লাঞ্চ বক্স – ৫

পাঁচ

সামনে দেখছি অপেক্ষার অপার পারাবার। তার ওপর কোন্ ফাঁকে গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে।

কতোক্ষণ একটি চেয়ারে বসে থাকা যায়? আমি খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালাম। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেই বাদলা ভাবটা অনেক আগেই কেটে গেছে। মাথার ওপর অজস্র তারা মিটমিট করছে। রেললাইনের ধারে রেল কর্তৃপক্ষ বিপদ চিহ্ন হিসেবে লাল বাতি রেখে দিয়েছেন। আবছা আলোতে, উপড়ে পড়া সেই কম্পার্টমেন্ট দুটিকে মাঠে ফেলে দেয়া দুটি দিয়াশলাইয়ের বাক্সের মতো দেখাচ্ছে।

আমি রেললাইন পেরিয়ে মাঠের ওপর এসে দাঁড়ালাম। সেখানে অনেকেই চলাফেরা করছেন। শরীর চর্চা বা হাওয়া খাওয়ার জন্য নয়। এই যে অনন্ত অপেক্ষা তার কারণে মনের মধ্যে যে অস্থিরতা জমা হয়েছে সেটাকেই ছাড়া দেয়ার জন্য। বেশ কিছুটা ব্যবধানে রাখা দুটি লুব্রিকেটিং অয়েলের ড্রামের ওপর দু’জন ভদ্রমহিলা বসে আছেন। একজন পারুল, সেই যিনি আমার সামনের আসনে এসে বসেছিলেন, আমাকে লাঞ্চ বক্স পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং সকলকেই সেই গানটি শুনিয়েছিলেন, ‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ…’। অপরজন সেই বোরখা পরা মহিলা। পারুল খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বেশ নাটকীয়ভাবে। আমি তাঁকে ধন্যবাদ দেয়ার জন্যও একটি নাটকীয় মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ঠিক করলাম, সেই মুহূর্তটি এসেছে। আমি তাঁর সামনে এগিয়ে গেলাম।

‘আপনি আমাকে যে লাঞ্চ বক্স পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। অবশ্য ধন্যবাদটা অনেক আগেই দেয়া উচিত ছিল।’.

‘লাঞ্চ বক্স! ছয়াট লাঞ্চ বাক্স? আমার কাছে তো কোনো লাঞ্চ বক্স ছিল না। আমি কি আপনাকে চিনি?’

আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি, আমার কথা শুনে তিনি যতোটা অবাক হয়েছিলেন, আমি তাঁর জবাব শুনে তার চেয়ে কম অবাক হই নি। এই জবাবই যদি শুনতে হবে তাহলে অতো সোহাগ করে তাঁকে পারুল নামটি দিতে গেলাম কেন? এবার তিনি উঠে চলেই গেলেন।

এই সময় খিলখিল হাসি শুনতে পেলাম। কোনো কোনো মহিলার খিলখিল হাসি যতোই মধুর লাগুক, ঝরনা থেকে গড়িয়ে পড়া নুড়ির শব্দের সঙ্গীত সুধা ঝরিয়ে দিক, তা শেষ পর্যন্ত একটা শব্দ, নিসর্গ বা পরিবেশের ওপর মৌনতা নামিয়ে দেয় না। কিন্তু সেই হাসি শুনে আমার মনে হলো বিশ্ব চরাচর স্তব্ধ হয়ে গেল, থামলো কালের চির চঞ্চল গতি। হাসিটা এলো সেই ঢাকা বোরখার পর্দার ভেতর থেকে। আমার আরো মনে হলো, আরব্য রজনীর একটি দরজা আমার চোখের সামনে খুলে গেল। সেই হাসিতে শ্লেষ ছিল, সঙ্গীত ছিল, মাদকতা ছিল, আর যাদু ছিল।

‘ওই ড্রামটি গড়িয়ে গড়িয়ে এখানে নিয়ে আসুন। আর আমার পাশে বসুন।

আরে এ যে শুনছি কেয়ার গলা। একে বকুল নাম দিতে যাবো কেন? কিন্তু কেয়া তার অনুপম মুখ আর শরীর বোরখা দিয়ে ঢেকেছে কেন? সে তো কোনোদিন পর্দা করে নি। বরং সত্যি কথা বলতে কি, লোকে তাকে দেখুক, আর তার রূপে মুগ্ধ হয়ে অচেতন হয়ে যাক, অন্তত মনে মনে চিরকাল সেটাই ছিল তার ইচ্ছা।

ড্রামটিকে ঘোর লাগা মানুষের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে আমি তার পাশে নিয়ে এলাম।

জোনাকি জ্বলছে-নিভছে, আর সে দৃশ্যটা সামনে থাকলে সুখ-দুঃখের আলাপটা জমে ভালো। কিন্তু সবকিছু মাটি করে দিচ্ছে থেকে থেকে কুকুর আর শেয়ালের চিৎকার। আমার মনে হলো, আমরা দু’জন আমাদের কক্ষপথ থেকে ছিটকে এখানে এসে পড়েছি।

কেয়া বললো, ‘আপনিও এসে বসলেন আর এভাবে শৃগালসঙ্গীত শুরু হয়ে গেল? পরিবেশটাকে আর রোমান্টিক হতে দিলো না।’

আমি বললাম, ‘আপনার একার উপস্থিতিই যথেষ্ট। তা সব কুশ্রিতাকে মুছে দেয়।’

‘আপনার মুখে এতো সাহসী কথা আর কখনো শুনি নি। আপনি তো চিরকালের পার্ফেক্ট জেন্টলম্যান।’

আমি সে কথার কোনো জবাব দিলাম না। মনে পড়লো কেয়াদের বাড়ি নিয়মিত যেতাম। সে সত্যিই অপরূপ সুন্দরী। শরীরটা বেশ লম্বা। তার ওপর গান গাইতো ভালো। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কেয়াদের বাড়িতে লোকজনের আড্ডা বসতো। সে আড্ডা ভাঙতেই চায় না। লোকজন আসতো তার গান শুনতে বা গান শুনবার নাম করে। আসলে তারা আসতো কেয়ার রূপানলে পতঙ্গের মতন আকৃষ্ট হয়ে। সত্যি কথা বলতে কি, আমিও তাই। আর দশজন বেশ খুল্লামখুল্লা কেয়ার প্রতি তাদের আকর্ষণের কথা জানিয়ে দিতো। কেয়া ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতো কিন্তু এই অবস্থাটা উপভোগও করতো। কেয়ার ব্যবহারে কোনোরকম প্রতিদান ছিল না, কিন্তু কিছুটা প্রশ্রয় থাকতো। এক আমি বাদে। বাড়িতে আমার স্ত্রী আছে। তাছাড়া কেয়ার স্বামী আমার পরিচিত লোক। ভদ্রলোক বয়সে আমার চাইতে বেশ কিছুটা বড়ো। কেয়ার প্রতি আকর্ষণের কথা কোনোদিন বুঝতে দিই নি। কেয়ার স্বামী মোতাহার স্ত্রীকে খুবই ভালোবাসেন। স্ত্রীর ওপর তাঁর আস্থাও আছে। তিনি জানেন, কেয়া যতোই মেলামেশা করুন, নিষিদ্ধ রেখাটি কোনোদিন অতিক্রম করবে না। কিন্তু এসব বহুদিন আগেকার কথা। তখন আমার বয়স তিরিশ মাত্র। এখন প্রায় পঞ্চাশ। কেয়া আমারই সমবয়সী।

আমি শুধু একবারই নিয়ম লংঘন করেছিলাম। একদিন দুপুরে কোনো কাজে কেয়াদের বাড়ির কাছ দিয়ে যাচ্ছি। আমি কাজ ভুলে কেয়াদের দরজায় কড়া নাড়লাম। কেয়া নিজেই দরজা খুলে দিলো।

‘মোতাহার বাড়ি আছে?’

‘সে তো এ সময় বাড়ি থাকে না।’ এই বলে কেয়া একটা হাসি গোপন করলো।

‘আমি ভেতরে এলে আপনি বিরক্ত হবেন?’

‘না না। একেবারেই না।’

সেদিন কেয়া আমাকে অনেকগুলো গান শুনিয়েছিল।

কেয়াকে বললাম, ‘আপনি তো কোনোদিন পর্দানশীল ছিলেন না। বোরখা পরে আছেন কেন?’

‘সে অনেক কথা।’

‘বলুন না, শুনি।’

‘শুনবেন?’

কেয়া যা বললো তা সংক্ষেপে এই।

বাড়িতে প্রায়ই পার্টি-টার্টি হয়। একজন লোক একেবারে নাছোড়বান্দা। কেয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। মোতাহার আর কেয়া দু’জনেই তাকে আসতে মানা করে দিয়েছে। একদিন সেই লোকটি একটি কাণ্ড করলো।

এইখানে একটু ইতস্তত করে কেয়া মুখ থেকে বোরখা সরিয়ে নিলো। আমি আঁতকে উঠে লাফিয়ে পড়ে দু’হাত পিছিয়ে গেলাম। কেয়ার গায়ের রঙ যাকে বলে দুধে-আলতা। তার গালের একটি দিক পুড়ে কালো হয়ে গেছে।

আবার সেই খিলখিল হাসি শুনতে পেলাম।

‘সহ্য করতে পারলেন না তো?’

নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ফিরে এলাম।

‘কি করে হলো?’

‘সেই বদমাশ লোকটা অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছিল।’

‘আপনার সঙ্গে মোতাহার সাহেবকে দেখছি না?’

কেয়া আবার হাসলো।

‘আপনি ভাবছেন, আমার গাল পুড়ে যাওয়ার পর মোতাহার আমাকে ছেড়ে দিয়েছে কি না? না, মোতাহারের মতো লোক হয় না। সে বরং সেই ঘটনাটির পর থেকে আমাকে আরো বেশি ভালোবাসে। কী যে যত্ন নেয়, বিশ্বাস করতে পারবেন না।’

‘কিন্তু তাঁকে দেখছি না?’

‘সে তার নিজের ব্যবসার কাজে কোরিয়া গেছে। আমার সঙ্গে একটি কাজের ছেলে আছে।’

‘হ্যাঁ, দেখেছি। আপনার বড়ো ছেলেটি কি করছে? কতো বড়ো হয়েছে।’

‘মাশাল্লাহ, ছাব্বিশ বছর বয়স হলো। বিলেতে লেখাপড়া শেষ করে এখন বাপের সঙ্গে ব্যবসা করছে।’

‘আর ছোট ছেলে?’

‘তারও বাইশ পেরিয়ে গেছে। আমেরিকায় মাস্টার্স করছে।’

‘মোতাহার সাহেব ফিরবেন কবে?’

‘এতোক্ষণে নিশ্চয় তার প্লেন এসে গেছে। সে-ই স্টেশনে আমাকে নিতে আসবে।’

‘তাকে আমার সালাম দেবেন।’

‘দেবো।’ এই বলে কেয়া উঠলো।

আমিও আমার আসনে ফিরে আসছি। দু’জনে পাশাপাশি হাঁটছি।

হঠাৎ কেয়া বললো, ‘আপনাকে চিরকালের পার্ফেক্ট জেন্টলম্যান বললাম। কথাটাকে আপনি নিশ্চয় কমপ্লিমেন্ট হিসেবে নিয়েছেন।’

‘হ্যাঁ, কমপ্লিমেন্ট বৈ কি?’

‘আসলে, সেটাই আপনার বিরুদ্ধে আমার চিরকালের নালিশ।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *