দুই
ভাত খাই নি, কিছুই খাই নি, তাই ভাতঘুমে পাওয়ার কথা নয়। তবু চোখ দুটি ঢুলঢুল করছিল। আসলে, সুযোগ পেলেই দিবানিদ্রা বিলাসটা যে কখন অভ্যাস হয়ে গেছে, সেই সময়টাকে মনে রাখি নি। তবু এই তন্দ্রার মধ্যেও মনে হচ্ছিলো, আমার একটা কিছু করবার আছে, কিন্তু আমি করি নি। অতোটা মনে পড়ছে ঠিকই, কিন্তু সেই কাজটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। তার বদলে অন্য একটি কথা মনে পড়লো। মনে পড়লো, যখন থেকে ট্রেনে উঠেছি, একবারও ওঠাবসা করি নি, টয়লেটে পর্যন্ত যাই নি, এই চেয়ারটিতেই জড়ভরতের মতো বসে আছি। আমার সামনের ভদ্রলোকও তাই। তাঁর সঙ্গে না হয় জরুরি কাগজপত্র আছে। উঠে গেলে সেগুলোর গোপনীয়তা রক্ষা করবে কে? তিনি অবশ্য বলেছেন, আমাকে চেনেন। কিন্তু চেনা তো কতোরকম হয়। ভদ্রলোকের শিষ্টাচারের মধ্যে এক সর্বজনীন অবিশ্বাসও কোথাও তাঁর স্বভাব বা শিক্ষার মধ্যে গোপন আছে, এমন এক শরীর শিরশির করা অনুভূতিও হয়।
বাদবাকি যাত্রীদের দেখে মনে হয়, এই ট্রেনের মধ্যেই তাঁদের বিস্তর কর্তব্য ছড়িয়ে- ছিটিয়ে আছে। বারবার উঠে পড়ে, সামনে-পেছনে যাতায়াত করে, দরজা খুলে আবার তা আবজে দিয়ে, জানালার ভেতর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কলা, কাঁচা আমড়া, আর ডিমসিদ্ধ কিনে, কাজের কোনো কূল পাচ্ছেন না। একেবারে নিষ্কর্মা হয়ে বসে আছি একা আমি। লাকসাম স্টেশন-ঢাকা যাওয়ার পথে ডান হাতে—একটা টিনের ছাউনি আছে। জায়গাটাকে অপরিসর বলা যাবে না। সেখানে মায়ের কোলে শিশু; পাশে দাঁড়ানো কিশোর-কিশোরী; প্রৌঢ়া প্রৌঢ়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা; যুবতী—শতরকমের অভাব সত্ত্বেও যাদের পীনঘনস্তন এখনও অবনত হয় নি; সেই সঙ্গে বিভিন্ন রকমের মালের প্যাটরা, এক বিচিত্র সমাবেশ তৈরি করেছে। এই দৃশ্যটি দেখে সবকিছুর ওপর উপচে পড়া যে ধারণাটি মনকে অধিকার করে, তা হচ্ছে অবিমিশ্র অবিচ্ছিন্ন অশেষ দারিদ্র্যের ছবিটি। তবু, এদের মুখেও হাসি দেখি; দেখি কোলের শিশুকে আদর করার দৃশ্য; আরো দেখি স্বামীর জন্য স্ত্রীর চোখে এক পলক সোহাগ। দেশ যেন এক বারোমেসে চিরকালীন দুর্ভিক্ষের কবলে ধুঁকছে। ট্রেন কোনো স্টেশনে দাঁড়ালেই তারা সাহায্যের জন্য জানালার কাছে ছায়ার মতো এসে দাঁড়ায়। একটি ছায়াকেই শত শত ছায়া মনে হয়। মনে হয় পৃথিবীর ওপর উজ্জ্বল আলোতেও ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। প্রতিটি জানালায় চাপ চাপ দারিদ্র্যের অন্ধকার প্রতিমূর্তি। মেয়েদের শরীরের আব্রু রক্ষা করে চলতে বলে সকলে। এই যুবতীদের আব্রু রক্ষা করবে কে? কেউ কেউ নির্বিকার যাত্রীর মনোযোগ আকর্ষণ করবার জন্য, যাত্রীর হাত স্পর্শ করে, আর তিনি বিবমিষায় আক্রান্ত হয়ে জানালা থেকে যতোদূরে সম্ভব দূরে সরে বসেন, রুমাল দিয়ে স্পৃষ্ট জায়গাটি বারবার ঘষতে থাকেন। তিনি জানলেনও না যে সেই মুহূর্তেই তাঁকে তাঁর দেশ স্পর্শ করলো। বহুবার এমনও হয়েছে যে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ভিখিরি—আর কি বলতে পারি? -এক সুযোগে টেবিলের ওপর রাখা খাবার বাক্সটি টান মেরে কেড়ে নেয়। কাজটি তারা করে ট্রেনটি যখন চলতে শুরু করেছে। যাত্রী ফোঁসফোঁস করে—আর কিছুই করতে পারেন না। তখন ট্রেনের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা শুরু হয়। সকলেই এক বাক্যে বলাবলি করেন, রেল কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই এই দৌরাত্ম্য। প্লাটফর্মে টিকিট না কেটে ওরা আসে কি করে? সে আলোচনায় আমিও সম্মতিসূচক মত দিই। দু’-একজন থাকেন তাঁরা একটি কথাও বলেন না। জানালার ভেতর দিয়ে দৃষ্টিকে আকাশে মেলে দিয়ে মলিন মুখে উদাস হয়ে কিছু ভাবেন তাঁরা। ট্রেন স্টেশন ছেড়ে সবুজের মধ্যে এসে পড়া সত্ত্বেও অনেকগুলো কঙ্কাল চোখের সামনে পিনপিন কিলবিল করতে থাকে। আর সবুজ? ছেলেবেলায় বাংলাদেশের গাছের পাতা, মাঠের ঘাস যেমন সবুজ দেখেছি, এখন সে-ই শ্যামলিমা চোখে পড়ে না। একটু যেন তামাটে হয়ে গেছে। ঘাস উঠে গেছে। মাঠকে রোঁয়া ওঠা বাদামি ধু-ধু সৈকত মনে হয়। বাংলাদেশের কি কোনো কঠিন অসুখ হয়েছে?
রেলগাড়ির চাকা আবার হঠাৎ তার শব্দ চৌদুলে তুললো। যেন পরীক্ষার আগে পড়াশোনায় অবহেলা করেছে, শেষ দু’হপ্তায়, মেকআপ করে নেবে। আমার চট্কা ভেঙে গেল। এমন সময় রেলের বেয়ারা আমার সামনে টেবিলের ওপর একটি লাঞ্চ বক্স রাখলো। সেটি চিটাগং কো- অপারেটিভ রেলওয়ে স্টোর বিল্ডিং-এর নিচে ‘স্যাভয়’ নামে যে কনফেকশনারি আছে, সেখান থেকে কেনা। আমার কাছে রাখলো কেন? বেয়ারাটি চলে যাচ্ছিলো। খপ করে তার হাত ধরে ফেলে জিগ্যেস করলাম, আমাকে কেন? বেয়ারা সুদূরের কোনো কম্পার্টমেন্টের দিকে একটি ইঙ্গিত করে বললো, ঐখানের এক বেগম সাহেব পাঠিয়েছেন। আমি আবার বললাম, আমাকেই পাঠিয়েছেন বুঝলে কি করে? বেয়ারা বললো, এই কামরার আর আপনার চেয়ারের নম্বর দিলেন। আমার আরো দু’একটি প্রশ্ন ছিল। কিন্তু অতো জেরার জবাব দেয়ার সময় বেয়ারার নেই। সে দ্রুত পায়ে অন্য কাজে চলে গেল।
আমার সামনের সেই ভারিক্কি ভদ্রলোকটির মুখের একটি রেখাও এদিক-ওদিক হলো না। একটিও নতুন রেখা মুখে ফুটে উঠলো না। বা যেগুলো আগে থেকেই ছিল, তার একটিও বিলীন হলো না। এমন ঘটনা যেন তিনি প্রতি মুহূর্তেই দেখছেন। সরকারি কাগজে তাঁর দরকারি মনোযোগ অটল থাকলো।
আমি ঠিক করলাম, যে মহিলাটি প্রথমে ভুল করে আমার সামনের চেয়ারটিতে বসে পড়েছিলেন, এবং টিকিট কালেক্টর বা কন্ডাক্টর যাঁকে অন্য একটি কক্ষে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, এই কাজটি তাঁরই; মানে, খাবার তিনিই পাঠিয়েছেন। আমার কামরা আর সিইটের নম্বর আর কোন মহিলা জানবেন? এই ব্যাখ্যাটির জন্য আমি আমার বুদ্ধির তারিফ করলাম। তিনি নম্বর-টম্বর জানতে পারেন। কিন্তু আমাকে খাবার পাঠালেন কেন? এই প্রশ্নটাই বেয়ারাকে করতে চেয়েছিলাম। তার তাড়া ছিল। চলে গেল। কথাটা জিজ্ঞাসাই করা হলো না। এখন সেই প্রশ্নটি নিজেকেই করলাম। এই মুহূর্তে আমার মাথার মগজ অলস হয়ে বসে আছে। তার কোনো তাড়া নেই। কিন্তু সেও কোনো জবাব দিতে পারলো না। যাই হোক, আমার খিদে পেয়েছে। স্যান্ডউইচ, কেক, সিদ্ধ ডিম, কলা কিছুই পড়ে থাকলো না। এটি করিডোর ট্রেন। এক কামরা থেকে আর এক কামরায় যাওয়া যায়। এক সময় উঠে গিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে আসবো।
বলতে ভুলে গেছি, আমি যেখানটায় বসে আছি, সেখান থেকে দুই সারি পেছনে, ডান দিকের ডবল সিটের দুটি মুখোমুখি আসনে চারজন সমবয়সী আর্য-সন্তান বসে আছে। ইরানের ছেলে। প্রাণ-প্রাচুর্যে টগবগ করছে কিন্তু তাদের কথায় হাসি সবই নিম্নস্বরে নিম্নগ্রামে। সৌজন্য কাকে বলে এরা জানে। যদিও খুব ফুর্তি করছে, অন্যের ফুর্তি বা কাজে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে। কি জানি কেন, আমার মনে হলো, এরা কোনো এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে এখানে ইউনিভার্সিটি লেভেলে লেখাপড়া করছে। এসব প্রোগ্রাম-টোগ্রাম সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই। কথাটা একেবারে আন্দাজে বললাম। আপনারা দার্জিলিং-এ পাগলা ঝোরা দেখেছেন? না, দেখেন নি। খুব সম্ভব, ব্রিটিশ আমলে দেখে না থাকলে, সে সম্ভাবনা খুবই কম। ছেলেগুলোকে ঠিক পাগলা ঝোরার মতো প্রাণের ফোয়ারা মনে হয়। এদের কথা সংক্ষেপে আবার আসবে। তাই এখানেই পরিচয় করিয়ে দিলাম।
হঠাৎ ক্যাচ ক্যাচ ক্যাচ ক্যাচ, কয়েকবার এই রকম শব্দ করে এবং প্রতিটি শব্দের সঙ্গে একটু একটু করে গতি মন্থর করে রেলগাড়িটি দাঁড়িয়ে পড়লো। এখানে দাঁড়াবে কেন? কুমিল্লা এখনো দূরে এবং ত্রিসীমানায় কোনো স্টেশনও নেই। আছে একটি এঁদো পুকুর। গুঞ্জন শোনা গেল, রেলগাড়ি সার্চ করা হবে। কেন? স্মাগলিং খুব বেড়ে গেছে। মাঝে মাঝে রাস্তায় গাড়ি ও ট্রেন থামিয়ে সারপ্রাইজ চেকিং হয়। দশ মিনিট ট্রেনটি নিষ্কর্মার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। চেকিং-টেকিং কিছুই হলো না। আবার চলতে শুরু করলো। তখন এক একজন এক এক কথা বললেন। কেউ বললেন, নিশ্চয় কেউ চেইন টেনেছিল। আর একজন বললেন, ড্রাইভার সিগন্যাল ক্লিয়ার পায় নি। আরো একজন বললো, ড্রাইভার চা খাবার জন্য নেমে পড়েছিল। বেচারা ড্রাইভারের বিরুদ্ধে এই অপবাদ যে সম্পূর্ণ অমূলক তা খুবই দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায়। কারণ, চা-পানের ব্যবস্থা ট্রেনের মধ্যেই আছে। এবং রেলগাড়ি যেখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল তার ধারে-কাছে কোথাও চায়ের দোকান নেই।
ডান দিকের টু-সিটের আসনে কোনোমতে জায়গা করে নিয়ে দু’জন ভদ্রলোক নামাজ পড়ছেন। আসরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। ট্রেনের আসনে নামাজের জায়গা করে নেয়া সহজ কাজ নয়। কিন্তু সেই দুই নামাজীর সুবিধা করে দেয়ার জন্য তাঁদের পাশের দুই ভদ্রলোক তাঁদের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। জানালা দিয়ে পশ্চিমের রোদ প্রবেশ করছে। আমি নিজে নামাজী নই; কিন্তু সত্যিকার ধর্মপ্রাণতার দৃশ্য আমার খুব ভালো লাগে।
হাওয়া বদলের জন্য এবার আমিও উঠলাম। আমি একটা কোনো কর্তব্যে অবহেলা করছি তা বেশ বুঝতে পারছি; কিন্তু কর্তব্যটাই মনে করতে পারছি না। সেই যে ভদ্রমহিলা আমাকে খাবার বাক্স পাঠিয়েছেন, তাঁকে ‘থ্যাংকস’ দেয়ার কথাটি আমার মনে আছে। দুটি কম্পার্টমেন্ট পেরিয়ে এসেই তাঁকে দেখতে পেলাম। একটু এগিয়ে গিয়ে ‘থ্যাংকস’-এর পালাটা সেরে ভারমুক্ত হতে পারি। কিন্তু ঠিক করলাম, ব্যাপারটাকে অমন হালকা-পলকা করবো না। ঘটনাটির মধ্যে কিছুটা ড্রামার স্বাদ আছে। আমি আমার ধন্যবাদটি দেয়ার জন্যও উপযুক্ত দৃশ্যের অপেক্ষা করবো। এই ট্রেনে খুব ভিড় হয়। আগে থেকে রিজারভেশনের দরকার হয়। কিন্তু লোকে যাই বলুক, জীবনে এখনো বিস্ময়ের জায়গা আছে। একটি চেয়ার দেখলাম খালি পড়ে আছে। সেটির ওপর বসে পড়লাম।
দু’জন আলাপ করছেন।
‘শেখ মুজিবের সেভেনটি-টুর গভর্নমেন্টকে ইল্লিগেল বললেন কি করে? সেভেনটির ইলেকশনে তিনি সারা পাকিস্তানের গভর্নমেন্ট ফর্ম করার ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন কিনা?’
অপর ভদ্রলোক ভালো ছেলের মতো মেনে নিলেন, ‘হ্যাঁ, পেয়েছিলেন?’
‘ইয়াহিয়া আর ভুট্টো পার্লামেন্ট বসতে দিয়েছিল?’
‘না, দেয় নি।’
‘তারপর বাংলাদেশে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ, হয়েছিল।’
‘তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো?’
‘হাঁ, হলো।’
‘এই বাংলাদেশই সেভেনটির ইলেকশনের সময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল?’
‘হ্যাঁ, তাও ছিল।’
‘তাহলে, শেখ সাহেব যদি সারা পাকিস্তানেরই গভর্নমেন্ট ফর্ম করবার ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন, তাহলে যে অঞ্চলে বলতে গেলে সেন্ট পার্সেন্ট ম্যান্ডেন্ট পেয়েছিলেন সেখানে তিনি গভর্নমেন্ট গঠন করবেন না তো কে করবে?’
‘তাও লোকে…’
‘আরো একটি কথা। বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলো স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে। বলতে পারেন রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের ভেতর দিয়ে। বিপ্লবের পরমুহূর্তেই তো আর নির্বাচিত সরকার হতে পারে না। বিপ্লবের নেতারাই সরকার গঠন করেন। তবু তো শেখ সাহেব সেভেনটি থ্রিতে ইলেকশন দিয়ে আবার দেখিয়ে দিলেন সরকার গঠনের অধিকার কার…’
একজন ছিলেন বক্তা। একজন শ্রোতা। কিন্তু বক্তা হঠাৎ গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘এ আলোচনা থাক। এখন আর একজনের শাসনামল। রেডিও-টেলিভিশন দেখে বুঝতে পারবেন শেখ মুজিবুর রহমান নামে একজন ছিলেন? স্মৃতি থেকে তাঁকে মুছে ফেলার জন্য কিনা করা হচ্ছে? শেখ সাহেবের নাম উচ্চারণ করাও মানা।’
শ্রোতা বললেন, ‘না, অতো আর কি। লোকে তো তবু বলছে।
বক্তা বললেন, ‘চুপ। পাশের ঐ ভদ্রলোকটি কেমন এসে নিঃশব্দে বসে পড়লেন, দেখলেন তো!’
শ্রোতা বললেন, ‘ট্রেনটি এমন ঝনঝন শব্দ করছে যে ঠিক নিঃশব্দেই বসে পড়লেন তা বলা সম্ভব নয়। তাছাড়া, কোথাও বসলে তেমন একটা আওয়াজ হয়ও না। চেয়ারের পায়ার শব্দ হবে, এখানে সেটাও সম্ভব নয়। সবগুলো চেয়ারের পা ফ্লোরের সঙ্গে একেবারে গাঁথা।’
‘তবু, বলা যায় না। লোকটি পুলিশের খোঁচড় হতে পারে।’
আমি ভাবলাম, উঠে এসে ভালোই করেছিলাম। একঘেয়ে যাত্রায় একটা রিক্রিয়েশন হলো। আমি কিন্তু বলছি দীর্ঘকাল আগের কথা।
অনতিদূরে দুই ইয়ংম্যানকে দেখলাম। বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। একজনের চোখে নীল চশমা, গায়ের প্যান্ট-শার্টের ছাট ভালো। স্বাস্থ্য বেশ দামড়া গোছের কিন্তু মস্তান মনে হয় না। কিন্তু তার মুখের ভাষা শুনে তার সম্পর্কে কোন্ ধারণাটা ঠিক হবে বলা দুরূহ হয়ে গেল। সে তার সঙ্গীকে বলছে, ‘জানিস, আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় আছে। তার স্ত্রীটি আমাকে দু’চোখে দেখতে পারে না; কারণ আমি তাদের কাছে নিয়মিত গিয়ে টিপ করে আসি না। এই সো-কলড আত্মীয়াটির বাপ শুনেছি ব্রিটিশ আমলে মন্ত্রী-টন্ত্রী ছিল। মন্ত্রী না হলেও মাতব্বর গোছের কিছু ছিল। তাই খুব সালাম পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নিজে সে কলেজের ডিগ্রি-টিগ্রি পেয়েছে, কিন্তু আসলে আকাট মূর্খ। মুখে সবসময় বড়ো বড়ো কথা। আর মুখে উপদেশের ফোয়ারা ছুটছে। ভাবখানা এই, তাঁর সার্টিফিকেট না পেলে তুমি মানুষই না! তা, আমি শালা তাকে সালাম বাগাতে যাবো কেন? তার কি কোনো সুন্দরী বোন আছে অবিবাহিতা? আর আমিই কি বানের পানিতে ভেসে এসেছি? যা হোক একটা চাকরি করি না? বি.এ-তে একটা সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট আছে না? বেটি বলে কি জানিস আমার সম্পর্কে? বলে, দু’পয়সার লোকটা নিজেকে কী যে মনে করে! আচ্ছা, তুই-ই বল, আমি দু’পয়সার লোক? তাছাড়া, আমি নিজেকে যা খুশি তাই মনে করবো, তোর বাপের তাতে কি? আমি নিজেকে যা মনে করি, তুইও আমাকে তাই মনে কর এমন আবদার তো তোর কাছে আমি করি নি।’
মানতেই হবে ছোকরার জিভে ধার আছে বা তা হয়তো ভোঁতা ছুরির মার। কিন্তু যে বি.এ-তে সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে তার জবান আর একটু দুরস্ত হবে বলে লোকে আশা করবে।
রাগী ছেলেটি তখনো তার কথা শেষ করে নি।
সে বললো, ‘সেই ভদ্রমহিলা মনে করেন, তিনি আমাদের আত্মীয় মহলে বিয়ে করে আমাদের ধন্য করে দিয়েছেন। আত্মীয় মহলের কোনো গ্যাদারিং হলে যারা গণ্যমান্য বেছে বেছে কেবল তাদের সঙ্গে মেলামেশা করবেন। ভদ্রতা ও সৌজন্য তাঁর মনে জায়গা পায় নি; কিন্তু আচরণে তার প্রাচুর্য যে উপচে উঠতে পারে এই সময় তা বোঝা যায়। রুটির কোন দিকে যে মাখন লাগানো আছে তিনি বিলক্ষণ জানেন। আর যারা তেমন বিশিষ্ট নয়, তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। যেন তাদের কোনোদিন চোখেও দেখেন নি!’
এইবার সঙ্গের যুবকটি বললো, ‘তার মানে রুটির কোনো দিকে মাখন লাগানো নেই, তাও তিনি বিলক্ষণ জানেন!’
‘এগজ্যাকটলি!’
‘কিন্তু দোস্ত, তোর ভাষাটা মাঝে মাঝে বড়োই ভোঁতা হয়ে পড়ে।
‘কি করবো বল। কোনো কোনো লোক অন্য কোনো ভাষা বোঝেই না।’
‘তা, এখনই তোর প্রিয় আত্মীয়ার কথা মনে পড়লো কেন?’
‘তার কারণ তিনি এই ট্রেনেই আছেন। এবং কিছু আগেই সেই নবাবজাদীর কাছ থেকে রূঢ় ব্যবহার লাভ করেছি।’
‘আমার ভাবি কিন্তু একেবারে অন্যরকম মানুষ। তিনিও মস্ত বড়লোকের মেয়ে। কিন্তু আমাদেরকে ঠিক নিজের ভাইবোনের মতো দেখেন। আমরাও বলতে গেলে তাঁকে মায়ের মতো দেখি। তাঁকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি ভয় করি। আমাদের যতো দরকার ভাবির কাছে। বহু আগে একবার শুধু একটা গোলমাল হয়েছিল। মেজ ভাই প্রথমদিকে ভাবিকে বুঝতে পারেন নি। তিনি ভাবিকে বোঝাতে চেয়েছিলেন ভাইয়ের জোরেই বাড়িতে তাঁর জোর, ভাবিকে পাত্তা দেয়ার দরকার নেই। তখন যদি ভাবিকে দেখতিস। ভাবি এমনিতে খুব কোমল, ভদ্র, গলা চড়েই না; কিন্তু মেজ ভাইয়ের এ্যাটিচুট দেখে বড় ভাইকে সোজা বলে দিয়েছিলেন, এ সংসার আমার। তোমার থ্র-তে এ বাড়িতে কেউ জোর খাটাতে পারবে না। এটা সবাইকে সাফ করে বুঝিয়ে দিও। এমনকি আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে তুমি পর্যন্ত এ সংসারে কোনো রদবদল করতে পারবে না। এটা সকলেরই বুঝে নেয়া দরকার। আমি এ সংসারে কর্ত্রী হয়ে এসেছি, দাসী হয়ে আসি নি। ঐ একটি ব্যাপার তিনি একেবারে আনকমপ্রোমাইজিং। কিন্তু আমাদের ভালোবাসেন ঠিক ভাইবোনের মতো। আমরাই বরং এক্সপ্লয়েট করি। আর মজা কি জানিস? মেজ ভাই বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেল। বড়ো ভাইয়ের বাড়িতে তার রাইটফুল অধিকার আছে; বড়ো ভাই বাড়ির হায়ারার্কিতে নাম্বার ওয়ান; মেজ ভাই নাম্বার টু; আর ভাবি কোনো ফ্যাক্টর-ই নয়। মেজ ভাই এই ফিলসফিতে বিশ্বাস করে। তাই মেজ ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠতে আমার কোনো দ্বিধাই আসে নি। কিন্তু মেজ ভাই আর ভাবি দু’দিনেই বুঝিয়ে দিলো সংসার ও বাড়িটা তাদের। অধিকার তো দূরের কথা আমি এক উৎপাত মাত্র। সত্যিই তো, আমার কোনো অধিকার নেই। অধিকার দিলেই আছে, নইলে সত্যিই তো আমি কেউ নই। সেই অধিকার আমাকে দিয়েছে বড়ো ভাবি। মাইনের টাকা সব তাঁর হাতে এনে দিই। তিনি নিজের হাতে আমার ব্যাংক আকাউন্টে জমা দেন। যখন দরকার চেয়ে নিই। আমার তো মনে হয় না আমার আকাউন্টের একটি পয়সাও খরচ হয়।
একই যাত্রায় তিন সংসারের তিন রকম কাহিনী শুনলাম। এই বহুবর্ণ বৈচিত্র্যের নামই জীবন। ট্রেন এখানে আবার এক পেল্লায় লাফ দিলো। অনেকেরই অভিজ্ঞ অভিমত ট্রেনের পায়ের তলায় একটা মস্ত পাথর পড়েছিল। কেউ বললেন, না, জিনিসটা একটা গরু। তাতে অবশ্য ট্রেনের কিছু হয় নি। পাথরই হোক, আর বাছুরই হোক, সেটাই গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল। ট্রেনটিকে অবশ্য ইচ্ছার বিরুদ্ধেই একটা ভীষণ ঝাঁকুনি খেতে হলো। আর আমাদের পিলেটা একটু চমকে গিয়েছিল। এবং এই ঘটনাটি ঘটেছিল বলেই আমার বুদ্ধির জট খুলে গেল। কী একটা কর্তব্য আমাকে দেয়া হয়েছে অথচ সেটাই মনে পড়ছে না। ট্রেনের উল্লম্ফনের পর একই সঙ্গে কর্তব্য মনে পড়ে গেল ও খচ্খচানি দূর হলো। এবং কর্তব্যটা সারবার জন্য বা শুরু করবার জন্য আমাকে এবার উঠতে হলো।
জীনাতকে মনে আছে? মনে নেই? তাহলেই বুঝুন, আমি একাই সব ভুলে যাই নি। সেই যে আমার স্ত্রীর বান্ধবী, যিনি চিটাগাং স্টেশনে তাঁর মেয়েকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, মেয়েটি একাই ঢাকা যাচ্ছে, মানে একা তো আর নয়, কোনো চেনা সঙ্গী নেই, তার ওপর যেন একটু চোখ রাখি, মানে একটু যেন দেখাশোনা করি। সর্বনাশ, কুমিল্লা এসে গেল প্রায়, মেয়েটিকে একটিবারও দেখি নি, একবারও তার গলার আওয়াজ শুনি নি। তার মুখটা দেখলে বা গলাটা শুনলে যে কোনোটাই চিনবো সে ভরসাও নেই। কারণ তাকে আমি ভালো করে লক্ষ্যই করি নি। আর আমার উপস্থিতিকালে সে একটি কথাও বলে নি যে গলাটা পরিচিত হয়ে যাবে। তবে যেন মনে হচ্ছে এই কক্ষটিতেই সে উঠেছিল। যেদিকটায় সে বসেছিল সেদিকে নিঃসঙ্গ একজনকেও দেখলাম না। একটা টু-সিটারে তারই বয়সী একটি মেয়ে আছে বটে, কিন্তু তার পাশে এক যুবকও আছে এবং তারা দু’জনেই এমনভাবে কলকলাচ্ছে যে তাদের পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ আর প্রিয় মনে হচ্ছে, সুতরাং এ মেয়ে সে নয়। একে দেখবার লোক আছে। অবশ্য এই কক্ষটিতেই সে উঠেছিল, আমার মনটা পরিশ্রমবিমুখ বলে সেটাই আন্দাজ করে নিলেও আসলে তা নাও হতে পারে। সব ক’টি কক্ষই একই রকম দেখতে। আমি যে ফিরে গিয়ে আমার কামরাটি চিনতে পারবো, সে কামরাটির জন্য নয়। আমার সামনে যে যাত্রীটি বসে আছেন তাঁর উপস্থিতিই আমাকে আমার কামরা আর আসন চিনিয়ে দেবে। অবশ্য কম্পার্টমেন্টগুলোর আলাদা আলাদা নম্বর আছে। কিন্তু অতো আর কে মনে রাখে!
তবু চারদিক ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। এক কোণে ভদ্রমহিলা আপাদমস্তক বোরখায় ঢেকে বসে আছেন। আমার মনে হলো—মনে কি না হয়?—যে বোরখার চোখের সামনে যে ফুটো আছে তার ভেতর দিয়ে তিনি বারবার আমাকে দেখছেন। তাঁর পাশে একটি বালক বসে আছে।
আর ঠিক আমার দিকে মুখ করে, সামনের দুটি আসন বাদে বসে আছেন সেই মহিলা যিনি বেমালুম ভুল করে আমার সামনের আসনে বসেছিলেন এবং সমালুম আমাকে একটি লাঞ্চ বক্স পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমি আমার অনুরাগ জানাবার জন্য বারবার তাঁর চোখে চোখ রাখতে চেষ্টা করছি; কিন্তু তাঁর ভাবভঙ্গিতে একটুও প্রকাশ পাচ্ছে না যে তিনি আমাকে একবারও চোখের দেখাটি পর্যন্ত দেখেছেন। কোনো কোনো ব্যক্তি অলক্ষ্যে উপকার করেন, জানতে দিতে চান না। এই মহিলাও পরিচয়ের কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছেন না, পাছে আমি বুঝে ফেলি তিনিই উপকারিণী। তাঁর সামনে বসে আছেন আর এক মহিলা। তাঁদের আলাপের ধরন দেখে মনে হলো তাঁরা পরস্পরের পরিচিতা। হঠাৎ ট্রেনে দেখা হয়ে গেছে। তাঁরা কোনো গুরুতর বিষয়ে আলাপ করছিলেন।
এই সময় একটা আওয়াজ শোনা গেল—মনে হলো কোনো মানব নয়, বাতাস শব্দটির জন্ম দিয়েছে। আরো দু’বার সেই আওয়াজটি শুনতে পেলাম। ‘আনকেল, আনকেল’। শব্দ অনুসরণ করে দেখলাম সেই মেয়েটি। যে কলকলাচ্ছিল।
‘জি, আমি এখানে।’
তাহলে এই মেয়েটিই আমার স্ত্রী বন্ধু জীনাতের কন্যা! কিন্তু তার সফরসঙ্গী নেই, এ কথা বলা হয়েছিল কেন?
আমি উঠে তার কাছে গেলাম।
মেয়েটি বললো, ‘আমার ‘কাজিন’। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।’
আমি আর কোনো কথা না বলে আমার আসনে যেখানে আমি এখন অনধিকার বসে আছি, সেখানে ফিরে এলাম। আমার অপবিত্র মনে এই চিন্তা এলো যে দেখাটা হঠাৎ নয়। আগে থেকেই ঠিক করা। মেয়েটির মা তা জানেন না। মেয়েটির মুখ ভালো করে দেখে রেখেছি। জীনাত আমাকে আর একটি কাজ দিয়েছেন। ঢাকা স্টেশন মোটর থাকবে। আমি যেন মেয়েটিকে গাড়িতে তুলে দিই। তার খুব প্রয়োজন হবে মনে হচ্ছে না। কিন্তু আমি যে কথা দিয়েছি সে কাজটি করবার চেষ্টা করতে হবে।
হঠাৎ দিনটা বাদলা হয়ে এলো। একটু ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। অনেকক্ষণ থেকে। দেখতে পাচ্ছি, আমার নিমেষের সেই সম্মুখবর্তিনী মহিলাকে তাঁর বর্তমান সঙ্গিনী একটা কিছু অনুরোধ করছেন। সেই অনুরোধের বৃন্তেই ফল ফললো কিনা জানি না। কিন্তু হঠাৎ বাতাসের গায়ে একটি করুণ গান লুটোপুটি করতে শুরু করলো। সেই মহিলাই গাইছেন : ‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ, তেমনি করে গাও গো’। তিনি গাইছেন এবং আমরা সকলেই তন্ময় হয়ে কান পেতে শুনছি। ভদ্রমহিলা পরিবেশের সঙ্গে গানটিকে কী আশ্চর্যভাবে মিলিয়ে দিলেন। এক সময় গান শেষ হলো। আবার গাইবার অনুরোধ এলো। কিন্তু ভদ্রমহিলা দ্বিতীয়বার গাইলেন না। আমার আর একটি আশ্চর্য অনুভূতি হলো। মনে হলো, সেই বোরখাপরা মহিলা চোখের ফুটো দিয়ে আমার তন্ময় ভাব লক্ষ্য করছেন। এক মুহূর্তের অসাবধানে বোরখাপরা মহিলার একটি হাত অনাবৃত হয়ে গিয়েছিল। অমন আশ্চর্য সুন্দর হাত আমি দেখি নি। এবং সেই সঙ্গে আর একটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক কথা এলো মনে। যে মহিলা অমন সুন্দরী, অমন উচ্চাঙ্গের বিদ্যালাপ করতে পারেন, এক অপরিচিত লোককে লাঞ্চ বক্স পাঠিয়ে দিতে পারেন, তাঁর গলা থেকে এমন গানও বেরুতে পারে, চিন্তাই করতে পারি নি।
গানটির রেশ অনেকক্ষণ কামরাটিকে আচ্ছন্ন করে রাখলো; কিন্তু রেশ এক সময় কেটে গেল।
কুমিল্লা স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ করছে। আমি উঠলাম। একবার প্লাটফর্মে অল্পক্ষণের জন্য খোলা হাওয়ার নিচে দাঁড়াবো।
শুনলাম আমার ট্রেনের অন্নদায়িনীকে তাঁর সঙ্গী একটি বই থেকে পড়ে শোনাচ্ছেন : Machiavelli accounted for the cyclical nature of history by the eternal sameness of men but christian histriography, added the eternal sameness of God’s justice.
বাপরে! এই ট্রেনটিকে তো সহজেই এক ভ্রাম্যমাণ বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায়।