লাঞ্চ

লাঞ্চ

নার্গিসি কোফতা থেকে ডিমের ডেভিল

মূল ব্যাপারটা হল একটা সিদ্ধ ডিম নিয়ে তার চারদিকে মাংসের কিমার পুর, ব্রেডক্রাম্ব দিয়ে মুড়ে ছাঁকা তেলে ভাজা। মুঘল আমলে এই ভাজা ডিমকেই আবার গ্রেভিতে ছেড়ে দেওয়া হত। কেন এর এমন নাম? নার্সিসাস ফুলের নাম সবার জানা। সেই নার্সিসাস, যে দিনরাত ঝরনার জলে নিজের রূপ দেখত বলে দেবী তাকে জলের ধারে ফুটে ওঠা ফুল বানিয়ে দেন। নিজেকে ভালোবাসার আর-এক নাম হয়ে যায় নার্সিসিটি। মুঘলরা এই ফুলকে ডাকতেন নার্গিস নামে। নার্গিসের রং সাদা, ভিতরটা হলুদ। ঠিক ধরেছেন, অনেকটা সিদ্ধ ডিমের মতো। আর তা থেকেই কোফতার এই নাম। ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারতে থাকাকালীন এই খাদ্যটি খান আর রেসিপি নিয়ে যান ইংল্যান্ডে। ১৭৩৮ সালে লন্ডনের বিখ্যাত ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ফোর্টনাম অ্যান্ড ম্যাসন গ্রেভি বাদে এই খাদ্যটি বিক্রি করতে থাকে। খোদায় মালুম কেন তাঁরা এর নাম স্কচ এগ দিয়ে দেন। স্কটদের সঙ্গে তাঁদের দূরদূরান্তের কোনও সম্পর্কই নেই। ১৮০৬ সালে মিসেস মারিয়া রান্ডাল ‘ডোমেস্টিক কুকারি’ নামে এক বই লেখেন, যা তখনকার দিনে ‘সেলিং লাইক হট কচুরিস’। সেই বইতে র‍্যান্ডাল অন্য খাবারের সঙ্গে স্কচ এগের রেসিপিও দিয়েছিলেন।

আমেরিকায় যখন এই খাবার গেল, নাম বদলে গেল আবার। তাঁরা একে বলতেন স্টাফড এগ, স্যালাড এগ (স্যালাড দিয়ে খাওয়া হত বলে), এমনকি এঞ্জেল এগ। খোদ ভারতের রাজধানী কলকাতায় নবরূপে নার্গিসি কোফতা যখন ফিরে এল, তখন এর গ্রেভি হাওয়া হয়ে গেছে। একে খাওয়া হত কাসুন্দি, সস ইত্যাদি দিয়ে। আর ডিমকে মোড়া হত গোলমরিচ, লংকার ঝাল ঝাল পুরে। এই অতিরিক্ত মশলাদার, ঝাল রান্নার একটা ইংরেজ নাম ছিল। ডাক্তার জনসনের জীবনীকার বসওয়েল সাহেব অষ্টাদশ শতকে এমন তীব্র মশলাদার খাবারকে ডেভিল নাম দিয়েছিলেন। ব্যস, খাঁটি ভারতীয় নার্গিসি কোফতা স্কটল্যান্ড ঘুরে কলকাতায় ফিরে এল ডিমের ডেভিল নাম নিয়ে।

জন মন্টেগু, আর্ল অফ স্যান্ডউইচ
জন মন্টেগু, আর্ল অফ স্যান্ডউইচ

শয়তানের খাদ্য

স্যান্ডউইচকে ব্রেকফাস্টে রাখাই যেত। কিন্তু রাখলাম না, কারণ প্রথমে একে খাওয়া হত লাঞ্চ হিসেবেই। ব্রিটেনের কেন্টে ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠা স্যান্ডউইচ গ্রামের নামের মানে বালির গাঁ (পুরোনো ইংরাজিতে wic মানে গ্রাম)। সমুদ্রের কাছে হওয়ায় রাজা দ্বিতীয় চার্লস তাঁর নৌ-সেনাপতি স্যার এডওয়ার্ড মন্টেগুকে এই গ্রামের আর্ল বানিয়ে দেন। তাঁর নাতির ছেলের নাম ছিল জন মন্টেগু। এঁকে নিয়েই আমাদের গল্প। এঁর মতো অলস, অকর্মণ্য আর ঘুষখোর আর্ল আগে পরে আর কেউ ছিলেন না। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটিশদের নৌসেনাদের শোচনীয় পরাজয়ের কৃতিত্ব অনেকটাই এই ভদ্রলোকের। আর-একটা মহাগুণ ছিল এই আর্লের। জুয়া খেলতে দারুণ ভালোবাসতেন। গল্পটা এইরকম, ১৭৬২ সালে একদিন জন মন্টেগু তাসে একের পর এক দান জিতছিলেন। খেলার নেশা চড়ে গিয়েছিল মাথায়। এদিকে দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। চাকর বারবার এসে জানাচ্ছে, ‘হুজুর, গিন্নিমা কিন্তু এবার…।’ বিরক্ত মন্টেগু বললেন, ‘এখন খেলা ছেড়ে ওঠা যাবে না। এক কাজ করো। দুই পিস পাউরুটির মাঝে কিছু মাংস ভরে নিয়ে এসো। খাওয়া যাবে। আঙুলও এঁটো হবে না।’ দেখাদেখি তাঁর বন্ধুরাও একই খাবার আনতে বললেন। খুব তাড়াতাড়ি তাসের টেবিলে এই খাবার জনপ্রিয়তা লাভ করল। ইংরেজদের জীবনযাত্রার অন্যতম অংশ হয়ে উঠল এই খাদ্য।

আর্ল অফ স্যান্ডউইচের আরও কীর্তি ছিল। তিনি নিজে শয়তানের উপাসক হেলফায়ার ক্লাবের সদস্য ছিলেন। সেখানেও তাঁর প্রভাবে স্যান্ডউইচ খাওয়া শুরু হয়। ১৭৯২ সালে তিনি যখন মারা যান তখন তাঁর বদনাম গোটা ইংল্যান্ড জুড়ে। ঐতিহাসিকরা যতই বলুন, আরও একটা কীর্তির জন্য আমরা ভদ্রলোককে মনে রাখব। ক্যাপ্টেন জেমস কুককে তিনিই পয়সাকড়ি দিয়ে সমুদ্র অভিযানে পাঠান। কুক যখন হাওয়াই দ্বীপ আবিষ্কার করেন, তিনি প্রথমে এর নাম রাখেন স্যান্ডউইচ আইল্যান্ড, যদিও পরে তা বদলে দেওয়া হয়। অবশ্য এখনও সেখানে স্যান্ডউইচ স্ট্রেইট এক প্রাচীন জুয়াড়ির স্মৃতি বহন করছে। স্যান্ডউইচ পরে আরও দুই রকমে পাওয়া যেতে লাগল। এক স্লাইস পাউরুটির উপর মাংস দিয়ে ওপেন স্যান্ডউইচ আর দুই স্লাইস পাউরুটির উপরে আরও এক স্তর মাংস আর এক স্লাইস রুটি দিয়ে মার্কিন ক্লাব স্যান্ডউইচ।

পিকনিক কীভাবে এল?

তারাপদ রায়ের একটা গল্প পড়েছিলাম। চার বন্ধু মিলে পিকনিকে যাবে। ঠিক হল সবাই কিছু না কিছু সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। একজন নিয়ে এল ভাত, ডাল, তরকারি, একজন মাংস, অন্যজন মিষ্টি। শেষ বন্ধু নামকরা কিপটে। সে সঙ্গে নিয়ে এল তার ভাইকে। গল্পটা মনে পড়ার অন্য একটা কারণও আছে। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ফরাসিরা এক নতুন ধরনের পার্টি শুরু করেন। নাম pique-nique। পিক মানে উঠিয়ে দেওয়া আর নিক মানে যা খুশি। এতে অতিথিরা সবাই কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসতেন, ফলে গোটা দায়িত্ব হোস্টের উপর পড়ত না। ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে এই পার্টি ইংল্যান্ডে যখন এল, তখন মূলত বাড়ির বাইরে খোলামেলা জায়গায় সবাই মিলে লাঞ্চ করাকেই পিকনিক নাম দেওয়া হল। ১৭৯৩ সালে ফরাসি বিপ্লবের পরে প্যারিসের বড়ো বড়ো রাজকীয় উদ্যানগুলো যখন সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হল, তখন ফ্রান্সে পিকনিকের জোয়ার ওঠে। লন্ডনবাসীরাও হিংসায় জ্বলে পুড়ে নিজেদের পিকনিক ক্লাব খুলে দেদার পিকনিক শুরু করলেন। গোটা ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স জুড়ে বেশ একটা পিকনিক পিকনিক কালচার আরম্ভ হয়। সেই আগুনে ঘি দিলেন চার্লস ডিকেন্স, আর্নল্ড বেনেটের মতো লেখকরা, যাঁদের লেখায় প্রায়ই দারুণ সব পিকনিকের লোভনীয় বর্ণনা থাকত।

এডওয়ার্ড মানের আঁকা পিকনিকের ছবি
এডওয়ার্ড মানের আঁকা পিকনিকের ছবি

১৯১০ সালে তৈরি হয় লুই ভিতো কেজ, যা গাড়ি বা মোটরসাইকেলে করে সহজে বহন করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি৷ এই কেজে চাপিয়ে পিকনিকের সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হত অকুস্থলে। মৃতের দিন বা দিয়া দে লোস মুয়ের্তোস মেক্সিকোর অন্যতম ছুটির দিন৷ মৃতের পরিবার ও স্বজনরা এই দিনটি উদযাপন করেন৷ এই দিনে পরিবারের সদস্যরা কবরস্থানে জড়ো হয় এবং বড়োরকমের ভোজের আয়োজন করে৷ সেখানে বসেই তারা খায়৷ এও তো একরকম পিকনিকই বটে।

মাঝে মাঝে তব দেখা ‘পাই’

পাই-এর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ডন ম্যাকলিনের ‘আমেরিকান পাই’ শুনে আর স্ট্যাটিস্টিকস ক্লাসের পাই চার্ট দেখে। মানতে লজ্জা নাই, আজ অবধি ভালো পাই খাই নাই। এই পাই মূলত ইউরোপিয়ান খানা, যা পরে রোমানরা আমেরিকায় নিয়ে যায়। খাদ্য-ঐতিহাসিক অ্যালান ডেভিডসনের মতে, আসলে পাই হল ম্যাগপাই-এর ছোটো ফর্ম। ম্যাগপাই হল এমন পাখি, যে যা পায় কুড়িয়ে এনে নিজের বাসায় জড়ো করে। যারা টিনটিনের ‘পান্না কোথায়’ পড়েছেন, তাঁদের আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। প্রথম যুগে এই পাইতেও মাংসের টুকরো, বাসি সবজি, ফলের টুকরো, যা হাতের কাছে পাওয়া যেত মেশানো হত। ম্যাগপাইয়ের বাসার মতো। অনেক পরে একটা নির্দিষ্ট জিনিস দিয়ে পাই বানানো শুরু হয়, যেমন আপেল পাই, ব্লুবেরি পাই।

পাই নিয়ে একটা ছোটো গল্প বলে শেষ করব। ইংরাজিতে ‘to eat humble pie’ বলে একটা কথা আছে। যার মানে অপমান গিলেও ক্ষমা চাওয়া। স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় এ আবার কী ধরনের পাই? মধ্যযুগে জমিদাররা হরিণ শিকার করে আনলে হরিণের সেরা মাংস দিয়ে যে পাই বানানো হত, তা জমিদার আর সাঙ্গোপাঙ্গরা খেতেন। নাড়িভুঁড়ি আর ফেলে দেওয়া ছাঁট মাংস (যাকে ইংরাজিতে umble বলা হয়) দিয়ে তৈরি পাই খেতে দেওয়া হত দরিদ্র প্রজাদের। বেচারারা খিদের জ্বালায় অপমান সহ্য করেও সেই পাই খেতে বাধ্য হতেন। অতএব…

রোস্টের রূপরেখা

৭ মার্চ, ৩২১ খ্রিস্টাব্দ। সদ্য খ্রিস্টান হওয়া রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন ফরমান জারি করলেন, রবিবার সবার ছুটির দিন। ওইদিন সব অফিস কাছারি, দোকানপাট বন্ধ থাকবে। মানুষ কোনও সক্রিয় কাজ করতে পারবে না। শুধু প্রার্থনা আর খাওয়া ছাড়া। ফলে খুব শিগগির রবিবার মানেই সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে দাঁড়াল সকালে চার্চে গিয়ে প্রভু যিশুর নামগান করা আর দুপুরে গান্ডেপিন্ডে খাওয়া। অনেক মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের কাছে এই দিনটাই ছিল সাপ্তাহিক মাংস খাবার একমাত্র দিন। সেইদিন ম্যানরের জমিদার বড়ো একটা ষাঁড় রোস্ট করে তার মাংস প্রজাদের বিলোতেন। এভাবেই রবিবারের রোস্টের জন্ম। অবশ্য নিজের বাড়িতে রোস্টের সরঞ্জাম আনতে আনতে মধ্যবিত্তদের প্রায় বিশ শতক অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। রবিবারের এই রোস্টের মধ্যে ষাঁড়ের মাংসের দুটো কাট বা অংশ এখনও হোটেলে হোটেলে পাওয়া যায়। একটার নাম স্যারলয়েন আর অন্যটা ব্যারন। শুনেই বেশ জমিদার জমিদার ভাব জাগে।

ষাঁড়ের রোস্টের পিছনের রান থেকে নেওয়া সবচেয়ে দামি অংশের নাম স্যারলয়েন। লয়েন কিন্তু কারও নাম না। পিছনের দাবনাকে ইংরাজিতে লয়েন বলে। রসিকরা বলেন, রাজা অষ্টম হেনরি নাকি এই মাংস খেয়ে এত খুশি হয়ে গেছিলেন যে দিলদরাজ হয়ে তিনি এঁকে নাইটহুড দিয়ে দেন। সেই থেকে এর নাম স্যারলয়েন। গল্পটা শুনতে দারুণ। কিন্তু ভুল। স্যার লয়েন শব্দ এসেছে ফরাসি শব্দ surlonge থেকে, যার মানে… খুবই সাদামাটা, ‘পিছনের রান’।

মাংসের বিভিন্ন কাট (উনবিংশ শতকের ছবি)
মাংসের বিভিন্ন কাট (উনবিংশ শতকের ছবি)

ব্যারনের ব্যাপারস্যাপার আর-একটু বড়ো। পিছনের দুটো স্যারলয়েন সুদ্ধু ষাঁড়ের মেরুদণ্ডকে রোস্ট করলে যা পাই, তাকেই ব্যারন বলে। এর উল্লেখও প্রথম পাই অষ্টম হেনরির আমলে। যদিও এর নামের পিছনেও আছে ফরাসিরা। ফরাসি bas-rond মানে পিছনের গোলাকার অংশ।

কোথাও গিয়ে যথোচিত অভ্যর্থনা না পেলে বা সবাই এড়িয়ে গেলে ইংরাজিতে তাকে বলা হয় ‘giving the cold shoulder’। আগে কথাটা শুনে ভাবতাম কাঁধ আবার ঠান্ডা হয় কীভাবে? আর তাতে অপমান করার আছেটাই বা কী? এই বইয়ের জন্য পড়তে গিয়ে পেঙ্গুইনের ‘Companion to Food’-এ এক আশ্চর্য তথ্য পেলাম। মধ্যযুগে ইংল্যান্ডের বড়ো বড়ো ভোজসভা প্রায় কয়েকদিন ধরে চলত। প্রচুর খাদ্য, পানীয়, গানবাজনা, জাদুর খেলা, এমনকি নাটকও দেখানো হত সেইসব সভায়। ভোজসভা কখন শেষ হবে তার একটা ইঙ্গিত ছিল। ষাঁড়, খাসি বা শূকরের কাঁধের অংশ থেকে ঠান্ডা মাংসের টুকরো দেওয়া হত অতিথিদের। যেমন এখনকার ভোজে ঠান্ডা দই বা আইসক্রিম দেয়। এটা পেলেই অতিথিরা বুঝতেন ভোজ শেষ, এবার বাড়ি যেতে হবে। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা অপমান করার জায়গায় চলে এল। যেসব অতিথিরা অন্যদের থেকে বেশিদিন থেকে যেতেন বা যাদের গৃহস্বামী পছন্দ করতেন না, তাঁদের খাবার শুরুতেই এই কোল্ড শোলডার দেওয়া শুরু হল। মানে একটাই। অনেক হয়েছে, এবার মানে মানে কেটে পড়ো বাপু।

পোলাও, বিরিয়ানি ইত্যাদি

ছোটোবেলায় ব্যাকরণ বইতে পড়তাম পল+অন্ন= পলান্ন। মানে পোলাও। পল মানে নাকি মাংস। অর্থাৎ পোলাও মানে মাংস-ভাত। এই জায়গাটা আমার চিরকাল গোলাত। কারণ যেখানে যেখানে পোলাও খেতাম, কোথাও মাংস পাইনি। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম, এ খাওয়া একেবারে বৈদিক খাদ্য। ব্যাকরণ বইতে আছে হাজার হোক। কিন্তু পোলাও-এর ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে পুরো কনফিউজড হয়ে গেলাম। কোনও দুজন এর উৎপত্তি নিয়ে একমত হতে পারেননি। অতএব ঘেঁটে যা পেলাম, সবকটা পেশ করি। আপনাদের যেটা পছন্দ মেনে নেবেন।

প্রথম পোলাও নাকি রান্না হয়েছিল সম্রাট আলেকজান্ডারের জন্য। তিনি যখন শ্বশুরবাড়ি স্ত্রী রোক্সানার কাছে যান, তখন তাঁকে পোলাও খাইয়ে আপ্যায়ন করা হয়। তাঁর শ্বশুরবাড়ি বর্তমান ইরানে। ফলে খাদ্যটি ইরানি। অন্য গল্প বলে, সমরখন্দ জয় করলে সেখানে আলেকজান্ডার এক ভোজসভা আয়োজন করেন, যাতে স্থানীয় লোকজন তাঁকে পোলাও খাইয়ে খুশি করেছিলেন। তবে আবিষ্কার যেখানেই হোক, প্রথম পোলাও-এর রেসিপি লিপিবদ্ধ করেন আবু আলী হোসাইন ইবনে সিনা নামে এক উজবেগ (যাঁদের থেকে উজবুক কথাটা এসেছে) পণ্ডিত। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সেরা চিকিৎসক, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক এই ভদ্রলোক এত কাজের মধ্যে রান্নার রেসিপিও লিখবার সময় পেয়েছিলেন ভাবলে চমকে যেতে হয়।

ইন্ডিয়ান ফুড হিস্ট্রি বইটিতে কে.টি আচাইয়া দাবি করেছিলেন যে পার্সিয়ান এবং আরবরা প্রথম ‘পুলাও’ বা ‘পুলাভ’ এই শব্দটি ব্যবহার করেন, পরে সেটির ভারতীয় উৎপত্তি অনুযায়ী নাম পোলাও রাখা হয়। কিন্তু সঠিক পুলাও-এর উৎপত্তি কোথায় সেটা নিয়ে কিন্তু খাদ্যবিশেষজ্ঞদের মধ‍্যে নানান মতভেদ আছে। অনেকের মতে এই খাবারটি নাকি আরব সভ্যতা থেকে ভারতে এসেছে। আবার অনেকে বলেন যে ভারতীয়রাই প্রথম একপ্রকার মিষ্টি ভাত তৈরি করে, সেটারই নাকি আধুনিক প্রতিফলন এই পোলাও। যদিও বা সঠিক কোনটা সেটা এখনও জানা যায়নি। পারস্যে মাংসের সুরুয়ার সঙ্গে আধসিদ্ধ ভাত মিশিয়ে ‘পোলো’ নামে যে রান্না হয়, সেটা থেকেও পোলাও আসতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

বাবরের ব্যাঙ্কোয়েট। মুঘল পেন্টিং
বাবরের ব্যাঙ্কোয়েট। মুঘল পেন্টিং

অবশ্য এখন যে সুস্বাদু পোলাও খাই, তার জন্য দায়ী কিন্তু সম্রাট আকবর। তিনিই প্রথম মুঘল রসুইখানায় মশলা জলে গরম করে (একেই আখনি বলে), দই দিয়ে জাঁক দেওয়া মাংসের সঙ্গে কাশ্মীরি জাফরান মিশিয়ে পোলাও রান্না শুরু করান। আইন-ই-আকবরীতেও এই খাবারের নাম আছে। অবশ্য বেশিদিন আকবর এই পোলাও খাননি। শেষ দিকে আমিষ তাঁর বিশেষ সহ্য হত না। লখনউতে বাবুর্চিরা পোলাওকে অন্য লেভেলে নিয়ে গেছিলেন। অযোধ‍্যার শাসকদের বিরিয়ানি পছন্দের হলেও তাঁদের সর্বাধিক প্রিয় ছিল পোলাও। ভালো জাতের পোলাও-এর কাছে বিরিয়ানির স্বাদ নস্যাৎ হয়ে যেত। অযোধ‍্যার শাসকদের পোলাও প্রীতির কথা মাথায় রেখেই তাঁদের শাহি রসুইখানার বাবুর্চিরা পোলাও নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মেতে উঠতেন। ফলে নবাবদের মেনুতে যোগ হত পোলাও-এর সব নতুন নতুন পদ। অযোধ‍্যায় ঝাল ও মিষ্টি মিলিয়ে প্রায় সত্তর রকমের পোলাও প্রচলিত থাকলেও যেসব বিখ্যাত পোলাও দিয়ে শাহি দস্তরখান সাজানো হত সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল মোতি পোলাও, আনারদানা পোলাও, গুলজার পোলাও, নূর পোলাও, কোকো পোলাও, চামবেলি পোলাও, নওরতন পোলাও প্রভৃতি। তবে এইসব পোলাওয়ের মধ্যে বাবুর্চিদের দুটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার ছিল আনারদানা পোলাও ও নওরতন পোলাও। আনারদানা পোলাও-এর ক্ষেত্রে প্রতিটি চালের অর্ধেকটা ছিল লাল, ঠিক যেন রত্ন, আর বাকি অর্ধেকটা ছিল সাদা কাচের মতো চকচকে। এই চালের পোলাও দস্তরখানের উপর সাজিয়ে রাখলে মনে হত যেন থালায় রঙিন জহরত সাজানো রয়েছে।

অন্যদিকে নওরতন পোলাও বিখ্যাত নবরত্ন পাথরের মতো নয় রংয়ের চাল মিশিয়ে তৈরি করা হত। এই পোলাওয়ে বর্ণের স্বচ্ছতা ও শোভা এক অনন্য স্বাদের জন্ম দিত। শুধু অযোধ‍্যার শাসকরাই নন, তাঁদের দেখাদেখি বহু আমির ওমরাহরাহরাও নতুন নতুন পদ দিয়ে দস্তরখান সাজাতে শাসকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতেন। অযোধ‍্যার শাসক গাজিউদ্দিন হায়দারের সমসাময়িক নবাব সালারজং-এর বংশের রইস নবাব হুসেন আলি খাঁ ছিলেন পোলাওয়ের অন্ধ ভক্ত। তাঁর দস্তরখানে নানান স্বাদের পোলাও সাজানো থাকত। পোলাও প্রীতির জন্য সমগ্র অযোধ‍্যা জুড়েই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর অত্যধিক পোলাও প্রীতির জন্য তিনি পরিচিত হয়েছিলেন চাওয়াল ওয়ালে নামে। নবাব, ধনী ও শৌখিন আমিরদের পোলাও ও বিরিয়ানি তৈরিতে যে মুরগির মাংস ব্যবহার করা হত, সেই মুরগিগুলিকে কয়েক মাস ধরে কেশর ও কস্তুরীর গুলি তৈরি করে খাওয়ানো হত, যাতে করে ওই মুরগির মাংসে এই দুই বস্তুর সুগন্ধ মিশে যায়। রান্নায় উচ্চ তালিম প্রাপ্ত কিছু বাবুর্চি পোলাও রান্না করে তা এমনভাবে পরিবেশন করতেন যে সবাইকে চমকে দিত। পোলাও-এর মাংসকে সেদ্ধ করে তা দিয়ে পাখি তৈরি করা হত। এমন কৌশলে তা রান্না হত যে রান্নার পরও পাখির আকৃতিতে কোনও পরিবর্তন হত না। রান্নার পর পোলাও এমনভাবে থালায় পরিবেশন করা হত যে, দেখে মনে হত থালায় পাখি বসে দানা খাচ্ছে।

বিরিয়ানির প্রকৃত উৎস খাদ্য-ইতিহাসবিদেরা খুঁজে পাননি। সাফাদি সাম্রাজ্যের সময় আর্যভূমিতে ‘বেরিয়ান পিলাও’ নামে একধরনের বিরিয়ানি তুল্য খাবার পাওয়া যেত। ঐতিহাসিক লিজি কোলিংহামের মতে, ভারতীয় শস্যদানার খাদ্য ও আর্যভূমির ‘পিলাফ’ বা পোলাও, এ দুটি খাবারের ধারণা থেকে প্রস্তুত খাদ্য মুঘল দরবারে পরিবেশিত হত, যার নাম তিনি বিরিয়ানি বলে উল্লেখ করেছেন। ভারতবর্ষে বাবরের আগমনের পূর্বে বিরিয়ানি ছিল বলে অনেকে ধারণা করেন। তবে সেই বিরিয়ানি আর মাংসের খিচুড়িতে কোনও তফাত ছিল না। আর-এক ধারণামতে, তুর্কিরা যখন ভারতবর্ষে এসেছিল তখন তারা যুদ্ধের আগে দ্রুত প্রাতরাশ সেরে নেওয়ার জন্য চাল ও কাঁচা মাংস কড়াইয়ে চড়িয়ে একধরনের খাবার প্রস্তুত করত, যাকে বিরিয়ানি বলা যায়, কিন্তু সেই খাবারে তারা মশলা, এমনকি নুন পর্যন্ত ব্যবহার করত কি না তা কারও জানা নেই। ‘আইন-এ-আকবরী’ গ্রন্থ অনুযায়ী পোলাও আর বিরিয়ানির মাঝে কোনও তফাত ছিল না, শুধু পার্থক্য হচ্ছে বিরিয়ানি শব্দটা ভারতে বহু আগেই প্রচলিত ছিল। বিখ্যাত পরিব্রাজক অলবিরুনির বর্ণনায় মুঘল ও মুঘল সাম্রাজ্যের পার্শ্ববর্তী সাম্রাজ্যগুলোতে বিরিয়ানির উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত আছে একদা শাহজাহানের সুলতানা মমতাজ সেনানিবাস ভ্রমণে সৈন্যদের অবসাদগ্রস্ত দেখে বাবুর্চিকে সেনাদের ক্লান্তি দূরীকরণে বিশেষ খাবার রান্নার নির্দেশ দেন, যা পরে বিরিয়ানি নামে পরিচিত হয়। প্রতিভা করণের মতে, আরব বণিকদের হাত ধরে পোলাও দক্ষিণ ভারত তথা দ্রাবিড়াঞ্চলে এসে আঞ্চলিক রন্ধনশৈলীর স্পর্শে বিরিয়ানি হয়েছে। এ ছাড়াও তামিলনাড়ুতে ২০০ খ্রিস্টাব্দে ‘উন সোরু’ নামক বিরিয়ানির মতো খাবারের নাম পাওয়া যায়। সৈন্যদের জন্য তৈরি এই পদ হত চাল, ঘি, মাংস, হলুদ, ধনে, তেজপাতা আর গোলমরিচ দিয়ে। দক্ষিণী বিরিয়ানি তাই এখনও বেশ স্পাইসি। মুঘল দরবারের বিরিয়ানি কেমন ছিল সেটা এখনও গোপন রয়ে গেলেও ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ মুঘল দরবারের বিরিয়ানির কিছুটা স্বাদ আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর চাকরিচ্যুত সিপাহি ও মুঘল প্রাসাদের রন্ধনশিল্পীরা সেই বিরিয়ানিকে পুরো ভারতে ছড়িয়ে দেয়, পেটের তাগিদে তারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বিরিয়ানি বিক্রির দোকান খুলে বসে।

অযোধ‍্যার শাহি বাবুর্চিরা নানারকমের বিরিয়ানির উদ্ভব করেছিলেন। বিরিয়ানিতে পাখির মাংসের ব্যবহার শুরু করার কৃতিত্বও আওয়াধি বাবুর্চিদেরই প্রাপ্য। এ ছাড়াও তাঁদের অন্যতম কৃতিত্ব ছিল দমপখত বিরিয়ানির উদ্ভব। চাল, মাংস ও মশলা হাঁড়ির ভেতরে দিয়ে সেই হাঁড়ি হালকা আঁচের উনুনে বসিয়ে ধীরে ধীরে তা রান্না করা হত। নবাব আসফ-উদ-দৌল্লার আমলে বড়ো ইমামবাড়া নির্মাণের সময় নির্মাণকার্যে নিযুক্ত শ্রমিকদের মাঝে এই বিরিয়ানি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। ইমামবাড়া তৈরির সময় নবাবি লঙ্গরখানার উনুনে অল্প আঁচে চাপানো থাকত এই দমপখত বিরিয়ানি। শ্রমিকরা তাদের কাজের ফাঁকে এসে খেয়ে যেত। পরবর্তীতে এই দমপখত বিরিয়ানি নবাব পরিবারেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

কলকাতার বিরিয়ানি উদ্ভবের আবার আলাদা ইতিহাস। ১৮৫৬ সালে অযোধ‍্যার শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে কলকাতার মেটিয়াবুরুজে নির্বাসিত করা হয়। তিনি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তাঁর প্রাসাদের বাবুর্চিকেও। বাবুর্চি সেখানে বিরিয়ানি রান্না করে এবং মেটিয়াবুরুজ সহ কলকাতাবাসী সেই রান্না শিখে নেয়। কলকাতার দরিদ্র পরিবারগুলো মাংস কিনতে অসমর্থ হওয়ায় তারা মাংসের বদলে আলু ব্যবহার করতে শুরু করে। লখনউ বিরিয়ানিতে মাংসের সঙ্গে আলু যুক্ত করে নিজেদের মতো মশলা ব্যবহার করে কলকাতাবাসীরা যে বিরিয়ানির জন্ম দেয় সেই বিরিয়ানিই এখন কলকাতাইয়া বিরিয়ানি নামে শহরতলির দোকানগুলোতে বিক্রি হয়ে থাকে।  মেটিয়াবুরুজে বসবাসকালেও সুলতানের দস্তরখান সাজানো থাকত নানান রকমের শাহি খাবার দিয়ে। সুলতান ওয়াজিদ আলি শাহ প্রতিটি পদের এক চামচ অথবা এক মুঠো পরিমাণ খাদ্য নিতেন। সুলতান ওয়াজিদ আলি শাহের মেটিয়াবুরুজ প্রাসাদের এক বাবুর্চি প্রতিদিন সুলতানের জন্য এক আশরফি (সোনার মোহর) সহযোগে পোলাও রান্না করতেন। নিপুণ পাচক আশরফিকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এমন দ্রবণে পরিণত করতেন যে পোলাওয়ের মধ্যে তার চিহ্নও দেখতে পাওয়া যেত না।

কাশ্মীরে তেহারি নামে একধরনের বিরিয়ানি পাওয়া যায়। তেহারিকে বিরিয়ানির একটি বিশেষ পরিমার্জিত ধরন বলা চলে। তেহারিতে মাংসের পরিমাণ থাকে কম। আলু ও হাড় থাকে বেশি। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চড়া দামের কারণে খরচ বাঁচাতে এই বৈচিত্র্য আনা হয়েছিল। তবে প্রেক্ষাপট বদলে গেলেও এখনও আবেদন বদলে যায়নি তেহারির। কাশ্মীরে তেহারি এখনও একটি অতি জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড।

পুরোনো ঢাকায় সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হল কাচ্চি বিরিয়ানি। কাচ্চি শব্দটা এসেছে উর্দু কাচ্চা শব্দটি থেকে, যার বাংলা অর্থ কাঁচা। যেহেতু সুগন্ধি চালের সাথে মাংস সরাসরি রান্না করা হয়, তাই এর নাম হয়েছে কাচ্চি। এটি হিন্দি এবং উর্দুতেও একই নামে পরিচিত। সেদ্ধ না করা খাসির গোস্ত টকদই দিয়ে মাখিয়ে তার উপর আলু আর চালের আস্তরণ দিয়ে রান্না করা হয় কাচ্চি বিরিয়ানি। অন্যদিকে সেদ্ধ বা পাক করা মাংস চালের সাথে মিশিয়ে তৈরি করা হয় পাক্কি বিরিয়ানি।

গবেষক মুহিত হাসান তাঁর ‘দিশি ও বিলাতি’ গ্রন্থে লিখছেন, “মোগল আমলে নাহয় বাংলায় বিরিয়ানির প্রবেশ ঘটল, কিন্তু তখনই কি তা ঘরে ঘরে বিলাসী খাবার বা উৎসবের খাবার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল? তেমন তথ্যপ্রমাণ কিন্তু মেলে না। মধ্যযুগের একাধিক বাংলা কাব্যে বিলাসী খাদ্য হিসেবে পোলাওয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। পূর্ব্ববঙ্গগীতিকার ‘চৌধুরীর পালা’য় এক জমিদার বন্ধুদের আপ্যায়নের জন্য ‘পোলাউ কোরমা তৈয়ার করিল/পাঠাখাসী বহুত মারিল’ এমন সংবাদও মেলে। কিন্তু বিরিয়ানি গরহাজির। আবার ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যের নায়িকা ছাগমাংস ও খিচুড়ি রান্না করলেও বিরিয়ানি নৈব নৈব চ। বাংলার নবাব আলিবর্দি খানের খাদ্যতালিকায় খিচুড়ির দেখা মেলে, কিন্তু বিরিয়ানির কথা সেখানে নেই। এখনও অব্দি প্রাপ্ত বাংলা ভাষার প্রথম দুটি রান্নার বই পাকরাজেশ্বর (প্রথম প্রকাশ ১৮৩১-এ) ও ব্যঞ্জন রত্নাকর (১৮৫৮)-এ (দুটি বই-ই বর্ধমানের রাজপরিবারের উদ্যোগে প্রকাশ পেয়েছিল) বিরিয়ানির নামগন্ধ অব্দি নেই। কিন্তু বহুরকমের পোলাওয়ের পাক-প্রণালী দুটি বইতেই লিপিবদ্ধ হয়েছিল। শেষোক্ত বইটিতে তো ষাট রকমের পোলাও-প্রকরণের উল্লেখ রয়েছে। ‘আম্র পলান্ন, ‘অলাবু-পলান্ন’, ‘শীরাজি পলান্ন’ থেকে শুরু করে এমনকি ‘তিন্তিড়ী পলান্ন’ অর্থাৎ তেঁতুলের পোলাওয়ের কথাও বাদ যায়নি! উনিশ শতকে প্রকাশিত আরেকটি রান্নার বই শরৎচন্দ্র দাসের বিশুদ্ধ পাক-প্রণালী-তেও গোলাপ ফুলের পোলাও বা হাবশি পোলাওয়ের রেসিপি আছে, কিন্তু বিরিয়ানি যথারীতি অনুপস্থিত।”

বাঙালির ভাত-পাতে

‘বাইর থিক্যা ঘরে আসি মনের হাউস লইয়া
ক্ষুধাত পামু গরম ভাত ডাইলে লেবু দিয়া।
ভাজা বড়ার মুচমুচ্যানি জিবে পানি আনে
ঝুলের থিক্যা উঁকি মাইর‍্যা মাছের মুড়া দেখে।’

কথায় বলে বাঙালি হল ভাতে আর মাছে। একেবারে শুরুর দিন থেকেই প্রচুর জলাজমি, নদী আর বৃষ্টির জন্য বঙ্গভূমি ধান চাষের জন্য একেবারে আদর্শ। অনাবৃষ্টিতে ধান নষ্ট, আবার অতিবৃষ্টিতে পোকা লেগে শস্যের ক্ষতি। বাঙালি তাই ছড়া বাঁধে ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে/ ধান দেব মেপে/ ধানের ভিতর পোকা/ জামাইবাবু বোকা।’ বাংলাদেশে ধান হল লক্ষ্মী। কত বৈচিত্র্য তার। শালিধান, দুধের সর, জয়া, রত্না, লক্ষ্মীবিলাস, সীতাভোগ, বালাম, বউয়ারি, এমনকি রাঁধুনিপাগল (মানে যার সুগন্ধে স্বয়ং রাঁধুনিও পাগলপারা)। বাঙালি তখন খেতেও পারত তেমনি। বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় পাই, ‘তখনকার দিনে অধিকাংশ লোক ভাত খাইত। শহরে লোকেরা আড়াই পোয়া চালের ভাত, রাত্রে আধসের চাল ও তদুপযুক্ত তরকারী।’ আর সে ভাত রান্নাও হত নানা বিচিত্র রকমে। হাঁড়ি ধুয়ে আধফোটা জলে চাল দিয়ে ঝরঝরে ভাত, রোগীর জন্য নরম ভাত, নামাবার আগে গন্ধরাজ লেবুপাতা দিয়ে সুগন্ধি ভাত কিংবা মাড় গালার পরেই অল্প ঘি দিয়ে ঘি-ভাত। বাসি ভাতকেও সুস্বাদু করতে তাতে জল ঢেলে কাঁচালংকা/মরিচ, পেঁয়াজ, কাসুন্দি, ভাজা আর চচ্চড়ি দিয়ে পান্তা খাওয়া হত সে কবে থেকে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে কবি হনুমানকেও ভাত খাইয়ে ছেড়েছেন। সীতা ব্যঞ্জন আনার আগেই নাকি হনুমানের পাতের ভাত শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তবে সব ভাতের মধ্যে পান্তা নিয়ে বাঙালির যত নস্টালজিয়া, এমনটি বোধহয় অন্য কোথাও নেই। পান্তার মধ্যে এক অদ্ভুত সরল জীবনচর্যা, অপচয়বিরোধী মনোভাব আর জ্বালানি বাঁচানোর প্রচেষ্টা দেখা যায়। আজও ঢাকায় নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয় পান্তা খেয়ে। বরিশাল জেলায় একে বলে ‘পসুতি’ ভাত, আবার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় পেট ঠান্ডা রাখা পান্তার নাম ‘পোষ্টাই।’ বাঙালি লোককথা, গানে আর ছড়াতেও পান্তার জয়জয়কার। একটি শিশু ছড়ায় আছে, ‘পান্তা খেয়ে শান্ত হয়ে কাপড় দিয়ে গায়/ গোরু চরাতে পাঁচন হাতে রাখাল ছেলে যায়।’ দুর্গাপুজোর দশমীর দিন সকালে দেবীকে পান্তা ভাত আর কচুর শাক খাইয়ে বাঙালি তাঁকে বিদায় জানায়। তিন দিন বাপের বাড়িতে নানা ব্যঞ্জন খাবার কথা স্বামীর থেকে গোপন রাখতেই নাকি শেষ দিন দেবী কচুর শাক আর পান্তা খান। স্বামী ‘কী দিয়ে খেয়ে এলে?’ জিজ্ঞেস করলে যেন বলতে পারেন দরিদ্র পিতা এর বেশি কিছু খাওয়াতে পারেননি।

ভাতের আলোচনায় ডালের প্রসঙ্গ আসবেই। ভাত কার্বোহাইড্রেট আর ডাল প্রোটিন— তাই ডালে ভাতে এক সুষম খাবারের দিশা দেখায়। বাংলায় ডাল খাওয়া খুব সম্ভব মধ্যযুগ থেকে শুরু। ডালের একঘেয়েমি দূর করতে ভিন্ন ভিন্ন ফোড়নের নির্দেশ দিয়েছেন বাঙালি রাঁধুনিরা। কাঁচালংকা, পাঁচফোড়ন, জিরে, কালোজিরে, মেথি, শুকনো লংকা, রাঁধুনি, পেঁয়াজ, রসুন— এক-এক ডালে এক-এক ফোড়ন। ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল, শিম দিয়ে মুসুর ডাল, লাউ আর করলা দিয়ে তেতোর ডাল, গরমের দিনে আম আর চালতার টকডাল, আদা বাটা দিয়ে অড়হর ডাল, গরম মশলা-ঘি-তেজপাতা-নারকেল দিয়ে ছোলার ডালের কী অপূর্ব স্বাদ, তা বাঙালি মাত্রেই জানেন।

ডাল-ভাতের সঙ্গে বিভিন্ন সবজি খাবার প্রচলন অনেক আগের। তবে পর্তুগিজরা আসার আগে বাঙালি আলুর সঙ্গে পরিচিত ছিল না। মধ্যযুগের নানা লেখা থেকে বোঝা যায়, তরকারি হিসেবে প্রধান ছিল কুমড়ো, বেগুন, ঝিঙে, থোড়, মোচা, কাঁচকলা, পটল, লাউ, ওল, কচু, মুলো, শিম আর নিমপাতা। বাংলা প্রবাদে আছে, ‘আগে তিতা পাছে মিঠা’— আগে তেতো খেয়ে পরে মিষ্টি খেতে হয়। তিক্তরস স্বাদগ্রহণের শক্তি বৃদ্ধি করে, শরীরের দোষ নাশ করে। মনসামঙ্গলেও চাঁদের পত্নী সনকা পাটাতে পলতা পাতা ছেঁচে ধনিয়া, বেগুন দিয়ে ‘জ্বর পিত্ত আদি নাশ করার কারণ/ কাঁচকলা দিয়া রান্ধে সুগন্ধ পাঁচন।’ তেতো খাবারের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বোধ করি শুক্তো। শুক্তো কী কী দিয়ে রান্না করা যায়, তার তালিকা বিশাল— পেঁপে, কাঁচকলা, থানকুনি পাতা, শিম, বেগুন, উচ্ছে, মুলো, কুমড়ো, রাঙা আলু, শাপলা, ধুঁধুল (ইত্যাদি)। চণ্ডীমঙ্গলে পাই— ‘সিম, নিম, বেগুনের তিতা, কুমড়া, বেগুনের সুকতা।’

শুক্তোর পরেই আসে শাকের কথা। শাক খাবারে স্বাদ বাড়ায়, কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখে, রক্তাল্পতা দূর করে। গ্রীষ্মে নটে, জলসাচি, বর্ষায় কলমি, পুঁইডাঁটা, চালকুমড়ো, শীতে মুলো, পালং, সর্ষে শাক, লাউ শাক, নলতে শাক খাওয়া হত। কালীপুজোর আগের দিন চতুর্দশীতে এখনও চৌদ্দ শাক খাওয়া হয়। শাকের মহিমা আছে মহাভারতেও। ধর্মরাজের ‘সুখী কে?’ প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলছেন, ‘… অপ্রবাসে যেইজন রয়/ যদ্যপি মধ্যাহ্ন কালে শাক-অন্ন খায়।’ চণ্ডীমঙ্গলে খুল্লনার গর্ভের সপ্তম মাসে সাধ দেওয়ার জন্য পালং, গিমা, হেলেঞ্চা, কলম্বু শাক, তির পোর লার শাক, পুঁই শাক ও গান্ধারি খুরিয়ার শাকের উল্লেখ পাই। চণ্ডীর কাছে মহাদেব আমড়া দিয়ে পালং শাক রান্নার প্রস্তাব দিয়েছেন। শচী দেবী শ্রীচৈতন্যকে রান্না করে খাইয়েছেন কুড়ি রকম শাক। চৈতন্যর দীক্ষাগুরু কেশব ভারতীর বাস ছিল কাটোয়ায়। কাটোয়া আবার শাক ও ডাঁটার জন্য বিখ্যাত। ডাঁটার মধ্যে লাউ, কুমড়ো, পুঁইডাঁটা, সজনে ডাঁটা বাঙালির রসনাকে এখনও তৃপ্ত করছে সমানভাবে। তবে মূলত পূর্ববঙ্গে তরকারি হিসেবে আরও একটি দ্রব্য বিখ্যাত। তা হল কচু। কচুর মূল, ডাঁটা, পাতা, ফুল— কিছুই ফেলনা নয়। কচু ভাতে, নারকেল দিয়ে কচু বাটা, আলু কুমড়োর সাথে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচু রান্নায় অপূর্ব স্বাদ আনে।

জলের দেশ বাংলা। আর তাই মাছের প্রাচুর্য এখানে চিরকাল। মধ্যযুগের রান্নার বর্ণনায় জিরে লবঙ্গ দিয়ে কই, মরিচ দিয়ে চিতল মাছ, মাগুর মাছের ঝোল, মানকচু দিয়ে শোল মাছ, সবজি দিয়ে রুই মাছের কথা পাই। সতীশ চন্দ্র মিত্র যশোর-খুলনার ইতিহাস বইতে যশোর জেলার যেসব মাছের বর্ণনা দিয়েছেন তার তালিকা চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো— চিতল, ফলি, ফ্যাসা, চাপিলা, কাচকি, কুকর জিব, কুমিরের খিল, পোটক, কাকিলা, ইটাখোটা, শোল, গজাল, ল্যাটা, চ্যাং, মোলা, ঘনিয়া, রানি মাছ, গুটুম, কানি পাবদা, মধু পাবদা, চাকা, ঘাউরা, রিটা, আগরে ইত্যাদি মোট পঞ্চাশ রকম। খুলনা জেলার গলদা, চাকা, বাগদা, চাষনে ও হরিণা চিংড়ি ছিল বিখ্যাত। শাস্ত্রে অবশ্য মাছের রাজা ইলিশ দুর্গাপুজোর পর থেকে সরস্বতী পুজো অবধি না খেতে বলেও এর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে— ‘সর্বৈষামেব মৎস্যানাং ইল্লিশঃ শ্রেষ্ঠ উচ্চ্যতে।’ বাংলাদেশে একে বলে— ‘জামাই ভুলাইনা মাছ/ ছাওয়াল কাদাইনা মাছ।’ ইলিশের আঁশ ঘরে পোঁতা থাকলে নাকি গৃহস্থের মঙ্গল হয়। সরস্বতী পুজোতে জোড়া ইলিশ ঘরে তোলার নিয়ম আছে।

কালীঘাট পট। বিড়াল তপস্বী
কালীঘাট পট। বিড়াল তপস্বী

মাছ রান্নায় বাঙালি যত পটু, মাংস রান্নায় ততটা দড় নয়। মুজতবা আলী বলেছেন, বাঙালি পঁয়ষট্টি রকম মাছ রাঁধতে পারে, কিন্তু মাংস রাঁধতে একেবারেই ব্যর্থ। মঙ্গলকাব্যে কিন্তু সনকার মাংস রাঁধার বর্ণনা পাই, ‘মাংসেতে দিবার জন্য ভাজে নারিকেল/ ছাল খসাইয়া রান্ধে বুড়া খাসির তেল।’ মুসলমানি প্রভাবে বাংলায় কাবাব, জবাই করা মাংস জনপ্রিয় হয়। ‘পাঁটা’র মাংসের সঙ্গে বাঙালির সেই যে মিলন হল, আজও বাঙালির পাঁঠার মাংসের নামে নোলা সকসক করে। কবি ঈশ্বর গুপ্ত সেই কবেই লিখেছেন, ‘রসভরা রসময় রসের ছাগল/ তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল।’ মুরগির ঝোল ঝাল ঝাল করে অপূর্ব রাঁধতেন গোয়ালন্দ, চাঁদপুরের মুসলমান খালাসিরা। কিন্তু বাঙালি ঘরে ‘রামপাখি’ ঢুকতে সময় নিয়েছে বেশ কয়েক যুগ।

প্রথম দিকে ডিম বলতে একমাত্র হাঁসের ডিম খেত বাঙালি। অনেক পরে মুরগি আর কচ্ছপের ডিম খাদ্যতালিকায় আসে; কচ্ছপের খোলা ছাড়া ডিম সেদ্ধ করে, ভেজে হলুদ, নুন, লংকা, পেঁয়াজ, রসুন দিয়ে অপূর্ব রান্না হয়।

খাদ্যরসিক বাঙালির টকও বড্ড প্রিয়। খাবার শেষ হবার মুহূর্তে তার চাই-ই চাই অম্বল, চাটনি, নয় আচার। এর জন্য রয়েছে আম, আমড়া, করমচা, তেঁতুল, টমেটো, আনারস, আলুবোখরা, ইদানীং কাঁচা পেঁপের চাটনিও বাঙালিদের প্রিয় হয়েছে। প্রিয় হয়েছে ধনেপাতার চাটনিও। কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যজীবনকথায় লিখছেন—

 নেবু আদা আম্র কোলি বিবিধ বিধান
 আমসী আম্রখণ্ড ইতলম্বি আমতা।
 যত্ন করি গুন্তি করি পুরাণ মুকুতা।

সব খাওয়া শেষ হলে এক খিলি পান মুখে না পুরলে বাঙালির জমে না। আগে সব বাড়িতেই পান সাজার সরঞ্জাম থাকত। পান তিন রকমের— ছাঁচি পান, মিঠা পান আর দেশি পান। পান সাজাও এক আর্ট। খিলি পান, ডবল খিলি, চৌকা খিলি তো আছেই, অনেকে আবার পানের ধারকে কাঁটা কাঁটা করে অদ্ভুত সুন্দর আকৃতি দিত। সুপারি কাটা হত ডুমো ডুমো করে, অথবা সরু সরু চুলের মতো। জাহাজি সুপারি আগে দুধে সিদ্ধ করে তবে কাটা হত। কেউ কেউ কাটা সুপারিতে পদ্মকাঁটা গোলাপকাঁটার মতো ফুলও তুলতে পারতেন। সঙ্গে থাকত দারুচিনির কাঠি, মলমলের কাপড়ে ছাঁকা খয়ের, লবঙ্গের ফুল, চুন, দোক্তাপাতা, জরদা। কাশীতে পাওয়া যেত সোনা বা রুপার পাত মারা পান। আর সে পান খেয়ে রাঙা ঠোঁট, রাঙা জিভ নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলত বাঙালি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *