লালগড়ের রত্নপেটিকা
প্রস্তাবনা
সেবার ডিসেম্বরের মাঝামাঝি কয়েকটা দিন আমার এক বন্ধু মেজর শৌরীন্দ্র উপাধ্যায়ের বাড়িতে কাটিয়েছিলুম। তাঁর বাড়ি বিহারের রাজমহল এলাকার একটা সমৃদ্ধ জনপদ লালগড়ে। গঙ্গার একটা শাখা এঁকে-বেঁকে কিছুদূর চলার পর আবার ধনুকের মতো বেঁকে গঙ্গায় মিশেছে। কাজেই বলতেই হবে এর মাঝামাঝি পাহাড় আর অরণ্যের মাঝখানে লালগড়কে যেন গঙ্গাই দু’হাত বাড়িয়ে নিজের কোলে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। ভূপ্রকৃতির এই ধরনের খেলা সচরাচর দেখা যায় না। শৌরীন্দ্র আমাকে বলেছিলেন, তাঁর পূর্বপুরুষ বসবাসের জন্য এই লালগড়কেই বেছে নিয়েছিলেন। কারণ এর চারদিকেই গঙ্গামাঈজী পাহারা দিচ্ছেন। উত্তরে গঙ্গা, পূর্বেও গঙ্গা, পশ্চিমেও গঙ্গা আবার দক্ষিণেও গঙ্গা। অবশ্য দক্ষিণের গঙ্গা-ই মূল ধারা। সেখানে এই নদী পূর্ববাহিনী। বিস্তারও কমপক্ষে চর-সমেত সাত-আট মাইলেরও বেশি। কিন্তু শাখানদীটির বিস্তার কোথাও সংকীর্ণ, কোথাও কিছুটা প্রশস্ত। প্রথমে উত্তরবাহিনী হয়ে ঘুরতে ঘুরতে আবার সে দক্ষিণে এসে মূল ধারায়। মিশেছে। শৌরীন্দ্রের ধারণা, তারই কোনো পূর্বপুরুষ লালগড়কে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য আসলে একটা খাল কেটেছিলেন। তা না হলে এই প্রায় ত্রিকোণ শাখাঁটির নাম কাটিগঙ্গা হবে কেন।
কাটিগঙ্গা দিয়ে ঘেরা পাহাড় আর অরণ্যময় ভূখণ্ডটির আয়তন প্রায় চল্লিশ বর্গমাইল। লালগড় ঠিক মাঝখানে মোটামুটি সমতল একটা উপত্যকায় অবস্থিত। লালগড়ের চারধারেই কাটিগঙ্গার ধার ঘেঁষে অনেক জনবসতি আছে। সেখানে বাস করে যারা তাদের জীবিকা মাছ ধরা। এছাড়া অন্যসব জায়গায় বসবাস আদিবাসীদের। শৌরীন্দ্ৰ উপাধ্যায়ের ঠাকুরদা ব্রিটিশ সরকারের কাছে কাটিগঙ্গার উত্তরদিকে একটা ব্রিজ তৈরির জন্য সাধাসাধি করেও সফল হননি। কিন্তু স্বাধীনতার পর বছর দশেকের মধ্যেই উত্তরে ব্রিজ তৈরি হয়েছিল। এর ফলে ত্রিভুজাকৃতি ভূখণ্ডটির সঙ্গে উত্তর বিহারের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। আর তাতে লালগড়ের সমৃদ্ধি আরও স্ফীত হয়ে ওঠে। তখন অবশ্য উপাধ্যায় পরিবারের মুঠো থেকে ভূখণ্ডটি বেরিয়ে গেছে। লালগড়ে পুলিশের খানা, কোর্ট-কাছারি সবই হয়েছে। স্কুল-কলেজও হয়েছে। শুধু একটি বিস্তীর্ণ টিলার মাথা কেটে গড়ে তোলা কেল্লাবাড়িটি উপাধ্যায় পরিবারের হাতেই থেকে গেছে। তবে সেই কেল্লাবাড়ি আর বাসযোগ্য হয়ে ছিল না। প্রাসাদগুলি ভেঙেচুরে জঙ্গল গজিয়ে উঠেছিল। বংশের একমাত্র সলতে শৌরীন্দ্র উপাধ্যায় তাঁদের পরিত্যক্ত কেল্লাবাড়ি থেকে একটু তফাতে বাড়ি তৈরি করেছিলেন। বাড়িটা একেবারেই বাংলোর ধাঁচে গড়া। এই ধরনের বাংলোয় একসময় য়ুরোপীয়রা বাস করতেন। এই সুযোগেই জানানো উচিত, শৌরীন্দ্র উপাধ্যায় আমার মতোই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ছিলেন। বয়সে আমার চেয়ে কিছুটা ছোট এবং মজার কথা আমার অধীনেই স্বাধীন সরকারের পূর্বাঞ্চল বাহিনীতে তিনি ছিলেন একজন কমিশন্ড অফিসার মাত্র। নেফা জঙ্গলে একটি বাহিনীকে গেরিলা যুদ্ধে তালিম দিতুম আমি। সেই বাহিনীতে বেছে বেছে সৈনিক এবং অফিসার অর্থাৎ কমিশন্ড ব্যাংকের লোকেরাও ছিলেন। আমি অবসর নিয়ে চলে আসার কিছুদিন পরে শৌরীন্দ্র মেজর র্যাঙ্কে ওঠেন।
অবসর গ্রহণের পরও আমার সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখতেন। কখনো আমার অ্যাপর্টমেন্টে এসে অতিথি হতেন। কখনো চিঠি লিখে খবরাখবর নিতেন। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের একটা প্রধান কারণ আমরা দুজনেই প্রকৃতি-প্রেমিক। যাইহোক, তারই ডাকে অনেকবারই আমি লালগড়ে তাঁর বাংলোয় গিয়ে বাস। করেছি। বন-জঙ্গল পাহাড়-পর্বতে দুজনেই টো টো করে ঘুরেছি। তখন বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ ছিল না। মাঝে মাঝে মেজর শৌরীন্দ্র উপাধ্যায় নেহাৎ খাওয়ার জন্য পাখি শিকার করতেন। উল্লেখ করা উচিত তখনও আমি প্রকৃতি পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্যের অর্থাৎ ইকোলজির ব্যাপারটা স্পষ্ট করে বুঝতাম না।
দুই বন্ধুতে সারাদিন পাহাড়ে জঙ্গলে পাখি, প্রজাপতি আর অর্কিডের খোঁজে ঘুরে বেড়াতুম আর প্রায় প্রতিদিনই দুপুরে আর রাত্রে খাওয়ার জন্য বুনো হাঁস বা তিতির শিকার করে আগুনে ঝলসে লাঞ্চ পর্ব সেরে নিতুম। সঙ্গে থাকত এক ধরনের রুটি। তন্দুরের রুটি বলাই ভালো আর প্যাকেটে ভর্তি থাকত নুন, কাঁচালঙ্কা এই সব চিনিস, যা মানুষের জিভের জন্য অপরিহার্য।
বাড়তি কিছু শিকার নিয়ে বাংলোয় ফেরা ছিল আমাদের অভ্যেস। রাত্রে বাংলোর ফায়ার প্লেসের সামনে বসে কফি পানের পর চুরুট টানতে টানতে আমরা সামরিক জীবনের অনেক স্মৃতি নিয়ে আলোচনা করতুম।
বাংলো পাহারা দেওয়ার জন্য একজন দারোয়ান আছে, তার নাম মহাবীর সিং। সে-ও সেনাবাহিনীতে ছিল। মেজর শৌরীন্দ্রের সঙ্গে সেই সূত্রে তার আলাপ। আর। কেয়ারটেকার এবং বাজার সরকার–দুই কাজের দায়িত্ব রতনলাল শর্মার হাতে। মধ্যবয়সী এবং মোটামুটি লেখাপড়া জানা এই মানুষটি শৌরীন্দ্রের খুব বিশ্বস্ত। রতনলালের পূর্বপুরুষও লালগড় কেল্লার কর্মচারী ছিলেন। আর রান্নার ভার এক মুসলমান বাবুর্চির হাতে, তার নাম করিম খাঁ। শৌরীন্দ্রের পরিবারে নাকি জাতবিচার একেবারেই ছিল না। তার বাবা, ঠাকুরদা সবাই বিলেত ফেরত ছিলেন এবং মানুষ হিসেবে খুব উদার প্রকৃতির। উপাধ্যায় পদবি একান্তভাবে ব্রাহ্মণের। উপাধ্যায় থেকেই ওঝা শব্দটা এসেছে। বাংলায় ওঝা পদবিধারীরা ব্রাহ্মণ। অথচ এটাই আশ্চর্য ওই ত্রিকোণ ভূখণ্ডে যারা আগে বাস করত তারা রাজবাড়ির এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাত না। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে লালগড়ে যখন বাইরের লোকের ভিড় বেড়েছিল তখন রাজ-পরিবারের একমাত্র শেষ জীবিত বংশধর মেজর শৌরীন্দ্র উপাধ্যায় একেবারে বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করেন। তাঁকে নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। শৌরীন্দ্রের স্ত্রী ছিলেন এক মেমসাহেব। কিন্তু স্বামীর এই বন্য জীবনযাপনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে তিনি ডিভোর্স নিয়ে লন্ডনে ফিরে যান। শৌরীন্দ্র বলতেন, আমার সৌভাগ্য যে এমিলির গর্ভে কোনো সন্তান আসেনি। বিহারের জাত-পাত সংক্রান্ত উগ্র কুসংস্কার শৌরীন্দ্র-পরিবারকে বরাবর দূরে সরিয়ে রেখেছিল। এতে তিনি স্বস্তি পেয়েছিলেন।
এতক্ষণ ধরে বিস্তারিত এই বিবরণ দেওয়ার একটিই উদ্দেশ্য, যিনি আমার এই জার্নাল পড়বেন, তার কাছে সে ঘটনা বলতে যাচ্ছি, তার পরিপ্রেক্ষিত স্পষ্ট হবে। বিশেষ করে সেবার ডিসেম্বরে গিয়ে যে রোমাঞ্চকর এবং রহস্যময় গোলকধাঁধায়। ঘুরে মরছিলুম তার সূত্র পেতে এই প্রস্তাবনার দরকার ছিল।
.
পাগলাবাবার আবির্ভাব
সেই ডিসেম্বরের মাঝামাঝি লালগড়ে সাংঘাতিক শীত আমাদের দুজনের মতো প্রাক্তন যৌদ্ধাকে, যারা একসময় এর চেয়েও ভয়ঙ্কর অবস্থায় কাটিয়েছে, তাদের পক্ষেও অসহনীয় ছিল একথা অস্বীকার করা ঠিক হবে না। তাছাড়া বয়সের ব্যাপারটাও একটা কারণ।
তাই অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণে বের হতুম বেশ খানিকটা দেরি করেই। দশটার আগে কুয়াশা মিলিয়ে যেত না। আমরা বেরিয়ে পড়তুম সাড়ে সাতটা নাগাদ। তারপর কাঁচা রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে প্রাচীন একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের পাশে প্রকাণ্ড বেদির মতো পাথরে বসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতুম। মেজর শৌরীন্দ্র শিশিরভেজা ঝরা পাতা সরিয়ে শুকনো পাতা আর কাঠকুটো কুড়িয়ে এনে পায়ের কাছে আগুন জ্বালিয়ে দিতেন। তারপর দুজনে একটা পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে সোজা দক্ষিণে গঙ্গার মূল ধারার দিকে যেতুম। এদিকটায় বড়ো বড়ো ভাঙা ইট, শিলা ছড়িয়ে আছে। তার নীচেই বুনো হাঁসের ঝাক গঙ্গার জলে ভেসে বেড়াত। প্রতিদিনই ওই সময় কিছুটা দূরের একটা আদিবাসী বসতি থেকে একজন মধ্যবয়সী লোক আমাদের অপেক্ষা করত। মেজর শৌরীন্দ্র বন্দুকের গুলিতে এক ঝাঁক হাঁসকে ভয় পাইয়ে দিতেন এবং তারা তাঁর বন্দুকের আয়ত্তে আসার জন্যই যেন একটুখানি উড়ে গিয়ে ঘুরে ঝাঁপিয়ে পড়ত। ওই অবস্থায় শৌরীন্দ্রের বন্দুক থেকে দ্বিতীয় গুলি কমপক্ষে তিনটি হাঁসকেও আঘাত করতে পারত।
আদিবাসী লোকটির নাম ছিল ভারুয়া। অবাক হয়ে লক্ষ করতুম সে তখনই গঙ্গার ঠান্ডা হিম জলে ঝাঁপ দিয়ে আহত বা মৃত হাঁসগুলোকে আশ্চর্য দক্ষতায় কুড়িয়ে পড়ে ওঠে আসত। শৌরীন্দ্র তাকে একটা হাঁস বখশিস দিলেই সে খুশি।
সেবার আমি লালগড়ে যাওয়ার তৃতীয় দিনে সেই মন্দিরের কাছে পাথরের উপর বসে আছি এবং শৌরীন্দ্র যথারীতি শুকনো পাতা, কাঠকুটো কুড়িয়ে জড়ো করছেন। এমন সময় পেছনের দিক থেকে শুকনো পাতার ওপর পায়ের শব্দ কানে এল। আমার প্রশিক্ষিত কানে সেই শব্দ ধ্বনিত হতেই বুঝতে পারলুম পিছনে ধ্বংসাবশেষের আড়াল থেকে যে হেঁটে আসছে সে মানুষই বটে কিন্তু তার শরীরটা আমার চেয়েও ওজনদার।
মুহূর্তের জন্যে আমার সেই ইনটিউশন জানিয়ে দিল সম্ভবত আমরা বিপন্ন।
আমার ওভারকোটের ভেতর পকেটে অটোমেটিক সিক্স রাউন্ডার রিভলবার আছে। তবে আমার হাতে মেজর শৌরীন্দ্রের লোডেড রাইফেলটাও আছে। পাখি শিকারের বন্দুকটা তিনি পাখি শিকারের সেই পাথরটার গায়ে ঠেস দিয়ে রেখেছিলেন।
ভারী পায়ের শব্দটা শোনামাত্র আমি ঘুরে বসেছিলুম এবং তারপরেই উঠে দাঁড়িয়ে রাইফেল তাক করে হিন্দিতে প্রায় গর্জন করে উঠলুম-কে আসছ সাড়া দাও।
অমনি শব্দটা থেমে গেল। মেজর শৌরীন্দ্র চমকে উঠেছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই বন্দুকটা হাতে নিয়ে জিগ্যেস করলেন, কী হয়েছে কর্নেল সরকার?
তার কথার জবাব না দিয়ে আবার আমি হুমকি দিয়ে বলে উঠলুম, এখনই সামনে না এলে আমি গুলি ছুড়ব। তুমি কোথায় আছ আমি জানতে পেরেছি।
এবার কেউ হা হা করে হেসে উঠল। অমনি শৌরীন্দ্রও হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, আপনাকে বলা হয়নি কর্নেল সরকার। সম্প্রতি এই এলাকায় এক পাগলা সাধুবাবা এসেছে। সবাই তাকে পাগলাবাবা বলে। তাকে দেখলে আপনি অবাক হবেন, কারণ–
এবার দু’হাতে পিছন দিকে ঝোঁপঝাড় ঠেলে সেই পাগলাবাবার আবির্ভাব ঘটল। আমি সত্যিই হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলুম। আমার উচ্চতা ছ’ফুট দু’ইঞ্চি আর ওই সাধুবাবা আমার চেয়েও উঁচু মানুষ। প্রকাণ্ড তার শরীর। এই প্রচণ্ড শীতে তার শরীর প্রায় নগ্ন বলা-ই চলে। শুধু কোমরে একফালি নোংরা লাল কাপড় কৌপীনের মতো পরা আছে। তার গলায় একটা রুদ্রাক্ষের মালা, মাথায় ধূসর জটা, মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, কপালে খানিকটা লাল ছোপ–সম্ভবত সিঁদুরের তিলক কীভাবে ঘষা খেয়ে রক্তের ছোপের মতো দেখাচ্ছে। সত্যি বলতে কী এইরকম প্রকাণ্ড মানুষ আমি আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যেই দেখেছি। এই সাধুবাবা অবশ্য কৃষ্ণাঙ্গ নন। ধুলো বা ছাই মাখা শরীরের কোনো কোনো জায়গা শিশিরে ভিজে চামড়ার প্রকৃত রঙ বোঝা যাচ্ছে। পাগলাবাবা গঙ্গাস্নান করলেই ফর্সা হয়ে যাবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
পাগলা সাধু আমার সামনে অন্তত হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে গেলেন। তার দু’চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলুম। চোখ দুটো যেন মানুষের নয়, কোনো হিস জন্তুর।
ততক্ষণে আমি রাইফেল মাটিতে নামিয়ে নলটা ধরে আছি। পাশ থেকে মেজর শৌরীন্দ্র সকৌতুকে এই দৈত্যাকৃতি সন্ন্যাসীকে করজোড়ে প্রণাম করে হিন্দিতে বললেন, ক্ষমা করবেন সাধুবাবা। ইনি আমার বন্ধু। আসলে আপনার কথা উনি জানতেন না। তাই আপনার সঙ্গে বেয়াদপি করে ফেলেছেন।
আমি শৌরীন্দ্রের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে লক্ষ করলুম তিনি চোখের ভাষায় আমাকে কিছু বলছেন। নিমেষে বুঝতে পারলুম আমাকেও করজোড়ে প্রণাম করে ক্ষমা চাইতে হবে। অতএব আমিও রাইফেলের নল আমার উরুর উপর ঠেকিয়ে রেখে তাকে প্রণাম করে বললুম, ক্ষমা করবেন সাধুবাবা। আসলে আমি ভেবেছিলুম আপনি নয়, অন্য কেউ আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করতে আসছে।
পাগলাবাবার চোখ থেকে সেই হিংস্র ভাবটা মুছে গেল এবং তিনি আবার হা হা করে অট্টহাসি হাসলেন। তারপর চাপা কণ্ঠস্বরে শৌরীন্দ্রের উদ্দেশে বললেন, বেটা, তোর কপালে রাজতিলক দেখতে পাচ্ছি। এতদিন তোকে দূর থেকে দেখছি। এবার কাছে থেকে দেখার জন্য চুপিচুপি আসছিলুম। হ্যাঁ, তুই লালগড়ের রাজ বংশধর। তোর খোঁজেই আমি লালগড়ে এসেছিলাম।
শৌরীন্দ্রের চোখে মুখে তীব্র বিস্ময় ফুটে উঠল। তিনি বললেন, আমার খোঁজে আপনি এসেছেন! কেন সাধুবাবা?
পাগলাবাবা তার কৌপীনের মতো পরা নোংরা লাল কাপড়ের ভাঁজ খুলে একটা তামার কবচ বের করলেন। তারপর বললেন, বেটা! এই কবচটা তোকে দেব বলে আমি হিমালয় থেকে লালগড়ে এসেছি। কবচটা তোকে তার হাত থেকে রক্ষা করবে। এই নে।
শৌরীন্দ্র দু’হাত পেতে কবচটি নিলেন। তারপর বিচলিত কণ্ঠস্বরে বললেন, কে আমার শত্রু? সাধুবাবা, এই লালগড়ে আমি দশ বছর ধরে আছি। আমার সঙ্গে কারুর তো শত্রুতার সম্পর্ক নেই। আমি এখানে কারুর কোনো ক্ষতি করিনি। তাহলে আমাকে কে প্রাণে মেরে ফেলবে, অনুগ্রহ করে যদি বলেন তাহলে আমি আরও সতর্ক হতে পারি।
পাগলাবাবা বিকৃত মুখে ধমক দিলেন, কোনো প্রশ্ন নয়। তোর শত্রু আছে। তুই তার সাংঘাতিক ক্ষতি করেছিস। কিন্তু সেই কাজ তুই না জেনেই করেছিস। অথচ সে তা বোঝেনি। ব্যস, আর কোনো কথা নয়।
বলে পগলাবাবা কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালেন। আমার দিকে আঙুল তুলে বললেন, এই দাড়িঅলা লোকটা কি ম্লেচ্ছ পাদরি? বুঝতে পেরেছি। আদিবাসীদের মধ্যে সে ধর্মপ্রচার করতে এসেছে।
শৌরীন্দ্র দ্রুত বললেন, না বাবা। ইনি আমাদেরই মতন একজন হিন্দু। ইনি কলকাতায় থাকেন। এঁর নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
পাগলাবাবার দু’চোখে কৌতুকের ঝিলিক দেখতে পেলুম। কেন কে জানে তিনি ফিক করে হেসে বললেন, বাঙালি বাচ্চা! তাতে একেবারে বুড়োর বুড়ো।
আমি একটু হেসে বললুম, ঠিক ধরেছেন বাবা। আমি সত্যিই বুড়োর বুড়ো।
পাগলাবাবা মিটিমিটি হেসে বললেন, তোর কপালের লেখা দেখে বুঝতে পারছি তুই মহাধুরন্ধর। তোর সামনে-পেছনে তিনটে চোখ। তবে তোর উপরে আমার রাগ কিন্তু থেকেই গেল। তুই আমার দিকে বন্দুক তুলেছিলি! ওরে বোকা, তুই গুলি ছুঁড়ে দেখ আমার গায়ে গুলি বিধবে না।
কথাটা বলেই সন্ন্যাসীর চোখ দুটো আবার আগের মতো হিংস্র এবং উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ওঠা বন্দুক, পরীক্ষা করে দেখ আমার গায়ে গুলি বিধবে কি না, দেখে নে।
মেজর শৌরীন্দ্র একটু এগিয়ে গিয়ে করজোড়ে বললেন, আমার বন্ধুকে মাফ করে দিন। উনি না জেনে অন্যায় করেছেন। এত ভয়ঙ্কর শীতেও আপনার শরীর নগ্ন। কাজেই আমার বন্ধুর বোঝা উচিত ছিল আপনার শরীরে সত্যিই গুলি বিধবে না।
পাগলাবাবা বললেন, ঠিক আছে। তোর বন্ধুকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু তোকে যা বললুম মনে রাখবি। তোর শত্রু তোকে প্রাণে মারার সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে। সাবধান।
এই বলেই পাগলাবাবা ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাতির মতো সবেগে উধাও হয়ে গেলেন। আমরা দুজনেই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম।
একটু পরে মেজর শৌরীন্দ্র জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ঐ সন্ন্যাসী যা বলে গেলেন তা কখনোই সত্য হতে পারে না। আমি বুঝতে পারছি না আমি না জেনে কার এমন ক্ষতি করেছি।
এই কবচটা আমি তার হাত থেকে নিয়ে দেখতে দেখতে বললুম, এটা একটা সাধারণ কবচ বলে মনে হচ্ছে। এর একটা দিক গালা দিয়ে সিল করা আছে। তবে আমার ধারণা এই সন্ন্যাসী সত্যি একটা পাগল। আমাদের সামনে পাগলামি করে গেল। চলুন, আমরা গঙ্গার ধারে যাই।
মেজর শোরীন্দ্র যে এমন কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ তা কল্পনাও করিনি কোনোদিন। তিনি ক্লান্তভাবে বললেন, নাহ, কর্নেল সরকার, আজ থাক। চলুন বাংলোয় ফিরে কফি খেয়ে নার্ভ চাঙ্গা করে নিই।
.
রহস্যের মুখোমুখি
বাংলোয় ফিরে দক্ষিণের বারান্দায় বসে আমরা কফি পান করছিলুম। মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ চোখে আমার বন্ধুকে দেখে নিচ্ছিলুম। ক্রমশ আমার বিস্ময় বেড়ে যাচ্ছিল। কারণ এতকাল যে শৌরীন্দ্র উপাধ্যায়কে দেখে আসছি তিনি যেন সেই মানুষটি নন। সতত বেপরোয়া এবং যেকোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত এমন একজন দুঃসাহসী এবং এই বয়সেও দৈহিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী মানুষটি আজ হঠাৎ যেন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছেন। যতক্ষণ তিনি কফি পান করলেন ততক্ষণ তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল রুগ্ণ এবং আড়ষ্ট। তিনি নির্বাক বলেই আমিও নিশ্চুপ ছিলুম।
কফি পানের পর চুরুট ধরিয়ে চেয়ারে হেলান দিলুম। ততক্ষণে কুয়াশা অনেকটা স্বচ্ছ হয়েছে। হঠাৎ মেজর শৌরীন্দ্র যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠার মতো নড়ে বসলেন। তারপর ‘এক্সকিউজ মি’ বলে চেয়ার থেকে উঠে ঘরে ঢুকলেন। তার বন্দুক এবং রাইফেল পিছনে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো ছিল। আগ্নেয়াস্ত্র দুটো নিয়ে যেতে তিনি যেন ভুলে গেলেন। গেটের দিকে মহাবীর সিংকে দেখতে পাচ্ছিলুম। গেটটা সে খুলে দিল। রতন শর্মা সাইকেলে চেপে বাজার থেকে ফিরলেন। তারপর আমার চোখে পড়ল গেটের কাছেই মহাবীর তাকে কিছু বলল। অমনই রতনবাবুর মুখের হাবভাব বদলে গেল। তিনি লন দিয়ে। সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে বাঁদিকে ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বাংলোবাড়ির সদর দরজাটা পশ্চিমে। কিচেন এবং রতনবাবুর থাকার ঘর উত্তরে।
একটু পরে করিম খাঁ কফির কাপ-প্লেট এবং অর্ধভুক্ত স্ন্যাকসের প্লেটসুষ্ঠু প্রকাণ্ড ট্রেটা দু’হাতে তুলে ধরে গম্ভীর মুখে চাপা স্বরে বলল, হুজুর কর্নেল সাব, আপকা দোস্ত আজ হাপে ফিরে এলেন। তাকে এক পলক দেখে মালুম হল কিছু গড়বড় হয়েছে।
সে প্রায় ফিসফিস করে কথা বলছিল। আমিও তেমনই চাপা স্বরে তাকে বললুম, এর আগেও কি আমার দোস্তসাবকে কখনো তুমি এমন অবস্থায় দেখেছো? না, আমি খালি হাতে ফেরার ব্যাপারটা বলছি না। তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ ওঁকে খুব কাহিল দেখাচ্ছে।
করিম খাঁ বিকৃত মুখে বলল, আমার মনে হচ্ছে কর্নেল সাব, আপনার চোখে না পড়লেও আমার মালিকের চোখে আবার সেই শয়তানটা ধরা পড়েছিল।
চমকে উঠে বললুম, শয়তানটা কে?
করিম খাঁ বলল, আপনি আমার মালিককে পুছ করলে উনি কথাটা হেসে উড়িয়ে দেবেন। কিন্তু আমি জানি যখনই উনি ওই শয়তানকে জঙ্গলের আড়ালে কোথাও উঁকি দিতে দেখেন তখনই উনি জঙ্গলের দিকে তাক করে ফায়ার করেন।
দ্রুত বললাম, আজ কিন্তু তোমার মালিক তেমন কিছু করেননি। তবে এক সাধু, যাকে সবাই পাগলাবাবা বলে–
করিম খাঁ আমার কথার উপর বলে উঠল, পাগলাবাবাকে আমিও দেখেছি। সে আবোলতাবোল বাতচিত করে। তার কথা আমি বলছি না। হুজুর কর্নেল সাব, মওকা পেলে আমি আপনাকে শয়তানটার কথা বলব। এর আগে আপনি কতবার এসেছেন, তখন কিন্তু এই আপদটা ছিল না।
কথাটা বলেই সে ট্রে হাতে নিয়ে দ্রুত বারান্দার পূর্বদিকে এগিয়ে গেল এবং বাঁদিকে ঘুরে অদৃশ্য হল। বলা দরকার বাংলোবাড়িটার চারদিকেই চওড়া বারান্দা এবং বারান্দার উপরটা রঙিন টালির ঢালু চালে ঢাকা। আমার পিঠের দিকে যে ঘর সেটা গেস্টরুম। ওই ঘরটায় আমি থাকি। এর সংলগ্ন একটা বাথরুম আছে। তার ওপাশে প্রশস্ত ড্রইংরুম এবং তার সংলগ্ন মেজর শৌরীন্দ্রের বেডরুম। মেজর সম্ভবত তার বেডরুমে গিয়ে ঢুকেছেন বেবে আমি বাঁদিকে মুখ বাড়িয়ে দরজার ভিতর লক্ষ করছিলুম তিনি ফিরে আসছেন কি না। সব ঘরেই কার্পেট পাতা কাজেই পায়ের শব্দ শোনা সম্ভব নয়। কিন্তু ড্রয়িংরুমের পর্দাও খোলা ছিল। তাই আমি অপেক্ষা করছিলুম আমার বন্ধু বেডরুম থেকে কখন বেরিয়ে আসবেন।
বেশিক্ষণ এভাবে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকা হাস্যকর। তাই সোজা হয়ে বসে ঘড়ি দেখলুম। সাড়ে নটা বাজতে চলেছে। দশটার মধ্যেই ব্রেকফাস্ট খেয়ে নেওয়ার কথা। আমি পা দুটো বেতের টেবিলের তলা দিয়ে লম্বা করে পায়ের আড়ষ্টতা ভাঙার চেষ্টা করলুম। সেই সময় দেখলুম টেবিলের তলায় পাগলাবাবার দেওয়া সেই কবচটা পড়ে আছে। তখনই মনে পড়ল শৌরীন্দ্র একবার কবচটা বের করে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে কফিতে চুমুক দিচ্ছিলেন। সম্ভবত প্রচণ্ড অন্যমনস্কতায় জন্য কবচটা তার হাত থেকে নীচে গড়িয়ে পড়েছিল।
দ্রুত একটু ঝুঁকে আমি জুতোর ডগা দিয়ে কবচটা কাছে অনলুম। তারপর সেটা তুলে নিলুম। দেখলুম কবচটা তামারই বটে এবং তত বেশি পুরনো নয়। কবচটা বেশ মোটা। একটা মুখে এবড়ো-খেবড়ো গালার সিল। আতস কাঁচ বের করে সিলটা পরীক্ষা করলুম। তারপর আমার মাথায় তীব্র খেয়াল চেপে বসল। আমি গেস্টরুমে ঢুকে ওভারকোট আর টুপি খুলে রাখলুম। গলা থেকে বাইনোকুলার খুলে টেবিলে রেখে দিলুম। আমার পরনে এখন পুরু একটা জ্যাকেট। জ্যাকেটটা খুলেই আমি সটান বাথরুমে ঢুকে গেলাম। মেজর শৌরীন্দ্র লালগড় থেকে নিজের খরচায় বিদ্যুতের পোল বসিয়ে তার বাংলোয় বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছেন। দরজা বন্ধ করে আলো জ্বেলে সিলটা বুড়ো আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে বের করার চেষ্টা করলুম। কিন্তু সম্ভব হল না। তখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে আমার বিটব্যাগটা থেকে একটা নরুণ এবং একটা চিমটে বের করে নিলুম। এই ব্যাগে একজন। মানুষের পক্ষে দরকারি সবকিছুই রাখা আছে। তখনও মেজরের সাড়া নেই। অতএব আমার পক্ষে সুযোগটা ছিল প্রচুর। বদ্ধ বাথরুমের ভিতর আলো জ্বেলে বেসিনের পাশে সিলের গালাগুলো খুঁচিয়ে বের করে রাখলুম। তারপর দেখলুম ভিতরে একটা ভাঁজ করা কাগজ। সিলের গালাগুলো সযত্নে জড়ো করে রাখার পর সরু চিমটের সাহায্যে ভাঁজ করা কাগজটা টেনে বের করলুম। তারপর সাবধানে কাগজের ভাজ খুলে ফেললুম। ইঞ্চি তিনেক লম্বা আর ইঞ্চি দুয়েক চওড়া একটা পুরু ম্যাপলিথো কাগজ। তার উপরে হিন্দি দেবনাগরী লিপিতে যা লেখা আছে তার বাংলা করলে এই রকম দাঁড়ায় :
আমার বংশধরদের মধ্যে কেউ যদি এখনও জীবিত থাকে তাকে জানাচ্ছি যে ধরমদাস শেঠের উত্তরাধিকারীর কাছে সে যেন আমার গচ্ছিত রত্নের বাক্সটি দাবি করে। তার সঙ্গে দেবতা সাক্ষী করে এই চিঠি লেখা হল। নীচে তার স্বাক্ষরও আছে। এটি দেখালেই সে বাক্সটি দিতে বাধ্য। যদি না দেয় তাহলে সে যেন আমার বন্ধু বংশীধারী লালার পরিবারের কোনো বংশধরের সাহায্য চায়। ইতি—
জগদিন্দ্ৰ উপাধ্যায়
এই চিঠির বাঁপাশে কোণের দিকে অস্পষ্টভাবে ধরমদাস শেঠের স্বাক্ষর আছে। যে তারিখ দেওয়া হয়েছে তা শকাব্দের। অতএব আমাকে আবার আমার কিটব্যাগের ভিতর নোটবইটার শরণ নিতে হবে। এটাই আশ্চর্য, কাগজটা আমার তত পুরনো মনে হল না। ম্যাপলিথো কাগজ বলছি বটে কিন্তু কাগজটা আগের দিনের আর্ট পেপারও হতে পারে। লাল কালিতে লেখা অক্ষরগুলো কোথাও কোথাও অস্পষ্ট হলেও বুঝতে আমার ভুল হয়নি। কাগজটা আবার ভাজ করে কবচে ডুকিয়ে দিলুম। তারপর কিছুটা গালা তাতে গুঁজে দিয়ে বাকি গালাটুকু লাইটার জ্বালিয়ে গলিয়ে নরুণের সাহায্যে চ্যাপ্টা করে দিলুম। তারপর গরম অবস্থায় চিমটে দিয়ে সেটা কবচের মাথায় বসিয়ে দিলুম। এবার নরুণের সাহায্যে সিলটা এবড়ো-খেবড়ো করে দিলুম। শকাব্দের তারিখটা আমি মুখস্থ করে নিয়েছিলুম। এরপর বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলুম তখনো শৌরীন্দ্রের পাত্তা নেই। অতএব কিটব্যাগে নরুণ আর চিমটেটা রেখে দিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে টেবিলের তলায় কবচটা রেখে দিলুম। তারপর ঘরে ফিরে ইজিচেয়ারে বসে কিটব্যাগের জরুরি নোটবইটা খুলে শকাব্দের হিসেবের পাতায় চোখ রাখলুম। বলা দরকার এই নোটবইয়ে ভারতের সমস্ত অঞ্চলের তো বটেই, বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রচলিত সন-তারিখের খ্রিস্টাব্দের হিসেব আমি তৈরি করে রেখেছি। এই নোটবইটাকে আমার স্নেহভাজন সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্ত ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ বলে ঠাট্টা করে। প্রকৃতপক্ষে এটা তা-ই। শকাব্দের তারিখ হিসেব করে দেখলুম ওই কবচের চিরকুট অর্থাৎ দলিলটা প্রায় সত্তর বছর আগে লেখা। তারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর নোটবইটা যথাস্থানে রেখে আমি উঠে দাঁড়িয়েছি, সেই সময় মেজর শৌরীন্দ্র গেস্টরুমের ভিতর দিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় গেলেন। আমার দিকে তিনি যে তাকাননি তা একটু পরেই টের পেলুম। তিনি ডাকছিলেন-কর্নেল সরকার, আপনি কোথায়? তার কণ্ঠস্বর রুগ্ণ মানুষের। আমি সাড়া দিয়ে সেদিকে গেলুম। বললুম, আমি বাথরুমে ছিলুম।
তারপর লক্ষ করলুম তার ডান করতলে সেই কবচটি রাখা আছে এবং তিনি নিষ্পলক চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বসার পর বললুম, পাগলাবাবার কবচটা–এই সম্পর্কে আপনি নিশ্চয় কিছু ভাবছেন?
তিনি অন্যমনস্কভাবে বললেন, হ্যাঁ। তবে শুধু কবচটা সম্পর্কে নয়। সেই পাগল সন্ন্যাসী সম্পর্কেও আমি চিন্তিত।
বললুম, মেজর উপাধ্যায়, এযাবৎকাল আমার ধারণা আপনি কিছু গোপন করেননি।
–হ্যাঁ। এবারও যা ঘটল সে সম্পর্কে আমার ধারণার কথা আপনাকে গোপন করব না।
এই সময় করিম খাঁ এসে সেলাম ঠুকে বলল, হুজুর সাব ব্রেকফাস্ট রেডি।
শৌরীন্দ্র যেন কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন। ডাইনিং রুমে যাই। আপনার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। আপনাকে এখানে একলা বসিয়ে রেখে চলে গিয়েছিলুম সেজন্য ক্ষমা চাইছি।
বলে তিনি রাইফেল আর শটগানটা দু’হাতে তুলে নিয়ে পা বাড়ালেন। দুজনে পূর্বের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ডাইনিং রুমে গেলুম। সেই সময় জিগ্যেস করলুম, এতক্ষণ আপনি কোথায় ছিলেন?
তিনি শুধু বললেন, যথাসময়ে বলব।
তার দু’কাঁধে দুটো আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে দিয়ে করিম খাঁ মুচকি হেসে বলল–হুঁজুর মেজরসাব! বন্দুক দুটো মেহেরবানি করে টেবিলে রাখুন। তা না হলে হাত দিয়ে খাবেন কী করে?
মেজর শৌরীন্দ্রের মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটল। তিনি বললেন, করিম খাঁ। তোমার দেখা শয়তানটা আজ খাওয়ার সময় যদি হামলা করে, তাকে মারতে হবে না?
করিম খাঁ হাসিমুখে টেবিলে প্লেট সাজাতে ব্যস্ত হল। সুযোগ পেয়ে জিগ্যেস করলুম-কে সেই শয়তান মেজর উপাধ্যায়?
সৌরীন্দ্র যেন কষ্ট করে হেসে আস্তে বললেন–আমি তাকে চিনি না। দেখিনি। শুধু আমার এই বাবুর্চি খানসাহাব তাকে নাকি দেখেছে।
লক্ষ করলুম, করিম খাঁ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। রহস্যটা বোঝা দরকার। অর্থাৎ এবার লালগড়ে এসে আমি একটা বিদঘুঁটে রহস্যের মুখোমুখি হয়েছি। কারণ সেই পাগলাবাবাও শৌরীন্দ্রকে সতর্ক করেছেন।…
.
গোলকধাঁধার দিকে এক পা
ব্রেকফাস্টের পর আমি গেস্টরুমের দক্ষিণের বারান্দায় বসে চুরুট টানছিলুম। একটু পরে মেজর শৌরীন্দ্র উপাধ্যায় গেস্টরুমের ভেতর দিয়ে বারান্দায় আমার বাঁপাশে এসে বসলেন। এখন বারান্দায় কিছুটা রোদ এসে পড়েছে। দেখলুম শটগান রেখে শোরীন্দ্র রাইফেলটা নিয়ে এসেছেন। সেটা দরজার পাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি জ্যাকেটের পকেট থেকে সেই কবচটা বের করে বললেন, কর্নেল সরকার, আমি বুঝতে পারছি না এই কবচটা কীভাবে আমাকে কোনো অজানা শত্রুর হাত থেকে বাঁচাবে। আপনি তো জানেন, আমার কোনো কুসংস্কার নেই।
বললুম, কিন্তু ব্রেকফাস্টের টেবিলে করিম খাঁ এবং আপনার মধ্যে তখন একজন শয়তানের প্রসঙ্গে উঠে এসেছিল। সে নাকি আপনাকে দূর থেকে উঁকি মেরে দেখে অথবা অনুসরণ করে। আমার প্রশ্ন এই শয়তানটি কে?
শৌরীন্দ্র আমার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিলেন। আমার কথা শুনে তিনি বললেন, ওটা আসলে করিম খাঁয়ের একটা অদ্ভুত কল্পনা। হা–আমার একটা অভ্যেস ছিল বটে। ওটার জন্য দায়ী করিম খাঁ। তারপর থেকে কোথাও বেরুলে আমার মনে হত আমার পিছনে কেউ আড়াল থেকে লক্ষ করছে।
কথাটা বলেই তিনি একটু নড়ে উঠলেন-কর্নেল সরকার, আপনিই আমাকে একবার জিগ্যেস করেছিলেন আমি বারবার পিছু ফিরে পিছনে তাকাই কেন।
-হ্যাঁ। তবে এবারে লক্ষ করেছি আপনার ওই অভ্যাসটা আর নেই।
শৌরীন্দ্র হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আমার বাবুর্চি করিম খাঁ যে কারণেই হোক, যদিও আমি তাকে অসংখ্যবার প্রশ্ন করেও সদুত্তর পাইনি, যেন আমাকে অমূলক আশঙ্কা উপহার দিয়েছিল। যাই হোক, আমি নিজের চেষ্টায় এবং মরিয়া হয়ে ওই অভ্যাসটা দূর করেছিলুম। অবশ্য কখনো কখনো হঠাৎ নিজের অগোচরে আমি চমকে উঠে পিছু পিরে দৃষ্টির আয়ত্তে থাকা সব কিছু দেখে নিই।
কথাটা বলে তিনি কবচটা করতলে রেখে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে আমি চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে জিগ্যেস করলুম, আপনাদের বংশে জগদিন্দ্র উপাধ্যায় নামে কাকেও মনে পড়ে?
শৌরীন্দ্র ভীষণ চমকে উঠলেন। বললেন, জগদিন্দ্র?
বললুম, হ্যাঁ। জগদিন্দ্র উপাধ্যায় ধরুন, অন্তত পঞ্চাশ থেকে সত্তর বছর আগে তিনি জীবিত ছিলেন।
শৌরীন্দ্র ব্যগ্রভাবে বললেন, জগদিন্দ্র তো আমার কাকা ছিলেন। তার কথা আপনাকে কখনো বলেছি বলে মনে করতে পারছি না। আপনাকে কে–
তার কথার উপর বললুম, এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন। আপনি কি ধরমদাস শেঠকে চিনতেন?
শৌরীন্দ্রকে উত্তেজিত দেখাল। তিনি শ্বাসপ্রশ্বাসক্লিষ্ট, কণ্ঠস্বরে বললেন, আমার ছেলেবেলায় তাকে চিনতুম।
এবার বললুম, তৃতীয় প্রশ্ন। বংশীধারী লালা নামে কাউকে নিশ্চয় চিনতেন?
শৌরীন্দ্র হঠাৎ যেন ম্রিয়মান হয়ে গেলেন। গলার ভিতরে বললেন, বংশীধারী লালাকেও ছেলেবেলায় চিনতুম। তিনি ছিলেন লালগড়ের সবচেয়ে বড়ো ব্যবসায়ী। আর শেঠজীও মহাজনী কারবার করতেন। সুদখোর বলে তাঁর খুব দুর্নাম। ছিল। কিন্তু আপনি কি করে এঁদের কথা জানতে পারলেন?
আমি একটু চুপ করে থাকার পর মিটিমিটি হেসে বললুম, আপনার ঐ কবচটা আমাকে এইসব খবর দিয়েছে। এতে আপনার অবাক হওয়ার কিছু নেই। কবচ। আপনার হাত থেকে টেবিলের তলায় পড়ে গিয়েছিল। আমার অপরাধ নেবেন না। আপনি তো জানেনই কোনো ঘটনা রহস্যময় মনে হলেই আমি অভ্যাসবশে সেদিকে ঝুঁকে যাই। খুলেই বলছি। কবচটার সিল আমি খুলেছিলুম এবং তার ভিতরে ভাঁজ করা একটা চিরকুট ছিল। আপনি যদি বলেন তাহলে আবার আমি সিল খুলে আপনাকে তা দেখাব।
মেজর শৌরীন্দ্র হতবাক হয়ে কবচটা আমাকে দিলেন। আমি উঠে গিয়ে ঘর থেকে কিটব্যাগটা বের করে নিয়ে এলুম। তারপর আগের মতোই নরুণ ও চিমটের সাহায্যে কাগজটা বের করলুম। তখন বিদ্যুতের আলোয় কাগজটা যতটা সাদা মনে হয়েছিল, বারান্দায় ছায়ায় দেখলুম ওটা ততটা সাদা নয় বরং ঈষৎ ধূসর। ভাঁজ খুলে চিরকুটটা আমি শৌরীন্দ্রকে দিলুম। বললুম, এতটুকু উত্তেজিত না হয়ে শান্তভাবে এটা পড়ে দেখুন। তারপর এটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
অন্তত দীর্ঘ দশ মিনিট ধরে বিড়বিড় করে ওটা পড়ার পর মেজর শৌরীন্দ্র গম্ভীর মুখে বললেন, কর্নেল সরকার, আমি যখন উত্তর প্রদেশের বানগড় ব্যারাকে। ছিলুম, আমার মায়ের মৃত্যুসংবাদ পাই। আমার কাকা জগদিন্দ্র তখনও জীবিত। বাবা তো! আগেই মারা গিয়েছিলেন। কাকা আমকে মায়ের মৃত্যুসংবাদ দিয়ে। শিগগিরই লালগড়ে ফিরতে বলেন। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য ওই সময় কর্তৃপক্ষ আমাকে ছুটি দেননি। পাকিস্তান বর্ডারে ব্যাপক হানাদারির বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী–
তার কথায় উত্তরে বললুম, বুঝতে পেরেছি। তা আপনার কাকার চিঠিতে এই রত্নপেটিকার উল্লেখ ছিল কি?
শৌরীন্দ্র বললেন, হ্যাঁ ছিল। শেঠজীর কথাও ছিল। কিন্তু তখন আমি ফ্রন্টে। আমার বাঁ পায়ে মর্টারের একটা শার্পনেল ঢুকে মাসখানেক শয্যাশয়ী ছিলুম। বছর তিন-চার একটু খুঁড়িয়ে হেঁটেছি। তারপর আমার হাঁটাচলা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, তারপর আমি রত্নপেটিকার কথা ভুলেই গিয়েছিলুম। সম্ভবত এমিলির সঙ্গে তখন আমার রোমান্টিক অ্যাফেয়ার চলছিল।
বললুম, মেজর উপাধ্যায়, এখানেই আমরা একটা রহস্যের মুখোমুখি এসে পড়ছি। এই চিরকুটটা একটা দলিল। কিন্তু এটাকে এভাবে কবচের মধ্যে লুকিয়ে অর্ধ উন্মাদ সন্ন্যাসীর কাছে দেওয়া হয়েছিল। আমার ধারণা জগদিন্দ্রই কোনো কারণে এই কাজটা করেছিলেন। এখানে আরেকটা প্রশ্ন করছি। আপনার মায়ের মৃত্যুর কতো পরে আপনার কাকার মৃত্যু হয়?
শৌরীন্দ্র একটু ভেবে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ। প্রায় বছর পাঁচেক পরে। তখন আমি রাজস্থানের জয়পুরে ছিলুম।
বললুম, আমার ধারণা ওই পাগলাবাবা ছিলেন আপনার কাকার বিশ্বস্ত মানুষ। মৃত্যুর আগে সম্ভবত তিনি ওটা ওনার হাতেই গচ্ছিত রাখেন।
শৌরীন্দ্র বললেন, কিন্তু পাগলাবাবা এতদিন পরে আজ সকালে কেন চুপিচুপি ওটা দিতে গেলেন? এটাই কি সবচেয়ে রহস্য নয় কর্নেল সরকার?
বললুম, অনুমান করা যায় একজন অর্ধ উন্মাদ মানুষ আপনাকে কবচটা দিতেই হিমালয় থেকে ছুটে এসেছিলেন। সম্ভবত তার বিবেক তাঁকে সচেতন করেছিল। কিন্তু এখানে এসেই তিনি তার মিশনটার কথাই বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন। অবশ্য এগুলো অনুমান মাত্র। আপনার এখন প্রথম কাজ হচ্ছে শেঠজির ফ্যামিলির সঙ্গে যোগাযোগ করা।
মেজর বললেন, ধরমদাস শেঠের মৃত্যু হয়েছে বছর দশেক আগে। আমার বাবুর্চি করিম খাঁ লালগড়ের যত খবর দিয়েছে, রতন শর্মা তত কিছু দিতে পারেনি।
দ্রুত বললুম, এর থেকে তাহলে একটা পয়েন্ট পরিষ্কার হল, যেভাবেই হোক করিম খাঁ আপনাদের পরিবারের রত্নপেটিকার কথা জানতে পেরেছে। তবে এখনই টেলিফোনে শেঠ পরিবারের কোনো লোকের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ করা দরকার। আপনি ফোন করুন। আমি করিম খায়ের কাছে গিয়ে কফি খাওয়ার ছলে বাক্যালাপ করি।
মেজর বললেন, রতন থাকলে কিন্তু কিছু বললেন না।
বললুম, না। তবে সে একা থাকলে আমি তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে যাচাই করে নিতে চাই সে এই রহস্যের ব্যাপারে কিছু জানে কি না।
.
সহসা রক্তাক্ত চ্যালেঞ্জ
শৌরীন্দ্র দ্রুত উঠে ভিতরে গিয়েছিলেন। প্রায় মিনিট পনেরো পরে ফিরে এসে বললেন, আপনি বিশ্রাম করুন। আমি রতনকে নিয়ে বেরুচ্ছি।
জিগ্যেস করলুম, মনে হচ্ছে আপনি কোথায় বেরুচ্ছেন তা বলতে বাধা আছে। তাই কিছু জিগ্যেস করছি না। কিন্তু জানতে ইচ্ছা করছে শেঠজীর ফ্যামিলির কাউকে আপনি ফোন করেছেন কিনা।
শৌরীন্দ্র বললেন, করেছি। শেঠজির কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। একমাত্র মেয়ে ছিল নারায়ণী! তার জামাই কিষণচাঁদ কারবার চালাত, সে মারা গেছে। তার নাতি চন্দরনাথ এখন গদির মালিক। তবে তার দিদিমা নারায়ণী এখনও বেঁচে আছে। আমি হঠাৎ চন্দরনাথকে টেলিফোন কথায় সে বলল, আমি যে লালগড় রাজবাড়ির লোক, তা সে জানে। তার দিদিমা অসুস্থ। কিন্তু মাঝে মাঝে তাকে নাকি বলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু চন্দরনাথ কারবার নিয়ে ব্যস্ত। বারদুয়েক সে নাকি আমার কাছে তোক পাঠিয়েছিল। কিন্তু আমার দারোয়ান তাকে ভাগিয়ে দিয়েছে। এটা অবিশ্বাস্য।
কথাটি আমারও বিশ্বাস হল না। এই সময় রতন শর্মা উত্তরের গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে পশ্চিমের লনে দাঁড় করালেন। বললুম, আপনি তাহলে শেঠবাড়ি যাচ্ছেন?
মেজর উপাধ্যায় ঈষৎ বিব্রত মুখে চাপা স্বরে বললেন, আপনি বাইরের মানুষ। কাজেই আপনার সামনে হয়তো কোনো কথা খুলে বলতে নারায়ণী কিংবা তার নাতি চন্দ্রনাথের দ্বিধা হবে।
একটু হেসে বললুম, আমার মনে হচ্ছে এই পরামর্শ বুদ্ধিমান রতন শৰ্মাই আপনাকে দিয়েছেন।
কয়েক মুহূর্তের জন্য শৌরীরে চোখেমুখে চমক লক্ষ করলুম। পরক্ষণে তিনি হাসি দিয়ে চমকটা ঢেকে বললেন, আপনি তো জানেন রতন খুব বিচক্ষণ লোক। তার কাছে আমার কিছু গোপন থাকে না। আচ্ছা, আপনি বরং করিম খায়ের সঙ্গে কিচেনে গিয়ে আড্ডা দিন। বরাবর তো আপনার এই স্বভাবটা লক্ষ করেছি। করিম আপনাকে লালগড় মুলুকের অনেক ঘটনার কথা শোনায়। অবশ্য তার মধ্যে নব্বই শতাংশ গালগল্প। শুধু তার গলায় গজল-ঠুংরি শুনতে আপনার ভালোই লাগবে। বলে বারান্দা দিয়ে শৌরীন্দ্র এগিয়ে গেলেন।
তাঁর হাতে যথারীতি রাইফেলটা আছে। আমার চিন্তা হল উনি কি নারায়ণী দেবীর সঙ্গে রাইফেল হাতে নিয়েই কথা বলবেন?
দারোয়ান গেট খুলে দিল। তার পর গাড়িটা ঢালু প্রাইভেট রোড দিয়ে নেমে নীচের রাস্তায় পৌঁছল। বাউন্ডারির দেওয়াল ফুট ছয়েক উঁচু এবং তার উপরে কাঁটাতারের বেড়া। কাজেই গাড়িটা দেখা গেল না। কিন্তু লালগড় বাজার তো উত্তরদিকে। অতএব মেজর উপাধ্যায় সিধে রাস্তায় যাবেন এটা ধরে নেওয়া যায়। আমি পশ্চিমের বারান্দায় গিয়ে নেহাৎ খেয়ালবশে লন পেরিয়ে কেয়ারি করা রম্য উদ্ভিদ আর ফুলের বাগানের ভিতর দিয়ে দেওয়ালের কাছে পৌঁছলুম। লক্ষ করলুম দারোয়ান আমাকে দেখছে না। সে খাঁটিয়ায় রোদ্দুরে শুয়ে পড়েছে এবং যথারীতি তার খাঁটিয়ার পাশে বন্দুকটা দাঁড় করানো। আমি পিছন ফিরে কিচেনের দিকটাও দেখে নিলুম বাবুর্চি খাঁ সাহেবও আমাকে লক্ষ করছে না! কিচেনের ভিতর থেকে তার চাপা গলায় গাওয়া গানের সুর ভেসে আসছে। করিম খাঁ শুধু উঁচু দরের বাবুর্চিই নয়, সে চমৎকার গজল বা ঠুংরি গানেও ওস্তাদ। আমাকে শ্রোতা পেলে সে খুশি হয়।
আমার চোখ তখনও বাইনোকুলারে। আমি জানি রাস্তাটা একটু পরেই চড়াই-এ উঠেছে। কাজেই মেজরের গাড়িটা দেখতে পাব। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পরে গাড়িটাকে আবিষ্কার করলুম পশ্চিম দিকে একটা সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আবার ডানদিকে ঘুরল তারপর শালবনের ভিতর অদৃশ্য হল। এটা কি রতনের পরামর্শে শৌরীরে অতিরিক্ত সতর্কতা, নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
আমি ওখান থেকে ক্যাকটাসের টবগুলোর পাশ দিয়ে উত্তরের বারান্দায় উঠে গেলুম। ওখানেই সামনে রতনের ঘর তালাবদ্ধ। বাঁদিকে স্টোররুম। তারপর পূর্বের বারান্দায় গিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলেই ডাইনে ডাইনিং রুম। ডাইনিং রুম খোলা আছে। তার পিছনে কিচেন। আমি ‘খা সাহাব’ বলে অভ্যাসমতো সকৌতুকে ডাকতেই সাড়া এল কিচেন থেকে। করিম খায়ের পরনে বাবুর্চির অ্যাপ্রন, মাথায় উঁচু টুপি। রাজবাড়ির কেতা সে এখনও বজায় রেখে চলছে।
আমাকে দেখে অবশ্য সে মিলিটারি স্যালুট ঠুকল। তারপর বলল, আপনি কিচেনে এসে বসলে খুব আরাম পাবেন। চারদিকে ঠান্ডার বজ্জাতি।
তার কথায় আমি কিচেনে ঢুকে গেলুম। প্রশস্ত আধুনিক কিচেন। এই কিচেন তৈরি হয়েছিল শৌরীন্দ্রের মেমসাহেব স্ত্রী এমিলির তাগিদে। তাকে আমি দেখিনি কিন্তু এসব কথা আমার জানা। কিচেনের একপাশে একটা গদিআঁটা সুন্দর চেয়ার। আগের মতো আমি সেখানেই গিয়ে বসলুম। করিম খাঁ বলল, এক মিনিট কর্নেল সাব, আপনার জন্য হিটারে কফি বানাচ্ছি। যদি আমার বেয়াদপি মাপ করেন তাহলে আমিও আপনার সামনে কফি খাব। কারণ আমার মেজাজ একটু বিগড়ে গেছে।
সে হিটারের সুইচ অন করে কেটলি বসিয়ে দিল এবং গ্যাসের ওভেনে একটা হাঁড়ির ঢাকনা তুলে একটা হাত দিয়ে তরকারি ঘেঁটে দিল। তারপর আমার দিকে ঘুরে সে ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বরে বলল, রতনবাবুকে মেজর সাব খুব বিশ্বাস করেন।
জিগ্যেস করলুম, তুমি করো না?
করিম খাঁ আস্তে বলল, আগে করতাম, এখন করি না। যদি আমাকে পুছ করেন কেন করি না তাহলে বলব ম্যানেজারবাবু কখনো কখনো গোপন পুর্বের গেট খুলে জঙ্গলের ভিতরে যান। কেন যান বুঝতে পারি না। একদিন তাকে দেখলাম দৌড়ে একেবারে জানোয়ারের মতো হামাগুড়ি দিয়ে এসে গেটে ঢুকলেন। তারপর গেটের পাশে দেওয়ালের উপর মুখ রেখে কী যেন দেখতে লাগলেন।
বললুম, তুমি গিয়ে তখন ওঁকে জিগ্যেস করলে না কেন–করিম আমার কথার উপর বলল, করিনি, কারণ আমি তাঁর এই লুকোচুরি খেলার ব্যাপারটা তাঁর অজান্তেই বুঝতে চাইছিলাম। তারপর একদিন ঠিকই বুঝে গেলাম।
সে যখন কফি তৈরি করছে তখন আমি বললুম, তুমি আমাকে যে শয়তানটার কথা বলছিলে, রতনবাবু কি তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে?
করিম কোনার দিক থেকে একটা ছোট্ট টেবিল টেনে আমার পাশে রাখল। তারপর কফির কাপপ্লেট রেখে দু’পা এগিয়ে নিজের কাপটা তুলে নিয়ে চুমুক দিল। সে বলল, আপনি ঠিকই ধরেছেন কর্নেল সাব। আমি সেদিনই বুঝতে পেরেছি ওই শয়তানটার সঙ্গে ম্যানেজারবাবুর ঝগড়া-বিবাদ হয়েছে. তো, কর্নেল সাব, আমি এক নাদান আদমি। মেজর সাব আমার সব কথা হেসে উড়িয়ে দেন। কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখেছি ম্যানেজার সাবের সঙ্গে শয়তানটার বিবাদ হওয়ার পর থেকে সে মেজর সাহেবের পেছনে লেগেছিল।
কফিতে চুমুক দিচ্ছিলুম আর এই রহস্যকথা উপভোগ করছিলুম। এবার বললুম, তুমি তো মালিককে জানিয়েছিলে কেউ গোপনে তার পিছু নেয়। তার উদ্দেশ্য যে ভালো নয় তা-ও তুমি বলেছিলে। কিন্তু আড়ালের সেই দুশমনকে তুমি কি চিনতে পেরেছিলে?
বাবুর্চি করিম খাঁ কিচেনের জানালা দিয়ে পশ্চিম দিকটা দেখে নিল। তারপর খুব চাপাস্বরে বলল, ওই শয়তানটার নাম কালুয়া। একসময় সে লালগড়ে গুন্ডাদের সর্দার ছিল। তাকে হাতে রাখতে শেঠজীদের জামাইবাবু টাকা-পয়সা দিতেন। কতবার দেখেছি জামাইবাবুর গাড়িতে চেপে সে কাহা কঁহা মুল্লুক ঘুরতে যাচ্ছে। তারপর কালুয়া শেঠজিদের দুশমন লালাবাবুদের এক ভাইকে খুন করেছিল। এখানকার পুলিশ শেঠজিদের খানদানের সঙ্গে খুব দোস্তি করে চলে। জামাইবাবু কিষণচাঁদ কেসটা চাপা দিয়েছিল। কিন্তু লালাজিদের বাড়ির ছোট ছেলে, সবাই তাতে ছোটকাবাবু বলে ডাকে, তিনি মেজর সাহেবের চাইতেও বড়ো শিকারি। কম বয়সেই জঙ্গলে বাঘ মেরেছিলেন। দশ বছর আগেও লালগড়ের জঙ্গলে বাঘ ছিল। ভালুক, বুনো শুয়োর, আরও সব অনেক জানোয়ার পশ্চিমের জঙ্গলে থাকে। তো, এই ছোটকা সাব কালুয়াকে লালগড় থেকে ভাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বন্দুকের গুলি কান্দুয়ার বাঁ কানের উপর দিকটা উড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে তোক তাকে বলত কানকাটি কাল্প’। কর্নেল সাব, কালুয়া লালগড় বসতি থেকে ভেগে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। কোথায় কী খেতে পায় জানি না, শুনেছি আদিবাসীরা তাকে খুব খাতির করে।
ততক্ষণে কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়েছি। করিম খা আমার কাপপ্লেটটা তুলে নিয়ে বেসিনে রেখে এল। তারপর বলল, কাল্লুয়ার হাতে বন্দুক পিস্তল আর নেই। তবে তার কাছে ছোরা বা ভোজালি থাকতে পারে। আমি দেখিনি তবে আমার এই রকমই মালুম হয়।
উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, খাঁ সাহেব, আমি থাকতে থাকতে যদি কোথাও কালুয়া উঁকি মারতে এসেছে বলে টের পাও, তখনি আমাকে খবরটা দেবে।
করিম বাবুর্চি একটু ঝুঁকে এবার কপালে হাত টেকিয়ে বলল, জরুর।
আমি কিচেন থেকে বেরিয়ে পুবের বারান্দা ঘুরে আমার ঘরে গেলুম। কারণ শৌরীন্দ্রের ঘরগুলোর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ড্রয়িংরুমের দরজাও বন্ধ। দক্ষিণের জানলায় গিয়ে দেখলুম দারোয়ান খাঁটিয়ায় তেমনই শুয়ে আছে। তবে এবার হাত হাত বন্দুকের নলে।
আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলুম। বারোটা বাজতে চলেছে তবু শৌরীন্দ্রের পাত্তা নেই। গেস্টরুমে টেলিফোন নেই। একটা টেলিফোন ড্রয়িংরুমে আছে, কিন্তু লক্ষ করিনি মেজর উপাধ্যায় বেরিয়ে যাওয়ার আগে সম্ভবত আমার অগোচরে রতন শর্মাই আমার ঘর থেকে ড্রয়িংরুমে যাবার দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। সদর দরজা তো বন্ধই থাকে। আমি অস্থিরভাবে বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চোখ বুজে চুরুট চানছি, হঠাৎ একটা অমানুষিক আর্তনাদ কানে আসতেই চোখ খুলে সটান উঠে দাঁড়ালুম। দারোয়ানও বন্দুক হাতে উঠে দাঁড়িয়েছিল। পরের বার আর্তনাদ শুনে সে পুর্বদিকের গেটে ছুটে গেল। আমিও দৌড়ে গেলুম। তৃতীয়বারের আর্তনাদটা হঠাৎ থেমে গেল। আমি চিৎকার করে উঠলুম, মহাবীর সিং, দরওয়াজা খুলে দাও।
কারণ পুবের দরজায় তালা আটকানো ছিল। এদিকে করিম খাঁও হন্তদন্ত আমাদের কাছে এসে পৌঁছে গেছে। সে ব্যস্তভাবে বলল, আমার বরাত, রান্না এখনও শেষ হয়নি। তা না হলে আপনাদের সঙ্গে যেতুম। মহাবীর সিং দরজা খুলে দিয়ে বলল, তুমি বুদ্ধ আছে করিম খাঁ। তোমার তলোয়ারটা বার করে বাংলো পাহারা দাও! আসুন কর্নেল সাহাব।
ওদিকটায় রাস্তা ঢালু হয়ে গেছে। সেখানে কোথাও কোথাও ঘন ঝোঁপ, গাছ। একটু দূরে জঙ্গলে ঢাকা একটা টিলা। মহাবীরকে অনুসরণ করে মোটামুটি সমতল একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছলুম। সেখানে কোন আমলের পাথরের তৈরি একটা বাড়ির ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে। এই জায়গাটা আমার দেখা। কিন্তু এটার সম্পর্কে কোনো প্রামাণিক তথ্য মেজর শৌরীন্দ্রের জানা নেই। তবে লালগড়ের লোকে বলে এটা মোগল আমলের কোনো ফৌজদারের বাগানবাড়ি ছিল। এখানে এসে তিনি নাকি ইয়ারদোস্ত নিয়ে ফুর্তি করতেন আর বাঈজিদের নাচগান হত।
মনে পড়ল করিম খাঁর কাছ থেকে শুনেছিলুম এখানে কোনো কোনো রাতে আলো দেখা যায় আর বাঈজিদের পায়ের নূপুরের শব্দ শোনা যায়। কিন্তু করিম খাঁ নিজের কানে কিছু শোনেনি।
একটা পাথরের উপর বসে বাইনোকুলারে আমি জায়গাটা দেখার চেষ্টা করছিলুম। কিন্তু গাছপালা বাধার সৃষ্টি করছিল বটে কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরে আমার চোখে পড়ল একটা পাথরের স্তূপের পাশে সিংহের কেশরের মতো কী দেখা যাচ্ছে। আমি পকেট থেকে লোডেড রিভলবার বের করে নিয়েছিলুম। এবার মহাবীরকে আমার পিছনে চারদিকে লক্ষ করে চলতে বলে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চললুম। তখন আর চোখে বাইনোকুলার নেই। কিন্তু খালি চোখে যা দেখলাম তাতে আমি শিউরে উঠে হন্তদন্ত এগিয়ে গেলুম।
একটু পরেই আমি থমকে দাঁড়ালুম। মহাবীর সিংহ এক লাফে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে বলে উঠল, হায় রাম। এ তো দেখছি পাগলাবাবা আছে। ওঃ! পাগলাবাবার শরীরে এত রক্ত কেন?
বলেই সে ছুটে গেল। আমি তাকে অনুসরণ করে গিয়ে দেখলুম যেগুলো সিংহের কেশর বলে মনে হচ্ছিল তা পাগলাবাবার জটা। তার বুকে অনেকগুলো অস্ত্ৰক্ষত। দেখা মাত্র বুঝলুম ভোজালির ঘায় তার বুকে কয়েকটা জায়গায় আঘাত করা হয়েছে এবং তখনো সেখান দিয়ে চাপ চাপ রক্ত বেরুচ্ছে। দ্রুত বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিয়ে বললুম, মহাবীর, তুমি বাংলায় গিয়ে দেখ মেজর সাহেবকে ফোন করা যায় নাকি। তিনি শেঠজিদের বাড়ি গেছেন। তোমার কাছে কি ড্রয়িংরুমের চাবি আছে?
আছে বলে মহাবীর সিং দ্রুত উধাও হয়ে গেল। আমি রক্তাক্ত মৃতদেহের পাশের উঁচু পাথরের উপর উঠে আততায়ীকে খুঁজতে লাগলুম। আমার এক হাতে বাইনোকুলার, অন্য হাতে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র। কিন্তু কোথাও কোনও আততায়ীকে খুঁজে পেলুম না। একটু পরে পূর্বে একটা টিলার দিকে জঙ্গলে ময়ূরের চিৎকার শুনলুম। আমি জানি ওই চিৎকার স্বাভাবিক চিৎকার নয়। কোনো অদ্ভুত কিছু দেখে বা কারও তাড়া খেয়ে কয়েকটা ময়ূর একসঙ্গে চিৎকার করে উঠেছে। কিন্তু এখন আমাকে এই রক্তাক্ত মৃতদেহটা পাহারা দিতেই হবে। বুঝতে পারলুম আবার এক অদৃশ্য চিরকালের আততায়ী একটা রক্তাক্ত লাশ ফেলে আমাকে চ্যালেঞ্জ জানয়েছে।
.
খুনি কি ফিরে এসেছিল অকুস্থলে?
এর পরের ঘটনাটা সংক্ষেপে জার্নালে লিখে রাখছি। কারণ এ ধরনের খুনের ঘটনায় পুলিশের একটা রুটিনবাঁধা পদ্ধতি আছে। থানার ওসি বদ্রিপ্রসাদ সিংহ আমাকে ততো পাত্তা দেননি। তাছাড়া আমিও লালগড়ে আসার আগে আমার রীতি অনুসারে এলাকার পুলিশ কর্তৃপক্ষকে কিছু জানিয়ে আসিনি। আসলে আমি কল্পনাও করিনি যে লালগড়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।
বলা দরকার দারোয়ান মহাবীর শেঠজীদের বাড়িতে ফোন করে মেজর শৌরীন্দ্রের খোঁজ পায়নি। অগত্যা নিজের বুদ্ধিমতো সে থানায় ফোন করেছিল। তারপর পুলিশ ঐ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কাঁচা পথে গাড়ি নিয়ে এসে আমাকে এবং মহাবীর সিংকে প্রশ্ন করে দুজনের বক্তব্য জেনে নিয়েছিল। আমার প্রশ্নের উত্তরে থানার ওসি বদ্রিপ্রসাদ সিংহ বলেছিলেন, এই পাগলাবাবা নামে সন্ন্যাসীকে খুনের একটাই কারণ থাকতে পারে–সম্ভবত পাগলাবাবা এলাকার কোনো ডাকুর ডেরায় খোঁজ পেয়েছিল। লাগগড়ে অবশ্য আমি আসবার পর চোর-ডাকু ইঁদুরের মতো ভেগে গেছে। কিন্তু আমার হাতে খবর আছে তাদের ডাকাতি করা মাল বেচার জন্য এই পাহাড়-জঙ্গল এলাকায় কোথাও তাদের গোপন ডেরা আছে। যেখানে মালগুলো তারা লুকিয়ে রাখে। সেই মাল কিনে নেবার মতো লোকের অভাব এখানে নেই।
মহাবীর সিং তাকে কিছু বলতে চেষ্টা করছিল কিন্তু তিনি কোনো কথা না শুনেই তার জিপগাড়িতে উঠেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, তোমাদের মেজর সাহেবকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।
মেজর শৌরীন্দ্র উপাধ্যায় যে বাংলো থেকে বেরিয়ে গেছেন তা আমি ওসিকে আগেই বলেছিলুম। পুলিশবাহিনী অ্যাম্বুলেন্সে রক্তাক্ত লাশ তুলে নিয়ে যাওয়ার পর বাংলোয় এসে বসে শোরীন্দ্রের অপেক্ষা করছিলুম। মহাবীর সিং লালাজির বাড়িতেও ফোন করেছিল কিন্তু সেখানেও শৌরীন্দ্রের খোঁজ পায়নি।
প্রায় একটা বাজতে চলেছে। লাঞ্চের সময় হয়ে এল। অথচ শৌরীন্দ্রের কোনো পাত্তা নেই। মহাবীর খুব উদ্বিগ্ন হয়ে গেটের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। করিম খাঁ। তার কাছেই সব ঘটনা শুনেছিল এবং সে দূর থেকে পুলিশের গাড়ি দেখেছিল। তারপর সে আমার কাছে এসে উদ্বিগ্ন মুখে বলল, কর্নেল সাব, খুব ভয় লাগছে। মেজর সাবের কোনো ক্ষতি হয়নি তো?
আমি ওকে বললুম, মেজর সাব সঙ্গে রাইফেল নিয়ে বেরিয়েছেন। উনি মিলিটারির অভিজ্ঞ অফিসার। নিজেকে বাঁচাবার ক্ষমতা তার আছে। কিন্তু তোমার কাছে আমার জানতে ইচ্ছা করছে পাগলাবাবাকে এমন নির্মমভাবে খুন করল কে?
করিম খাঁ গম্ভীর মুখে বলল, এ কাজ সেই শয়তান কালুয়ার। এর আগে একটা লোককে সে খুন করেছিল ঠিক যেভাবে আপনারা বলছেন পাগলাবাবার বুক ফালা ফালা করে দিয়েছে, ঠিক সেইভাবে। সে প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা।
জিগ্যেস করলুম, একজন পাগল সাধুকে খুন করে তার কী লাভ?
করিম বলল, আমি ভালোভাবেই জানি কালুয়া ভাড়াটে খুনির কাজ করে। কেউ তাকে দিয়ে এই খুনটা করিয়েছে।
জিগ্যেস করলুম, একজন পাগলা সন্ন্যাসীকে খুন করে তার কী লাভ হবে?
করিম বলল, এখন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে হুজুর কর্নেল সাব, আমি সুযোগ পেলেই লালগড় যাব। সেখানে আমার অনেক ইয়ারদোত্ত আছে।
এই সময় গেটের দিকে মেজরের গাড়ি দেখতে পেলুম। মহাবীর গেট খুলে দিয়ে সেলাম ঠুকে কিছু জিগ্যেস করল। শৌরীন্দ্র কী বললেন বোঝা গেল না। কিন্তু তিনি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে এসেছেন। গাড়ি গ্যারেজে রেখে তিনি আমার কাছে এসে বললেন, দুঃখিত কর্নেল সরকার, একটা ঝামেলায় পড়ে এতক্ষণ সময় নষ্ট হল। নিশ্চয় আপনার খুব খিদে পেয়েছে। খাঁ সাহেব, লাঞ্চের টেবিল সাজাও।
বললুম, আপনার ম্যানেজার রতনবাবুকে কোথায় রেখে এলেন?
শৌরীন্দ্র বললেন, রতনকে লালাজীর বাড়ির ছোটকুর সঙ্গে একটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে এলুম। সে ছোটকুদের বাড়িতেই খেয়ে নেবে।
শৌরীন্দ্রের হাতে যথারীতি সেই রাইফেলটা ছিল। তিনি আমার ঘরের ভিতর পা বাড়িয়েই পেছিয়ে এলেন। বললেন, অতি সাবধানী রতনের কাণ্ড। এদিকের দরজা ওকে কে বন্ধ করতে বলল? যাই হোক, কর্নেল সরকার, আপনি সম্ভবত এত বেলায় আর স্নান করবেন না। পোশাক বদলে সোজা ডাইনিং হলে চলে আসুন।
বলে তিনি পূর্বে কয়েক পা এগিয়ে দেওয়ালের আড়ালে অদৃশ্য হলেন।
আমি পোশাক বদলানোর ঝামেলায় গেলুম না। বাথরুমে সাবান দিয়ে রগড়ে দুই হাত ধুয়ে ফেললুম। মুখে ও দাড়িতে জল ছিটিয়ে তোয়ালেতে মুছে অস্বস্তি ও ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে পারলুম।
ডাইনিং রুমে ঢুকে দেখি খাঁ সাহেব টেবিল সাজাচ্ছে। শৌরীন্দ্র তখনও আসেননি। আমি চাপা স্বরে বললুম, রতনবাবুকে তোমার মালিক লালাজির বাড়ির ছোটকুর সঙ্গে কী একটা কাজে পাঠিয়েছেন।
করিম খাঁ একটু চমকে উঠল। তারপর খুব চাপা স্বরে বলল, বুঝেছি। ম্যানেজারবাবু ছোটকুকে সঙ্গে নিয়ে
তার কথা থেমে গেল। ভিতরের দরজার পরদা তুলে মেজর শৌরীন্দ্ৰ উপাধ্যায় ঘরে ঢুকলেন। দেখলুম তিনিও পোশাক বদলাননি। খাওয়ার টেবিলে কথা বলার আমি ঘোর বিরোধী। শৌরীন্দ্র তা ভালোই জানেন। অতএব দুজনে নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলুম। তারপর শৌরীন্দ্র বললেন, আমার সঙ্গে আসুন কর্নেল সরকার। আপনার তো লাঞ্চের পর শুয়ে পড়ার অভ্যাস নেই, আমারও নেই। ড্রয়িংরুমে। বসে আমরা কিছু জরুরি বিষয়ে আলোচনা করব।
তিনি ড্রয়িংরুমের সদর দরজা খুলে দিলেন। আমরা যেখানে সোফায় বসলুম সেখানে থেকে গেটের কিছু অংশ দেখা যায়। চুরুট ধরিয়ে আমি সোজাসুজি চার্জ করার ভঙ্গিতে বললুম, মেজর উপাধ্যায়, আমার ধারণা ফৌজদারের কোঠির ধ্বংসাবশেষের কাছে পাগলাবাবা খুন হওয়ার কথা আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন।
শৌরীন্দ্রকে মাঝে মাঝে, অবশ্য কদাচিৎ পাইপ টানতে দেখেছি। তিনি পাইপের নল পরিষ্কার করে তামাক ভরে বললেন, আপনার লাইটার দিয়ে জ্বেলে দিন প্লিজ। তারপর পাইপ টেনে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, হ্যাঁ, আমার দেরি হওয়ার কারণ ওটাই। আমি যখন চন্দরনাথ শেঠের গদিতে বসে কথা বলছিলুম তখনই পুলিশের একটা জিপ, একটা ভ্যান এবং একটা অ্যাম্বুলেন্স তীব্র বেগে কোথাও যাচ্ছে লক্ষ করেছিলুম। চন্দরনাথই তো ব্যাপারটা দেখে বলেছিল নিশ্চয়ই কোথাও ডাকাতি বা খুনখারাপি হয়েছে। কথাটা বলে সে টেলিফোনে চাপা স্বরে কার সঙ্গে কথা বলেছিল। তারপর ফোন রেখে একটু বাঁকা হেসে আমাকে বলেছিল, আপনি তো বন-জঙ্গলে ঘোরেন তাহলে পাগলাবাবাকে তো জানেন। সে আবার বলেছিল ফৌজদারের জঙ্গলের পাগলাবাবাকে কে মার্ডার করেছে। আমার চমক লক্ষ করে সে বলেছিল, মেজর সাব, আমি জানি পাগলাবাবা পাগলা ছিল না। সে এক। হুঁশিয়ার ধুরন্ধর লোক। হা, সে একজন সাধু-সন্ন্যাসী তাতে ভুল নেই। কিন্তু পাগলামিটা তার ইচ্ছাকৃত।
প্রায় দু’মিনিট চুপচাপ পাইপ টানার পর শৌরীন্দ্র নির্বিকার মুখে বললেন, আমি পাগলাবাবার মার্ডার নিয়ে সে মুহূর্তে আর মাথা ঘামাইনি। আমার মনের মধ্যে ভীষম উত্তেজনা ছিল কিন্তু উত্তেজনা চেপে যে কারণে আমি তার কাছে গেছি সেই কথাটা তুলেছিলুম।
শৌরীন্দ্র হঠাৎ চুপ করলে আমি জিগ্যেস করলুম, চন্দরনাথকে কি কবচটা দেখিয়েছিলেন?
শৌরীন্দ্র বললেন, না। আমি কবচের ভিতরে রাখা ওই চিরকুটটা ওকে দেখালুম। কাগজটা তার হাতে দিইনি। সে বিড়বিড় করে পড়ে নিয়ে বলল, এসব কথা তো আমি কিছুই জানি না। তবে আমার দিদিমা নারায়ণী একদিন এইরকম কিছু আমাকে বলতে চাইলেন। তার মানে লাগগড় রাজবাড়ির কোনো লোকের কথা। তিনি নাকি দিদিমার শ্বশুরমশাইকে একটা কবচ না অন্য কিছু রাখতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার শ্বশুরমশাই সেটা হারিয়ে ফেলেন। বলে চন্দরনাথ খুব হাসতে থাকল। শেষে বলল, এটা যেন খাজানা তার মানে গুপ্তধনের গল্প হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু মেজর সাব, আপনার হাতের এই কাগজটা খুব ভাঁজ করা মনে হচ্ছে। আমার সন্দেহ ওটা কোনো কবচের ভেতর লুকানো ছিল।
চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললুম, চন্দরনাথ সত্যিই বিচক্ষণ এবং ধুরন্ধর।
শৌরীন্দ্র বললেন, হ্যাঁ। তবে তার বয়স পঁচিশের বেশি নয়। এই বয়সেই সে কারবার চতুগুণ ফুলিয়ে তুলেছে।
বললুম তারপর?
শৌরীন্দ্র বললেন, আমার মাথার ভিতর যেন আগুন ধরে গিয়েছিল। একটা ব্যবসায়ী গদির অর্ধশিক্ষিত ছোকরা আমার সঙ্গে যেন তামাশা করছে। আমি অমনি তাকে রুষ্ট কণ্ঠস্বরে বললুম, হ্যাঁ। এটা একটা কবচের ভেতরেই ছিল। কিন্তু তোমার দিদিমার কথা শুনে মনে হচ্ছে অবিকল এই কাগজের কথাগুলি লিখে শেঠ পরিবারে পূর্বপুরুষ ধরমচাঁদ শেঠকে আমার ঠাকুরদা রাজা জগদিন্দ্ৰ উপাধ্যায় এর একটা হুবহু কপি দিয়েছিলেন এবং সেই সতর্কতাবশে ঠিক এইরকম একটা কবচের মধ্যে পুরেই সিল করে রাখতে দিয়েছিলেন।
বললুম, আপনার এই অনুমান অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য।
মেজর বললেন, দুটো কবচের ভিতর থেকে চিরকুট বের হলে ধর্মত এবং আইনত রত্নপেটিকাটি আমার প্রাপ্য। চনদরনাথ আমার রূঢ় কণ্ঠস্বর শুনে একটু ভড়কে গিয়েছিল। লালগড়ে আমার প্রতিপত্তি আছে, সে ভালোই জানে। তাছাড়া তখন আমার হাতে রাইফেল। গদির পেছনের দিকে একটা ঘরে আমরা দুজনে কথা বলছিলুম।
অস্থির হয়ে বললুম, শীতের বেলা দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। আপনি সংক্ষেপে বলুন তারপর কী হল।
শৌরীন্দ্র বললেন, ঠিক সেই সময় টেলিফোন বেজে উঠল। চন্দরনাথ টেলিফোন তুলে সাড়া দেওয়ার পর তার মুখে চমক লক্ষ করলুম। সে ক্রমাগত হুঁ। হুঁ বলতে থাকল। প্রায় পাঁচ মিনিট পরে সে বলল, তুমি একটা বুন্ধু। তোমাকে কবে বলেছিলুম, একদিন তুমি–চুপ। পরে কথা হবে। বলে সে ক্রেডেল রিসিভারটা রেখে দিল। আমি সতর্কভাবে তাকে জিগ্যেস করলুম, হঠাৎ কার উপর খাপ্পা হলে চন্দরনাথ? সে বলল আমি অনেক টাকা পাই। সুদসহ প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। ওটা আদায় করার জন্য একটা লোককে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। সে বলছে লোকটা বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে। যাই হোক, আমি বললুম, তা আমার এই কবচের ব্যাপারে আমাকে দেখা করতে হবে। চন্দ্রনাথ বলল, আমার দিদিমা শয্যাশায়িনী। এখন তো আমার গদি ছেড়ে বেরুনোর উপায় নেই। আপনি বরং রাত্তির দিকে একটা টেলিফোন করে আমাদের বাড়িতে আসবেন।
মেজর উপাধ্যায়ের পাইপের আগুন নিভে গিয়েছিল। তাঁর কথায় লাইটার জ্বেলে আবার ধরিয়ে দিলুম। তারপর বললুম, রতনবাবুকে ছোটকুর কাছে কী কাজে পাঠিয়েছেন আমার জানতে ইচ্ছা করছে। মেজর উপাধ্যায়, আমি এতক্ষণে বুঝে গেছি কেন পাগলাবাবা খুন হয়েছেন, কেন তিনি মৃত্যুর আগে কবচটা আপনাকে দিয়ে যেতে পেরেছেন।
শৌরীন্দ্র কী ভাবলেন জানি না। তিনি টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। তারপর সাড়া বলে বললেন, ওসি মি. সিনহা আছেন কী?…বলুন মেজর উপাধ্যায় কথা বললেন… নমস্কার। পাগলাবাবার মার্ডার সম্পর্কে আমি ইন্টারেস্টেড মিঃ সিনহা। তার বডি কি হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছেন আমার। সঙ্গে আমার বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকারও যাবেন…ও, তার সঙ্গে আপনার ঘটনাস্থলে আলাপ হয়েছে। …ঠিক আছে, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরুচ্ছি।
কিছুক্ষণ পরে শৌরীন্দ্র গাড়ি বের করলেন। তারপর আমি তার বাঁ পাশে বসলুম। দারোয়ান গেট খুলে দিল। শৌরীন্দ্র তাকে বলে এলেন, সতর্ক থাকবে মহাবীর। আর খাঁ সাহেবকে বলবে সে যেন তার তলোয়ারটা নিয়ে তৈরি থাকে।
আমাদের গাড়ি রাস্তায় নেমে যাওয়ার পর জিগ্যেস করলুম, আপনি জানেন আমার আড়ি পাতার অভ্যাস আছে। আপনারা বেরিয়ে যাওয়ার পর বাইনোকুলারে দেখেছিলুম শালবনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। শালবনটা এখন হতশ্রী এবং ততটা আড়াল নেই। আমি আপনাদের গাড়িটা আর দেখতে পাইনি।
শৌরীন্দ্র বললেন, আমি রতনকে গোপনে লালাবাড়ি পাঠিয়েছিলুম। ওই পথে গেলে লালগড়ের পিছন দিকটায় ছোটকুর নিজস্ব বাংলোয় যাওয়া যায়। ওইদিকে একটা টিলার গায়ে তার বাংলো৷
বললুম, রতনকে কি এই কবচের কথা সব খুলে বলেছেন?
শৌরীন্দ্র বললেন, হ্যাঁ। রতন বিশ্বাসী, ছোটকুর সঙ্গে তার ভালো সম্পর্কে আছে।
বলেই তিনি একটা গাছের ধারে গাড়ি দাঁড় করালেন। তখন দেখলুম রতন শর্মা একটা সাইকেল রিকশতে চেপে ফিরে আসছেন। গাড়ির কাছে রিকশ দাঁড় করিয়ে তিনি মেজরের কাছে এসে বললেন, ওদিকে সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। পাগলাবাবাকে কেউ মার্ডার করেছে। হাসপাতালের কাছে প্রচণ্ড ভিড় করে লোকেরা দাঁড়িয়ে আছে। পাগলাবাবাকে সবাই প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করত।
মেজর বললেন, জানি। ছোটকু তোমাকে কী বলল?
রতনবাবু বললেন, বাংলোয় গিয়ে আমি ছোটকুকে পাইনি। তার দারোয়ান বলল, লালাবাবুকে কেউ টেলিফোন করেছিল তারপর তিনি বন্দুক হাতে মোটর সাইকেলে চেপে বেরিয়ে গেছেন। কী আর করা যাবে, আমি ওই পথেই লালগড়ে গিয়ে ঢুকলুম। তারপর লালাজির বাড়িতে ছোটকুর খোঁজ করলুম। ওই বাড়ির একজন চাকর বলল, ছোটকুবাবা বাড়িতে আসেননি। তিনি বোধহয় বাংলোতেই আছেন। আমি তখন ভাবলুম ছোটকুবাবা ক্লাবে গেছেন নাকি। ক্লাবেও তিনি নেই। তারপর রাস্তায় বেরিয়ে শুনি পাগলাবাবা মার্ডার হয়েছেন।
শৌরীন্দ্র বললেন, ঠিক আছে, তুমি বাংলোয় ফিরে যাও। আমরা থানায় যাব।
হঠাৎ আমার মনে হল থানায় গিয়ে কী হবে? বরং আমার মন টানছে। ঘটনাস্থলে, যেখানে পাগলাবাবা খুন হয়েছেন। আমার ভিতর থেকে একটা তীব্র বাধার আবেগ আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। বললুম, মেজর উপাধ্যায়, থানায় পরে যাবেন। চলুন রতনবাবুকে নিয়ে আমরা বাংলোয় ফিরে যাই। তারপর আপনাকে নিয়ে আমি ঘটনাস্থলে যাব।
মেজর উপাধ্যায় আমার দিকে তাকিয়ে আমার মনোভাব আঁচ করলেন। তিনি বললেন, ঠিক আছে। তবে গাড়ি করেও সেখানে যাওয়া যায়। ওই রাস্তাটা গেছে। একটা আদিবাসী গ্রামের দিকে। তার কাছে ফৌজদারি কুঠির ধ্বংসাবশেষ।
রতনবাবু রিকশয় গিয়ে উঠলেন। মেজর উপাধ্যায় গাড়ি ঘুরিয়ে দক্ষিণে চললেন। ওই পথেই সকালে আমরা এসেছিলুম। মিনিট পাঁচেক পরে জঙ্গলে ঘুরে মেজরকে গাড়ি দাঁড় করাতে বললুম। গাড়ি থেকে নেমে বাইনোকুলারে লক্ষ করলুম চকরাবকরা সোয়েটার পরা এবং মাথায় টুপি ও মাফলার জড়ানো একটা লোক এইমাত্র পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। লোকটা যে খুনের জায়গায় কিছু একটা করছিল এতে সন্দেহ নেই। অপরাধতত্ত্বে বলে হত্যাকারী তার হননস্থলে আবার ফিরে যায়। এটা নাকি মনস্তত্ত্বের কথা।
ওই লোকটাই কি খুনি?
লোকটাকে খুঁজে বের করার জন্য আমি আরও একটা পাথরের স্লাবের উপর উঠে বাইনোকুলারে লক্ষ রাখলুম। যখন আমি তাকে তন্ন তন্ন খুঁজছি তখন উপাধ্যায় জিগ্যেস করলেন, আপনি কি কাউকেও দেখতে পেয়েছেন?
মুখে কিছু বললুম না কিন্তু আমার বাইনোকুলারে সে ধরা পড়েছিল। সে বাঁদিকে আমার কাছ থেকে অন্তত দুশো গজ দূরে ঝোঁপঝাড়ের আড়াল দিয়ে গুঁড়ি মেরে চড়াই-এ উঠে যাচ্ছিল। তারপর তাকে আর দেখতে পেলুম না। নীচে নেমে এসে বললুম, যাকে খুঁজছিলুম তাকে পেয়ে গেছি তবে তার পিছনে ছুটে লাভ নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমি পাগলাবাবার খুনিকেই দেখলুম।
শৌরীন্দ্র চমকে উঠে বললেন, সে আবার কেন এখানে এসেছিল?
বললুম, কথাটা বলব, আপনি একা গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে বাংলোয় চলুন। আমি পায়ে হেঁটে নাক বরাবর আপনার বাংলোর পূর্ব গেটে পৌঁছচ্ছি। দেরি করবেন না। প্রতিটি মুহূর্ত এখন মূল্যবান।
মেজর গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। আমি বাংলোর গেটে পৌঁছনোর আগেই দেখলুম, রতনবাবু ছুটে আসছেন। তিনি বললেন, মেজর সাব কোথায়?
বললুম, উনি গাড়ি নিয়ে ঘুরপথে আসছেন। কী ব্যাপার?
ছোটকা এসে বসে আছে।
বলে রতনবাবু বাংলোর দিকে চড়াই-এ উঠতে থাকলেন। আমি তাকে অনুসরণ করলুম।
রতনবাবুর সঙ্গে বাংলোর ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখি একজন বলিষ্ঠ চেহারার যুবক বসে আছে। সে আমাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল। রতনবাবু বললেন, ইনি কলকাতার সেই কর্নেল সাব।
ছোটকা তখনই আমাকে প্রণাম করতে এল। আমি তার দুধে হাত রেখে দাঁড় করিয়ে দিলুম। বললুম, প্রণাম মনে মনে করো। মেজর সাব এখনই এসে পড়ছেন। আমার মুখোমুখি বসো। আমি তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব।
ছোটকাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। সে বসার পর বলল, বলুন কর্নেল সাব, আমি এখনই হাসপাতালের মর্গ থেকে আসছি।
কথাটা শুনেই বললুম, তুমি কি পাগলাবাবাকে চিনতে পেরেছে?
সে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে গলার ভিতরে বলল, হ্যাঁ, পাগলাবাবাকে আমি চিনতে পেরেছি। এতদিন তার কথা শুনেছি। বার দুই দূর থেকে জঙ্গলের ভিতর তাকে দেখতেও পেয়েছি। কিন্তু কর্নেল সাব, আমি বুঝতেই পারিনি এই সন্ন্যাসী আমার নিরুদ্দিষ্ট ছোট ঠাকুরদা অনন্তরাম লালা। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না কে তাঁকে অমন নির্মমভাবে খুন করল, কেনই বা তাকে খুন করা হল।
বললুম, তার আগে তুমি বলো কে তোমাকে টেলিফোনে ডেকেছিল যে তোমার বাংলো ছেড়ে মোটর সাইকেলে বেরিয়ে গিয়েছিল?
ছোটকা জ্যাকেটের পকেট থেকে রুমাল বের করে দু’চোখ মুছে বলল, আমাকে শেঠবাড়ির মহিলা টেলিফোনে বলেছিলেন চন্দরনাথের দিদিমা নারায়ণী দেবী আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমি যেন এখনই গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি।
এই সময় বাইরে গাড়ির শব্দ হল। দেখলুম শৌরীন্দ্রের গাড়ি বাংলোর গ্যারেজের দিকে অদৃশ্য হল। রতনবাবু বেরিয়ে সম্ভবত শৌরীন্দ্রকে ছোটকার খবর দিতে গেলেন।
আমি বললুম, তারপর তুমি শেঠবাড়ি গেলে? নারায়ণী দেবী কী বললেন?
ছোটকার চোখেমুখে বিস্ময় লক্ষ করলাম। সে বলল, আমার মনে হচ্ছে মেজর সাহেবের কাছে আপনি শেঠবাড়ির কথা শুনেছেন।
বললুম, শুনেছি। তবে আমি জানি না মেজর শৌরীন্দ্র উপাধ্যায়ের ঠাকুরদা রাজা জগদিন্দ্ৰ উপাধ্যায়ের কোনো রত্নপেটিকা সংক্রান্ত গোপন কাহিনি তুমি জানো কিনা?
ছোটকা চাপা স্বরে বলল, আমার ঠাকুরমা বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর কাছে ওই গুপ্তকথা শুনেছিলুম। তখন থেকে আমি মেজর সাবকে বারবার এসে সেই গোপন কথা শুনিয়েছি। কিন্তু উনি আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে আমি আর ওইসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি।
শৌরীন্দ্র ঘরে ঢুকেই কথাটা শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, ছোটকা, আমি সত্যিই নির্বোধ। সামরিক জীবনে আমি শুধু কেমন করে মানুষ মারতে হয়–এইটুকুই শিখেছি।
বললুম, মেজর উপাধ্যায়, আপনার কোনো দোষ নেই। যতক্ষণ না আপনি আপনার ঠাকুরদার রত্নপেটিকা সম্পর্কে কোনো প্রামাণ্য তথ্য হাতে পাচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি কেমন করে ওসব কথায় বিশ্বাস করবেন।
ছোটকা বলে উঠল, কাকাজী, পাগলাবাবাকে আমি দেখে এলাম। তিনি আমার নিরুদ্দিষ্ট ছোট ঠাকুরদা অনন্তরাম লালা।
শৌরীন্দ্র নড়ে বসলেন। তার ডান হাতে রাইফেল। বাঁ হাতে কপালে একটা থাপ্পড় দিয়ে তিনি বললেন, ওঃ মাই গড! আমার ঠাকুরদার কাছে আমার বয়সী একটি ছেলেকে আমি দেখেছিলাম মনে পড়ছে। ঠাকুরদা বলেছিলেন, একে তুমি বন্ধু করে নাও। লালাজিদের বাড়ির এই ছেলেটি এত কম বয়সেই কত কিছু জানে।
আমি দ্রুত বললুম, এসব কথা পরে হবে। ছোটকা, এবার তুমি বলো শেঠবাড়ির নারায়ণী দেবী তোমাকে ডেকে কী বলেছিলেন?
ছোটকা বলল, উনি আমাকে বলেছেন আমার বড়ো ঠাকুরদা বংশীধারী লালা মৃত্যুর আগে আমাকে কোনো গোপন কথা বলে গেছেন কি না। অমনি আমার মনে পড়েছিল তিনি আমাকে একটা কবচের কথা বলেছিলেন। তার ভিতরে একটা দলিল লুকোনো আছে। তার সাক্ষী তিনি। আমার কথা শুনে নারায়ণী দেবী বললেন, তুমি মেজর সাবকে এখনই গিয়ে জিগ্যেস করো তার কাছে কোনো কবচ আছে কি না। যদি থাকে তাহলে তাকে সঙ্গে নিয়ে তুমি আমার কাছে চলে আসবে। তারপর আমি বাইরে বেরিয়েছি এমন সময় আমাদের ক্লবের এক বন্ধু জ্ঞানেশ্বর প্রসাদ আমাকে দেখেই থামতে বলল। তারপর সে কাছে এসে আমাকে চুপি চুপি বলল সে হারামজাদা কান্দুয়াকে শেঠদের গদি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিল। কান্দুয়া আমাকে, আর জ্ঞানেশ্বরকে প্রচণ্ড ভয় করে চলে। কারণ আমাদের ক্লাব থেকে ওকে একসময় আমরা দুজনেই টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতুম। কারণ তখন তার হাতে কোনো কাজ ছিল না। সে লালগড়ে লোকের বাড়িতে চেয়েচিন্তে খেয়ে বেড়াত। কিন্তু আমরা জানতুম তার মধ্যে এক ভয়ঙ্কর খুনি আছে। তাকে সৎপথে আনার জন্য ওর জন্য কাজ খুজতুম। কিন্তু কিছুদিন আগে সে চন্দরনাথের পাল্লায় পড়ে। আমাদের সঙ্গে দেখা হলে সে এড়িয়ে যায়।
এই সময় বাবুর্চি করিম খাঁ ঘরে ঢুকে বলল, ছোটকা সাব, আমার কাছে জেনে নিন পাগলাবাবাকে খুন করেছে ওই শয়তানের রাজা কালুয়া।
ঘরে যেন হঠাৎ বজ্রপাত হয়েছে এইভাবে মেজর উপাধ্যায়, ছোটকা এবং রতনবাবু চমকে উঠেছিলেন। আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললুম, করিম খাঁ ঠিকই বলছে। মেজর উপাধ্যায়, আপনি তখন বলছিলেন আপনার সামনেই চন্দরনাথকে কেউ টেলিফোন করেছিল এবং চন্দরনাথ তাকে ক্রুদ্ধস্বরে কী বলেছিল, আপনার নিশ্চয় মনে পড়ছে।
শৌরীন্দ্র বললেন, হ্যাঁ। মনে পড়ছে। কর্নেল সরকার, তাহলে কি তাকে ফোন করেছিল
তার কথার উপর বললুম, ফোন করেছিল কাল্প। আমার হিসেব মতে সে টেলিফোনে জানিয়েছিল পাগলাবাবাকে খুন করেও সে তার কাছে কোনো কবচ খুঁজে পায়নি।
ছোটকা বলল, আমার সামনে থেকে একটা পরদা সরে গেল। আমি বুঝতে পারছি আমাকে নারায়ণী দেবী ডেকেছেন সেই খবর শেঠবাড়ি থেকে তাদের গদিতে চন্দরনাথের কাছে কেউ পৌঁছে দিয়েছিল। তাই সে কালুয়াকে দায়িত্ব দিয়েছিল পাগলাবাবাকে যে কোনো ছলে কোনো নিরালা জায়গায় নিয়ে গিয়ে খুন করার। কারণ সে কবচ চাইলে পাগলাবাবা তাঁর দৈত্যের মতো বিশাল শরীর নিয়ে কালুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন এবং কাল্পর মতো একটা ইঁদুর ভোজালি দিয়েও আত্মরক্ষা করতে পারবে না। তাই তাকে উপর্যুপরি ভোজালির আঘাতে ধরাশায়ী করেছিল সে।
আমি বললুম, ঠিক তা-ই। কারণ পাগলাবাবা আর্তনাদ করছিলেন। সেই আর্তনাদ শুনেই আমরা ছুটে গিয়েছিলুম। আমরা তাঁকে প্রায় নগ্ন দেখেছিলুম। তার মানে কালুয়া কবচ খুঁজে বের করার জন্য তার পরনের কৌপীনের মতো কাপড়টা এক টানে খুলে ফেলেছিল। তারপর আমাদের সাড়া পেয়ে পালিয়ে যায়।
মেজর উপাধ্যায় বললেন, সত্যি, আমাদের মুখের উপর থেকে একটা কালো পরদা সরে গেল। এখন আমার ভয় হচ্ছে শয়তান চন্দরনাথ তার দিদিমার কোনো ক্ষতি করবে কি না।
বললুম, ঠিক বলছেন মেজর উপাধ্যায়। আপনি এখনই টেলিফোনে ওসি মিঃ সিনহাকে জানিয়ে দিন যেন চন্দরনাথকে গ্রেপ্তার করেন। তাঁকে খুলেই বলুন চন্দরনাথই কালুয়াকে দিয়ে পাগলাবাবাকে খুন করিয়েছে। খুনের মোটিভ আপনি থানায় গিয়ে পরে জানাবেন।
শৌরীন্দ্র তখনই টেলিফোনের কাছে গিয়ে রিসিভার তুলে ডায়াল করতে শুরু করলেন। আমি পিছু ফিরে করিম খাঁকে ইশারায় কফি করতে বললুম। এ মুহূর্তে আমিও উত্তেজিত। কফি আমাদের নার্ভকে শায়েস্তা করে ফেলবে।
শৌরীন্দ্র ফোন করে এসে বসার পর আমি বললুম, আর তাড়াহুড়োর কারণ নেই। খাঁ সাহেবকে কফি আনতে বলেছি। কফি খেয়েই আমরা ধীরে-সুস্থে বেরুব।
রতন শর্মা বললেন, আমাকেও কি আপনাদের সঙ্গে যেতে হবে?
শৌরীন্দ্র বললেন, না। তোমাকে আমার শটগানটা দিচ্ছি। তুমি বাড়ি পাহারা দেবে। কারণ ওই শয়তান কালুয়া এবার হয়তো আমার বাংলোয় চুপিচুপি হানা দেবে। না–এখন নয়। শীতের বেলা ফুরিয়ে আসছে। একটু পরেই কুয়াশার অন্ধকারে চারদিক ঢেকে যাবে। বাড়ির চারপাশের সব আলো জ্বেলে দেবে। তারপর সতর্কভাবে চারদিক লক্ষ রাখবে।
বলে তিনি তার বেভরুম থেকে শটগানটা নিয়ে এলেন। রতনবাবুকে দিয়ে তিনি আবার বললেন, আরও চারটে কার্তুজ তুমি প্যান্টের পকেটে রেখে দাও। এতে একটা কার্তুজ ভরা আছে।
রতন শর্মা বন্দুক হাতে বেরিয়ে গেলেন। তাঁকে মহাবীরের কাছে যেতে দেখলুম। কিছুক্ষণের মধ্যে করিম খাঁ কফির ট্রে নিয়ে এল। আমরা তিনজনে কফির পেয়লা তুলে নিলুম।
শৌরীন্দ্র বললেন, করিম আমি রতনকে বাড়ি পাহারার দায়িত্ব দিয়েছি। তুমিও হুঁশিয়ার থাকবে।
বললুম, হ্যাঁ। তুমি তোমার ধারালো তলোয়ার নিয়ে কাল্পর হামলার জন্য তৈরি থাকবে।
.
আমরা যখন লালগড়ের শেঠবাড়িতে পৌঁছলুম তখন রাস্তার ধারে সব আলো জ্বলে উঠেছে। ছোটকা তার মোটর সাইকেল থেকে নেমে বাড়ির গেটের দিকে এগিয়ে গেল। মেজর উপাধ্যায় এবং আমি গাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখলুম গেটের ভিতরে এবং বাইরে এক দঙ্গল আর্মড কনস্টেবল এবং একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। শৌরীন্দ্রকে দেখেই তিনি নমস্কার করে বললেন, চন্দরনাথকে এই বাড়ির ভিতর থেকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। ওসি মিঃ সিনহা নিজে অসেননি, কী করতে হবে বলে দিয়েছিলেন। আমরা আসতে আর পাঁচ মিনিট দেরি করলে হয়তো কিছু ঘটে যেত।
আমি জিগ্যেস করলুম, কী ঘটে যেত, বলতে আপত্তি আছে?
পুলিশ অফিসার একটু হেসে বললেন, আপনিই সেই বিখ্যাত কর্নেল সাব? আমি চন্দ্রপুর থানায় থাকার সময় আপনার কথা শুনেছিলুম। আপনারা ভেতরে যান। নারায়ণী দেবীর ঘরে সেকেন্ড অফিসার আছেন। চন্দরনাথকে থানার হাজতে পাঠানো হয়েছে।
ছোটকা বলল, একটু ঝেড়ে কাশুন মিঃ ত্রিবেদী।
পুলিশ অফিসার মিঃ ত্রিবেদী বললেন, ভিতরে গিয়ে নিজেই দেখতে পাবেন। চন্দরনাথ তার অসুস্থ দিদিমাকে কোনো কবিরাজের পাঁচন খাওয়াতে যাচ্ছিলেন। ওই পাঁচন খেলে নাকি নারায়ণী দেবীর ম্যাজিক কিওর হয়ে যেত। উনি কিছুতেই খেতে চাইছিলেন না। তাকে খাওয়ানোর জন্য ধ্বস্তাধ্বস্তি চলছিল। এমন সময় আমাদের সেকেন্ড অফিসার রামেশ্বর রাও নারায়ণী দেবীর ঘরের দরজায় ধাক্কা দেন। কিন্তু দরজা কেউ খুলে দিচ্ছিল না। পুলিশের লাথির জোর আপনি তো বোঝেন। লাথির জোরে দরজা ভেঙে গিয়েছিল। বাকিটা নিজেরাই করেছিল।
দুজন কনস্টেবল মিঃ ত্রিবেদীর ইশারায় আমাদের সঙ্গে নিয়ে লন পেরিয়ে উঁচু। বারান্দায় উঠল তারপর বাঁদিকের একটা ঘর দেখিয়ে বলল, ঐদিকে চলে যান। আমি শৌরীন্দ্র ও ছোটকাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত ওই ঘরে ঢুকলুম। ঘরে উজ্জ্বল। আলো জ্বলছিল। একটা চেয়ারে একজন অফিসার বসেছিলেন। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দেখলুম দেওয়াল ঘেঁষে উঁচু পালঙ্কের উপর এক বৃদ্ধা মহিলা পিছনে কয়েকটা বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছেন। পালঙ্কের নীচে একটা ভাঙা গেলাস আর কিছুটা কালচে রঙের তরল পদার্থ পড়ে আছে। পালঙ্কের মাথার দিকে দাঁড়িয়ে আছেন এক বলিষ্ঠ প্রৌঢ়া। সম্ভবত তিনি নারায়ণী দেবীর পরিচারিকা।
সেকেন্ড অফিসার রামেশ্বর রাও বললেন, আসুন মেজর সাব। ওসি মিঃ সিনহা এখনই এসে পড়বেন। ওই দেখুন ওখানে বিষাক্ত আরক পড়ে আছে। ওই মহিলাটির নাম কলাবতী। নারায়ণী দেবীর পরিচারিকা। দেখতেই পাচ্ছেন কলাবতী একজন সমর্থ স্ত্রীলোক। তার ধাক্কাতেই বিষাক্ত আরকের গ্লাসটা পড়ে ভেঙে গেছে।
মেজর শৌরীন্দ্র উপাধ্যায় নারায়ণী দেবীর কাছে গিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, আমাকে চিনতে পারছেন?
নারায়ণী দেবী ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি মাথা নাড়লেন। তখন আমার নির্দেশে শৌরীন্দ্র তার বুকপকেট থেকে সেই কবচটা বের করে বৃদ্ধাকে দেখিয়ে বললেন, আমি লালগড় রাজবাড়ির বংশধর শৌরীন্দ্র উপাধ্যায়।
বৃদ্ধার হাত দুটি লেপের মধ্যে ঢোকানো ছিল। কলাবতীর সাহায্যে তিনি ডান হাত বের করলেন। তারপর শৌরীন্দ্রের কাছ থেকে কবচটা নিয়ে দেখে সেটা মাথায় ঠেকালেন। তারপর রুগণ কণ্ঠস্বরে বললেন, কলাবতী, আমার পিঠের এই বালিশগুলো সরিয়ে দাও। তারপর আমাকে বিছানার মাঝখানে বসিয়ে দাও।
কলাবতী তার নির্দেশ পালন করলেন। এরপর নারায়ণী বললেন, কলাবতী, আমার মাথার উপর ওই কুলুঙ্গিতে ভগবতী মাঈজীর পেছনে একটা কবচ আছে। সেটা আমাকে দাও।
কলাবতী সে কবচটা এনে দিলেন। বৃদ্ধা বললেন, পুলিশ অফিসারকে এখানে ডাকো।
মিঃ রামেশ্বর রাও তখনই তার কাছে এসে গেলেন। তিনি কবচ দুটোর সিল খুলে তার ভিতর থেকে দুটো কাগজ বের করতে বললেন।
মিঃ রাও শৌরীন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা মোটা সুই পেলে হত।
আমার জ্যাকেটের ভিতর পকেটে নরুণ ও চিমটে নিয়ে গিয়েছিলুম। বললুম, কবচ দুটো আমাকে দিন।
শৌরীন্দ্র বললেন, আমার বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
মিঃ রাও তখনই উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট ঠুকলেন। আমি অবাক হয়েছিলুম। তিনি বললেন, আমাকে আপনি ভুলে গিয়েছেন কর্নেল সাব? আমি রামগড় থানায় পাঁচ বছর আগে পুলিশ সার্জেন্ট ছিলাম। আপনারই কৃপায় আমি প্রমোশন পেয়েছিলুম।
মিঃ রাওয়ের কথা আমার মনে ছিল না। এমন অনেক অফিসার আমার এই রহস্যভেদী জীবনে দেখেছি। সবাইকে মনে রাখা সম্ভব নয়। আমি চিমটে দিয়ে দুটোরই কাগজ বের করে ভাঁজ খুললুম তারপর বৃদ্ধার হাতে দিয়ে বললুম, এবার মিলিয়ে দেখুন। লক্ষ করলুম চোখের সামনে কাগজ দুটো ধরে আছেন তিনি। তাঁর দু’হাত কাঁপছে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
কলাবতী তার দুধে হাত দিয়ে বললেন, কাঁদবেন না দিদি। এবার কী করতে হবে বলুন।
বৃদ্ধা কাগজ দুটি এগিয়ে দিলেন মিঃ রাওয়ের দিকে। তারপর বললেন, আপনি পুলিশ অফিসার, আপনি মিলিয়ে দেখুন ঠিক আছে কি না।
মিঃ রাও মিলিয়ে দেখে বললেন, ঠিক আছে। কিন্তু রত্নপেটিকা মানে?
বৃদ্ধা বললেন, কলাবতী, চাবিটা নাও। বলে তিনি সোয়েটারের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে সেখান থেকে একটা চাবি বের করলেন। বেশ মোটা চাবি। তারপর বললেন, কলাবতী, গদি তুলে দেখ একটা ছোট বাক্স আছে খাটের সঙ্গে আটকানো। তুমি সেই বাক্সের তালা খুলে ভিতরে যা আছে আমাকে দাও।
কলাবতী তার নির্দেশ পালন করার পর দেখলুম লাল রেশমি কাপড়ে জড়ানো একটা চৌকো পেটিকা।
বৃদ্ধা সেটা শৌরীন্দ্রের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, খুলে দেখ বাবা, তোমাদের রাজবাড়ির পূর্বপুরুষদের ধনরত্ন। আমাকে বিশ্বাস করো, গঙ্গামাঈজীর নাম নিয়ে বলছি কখনো ওটা খুলে দেখিনি। আমার স্বামী যে অবস্থায় ওটা আমাকে দিয়েছিলেন, সেভাবেই এখনও আছে।
এই সময় ওসি মিঃ সিনহা এসে গেলেন। সহাস্যে বললেন, এ তো অভাবনীয় ব্যাপার। মেজর উপাধ্যায় কি তাঁর পূর্বপুরুষের গচ্ছিত সম্পদ ফেরত পেলেন?
ততক্ষণে লাল রেশমি কাপড় খুলতেই বেরিয়ে পড়ল কারুকার্যখচিত ও নানারকম পাথর বসানো একটা পেটিকা। পেটিকায় কোনো তালা নেই। সেটা খুলতেই আমাদের সবার চোখ যেন জ্বলে গেল। একটা জড়োয়া নেকলেস এবং এক ডজন হিরেখচিত একটা চৌকো বাজুবন্ধ। না–একটা নয়। ওটা তুলতেই তার তলায় আরেকটা দেখা গেল।
বৃদ্ধা বললেন, আমার স্বামীর কাছে শুনেছি, রাজবাড়িতে নতুন বউমা এলে তাকে এই গয়না পরিয়ে দেওয়া হত।
শৌরীন্দ্র বললেন কাকিমা, তুমি আমার পূর্বপুরুষের এই ধনরত্ন বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলে। আমি এর প্রতিদানে তোমাকে কী দেব?
কলাবতী বলে উঠলেন, হুজুর, দিদিমণির চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। আজ আমি ওঁকে ভগবানের ইচ্ছায় বাঁচতে পেরেছি। কিন্তু ওই বেইমান ছোকরাটা আবার একদিন ফিরে আসবে। তখন কী হবে ভাবতেই আমার ভয় করছে।
ওসি মিঃ সিনহা সহাস্যে বললেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে। তবে ওই বজ্জাত চন্দরনাথ সহজে রেহাই পাবে না। আইনে আছে–খুন যে করে তার চাইতেও বেশি দোষী যে খুন করায়, সে।
ছোটকা বলল, দিদিমাকে আমি আমার বাংলোয় নিয়ে যাব। ওসি মিঃ সিনহা প্লিজ আমাকে সেই অনুমতি দিন।
মেজর উপাধ্যয় বললেন, না, ছোটকা। আমি খুব শিগগির ওঁকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে কোনো নার্সিংহোমে রেখে চিকিৎসা করাব।
এইসব কথাবার্তা চলতে লাগল। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা চুরুট ধরিয়ে লক্ষ করলুম সর্বাঙ্গে অলঙ্কার পরা এবং মাথায় ঘোমটা একজন যুবতী নিঃশব্দে কাঁদছেন। আর পাশে এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তাহলে এই যুবতী চরনাথের স্ত্রী আর অন্য মহিলা হয়তো আত্নীয়া। আমার ইনটিউশন বলে দিল এঁরা নিপাপ। এঁদের দ্বারা নারায়ণী দেবীর কোনো ক্ষতি হবে না। এঁদের অগোচরেই চন্দরনাথ নারায়ণী দেবীকে স্লো পয়জন করে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। পারেনি বিশেষ করে কলাবতীর জন্য।
আমি চুরুট টানতে টানতে লন পেরিয়ে গেটের কাছে গেলুম। সেই পুলিশ অফিসার বললেন, আমার ভারি তাজ্জব লাগে আপনি যেখানেই যান, সেখানেই খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়েন শুনেছি। আপনি কি এ সম্পর্কে কিছু ভেবেছেন?
কষ্ট করে হেসে বললুম, হ্যাঁ ভেবেছি। এটাই আমার নিয়তি। যেখানেই যাই একজন ইটারন্যাল মার্ডারার আমার সামনে একটা রক্তাক্ত লাশ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমাকে চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু প্রতিবারই আমি জিতে যাই। যেদিন হেরে যাব সেদিন পৃথিবী থেকে আমার অস্তিত্ব মুছে যাবে। জানি না সেদিন আর কত দূরে।