লাঞ্চ বক্স – ৬

ছয়

কাল জিনিসটা যে নিরবধি এই রেলগাড়িতে বসে যেভাবে উপলব্ধি করছি, আগে কখনো সেরকম পারি নি। কিছুই করবার নেই। শতো চিৎকার করলেও ট্রেন নড়বে না। তবু অনেকেই চিৎকার করছেন। তাঁদের আশা তাঁদের গলার আওয়াজই রেলগাড়ির চাকায় গতি এনে দেবে। আমার সেরকম কোনো বিশ্বাস নেই। তাই চুপ করে ধৈর্যের পর্বতের মতো বসে আছি। কিন্তু মনের ভেতরটা ডাক ছেড়ে কাঁদছে। গাড়ি ঢাকা পৌঁছে যাবে সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায়। স্বামী স্ত্রীর এবং স্ত্রী স্বামীর প্রিয় মুখটি দেখতে পাবেন—এবং সেই মুখটি যদি প্রিয় না হয়, অন্তত টেলিভিশনটি খুলে পা ছড়িয়ে বা গুটিয়ে যে যে ভঙ্গিতে আরাম পান, বসতে পারবেন, এ সতৃষ্ণ ইচ্ছেটা হতে পারছে না বলে এখন বুঝতে পারছেন, বাড়িতে কী আরামেই থাকেন। ট্রেনের কেটারিং-এ খাবার ব্যবস্থা ছিল শুধু দুপুরের, এখন হতে চললো, রাত দুপুর। খাবার শেষ হয়ে গেছে সেই কবে, কিন্তু দুপুরে একবার খেলেই মানুষের খিদে সারাজীবনের জন্য, এমনকি সারাদিনের জন্যও শেষ হয়ে যায় না। সকলের খিদে পেয়েছে। এবং বসে বসে কিছুই করবার নেই বলে খিদেটা বেশ মালুম দিয়ে যাচ্ছে। বই পড়তে পারেন। এখন ট্রেনে কোনো ঝাঁকুনি নেই। সহজেই কাজটি করা যায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কারোই বইয়ে মন নেই। বরং ট্রেন যখন চলছিল তখন অনেকে সে চেষ্টা করেছেন। এখন বোঝা যাচ্ছে পেট খালি থাকলে কিছুই ভালো লাগে না। অথবা এমনও হতে পারে যে মানুষের সমস্ত ক্রিয়াকর্মই তার প্রেরণা পায় চলিষ্ণু সাংসারিক অবস্থা থেকে। এখানে ট্রেন এমন চুপ ও স্থির হয়ে বসে আছে যে মানুষগুলোর পর্যন্ত মনে হচ্ছে ট্রেনের সঙ্গে তারাও সংসারত্যাগী হয়েছে। সংসার ত্যাগ করে কেউ নাটক-নভেল পড়ে না। এমনকি চিত্রতারকাদের ছবি পর্যন্ত দেখে না। বৌ-এর মুখটাও বিস্বাদ মনে হয়। এই ট্রেনে একাধিক দম্পতি আছে। তাঁরা মুখ মলিন করে পরস্পরের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রেখেছেন। স্বামী ভাবছেন এই অবস্থার জন্য যেন স্ত্রীই দায়ী। আর স্ত্রী ভাবছেন স্বামী দায়ী। নতুন কিছু নয়। সংসারধর্ম পালন করতে গিয়েও পরস্পরের প্রতি তাঁদের মনোভাব এই রকমই হয়। মুখ ফুটিয়ে কথাটি বলেন না; কিন্তু মুখ ফোটাতে হয় না। তবু সেই মুখটাই কথাটি বলে দেয়।

খাবার যখন নেই, রাগ করে চিৎকার করে, ডাঁট দেখিয়ে ঝাঁঝালো গলায় কথা বলে, সেই খাবার পাওয়া যাবে না। মাঝখান থেকে নিজের অবস্থাটাই আরো অসহনীয় হয়ে যাবে।

জাফর সাহেব কোনো রূপচর্চা করে যাত্রা শুরু করেন নি। তবু এতোক্ষণ তাঁকে বেশ তাজাই দেখাচ্ছিল। ক্লান্তিকে তিনি বুঝতে দিচ্ছেন না, কিন্তু ক্লান্তি নিজেকেই বুঝিয়ে দিচ্ছে। দেখলাম তাঁর চোখের কোণে কালের পায়ের ছাপ বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এটা আগে দেখি নি। হঠাৎ তাঁর জন্য একটু মায়া হলো। আমি আমার নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তিনি এখন যে কথাটি বললেন, তা শুনে মনে হলো, আমার জন্যও তাঁর মায়া হচ্ছে এবং তাঁর মায়াটাও আমার মুখ দেখেই।

জাফর সাহেব বললেন, ‘স্টেশনে গাড়ি আসবে তো?’

‘এতো রাত হয়ে গেছে। তার ওপর কার্ফু। বলতে পারছি না।’

‘চিন্তা করবেন না। আমি পৌঁছে দেবো।’

এরকম একটি কথা জাফর সাহেব আগেও একবার বলেছেন।

কেয়ার মুখটা আমি এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি না। তার মুখটা এমনভাবে ঢাকা থাকবে যা সামনে গিয়ে দাঁড়ালেও দেখতে পাবো না। তবু এখানে বসেই তার জন্য আমার মায়া হচ্ছে।

সে কি করছে দেখে আসার জন্য আমি এবার উঠলাম। সেই কম্পার্টমেন্টে পৌঁছে প্রথমে নজরে পড়লো সেই মহিলা যাঁকে আমি ভুল করে পারুল নাম দিয়েছিলাম। তিনি তাঁর সেই বান্ধবীকে খুব মেজাজের মাথায় বাংলাদেশের রেলওয়ে সিস্টেম সম্পর্কে কিছু বলছিলেন, তার খানিকটা শুনেই আমার মনে হলো তনি বাংলাদেশের মানুষকে জংলি মনে করেন। শুনে আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। তাঁর জিভের আড় শুনে আগেই আমার মনে হয়েছিল, ভদ্রমহিলার জন্ম এ দেশে হলেও তিনি দীর্ঘকাল কোনো ইউরোপীয় দেশে ইমিগ্রেন্ট বা নাগরিক হয়ে আছেন। তাঁর হাবভাব দেখে মনে হয়, বাংলাদেশকে তিনি বসবাসের যোগ্যই মনে করেন না। একবার ভাবলাম, সোজাসুজি তাঁর মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু দাঁত ভাঙা কথা শুনিয়ে দিয়ে আসি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না করে মনে মনে গজরাতে লাগলাম। শোনো লেডি, এ দেশটা আমাদের। কোনো কিছুকে গালমন্দ করতে হলে আমরাই করবো। কোথাও কিছু উন্নতির প্রয়োজন হলে সে কথা আমরাই বলবো, উন্নতির চেষ্টাও আমরাই করবো। তুমি বাইরের লোক হয়ে ওভাবে ডাঁটের সঙ্গে কথা বলো না। যেখানে গিয়ে দেশত্যাগী হয়ে ইমিগ্রেন্ট হয়েছো, সেখানে যে তোমাদের কী চোখে দেখা হয়, আমাদের তা ভালো করেই জানা আছে। অবশ্য সবাই আপনার মতো নয়। লাখ লাখ ইমিগ্রেন্ট বাংলাদেশ থেকে নানা কারণে চলে গেছে। এখনও বাংলাদেশের জন্য তাদের প্রাণ কাঁদে।

আসলে ঐ মেসসাহেবটি আমাকে সেই লাঞ্চ বক্সটি পাঠান নি শোনার পর থেকেই তাঁর ওপর আমার রাগ। একজন অপরিচিতা মহিলা এক বেগানা পুরুষকে কিছু পাঠাবেন, সেটা মনে করাই আমার অন্যায় হয়েছিল। রাগ সেজন্য নয়। কিন্তু কথাটা তিনি একটু ভদ্রভাবে বললে পারতেন। ওঁর মতো এক রূঢ় ব্যক্তি যে কী করে অমন চমৎকার গান করতে পারেন, সে কথা ভেবেই এখন আমার খারাপ লাগছে। অবশ্য এমন আরো হতে দেখেছি। অতি বদ লোক কিন্তু খুব মহৎ মহৎ কবিতা লিখে। যাই হোক, আমি ইংরেজকে লোক ভালো হলে পছন্দ করি। বাঙালিকে লোক ভালো না হলেও ভালোবাসি। কিন্তু বাংরেজকে দু’চোখে দেখতে পারি না। তাই সেই মেমসাহেব আমার চোখে বিষ হয়ে গেলেন। কেয়া পাশেই বসে আছে। সঙ্গের ছেলেটিকে দেখছি না। কোথাও খেতে গেছে। কিন্তু কেয়া বোরখার ফুটো দিয়ে আমাকে দেখেও দেখছে না। সেটা যে আমাকে কোনো প্রশ্রয় না দেয়ার দৃঢ় সঙ্কল্প তাই বুঝে নিয়ে ঠিক করলাম আমিও আর গায়ে পড়ে মিশবো না। যদিও ছেলেটি পাশে বসে নেই, তাই গায় পড়ে মিশবার এটাই ছিল বড়ো সুযোগ। দু’দিক দিয়েই ধাক্কা খেয়ে আমি নিজের আসনে ফিরে এসে গালে হাত দিয়ে চুপটি করে বসে থাকলাম।

জাফর সাহেব বললেন, ‘আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, মেজাজ চওথা আসমানে। কি হলো?’

জাফর সাহেব যে এরকম লঘুভাবে কথা বলবেন, ভাবতেই পারি নি। তবে একটু মগজ খাটিয়ে কারণটা বুঝতে পারলাম।

আমার নিকট বন্ধুরা এতো দূরে থাকেন যে দশ মাস একবার দেখা হয় কি হয় না। আর সেই একবার দশ মিনিটও কথা হয় না। এদিকে জাফর সাহেবের মুখোমুখি বসে আছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নিকট কেন—বলতে গেলে তিনি আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুই হয়ে গেছেন। সুতরাং একটু লঘু সুরে কথা বলতেই তো পারেন। সেটা কোনো বিস্ময়ের কারণ নয়। আশ্চর্য হলাম এই দেখে তাঁর ব্যক্তিত্বেও একটি তরল দিক আছে। আমি তাঁর কথার কোনো জবাব দিলাম না। অন্তরঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে এমন ব্যবহারের অধিকার আছে।

কাজ নেই, চলন নেই, স্থিতি নেই, এমনকি মাথাটা, যেখানে আর কিচ্ছু না থাক, সব সময় অন্তত কিছু চিন্তা থাকে, সেটা পর্যন্ত ফাঁকা মনে হচ্ছে। সেই মাথায় অবশ্য মাঝে মাঝে কিছু ভাবনা আসছে। একজন বিখ্যাত লেখক আর একজন বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ভাবনা হচ্ছে ভাষার অভাব। আমি ঠিক করলাম, ভাষা দিয়ে ভাবনাকে দূর করবো। কেয়া পেয়েছে কি? বলে গেল, ‘আপনি যে চিরকালই পার্ফেক্ট জেন্টলম্যান, সেটাই আপনার বিরুদ্ধে আমার চিরকালের নালিশ।’ অথচ এখন যখন সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, আমাকে চিনতেই পারলো না। খুব সহজেই পাশের জায়গাটিতে বসতে বলতে পারতো। ট্রেনে চেনা মানুষ পাশে বসে গল্প করলেই তারা প্রণয়ী-প্রণয়িনী হয়ে যায় না। তাছাড়া কেয়া সত্যিই কোনো অসূর্যম্পশ্যা নয়। সে বোরখা পরে থাকে পর্দা করবার জন্য নয়। এক পাশের গাল অ্যাসিডে পুড়ে ক্ষতের দাগ রেখে গেছে, সেটাই গোপন করবার জন্য। কেয়ার ওপর আমার রাগ হয়েছে—সে আমাকে উপেক্ষা করেছে বলে; কিন্তু সেই সঙ্গে এই মুহূর্তে দুঃখও হচ্ছে, অমন এক সুন্দরী মহিলার মুখে অমন একট অনুপমেয় কলঙ্ক রেখে গেছে এক দুর্বৃত্ত—সেই কথা ভেবে। কেয়ার আচরণের একটা ব্যাখ্যা দরকার। আমি আবার উঠলাম।

কেয়া তেমনি চুপ করে বসে আছে। পাশের জায়গাটি এখনো শূন্য। আমি সেখানে গিয়ে বসলাম। দূরত্ব রচনা করবার জন্য কেয়া জানালার আরো কাছে ঘেঁষে সরে বসলো। আরো একটু দূরত্ব রচনা করবার জন্য আমি অন্য পাশে আরো সরলাম। নিজেই উঠে এসেছি বলে নিজের অহঙ্কারকে ভূমিশয্যায় লুটিয়ে দিই নি।

‘এর আগে একবার এসে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখেছিলেন নিশ্চয়। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন কেন?’

কেয়ার মুখটা ছিল জানালার বাইরের দিকে ফেরানো। সে আমার কথা শুনে আমার দিকে মুখ ফেরালো। মাথায় বোরখা ছিল। বোরখাটা তুলে ফেললো। আর অমনি আমার হৃৎপিণ্ডটা লাফ দিয়ে গলার কাছে উঠে এলো। এতো কেয়া নয়। কোনো গণ্ডেই কোনো দাগ নেই, যদি না একটা ছোট্ট তিলকে সেরকম কিছু বলা যায়। মুখটা যেন রেনেসাঁ যুগের কোনো স্থপতির হাতে গড়া। চোখে একবার মাত্র একটা কোনো ভাব কেঁপে উঠেই আবার স্থির হয়ে গেল। এতো ক্ষণস্থায়ী চোখের সেই কম্পন, যে তার অর্থ উদ্ধার করা গেল না। মুখটি শুধু অনুপম নয়, অবিস্মরণীয়। এই জগতে যে এতো রূপ কোনো মহিলার শরীর ধারণ করতে পারে এই মহিলাকে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। আপনারা ভাবছেন বাড়াবাড়ি করছি? বাড়াবাড়ি করবো কি! এর প্রতি সুবিচার করতে পারবে, আমার কলমে সেরকম জোরই নেই। কারো কলমেই সেরকম সৌন্দর্য আছে বলে জানি না। নাক-নকশা গ্রীসীয় ধ্রুপদী। কিন্তু তিনি বাঙালি। তাঁর সারা শরীর প্রকৃতির পূর্ণ বিকাশে, লতায়-পাতায়, শাখায়-প্রশাখায় মঞ্জুরিত, পুষ্পিত সুসজ্জিত ফুল্ল হয়ে উঠছে। ফুল্ল? তা বোধহয় নয়। মনে হলো, কেউ কোনোদিন এই শরীরের ঘ্রাণ নিতে পারে নি। বয়স চল্লিশের ঊর্ধ্বে হবে। কিন্তু তাঁর শারীরিক স্থাপত্য এখনো এমন এক কাঠিন্য রক্ষা করে আছে যে বয়স তিরিশের বেশি মনে হলো না। আর একটি কথা মনে হলো যার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। বিশেষ কোনো কারণে মহিলা বিয়ে করেন নি

‘আমি কেয়া নই। আমার নাম নাদেরা!’

মুখে আবার বোরখা তুলে তিনি জানালার বাইরে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। একটি ছোট্ট শ্বাস পড়লো কি?

‘মাফ করবেন’। এই বলে আমি উঠে পড়লাম।

‘নাদেরা’ নামটি যখন তিনি উচ্চারণ করলেন তখন আমার মনে হলো, সমুদ্রের অতল গভীর থেকে একটা বুদ্বুদ উঠে এলো। তাঁর গলাতেই সেরকম কিছু ছিল বলেই শুধু নয়। আমার নিজের স্মৃতির অতলে নামটি কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল, এখন আবার একটু নড়ে উঠলো। মনে হলো এই নামটি কোথাও কখনো কোনো উপলক্ষে শুনেছি।

এই মহিলা সত্যিই যদি বিয়ে না করে থাকেন, করেন নি কেন? রাজা-বাদশাও তো তাঁর পদপ্রান্তে লুটিয়ে পড়তেন। কারণ, আমি কি করে অনুমান করবো? যে যার নিজের কারণ, নিজের দুঃখ, একা নিজেই বহন করতে পছন্দ করে।

আমি আবার আমার নিজের জায়গায় ফিরে এসেছি। বারবার আমার নিয়তি আমাকে নিজের জায়গায় ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমার মনের মধ্যে একটি নাগরদোলা ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি কয়েকটি হিসাব মিলাতে পারছি না। এমন সময় রেল কর্মচারীদের মধ্যে একটা কর্মচঞ্চলতা দেখা গেল। তাঁরা ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছেন। রেলগাড়ির করিডোর ছোটো বলে ছোটাছুটি করতে গিয়ে একে অপরকে ধাক্কা দিচ্ছেন। তারই মধ্যে ঝটপট করে রেলগাড়ির সব জানালা-দরজা বন্ধ করা হচ্ছে। শোনা গেল, মাঠের মাঝখানে যেখানে ট্রেনটি আটকা পড়েছে সে জায়গাটা ভালো নয়- গাড়িতে ডাকাত পড়তে পারে। ডাকাত পড়তে পারে? এই জায়গাটিতে রেলগাড়ি তো আর নতুন পড়ে নেই—সেই কবে থেকেই পড়ে আছে। এতোক্ষণ আপনারাই-বা কোথায় ছিলেন আর এখন ডাকাতরাই-বা এলো কোথা থেকে? অন্য সময় হলে আর ঘোষণাটি শুনে মনের কি অবস্থা হতো বলতে পারি না। কিন্তু এখন যেন মনে হচ্ছে খবরটা শুনে ভালোই লাগলো। ডাকাত পড়ুক, রাহাজানি লুটতরাজ হোক, জান যাক, যা খুশি হোক—তবু কিছু হোক। এভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে চুপ করে আর বসে থাকা যাচ্ছে না।

আপনারা ভাবছেন নিজেকে তো খুব ‘পার্ফেক্ট জেন্টলম্যান’ খেতাব পাইয়ে দিলেন; কিন্তু আপনি তো দেখছি ‘ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভালো।’ একজনকে দেখে, থামিলো কালের চিরচঞ্চল গতি। আর একজনকে দেখে বলেছেন রেনেসাঁ যুগের স্থপতির হাতে গড়া মূর্তির মতো সুন্দরী। এদিকে আবার বাড়িতে বিয়ে করা এক বৌ-ও আছে। একজন ‘পার্ফেক্ট জেন্টলম্যান’-এর আচরণ ও রকমসকম তো এরকম হওয়ার কথা নয়।

আপনারা যা ভাবছেন ভাবুন। বাধা দেবো না কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মাথা যে চিন্তা দখল করে আছে তার কথা শুনুন।

নাদেরার মুখ দেখে, এবং দেখা মুখ থেকে বাকি অংশ কল্পনা করে আমার মনে হয়েছিল এক কালে সে রক্তমাংসের মানুষ ছিল; কিন্তু এখন পুরুষ সান্নিধ্যেও বিন্দুমাত্র চঞ্চল হয় না— একেবারে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে।

কিন্তু আমার কথাটা হচ্ছে, যেখানে কেয়া বসেছিল, সেখানে একই কালো রঙের বোরখা পরে নাদেরা বসে আছে কি করে? কেয়াই-বা গেল কোথায়? নাদেরার আসনটাই যে কেয়ার ছিল সে সম্পর্কে তো কোনো ভুল হতে পারে না। ঐ আসনে কেয়া আছে তা অবশ্য আমি জানতাম না; কিন্তু পারুলকে দেখতে এসে (সেই যে মহিলাটি একেবারে শুরুতেই ভুল করে ঠিক আমার সামনের চেয়ারটিতে বসেছিলেন—পরে টিকিট কালেক্টর এসে যাঁকে উচ্ছেদ করেন।) ঐ চেয়ারটিতেই কালো বোরখা-পরা একজন মহিলাকে দেখেছিলাম। তিনি যে কেয়া তার নির্ভুল পরিচয় ও প্রমাণ পেলাম, যখন একটুখানি হাওয়া খেতে বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, আর সেই ড্রামটির ওপর কালো বোরখা পরে বসে কেয়া প্রথমে বোরখার ভেতর থেকেই খিলখিল করে হেসে উঠেছিল এবং পরে একবার বোরখা তুলে মুখটা দেখিয়েছিল। ট্রেনের মধ্যে ঐ আসনে বসে থাকাকালে আমি কেয়ার মুখ একবারও দেখি নি—কিন্তু এক মহিলা তো অবশ্যই সেখানেই বসে ছিলেন কালো বোরখা পরে। সেটুকু নিজের চোখেই দেখেছি। আর সেই আসনে বসে থাকা অবস্থায় এক লহমার জন্য যে মুখখানা দেখলাম এবং দেখবার পর জীবনের প্রতিটি লহমাই যে মুখটি মনে থাকবে সেটি নাদেরার।

তাহলে… তাহলে কি কালো বোরখা দু’জনেই পরে আছে? আর কেয়া বসে আছে অন্য কোনো কম্পার্টমেন্টের অন্য কোনো আসনে? তাই হবে। আর কি হতে পারে? তবু উঠে রেলগাড়িটির এ-মাথা থেকে ও-মাথা ঘুরে এলাম। সত্যিই তাই। অন্য কক্ষে অন্য এক আসনে কালো বোরখা। তার ভেতর যে কেয়া আছে সন্দেহ কি? পাশে একটি ছেলেও বসে আছে। আমি কেয়ার দিকে আর এগুলাম না। কেয়ার জন্য আমার সব আকর্ষণ উবে গেছে। তবে মনে হলো তাঁর সঙ্গে যে বালকটিকে এখন দেখছি এবং এখন যেটাকে নাদেরার আসন বলে জানি, সেখানে যে বালকটি বসেছিল এ সে নয়। না হওয়ারই কথা। আসলে নাদেরার পাশেও যে বালকটি বসেছিল সেখানে এখন কেউ নেই। বালকটি গেল কোথায়?

খাবার বাক্সটি যে কেয়াই পাঠিয়েছিল এখন আর সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। তবু উঠে গিয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানাবার ইচ্ছেটা পর্যন্ত হলো না। বরং আশ্চর্য এই যে, কেয়ার কথা মনে পড়তেই মনটা বিরক্তিতে ভরে যাচ্ছে। কেয়া জানলো কি করে আমি এখানে বসে আছি? নিশ্চয় ঐ কম্পার্টমেন্টে উঠতে দেখেছে। কিন্তু সিট নম্বর পর্যন্ত জানলো কি করে? এই কথাটা আমাকে ভাবিয়েছে। তার একটা জবাবও পেয়েছি। স্টেশনে প্লাটফর্মে ঢুকবার আগে যে কোলাপসিবল গেটটা আছে, তার গা ঘেঁষে কাচের ঢাকনা দেয়া একটা বাক্সের মতো আছে। দিনের বেলাও তার মধ্যে আলো জ্বলে। সেখানে প্যাসেঞ্জার লিস্ট আছে। প্যাসেঞ্জারের নাম, তাঁর কম্পার্টমেন্ট ও আসনের নম্বর—সবই দেয়া আছে। কেয়া সেখানেই আমার নাম ইত্যাদি দেখেছে আর মনে রেখেছে। একই নামের অন্য লোক নয় সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে আমাকে ট্রেনে উঠতে দেখে।

আমরা শেষ পর্যন্ত যখন ঢাকা এসে পৌঁছলাম তখন রাত আড়াইটা বাজে। মানে বিলিতি সমাজে সক্কালবেলা। টু-থার্টি এ-এম।

অনেক লোক। প্লাটফর্ম দিয়ে হেঁটে লোহার গেট পেরিয়ে বাইরে যেতে হবে। পিঠের ওপর, হাতের ওপর, বুকের ওপর লোকের চাপ।

জাফর সাহেব বললেন, ‘আমি এগুচ্ছি। আপনি আসুন। আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো।’

জাফর সাহেবের সৌজন্যকে আমি এতোক্ষণ খাটো করে দেখেছি, কারণ সৌজন্যের চাইতেও বড়ো জিনিস এতোক্ষণ আমার মন অধিকার করে ছিল আর তা হচ্ছে নারী প্রসঙ্গ। কিন্তু এতোক্ষণে আমার মনে হলো জাফর সাহেবের ভদ্রতা আর সৌজন্য চিরকাল মনে রাখবার মতো। তাঁর মতো শরিফ মানুষ সচরাচর দেখা যায় না।

কিন্তু আমার মাথায় তখন একটা বড়ো দুশ্চিন্তা কুলিদের মাথায় মালপত্রের চাইতেও ভার হয়ে বসে আছে। আমার স্ত্রীর বান্ধবী জীনাত বলে দিয়েছিলেন তাঁর মেয়েকে যেন তাঁদের মোটরগাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিই। কিন্তু সেই মেয়েটিকে কোথাও দেখছি না।

একটি কালো বোরখা-পরা মহিলা একটু দ্রুত হেঁটে এগিয়ে এসে একটি কথা বলেই আবার ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। কথাটা হচ্ছে, ‘খাবার বাক্সটা কিন্তু আমি পাঠিয়েছিলাম।’ একে তো ভিড়ে হন্তদন্ত হচ্ছি, তার ওপর জীনাতের মেয়েকে কোথাও দেখছি না, এবং তারও ওপর লাঞ্চ-বক্সের প্রয়োজন কবেই ফুরিয়ে গেছে। তাই কেয়ার কথায় কর্ণপাত বা তার গমন পথে দৃষ্টিপাত কোনোটাই আমি করলাম না। হঠাৎ জীনাতের মেয়েকে দেখলাম। এক ভদ্রলোকের পাশে হাঁটছে। পাশে সেই কাজিনটিও আছে। এই ভদ্রলোককে আমি চিনি। তিনি একজন ব্যাংক একজিকিউটিভ। তাঁর বাসায় আমি একাধিকবার ডিনার খেয়েছি। শুধু তখনই মনে হলো চিটাগাং স্টেশনে যে মহিলাটিকে দেখেছিলাম, তিনি আমার স্ত্রীর বন্ধু জীনাত নন, তিনি এই ভদ্রলোকের স্ত্রী। আমি তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম— ‘হ্যালো।’

‘হ্যালো, হ্যালো। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এই ছেলেটি আমার ভাইপো। আগামী সপ্তাহে ওর বিয়ে। হঠাৎ ট্রেনে দেখা হয়ে গেছে।’

ছেলেটি হচ্ছে, সেই মেয়েটি যাকে ‘কাজিন’ বলে পরিচয় দিয়েছিল এবং যাদের সম্বন্ধে একটি মন্দ ধারণা নিয়ে আমি বসেছিলাম। মনে মনে কান মললাম। মানুষ সম্পর্কে চট্-জলদি কোনো ওপিনিয়নকে আর প্রশ্রয় দেবো না।

গেট পেরিয়ে বাইরে এসে যা দেখলাম, তা দেখে ভালো লাগলো না। আমার গাড়িটাই দাঁড়িয়ে আছে। আর জাফর সাহেবের গাড়িটা আসে নি।

আমি বললাম, ‘জাফর সাহেব চলুন আমার গাড়িতে বসে বসেই একটু ঘুমিয়ে নিতে চেষ্টা করি। আর একটু পরই তো কার্ফু উঠে যাবে। তখন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো।’

জাফর সাহেব বললেন, ‘না ভাই, সেটা হওয়ার জো নেই। বাকি সময়টা জেগে আমাকে রিপোর্টটা শেষ করতেই হবে। সোজা বাড়িতেই চলুন।’

‘কার্ফু আছে যে?’

‘বলেছি তো, কোনো অসুবিধা হবে না। সে দায়িত্ব আমার।’

জাফর সাহেবের রিপোর্টটি কি, সেটা কতোটা সবুর সইতে পারবে, আর কতোটা সবুর সইতে পারবে না, তিনি কি করেন, কিছুই জানি না। এদিকে রিপোর্টটি যদি খুব জরুরি হয় আর বাড়ি পৌঁছে দিই নি বলে সেটি শেষ করতে পারলেন না—এবং তার জন্য যদি দেশের কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে বলবেন, আমি সহযোগিতা করি নি বলেই তা ঘটেছে। আর ওদিকে কার্ফু অমান্য করলে যে কী হবে সে তো সবাই জানে। জাফর সাহেব বলছেন বটে, কার্ফুর পাসের ব্যাপারটা তিনিই ম্যানেজ করবেন, আমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, তবু আমার দুশ্চিন্তা যায় না। লোকে অমন কতো কিছু বলে দেয়। কাজের বেলা দেখা যায়, সেটা ফাঁকা আওয়াজ। আমি পড়লাম মহা ফাঁপরে। এমনিতেই তো সারাটা পথ পদে পদে শুধু বিপদেই নয়, বিপথেও পড়েছি। অবশ্য আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বলেন, অকারণে, বড়ো জোর খুব সামান্য কারণেই, আমার মাথার উদ্বেগ দুশ্চিন্তা নাগর দোলার মতো চক্কর দিতে থাকে। তাঁরা বলেন, এটা ঘটে এই জন্য যে আমার জিনি বা জিনিয়াসের মধ্যেই কিছু আছে। নিজের সম্পর্কে ‘জিনিয়াস’ শব্দটির ব্যবহার শুনে খুশি হই; কিন্তু সেই ভাবটা খুবই স্বল্প স্থায়ী হয়। আমার সম্পর্কে ‘জিনিয়াস’ কবুল তাঁরা যে জিনিসটা প্রমাণ করবার জন্য করেন তা জানবার পর খুশির কিছু থাকে না। তাঁরা বলেন, কল্পনা দিয়ে আমি সামান্য জিনিসকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে একটি বড়ো বেলুন তৈরি করি। তারপর যখন দেখা গেল, সমস্ত উদ্বেগই অকারণ-কারণে ঘটেছে তখন অবশ্য বেলুনটা ফেটে যায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় নতুন দুশ্চিন্তার অঙ্কুরা প্রবেশ করে। আমি বলি আমার মধ্যে জিনিয়াস অবশ্য থাকতেই পারে, কিন্তু দুশ্চিন্তাটা জিনিয়াসের মধ্যে নেই, আছে ঘটনার মধ্যে। তোমাদের অর্ন্তদৃষ্টি নেই বলে দেখতে পাও না।

একদিনের কথা বলি। সে বহু বছর আগেকার কথা। আমার বয়স তখন নেচারালি অনেক কম। আমি কাজে পাবনা গেছি। উঠেছি ডাকবাংলোয়। এখনকার কথা জানি না। সেকালে ডাকবাংলোটি ছিল পোস্ট অফিসের পাশে। এর বাম দিকে একটু এগিয়ে গেলে নয়ন ভোলানো সর্ষের খেত। সামনে একটুখানি মাঠের মতো ছিল। মাঠ পেরিয়ে গেট ছাড়িয়ে রাস্তাটা মাড়িয়ে আবার একটা মাঠের মধ্যে পড়বেন। সেই মাঠেরই একটু পেছনের দিকে ছিল কোর্ট-কাছারি। সেই কাছারির সামনে ছিল বড়ো বড়ো গাছ। আসামি-ফরিয়াদি সকলই সেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বা বসে অপেক্ষা করতো। রোদ তাদের কোনো কষ্ট দিতে পারতো না। অবশ্য খোদার হাজার শুকুর আমাকে কোনোদিনই সেই গাছের নিচে দাঁড়াতে বা বসতে হয় নি। বেশ ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন ছিল ডাকবাংলোটি এবং তার পরিবেশ।

একদিন হয়েছে কি, কাজ সেরে ডাকবাংলোয় ফিরে এসেছি। এসেই শুনলাম, এস.পি সাহেব আমার কাছে এসেছিলেন। আমি ফিরে আসা মাত্র কালবিলম্ব না করে যেন তাঁর কাছে যাই। লে বাবা! আমি কী করলাম? স্বয়ং এস.পি. সাহেব আমার খোঁজে এসেছিলেন। খাওয়াটা পর্যন্ত ঠিকমতো খেতে পারলাম না। জগে পানি রেখেছিলাম। টিউবওয়েলের পানি। দেখি, তলায় মর্চের মতো কী পড়ে আছে। চৌকিদার বললো, এখানকার পানিতে অনেক আয়রন। তাই খেলাম।

এস.পি. সাহেবের বাড়ি খুঁজে বের করতে একটুও সময় লাগলো না। সকলেই জানে; কিন্তু ব্যক্তিটিকে আমি জানি না। সেখানে পৌঁছতেই এসপি সাহেব দু’বাহু বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। দেখলাম যে তিনি আমার ছেলেবেলার বন্ধু—যদিও বয়সে কিছুটা বড়ো। আমার বন্ধুদের মধ্যে এস.পি.র মতো উচ্চপদস্থ অফিসারও আছেন জানতে পেরে আমি নিজে ও এস.পি.র মর্যাদার কিছুটা স্বাদ লাভ করলাম। এই রকম কতো বন্ধু কতো ক্লাসফ্রেন্ড কতো বড়ো উঁচু উঁচু পজিশনে আছে, জানিও না। ঠিক করলাম সব খুঁজে পেতে তাদের একটা তালিকা বানাবো। কখন কি ঠেকায় পড়ি কেউ বলতে পারে? আরো ঠিক করলাম সেই তালিকা থেকে আত্মীয়দের বাদ দেবো। কারণ, দেখেছি আত্মীয়রা সাধারণত কেবল ফুটানি দেখায়, কোনো উপকার করে না। দরকার হলে আপনার দুটি পা ধরতেও পিছপা হবো না। যদি টান মেরে নিচে নামিয়ে দেয়া যায়।

এই বন্ধুটির শিকারের খুব শখ। তাছাড়া তাঁর নিজের বাড়িতেই হরেক রকমের জন্তু- জানোয়ারের চিড়িয়াখানা আছে। পাঠকরা যেন একথা মনে করে না বসেন যে সেই চিড়িয়াখানায় শুধু-চিড়িয়াই আছে। রীতিমতো কুমির পর্যন্ত আছে। একটি অজগর সাপও আছে।

জিগ্যেস করলাম, ‘তোমার ভয় করে না?’ কথাটা জিজ্ঞাসা করার সময় আমার গলায় কৌতূহলের চাইতে ভয়টাই প্রকাশ পেয়েছিল বেশি।

বন্ধু শুধু হাসলেন। সেই হাসিতে আবার তাঁর মনের উৎফুল্লতার চাইতে নির্ভীকতাই প্ৰকাশ পেলো বেশি।

আমার ডাকবাংলোয় আসতে হলো। কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম কাশীনাথপুরের দিকে। সেই সময়ই পাবনা থেকে কাশীনাথপুর পর্যন্ত পাকা রাস্তাটি তৈরি হচ্ছে— ঢাকা যাওয়া খুব সহজ হবে। রাতটি কাটালাম কাশীনাথপুর ডাকবাংলোয়। খাওয়া- দাওয়া যা হলো তার বিরুদ্ধে অতি বড়ো নিন্দুকও কোনো নালিশ করতে পারবেন না। সময়টা ছিল শীতকাল।

পরদিন সকালে আমরা জিপে করে একটি চরে গেলাম। সঙ্গে ছিলেন পুলিশের আর এক ভদ্রলোক। পাবনার ইন্সপেক্টর বা কিছু হবেন।

পাখি শিকার করবো। অবশ্য আমি না। আমি জীবনে কোনো বন্দুক হাত দিয়ে স্পর্শ ও করি নি। নৌকা চরের যতোটা কাছাকাছি যেতে পারে ততোটা এগুচ্ছে। সঙ্গে অনেক রকম খাবার ছিল। আমি তারই সদ্ব্যবহার করছি। ওঁরা দু’জন অবশ্য বসে থাকা পাখি মারার মতন ছেলেখেলায় উৎসাহী নন। শুধু উড়ন্ত পাখি মারবেন। তেমন কামিয়াব হচ্ছেন না। অনেকগুলো কার্তুজ না গুলি কি বলে খরচ করে একটি বা দুটি পাখিকেও শুধু জখম করতে পেরেছেন মাত্র।

বন্ধুর কি খেয়াল হলো, বললেন, ‘এবার তুমি চেষ্টা করে দ্যাখো।’

‘আমি যে জীবনে বন্দুক ছুঁয়েও দেখি নি!’

‘তাতে কি। সবকিছুরই শুরু আছে।’

এই বলে তিনি আমার হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিলেন। বললেন যে বন্দুকের গুলি ছুঁড়বার পর কাঁধে একটা ঝাঁকানি দেবে। বন্দুকের ওপরের কোন দুটি ফুটোর ওপর দিয়ে চোখ চালিয়ে দিয়ে নিশানা ঠিক করতে হবে তাও দেখিয়ে দিলেন।

আমি নিশানা ঠিক করলাম। গুড়ুম করে গুলি ছুঁড়ে দিলাম। ঝপাৎ করে একটি পাখি পানির ওপর পড়ে গেল। আমার মনে আছে, নির্দেশমতোই নিশানা-টিশানা ঠিক করেছিলাম। কিন্তু ট্রিগার টিপবার সময় এতোই নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম যে আমার হাত বেজায় কেঁপে উঠেছিল। নিশানা-টিশানা সব ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। আজও আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঠিক সেই কারণে গুলিটা পাখির ঠিক বুকে গিয়ে লেগেছিল।

বন্ধু চিৎকার করে উঠলেন, ‘ওয়ান্ডারফুল।’

কিন্তু সেই ইন্সপেক্টর সাহেব দেখছি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আর আমার মনে হলো, তিনি ভাবছেন সারাজীবন বন্দুক দিয়ে মানুষ খুন করে করে আমি হাত পাকিয়েছি।

আপনারাই বলুন, এই চিন্তাটা কি আমার জিনিয়াস থেকে এসেছে?

অবশ্য বন্ধু-বান্ধবদের কথাতেও একটা কোনো সত্য থাকতেও পারে। স্টেশনে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, জাফর সাহেবকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার উভয় সঙ্কটটা চোখের সামনে— সেই সময় এসব কথা অন্য কারো মনে পড়বে? আপনারাই বলুন?

হঠাৎ অন্ধকারের বুক চিরে বিদ্যুৎ আকাশটিকে ঝলসে দিলো। বিদ্যুৎ জিনিসটা যখন মাথায় পড়ে তখন তা খুব খারাপ জিনিস; কিন্তু যখন তা শুধু আলো দেখায় তখন দেখতে খুব সুন্দর।

জাফর সাহেবের মুখটি হঠাৎ তেমনি আলোকিত সুন্দর দেখাচ্ছে।

‘ঐ যে আমার গাড়িও এসেছে।’

দেখলাম, একটি জিপ এসে সামনে দাঁড়ালো।

‘চলুন, আপনাকেও লিফট দিই।’

‘আমার লাগবে না। আমার তো গাড়ি এসেছেই।’

‘তবু আপনার…?’

‘না না, আমি পরে যাবো। তাছাড়া এখানে আমার একটু কাজও আছে।’

এখানে আমার কোনো কাজ থাকার কথা জাফর সাহেব বিশ্বাস করলেন না তাঁর মুখ দেখেই বোঝা গেল।

তিনি বললেন, ‘শিওর? আমার কিন্তু কোনো অসুবিধা হতো না।’

আমি বললাম, ‘শিওর।

‘আচ্ছা, সালাম আলায়কুম।’

‘ওয়ালেকুম আসসালাম।’

আমি আমার গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ড্রাইভার সেই সন্ধ্যা ছ’টায় এসে এখন পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। মনে মনে তার কর্তব্যনিষ্ঠার প্রশংসা করলাম। যাই হোক, এখন গাড়িতেই বিশ্রাম নেবো। কার্ফু উঠলে তবে যাবো। তার আর বেশি দেরি নেই।

তন্দ্রার মধ্যেই আবার চোখের সামনে বিদ্যুৎ চমকালো।

স্টেশনে লোহার গেট পেরুবার সময় বোরখার ভেতর থেকে ‘খাবার বাক্সটা কিন্তু আমি পাঠিয়েছিলাম’—সেই যে আওয়াজটা বেরিয়ে এসেছিল সেটা কেয়ার গলার আওয়াজ নয়। গলার আওয়াজটা নাদেরার। নাদেরাই লাঞ্চ বক্সটা পাঠিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *