লালজি
নামনি আসামের ধুবড়ি শহর থেকে কয়েকমাইল দূরত্বেই গৌরীপুর। গৌরীপুরের জমিদারদের রাজা আখ্যা ছিল। বাংলার চলচ্চিত্র জগতের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়ার নাম আপনারা সকলেই জানেন। প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়া ছিলেন ছোট রাজকুমার। তাঁর নামই লালজি। ছোট্টখাট্টো মানুষটি—অসাধারণ রসবোধসম্পন্ন। প্রথম যৌবনে অসাধারণ শিকারিও ছিলেন। বন্দুক রাইফেল এবং পিস্তলে তাঁর ‘হাতের’ জন্যে আজও তিনি কিংবদন্তি হয়ে আছেন ওই অঞ্চলে। ওঁর দিদি বড় রাজকুমারীও মাত্র তেরো বছর বয়সে প্রথম বাঘ মারেন।
বড়ুয়া পরিবারে হাতির এক বিশেষ স্থান ছিল। যাঁরা প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ ছবিটি দেখেছেন তাঁদের সেই পাহাড়প্রমাণ হাতিটির কথা মনে থাকতে পারে। তার নাম ছিল সম্ভবত জংবাহাদুর। দুরারোগ্য অ্যানথ্রাক্স রোগে সে মারা যাওয়ার পরে গৌরীপুরের রাজাদের বাসস্থান মাটিরাবাগ প্যালেস—এ তাকে কবর দেওয়া হয়। রাজবাড়িটি এখনও আছে। একটি টিলার ওপরে।
শিকারি হিসেবে নয়, হাতি—বিশেষজ্ঞ হিসেবে লালজি সারা পৃথিবীতে পরিচিত ছিলেন। দু’ভাবে বুনো হাতি ধরা হয় আমাদের দেশে। এক ‘খেদা’, আরেক ‘মেলা’। মধ্যযৌবন থেকেই লালজির পেশা ছিল বনবিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে হাতি ধরে সেই হাতি বিভিন্ন রাজা, মহারাজা, জমিদার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে বিক্রি করা। শেষ জীবনে যখন হাতি—ধরা বেআইনি হয়ে যায় তখন তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুরোধে বুনো হাতি গ্রামগঞ্জে ঢুকে উৎপাত শুরু করলে তাদের তাড়ানোরও দায়িত্ব নিতেন। তিনি তো বটেই তাঁর কন্যা পার্বতী বড়ুয়াও এই বিশেষ কাজে দক্ষ। এবং উনিও বনবিভাগের এই কাজে শামিল হন প্রয়োজন হলেই।
শোনপুরের মেলায়, যা ভারতের নানা বড়—ছোট প্রাণীর সবচেয়ে বড় বাৎসরিক মেলা—যেখানে সারা ভারত থেকে মানুষ হাতি বেচা—কেনা করতে আসতেন, সেই মেলাতে লালজির মতামতই ছিল শেষ কথা হাতির ব্যাপারে। লালজিকে সকলে ‘বাবা’ বলে ডাকত সেখানে। হাতির পায়ের নখ দেখে বাবা বলে দিতেন কোন হাতি সুলক্ষণা। হাতির দাঁত, শুঁড় ও লেজ দেখেও বলতে পারতেন। একদাঁতি ‘গণেশ’—এর মধ্যে কার স্বভাব কেমন হবে তাও বলতে পারতেন।
ওঁকে আমি প্রথম দেখি আমার বারো বছর বয়সে। প্রিয়নাথ মুখার্জি তখন আসাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরার আয়কর কমিশনার ছিলেন। তখন খাসি ও জয়ন্তীয়া হিলসও আসামের অধীনেই ছিল। লালজি যমদুয়ারের কাছে রাঙানদীর পাশে হাতি ধরার ক্যাম্প করে ‘খেদা’ করে হাতি ধরছিলেন তখন। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে। বাবা এইট মিমি মুভি ক্যামেরাতে বুনো হাতি পোষমানানো, তাদের দৌড় করানো, নানা আদেশ রপ্ত করার নানা প্রক্রিয়ার রঙিন ছবি তুলে রেখেছিলেন।
পরবর্তী জীবনে লালজির অনেক স্নেহ ও সম্মান পেয়েছিল এই অধম। তিনি আমার লেখার খুবই ভক্ত ছিলেন এবং বারবার সে কথা নানা চিঠিতে প্রকাশও করেছেন। তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল যে তাঁকে নিয়ে আমি একটি বই লিখি। এ প্রসঙ্গে ওঁর লেখা একটি চিঠি আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত আমার ‘বনজ্যোৎস্নায়, সবুজ অন্ধকারে’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে উদ্ধৃতও করেছি। উৎসাহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন।
পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগে যেখানে গরুমারা অভয়ারণ্য, তার কাছেই মূর্তিনদীর ওপরে বনবিভাগ অতি চমৎকার বনবাংলো ও গাছ—বাড়ি বানিয়েছেন সাম্প্রতিক অতীতে। সেই মূর্তি ব্লকের এক ফরেস্টার বা রেঞ্জারের কোয়ার্টারে তাঁর দুটি হাতি নিয়ে থাকছিলেন একসময়ে লালজি বনবিভাগের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে। শিলিগুড়িতে কাজে গিয়ে সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে শুধুমাত্র ওঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্যেই অনেক খুঁজে খুঁজে মূর্তিতে গিয়ে এক শীতের বিকেলে পৌঁছেছিলাম। সেদিন মূর্তি বস্তিতে হাট ছিল। উনি হাট করছিলেন। ‘রাজা’কে খুঁজছি শুনে হাটুরেরাই তাঁকে দূর থেকে দেখিয়ে দিল। একটি হাতে—সেলাই—করা কাপড়ের থলি গলা থেকে পেটের ওপরে ঝোলানো, খাকি প্যান্টের সঙ্গে ইস্ত্রিবিহীন খাকি শার্ট এবং পায়ে বাটা কোম্পানির সস্তাতম লাল কেডস পরে রাজা যখন হাসিমুখে এলেন গাড়ির সামনে, আমার আরণ্যক—এর রাজা দোবরু পান্নার কথা মনে হয়েছিল।
বড়ই দুঃখের কথা এই যে, এইরকম একজন মানুষ যোগ্য প্রচার পেলেন না। উনি প্রায় বারো—তেরোটি আদিবাসী ভাষা বলতে পারতেন তাদেরই মতো করে। শুনেছি, যে—জঙ্গলেই ক্যাম্প করে যখন থাকতেন সেখানের কোনও আদিবাসী তরুণীকে সঙ্গিনী করতেন। প্রকৃতি আর যুবতী নারী যাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গিনী ছিল তাঁর তো কোনওদিনই বুড়ো হওয়ার কথা নয়। বুড়ো বলতে আমরা যা বুঝি তা কখনও হনওনি। রসবোধও ছিল প্রচণ্ড। মূর্তিতে ওঁর জন্যে রাম নিয়ে গিয়েছিলাম। রাম আর ডিম ভাজা খেতে খেতে অনেকক্ষণ গল্প হল। আমার রাতেই শিলিগুড়ি ফেরার ছিল, পরদিন বাগডোগরা থেকে প্লেন ধরার জন্যে। উনি বললেন, নবকান্ত বড়ুয়া একবার আইস্যা কইল,—রাজা, আপনারে ইলেকশনের টিকিট দিমু, আপনার মন্ত্রী হওন লাগে। তাতে উনি বলেছিলেন, আমি রাজা, কোন দুঃখে মন্ত্রী হইতে যাম?
জানি না, অতবড় একজন গুণী ও মানী মানুষ ওঁর চেয়ে বয়সে তো বটেই, সবদিক দিয়েই ছোট আমার মতো একজন নগণ্য মানুষকে কেন ‘গুহসাহেব’ বলে ডাকতেন। ওঁর চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে আমার অফিসে এসে যমুনাদেবীর ছেলেকে একটি কাজ দেওয়ার অনুরোধ জানান। আমার ভাই বিশ্বজিৎ এবং অন্য অংশীদারেরাই এখন অফিসের কাজ দেখেন। ভাইকে বলাতে সে তাকে আমাদের অফিসেই একটি যৎসামান্য কাজে বহাল করে। সে আজও আমাদের কাছেই আছে। এই আমার এক বিশেষ আনন্দ।
লালজির মতো মানুষের স্নেহ এবং আশ্চর্য শ্রদ্ধা এবং বনের রাজার কাছ থেকে আমার বনজঙ্গলের লেখার উদার প্রশংসা যে পেয়েছি তা আমার জীবনের মস্ত বড় পাওয়া। যাঁরা বনে—জঙ্গলেই সারাজীবন কাটিয়েছেন, বন ও বন্যপ্রাণী সম্বন্ধে যাঁদের অজানা কিছুই নেই তাঁদের প্রশংসার দামই আলাদা। বড় বড় সাহিত্য পুরস্কার নাই—ই বা পেলাম এ জীবনে— পাঠক—পাঠিকাদের ভালবাসা ও শ্রদ্ধাই আমার শিরোধার্য।
দুঃখ হয় একটা কথা ভাবলে যে দেশে এত ফিল্ম ডিরেক্টর, এত ওয়াইল্ড—লাইফ রাইটার এবং ফোটোগ্রাফার তাঁদের মধ্যে একজনও লালজির মতো মানুষকে নিয়ে একটি বই লিখলেন না, ডকুমেন্টারি ছবি করলেন না। আজকে তো মাথা খুঁড়লেও আর তাঁকে পাওয়া যাবে না। যখন উনি ওঁকে নিয়ে লিখতে বলতেন তখন আমার পেশাতে আমি এতই ব্যস্ত ছিলাম যে সারা ভারতে চরকির মতো ঘুরতে হত—তাই সম্ভব ছিল না। তবে একটিমাত্র বই লেখা হয়েছে লালজির উপরে। পুলিশের অবসর প্রাপ্ত ডি. আই. জি. শ্রীপাঁচুগোপাল ভট্টাচার্য ”হাতির সঙ্গে পঞ্চাশ বছর” লিখেছিলেন লালজির সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়ে। বইটি ভাল বই। তবে লালজির ধারণা ছিল যে ওঁকে নিয়ে আমি লিখলে বইটি আরও ভাল হতে পারত। আমি অবশ্য সে কথা মানি না। বইটি যথেষ্টই ভাল বই।
শেষ করার আগে বলি যে, লালজির দিদি প্রতিমা বড়ুয়াও আসামের বিখ্যাত গায়িকা। এবং তাঁর গোয়ালপারিয়া গান—হস্তীকন্যার গানগুলি সারা দেশেই বিখ্যাত। ওঁরও খুব ইচ্ছে ছিল যে ওঁকে নিয়ে আমি একটি বই লিখি। বেশ কয়েক বছর আগে যখন ধুবড়ি বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়েছিলাম তখন উনি আমাকে গৌরীপুরে তলব করেছিলেন। ওঁর কাছে যাওয়াতে ওই অনুরোধই করেছিলেন দু—হাত ধরে। কিন্তু আগেই বলেছি, আমি তো অন্য পেশার মানুষ। ফাঁকিবাজিতে যেহেতু বিশ্বাস করি না, কোনও কাজ হাতে নিয়ে তা ভালভাবে করতে না পারলে সে কাজে আমি হাতই দিতে চাই না। কোনও গুণী ও বিখ্যাত মানুষের জীবনী লিখতে হলে যে সময় এবং যে লাগাতার মনোযোগ সেই কাজে দেওয়া প্রয়োজন, সেই সময় আমার হাতে ছিল না। সেই দুঃখ আমারই রইল। প্রতিমা বড়ুয়াও গত হয়েছেন কিছুদিন হল।
হাতিই ছিল বড়ুয়া পরিবারের সুখ এবং দুঃখও। বড় রাজকুমারীর ছেলে মুণীন্দ্র বড়ুয়াকেও আমি চিনতাম। আমার পৈতৃক নিবাসের কাছেই বাড়ি করেছিলেন ওঁরা। মুণীনবাবুও হাতি শিকার করতে গিয়ে এক রাতেরবেলা হাতির তাড়া খেয়ে আলু—খোঁড়া গর্তে পড়ে গিয়ে মেরুদণ্ডে আঘাত পান। বাকি জীবন তাঁকে শয্যাশায়ীই থাকতে হয়। এ খবরও আমি লালজির কাছেই পাই।
লালজির মেয়ে পার্বতী উত্তরবঙ্গেই বাড়ি করে থিতু হয়েছে। মাদারিহাটের সামনের হাইওয়ে থেকে পার্বতীর বাড়ি দেখা যায়। পথের বাঁদিকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে পার্বতীও ভাল গান গায়, হস্তীকন্যার গান। তার সঙ্গে দু বছর আগে আমার প্রথম দেখা হল ‘আরণ্যক’ আয়োজিত ওয়াইল্ড লাইফ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরে সঞ্জয় বুধিয়ার দেওয়া একটি পার্টিতে। বেঙ্গল ক্লাবে। পার্বতীর কাছেই শুনলাম যে আমি যখন মূর্তিতে লালজির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম তখন ও—ও ছিল সেই বাংলোতে। আমি দুর্জন বলেই হয়ত লালজি আমার সঙ্গে তাঁর সুন্দরী কন্যার মোলাকাত করাননি।
আমার সঙ্গে শিলিগুড়ির একজন ব্যবসাদার ছিলেন যিনি লালজির সম্পূর্ণই অপরিচিত, হয়তো সেই জন্যেই করাননি।