লাটুর ঘরবাড়ি

লাটুর ঘরবাড়ি

লাটু নস্কর মোটেই তেজালো লোক নয়। তাকে মেনিমুখো বললেও বেশি বলা হয় না। চেহারাখানা লম্বা চওড়া বটে, কিন্তু ভিতুর ডিম। তার তিন কুলে কেউ নেই। জমিজমা নেই, বাড়ি—ঘর নেই। বদন ঘোষের জমিতে খেতমজুরি করে পেট চলে তার। আর খালধারে যে খাপড়ার ঘরটায় সে থাকে তাও নাকি কে একজন গিরিবাবুর জমিতে।

বছর চারেক আগে তার বাবা গত হয়। তার আগে বাবার মুখেই শুনেছে, গিরিবাবু নাকি তার বাবাকে বলে গেছে জমিটা দেখেশুনে রাখিস, আমি ফিরে এসে দখল নেব। তা গিরিবাবু এসে যদি কান ধরে লাটুকে তুলে দেয় তাহলে লাটুর চারদিক একদম ফর্সা। গিরিবাবু না এলেও তার ছেলেমেয়েরাও তো এসে দখল নিতে পারে! তাই লাটু বড়ো ভয়ে ভয়ে থাকে।

আর ঘরখানারই বা কী বাহার। খাপড়ার ছাউনি আর হোগলার বেড়া। বর্ষাকালে সাপখোপ, বিছে, ব্যাঙ, কেঁচোর অবিরল যাতায়াত। তাদের সঙ্গেই মিলেমিশে থাকা। তেমন বাদলা হলে খালের জল এক লম্ফে ঘরে উঠে আসে। আর খাপড়ার ফাঁক দিয়ে জল পড়া তো আছেই। একটা বাঁশের মাচায় বস্তা পেতে তার বিছানা। খাওয়ার কোনো ঠিক—ঠিকানা নেই। রাতে মেটে হাঁড়িতে ভাত রেঁধে নুন লঙ্কা দিয়ে ফ্যানা ভাত খায়, খানিকটা ভিজিয়ে রেখে পরদিন পান্তা খেয়ে কাজে যায়। অসুরের মতো খাটুনি।

তাও তার চেহারাখানা বেশ তাগড়াই। তার কারণ, যে মাঠপুকুরের জঙ্গলে আর ঝোপঝাড়ে ঘুরে যখন যেমন ফলপাকড় পায় তা গোগ্রাসে খেয়ে নেয়। কখনো ফলসা, কখনো ডাঁশা পেয়ারা, করমচা, বুনো কুল, ডেউয়া, আঁশফল, যা পায়।

এক—একদিন আস্ত মৌচাক পেয়ে গেলে তাকে আর পায় কে? ভেজা খড়ে আগুন দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করে মৌমাছিদের তাড়িয়ে আস্ত চাকটা নামিয়ে আনে।

এক—একদিন মেটে আলু বা মানকচু পেয়ে গেলে সেটা কোটালপুরের হাটে নিয়ে বেচে দেয়। ইটাগঞ্জের গোপাল কবিরাজমশাইয়ের জন্য মাঝে মাঝে ঘৃতকুমারী, নিমগুলঞ্চ, বিশল্যকরণী, অর্জুনছাল এনে দেয়। গাছপালা সে খুব ভালো চেনে। কবরেজমশাই দু—চার টাকা দেন মাত্র। তবে বড্ড স্নেহ করেন।

তা এইভাবেই টিকে আছে লাটু। খুব খারাপ আছে, এমন কথা তার মনে হয় না। শুধু এখন একটাই ভয়, গিরিবাবু কবে এসে ঘর থেকে তাকে তাড়ান। তবে এটাও সত্যি কথা যে, এই ঘর আর জমিটুকু থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেলেও তার অবস্থার খুব একটা হেরফের হওয়ার নয়। তখন হয়তো হাটখোলার চালার নীচে বা কারও গোয়ালঘরে, নিদেন গাছতলায় গিয়ে জুটতে হবে। তার মতো মনিষ্যির আর এর চেয়ে বেশি কিই বা হবে!

কানু মণ্ডলের স্যাঙাৎ চিকুর ম্যালেরিয়া। তাই কানু এসে লাটুকে ধরল বড়োখালে তার সঙ্গে নৌকোয় মাছ ধরতে যেতে। লাটুর আপত্তি নেই। সে সব কাজেই রাজি। সারারাত বৃষ্টি, নৌকো খানিক বেয়ে, খানিক ঠেলে খাল তোলপাড় করে কানু মাছ ধরল মন্দ নয়। দুটো মাঝারি বোয়াল, কিছু পাঙাস, মৃগেলের বাচ্চচা আর চুনো মাছ মিলে চার—পাঁচ কিলো হবে। কানু হিসেবি লোক। লাটুকে একখানা বোয়াল আর কিছু চুনোপুঁটি দিয়ে বিদেয় করল। অবিশ্যি তাতে লাটুর তেমন আপত্তি হল না, তার কিছু হলেই হয়।

ভোরবেলা ঘাটে নেমেই সোজা আশু পালের বাড়ি গিয়ে পাল গিন্নিকে মাছ গছাল সে। কুড়িটা টাকা পেল। তার মনে হল, এই তো যথেষ্ট।

বাড়ি এসে ঘরের ঝাঁপটা খুলতে যাচ্ছিল, পিছন থেকে কে যেন সাড়া দিল, বলি গয়েশ নস্কর বাড়ি আছে?

লাটু ফিরে দেখে ছাতা হাতে এক আধবুড়ো বাবুমতো লোক দাঁড়িয়ে আছে। এ বাড়িতে এমন মানুষের আসার কথাই নয়।

সে বলল, আজ্ঞে গয়েশ নস্কর আমার বাবা। তিনি তো গত হয়েছেন, তা তিন—চার বছর হল বোধহয়।

অ! তা এখানে তুমিই থাকো বুঝি?

যে আজ্ঞে, আমি হলুম গে লাটু নস্কর।

লোকটার পরনে একটা কালো পাতলুন, গায়ে হাফহাতা সাদা শার্ট। বলল, হ্যাঁ, বাবা বলেছিল বটে এ জমির দেখভাল করার জন্য যাকে বহাল করে গিয়েছিল সেই গয়েশ নস্করের একটা কচি ছেলেও আছে। আমি হলুম গিরি নায়েকের ছেলে যদু নায়েক। বুঝলে কিছু?

বুকটা একটু ধক করে উঠল লাটুর। না বুঝবার কথাও তো নয়। বৃত্তান্ত তো জানাই। গিরিবাবুর জমির দখল নিতে তার ছেলে এসে গেছে। লাটু ঘাড় কাত করে বলল, যে আজ্ঞে। বুঝেছি। তা আমাকে কবে ভিটে ছাড়তে হবে?

লোকটা একটু চিন্তিত ভাবে তার মুখের দিকে চেয়ে ছিল। বলল, এখানে কতটা জমি আছে বলো তো?

লাটু মাথা চুলকে বলে, আজ্ঞে কাঠার হিসেব তো ঠিক জানা নেই। তবে উত্তরে ওই যে কাঁঠালগাছটা দেখছেন এখান থেকে দক্ষিণের খালধার পর্যন্ত, আর পুবের ওই বাঁশঝাড়টা থেকে পশ্চিমের কাছে মিয়ার বাড়ির কাঁটাতারের বেড়া অবধি।

তাহলে তো বেশ অনেকটাই জমি, কী বলো হে!

তা মন্দ নয়। আমার আন্দাজ বিঘে দুই হবে।

জমিটা চারদিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখল যদু নায়েক। তারপর তার দিকে চেয়ে বলল, তা জমিটি খামোখা পড়ে আছে কেন? একটু চাষ—বাস করতে পারলে না?

আজ্ঞে, আমি অন্যের জমিতে খাটতে যাই তো, তাই আর ফাঁক পাই না। তারপর ধরুন, আমার হালগোরু নেই, চাষের পয়সা নেই। গিরিবাবু এলেই জমি ছেড়ে দিতে হবে বলে বাবা বুঝিয়ে গেছে। তাই আর হাঙ্গামা করিনি। তা আমাকে কী আজই উঠে যেতে হবে?

কেন, তুমি কি আরও সময় চাও?

লাটু মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে না, সময় নিয়ে হবেই বা কী! আমার তো গেরস্থালি নেই, জিনিসপত্রও নেই। আজ বললে আজই বেরিয়ে পড়ব।

যদু নায়েক গম্ভীর হয়ে বলে, হুঁ!

তা বাবু, আপনি কি এখন গাঁয়েই থাকবেন?

ভাবছি। হেতালডুবিতে আমাদের খানিকটা চাষের জমিও আছে। বহুকাল আদায় উসুল হয় না।

যে আজ্ঞে! বারো বিঘে জমি। পরশুরাম হেলা চাষ করে। আপনার বাবার আমলের বর্গা, পরশুরাম খুব টেটিয়া লোক।

হ্যাঁ। তাই ভাবছি গাঁয়ে আমাদের এত কিছু থাকতে গঞ্জ শহরে পচে মরি কেন? ও জায়গা আমাদের সয় না।

যে আজ্ঞে। তা আমার তো বাঁধাছাঁদার কিছুই নেই। সামান্যই জিনিস। বেরিয়ে গেলেই হয়।

তুমি তো আচ্ছা লোক হে বাপু! একজন উটকো লোক এসে বলল, আমি গিরিবাবুর ছেলে, এ জমি আমার, আর অমনি তুমি ভিটে ছেড়ে চলে যেতে পা বাড়িয়েছ!

লাটু খুব ভাবনায় পড়ে গেল। তাই তো! সে না চেনে গিরিবাবুকে, না চেনে তার ছেলেকে, এ জমির দলিল—দস্তাবেজ কোথায় তাও সে জানে না। শুধু তার বাবা বলেছিল, এ হল গিরিবাবুর জমি, একদিন ছেড়ে দিতে হবে।

মাথা—টাথা চুলকে লাটু বলে, আজ্ঞে, সে কথা ঠিক, তবে বাবু মানুষেরা তো আর ভুল কথা বলেন না।

তুমি তো দেখছি মানুষ বড়ো জব্বর চিনেছ! বাবুদের বুদ্ধি বেশি বলে তারা বদমাইশিও খুব মাথা খাটিয়ে করে।

বাবু, তাহলে কি আপনি গিরিবাবুর ব্যাটা নন?

হলেই বা। প্রমাণ ছাড়া আমাকে জমি ছেড়ে দিতে যাবে কেন?

লাটু শুকনো মুখে বলে, আজ্ঞে ধরা—ছাড়ার কথাই তো ওঠে না। জমি যে মোটেই আমার নয় মশাই!

দখলি স্বত্ব বলে একটা কথা আছে, জানো! জমি যখন যার দখলে থাকে, তখন তাকে পট করে উচ্ছেদ করা যায় না।

লাটু বলে, আমি কী আইনের মারপ্যাঁচ জানি বাবু? হুড়ো দিলেই আমরা ভয় খেয়ে যাই। নিজের জমিই রাখতে পারে না কতজন! আর এ তো পরের জমি।

পেটে বিদ্যে আর মগজে বুদ্ধি না থাকলে ওরকমই হয়।

লাটু হেসে মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে ও বড়ো জব্বর কথা! আমি কী আর মনিষ্যির মধ্যে পড়ি!

তা বাপু, তোমার চলে কীসে? ঘরদোরের যা লক্ষ্মীছাড়া দশা দেখছি তাতে তো মনে হয় তোমার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।

লাটু একটা শ্বাস ছেড়ে বলে, সে তো ঠিক কথা বাবু। তবে কিনা এভাবেই তো এতটা বয়স অবধি কেটে গেল।

বলি, তোমার বয়স কত?

বছর কুড়ি—বাইশ হবে বোধহয়। দু—চার বছর এদিক—ওদিক হতে পারে।

তা বেশ কথা। এখন এ ঘর যদি ছেড়ে দাও তাহলে যাবে কোথা? বলি যাওয়ার কোনো জায়গা আছে?

লাটু একগাল হেসে বলে, তা দু—একটা খোঁজ যে নেই তা নয়। একজনের গোয়ালে একটু থাকার বন্দোবস্ত করে নেওয়া যাবে। নইলে শেষ অবধি গাছতলা তো আছেই।

ভারি অবাক চোখে তার দিকে চেয়ে যদু নায়েক বলে, তুমি একজন তাজ্জব লোক হে। কিছুতেই কোনো হেলদোল নেই দেখছি।

লাটু একটা শ্বাস ফেলে বলে, আজ্ঞে, মনটা খারাপ লাগছে ঠিকই। বাবার আমল থেকেই এই ঘরে আছি কিনা। এখানেই জন্ম। কিন্তু তা বলে তো আর অধর্ম করতে পারি না।

যদু নায়েক গম্ভীর হয়ে বলে, হুম, তোমার ঘরে একটু উঁকি মেরে দেখলাম, তুমি সত্যিকারের দিগম্বর মানুষ। বিষয়বুদ্ধিতে লবডঙ্কা।

লাটু হতাশ হয়ে বলে, আজ্ঞে বিষয়ই তো নেই, বুদ্ধি থাকবে কী করে?

যদু নায়েক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, এবার সত্যি কথাটা বলেই ফেলি বাপু। মন দিয়ে শোনো।

লাটু একটু তটস্থ হয়ে বলে, যে আজ্ঞে।

গিরিধারী নায়েকের কোনো ছেলেপুলে ছিল না। তার আসল ওয়ারিশানও কেউ নেই। বুঝলে! আমার নাম যদু নায়েক হলেও আমি কিন্তু গিরি নায়েকের ছেলেও নই, ভাতিজাও নই। সোজা কথা হল, গিরি নায়েকের বিষয়—সম্পত্তি সবই এখন বেওয়ারিশ। ইচ্ছে করলে সরকার বাহাদুর এসব দখল করলেও করতে পারে। কিন্তু একটা বিপদ হল, অনেকেই গিরি নায়েকের ওয়ারিশান সেজে হাজির হতে পারে। তেমন তোড়জোড় হচ্ছে বলেই শুনেছি আর আমি তাই ব্যাপারটা সরেজমিনে দেখে যেতে এসেছি।

চোখ গোল গোল করে লাটু যদু নায়েকের কথাগুলো শুনছিল। সে বুদ্ধিতে খাটো হলেও একথাগুলো বেশ বুঝতে পারল। খুব চিন্তিত মুখে বলল, তাহলে এখন কী হবে বাবু?

সেটাই বুঝতে আসা। কিন্তু তুমি তো দেখছি বড্ড বোকাসোকা লোক। যে—কেউ এসে তোমাকে তাড়িয়ে জমি দখল করতে পারে। আর একবার দখল নিয়ে গেড়ে বসলে সরানো ভারি কঠিন।

কাঁচুমাচু মুখে লাটু বলে, আজ্ঞে, তা তো বটেই।

তুমি উচ্ছেদ হয়ে যাও, এটাও আমার ইচ্ছে নয়।

কিন্তু কেউ এসে হুড়ো দিলে?

তুমি কি খুব ভিতু লোক?

যে আজ্ঞে।

চেহারাটা তো বেশ তাগড়া, তবে অমন মেনিমুখো কেন?

আজ্ঞে আমি এমনধারাই। নিজেকে আমার নিজেরও তেমন পছন্দ হয় না।

যদু নায়েক বলে, বলি ঘরে লাঠিসোটা কিছু আছে?

লাটু একগাল হেসে বলে, তা আর নেই! সাপখোপ, শেয়াল বাগডাশার সঙ্গে ঘর করতে হয় তো! তাই একখানা পাকা বাঁশের লাঠি আছে বটে। বাবা বলেছিল, ঠাকুরদার জিনিস। তিনি মস্ত লেঠেল ছিলেন। আর আগাছা কাটবার একখানা হেঁসো আছে। একখানা দা—ও আছে।

বাঃ! তাহলে আর চিন্তা কী? কেউ যদি এসে জমি বাড়ি দখলের কথা বলে তাহলে তুমি বাপু নেড়ি কুকুরের মতো লেজ দেখিয়ো না। লাঠি হাতে নিয়ে একখানা হাঁকাড়ে ছেড়ে বাইরে এসে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে। তাহলেই দেখবে কাম ফর্সা।

লাটু মিটমিট করে চেয়ে বলল, সে কী আমি পারব? আস্পদ্দী হয়ে যাবে না?

তাহলে বাপু, তোমার পাততাড়ি গোটানোই ভালো। তোমার দ্বারা এ কাজ হওয়ার নয়। ভগবান তোমাকে একখানা দিব্যি লম্বা চওড়া শরীর দিয়েছেন। এ জিনিস ক—জনার কাছে বলো তো! তা ভগবান যখন দিয়েছেনই তখন তার একটা দাম তো দিতে হয় বাপু! এরকম একখানা ডাকাতে চেহারা নিয়ে ভেড়ার মতো হাবভাব করলে যে স্বয়ং ভগবানও খুশি হবেন না! যা ভালো বোঝো বাপু তাই করো। আমার যা বলার বলেছি, এখন তোমার কপাল।

যদু নায়েক চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ বসে বসে ভাবল লাটু। যদু নায়েকের কথাগুলো তার যেন ন্যায্য বলেই মনে হচ্ছে। ভগবান যখন চেহারাখানা দিয়েছেন, তখন সেটা কাজে না লাগানোর মানে হয় না। তবে তার বুকের জোর কম। সাহস মোটেই নেই।

দিন তিন—চার পরের কথা। লাটু কাজে বেরোবে বলে পান্তা খাচ্ছিল। এমন সময় বাইরে জনাকয়েক লোকের আগমন টের পেল সে। কারা যেন বাইরে নিজেদের মধ্যে কথা কইছে। লাটু শেষ দুটো গরাস গোগ্রাসে গিলে জল খেয়ে উঠে পড়ল।

বাইরে বেরিয়ে দেখল, জনা চারেক মানুষ। ভদ্রলোকের মতোই চেহারা। সবচেয়ে বয়স্ক গুঁফো লোকটা তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, তুই কে রে? এ জমিতে বেআইনি ঘর তুলে রয়েছিস যে বড়ো?

লাটু অন্যসময়ে হলে ভয় খেয়ে গুটিয়ে যেত। মিউ মিউ করত। কিন্তু যদু নায়েক যেমন শিখিয়ে দিয়েছে, সে তেমনটাই করল। হঠাৎ বুক টান করে দাঁড়িয়ে বলল, তাতে আপনার কী দরকার? আপনি কে?

এ জমি আমাদের। এক ঘণ্টার মধ্যে জমি ছেড়ে পালা। নইলে পুলিশ এসে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যাবে।

লাটু ঘরে ঢুকে পাকা বাঁশের লম্বা লাঠিটা হাতে করে বেরিয়ে এসে বাঘা গলায় বলল, এটা দেখেছ? সব ক—টাকে এ জমিতে পুঁতে ফেলব! বেরোও! বেরোও…

মাত্র দু—পা এগিয়ে গিয়েছিল লাটু।

আর তাইতেই ভয় খেয়ে লোকগুলো এমন দুদ্দাড় পালাল যে লাটু হাসি চাপতে পারল না। এই কায়দায় যে ভালো কাজ হয় তা বুঝতে তার একটুও দেরি হল না।

আরও দিন দুয়েক পর লাটু যখন খেতে কাজ করছিল, তখন কালী স্যাঁকরার ছেলে বিশু দৌড়ে এসে তাকে খবর দিল, ও লাটু। কারা যেন তোর ঘর ভাঙছে! শিগগির যা।

লাটুর আজকাল সঙ্গেই লাঠিগাছ থাকে। গাছের গায়ে ঠেসান দিয়ে দাঁড় করানো ছিল। লাঠিগাছ নিয়ে সে কয়েক লম্ফে তার ঠেক—এ পৌঁছে দেখে চার—পাঁচজন মুনিশ লোক তার ঘরের অর্ধেক ভেঙে ফেলেছে। একজন মুরুব্বি গোছের লোক কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো।

লাটুর দোষ নেই। ঘরখানা গেলে তার কিছুই থাকে না। সুতরাং আগুপিছু চিন্তা তার মাথায় এল না। সে সোজা লাঠি চালিয়ে চারজন মুনিশকে এমন ঘায়েল করল যে তারা ‘বাপ রে, মা রে’ বলে দৌড়। মুরুব্বি লোকটা ‘অ্যাই, অ্যাই’ বলে চোখ পাকিয়ে তেড়ে আসতেই লাটু লাঠিটা আপসে বলল, জমি দখল করতে এসেছ? এই জমিতেই তোমাকে শুইয়ে দেব, বুঝলে!

কেন, দেশে থানা—পুলিশ নেই? গুন্ডামি করে পার পাবে ভেবেছ?

গুন্ডামিটা কে করল বলো তো বাবু? আমি না তুমি? কোন আইনে তুমি আমার ঘর ভেঙেছ? তোমার বাপের জমি?

আমার দলিল আছে।

আমারও আছে। এখন বিদেয় হও। আর কখনো যেন আমার জমির ত্রিসীমানায় না দেখি!

লোকটা গায়েব হয়ে গেল।

দুদিন পর যদু নায়েক সকালবেলায় এসে বলল, সাবাস! এটাই তো চেয়েছিলুম। এখন গতরে খেটে বাঁশ বাখারি ডালপালা দিয়ে জমিটি ঘিরে ফেলো। সীমানা থাকা দরকার। আর সেই সঙ্গে একজন পাহারাদারও যে চাই। সবচেয়ে ভালো পাহারাদার হল বউ। একটা বউ নিয়ে এসো হে।

লাটু লজ্জায় অধোবদন।

যদু নায়েক বলল, গিরি নায়েকের কাছে আমার কিছু টাকা দেনা ছিল। হাজার দশেক। সুদ সমেত পনেরো হাজার হয়েছে। শোধ না দিতে পারায় মনস্তাপে ভুগছি। টাকাটা তুমি রাখো। এও একরকম শোধ দেওয়াই হল। কী বলো?

লাটু হঠাৎ মুখ তুলে বলে, বাবু, আপনি আসলে ছদ্মবেশে ভগবান নন তো?

তা কে জানে বাপু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *