লাঞ্চ বক্স – ৩

তিন

স্টেশনে নেমেই প্রথমেই যে দৃশ্যটি আমাকে হোঁচট খাওয়ালো সেটা খুব এক ইতর দৃশ্য। বিশ-বাইশ বছরের এক কৃশ যুবতী কোলের বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। অদূরে বসে পঞ্চাশ ষাট বছরের একটি লোক সেদিকে কামদ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাওয়া বিষাক্ত হয়ে গেল। আমি ট্রেনে উঠে এসে এবারে নিজের আসনটিতে বসলাম।

দেখি, দু’জন ভদ্রলোক নেমে যাচ্ছেন। একজন বেশ লম্বা। তিনি যেতে যেতেই বলছেন, ‘আজকাল সকলের নিজেরই এতো দুঃখ আছে যে পরের দুঃখে আর দুঃখ পায় না।’ কথাটা আমার কাছে সত্য মনে হলো।

কুমিল্লা স্টেশনের বাম দিকে একটি পাওয়ার হাউস আছে। এই ট্রেন থেকে কি দেখা যায়? মনে পড়ছে না। মোটর পথে খানিকটা ঘুরে গেলে কুমিল্লার মিষ্টি পাড়া। চমচম বড়ো বেশি মিষ্টি লাগে। কিন্তু গাড়ি দাঁড় করিয়ে বহুবার খুড়িতে করে রসমালাই খেয়েছি। অদূরেই দু’তিনটি খাদির দোকান। কুমিল্লার খদ্দরের কাপড় একদা বিখ্যাত ছিল। আমাদেরই দেশের কাপড় তবু খদ্দর পরবার জন্য সাহস লাগে। অনেকে তাকিয়ে থাকে। কংগ্রেস দলের সমর্থক মনে করে, যদিও এ দেশে কংগ্রেস নেই। খাঁটি খদ্দরের পাঞ্জাবি-পাজামা পরে আরাম আছে। আর ধুলে এমন ফুটফুটে সফেদ দেখায় দুধের মতো। গেরুয়া রঙের খদ্দরও আছে, কাজী নজরুল ইসলাম পরতেন। আর সাদা রঙের পরতেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তাঁদেরকেও কি কথা কম শুনতে হয়েছে? খদ্দরের সঙ্গে কংগ্রেসের গাঁটছড়া বেঁধে দেয়া হয়েছে বলে খুব কম লোকই পরতে সাহস করেন। ফলে দেশের বিরাট এক বস্ত্রশিল্প নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই কুসংস্কার দূর করে দেয়ার জন্য সরকার নিজের উদ্যোগেই খদ্দরের জন্য এক সেলস প্রমোশন ড্রাইভ শুরু করলে পারেন।

একটি দশ-বারো বছরের ছেলেকে বহুবার এই ট্রেনে দেখেছি। কুমিল্লা স্টেশনে ট্রেনে উঠে পড়ে। নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সে হাত পেতে সাহায্য চায় না। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। পরনে থাকে লুঙ্গি আর হাফ শার্ট। একটি চোখেও কোনো দোষ আছে। পা টিপে টিপে ট্রেনের মধ্যে হাঁটে। আর বাঁশি বাজায়। খুব ভালো বাজায় বলতে পারবো না। বেশির ভাগ লোকই গ্রাহ্য করেন না। কোনো কোনো লোক সিকিটা, আধুলিটা, এমনকি পুরো একটি টাকা পর্যন্ত এগিয়ে দেন। আমি ছেলেটিকে বহুবার দেখেছি এবং উপার্জন করবার জন্য এমন একটি সম্মানজনক পথ বেছে নিয়েছে বলে তাকে আমি মনে মনে শিল্পীর মর্যাদা দিয়েছিলাম। তার জন্য আমার কাছ থেকে পাঁচটি টাকা বরাদ্দ ছিল। একবার টিকিট কালেক্টর মারতে মারতে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিলো। ছেলেটি খুব কেঁদেছিল। আর আমার খুব খারাপ লেগেছিল। ছেলেটিকে তার পর দেখি নি। সে আর এই ট্রেনে উঠবে না। তার শিল্পী আত্মাভিমানে গেলেছিল।

আমি আরো একটি কথা ভাবছি। সেই পঞ্চাশ-ষাট বছরের বৃদ্ধের উলঙ্গ কামলোলুপের দৃষ্টি দেখে, আমি যে প্রায় সর্পাহতের মতো ফিরে এলাম, আমার সঙ্গে তার কি কোনো সত্যিকার পার্থক্য আছে? মহিলাদের বাহু দেখা; উঠে দাঁড়িয়ে দু’বাহু উপরে তুলে কিছু রাখলে বা নামালে তাঁদের শরীরের রেখাগুলোতে যে তরঙ্গ ওঠে তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা, এসব কি? এ কি কাম? কিংবা সৌন্দর্য উপাসনা? আমার মধ্যে কি কাম নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু তা সার্বক্ষণিক নয়। নয়?

এখন আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া খুব দূরে নয়। আবার খুব কাছেও নয়। কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত দৌড়টা মোটামুটি লম্বাই। বাদলা ভাবটা কেটে গেছে। সূর্য আবার মুখ দেখিয়েছে। আরো অন্তত ঘণ্টাখানেক আলো থাকবে।

ছেলেবেলায় আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাস করেছি। এখনো জায়গাটির প্রতি আমার টান আছে। সেখানকার ছানামুখী জিভে যে স্বাদ রেখে গেছে তার কাছে সব মিষ্টিই আলনি লাগে।

একমাত্র তুলনা চলে ভীননাগের সেই তবক দেয়া হলুদ রঙের দিলখোশ সন্দেশের সঙ্গে। একবার চাটগাঁ থেকে মোটরগাড়িতে ঢাকা যাচ্ছি। সঙ্গে চাটগাঁর তরমুজ, কয়েক বিড়ে পান, শুঁটকি মাছ। বন্ধু-বান্ধবদের ফরমাশ। অফিসের খরচে টেলিফোন করে এই সব জরুরি জাতীয় প্রয়োজনের সরবরাহ আনতে বলেছেন। শুঁটকি মাছ ট্রেনে আনতে দেয় না। যাত্রীরা আপত্তি করেন। হঠাৎ একটা ইচ্ছা মাথায় এলো এবং আমি আমার কর্তব্য স্থির করে ফেললাম। বা বলতে পারেন সামান্য সংশোধন করলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া একবার দেখে যাই। চাটগাঁ থেকে ঢাকার সড়কপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পড়ে না। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পেরিয়ে অন্য পথে যেতে হয়। পাকা রাস্তা। বোধহয় শ্রীহট্ট পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আমাদের ছেলেবেলায় বড়োরাও কল্পনা করতে পারতেন না যে এরকম রাস্তা হতে পারবে।

কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া যে একেবারেই বদলে গেছে। সেই সবুজ কোথায়? সেই বিস্তীর্ণ মাঠ, জর্জ হাই স্কুলটি তো অনেক আগেই নাম পাল্টে নিয়াজ মোহাম্মদ হাই স্কুল হয়ে গেছে। কে বলে ‘নামে কি আসে যায়।’ অনেক কিছু আসে যায়। ইতিহাস উল্টে দেয়া যায়। নামের যাদু যে ব্যঞ্জনা আর প্রেরণা তৈরি করে তাকে মুছে বা মেরে ফেলা যায়। ‘অনুবাদ’ হয়েছে ‘তরজমা’। ‘বাংলাদেশ বেতার’ হয়েছে ‘রেডিও বাংলাদেশ।’ আর অবশ্যই ‘জয়বাংলা’ হয়েছে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।’ ছিলাম ‘বাঙালি।’ রাতারাতি হয়ে গেলাম ‘বাংলাদেশী’। যুক্তি দেখানো হলো ‘দেশের নাম বাংলাদেশ’। সুতরাং আমরা ‘বাংলাদেশী’। অনেকেই যেমন যখন ক্ষমতায় তাঁদের গীতেই তবলা ঠোকেন, এবারও তাঁরা বললেন ‘ঠিক ঠিক। বটেই তো।’ কিন্তু যাঁরা ঠিক ঠিক করলেন তাঁরা ভুলে গেলেন দেশের নাম চিরকালই বাংলাদেশ ছিল। এবং আমরাও চিরকালই বাঙালি ছিলাম। এখন এই বোল ও ভোল বদলানো হলো কোন প্রয়োজনে বা কিসের স্বার্থে?

একাত্তরের বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কি একজন লোকও ছিলেন, যিনি ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়েছিলেন? যাঁরা আজ অন্য কথা বলেন, তাঁরা কি জানেন, ‘বাঙালি’ থেকে ‘বাংলাদেশী’ হয়ে গেলে আমরা আর আমরা থাকি না—অন্য কিছু হয়ে যাই। আমরা সকলে বিগড়ে গিয়েছিলাম। জিয়াউর রহমান সাহেব আবার শুধরে দিলেন। চাকাকে আবার ঠিক লাইনে বসিয়ে দিলেন। কিন্তু মানুষের স্বভাব যে ভাষা তৈরি করে হাত তা মুছে ফেলতে পারে না।

দেখছি অনেকগুলো পাকা দালানকোঠা উঠেছে। গ্যাস সরবরাহের জন্য একটা ডিপো তৈরি হয়েছে। এসবই উন্নতির লক্ষণ। প্রশংসার যোগ্য। তবু আমার ছেলেবেলার ‘স্মৃতির শহর’টি হারিয়ে গেছে বলে দুঃখ পেলাম।

খোদার হাজার শুকুর, সেই কালভার্টটা এখনো আছে। পাশের সেই দোকানটিও। খুঁজে পেতেই মিষ্টান্ন পাড়ায় এলাম। আছে, আছে, সব আছে। কারণ এখনো ছানামুখী তৈরি হয়। দোকানের মালিকের নাম সরোজ বাবু। আমি এতোটা পথ ঘুরে ছানামুখী কিনতে এসেছি শুনে সরোজ বাবু তাঁর চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন। আমরা সমবয়সী। ছেলেবেলায় আমি ও এখানে ছিলাম শুনে তাঁর সে কী আনন্দ। আমরা সেই মুহূর্তেই বাল্যবন্ধু হয়ে গেলাম। ছানামুখী কেবল তাঁর স্বাদেই অমর হয়ে নেই, তাঁর কণ্ঠেও নামটি সঙ্গীতের মতো বাজে। কারণ মিষ্টিটির সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম জড়িত আছে। এ গৌরব যেন তাঁরই গৌরব। এও একরকম দেশোয়ালি প্ৰীতি ।

সরোজ বাবু দুঃখ করে বললেন, ‘আজকাল আর সেরকম পারি না। দুধের সাপ্লাই কম। সে দুধও খাঁটি নয়। তবু চেষ্টা করি; কিন্তু বলে দিচ্ছি, ছেলেবেলায় আমরা যে ছানামুখী খেয়েছি, তার স্বাদ জিভে এখন স্মৃতি হয়ে আছে।’

দেখলাম দু’হাঁড়ি মিষ্টি গাড়িতে উঠলো। ভদ্রলোক কিছুতেই দাম নেবেন না। তিনি দু’হাতে আমার হাত চেপে ধরলেন। তাঁর দু’চোখে পানি।

‘মনে করুন, এটা আপনার ছেলেবেলার শহরের সামান্য উপহার।’

আমি কিছুতেই তাঁকে দাম দিতে পারলাম না। আমার একটি কার্ড তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম।

‘ঢাকা এলে আমার বাসায় পদধূলি দিলে খুব খুশি হবো।

সরোজ বাবু জিভ কাটলেন।

‘পদধূলি? ওভাবে লজ্জা দেবেন না। অবশ্যই যাবো। তবে কি জানেন? ওদিকে যাওয়া হয় না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে যেতেই মন চায় না। হার্টের রোগী। মনে করুন, ঢাকায় গিয়ে হঠাৎ মরেই গেলাম। সেখানেই দেহটা পুড়িয়ে ফেলবে? তা চাই না। যা হওয়ার এখানেই হোক।’

আজ ট্রেনে যাচ্ছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর কতো দূরেই-বা হবে? অবশ্য ট্রেন কুমিল্লা স্টেশন ছেড়েছে তা বেশিক্ষণ হয় নি। আমি সবসময়ই ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনটি রেলের কামরা থেকেই দেখি। জর্জ হাই স্কুলটি দেখা যায়। বাম হাতে কবরস্থানটিও চোখে পড়ে।

এবার কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনটি দেখা খুব সহজ হলো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *