লাজ আবরণ – কৃশানু বন্দ্যোপাধ্যায়
ঘুরে দাঁড়াল সুলগ্না। হাসল একটু।
হাসলে যে? প্রণয় প্রশ্ন করল।
হাসলাম তোমার অবস্থা দেখে। তুমি ভয় পেয়ে গেছ। হয়তো পিছিয়েও যাবে।
ভয় আমি পেয়ে গেছি ঠিকই, তবে পিছিয়ে যাব না। বাড়ি থেকে শেষ পর্যন্ত মত আদায় করতে পারব বলেই মনে হয়।
আর যদি মত না পাওয়া যায়?
তবে····
অনুনয়ে ভেঙে পড়ল সুলগ্না ; কোন ‘তবে’ নয়। একটু শক্ত হও প্রণয়। আপ্রাণ ভাবে আমার পাশে এসে দাঁড়াবার চেষ্টা কর। নইলে আমি কোথায় ভেসে যাব একবার ভেবে দেখ।
প্রণয় দু’বার কেশে নিয়ে বলল, এখন থেকে কেন তুমি এত উতলা হয়ে পড়ছো লগ্না। হয়তো অশুভ কোন কিছু ঘটবে না। হয়তো·····।
ওই ‘হয়তো ’ কথাটাতেই আমার আপত্তি। সমাধান তো তোমার হাতে রয়েছে। তুমি ভাল চাকরি করছ—তুমি স্বাবলম্বী, কেন পরের কথার ওপর নির্ভর করে থাকবে?
প্রণয় সুলগ্নার কাঁধে হাত রেখে বলল, কেন তুমি মিথ্যে চিন্তা করছ? বলছি তো সব ঠিক হয়ে যাবে। সন্ধ্যা হয়ে এল। চল, এখন ফিরি।
বার্চ স্ট্রীটের একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে সুলগ্না থাকে। ওকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে সেদিনকার মত বিদায় নিল প্রণয়। বিমর্ষ ভাবে করিডর অতিক্রম করল সুলগ্না। ওধারের বারান্দায় পা দিতেই আনন্দবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সুলগ্নার নেক্সট্ ডোর নেবার। তিনি ব্যস্ত ভাবে কোথায় যাচ্ছিলেন। ওকে দেখে বললেন, তোমার বাবা অনেকক্ষণ থেকে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
সুলগ্না দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে এল। উমানাথ ডেকচেয়ারে বসে পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। বিজয় দাঁড়িয়ে ছিল জানলার একপাশে। মেয়েকে দেখে উমানাথ বললেন, ঘণ্টাখানেক হল আমি এসেছি।
অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়ে গেল বাবা। সুলগ্না বলল, চা খাবে তো?
না । ভেবেছিলাম শনিবার দিন তুমি বাড়ি যাবে। গেলে না যখন, অগত্যা আমাকেই আসতে হল। তোমার ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি আমার কাছে ছিল, তাই—নইলে ঘণ্টাখানেক বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে হত। যাক, যা বলতে আসা, তাই এখন আরম্ভ করা যাক। আটটা সাতাশের ট্রেনে আবার আমায় ফিরে যেতে হবে। বিজয়—
ভাইপোর দিকে তাকালেন উমানাথ।
বিজয় বলল, দত্তরা আর অপেক্ষা করতে চাইছে না। সামনের ফাল্গুনেই শুভকাজটা শেষ করে ফেলতে চায়।
আর,—উমানাথ বললেন, তুমি এই সপ্তাহের মধ্যে চাকরিতে ইস্তফা দেবে।
কিন্তু····
যুগের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে গেলে স্ত্রী-স্বাধীনতাকে সমর্থন করতেই হবে। আমি তাই করেছি। তোমাকে চাকরি করবার স্বাধীনতা আমি দিয়েছি। এবার বিয়ে-থা করে সংসারী হও—এই আমার ইচ্ছে। অমিয় ছেলেটি ভাল, তাকে তুমি দেখেছ। তার ইচ্ছে নয় বিয়ের পর তুমি চাকরি কর। ইস্তফার কথা তাই বললাম।
সুলগ্নার মনের মধ্যেটা গুলিয়ে উঠল। অসংখ্য কথা ভিড় করে এল ঠোঁটের আগায়। কিন্তু রাশভারী উমানাথের মুখের ওপর একটা কথাও বলতে পারল না। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।
আরো দু-চার কথা বলবার পর খুড়ো-ভাইপো বিদায় নিলেন।
দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনায় সুলগ্নার মন আগে থেকেই ভারাক্রান্ত ছিল। এখন যেন একেবারে নুয়ে পড়তে চাইছে। ওর প্রতি একি অবিচার? এখন সমস্ত কিছু নির্ভর করছে প্রণয়ের ওপর। সেই একমাত্র পারে এই জটিল পরিস্থিতির ওপর সুন্দর ভাবে যবনিকা টেনে দিতে।
ভেতরে আসতে পারি?
উমানাথ চলে যাবার পর তাঁরই পরিত্যক্ত ডেকচেয়ারে বসে চিন্তার অতলান্ত সমুদ্রে সাঁতরে বেড়াচ্ছিল সুলগ্না। চমকে মুখ তুলল সে। অমিয় দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার সামনে। অমিয় দত্ত—সুলগ্নাদের সোনারপুরের প্রতিবেশী। ন্যাশনাল রেফ্রিজারেটার কোম্পানিতে ভাল চাকরি করে। সেই সুলগ্নাকে ওখানে কাজ সংগ্রহ করে দিয়েছে। অবশ্য সুলগ্না তাকে কোনদিনই আমল দেয়নি। অফিসে যোগ দেবার পরই প্রণয়ের সঙ্গে ওর পরিচয় হয়। এবং সেই পরিচয় ধীরে ধীরে অন্তরঙ্গতায় পরিণত হয়েছে। একথা যে অমিয়র অজানা, তা নয়। তবু সুলগ্নাকে সে বিয়ে করতে চায়। উমানাথ প্রণয়ের সম্পর্কে কিছু জানেন না। অমিয়কে তাঁর পছন্দ। তার কৈশোর থেকেই তাকে তিনি দেখছেন। বেশ ছেলে। খাসা জামাই হবে।
অমিয়কে দেখেই সুলগ্না জ্বলে উঠল। ওকে পরিষ্কার ভাবে নিজের মনের ভাব বুঝিয়ে দেবে এখুনি।
কি চান?
তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল।
বাজে নষ্ট করবার মত সময় আমার নেই। বাবা এসেছিলেন একটু আগে। তাঁর মুখের ওপর যে কথাটা বলতে পারিনি, আপনি যখন এসে পড়েছেন, তখন শুনে যান—আপনার সঙ্গে কোন রকম সম্পর্ক গড়ে তোলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
অমিয়র চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।—ভুলে যেও না, তোমার আজকের স্বচ্ছলতার জন্যে দায়ী বোধ হয় আমিই। আমি চাকরির ব্যবস্থা করে না দিলে·····
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সুলগ্না বলল, আপনি আমার উপকার করেছিলেন, সেকথা আমি অস্বীকার করছি না; কিন্তু সেজন্যে আপনাকে বিয়ে করতে হবে—এমন কোন বাধ্যবাধকতা নিশ্চয়ই নেই।
কথাটা শেষ করেই সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলে। আবার এসে বসল ডেকচেয়ারে। ভালই হল, অমিয়কে পরিষ্কার করে বলে দেওয়া গেছে। এখন মাকে জানাবে নিজের অবস্থার কথা। লজ্জার মাথা খেযেই জানাবে। ডেকচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সুলগ্না। ঘরখানা ওর মাঝারি সাইজের। আসবাবপত্র যে খুব বেশি আছে তা নয়। একখানা স্প্রীং দেওয়া লোহার খাট, ছোট একটা ট্রাঙ্ক, স্যুটকেশ, টেবিল-চেয়ার, ডেকচেয়ারখানা ও রেফ্রিজারেটার। দামী রেফ্রিজারেটারটা ও কোম্পানি থেকেই সংগ্রহ করেছে। সুলগ্না টেবিলের সামনে গিয়ে বসল। প্যাড টেনে নিয়ে মাকে চিঠি লিখতে আরম্ভ করল।
সোনার চামচ মুখে নিয়ে উমানাথ জন্মেছিলেন উত্তর কলকাতার এক অভিজাত পরিবারে। কিন্তু সেই সোনার চামচ জার্মান সিলভারে রূপ নিতে খুব বেশি সময় নেয়নি। কিছু বয়স বাড়ার পরই উমানাথ দেখলেন তাঁদের বিরাট বাড়ির খিলেনে খিলেনে ফাটল ধরেছে। সব ঘরের ঝাড়লণ্ঠনগুলো আর জ্বলে না। ঘরে ঘরে পাতা দামী জাজিমের ছোট ছোট খোঁচ বিরাট বিরাট হাঁ-এর আকার নিয়েছে।
এই সব ব্যতিক্রম কেন?
‘কেন’র উত্তর যে উমানাথের অজানা, তা নয়। প্রথম যেদিন তিনি তাঁর বাবা দিবানাথকে অনেক রাত্রে টলতে টলতে বাড়ি ফিরতে দেখেন, সেই দিন থেকেই তিনি জানেন, তাঁদের সমস্ত ঐশ্বর্য ওই মদের স্রোতেই ভেসে যাচ্ছে। বাড়ির ইঁটটিও বোধ হয় বিক্রি হয়ে যেত, যদি না দিবানাথ মারা যেতেন। মারা যাবার সময় তিনি ছেলের জন্যে রেখে গিয়েছিলেন শুধু বিরাট আধভাঙা বাড়িখানা—আর কিছু নয়।
এরপর উমানাথের জীবন-সংগ্রামের পালা।
বহু বাধা-বিঘ্নকে অতিক্রম করে····কঠিন পরিশ্রমে নিজেকে বিলিয়ে অবশেষে জয়লাভ করেছেন তিনি। প্রচণ্ড বড়লোক অবশ্য হতে পারেননি, তবে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে সংসার-সমুদ্রে ডুবে না গিয়ে, কুটো অবলম্বন করে ভাসতে পেরেছেন। তাঁর চাকরি জীবন শুরু হয়েছিল এ-এস-এম’য়ের পদে নিয়োগ পেয়ে। উত্তর কলকাতার ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে উঠে এসেছিলেন সোনারপুরের নিরালা আওতায়।
তারপর কত বছর কেটে গেছে। অশোক ও সুলগ্না বড় হয়েছে। মাতৃ-পিতৃহীন বিজয়—সে অশোকের বয়সী। সেও আছে সংসারে। খরচ ক্রমেই বেড়ে চলেছে, অথচ সেই অনুপাতে আয় বাড়েনি। রেলের অ্যাসিস্টেন্ট স্টেশন মাস্টারের কতই বা মাইনে! কিছু উপরি পাওনা আছে, এই যা রক্ষে। বাড়িতে সমর্থ দু-দুটো ছেলে—চাকরির জন্যে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে তারা। কিন্তু কোথায় চাকরি?
উমানাথের পাশের বাড়িতেই থাকেন দত্তরা। দত্তদের বড় ছেলে অমিয় কলকাতার এক বিখ্যাত রেফ্রিজারেটার কোম্পানিতে কাজ করে। সে সংবাদ দিল একদিন, তাদের অফিসে সুলগ্নার চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। রিসেপশান কাউন্টারে একজন মহিলার প্রয়োজন। ব্রাঞ্চ-ম্যানেজারের সঙ্গে খাতির আছে অমিয়র। অনুরোধ করলে সুলগ্নাকে ওই পদে তিনি মনোনীত করতে পারেন। সুলগ্না ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বসেছিল। এই প্রস্তাবে উমানাথ রাজী হতে পারলেন না। তিনি প্রাচীনপন্থী, স্ত্রী-স্বাধীনতাকে খুব ভাল চোখে দেখেন না। বাড়ির লোকেদের চাপে পড়ে মেয়েকে পড়িয়েছেন, আবার চাকরি!
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে মত দিতে হল।
অশোকও বিজয় অনেক বোঝাল। সংসারের অবস্থা কতটা স্বচ্ছল হয়ে উঠবে, সে সম্পর্কে ইঙ্গিত দিল। সবশেষে জানাল, ওদের দুজনের মধ্যে একজনের চাকরি হয়ে গেলেই সুলগ্নাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে আনা হবে। কাজে যোগ দিল সুলগ্না। কিন্তু ছ’মাসের মধ্যে ওকে বাড়ি ছাড়তে হল—অর্থাৎ কাজে যোগ দেবার সময় এমন ভাবে নির্দিষ্ট হল, যাতে নিয়মিত সোনারপুর থেকে গিয়ে অফিস করা যায় না। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেয়ের কলকাতায় বাসা ঠিক করে দিলেন উমানাথ। তাঁর বন্ধু আনন্দ বার্চ স্ট্রীটের এক বাড়িতে তিনখানা ঘর ভাড়া নিয়ে বাস করতেন। তিনখানা ঘর তাঁর প্রয়োজন হত না । একখানা সাবলেট করবেন ঠিক করেছিলেন।
কথায় কথায় উমানাথকে একদিন বলেছিলেন, একজন ভদ্রলোক পেলে ঘরটা তাকে দিই
মৃদু হেসে উমানাথ বলেছিলেন, আজকাল ভদ্রলোক আর তুমি পাচ্ছ কোথায়?
শেষ পর্যন্ত ওই ঘরখানাই সুলগ্নার কাজে লেগে গেল। খাওয়া-দাওয়া অবশ্য আনন্দবাবুর ওখানেই সারে পেয়িং গেস্ট হিসেবে। ইতিমধ্যে অবশ্য অশোক আর বিজয়ের চাকরি হয়েছিল।
অমিয়কে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার পর দিন সাতেক কেটে গেছে। গোধূলি লগ্ন তখন। আনন্দবাবু অফিস থেকে ফিরে এলেন। করিডর অতিক্রম করে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতে যাবেন, দেখলেন একজন অপরিচিত লোক সুলগ্নার দরজা ঠেলাঠেলি করছেন। সুলগ্না ফিরে এসেছে নাকি? তাঁদের না বলে-কয়েই কোথায় ডুব মেরেছিল ও কাল থেকে?
দরজার কাছে গিয়ে আনন্দবাবু দেখলেন, কড়ায় তালা লাগানো নেই। হঠাৎ তাঁর মনে হল, অফিসে যাবার সময়ও যেন দরজার কড়ায় তালা দেখেননি। সকালেই সুলগ্না নিশ্চয় ফিরে এসেছে। তাঁর সঙ্গে দেখা করেনি কেন?
লোকটার দিকে তাকিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, কাকে চাই?
সুলগ্না দেবীর সঙ্গে দেখা করব। তাঁর নামে চিঠি আছে।
ও। সাড়া দিয়েছেন?
না । প্রায় দশ মিনিট ধরে ধাক্কাধাক্কি করছি দরজা।
বিস্মিত হয়ে ভ্রূ কুঁচকোলেন আনন্দবাবু। দশ মিনিট ধরে দরজা ধাক্কা দেবার পরও সুলগ্না দরজা খুলল না—এরকম তো হবার নয়। ওর শরীর খারাপ হল নাকি? তিনিও বার কয়েক ধাক্কা দিলেন। নাম ধরে ডাকলেন। কোন সাড়া নেই। এই সময় পাশের ফ্ল্যাটের শৈলেনবাবু এলেন ঘটনাস্থলে। তিনি সব শুনে যা বললেন তা আরো চিন্তার কথা। গত সন্ধ্যা থেকেই তিনি দরজার কড়ায় তালা দেখছেন না। আনন্দবাবুর বিস্ময় আরো বর্ধিত হল, কারণ সুলগ্না তাঁর ওখানেই খাওয়া-দাওয়া করে—কাল থেকে আজ অবধি তাঁদের কাছে যায়নি। দরজা বন্ধ করেই বা এতক্ষণ করছে কি? সন্দেহের আর অবকাশ নেই, নিশ্চয়ই মারাত্মক রকমের অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে।
অন্যান্য ফ্ল্যাটেরও কয়েকজন উপস্থিত হলেন। পরিস্থিতি নিয়ে বাক্য বিনিময় হল। দরজা ভেঙে ফেলা হবে কিনা এই প্রশ্নে, দরজা ভেঙে ফেলার পক্ষেই সকলে রায় দিলেন। কিন্তু তবু দরজা ভাঙা হল না। সকলে ইতি-উতি করতে লাগলেন। চাপা গুঞ্জনে জল্পনার জাল বোনা আরম্ভ হল।
অশোক ও বিজয়কে সঙ্গে নিয়ে উমানাথ উপস্থিত হলেন ঘটনাস্থলে। সুলগ্নার ঘরের সামনে এত লোকজন দেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, কি হয়েছে আনন্দ?
কিছুই বুঝতে পারছি না ভাই। কাল থেকে দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে রয়েছে সুলগ্না।
সেকি! কাল তো সোনারপুর যাবে বলে চিঠি দিয়েছিল। তাকে আজকেও ওখানে যেতে না দেখে আমরাই চলে এলাম ব্যাপার কি জানতে।
সকলের মুখ থেকে বৃত্তান্ত শোনার পর অশোক বলল, আর আমাদের অপেক্ষা করা উচিত নয়। দরজাটা এবার ভেঙে ফেলাই ভাল।
একটা শাবল সংগ্রহ করা হল তখুনি। শাবলের চাড় দিয়ে ভেঙে ফেলা হল দরজা। ফাঁকা ঘর। সুলগ্নার সন্ধান পাওয়া গেল না ঘরের মধ্যে। অথচ দরজা ভেতর থেকেই খিল তুলে বন্ধ করা ছিল। একি রহস্য। সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন।
আনন্দবাবুই প্রথমে নীরবতা ভঙ্গ করলেন : ব্যাপার ভাল ঠেকছে না। আমার মতে পুলিশে খবর দেওয়া উচিত।
পুলিশ ! সমবেত কণ্ঠে কথাটা ধ্বনিত হল।
আনন্দবাবু দক্ষিণ দিকের খোলা জানলাটা দেখিয়ে বললেন, আমার মনে হচ্ছে, ওই জানলা দিয়েই কেউ সুলগ্নাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে।
কিডন্যাপ! বিস্ময়ে ভেঙে পড়লেন উমানাথ।
পুলিশে খবর দেওয়া হল।
যে লোকটি চিঠি নিয়ে সুলগ্নাকে ডাকাডাকি করছিল, তার দিকে তাকিয়ে বিজয় বলল, কি চিঠি এনেছিলেন দেখি।
মধ্যবয়স্ক চাকর শ্রেণীর লোকটি পকেট থেকে চিঠিটা বার করে দিল। বিজয় চিঠিখানার ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে :
লগ্না,
চতুর্দিকের পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমার পক্ষে রাজী হওয়া সম্ভব নয়। তুমি আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছ, নিশ্চিত ভাবে আমি সে সম্পর্কে একা দায়ী নই। আশা আছে, এরপর তোমার আর কোন বক্তব্য থাকতে পারে না।
প্রণয়
বিজয় উমানাথের দিকে চিঠিখানা এগিয়ে ধরল। বিপর্যস্ত মন নিয়ে উমানাথ পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিলেন। চিঠিখানা পড়ে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলেন না। সুলগ্নার প্রণয়ঘটিত ব্যাপারটা তাঁর হয়তো জানা ছিল না।
কিছুক্ষণের মধ্যে সদলবলে ইন্সপেক্টর বলাই সামন্ত এলেন। প্রবীণ এই পুলিশ কর্মচারীর দক্ষতা সর্বজনবিদিত। তিনি খুঁটিয়ে শুনলেন সব কথা। উমানাথ ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হলেন।
ঘরখানা তিনি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। খাট, রেফ্রিজারেটার, ট্রাঙ্ক ইত্যাদির ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে তিনি টেবিলের দিকে তাকালেন। টেবিলের ওপর প্যাড ইত্যাদি ছাড়াও গোটা কয়েক ওষুধের শিশি রয়েছে। ভ্যানিটি ব্যাগটাও আছে। টেবিলের বেশ কিছু ওপরে দেওয়ালের সঙ্গে কাঠের র্যাক আটকানো। র্যাকের ওপর খবর-কাগজের গোছা ও টিন বা ওই জাতীয় কিছুর জাফরিকাটা কয়েকটা ট্রে রয়েছে।
ইন্সপেক্টর সামন্ত খুঁটিয়ে জেনে নিলেন উমানাথের কাছ থেকে তাঁর পারিবারিক কথা এবং সুলগ্না সম্পর্কে মোটামুটি তথ্য। প্রশ্ন করলেন, আপনি তো প্রাচীনপন্থী, মেয়ের চাকরি করাটা পছন্দ করতেন?
অনন্যোপায় হয়ে ওকে চাকরি করতে অনুমতি দিয়েছিলাম। অবশ্য এখন আর সাংসারিক প্রয়োজনে ওর চাকরি করবার কোন দরকার পড়ে না। আমার ছেলে ও ভাইপোর চাকরি হয়েছে। তাছাড়া আমি ওর বিয়ের ব্যবস্থাও পাকা করে ফেলেছি। কিন্তু কোথায় গেল মেয়েটা বলুন তো?
পায়ে হেঁটে বা স্বেচ্ছাকৃত ভাবে তিনি যে কোথাও যাননি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। দরজা দিয়ে না গিয়ে তিনি জানলা টপকে যাবেন কোথাও—বিশেষে মেয়েমানুষ হয়ে, এটা নিশ্চয়ই বিশ্বাসযোগ্য নয়। শুনুন উমানাথবাবু, আমার সবকিছু দেখেশুনে দৃঢ় ধারণা হচ্ছে, সুলগ্না দেবীকে কেউ জোর করে নিয়ে গেছে। আচ্ছা, তাঁর কি কোন পুরুষ-বন্ধু ছিল?
বন্ধু·····
আপনি ব্যক্তিগত ভাবে কাউকে চেনেন?
না, তবে এই চিঠিখানা দেখে মনে হয়, তার একজন পুরুষ বন্ধু ছিল।
উমানাথবাবু প্রণয়ের লেখা চিঠিখানা অশোকের হাত থেকে নিয়ে এগিয়ে ধরলেন। গম্ভীর মুখে ইন্সপেক্টর চিঠিখানা পড়লেন। পকেটে রাখতে রাখতে বললেন, আপনার নামই তো আনন্দবাবু? উমানাথবাবুর বন্ধু তো আপনি?
আনন্দবাবু বললেন, হ্যাঁ।
এই ফ্ল্যাটে তো আপনারা থাকেন। বলতে পারেন, প্রণয় নামে কোন ছেলে সুলগ্না দেবীর কাছে যাওয়া-আসা করত কিনা?
ইদানীং একজনকে ওর কাছে যাওয়া-আসা করতে দেখেছি। একদিন প্রশ্ন করায় লগ্না বলেছিল—অফিসের পরিচিত। নাম জানায়নি।
অশোক ও বিজয়কেও প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর। উল্লেখযোগ্য কোন সংবাদ সংগ্রহ করতে পারলেন না । শুধু জানা গেল সুলগ্নার সঙ্গে কার বিয়ে হবার কথা হয়েছিল এবং অমিয়র ঠিকানা।
সকলকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ইন্সপেক্টর। দরজা বন্ধ করে, সেখানে একজন কনস্টেবল মোতায়েন করে তিনি বাগানে এলেন। সুলগ্নার ঘরের খোলা জানলাটার ওপাশ পরীক্ষা করাই তাঁর উদ্দেশ্য। বাগানের এই অংশে রজনীগন্ধার সমারোহ। ইন্সপেক্টর সামন্ত চোখ বুলিয়ে গেলেন চারধারে। সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেল না।
ফিরে আসবার মুখে চকচকে কি একটা পড়ে থাকতে দেখলেন। ঝুঁকে তুলে নিলেন সেটা। বোতাম—নিকেলের বোতাম একটা। বোতামটা পকেটস্থ করে সামন্ত বাইরে অপেক্ষমান জীপে গিয়ে বসলেন। জীপ এগিয়ে চলল। আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলেন তিনি। কেসটাকে কিছুতেই আয়ত্তে আনতে পারছেন না। মেয়েটাকে কেউ সত্যিই জোর করে নিয়ে গেল, না সমস্তটাই গটআপ? সে কি কারো সঙ্গে পালিয়ে গেছে—এই ভাবে সকলকে বোকা বানিয়ে বা বিপথগামী করে?
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায় সোজা হয়ে বসলেন সামন্ত। এ সম্পর্কে বাসবের সঙ্গে পরামর্শ করলে কেমন হয়? বহু রহস্যের নির্ভুল দিক-নির্দেশক বাসব। কয়েকটি তদন্তে একই সঙ্গে কাজ করেছে দুজনে। ওর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ওপর প্রগাঢ় আস্থা আছে সামন্তর। তিনি জীপের মুখ ঘোরালেন।
দুশো একচল্লিশের কে হ্যাঙ্গার ফোর্ড স্ট্রীটের বাড়ির বাইরের ঘরে তখন তর্কের তুফান চলেছে। চীন আবার ভারত আক্রমণ করবে কিনা, সাবজেক্ট এই। ঘরে অবশ্য অনেক লোক নেই। তর্ক চলেছে বাসব ও শৈবালের মধ্যে।
ইন্সপেক্টর সামন্ত ঘরে প্রবেশ করলেন।
বাসব উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কি সৌভাগ্য! কোতোয়াল সাহেব যে?
বসতে বসতে সামন্ত বললেন, বিশেষ প্রয়োজনে আপনার কাছে এলাম—
বলাই বাহুল্য। প্রয়োজন না থাকলে এ-পথ মাড়াবার পাত্র আপনারা নন।
ঘর ফাটিয়ে হাসলেন ইন্সপেক্টর।
যাক, এসে যখন পড়েছেন, তখন,—বাসব বলল, বাহাদুরকে অতিথি সৎকারের সুযোগ না দিলে চলবে না। ডাক্তার, বাহাদুরকে গিয়ে একটু সচেতন করে এস।
শৈবাল ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হল।
বলুন এবার, ব্যাপারটা কি?
সামন্ত সমস্ত ঘটনাটা বললেন। কোন কিছু বাদ দিলেন না। প্রণয়ের লেখা চিঠিখানা ও বোতামটা দেখালেন। গভীর মনঃসংযোগে চিঠিখানা পড়ল বাসব। বোতামটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল।
ঘটনাটা শুনে কিরকম বুঝলেন মিস্টার ব্যানার্জি?
ঘটনাস্থলে না গিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। আপনি ঠিকানা রেখে যান। কাল বিকেলে আমি আর ডাক্তার যাব সুলগ্না দেবীর ঘরে। আপনি সবাইকে উপস্থিত থাকতে বলবেন। প্রণয় আর অমিয়ও যেন বাদ না পড়ে।
শৈবাল আগেই ফিরে এসেছিল। এখন ট্রে হাতে বাহাদুরকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখা গেল। ধূমায়িত কফি এবং আরো কি সব ছিল যেন ট্রে’তে।
পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে বাসব ও শৈবাল গিয়ে হাজির হল সুলগ্নার আস্তানায়। সামন্ত তখন অন্যান্য সকলকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাসবের সঙ্গে তিনি সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। অবশ্য পূর্বাহ্ণেই জানিয়ে রেখেছিলেন এই তদন্তের সূত্রেই ওর এখানে আগমন হবে!
এদিকে সম্ভব অসম্ভব সমস্ত স্থানে সুলগ্নার অনুসন্ধান করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও সন্ধান পাওয়া যায়নি। বারান্দাতেই সকলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইন্সপেক্টর। বাসব বলল, আগে এঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিই, তারপর ঘরটা দেখা যাবে। কি বলেন মিস্টার সামন্ত?
আপনার যেমন অভিরুচি।
প্রথমে আমি প্রণয়বাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
প্রণয় এগিয়ে এল। বাসব তার বলিষ্ঠ চেহারার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, শুনেছেন নিশ্চয়ই, সুলগ্না দেবীকে পাওয়া যাচ্ছে না?
শুনেছি। নিস্তেজ গলায় প্রণয় বলল।
আপনার কি মনে হয়, তাঁকে জোর করে কেউ ধরে নিয়ে গেছে? না তিনি নিজের ইচ্ছেয় কোথাও চলে গেছেন?
ও সম্বন্ধে আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।
কিন্তু এই চিঠিটা—এ সম্বন্ধে নিশ্চয়ই কিছু বলতে পারবেন?
বাসব চিঠিখানা এগিয়ে ধরল।
প্রণয়ের চোখ ঘোলাটে হয়ে উঠল। অসংলগ্ন গলায় সে বলল, চিঠিটা····হ্যাঁ, চিঠিটা আমারই লেখা। নেহাৎই ব্যক্তিগত ব্যাপার।
তবু শুনতে চাই। বলুন।
আমরা ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত ছিলাম। ইচ্ছে ছিল সারাটা জীবন স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই আমাদের কাটবে। কিন্তু আমার বাড়ি থেকে এ বিষয়ে সমর্থন না পাওয়ায় আমি আর অগ্রসর হতে চাইনি। সেই কথাই লিখেছিলাম।
কিছু মনে করবেন না, বাড়ির মতামতকে আজকাল ক’জন পরোয়া করে মশাই?
কোন বিশেষ কারণে পরোয়া করে চলা ছাড়া আমার উপায় ছিল না।
এরপর উমানাথের সঙ্গে কথা আরম্ভ করল বাসব।
শুনলাম, উনি আপনাকে চিঠি দিয়েছিলেন বাড়ি যাবেন বলে। আর কোন কথা লেখা ছিল তাতে?
উমানাথ বললেন, না।
আপনার মেয়ে বোধ হয় উগ্র আধুনিকা ছিলেন?
হ্যাঁ।
মেয়ের এই স্বভাব আপনি পছন্দ করতেন?
না।
আপনি তো রেলে চাকরি করেন?
‘হ্যাঁ। সোনারপুর স্টেশনে পোস্টেড। সুলগ্নার সন্ধান কি সত্যি পাওয়া যাবে না?
সবকিছু বাজিয়ে না দেখে আমি কিছুই বলতে পারছি না।
এবার অমিয়র সঙ্গে দু-চার কথা হল বাসবের। বলা বাহুল্য, সুলগ্না যে তাকে রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেকথা অমিয় সম্পূর্ণ চেপে গেল। বাসবের ইঙ্গিতে ঘরের সীল ভাঙা হল। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে ও চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। খাট, টেবিল, রেফ্রিজারেটার, র্যাকের ওপর রাখা জাফরি-কাটা ট্রেগুলো —কিছুই ওর দৃষ্টি এড়িয়ে গেল না। বাসব এগিয়ে গেল জানলা দুটোর কাছে। রডের সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় একটায় পর্দা লাগানো রয়েছে, অন্যটায় নেই।
ঘুরে দাঁড়িয়ে বাসব বলল, দুটো জানলাতেই কিন্তু পর্দা থাকা উচিত ছিল ইন্সপেক্টর—
ইন্সপেক্টর আনন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, দ্বিতীয় জানলাটায় পর্দা নেই আনন্দবাবু?
এই ধরণের প্রশ্নে আনন্দবাবু যেন থতমত খেলেন : ছিল বৈকি, কয়েক দিন আগেও আমি দেখেছি।
বাসব কোন কথা না বলে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে লাগল। থমথমে অবস্থার মধ্যে মিনিট দুয়েক কাটল। শেষে সামন্তই নীরবতা ভঙ্গ করলেন : কি বুঝছেন—কি বুঝছেন মিস্টার ব্যানার্জি? সুলগ্না দেবীকে কোথায় পাওয়া যাবে?
বাসব সকলের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, তাঁকে আর জীবিত অবস্থায় পাওয়া যাবে না তিনি খুন হয়েছেন।
খুন!! সকলে চমকে উঠলেন।
কি বলছেন আপনি? কাতর গলায় উমানাথ বললেন।
যা ঘটেছে, তাই আমি বলছি উমানাথবাবু। টেবিলের ওপর ওই যে ওষুধের শিশিগুলো রয়েছে, ওরই মধ্যে একটা শিশি আমাকে প্রকৃত তথ্য আবিষ্কারে সাহায্য করেছে।
অর্থাৎ—? সামন্ত প্রশ্ন করলেন।
বাসব এগিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে একটা শিশি তুলে নিয়ে বলল, প্রিনেটাল ক্যাপসুলের শিশি এটা। এখন আপনারাই বলতে পারবেন, ঠিক কোন সময় মেয়েরা এই ক্যাপসুল ব্যবহার করে থাকে।
কারো মুখে কথা নেই। সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছেন।
প্রেগনেন্ট হলে, —বাসব আবার বলল, এখন আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে সুলগ্না দেবী প্রেগনেন্ট ছিলেন। এই লজ্জাকর বিষয়টা সকলের কর্ণগোচর হবার আগেই তাঁকে খুন করেছে একজন।
এবার চিৎকার করে উঠল অমিয়, যদি তাই হয়, তবে এর জন্যে সম্পূর্ণ দায়ী প্রণয় সেন। আমি জানি····
তার কথা শেষ হল না, প্রণয় তীব্র প্রতিবাদ করে উঠল, অমিয়বাবু, আপনি ভব্যতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন!
উমানাথ ভাঙা গলায় বললেন, কিন্তু আমি যে ভাবতেও পারছি না, সুলগ্নাকে শেষ পর্যন্ত·····
বাসব নির্বিকার গলায় বলল, কথাটা আপনার অজানা ছিল না।
আমার!! কি বলছেন?
আপনি একজন প্রাচীনপন্থী, সংস্কারবদ্ধ বাপ ; মেয়ের উগ্র আধুনিকতা আপনি পছন্দ করেননি।
শেষ পর্যন্ত·····
কিন্তু····
‘কিন্তু’র আর কোন অবকাশ নেই। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি সুলগ্না দেবীকে খুন করেছেন।
ঘরের প্রতিটি প্রাণীর বুকের মধ্যে রক্ত তোলপাড় করে উঠল।
আমি····আমি·····
হ্যাঁ, আপনি। কুমারী মেয়ে প্রেগনেন্ট হয়েছে, কোন রকমে এই সংবাদ আপনি পেয়েছিলেন। হিতাহিত জ্ঞানের শেষ প্রান্তে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল আপনার সংস্কারী মন। কন্যা-স্নেহ ম্লান হয়ে গিয়ে সংস্কার আর লোকলজ্জার জয়লাভ ঘটেছিল। এবং আপনি যা করা উচিত নয় তাই করে ফেলেছেন।
উমানাথ বসে পড়লেন মাটিতে। দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। হয়তো অনুশোচনার কান্না, হয়তো ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জায় কান্না। ঘরের সকলে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে আছেন।
ইন্সপেক্টর সামন্ত বললেন, মৃতদেহ কোথায়?
কেন, ওই রেফ্রিজারেটারের মধ্যে!
বাসব রেফ্রিজারেটারের হ্যান্ডেল ধরে টান দিল। পাল্লাটা খুলে যেতেই সুলগ্নার মৃতদেহ গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। প্রাণহীন দেহ ঠাণ্ডায় জমে একেবারে শক্ত হয়ে গেছে। হালকা বরফের আস্তরণ ওই সঙ্গে ঢেকে দিয়েছে ওর সারা দেহটা।
কল্পনাতীত দৃশ্য!
আমরা এখন চলি ইন্সপেক্টর। —বাসব বলল, সময় করে আসবেন আমার ওখানে। এস ডাক্তার।
রাস্তায় নেমেই ট্যাক্সি ধরল ওরা। নির্দেশ মত ট্যাক্সি এগিয়ে চলল গন্তব্যস্থলের দিকে। ভাল করে হেলান দিয়ে বসে শৈবাল বলল, তুমি কিভাবে বুঝতে পারলে উমানাথ হত্যাকারী?
এটা রুল অফ থ্রির কথা ডাক্তার। অনেক সময় অনুমানের ওপর নির্ভর করেই আসল সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ইন্সপেক্টরের মুখে শুনেছিলাম সুলগ্না ও প্রণয়ের ঘনিষ্ঠতার কথা। ওখানে গিয়ে প্রিনেটাল ক্যাপসুলের শিশি পেলাম। তাছাড়া প্রণয়ের চিঠির একটা লাইন ছিল, ‘আমার বিরুদ্ধে তুমি যে অভিযোগ এনেছ, নিশ্চিত ভাবে তার জন্যে আমি একলা দায়ী নই।’ কাজেই আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম সুলগ্না প্রেগনেন্ট ছিল। ওই সঙ্গে নিশ্চিত হলাম, তাকে হত্যা করার বিষয়। এখন প্রশ্ন হল, কে তাকে হত্যা করতে পারে? প্রণয়কে বাদ দিতে হবে। কারণ সে হত্যাকারী হলে ওই ভাষায় কখনোই চিঠি দিত না। আপাতদৃষ্টিতে আনন্দবাবুর কোন স্বার্থ দেখা যাচ্ছে না। অমিয় সুলগ্নাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, খুন করতে যাবে কেন? হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় হত্যাকারী আমার কাছে ধরা পড়ে গেল। ইন্সপেক্টর বাগান থেকে একটা বোতাম কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। ওই ধরণের বোতাম রেলকর্মীদের কোটে ব্যবহৃত হয়। উমানাথ রেলে কাজ করেন। মেয়ে অবৈধভাবে কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছে সংবাদ পেয়ে—আমার মনে হয়, অমিয়র সঙ্গে তার যাতে বিয়ে না হয়, তাই সুলগ্নাই নিজের অবস্থার কথা জানিয়েছিল—তিনি এই কাণ্ডটা করে বসেছেন।
কিন্তু তুমি কি সূত্রে অনুমান করলে মৃতদেহ রেফ্রিজারেটারের মধ্যে রয়েছে?
বাসব সিগারেট ধরিয়ে বলল, একটু চোখ খুলে চারদিক তাকালে তুমিও বুঝতে পারতে। একটা জানলায় পর্দা ছিল না। ওই জানলার পদার রড খুলে সুলগ্নাকে আঘাত করা হয়েছিল। র্যাকের ওপর রাখা জাফরি-কাটা ট্রেগুলো আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি, ওগুলো যে রেফ্রিজারেটারের ট্রে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু ট্রেগুলো রেফ্রিজারেটারের মধ্যে না থেকে ওখানে রয়েছে কেন? সঙ্গে সঙ্গে রহস্য সরল হল আমার কাছে। তবে কি রেফ্রিজারেটারটাকে স্যুট-রাখা আলমারির মত সম্পূর্ণ খালি করে ফেলা হয়েছে? তারপর সুলগ্নাকে আহত করে ওরই মধ্যে রাখা হয়েছে? আমার অনুমান যে মিথ্যে হয়নি তা তোমরা দেখেছ।
শৈবাল বলল, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই রকম, মেয়ের পদস্খলনের সংবাদ পেয়ে লোক-জানাজানি হওয়ার আগেই তাকে খুন করার পরিকল্পনা করে, তারই ঘরে এক সময় গিয়ে লুকিয়ে থাকল উমানাথ, এবং সুলগ্না ঘরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পর্দার রড দিয়ে আঘাত করেন। তারপর তার দেহটা রেফ্রিজারেটারের মধ্যে চালান করে দিয়ে জানলা টপকে অদৃশ্য হন। অ্যাম আই কারেক্ট?
কারেক্ট ডক—