লাট্টু আর বলের কথা
একটা দেরাজের ভিতরে অনেকরকম খেলনার সঙ্গে একটা লাটু, আর একটা বল পাশাপাশি রাখা ছিল। বলকে লাটু, বলল, “এতই যখন আমাদের কাছাকাছি রাখা হয়, তখন আমরা বর-কনে হয়ে যাই-না-কেন ?” বলটা মিহি মরক্কো চামড়ার তৈরি। তার ধারণা সে একজন হাল ফ্যাশনের বিবি। তা সে লাটুর কথা শুনবে কেন ? পরদিন খেলনাগুলোর মালিক দেরাজের কাছে এল । আসলে সে একটি ছোটাে ছেলে। লাটুর গায়ে সে লাল, হলুদ রঙ মাখাল আর পেটের মাঝখান দিয়ে একটা পিতলের পেরেক ঠুকে দিল। তার পর যখন লাটুটাকে ঘোরাল, কি চমৎকার দেখতে লাগল ! লাটু, তখন বলকে বলল, “একবার আমার দিকে তাকাও দিকিনি। এখন কিরকম মনে হচ্ছে ? বর-কনে হব নাই-ব কেন, বল ? দিব্যি মানাবে দুজনাকে ! তুমি লাফাতে পার, আমি ঘুরতে পারি। আমাদের যদি বিয়ে হয়, আমাদের মতো মানিকজোড় খুঁজে পাওয়া দায় হবে।”
বল বলল,“তোমার তাই মনে হয় বুঝি? জান, আমার মা-বাবা ছিলেন মরক্কো চামড়ার চটি আর আমার গায়ের মধ্যে কর্ক আছে!”
লাটু বলল, “তা হতে পারে, তবে আমার গায়েও মেহগনি কাঠ আছে ; মোড়লমশাই নিজের হাতে আমাকে গড়েছেন ; তাঁর নিজের র্যাঁদা আছে ; আমাকে গড়তে গিয়ে তিনি সে কি খুশি ।” বল বলল, “ঠিক বলছ তো ?” লাটু, বলল, “মিথ্যা বললে যেন আর না ঘুরি ”
বল বলল, “কথাবার্তা তোমার মন্দ নয়, কিন্তু আমি তে। আর স্বাধীন নই। একটা শ্যামা পাখির সঙ্গে আমার বিয়ের কথা একরকম পাকা হয়ে আছে। যেই আমি আকাশে উঠি, পাখিটাও অমনি বাসা থেকে মুণ্ডু বের করে বলে, “আমাকে বিয়ে করবে ? মনে মনে তাকে কথা দিয়েই ফেলেছি, তার সঙ্গে পাকা কথার কি তফাত গা ? তবে একটা কথা বলে রাখি, তোমাকেও আমি কখনো ভুলব না।”
লাটু, বলল, “তাতে তো আমার ভারি সুবিধা হল!” এর পর এ বিষয়ে আর কোনো কথা হয় নি।
তার পর দিন বলটাকে বের করা হল। লাটু, তাকে পাখির মতো আকাশে উড়ে যেতে দেখল, সে এত উঁচুতে যে চোখ অতদূর যায় না। অবিশ্যি আবার বল ফিরে এল। কিন্তু যতবার নেমে মাটি ছোঁয়, ততবার লাফিয়ে আরো উঁচুতে ওঠে ! এর কারণ, হয় প্রেম, নয় ওর গায়ের ভিতরে সেই কর্ক !
নয় বারের বার বল আর ফিরে এল না। ছেলেটা কত খুঁজল, কিন্তু কোথাও তাকে পেল না। সে গেল তো গেলই ! লাটু, মনে মনে বলল, “আমি বেশ জানি বলটা কোথায় গেছে। নিশ্চয়ই শ্যামা পাখির বাসায়। সেখানে নিশ্চয় বিয়ের বাদ্যি বাজছে। লাটু যতই এসব কথা ভাবে, বলকে ততই সুন্দরী বলে মনে হয়। ওর সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে না বলে যেন ওর ভালোবাসাটাও দ্বিগুণ বেড়ে যায়! ওর চাইতে বলের আরেকজনকে বেশি পছন্দ, তাই-বা সে কেমন করে ভোলে! লাটু, ঘোরে, গুন গুন শব্দ বেরোয়, কিন্তু মন পড়ে থাকে তার আদরের বলটির কাছে। কল্পনার চোখে তাকে দিনে দিনে বেশি ভালোবাসার পাত্রী বলে মনে হয়। এইভাবে কয়েক বছর কাটল। লাটুর ভালোবাসা এতটুকু টস্কাল না।
এখন লাটুর যৌবন গিয়েছে। একদিন কিন্তু তার সারা গায়ে সোনালি রঙ লাগান হল, অমনি আগের চাইতেও বেশি করে রূপ খুলে গেল। এখন সে হয়েছে গিন্টি করা লাটু, যেমনি খাসা ঘোরে, তেমনি গুন গুন শব্দ করে, তার গুণের আর অন্ত নেই। এমন সময় হঠাৎ একদিন বড়ো বেশি উঁচু লাফ দিয়ে ফেলে, সে-ও হল অদৃশ্য ! ওরা কত খুঁজল, মাটির নীচের গুদোমঘরটি পর্যন্ত বাদ দিল না। তবে গেল কোথায় ?
নালার মুখে একটা পিপে বসান ছিল, তাতে যত রাজ্যের ফালতু জিনিস জমা হত, বাঁধাকপির বোটা, আঁস্তাকুড়ের ময়লা, ঝাঁটার ধুলো, এই সব। তারই মধ্যে লাষ্ট্র, গিয়ে পড়ল।
লাটু, বলল, “হায়, হায়, এখানে পড়ে থেকে থেকে আমার এমন খাসা গিল্টি করা রঙ যাবে জ্বলে! আর কি বাজে সব আবর্জনার মধ্যেই-না পড়া গেছে!” এই বলে সে তাকিয়ে দেখে কি বিশ্রীরকম গা ঘেষে পড়ে আছে লম্বা একটা বাঁধাকপির বোঁটা আর কতকটা আপেলের মতো দেখতে, অদ্ভুত একটা গোল জিনিস। ওটা কিন্তু মোটেই আপেল নয় ; ওটা আসলে একটা পুরনো বল, অনেক বছর নালায় পড়ে থেকে থেকে জলে ভিজে একাকার!
বলটা গিন্টি করা লাটুর দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে বলল, “ভাগ্যি ভালো, এতদিন পর কথা বলার একটা সঙ্গী পাওয়া গেল ; জান, আমি মরক্কো চামড়া দিয়ে তৈরি ; একজন অল্পবয়সী মহিলা আমাকে নিজের হাতে সেলাই করেছেন ; আমার শরীরে কর্ক আছে। কিন্তু কেউ আর এখন আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না। একটা শ্যামা পাখির সঙ্গে আমার বিয়ে হয় হয়, এমন সময় নালার মধ্যে পড়ে গেলাম! সেখানে পাঁচ বছর পড়ে রইলাম ; শেষটা জলে ধুয়ে এখানে এসে পৌছেছি। ভিজে সপসপ করছি। একজন অল্পবয়সী মেয়ের পক্ষে এমন অবস্থায় পড়াটা কি সর্বনাশ বল দিকি ”
লাটু, কোনো উত্তর দিল না। তার বহু দিনের হারান সঙ্গিনীর কথা মনে পড়ে গেল। এর কথা শুনে শুনে মনে হতে লাগল—তবে এই নির্বাং সেই !
এমন সময় বাড়ির দাসী এসে পিপেটা উলটে ফেলতে গিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “কি মজা! এই তো সেই গিল্টি করা লাটুটা।”
তখন লাটুকে আবার খেলাঘরে নিয়ে আসা হল। সবাই তাকে নিয়ে আবার খেলতে লাগল আর তারিফ করতে লাগল। কিন্তু বলের কথা কেউ কিছুই বলল না। এমনকি, লাটু, নিজেও আর কোনোদিনও তার সেই পুরনো ভালোবাসার কথা মুখেও আনল না। ততদিনে ভালোবাসাটা নিশ্চয় একবারে কেটে গেছিল। আর তা হবে নাই-বা কেন ? পাঁচবছর বৃষ্টির জল যাবার নালায় শুয়ে থেকে থেকে বলের সেই রূপজৌলুস কোথায় ? তার পর পিপের মধ্যে আঁস্তাকুড়ের ময়লার মাঝখানে যখন তার দেখা মিলল, তখন তাকে চেনাই দায় !