লাভিং ইউ
সন্ধ্যে নেমে এল, নিরু ছাদের এক কোণে ঠায় বসে, কিন্তু ওর ঝিল্লি পায়রাটা এখনও ফিরে এল না। বুকের মধ্যে একটা ভয় দুপদুপ করছে নিরুর, টিপটিপ করে পাড়ার একেকটা বাড়িতে আলো জ্বলে উঠছে। কানে এখনও মাখামাখি হয়ে আছে খানিক আগে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজের ‘হোঁ ও ও ও ও ও ও ও … আওয়াজটা। নিবু নিবু নীল আকাশের একটা পাশ মেঘে কালো হয়ে এসেছে। কাকা সকালে কাগজ পড়তে পড়তে বলেছিল, আজ রাতে বর্ষা নামবে। নিরুর খুব আহ্লাদ হয়েছিল তখন। অথচ এখন বৃষ্টির কথা ভেবে ওর কান্না পাচ্ছে। এই নিয়ে ওর তিন-তিনটে চিঠির উত্তর করল না নন্দিনী। যে কিনা শেষ চিঠিতেও কেঁদে-কঁকিয়ে লিখেছিল, তোমার চিঠির দেরি দেখলে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।
রাগের মাথায় জোরে জোরে নিরু বলল, ছাই করে! সব মেয়েই ওই সব বলে। কোনো মেয়েরই কোনো মনুষ্যত্ব নেই। তারপর একটু থেকে বলল, শুধু মা ছাড়া।
হঠাৎ কোত্থেকে এক টিপ জল এসে পড়ল নিরুর নাকে। নিরু ওপরে চেয়ে দেখল কালো মেঘগুলো আকাশের এক পাশ থেকে হাওয়ায় ভেসে মধ্যিখানে চলে এসেছে। জলের ফোঁটাগুলো বাড়তে থাকলেই বৃষ্টি হয়ে যাবে। আর তখন পায়রাটার বাসায় ফেরার কোনো পথ থাকবে না।
নিরুর বুকের ধুকপুকুনি ক্রমেই বাড়ছে। ঝিল্লি, দাদার পায়রা। দাদা ট্রেনিং দিয়ে ওকে এখানে-ওখানে পাঠায়। দাদার আইডিয়াই নেই নিরু ওর পায়রাকে দিয়ে প্রেমপত্র পাঠানো শুরু করেছে নন্দিনীদের বাড়ি। পায়ে চিঠি বেঁধে চিলেকোঠার ছাদে চড়ে নিরু ঝিল্লিকে নন্দিনীদের চারতলার বারান্দাটা দেখায়। মুখে আদর করে ডাকে, ঝিল্লি ! ঝিল্লি ! ঘাড়ে, মাথায় নরম করে হাত বুলিয়ে দেয়। তখন আরামে, আবেগে নানান রকম ধ্বনি করে ঝিল্লি। তারপর একটু হাত আলগা দিলেই পতপত করে উড়ে যায় উত্তর-পশ্চিম কোণে নন্দিনীদের বাড়ির নিশানায়। নিরু তখন স্পাইরাল সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে চিলেকোঠার ছাদ থেকে। আর ঢুকে পড়ে চিলেকোঠার ওর পড়ার জায়গায়। খুলে বসে পড়ার বই, যার ওপর শুধু চোখ ভাসে। কান দুটো একটু একটু গরম হয়, মন শুধু গোনে মিনিট, মিনিট আর মিনিট…
খুব রাগ হচ্ছে নিরুর। নাক থেকে ও বৃষ্টির জল মুছল না। ঝিল্লি না ফিরলে মার আছে কপালে ওর। আর ফেরেও যদি নন্দিনীর চিঠি নিয়ে পায়ে সটান দাদার হাতে তাহলে… উঃ! কী নিরু সে-দৃশ্য ভাবতেও পারছে না। তাহলে শুধু মার নয়, রীতিমতো লাঞ্ছনা আছে কপালে। নিরু আস্তে করে আলসে থেকে নেমে গুটি গুটি হেঁটে গেল চিলেকোঠার ঘোরানো সিঁড়ির দিকে। যখন কানে ভেসে এল বাড়ির পিছনে অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান মেয়ে লোরেনের ফ্ল্যাট থেকে গ্রামের আওয়াজ। গমগমে আওয়াজে এলভিস প্রেসলি গাইছে লাভিং ইউ, জাস্ট লাভিং ইউ।
নিরুর আর চিলেকোঠার ছাদে চড়া হল না। ও চিলেকোঠাতেই ঢুকে পড়ে পিছন দিককার জানালা খুলে আসন করে বসল। ওর ঘর অন্ধকার, কিন্তু লোরেনের ঘরের আলো ফ্যাটফ্যাট করে জ্বলছে। লোরেন একটা বড়ো টার্কিশ তোয়ালে জড়িয়ে জামা ইস্তিরি করছে গানের ছন্দে ছন্দে। একটু পরেই হয়তো তোয়ালেটুকুও খসিয়ে দেবে শরীর থেকে যদি টের পায় নিরু ওকে দেখছে। নিরুকে দেখিয়ে দেখিয়ে বেলি ডান্স কি স্ট্রিপ টিজ করা ওর বদভ্যাস। নিরু জানে সেটা। নিরু বিব্রত হয়। সব দেখে আরও বেশি করে অসভ্যতা করে ফিরিঙ্গিটা। নিরুর দিদি বলে লোরেন সুইন্টনের জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাই হল বিখ্যাত বেলি ডান্সার হওয়া। হয়তো হয়েও যাবে কোনো দিন। শুধু নিরুই জানে কত বড়ো বেহায়া ওই লোরেন। কত বড়ো অসভ্য ও। কিন্তু এখন নন্দিনীর ওপর রাগ করে নিরু চোখ ভরে দেখতে চাইছে ওই অসভ্য মেয়েটাকেই। ষোলো বছরের দুধ সাদা ওর পেলব ওই শরীর, ওই দুটো বুক, ওই কোমর, পা আর… লজ্জায় জিভ কাটল নিরু। মনে পড়ল সেদিনই কাকা বলছিল নিরুকে বোর্ডিঙে ভর্তি করে দেবে। অসভ্য ছেলে-মেয়েতে নাকি ভরে গেছে পাড়াটা। তাও তো কাকা নিরুর প্রেমপত্রের কথা জানে না! জানে না চিলেকোঠার পড়া করতে করতে কত খারাপ খারাপ জিনিস দেখে নিল নিরু! কাকা ভাবতেও পারবে না বাবা-মরা ছেলেটা সারাদিন একলা বসে বসে কত খারাপ খারাপ কথা ভাবে। হঠাৎ নন্দিনী, কাকা আর নিজের ওপর একই সঙ্গে অভিমান হল নিরুর। ও গজরাতে গজরাতে বলল, আমি খারাপ হয়ে যাব! আমি খারাপ হয়ে যাব! আমার কেউ ভালো করতে চেয়ো না। বলে খট করে জ্বালিয়ে দিল ঘরের বাতিটা। যাতে লোরেন টের পায় যে ওর একলা বালক দর্শক আসনে হাজির।
আলো জ্বলতেই লোরেন ঘাড় ঘুরিয়ে নিরুদের ছাদের দিকে তাকাল। ওর এক রাশ সোনালি চুলের পাপড়ি চোখের ওপর থেকে হাত দিয়ে পাশে সরিয়ে রাখল। একটা দুষ্ট, শয়তানি হাসিও হয়তো হাসল। তারপর গ্রামের দিকে সরে গিয়ে গানের আওয়াজ আরও জোর করে দিল। এলভিসের ‘জেলহাউজ বৃক’ গানটা গাঁক গাঁক করে চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। উত্তেজনা বোধ করে নিরু হঠাৎ করে বলেই বসল, হাই লোরেন! আই’ম হিয়ার! আর তখনই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামল।
বৃষ্টি নামলে খটখটাস খটখটাস করে কাঠের জানালা বন্ধ হওয়ার একটা চেনা শব্দ আছে এপাড়ায়। কিন্তু অনেকে দিনের গরমের পর আজকের এই প্রথম বৃষ্টিতে জানালা-টানালা সেভাবে বন্ধ হল না। নিরু নিজেও জানালা দেওয়ার কথা ভাবছে না। কিন্তু লোরেনই এগিয়ে এসেছে ওদের ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো টেনে দিতে। একই সঙ্গে সব জানালা আর দরজা। প্রথমে নীচের দরজার ভাগটা টেনে দিল মেয়েটা। তারপর জানালার অংশ টানতে টানতে নিরুর দিকে মুখ তুলে বলল, নিরু! ড্রপ ইন টুনাইট। ইটস মাই বার্থডে। তারপর ইস্তিরির টেবিল থেকে লম্বা সিল্কের গাউনটা তুলে ধরে বলল, মাই বার্থডে ড্রেস। ইজনট ইট বিউটিফুল? নিরু বলল, ইয়েস! কিন্তু বৃষ্টির ঝমঝমানিতে কিছু শোনা গেল না। নিরু সজোরে টেনে দিল ওর নিরিবিলি পড়ার ঘরের জানালার পাল্লা। তারপর ঘরের আলো নিভিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। যতক্ষণ না বৃষ্টি থামে।
কখন বৃষ্টি থেমেছে নিরুর হুঁশ নেই। জানালা-দরজার বন্ধ কুঠরিতে ওর হাঁপ ওঠার কথা, কিন্তু নিরু যেন নিরুর মধ্যেই নেই। রাগ হলে ছোটোবেলায় ফিট হয়ে যেত নিরু। তাই ভয়ে ভয়ে কেউ বড় একটা শাসন করে না ওকে। মার হাত ওঠে না ওর মুখের দিকে চাইলে। ঠিক যেন ওর বাবার মুখটি বসানো। নিরুর ওপর রাগ হলে কাকা চাকর-বাকরদের খামাখা গালিগালাজ করে। কিল, গাঁট্টা যা মারার দাদাই মারে। যে যখন নিরু ওর লাটাই ভাঙে কি পায়রাদের জ্বালায়। তখন রে রে করে দাদার দিকে ছুটে আসে চাকর চিন্তা, ভানু কি বড়োঠাকুর।
বৃষ্টির আওয়াজ থেমেছে বলে চিলেকোঠার পায়রাদের ‘গুগুরগু! গুগুরগু! কানে আসছে। কিন্তু সেসব শুনেও শোনা হচ্ছে না নিরুর। ওর তিন-তিনটে জবাব দেয়নি নন্দিনী। আর একটু আগে লোরেন ওকে জন্মদিনে ডেকেছে। যে লোরেনের বাড়ি ও কোনোদিনও যাবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল। গেলেই তো খারাপ হয়ে যাবে। ওকে ন্যাংটা হওয়া নাচ দেখায় মেয়েটা দূর থেকে। হাতের নাগালে পেলে কী করবে কে জানে! কথাটা মনে হতেই আপনা থেকে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল একটা নিষিদ্ধ শব্দ—প্রস্টিটিউট! সদ্য শিখেছে উজ্জ্বলদার থেকে। যার মানে নাকি…
ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ হল বাইরে! ফতফত ফতফত… তরপর ঝিল্লির ডাক করর কররর …নিরু ‘ঝিল্লি?’ বলে ডেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। আর অমনি ফতফত করে পায়রাটা ঢুকে পড়ল ঘরে। জায়গা মতো বসতে গিয়ে গা ঘষে গেল নিরুর সঙ্গে। আহা বেচারি! ভিজে নেতিয়ে আছে। কোথায় ছিল এতক্ষণ? নিরু ঠক করে লাইট জ্বালিয়ে দিল। ইচ্ছে হচ্ছে জামা দিয়ে ওর গা মুছিয়ে দেয়। কিন্তু ওমা ওকী! ওর পায়ে তো কোনো চিঠি নেই। নন্দিনী নিরুর চিঠিটা খুলে নিয়েছে, কিন্তু নিজের চিঠিটা দেয়নি।
রাগে দপ করে জ্বলে উঠেছে নিরুর মাথা। ও ফের লাইট নিবিয়ে দুদ্দাড় করে নেমে এল নীচে। মা বেরুচ্ছিল ঠাকুর ঘর থেকে, ও সোজা সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, মা, দুটো টাকা দেবে? কাকা এলে দিয়ে দেব।
মা বুঝল না নিরুর হঠাৎ দুটো টাকার প্রয়োজন হল কেন। আর কাকা এলে তা ফেরত করার কথাই বা উঠছে কেন। একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল মা, কেন, দুটো টাকার কী দরকার?
নিরু বলল, লোরেনের জন্য গিফট কিনব।
মার রহস্য কাটল না। বলল, কে লোরেন? ও ধিঙ্গি ফিরিঙ্গিটা? নিরু কিছু মনে করল না। লোরেন সম্পর্কে সব্বাই এইভাবে কথা বলে। ও শুধু বলল, ওর জন্মদিন আজ।
তা সে তো তোমার দিদির বন্ধু। তোমাকে নেমন্তন্ন করে কেন? আপনা থেকে ওর সেই ছোটোবেলার রাগটা বেরিয়ে এল। নিরু ঝাঁঝ করে বলল, সে তোমায় জানতে হবে না !
মা বোধ হয় ওর বাবাকেই দেখল ওর মুখের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে গলা নামিয়ে বলল, দিচ্ছি, কিন্তু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে। আর কাকার থেকে নিয়ে ফেরত দেবার দরকার নেই।
নিরু কিছু না বলে টাকা নিয়ে হলঘরের একধারে রাখা চটি পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে গেল মুকুন্দর দোকানের দিকে। যেখানে ক-দিন ধরে কিছু নতুন ফিতে আর ইয়ো-ইয়ো ঝুলছে। লোরেনের কালো গাউনের সঙ্গে মানাবে বলে একজোড়া সাদা রিবন কিনল ও। আর একটা লাল ইয়ো-ইয়ো। তারপর পাশের গলি দিয়ে জোরে পা চালিয়ে এগিয়ে পড়ল লোরেনদের বাড়ির দিকে।
লোরেন বিশ্বাসই করতে পারছে না সত্যিই নিরু ওটা ওর বার্থডে ভেবেছে। আসলে ও তো ঠাট্টা করেছে। কিন্তু এখন নিরুর হাতে রিবন আর ইয়ো-ইয়ো দেখে একেবারে ব্যাজার। ও যে কী বলবে তাই মুখে জোগাচ্ছে না। ও শুধু বলল, ইউ রিয়েলি থট ইটস মাই বার্থডে?
নিরুর কান্না পাচ্ছে। ও কোনোমতে গলার কাছটায় জমে ওঠা কান্নার দলাটাকে নিঃশ্বাসে চেপে বলল, আই বিলিভ ইউ, লোরেন।
ফের একবার যেন সাপের ছোবল খেল মেয়েটা, কিছুতেই আর অবস্থাটা হালকা করে আনতে পারছে না। ভয়ে গা-ঝাড়া হাসিও হাসতে পারছে না। পাছে অভিমানী ছেলেটা রেগে ফেটে পড়ে।
ও আস্তে করে হাত রাখল নিরুর গায়ে। নিরুর গা ঘেন্নায় গুলিয়ে উঠল। মেয়েগুলো পেয়েছে কী ওকে? সব কটা প্রস্টিটিউট! বেশ্যা! ও এক ঝটকায় লোরেনের হাত সরিয়ে দিল গা থেকে।
লোরেন ওর হাত থেকে উপহারগুলো নিয়ে গালে ঠেকাল। নিরু সেদিকে ফিরে চাইলও না একটা প্রতিশোধের ভাব জাগছে ওর ভেতরে। বাড়ির পথে ও নন্দিনীদের জানালায় একটা ঢিল ছুড়বেই। আর সেটাই ওদের ভালোবাসার শেষ কথা। ও তড়াক করে ডিভান থেকে লাফিয়ে উঠে দরজার দিকে পা বাড়াল। আর কিছু ঠাউরে ওঠার আগে আটকে পড়ল লোরেনের বুকের মধ্যে। লোরেন ওকে জাপটে ধরে গালে গাল ঘষছে, ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে। জড়িয়ে জড়িয়ে অসভ্য ইংরজিতে কী সব বলছে কানে ফিস ফিসিয়ে। ও শুধু একটা কথারই হদিশ করতে পারছে— আই লাভ ইউ, লিটল লাভার, লিটল লাভার…
এক অদ্ভুত অনুভূতিতে শরীর অবশ হয়ে আসছে নিরুর। ও হাত দিয়ে অনুভব করছে লোরেনের বুক দুটো। কী মিষ্টি স্পর্শ! কী ভীষণ অন্যরকম সব কিছুর থেকে! অবশ হতে হতে ও গড়িয়ে পড়েছে ডিভানে। লোরেন সেই সুযোগে ফের চালিয়ে দিয়েছে এলভিসের গান ‘লাভিং ইউ, জাস্ট লাভিং ইউ। তারপর ফিরে এসে ফের আঁকড়ে ধরেছে নিরুকে। নিরুর হাতও …
হঠাৎ প্রবল চেঁচামিচি বাইরে। বেহেড মাতাল কিছু জাহাজি লোক হই হই করে ঢুকে পড়েছে ফ্ল্যাটে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ইংরেজি গান গাইছে লোরেনের মা মার্লিন। নিরুকে ছেড়ে দিয়ে ডিভানে সোজা হয়ে বসল লোরেন। তারপর দু-হাতে মাথা গুঁজে কাঁদতে লাগল, দ্যাট বিচ উইল নেভার গিভ মি পিস। নেভার! নেভার! নেভার! ওর চোখের গরম গরম জলের ফোঁটা ছিটকে এসে পড়ল নিরুর গায়ে। আর ওর মনে পড়ল নন্দিনীকে, যাকে ও একবার এভাবে কাঁদতে দেখেছে। যখন ওর দিদি কলেজের প্রফেসরের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করে চলে গেল।
নিরু উঠে ঘরের দরজা খুলে দাঁড়াল। দেখল তিনটি যুবক প্রায় চ্যাংদোলা করে আনছে মার্লিনকে। মার্লিন নেশায় চুর, কিছুই দেখছে না চোখে, শুধু জোরে জোরে বেসুরো ভাবে গেয়ে যাচ্ছে ‘ নেভার অন আ সানডে। মার্লিন নিরুকে দেখতেও পাচ্ছে না, লোকগুলোকে বলতে শুনল, হাই বয়! ইউ নিভ আ ওম্যান?
নিরু জোরে পা চালিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। ভাবল, দিদি ঠিকই বলে যে, লোরেনের মা একটা যাচ্ছেতাই। আইজায়াস না কী একটা বার-এ গান গায়। যার-তার সঙ্গে মেশে। সুন্দরী মেয়েটাকেও খারাপ করে দিতে চায়। কিন্তু লোরেন হবে না। ও সত্যিকারের বড়ো ডান্সার হতে চায়।
বাড়ি ফিরে আর খিদে পেল না কিছুতেই নিরুর। মাকে, কাকাকে, বড়োঠাকুরদাকে বলল, খুব খেয়েছি লোরেনের জন্মদিনে। তাও জোর করে এক বাটি দুধ গেলাল মা। তারপর কাকার ঘরে কাকার বিছানায় গিয়ে মুখ গুঁজে শুল। কারণ শুধু খিদে নয়, ওর ঘুমও বোধ হয় চিরতরে কেড়ে নিয়েছে লোরেনের চুমু, বুকের স্পর্শ, গায়ের গন্ধ। মনে পড়ল নন্দিনীর ঠোঁট। যে ঠোঁটে কোনোদিনও চুমো দেওয়ার সাহস হয়নি নিরুর। নন্দিনীকে ছুঁতেই পারেনি কোনোদিন।
এটা মনে হতে নিজেকে খুব পাপী মনে হল নিরুর। নিজেকে ঘেন্না হল। বুঝতে পারল যে লোরেন যা করেছে তার জন্য সে নিজেও অনেকখানি দায়ী। নিরু তো সত্যিই …নিরুর চোখ ফেটে জল আসছে। জেগে থাকা আর ঘুমের মধ্যে একটা আবেশের জায়গা আছে। যেখানে তলিয়ে যাচ্ছে নিরু। কতক্ষণ এভাবে ও মুখ গুঁজে পড়ে ও ভুলেও গেছে। কাকা এসে না ডাকলে ও উঠবে না।
কিন্তু ও এখন স্পষ্ট শুনল কাকা মাকে বলছে, আমি জানি তোমার কষ্ট হবে বউদি । তাহলেও বলছি নিরুকে আমি ভালো বোর্ডিঙে পাঠিয়ে দেব। এখানে থাকলে ও নষ্ট হয়ে যাবে।
কাকা একটু চুপ করল। মা-ও চুপ। তারপর মা বলল, ওকে নিয়েই তো থাকি। এত ছোটো।
কাকা বলল, সে কষ্ট কি আমার নেই, বউদি?
মা বলল, ও তো পড়াশুনোয় এত ভালো। কী এমন হল?
কাকা বলল, সেজন্যই তো ভাবি। পাশের রাস্তার নন্দিনী বলে মেয়েটা আছে, ওর বাবা আমাকে আজ তিনটে লাভ লেটার দিলেন। বলছেন, নিরু লিখেছে ওর মেয়েকে।
মা আঁৎকে উঠে বলল, সে কী!
কাকা বলল, কিন্তু বউদি, কী সুন্দর চিঠি সেগুলো। ভাবতেই পারছি না আমাদের নিরু লিখেছে। ও কত নিঃসঙ্গ, একলা, আমরা কোনো খবরই রাখি না। আমরা তো ওকে নষ্ট করে ফেলব!
নিরু শুনল মার ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে ওর, কিন্তু ও কখনোই সেটা করবে না। মা, কাকা কেউ তো ওকে কিছু বলেনি। ও কাঁদলে ওরা লজ্জা পাবে, দুঃখ পাবে। আর ওকে ভেতরে ভেতরে মরে যেতে হবে। ও বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইল ভাঙা পুতুলের মতো।
আরও রাতে কাকা যখন এসে ওর পাশে শুল ও উঠে বসে ধরা গলায় বলল, কাকা, আমায় বোর্ডিং-এ ভর্তি করে দাও। নিরুর মুখে একথায় কাকা বেশ হকচকিয়েই গেছিল। উঠে বসে নিরুর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে জিজ্ঞেস করল, কেন, কী হয়েছে বাবু?
নিরু কান্নায় ভেঙে পড়ে কাকার কোলে মুখ লুকিয়ে বলতে লাগল, এখানে থাকলে আমি খারাপ হয়ে যাব, কাকা! এখানে থাকলে আমি খারাপ হয়ে যাব। বাবলিকে দেখছি। আস্তে আস্তে কীরকম পাথরের মতো হয়ে যাচ্ছে বাবলি, ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার দিকে স্থির তাকিয়ে বলছে, জিম ভালো ব্যাবসা করছে। আমার নীলুকে কেড়ে নিয়ে অ্যাণ্ডি তুলে দিয়েছে। স্ট্রং, হ্যাণ্ডসাম, অ্যামেরিকান ইয়ুথ। আই শুড বি হ্যাপি। আমার কী সৌভাগ্য নীতিনদা।
আর থাকতে পারছি না ঘরে। গলার কাছে মোচড়াচ্ছে কীরকম। বাললি দু-হাতে চোখ ঢেকেছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে জল গড়াচ্ছে। নীল কার্পেটের ওপর দৃষ্টি এঁটে মনোরোগীদের কায়দায় আপন মনে বিড়বিড় করে কী সব বলে যাচ্ছে বাপী। আমি একটা বড়ো স্টেপে ঘরের বাইরে গিয়ে টয়লেটটা খালি পেয়ে ওখানেই ঢুকে গেলাম। পিছনে দরজা টেনে দিয়ে দোনামনায় পড়লাম। এই ছোট্ট এক চিলতে টয়লেটে দাঁড়িয়ে আমার কী উপকার হবে? তার চেয়ে…
আমি পাশ ঘুরতেই বেসিনের আয়নাটাকে সামনে পেলাম। আর আয়নার মধ্যে নিজেকে। আর, আমার চোখে জল। গন্ডদেশ দিয়ে গড়াচ্ছে। কেন? কার জন্যে? কতটুকু?
আমি দেখছি আমি কাঁদছি। বাপী কাঁদতেও পারে না, তাই বোবা মেরে বসে আছে। বাবলির সামনে। বাবলিও কাঁদছে, কিন্তু ও চায় না আমরা দেখি। আমি চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছি টয়লেট থেকে, ফের আয়নার একটা অংশে চোখ গেল। লাল লাল দাগ কীসব! আমি কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। লাল লিপস্টিকে আঁচড় কাটা। নিশ্চয়ই বাবলির। কিন্তু কার জন্য? আমি আরও ঘনিষ্ঠ হলাম আয়নার। আর স্পষ্ট দেখছি
—ফেয়ারওয়েল নীলু? আই স্টিল লাভ ইউ।
ভেতরে কীরকম প্রতিরোধ হচ্ছে একটা। নীলু নীলু নীলু। পাষন্ড, বাস্টার্ড, সোয়াইন। ও কোনোদিনও বুঝবে না ভালোবাসা কী। ও কোনোদিন বুঝবে না বাবলিই বা কী। শুধু ভালোবাসার জন্যই ভালোবেসে বেসে মরে যাবে মেয়েটা। আমি পকেটের রুমাল বার করে আয়নার লেখাগুলো ঘষে ঘষে মুঝতে লাগলাম। নীলুর প্রাপ্য নয় এই ভালোবাসা।