চার
বিনা মেঘে বজ্রাঘাত কথাটি শুনেছি। কিন্তু ঘটতে দেখি নি। কিন্তু এই মাত্র তার আওয়াজটি শুনলাম। আখাউড়া স্টেশনের কাছাকাছি ট্রেনটি তার শরীরের আড়িমুড়ি ভেঙে হঠাৎ এমন জোরে ছুটতে লাগলো যে মনে হলো ট্রেনটির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আর তখনই বজ্রপাতের সেই কড়কড় মড়মড় শব্দটি শোনা গেল। সেই লম্বা ট্রেনটির পুরো শরীর কয়েকবার প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেল। সেই কড়কড় শব্দ, এবং সেই সারা শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসার মতো কম্পন—এই দ্বৈত ঘটনাটি ঘটতে সময় লাগলো খুবই কম; কিন্তু তারই মধ্যে ট্রেনের মধ্যে যে ঘটনাগুলো ঘটে গেল তা কম নয়। অনেকে যে ক’টি মাল হাতে নেয়া সম্ভব হলো, পলকের মধ্যে তা হাতে নিয়ে তারপর কি করবেন স্থির করতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়েই থাকলেন। ট্রেনের এক পাশে একটি মজা-হাজা পুকুর এবং অন্যপাশে একটি ভরা পুকুর। ট্রেনের দু’দিকের দরজার সেই পাঁচ ফুট উঁচু থেকে লাফ দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে যে যেদিকে পারলেন ‘ডাইভ’ দিলেন। কে অক্ষত থাকলেন, কার বুকের পাঁজর বা পায়ের হাড় ভাঙলো তা নিয়ে আহতরাও ‘উঃ আঃ’ করলেন না—জানটা বেঁচে গেল সে কথা ভেবেই হাজার শুকুর। যাঁরা বিদ্যুৎগতিতে লাফ দিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন, যাঁদের মাথায় টুপি, পরনে লুঙ্গি। টার্জন-এর ছবিতেও এমন অবিশ্বাস্য ঝাঁপ দেখি নি। প্রথমে শোনা গেল, ট্রেনে ডাকাত পড়েছে। তারপর দেখা গেল, দুটি কক্ষ লাইনচ্যুত হয়ে পাশের দুটি সমান্তরাল লাইনে উপড়ে পড়েছে। এমনভাবে পড়েছে যে মনে হচ্ছে অনেকে মিলে হাত দিয়ে ধরে কক্ষটিকে খুব সযত্নে পাশের লাইনে বসিয়ে দিয়েছে। এদিকে-ওদিকে একটুও কাত হয় নি। এবং একজনও হতাহত হন নি। যাঁরা ঝাঁপ দিয়েছিলেন, শুধু তাঁদের মধ্যেই কেউ কেউ গুরুতর আহত হয়েছেন। যাঁরা মজা-হাজা পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, তাঁদের মাজা ভেঙেছে নিশ্চয়।
আমি স্থির হয়ে বসে থাকলাম। এ্যাকসিডেন্ট যা হওয়ার হয়ে গেছে। ট্রেন এখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সহজে নড়বে বলে মনে হয় না। সুতরাং ঢাকা দূর অস্ত।
এরই মধ্যে এক প্রৌঢ়া ‘ওগো, মাগো কি হবে গো, মরে গেলাম গো’ বলে প্রাণপণে আর্তনাদ করছেন। আর যে মরে মরুক, এ মহিলাটি যে সহজে মরবার পাত্রী নন, তাতো বোঝাই যাচ্ছে। যে মরে গেছে সে এভাবে চেঁচাতে পারে না।
নিজেকে বললাম, ‘রিল্যাক্স। ব্যস্ত হয়ো না। ছটফট করো না। একটি রেলগাড়ির দুটি বগি দলছুট হয়ে অন্য লাইনে গিয়ে উড়ে বসে আছে, রেলভ্রমণের ঘটনা হিসেবে এটি চাট্টিখানি কথা নয়। এই ট্রেন আর সহজে নড়ছে না। এই ফাঁকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর একটি করে নাম দিয়ে রাখি, যদিও আমার কাহিনীর শেষ মুহূর্ত এসে গেছে। আমার সামনের সেই ভারিক্কি ভদ্রলোকের নাম দেয়া যাক জাফর সাহেব। আমার এক চাচার নাম জাফর। তিনি ঐ রকম দেখতে। আর যে মহিলা আমাকে লাঞ্চ বক্স পাঠিয়েছিলেন—মনে পড়ছে না? সেই যে মহিলা আমার সামনের আসনটি তাঁরই আসন মনে করে বসেছিলেন, তাঁর কথা বলছি। তাঁর নামটি পারুল দিলে কেমন হয়? আর সেই বোরখাপরা মহিলা? হ্যাঁ, তাঁকেও আমাদের প্রয়োজন হবে। একজন যদি পারুল হলেন, তাহলে দ্বিতীয়জনের নামকরণ খুবই সোজা হয়ে যায়। এবং সেটা অনিবার্যভাবেই বকুল। রবীন্দ্রনাথ গান লিখে আমাদের কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছেন। এবং আমার স্ত্রীর বান্ধবীর কন্যার নাম রাখা যাক রূপরেখা। কোনো কারণ নেই। শব্দটি হঠাৎ মনে পড়লো, কানে ভালো লাগলো, আর দুম করে সেটা বসিয়ে দিলাম। অমন একটি শব্দ শুনতে যতোই ভালো লাগুক একটি মেয়ের নাম হতে পারে কিনা ওসব বেয়াড়া প্রশ্নের দিকে আমরা যাবো না।
চুপ করে এইসব সাত সতেরো ভাবছি। এমন সময় মনে পড়লো আমরা যদি আজ ঢাকা পৌঁছাতে পারি, তো অন্তত সাত-আট ঘণ্টা ‘লেট’-এ পৌঁছাবো। তখন ঢাকায় সান্ধ্য আইন। আগেই বলেছি, যে সময়কার ঘটনা বিবৃত করছি, সেটা শেখ মুজিবের পরবর্তী শাসনামল। দেশে কি সব ঘটছিল। তিনি বসিয়ে দিলেন সান্ধ্য আইন। সেই যে বসলো আর উঠতে চায় না। সান্ধ্য আইনের মেয়াদ অবশ্য একটু একটু করে কমিয়ে দেয়া হলো। তবু আমরা যখন ঢাকা পৌঁছাবো তখন সান্ধ্য আইন থাকবে। সান্ধ্য আইন হচ্ছে সান্ধ্য আইন। লাইটলি নেয়া বেকুবের কাজ। বাড়ি থেকে পা বাড়িয়েছো কি ‘গুডুম’ করে একটি শব্দ এবং ‘গেলুম’ বলে আপনি একেবারে পরপার। বাড়ি যাবো কি করে?
জাফর সাহেব অন্যের মাথার চিন্তা পাঠ করতে পারেন কিনা জানি না; কিন্তু এবার তিনি যা বললেন, তা শুনে আমার যদি তাই মনে হয়ে থাকে আমাকে দোষ দিতে পারবেন না।
জাফর সাহেব বললেন, ‘আপনি ভাবছেন, ‘কার্ফুর’ মধ্যে বাড়ি যাবেন কি করে?’
‘জি। সে চিন্তা তো আছেই।’
কোনো অসুবিধা হবে না। আমি পৌঁছে দেবো।’
কোনো কোনো লোক আছেন, যাঁদের দেখে শুধু আস্থাবানই মনে হয় না, বরং তাঁদের দেখলে সেই আস্থা অন্যের মধ্যেও চালান হয়ে যায়। জাফর সাহেব তাঁদেরই একজন।
জানালার বাইরে চোখ যেতেই দেখি সেখানে দাঁড়িয়ে একটি লোক সিগারেট ফুঁকছে আর আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। কথাটা বললাম বটে, কিন্তু সত্যের খাতিরে মানতেই হবে জুলজুল করে তাকানো কাকে বলে তা-ই আমি জানি না।
এভাবে বসে থাকতে নিজেকে সহায়-সম্বলহীন মনে হচ্ছে। এ এক নিশ্ছিদ্র অনিশ্চয়তা। এরকম অবস্থায় পড়লে ট্রেন আবার নড়ে উঠতে কতো সময় লাগে সে সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। লোকজনের কথা শুনে মনে হচ্ছে, সাত-আট ঘণ্টার ধাক্কা। কেউ বা কারা আসবে, রিলিফ ট্রেন আসবে, লাইন সাফ হবে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনোটাই শুরু হয় নি। বিশ্বাস করুন, কথাটা বিদ্যা ফলাবার জন্য বলছি না; কিন্তু এইভাবে অপেক্ষা করতে করতে আমার মনে পড়ে গেল স্যামুয়েল বেকেটের নাটক ‘ওয়েটিং ফর গোডোট’-এর কথা। আমাদের সকলেরই মনের সেই দশা : ‘নার্থিং হ্যাপেনস, নোবডি কামস, নোবডি গোউজ, ইট ইজ অফুল।’
না একটা কিছু ঘটছে। একটা ভরা পুকুরের কথা বলেছি। সেখানে কোথাও একটা ডিঙি বাঁধা ছিল। দেখলাম সেই ইরানি যুবকদের দু’জন আর আমাদেরই দুই অর্ধ উলঙ্গ কিশোর সেই পুকুরে দাঁড় টেনে নৌকা বাইছে। তাদের সে কী আনন্দ আর উল্লাস। ইরানি যুবক আর বাংলাদেশের কিশোর মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। সকলেরই মধ্যে প্রাণের ফোয়ারা। তাদের খেলায় আর মেলামেশায় কোথাও বেসুরো কিছু বাজছে না। তখন আমার আর একটি কথা মনে হলো। এই বিশ্বসংসারটি সত্যিই একই সংসার। আসলে মানুষে মানুষে সত্যিকার কোনো পার্থক্য নেই।
চুপচাপ বসে থেকে কতোটা সময় উতরে গেছে জানি না। এক সময় খেয়াল করলাম সেই চারজন ইরানি ছেলে আবার এক সঙ্গে বসে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে।
‘খোদার কিন্তু অশেষ মেহেরবান।’
‘বেশক। কিন্তু হঠাৎ এই সময় তোমার কথাটা মনে হলো?’
‘দেখলে না? তিনি আমাদের দ্বিতীয় জীবন দিলেন। যে রকম এ্যাক্সিডেন্ট হলো তারপর
তো আমাদের বেঁচে থাকারই কথা নয়।’
‘খোদা কিন্তু আমাদের ওপর আরো বেশি মেহেরবান হতে পারতেন।!’
‘কি রকম?’
‘এই এ্যাক্সিডেন্টটা আদৌ না ঘটলে আরো ভালো হতো!’
কি যে বলো। খোদার কাজের মাসলেহাত বুঝতে পারা ক্ষুদ্র মানুষের কর্ম নয়!’ তারা আলাপ করছিল ইংরেজি ভাষায়।