্রিয়ে মেয়েটির মুখের ছায়া ধরা পড়েছে। কিন্তু এখানে কী করে এল মোহিনী? আর এ কে? এ তো কাশিম ভাই! মনে পড়ে যায়, কাশিমের ওপর আস্তাবলের ঘোড়াদের দেখভালের দায়িত্ব ছিল। লালনের সঙ্গে টুকরোটাকরা কথা বলত ওই কাশিম ভাই। ওরা এখানে এল কী করে? একজন হিন্দু বামনী, বিধবা, অন্যজন মুসলমান। কীভাবে মিলন হল তাদের? তাহলে? আনন্দে হাত তালি দিয়ে লালন গান ধরেছে—চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে তোমরা ভেবে করবে কী?

সত্যিই তো, যখন প্রেমের বাঁধনে মানুষ ধরা পড়ে, তখন সে কি দেখে জাত, ধর্ম কার কী? এ হল এমন এক স্বর্গীয় অনুভূতি, যা সব অস্পৃশ্যতাকে ঘুচিয়ে দেয়। জাতপাতের বিভেদ বিভাজনকে দূর করে দেয়।

কিন্তু আনোয়ার ছাড়বে কেন? তার জ্বলন্ত চোখ থেকে ঝরে পড়ছে জিঘাংসা। সে কাঠারি উঁচিয়ে বলে—কাশিম, তুমি এই মেয়েটাকে বেআব্রু করেছ কেন? আমি এখনই তোমার ধড় থেকে মুণ্ডটাকে আলাদা করব।

রণোন্মাদ আনোয়ারকে দেখে কাশিম সরে যায়। দু’হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে মোহিনী—দোহাই, দোহাই আনোয়ার, এমন কাজ তুমি করো না। দেখছ তো আমরা জঙ্গলের পশুর মতো জীবন বেঁচে আছি। আমাদের একটু আশ্রয় দাও। লালন, মনে কি পড়ে আমাকে? চেয়ে দেখ, ভালো করে।

মোহিনীর মুখ, মোহিনীর টানা টানা দুটি চোখ, লালনের সব কিছু মনে পড়ে যায়। লালন রুদ্রমূর্তি ধরে আনোয়ারকে বলে—শোনো আনোয়ার, আমি জীবন থাকতে এদের কোনো ক্ষতি হবে দেব না।

তারপর মোহিনীকে লক্ষ্য করে বলে—চলো, চলো আমাদের একটুকরো মাচা ঘরে। আমরা দুজন আছি, তোমরা দুজন হলে—দুয়ে দুয়ে মিলে চার। আহা, এ আমাদের আজব কারখানা।

অবশেষে সংসার একটু বাড়ল। এতদিন এখানে কোনো নারী ছিল না। ছিল না কোনো শ্রী। এবার এক মোহিনী কন্যা এসেছে। নিজের হাতে সংসারের সব কাজের দায়িত্ব নিয়েছে সে। কাঠ জ্বেলে রান্না করা, খাবার দেওয়া, মাটির বাসন গুছিয়ে রাখা, সব কাজেই নিপুণা সে। প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিয়ে মোহিনী কেমন যেন হয়ে যায়। তার অদ্ভুত জীবন সত্যি এক রহস্যময় রূপকথা। বামনী হয়ে জন্মেছিল, ঠাকুরদার বয়সী কারো সাথে বিয়ে হয়েছিল, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিধবা, জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া। কাশিমের নেকনজরে পড়ে যাওয়া। তারপর? তারপর আর কী? বাড়ি থেকে পালিয়েছিল এক রাতে। আর একটু হলে ধরা পড়ে যেত। ধরা পড়লেই বোধহয় ভালো হত। আবার ভাবে, ভাগ্যিস পড়েনি, তাই তো জীবনের এই চরাই উৎরাই চোখের সামনে থেকে দেখতে পাচ্ছে সে। এই অরণ্য অভ্যন্তরে এত স্বাধীনতা? এত আনন্দ? ভাষায় প্রকাশ করবে কেমন করে?

লালনকে দেখে চিনতে পারেনি সে। কী চেহারা ছিল লালনের, আর এখন কেমন হয়ে গেছে। মনে হয়, এ বোধহয় অন্য কোনো মানুষ, যাব সাথে মোহিনীর কখনো দেখা হয়নি।

এবং আনোয়ার, এই উদ্ধত যুবকটিকে বড্ড ভয় পায় মোহিনী। কোনো এক নিভৃত অবকাশে হয়তো কিছু ঘটে গিয়েছিল আনোয়ারের সাথে। কেউ কেউ বলে থাকে। তারপর থেকে নাকি আনোয়ার উন্মাদ হয়ে গেছে। এর জন্য মোহিনী মনে মনে বড়ো কষ্ট পায়। নিজেকে এক নষ্টা মেয়েছেলে বলে মনে হয়। কী করবে সে? এই ভরা যৌবন দিন, কামনা-বাসনার আগুন শিখা সব সময় জ্বলে তার মনের ভেতর। এমন কোন পুরুষ কি আছে, যে সবকিছু প্রশমন করবে?

তখনই হঠাৎ লালনের প্রশান্ত মুখখানি ভেসে ওঠে তার মনের মধ্যে। কিন্তু লালন তো এক দরবেশ। তার কাছে আমি আমার ভ্রষ্টা যৌবন নিয়ে যাব কী করে? পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় মোহিনীর কেন, ফকিরি বিদ্যায় নারী সঙ্গিনী লাগে। আমি কি লালনের সাধনসঙ্গিনী হতে পারি না? আহা, সেই কল্পিত দৃশ্য তাকে বড়ো আমোদিত করে তোলে। মনে মনে শপথ নেয়, আজ অথবা আগামী কাল সে লালনের শয্যাসঙ্গিনী হবে। না, ইন্দ্রিয়ের আগুন দিয়ে লালনকে পোড়াবে না। বরং ধূপের মতো নিজেই জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আর একমুঠো সুগন্ধি রেখে যাবে লালনের জন্য। লালনকে সে সত্যি বড়ো ভালোবেসে ফেলেছে।

এগারো

দুজন যুবক, শীর্ণ দেহ, সমস্ত শরীরে দরিদ্রতার ছাপ সুস্পষ্ট, ভয়চকিত দৃষ্টি, এসে দাঁড়িয়েছে লালনের পদপ্রান্তে। হাত জোড় করে বলছে—সাঁইজী, আমরা দু’জন বড়ো গরীব, অনুগ্রহ করে এখানে স্থান দিন। গায়ে গতরে খেটে দেব। ফাইফরমাস পালন করব। আপনি দয়া না করলে আমরা যাব কোথায়?

লালন তখন সবেমাত্র সকালের সুর সাধনা শুরু করেছিল। রোজ সকালে উঠে একতারা বাজিয়ে গান গায় সে। মুখে মুখে শব্দ নিক্ষেপ করে। সুর দেয়, সেই সুর মানুষের মনের ভেতর গেঁথে যায়। ইদানিং লালনের বেশ নামডাক হয়েছে। এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে তার সংগীত সুধারসের ধারা। কেউ কেউ লালনের গান গেয়ে মাধুকরী বৃত্তিতে মেতে ওঠে। এই দুই যুবককে দেখে লালন একটু অবাক হল। সে জানে, এ সবই হল ঈশ্বরের অনুগ্রহ। ঈশ্বর হয়তো চাইছেন এই আখড়ায় আরও মানুষজন আসুক। আরও বেশি বাড়বাড়ন্ত হোক।

লালন শুধাল—নাম কী তোদের?

—আজ্ঞে আমি হলাম শীতল শা আর ও হল ভোলা শা।

—সাকিন কোথায়?

—সাকিন? জানিনা তো। আমরা দুই পথচলতি যুবক। হাতে হাত রেখেছি সাঁইজী, অনুগ্রহ করে আমাদের তাড়িয়ে দেবেন না।

লালন বলল—বেশ, বেশ। আমার একদিকে শীতল আর অন্যদিকে ভোলা। নামের তো ভারি বাহার। বলি, কাঠ কাটতে পারবি? দাঁড় বাইতে পারবি? গঞ্জের হাট থেকে বাজার করতে পারবি?

সবেতেই ঘাড় নাড়ল দুই যুবক। তাহলে আর কী, ছিলাম চার, হল ছয়। এই আমাদের আজব কারখানা।

খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মোহিনীর ঢলঢল মুখখানি। আহা, কত বড়ো সংসারের দায়িত্ব তাকে একা হাতে সামলাতে হচ্ছে। কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে দিনগুলি। সাংসারিক কাজের মধ্যে। কিন্তু মোহিনীর বড়ো সাধ, সে-ও লালনের পায়ের তলায় বসে ফকিরি বিদ্যার সাধনা করবে। মানুষের জীবনরহস্য জানতে উন্মুখ হয়ে ওঠে। শুধু কী তাই? লালনের গান গাইবে সে একতারা বাজিয়ে। লালন কবে আমার দিকে কৃপাদৃষ্টি দেবে? রোজ রাতে শুতে যাবার আগে এই কথা ভাবে সে।

এবং কাশিম, এখন কেমন যেন হয়ে গেছে সে। নেহাত ইন্দ্রিয়ের তাড়নায় মোহিনীকে নিয়ে ঘর থেকে পালিয়ে ছিল। এখন খালি গাঁজা খাবার দিকে মন দেয়। শরীরটা শুকিয়ে গেছে। খকখক করে সারা রাত ধরে কাশে। তার কি সাধ্য মোহিনীর যৌবনজ্বালা মেটাবে? সারা রাত একরাশ বাসনা কামনা নিয়ে ছটফট করে মোহিনী। মাঝে মধ্যে বাইরে এসে দাঁড়ায়। একটুখানি বসে, চারপাশে নিঝুম অরণ্য। পাশের কুঠুরিতে লালন নিদ্রামগ্ন। ভারি সাধ হয় তার, একবার দরজা ঠেলে সেখানে ঢুকে পনবে। জাগিয়ে দেবে লালনকে। জাগ্রত পৌরুষের সামনে দাঁড়াবে এক সর্বনাশিনী কন্যা হয়ে। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেয়। না না, এভাবে লালনের ক্ষতি আমি করব না। শাস্ত্রে লেখা আছে নারী নরকের দ্বার। কত নারী এই ভাবে পুরুষের সংযমকে আঘাত করেছে। তাকে বিপদগামী করেছে। লালনকে আমি সত্যি সত্যি ভালোবাসি। তখন মোহিনীর মনের মধ্যে লেগেছে দ্বিধা আর দ্বন্দ্ব। একবার ভাবছে, ভালোবাসার জারক রসে সে লালনকে সম্পৃক্ত করবে। সত্যিকারের প্রেমিকা হবে তার। তার জীবনের সাথে ছায়ার মতো লেপটে থাকবে।

পরক্ষণেই ভাবছে, না, সত্যিকারের প্রেম মানুষকে দূর থেকে আরও দূরে সরিয়ে রাখে। সত্যিকারের প্রেমিকা কি কারো ক্ষতিসাধন করতে পারে?

সেদিন মোহিনী শুতে যাবার আগে ভাবল, নাহ আর দেরি সইছে না আমার। এইভাবে একদিন যৌবনসূর্য অস্তমিত হবে। কী করব আমি? ভরা যৌবনের ছলছলাত শব্দ তুলে লালনকে জাগিয়ে দেব? লালনই আমার প্রিয়তম পুরুষ হবে। তার কাছে নিবেদন করব ইহজীবনের সবকিছু? বলব, এই নাও আমার ঘৃণা, আমার অপমান, আমার জ্বালা, আমার যৌবনযন্ত্রণা—আমাকে পরিশুদ্ধ করো, আমাকে মুক্ত করো, আমি যে আর থাকতে পারছি না এই চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দিনী হয়ে।

বারো

ধীরে ধীরে বাড়ছে ভক্তশিষ্যের সংখ্যা। এখন এক বিরাট সংসারের কর্ত্রী হয়েছে মোহিনী। মাঝে মধ্যেই লালন ফকিরের পায়ের তলায় বসে থাকে সে। লালনের সমস্ত শরীরের মধ্যে জেগেছে এক অলৌকিক প্রশান্তি। দেহতত্ত্বের গান গাইতে ভালোবাসে সে। কত প্রশ্ন করে ভক্ত শিষ্যরা। লালন সহজ সরল ভাষায় প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করে। একদিন ভোলা শা জানতে চাইল—সাঁইজী, এই যে জীবনের বাকি দিনগুলো এই ছোট্ট কুটিরে কাটিয়ে দিলেন, এতে কি আপনার অসুবিধা হয় না?

লালন হাসল। সেই হাসির মধ্যে ঝরে পড়ল এক অপার রহস্য। লালন বলল অসুবিধে? এক তারায় সুর তুলে গাইতে শুরু করল—

আমার এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে?

 আমি জনম ভরে একদিনও দেখলেম নারে

 নড়ে চড়ে ঈশান কোণে

 আমি দেখতে পাই না দু’নয়নে

 হাতের কাছে যার ভবের হাট বাজার

 হাত বাড়ায়ে ধরতে পেলেম না তারে।

প্রতিটি শব্দের মধ্যে একটা অদ্ভুত অর্থের দ্যোতনা। এরা সব গ্রামের মুখ্যসুখ্যু মানুষ। আধ্যাত্মিক তত্ত্বকথা বুঝবে কেমন করে? তাই বোধ হয় লালন এত সহজে গানের মাধ্যমে সব কিছু বলতে চায়।

শীতল জানতে চাইল—সে মানুষের সন্ধান কোথায় পাব, সাঁইজী? সে কি চোখের সামনে আছে?

লালন বলল—বিষয়ের চোখ দিয়ে তাকালে তাকে পাওয়া যায় না। সে হল আমাদের মনের মানুষ। তাকে দেখতে হলে দেখার চোখ চাই।

আবার সুর তুলল সে—

 সোনার মানুষ ভাসছে রসে

 যে জানে সে রসপান্তি

 সে-ই দেখতে পায় অনায়াসে

 তিনশো ষাট রসের নদী

 বেগে ধায় ব্রহ্মাণ্ড ভেদী

 যার মধ্যে রূপ নিরবধি

 ঝলক দিচ্ছে এই মানুষে—

ভোলা শা অসহায় আত্মসমর্পণ করল। কিছুই বুজতে পারছে না সে। সে পরিষ্কার জানতে চাইল— আমাদের এই দেহের মধ্যেই সেই মানুষ বিরাজ করছে, তাই না সাইজী?

লালন বলল—তুই ঠিকই ধরেছিস। আগে দেহটাকে জানতে হবে। এই দেহটার গঠন বড্ড খটমটে। ষট চক্রভেদী সাধনায় বলে এই দেহের ছটি চক্র আছে।

শিষ্য শিষ্যারা অবাক হয়ে লালনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা জানে লালন এবার দেহ তত্ত্বের আসল রহস্য উদঘাটন করবে।

লালন দূর আকাশের দিকে তাকায়। দূরের অরণ্যানীর দিকে দৃকপাত করে। বিকেলের মরা রোদ ক্রমশ মলিন হয়ে আসছে। শীত অবসান, গাছে গাছে নবকিশলয়ের সন্ধান জেগেছে। মধুপিয়াসী মৌমাছিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভ্রমরের গুনগুন শব্দ। লালন জানে, এসবই হল ক্ষণিকের সমারোহ। আবার ঋতুচক্রের আবর্তনে দহন দগ্ধ গ্রীষ্ম আসবে।

লালন বলে—মেরুদণ্ডের শেষভাগে আছে মূলাধার। তার উর্দ্ধে লিঙ্গ মূলের স্বাধিষ্ঠান। তার উর্দ্ধে নাভিমূলে মণিপুর, তারপর হৃদয়ে অনাহত, কণ্ঠে বিশুদ্ধ, ভ্রূমধ্যে আজ্ঞা—এই ছটি চক্রই আছে আমাদের দেহে। তারা সুষুম্না পথে অবস্থিত।

শিষ্যরা হয়তো কিছুই বুঝতে পারছে না। মোহিনী বলল—কিছুই বুঝলাম না সাঁইজী। একটু ভালো করে বুঝিয়ে দেবে।

—সাধনা কর, তবে তো বুঝবি। লালন একটু থামল। তারপর বলল—কুণ্ডলী শক্তি যখন মূলাধারের ভিতর থেকে সুষুম্না পথের ওপরে চক্রগুলি অতিক্রম করে, তখন সবশেষে সে অচিন দলে বা সপ্তম ভূমিতে অবতীর্ণ হয়। এই অবস্থায় একজন শিষ্য তার চিরকাঙ্খিত গুরুর দর্শন লাভ করে। এছাড়া প্রতিটি চক্র অতিক্রমকালে নানা ধরনের দর্শন হয়। তারপর আমাদের দেহান্ত হবার পর জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হয়ে যায়।

কেউ কি বুঝল এই কথার মধ্যে কী রহস্য লুকিয়ে আছে? লালন গানের মাধ্যমে প্রকাশ করতে চায়। সে গলা ছেড়ে গান ধরল, শিষ-শিষ্যারা ধুয়া তুলেছে। সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে। লালন গাইছে—

 কীবা শোভা দ্বিদলের পরে

 রাসমণি মাণিক্যের রূপ ঝলক মারে

 অবিম্ব সম্মতে শাণিত্যগোলোক

 তাহে বিরাজ করে পুণ্য ব্রহ্মলোক

 হলে দ্বিদল নির্ণয়, সব জানা যায়,

 পোসন্ধি থাকে না সাধন দ্বারে।

 শত কিংবা সহস্রদল

 রসমতী করে চলাচল

 ওগো দ্বিদলে স্থিতি দীর্ঘ আকৃতি

 ষোলো দলে বাড়াম যুগান্তরে

 ষড়দলে সে তো ষড়তত্ত্ব হয়

 দশম দলে মৃণাল গতিগঙ্গাবয়

 ওগো তীর ধারা তার শ্রীগুণ বিচার

 লালন বলে গুরু অনুসারে।

এতক্ষণে হয়তো কিছুটা বুঝতে পেরেছে ভোলা আর শীতল। শিষ্যরা সমস্বরে বলল—লালনজী, আপনি আমাদের দীক্ষা দিন। সাধনার মন্ত্র শিখিয়ে দিন।

লালন হাসল। বলল—আমি কী করে গুরু হব। আমি তো সর্বত্যাগী এক ফকির। তোরা নিজেরা তপস্যা কর। মনের মধ্যেই মন্ত্র লুকিয়ে আছে। মন তোর এই তো আসল মন্ত্র। আগে নিজেকে জান। তবেই তো তাকে জানতে পারবি। মনকে জানলেই আমরা মনের মানুষের সন্ধান পাব। তুই কে? কোথা থেকে এসেছিস? কোথায় যাবি? এসব প্রশ্ন কি কখনো জাগে তোদের মনের মধ্যে? বিশ্বচরাচরে তোর স্থান কোথায়? ভেবে দেখ, যে পরম শক্তি বিরাজ করছে মহাশূন্য থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার মধ্যে তাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা কর। তাহলেই তুই আসল পথের সন্ধান পাবি। অনেক সাধনার পর আমরা মনুষ্য জন্ম পেয়ে থাকি। এই জন্ম পাওয়া খুব সহজ নয়। তাই প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগা। তাই তো বলি—

 আপন খবর আপনার হয় না

 আপনারে চিনলে পরে

 যায় অচেনারে চেনা

লালন আবার গান সাগরে ডুব দেয়। মোহিনী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে লালনের দিকে। লালনের সমস্ত শরীর থেকে নির্গত হচ্ছে এক অলৌকিক প্রভা। সহসা মোহিনীর মনে হয়, আজ রাতে সে লজ্জা ঘৃণা ভয়কে জয় করবে। যে করেই হোক লালনের ঘরে ঢুকে পড়বে। তার পদতলে মাথা রেখে কাঁদবে। সেই কান্নায় তার বিগত জীবনের সমস্ত পাপ আর অভিশাপ ধুয়ে মুখে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কাল সকালে নতুন জীবন লাভ করবে সে।

তেরো

মোহিনী বলল—সাঁইজী, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

লালন হাসল। লালন সব কিছু বুঝতে পারে। সে জানে, এই যৌবনজ্বালা নিয়ে মোহিনী আর থাকতে পারছে না। চোখের ইঙ্গিতে সে মোহিনীকে নিজের ঘরে ডেকে নিল। মোহিনী ঢুকল, এই প্রথম তার রূপের ছটায় মুগ্ধ হয়ে গেল লালন। সত্যিই তো গুরু সিরাজ সাঁইয়ের কথা মনে পড়ে গেল তার। সিরাজ বলেছিল—লালন, নারীদেহের সন্ধান না করলে আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশ করতে পারবি না তুই। আগে নারীরহস্য উদঘাটন কর। তারপর জীবনরহস্যের বন্ধ-দুয়ারে আঘাত করবি।

কিন্তু মোহিনী? মোহিনীকে সে অন্য চোখে দেখে। মোহিনীর সঙ্গে তার সখ্যতার সম্পর্ক। মোহিনী যথেষ্ট যৌনবতী, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দীর্ঘদেহী, গরীবের ঘরে এত রূপ এল কোথা থেকে? গৌরবর্ণা, এত ফরসা, যে মাঝে মধ্যে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। টিকোলো নাক, আয়ত দুটি চোখের তারায় কী যেন এক অস্ফুট অভিমান খেলা করে।

লালন বলল—মোহিনী, আমি তোমার মনের ব্যথা বুঝতে পারছি, বলো, কীভাবে তোমাকে সাহায্য করব?

মোহিনী তাকাল, সেই চাউনির ভেতর একটা আশ্চর্য অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আছে। মোহিনী আজ সব কিছু দেবে বলে প্রস্তুত হয়ে এসেছে। মোহিনী বলল—ঠাকুর তোমার কি মন বলে কিছু নেই? তুমি কি আমাকে তোমর মনের মানুষ বলে ভাবতে পারো না?

সহসা লালনের মনে হল, এ বুঝি গুরুর নির্দেশ। সাঁইজী বোধহয় এভাবেই লালনকে সাধনার আর একটি স্তরে তুলতে চাইছে। এই প্রথম লালন তার হৃদয়ের দরজার আগল খুলে দিল। মোহিনী সেখানে নিরাপদে প্রবেশ করতে পারে, এমন ব্যবস্থা করল। বলল—যা, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আয়।

তারপর এক ফুঁয়ে লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিল। মরাচাঁদের ফ্যাকাশে আলো ঢুকে পড়েছে ছোট্ট ঘরখানিতে। ঘরের কোণে পরিপাটি শয্যা। শিষ্যেরা ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেই আধো অন্ধকারে মোহিনীকে কাছে টেনে নিল সে। মোহিনী হয়তো এই কাঙ্ক্ষিত প্রহরের জন্য ছিল প্রতীক্ষায়। সে পাগলিনীর মতো লালনের বুকে মাথা ঘষতে লাগল। আকুল কান্নায় ভেসে গেল। বলল—ফকির আমার কী দোষ? আমি কেন বালবিধবা হলুম? আমার সমস্ত শরীরে যৌবনের জোয়ার, অথচ কার কাছে গিয়ে আমি একটুখানি শান্তি পাব, বলতে পারো? কাশিমকে তো জানো, সারাদিন গাঁজার আড্ডায় পড়ে থাকে। রাতে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয়। আর আমি? ঠাকুর, আমাকে কি তুমি তোমার সাধনসঙ্গিনী করবে?

লালন হাসছে, দুর্জ্ঞেয় হাসি। মোহিনীকে সাধনসঙ্গিনী করলে কেমন হয়? এই প্রশ্নটা বারবার তাকে আঘাত করছে। কিন্তু প্রতিবারই সে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হয়েছে দিশেহারা। আজ লালনের মনে হচ্ছে, সাধনসঙ্গিনী হিসাবে মোহিনীকে নির্বাচন করাটাই ঠিক। তাহলে এই হতভাগিনী মেয়েটির প্রতি অন্তত কিছুটা করুণা দেখানো যাবে। এখনও মনকে প্রস্তুত করতে পারছে না লালন। লালন জানে, একজন নারীসঙ্গিনী না থাকলে তন্ত্রসাধনার শেষতম ধাপে সে উঠতে পারবে না। ফকির তত্ত্বের অনেক গূঢ় বিষয় আত্মস্থ করতে পারবে না। উপলব্ধি করতে পারবে না নারী-পুরুষের চিরন্তন প্রেম আকুতির রহস্য কথা। তাহলে? সে কি সম্মতি দেবে? ওই অসহায়া রমণীকে দেবে সান্ত্বনা? যা হবার হোক আজকের রাতটুকু মোহিনীকে তার ভীষণ দরকার। সেই কবে চম্পার সাথে শেষ সংগত করেছিল। সেই স্মৃতি ক্রমশ ফিকে হয়ে এসেছে। তবু কী অবাক মোহিনীকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরার মুহূর্তে হঠাৎ চম্পার অসহায় মুখখানা ভেসে উঠল লালনের চোখের তারায়।

লালন চিৎকার করল। বলল—মোহিনী, তুই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। তুই এক কুলটা রমণী, হিঁদুর ঘরের বিধবা, এখন আমার চরিত্র ভাঙাতে এসেছিস? এখুনি চলে যা।

মোহিনী ভাবতে পারেনি এমন একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটে যাবে। লালনকে সে শ্রদ্ধা করে। সেই কবে প্রথম দেখা, বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের দরবারে। তারপর সেবাশুশ্রূষা করা। মৃত্যুর সাথে লড়াই করা, তখন থেকেই লালনকে সে মনের রাজার আসনে বসিয়েছে। আজ রাতে তাকে যে এই ভবে অপমানিত হয়ে চলে যেতে হবে সেটা ছিল মোহিনীর ধারণার বাইরে। কাঁদতে কাঁদতে সে ছিটকে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

এবং লালন? আকুল আর্তনাদে বলল—মোহিনী, মোহিনী, তুই আমাকে ক্ষমা করিস, এখনও চম্পা আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে অবস্থান করছে। আমি কথা দিচ্ছি মোহিনী, আজ অথবা আগামীকাল আমি নিজেই তোকে ডাকব। আগে চম্পার স্মৃতিটা জ্বলেপুড়ে একেবারে ছাই হয়ে যাক। তারপর? তারপর তুই-ই হবি আমার আসল সাধনসঙ্গিনী।

চোদ্দ

খবরটা রটে গেছে। নদীর ওপারে জ্বলছে দাউ দাউ চিতা। সালংকরা এক বিবাহিতা, অথচ এই মাত্র বিধবা হওয়া কন্যাকে সেখানে নিক্ষেপ করা হবে। যদিও আইনত সতীদাহ নিষিদ্ধ কিন্তু গ্রামেগঞ্জে এ আইনের খবর কে রাখে? মাতব্বররা এসে পড়েছে, ঢাক বাজছে, উৎসব মুখরিত পরিবেশ। পণ্ডিতমশাই সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। আর একটুক্ষণ পরে ওই মেয়েটিকে জ্বলন্ত কুণ্ডে নিক্ষেপ করা হবে।

শীতল আর ভোলা শা নাও বেয়ে ফিরছিল। গঞ্জের হাট থেকে বেশ কিছু জিনিসপত্র কিনেছে তারা। ওই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল দু’জনে। অতি দ্রুত পৌঁছে গেল লালনের কাছে। লালন তখন শিষ্য-শিষ্যা পরিবৃত হয়ে গান শোনাতে ব্যস্ত ছিল। দূর থেকে শীতল আর ভোলাকে এইভাবে ছুটে আসতে দেখে অভিজ্ঞ লালন বুঝতে পারল ভয়ংকর কোনো ঘটনা ঘটে গেছে।

লালন উঠে দাঁড়াল। ওরা এসে বলল—সাঁইজী, সর্বনাশ হয়ে যাবে, এক যুবতী মেয়েকে পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। আপনি এখনই চলুন।

লালনের সাথে একদল লাঠিয়াল নিয়মিত নিযুক্ত থাকে। তারা নানাভাবে লালনকে সাহায্য করে। সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ, সবল চেহারার অধিকারী। তারা উঠে দাঁড়াল।

অতি দ্রুত লালন পৌঁছে গেল নদীর অপর দিকে। এতজন লাঠিয়ালকে ছুটে আসতে দেখে পণ্ডিমশাই ভাবলেন—এরা বোধহয় সরকারি পাইক। সরকারি হুকুম তামিল করতে এসেছে। সতীদাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এখন যদি কেউ সরকারি কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সতীদাহ করে তাহলে তার হাজতবাস অনিবার্য। তিনি দ্রুত লোকজন নিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলেন।

কিন্তু যে মেয়েটিকে নিয়ে এসেছিলেন জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করবেন বলে, তার এখন কী অবস্থা? একটু আগে মৃত্যু ভয়ে কাঁপছিল সে। এখন হঠাৎ জীবনের জয় গান শুনতে পেল। ব্যাপারটা তার কাছে অভাবিত। এরা কারা? এরা কি আমার সতীত্ব নষ্ট করতে এসেছে?

মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে গেছে। সালঙ্করা এবং রূপবতী। দেখলেই বোঝা যায় কোনো বড়ো ঘরের কন্যা। আহা, কদিনই বা বিয়ে হয়েছে? হয়তো বয়েসে অনেক বড়ো কোনো এক কুলীনের সাথে। লালন চোখের জল মুছল। সহসা সে অশ্রুপাত করে না। কিন্তু যখন চোখের সামনে এইসব দৃশ্য দেখে, তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না।

ভোলা জিজ্ঞাসা করল—সাঁইজী, এই মেয়েটিকে কোথায় নিয়ে যাব?

লালন বলল—সেসব কথা পরে ভাবতে হবে। মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে গেছে, এখন তাড়াতাড়ি এর চোখে মুখে জল দে। কোনোরকমে একে নৌকাতে নিয়ে গিয়ে তোল। মোহিনীকে ডেকে পাঠা। এই মেয়েটির দায়িত্ব মোহিনীকেই নিতে হবে।

নৌকো এগিয়ে চলল। কিছুক্ষণ বাদে মেয়েটিকে ধরাধরি করে আখড়াতে নিয়ে আসা হল। মোহিনীর সেবা শুশ্রূষায় চোখ মেলে তাকাল সে। তখনও কেমন উন্মাদিনীর মতো আচরণ করছে। বার বার বুক চাপড়াচ্ছে। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না, বেঁচে আছে। চিৎকার করে কাঁদছে। লালনের চারপাশে বসে থাকা ওই কিম্ভূত দর্শন বাউলদের দেখে ভয়ে আর্তনাদ করছে। মোহিনী তাকে বারবার সান্ত্বনা দিচ্ছে।

মোহিনী বলল—দিদি তুমি কাঁদছ কেন? চেয়ে দেখ আমরা সবাই তোমার বন্ধু। তুমি এখানে যতদিন খুশি থাকতে পারো আবার ইচ্ছে হলে তোমার গাঁয়ে ফিরতে পারো। সেসব কথা পরে আলোচনা হবে। তুমি ক্লান্ত। চল, আমার ঘরে, বিশ্রাম নেবে।

এবার বোধহয় মেয়েটা সাহস ফিরে পেয়েছে। মোহিনী তাকে ধীরে ধীরে তার ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। সমস্ত রাত হয়তো তাকে জেগে কাটাতে হবে। মৃত্যুর মুখ থেকে উঠে আসা এই মেয়েটিকে সান্ত্বনা দিতে হবে। এসব কাজ করতে মোহিনী খুবই ভালোবাসে। এখন মনটাকে অনেক শান্ত করেছে সে। সে ভেবেছে, এ হয়তো বিধির বিধান। ভগবান কাকে দিয়ে কোন কাজ করাতে চায় আমরা তার খবর রাখি না। আমাকে বোধহয় সেবিকা হয়েই সারাজীবন কাটাতে হবে।

পরদিন সকালে মেয়েটির আসল পরিচয় জানা গেল। জিকরদ গ্রামের মিত্র বংশের মেয়ে। তার নাম মীরা। ছবছর আগে তার বিয়ে হয়েছিল দিগম্বর মিত্রের সঙ্গে। দিগম্বর মিত্র এক সম্ভ্রান্ত কুলীন। অনেক জমিজমার মালিক। মীরা তার ষোলো নম্বর স্ত্রী। বছর ছয়েকের দাম্পত্য জীবন। তারপর নিভে গেল প্রদীপ। অষ্টাদশী মীরাকে আজ বিধবা হতে হয়েছে। ঢাকঢোল বাজিয়ে তাকে চিতায় তোলার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মীরা বার বার নিজের ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছে। কপালে আঘাত করছে। সে বলছে—তোমরা আমাকে বাঁচালে কেন? আমি তো একটা নষ্টা মেয়েছেলে হয়ে গেলাম। তোমাদের হাতে পড়েছি সমাজ আমাকে গ্রহণ করবে না। কিন্তু এখানে থাকব কী করে? এখানে কী কোনো ভদ্রঘরের মেয়ে থাকতে পারে?

মীরার কথার মধ্যে যুক্তি আছে। সহসা লালনের মনে হল, তারা ফকির মানুষ, এই ঝামেলায় না জড়ালেই বোধহয় ভালো হত। কেউ কেউ আবার অন্য কথা বলছে। তারা বলছে, ওই পাষন্ড পন্ডিতের দল সহজে ছাড়বে না। গ্রামে কানাঘুষো শুরু হয়ে গেছে। লালন নাকি দুশ্চরিত্র মাতালদের নিয়ে মদের আখড়া খুলেছে। এখানে সস্তায় মেয়েমানুষ পাওয়া যায়। তার ওপর এই আচরণ, ওরা যদি সরকারি পেয়াদা ডেকে আনে? তাহলে কী হবে?

মোহিনী বলল—শোনো বোন, তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি আমাদের মধ্যে থাকতে পারো। কেউ তোমায় সামান্যতম বিরক্ত করবে না। আমি কথা দিচ্ছি, আমি দিদির মতো তোমার দেখভাল করব।

শেষ অব্দি এই প্রস্তাবে রাজি হতেই হল বেচারী মীরাকে। সমস্ত গয়না সে তুলে দিল লালনের হাতে। লালন হেসে বলল—শোনো, আমি সামান্য ফকির পথে—প্রান্তরে ঘুরে বেড়াই। এত গয়না নিয়ে আমি কী করব? যদি ইচ্ছে হয়, তুমি মোহিনীর কাছে রেখে দাও, যখন চাইবে তখন ফেরত পাবে।

তখন থেকে মীরা এই আখড়ার একজন হয়ে গেছে। মোহিনীর ভারি সুবিধা হয়েছে। সব কাজে মীরা হাত লাগাচ্ছে। মেয়েটি সুন্দর স্বভাবের। যৌবনের উৎফুল্ল আনন্দে ডগমগ। সে আসার পর আখড়ায় নতুন করে প্রাণের সঞ্চারণ ঘটে গেছে। মোহিনী আর মীরা মিলে সব কাজ পরিপাটি ভাবে শেষ করতে পারছে।

পনেরো

—আমার নাম কাঙাল হরিনাথ। আমি একটা পত্রিকা প্রকাশ করে থাকি। গ্রামবার্তা। আপনার গান শুনেছি, আপনার গানের মধ্যে অধ্যাত্মচেতনার যে কথা আছে তা শুনে ভারি অবাক লেগেছে। তাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।

একটু থামল কাঙাল হরিনাথ। ভালোভাবে দেখল লালনকে। অবাক হল সে। এই অরণ্যপ্রান্তরে এমন স্বর্গকানন কে রচনা করেছে? কে মুখে মুখে এমন গান বাঁধতে পারে, যার মধ্যে তীব্র জীবন দর্শন লুকিয়ে আছে? কে সেই মানুষ? অনেক দিন ধরেই কাঙাল হরিনাথের মনে এইসব প্রশ্নের উতরোল। দারুণ ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, সে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কথা প্রকাশ করবে তার পত্রিকার মাধ্যমে। এই কাজ করতে গিয়ে অনেক ঝঞ্ঝাটের সামনে তাকে দাঁড়াতে হয়েছে।

এমনকি কলকাতার দোর্দন্ডপ্রতাপ জমিদার ঠাকুরবংশের কর্তাব্যক্তিরা তার প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে। সে পত্রিকার পাতায় পাতায় নির্ভীক ভাবে প্রকাশ করেছে ঠাকুর জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনী। লালনের গান সম্পর্কে তার অনেকদিনের আগ্রহ। অনেক দিন ধরেই সে ভেবেছে একবার ছেঁউরিয়ার এই আখড়ায় চলে যাবে। তাছাড়া লোকমুখে শুনেছে, এখানে নাকি নানা অসামাজিক কাজকর্ম হয়। হরিনাথ সেসব কথা বিশ্বাস করে না। কিন্তু সত্যিই তেমন যদি কোনো ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে লালনকে রক্ষা করতে হবে। হরিনাথ জানে সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষরা কতখানি প্রতিহিংসাপরায়ণ। তারা অকারণে ষড়যন্ত্র করতে ভালোবাসে। লালন যে স্বাধীন মুক্তচিন্তার কথা বলছে, তাতে আঁতে ঘা লেগেছে ওই ব্রাহ্মণ আর মৌলবীদের। হয়ত হাত মিলিয়েছে তারা। হরিনাথের কানে সব খবরই পৌঁছে গেছে।

হরিনাথ বলল—আর ইনি হলেন মীর মশাররফ হোসেন, এক তরুণ সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। ইনিও আপনার গান সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।

লালন অবাক হয়ে গেছে। দু-দুজন ভদ্রপোশাক পরা শহুরে মানুষে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন? এ কী কম সৌভাগ্যের কথা। সে শশব্যস্ত হয়ে উঠল। বলল—আপনাদের মত লোকদের আমি বসাই কোথায়? ভোলা শীতল, তোরা শীতলপাটির ব্যবস্থা কর। বাবুদের মুড়িবাতাসা খেতে দে। আজ দুপুরবেলা আমাদের সঙ্গে যদি খান, তাহলে আমাদের বড়ই ভালো লাগবে।

প্রথম দেখাতেই লালন ফকিরকে ভালো লেগে গেছে কাঙাল হরিনাথের। তিনি এমনই এক মানুষের সন্ধান করছিলেন। কথায় কথায় অনেক কথা হল। কাঙাল হরিনাথ বলল—লালন ফকির। এই যে জঙ্গলের মধ্যে আপনি ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছেন এর জন্য জমিদারদের কর দিতে হবে।

একথা শুনে লালন অবাক হয়ে গেল। লালন লাজুক মুখে বলল—বাবু, এই বিরাট অরণ্য প্রান্তর, এই নদী আকাশ—সবই তো ঈশ্বরের সম্পত্তি। সেখানে আমি কাকে কর দেব?

মীর মশাররফ হোসেন এতক্ষণ সব কথা শুনছিলেন। সে মুচকি হেসে বলল—লালনসাহেব, আপনার হয়তো জানা নেই, সারা পৃথিবীর সব অরণ্য এখন বিকিয়ে গেছে। কিনে নিয়েছে বাবু জমিদারদের দল। উপযুক্ত কর না দিলে তারা যে কোনদিন লেঠেল পাঠিয়ে আপনাকে গ্রাম ছাড়া করবে। সে ভারি লজ্জায় বিষয় হবে। আচ্ছা আমি আর হরিনাথ ব্যাপারটা ফয়সালা করবো এখন।

হরিনাথ জানে, ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্কটা এখন তিক্ত হয়ে গেছে। তাহলে অন্য কারোর শরণাপন্ন হতেই হবে।

লালনের গানে দর্শনচিন্তার প্রকাশ দেখে হরিনাথ অবাক হয়ে গেল। কথা দিল একদিন এই আখড়ায় এসে সারারাত থাকবে। কিছুদিন বাদেই লালনের ভান্ডারা উৎসব। সেদিন আরও অনেক বাউল ফকিররা এই আখড়াতে আসবে। সমস্ত রাত ধরে গানের আসর বসবে। গুবগুবি বাজবে। শিষ্যশিষ্যরা সমস্বরে ধুয়া দেবে। হরিনাথ কথা দিল মীর মশারফের হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে আসবে এই ভান্ডারা উৎসবে। নিজের চোখে দেখবে, নিম্নবর্গীয় বাঙালিরা কীভাবে উৎসব আনন্দে মেতে থাকে। তথাকথিত ভদ্রসমাজ হয়তো এইসব উৎসবের মূল্যকে স্বীকার করে না। আতে কী? তাতে কি মনের আগুন নিভে যায়? আবেগের উচ্চারণ স্তব্ধ হয়? ঢাকা পড়ে যায় প্রণোদিত উন্মাদনা!

ষোলো

তখন মধ্যরাত। ছলছলাত শব্দে বয়ে চলেছে শীর্ণা তটিনী। চাঁদ এক স্বপ্নীল মায়াবী আলো ছড়াচ্ছে চারপাশে। মোহিনী আর লালন মুখোমুখি বসে আছে। মোহিনীকে দেখে এক অদ্ভুত মায়া জাগছে লালনের মনে। আহা, সে রাতে মিলনোন্মুখ এই মেয়েটিকে আমি বড্ড ব্যথা দিয়েছি। আজ সমস্ত ব্যথা আমি ধুইয়ে দেব। আজ আমি অন্তত একবারের জন্য সত্যিকারের পুরুষ হব। নাহ, মোহিনীকে আমি আমার সাধনসঙ্গিনী করতে পারব না। কেন জানিনা তাকে দেখে আমার মনের মধ্যে কোথাও বাসনার উদগীরণ হয় না। মনে হয় মেয়েটি বড়ো অসহায়া। তাকে দেখে করুণা করতে ইচ্ছে করে, ভালোবাসতে সাধ জাগে কিন্তু সে হবে আমার লীলাসঙ্গিনী। তা কেমন করে সম্ভব!

কেউ কোনো কথা বলছে না। বিরাজ করছে বিচিত্র নীরবতা। বেশ কিছুক্ষণ বাদে এই নৈঃশব্দ্য ভাঙল মোহিনী। সে বলল—সাঁইজী, একটা অনুরোধ করব, রাখবে?

অবাক হয়ে তার চোখের দিকে তাকাল সাঁইজী। কী আশ্চর্য, সেই চোখ থেকে এখন আর কৌতুক কণার দ্যূতি চোখে পড়ে না। চোখ দুটি বুঝি নিষ্পন্দ পাথর হয়ে গেছে।

লালন প্রশ্ন করল—বলো, কী তোমার অনুরোধ? যদি অসাধ্য না হয় তাহলে আমি রাখব।

লালনকে অবাক করে দিয়ে মোহিনী বলল—তুমি মীরাকে তোমার সাধনসঙ্গিনী কর। এটাই আমার অনুরোধ!

লালন বুঝতে পারল, কতটা দুঃখ জ্বালা যন্ত্রণায় মোহিনী এই কথা বলছে। সে আর একটু কাছে এসে বলল। সহসা কী যেন ঘটে গেল তার মনের মধ্যে। এতদিন ধরে সে নিজেকে নিস্পৃহ রেখেছিল। আজ মোহিনীকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। আহা, চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, তোমরা ভেবে করবে কী? চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল তার সমস্ত শরীর।

মোহিনী এই অভাবিত আচরণে অবাক হয়ে গেছে। ভারি তৃপ্তির নেশা লেগেছে তার চোখের তারায়। সে বলল—না ঠাকুর, এখানে এইভাবে নয়, চলো তোমার ঘরে যাই।

লালন বলল—না মোহিনী, তোমাকে আদর করতে হয় নীল আকাশের নীচে। ঘাসের জাজিমে। তুমি আমার সেই অচিন পাখি যার সন্ধানে আমার জীবনের প্রতিটি প্রহর কেটে যাবে। তবু মোহিনী আমি কখনো তোমার মনের তল পাব না। চলো, আমরা অরণ্য অভিসারে বেরিয়ে যাই। এই আমার হাতে হাত রাখো। ভয় নেই, তোমার লালন কখনো তোমাকে বিপদের মুখে ঠেলে পালাবে না?

সে এক অলৌকিক পদযাত্রা। এক নারী এবং এক পুরুষ। দুজনে হাঁটছে পাশাপাশি। শরীরে শরীর মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রার্থিত উষ্ণতার সন্ধানে তারা মত্ত হয়েছে এখন। পায়ে পায়ে পৌঁছে গেল ঘাসের শয্যায়। চারপাশে আকাশচুম্বী গাছ রচনা করেছে চক্রব্যূহ। তারই মধ্যে ঢুকে পড়ল মোহিনী আর লালন। আকাশের নিলাজ চাঁদ অবাক চোখে দেখল সবকিছু। শেষঅব্দি নির্গত জলধারায় সিক্তা হল মোহিনী। তার এতদিনের পাপ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে গেল। সে নিষ্ক্রিয় হয়ে শুয়েছিল লালনের পাশে। মুহূর্তের জন্য নিজেকে উদ্বেলিত করেনি। অথচ এই মিলন প্রহরটির জন্য কতদিন ধরে সে ছিল প্রতীক্ষিতা। আর আজ এই পরিপূর্ণতার দিনে এমন নিস্পৃহ থাকল কেন? সে ভাবল। আরও একবার কি সে তার মনের মানুষকে নিজের করে পাবে?

লালন বলল—মোহিনী, তোমার সাথে আর কখনো মিলিত হব না আমি। জানো তো দ্বিতীয় মিলনে আসে বিবর্ণতা। দ্বিতীয় মিলন এক ধারাবাহিকতা। তুমি আমার কাছে স্বর্গের এক দেবী হয়েই বিরাজ করবে। তোমার শরীর বুঝি পদ্মপাতার জল। টলমল করছে। সামান্য আঘাতে কোথায় বুঝি হারিয়ে যাবে। তুমি আমাকে ক্ষমা করো মোহিনী!

মোহিনী বুঝতে পারছে, লালন তাকে কতখানি ভালোবাসে। তখন সহসা ঘর বাঁধার সাধ হল তার। নাহ, এই জঙ্গল আবাস আর ভালো লাগছে না।

লালনকে বলল—সাঁই, এসব ফকিরি ধর্ম তুমি ছেড়ে দাও। চল, তোমাতে আমাতে এমন দেশে চলে যাই, যেখানে আইনের শাসন নেই, ধর্মের গন্ডি নেই। তুমি কি আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধতে পারো না?

সিরাজ সাঁইয়ের মুখখানি মনে পড়ে গেল লালনের। সিরাজ বলত, আগে নারীর বন্ধন ছিন্ন কর ব্যাটা, তবেই তুই আসল ফকির হতে পারবি।

সেই মধ্যরাত, মাঝেমধ্যে রাতপাখির চিৎকার, মোহিনীর চোখের তারা থেকে ঝরে পড়া আকণ্ঠ আকুতি, লালন কেমন যেন হয়ে গেল। একটি ঘর বাঁধতে বড়ো সাধ হল তার। আহা, দোলনায় দোল খাবে ছোট্ট ছেলে, আমি আর আমার স্ত্রী, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যত আমি মাটি কোপাব, বীজ বপন করব, সোনালী শস্য গোলাজাত করব। তারপর? ক্লান্ত শ্রান্ত আমি ফিরে আসব আমার ঘরের আঙিনায়। আমার মোহিনী সুন্দরী আমার পরিচর্যা করবে। সারারাত আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকব। চোখে চোখ, হাতে হাত, হৃদয়ে হৃদয়—

পরক্ষণেই অন্যতর অনুভূতি, চিৎকার করে উঠল লালন—মোহিনী, তুই আমার চোখের সামনে থেকে দূরে চলে যা। তুই এক সর্বনাশী ডাকিনী রাক্ষসী। তুই কেন আমার সাধনপথে এসে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিস? না না, তোকে আমি আর কখনো কাছে ডাকব না।

মোহিনী জানে, এ এক অসহায় মানুষের আর্তনাদ। আগে হলে সে হয়তো ছুটে চলে যেত। কিন্তু এখন এই মধ্যরাতে, অরণ্যের অভ্যন্তরে, লালনকে একলা রেখে সে কোথাও যাবেনা। সে এসে লালনের মাথায় হাত দিল। চুলগুলো বিন্যস্ত করার চেষ্টা করল। তারপর বলল—সাঁই, তুমি নিজেকে এত ভয় পাও? তাহলে সত্যিকারের ফকির হবে কী করে?

সতেরো

লালনের ভান্ডারা। অনেক মানুষ সকাল থেকে ভিড় করেছে। শিষ্যরা একটি তুলসিমঞ্চকে কেন্দ্র করে আসরের ব্যবস্থা করেছে। সেই আসরে এসেছে কাঙাল হরিনাথ। সঙ্গে মীর মশাররফ হোসেন। দু-চারজন উৎসাহী শ্রোতাও এসেছে।

সবকিছু লক্ষ্য করে কাঙাল হরিনাথ অবাক হয়ে গেল। সে বলল—এই গাঁয়ে তো আপনার অনেক অনুরাগী। এরা সকলেই বাউল গানের ভক্ত তো?

একটু হেসে লালন বলল—সবাই কী আর ভক্ত হয়? তামাশা দেখতে এসে অনেকে মিশে যায়। এইতো গানের খেলা বাবু। আগে আমরা শুরু করি। লোকমুখে শুনেছি আপনি নাকি গান বাঁধতে পারেন। আপনাকে কিন্তু আজ ছাড়ছি না।

সলাজ হাসি হেসে কাঙাল হরিনাথ বলল—ওই একটু আধটু আর কী। সবই গুরুর কৃপা। আগে আপনাদের গান শুনি, তারপর না-হয় দু-একটা গেয়ে শোনাব।

একতারা বাজিয়ে লালন গান ধরল—

 হিরে মন জহুরা কাটি ময়।

 যে চাঁদ লক্ষ যোজন দূরে রয়।

 যে চাঁদ পাতালে

 উদয় ব্রহ্মতলে,

 যে চাঁদ মৃণাল ধরে

 উজান গায়।

সকলে বলল—সাধু সাধু।

এবার লালনের শিষ্য ভোলা শা গান গাইবে। ভোলার গলাটি ভারি পরিষ্কার। কিন্তু ভোলা এক অমনোযোগী ছাত্র। কখনো কোনো আসরে গান গাইতে চায় না। লালনের বকাঝকায় ভোলা গেয়ে উঠল—

 মধুর দিলদরিয়ায় যে জন ডুবেছে

 যে না সব খবরের জবর জেনেছে।

 পর্বতের উপরে গঙ্গা

 জলের ভিতরে ডাঙা

 ডুবে দ্যাখ না একবার ডুবে দ্যাখনা

 ভুবনে ডাঙ্গা পাই

 উঠিলে ভেসে যাই

 বিষয় তরঙ্গে বড় তুফান রে …

আসর জমে উঠেছে। সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে। জ্বলে উঠেছে অনেকগুলি প্রদীপশিখা। ম্লান আলোয় উদ্ভাস চারপাশ। কাঙাল হরিনাথ সারাজীবন ধরে গ্রামবাংলায় ঘুরে বেড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট নিজের চোখে দেখেছে। অন্নের সংস্থান নেই, কিন্তু নিয়মিত পত্রিকাটি প্রকাশ করে থাকে। কাঙাল হরিনাথের অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল এমন একটি আখড়ায় রাত কাটাবে। এই স্মৃতিকে অমলিন রাখবে সারাজীবন।

মীর মশাররফ হোসেন ইতিমধ্যে উপন্যাস এবং গল্প লিখে বেশ নাম করেছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হচ্ছে। সেও কিন্তু আপনভোলা মানুষ। কী দরকার ছিল তার একটা পত্রিকা সম্পাদনা করার? কাঙাল হরিনাথের মত তারও মনোগত বাসনা সে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াবে। যেসব কথা কেউ কোনোদিন শুনতে পাবেনা, সেই কথা প্রকাশ করবে তার পত্রিকায়। কাঙাল হরিনাথকে মনে মনে ধন্যবাদ দিল মীর মশাররফ হোসেন। এমন বন্ধু না থাকলে সে এই ছেঁউরিয়াতে আসতে পারত কি? অনেক দিন ধরেই তার মনে সাধ, লালনের গান শুনবে। আজ সেই সাধ পূর্ণ হয়েছে।

সামান্য আহারের ব্যবস্থা। খেয়ে সকলেই পরিতৃপ্ত। কাঙাল হরিনাথের সঙ্গীসাথীরা নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। এমন সময় এক তীক্ষ্ন সুরেলা মহিলাকণ্ঠ শোনা গেল। সকলে সচকিত হয়ে উঠল। একী? মোহিনী আজ নিজেকে সম্পূর্ণ বাউলকন্যার বেশে সাজিয়েছে। গেরুয়া বসন পরেছে। ভারি সুগঠিত চেহারাটি তার। চোখ বন্ধ করে নেচে নেচে গাইছে—

 বিন্দে লো পায়ে ধরি,

 তুই একা কেন এলি?

 পায়ে ধরে সেধেছিলাম,

 তারে কোথা থুলি?

 বিলে লো তোর পায়ে ধরি,

 এনে দে আমায় বংশীধারী,

 মন-আগুনে পুড়ে মরি

 বরণ হলো কালি।

এই গান শুনে অনেকের চোখে জলের ধারা। অনেকে হরিধ্বনি দিল। কেউ আবার উন্মাদের মতো নাচতে শুরু করল। লালন বুঝেছে, ওদের মধ্যে ভাবাবেগ এসে গেছে। প্রতি বছর মচ্ছবের আসরে এমনটিই হয়ে থাকে। লালনের সঙ্গীসাথীরা চারদিকে নজর রেখেছে। কেউ যেন ভাবের ঘোরে বেলেল্লাপনা করে না বসে। শহরের বাবুরা এসেছেন। কত গণ্যমান্য মানুষ তাঁরা। তাঁরা এখানে সারারাত থাকবেন।

এবার বোধহয় কাঙাল হরিনাথের পালা। ফিকিরচাঁদ ছদ্মনামে সে বেশকিছু বাউল গান লিখে ফেলেছে। নিজেই সুর বসিয়েছে। তার বড়ো ইচ্ছে, সেও লালনের মত একটা বাউল গানের দল খুলবে। তবে ঠিকমত সময় পাচ্ছে না।

চোখ বন্ধ করে কাঙাল হরিনাথ গাইল—

 হরি দিনতো গেল সন্ধ্যা হল পার করো আমারে

 তুমি পারের কর্তা শুনে বার্তা, ডাকছি হে তোমারে

 আমি আগে এসে ঘাটে রইলাম বসে

 ওহে আমায় কি পার করবে না হে,

 আমি অধম বলে

 যারা পাছে এল, আগে গেল,

 আমি রইলাম পড়ে…

এমন সুন্দর সুর—লালন অবাক হয়ে যায়। একতারা আর খঞ্জনীর সুর স্পন্দিত হয় চারপাশে। বাতাসার লুট পড়ে। হরিনাথের কণ্ঠ থেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে লালন গান ধরল—

 পার করো হে দয়ালচাঁদ আমারে

 ক্ষম হে অপরাধ আমার ভব-কারাগারে

 না হলে তোমার কৃপা সাধন-সিদ্ধি

 কে করিতে পারে?

 আমি পাপী তাইতো ডাকি

 ভক্তি দাও মোর অন্তরে।

 পাপী তাপী জীব তোমার,

 না যদি কর হে পার

 দয়া প্রকাশ করে,

 পতিতপাবন পাতকনাশা

 বলবে কে আর তোমারে?

 জলে-স্থলে সব জায়গায়

 তোমার সব কীর্তিময়

 বিবিধ সংসারে

 না বুঝে অবোধ লালন

 পড়লো বিষম ঘোরতরে।

অনেকের মধ্যেই ভাবোন্মাদ অবস্থা। তারা নেচে নেচে চারপাশে পুরছে। এককোণে চুপ করে বসে আছে মোহিনী। জীবনের মস্ত বড় অগ্নি-পরীক্ষায় সে হয়ত আজ সফল হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে তার মনোগত বাসনা ছিল, সে গুরুর কাছে নাড়া বাঁধবে। গান শিখবে, দেহতত্ত্বের নিগূঢ় বিষয়গুলিকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করবে। অনেক সাধ্যসাধনার পর শেষপর্যন্ত লালন মত দিয়েছে, একি কম আনন্দের কথা।

এখন সে এক অনুগতা ছাত্রী। লালনের পায়ের তলায় বসে গান শেখে। সুর আর ভাবের খেলায় মেতে ওঠে। কখনো কখনো সেখানে এসে বসে ওই মীরা। তার গলাটিও ভারি চমৎকার। সেও হয়ত একদিন আসরে এসে গান গাইবে। এমন ভাবেই তো লালন গানের পর পরম্পরা বেঁচে থাকবে।

যখন লালন চোখ বন্ধ করে গান শেখায়, তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে মোহিনী। সেই অলৌকিক রাতের কথা বারবার মনে পড়ে যায় তার। কিন্তু সে জানে, লালন আর কখনো তাকে এইভাবে শরীর দেবে না। যে ঘটনাটা একবার ঘটে গেছে, তাকে মনের মধ্যে গেঁথে রাখতে হবে। সারা জীবন—মৃত্যুর প্রাক-মুহূর্ত পর্যন্ত। তাতেই পরিতৃপ্তা মোহিনী, জীবনে অন্তত একবার সে সত্যিকারের পুরুষের সাহচর্য চেয়েছিল। তার জীবনটা শুধু দুঃখে ভরা। শেষ অব্দি সেই স্বপ্ন তার সফল হয়েছে এখন সে খুশি। সে জানে, বেশি লোভ করা কখনোই উচিত নয়।

একটির পর গান, সকলের সমবেত ধুয়া, অন্ধকার নামছে ছেঁউরিয়ার এই আখড়াতে। শহুরে মানুষজন ঘুমে অচেতন। গ্রাম্যমানুষের চোখেও ঘুম নেমেছে। কিন্তু জেগে আছে লালন ফকির আর তার শিষ্যশিষ্যাদের দল। বছরে এমন বাঁধনহারা উৎসবের মুহূর্ত তো বেশি আসে না। এবছর শেষ হলে আবার আগামী বছর। কে বেঁচে থাকবে, কে স্বর্গ কিংবা বেহেস্তে চলে যাবে, কে জানে। যতক্ষণ জীবন আছে, প্রাণের ধুকপুকানি, দুহাত তুলে আনন্দ করো। ভগবানের চরণে সবকিছু সমর্পণ করো। মুরশিদ কিংবা গুরুর কথা চিন্তা করো।

তাইতো লালনপন্থীরা বল্গাহারা আনন্দে উন্মাদ হয়ে গেল। খঞ্জনি বাজিয়ে তারা সমবেত কণ্ঠস্বরে গাইতে লাগল—

মুরশিদ আমায় ফেলোনা, চরণ দিতে ভুলোনা।

আমি পদে পদে অপরাধীগো,

আমার বাদী রিপু ছয়জনা

এমন করেই সারারাত কেটে গেল। চাঁদ গেল অস্তাচলে। এবার পাখির দল ডাকতে শুরু করেছে। এমন অলৌকিক রাত, বনবাসরে, হরিনাথ ভাবতে পারেনি। তার মন আজ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এবার যাবার পালা। প্রায় সমস্ত রাত জেগেছে সে। তবু তার শরীরে কোথাও এতটুকু ক্লান্তি জেগে নেই। ভারি পরিতৃপ্ত হয়েছে সে। এবং মীর মশাররফ হোসেন-বাড়ি গিয়ে নতুন একটি উপন্যাসের খসড়া তৈরি করতে হবে। গ্রামবাংলার লোকসংগীত, নিম্নবর্গের এইসব মানুষরা সেই ধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এটাই হল বাংলার সংস্কৃতির আসল প্রাণপ্রবাহ। কিন্তু আমরা এই সংস্কৃতির কথা তুলে ধরতে চাই না। চোয়াল শক্ত হল কাঙাল হরিনাথের। শপথ নিল সে, আজ থেকে তাকে আরও বেশি অনুসন্ধিৎসু হতে হবে। গ্রামবাংলায় ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে কোথায় কত দুর্দশা লুকিয়ে আছে। সাহসের সঙ্গে সেইসব প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে তার পত্রিকায়। তার জন্য যদি রাজরোষ নেমে আসে তার কোনো দুঃখ নেই। খবর শোনা যাচ্ছে জমিদাররা নাকি তার এই উদ্ধত আচরণে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। যে কোনো সময় তার ওপর শারীরিক আক্রমণ হতে পারে।

—একটা কাজের কথা বলা হয়নি, হরিনাথ বলল, লালন তোমার গুপ্ত শত্রুর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তুমি যে হিন্দু আর মুসলমান ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতি আনতে চাইছ পন্ডিত আর মৌলবীরা তা হতে দেবে কেন? তাই বলি কী আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করো।

অবাক হয়ে কাঙালটা হরিনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে লালন বলল— আত্মরক্ষা। করব কী করে? আমরা তো কৌপীনধারী সন্ন্যাসী, আমাদের না আছে ঢাল, না আছে তলোয়ার। বাবু আপনি বলে দিন।

কাঙাল হরিনাথ বলল—কেন তোমার দলে জোয়ান তাগড়া ছেলেদের তো দেখতে পাচ্ছি। ওদের লাঠি খেলায় শিক্ষা দাও। রণপা চড়ে বন পাহারা দাও। আমি ব্যাপার স্যাপার ভালো বুঝছি না। তোমরা চিতা থেকে সোমত্থ মেয়েটাকে তুলে এনেছ। মৌলবী আর পন্ডিতরা ঘোঁট পাকাচ্ছে—যে কোনো সময় তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

এই কথাগুলি শোনা মাত্র লালনের সমস্ত শরীর শিহরিত হয়ে উঠল। সে হাঁক দিল—ভোলা, হাঁক দিল শীতল। ওরা আসতেই কর্তব্যটা বুঝিয়ে দিল। এবার লাঠি খেলার অনুশীলন শুরু করতে হবে।

লালন হেসে বলল—এরপর যখন আসবেন তখন ওই লেঠেল আর রণপা চড়া লোকেরাই আপনাকে স্বাগত জানাবে— এই আমি কথা দিচ্ছি, বাবু।

নৌকো ঘাটে লাগানো ছিল। সকলে চলে গেল। কাল সারারাত এখানে মহোৎসবের আসর বসেছিল। এখন এই মধ্যদিনে নেমেছে নিঝুম ক্লান্তি। আখড়া থেকে একটু দূরে, নদীর খেয়াঘাটে লালন একা একা বসে আছে। না এখন আর একতারাটা সঙ্গে নেই তার। সে জানে, সংগীতহারা হলে সে বাঁচবে না। আজ হঠাৎ ফেলে আসা দিনযাপনের কথা মনে পড়ে গেল লালনের। আর তখনই মনের আয়নাতে আর তখনই ভেসে উঠল চম্পার টলটলে মুখখানি। সহসা ভাবল লালন, চম্পা কি বেঁচে আছে?

আঠারো

আঘাতটা অভাবিত, হয়ত কিছুটা প্রত্যাশিত। ছোট্ট ঘরে বসে কাঙাল হরিনাথ আপনমনে পত্রিকার কাজ দেখাছিল। গত কদিন দারণ খাটাখাটনি গেছে তার। এখানে সেখানে ছুটে অনেক লোভনীয় সংবাদ সংগ্রহ করেছে। বিশেষ করে ঠাকুর পরিবারের অত্যাচারের কাহিনী। যেসব প্রজাদের ঠাকুরের নায়েবরা উচ্ছেদ করেছে তাদের বিবরণ, আগুন—আখরে লেখা। দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক শুভানুধ্যায়ী বারণ করেছে। বলেছে—কাঙাল, তোর পকেটে পয়সা নেই। তুই কেন জমিদারবাবুদের পেছনে লাগছিল? ওদের কত পোষা গুন্ডা আছে জানিস? এমনটি করলে তোর প্রাণ চলে যাবে।

কাঙাল হরিনাথ হাসতে হাসতে বলেছে—বাবুমশাই, জন্মালে মরতে হবে, এতো বিধির বিধান। তাবলে আমি কাপুরুষের মত গর্তে মুখ ঢুকিয়ে বসে থাকব? তা কখনো হবে না। ভগবান আমাকে বুদ্ধি দিয়েছেন, হাতে কলম দিয়েছেন, অন্তরে ভাব-আবেগ দিয়েছেন, আমি কি মানুষের সেবা করব না?

অকাট্য যুক্তি। সকলে বুঝেছে এবার আর কাঙাল হরিনাথের রক্ষা নেই। এবার হয়ত তাকে মরতে হবে।

রে-রে করে ওরা ছুটে এল, কাঙাল হরিনাথ অবাক হয়ে দেখল, একদল লেঠেল, তেল চকচকে গা, পাকানো মোচ, চপচপে তেলে মাখা লাঠি। তারা হুঙ্কার দিচ্ছে। এখনই কাঙালকে বেঁধে জমিদারবাবুর কাছে নিয়ে যাবে। জমিদার নাকি কাছারি বাড়িতে অপেক্ষা করছেন।

কাঙাল আর কী করবে? বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ! এছাড়া আর কোনো কিছুই করতে পারবে না সে। ধরা দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এমন সময় সেখানে আর একটি ঘটনা ঘটে গেল।

আর একদল লেঠেল রে রে করে তেড়ে এসেছে। তারা কোথা থেকে এল কাঙাল কিছু বুঝতে পারছে না। দুই দল লাঠিয়ালের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে। কার লাঠির আঘাত করে ঘাড়ে পড়ছে, যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে কে মাটিতে শুয়ে পড়ছে। কার পিঠে আঘাত, কার কপাল থেকে রক্তের ক্ষীণ রেখা।

কাঙালের আঙিনা তখন হিংসার উন্মাদনায় কাঁপছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে কাঙাল দুপক্ষকেই শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? এরা বোধহয় আজ পৌরুষের সব থেকে বড় পরীক্ষা দেবে। একদল ফুঁসছে, অন্যদল চিৎকার করছে। একদল বাছাবাছা কিছু শব্দ উচ্চারণ করছে। অন্যদল দ্বিগুণ উৎসাহে গালাগাল দিচ্ছে।

অনেকক্ষণ চলেছিল এই লাঠির লড়াই। শেষ পর্যন্ত যারা আগে এসেছিল তারা রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হল। আসলে বিরুদ্ধ পক্ষরা অনেক বেশি শক্তিশালী। যাবার সময় তারা অভিশাপ দিল। বলল—জমিদারের কাছে সব নালিশ করা হবে। ভিটেমাটি চাটি করা হবে কাঙাল হরিনাথের। দেখি ও ব্যাটা সাংবাদিকের কত সাহস, আমাদের বাবুর পেছনে লেগেছে, ঈশ্বর ওকে ক্ষমা করবে না।

হরিনাথ নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বসেছিল। সবকিছু মিটে যাবার পর সে উঠে এল। তাকে কেন্দ্র করে এতবড় লড়াই অথচ তার হাবভাবে উত্তেজনার কোনো ছাপ নেই। অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের মানুষ সে। সে জানে, স্থৈর্য আর ধৈর্য না থাকলে জীবনের কোনো যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না। শুধু একটি বিষয়ে তার অসীম কৌতুহল তা হল, কোথা থেকে এল এইসব লেঠেলরা, এরা না থাকলে আজ হয়ত সে প্রাণে বেঁচে থাকত না। সবই কি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের করুণা? হরিনাথ বাস্তববাদী। যুক্তিতর্কের ধার ধারে। সে জানে, এর অন্তরালে নিশ্চয়ই একটা রহস্য আছে। কেউ হয়ত তাকে রক্ষা করতে চায়। কিন্তু কে?

গ্রামের সকলের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। কায়েমি স্বার্থকে সে আঘাত করেছে। মৌলবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এমন মানুষের শত্রু তো থাকবেই, সেটাই স্বাভাবিক।

সে ধীরে ধীরে লেঠেলদের সর্দারের কাছে এগিয়ে গেল। লেঠেল সর্দার বলল—বাবু, একটু সাবধানে থাকবেন। তবে ভয় নেই, এরা দুজন আজ থেকে আপনাকে পাহারা দেবে।

দুটো ষন্ডামার্কা ছেলেকে দেখাল লেঠেল সর্দার। ঘটনা পরম্পরায় হরিনাথ আরও অবাক হয়ে গেছে। সে শুধাল—তোমাদের কে পাঠাল। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

কুর্নিশ করে লেঠেলসর্দার বলল—লালন ফকির!

ঊনিশ

—সাঁই, একটা কথা বলব, আলতো সুরে বলল মোহিনী।

সাঁই তখন সবেমাত্র তার সন্ধ্যাভজন শুরু করেছে। তার ভজন মানে শুধুই গান আর গান। নতুন একটা সুর ভাঁজছে সে কদিন ধরে। ঠিক জুতসই হচ্ছে না। শব্দগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সাঁইয়ের মনে হচ্ছে, এবার বোধহয় তাকে ছুটি নিতে হবে এই বিশাল পৃথিবী থেকে। কিন্তু অনেক কাজ বাকি থেকে গেছে। আরও অনেককিছু করতে হবে। স্মৃতির পাতা এলোমেলো।

সাঁই বলল—বলো, কী বলতে চাও।

লালন লক্ষ্য করেছে, ইদানিং মোহিনী তাকে এড়িয়ে চলতে ভালোবাসে। নেহাত সৎসাবের সব দায়দায়িত্ব তার মাথার ওপর চাপানো আছে, তাই দু-চারটে কেজো কথা বলতে হয়। কিন্তু সেই কথার মধ্যে আবেগ মৃত, অভিমান নিরুদ্দেশ।

এর কারণ কী? লালন জানে, সে-ই মোহিনীকে দূর থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। মোহিনীর মধ্যে একটা ছাই চাপা আগুন আঁচ দেখা যায়। প্রচন্ড দহনজ্বালা। লালন অনুভব করে তার যৌবনের দীপ্তি। একা একা আর কতদিন সে এইভাবে বসে থাকবে? অচিন দরিয়ায় নৌকো ভাসিয়ে?

মোহিনী বলল—আমি বলি কী, তোমার তো বয়স হচ্ছে। আমার মাথায় সংসারের বোঝা চাপানো আছে। কতজনের পাত পড়ে বলো তো? আমি কি তোমার দেখাশোনা করতে পারি?

লালন জানে, এ হল অভিমানের কথা। এর অন্তরালে কোথায় একটা দুঃখ দুঃখ মনোভাব লুকিয়ে আছে। মোহিনী তার সাহচর্য চায়। চায় আর একটু প্রশ্রয়। কিন্তু লালন এখন একেবারে নির্বিকার হয়ে গেছে। সে জানে, সাধনমার্গের কঠিন স্তর অতিক্রম করতে হলে নিয়মিত নারীসঙ্গ দরকার। কিন্তু মোহিনীকে কখনোই সে তার সাধনসঙ্গিনী হিসাবে ভাবতে পারে না। মোহিনী অনেকটা তার সখীর মতো।

—আমি বলি কী, তুমি মীরাকে নাও, মীরা বড়ো অসহায়। ও তোমার দেখাশোনাও করবে। তোমার সাধনসঙ্গিনীও হতে পারবে।

ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। মোহিনী একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলল। লালন হো হো করে হাসল। সেই হাসির মাধ্যমে সব অনিশ্চয়তার কালো মেঘ আরও দূরে উড়িয়ে দিল। হাসতে হাসতে বলল—এটাই কি তোমার মনোগত বাসনা? বলো, বলো মোহিনী, তুমিতো কখনও মিথ্যে কথা বলো না। নাকি এভাবেই ইচ্ছে করে আমার থেকে আরও দূরে চলে যেতে চাইছ? লালনকে তুমি অত সহজে বোকা বানাতে পারবে না।

ইঙ্গিতটা সুস্পষ্ট। এ কেমন মানুষ তুমি? মোহিনী মনে মনে ভাবে। আমার খাঁচায় ধরাও দেবে না আবার অন্য খাঁচায় বসবে না। তুমি কি সত্যি মানুষ, নাকি দেবতা? নাকি অমানুষ? আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তোমার মধ্যে পৌরুষের একটা দারুণ শক্তি আছে। চোখ বন্ধ করলে মোহিনী সেই অরণ্য অভিসারের কথা ভেবে নেয়। সত্যিই তো, লালন সব অর্থে যথার্থ পুরুষ, কিন্তু নারীসঙ্গে তার তীব্র অনীহা কেন? তবে কি মন থেকে সে তার স্ত্রীকে মুছে ফেলতে পারেনি? যখনই কোনো নারী তার চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়, সে ভাবে, বুঝি চম্পা এসেছে। এই নারীর মুখ আর চম্পার মুখ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তাই হয়তো লালনের ব্যবহারে এত অসঙ্গতি ধরা পড়ে।

—আচ্ছা, তুমি যখন বলছ, দিও পাঠিয়ে। দেখব মেয়েটা কেমন। আমার তেজ সহ্য করতে পারবে তো?

ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, মোহিনী বুঝতে পারে। মোহিনী মাথা নীচু করে বলে, সবাই কি আমার মতো নির্লজ্জ বেহায়া? তবে মেয়েটা মন্দ নয়। চালাক চতুর, শিখিয়ে পরিয়ে নিলে তোমার কজে লাগবে। তাছাড়া—

কী যেন বলতে গিয়ে থেমে যায় মোহিনী। লালন বলে—বলো, কী বলতে চাও। আমার কাছে কোনো সঙ্কোচ করো না।

—মেয়েটির গানের গলা ভারি চমৎকার। ছোটো থেকেই গান শিখেছে। কী দুর্ভাগ্য, আট বছর বয়স হতে না হতেই ওকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। কবে যে গ্রামবাংলার মেয়েগুলো সত্যিকারের মুক্তি পাবে!

আর একটি দীর্ঘশ্বাস—নিজের জন্য নয়, সকলের জন্য, চেপে ফেলল মোহিনী।

লালন নিস্পৃহ কণ্ঠস্বরে বলল—ঠিক আছে। সন্ধ্যের আগে পাঠিয়ে দিও, কেমন? দেখব মেয়েটা সত্যি ভালো কিনা। তেমন হলে না হয়…

কথাটা শেষ করল না লালন। আশা নিরাশার মধ্যে মোহিনীকে রেখে দিল। তখনও কি মোহিনী ভাবছে, শেষ অব্দি লালন তাকেই ডাক দেবে? সেই ডাকে সাড়া দেবার জন্য সেতো উন্মুখ হয়ে বসেই আছে।

শেষ বিকেলের ক্লান্ত আলো গায়ে মেখে মীরা এসে ঢুকল লালনের আখড়াতে। লালন তখন জপে বসেছে। ঈশ্বরের নাম স্মরণ করছে। হাতে জপের মালা। চোখ দুটি বন্ধ। তাকে এই ভাবে বসে থাকতে দেখে মীরা একটু ভয় পেল। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার পর সে এমনই ভীতু হয়ে গেছে। অবশ্য সে কোনোদিনই সাহসী ছিল না। গ্রামবাংলার মেয়েরা যেমনটি হয়ে থাকে। এখনও প্রতি মুহূর্তে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে। ভগবানকে অভিশাপ দেয়। সত্যিইতো, তার জীবন নাটক কীভাবে চড়াই আর উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তবে ছেঁউরিয়ার এই আখড়াকে সে সত্যি ভালোবেসে ফেলেছে। প্রথম প্রথম তার মনের মধ্যে কেমন একটা বিরক্তিবোধের জন্ম হত। এই নোংরা অসভ্য লোকগুলো, চান করে না, কাপড় কাচে না, গব গব করে খায়। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। এদের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা নেই। দাম্পত্য জীবন নেই। সন্তান উৎপাদনের প্রচেষ্টা নেই। এই কি একটা জীবন নাকি?

এখন ধীরে ধীরে এই জীবনটাকেই ভালোবেসেছে অথবা ভালোবেসে ফেলতে বাধ্য হয়েছে মীরা। সে জানে, বাইরের পৃথিবীর মানুষ হিংসা আর লোভের জগতে বাস করে। সেখানে একজন অন্যজনের সুখ্যাতি করে না। পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব আর বিভীষিকা। তার থেকে এখানে সে অনেক ভালো আছে। অন্তত সমাজপতিদের গালাগাল তাকে শুনতে হচ্ছে না। স্বামীখেকো বিধবা বলে কেউ তাকে অভিশাপ দিচ্ছে না। জ্বলন্ত চিতায় তাকে পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র কোথাও লেখা নেই। এই লোকগুলো সহজ সরল মুখ্যুসুখ্যু। শহুরে সভ্যতার ধ্যানধারণা তাদের মধ্যে নেই একথা সত্যি, কিন্তু এরা খাঁটি মানুষ, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কদিন থেকেই মোহিনী তার কাছে এই প্রস্তাবটা পাড়ছে। এখানে থাকতে গেলে কারো না কারো সাধনসঙ্গিনী তো হতেই হবে। সবদিক দিয়ে বিচার বিবেচনা করলে লালন সাঁইয়ের মতো সঙ্গী পাওয়াটাই ভাগ্যের ব্যাপার। প্রথমদিকে মীরা এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তার মনে একটা ক্ষীণ আশা—সে হয়তো কোনোদিন সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে পারবে। কিন্তু কী ভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। হঠাৎ কেউ যদি সামনে এসে দাঁড়ায়? বাবা কিংবা বড়দা? তাকে বাড়িতে নিয়ে যায়? বিয়ের আগে যেমনটি সে থাকত? আবার সেই জীবন ফিরে পায়? না, এটা নেহাতই একটা কষ্টকল্পনা। যে মেয়ে চিতার আগুন থেকে উঠে এসেছে সে তো অশুদ্ধা, সে কুলটা, সংসারে তার প্রবেশ নিষেধ। তাকে সংসার সীমান্তে বাস করতে হবে। শরীর খাটিয়ে খেতে হবে। এটাই হল আমাদের চিরন্তন ধ্যানধারণা।

শেষপর্যন্ত মীরা ঠিক করল লালনকেই সে তার সঙ্গী হিসাবে বেছে নেবে। অবশ্য লালন যদি তাকে পছন্দ করে। কী গম্ভীর মানুষ। মাঝে মধ্যে চোখাচোখি হয় কিন্তু লালনের চোখ থেকে শুধুই ঝরে পড়ে আদেশ আর অনুশাসন। মীরাকে কি সে সহ্য করতে পারছে না? মীরা এখন সব কাজে মোহিনীকে সাহায্য করে। মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগে যায়। মোহিনী পাকা গিন্নি। এই আখড়ার সর্বময়ী কর্ত্রী। নবাগতা মীরাকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়বে না। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দুই নারীর খুনসুটি দেখতে দেখতে নিজের মনে হাসে লালন। সংসারের বাইরে এসেছে সে। ভেবেছিল মায়ার বন্ধন ছিন্ন করবে। কিন্তু এখানে আর এক মায়ার জগত। কোন সে তাঁতী অদৃশ্য সুতোর টানা আর পোড়েনে মায়াশাড়ি তৈরি করছে। এ সবই বোধহয় ঈশ্বরের মহিমা।

অনেকক্ষণ বাদে লালন চোখ দুটি খুলল। সেই মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বুঝি অন্য জগতের বাসিন্দা। এতক্ষণ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের দুয়ার বন্ধ রেখেছিল। শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি ছিল নিয়ন্ত্রিত। এবার লালন ভালোভাবে তাকাল মীরার মুখের দিকে। বলল—ছিঃ ছিঃ, তুমি কতক্ষণ বসে আছো? আমার ধ্যান ভাঙালে না কেন?

মাথা নীচু করে মীরা বলল—আমি অবাক হয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বিশ্বাস করুন, আপনি যখন চোখ বন্ধ করে জপ করছিলেন, তখন আমার কেবলই মনে হচ্ছিল আপনি বোধহয় এই পৃথিবীর মানুষ নন। আকাশ থেকে ছুটে আসা এক দেবদূত। বিশ্বাস করুন, আমি স্পষ্ট দেখেছি, আপনার শরীরের চারপাশে এক অপরূপ জ্যোতির্বলয়। এ আমায় কী রূপ দেখালেন আপনি, সাঁই? আপনি কি আমাকে গ্রহণ করবেন?

চিরন্তন প্রশ্ন। কত বছর আগে সরস্বতী নদীর তীরে একই প্রশ্ন করেছিলেন যাজ্ঞবল্ক্যের স্ত্রী মৈত্রেয়ী। বলেছিলেন, আমি কি বেদপাঠ করতে পারি না? আমার কি শাস্ত্রচর্চায় অধিকার নেই?

কী উত্তর দিয়েছিলেন যাজ্ঞবল্ক্য? পুরাণে তা লেখা আছে। ছোটবেলায় মায়ের মুখ থেকে এসব গল্প কত শুনেছে মীরা। আজ মনে হল, সে আবার একটা চিরকালীন প্রশ্ন ভাসিয়ে দিয়েছে প্রাক-সন্ধ্যার বাতাসে। লালনের কাছে জানতে চেয়েছে, সে কি তার সাধনসঙ্গিনী হতে পারে? এভাবেই তো যুগে যুগান্তরে মেয়েরা বারবার পুরুষের কাছে এসে যাচনা রেখেছে। প্রশ্ন করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের বিফল মনোরথ হয়ে ফিরতে হয়েছে। মীরা জানে না, লালন তাকে গ্রহণ করবে কিনা। লালন সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি। সে নাকি নারীসংসর্গ এড়িয়ে চলতে ভালোবাসে। কিন্তু এভাবে সে কি ফকিরিবিদ্যায় পারদর্শী হতে পারবে? ষটচক্রের ক্রিয়াকলাপে কুশলী? এতসব জানে না মীরা, আপাতত লালনের কাছে সে নিশ্চিত নিরাপত্তা চায়। তার এই যৌবন থরথর শরীর, চারপাশে চক্রব্যূহ রচিত না হলে সে থাকবে কেমন করে? মীরা স্পষ্ট বুঝতে পারে, আখড়ার অনেক তরুণ ফকির লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। আড়ালে আবডালে কুপ্রস্তাব দেয়। আর কতদিন এভাবে সে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে? আর কার জন্যই বা রাখবে? সে তো কখনো কারো বিবাহিতা স্ত্রী হতে পারবে না। তাহলে তাকে তো কারোর সাধনসঙ্গিনী হতেই হবে।

অনেকক্ষণ মীরাকে নিরীক্ষণ করল লালন। তারপর বলল—এসো, আজ থেকে তুমিই হবে আমার সাধনসঙ্গিনী!

তখনই, আর তখনই দু-চোখের পাতা বন্ধ করল মোহিনী। এবারের দীর্ঘশ্বাসটা উঠে এল তার বুকের খাঁচা থেকে। না, সে আর কখনো কোনো শোকে দুঃখে বিষণ্ণতায় চোখ থেকে লবণাক্ত অশ্রুকণা ঝরাবে না। অনেক আঘাত আজ তাকে সত্যি সত্যি এক পাষাণ-প্রতিমা করে দিয়েছে।

কুড়ি

নদীর ওপর বাঁশের সাঁকো, দুপাশে দুজন। সতর্ক দৃষ্টি, একজনের ছায়া যেন অন্যজনের গায়ে না লাগে।

একদিকে পন্ডিত নিবারণ চক্রবর্তী, দীর্ঘদিন সংস্কৃত টোলে পড়াশোনা করেছেন। অসংখ্য যজমান আছে তাঁর। টিকিতে জবাফুল গোঁজা। উড়ানি আর ধুতি পরা, শীর্ণ শরীর। বয়স হয়েছে, তবু দেহের তাকত এতটুকু কমেনি। সবসময় তর্ক করতে ভালোবাসেন। বিধাতা বোধহয় তাঁর মাথার ওপর সংসার দেখাশোনার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি পরনিন্দা আর পরচর্চা। কার বাড়ির বউ পালিয়ে গেছে, কোথায় স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর বনিবনা হচ্ছে না সব খবর তাঁর পেটের মধ্যে থাকে।

অন্যদিকে মৌলবী শাহাবুদ্দিন। লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা, তার ওপর ধবদবে সাদা পাঞ্জাবি। সাদা দাড়িতে লাল রং লাগানো। মাথায় আরবি টুপি তেরচা করে বসানো। কথায় কথায় কোরানের শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন। এক একটা বরাতের এক একরকম মানে করেন। উনি জানেন, কোন কাজ করলে গুণাহ হবে। আর কোন কাজ করলে আমরা বেহেস্তের চাবিকাঠি পেয়ে যাব। কোনো বেয়াদপি চোখের সামনে সহ্য করতে পারেন না।

দুজনে মিলে অনেকদিন ধরেই শলাপরামর্শ শুরু করেছেন। যেকরেই হোক লালন ফকিরকে ঠান্ডা করতে হবে। ব্যাটা ভেবেছে কী? গাঁয়ের নিয়মনীতিকে এইভাবে ভূলুন্ঠিত করবে? মত্ত যুবতী মেয়েদের নিয়ে মেতে উঠবে রঙ্গলীলায়? আর বলিহারি ওই ছেলেছোকরাদের দল। ওরা সবাই এখন লালনের ভক্ত সেজেছে। রাস্তার ভিখিরিরা পর্যন্ত লালনের গান গেয়ে ভিক্ষা করছে। বড্ড বাড় বেড়েছে লালনের। একদল লেঠেল পুষেছে সে। রণপা পায়ে ডাকাতরা গৃহস্থ বাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এটা সেটা চুরি করছে। না, এর একটা বিহিত করতেই হবে।

অবশেষে ঠিক হল লালনকে ডাকা হবে বায়াস অর্থাৎ তর্কের আসরে। দেখা যাক কীভাবে সে নিজেকে সমর্থন করে। প্রথমে জানতে চাওয়া হবে, সে কোন জাতের? সে কি হিন্দু, নাকি মুসলমান? নাকি সে জাতপাত কিছুই মানে না?

অবশেষে জমিদারের পেয়াদা এসে এত্তেলা ধরিয়ে দিল। না, ঠাকুরবংশের কেউ নন, পাশের গ্রামের জমিদার সুদর্শন রায়চৌধুরীর প্রশস্ত দালানে এই বিচারসভা বসবে। মৌলবী এবং পন্ডিত জানেন, ঠাকুর বংশের অনেকে লালনকে যথেষ্ট শ্রদ্ধাভক্তি করে থাকেন। তাঁরা বোধহয় এমন এক প্রস্তাবে রাজি হবেন না। অবশ্য সুদর্শনবাবু ভালো মানুষ। তাঁর কানেও লালনের এই সংগীতপ্রীতির কথা পৌঁছে গেছে। তাঁকে অন্যভাবে বোঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে, লালন সেখানে সংগীত পরিবেশন করবে। ইচ্ছে করলে, সঙ্গে সে তার শিষ্য শিষ্যাদের আনতে পারে। এমন কথাই পৌঁছে দেওয়া হল ছেঁউরিয়ার আখড়াতে।

লালন অবাক হয়ে গেল। এই প্রথম কোনো জমিদার বাড়িতে ডাক পাচ্ছে সে। অতএব শুরু হয়ে গেল তার অনুশীলন পর্ব। লালন অবশ্য এইসব অনুশীলনে মোটেই বিশ্বাস করে না। সে জানে, গানের উৎস হল আমাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থল। অন্তরের তন্ত্রীতে আঘাত লাগলে তবেই আমরা মুখ থেকে কোনো সুর উৎপাদন করতে পারি। না হলে শত চেষ্টাতেও কোনো মানুষ গায়ক হতে পারে না।

তবুও জমিদার বাড়িতে প্রথম অনুষ্ঠান, একটু তৈরি হতে হবে বৈকি। লালনের বড়ো ইচ্ছা, ওই আসরে তার দুই শিষ্যা মোহিনী আর মীরার কণ্ঠে বাউল গান শোনাবে। সেইমতো প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। সঙ্গে নেবে সে ভোলা আর শীতল শা-কে। সংক্ষেপে বলা যায়, তারাই হল লালনের ডানহাত আর বাঁহাত। আনোয়ার যাবার জন্য বায়না করছে। ইদানিং আনোয়ারের মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করছে লালন। আগে মাঝেমধ্যে ক্ষেপে যেত, হাঁসুলি হাতে ছুটে যেত, এখন কিন্তু অনেক শান্ত হয়ে গেছে সে। কখনো কখনো অবাক চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝরাতে একা একা বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। কাউকে ভয় করে না সে। সে কি আরও বেশি উন্মাদ হয়ে যাবে? আপন মনে ভাবে লালন, সে জানে আনোয়ারের দুঃখের উৎস কোথায় লুকিয়ে আছে। এই জীবনে নারীসঙ্গলাভে ব্যর্থ হয়েছে সে। তার এই উড়নচন্ডী মনটাকে ঠান্ডা করতে হলে একজন সুযোগ্য নারীসঙ্গিনী দরকার। কিন্তু কে আছে এখানে? অনেকেই তো এখানে আসার জন্য আসে। দু—চারদিন থেকে চলে যায়। লালন কাউকে জোর করে না। একজন মেয়েকে আমন্ত্রণ করা মানে আরও অনেক ঝামেলা মাথায় পেতে নেওয়া। মোহিনী আর মীরা তো বেশ আছে। ওরা দুজনে মিলে সংসারের সব কাজ সামলাচ্ছে। এখন আবার তৃতীয়জনকে এনে কী লাভ?

তাহলে? আনোয়ারের মাথার গোলমাল সারবে কী করে? তখনই হঠাৎ সামনে বসে থাকা মোহিনীর দিকে নজর পড়ে গেল লালন ফকিরের। চমকে উঠল সে। এই ভয়ংকর প্রস্তাবটা সে কখনো মোহিনীর সামনে করতে পারবে না। হাজার হোক মোহিনীকে সে সত্যি ভালোবাসে।

ছপ্ ছপ্ ছপাত্ শব্দে এগিয়ে চলেছে পানসি। নদীর জল টলটল করছে। কাকবন্ধ্যা জলে আকাশের মেঘের ছায়া পড়েছে। শান্তস্নিগ্ধ একটি সকাল। সকলেই গুনগুন করে গান গাইছে। লালন আজ সত্যি সেজেছে রাজার বেশে। ধবধবে সাদা আলখাল্লা পড়েছে সে। মাথায় সাদা পাগড়ি। একতারাটি হাতে নিয়েছে। নদীর স্রোতে ভাসতে ভাসতে লালন গান ধরেছে—

খাড়া ভাঙনের উপর

 আছ রে মন যে,

 একাই ভাঙ্গিতে পারে

 ঢেউ লাগে যদি কষে।

 ধর্ম-ডিঙা বাঁধলি না রে মন,

 জলে-প’লে বাঁচবি দিয়ে

 যে বেঁধেছে ধর্ম-ডিঙ্গা তার

 পাড়ের ভাবনা কিসে?

দেখতে দেখতে তারা পৌঁছে গেল ওই জমিদার বাড়িতে। একী? এখানে এতবড়ো আসর? লালন অবাক হল। জমিদার সুদর্শন রায়চৌধুরী নিজে এগিয়ে এলেন। বিনীত কণ্ঠস্বরে বললেন—আপনি কতবড়ো ফকির মানুষ, অনেকদিন ধরেই আপনার নাম শুনেছি। আপনার গান নাকি মানুষকে কাঁদিয়ে দেয়। ইচ্ছে ছিল, সামনে বসে আপনার গান শুনব। আজ আমার সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে। আশা করি আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি হবে না। আপনি আসুন, একটু বিশ্রাম করুন। একটু বাদে আপনাদের ডেকে পাঠানো হবে।

লালন তার শিষ্য শিষ্যাদের নিয়ে চলে গেল বারমহলে। ভারি সুন্দর ব্যবস্থা। সত্যিই তো, অতিথি নারায়ণ। শাস্ত্রে লেখা আছে। তার সেবাযত্নের দায়িত্ব নিতে হবে বৈকি। ভালো লাগল জমিদারবাবুর এই সৌজন্যবোধ দেখে। সামান্য কিছু ফলাহার। তারপর ডাক পড়ল আসরে।

লালন তার শিষ্য শিষ্যাদের নিয়ে সেখানে পৌঁছে গেল। আজ তার সঙ্গে ধুয়া দেবে ভোলা আর শীতল। লালন প্রথমে নিজে গাইবে না, সে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল—বাবুমশাই, আমার গান তো অনেক হবে, তার আগে আমার দুই শিষ্যার গান শুনুন। এ হল মোহিনী, একে আমি নিজের হাতে শিখিয়েছি। আর এ হল মীরা, এর গলাটিও ভারি চমৎকার।

মোহিনী আর মীরাকে দেখে দর্শকদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন উঠল। মোহিনীর ফেলে আসা ইতিহাস যারা জানে, তাদের কাছে মোহিনী এক কুলটা দুশ্চরিত্রা নারী ছাড়া আর কিছুই নয়। হিন্দু ঘরের বামনী হয়ে সে এক মুসলমানের সঙ্গে সহবাস করে। ব্যাপারটা তারা সহজে মানবে না।

আর মীরা? চিতা থেকে তাকে তুলে আনা হয়েছে, এমন একটা রটনা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। নেহাত জমিদার রায়চৌধুরীর নিজস্ব লোকবল অনেক বেশি, নাহলে কেউ হয়তো এখনই চিৎকার করে প্রতিবাদ করত। ওই বারাঙ্গনাদের নিয়ে ফূর্তি করা, আমরা সহ্য করব না—এমন কথা বলত হয়তো।

ভিড়ের মধ্যে মিশে আছে পন্ডিত নিবারণ চক্রবর্তী আর মৌলবী শাহাবুদ্দিনের পেটোয়া গুন্ডারা। তারা সুযোগ খুঁজছে। সুযোগ বুঝে লালনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তেলচকচকে লাঠি আর ছোরা লুকোনো আছে ফতুয়ার নীচে।

গান ধরল মোহিনী—কত রাত জেগে জেগে সে সুর অনুশীলন করেছিল। রাতজাগা তারার কাছে প্রার্থনা করেছিল, আর একটু স্মৃতি। আহা, কী অদ্ভুত তার গায়কিভঙ্গি। চোখের জলে নিবেদন।

সে গাইল—

 সে ভাব সবাই কি জানে।

 যে ভাবে শ্যাম আছে বাঁধা

 গোপীর সনে।

 গোপী বিনা জানে কেবা

 শুদ্ধ রস অমৃত সেবা

 গোপীর পাপপুণ্য স্থান থাকে না

 কৃষ্ণ দরশনে।

গান শেষ হয়ে গেল। মনের মধ্যে তার রেশ থেকে গেছে। সামনের দিকে যারা বসেছিল, ছেলেছোকরার দল, তারা হাতে তালি দিয়ে বলল—আর একটা, আর একটা।

লালন এগিয়ে এসে বলল—বাবুমশাই, আর বেশি গান তো ওর জানা নেই। কথা দিচ্ছি, আবার যখন এখানে আসব, তখন মোহিনী অনেকগুলো গান শোনাবে আপনাদের। আপনার একটু চুপ করে বসুন, এবার মীরার গান শুনুন।

মীরাকে দেখে মনে হল, সে বুঝি সত্যি সত্যি এক বাউল কন্যা হয়ে গেছে। গেরুয়া পোশাকে সাজিয়েছে নিজেকে। গলায় মালা। হাতে একতারা। চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে মীরা। গান গাইবার আগে হঠাৎ ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করল সে। ফেলে আসা দিন-যাপনের অনেক গ্লানিময় মুহূর্তের কথা মনে পড়ে গেল তার। কাছাকাছি গ্রামেই তার জন্ম। এখানে আসার পর থেকে তার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত উচাটন।

লালনের নাম স্মরণ করে মীরা গান ধরল—

 পার কর হে দয়ালচাঁদ আমারে!

 ক্ষম হে অপরাধ আমার ভব কারাগারে।

 জলে-স্থলে সব জায়গায়

 তোমার সব কীর্তিময়

 বিবিধ সংসারে

 না বুঝে অবোধ লালন

 পড়লো বিষম ঘোরতরে।

তার গানের ভেতরে একটা অদ্ভুত নিবেদনের সুর আছে। হে প্রভু, তুমি আমার সকল কিছু গ্রহণ করো, আমার সুখ এবং দুঃখ, আমার অনুরাগ এবং বিরাগ, আমার লাভ এবং ক্ষতি, আমাকে এক নিঃস্ব রিক্ত বাউল করে দাও।

মীরার গান শেষ হয়ে গেছে। সমবেত জনতা এবার অধৈর্য হয়ে উঠেছে। এখনই লালনকে গান শুরু করতে হবে। নাহলে ওরা ক্ষেপে যাবে।

একতারাটি হাতে রেখে লালন গান শুরু করতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ ছন্দপতন। যমদূতের মতো মৌলবী আর ব্রাহ্মণ সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা লালনের সঙ্গে কিছু কথা বলতে চান।

লালন প্রস্তুত। লালন মাথা নীচু করে বলল—বলুন, আপনার কী বলার আছে পন্ডিতমশাই? আমি সব প্রশ্নের উত্তর দেব, একটাও বাকি রাখব না।

পন্ডিত নিবারণ চক্রবর্তী পৈতে স্পর্শ করে প্রশ্ন করলেন—লালন আগে বলো, তুমি কোন জাতের? শুনেছি, তুমি নাকি হিন্দু ঘরের ছেলে? এখন যবনদের হাতে পড়ে গোমাংস খাও। নারী নিয়ে বেলেল্লাপনা করো। সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলোতো তোমার আসল জাত কী?

এমন একটা আক্রমণ যে হতে পারে, লালন তা জানতই না। সে এসেছিল, মানুষকে গান শোনাবে বলে। অভাবিত আক্রমণে একটু বিহ্বল হল সে। তারপর বলল—এত রাগ করছেন কেন, পন্ডিতমশাই? আপনি কি জানেন না যে, ক্রোধ হল আমাদের সবথেকে বড়ো শত্রু। আপনি চুপটি করে বসুন, আমাকে একটু সুযোগ দিন। আমিতো গানের মাধ্যমেই সবকিছু বলব। আসুন বলি, আমি কোন জাতের মানুষ।

একতারা বেজে উঠল। লালন গাইতে শুরু করল—

 সবলোকে কয় লালন কী জাত সংসারে

 লালন কয় জেতের কী রূপ

 দেখলেম না এ নজরে

 যদি সুনুন্নত দিলে হয় মুসলমান

 নারীর তবে কী হয় বিধান?

 বামন চিনি পৈতা প্রমাণ

 বামনী চিনি কীসেতে?

 কেউ মালা কেউ তসবি গলায়

 তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়?

 যাওয়া কিংবা আসার বেলায়

 জেতের চিহ্ন রয় কাররে?

 জগত বেড়ে জেতের ফাতা

 লোকে গৌরব করেন যথাতথা

 লালন সে জেতের ফাঁকা

 বিকিয়েছে সাত-বাজারে।

অসাধারণ গান। অপূর্ব গায়কি ভঙ্গি। নিম্নবর্গের শ্রোতারা হাততালি দিয়ে ওঠে। কিন্তু রেগে গেছেন পন্ডিতপ্রবর। তিনি বললেন—এভাবে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে আমার মুখ বন্ধ করতে পারবে না লালন। আবার বলো, ঈশ্বরের কসম খেয়ে তুমি কোন জাতের? তুমি কি হিন্দু নাকি মুসলমান?

লালন এবার হেসে উঠল। হো হো করে হাসল। হাসির মধ্যে দিয়ে জীবনের সব মলিনতা আর ক্লিন্নতাকে দূরে সরিয়ে দিল। তারপর বলল—ঠাকুরমশাই, এত জাতজাত করে মরছেন কেন? আমরা মৃত্যুর সময় কি জাতের কথা মনে রাখি? এ পৃথিবীতে আমরা একটাই জাত, আমরা হলাম মানুষ।

মুখের ওপর জবাব দিয়েছে লালন। ঠাকুরমশাই বসে পড়তে বাধ্য হলেন। এবার উঠে দাঁড়িয়েছেন মৌলবী শাহাবুদ্দিন। তিনি জানেন, তাঁর অসংখ্য চেলাচামুন্ডা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারপাশে। মৌলবী একবার ইঙ্গিত করলে তারা রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়বে লালন আর তার সঙ্গীদের সাথীদের ওপর। লালনকে আজ এখানে মেরে ফেলতে হবে—এমনই কথা বলা আছে। তার জন্য একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

মৌলবী বললেন—লালন, তোমার কী জাত, তা নিয়ে আমি মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না। শুনেছি, তুমি নাকি মদ আর মেয়েছেলের আসর বসাও তোমার ছেঁউরিয়ার আখড়ায়? কথাটা কি সত্যি?

লালন হাসল। এখন সে জানে তাকে নানা অপ্রীতিকর প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সে বলল—মৌলবীসাহেব, আপনি আসুন না আমাদের আখড়াতে, দুদন্ড থাকুন, তাহলেই বুঝবেন ওখানে কীসের সাধনা হয়।

উত্তরটা মনোমত হয়নি। মৌলবীসাহেব তর্জনী উচিয়ে বললেন—এই মেয়েটি? এতো হিঁদু ঘরের বিধবা, চিতায় যাচ্ছিল, তোমরা তাকে জোর করে তুলে নিয়ে এসেছ।

এবার লালনের রুখে ওঠার পালা। এ ঘটনাটি বারবার তার মনকে আক্রান্ত করে। সতীদাহ প্রথা দেশ থেকে রদ হয়ে গেছে। সাহেব আইন করেছে। তবুও গ্রামেগঞ্জে এখনও অসংখ্য মেয়েকে সতী হতে হয়। জীবন্ত হত্যা ছাড়া এটা আর কিছু নয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে কিছু মানুষ এত নীচ কাজ করে কী করে?

লালন চিৎকার করে বলল—শুনুন মৌলবীসাহেব, মেয়েটিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছিল। বলুনতো, ও তো আমাদের ঘরের মেয়ে। ওর মা বাবা আছে। আপনার মেয়েকে যদি এইভাবে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দেওয়া হয় তাহলে আপনি কি বাধা দেবেন না? আপনি কি জানেন না, সতীদাহ প্রথা রদ হয়ে গেছে? তাহলে কেন মিছিমিছি সেই প্রথাটাকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন?

…ওর দিকে তাকিয়ে দেখুন তো, আমরা কি ওকে অযত্নে রেখেছি? ইচ্ছে হলে ও আবার সংসার জীবনে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু আপনার মতো কুচক্রী মৌলবী আর ব্রাহ্মণদের দল ওকে সংসারজীবনে ফিরতে দেবে না। বলুন, এটা কি অন্যায় নয়?

সমবেত জনতা বলল—হ্যাঁ, ঠিক ঠিক বলেছেন, লালন। এত যুক্তিতর্ক আমরা শুনতে আসিনি। লালন আপনি এবার গান ধরুন। কী সুন্দর আপনার গলা, কী অপূর্ব আপনার গায়কি ভঙ্গি। আমরা এখানে এসেছি শুধু আপনার গান শোনার জন্য।

লালন বলল—দেখলেন তো জমিদারমশাই, এরা কূটতর্কে যেতে চায় না। এরা গান শুনতে চায়। আপনি অনুমতি করুন, আমি দুকলি গেয়ে শোনাই।

কিন্তু শাহাবুদ্দিন ছাড়বেন কেন? হিসাবনিকাশ যা কিছু আজ করতে হবে। সকলের চোখের সামনে। তাই তিনি গলা চড়িয়ে বললেন—না, জমিদারমশাই না। আমাদের বায়াস এখনও শেষ হয়নি। লালন বলোতো, তোমরা জীবনে বিয়ে-থা করোনা কেন? সাধনসঙ্গিনীদের নিয়ে কী করো আমাদের জানতে বাকি নেই। তোমরা বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলোর মাথা খেয়েছ। তারা এসে তোমার নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। আমরা তো গাঁ ছেড়ে পালাবার কথা চিন্তা করছি। তোমার বেয়াদপি আর সহ্য করা হবে না।

লালন বুঝতে পেরেছে, এসব হল ইচ্ছাকৃত আক্রমণ। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। জনতার একাংশ ক্ষেপে গেল। লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল লালন আর তার সঙ্গীসাথীর ওপর। বেশ কিছুক্ষণ একতরফা মার খেতে হল লালনকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত শরীর। ছুটে এসেছে মোহিনী। বলেছে—আগে আমার মাথায় আঘাত করো তারপর আমার সাঁইজীর গায়ে হাত দেবে।

বিচক্ষণ জমিদার সুদর্শন রায়চৌধুরী, তিনি হয়তো এমনই একটা বিপদের আঁচ করেছিলেন। তাই তাঁর লেঠেলরাও তৈরি ছিল। মুহূর্তের মধ্যে আসর ফাঁকা হয়ে গেল। গ্রামবাসীরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পালাতে ব্যস্ত। এবার লালনের চিকিৎসা করতে হবে। অতি দ্রুত তাকে অন্দরমহলে নিয়ে যাওয়া হল। সমস্ত গায়ে পট্টি বেঁধে দেওয়া হল। কাপড় ভিজে যাচ্ছে রক্তে। মোহিনী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে বলল—ঠাকুর, ঠাকুর, তুমি একী করলে? তুমি যে আমার সাঁইজী। এভাবে তুমি আহত হলে আমার কি ভালো লাগবে?

লালন হাসল, মলিন হাসি। সে জানে, এখন থেকে তাকে এখন অনেক আঘাত সহ্য করতে হবে। সে যে সমাজের তৃণমূলে আঘাত করেছে। যুগযুগান্তবাহিত চিন্তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। নারী এক পণ্য, কেনাবেচার সামগ্রী—এই মনোভাব দূর করতে হবে। নারীকে যথার্থ সম্মান দিতে হবে। তবেই তো সে আমাদের সাধনসঙ্গিনী হতে পারবে।

হাতজোড় করে জমিদার বললেন—লালন ফকির, এখানে যা ঘটে গেল, তার জন্য আমি দুঃখিত। যদি জানতাম, জনরোষ এইভাবে আছড়ে পড়বে, তাহলে আমি কখনো আপনাকে আমন্ত্রণ জানাতাম না। তবে ভয় পাবেন না, দুর্বৃত্তদের আটকে রাখা হয়েছে। আমি ওদের শাস্তি দেব।

লালন বলল—না না, যা হবার তো হয়েই গেছে। এখন ওদের শাস্তি দিয়ে কী লাভ? ওরা দীনদরিদ্র মানুষ, নীতিবাক্য কিছুই শেখেনি। ওদের বরং আমার আখড়াতে পাঠিয়ে দেবেন। দেখা যাক আমরা ওদের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন করতে পারি কিনা।

এবার নৌকো ফিরে চলেছে উলটো পথে। সকালে যখন সবাই নৌকোর সওয়ার হয়েছিল, তখন মনে ছিল খুশির ঢেউ, অজানা আনন্দের পরিপ্লাবন। নতুন দেশে চলেছে ওরা, নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, সেখানে লালনের নামে মহিমাকীর্তন হবে। সকলে লালনের নাম জানবে, এ কী কম কথা?

আর এখন? ক্লান্ত শ্রান্ত রক্তাক্ত কটি মানুষ ফিরে চলেছে আখড়ার দিকে। কিছুই আর ভালো লাগছে না লালনের। গলুইয়ের ওপর বসে সে গান ধরল—

 লীলা দেখে লাগে ভয়।

 নৌকার ওপর গঙ্গা বোঝাই

 ডেঙ্গা বেয়ে যায়।

ধীরে ধীরে নৌকা এসে ভিড়ল ছেঁউরিয়ার ঘাটে। তখন সন্ধ্যা নেমেছে। লালন বলল—আজ সবাই বিশ্রাম করো, কাল সকালে আলাপ আলোচনা হবে, কেমন?

টলতে টলতে কোনোমতে সে তার ঘরে পৌঁছে গেল। পরিপাটি করে সাজানো বিছানা। লালন শুয়ে পড়ল। কিন্তু একী? কে তার পায়ে মাথা রেখে আকুল হয়ে কাঁদছে? উঠে বসল লালন, চোখ মেলে দিল, আধো অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পেল—মোহিনী!

একুশ

আখড়ায় বসে লালন দেখতে পেল, ঘোড়ার পিঠে চড়ে যে যেন এদিকে এগিয়ে আসছে—কে আসছে? সরকারের পাইকবরকন্দাজ নয়তো? কতবার কাঙাল হরিনাথ বলেছিল, লালন, এবার একটু বিষয়সম্পত্তিতে মন দাও। তোমার যে এত শিষ্য শিষ্যা, তুমি চোখ বুজলে এদের কী হবে? ঠাকুর পরিবারের কাছে আবেদন করো। আশা করি তোমার আবেদন রক্ষা করবেন।

করছি, করব করে দিনগুলো কেটে গেছে। লালন এবার সত্যি ভয় পেয়েছে। নিজের জন্য তার বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। সে পথে পথে কাটিয়ে দেবে জীবনের বাকি দিনগুলো। কিন্তু এদের কী হবে? এই যে তাকে কেন্দ্র করে এতজন মানুষ এখানে এসে বাস করছে? আনোয়ার, কাশিম অথবা ভোলা শা? মোহিনী কিংবা মীরা? নাহ, এবার বিষয়সম্পত্তিতে মন দিতে হবে।

কিন্তু ঘোড়ার পিঠে চড়ে কে আসছে? লালন তার শিষ্য ভোলা আর শীতলকে পাঠিয়ে দিল। খবরটা আগাম জানতে হবে। তেমনটা হলে আত্মপক্ষ সমর্থনের কথাগুলো ভাঁজতে হবে।

একটু বাদে ছুটে এসে ভোলা শা বলল—না সাঁই, তেমন কোনো ঘটনা নয়। ওই ঘোড়াটা তোমাকে দেওয়া হবে, জমিদারের উপহার। তুমি একটুখানি অপেক্ষা করো।

নিজের কানে শোনা এই খবরটা বিশ্বাস করতে পারল না লালন। ছোটবেলা থেকেই ঘোড়ায় চড়া শখ তার। মনে পড়ে গেল বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের কথা। তার আস্তাবল থেকে পক্ষীরাজকে বের করত সে। মাঝরাতের অন্ধকারে। তখন তার কতই বা বয়স হবে। আঠারো বছরের বেশি নয়। পক্ষীরাজের পিঠে চড়ে কোথায় কোথায় চলে যেত। নিজের হাতে দলাইমলাই করত পক্ষীরাজকে। তার জীবনে যে সমস্ত ঘটনা ঘটে গেছে তার অন্তরালে আছে এই ঘোড়ার প্রতি ভালোবাসা। ঘোড়াকে ভালোবাসে বলেই কালীকিঙ্কর তাকে একটা চাকরি দিয়েছিলেন। সেই চাকরিসূত্রেই তাকে গঙ্গাযাত্রা করতে হয়েছিল। তারপর সে মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে, ঈশ্বরের অনুগ্রহে প্রাণ ফিরে পায়। তার মানে? যে বিশ্ববিধাতা অদৃশ্য সুতোর টানে লালনের জীবন বুনে চলেছে সেকি এভাবেই তার জীবনকে আবার পরিবর্তিত করতে চায়?

ঘোড়ার পিঠ থেকে ছেলেটি নামল। কপালের ঘাম মুছে বলল—আমাদের বাবু এই ঘোড়াটি পাঠিয়েছেন। তিনি জানেন, আপনি ঘোড়ায় চড়তে ভালোবাসেন। তাছাড়া আপনাকে পায়ে হেঁটে এক গাঁ থেকে অন্য গাঁয়ে যেতে হয়। আজ থেকে এই ঘোড়াটা আপনার। একে যেমন খুশি ব্যবহার করবেন। আর একটা কথা, আমাদের বাবু বলে পাঠিয়েছেন, সময় সুযোগ হলে ওনার জমিদারিতে আসবেন। একরাত থাকবেন। উনি একটা গানের আসরের ব্যবস্থা করবেন।

অতিথিকে কি এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায়? লালনের ইঙ্গিতে ছেলেটিকে একপেট খাইয়ে দেওয়া হল। ছেলেটি চলে যাবার পর লালন ঘোড়ার সামনে এসে দাঁড়াল। কী আশ্চর্য, ভগবান নেই—কে বলে। ভগবান আছেন বলেই তো আমি এমন একটা দামী উপহার পেলাম। না, এখন থেকে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। ঘোড়ার পিঠে চড়ে অতি দ্রুত আমি এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে পারব। গ্রামে গ্রামে গিয়ে আমার ধর্মমত প্রচার করব। আমি যে সত্যি সত্যি সম্পীতির প্রতীক, তা লোককে জানাতে হবে বৈকি! নাহলে হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে হানাহানি কখনও থামবে না।

মনে মনে কুর্ণিশ করল সে। জমিদার সুদর্শন রায়চৌধুরীকে। ঘোড়াটির দিকে তাকাল। তার গায়ে হাত রাখল। অনেক বছর আগের স্মৃতি ভেসে উঠছে। না, ঘোড়াটাকে ভালোভাবে যত্ন করতে হবে। ভোলাকে নির্দেশ দিল, তার জন্যে একটা আস্তাবল তৈরি করতে। মুখের কথা খসতে না খসতে আনোয়ার একপায়ে এসে হাজির। সত্যি সে জাতঘরামি। মুহূর্তের মধ্যে খড় দিয়ে একটা সুন্দর ঘর বানিয়ে দিল। সেখানে ঘোড়াটাকে রাখার ব্যবস্থা করা হল। হঠাৎ লালনের মনে হল একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করলে কেমন হয়? পায়ে হেঁটে এতটা পথ পার হওয়া যাবে না বলে সে মনের এই ইচ্ছেটাকে চেপে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। এখন ঈশ্বরের অনুগ্রহে যখন একটা ঘোড়া পেয়েছে, তখন মনের এই ইচ্ছেটাকে পূরণ তাকে করতেই হবে।

কতদিন মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। মা কি আমাকে দেখলে চিনতে পারবে? ধুলিধূসরিত এই পোশাক, কোঠরাগত দুটি চোখ। মারাত্মক সময় এঁকেছে তার সর্বনাশা চিহ্ন। মায়ের চোখে আমি হয়তো এখনও সেই ছিপছিপে কিশোর লালন। দুবেলা মায়ের সাথে কত খুনসুটি।

স্মৃতির পর্দা ওড়ে, লালন আনমনা হয়ে যায়। রোদের তাপ ক্রমশ কমে আসে। সন্ধ্যা নামে। লালন ঠিক করল, না, আর দেরি করা উচিত হবে না। কাল সকালে কাউকে কিছু না বলে আমি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাব।

বাইশ

এই সেই শিমূলতলা। ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল লালন। চারপাশে ভালোভাবে তাকাল। কই, পরিচিত মানুষজন তো চোখে পড়ছে না। অথচ, একদিন এই শিমূলতলাতেই বসত তাদের বাউল গানের আসর। সনাতন উদাস কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে। লালনের ভারি সাধ হল একবার তাদের সাথে দেখা করতে। তাদের সঙ্গে দেখা হলে হয়তো ক্ষণকালের জন্য হারানো শৈশবদিন ফিরে আসবে। কিন্তু সেই দিনগুলোতে ফিরে গিয়ে কীই বা লাভ? জীবন এক বহমানা তটিনীর মতো। স্রোতের বাঁকেবাঁকে ঘাতে প্রতিঘাতে সাগর সন্ধানে ছুটে যায়। যা গেছে, তাতো চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে। তাকে ফিরিয়ে এনে কী লাভ?

লালনকে দেখে বন্ধুরা বোধহয় আজ আর চিনতে পারবে না। একেবারে পালটে গেছে সে। বরং বলা যায় সে নিজেকে পালটে ফেলেছে। জাতের নামে এই বজ্জাতি, ধর্মের নামে এই অত্যাচার, নিজের চোখে সবকিছু দেখেছে লালন। এখন সে বুঝি এক সর্বংসহা ঋজু মহীরুহ। সহসা ঝড়ের আঘাতে কাত হবে না।

ঘোড়াটিকে এখানেই বেঁধে রাখতে হবে। এই গ্রামে ঘোড়ার পিঠে চড়ে সহসা কেউ আসা যাওয়া করে না। লোকের প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে। লালন তাই ঠিক করল, পায়ে হেঁটেই সে এগিয়ে যাবে তার ভিটেটির দিকে। তার আগে, অন্ত একবার গৌরীর সাথে খুনসুটি খেলা খেলবে। তার আজন্মের সখি, বাল্যের সহচরী, কত রক্তাক্ত সন্ধ্যায় সে গৌরী নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকত। এই নদী তার কানে কানে বাউলমন্ত্রের দীক্ষা দিয়েছে। ফকিরি মতবাদে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই নদীটি না থাকলে সে বোধহয় এত সহজে দেহতত্ত্বের গান লিখতে পারত না। নারী-শরীর যে কী এক রহস্য আধার, সে কথাও জানতে পারত না।

এই সেই তটিনী, এখন শীর্ণা, সময়টা শীতকাল। ভরাবর্ষার ছলছলাত আহ্বানে সে যৌবনবতী হয়ে উঠবে। দুকুল ছাপিয়ে হয়তো বন্যা নামবে। তবে গৌরী ভারি শান্ত এবং সুশীলা। কখনো মানুষের স্বপ্নের ঘরবাড়ি ভাসায় না। হয়তো একটু স্ফীতা হয়, একটু প্রগলভা, তাতে কী? তার সেই রূপ দেখতে বরং ভালোই লাগে।

গৌরীর জলে পা ডুবিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসেছিল লালন। একতারা বাজাল, গান গাইল। সেই গানের সুর ভেসে গেল স্রোতের তালে তালে। হারিয়ে গেল কোথায় কে জানে। এবার তাকে স্মৃতির সরণী ধরে ফিরতে হবে। বড়ো কঠিন এই পিছুটান। লালন ভাবল, ভাগ্যিস, আমার কোনো সন্তান নেই। তা হলে? বাঁধন ছিঁড়তে হয়তো আরও বেশি কষ্ট হত।

কিন্তু আমিতো এক ফকির। আমি কেন এসব কথা চিন্তা করছি। সহসা গুরু সিরাজ সাঁইয়ের মুখখানা মনে পড়ে গেল তার। দীর্ঘ দেহ, উদাত্ত কণ্ঠস্বর। লালন জানেনা, সিরাজ এখনও বেঁচে আছে কিনা। থাকলেও হয়তো অনেক বয়স হয়ে গেছে। আর কখনো কি গুরুর সঙ্গে দেখা হবে না?

লালন ভাবল, পরক্ষণেই তার মনে হল, না, গুরুর সঙ্গে দেখা হলে হয়তো কষ্ট হবে তার। সেই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ এখন হারিয়ে গেছে। চোখের তারায় ক্লান্তি নেমেছে। দেহে জেগেছে শিথিলতা। এখন হয়তো সিরাজ আর বাজখাঁই গলায় আসর জমাতে পারে না। হয়তো পরিত্যক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। রোগজীর্ণ এক মুমূর্ষু মানুষ।

তার থেকে এই-ই ভালো, তার মনের পটে সিরাজ সাঁইয়ের যে ছবিটি ধরা আছে, সেটিকেই সে সযত্নে বাঁধিয়ে রাখবে, মৃত্যুর প্রহর পর্যন্ত।

চেনা পথ, কিছুটা পালটে গেছে হয়তো। কেউ কি তার দিকে দৃকপাত করছে? এখন সবেমাত্র সকাল হয়েছে। মানুষজন সেভাবে কর্মব্যস্ততার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। অবশ্য এ গ্রামের জীবন মন্দাক্রান্তা ছন্দে এগিয়ে যায়। এখানে সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। অহেতুক কৌতুহল দেখায় না। তাই বোধহয় লালনের পক্ষে অতি সহজে তার ভিটেখানির সামনে এসে দাঁড়ানো সম্ভব হল।

কিন্তু সে কোথায়? এই কি আমার কুটির? আমার শৈশবের স্বপ্ন। কৈশোরের রোমাঞ্চ। যৌবনদিনের অহংকার। এই ছোট্ট ঘরটি থেকেই আমি একদিন বেরিয়ে গিয়েছিলাম গঙ্গাস্নান করব বলে। তারপর আর সেভাবে ফেরা হল কই? এখানেই কি আমাকে অপমানবাণে বিদ্ধ করা হয়েছিল? বলা হয়েছিল তুমি যবনের ভাত খেয়েছ। তুমি কুলাঙ্গার। হিন্দু শাস্ত্রানুসারে তুমি মৃত। তোমার পিন্ডদান করতে হবে। তুমি এখনই এই গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাও। যতক্ষণ তুমি এই গ্রামে থাকবে, এখানকার বাতাস হবে বিষাক্ত। মানুষের মনে কুটিল ভয়ের জন্ম হবে। দোহাই লালন, তুমি আমাদের সুখের সংসারে আগুন জ্বালিও না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে লালন। ভাবে, আমার কী দোষ? আমি কি ইচ্ছে করে যবনঘরে ভাত খেয়েছি? তাছাড়া আমিনা আমার জন্ম-জন্মান্তরের জননী। সে যদি বুক দিয়ে আগলে না রাখত, তাহলে আমি তো কবে মরে যেতাম। ধিক তোমাদের জাতের অহংকার। ধিক এই ব্রাহ্মণ্যবাদের মিথ্যে আস্ফালন।

বাড়িখানি প্রায় ভেঙে পড়েছে। বাঁশের কাঠামোটা কোনোরকমে জেগে আছে হাড় জিরজিরে কঙ্কালের মতো। এখানে সেখানে মাটির প্রলেপে ধূসর বিবর্ণতার ছাপ। কতদিন নিকোনো হয়নি। খড়ের ছাদ উড়ে গেছে। বর্ষার আক্রমণ এবং ঝড়ের প্রাবল্যে। তবু অনেক-অনেক আশা জমে আছে লালনের মনের মধ্যে। কতদিন বাদে চম্পার সাথে দেখা হবে তার। চম্পাকে দেখলে সে কি চিনতে পারবে? তার যেমন বয়স হয়েছে, একই ভাবে চম্পার তো বয়স বাড়ছে। চোখ বন্ধ করলে যে চম্পাকে সে দেখতে পায়, সে চম্পা নেহাতই এক কিশোরীমাত্র। তার দেহে তখনও পর্যন্ত তেমনভাবে যৌবন আসেনি। অথচ মন শরৎস্নিগ্ধ শিউলির মতো অভিমানী। সেই চম্পার সঙ্গে তার কত খুনসুটি খেলা। সেই চম্পাই তো তাকে প্রথম নারী সংসর্গের রহস্য শিখিয়েছিল। খিলখিলে হাসির তোড়ে তার পৌরুষকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। লালনের কেবলই মনে হয়। এই যে সাধনতত্ত্বে সে বিশ্বাস করে, তার আসল দীক্ষাগুরু হল ওই চম্পা। ঈশ্বরের আশ্চর্য অবদান এই রমণীরা। পাতলা শরীর, শক্তি খুবই কম, বীরত্বের আস্ফালন নেই, কিন্তু কী আছে? খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর। সেই পরশপাথরের সন্ধানে সব পুরুষ রমণী-সাগরে ডুব দেয়। কেউ কেউ তল খুঁজে পায়, বেশিরভাগই হারিয়ে যায়। কেউবা ডুব সাঁতারে পার হতে চায় ভয়ংকর স্রোত।

কিন্তু কিন্তু করে দাঁড়িয়ে পড়েছে লালন। ভাবছে কারো নাম ধরে ডাকবে কিনা। একবার যদি সে মা বলে ডাকে। পদ্মাবতী কি তাহলে ক্ষমা করে দেবে না? কতদিন হয়ে গেল মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি তার। সহসা লালনের মনে হল মা কি বেঁচে আছে? কালাত্মক যম কি মাকে গ্রাস করেছে? বাড়িতে এত বিষাদের ছাপ কেন?

সাহস সঞ্চয় করে আর একটু ভেতরে ঢুকে পড়ল লালন। আর তখনই বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল তার। শূন্য ঘর, শূন্য খাঁচা, কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। তাহলে? ভয়ংকর একটা সম্ভাবনার কথা মনে পড়ে গেল লালনের। সমাজপতিদের অত্যাচারে মা আর বউ কি ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে? কোথায় গেছে ওরা? কোন বিদেশ বিভুঁইতে? কী ভাবে দুবেলা দুমুঠো খাবারের সংস্থান করছে? পরনের কাপড়? না, তা কখনো হতে পারে না।

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেল লালন ফকির। একী? বয়সের ভারে ন্যুব্জা এক মহিলা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তাকে দেখে বোঝা যায়, বিভিন্ন রোগ তার শরীরে বাসা বেঁধেছে।

লালনকে দেখে সে একেবারে অবাক হয়ে গেছে। স্নেহবিজড়িত কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন করল—কে বাবা তুমি? এখানে কী চাও? ভিক্ষা চাও কি? না, আমার ঘরে একমুঠোও চাল নেই যে, তোমাকে ভিক্ষা দেব।

থেমে থেমে কথাগুলি বলছে সে। বেশ বোঝা যাচ্ছে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তার। হয়তো তার এমন মারণব্যাধি হয়েছে যার কোনো প্রশমন নেই। পৃথিবীর মানুষের এত দুঃখ কেন? কখনো যদি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সাথে দেখা হয় লালনের, তাহলে এই একটি মাত্র প্রশ্ন সে করবে। জানতে চাইবে—মানুষে মানুষে এত বৈষম্য কেন? জমিদাররা কত আনন্দসুখে দিন কাটায়। কত টাকা বাজে খরচ করে। আলোর রোশনাই, বেড়ালের বিয়ে। আর এত মানুষ দুবেলা দুমুঠো খেতে পায় না। রোগের যন্ত্রণায় ছটফট করে। কেন এমন হয়? অভিমানী লালন জানতে চায় সবকিছু।

লালন বলল—এটা আমারই ঘর। এই ঘরে আমি জন্মেছিলাম। আমার মা আর বউয়ের কোনো খবর জানো?

মহিলা আর একটু কাছে এগিয়ে এল। ভালো করে লালনকে দেখার চেষ্টা করল। একটু পরে খুশিতে উদ্ভাস হয়ে উঠল তার শুকনো মুখ। সেকাল—তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি, ভালো করে আমার দিকে চেয়ে দেখতো, আমাকে কি তুমি আগে দেখছ?

এ কী? স্মৃতির সমুদ্রের তোলপাড়। মুখখানা বড়ো চেনাচেনা বলে মনে হচ্ছে—তুমি কি নিশিগোয়ালিনী! সেই কবে ছোটবেলায় দুধ দই ক্ষীর নিয়ে আসতে পসরা সাজিয়ে! আমি তোমার বড়ো ন্যাওটা ছিলাম, তাইনা নিশিগোয়ালিনী।

একটু চিলতে হাসির ঝিলিক, শুকনো ঠোঁটে। নিশি বলল—আমি আর চোখে একদম দেখতে পাই না। তোমার মা ঠাকুরের মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছেন। তুমি যে কী করলে লালন, এইভাবে কেউ মাকে কষ্ট দেয়!

—কোথায়? কোথায়? লালন জানতে চাইল।

নিশি বলল—গ্রামেরই একপ্রান্তে, গোপালমন্দিরে। সেখানে কোনোরকমে দুবেলা দুমুঠো অন্নজোটে। তার বিনিময়ে মাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। মন্দিরের বাসনপত্র মাজতে হয়, ঘর পরিষ্কার করতে হয়।

দুঃখে লালন কেমন যেন হয়ে গেল। ভুলে গেল সে এক ফকির, পূর্বজীবনের কোনো স্মৃতি মনে করাটা পাপ তার কাছে। সিরাজ সাঁই পইপই করে বারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু বাড়ির টান এত সহজে কি ছোঁড়া যায়?

একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে লালন জানতে চাইল—আচ্ছা, নিশিগোয়ালিনী, আমার বউ? আমার বউ চম্পা কেমন আছে?

মুহূর্তের বিহ্বলতা, কীসের ইঙ্গিত? সর্বনাশা সংকেত? লালন আর থাকতে পারছে না, হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়েছে। সে বলল—বলো না, নিশিগোয়ালিনী আমার বউ কেমন আছে? অন্তত একটিবার কি তার সঙ্গে আমার দেখা হবে না?

নিশি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। লালন বুঝতে পারে, ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে গেছে। বিভিন্ন সম্ভাবনার কথা মনে পড়ে গেল তার। চম্পা যুবতী, চম্পা রূপসী, তার মানে? রক্তলোলুপ হিংস্র পশুরা কি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? হরণ করেছিল তার সতীত্ব? সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে চম্পা হয়েছে আত্মঘাতিনী। স্বামী হয়ে আমি তাকে বাঁচাতে পারিনি।

নাকি গৌরীর জলে শেষ আশ্রয় নিয়েছে সে? মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে স্রোতস্বিনীর সাথে।

নিশিগোয়ালিনী নিঃশ্বাস ফেলল। লালনের মুখের দিকে তাকাল। বেশ বোঝা যাচ্ছে এই শোকসংবাদটা দিতে গিয়ে দ্বিধাগ্রস্তা। কিন্তু যা সত্যি তাকে তো ঘোষণা করতেই হবে। লালনকে মিথ্যে গোলকধাঁধার মধ্যে রেখে কী লাভ?

নিশিগোয়ালিনী বলল—লালন মনটাকে শক্ত করো, পৃথিবীতে কেউই চিরদিন বেঁচে থাকে না। তোমার চম্পা আর বেঁচে নেই!

মাত্র কয়েকটি শব্দ, তীক্ষ্ন ছুরি হয়ে আঘাত করেছে লালনকে। ডুকরে কেঁদে উঠল সে। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। এ কী? আমি ফকিরি মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছি। আমার মন্ত্র আমাকে কী শিখিয়েছে? এই পৃথিবীতে মৃত্যু বলে কিছু নেই। জন্ম বলে কিছু নেই। মানুষ এক প্রবহমান প্রাণসত্তার সামান্য অংশমাত্র। জন্মগ্রহণ করলে মৃত্যু অনিবার্য। আজ অথবা আগামীকাল। তার জন্য বৃথা কেন দীর্ঘশ্বাস। বৃথা কষ্ট! তবুও মন কি মানে? চোখ বন্ধ করলে চম্পার কত স্মৃতি ভেসে ওঠে। আহা, ভারি সুন্দরী ছিল মেয়েটি। আবেগময়ী এবং মমতাবতী। আমি তাকে শুধু ঘৃণা দিয়েছি। দিয়েছি অপমান। দাম্পত্য জীবনের সুখ শান্তির সন্ধান কখনো সে পায়নি। তাই বোধহয় বড়ো অভিমান করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।

এখানে থাকা অর্থহীন। নিশিগোয়ালিনী বলল—তোমার মা সাক্ষাৎ লক্ষ্মীপ্রতিমা। আমার তখন খুবই দুরবস্থা। থাকব কোথায়? ঝড়ের দাপটে ভিটেখানা ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। তোমার মার কাছে বলেছিলাম, উনি যাবার আগে আমাকে এই ঘরে থাকতে অনুমতি দিয়ে গেছেন। একবার দেখা করে যাও। বারেবারে মা তোমার কথাই বলেন। তুমি কী পাষন্ড লালন। এভাবে মাকে কি কেউ কষ্ট দেয়?

লালনের মনে হল, চিৎকার করে সে সব কথা শোনাবে নিশিগোয়ালিনীকে। কী অবস্থায় তাকে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল, সেই অভিশপ্ত বৃত্তান্ত। পরমুহূর্তেই এক অদ্ভুত উদাসীনতা এসে গ্রাস করল তাকে। কী লাভ এসব কথা বলে? যা গেছে, তা তো চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে। তাতো আর কখনো ফিরে আসবে না।

শেষবারের মতো ভিটেমাটির দিকে তাকাল লালন। সে জানে, আগামী বর্ষায় এই স্মৃতিটুকু একেবারে উৎপাটিত হবে। পরিত্যক্ত ভূমিখন্ডে পরিণত হবে এই স্নেহের ভিটেখানি। হয়তো কোনো একদিন আবার এই গ্রামে আসবে লালন। তখন চিনতে পারবে কি কোথায় সে জন্মেছিল? কোথায় সে বড়ো হয়েছিল? নাকি কালস্রোতে সবকিছু হারিয়ে যাবে? জেগে থাকবে স্মৃতির চিরাগ। জ্বলবে, জ্বালাবে সারাজীবন।

ঘোড়ার পিঠের সওয়ার হল সে। পরিচিত গ্রাম, লোকজন কাজে ব্যস্ত। জোলারা তাঁত বুনছে। চাষীরা চাষের জমিতে কাজ করছে। জেলেরা মাছ ধরছে। ভারি পরিচিত সুন্দর খন্ড খন্ড দৃশ্য। এইসব ছবি দেখতে দেখতে শেষ পর্যন্ত লালন গ্রামের প্রান্তভাগে গোপাল মন্দিরে পৌঁছে গেল। মন্দিরে তখন পুজার্চনা চলেছে। কে যেন উদাত্ত কণ্ঠস্বরে ভারি সুন্দর শ্লোক পাঠ করছে। লালন তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকল রাধাকৃষ্ণের যুগলস্মৃতির দিকে। হঠাৎ বুকফাটা কান্না বেরিয়ে এল তার চোখের জল হয়ে। বেশ কিছুক্ষণ কাঁদল সে একা একা। এভাবেই বোধহয় বুকের ওপর চেপে থাকা পাষাণ ভারটাকে সরিয়ে দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করল।

মা কোথায়? মাকে দেখলে আমি কি চিনতে পারব? মার ওপর নিশ্চয়ই বয়স এঁকেছে তার ব্যথার্ত জলছবি। তবুও যাকে একবার চোখের দেখা দেখতে ভীষণ-ভীষণ ইচ্ছে হল তার। চারপাশে মেলে ধরল তার উৎসুক দৃষ্টি। আরে ওইতো, নীচু হয়ে ঘর মুছছে। বয়স তাকে আক্রমণ করেছে। লালন ভাবল, পায়ে পায়ে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করবে কিনা। এর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল সে। এখন সে অনেক অভিজ্ঞ। সে জানে, তাকে এই মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এখানে যে রাখালরাজার বসবাস। আদরিণী রাধাকে নিয়ে চলেছে তাঁর অভিসার। তিনিতো প্রেমসাগরে সকলকে ভাসাতে চেয়েছিলেন। অথচ, কী অবাক, তাঁরই নামাঙ্কিত মন্দিরে বাউল ফকিরদের প্রবেশ নিষেধ। ওরা কোনো ধর্ম মানে না। ওরা খোদার কাছে আর্জি জানায়, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে।

তাহলে? মায়ের সাথে কথা হবে না আমার। লালন ভাবল। একটু পরে বাতাসে ভাসিয়ে দিল তার কণ্ঠস্বর। —মা, প্রথমে ডাকল একটু আলতো করে। মায়ের কানে সে ডাক পৌঁছোল না, পৌঁছোবার কথা নয়। তারপর লালন সাহস আর শক্তি সঞ্চয় করে একটু জোরে ডাকল—মা, মাগো, আমি লালন, তুমি কি একবার আমার কাছে আসবে?

ঘর মুছতে মুছতে পদ্মাবতী বোধহয় কিছু একটা ভাবছিলেন। দিনগত পাপক্ষয়, সকালে সূর্য ওঠে, মন্দিরের কাজ শুরু হয়। বিকেলে সূর্য অস্ত যায়, এবার কাজের ঝাঁপি বন্ধ করতে হবে। দেনাপাওনার হিসাব কষতে হবে। নিঃস্ব রিক্ত পদ্মাবতী আকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকেন। চোখের দৃষ্টি এখন অনেকটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। নানা ব্যাধির প্রকোপ সমস্ত শরীরে। পা ফেলতে গেলে কষ্ট হয়। হাঁপ ধরে যায়। লালনের কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। লালনকে তিনি দশমাস দশদিন গর্ভে ধারণ করেছিলেন। এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন। সাধ্যমতো সেবাযত্ন করেছিলেন। সেই লালন কিনা আজ বিধর্মী হয়ে গেল। যবনের হাতে ভাত খেয়ে জাত খোয়াল। তবুও তিনি তো মা। লালনকে একবার চোখের দেখা দেখতে বড়ো সাধ যায় তাঁর। তিনি জানেন, এজীবনে আর কখনো লালনের সঙ্গে দেখা হবেনা তাঁর। কিন্তু রাধাগোবিন্দ কি আমার কথা শুনবেন না? লালনের সাথে অন্তত একটিবার দেখা না হলে আমি মরণের ওপারে যেতে পারব না। সবসময় আমাকে এক স্মৃতির টানে এখানেই ঘুরতে হবে।

লালন, লালন, তুই কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না? লোকমুখে শুনেছি তোর নাকি খুব নামডাক হয়েছে এখন। মুখে মুখে গান লিখতে পারিস। সুর দিতে পারিস। একতারা বাজিয়ে গাইতে পারিস। তোর নাকি একদল চেলাচামুন্ডা জুটে গেছে। তুই কি একবার আসবি না?

এসব কথাই হয়তো ভাবছিলেন পদ্মাবতী। পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে একটুখানি চমকে গেলেন তিনি। পায়ে পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন। ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন—একী লালন, তুই? আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। মনে হল প্রচন্ড আনন্দ আর উচ্ছ্বাস তাঁকে একেবারে শব্দহীনা করে দিয়েছে।

লালনের ভারি ইচ্ছে করছিল মাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু তাকি সম্ভব? সে জানে এখানে অনেক বাধার লাল নিশান। নিজেকে অনেক কষ্টে সংবরণ করল সে। মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল অনিমিখ—এ কী? মা কোনো কথা বলছে না কেন? তা হলে? সেই বরফজমা অভিমান কি এখনও থেকে গেছে? মা, মাগো—শুধু তোমার সাথে দেখা করব বলে আমি এতটা পথ ছুটে এসেছি। বলো, কী বলার আছে!

মাতৃত্ব বলছে, ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরি। সংস্কার বলছে, তাকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিই। এ এক আশ্চর্য দ্বন্দ্ব। শেষ পর্যন্ত সংস্কার জয়ী হল। মায়ের চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল অবুঝ অশ্রুধারা।

পদ্মাবতী বললেন—লালন, তোকে একবার চোখের দেখা দেখব বলেই বোধহয় আমার প্রাণটা ধুকপুক করছিল। আমি জানি, আর তোর সঙ্গে কখনো দেখা হবে না। এই হয়তো ভালো হল। লোকমুখে আমার মৃত্যুসংবাদ শুনবি। তুইতো বিধর্মী, শ্রাদ্ধশান্তি করবি না। তবে আমার জন্য অন্তত একটা প্রদীপ জ্বেলে দিস, তাতেই আমার আত্মা শান্তি পাবে।

হু হু কান্নার অভিশাপ। সর্বত্যাগী ফকির লালন এবার সত্যিই কেঁদে ফেলল। নাহ, আরও একবার সংস্কার এসে গ্রাস করল তাকে। মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নার অবুঝ উদগীরণ সম্ভব হল না। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সে তার মায়ের দিকে। সত্যি কি এই শেষ দেখা? হয়তোবা। মা হয়তো সব জানতে পেরেছে। তাই এভাবেই তার মনের ইচ্ছের কথা বলে দিল।

শেষবারের মতো রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির দিকে তাকাল লালন। প্রাণটা হাহাকার করে উঠল তার। সিরাজ সাঁইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। লালন বেটা, স্মৃতির টানে কখনো ভাসবি না। জীবনটাকে মনে করবি পদ্মপাতার জল। আজ আছে কাল নেই। এই পৃথিবীতে কে কার?

লালন গান ধরল—

 দিল-দরিয়ার মাঝে

 দেখলাম আজব কারখানা।

 দেহের মাঝে বাড়ি আছে

 সেই বাড়িতে চোর লেগেছে

 ছয়জনাতে সিঁদ কাটিছে

 চুরি করে একজনা।

 দেহের মাঝে বান আছে

 নানা জাতের ফুল ফুটেছে

 ফুলের সৌরভে জগৎ মেতেছে

 কেবল লালনের প্রাণ মাতলো না।

কেউ কেউ উৎসুক হয়ে গান শুনছিল, জানতে চাইছিল তার আসল পরিচয়। মায়ের মুখ থেকে সব কথা শোনার পর অনেকে অবাক হল। এখন গ্রামবাংলায় লালন এক পরিচিত চরিত্র। তার গানের কলি কত ভিখারির কণ্ঠে নিনাদিত হয়। হ্যাঁ, তথাকথিত ভদ্রসমাজে প্রবেশের ছাড়পত্র সে হয়তো পায়নি এখনও, কিন্তু নিম্নবর্গের হাজার হাজার মানুষ তাকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করে। এটাই বা কী কম পাওয়া!

এবার তাকে যেতে হবে। পদ্মাবতীর মনে সাধ ছিল, লালনকে আজ দুপুরের খাবার খাইয়ে দেবেন কিন্তু তা কী করে সম্ভব? মন্দিরের লোকেরা বাধা দেবে হয়তো। মনের ইচ্ছে মনের মধ্যেই মরে গেল। শেষবারের মতো লালনের দিকে তাকালেন তিনি। অনেক আশীর্বাদ করলেন। তারপর? তারপর দূর থেকে মাকে প্রণাম করে লালন তার প্রিয় ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল। অতি দ্রুত ভাঁড়ারা থেকে বেরিয়ে গেল। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকলে সে বোধহয় আর ফকিরি জীবনে ফিরতে পারবে না। সাঁইজীর কাছে শেখা মন্ত্রমালা ভুলে যাবে। এ বড়ো কঠিন জায়গা, একে বলে সংসার। এর পরতে পরতে অমোর রহস্যের হাতছানি। লালনের মনে হল, এই পৃথিবীতে সবথেকে শক্ত বোধহয় সংসার জীবনযাপন করা। তার থেকে অনেক ভালো, কোনো এক সাঁইকে খুঁজে নিয়ে তার শিষ্য হয়ে যাওয়া।

তেইশ

মধ্যরাত। সুসুপ্তির অন্ধকারে মুখ ঢেকেছে ছেঁউরিয়ার এই আখড়া। মানুষজন নিদ্রাদেবীর সাধনায় মগ্ন। শুধু জেগে আছে তিনজন। তাদের চোখে ঘুম নেই, অবশ্য বিভিন্ন কারণে।

প্রথমেই আমরা লালন ফকিরের কথা বলব। সাধনসঙ্গিনী মীরা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার নিশ্বাসে ফুলে ফুলে ওঠা বুকের দিকে নজর পড়ে যাচ্ছে লালনের। কিন্তু সে অত্যন্ত সংযমী পুরুষ। সিরাজ সাঁইয়ের কথা সবসময় মনে রাখে। সিরাজ বলেছিল—সাধনসঙ্গিনীকে কখনও অযথা ব্যবহার করবে না। তাহলে বীর্যক্ষয় হবে। পুরুষত্বে কলঙ্কের দাগ লাগবে। মনে রেখো সে হল তোমার মানবী ঈশ্বরী।

তাইতো মীরার শারীরিক আকর্ষণ লালনকে বিন্দুমাত্র বিভ্রান্ত করতে পারে না। মীরা মেয়েটি বড়ো মায়াবী। মোহিনী আর মীরা—পাশাপাশি দুই কন্যা ষড়রিপুর সমাহার অথচ দুজনের মধ্যে কত অমিল। মোহিনীকে দেখলে মনে হয়, সে বুঝি কালবৈশাখীর ঝড়। যখন আসে সবকিছু তছনছ হয়ে যায়। যা পড়ে থাকে, তাকে আমরা অস্থি-অবশেষ বলতে পারি।

কিন্তু মীরা? সে বুঝি ফাগুনদিনের বসন্ত বাতাস। তার চলার মধ্যে একটা মন রাঙানিয়া ছন্দ আছে। আছে সুখজাগানিয়া উপলব্ধি।

লালন কেন জেগে আছে? মায়ের সঙ্গে দেখা হবার পর মনটা তার মোটেই ভালো নেই। থাকার কথা নয়, হাজার হোক সেতো এক সন্তান। আজ না হয় ফকির বিদ্যার অধিকারী হয়েছে। মুখে মুখে গান বানাচ্ছে, সুর দিচ্ছে। আখড়ার আসর জমে উঠছে।

মাঝে মাঝে নিজেকে দায়বদ্ধ করে লালন। ভাবে, আমি কেন এমন হলাম? কেন ছোট্টবেলা থেকে আমার কণ্ঠে সুর এল? আমার মনের ভেতর এল নানা চিন্তা। আমি কেন মুখে মুখে গান লেখার মতো প্রতিভা অর্জন করলাম? এসব না হলে আমি তো সনাতন কিংবা বিশুর মতো সুখে শান্তিতে সংসার করতে পারতাম। মনে পড়ছে চম্পার কথা। চম্পা নেই, এটা ভাবতে ভালো লাগছে না তার। সেই অন্ধকার রাতে হঠাৎ চম্পাকে দেখতে পেল চোখের সামনে। কী আশ্চর্য! এতগুলো বছর কেটে গেছে কিন্তু সময় চম্পার ওপর বিন্দুমাত্র আচড় কাটতে পারেনি। কোথাও নেই তার বাঘনখের শাণিত আক্রমণ। চম্পা বোধহয় সেই তরুণী যে তার চিকন দেহ-বল্লরীকেই ধরে রেখেছে এক আশ্চর্য সংযমে।

আর জেগে আছে মোহিনী। উথালপাথাল হৃদয় তার। মৃতপ্রায় কাশিমের দিকে তাকালে বড়ো করুণা জাগে তার মনের মধ্যে। এই কাশিমই কিন্তু একদিন তাকে নীল আকাশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। নাহলে আজও তাকে বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের রসুই খানার পাচিকা হয়ে থাকতে হত। সকাল বিকালে নানা কাজে মগ্না। গালে হাত দিয়ে মোহিনী ভাবে, কোনটা আসল জীবন? ছেঁউরিয়ায় এই আখড়া, নাকি বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের প্রাসাদোপম বাড়ি? এই প্রশ্নের জবাব সে কখনো খুঁজে পায় না।

মনের ভেতর ধিকিধিকি জ্বলে বাসনার আগুন আঁচ। লালনকে সে মুঠোবন্দী করতে পারেনি। হয়তো পারত আর একটু প্রগলভা অথবা বেশরম হলে। কিন্তু লালনকে সে সত্যি সত্যি ভালোবাসে। তাইতো লালনের সাধনপথে কোনো বাধার প্রাচীর রচনা করেনি। নিজের হাতে মীরাকে সাজিয়ে দিয়েছে। তুলে দিয়েছে লালনের হাতে। বলেছে—আজ থেকে এ-ই হবে তোমার সাধনসঙ্গিনী।

তাই কি রুদ্ধ ক্ষোভ স্মৃতির দংশন? তাই কি চিত্রিত অভিমান? তাই কি নিরুচ্চার বেদনবোধ? তাই কি সমস্ত রাত জেগে থাকা? মোমের মতো গলে গলে যাওয়া। ধূপের মতো পুড়ে যাওয়া। তাই মোহিনী আজ রাত জাগছে—একা এবং নিঃশব্দে।

বাঘের রোখ আর হায়নার চোখ নিয়ে জেগে আছে আনোয়ার। মাঝে মধ্যে মাথার ভেতর কারা যেন দ্রিমিদ্রিমি মাদল বাজায়। তখন চিরচেনা পৃথিবীটাকে বড্ড বেশি আলাদা বলে মনে হয় তার। মনে হয় তখনই সে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেবে। ধ্বংসের বাঁশী বাজাবে, গাইবে বিদায়ের গান। ভালো লাগে না, ভালো লাগে না এই সুন্দর শান্ত জীবনধারা। আনোয়ার মানেই ধুমকেতু। আনোয়ার মানেই স্ফুলিঙ্গ। আনোয়ার মানেই দারুণ বিশৃঙ্খলা।

আজ রাতে কিছু একটা করতে হবে। অনেকদিন ধরে মনকে প্রস্তুত করছিল আনোয়ার। ভালোমন্দের দ্বন্দ্ব। আশা নিরাশার সংঘাত। না, শেষপর্যন্ত অনেক ভাবতে ভাবতে আনোয়ার স্থির করল প্রতিস্পর্ধীকে পৃথিবী থেকে সরাতেই হবে। নাহলে সে কোনোদিন তার মনের মানুষকে পাবে না।

আনোয়ার টাটকা রমণী চায়। রমণীকে নিয়ে সাধনভজন? এসব ব্যাপারে আনোয়ারের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। সে ছিল এক ঘরামি, আজ ভাগ্যদোষে ফকির লালনের শিষ্য হয়েছে। তার মনের ভেতর সবসময় জ্বলছে আগুন, বাসনা আর কামনার। ওই কাশিমকে পৃথিবী থেকে নিকেশ করতে হবে। তার জন্য যদি খোদাতাল্লাহর দরবারে তার বিচার হয়—সে হাসতে হাসতে ওই বিচারসভায় যোগ দেবে। কী হবে? হয়তো তাকে দোজখের তপ্ত কড়াইতে নিক্ষেপ করা হবে। বীভৎস প্রেতরা তার চারপাশে নাচতে থাকবে। তাহোক, কাশিমকে নিকেশ না করা পর্যন্ত চোখের তারায় ঘুম নামবে না তার।

যে হাঁসুলি দিয়ে সে খড় কাটে, সেটাই তার আত্মরক্ষার অস্ত্র অথবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার যন্ত্র হাঁসুলিটা বের করল। নাহ, গাঁজায় একটু দম দিতে পারলে ভালো হত। নেশাতুর না হলে কেউ কি খুনি হতে পারে? ছিলিম তৈরি করল। ভুরুক ভুরুক গাঁজা টানল। তারপর? ঢুলুঢুলু চোখে বেরিয়ে এল। মরাচাঁদের আলোয় তাকে দেখে মনে হল, সে বুঝি এক জীবন্ত আততায়ী। অথবা শ্বাপদ শয়তান। চলেছে রক্তলোলুপ জিঘাংসায়।

দরজাটা খোলাই ছিল, এখানে এটাই দস্তুর। এখানে কেউ স্বামী-স্ত্রী নয়। এখানে মৈথুনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় না। তবে এখানকার একটা আলাদা সহবত আছে। কেউ কারো ঘরে রাতের অন্ধকারে প্রবেশ করে না। তাই চোখের সামনে মূর্তিমান বিভীষিকাকে দেখে অবাক হল মোহিনী। কী ঘটতে চলেছে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না তার। কী অবাক, সে কিন্তু মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করল না। তাহলে? সেও কি মনে মনে চাইছে কাশিম নিকাশ হোক। তাহলে সে মুক্ত স্বাধীন হতে পারবে। কিন্তু কেন? কাশিম তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে পারেনি, একথা সত্যি, কিন্তু তাই বলে? এখন আমরা মোহিনীকে কি এক পিশাচিনীর ভূমিকায় দেখছি?

তড়াক করে লাফ দিল আনোয়ার। ঝাঁপিয়ে পড়ল কাশিমের বুকের ওপর। আর তখনই, তখনই মোহিনী চিৎকার করল। হয়তো প্রতিবর্ত প্রতিক্রিয়ায়। চিৎকারের শব্দ রাতের ঘনীভূত নৈঃশব্দ্যকে চিরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। লালন বুঝতে পার, সর্বনাশ ঘটে গেছে। সে ভবিষ্যদ্রষ্টা। সে জানত আজ বাদে কাল এ ঘটনা ঘটবেই। একই আকাশের নীচে আনোয়ার এবং কাশিম—দুই পুরুষ কখনো থাকতে পারে না। একজনকে যেতেই হবে। কিন্তু কে? অবশ্যই কাশিম। অতিরিক্ত গাঁজা খেয়ে খেয়ে সে একেবারে মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। নিকেশ করতে বেশি সময় লাগল না। রক্তমাখা হাঁসুলিটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠল আনোয়ার।

বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে ভোলা আর শীতল। অন্য শিষ্যরাও জুটেছে চারপাশে। এখন কী হবে? এখন তো পাইক এসে আনোয়ারকে গ্রেপ্তার করবে। খুনের দায়ে মৃত্যুদন্ড হবে তার?

সব রহস্যের সমাধানের চাবিকাঠি আছে লালন সাঁইয়ের হাতে। তারা তাই লালনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা জানে লালন জাদু জানে। সে নিশ্চয়ই এই ভয়ংকর সমস্যার একটা সমাধান করতে পারবে।

লালন বলল—শোনো, ব্যাপারটা পাঁচকান করো না। তাতে সকলের বিপদ। জানো তো আমরা এখানে জবরদখল করে বসে আছি। পাইক পেয়াদা এলে এই আখড়ার জমি ছাড়তে হবে। আমি বলি কী, একটু থামল সে, তাকাল তার দুই প্রিয় শিষ্য, ভোলা আর শীতল শা-র দিকে। তারপর বলল—ভোলা, শীতল, তোমরা এখনই লাশটাকে গাঙের জলে ভাসিয়ে দাও। দেখো, কোথাও যেন খুনের চিহ্ন না থাকে। আর হাঁসুলিটাও ফেলে দাও জলের মধ্যে। তার আগে আনোয়ারকে পিছমোড়া করে বাঁধো। একদিন তাকে এভাবেই থাকতে হবে। তেষ্টায় ছাতি ফেটে গেলেও তার মুখে একফোঁটা পানি দেবে না। খাবার দেবে না। এটাই হবে তার শাস্তি।

লালন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মনটা মোটেই ভালো ছিল না তার। তার ওপর এই উটকো ঝামেলা। যাবার আগে তাকাল মোহিনীর দিকে। একী? মোহিনীর সমস্ত শরীর থেকে একটা অদ্ভুত আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। সেই অলৌকিক প্রভায় মোহিনীকে ভারি সুন্দরী বলে মনে হচ্ছে লালনের। আরও একবার সংযমের বাঁধ বেঁধে গেল তার। অনুশাসনের বেড়া দিয়ে সেই বাঁধ বাঁধার চেষ্টা করল লালন। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল মোহিনীর কাছে। বলল—মোহিনী, তুমি তো আমার অনেক অনুরোধ রেখেছ। আর একটা অনুরোধ করব, রাখবে?

মোহিনী তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। জিভের ডগায় চুকচুক শব্দ করে বলল—বলো সাঁই, অনুরোধ বলছ কেন? বলো, এ হল তোমার আদেশ। তোমার এখানে আছি। দুবেলা দুমুঠো খেতে পড়তে পাচ্ছি, কেউ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে না, এসব তো তোমারই দান, তুমি যা বলবে, শত দুঃখ হলেও আমি তা পালন করার চেষ্টা করব।

লালন বুঝতে পারল, এ সবই হল মোহিনীর অভিমানের অঞ্জলি। কিন্তু সে কী করবে? সে তো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। সে কি এক রমণী থেকে অন্য রমণীতে যেতে পারে? তাহলে তো সাধনভজনে বিঘ্ন ঘটে যাবে।

সে বলল—মোহিনী, আমি বলি কী, এখন থেকে আনোয়ারের দায়িত্ব তুমি নাও। তুমি ছাড়া কেউ তার পাগলামি ছাড়াতে পারবে না।

চব্বিশ

—ওরা সব তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে লালন।

সদা হাস্যময় লালনের মুখে রহস্যময় হাসি। এইমাত্র প্রভাত সংগীত শেষ করেছে সে। সেই গানের মধ্যে প্রকৃতি তন্ময়তা আর নারীপ্রেম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এবার সামান্য প্রাতঃরাশের আয়োজন। আর তখনই ছপছপাত শব্দ তুলে একটি নৌকো এসে ভিড়ল ছেঁউরিয়ার এই ঘাটে। কাঙাল হরিনাথ স্বয়ং এসেছে। সঙ্গে এনেছে কয়েকজন গণ্যমান্য মানুষকে। তাদের মধ্যে যার কথা প্রথমেই উল্লেখ করা উচিত, সে হল রাজেন মিত্র, ঠাকুর পরিবারের দেওয়ান।

ঠাকুরদের কাছারিবাড়ি শিলাইদহ। ছেঁউরিয়া থেকে খুব একটা দূর পথ নয়। শিলাইদহের পাশ দিয়ে পদ্মা প্রবাহিত। পদ্মার বজরা ভাসিয়ে দিয়ে জমিদারির তদারক করেন ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা। তখন ঘাটে বজরা ভেড়ে, তখন প্রজাদের মনে সে কী আনন্দ। তারা ভিড় করে বজরার চারপাশে। এবার এসেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। যেমন সুপুরুষ চেহারা, তেমনই গুণী মানুষ। ভারি ভালো পিয়ানো বাজাতে পারেন। ছবি আঁকতে পারেন, মনে কোনো অহংকার নেই। এককথায় বলা যায়, তিনি হলেন বিনয়ের প্রতিমূর্তি।

কাঙাল হরিনাথের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল লালন। লালন জানে, কাঙাল তাকে একটু বেশি পছন্দ করে। কেন করে? এ প্রশ্নের জবাব তার জানা নেই। কাঙাল কত বড়ো সাংবাদিক। শহরের গণ্যমান্য মানুষদের সাথে তার ওঠাবসা। সে কেন এইভাবে লালনের কাছে বারবার ছুটে আসে?

কাঙাল বলল—লালন, তোমার ভাগ্য খুলে গেল। স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। তুমি কবে আসবে তাঁর বজরাতে? তিনি যে অপেক্ষায় থাকবেন।

আমন্ত্রণটা অভাবিত। লালন জানে, যে জঙ্গলে তারা এই আখড়া তৈরি করেছে, সেটা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জমিদারি। অন্য কেউ হলে হয়তো এখনই এই প্রস্তাবটা লুফে নিত। হুমড়ি খেয়ে পড়ত জমিদারবাবুর চরণে। আবেগ গদগদ কণ্ঠস্বরে বলত—বাবু, আমি আপনার খাসতালুকের প্রজা। দেখবেন, আমার ভিটেমাটি যেন নষ্ট না হয়। অনেক কষ্টে এই আখড়াটা গড়ে তুলেছি। আপনি তাড়িয়ে দিলে আমরা কোথায় যাব?

লালন একেবারে অন্য ধাতের মানুষ। সে কখনো কারো কাছে কিছু চাইতে পারে না। মাথা নোয়ায় না। সহজ সরল জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী। সে জানে, পৃথিবীটা ঈশ্বরের জমিদারী। এখানে মানুষ নিমিত্তমাত্র। এই যে বিশাল অরণ্য যেখানে বর্ষার দিনে বৃষ্টির রিমঝিম গান শোনা যায়, বসন্ত এলে ফুলেরা রঙিন হয়ে ওঠে, রঙিন প্রজাপতি ওড়ে—তার আসল মালিক কে? তার মালিক হলেন ওই আল্লাহ বা ভগবান। আর আমরা, এইসব জমিদারের দল, বোকার মতো ওই অরণ্যের ওপর আমাদের স্বার্থ কায়েম করার চেষ্টা করি। আমরা কি জানি, জীবন কত ক্ষণস্থায়ী? কেউ কি বলতে পারে, আগামীকাল সকালে আমি বেঁচে থাকব কিনা? তাহলে কেন এই মিথ্যা অহংকার? কেন এই গৌরবগাথা উচ্চারণ?

সঙ্গে আর যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা কৃতবিদ্য পুরুষ। মীর মশাররফ হোসেন আবার এসেছে। লালন সম্পর্কে কিছু লিখতে চাইছে, তার সম্পাদিত পত্রিকাতে। লালনের মুখ থেকে শুনতে চাইছে ফেলে আসা দিনযাপনের স্মৃতিচারণ। কিন্তু লালন সহজে মুখ খুলতে চাইছে না। নিজের কথা সে কাউকে শোনাতে চায় না। সে নিজের চারপাশে এক বেড়া রচনা করেছে। সেই বেড়ার মধ্যে দিয়ে সূর্যালোক ঢুকে পড়বে—এটা তার খুবই অপছন্দের ব্যাপার। লালন জানে, তাতে সাধনায় বিঘ্ন ঘটে। সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে সে যদি বিকিয়ে যায়, তাহলে ফকিরি বিদ্যার অবক্ষয় ঘটে যাবে। সিরাজ সাঁইয়ের কথা সবসময় মনে পড়ে লালনের। কথায় কথায় সিরাজ সাঁই বলেছিল—নিজেকে লুকিয়ে রাখবি। গ্রহণ লাগা চাঁদের মতো। দেখিস কেউ যেন তোর আসল পরিচয়টা না পায়। তবে দু-চারজনের কাছে এই মন্ত্রগুপ্তির শপথ শুনিয়ে রাখবি। নাহলে তোর ইন্তেকালের পর কে তোর এই কাজের দায়িত্ব নেবে?

লালন বলল—বাবুমশাই, আপনারা বড্ড উদার। আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। আমার সঙ্গে কথা বলে কী রস পাবেন আপনি?

তবু ছাড়বে না মীর মশাররফ হোসেন। অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করল। অনেক কথা জেনে নিল। এইসব কথাগুলি সাজিয়ে যে এক প্রতিবেদন লিখবে তার সম্পাদিত পত্রিকায়। মীরসাহেবের বড়ো ইচ্ছা, লালনের প্রতিভার কথা যেন শহুরে পাঠকরা জানতে পারে। লালন এই ব্যাপারে খুবই নিরুৎসাহী। সে জানে, এখানে বেশি ভীড় হলে সাধনভজনে ব্যাঘাত ঘটে যাবে। পিলপিল করে মানুষ যদি আসতে থাকে, তাদের আতিথেয়তার বন্দোবস্ত করতে হবে। সেও এক মহা-ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার।

লালনের মনোভাব বুঝতে পেরেছে কাঙাল হরিনাথ। কাঙাল বলল—লালন, তুমি কিছু ভেবো না, এখন থেকে তোমার মাসোহারার বন্দোবস্ত হবে। আমাদের জমিদার সুদর্শন রায়চৌধুরী অত্যন্ত ভালো মানুষ। তিনি তোমার গানের এক সমঝদার। তাঁর কাছে আমরা দরবার করেছিলাম। নিজের চোখে তো দেখতে পাচ্ছি, কী দুরাবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে তোমাদের। ফকিরি বিদ্যে করে কি জীবন চালানো যায়? উনি রাজী হয়েছেন। মাসে মাসে কিছু টাকা মাসোহারা হিসাবে উনি পাঠিয়ে দেবেন তোমার হাতে। আশা করি এরপর থেকে আর কোনো অসুবিধা হবে না।

কাঙাল হরিনাথ বাস্তববোধ সম্পন্ন মানুষ। সে চাইছে জীবনের চলার পথে লালনের যেন কোনো অসুবিধা না হয়। লালনকে কেন্দ্র করে বিরাট এক সংগঠন গড়ে উঠেছে। এখানে হিন্দু মুসলমান সকলেই সদস্য হতে পারে। মানুষকে ভালোবাসতে হবে, মনের মানুষ খুঁজে নিতে হবে, কারো প্রতি হিংসাদ্বেষ করা চলবে না—এ হল লালন ধর্মের মূলনীতি। লালন মানবতার ধর্মে বিশ্বাস করে। তার কাছে হিন্দু অথবা মুসলমানের আলাদা কোনো স্থান নেই। সে জানে, এই পৃথিবীতে আমরা সবাই মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করি। কুচক্রী কিছু লোক আমাদের কপালে ছাপ মেরে দেয়। বলে, তুমি হিন্দুর ঘরের বিধবা, তুমি মুসলমান ঘরের কন্যা, তোমরা একে অন্যের মুখ দর্শন করবে না। তোমাদের জাত আলাদা, ধর্ম আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা। বয়েত আলাদা, তোমরা বুঝি দুইগ্রহের বাসিন্দা।

লালনের জেহাদ এই পচাগলা সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। লালন জানে, এ হল নেহাতই আহাম্মকি অহংকার। শেষ অব্দি এই জেহাদের কতখানি থাকবে, আর কতখানি কর্পূরের মতো উবে যাবে, সে জানে না। তবু লালন কারো সাথে আপোস করবে না। মাথা নত করবে না। যদি সে শেষ পর্যন্ত কোথাও যায়, তাহলে মাথা উঁচু করে তার মতবাদের কথা সকলকে শোনাবে। লালনের স্থির বিশ্বাস, প্রতিটি মানুষের মনে এই জাতীয় চিন্তাধারা জন্ম হয়। কিন্তু উপযুক্ত গুরুর সন্ধান না পেলে, মানুষ তার চিন্তাধারাকে পরিপুষ্ট করবে কীভাবে? তাই এসব লোকেরা বিষয়বুদ্ধির মধ্যে থাকতে বাধ্য হয়। লালনের মতো একজন মুরশিদ থাকলে হাজার হাজার মানুষ অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারত। তাই বোধহয় কাঙাল হরিনাথ আন্তরিকভাবে চাইছে লালনের জন্য কিছু একটা করতে। এমনকিছু যা, লালনের পায়ের তলার জমিকে শক্ত ভিটের ওপর দাঁড় করাবে। লালনের চারপাশে নিরাপত্তার ব্যূহ রচনা করবে। না হলে লালন মনের সুখে সাধনভজন করবে কেমন করে?

কাঙাল হরিনাথ ফকিরিবিদ্যা সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছে। সে বুঝতে পেরেছে, এ বিদ্যা আয়ত্ত করা সহজ নয়। মনঃসংযোগ দরকার, ধ্যানমগ্ন প্রহর কাটাতে হবে। তবেই আমরা নিজের মধ্যে ঈশ্বরকে অস্তিত্ব অনুভব করতে পারব। এ বড়ো কঠিন উপলব্ধি। পাতার পর পাতা লেখা সম্ভব, ঘন্টার পর ঘন্টা ভাষণ দেওয়া সম্ভব, কিন্তু সত্যি সত্যি ঈশ্বরের সান্নিধ্য—উপলব্ধি করা? নাঃ, ব্যাপারটা খুব একটা সহজ নয়। তবে কাঙাল হরিনাথের স্থির বিশ্বাস, আজ অথবা কাল হোক লালন একদিন ওই সাধনমার্গে পৌঁছোতে পারবে। তার ওপর ভগবানের অশেষ করুণা অবিরাম বৃষ্টিধারার মতো ঝরে পড়ছে।

পঁচিশ

বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা হব হব, লালন এখন সন্ধ্যাবন্দনায় বসবে। গানে গানে ভুবন ভরাবে। গান ছাড়া আর কীই বা আছে তার যা সে তুলে দেবে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের পায়ে?

আচমকা ডাকটা শুনে থমকে থেমে দাঁড়াতে বাধ্য হল লালন। একী? মীরা, তুমি? আহা, কী সুন্দর সজ্জায় সাজিয়েছ নিজেকে। মীরাকে দেখে ভারি অবাক লাগল লালনের। সহসা মীরা নিজেকে সাজায় না। সে অসম্ভব সুন্দরী, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আজ সারা অঙ্গে অলংকার পরেছে। বিয়ের অলংকার, যা নিয়ে সে জ্বলন্ত চিতার আগুনে মরতে বসেছিল। কপালে সুন্দর করে সিঁদুরের টিপ এঁকেছে। লাল টকটকে সিঁথি, মনে হচ্ছে সে বুঝি সালংকারা এক নববধূ। এখনই সাতপাকের বাঁধনে তাকে বেঁধে ফেলা হবে। সে শুরু করবে এক আনন্দিত দাম্পত্য জীবন।

তার ডাকের মধ্যে কী এক অদ্ভুত কুহকমায়া লুকোনো ছিল, লালন যেতে পারল না, ফিরে আসতে বাধ্য হল। মুখোমুখি বসল মীরা। মীরার চোখ থেকে একটা অদ্ভুত বিপন্নতা ঝরে পড়ছে। মীরা মুখ নামাল। বলল—সাঁই, আমি কী অপরাধ করেছি তোমার কাছে? তুমি তো আমাকে ওদের মতো ভালোবাসো না।

ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। সত্যিই তো লালন কেন এ ধরনের আচরণ করে মীরার সঙ্গে? মীরাকে কি তার পছন্দ হয়নি? মীরা বুঝতে পারে, মোহিনীর প্রতি চাপা অভীপ্সা আছে লালনের। মোহিনীকেই সে হয়তো সাধনসঙ্গিনী করতে চেয়েছিল। মাঝখানে থেকে মীরা জুড়ে বসেছে। নিজের ওপর ভীষণ-ভীষণ বিতৃষ্ণা হয় তার।

আজ সে শেষবারের মতো লালনের মন ভোলানোর চেষ্টা করবে। তাই তো এখানে এই প্রথম আবার সালংকরা করল নিজেকে। টিপ পরল। সিঁদুরের চিহ্ন আঁকল তাঁর সিঁথিতে। অপরূপা সাজে সজ্জিতা হয়ে এসে বসল লালনের চোখের সামনে। আসন্ন সন্ধ্যার বাতাসে ভাসিয়ে দিল তার সুরেলা কণ্ঠস্বর। তাকে এই অবস্থায় দেখে লালন কেমন যেন হয়ে গেল। লালন বুঝতে পারল, এই অভিমানী মেয়েটির মান এখনই ভাঙাতে হবে। আখড়ার পরিস্থিতি ভালো নয়। কাশিমের মৃত্যুর পর চারপাশটা থমথম করছে। আগেকার মতো সেই আনন্দের পরিবেশ হারিয়ে গেছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারই মধ্যে রণপায়ে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই লেঠেলদের দল। সারাদিন লাঠির ঠোকাঠুকি শব্দ শোনা যাচ্ছে। এ কী আখড়া, না রণক্ষেত্র? মাঝেমধ্যে নিজেকে প্রশ্ন করে লালন। উত্তর খুঁজে পায় না।

এমনই একটা আখড়া সে কি তৈরি করতে চেয়েছিল? না, তাতো সে চায়নি। সে চেয়েছিল অরণ্য-অভ্যন্তরে নির্জনে নিরালায় ঈশ্বরের সাধনভজন করতে। গানে গানে ভুবন ভরাতে। আজ কেবলই মনে হচ্ছে লালনের, এ বোধহয় তার অধঃপতন। কোথা থেকে কোথায় এসে পৌঁছে গেছে সে। অনেকে তাকে সুফী সাধকের মর্যাদা দিচ্ছে। অনেকে দূরদূরান্ত থেকে আসছে রোগাক্রান্ত শিশুকে কোলে করে। লালন কি এক অলৌকিক মানুষ নাকি, সে তো খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। কিছু গান গাইতে পারে, সুর দিতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে অলৌকিক শক্তি বলে কিছু নেই। লালন জানে না, কবে এই খাঁচা থেকে মুক্তি পাবে। কবে নীল আকাশের বুকে ভেসে যাবে মুক্ত বিহঙ্গের মতো।

তার ওপর মীরার এই আহত অভিমান। লালন বলল—শোনো মীরা, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। তুমি আমার সাধনসঙ্গিনী। তোমার মধ্যে কখনও আমি আমার মাকে প্রত্যক্ষ করি। আবার কখনো মনে হয় তুমি আমার জন্ম-জন্মান্তরের প্রেমিকা। আবার কখনো মনে হয় তুমি আমার আত্মজা, তুমি আমার কন্যা। প্রত্যেক নারীর মধ্যে এই তিনভুবনের খেলা দেখতে পাওয়া যায়। তাইতো শাস্ত্রে বলে, নারী সবথেকে রহস্যবতী। এই রহস্যের কোনো শেষ নেই।

ঠোঁট উলটে মীরা বলল—এসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না, সাঁই। তুমি কি জানো না আমি কী চাই? আমি এসব তত্ত্বকথা বুঝি না। সাধনভজন বুঝি না। আমি শুধু তোমাকে চাই। এই দেখো, আমার দিকে তাকিয়ে। আমি কি মোহিনীর থেকে কম সুন্দরী? আমার মধ্যে কি কোনো আলাদা আকর্ষণ নেই? একবার ভেবে দেখতো, কী পেলাম আমার যৌবনদিনে? দাদুর বয়সী একজনের সঙ্গে বিয়ে হল, দাম্পত্য সুখ বলতে কী বোঝায়, তা কখনো জানতে পারলাম না। বরটার মরণ হল, আমাকে জ্বলন্ত চিতার আগুনে পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র করা হল। তখন কেন আমাকে বাঁচালে? কেন আমাকে এখানে নিয়ে এলে? বলো বলো সাঁই, বলো, আজ তোমার মুখ থেকে সবকথা আমি শুনব। নাহলে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করব, এই তোমায় শেষ বলে রাখছি।

লালন আঁতকে উঠল। লালন জানে, এসব অভিমানী মেয়েদের কাছে জীবন বুঝি শীতবাতাসের শিমূল তুলো, যখন তখন জীবন অবসান ঘটাতে পারে তারা। সে জানে, এখন অনেকটা সময় তাকে এখানে বসে থাকতে হবে। শান্ত করতে হবে ওই রণরঙ্গিনী মূর্তিকে। লালন তাকাল মীরার চোখের তারায়। কী চাউনি ভেসে আসছে সেখানে থেকে? চিরন্তন ভালোবাসার আকুতি। ইচ্ছে হলে সে এখনই মীরাকে আদরে আদরে প্লাবিত করতে পারে। মীরা তার সাধনসঙ্গিনী, কেউ বাধা দেবে না, কেউ আঙুল তুলে শাসাবে না, নিষেধের বেড়া রচনা করব না, কিন্তু কী আশ্চর্য! মীরার সান্নিধ্যে লালনের সমস্ত শরীর পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। আবেগের মৃত্যু ঘটে। কেন? তার উত্তর লালন জানেনা।

তবে কি সে মোহিনীকেই ভালোবাসে? যদি ভালোবাসে, তাহলে সেকথা মুখ ফুটে বলতে পারে না কেন? তার জীবনে তিনজন নারী এসেছে। চম্পা, মোহিনী এবং মীরা। তিনজন বুঝি তিন আলাদা জগতের বাসিন্দা। কারো সাথে কারো মিল নেই। এই তিন নারী নানাভাবে লালনকে বিভ্রান্ত করেছে। প্রতারিত করেছে। লালনের মনে হচ্ছে, কবে আমি এই নারীসঙ্গ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারব? কিন্তু নারীসঙ্গিনী না থাকলে সাধনভজনের পথে সিদ্ধিলাভ তো হবে না। সাঁই, আমাকে বলে দাও, তুমি আমায় একী উভয় সংকটের মধ্যে এনে ফেললে। কীভাবে এই সংকট থেকে আমি মুক্তি পাব? বলো, বলো সাঁই, বলো?

আর তখনই লালনের মনের আকাশে বজ্রপাত। সিরাজ সাঁই-এর উদাত্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে। —কী বোকার মতো কথা বলছিস, তুই না পুরুষ। তোর হাতে বিশ্ববিধাতা পৃথিবী জয়ের চাবিকাঠি তুলে দিয়েছে। তুই বীর্যবান, তুই তোর পৌরুষত্ব দিয়ে মীরাকে বশ কর। মীরা তোর জন্ম-জন্মান্তরের সঙ্গিনী। একথা মনে রাখিস, আমার আশীর্বাদ রইল।

লালন চোখ খুলল, অন্য দৃষ্টিতে তাকাল মীরার চোখের দিকে। ভাবল, মীরাকে আজ এক নববধূ হিসাবে ভাবলে কেমন হয়?

লালন বলল—শোনো মীরা, তুমি জানো না, তুমি কে? তুমি হলে আমার মনের মানুষ, তোমার সাথে আমার মিলন হবে, এ হল বিধির বিধান। আমরা কেউ তা অগ্রাহ্য করতে পারব না। আমি জানি, সারাজীবন তোমাকে কত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। এখন থেকে তুমি আর কষ্ট পাবে না। কখনো আত্মঘাতিনী হবার কথা চিন্তা করবে না। এই দেহ হচ্ছে খোদাতাল্লার মসজিদ, আমার মনের মানুষের মঞ্জিল। কখনো দেহকে কষ্ট দেবে না। দেহকে কষ্ট দিলে খোদাতাল্লা কষ্ট পাবেন। আশা করি আমার এই কথাটা তুমি মনে রাখবে।

লালন এগিয়ে এল, দরজাটা ভেজিয়ে দিল। মীরার মাথায় হাত রেখে বলল—পাগলি মেয়ে, অমন করে কী কাঁদতে আছে? আয়, তোকে আমি আমার মনের কারবারি করি। তোর জন্যই তো আমি একতারা বাজিয়ে সুর তুলি। গান লিখি, তুই কি বুঝতে পারিস না? ঠিক আছে, কথা দিলাম, এখন থেকে তোকে আর কখনও কষ্ট দেব না।

অবশেষে এক কাঙ্ক্ষিত মিলন মুহূর্ত। মীরার চোখের দিকে চোখ রেখে লালন বলল—তুমি আমার ফকিরানি, তুমি আমার ব্রহ্মাণী, আমার ভৈরবী, আমার বৈষ্ণবী, তোমার মধ্যে কখনও আমি আমার খোদাতাল্লাহকে খুঁজে পাই। আবার কখনও মনে হয় তুমি হলে আমার রাধিকা। তুমি আমার দিব্যপথের ধ্রুবতারা। আমায় কখনও ভুল বুঝো না কেমন?

মীরা অবাক হল। সে জানত না, লালনের মধ্যে এমন একটা অনুভবী মন লুকিয়ে আছে। লালনকে সে পাষণ্ডপুরুষ বলে ভেবেছে। লালনের আচরণের মধ্যে লৌহকঠিন আবরণ। লালন যে এভাবে ভেঙে পড়তে পারে, প্রেমের কাঙাল হতে পারে, এই পরিচয়টা পেয়ে মীরা খুশি হল। মীরা লালনকে আঁকড়ে ধরে শুয়েছিল। ধীরে ধীরে রাত নামল, গভীর থেকে গভীরতর হল অন্ধকার। তবুও ওরা কেউ কাউকে ছাড়তে পারল না। মীরা জানে, এমন অলৌকিক রাত জীবনে খুব কমই আসে। সেই রাতকে পূর্ণাঙ্গভাবে গ্রহণ করতে হয়। প্রতিটি প্রহরকে উপলব্ধি করতে হয়। ভাবতে হয়, এই রাতে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মনে একশো সূর্যের উদয় ঘটে যায়। মানুষ নিজেকে চিনতে পারে। আর তাইতো, লালনের বুকের মাঝে নিজেকে নিঃশেষে সমর্পণ করে মীরা সত্যি সত্যি বুঝি স্বর্গলোকের বাসিন্দা হয়ে গেল। এই জীবনের সকল শোক, সকল সন্তাপ, সকল দুঃখের অবসান ঘটে গেল।

যখন ভোর হল, অলৌকিক সূর্যোদয় দেখতে দেখতে মীরা নিজেকে পৃথিবীর সুখীতমা রমণী বলে ভাবল। পাশে ঘুমিয়ে থাকা লালনের দিকে স্নেহার্দ্র চোখে তাকাল সে। আহা, লালনকে মনে হচ্ছে, সে বুঝি মীরার আত্মজ। অনেকদিন ধরে গর্ভধারণ করে তার লালনকে পৃথিবীতে এনেছে সে। লালনের দিকে তাকাল। হাত বুলিয়ে দিল তার সর্বাঙ্গে। না, মনের অরণ্যে আর কামনার দাউদাউ আগুনশিখা জ্বলছে না। এখন সেখানে প্রবাহিত হচ্ছে স্নেহের ঝরণা। সেই ঝরণা এখন তার সমস্ত দহনদগ্ধ জ্বালাকে প্রশমিত করবে। সিক্তা মীরা এক নতুন উপলব্ধির সন্ধান পারে। সে বুঝতে পারবে, ভালোবাসার আসল অর্থ কোথায় লুকিয়ে আছে? শরীর না মনে!

ছাব্বিশ

এত বৈভব? এত ঐশ্বর্য? আভিজাত্যের উজ্জ্বল উদ্ধার!

সুসজ্জিত বজরায় প্রবেশ করে অবাক হয়ে গেল লালন। এর আগে কেউ তাকে এমন সমাদর করে ডেকে আনেনি। নিজেকে বড়ো ভাগ্যবান বলে মনে হল তার। অবশ্য লালন এসব জনপ্রিয়তার তোয়াক্কা করে না। আজ ভাগ্যদোষে নানা জায়গাতে তাকে অবতীর্ণ হতে হচ্ছে। কোথাও ঘোষণা করা হচ্ছে, সে হল ঈশ্বরের সাক্ষাত অবতার। কোথাও বলা হচ্ছে সে নাকি ভবিষ্যদ্রষ্টা। চোখ বন্ধ করলে বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যৎ—সবকিছু দেখতে পায়। এসব প্রচারে বিরক্ত হচ্ছে লালন। কিন্তু কী করবে?

অবশ্য আজকের আমন্ত্রণের অন্তরালে আন্তরিকতার পরশ আছে। কাঙাল হরিনাথ বলেছিল, বাবু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তোমার গানের গুণগ্রাহী। তাঁর সঙ্গে একবার আলাপ হলে বুঝতে পারবে, জন্মসূত্রে তিনি হয়তো জমিদার, কিন্তু তাঁর মনটা শিশুর মতো সরল। দুচোখের তারায় অসীম কৌতুহল মাখা। তার আমন্ত্রণ কখনো উপেক্ষা করো না। তিনি সত্যি সত্যি তোমার গান শুনতে আগ্রহী।

অবশেষে আমন্ত্রণ পত্রখানি এল। জমিদার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন— লালন ফকির, আমি আপনার গানের গুণগ্রাহী। আগামী পরশু সকালে যদি আমার বজরাতে আসেন, তাহলে দুজনে মিলে নিভৃতে বসে একটু শাস্ত্র আলোচনা করতে পারি। শুনেছি বিভিন্ন শাস্ত্রে আপনি সুপন্ডিত। আপনার মুখনিঃসৃত মধুর বচন শোনার জন্য আমি আগ্রহী। এছাড়া, আপনার গান, তা হবে উপরি পাওনা। আশা করি, আপনি আমার এই নিমন্ত্রণ রক্ষা করবেন।

পত্রবাহককে লালন জানিয়ে দিয়েছিল, অবশ্যই সে আসবে। জমিদারের তরফে একটি নৌকো পাঠানো হবে লালনকে নিয়ে আসার জন্য। এসব আড়ম্বর লালন মোটেই পছন্দ করে না। কিন্তু কী আর করবে? দুই প্রিয় শিষ্য, শীতল আর ভোলাকে নিয়ে বজরায় এসে প্রবেশ করল। দোতলা বজরা, আধুনিক জীবনযাপনের সমস্ত সুযোগ সুবিধা রয়েছে সেখানে। যে ঘরে বাবু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসবাস, ঘরখানা প্রশস্ত। চারপাশের জানলা দিয়ে পদ্মা দেখা যাচ্ছে। এমন অপূর্ব নৈসর্গিক শোভার মধ্যে দাঁড়িয়ে লালন গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠল—

 আমি একদিনও না দেখলেম তারে।

 আমার বাড়ির কাছে আরশীনগর

 পড়শী বসত করে।

 গ্রাম বেড়ে তার অগাধ পানি

 ও তার নাই কিনারা

 নাই তরণী পারের।

 মনে বান্দা করি দেখবো তারে

 কেমনে সে গাঁয়ে যাই রে।

 কি কবো পড়শীর কথা

 ও তার হস্তপদ স্কন্ধ মাথা

 নাই রে।

স্তব্ধ বিস্ময়ে তার গান শুনছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। গান শেষ হল। তিনি বললেন—সাধু সাধু। তারপর বললেন, আসুন লালন ফকির, এখানে বসুন, অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল, আপনাকে চাক্ষুষ দেখব। আজ দেখলাম, জীবনটা আমার ধন্য হয়ে গেল।

লালন বুঝতে পারছে এসব জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তরের অভিব্যক্তি। মুখের সাজানো বুলি নয়। এই পৃথিবীর সব জমিদারই একসূত্রে গাঁথা নন। এমন অনেক জমিদার আছেন, যাঁরা সংস্কৃতির গুণগ্রাহী। তাঁদের মধ্যে অবশ্যই এই বাবু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থান।

তারপর সুস্বাদু আহার্য এল। এল পানীয়। তৃপ্ত হল লালন ফকির। অবশ্য এইসব শাহরিক উন্মাদনার জন্য সে মোটেই আগ্রহী নয়। তার অনেক ভালো লাগে মোহিনীর হাতে দৈরি করা ওই হবিষ্যি। ঘুরে ঘুরে পথেপ্রান্তরে এখানে সেখানে তারা যে ভিক্ষে পায়, তাই দিয়েই রান্না শেষ করে। সেই খাবারের মধ্যে একটা আলাদা পরিতৃপ্তি আছে। —তাই তৃপ্তির ঢেঁকুর ওঠে।

অথচ, এত আয়োজন? সবই আমার জন্য—ভাবতে কেমন লাগছে লালনের। সমস্ত শরীরে শিহরণ।

তারা মুখোমুখি বসল। সাদা মতো একটা কাঠি বের করে তার হাতে দিলেন বাবু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বললেন অগ্নিসংযোগ করে খেয়ে দেখুন, ভালো লাগবে, মনটা তরতাজা হয়ে যাবে।

গাঁজা ছাড়া অন্য কোনো নেশায় কখনো আসক্তি ছিল না লালন ফকিরের। তাও সে নিয়মিত গঞ্জিকা সেবন করে না। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হলে খায়। মাথাটা খোলতাই হয়ে যায়। পৃথিবীটাকে অন্যরকম মনে হয়। মনে হয় চেনা মানুষগুলো বোধহয় মুখের ওপর অচেনার মুখোশ পড়েছে এখানে এই আগুনকাঠিতে টান দিয়ে বেশ ভালোই লাগছে লালন ফকিরের। ফুকফুক করে ফুঁকতে লাগল সে। ঘরটা সুগন্ধিত ধোঁয়ায় ভরে গেল।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মুখে প্রত্যয়ী হাসির ছাপ। উনি বললেন—ব্রিটিশদের তৈরি করা, একে সিগারেট বলে, দারুণ চল হয়েছে, দেব নাকি এক প্যাকেট?

লালন হেসে বলল—না, মাফ করবেন, বাবুসাহেব। আমি যেখানে থাকি, জঙ্গলের মধ্যে, সেখানে এসব পাব কোথায়? একবার নেশা ধরে গেলে আর ছাড়ান দিতে পারব না।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন—আচ্ছা ফকির সাহেব, আপনি যে ধর্মমত প্রচার করেন, তাতে নাকি হিন্দু-মুসলমানের মিলনের কথা বলা হয়েছে। আপনি কি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করুন যে, এই দুই জাতির মধ্যে মিলন সম্ভব?

চোখা প্রশ্ন। লালন একটু হাসল। তারপর বলল—দেখুন, আমি ব্রাত্য সমাজের মানুষ। নিম্নবর্গের প্রতিনিধি, আপনারা যারা লেখাপড়া শিখেছেন, তাঁদের ধারণার সঙ্গে আমাদের ধারণা মিলবে না কোনোদিন। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে কোনো তফাত নেই। আমরা সবাই একই ঈশ্বরের সৃষ্টি। কিন্তু মোল্লা আর বাউল পন্ডিতরা এই তফাতটা তৈরি করেছে। কেন জানেন? নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এভাবে তারা এক জাতকে অন্য জাত থেকে আলাদা করতে চাইছে। আমার স্থির বিশ্বাস, একদিন এই বিভেদ বিভাজন কোথায় হারিয়ে যাবে। সেদিন আমরা সবাই মানুষ নামে পরিচিত হব।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অবাক হলেন। গ্রাম্য ফকিরের মুখে সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী! লালন সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছিলেন তিনি। আজ চোখের সামনে লালনকে দেখে শ্রদ্ধা ও বিস্ময় অনেক গুণ বেড়ে গেল।

ঠাকুর পরিবারের সন্তান হলে কী হবে, স্বভাবের দিক থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একেবারে অন্য গ্রহের বাসিন্দা। বিষয় বৈভবের দিকে খুব একটা নজর নেই। প্রতিকৃতি আঁকতে ভালোবাসেন। যেখানেই যান নতুন মানুষের সাথে কথা বলেন। তাদের সুখদুঃখে অংশ নিতে চান। তাই তো, এখানে, পদ্মানদীতে ভাসমান এই বজরাতে, লালন ফকিরকে দেখে যথেষ্ট আশ্চর্য হয়েছেন তিনি। তাঁর একান্ত ইচ্ছা, একবার ছেঁউরিয়ার আখড়াতে যাবেন। মাথার ওপর কাজের চাপ। এত বড়ো জমিদারির ধকল তাঁকে সইতে হচ্ছে। তবুও তিনি একদিন যাবেনই, অত্যন্ত জেদিস্বভাবের মানুষ।

অনেকক্ষণ গল্প হল দুজনে। একজন নব্য সংস্কৃতির প্রতীক। রেনেসাঁসের আলোয় উদ্ভাস। অন্যজন গ্রাম্য লোকায়তশিল্পকে বুকের পাঁজরের মধ্যে ধরে রেখেছে। আধুনিকতা কাকে বলে সে জানে না। তবু তাকে কেন্দ্র করে এত মানুষের উন্মাদন। একী কম কথা?

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সবরকম আশ্বাস দিলেন। ছেঁউরিয়ার যে আখড়ায় লালন ফকির বসবাস করে, তার জন্য কিছু বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মাধুকরী অবলম্বন করে কি দিন চালানো যায়? লালন সেখানে যে শুধু শিষ্যশিষ্যাদের জন্য অন্নের সংস্থান করে তা নয়, অনেক অনাথ আতুর ছেলেদেরও সে দুবেলা দুমুঠো খেতে দেয়। মস্ত বড়ো তার হৃদয়। লালনকে দেখে সত্যি শ্রদ্ধা জাগে মনের মধ্যে।

এবার লালনকে বিদায় নিতে হবে। নৌকো তৈরি ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নির্দেশে মাঝিরা লালনকে নিয়ে চলল ছেঁউরিয়ার পথে। আবার একদিন আসতে হবে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের একান্ত ইচ্ছা, তিনি লালনের প্রতিচ্ছবি আঁকবেন। জীবন আরও অভিজ্ঞ হবে। আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরিয়ে গেল লালন ফকির।

সাতাশ

কোনো কিছুই আজকাল আর ভালো লাগেনা মোহিনীর। এই যে জীবন, বহমানা এক তটিনীর মতো—এই জীবনযাপন করে কী লাভ? ইদানিং এই প্রশ্নটা বেশি করে তাড়া করছে তাকে। অথচ, মোহিনী জনম দুখিনী হলেও সবসময় হাসিখুশিতে থাকতে ভালোবাসে। তাকে দেখে বোঝা যায় না, তার অন্ধ অতীতটায় এত কলঙ্ক লেগে আছে। সত্যিই তো, এই জীবন-নাটকে তাকে বিয়োগান্ত ভূমিকায় অভিনয় করতে হচ্ছে। এতে তার দোষ কোথায়? যদি কখনো সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে দেখা হত, তাহলে মোহিনী জানতে চাইত কী অপরাধে। তাকে এত শাস্তি ভোগ করতে হল। ব্রাহ্মণ ঘরের কন্যা, দরিদ্রতা নিত্য সহচর, উপযুক্ত পাত্রের সম্মান কি পাওয়া গেল না?

বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের পাচিকা হিসাবে দিনগুলো বেশ কাটছিল। হঠাৎ কোথা থেকে বিপর্যয় ঘটে গেল। সর্বনাশা সংকেত। মাঝরাতে যবনের সঙ্গে ঘর ছাড়ল মোহিনী। গ্রামের লোকেরা হয়তো পিটিয়ে মেরে ফেলত। কোথা থেকে দেবদূতের মতো এসে হাজির হল লালন ঠাকুর। তাকে দেখে মোহিনীর মন হয়ে উঠল উন্মন। লালনকেই সে এ জীবনের প্রেমিক করে বেছে নিতে চেয়েছিল। হতে চেয়েছিল লালনের সাধনসঙ্গিনী। কতবার, আভাসে ইঙ্গিতে একথা জানিয়েছে লালনকে। কিন্তু লালন কী এক অজ্ঞাত কারণে তাকে দূর থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তবুও ভাবতে ভালো লাগে, কাছে আসার সেই সংক্ষিপ্ত প্রহরগুলিকে। শরীরে শরীর মিশে গেলে কোথায় যেন জলতরঙ্গ বেজে ওঠে। কে যেন উদাত্ত কণ্ঠস্বরে গায় দেহতত্ত্বের গান।

লালনের সাথে কিছু কথা আছে মোহিনীর। কখন সময় হবে লালনের। ইদানিং সে নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। যখন তখন ডাক আসে তার। যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে লালন এখন। জমিদারবাবুরা আবদার করে, গান শোনাতে। কেউ কেউ বলে, গান শুনলে এত টাকা উপহার দেবে। লালন এইসব প্রলোভন এড়িয়ে চলতেই ভালোবাসে। সে মনের তাগিদে গান গায়। প্রকৃতির বিশালতার মধ্যে দাঁড়িয়ে। তার গানকে কি টাকা আনা পাইয়ের খাতায় বন্দী করা যায়?

যারা তার গানের সমঝদার তাদের কাছে লালন নিজেই চলে যায়। কোনো নিমন্ত্রণের ধার ধারে না। তাইতো লালনকে কাছে পাচ্ছে না মোহিনী। মনের আকাশে শ্রাবণের কালো মেঘের আনাগোনা। যে কোনো সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হবে।

আজ সকাল থেকে মোহিনী ঠিক করেছে, যে করেই হোক লালনের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাবে নিভৃত নিরালায় এমনকিছু কথা জমে আছে তার মনের মধ্যে, যা বলতে হবে। সে বুঝতে পারছে তার এখানে থাকার প্রহর সংক্ষিপ্ত। আজ বাদে কাল সে হয়তো আর ছেঁউরিয়ার এই আখড়াতে থাকবে না। হয়তো অন্য কোথাও চলে যাবে। কোনো এক বোষ্টমী হয়ে কিংবা…

ভাবতে ভাবতে কত কথাই মনে পড়ে যায় তার। কাশিম এখনও তার হৃদয়ের অনেকটা জুড়ে বসে আছে। কী আশ্চর্য, কাশিমের কাছ থেকে সে কি একটুকরো ভালোবাসা পেয়েছিল? যা পেয়েছে, তাকে আমরা বিকৃত কামনা ছাড়া আর কিছু বলতে পারি না।

এবং আনোয়ার, এই বন্যস্বভাবের উড়নচন্ডী মানুষটি। তাকে দেখলে এখনও বুকের মাঝে একটুখানি কাঁপন জাগে কেন? লালন ঠাকুর বলেছে আনোয়ারের দেখাশোনা করতে। মোহিনীর সান্নিধ্যে না এলে আনোয়ার আরও বেশি উন্মাদ হয়ে যাবে। খুনের দায়ে হয়তো ফাঁসি হবে তার। মোহিনী কি তা সহ্য করতে পারবে?

তাইতো অনিচ্ছাসত্ত্বেও আনোয়ারকে ডাক দিতে বাধ্য হয়েছিল মোহিনী। এক পড়ন্ত বিকেলবেলায়। আনোয়ার সবেমাত্র হাট থেকে ফিরেছে। ভারি ভালো নৌকো বাইতে পারে সে। উজান টানে দূর থেকে আরও দূরে চলে যায়। ঘূর্ণিস্রোতের মধ্যেও নৌকোটাকে বাঁচিয়ে রাখে। হাঁফাচ্ছিল আনোয়ার। সহসা তার দিকে দেখে একরাশ মায়া উথলে উঠল মোহিনীর মনের মধ্যে। হাতপাখা নিয়ে এগিয়ে গেল সে। আনোয়ার অবাক হয়েছে। এই মোহিনীকেই সে তার সর্বস্ব নিবেদন করেছে কিন্তু মোহিনী তার দিকে ফিরেও তাকায় না। আজ কি পশ্চিম আকাশে সূর্যের উদয় হয়েছে? আনোয়ার হো হো করে হেসে উঠেছিল।

কী অবাক, সেদিন মোহিনী দরজা খোলা রেখেছিল। মাঝরাতে আনোয়ার ঢুকল, চোখ দুটি টকটকে লাল। হয়তো কোনো বটগাছের তলায় বসে গাঁজা টানছিল। তাকে দেখে আর ভয় পেল না মোহিনী। লালনের কথা মনে পড়ে গেল তার। সাঁইজী যখন আদেশ করছে, সে আদেশ আমাকে পালন করতেই হবে।

আমার এই শরীর? আমি তো এঁটো হয়ে গেছি। বাজারের বারাঙ্গনার সঙ্গে আমার আর তফাতটা কী? একটু হাসল মোহিনী। একটুকরো বিষণ্ণতা লেগে ছিল সেই হাসিতে।

আনোয়ার ভাবতে পারেনি, তার মনের আশা এভাবে পূর্ণ হবে। সে লুকিয়ে চুরিয়ে সবকিছু দেখতে অভ্যস্ত। সত্যি সত্যি স্বর্গের অপ্সরী বন্দী হবে তার মুঠোর ভেতর? এত সুখ সে রাখবে কোথায়?

ঘৃণা এবং বিতৃষ্ণা—পাশাপাশি মিশেল। সত্যি হয়তো, আনোয়ারকে দেবার মতো কিছুই নেই মোহিনীর। তাছাড়া মন যেখানে প্রস্তুত নয়, শুধু শরীরের তাগিদ সেখানে জাগে কি? তবুও মোহিনী সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিল। আনোয়ারের সাথে মিলিত হবার সময় বারবার লালনের কথাই মনে পড়ছিল তার। লালনের মুখ, লালনের চোখ, সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। হায় ভগবান, এ আমি কী করলাম? আমি কি সত্যি এক কুলটা মেয়েছেলে হয়ে গেলাম নাকি? সাঁই যা বলবে তাই আমাকে শুনতে হবে কেন? আমি কি সাঁইয়ের বাঁদী? তবুও সাঁই সামনে থাকলে মোহিনী তার কথা অগ্রাহ্য করতে পারে না। মোহিনীর কেবলই মনে হয় সাঁইয়ের কথার মধ্যে এক অদ্ভুত আদেশ লুকিয়ে আছে।

কিন্তু একবার শরীরের স্বাদ পেলে আনোয়ার তো রক্তলোভী বাঘের মতো হয়ে যাবে। বারবার ঝাঁপিয়ে পড়বে অসহায়া হরিণীর ওপর। তখন কী হবে?

ব্যাপারটা হল ঠিক তাই। কিছুতেই আর লোভ মিটছে না আনোয়ারের। শেষ পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে উঠল মোহিনী। আর তখনই জীবন সম্পর্কে একটা ভয়ংকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল সে। না, সে আর এই ক্লেদাক্ত জীবনের ভার বহন করবে না। কী হবে বার্ধক্যকে আঁকড়ে ধরে। এখনও তার দেহে যৌবন আছে। শরীরের এখানে সেখানে আছে হাজার বাসনার দীপশিখা। আজ বাদে কাল দীপগুলি নিভে গেলে থাকবে শুধু জমাটবাঁধা অন্ধকার। কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাবে না। যেসব পুরুষের চোখে এখন লালসার ছায়া তিরতির করে কাঁপে, সেখান থেকে ঝরবে শুধুই করুণা। সকলের করুণার পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই মোহিনীর। তার চেয়ে অনেক ভালো হবে সে যদি আত্মঘাতিনী হয়। যদি মধ্যাহ্ন দিনেই সূর্য হয় অস্তমিত, তাহলে কার কী ক্ষতি হবে? মোহিনী জানে, সে চলে গেলে তার জন্য কেউ একফোঁটা চোখের জল ফেলবে না।

সহসা লালনের মুখখানি মনে পড়ে যায় তার। লালন কি আক্ষেপ করবে? নিজেকে দোষারোপ করবে না, মোহিনী জানে না এসব প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু সে জানে, এই ছেঁউরিয়াতে আর বেশিদিন তাকে থাকতে হবে না। সে এমন এক পৃথিবীর বাসিন্দা হবে যেখানে লোভ নেই, লালসা নেই, নেই উৎকট সামাজিক বিভাজন। অনুশাসনের নামে মেয়েদের হত্যা করা। সেখানে শুধুই আনন্দ বিরাজ করছে।

—সাঁই, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার।

লালন তখন সবেমাত্র শেষ করেছে তার সন্ধ্যাহ্নিক। ভারি নিষ্ঠাবান ফকির সে। দুবেলা নিয়ম করে ঈশ্বরের আরাধনা করে। সে একটু অবাক হল মোহিনীর কথা শুনে। তার দূরদৃষ্টি তাকে বলছে মোহিনী এমনকিছু কথা বলতে চায়, যা ভবিষ্যতে বলার সুযোগ সে হয়তো পাবে না আর।

সাঁই বলল—এসো মোহিনী। অনেকদিন তোমার সঙ্গে গল্প করা হয়নি আমার। তুমি কি আমার ঘরে আসবে?

—না। ওখানে যাব না। অভিমানী কণ্ঠস্বরে মোহিনী বলে। সে জানে ওই ঘরে এখন মীরার অধিষ্ঠান। মীরাকে সতীন ভাবতে বয়েই গেছে তার। সে-ই তো জোর করে মীরাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছে ওই ঘরে। সাঁইয়ের দেখভাল করার জন্য। ভাগ্যিস পাঠিয়েছে না হলে ভবিষ্যতে সাঁইয়ের কী হত? তার চলে যাবার পর? ভগবান যা করেন, ভালোর জন্যই করেন—একথা মনে হল মোহিনীর।

—তাহলে কোথায় যাবে?

—কেন ওই নদীটির পাশে, মনে নেই তোমার? আমরা সারারাত জেগে জেগে চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগা দেখেছিলাম। আজ আবার পূর্ণিমা এসেছে। দেখতে পাচ্ছো না। চলো, আমরা নদীর তীরে গিয়ে পাশাপাশি বসি। অনেক কথা বলার আছে আমার। তুমি শুনবে তো?

লালনের অন্তর কেঁপে ওঠে। আসন্ন বিষাদ কি শোকের ছায়া ফেলেছে? সে কি কিছু অনুমান করছে? এমন একটা বিপদ, যা রোধ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আবার নিঃশেষে আত্মমসমর্পণ করতে গেলে পৌরুষে বাধছে।

দুজনে মুখোমুখি বসল। বয়ে গেল বাতাস। আকাশ থেকে ঝরে পড়ল অবিরাম জ্যোৎস্নাধারা। চান করল তারা, সেই হলুদ জ্যোৎস্নায়, সেই মায়াবী নীল জ্যোৎস্নায়। একে অন্যের অনুরাগী হয়ে উঠল।

মোহিনী বলল—ফকির, আজ বাদে কাল যদি আমি না থাকি, তুমি দুঃখ করবে তো?

—একী কথা বলছ তুমি? আর্তনাদ করে ওঠে লালন। সত্যি তুমি আমাদের ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে নাকি?

একটু হাসল মোহিনী, ভারি দুঃখ মেশানো সেই হাসি। সে বলল—আমার বেঁচে থেকে কী লাভ বলো? আমি চেয়েছিলাম তোমার সাধনসঙ্গিনী হতে, তুমি আমাকে গ্রহণ করোনি। আমি চেয়েছিলাম তোমার কাছে নাড়া বাঁধতে, তোমার কাছে বসে গান শিখতে। তুমি আমার সেই অভিলাষও পূর্ণ করোনি। জানি না গত জন্মে কী দোষ করেছিলাম, এ জন্মে তোমাকে পেলাম কিন্তু সঙ্গী হিসাবে পেলাম না। আমি জন্মান্তরে বিশ্বাস করি। আমি জানি এক জীবনের পাপপূণ্য সে জীবনে বিচার হয় না। ভবিষ্যতের কোনো জীবন হয়তো পড়ে আছে আমার জন্যে। আমি যদি সত্যি সত্যি তোমাকে ভালোবেসে থাকি সাঁই, তাহলে আসছে জন্মে তোমাকে আমি আমার স্বামী হিসাবে পাব। তখন লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করতে হবে না। সেদিন আর আমার কপালে অভিশাপের টিকা পরানো হবে না। সমাজপতিরা আমার দিকে জ্বলন্ত আগুন দৃষ্টিতে দেখবে না। আমি রাস্তায় গেলে কেউ আঙুল তুলে বলবে না, একটা বারাঙ্গনা চলেছে।

এত দুঃখ, এত ক্ষোভ, এত রাগ, এত যন্ত্রণা জমে আছে মোহিনীর বুকের ভেতর? সাঁই অবাক হল। এই দুঃখের খবর সে রাখে না কেন? কেন, কেন, কেন? প্রশ্নগুলো তাকে বারবার আঘাত করছে। সে ভাবছে সত্যিই কি মোহিনী থাকবে না? তা হলে? জীবনটা তার কীভাবে কাটবে। ভাবতে পারছে না সে। চুপটি করে বসে আছে। বয়ে যাচ্ছে অনন্ত সময়।

ভোর হবার আগে, চাঁদ ডুবে গেল নদীর ওপর, তখনও সূর্য আসেনি। চাঁদের চলে যাওয়া এবং সূর্যের আসা—

এর মধ্যে কিছুটা সময়। মনে হয় স্বর্গ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসা। পাখিরা কলকাকলি পরিবেশকে শাব্দিক করেনি। বিরাজ করছে থমথমে নীরবতা। তখনই হঠাৎ মোহিনীকে আদর করতে ভীষণ-ভীষণ ইচ্ছে হল লালন সাঁইয়ের। মোহিনীকে নিয়ে যদি সে পালিয়ে যায়, তা হলে কী হয়? কিন্তু এসব নেহাতই অবান্তর কল্পনা। আজ লালনের মাথার ওপর মস্ত বড়ো বোঝা চাপানো আছে। কতজন শিষ্য শিষার দায়িত্ব তার কাঁধে সে কি তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে? ব্যক্তিগত জীবনে সুখদুঃখ অপমান শোক—সবই তো থাকবে। সবই উড়ে যাবে চৈত্রশেষের ঝরাপাতার মতো। কিন্তু কর্তব্য? বেঁচে থাকবে অহর্নিশ। বেঁচে থাকবে এবং অন্যকে বাঁচিয়ে রাখবে।

এবার মোহিনীকে ফিরতে হবে। লালন প্রভাতসংগীতে মগ্ন থাকবে। যাবার আগে মোহিনী বলল—এসো, আমরা দুজনে মিলে একটা গান গাই।

—কোন গান? জিজ্ঞাসু চোখে জানতে চায় লালন।

—মনে নেই সাঁই কত বছর আগে তুমি আমাকে শিখিয়েছিলে? প্রতিটি শব্দ এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে।

দুজনে গাইতে শুরু করল। পুরুষকণ্ঠের গাম্ভীর্য এবং নারীকণ্ঠের মাধুর্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।

লালন গাইল—

 আমার এ ঘরখানাতে

 কে বিরাজ করে।

 আমি জনম ভরে

 একদিন দেখলেম নারে!

আর মোহিনী গাইল—

 আপন ঘরের ঠিকানা হয় না

 মনে বাঞ্ছা করি পরকে চেনা।

দুজনে একসঙ্গে গাইল—

 লালন বলে পর বলতে

 পরমেশ্বর

 সে বা কিরূপ আমি কিরূপ রে।

গান শেষ হয়ে গেছে, দুজন তখন ভাবাবেগে উন্মাদ। একে অন্যকে ভীষণভাবে কাছে পেতে চাইছে। হঠাৎ লালনের মধ্যে কী যেন হয়ে গেল। নিস্পৃহ চোখে তাকাল সে মোহিনীর দিকে। তারপর বলল—চলো, অনেক বেলা হল। আমি এখন প্রভাতসংগীতে বসব। তুমি কি আমার সঙ্গে ধুয়া দেবে?

—না, যদি তুমি সত্যি আমাকে ভালোবাসতে, তাহলে এভাবে অপমান করতে না। একরাশ অভিমান জমে আছে মোহিনীর মনের মধ্যে। মাঝেমধ্যে তার প্রকাশ ঘটায় সে। সে চায় না, তার আচরণ বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করুক লালন ফকিরকে। লালন এখন এক সামাজিক মানুষ, অনেক দায়দায়িত্ব তার মাথার ওপর চাপানো আছে। অথচ এই লালনকেই কি চেয়েছিল মোহিনী? তা কেমন করে হবে? সে সেই লালনকে ভালো বেসেছিল, যার পায়ের তলায় সরষে, যার মাথার ওপর নীল আকাশ। ইচ্ছে হলেই যে ফুড়ুৎ পাখি হয়ে ওই আকাশে উড়ে যাবে। সময় কি সবকিছুকে পালটে দেয়? লালনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হল মোহিনীর।

তারপর? তারপর ফুরিয়ে গেল কথা বলার প্রহর। এইভাবে আর কখনো হয়তো লালনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় মেতে উঠতে পারবে না মোহিনী। এক ঘটনা বারবার ঘটলে তাতে পুনরাবৃত্তির ছাপ লেগে যায়। এ-ই হয়তো ভালো হল, জীবনটা একটা অসামাপ্ত কবিতা হয়েই থাকনা। নাইবা সেখানে থাকল ছন্দের উনমাদন, এলোমেলো কিছু শব্দ, কিছু অনুভূতি, কিছু আহত অভিমান…

ছোট্ট সংসার। সামান্য কিছু জিনিসপত্র। আজ সব স্মৃতি ছিঁড়ে ফেলে দিতে হবে তাকে। মায়ার জগতের সকল বন্ধন সে ছিন্ন করবে একা হাতে। তবুও কী অবাক, যেতে গিয়েও মন ফিরেফিরে চলে আসে। সাঁইজী বলেছে, এর নাম মায়া। এ জগত মায়াময়। আমরা জানিনা মায়ার কী অসীম শক্তি। কিন্তু মোহিনী আর কিছুতেই সংসার প্রকোষ্ঠের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখবে না। আজ সত্যি সত্যি বিশ্বপ্রকৃতির সাথে মিলন হবে তার। তাই বোধহয় এমনভাবে নিজেকে প্রস্তুত করছে। কিন্তু কীভাবে? কোন পথে মুক্তি? মোহিনী জানে, লালনের অনুচররা তার ওপর সতর্ক নজর রেখেছে। তাই অনেক ভেবেচিন্তে মোহিনী স্থির করল, না, এভাবে চলে গেলে হবে না, রাতের অন্ধকারে তাকে গৃহত্যাগ করতে হবে। যেতে হবে অসীমের সন্ধানে। তারপর? তারপর নির্ভয়ে সে যদি শরীরটা ভাসিয়ে দেয় স্রোতস্বিনীর জলে? কতক্ষণ আর সাঁতরাতে পারবে? জলরাশি কি তাকে গ্রাস করবে?

নাকি বিষাক্ত কোনোকিছু খেয়ে সে এই জীবনের ওপর ইতি টেনে দেবে? শরীরটা নীল হয়ে যাবে। মণি ঠিকরে বেরোবে, বীভৎস সেই মৃতদেহ দেখে লালন হয়তো আর্তনাদ করবে। মুখের ওপর সাদা কাপড় চাপিয়ে দেবে। সেটাই বোধহয় ভালো। জীবনে না হোক, মরণের মধ্যে দিয়ে হয়তো লালনকে পাবে মোহিনী।

অথবা, যদি সে গাছের ডালে ঝুলে পড়ে? শাড়ির আঁচল গলায় বেঁধে? প্রাণটা বেরিয়ে আসবে, অসম্ভব যন্ত্রণা। শরীরটা কেঁপে কেঁপে স্থির হয়ে যাবে বোধহয়!

অবশেষে এল সেই ভয়ঙ্কর রাত। পাছে কেউ সন্দেহ করে, তাই সেরাতে আগলে রাখল খুলে। গাঁজার নেশায় চুর হয়ে আনোয়ার ঢুকল। কী আশ্চর্য, এই লোকটাকে দেখলে ঘৃণা উথলে ওঠে তার মনের মধ্যে। কিন্তু তাকে সঙ্গ দিতে হয়। কী করবে মোহিনী? এজীবনে সাঁইয়ের বাঁধন ছিন্ন করতে পারল না সে। হয়তো কোনো একদিন…

আনোয়ার আজ উন্মত্তের মতো আচরণ করছে। বুনোপশু বুঝি ঘুম ভেঙে গেছে। তাকে শান্ত করল মোহিনী। ভাবল এই শেষবারের মতো অশুচি হল সে। কাল সকালে স্নান করবে নাকি? নাকি এই অশুচি দেহ নিয়েই সে আত্মঘাতিনী হবে?

আনোয়ার ঘুমিয়ে পড়েছে। একেবারে পশুর মতো স্বভাব। নিজের চাহিদা শেষ হলেই ক্লান্ত হয়ে যায়। সঙ্গিনীর দিকে ফিরেও তাকায় না। তার মধ্যে একটা বন্য উত্তেজনা আছে। আছে পাশবিক উল্লাস। তবে মাঝেমধ্যে এমন দুরন্তপনা ভালোই লাগে মোহিনীর।

মধ্যরাত। নিঝুম আঁধারে মুখ ঢেকেছে চারপাশ। পাশাপাশি অনেকগুলি ঘর। সেখানে নিদ্রিত বাউল ফকিরদের দল। সব শব্দ এখন থেমে গেছে। আকাশের বুকে জেগে আছে কালপুরুষ। জেগে আছে ধ্রুবতারা। কত বছর আগে মা আকাশ চিনিয়েছিল তাকে। সব কথা মনে পড়ে যায় বেচারী মোহিনীর। নেহাত দরিদ্র ঘরের কন্যা। বাবা দিনমজুরের কাজ করত। অকালে বাবাকে খেয়েছিল সে। সকলে বলেছিল, সে নাকি অভিশপ্তা বালিকা। তাইতো, মা আর দেরি করেনি। নবছর বয়সেই বিয়ের আসরে বসতে হয়েছিল মোহিনীকে। সেসব স্মৃতি এখনও আবছা মনে পড়ে। ফুলশয্যার রাত। বুড়োলোকটা ভোঁস ভোঁস করে ঘুমিয়েছে। মোহিনীকে বলাৎকার করার চেষ্টা করেছে। তখন থেকেই পুরুষ মানেই বীভৎস বিভীষিকা। তারপর? কী আশ্চর্য, তাকে কিন্তু চিতার আগুনে নিক্ষেপ করা হয়নি। শুধু জোর করে মুছিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার সিঁথির সিঁদুর। ভেঙে দেওয়া হয়েছিল তার হাতের শাঁখা এবং পলা। বলা হয়েছিল, আজ থেকে তুমি কদমছাট চুল ছাঁটবে। পরপুরুষের মুখ দেখা পাপ হবে তোমার। তুমি এমন জায়গায় থাকবে যেখানে পৃথিবীর কোনো আলোর প্রবেশ নিষেধ। ধবধবে সাদা থান পরবে। মনে কোনো বাসনা কামনাকে জায়গা দেবে না।

সকলকে কি এভাবে বন্দিনী রাখা যায়? ওরা পারেনি। তাইতো মোহিনী একদিন সাহসিকা হয়ে ঘর থেকে পালাল। সেটাও ছিল এমনই এক মধ্যরাত। যেকোনো মুহূর্তে ধরা পরার প্রবলতর আশঙ্কা। বাবু কালীকিঙ্কর দত্তের লেঠেলরা চারপাশে পাহারা দেয়। তার মধ্যে কাশিম কীভাবে ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল। তার পর? অনিশ্চিত অন্ধকারের মধ্যে কাটানো জীবন। তারপর…লালনের আবির্ভাব, আশ্রয় দেওয়া, এর পরের ঘটনা আমাদের সকলেরই জানা আছে।

অন্ধকার বনপথ দিয়ে এগিয়ে চলেছে মোহিনী। বেশকিছুটা এগিয়ে যাবার পর নদীর তীরে এসে বসল সে। শেষরাত, নিশান্তিকার আলো ফুটব ফুটব করে এখনও ফোটেনি। তখন পৃথিবীকে বড্ড মায়াবিনী বলে মনে হয়। মনে হয় এজীবনের যত সুখ আর শোক, মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মনে হয় শরীরটা কোনো ভার নেই। বিহঙ্গের মতো দুটি পাখা মেলে আমরা উড়ছি নীল আকাশের বুকে। এমনভাবেই নিজের শরীরটা ভাসিয়ে দিল মোহিনী। অনন্ত জলরাশি গ্রাস করল তাকে। তার এই জীবনের সকল দুঃখ শোক, বিরহ যন্ত্রণা, চাওয়া-না পাওয়া সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। আঃ, এই কি জীবন? অতল জলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মোহিনী ভাবল, এটাই বোধহয় আসল জীবন, কিন্তু আমরা, বোকা মানুষরা, এ জীবনের খবর রাখি না।

আঠাশ

লালন জানত, মোহিনীকে আটকে রাখা যাবে না। এই পৃথিবীতে মোহিনীর মতো মেয়েরা আসে এবং সকলকে কাঁদিয়ে চলে যায়। সাংসারিক জীবন তাদের প্রাপ্য নয়। তারা কোনোদিন সুখবতী হতে পারে না। তাদের শোকবিহ্বলা থাকতে হয়। তাই মোহিনীর সন্ধান সে করেনি। সে জানে, অচিরেই মোহিনীর মৃত্যুখবর ভেসে আসবে। কী অবাক, আনোয়ার মাছ ধরছিল, চিৎকার করে বলল—সাঁই, সর্বনাশ হয়ে গেছে।

তাকে পাগলের মতো বুক চাপড়াতে দেখে লালন বুঝতে পারল, কী ঘটনা ঘটেছে। এখন সৎকার করতে হবে। আমরা ফকিররা কী করি? দাহ নাকি কফেন? না না, মোহিনীর দেহটা ভাসিয়ে দিতে হবে গাঙের জলে। অনন্ত জলরাশিকে আশ্রয় করবে সে। মেয়েটি বড়ো দুঃখী, জীবনে এতটুকু শান্তি পায়নি। মরণেও সে অতৃপ্ত থাকবে নাকি?

লালনের নির্দেশে মোহিনীকে সাজানো হল এক সধবার বেশে। লালপাড় শাড়ি পরানো হল। মাথায় সিঁদুর। শেষবারের মতো মোহিনীর মুখের দিকে তাকাল লালন। আহা, এইতো সেদিন মেয়েটির সাথে প্রথম আলাপ হল তার। তখন লালনের ধুম জ্বর। আধো তন্দ্রা আধো জাগরণের মধ্যে দেখেছে সমস্ত রাত জেগে মোহিনী তার সেবা করছে। না, তোমাকে আমি বড্ড কষ্ট দিয়েছি। অত্যাচার করেছি। অপমান করেছি। তুমি কি আমায় ক্ষমা করবে?

হরিধ্বনি শোনা গেল, অথবা অন্য কোনো শব্দ। চারজন বাহক বইছে মোহিনীর মৃতদেহ। লালন গান ধরল, এমন গান সে কখনো বাঁধেনি, যে গানের মধ্যে তীব্র শোক এবং বিষণ্ণতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

লালন গাইল—

 পাখী কখন যে উড়ে যায়

 বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়।

 খাঁচার আড়া পড়লো খসে

 পাখী আর উড়বে কিসে?

 এই ভালো ভাবচি যে

 চমক জরা বইছে গায়।

 ভেবে অন্ত নাহি দেখি

 কার বা খাঁচায় কে বা পাখী

 আমার এ আঙিনায় থাকি

 আমারে মজাতে চায়!

 আগে যদি যাইত জানা

 জঙ্গলা কভু পোষ মানে না

 তবে উহার প্রেম করতেম না।

 লালন ফকির কেঁদে কয়,

না, আজ মনটা তার মোটেই ভালো নেই। এক এক করে সকলে চলে যাচ্ছে। রঙ্গমঞ্চ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এবার এসো দর্শকরা, তোমরাও বিদায় নাও। দেখছ না, আমাকে এবার চলে যেতে হবে। বানানো সংলাপ এখানেই শেষ হয়ে গেছে। যবনিকা কাঁপছে। আর কতক্ষণ? আর কতক্ষণ এভাবে আমি বাউলরাজা সেজে বসে থাকব? আমার তো নিজস্ব জীবন বলতে কিছু একটা আছে? তোমরা কি আমাকে একদন্ড শান্তিতে থাকতে দেবো না?

মোহিনী চলে যাবার পর লালন আরও আত্মমগ্ন হয়ে গেছে। এখন বিশেষ বাইরে যায় না। ঘরেতেই বসে থাকে। দাওয়ায় বসে গান লেখে, সুর দেয়, উদাত্ত কণ্ঠস্বর ভাসিয়ে দেয়। মাঝেমধ্যে কাঙাল হরিনাথ আসে। দু-একজন উৎসাহী যুবাপুরুষকে সঙ্গে নিয়ে। বাবু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন। তাঁর বড়ো ইচ্ছে, তিনি লালনের একখানি প্রতিকৃতি আঁকবেন। দিনসাতেক লালনকে থাকতে হবে ওই কাছারি বাড়িতে। লোভনীয় আমন্ত্রণ, না, এসব নিমন্ত্রণে লালন মোটেই লালায়িত হয় না। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মধ্যে একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। তাঁর সান্নিধ্য ভালোই লেগেছে লালন ফকিরের। দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা কিন্তু দুজনের মধ্যে অদ্ভুত মিল। লালন স্থির করেছে, আর কদিন বাদে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ডাকে ওই কাছারি বাড়িতে যাবে। বেশকিছুটা সময় কাটাবে ভাসমান বজরাতে। নদীর সাথে আত্মীয়তা পাতাবে। আর কী বা করবে সে? পিছুটান বলতে কিছুই তো নেই। এখন এভাবেই জীবনের বাকি দিনগুলো কাটাতে হবে। এ গাঁ থেকে সে গাঁয়ে, এ শহর থেকে অন্য শহরে। ক্রমশ বয়স হবে তার। এখনই যথেষ্ট বয়স হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে তার স্বাস্থ্য অটুট আছে। রোগবালাই নেই। কড়মড় করে শক্ত বাদাম চিবিয়ে খেতে পারে। দৃষ্টি পরিষ্কার। বয়স কত? কেউ শুধালে লালন অবাক হয়ে যায়। দু হাতে কর গুনে বয়স মাপার চেষ্টা করে। তখনই একরাশ লজ্জা এসে গ্রাস করে তার সমস্ত শরীর।

জীবনে চলার পথে কত অভিজ্ঞতাই তো হল লালনের। কত মানুষের সংস্পর্শে এল সে। কতজন তার দিকে ছুঁড়ে দিল ঘৃণা এবং অপমান। গেঁয়ো ভিখারি বলে অপমান করল কেউ। আবার কেউ ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিল। এই যেমন কাঙাল হরিনাথ, যেমন মীর মশাররফ হোসেন, আরও কত ভদ্রলোক, সকলের নাম ও পরিচয় লালনের জানা নেই।

এখন মীরা আরও বেশি সেবাযত্ন করছে তাকে। মীরার মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। সহসা শব্দহীনা হয়ে গেছে সে। আসলে মোহিনীর চলে যাওয়াটাকে সে বোধহয় মন থেকে মানতে পারছে না। নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়েছে। মাঝেমধ্যে মীরা সকলকে বলে, এখানকার জীবনের এই অন্তিম পরিণতি। আমাদের সকলকে আখড়া ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে।

লালন বলে—মীরা, চলে যাবার কথা কেন বলছ বলোতো? জন্মালে মরতে হবে, এতো আমরা সবাই জানি। কিন্তু যতদিন শরীরে যৌবন আছে, এসো, আমরা জীবনটা আনন্দে উপভোগ করি। তুমি না আমার ব্রাহ্মাণী, তুমি না আমার ঈশ্বরী? তুমি এমন করে ভেঙে পড়লে চলবে কেমন করে?

মীরার গোপন দুঃখের উৎস অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে। মীরা জানে, লালন মোহিনীকেই ভালোবাসত। মোহিনীকেই সে সবকিছু নিরুচ্চারে নিবেদন করেছিল। অথচ মনের সব কথা খুলে বলতে পারেনি। আর মীরার সঙ্গে এই যে শরীর সঙ্গত? এ সবটাই অভিনয়। এতে মীরার মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। সে জানে মোহিনীর সঙ্গে তার কোনো তুলনাই হয় না। তারা যে সবাই তাকে স্থান দিয়েছে, এতেই সে কৃতজ্ঞ। তাই সর্বাত্মকরণে লালনের উপকার করার চেষ্টা করে। অসুস্থ লালনের দেখাশোনা করে। সে অন্য কারো হাতে এই গুরুদায়িত্ব তুলে দেবে না।

অঘটনটা ঘটে গেল। কদিন ধরে লালনের শরীরটা মোটেই ভালো নেই। এখন আর নিয়মিত ঘোড়ার পিঠে চড়ে গ্রাম টহল দিতে পারে না। ডাক আসে দূরদূরান্ত থেকে। কত মানুষের কতরকম চাহিদা। লালন সেই ডাকে সাড়া দেয়। সাধারণ ছেলেমেয়ের মধ্যে মিশে যায়। কেউ কোনো উপহার দিলে অকাতরে তা বিলিয়ে দেয়।

সেদিন সকালবেলা প্রিয় ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়েছিল সে। তার ইচ্ছে একবার ভগবানপুরে যাবে। কতদিন আগে এই গ্রামে এসেছিল লালন। এখানকার ছোটো ছেলেমেয়েরা তাকে ঘিরে ধরেছিল। ভারি দরিদ্র এই গ্রামটি। মানুষের মুখে অন্ন নেই। পরনে বস্ত্র নেই। এমন মানুষদের লালন ভীষণ-ভীষণ ভালোবাসে। তারা তো তবু মাধুকী বৃত্তি করে খাবার সংস্থান করতে পারছে। কখনো কোনো বড়োলোক জমিদার দয়াপরবশ হয়ে প্রচুর অর্থ দান করছেন। জীবনটা মোটামুটি ভালোই কেটে যাচ্ছে। কিন্তু ওইসব লোকগুলো? যারা জীবিকা নির্বাহের কোনো উপায় জানেনা, যারা দাঙ্গা করে বেঁচে থাকতে চায়, তাদের মাঝে লালন নিজেকে হারাতে চায়। তাদের আবার সুপথে ফিরিয়ে আনতে চায়। এজন্য অনেক বাধা তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে। বিক্ষুদ্ধবাদীরা আজও সমান সক্রিয়। তারা জনসমক্ষে প্রকাশ করছে, লালন একটা ভন্ড প্রতারক। সে নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিভু বলে ঘোষণা করছে। কিন্তু ঈশ্বর কোথায় থাকে সে সম্পর্কে লাগনের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। বুদ্ধিজীবী মহলের কেউ কেউ ইতিমধ্যে লালনের সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছেন। কাঙাল হরিনাথ আপ্রাণ চেষ্টা করছে, যাতে লালনের পরিচয় সকলের কানে পৌঁছে যায়। কিন্তু সীমিত তার সামর্থ্য। কীভাবে লালনকে সে আরও জনপ্রিয় করবে?

ছুটে এল দুই প্রিয় শিষ্য—ভোলা আর শীতল। সাঁইজী কি অজ্ঞান হয়ে গেছেন নাকি? দেখা গেল ঘোড়ার পিঠের ওপর শুয়ে পড়েছে লালন। ক্ষীণ রক্তের রেখা বেরিয়ে এসেছে তার মুখ থেকে।

মীরা ডুকরে কেঁদে উঠল। তার মনের ভেতর কে যেন কু-গাইছে। মীরা বুঝতে পারল লালন আর বেশিদিন এই পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না। লালন যখন থাকবে না তখন আমার কী হবে? মীরা ভাবল, কিন্তু লালনকে বাধা দিলে সে কথা শুনছে না কেন? সেকি ইচ্ছে করেই মৃত্যু অভিসারী হয়ে উঠেছে? মোহিনী চলে যাবার পর তার মধ্যে একটা নিস্পৃহতা এসেছে। কোনোকিছু মন দিয়ে করছে না। এত খুঁটিনাটি কাজ পড়ে আছে, লালন সামাল দেবে কবে?

বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর চোখ মেলল লালন। অবাক হয়ে দেখল শিয়রে মীরা বসে আছে। জলপট্টি দিচ্ছে তার মাথায়। লালন হেসে বলল—কীরে বউ, তুই ঘাবড়ে গেছিস নাকি? না, অত সহজে আমি মরছি না। আমার দীর্ঘ আয়ু আছে, আমার ভয় হয় তোকে নিয়ে। আমার কেবলই মনে হয়, আমার অনেক আগে তুই-ই চলে যাবি এ পৃথিবী ছেড়ে।

এসব কথা শুনে মীরা কেমন যেন হয়ে যায়। সত্যিকারের দাম্পত্য জীবন বলতে কী বোঝায় তা তার জানা নেই। সে শুধু জানে, স্বামীকে সবসময় সেবা করতে হয়। স্বামী আর ঈশ্বরের মধ্যে কোনো তফাত নেই। লালনের সৌভাগ্য, সে এমন একজনকে সাধনসঙ্গিনী হিসাবে পেয়েছে। মেয়ে হিসাবে মীরা চমৎকার। তার চরিত্রের কোথাও একটুকরো অপমান লেখা নেই। ভোরের প্রস্ফুটিত পদ্মের মতোই সে সম্পূর্ণ নিষ্কলঙ্কা। তবুও মানুষ কি ছাড়ে? তার চরিত্র নিয়ে রসাল গল্প করতে ভালোবাসে। সব শুনতে পায় মীরা। কোনো বাধা দেয় না। সে সাঁইজীর একনিষ্ঠ সেবিকা হয়েই জীবন কাটিয়ে দেবে। এটাই তার মনোগত বাসনা।

পৃথিবীর সব মানুষের জীবন কি সফল হয়? অবশ্য অন্যভাবে দেখতে গেলে এটা এক চরম সাফল্য বৈকি। হাজার হাজার মেয়ে তো সুখেশান্তিতে ঘরসংসার করে। বছর বছর সন্তান উৎপাদন করে। গঞ্জনা সহ্য করে। স্বামীর অত্যাচার এবং আর ও কত কী। মীরা যে এখানে সেবিকা হতে পেরেছে, সেটা বোধহয় আগে থেকেই স্থির ছিল। নাহলে তার জীবনে এতগুলো নাটকীয় ঘটনা ঘটে যাবে কেন? সবকিছু মনে পড়ে যায় তার। কখনো কোনো মধ্যদিনের অবসর বেলায়। কীভাবে তার বিয়ে হয়েছিল, কীভাবে তাকে জোর করে চিতার আগুনে পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।

ইদানিং মনটা ভীষণ বিষন্ন হয়ে গেছে মীরার। যে মোহিনী তাকে বুক দিয়ে আগলেছিল, সেই মোহিনী যে এভাবে চলে যাবে, সেটা মীরা ভাবতেও পারেনি। মীরা জানে, এর জন্য অপ্রত্যক্ষ ভাবে সে-ই দায়ী। লালনকে কেন্দ্র করে দুই নারীর মধ্যে এই লড়াই, অথচ মীরা কিন্তু রণক্ষেত্রে অবতীর্ণা হতে চায়নি। সে কখনো মনেপ্রাণে চায়নি যে, লালনের সাধনসঙ্গিনী হবে। নেহাত অসহায়া মেয়ে হয়ে সে-ই আখড়াতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। লালন যদি তাকে সাধনসঙ্গিনী না করত, তাহলে সে হয়তো অন্য কারো সঙ্গে মেতে উঠতো শরীরী খেলায়। সেই সহবাসে মনে জমতো ঘৃণায় অভিজ্ঞতা। তাই নিজের ভাগ্যকে তারিফ করে সে। কিন্তু সারাক্ষণ আখড়ার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। তাই নিজের দিকে নজর দেওয়া হয় না। ধীরে ধীরে ক্ষয়রোগ বাসা বাঁধছে। রাতের অন্ধকারে খুকখুক কাশির আওয়াজ, মীরা লুকিয়ে ফেলে। মীরা জানে এই জীবনটার ভার বেশিদিন বহন করে কী লাভ? তাই তো এভাবে সে নীরবে ঝরে যেতে চায়। কাউকে কিছু না বলে।

ঊনত্রিশ

অবাক চোখে লালনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন বাবু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। বজরা ভাসছে পদ্মার জলে। শরৎ এসেছে গ্রামবাংলায়। শরত মানেই অভিমানী শিউলিফুলের অকারণ ঝরে পড়া। উদ্ধত কাশফুলের অনাঘ্রাত যৌবন। শরত মানেই উৎসবের মেজাজি মৌতাত।

অনেকক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হয়েছে বেচারি লালন ফকিরকে। পায়ে ঝিঝি ধড়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে বিরক্তির প্রকাশ। কিন্তু মুখে তার অভিব্যক্তি নেই।

তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। এই জীবনে অনেক বিখ্যাত মানুষের প্রতিকৃতি তিনি এঁকেছেন, সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষেরও ছবি আছে তাঁর সংগ্রহে। তিনি চাইছেন এভাবে প্রতিকৃতির এক আলাদা জগত তৈরি করতে। মানুষের মনের কি মুখের কথায় লেখা থাকে? এটা তাঁর অনেক দিনের প্রশ্ন। আমাদের দুর্ভাগ্য এই ব্যাপারটা নিয়ে এদেশে তেমন কোনো চর্চা হয়নি। কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি প্রতিকৃতি আঁকায় মন দেননি। বরং বলা যেতে পারে, এটা হল ব্রিটিশ সভ্যতার আমদানি। প্রতিকৃতি আঁকায় নিজেকে বেশ প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। এখানে সেখানে তাঁর খ্যাতির খবর ছড়িয়ে গেছে। অথচ এ ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাতামাতি তিনি মোটেই পছন্দ করেন না। এটা হল তাঁর নিভৃত মনের এক আশ্চর্য খেয়াল। খেয়ালের কথা পাঁচকান করে কী লাভ।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একটি সিগারেট ধরালেন। একটা এগিয়ে দিলেন সাঁইজীর দিকে। তারপর বললেন—কী লালন ফকির, বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে?

লালনের বয়স হয়েছে, যৌবনের সেই উন্মাদন কোথায় হারিয়ে গেছে। এমনকি হবারই তো কথা, অনিয়মিত জীবনযাপন, প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রম, মানসিক অশান্তি—কোনোকিছুই তো কম হয়নি। ইদানিং আখড়ার মধ্যে দেখা দিয়েছে গন্ডগোল। একদল শিষ্যের সঙ্গে অন্যদল শিষ্যের বনিবনা হচ্ছে না। সাঁই বুঝতে পারছে, সে চোখ বুজলে আখড়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কেন এমন হয়? কেন ব্যক্তিত্বের সংঘাত? অহংবোধের উল্লাস? মানুষ কি চিরদিনের জন্য পৃথিবীতে আসে? যে কদিন আসে, সে কদিন ভাবভালোবাসা করে থাকতে পারে না কেন?

তাই লালন ফকিরের মন আজ ভালো নেই। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণ সে উপেক্ষা করতে পারেনি। করতে পারেনি বলেই বোধহয় তার ছবিটি এভাবে আঁকা সম্ভব হল। দীর্ঘ সাত ঘন্টা ধরে লালনকে বসে থাকতে হয়েছে। যখন ছবি আঁকা শুরু হয় তখন সকাল দশটা। এখন সূর্য প্রায় অস্তাচলে। লালন আমেজ করে বসল। বাতায়ন পথে তাকিয়ে থাকল অস্তাচলের সূর্যের দিকে। রঙিন আভায় উদ্ভাস চারপাশ। প্রতিদিন সূর্য অস্ত যায়, কিন্তু প্রতিদিন এই দৃশ্য নতুন বলে মনে হয়। এই কি ভবের লীলা? ঈশ্বরের খেলা। সহসা লালনের মনে হল, এই যে দিনটা চলে গেল, সেই দিনটা আর কখনো ফিরবে না। এভাবেই বোধহয় একটি দিনের পর আর একটি দিন আসে, যেভাবে আমরা রুদ্রাক্ষের মালা গাঁথি, সেইভাবে মহাকাল বোধহয় দিনের মালা গাঁথছে। তারপর? তারপর কোথায় মালাটি ছিঁড়ে যায়। একটি জীবন আকাশের তারা হয়ে যায়।

দু-দুজন রমণীর জন্য ভীষণ-ভীষণ কষ্ট তার। একজন চম্পা, তার স্মৃতি এখন অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে। আর অন্যজন এই মোহিনী। তাকে লালন ভুলবে কেমন করে?

বজরা দুলছে। লালন তাকিয়ে আছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মুখের দিকে। এই মানুষটিকে যতই দেখছে সে, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিল, এসব বোধহয় বড়োলোকের খেয়াল। এমন কত খেয়ালই তো করে থাকে বড়োলোকেরা। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মধ্যে একটা আলাদা সংবেদনশীল মন আছে। তার সন্ধান পেয়েছে লালন। এইসব মানুষরা কেন যে শহর সভ্যতার মধ্যে আটকে থাকে? লালন ভাবে, নিজেকে প্রশ্ন করে। এরা যদি এসে আমার আখড়ায় যোগ দিত, তাহলে? তাহলে আখড়াটা কত বড়ো হয়ে উঠত। মনে মনে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে ধন্যবাদ জানায় সে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অনুমতি না থাকলে কবেই আখড়া ভেঙে যেত। পাইকপেয়াদা এসে সবকিছু তছনছ করত। মানুষটি মহান এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

নিজের প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকে লালন। কিছুই বুঝতে পারে না। হিজিবিজি কতগুলো রেখা বলে মনে হয় তার। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সিগারেট খেতে খেতে মুচকি হাসলেন। বললেন—লালন, একটা কথা বলি আপনাকে, এ জীবনে আমি অনেক ছবি এঁকেছি, কিন্তু এত প্রাণবন্ত ছবি বোধহয় আর একটাও হয়নি। আমি যখন থাকব না, আপনি যখন থাকবেন না, তখনও এই ছবিটি থেকে যাবে। আগামী দিনের মানুষ এই ছবি দেখে আপনাকে চিনতে পারবে। এটা আমার কাছে মস্তবড়ো পাওনা।

ব্যাপারটা এভাবে কখনো ভাবেনি লালন। মৃত্যুর পর তার গান বেঁচে থাকবে কিনা, এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে কাঙাল হরিনাথ বারবার বলেছে, লালনের আসল মূল্যায়ন হবে তার ইন্তেকালের পর। এখনও শহরের মানুষ তাকে সেভাবে চিনতে পারেনি। যদিও গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের কাছে সে অত্যন্ত জনপ্রিয়। লোকমুখে লালন শুনেছে উত্তর বাংলাতেও তার গানের কদর বেড়েছে। সেখানকার চাষীরা তার গান গেয়ে মাঠে ধান রোপন করে। জোলারা তার গান গেয়ে তাঁত বোনে। ভিখারিরা তার গান গেয়ে ভিক্ষে চায়। এটাই বোধহয় লালনের জীবনে সবথেকে বড়ো পাওনা। সরকারি উৎকোচের আশা সে কখনো করে না। গান গেয়ে প্রচুর টাকা আয় করবে, এমন চিন্তা কোনোদিনই বাসা বাঁধেনি তার মনের মধ্যে।

সে চেয়েছিল গ্রামবাংলার নিম্নবর্গের মানুষদের মনের রাজা হতে। যখন সে থাকবে না, তখন যেন তার গান এভাবেই বেঁচে থাকে—এটাই ছিল তার অন্তরের সুপ্ত বাসনা। আজ বোধহয় সেই বাসনা পূর্ণ হয়েছে। তার মানে? পৃথিবীতে আর বেঁচে থেকে কী হবে? প্রত্যেক মানুষ কয়েকটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে বেঁচে থাকে। আরাধ্য কাজ শেষ হয়ে গেলে বেঁচে থাকার অন্য কোনো অর্থ থাকে কি? এ বড়ো কঠিন প্রশ্ন। কার কাছে এ প্রশ্ন করবে লালন? এখন ভদ্রসমাজের অনেকে সঙ্গে তার ভাব ভালোবাসার সম্পর্ক। সুযোগ বুঝে কাউকে এই প্রশ্নটা করবে। কী উত্তর দেবে সে—সেটা শুনতে হবে।

অবশ্য শরীরের দিক থেকে লালন এখনো বেশ শক্তই আছে। মাঝেমধ্যে দুএকবার অসুখ করেছে তার। এছাড়া মন এবং শরীর—দুইই তরতাজা। এখনও অনায়াসে গান লিখতে পারে। চোখ বন্ধ করে সুর দিতে পারে। একতারা বাজিয়ে গাইতে পারে। এখনও তার কর্মোদ্যম দেখলে অবাক হতে হয়।

কিন্তু বেশিদিন বেঁচে থাকা মানেই আরও বেশি শোকের সমাহার। অনুজরা পৃথিবী থেকে চলে যাবে, আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখব—তা কেমন করে হবে? তাই লালন আর বেশিদিন পৃথিবীতে বাঁচতে চায় না। অনেক স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। জীবনের সব স্বপ্ন কি আর সফল হয়?

নৌকো প্রস্তুত। এখন লালনকে ছেঁউরিয়ার আখড়ায় ফিরতে হবে। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে দুপাশে। মানুষজন ব্যাস্ত আছে সাংসারিক ক্রিয়াকর্মে। ছপ্ ছপ্ ছপাত্ শব্দ তুলে নৌকো এগিয়ে চলেছে পদ্মার বুকে। দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। বর্ষার প্রবল বারিধারায় পরিপুষ্ট। লালন তাকাল। এই হল আসল বাংলা। শস্য শ্যামলা সুজলা সুফলা। এই বাংলার মানুষের মনে তাই এত আবেগ আর অভিমান। এত সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ।

নিজের আখড়ায় ফিরে মনটাকে শান্ত করল লালন। মীরা জেগে বসে আছে। অনেক কাজ বাকি আছে তার। সত্যি মেয়েটির কোনো তুলনা নেই। এই মেয়েটিকে কেন যে এত কষ্ট সহ্য করতে হল, এটাই বোধহয় লালনের কাছে সবচেয়ে বড়ো ধাঁধাঁ।

তিরিশ

দুঃসংবাদ এল সাতসকালে। লালন প্রভাতসূর্যের বন্দনায় মত্ত ছিল। সে জানে, সূর্য পৃথিবীর সমস্ত শক্তির উৎস। সূর্যের মাধ্যমেই আমাদের পৌরুষ জেগে ওঠে। তাই এখন নিয়ম করে সে সূর্যবন্দনা করে।

ছুটতে ছুটতে এসেছে সনাতন, যে হরিমন্দিরে পদ্মাবতী থাকতেন, সেখানকার অন্যতম সেবায়েত। লালনের সঙ্গে সামান্য ক্ষণের পরিচয়। তাতেই বোধহয় লালনকে ভালো লেগে গিয়েছিল তার। না হলে এতটা পথ পার হয়ে এই ছেঁউরিয়াতে আসবে কেন সে? কেনইবা ভোরের বাতাসে ভাসিয়ে দেবে সেই শোকসংবাদ—পদ্মাবতী বেঁচে নেই। দিন সাতেক আগে তিনি মহাপ্রয়াতা হয়েছেন। খবরটা হয়তো প্রত্যাশিত ছিল লালনের কাছে। যখন দেখা হয়েছিল, লালন বুঝতে পেরেছিল, এ দেখাই শেষ দেখা। এখন ভবিষ্যতের দৃশ্য স্পষ্ট দেখতে পায় সে। কিন্তু কিছুই করতে পারে না। এই অসহায়তা তাকে আঘাত করে।

যে ঘটনা ঘটবার ছিল, সেটা ঘটেই গেছে। লালন একবার ভাবল, এখনই ছুটে যাবে এই শ্রীমন্দিরে। তবে সেখানে গিয়ে কী লাভ? পদ্মাবতীকে আর কখনো দেখতে পাবে না। ছোটবেলার কত স্মৃতির উচাটন। কত না জ্বালাতন করেছে সে মাকে। পথেপ্রান্তরে ঘুরে বেড়াত। বাউলের আখড়ায় বসে থাকত। কত রাত বাড়ি ফেরেনি। আর মা? অনিদ্রিত প্রহর কাটিয়েছে একা। দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করেছে। রক্তাক্ত হয়েছে সামাজিক অনুশাসনে। তবুও কারো কাছে নালিশ জানায়নি। মনে কষ্ট হলে রাধাকৃষ্ণের যুগল প্রতিমার সামনে বসেছে। প্রার্থনা করেছে। আজ সব বাঁধন ছিন্ন হয়ে গেল। লালন ভেবেছিল, সময় ও সুযোগ হলে আবার ভাঁড়ারা গ্রামে যাবে। সেই শিমূলতলায় বসবে ক্ষণকাল। আজ মনে হল, এই জীবনে আর কখনো সে ভাঁড়া রাতে যাবে না। ভাঁড়ারাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করবে। ওই গ্রামে তার দুই প্রিয় মহিলার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। একজন মা, এবং অন্যজন স্ত্রী। সিরাজ সাঁইয়ের কথা মনে পড়ে গেল লালন ফকিরের। সত্যিই তো, একজন ফকির বা বাউল, পূর্বজীবনের কথা মনে করবে কেন? সেতো বিশ্বপথিক। তার চলার পথে কখনো ছড়ানো থাকবে কাঁটা। কখনো লালগোলাপের পাপড়ি। সম্পূর্ণ নিস্পৃহ উদাসীন পথিক হয়ে সে একতারাতে বাজাবে নিজস্ব সুর। গান গাইবে। সেই গানের শব্দে ফুলেরা চোখ মেলবে। মৌমাছি উড়বে। পাখির কলতান শোনা যাবে। নিঃস্ব রিক্ত দুঃখী মানুষ সেই গান শুনে নতুন করে বাঁচার শপথ নেবে।

লালন একতারাটা নিয়ে বসল দাওয়াতে। অনেক দিন বাদে সুর গুনগুন করছে তার গলায়। সে গাইল—

 বল কি সন্ধানে যাই সেখানে

 মনের মানুষ যেখানে

 আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি

 দিবারাতি নাই সেখানে।

 কত ধনীর ভাড়া যাচ্ছে মারা

 পড়ে নদীর তোড় তুফানে।

 লালন বলে মলেম জ্বলে—

 দিবানিশি জলে স্থলে।

 যেমন মণিহারা ফণীর মতো

 হারা হলেম পিতৃধনে।

শিষ্যশিষ্যারা গোল হয়ে বসেছে চারপাশে। তারা জানে এখন সাঁইজীকে সান্ত্বনা দিতে হবে। হাজার হোক, মাতৃবিয়োগের খবর পেয়েছে সে। এখন তার মন সংগতকারণেই ভারাক্রান্ত থাকবে।

একটু বাদে লালন উঠল। প্রিয় ঘোড়াটির পিঠে চাপল। মীরা বলল—যেও না, এখন যেও না কোথাও তুমি। শরীর ভালো নেই। মন খারাপ, এই অবস্থায় কেউ কি একা একা যায়?

লালন হাসল, বিশ্ববিজয়ের হাসি। হাত তুলে অভয় মুদ্রা দেখাল। তারপর বলল—মীরা, তুমি এখনও হয়তো আমায় চিনতে পারোনি। আমি একটু ঘুরে আসছি।

—কোথায় যাচ্ছো?

স্নেহময়ী জননীর মতো মীরা জানতে চায়।

—জানি না, তবে ফিরে আসব, তুমি নিশ্চিন্তে থেকো। আমি এমন কোনো কাজ করব না, যাতে তোমাদের মনে অশান্তির জন্ম হয়। আসলে তোমাদের সকলকে যে আমি ভীষণ-ভীষণ ভালোবাসি।

ঘোড়ার পিঠে লালন চলেছে গ্রামবাংলার পথেপ্রান্তরে। মনটা সত্যি ভালো নেই তার। অনিবার্য ঘটনাটা ঘটতই, সেতো নিমিত্তমাত্র। সহসা লালনের মনে হল সারাজীবনে আমি মাকে শুধু দুঃখই দিয়ে গেলাম। তবে আমার কোনো হাত নেই। আমি কি ইচ্ছে করে যবনের ভাত খেয়েছি? বিধর্মীর সংস্পর্শে এসেছি? এসব হয়তো হবার ছিল, কিন্তু আমার ক্ষেত্রেই এসব ঘটনা ঘটল কেন। ছোটোবেলার বন্ধুদের কথা মনে পড়ে গেল লালনের। মাকে আর বৌকে নিয়ে কেমন সংসার করছে তারা। আর আমি? তখনই নিজের ওপর ভীষণ-ভীষণ বিতৃষ্ণা হল তার। নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার দেবার ইচ্ছে হল। একটু পরে লালন ফিরে এল তার প্রিয় আখড়ায়। না, আজ আর কারো সঙ্গে কথা বলবে না সে। নিজস্ব ঘরটিতে গিয়ে বসল। ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাল বেশ কিছুটা সময়। তারপর? তারপর ঘুমিয়ে পড়ল সে। এমন ঘুম অনেক দিন ঘুমায়নি লালন। মনে হয়, সে বুঝি আজ সত্যি পরিশ্রান্ত। নিদ্রাদেবীর আরাধনা ছাড়া এই ক্লান্তির উপশম কিছুতেই সম্ভব হবে না।

একত্রিশ

মীরা চলে গেল, আচম্বিতে অকস্মাৎ। মধ্যরাতে। জানান দিল না। কেন? লালন জানে, এর অন্তরালে এক মহাশক্তি কাজ করে। সেই শক্তির বলেই আমরা জীবন্ত অবস্থায় পৃথিবীতে দিন কাটাই। আবার সেই শক্তির ইঙ্গিতে আমাদের জীবনদীপ নিভে যায়। কবে কে কোথায় কখন মারা যাবে, আগাম অনুমান করা সম্ভব নয়।

মীরাকে দেখে মনে হল সে বুঝি ঘুমিয়ে আছে। একটু বাদে চোখ মেলবে, কথা বলবে, সাংসারিক কাজের দায়িত্ব মাথায় নেবে।

মীরার দিকে তাকিয়ে মনটা হু হু করে ওঠে লালনের। পৃথিবীতে এসে মেয়েটি কী পেল? রাশি রাশি যন্ত্রণা আর অপমান! তবু হয়তো তার ভাগ্য ভালো, এতদিন বেঁচে থাকার ছাড়পত্র পেয়েছে। কবেই তার যুবতী শরীর আগুন গ্রাস করত। অস্থিমজ্জা সবকিছু গিলে ফেলত। কিছু শুকনো হাড় হয়তো বেঁচে থাকত!

মীরাকে গাঙের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। তারই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। সুন্দর করে সাজানো হল তাকে। এত গয়না? কী হবে? লালন বিপদে পড়েছে। শিষ্যরা কেউ কেউ বলেছিল, গয়নাগুলো রেখে দিত। কখন কোথায় কাজে লাগে কে জানে। এ ব্যাপারে লালন খুবই নিস্পৃহ। অন্যের ধন না বলে নিজের কাছে রাখতে নেই। তাহলে চুরি করা হয়। লালনের উপদেশে সমস্ত গয়না পরিয়ে দেওয়া হল মীরাকে। সালংকরা মীরা, বয়সের ভারে হয়তো যৌবনের চিকন দীপ্তি হারিয়ে গেছে। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বুঝি এক ঐশ্বর্যশালিনী রমণী। শেষ সূর্যের রশ্মি আভায় উদভাসিতা। তারপর? কেউ কি নীচু স্বরে হরিধ্বনি দিয়েছিল? কেউ কি ডেকেছিল আল্লার নাম ধরে? থমথমে পরিবেশ। সালংকরা এই দেহটি ভাসিয়ে দেওয়া হল গাঙের জলে। ভাসতে ভাসতে সেটা কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে।

আর তখনই ঝড় উঠল, আরণ্যক ঝড়। দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এল শুকনো পাতারা। অনেকদিন বাদে এমন ভয়ংকর প্রলয় দেখছে বসুন্ধরা। কড়কড় করাত শব্দে বাজ পড়ছে। শুরু হয়েছে বৃষ্টিধারা। লালন জানে, আজ পৃথিবী এভাবেই শীতল হবে। দীর্ঘদিনের জমিয়ে রাখা অভিমান আর হতাশা, বিষাদ আর বিষণ্ণতা এভাবেই অশ্রুকণা হয়ে নেমে আসবে। লালন বসে থাকল, ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। শিষ্যশিষ্যারা তার চারপাশে গোল হয়ে বসেছে। নাঃ, এই প্রথম লালনের মনে হল সব সুর সে হারিয়ে ফেলছে। সব কথা সে ভুলে গেছে। আর কোনোদিন ওই একতারা বা গুবগুবি যন্ত্রটা তার কাজে লাগবে না। আজ থেকে হয়তো সম্পূর্ণ মৌন হয়ে যাবে সে। আসলে এত দুঃখ? এত শোক? সবকিছু সে একা একা সইবে কেমন করে?

বত্রিশ

—গগন এসেছ? বসো। অনেক দিন ধরে তোমাকেই খুঁজছি আমি।

কথা বলতে কষ্ট হয়, গলা কাঁপে। তবুও কী আশ্চর্য, চোখের তারায় উজ্জ্বল জ্যোতি এখনও অমলিন।

গগন বসল, সঙ্গে তার স্ত্রী। গগন সামান্য হরকরা, এখানকার ডাক ওখানে নিয়ে যায়। মাসান্তে কিছু টাকা পায়। কিন্তু এটাই গগনের আসল পরিচয় নয়। গগন ভারি সুন্দর গান লেখে, সুর দেয়। তার কথা লোকমুখে শুনেছিল লালন। তার গান শুনে অবাক হয়েছিল সে। অনেকদিন ধরে লালন ভাবত, আমি চলে গেলে কে আমার গানের উত্তরাধিকার বহন করবে? পাঞ্জু শাহের নাম সে শুনেছে। কিন্তু পাঞ্জুর মতের সাথে তার বনিবনা হয়নি। পাঞ্জু নারীকে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে মনে করে। আর লালনের চোখে নারী হল অনন্ত শক্তির আধার। কুলকুন্ডলিনী শক্তির উদগাতা। সাধনক্রিয়ার সঙ্গিনী। তাই নিয়ে দুই দলের বিরোধ। লালন শুনেছে, নানা জায়গায় পাঞ্জু শাহের অনুগামীরা তাদের শিষ্যদের বিরুদ্ধে লড়াইতে মেতে উঠেছে। এই অনভিপ্রেত সংঘর্ষ তার ভালো লাগে না। কতদিন ভেবেছে পাঞ্জু শাকে আমন্ত্রণ জানাবে। বায়েসের জন্য। পাশাপাশি বসে তত্ত্বকথা আলোচনা করবে। প্রস্তাবও পাঠিয়েছে। কিন্তু পাঞ্জু শাহ অহংকারী। প্রত্যাখ্যান করেছে এই প্রস্তাব।

তখন থেকেই লালনের মন ভালো নেই। আমি চলে যাব, আর আমার গানের উত্তরাধিকার কেউ বহন করবে না, তা কেমন করে হয়। অবশেষে এই গগন হরকরা, তাকে দেখে অবাক হয়ে গেল লালন। পিছিয়ে গেল অনেকগুলো বছর। একশো বছর আগের পৃথিবী, সে তখন সবেমাত্র এক কিশোর। ডাগর দুটি চোখের তারায় শতসহস্র প্রশ্ন। শালুকবনে ঘুরে বেড়াচ্ছে একা একা। দেখছে কাঠবেড়ালি কোথায় কুটুর কুটুর শব্দে গাছ কাটছে। বিশ্বপ্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। সেই ষোলো বছরের লালন, আর এই গগন হরকরা—দুজনের মধ্যে অদ্ভুত মিল। চেহারা এবং মননে। গানের কথায় এবং সুরে।

লালন বলল—আমার যাবার সময় হয়েছে, গগন বড্ড দেরী করে এলে, তবে শেষপর্যন্ত যে আসতে পেরেছে, তাতেই আমি খুশি হয়েছি।

শ্যামা ডুকরে কেঁদে উঠল। গগনের একান্ত অনুরাগিনী। তার গানের ভক্ত। গানকে ভালোবেসেই অসহায় গগনকে বিয়ে করেছে শ্যামা।

তার মুখের মধ্যে চম্পাকে খুঁজে বেড়ায় লালন। খুঁজে পায় কি? লালন বলল—গগন, গান শোনাবে? আমার বড়ো সাধ ছিল, তোমার মুখ থেকে তোমার গান শুনব।

গগন জড়োসড়ো হয়ে এককোণে সরে গেল। আভূমি আনত হয়ে প্রণাম করল ওই মহাসাধককে। তারপর একতারাটি তুলে নিল। গাইল বেলা শেষের গান। গাইল জীবন যুদ্ধের গান। গাইল মহামৃত্যুর গান।

গগন গাইল—

 দু চোখ মেলে দেখ রে

 চেয়ে জগৎ সংসার।

 হেথা পাত্র-মিত্র শত্রু-বন্ধু

 কেউ তো নয় কার।

শ্যামা গাইল—

 ভবের খেলা সাঙ্গ হলে

 আসমানেতে যাবো চলে

 তখন কোথায় জীবন

 কোথায় যৌবন

 তখন মুরশিদ শুধু

 আমার।

দুজনে একসঙ্গে গাইল—

 দু চোখ মেলে দেখরে

 চেয়ে জগৎ সংসার।

তন্ময় হয়ে বসে আছে লালন। গান শেষ হয়ে গেছে। চারপাশে বিরাজ করছে নিঝুম নীরবতা। একটি দুটি তারার ঘুম ভাঙছে। একী সাঁই, তুমি কাঁদছ কেন? সত্যিই তো এই কান্নার উদগত ধারাকে লালন রোধ করল না। অনেকদিন সে ইচ্ছে করেই পৌরুষের আঘাতে কান্নাকে থামিয়ে দিয়েছে। আজ তার এই জীবনের যত দুঃখ জ্বালা যন্ত্রণা—সবকিছু কান্নার মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে। এ অশ্রু বড়ো পবিত্র, একে রোধ করতে নেই।

তেত্রিশ

কেউ জানে না, সাঁই কোথায় চলে গেছে। সঙ্গে নিয়ে গেছে তার প্রিয় একতারাটি। শিষ্যশিষ্যরা হতবাক। এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে, সেটা ছিল তাদের স্বপ্নের অগোচর। বিশেষ করে ভোলা আর শীতল। কত বছর হয়ে গেল লালনের সঙ্গে কাটিয়েছে তারা। কত শীত বর্ষা বসন্ত। কত বিষণ্ণতা এবং উল্লাস। আজ সবকিছু বড়ো ফাঁকা বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু, এ বিহ্বলতা ক্ষণকালের। আবার তাদের জেগে উঠতে হবে। কে বলেছে, লালন নেই? ওই তো সাঁই আছে নিশান্তিকায় আলোয়, অসংখ্য নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশে, বনতুলসীর গাছে, নবজাতিকার কান্নায়, ভোরের আজানে, সন্ধ্যা আরতির বন্দনায়—সে আছে এই মহাপৃথিবীর সর্বত্র।

তখন থেকেই শুরু হল এক নতুন সাধনা। সাঁইপন্থী শিষ্যরা ছড়িয়ে পড়ল এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে। তাদের পরনে গেরুয়া আলখাল্লা, হাতে একতারা, কন্ঠে লালনের গান। এভাবেই এখন তাদের কঠিনকঠোর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাতে হবে। সাঁইকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, অনাগত ভবিষ্যতের জন্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *