এক
আমি যে গল্পটি বলতে বসেছি সেটি শুনতে ইচ্ছুক হবেন ক’জনা বলতে পারবো না। কারণ গল্পটিতে রোমান্সের যে অংশটুকু আছে, তা খুবই বাসি আর যতোটুক এ্যাডভেঞ্চার আছে, খবরের কাগজগুলো নিত্যই তার ঢের বেশি পরিবেশন করছে। এই কাহিনীর মধ্যে খানিকটা গোয়েন্দা কাহিনীর রহস্য আছে। এবং লেখাটিতে যে কমেডিটুকু আছে তা পাঠ করে আপনাদের হাসির বদলে কান্নাও পেতে পারে।
আমাকে কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ধরে ঢাকা আসতে হচ্ছে। এই রেলগাড়িটা চিটাগাং রেলস্টেশন থেকে বেলা বারোটা কিংবা একটায় ছাড়ে, এখন বলতে পারবো না; কারণ বলতে বসেছি অনেক দিন আগেকার ঘটনা, সবকিছুর খুঁটিনাটি মনেও নেই, এবং যেহেতু ট্রেনের টাইমটেবিল গোচর করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, তাই সেটা কোনো কৌতূহলের বিষয় নয়। তবে সময়টা তারই ধারে-কাছে কোথাও হবে।
এই ট্রেনে শোবার ব্যবস্থা নেই। গদি-আঁটা চেয়ারে মুখোমুখি বসে সারাটা পথ যেতে হয়। কিন্তু এই বিশেষ ট্রেন সার্ভিসটি একটি আলাদা আভিজাত্য লাভ করেছিল—সেটা, শোবার ব্যবস্থা নেই বলেই কিনা বলতে পারবো না। এক এক দেশে এক এক জিনিস এক এক কারণে মূল্য লাভ করে। শুনেছি কোনো কোনো দেশে হাঁস, মুরগি, টার্কির তুলনায় ভোজনাগারগুলোতে সাপ, ব্যাঙ, পিঁপড়েরর চচ্চড়ি, অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনে খেতে হয়। এই ট্রেনটির দুটি মস্ত সুবিধা আছে। একটি এই যে, নির্দিষ্টসংখ্যক টিকিট বিক্রি হয়, দিনের ট্রেন হলেও আপনার আসনটি সুরক্ষিত—যদিও আপনার মাথার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে, আপনার ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছেন, এমন দৃশ্যও একেবারে বিরল নয়। ঘটনাটিকে দৃশ্য বলেই ছেড়ে দিতে পারতাম; কিন্তু আপনার নিজের ঘাড়টাই যখন ওভাবে বাতাস খায়, তখন সেটাকে একটা অভিজ্ঞতাই বলতে হবে। দ্বিতীয় সুবিধাটি হচ্ছে, এই ট্রেনটির সঙ্গে সংলগ্ন একটি ডাইনিংকার আছে। যা পাওয়া যায় তার মধ্যে পিঁপড়ে বা ব্যাঙ স্বভাবতই নেই। সুতরাং সে আপনি পাবেন না, যা পাবেন তাও খাবেন কিনা সেটা আপনার রুচি এবং পেটের ক্ষুধা কী হালে আছে, তার ওপর নির্ভর করবে।
রেলকক্ষগুলোর একপাশে আছে দুজন করে বসবার আসন; আর একপাশে আছে একজনের বসবার চেয়ার। সবগুলোই মুখোমুখি। রেল কর্তৃপক্ষ ধরেই নিয়েছেন হামসফররা সকলেই পরস্পরের অন্তরঙ্গ বন্ধু বা নিকট আত্মীয়। দিব্যি গল্প করতে করতে যাত্রাটা সারতে পারবেন। মাঝখানে টেবিল। এই টেবিল দুটি কাজে আসে। খাবার রেখে খেতে পারবেন। আবার কনুই রেখে সামনে একটু ঝুঁকে সম্মুখের যাত্রীর সঙ্গে কথাও বলতে পারবেন। আপনার সব কথা তো আর সকলের কানের জন্য নয়। তাছাড়া, ট্রেনের ঝাঁকুনি আর কাঁপুনি এমন শব্দের ঝড় তোলে, ঘরে যে ব্যবধানে বসেও কথা শ্রুতিগোচর করা যায়, ট্রেনে সেটা সম্ভব নয়। এই রেলগাড়িটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং দু’দিকের আসনের মাঝখানে যে করিডোর আছে, তাঁর ওপর দিয়ে হেঁটে গাড়িটির এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত চলে যেতে পারবেন। কল্পনার পুঁজির ওপর সামান্য একটু খামছি দিলে আপনি বৃটিশ আমলের সেই বিখ্যাত নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসের কথা স্মরণ করতে পারবেন। আজকালকার কেনাবেচা ও দরপত্রের জগতে যে স্যাম্পল বা নমুনা দেখানো হয় তার সঙ্গে সরবরাহকৃত বস্তুটির মিল যেমন সব ক্ষেত্রে থাকে না, অমিলটাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থাকে, তেমনি আপনার কল্পনায় যে দুটি রেলগাড়ির নমুনা আপনি নেড়েচেড়ে দেখছেন এবং যে রেলগাড়িটিতে বসে আপনার নিজের শরীরটাই এখন ঝাঁকুনি খাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যেও মিল ও অমিল ততোটাই-বা ততোধিক। তবু, জীবনের ফাঁকিগুলোকে খানিকটা কল্পনাবিলাস দিয়ে পূর্ণ করে না নিলে, সভ্য মানুষ কি আর এ জগতে বাস করতে পারবে?
আপনারা ভাবছেন, আমি এই ট্রেনের কথা এতো করে কেন বলছি? বুঝতেই পারছেন, আমার বলবার কথা বেশি নেই। অন্তত আপনারা শুনতে চাইবেন, এমন কথার সঞ্চয় খুব কম।
দু’তিনজন কিশোর ট্রেনের ভেতরে উঠে হাতে অনেকগুলো সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা আর হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ফেরি করছে। ক্রেতার কোনো অভাব নেই, কিন্তু ডানদিকের আসনে আমার পঙ্ক্তির এক শ্রেণী আগে একজন রাশভারি লোক খুব মন দিয়ে একটি ইংরেজি বই পড়ছেন—খুব সম্ভব কোনো গোয়েন্দা কাহিনী। তিনি বাংলা বইগুলোর দিকে ফিরেও তাকালেন না। সেগুলো যেন তাঁর মনোযোগের লায়েকই না। একা একা ট্রেনে বসে থাকলে, বিশেষ করে যদি ট্রেনটি স্থির হয়ে আছে, তখনো যাত্রা শুরু করে নি, তখন মাথায় নানান উটকো চিন্তা আর মনের ভেতর উদ্ভট ইচ্ছা কাজ করতে থাকে। একবার ভাবলাম, সেই কালো লোকটিকে বলি, ‘কেন সাহেব, বাংলাদেশের সাহিত্য কি আপনার শেভিং লোশন সুরভিত আঙুলগুলোর স্পর্শ লাভ করবার যোগ্য নয়?’ কিন্তু কেন জানি, আমাদের নিজের সাহিত্যের হয়ে ওভাবে গায়ে পড়ে ওকালতি করবার জন্য গলায় সে রকম জোর পেলাম না। যদিও বিশ্বাস করুন, হুমায়ূন আহমেদ আর তাঁর সাহিত্য উভয়কেই আমি স্নেহ করি। ‘স্নেহ’ শব্দটি ব্যবহার করছি বলে যদি কোনো টেরা-বুদ্ধির লোক হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য সম্পর্কে আমার বক্তব্যের কদর্থ করেন, তাই তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থটির দিকে। সেখানে ‘স্নেহ’ শব্দের বিভিন্ন অর্থের একট হচ্ছে ‘অনুরাগ’। আমি যদি বলতাম, আমি তাঁর সাহিত্যের ‘অনুরাগী’ তাহলে তো আর কোনো ঝুটঝামেলা হতো না? কিন্তু আমাকে আমার ভাষাই ব্যবহার করতে দিন না। প্রতিবাদে করলাম না, কারণ কাজটা অপরের স্বাধীন ইচ্ছা-চর্চার যে অধিকার আছে তার বিরুদ্ধে যায়। আরো বড়ো একটি কারণ আছে। আমি নিজেই একটি বইও কিনি নি আমার হাতেও একটি ইংরেজি উপন্যাস। তবু আমাকে ক্ষমা করা যায়। বইটি আমি ঐ লোকটির মতো পড়ছি না—একটি শিশুর মতো বইটি আমার কোলে শান্ত হয়ে পড়ে আছে, চেঁচামেচি করছে না। ট্রেনটি ছাড়বার পর যে বইটি নিয়ে বসবো এবং বিশ্বচরাচরের আর সবকিছু ভুলে যাবো, তা একেবারেই চিন্তা করা যায় না। এখানকার চলমান ট্রেনে আপনি আর যা খুশি করতে পারেন—প্রেম ও ডাকাতি পর্যন্ত, কিন্তু দুটি কাজ কিছুতেই পারবেন না। ট্রেনটি এতো লাফ দিয়ে দিয়ে দৌড় দেয় যে চোখের সামনে বইয়ের লাইনগুলো আপনার হাতের সঙ্গে নৃত্য শুরু করে দেয়। আপনি এক অভিনব নাচ দেখতে পাবেন— কিন্তু পাঠ? অসম্ভব। আর সেই অবস্থায় চা-পানের মতো বিলাসিতা? চেষ্টা করে দেখুন কাপটিসুদ্ধ একটি দুরন্ত শিশুর মতো আপনার মুখে, বুকে, কোলে তার সমস্ত উষ্ণ ভালোবাসা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
এখন আমার চোখ জানালার বাইরে প্লাটফর্ম দেখছে। সেখান আলাদাভাবে কিছু চোখে পড়বার আগে প্লাটফর্মের সম্মিলিত ছবিটিই প্রথমে ফুটে ওঠে। জায়গাটিতে এতোরকম বৈচিত্র্য আর বৈষম্য আছে যে মনে হয় সারাদেশের একটি প্রতীকী চিত্র দেখছি। একটু একটু করে অন্ধকার যেমন চোখে সয়ে আসে, তেমনি স্টেশনের আলাদা আলাদা বস্তু ও লোকজনও আপনার চোখের কাছে তাদের দাবি জানাতে থাকে।
সেইভাবেই দাবি জানালেন এক মহিলা। প্লাটফর্মে একটি ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা নিজের বয়স পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ হবে। তাঁকে অনেক আগেই আমি দেখেছি, কিন্তু লক্ষ্য করি নি। তবে মনে হয়েছে, যেন তাঁকে চিনি। আরো একটু বেশি মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, তিনি আমার স্ত্রীর বান্ধবী জীনাত। তাই যদি হয়, বয়স পঁয়ত্রিশ নয়, চল্লিশ হবে— পাঁচটি বছর চোখকে ফাঁকি দিয়ে আড়াল করে আছে প্রসাধনের পেছনে। আমার স্ত্রীর সব বান্ধবীকেই আমি ভালো করে চিনি না, সেরকম দেখাশোনা হয় নি বলে। এই ভদ্রমহিলা তাঁদেরই একজন। আমি জানালার ধারে এক আসনের চেয়ারে বসে আছি। জীনাত তা দেখেছেন। আমাকে দেখে দু’একবার তাঁর মুখ উজ্জ্বল বা আলোকিত হয়ে উঠেছে। না, তা আমার ব্যক্তিত্ব বা রূপের আকর্ষণে নয়; অন্য কোনো কারণে। সেটা দেখতেই পেয়েছি। আমার মনে হচ্ছিলো, তিনি আমাকে কিছু বলতে চান; কিন্তু সেই উদ্যোগ নেয়াটা ঠিক হবে কিনা স্থির করতে না পেরে ইতস্তত করছেন। আমি নিজেও কোনো অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারছি না। কারণ আমি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারি নি, ইনিই আমার স্ত্রীর বান্ধবী জীনাত।
এবার আমি আমার দুটি চোখের পূর্ণ দৃষ্টি মহিলার মুখের ওপর রাখলাম। অমনি তিনি হাত তুলে আমাকে সালাম দিলেন। আমার আর সন্দেহ থাকলো না, ইনিই জীনাত। আমার সালামটা তাঁর চোখেই পড়লো না, তা তাঁর মাথার ওপর দিয়ে অন্য কোথাও চলে গেল, এবং জীনাত বেশ দ্রুত পদে আমার দিকে এগিয়ে এলেন।
‘চিনতে পারছেন?’
‘কি যে বলেন!’ আমি আমার এতোক্ষণের অসৌজন্যতাকে কাটিয়ে দেয়ার জন্য ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মের ওপর এসে দাঁড়ালাম।
‘ভাই, আপনাকে একটু কষ্ট দেবো। আমার এই মেয়েটি ঢাকা যাচ্ছে। সঙ্গে কেউ নেই। আপনি যদি মেহেরবানি করে এর ওপর একটু চোখ রাখেন।’
‘না না। কষ্টের কোনো কথাই নেই; কিন্তু এই ট্রেনের সিটগুলো তো রিজার্ভ করা। যেখানে খুশি বসা যায় না। মেয়েটির সিট পড়েছে কোথায়?’
‘আপনার পাশের কম্পার্টমেন্টেই। মাঝে মাঝে একটু কষ্ট করে উঠে একবার দেখে আসবেন। আর কোনো অসুবিধা হবে না ঢাকা স্টেশনে গাড়ি থাকবে। একটু কষ্ট করে গাড়ি পর্যন্ত তুলে দেবেন।’
এই ভদ্রমহিলাকে একটু আগেই সুন্দরী মনে হয়েছিল। এখন আর হচ্ছে না। আমি খুব স্বার্থপর লোক। এসব জঞ্জাট একেবারেই পছন্দ করি না।
তিনজনেই ট্রেনে উঠলাম। মেয়েটি তার আসনে বসলো। তার আসনটি আমি চিনে নিলাম। মেয়েটি তার মাকে বললো, ‘তুমি আর মিছেমিছি দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে? এবার বাড়ি যাও।’
কথাটার মধ্যে যুক্তি ছিল। মা চলে গেলেন। আমি আমার জায়গায় ফিরে এলাম।
আমার আসনে ফিরে এসে দেখি, আমার মুখোমুখি আসনটিতে ভারি সুন্দরী এক মহিলা বসে আছেন। আমার সঙ্গে কথা শুরু করলেন না বটে; কিন্তু সামান্য একটু হাসলেন। তারই মধ্যে আভাস ছিল, সাড়ে ছ’ঘণ্টার এই জার্নিতে তো আর ওভাবে চুপ করে বসে থাকা যায় না, দু’ একটি কথাও হবে। চুপচাপ বসে থাকা যায় না, বললাম বটে, কিন্তু যায়। আমি নিজেই একটি কথাও না বলে এই ট্রেনে বহুবার যাতায়াত করেছি। প্রত্যেকবারই সামনে পুরুষযাত্রী পেয়েছি। অপরিচিত লোকের অতো নিকট সান্নিধ্যে আমি নিজেই একেবারে কুঁকড়ে যাই। আর কথা? কথার উৎসটাই শুকিয়ে যায়। তাঁরা এতো ফজুল কথা বলেন যে দেমাগটাই বিগড়ে যায়। কিন্তু এই মহিলা কথা বললে আমিও বলবো। তাঁর ফজুল কথাও ভালো লাগবে। একটু আগেই মনের মধ্যে যে বিরক্তি জমে উঠেছিল, অলরেডি তা উবে গেছে। ভদ্রমহিলা যে পারফিউম ব্যবহার করেছেন তা চড়া গন্ধের নয়। খুব নম্র সুগন্ধ। দেখে মনে হচ্ছে তিনি স্নান করে আসেন নি। পাউডার, পারফিউম, আর ঘামের মিশ্র গন্ধ এরই মধ্যে এমন একটা আমেজ সৃষ্টি করেছে যে নিজেকে আচ্ছন্ন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছেন সেই মিশ্র গন্ধ আমার কাছে এক অন্তরঙ্গ বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। আর আমি মনে মনে তাঁর কাছে আমার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছি। আপনি অনুগ্রহ করে উঠে যাবেন না। গেলে, এই দীর্ঘপথ আমার কাছে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গ মনে হবে। না, আমি আপনার প্রেমে পড়ি নি। এখন আর সেরকম ছেলেমানুষ নই যে পথে পথে প্রেম কুড়িয়ে বেড়াবো; কিন্তু এই পথটুকু আমার সঙ্গেই থাকুন।
ট্রেন আজ ‘লেট’ আছে মনে হচ্ছে। ‘লেট হওয়া’ বলে যখন একটা কথা আছে, ‘লেট’ থাকতেই পারে। অস্থির হয়ে লাভ নেই। মেনে নিতে হবে।
এমন সময় টিকিট কালেক্টর দেখা দিলেন। তাঁর পাশে বেজায় গম্ভীর এক লোক। আমি পকেটে হাত দিয়ে টিকিটটা বের করলাম। কিন্তু কালেক্টর আমার টিকিট দেখতে চাইলেন না। আমার সম্মুখবর্তিনী মহিলার দিকে সামান্য ঝুঁকে খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, কিছু মনে করবেন না, আপনার টিকিটটা একটু দেখতে পারি? এই মহিলা যে বিনা টিকিটে ভ্রমণ করবেন, কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। আমার অজান্তেই আমার হাত আমার পার্স-এর দিকে এগিয়ে গেল। জীবনে খুবই অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটে। মহিলা যদি টিকিট ছাড়াই উঠেছেন তাহলে টিকিটের মাসুল আমি দেবো; কিন্তু তিনি উঠে চলে যাবেন, সে মাসুল আমার ভালো লাগবে না। কিন্তু না, সেরকম কিছুই না। ব্যাগ থেকে মহিলা টিকিট বের করলেন। যে হাতে তিনি টিকিট ধরে আছেন—অমন একটি শান্ত হাত আমি জীবনে দুটি দেখি নি।
কালেক্টর বললেন, কিছু মনে করবেন না। একটা ভুল হয়ে গেছে। আসলে পাশে কম্পার্টমেন্টে এই একই নম্বর সিটটি আপনার।
ভদ্রমহিলা কিছুই মনে করলেন না। মালপত্র বলতে তাঁর সঙ্গে একটি মাঝারি সাইজের ‘লাস্ট মিনিট ব্যাগ’। এরোপ্লেনের আসনের মাথার কাছে টুকিটাকি জিনিস রাখবার জন্য যে রকম ছোটো ছোটো খুপরি আছে, এই ট্রেনেও তা আছে। কোনোরকম অস্থিরতা বা বিরক্তি না দেখিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, আর দু’হাত সেই খুপরিগুলোর একটি থেকে তাঁর সামান্য লাগেজ নামিয়ে নিলেন। যখন তিনি হাত দুটি তুলেছেন তখন তাঁর সারা শরীরের রেখাগুলোতে যে সৌন্দর্য সুষমা ফুটে উঠলো, সেখান থেকে আমি চোখ সরাতে পারি নি। আমার আত্মীয়-স্বজন বলে থাকেন, আমার কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক কমিটমেন্ট নেই। আমি এমনই বেরহম আর চশমখোর যে দেশের লোকের জন্য আমার প্রাণ কাঁদে না। দেশে কি ঘটছে না ঘটছে যেন দেখতেই পাই না। কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। অথচ আমার সমালোচক সেই আত্মীয়দের দিল তখন জখম হয়ে রক্তের দরিয়া হয়ে গেছে। মিছিলে না গিয়ে, গোলাবারুদের মুখে না পড়ে, তুচ্ছ প্রাণটা দেয়ার ঝুঁকি না নিয়ে আমার কোনো কোনো বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়ের মতো যদি ‘বিপ্লবী’ আখ্যা লাভ করতে পারতাম, তাহলে ইতিহাসে নাম থাকতো। বাংলাদেশ হওয়ার আগে পর্যন্ত বাংলাদেশ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন; বাংলাদেশ হওয়ার পর একটির পর একটি সরকারের খেদমত ও তাঁবেদারি করেছেন, আবার ঠিক সময় বুঝে ডুবন্ত নৌকা থেকে ঝাঁপ দিয়ে অন্য নৌকার ভিড়ে মিশে গেছেন এবং গিয়ে তাঁদেরই মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দিয়েছেন, ঠিক তাঁদের মতো ত্বরিতকর্মা হতে না পেরে আমি ‘আত্মকেন্দ্রিক’ খেতাব পেয়েছি।
যাই হোক, ব্যাগটা হাতে নিয়ে সেই ভদ্রমহিলা পাশের কম্পার্টমেন্টে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছেন, এমন সময় সেই টিকিট কালেক্টর খুব ভদ্রভাবে বললেন, ‘আপনি এগোন। আমি ব্যাগ পৌঁছে দেবো।’ কোনো পুরুষ—তিনি যদি আমলা না হন বা কোনো বৃদ্ধার জন্য এই টিকিট কালেক্টর উপযাচক হয়ে এই সেবাটুকুর জন্য এগিয়ে আসতেন কিনা, সে বিচার আপনারাই করুন।
হ্যাঁ, একটি জিনিসে আমারও কমিটমেন্ট একেবারে খাঁটি আর অটল। এবং তা হচ্ছে নারী সৌন্দর্য।
যাওয়ার আগে সেই মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে তাঁর এই সামান্য হাসিটুকু আবার নিক্ষেপ করলেন।
এবার আমার মুখের সামনে এসে বসলেন সেই বেজায় গম্ভীর ভদ্রলোক, যাঁর মুখের প্রতিটি রেখা বা রেখার অবয়ব বলে দিচ্ছে এখানে কোনো প্ৰশ্ৰয় নেই।
প্রশ্রয়ের কোনো জরুরতও আমার নেই। তিনি যদি খামোশ হয়ে বসে থাকেন এবং আমার দেশ কোথায়, কি চাকরি করি, কতো তনখা পাই, ছেলেমেয়ে ক’টি, আমার ইসমে শরিফ ও দৌলতখানা কি এবং কোথায়, শাদি করেছি কোন্ নবাবজাদীকে, এইসব অনর্গল সওয়ালের ঝরনাধারা খুলে না দেন, তাহলে সেটাকেই লাখো গাণিমাত মনে করবো।
অজগর সাপ দীর্ঘ ঘুমের পর জেগে উঠে যখন শরীরের আড়িমুড়ি ভাঙে, এবং তার ফলে শরীরটা যেভাবে নড়ে ওঠে, ট্রেনটি এবার সেইভাবে একটু ফুলে ফুলে উঠলো। প্রথম কদমগুলো নিচ্ছে খুব ধীরে, খুব সাবধানে, পায়ের নিচে মাটি কতোটা ভার সইতে পারবে জেনে নিচ্ছে। প্লাটফর্মটা পেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে পৌঁছে, বুক ভরে আলো-হাওয়া নিয়ে পায়ে গতি আনলো। চট্টগ্রাম থেকে এক দৌড়ে ফেনী।
চিটাগাং থেকে ফেনীর মাঝামাঝি কিংবা ফেনী হতে লাকসামের মাঝামাঝি একটি স্টেশন আছে, ঠিক মনে পড়ছে না এ দুটির কোনখানে—’চীন কা বাস্তি’ যে স্টেশনটির নাম। সেখানে এই গাড়িটা দাঁড়ায় না। কিন্তু জায়গাটা এমন একটা নাম পেলো কোথা থেকে সেটা বহুদিন থেকে আমার কৌতূহলের বিষয় হয়ে আছে। জায়গাটি কি বাংলাদেশের খুব প্রাচীন কোনো ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডের অতি দীন এক স্মৃতি হয়ে পড়ে আছে? কিছু মরা ঘাস, ধু-ধু বালু আর পাঁজর বের করা গরু, জানালা থেকে চোখে পড়ে—অবশ্যই উলঙ্গ বা অর্ধ-উলঙ্গ কয়েকজন বালক-বালিকাও তাদের খেলা থেকে খানিক ছুটি নিয়ে, হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে এই চলন্ত ট্রেনের যাত্রীদের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে, সে দৃশ্য তো আছেই। তবু ‘চীন কা বাস্তি’ নামটি নিয়ে মগজ খেলা করে, অনেক রকম কল্পনা রাঙিয়ে ফেনিয়ে ওঠে। এক ঝটকার জন্য বাংলাদেশকে বহুবর্ণ বহুমাত্রিক বিচিত্র দেশ মনে হয়। মনে হয় দেশের অতীতটা হারিয়ে গেছে, বর্তমানের কোথাও নেই।
ফেনীতে ট্রেন থামলে এক কাপ চা খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নেবো অনেক আগেই সেটা ঠিক করে রেখেছি। ট্রেন থামলো। একটি দুটি বেয়ারার ছুটোছুটি নজরে এলো। কিন্তু তারা কেবল দৌড়াদৌড়ি করছে, এক মিনিট দাঁড়িয়ে কোনো এক বিশেষ যাত্রীর প্রয়োজনটা জেনে নেয়ার সময় কারো নেই। তারই মধ্যে যে পারছেন তাঁর বার্তাটা কোনো কৌশলে তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। একজন চাইলেন এক কাপ চা, লোকটি ততোক্ষণে আরো এগিয়ে গেছে, সেখানে বসা ভদ্রলোক চাইলেন কাটলেট, আবার যে ভদ্রলোক চা চেয়েছিলেন, তাঁর পেছনের দু’সারিতে বসা মহিলাটি হয়তো একটি চপের আশা করেছিলেন; কিন্তু ততোক্ষণে লোকটি চা-পিপাসুর কাছে পৌঁছে গেছে এবং তার কান দুটি ডাইনিং হলের দিকে শুধু কয়েকট শব্দ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে : চা, কাটলেট, চপ ইত্যাদি। ডাইনিং হল থেকে সে যখন যাত্রীদের শখের জিনিসগুলো নিয়ে ফিরে এলো তখন দেখা গেল সে তৃষ্ণার্তকে দিচ্ছে কাটলেট, ক্ষুধার্তকে দিচ্ছে চা। তখন সবরকম পসারই টেবিলের ওপর জমা রেখে যাত্রীরা নিজেই নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে একটা বণ্টন ব্যবস্থা করে নেন। এই সময় আবার দেখা যায় যাঁরা চা-কাটলেট কিছুই চান নি, তাঁরা অকম্পিত হাতে এক কাপ চা বা এক প্লেট কাটলেট টেবিল থেকে তুলে নিচ্ছেন, আর যাঁরা চেয়েছিলেন তাঁরা হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। আমি হয়তো একটু বাড়িয়েই বললাম, কিন্তু বাড়িয়ে না বললে যে লোকে শুনতেই চায় না! অবশ্য সবসময়ই যে এমনটি হয় এরকম সফেদ ও সফেন মিথ্যা বলাটা সহি কাজ হবে না। কপাল ভালো থাকলে যে যার প্রয়োজনের জিনিসটা পেয়েও যান।
আমি আমার চায়ের কাপটি পেয়েছিলাম। কিন্তু কতোক্ষণে রেলগাড়িটি আবার ছুট দিয়েছে। অনেক কসরত করে পেয়ালাটিকে মুখের কাছে আনতে চেষ্টা করি; কিন্তু ছুটন্ত ট্রেনে তা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। পেয়ালাটি এসে মোলাকাত করছে আমার নাকের সঙ্গে বা আরো ক্ষিপ্র গতিতে হাতের ঝাঁকুনিতে পৌঁছে যাচ্ছে আমার চোখের কাছে এবং তরল পদার্থটি গড়াচ্ছে শরীরের সবরকম অপদার্থের ওপর। একেবারে শাব্দিক অর্থে আমার চোখের পানি আর নাকের পানি এক হয়ে গেল, তখন হাল ছেড়ে দিয়ে কাপটিকে আমি টেবিলের ওপর রাখলাম।
তারপরও কি শান্তি আছে? সেই মুহূর্তেই ট্রেন গতিবেগ কম-সে-কম বিশ মাইল বাড়িয়ে দিলো। কিসের আনন্দে যে হঠাৎ হঠাৎ করে রেলগাড়িটি অমন হুঙ্কার ছেড়ে পেল্লায় লাফ দেয়, তা বাপধন রেলগাড়িটিই বলতে পারবে; কিন্তু রেলগাড়ি বেগবান হলেও তার জবান নেই। কিন্তু আমাকে ফেললো এক নতুন গ্যাঞ্জামে। যেই না কাপটি টেবিলে রাখা, অমনি সঙ্গে সঙ্গে সেটি টেবিলের ওপর উল্টে যাওয়া। শ্রীমান কাপটি তার ভেতরের তরল পদার্থ আগেই উগরে দিয়েছেন—সামান্যই অবশিষ্ট ছিল, তবু সেইটুকুই টেবিলের ওপর শীর্ণ প্রবাহের প্রায় সমান্তরাল যে দুটি চলমান রেখা তৈরি করলো, তা তাকিয়ে দেখবার মতো। সাপের মতো ঠাণ্ডা তার গতি, নিয়তির মতো অপ্রতিরোধ্য। এই গতিকে অন্যদিকে বাঁকিয়ে দেয়ার কোনো উপায় নেই। মালেকাল মওতের মতো সে জানে তাকে কোথায় যেতে হবে।
রেখা দুটি হারিয়ে গেল টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রাখা সেই বেজায় গম্ভীর ভদ্রলোকের ‘জরুরি’ কাগজপত্রের ভেতর।
সম্মুখের ভদ্রলোকটি যদি পুলিশের কোনো বড়ো সাহেব হন, তাহলে ভাবতে পারেন আমি ইচ্ছে করে তাঁর গোপনীয় কোনো রেকর্ডকে বিকৃত, পাঠোদ্ধারের অযোগ্য করে দেয়ার জন্য পেয়ালা থেকে চা গড়িয়ে দেয়ার কৌশলটি আমার মাথা থেকে বের করেছি।
আমি সন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়ে আছি, তিনি এবার কী বলেন কী করেন, তারই অপেক্ষায়।
অমন এক অটল গাম্ভীর্যের প্রস্তরমূর্তির ভেতর দিয়ে যে অমন একটা কোমল নম্র হাসি বেরিয়ে আসতে পারে, আমরা যেমন অনেক কিছু কল্পনা করতে পারি না—এটাও পারি নি!
‘না না, ব্যস্ত হবেন না। অমন হয়েই থাকে। আপনি ভালো আছেন?’
‘জি, ভালোই। আপনি?’
‘জি, আপনার দোয়া। আমি কিন্তু আপনাকে চিনি।’
এবার আমার পাথর হওয়ার পালা।
‘আপনি ভাবছেন আপনি আমাকে চেনেন না, আর আমি চিনলাম কি করে? আপনারা ফেমাস লোক। আপনারা কি আর সকলকে চিনবেন। সকলে আপনাদের চিনবে।’
ভদ্রলোক এবার আবার নিজের কাজে মন দিলেন।
অদূরের একটি আসনে বসে দুই ভদ্রলোক নিরন্তর কথা বলছিলেন। তাঁদের চেহারায় এমন কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না যে বলতে হবে, যদি না তাদের মধ্যে একজন কোট-টাই পরেছিলেন সেটা উল্লেখযোগ্য কথা হয়। যা নিরন্তর ঘটতে পারে তা একমাত্র মনুষ্যালাপ নয়। এই ট্রেনের চাকা যে শব্দ করছে তাতেও কোনো বিরাম নেই, বরং তা প্রায় এমনভাবে গলা চড়ায় যে কানে হাত দিতে হয়। তবু এই শব্দসভার ভিড় ভেদ করে উক্ত ভদ্রলোকদ্বয়ের কিছু আলাপ আমার কান পর্যন্ত পৌঁছুতে পারছিল। তার ভেতর থেকে যে একটি কাহিনী আকার নিলো, তা এই রকম।
ভদ্রলোকের এক বন্ধু ছিলেন। তিনি খুব ছিমছাম ফিটফাট সাফসুতরা থাকতে ভালোবাসতেন। দু’বেলা গায়ের গেঞ্জি বদলাতেন। দোষের মধ্যে ছিল একটাই। তিনিও একটি কাজ করতেন যা ছিল নিরন্তর। চেইন স্মোকাররা যেমন একটির পর একটি সিগারেট খেতেই থাকে—রিলে রেসের মতো একটি সিগারেটের আগুন থেকে আর একটি ধরিয়ে নেয়, এই ঘটনার নায়ক ভদ্রলোকের তেমনি অভ্যাস ছিল, দুই হাতের আঙুল দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা, অন্তত জাগ্রত প্রহরগুলো, নাকের ভেতরটা চুলকোতে থাকা। ভদ্রলোকের অনেক টাকা ছিল; কিন্তু কোনো পানাভ্যাস ছিল না। এমনকি ধূমপানটা পর্যন্ত তিনি করতেন না। আর করবেনই- বা কি করে? সবসময়ই যদি নাকের মধ্যে আঙুল গোঁজা থাকে তাহলে মুখের মধ্যে যে ধোঁয়াটা টেনে নিলেন, নাকের ভেতর দিয়ে তা বাইরে আসবে কি করে? তিনি যে কী কৌশলে নিশ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ-বর্জন করতেন সেটাই পরম বিস্ময়।
যাই হোক, একবার হয়েছে কি, নাক চুলকানিতে এক মুহূর্তের বিরামের সুযোগ নিয়ে এক ফাঁকে একটি মশা তাঁর নাকের ভেতর প্রবেশ করলো। সেই যে প্রবেশ করলো, আর বেরুতে চায় না। ভদ্রলোক যতোই খোঁচাতে থাকেন, মশাটা বাইরে বেরুবার কোনো গরজ না দেখিয়ে বরং আরো গভীরে প্রবেশ করতে লাগলো। ভদ্রলোক মশাটির কথা এক সময় ভুলে গেলেন। তুচ্ছ মশাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে, নাক চুলকাবেন কোন সময়? মশাটি কিন্তু তাকে ভোলে নি। সে তার কাজ করে যেতে লাগলো। নাক, কান ও গলার মধ্যে একটা কটুম্বিতা আছে— চিকিৎসা শাস্ত্র সে কথা বলে। কিন্তু একটি মশা নাক দিয়ে প্রবেশ করে মগজ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে এটা সহজে কেউ বিশ্বাস করলেন না। যে ভুক্তভোগী নয় সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে অনেক কিছুই অবিশ্বাস করলেন না। যে ভুক্তভোগী নয় সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে অনেক কিছুই অবিশ্বাস করতে পারে। কিন্তু যাঁর নাকের ভেতর মশা ঢুকেছে, আর সেটিকে কেউ বেরিয়ে আসতে দেখে নি—তার বিশ্বাস-অবিশ্বাস একটু অন্যরকম। কিছুদিন পর দেখা গেল সেই ভদ্রলোকের ডান হাতের সার কমে এসেছে; ততোধিক কমে আসছে স্মৃতিশক্তি; কাজে কোনো সময়েই মন ছিল না, এখন দেখছেন সেটা একেবারে লোপ পেয়েছে; আর যেটার জন্য তিনি খুব বিখ্যাত ছিলেন সেই আহারে পর্যন্ত রুচি নেই। মন তাঁর সব জোর হারিয়ে ফেলেছে; এমনকি শরীরটাও একেবারেই কমজোর হয়ে গেছে।
ডাক্তার দেখানো হলো- একজন-দু’জন নয় ডজন। বদ্যিদের যে কতোরকম বিদ্যা আছে এবারে তা বোঝা গেল। কিন্তু একজনের বিদ্যে যে নির্দেশ দেয়, আর একজন তা উল্টে দেয়। কেউ হার্ট চিরতে চায়; কেউ ডান হাতটি খুঁড়তে চায়; কেউ মাথার খুপরি খুলতে চায়। শেষোক্তজনের কথা শুনে প্রথমে সকলেই বললেন, তাঁর নিজের মাথাটাই খারাপ। খুললে তাঁর খুপরিটাই খুলে ঐ বিগড়ে যাওয়া মগজটা ফেলে দাও। এদিকে বিষম অসুস্থ ভদ্রলোক সকলের কথা শোনেন। কিন্তু অসুবিধেটা কোথায় বুঝতে পারলেও, অসুখটা কি তিনিও স্বভাবতই বুঝতে পারছেন না। তবু একটি বিষয়ে তাঁর কোনো সন্দেহই নেই। কাজটি সেই মশার।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, ব্রেন টিউমার। ভদ্রলোক মরবার মুহূর্তে পর্যন্ত তাঁর সেই বিশ্বাসে অটল ছিলেন যে কাজটি সেই মশার। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে টিউমারটা বানিয়ে তুলেছিল। একজন আত্মীয় যখন বলেছিলেন, খোঁচাবার জন্য শক্ত একটা কিছু চাই তখন সেই ভদ্রলোক জবাব দিয়েছিলেন, মগজ জিনিসটা এতোই নরম যে ঠোকরাবার জন্য শক্ত কিছু লাগে না।
ঘটনাটির কথা শেষ করে অদূরে যাত্রীটি ঝুঁকে পড়ে, পায়ের কাছ থেকে তাঁর টিফিন কেরিয়ারটি তুলে নিয়ে একেবারে কোলের ওপর রাখলেন এবং ওপরের ঢাকনাটি খুলে টপাটপ একটির পর একটি সামুসা খাওয়ায় মন দিলেন। তাঁর অনুরাগী শ্রোতার দিকে একটিও এগিয়ে দিলেন। না।
দেখা গেল, শ্রোতা ভদ্রলোকটি খাদ্যের জন্য তাঁর সম্মুখযাত্রীর মোহতাজ নন। তিনি অবশ্য টিফিন কেরিয়ার বের করতে পারেন নি কিন্তু বের করলেন রুপোর তৈরি টিফিন বাক্স। তিনি সামুসাও বের করতে পারেন নি, কিন্তু যা বের করলেন তা স্বাদে আর আভিজাত্যে সামুসার কাছে হার মানবে না। আরো দেখা গেল খাদ্যকে একেবারে নিজস্ব জ্ঞান করার ফিলোসফিতে তিনিও বিশ্বাসী। কারণ তিনিও তাঁর খাদ্যের কোনো অংশ অপর ভদ্রলোককে দিলেন না। এবং একটু পর আরো বোঝা যাবে, তিনি কেবল শ্রোতাই নন, বক্তাও হতে পারেন।
রুপোর বাক্স আর টিফিন কেরিয়ারের মুখ বন্ধ হলো। টাই-কোট পরা এতোক্ষণের শ্রোতা ভদ্রলোকটি হাত-মুখ মুছে একটি সিগারেট ধরিয়ে তাঁর নিজের মুখ খুললেন। তিনি যা বললেন, তা এই রকম।
আমার এক বন্ধু, কলেজের অধ্যাপক—তাঁর মেয়ের বিয়ে দিলেন। মেয়েটি সুন্দরী, সুশীলা এবং বেশ নামকরা ছাত্রী। তার পাণিপ্রার্থীর অভাব ছিল না। বহু সুপাত্রই তাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। কিন্তু মেয়েটি লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে করবেই না। মেয়েটির পাত্রী হিসেবে আকর্ষণ সম্পর্কে এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে তার বিয়ের পরও খবরটা জানতেন না বলে একাধিক পাত্রের পিতা-মাতা পয়গাম পাঠিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে বিলেত- আমেরিকায় পড়া কোটিপতি তনয় ছিল; ওয়াশিংটনে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে কাজ করে সেরকম ছেলে ছিল, রাষ্ট্রদূতের একমাত্র সন্তান হার্ভার্ড-এর পাত্র ছিল। আরো অনেকেই ছিল। এমনকি পাকিস্তানের এক অভিজাত পরিবার থেকেও সম্বন্ধ এসেছিল। মেয়েটি শেষ পরীক্ষাটা না দিয়ে বিয়ে করবেই না বলে পণ করেছিল, কিন্তু হঠাৎ তার বিয়ে হয়ে গেল। অধ্যাপক সাহেব এমনিতে বেশ সেয়ানা; কিন্তু অনেক ব্যাপারে আবার খুবই কাঁচা, বিশেষ করে যাঁদের সঙ্গে তাঁকে মোকাবিলা করতে হলো তাঁদের অনেকের অতিপকুবুদ্ধির তুলনায়। একশেপসনাল আই-কিউর লোক তাঁরা। পাছে অন্য লোকে সেটা বুঝতে না পারে, তাই তাঁরা নিজেরাই কথাটা বড্ড বেশি বলেন। দু’-একজন আছেন তাঁদের পুরুষ আত্মীয়ের মধ্যে, তারা যখন একটি চেয়ারে বসেন, এমন এক ভঙ্গি করে বসেন যে, মনে হয় চেয়ারটিতে গুরুত্বের এক হিমালয় পর্বত বসলো।
যাই হোক বিয়েটা হয়ে গেল। কোন্ কথায় কী ভাবে, কোন্ শর্তে হলো এবং বিয়ের পর সেই কথা, সেইভাব, সেই শর্ত কীভাবে ভাঙচুর করা হলো, এবং কোন্ পক্ষ কথার কতোটা বরখেলাপ করলেন, সব কথা বলতে গেলে মহাকাব্য লিখতে হয়। হয়তো একদিন কেউ লিখবেন। কারণ কাহিনীটি কেবল ব্যক্তিগত বা পারিবারিক নয়—সেটার সুদূরপ্রসারী সামাজিক তাৎপর্যও আছে।
যাই হোক, বিয়েটা হলো। ছেলেটিকে মেয়ের পছন্দ হয়ে গেল। ছেলেটির চোখের দৃষ্টিতে এমন এক আন্তরিক গভীরতা মেয়েটি দেখেছিল যে তার মনে হয়েছিল, তাদের দু’জনের পরস্পরের আন্তরিকতা মিশবে আর মিলবে ভালো। আসলেই ছেলেটি ভালো। কিন্তু বিয়ের পরপরই ছেলেটির মা একটির পর একটি বোমাবর্ষণ করতে শুরু করে দিলেন। তাঁরা পাঁচ বোন। পাঁচজনই বিয়ের অল্পদিন পরই নিজেদের স্বামী ও সংসারকে গুটিয়ে-পটিয়ে নিজেদের বাপের বাড়িতে তুলে আনলেন। সেখানেই তাঁদের পারিবারিক শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করতে লাগলো। তাঁরা তাঁদের সেই বাপের বাড়িকে একটা ইনস্টিটিউশন জ্ঞান করেন। তা শুনে অন্যরা যে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, তার পরোয়া নেই। যাই হোক, তাঁরা নিজেদের বৃত্তকে আকবরের নবরত্ন সভা মনে করলেও কারো কিছু বলবার নেই। যে নিজেকে যা খুশি মনে করে স্ফীত হোক, সুখী হোক, সেই তো ভালো। শেষ পর্যন্ত সুখী হওয়াই তো জীবনের লক্ষ্য।
কিন্তু গোল বাধলো অন্য জায়গায়। পাঁচ বোন থাকেন নিজের বাপের বাড়ি; কিন্তু নতুন পুত্রবধূর কাছ থেকে তাঁরা একেবারে উল্টো আচরণ দাবি করতে লাগলেন। সেই মেয়েটিকে তার শ্বশুরবাড়ির দাসী, ইটপাটকেল, হাঁড়িপাতিল এবং শ্বশুরবাড়িতে যতোরকম শাশুরিক আত্মীয়স্বজন আছে, সকলের কাছেই গড় প্রণিপাত হতে হবে। কিন্তু তাঁরা নিজে, মেয়েটির বাপের বাড়ির কোনো আত্মীয়কেই নিজের আত্মীয় বলে মানবেন না। কিন্তু মেয়েটি যেন তাঁদের পুরো বংশ-প্রবংশকেই বিয়ে করেছে। ব্যাপারটা মেয়েটির কাছে একটু অসুরীক মনে হতে লাগলো।
টিফিন কেরিয়ারের মালিক বললেন, সেটা কি রকম?
রুপোর পাত্র বললেন, আদ-এর পর রুসুমাত আর ওয়ালিমা হবে। ছেলের মা মেয়ের বাপকে বললেন, ভালোয় ভালোয় রুসুমাত আর ওয়ালিমা হয়ে যাক, তারপর আপনারা আপনাদের মতো আর আমরা আমাদের মতোই বাস করবো। বিয়ের আগে ঠিক যেমনটি ছিল।
‘মেয়ের বাপ কি করলেন?’
‘তিনি আর কি করবেন। আদ হয়ে গেছে। পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন। তাছাড়া ভদ্রমহিলা এমনভাবে কথাগুলো বলেছিলেন, যেন তিনি বাদশাহী ফরমান জারি করছেন।’
‘মেয়ের বাপ দুঃখ পান নি?’
‘দুঃখ? হাঁ পেয়েছিলেন। বেচারা এক সামান্য অধ্যাপক। কেউ পাত্তাটাত্তা দেয় না। তিনি আশা করেছিলেন, নতুন বেয়াই-বেয়ান আর তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মেলামেশা ওঠাবসা করে একেবারে সমাজের উঁচুতলায় উঠে যাবেন। সেটা আর হতে পারলো না বলে, বড়ই মনোকষ্টে আছেন।’
‘ছেলের বাবা কিছু বলেন না?’
‘কিছু বললেন কিনা অতো শুনি নি। কিন্তু তাঁর স্ত্রীর ব্যক্তিত্ব ইন্দিরা গান্ধীর মতো। ইন্দিরা গান্ধী কি কোনোদিন তাঁর স্বামী ফিরোজ গান্ধীর কথা মেনে চলেছেন?’
‘পাত্রীটি থাকে কোথায়? সেই ইটপাটকেল হাঁড়ি-পাতিলের সঙ্গে?’
‘অতো জিগ্যেস করবেন না।’
‘মেয়েটি আর ছেলেটি সুখে আছে? তারা স্বামী-স্ত্রী যদি সুখে থাকে তাহলে আর কোনো সমস্যাই সমস্যা নয়।’
এমন সময় ট্রেনটি ঝমঝম ঝমঝম ঝমঝম শব্দ তুলে লাকসাম স্টেশনে প্রবেশ করে থম করে দাঁড়িয়ে পড়লো। প্রশ্নটির জবাব শোনা গেল না।