লাবুর গল্প

লাবুর গল্প

চাটুজ্জে বাড়ির বউ যখন এল তখন সবাই চোখ তুলে বউকে দেখছিল। লম্বা টানা টানা চোখ, গমের মত গায়ের রঙ আর সেরকম ফিগার খানি। কোমরটি দেখার মত। চাটুজ্জে বাড়ির ছোট ছেলে ক্ষ্যাপা লাবু লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল দোতলা থেকে বউদিকে। তার বড়দার পছন্দ আছে। যতই বলা হোক দেশ দুহাজার বারোতে পৌঁছেছে আসলে এ গাঁয়ের লোকজন এখনও অতদূর যায়নি। ছেলে শহরের বউ ঘরে তুলেছে বলে বাড়ির কর্তা অধীর চাটুজ্জের কিছুটা অভিমান ছিল কিন্তু বউমাকে দেখে সে অভিমান দূর হয়েছে। এ গ্রামের জমিদার ছিল এককালে চাটুজ্জেরা। বাড়ি ঘরদোরে জমিদারি রক্ত বোঝা যায়। ব্রাহ্মণ অভিমানও অধীর চাটুজ্জের বড়ছেলে রাখতে পারেনি। তার বউ কায়স্থ ঘরের মেয়ে। তবে পয়সাওয়ালা। ছেলে যখন বাড়িতে বলল অধীর সে রাতে খাননি। তবে এটুকু বুঝেছিলেন আজকালকার দিনের ছেলে পিলেরা বাপের “না” শোনার জন্য বসে থাকে না। আর জমিদারী মেজাজ দেখাতে গেলে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে বাড়িতে এক পয়সাও দেবে না। তাতে সংসার চালানো মোটেও সহজ হবে না। সেই দিন আর নেই। চুপচাপ মেনে নিয়েছিলেন।

এ গ্রামটা বর্ধমান জেলায়। কলকাতা থেকে ২০০ কিলোমিটার দূর। চাটুজ্জে আর খানদুয়েক ঘর ছাড়া সেরকম শিক্ষিত কেউ এ গ্রামে থাকে না। গ্রামটা খুব বেশি বড়ও না। চাষবাসই মূল উপজীব্য। বাম শাসনই হোক কিংবা রাম শাসন শাসকদলের যত উন্নয়ন শহর কেন্দ্রিক হবার দরুন এখনও এ গ্রামের বেশিরভাগ রাস্তা কাঁচা। বেশিরভাগ বাড়ি মাটির তবে ইলেক্ট্রিসিটি আছে। বেশিরভাগ স্ট্রিট লাইট রাত্তিরে জ্বলে না।

লাবু সেই সময়টাতেই বেরোয়। তার বেশ লাগে রাত বারোটার পরে গ্রামে হেঁটে হেঁটে ফিরতে। অধীর বাবুর আক্ষেপের অন্যতম মূল কারণ লাবু। ছেলেটা বড় ছেলে উজ্জল কিংবা মেজ সুনীলের মত মানুষ হল না। আধ পাগলা ক্ষ্যাপা থেকে গেল। লাবুর এই বেরনোর খবরটা অধীর জানেন। প্রথমে রাগারাগি করতেন। পরে দেখলেন চ্যাচামেচি করায় কোন লাভ নেই, তাই ধীরে ধীরে ছেড়ে দিলেন।

দাদার বাসরে লাবু সবার সাথে গোলাপ সাজাল বিছানায়। বউদিকে নিয়ে যখন দাদা ঘরে ঢুকল লাবু ড্যাব ড্যাব করে তাকাল। তার প্রাণের বন্ধু আসলাম আর সে খেতে বসল লাস্ট ব্যাচে। আসলামকে সে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করল,”ঘর বন্ধ করে কি করে রে?”

আসলাম ফিস ফিস করে বলল,”কি আর করবে, লুডো খেলে।“ বলে খিল খিল করে হাসতে থাকল।

লাবু রেগেমেগে আসলামের পাতের ইলিশ মাছটা খেয়ে নিল।

২।।

জ্যোৎস্না রাতে একটার পর থেকে চাঁদ মনে হয় আরও চকচকে হয়ে যায়। লাবুর অন্তত তাই মনে হয়। গ্রামের শেষে জমি পাহারা দেবার খাটিয়ায় বসে লাবু এই দার্শনিক চিন্তাগুলি করে। এই জমিটা শিবেন জোয়ারদারের। গত বছর ভোটের সময় শিবেন জোয়ারদার এক জবরদস্ত বুদ্ধি করলেন। নির্দল প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে গেলেন। পাঁচ হাজার টাকা গুনে গুনে দিয়ে পুলিশ স্টেশনে এক লম্বা চিঠি লিখে অভিযোগ করলেন তার প্রাণ সংশয় দেখা দিয়েছে ভোটে দাঁড়াবার পর, সরকার থেকে তাকে সিকিউরিটি দেওয়া হোক। দিন দুয়েকের মধ্যে দুই বন্দুকধারী হাজির হল শিবেন জোয়ারদারের কাছে। তখন ফসল কাটার সময়। শিবেন খাটিয়ায় শুয়ে লম্বা ঘুম আর সারারাত দুই সরকারি পাহারাদার ফসল পাহারা দিত। ভোট হল তিনমাস পরে। শিবেনের জামানত বাজেয়াপ্ত হল। সরকারি পাহারাদারেরাও চলে গেল। কিন্তু শিবেন বগল বাজিয়ে বলল দ্যাখো আমার কি বুদ্ধি। পাঁচ হাজার টাকায় বন্দুকধারী পাহারাদার তিন মাসে কে দেবে? হে হে হে হে।

সেই থেকে লাবুর ধারনা ছিল শিবেন জোয়ারদার সব চাইতে বুদ্ধিমান লোক। কিন্তু দাদার বিয়ের পর থেকে তার সে ধারনার পরিবর্তন হয়েছে। এত সুন্দর বউ যে আনতে পারে সেই সবচাইতে বুদ্ধিমান। তাদের বংশের মধ্যে দাদাই সব চেয়ে ভাল ছাত্র। এর মধ্যে একবার আমেরিকাও ঘুরে এসেছে। লাবুকে ওখান থেকে একটা দাড়ি কাটার ক্রিম এনে দিয়েছিল। লাবু সারা মুখে মেখে বসে থাকে। বড় ভাল লাগে তার। আমেরিকার ক্রিম। দারুণ ব্যাপার। দাদাকে সে খানিকটা ভয়ও করে। ছোটবেলায় দাদা তাকে খুব পেটাত পড়া পারত না বলে। সেই ভয় থেকেই দাদাকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি আমেরিকার চাঁদ কি রাত একটার পরে বেশি চকচক করে। যদি পেটায়!

লাবু প্রতিরাতেই তিনটের সময় ঘরে শুতে আসে। আজ দেরি করল। বাড়িতে পেছনের দরজা দিয়ে যখন ঘরে ঢুকছিল পরিষ্কার শুনতে পারছিল বড়দা বউদি নিচু গলায় ঝগড়া করছে। দাদা চাপা গলায় বলছে,”অন্তত একমাস তো তোমায় থাকতেই হবে এখানে, বিয়ে করে এসেছি, আমি না হয় প্রতি উইক এন্ডে একবার করে আসব।“

বউদি সাপের মত নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলছে,”এই শর্তটা বিয়ের আগে দিতে পারতে, তোমার থেকে শান্তনুই তবে বেটার অপশন ছিল, অ্যাটলিস্ট ওদের তো কোন ধ্যাদ্ধেরে গোবিন্দপুরে বাড়ি নয়।তার উপর মান্ধাতার আমলের বাড়ি। ভুতুড়ে বাড়ির মত লাগে। মাগো!“

দাদাও কম নয়, সেও ফোঁস করল,”হ্যারে মাগী, তোর যত অপশন এখনই দেখতে পাই, এতদিন তাহলে সব জেনে শুনে এখানে কি ছিঁড়তে এলি!”

ঝাড় খেয়ে বউদির গলাটা একটু নামল মনে হল,”এখানে স্যানিটারি ন্যাপকিন আমি কোথায় পাব। আগে বলতে পারতে, সেরকম স্টক আনলাম না।“

দাদা আদুরে গলায় বলল, “ সে আমি এনে দেব সোনা, এখন চল ঘুমোই।“

লাবু চুপচাপ সরে এল। স্যানিটারি ন্যাপকিনের মানেটা আসলাম জানে কিনা কে জানে!

৩।।

“তোর বউদির বুকখানা মাইরি দারুণ। তোর দাদা শালা কি যে করে, এমন বউ কেউ রেখে যায়!”

আসলামের কথা শুনে লাবু বুঝে উঠতে পারে না তার কি করা উচিত। ওকে তাড়া করে মারা যায়। কিন্তু এই সাত সকালে অত দৌড়ঝাঁপ তার পোষাবে না। সে শান্ত চিত্তে দাঁতন করতে লাগল। আসলাম আরও ঝুঁকে এল, “কি বে, তোর দাদার ঘরে উঁকি ঝুকি মারলি?কি করল দেখলি?” লাবু বুঝতে পারল না কাল রাতের ঘটনা আসলামকে বলা ঠিক হল নাকি। কিন্তু ওই যে কি ন্যাপকিন বলল ওটা বলতে আসলাম বলল ওটা ন্যাকড়ার মত। তুই বুঝবি না। লাবু ফিক ফিক করে হাসছিল। সে বুঝেছে আসলামও অতটা জানে না। এমনিতে আসলাম হাব ভাব দেখায় সব জান্তা। ব্যাটা আসলে যেটা জানেনা সেটাও রঙ চং মাখিয়ে বলতে ওস্তাদ। ওই তো গেল বছর আসলাম বলল জয়দেবের মেলায় সাইকেল করে যাবে। দুজন মিলে উদ্যোগ করে বেরিয়েওছিল। আসলামের কথায় ভেবেছিল আধঘণ্টা লাগবে। এ গ্রাম সে গ্রামের ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে প্রায় ঘণ্টা তিনেক পরে পৌঁছেছিল। তখন রাত আটটা বাজে। মেলা বলতে সব বাউলদের ঠেক আর নদীর চরে সারি সারি পায়খানা। বাড়ির কথা ভুলেই গেছিল লাবু। সারারাত বাউল ঠেকে গান শুনে আর মেয়ে বাউলের নৃত্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছিল তার। পরদিন বাড়ি পৌঁছালে বাড়িতে কম মার খেতে হয়নি বাবার কাছে। তবে লাবু আসলামের কথা বলেনি। আসলামকে সে খুব ভালবাসে। আসলামও তাকে কম বাঁচায়নি। পদ্মফুল আনতে গিয়ে চিতি সাপের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। পঞ্চাননতলার বটগাছের নীচে পাগলা কুকুরটা তাড়া করেছিল লাবুকে। সেটাকে ইট দিয়ে মেরে মাথা গুঁড়ো করে দিয়েছিল আসলাম।

তবে ব্যাটা মাঝে মাঝে বড্ড উলটো পাল্টা কথা বলে। তার বউদিকে নিয়ে এসব কথার কি দরকার। এমনিতে তার সাথে বউদি তো খারাপ ব্যবহার করেনি। তাকে ডেকে একদিন তত্তের মিষ্টি দিল। জিজ্ঞেস করল কোন ক্লাস অব্দি পড়েছে। তার মাথায় হাতও বুলিয়ে দিয়েছে। লাবুর একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। তারপর বাতাবি লেবু আনার নাম করে পালিয়েছে সেখান থেকে। তবে বউদি আসার পর লাবুর সারাক্ষণই বউদির সামনে সামনে থাকতে ইচ্ছা করে। যখন সে সুপারি গাছে ওঠে তখনও মনে হয় বউদি থাকলে ভাল হত। তাকে দেখত। মুসলমান পাড়ায় ফুটবল খেলতে যাবার সময় মনে হয় ইস বউদি যদি দেখত সে কত সুন্দর খেলতে পারে।

তবে লাবু ক্ষ্যাপা হলেও এসব কথা আসলামকে বলে না। সেও বুঝতে পারে, কিছু কিছু কথা আসলামকে বলার নয়।

৪।।

ঘটনাটা ঘটল বুধবার রাত্রিবেলা। দুটোর সময় লাবু ফিরছিল পেছনের দরজা দিয়ে। ঘরে ঢোকার সময় দেখল তার ঘরে বউদি বসে। লাবু কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সে আমতা আমতা করল, “ কি খবর বউদি, কেমন আছ?” লাবুর ঘরটা অন্ধকার থাকে। এখন সেরকমই ছিল। সে বুঝতে পারছিল কিছু একটা ঘটতে চলেছে। বউদি উঠে তাকে আচমকা জড়িয়ে ধরল। লাবু অবশের মত হয়ে গেল। তবু ওই সময়ের মধ্যেই বউদিকে টান দিয়ে সরিয়ে দেয়। ঘর থেকে একপ্রকার ঠেলেই বের করে দেয় বউদিকে। ছিটকিনি আটকে হাক পাক করে নিঃশ্বাস নেয়।

৫।।

আসলাম এই সতেরো বছর বয়সেই রোজা করে। রোজার সময় আসলামের চোখ নাক মুখ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সময় কোন অপবিত্র কথা শোনা, বলা পাপ।লাবু আসলামের সাথে সাথে ঘোরে। সাপের খোলস দেখে, পোড়া অশ্বত্থ গাছের ডালে ডালে পাখির বাসা খুঁজে বেরোয়, মাঝে মাঝে শিবেন জোয়ারদারের খাটিয়ায় গিয়ে বসে দুজনে মিলে। দাদা বউদিকে নিয়ে গেছে মাস খানেক হল। সেই ঘটনার পর বাড়িতে থাকা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিল লাবু, সব সময় সচকিত থাকত বউদির সাথে যেন কোন প্রকারে চোখাচুখি না হয়ে যায়। সাইকেল চালিয়ে অজয়ের তীরে গিয়ে বসে থাকত। শ্রাবণের ঘোর বৃষ্টিতেও এ গ্রাম সে গ্রাম একা একা ঘুরে বেরাত চাটুজ্জে বাড়ির ছোট ছেলে। দাদার যাবার সময় দাদা বউদিকে প্রনাম করার সময় বউদির চোখের কোণায় জল দেখতে পেয়েছিল লাবু।

এখন অনেকেই বলে লাবু চালাক হয়ে গেছে, সেই খ্যাপামি অনেক কমে গেছে। লাবু কিন্তু এখনও রাত একটার পর জ্যোৎস্নার চাঁদ বেশি চকচকে দেখে। শুধু মাঝরাতে ঘরে ঢোকার সময় টর্চ জ্বেলে ঘর দ্যাখার উপসর্গ যুক্ত হয়েছে লাবু খ্যাপার খ্যাপামিতে। বাকি সব ঠিকই আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *