লাজারুস

লাজারুস

সন্তর্পণে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল ছেলেটা৷ হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা আছে একটা পুরনো চাবি৷ বহুকষ্টে খুঁজে পেতে চাবিটা জোগাড় করেছে৷ সচরাচর এ চাবি কারওর হাতে আসে না৷

চাবির ঠান্ডা স্পর্শ ওর হাতের মধ্যে একটা শিরশিরানি ধরিয়ে দিচ্ছে৷ শরীরটা কেঁপে উঠল একবার৷

সিঁড়ি থেকে নেমে ধীরে ধীরে বেসমেন্টের দিকে এগিয়ে গেল ছেলেটা৷ বেসমেন্টের দরজাটা ভেজানো ছিল৷ হাত দিয়ে ঠেলে খুলতে ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল৷

একটু থমকে দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখে নিল সে৷ নাঃ, এ শব্দ কারও শুনতে পাওয়ার কথা নয়৷ একে শীতকাল, তার উপরে রাত প্রায় তিনটের কাছাকাছি৷ এবাড়ির জনাদশেক বাসিন্দা এখন গভীর ঘুমে মগ্ন৷ তাও চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে বেসমেন্টের মেঝেতে নেমে এল৷

খুচ করে একটা শব্দ হল৷ জ্বলে উঠল ওর হাতের টর্চটা৷ যদিও টর্চের প্রয়োজন এই মুহূর্তে ছিল না৷ যে দরজাটা খুঁজছে সেটা বেসমেন্টের কোথায় আছে তা ও ভালো করেই জানে৷

দেওয়ালের একদিকে আলো ফেলতেই দরজাটা চোখে পড়ল৷ বহু পুরনো জং ধরা লোহার দরজা৷ এ বাড়ির অন্য সমস্ত ঘর তকতকে করে গোছানো৷ দেওয়ালে আর দরজায় নতুন রং করা৷ কেবল এই দরজাটা দেখলে মনে হয় বহুবছর খোলা হয়নি সেটা৷ সত্যিই খোলা হয়নি৷

ছেলেটা পা টিপে টিপে এসে দাঁড়ায় দরজার সামনে৷ হঠাৎ ওর মনে হয় এ ঘরে ওর আগে থেকেই কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে৷ কে যেন ফিসফিস করে কথা বলে ওঠে ওর কানের কাছে৷ মনের ভুল? এখন এখানে কে আসবে? ওর নিজের অবচেতন মনই কি বারণ করছে দরজাটা খুলতে? একটা অবরুদ্ধ ভয় ওর পা দুটোকে অবশ করে দেয়৷ পরক্ষণেই ওর মুখটা চাপা হাসিতে ভরে যায়৷ ও জানে কে এসেছে৷

ওর পেছনে একটা পায়ের শব্দ শোনা যায়৷ সিমেন্টের মেঝের উপর খালি পায়ের শব্দ৷ তাও স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে ও৷

এবার ভয়ের বদলে মুখে একটা আলগা হাসি খেলে যায় ওর মুখে৷ চাপা স্বরে বলে, ‘আমি জানতাম তুই আগেই আসবি…’

‘আসতাম না, কিন্তু ঘুম আসছিল না৷ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল৷’ মেয়েলি গলার আওয়াজ, ফিসফিস করে ওঠে মানুষটা৷

‘কীসের দুশ্চিন্তা?’

‘যদি তোর কিছু হয়?’

‘আমার আবার কী হবে?’

ওর হাতের উপর পালটা চাপ দেয় ছেলেটা৷ কাঁপুনি কিছুটা প্রশমিত হয়৷ হাতের টর্চটা তুলে দেখায়, ‘আমার পেছনে থাকবি তুই৷ আমি আগে ঢুকব৷’

মেয়েটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়৷ অন্য হাতটা রাখে ছেলেটার কাঁধে৷ লোহার মরচে পড়া দরজাটায় একটা বিরাট চেহারার তালা ঝুলছে৷ দরজাটা পুরনো হলেও তালাটা তেমন জরাজীর্ণ নয়৷ তার ভিতর চাবি ঢুকিয়ে হালকা চাপ দেয় দিতেই ‘খুট’ শব্দ করে তালাটা খুলে যায়৷

দরজা খুলে যেতে প্রথমে অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না৷ টর্চের আলোটা ভেতরে গিয়ে পড়তেই ভিতরটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ ঘরের দেওয়ালগুলো পুরনো৷ জায়গায় জায়গায় শ্যাওলার আস্তরণ পড়েছে, কোথাও চাঙড় উঠে গিয়ে গর্ত তৈরি হয়েছে৷ ছাদের দিকে বেশ খানিকটা অংশ ভাঙা৷ সেখান থেকে লতাগুল্মের ডালপালা বিষধর সাপের মতন ফণা তুলেছে৷ তবে প্রথম দেখায় সেগুলোর দিকে দৃষ্টি যায় না৷

ঘরের মেঝের বেশিরভাগটা জুড়ে একটা সুড়ঙ্গের মুখ৷ ভালো করে দেখলে মনে হয় একসময় একটা কুয়ো ছিল এখানে৷ পরে চারপাশে মাটি ফেলে প্রায় বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ কেবল সুড়ঙ্গের মুখটা বিরাট একটা হাঁয়ের মতো রয়ে গেছে৷ তার উপরে কোনওমতে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে একটা স্যাঁতস্যাঁতে কাঠের স্ল্যাব৷

ছেলেটা এগিয়ে যায়৷ মেয়েটার হাতের জোর বেড়ে যায় ওর কাঁধে৷ ফিসফিস করে বলে, ‘বেশি এগোস না হিরু, কে জানে কী আছে ওর ভেতর…’

‘আমি জানি কি আছে…’ কথাটা বলে কাঠের স্ল্যাবটার উপরে বলপ্রয়োগ করে সেটাকে কিছুটা একপাশে ঠেলে দেয় ছেলেটা৷ তারপর ঝুঁকে পড়ে ভেতরে৷

মাকড়সার জাল আর ধুলোয় ভরা সুড়ঙ্গ পথ৷ ভিতরে কী আছে দেখার উপায় নেই৷ তাও ছেলেটার মনে হয় সবজেটে ধরনের একটা আভা দেখা যাচ্ছে কুয়োর ভেতর৷ কিছুক্ষণ বিমোহিতের মতো সেদিকে চেয়ে থাকে ছেলেটা৷ মেয়েটা ভয়ে ভয়ে মুখ বাড়ায়৷ কম্পমান হাতটা একদিকের দেয়ালে রেখেই সরিয়ে নেয় সে৷ ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কী আছে ওর ভেতর?’

ঠোটে আঙুল রেখে ছেলেটা অস্পষ্ট স্বরে একটা শব্দ উচ্চারণ করে, ‘লাজারুস…’

(দুই)

বদ্ধ ঘরের ভেতর গুমোটটা বেড়ে উঠছিল ক্রমশ৷ চেয়ারে বসে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিল মন্দাকিনী৷ দুটো হাত চেয়ারের দুটো হাতলের উপর পড়ে আছে৷ কোথা থেকে যেন বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে৷ করুণ বিষাদের সুর৷

দরজায় আওয়াজ হতে মুখ ফিরে তাকাল সে৷ হিরণ্ময় ঘরে ঢুকছে৷ ওকে দেখেই সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করল মন্দাকিনী৷ মুখের উপর থেকে বিষাদ মুছে ফেলে একটা হাসি ফুটিয়ে তুলল, ‘এই ভরদুপুরে কোথায় ঘুরছিলে বল তো?’

কপাল থেকে ঘাম মোছে হিরণ্ময়, ‘মাধবদাকে বলে একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট করলাম… উফ কী খাটনি…’

‘কীসের অ্যারেঞ্জমেন্ট?’

হিরণ্ময় কোনও উত্তর দেয় না৷ মন্দাকিনীর হুইল চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে চেয়ারে হাত রাখে৷

‘তুমি এখানে ঠিক কেন এসেছ বল তো? মতলবটা কী?’

‘আঃ, এত অধৈর্য হচ্ছ কেন? তোমাকে সব কথা বলব বলেই এতদূর আসা… তাছাড়া জায়গাটা খারাপ লাগছে নাকি তোমার?’

‘নাঃ, খারাপ লাগবে কেন?’

শেষ কথাটা বলতে গিয়ে মন্দাকিনীর মুখ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে৷ নিজের অক্ষম পায়ের দিকে একবার তাকায় সে৷ হাতটা পড়ে আছে হাঁটুর উপরে৷ কিন্তু ও জানে চাইলেও হাতের স্পর্শটা পায়ের উপরে অনুভব করতে পারবে না ও৷ হাঁটাচলা দূরের কথা, উঠে দাঁড়ানোটাও সম্ভব নয় ওর পক্ষে৷ আজ তিন মাস হল চেয়ার থেকে উঠে বেশি এদিক-ওদিক করতে পারেনি৷ ডাক্তার বলেছে একটু একটু করে তার হাত পায়ের উপর থেকে দখল কমবে৷ প্যারালিসিস এসে গ্রাস করবে ওর সর্বাঙ্গ৷

হুইল চেয়ারটা ধরে সেটাকে সামনের বারান্দার দিকে টেনে আনে হিরণ্ময়৷ সবে বিকেল নামতে শুরু করেছে৷ দূরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে লাটাইয়ের সুতোর মতো আলো গুটিয়ে নিচ্ছে কেউ৷ কয়েকটা ক্লান্ত পাখি উড়ে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে৷

সেখান থেকে চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকালে একটা বিস্তীর্ণ গ্রাম চোখে পড়ে৷ দূরে একটা ঝিল, তার আশপাশে কয়েকটা ভাঙাচোরা পাকা বাড়ি৷ বাড়িগুলো বেশিদিন আগের নয়৷ এই গ্রামে পুরনো বাড়ি বলতে হিরণ্ময়দের বাড়িটা৷ প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো৷ হিরণ্ময়ের ছোটোবেলাটা এ বাড়িতেই কেটেছে৷ পরে বড়ো হতে শিফট করেছে কলকাতায়৷ সেখানেই মন্দাকিনীর সঙ্গে আলাপ৷ বছর দুয়েকের প্রেম, তারপর বিয়ে৷

ছ-মাস আগে কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় মন্দাকিনীর৷ ছোটোখাটো কারণে চোখে অন্ধকার নামতে থাকে, অকারণেই হাত-পা কাঁপতে শুরু করে৷ খানিকটা ঝোঁকের বশেই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় হিরণ্ময়৷ বিয়ের আগে শুনেছিল মন্দাকিনীর নার্ভজনিত কিছু সমস্যা আছে৷ তবে সেটা এমন মারাত্মক কিছু নয়৷

ডাক্তার বর্মন মন্দাকিনীরই ক্লাসমেট৷ একসময় গভীর বন্ধুত্ব ছিল দু’জনের৷ ইদানীং যোগাযোগ কিছুটা কমে এসেছে৷ কিছু চেকআপের পর ডাক্তার বর্মন জানান মন্দাকিনী পারকিনসনস রোগে ভুগছে৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত অঙ্গ একটা একটা করে অকেজো হয়ে পড়বে৷ ব্যাপারটা জানার পর থেকেই ওদের সুখের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে৷ সমস্ত জায়গায় খোঁজ নিয়েও বিফল হয় হিরণ্ময়৷ এ রোগের কোনও চিকিৎসা নেই৷ অদৃষ্টের লিপি মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই৷

দু’বছর প্রেম চলাকালীন একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করেছিল মন্দাকিনী৷ কিছু বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে কেমন উদাস হয়ে যায় হিরণ্ময়৷ তার চোখদুটো কোথায় হারিয়ে যায়৷ মনে হয় কী একটা ভাবনায় যেন বারবার ডুবে যাচ্ছে সে৷ মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেছে মন্দাকিনী, ‘তোমার কী ব্যাপার বল তো? কী এত ভাব?’

‘আমার ছোটোবেলার কথা…’

‘কী এমন আছে তোমার ছেলেবেলায়?’

রহস্যময় হাসি হাসে হিরণ্ময়, বলে, ‘প্রচুর গল্পের বই, একটা কল্পনার জগত… আর…’

‘আর কী?’

বহুবার জিজ্ঞেস করেও এ প্রশ্নের কোনও উত্তর পায়নি মন্দাকিনী৷ কেবল একবার ভুল করে বলে ফেলেছিল ছেলেবেলার একাকীত্ব থেকে কীসব মানসিক রোগ হয় তার, কিন্তু ব্যস, ওই অবধি… এসব ব্যাপার বেশি কথা বলতে চায় না হিরণ্ময়৷ বেশি করে চেপে ধরলে এটা সেটা বলে এড়িয়ে যায়৷ মন্দাকিনী মনে মনে ভেবেছে হিরন্ময়ের জীবনে কিছু একটা রহস্য আছে৷ সম্ভবত তার ছেলেবেলার কোনও একটা ঘটনা, যা তাকে আজও উদাস করে দেয়৷

রোগটা ধরা পড়ার পর বাড়ি থেকে বেরনো কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মন্দাকিনীর৷ মাসখানেক আগে থেকে তার পাদুটো ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসতে থাকে৷ সোজা হয়ে দাঁড়ানো দুষ্কর হয়ে ওঠে৷ ঘরের মধ্যে হাঁটাচলার জন্য হুইল চেয়ারের আশ্রয় নিতে হয়৷ চার দেয়ালের বাইরে অন্য কিছু যে এ জীবনে আর দেখতে পাবে সে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল সে, এমন সময় দিনসাতেক আগে হিরণ্ময় বাড়ি ফিরে একটা অদ্ভুত প্রস্তাব দেয় তাকে৷

সে বলে এ সপ্তাহের শেষে মন্দাকিনীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে একবার যেতে চায়৷ সেখানে গেলে নাকি ওর চিকিৎসার কিছু সম্ভাবনা আছে৷ ব্যাপারটা শুনে একটু অবাকই হয় মন্দাকিনী৷ যে রোগ বিদেশের তাবড় তাবড় ডাক্তাররা সারাতে পারছে না, সারা পৃথিবীর কাছে যে রোগের কোনও ওষুধ নেই, সে রোগ একটা গ্রামে গেলে সেরে যাবে!

ব্যাপারটা বিশ্বাস হয় না তার৷ তাও বাড়ি থেকে বেরনোর অদম্য ইচ্ছাটাই তাকে রাজি করিয়ে দেয়৷

* * *

ঝিরিঝিরি হাওয়া খেলছে বারান্দায়৷ গ্রামের দিকে এলে এই হালকা হাওয়ায় উদ্ভিদের গন্ধ মিশে থাকে৷ বুকের ভিতর জমাট বাতাসটা মুহূর্তেই খালি হয়ে যায়৷

ওর কাঁধে একটা হাত রাখে হিরন্ময়৷ তারপর পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ে ক্লান্ত গলায় বলে, ‘তোমার মুখের দিকে তাকালে আজকাল কেমন ভয় লাগে জান?’

‘কীসের ভয়?’

‘মনে হয় তুমি যেন হাল ছেড়ে দিচ্ছ…’

‘আমিতো হাল অনেকদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছি…’

‘কবে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে হিরণ্ময়৷

‘যেদিন থেকে তুমি হাল ধরেছ৷ আমার আর ধরার দরকারই পড়েনি…’

‘যতসব ন্যাকা ন্যাকা কথা…’ হিরণ্ময় মুখ বাঁকায়৷ তারপর মন্দাকিনীর কাঁপা কাঁপা হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে৷ স্থির হয়ে যায় হাতটা৷

‘আচ্ছা! ন্যাকা কথা? ছেড়ে দেবে আমার হাত?’ অভিমানি গলায় বলে মন্দাকিনী৷

‘আমি এত সহজে কারও হাত ছাড়িনি, বিশ্বাস কর৷ এই বাড়িটা জানে৷ ছোটো থেকে যত মানুষের কাছে এসেছি, যত মানুষ আমার কাছে এসেছে, যতদূর পেরেছি কোনওদিনও কাউকে ছেড়ে দিইনি…’

‘কিন্তু চাইলেই তো আর ধরে রাখা যায় না৷ তার চেয়ে ভালো…’

একটু ঝুঁকে পড়ে হিরণ্ময়ের কাঁধে মাথা রাখে মন্দাকিনী, ‘যে ক-টা দিন আছে এখানেই কাটিয়ে দেব৷ আমারও শহরে ফিরতে ইচ্ছা করে না৷ তোমার সঙ্গে থাকলে ক-দিন থাকব সেটা বড়ো কথা নয়…’

‘ধুর, আমার কথাটা আদৌ বুঝতে পারনি তুমি…’

‘কোন কথাটা বল তো?’

‘ওই যে বললাম আমি সহজে হাল ছেড়ে দিই না৷ তোমাকে আমি কোথাও যেতে দেব না মন্দাকিনী…’

‘কী করে আটকে রাখবে?’

হঠাৎই হিরণ্ময়ের মুখটা থমথমে হয়ে যায়৷ কয়েক সেকেন্ডের জন্য কী যেন ভাবনায় ডুবে যায় সে৷ তারপর আচমকা মন্দাকিনীর মুখের দিকে চেয়ে বলে, ‘তুমি লাজারুস-এর নাম শুনেছ?’

‘লাজারুস! কোথাও শুনেছি, কিন্ত মনে পড়ছে না…’

‘একজন গ্রিক দেবতা৷ মরে যাওয়ার পরেও আবার বেঁচে উঠেছিল৷’

‘তাই নাকি? কিন্তু লাজারুসের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?’

‘উঁহু, লাজারুস না, আমি বলছি লাজারুস পিটের কথা৷’

‘সেটা আবার কী!’

‘এক ধরনের সুড়ঙ্গ৷ বা বলা যায় সুড়ঙ্গের মুখ৷ কথিত আছে এই পৃথিবীতে এখনও মোট চারটে এরকম সুড়ঙ্গ রয়ে গেছে৷’

‘বাবা! তো কী আছে তার মধ্যে?’

‘এক ধরনের সবুজ তরল৷ সুড়ঙ্গ বেয়ে একেবারে নিচে নেমে গেলে তার দেখা মেলে৷ সেই তরলের স্পর্শ একবার গায়ে লাগলে যত সাংঘাতিক রোগই থাকুক না কেন, সে সুস্থ হয়ে ওঠে৷ শুধু তাই নয়, সেই তরলকে স্পর্শ করলে মানুষের শরীরে অদ্ভুত ক্ষমতা চলে আসে…’

‘রূপকথার গল্প…’ মন্দাকিনী হাসে, ‘এই পরিবেশে গল্প শুনতে মন্দ লাগছে না…’

কথাটায় কান দেয় না হিরণ্ময়, দূরের দিকে চেয়ে একমনে বলে যেতে থাকে, ‘আমার বয়স তখন খুব কম… এই ধরো বছর তেরো হবে৷ ছোট থেকে দেখে এসেছিলাম আমাদের বাড়ির বেসমেন্টে একটা বন্ধ দরজা আছে৷ সেটা কখনও খোলা হত না৷ বিশেষ করে ছোটদের সে দিকে যাওয়া ভয়ঙ্কর রকমের নিষেধ ছিল৷ তুমি তো জানই যে জিনিসটা সেই বয়সে বারণ করা হয় সেই জিনিসটাই করার ইচ্ছা জাগে বেশি৷

তো আমি বহু খোঁজাখুঁজি করে সেই বন্ধ ঘরের চাবিটা চুরি করি একদিন রাতে৷ সেই রাতেই বেসমেন্টে নেমে এসে ঘরের দরজাটা খুলে ফেলি৷ তার ভেতরে ছিল একটা কুয়ো…’ হাসিমুখে স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকায় হিরণ্ময়৷

‘এই তুমি ইয়ার্কি মারছ তাই না?’

‘বাবাকে জিজ্ঞেস করলে বাবা অবশ্য বলতেন ওই ঘরের ভেতর একটা কুয়ো আছে৷ যেটা বহুদিন আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ ঘরের ভেতরে অত বড়ো একটা কুয়ো — তার উপরে এতদিন ধরে বন্ধ৷ কখন কী সাপখোপ বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে তাই আলাদা করে দেওয়া হয়েছে৷ তবে আমাকে কিন্তু বারবার টানত কুয়োটা, জানো? রোজ রাতেই মনে হত ওই কুয়োর ভেতর জীবন্ত কেউ যেন নিঃশব্দে ডেকে চলেছে আমাকে৷ রোজ রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে আসতাম ওই কুয়োর কাছে৷ কোনওদিন দেখতে পাইনি কাউকে৷ একাই বসে থাকতাম সারারাত৷ মাঝে মাঝে মনে হত অজান্তেই বিড়বিড় করে কী যেন কথা বলছি… কিন্তু কী বলছি নিজেই বুঝতে পারতাম না…’

‘ছেলেবেলায় তুমি কল্পনাপ্রবণ ছিলে সে আমিও জানি, কিন্তু এইসব গল্প তুমি আমাকে বলছ কেন বলত?’

হঠাৎই মুখটা মন্দাকিনীর ভীষণ কাছে নিয়ে আসে হিরণ্ময়৷ থমথমে কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলে, ‘জানো মন্দাকিনী, আমার মন বলছে ওই কুয়োটাই চারটের মধ্যে একটা লাজারুস পিট…’

‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’ খানিকটা ভর্ৎসনার সুরেই বলে মন্দাকিনী৷

‘লাজারুসের মিথ বলে মৃত্যুর পর সেই সবুজ তরলের স্পর্শে যার জীবন ফিরে আসে, সে আর আগের মতো থাকে না…’

‘পাগলের মতো কী সব বকছ বল তো? বাড়ির ভেতরে পুরনো দিনের চাপা দেওয়া একটা কুয়ো থাকতেই পারে৷ তার মানে তো এই নয় যে…’

‘আমার প্রথম সন্দেহ হয় কুয়োর ভেতর সবুজ আভাটা দেখে৷ তারপরে ভাবি সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়৷ কুয়োর ভিতরের দেওয়ালে ছোট ছোট গাছপালা, শ্যাওলা এইসব হয়েছিল৷ তার রঙেই হয়তো ভিতরটা সবুজ হয়ে আছে৷

তবে একদিন ওর পাশে দাঁড়িয়েছিলাম আমি৷ সেসময় একটা বিড়াল ছিল বাড়িতে৷ নাম ছিল মতি৷ মতিকে কয়েকটা কুকুর মিলে ছিঁড়ে খেয়েছিল৷ আমার হাতের উপর শুয়ে মিহি স্বরে ডাকতে ডাকতে মতি ঢলে পড়ছিল মৃত্যুর কোলে৷ আমি ওকে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম কুয়োর পাশে৷

হঠাৎ মনে হল মতি তো মরেই যাবে, ওকে অন্য কোথাও কবর দিতে হবে কিংবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে৷ তার চাইতে সে কুয়োর তলাতেই থেকে যাক বরঞ্চ৷

মনে হতেই যেন আমার হাত থেকে খসে পড়ে গেল মতি৷ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে কাঁদলাম৷ শেষে চোখের জল মুছে ফিরে আসতে যাচ্ছি, হঠাৎ ওর ভেতর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল৷ প্রথমে ভেবেছিলাম মতির গলার আওয়াজ৷ কিন্তু তা কী করে হয়? একে ক্ষতবিক্ষত, তার উপরে একটু আগেই এতটা নিচে গিয়ে পড়ে ওর ঘাড় ভেঙে যাওয়ার কথা৷

মতি ফিরে এসেছিল, তবে ওর আচরণ পালটে গেছিল৷ সেদিন আমার প্রথম মনে হয় ওই কুয়োর তলায় কিছু একটা আছে৷ ওটা কোনও সাধারণ কুয়ো নয়৷

আস্তে আস্তে ব্যাপারটা পরীক্ষা করতে শুরু করি আমি৷ প্রথমে ছোট ছোট প্রাণী, ইঁদুর, বিড়াল, হাঁস, মুরগি মরতে বসেছে দেখলেই আমি তাদেরকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নামিয়ে দিতাম ঐ কুয়োর ভিতরে৷ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম৷ কিছুক্ষণ পর তাদের ডাক শুনতে পেতাম কুয়োর ভেতর থেকে৷ ধার বেয়ে উঠে আসত তারা…’

‘এসব তোমার মনের ভুল৷ তুমি কী বলছ তুমি নিজে বুঝতে পারছ?’

‘তুমি পরীক্ষা করে দেখতে চাও?’

‘আমি কী পরীক্ষা করব?’

‘এই যে সত্যিই ওই কুয়োটা একটা লাজারুস পিট কি না?’

‘কিন্তু কী করে?’

‘রঘুবীর রোজ কতগুলো নেড়ি কুকুরকে খেতে দেয়৷ তাদের মধ্যে একটার কিছু রোগ হয়েছে৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আজ রাতটা কাটবে না৷ ধরো যদি…’

‘না, অসম্ভব৷ এসব আজগুবি খেলা না তো আমি খেলব, না তোমাকে খেলতে দেব… এগুলো সব তোমার ছেলেবেলার খেয়াল৷ তোমার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি আমি৷ অনেক বড়ো বয়স অবধি এমন অনেক আজগুবি খেয়াল ছিল তোমার… আমি ভাবতে পারিনি সেগুলো এখনও…’

‘ভেবে দেখ মন্দাকিনী…’ ওর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে হিরণ্ময়, ‘যদি পরীক্ষা মিথ্যে হয় তাহলে কেবলমাত্র একটা কুকুরের প্রাণ যাবে৷ যদি সত্যি হয় তাহলে…’

কয়েক সেকেন্ড আর কোনও প্রশ্ন করে না মন্দাকিনী৷ একটু আগে যে নরম হাওয়াটা বইছিল সেটা এখন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে৷ বারান্দার গুমোট ভাবটা কয়েকগুণ বেড়ে উঠেছে৷ বাঁশির সুরটা থেমে গেছে অনেকক্ষণ আগে৷

কিছুক্ষণ পরে মন্দাকিনী মুখ তুলে তাকায়, চোখ থেকে জল মুছে শান্ত গলায় বলে, ‘বেশ! কিন্তু একটা শর্তে৷ গোটা জিনিসটার সাক্ষী থাকব আমি…’

হিরণ্ময় মুখে বিজয়ীর হাসি খেলে যায়, ‘তাই হবে…’

(তিন)

ছাদের কিনারে এসে দাঁড়ায় মেয়েটা৷ দুপুরের রোদ এসে পড়েছে সমস্ত ছাদ জুড়ে৷ কোথাও লুকানোর জায়গা নেই৷ তবে শীতের রোদ বলে গায়ে মাখতে নেহাত মন্দ লাগে না৷

 ‘আমি বলছি তোকে, একটু বিশ্বাস কর আমায়…’ পেছন থেকে নাছোড়বান্দা গলা শোনা যায়, ‘তোর সব রোগ সেরে যাবে৷’

‘আমার খুব ভয় লাগছে হিরু…’ ছাদের পাঁচিল শক্ত করে চেপে ধরে মেয়েটা৷ চোখদুটো অস্থির হয়ে উঠেছে তার৷ এই শীতেও কপাল বেয়ে ঘামের ধারা নেমেছে৷

‘বাবা বলেছে শহরে নিয়ে গিয়ে বড়ো ডাক্তার দেখাবে…’

‘থাক, আমি সব খবর নিয়ে দেখেছি৷ তোকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখার জন্য ওসব গল্প শুনিয়েছে৷ তাছাড়া আমি কি তোকে ডাক্তার দেখাতে বারণ করেছি? শুধু দেখানোর আগে আমার কথাটা একবার শুনে দেখ…’

এবার ছেলেটার দিকে ঘুরে দাঁড়ায় মেয়েটা, তেমনই চাপা গলায় বলে, ‘কিন্তু ওই কুয়োর পাঁচিল বেয়ে আমি নামব কী করে?’

‘বাগানের গেটে একটা মোটা দড়ি ঝোলে, দেখেছিস? ওটা সরিয়ে রেখেছি৷ তোর কোমরে বেঁধে দেব৷ কোনও চিন্তা নেই তোর…’

‘আর নিচে যদি সাপখোপ থাকে?’

‘একটা মাস রোজ রাতে আমি ওই কুয়োর আশেপাশে ঘুরছি৷ কিচ্ছু চোখে পড়েনি… তোর ভয়টা কীসের?’

‘বাবা বলছিল…’

‘কী বলছিল?’

পরের কথাগুলো বলতে একটু ইতস্তত করে মেয়েটা, কেটে কেটে বলে, ‘বাবা বলছিল তোর সঙ্গে কম মিশতে৷’

‘কেন?’

‘মা মারা যাওয়ার পর থেকে তুই কারও সঙ্গে কথা বলতিস না, নিজের জগৎ নিয়ে থাকতিস, আজগুবি জিনিসকে সত্যি বলে বিশ্বাস করতিস…’

‘তোর বিশ্বাস হয় এসব?’

ভেজা চোখেই দু-দিকে মাথা নাড়া মেয়েটা, ‘আমি তোকে বিশ্বাস করি হিরু… তোকে…’ এগিয়ে এসে ছেলেটার দু-গালে হাত রাখে, ‘তুই সত্যি বলছিস হিরু? আমি সুস্থ হয়ে যাব তো?’

‘যাবি, শুধু একটা শর্ত…’

‘কী?’

‘কুয়োর ভিতরে যে সবুজ জলটা আছে ওটার ভিতরে একটা ডুব দিতে হবে তোকে৷ একেবারে মাথার চুল অবধি৷ যখন ডুব দিবি সারা শরীরে ভীষণ আরাম লাগবে৷ জল ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করবে না৷ তাও মনের জোর রাখবি৷ বেশিক্ষণ ওই জলের ভিতরে থাকলে…’

‘কী হবে?’ মেয়েটার গলার স্বর কেঁপে যায়৷

ছেলেটা মুখ নামিয়ে নেয়, ‘তোর শরীরটা সুস্থ হয়ে উঠে আসবে, কিন্তু সে শরীরের ভিতরে আর তুই থাকবি না… তোর আত্মাটা পড়ে থাকবে ওই জলের ভিতরে… অন্য কেউ এসে বাসা বাধবে তোর শরীরে…’

আতঙ্কের স্রোত খেলে যায় মেয়েটার সমস্ত শরীরে৷ ছেলেটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে, ‘আমার খুব ভয় করছে হিরু, যদি কিছু গোলমাল হয়?’

মেয়েটার মাথায় হাত রেখে ছেলেটা হাসে, ‘ধুর পাগলি, ভুলে যাচ্ছিস কেন, দড়ি তো আমার হাতে থাকবে৷ তোকে বেশিক্ষণ ডুবে থাকতেই দেব না…’

‘আর যদি হাত ছেড়ে দিস?’

ছেলেটার ঠোঁটের কোণে নরম হাসি খেলে যায়, ‘বলেছি না? কখনও হাত ছেড়ে দেব না? আমি কারও হাত ছেড়ে দিই না কখনও…’

(চার)

ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে ঘাসের উপরে৷ তার উত্তাপে ভিজছে তিনটে মানুষের শরীর৷ হলদে আলো এসে পড়ছে ওদের তিনজনের শরীরে৷ সে আলোয় তিনটে ভিন্ন অভিব্যক্তি খেলে যাচ্ছে ওদের মুখে৷

পেল্লায় বাড়িটার বাইরে ঘাসের জমির উপরে আগুন করা হয়েছে৷ সেখান থেকে ভেসে আসা পোড়া কাঠের ফটফট আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই৷ হলদে শিখায় জ্বলছে মন্দাকিনীর চোখ৷ তার হুইল চেয়ারের হাতলে মাথা দিয়েই ঘাসের উপরে বসে আছে হিরণ্ময়৷ একটু আগে অবধিও কান খাড়া করেছিল সে৷ আশায় বুক বেঁধেছিল৷ কিন্তু প্রায় মিনিট কুড়ি কেটে গেছে৷ কুয়োর দিক থেকে কোনও শরীরের আভাস পাওয়া যায়নি৷ কোনও শব্দ ভেসে আসেনি৷

অগত্যা দমবন্ধকরা পরিবেশটা ছেড়ে এক চিলতে আগুনের পাশে এসে বসেছে ওরা৷

মাধব ওদের থেকে একটু দূরে বসেছিল, সে দু’হাতে ভর দিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘কুকুরটা এমনিই যায় যায় করছিল স্যার৷ ওর আর বাঁচার আশা নেই…’

দড়ির ডগায় বাঁধা কুকুরের শরীরটা কুয়োতলাতেই ফেলে রেখে এসেছে ওরা৷ যেমন নিস্পন্দ অবস্থায় কুয়োর নিচে সেটাকে নামিয়েছিল ওরা, তেমন অবস্থাতেই উঠে এসেছে৷

‘আপনারা কুকুরটাকে নামিয়েছিলেন কেন বলুন তো?’ মাধব এতক্ষণ সংকোচেই চেপে রেখেছিল প্রশ্নটাকে৷

‘আমারই মাথা খারাপ…’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে হিরণ্ময়, ‘আসলে ছোটবেলায় মা মারা যায় তো, কথাবলার মতো লোকজনও তেমন ছিল না, ফলে বইপত্র পড়েই সময় কাটত৷ কবে যে কল্পনার জগৎ আর বাস্তব গুলিয়ে ফেলেছি কে জানে…’

মন্দাকিনী এতক্ষণ স্থির চোখে আগুনের দিকে চেয়েছিল, এবার মুখ ফিরিয়ে সে বলে, ‘আচ্ছা এই কুয়োটার কথা আমি ছাড়া আর কাউকে বলনি তুমি?’

দু-দিকে মাথা নাড়ায় হিরণ্ময়, ‘বললে কেউ বিশ্বাস করত? উলটে আমারই কুয়োটার কাছে যাওয়া বন্ধ হয়ে যেত…’

‘কিন্তু এত বড়ো একটা আবিষ্কার, বলতে ইচ্ছা করত না কাউকে? ধর কোনও বন্ধু…’

‘বললাম যে, আমার বন্ধুবান্ধব বলে তেমন ছিল না কেউ…’

কী একটা আগ্রহ যেন পেয়ে বসেছে মন্দাকিনীকে, সে চেয়ারটা ঘুরিয়ে নেয় হিরন্ময়ের দিকে, ‘আচ্ছা তুমি বলেছিলে এই কুয়োটা তোমাকে টানত৷ তাহলে এটাকে ছেড়ে কলকাতায় চলে গেলে কী করে? এত বছরে একবারও ফিরে এলে না…’

হিরণ্ময় হাসে, ‘কলকাতায় এমন একজনকে খুঁজে পেলাম যে আমাকে কুয়োটার থেকেও বেশি টানল…’

মন্দাকিনীর মুখটা আরও গম্ভীর হয়ে গেল৷ সে আবার আগুনের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমার কী মনে হয় জান?’

‘কী?’

‘তুমি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছ…’

‘সে আর নতুন কথা কী৷ বিয়ের আগে থেকেই এই এক কথা মনে হয় তোমার…’

একটা ছদ্মহাসি খেলে যায় মন্দাকিনীর মুখে, ‘দেখ যা কিছু বলার এইবেলা বলে ফেল৷ আমি কিন্তু আর বেশিদিন নেই… তারপর চাইলেও বলতে পারবে না৷’

‘বাজে কথা বোলো না তো… কালই কলকাতায় ফিরব আমরা, ঠিক করে চিকিৎসা করাতে পারলে…’

উঠে দাঁড়ায় হিরণ্ময়৷ এগিয়ে গিয়ে আগুনের ভিতরে একটা কাঠ উসকে দেয়৷

মন্দাকিনী এবার মাধবের দিকে তাকায়, ‘কুয়োর ভিতরে তুমি আগে নেমেছ মাধবদা?’

দু-দিকে মাথা নাড়ায় মাধব, ‘নাঃ, ও কুয়ো বহুকাল অমনই ফাঁকা পড়ে আছে৷ ওদিকটায় কেউ যায়ই না৷’

‘ভিতরটা অমন সবুজ হয়ে আছে কেন বল তো? সকালের দিকে নাহয় শ্যাওলা পড়া জলে সবুজ রং ধরতে পারে৷ কিন্তু এই সন্ধেবেলাও কেমন সবজে আভা বের হচ্ছিল…’

মাধব ঠোঁট উলটায়, ‘কী জানি, আমারও অবাক লাগল…’

‘উপর থেকে নিচ তাও কতটা হবে?’

‘কত আর, মিটার পনেরো৷ তবে নিচটা ঝোপঝাড়ে আর মাটিতে ঢেকে গেছে তো, বলা মুশকিল…’

‘অত উঁচু থেকে নিচে গিয়ে পড়লে কী হবে বল তো?’

অদ্ভুত প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিল না মাধব৷ সে একটু হকচকিয়ে যায়৷ সামলে নিয়ে বলে, ‘হাত পা তো ভাঙবেই, কিন্তু কেন বলুন তো দিদি?’

হুইল চেয়ারটা চালিয়ে ঘরের দিকে ফেরার উপক্রম করে মন্দাকিনী, ‘তুমি তো বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে এ বাড়িতেই থাক৷ একটু খেয়াল রেখ বাচ্চারা যেন ওদিকে না যায়… কেমন?’

মন্দাকিনীকে সাহায্য করতে আগুন ছেড়ে এগিয়ে আসছিল হিরণ্ময়৷ এমন সময় একটা বিশেষ শব্দে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে৷ চোখ তুলে তাকায় বাড়ির সদর দরজার দিকে৷

কান ফাটানো শব্দ করে ডাকতে ডাকতে একটা কুকুর ছুটে বেরিয়ে আসছে দরজা দিয়ে৷ তার পেটের কাছে শক্ত করে বাঁধা লম্বা দড়িটা লুটোচ্ছে ধুলোয়৷

‘লাজারুস…’ মন্দাকিনীর ঠোঁটের ফাঁকে অস্ফুট শব্দটা ফুটে ওঠে৷

(পাঁচ)

‘আস্তে… খুব সাবধান…’ মন্দাকিনীর একটা হাত কাঁধে নিতে নিতে বলে হিরণ্ময়৷ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হয় তার৷ দুটো ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরে এক অপরকে৷ চোখের পাতা কেঁপে যায় কয়েকবার৷ কোমরের দড়িটা শক্ত করে এঁটে বসেছে৷ তবে তার অনুভূতিটাও তেমন জোরালো নয়৷ মন্দাকিনীর মনের ভিতরে তার থেকে ঢের বেশি ঝড় চলেছে৷ কুয়োর ভিতরের অন্ধকারের দিকে চোখে গেলে ভয়টা আরও কয়েক পরত বেড়ে উঠছে৷

ছোট্ট ভাঙা ইটের ঘরটার ভিতরে একটা সাদা আলো জ্বলছে৷ কুয়োর পাশেই রাখা আছে ল্যাম্পটা৷ তার জোরালো আলোয় ভরে আছে ঘরের ভিতরটা৷ মন্দাকিনীর অপর হাতটা মাধবের কাঁধে৷

দড়ির বাঁধনটা আর একবার পরীক্ষা করে নেয় হিরণ্ময়৷ দৃঢ় গলায় বলে, ‘চিন্তা কোরো না৷ দড়ি খুলবে না৷ জল ছোঁয়ার আগে চোখ বন্ধ করে নেবে, আমরা ঠিক সময়মতো তুলে নেব তোমাকে৷’

মাথাটা হিরণ্ময়ের কাঁধে এলিয়ে দেয় মন্দাকিনী, মুখে কিছু বলে না সে৷ যেন সেখান থেকেই খানিকটা মনের জোর সঞ্চয় করে নিতে চায়৷

‘খুব বেশি ভয় লাগলে আজ ছেড়ে দাও৷ কুয়ো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না…’

মন্দাকিনীর মুখে একটা করুণ হাসি ফোটে, ‘আমাদের কাছে আর কোনও উপায় নেই… যা করার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব…’

মাধবকে যতটা সম্ভব ব্যাপারটা বুঝিয়েছে হিরণ্ময়৷ তবে সমস্তটা খুলে বলেনি৷ তার মুখে অবিশ্বাসের ছাপ লাগলেও মুখে তেমন কিছু প্রতিবাদ করেনি৷ দড়ির অপর প্রান্তুটা নিয়ে গিয়ে দেওয়ালের শক্ত আংটার সঙ্গে বেশ কয়েকটা গিট দিয়ে বেঁধে ফেলে সে৷ তারপর আবার এসে দাঁড়ায় কুয়োর সামনে৷

এই বদ্ধ ঘরের ভিতরে ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে কোথাও৷ ভাঙা ইটের দেওয়ালের ফাঁক থেকে হাওয়া চলাচলের ছন্দবদ্ধ আওয়াজ ভেসে আসছে এখনও৷ ঘড়ির কাঁটা এখনও ন’টার গণ্ডি ছাড়ায়নি৷ অথচ মনে হচ্ছে বিশ্ব চরাচরে কোনও জীবিত প্রাণী জেগে নেই৷ কেবল এই ছোট্ট ইটের ঘরের ভিতরে কোন নিষিদ্ধ মন্ত্র উচ্চারণের শব্দ কান খাড়া করে শুনছে তিনজন৷

‘আমি ঠিক হয়ে যাব বল?’ মন্দাকিনী হিরণ্ময়ের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে৷

‘যাবে, একদম ঠিক হয়ে যাবে…’

‘একটা গোটা জীবন একসঙ্গে কাটাব আমরা, আমায় সবসময় ভালোবাসবে তুমি, বল?’

উত্তর দেয় না হিরণ্ময়৷ কেবল মন্দাকিনীর শরীরটা আর একটু বেশি করে আগলে নেয় নিজের কাছে৷ তারপর তাকে দু’হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে নামিয়ে দেয় কুয়োর শূন্য গহ্বরে৷

একটু একটু করে নিচে নামতে থাকে মন্দাকিনীর দেহ৷ দড়িটা হিরন্ময়ের হাতে দিয়ে আলোটা কুয়োর উপরে তুলে ধরে মাধব৷ তার আলোয় কুয়োর ভিতরটা আলোকিত হয়ে ওঠে৷ একটা সবজেটে আভা সত্যি দেখা যাচ্ছে নিচের দিকে৷ ক্রমশ সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে মন্দাকিনীর দেহ৷ তার চোখদুটো এই মুহূর্তে বন্ধ৷ কীসের যেন অপেক্ষা করছে সে৷ কোনও স্পর্শের…

‘টেক আ ডিপ ব্রেক, জাস্ট কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার…’ ফাঁকা কুয়োর ভিতরে প্রতিধ্বনিত হয় হিরণ্ময়ের গলা৷

একটা অদ্ভুত গন্ধ এসে লাগে মন্দাকিনীর নাকে৷ চোখদুটো ভরে যায় সবুজ আলোর রেখায়৷ বন্ধ চোখের পাতায় এসে পড়ে সেই সবুজ আলো৷ সঙ্গে পিঠে একটা আলতো স্পর্শ৷ হ্যাঁ, তরলের স্তর স্পর্শ করেছে ওর পিঠ৷ কুলকুল করে জল উঠতে থাকে ওর বুকে পিঠে কোমরে… কান, চোখ নাক, ক্রমশ গোটা শরীরটা গ্রাস করে নেয় সবজে তরল৷

নিস্পন্দ কয়েকটা মুহূর্ত কেটে যায়৷ কুয়োর নিচে আর উপরে দুটো মানুষ৷ তাদের দু-জনের নিঃশ্বাসের গতিই ভিন্ন কারণে স্তব্ধ হয়ে যায়৷ মাধব স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে মন্দাকিনীর দেহ সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়েছে সবুজ তরলের ভিতর৷

ঠিক দু-সেকেন্ড পরেই দড়িতে সজোরে একটা টান মারে হিরণ্ময়৷ সবার আগে জল থেকে তুলে আনতে হবে মন্দাকিনীর শরীরটা৷ কিন্তু টান দিয়েই সে থমকে যায়৷ মন্দাকিনীর দেহ এক বিন্দুও উপরে ওঠে না৷

‘শিট…’ আরও জোরে টান মারে সে৷ তাতেও লাভ হয় না৷

‘হাত লাগাও, প্লিজ…’ মাধবের দিকে চেয়ে কাতর কণ্ঠে অনুনয় করে হিরণ্ময়৷

মাধবও এগিয়ে আসে৷ সেও চেপে ধরে দড়িটা৷ চারটে হাত সর্বশক্তি প্রয়োগ করে টানতে থাকে দড়ির উপরের প্রান্ত৷ মাধব বিড়বিড় করে বলে, ‘কিছুতে আটকে গেছে মনে হয়…’

‘আটকে গেছে মানে! কীসে?’ উন্মাদের মতো চিৎকার করে ওঠে হিরণ্ময়৷

‘কিছু হয়তো ছিল জলের নিচে, একবার নেমে দেখে নেওয়া উচিত ছিল স্যার…’

ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে আগের মতো৷ কেবল তার গতি যেন ভীষণ দ্রুত হয়ে পড়েছে এখন৷ মন্দাকিনীর শরীরটা দেখা যাচ্ছে না এখনও৷ দড়ির শেষ প্রান্ত ডুবে রয়েছে সেই সবজে তরলের ভিতর৷

‘হে ভগবান! এ কী করলাম আমি!’

এবার নিজের সমস্ত শরীরটা কুয়োর ভিতরে ঝুঁকিয়ে দিয়ে আবার হ্যাঁচকা টান দেয় হিরণ্ময়৷ এবার কাজ হয়৷ দড়িটা আবার নরম হয়ে উপরে উঠতে থাকে দেহটা৷ মন্দাকিনীর সমস্ত দেহ ঢেকে আছে সবজেটে রঙে৷ চোখদুটো নিপুণ ভাবে বন্ধ করা৷ বুকের ওঠাপড়া দেখে বোঝা যায় এখনও বেঁচে আছে সে৷ কী একটা যেন বদলে গেছে তার শরীরে…

বলিষ্ঠ হাতের টানে উপরে উঠে আসে দেহটা৷ সদ্যোজাত শিশুর মতোই সেটা মাটির উপরে শুইয়ে দেয় হিরণ্ময়৷ কোমর থেকে খুলে দেয় দড়িটা৷

হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ডাকতে থাকে হিরণ্ময়, ‘মন্দাকিনী, শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?’

মন্দাকিনীর চোখের পাতা কেঁপে ওঠে কয়েকবার৷ ঠোঁটদুটোও স্পন্দিত হয়৷ তারপর আবার নিস্তেজ হয়ে ঝিমিয়ে যায়৷

ওর নাকের কাছে হাত রাখে হিরণ্ময়৷ ছেলেটার সমস্ত মুখ ঢেকে ফেলেছে দুশ্চিন্তার রেখা৷ আবার পাঁজাকোলা করে স্ত্রীকে তুলে নেয় সে৷ তারপর ছুটে বেরিয়ে আসে বাইরে৷ খোলা হাওয়ায় একটু নিঃশ্বাস নেওয়া দরকার মন্দাকিনীর৷ সেই সঙ্গে একটু উত্তাপ…

হঠাৎ গলার কাছে কীসের যেন স্পর্শ অনুভব করে হিরণ্ময়৷ সে স্তম্ভিত হয়ে যায়৷ পরমুহূর্তেই উচ্ছ্বাসের ঢেউ এসে গ্রাস করে ফেলে তার সমস্ত শরীর৷ একটা হাত দিয়ে সজোরে ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে মন্দাকিনী৷ যে আলিঙ্গনের উষ্ণতা কয়েকমাস যাবৎ হারিয়ে ফেলছিল দু-জনে, আর তা আবার মৃত লাজারুসের মতোই আবার একটু একটু করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে…

শিশুর আবেগে চিৎকার করে ওঠে হিরণ্ময়…

(ছয়)

‘রিনি… শুনছ… রিনি…’

ধীরে ধীরে চোখে খোলে মন্দাকিনী৷ হিরণ্ময়ের উচ্ছ্বাসে ভরা মুখটা ঝুঁকে রয়েছে ওর মুখের উপরে৷ চোখদুটো খুলতেই ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল হিরণ্ময়, ‘আমরা পেরেছি রিনি, তুমি একদম ঠিক হয়ে গেছ… ছুঁয়ে দেখ আমাকে…’

দু-হাতে ওর দুটো হাত নিজের গালে রাখে হিরণ্ময়৷ হাতের স্পর্শ বুলিয়ে দেয় সমস্ত শরীরে৷ মন্দাকিনী হাসতে যায়, কিন্তু পারে না৷ এক অদ্ভুত ক্লান্তিতে শরীর ঝিমিয়ে আসে তার৷ হাতটা নেমে আসে হিরণ্ময়ের বুকে৷

মাথার উপরে তারাভরা আকাশ ঝিকমিক করছে৷ আগুনের তাপে শরীর জুড়িয়ে আসছে৷ গায়ে লেগে থাকা স্যাঁতস্যাঁতে শীতলতা মুছে গিয়ে এক অদ্ভুত নিরাপত্তার চাদর টেনে দিচ্ছে যেন কেউ৷

মাটির উপরে হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে মন্দাকিনী৷ একটা কাঠের পাঁজা রাখা ছিল পাশে৷ তার গায়েই পিঠ এলিয়ে দেয়৷ হিরণ্ময়ের উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত চোখে হাসে, ‘তুমি একটু শান্ত হও এবার…’

দূরে ঝোপঝাড়ের গায়ে জোনাকি জ্বলছে৷ কোথা থেকে যেন বার দুয়েক শেয়ালের ডাক শোনা গেল৷

‘মাধবদা, চল ওকে নিয়ে উপরে যাই…’

হাত তুলে বাধা দেয় মন্দাকিনী, ‘উঁহুঁ, এখানে এইভাবে একটু থাকতে দাও, কতদিন হাত দিয়ে ভেজা ঘাস ছুঁইনি বল তো…’

হিরণ্ময় হেসে ফেলে৷ ভিতরের ঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলে, ‘আমি কুয়োটা ঢাকা দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করি৷ ততক্ষণ তুমি এখানে থাকো নাহয়…’

মন্দাকিনীর মাথায় হাত ছুঁইয়ে ভিতরের ঘরের দিকে পা বাড়ায় হিরণ্ময়৷ তার পায়ের শব্দ ভিতরের দিকে মিলিয়ে আসতেই মাধবের দিকে চেয়ে একবার হাসে মন্দাকিনী, তারপর চাপা গলায় বড়ো করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, ‘কাল আমরা এখান থেকে চলে গেলে কুয়োর নিচের আলোটা সরিয়ে ফেল৷ নইলে আবার কেউ সবুজ আলো দেখতে পাবে… আর দেখ কুকুরটা ঠিক আছে কি না…’

‘থাকবে না কেন, ঘুমপাড়ানি ওষুধে ক্ষতি হয় না কিছু…’ কথাটা বলেই মাধব একবার সন্তর্পণে চারদিকটা দেখে নেয়, তারপর ততোধিক নিচু গলায় বলে, ‘আপনি এতকিছু কেন করলেন দিদি? ওই কুয়োতে কিচ্ছু নেই, একটা পচা এঁদো কুয়ো…’

মন্দাকিনী মাথা নামিয়ে নেয়, শরীরটা ক্লান্ত লাগছে ভীষণ৷ মাথাটা ঝিমঝিম করছে৷ অথচ একটা অনাবিল হাসি ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত মুখে, ‘আমার একটা জিনিস জানার ছিল মাধবদা, না জানলে কিছুতেই ঘুমাতে পারতাম না৷ একটা বছর রোজ রাতের ঘুম নষ্ট করেছে প্রশ্নটা আমার…’

‘মানে?’

মনে মনে উত্তরগুলো গুছিয়ে নেয় মন্দাকিনী৷ আজ সত্যি সমস্ত ঘটনাটা কাউকে খুলে বলতে ইচ্ছা করছে ওর, মাথা তুলে আকাশের দিকে চেয়ে সে একটানা বলতে থাকে, ‘এক একটা মানুষের এক এক রকমের অবসেশন থাকে, জানো মাধবদা৷ আর কখনও কখনও দুটো মানুষের অবসেশন একটা বিন্দুতে এসে মিলে যায়…

কলেজে পড়তে আমার একটা ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়৷ ভারি ভালো লাগে ছেলেটাকে৷ একেবারে ল্যাজামুড়োসুদ্ধু প্রেমে পড়ে যাই৷ কিন্তু কিছুদিন মেলামেশার পর একটা ব্যাপার বুঝতে পারি৷ এ ছেলের জীবনে কিছু একটা রহস্য আছে৷ এমন কিছু আছে যা একে মাঝে মধ্যেই উদাস করে দেয়…’

‘তারপর?’

‘মেয়েদের এই এক স্বভাব, বুঝলে? কিছু একটা ব্যাপারে সন্দেহ হলে তার চোদ্দোগুষ্টি ঘেঁটে একেবারে উদ্ধার করে দেবে৷ আমিও খোঁজখবর শুরু করলাম৷ আসল ঘটনা জানতে আমার বেশিদিন সময় লাগেনি৷ তবে সেটা যে আমি জানি তা হিরণ্ময়কে জানতে দিইনি কখনও…’

‘আসল ঘটনা! সেটা কী?’

‘হিরণ্ময়ের মা মারা যায় ছোটোবেলায়৷ কিছু একটা ক্রনিক রোগে ভুগতে ভুগতে৷ ওইটুকু ছেলের কাছে ব্যাপারটা আঘাত হয়ে নেমে আসে৷ সে বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গল্পের বই আর কল্পনার জগতে বাঁচতে শুরু করে৷ লাজারুস পিট নামে আদৌ কোনও মিথ কোনও দেশে নেই৷ আছে একমাত্র ব্যাটম্যানের কমিক্সে৷ ওই বয়সের এমন কল্পনাপ্রবণ ছেলে ব্যাটম্যানকেই সত্যি হিসেবে মেনে নেয়৷ রা’স আল ঘুল লাজারুস পিট খুঁজে পেয়ে এক মরণাপন্ন রাজপুত্রের জীবন বাঁচায়৷ ব্যাপারটা ভাবিয়ে তোলে হিরণ্ময়কে —যদি ওর কাছেও এমন কোনও লাজারুস পিট থাকত তাহলে ও হয়তো মাকে বাঁচাতে পারত…

এই এক চিন্তা ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে ওকে৷ দুয়ে দুয়ে চার হয় যখন একদিন খেলার ছলে বাড়ির বেসমেন্টে একটা লুকানো কুয়ো খুঁজে পায় সে৷ কুয়ো আদৌ লুকানো ছিল না৷ কেবল সাপখোপের ভয়েই বাচ্চাদের সেদিকে যাওয়া মানা ছিল৷ হিরণ্ময়ের মনের গভীরে বেড়ে ওঠা লাজারুসের কুয়োর জায়গা দখল করে ওই এঁদো কুয়োটা…’

‘কিন্তু তাহলে আপনি আজ…’

‘আমি কী করে সেরে উঠলাম? তাই তো?’ মন্দাকিনী হাসে, ‘কারণ আমি অসুস্থ ছিলামই না…’

থতমত খেয়ে যায় মাধব, ‘তাহলে…’

‘তবে এই সময়ে হিরণ্ময়ের একটি প্রেমিকা ছিল৷ ছোটোবয়সের প্রেমিকা যেমন হয় আর কী৷ অস্বাভাবিক কিছু না৷ মুশকিলটা তখন হল যখন হিরণ্ময় জানতে পারল তার মায়ের মতো প্রেমিকারও একটি জটিল নার্ভের রোগ আছে৷ মাকে না বাঁচাতে পারার ক্ষত ভুলতে সে ঠিক করল তার প্রেমিকাটিকেও একবার ওই সবজে জলে চুবিয়ে আনবে৷ সেই মতো দু-জনে প্ল্যানও করল৷ কিন্তু মুশকিল হল রাত্রিবেলা কোমরে দড়ি বেঁধে কুয়োর নিচে নামতে গিয়ে প্রেমিকাটি ভয় পেয়ে বেঁকে বসে৷ সে কিছুতেই রাজি হয় না৷ ঝোঁকের মাথায় জোর করে তাকে নিচে নামাতে গিয়ে ধাক্কা মেরে তাকে কুয়োর ভিতরে ফেলে দেয় হিরণ্ময়৷’

‘সেকী!’

‘হুম… নিচে পড়ে মেয়েটির কোমরের হাড় ভেঙে যায়৷ বাড়ির লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করে৷ হিরণ্ময়কে মাথার ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়৷ আমি এতকিছু সেই ডাক্তারের কাছ থেকেই জানতে পেরেছি৷’

‘সেই মেয়েটার কী হয়?’

‘সে এবং তার বাড়ির লোক আর হিরণ্ময়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না৷ এই হিংস্রতায় মেয়েটিও ভালোবাসার বদলে ভয় পেতে শুরু করে হিরণ্ময়কে…’

একটু থেমে বড়ো করে নিঃশ্বাস নেয় মন্দাকিনী, ‘মানুষের মন ভারি বিচিত্র বস্তু, বুঝলেন মাধবদা, মেয়েটির এই বদলে যাওয়ার অন্য একটি ব্যখ্যা খাড়া করে হিরণ্ময়৷ আবার সেই রা’স আল ঘুলের গল্প৷ হিরণ্ময় ব্যাটম্যানের কমিকসে পড়েছিল লাজারুস পিট আসলে আত্মাকে শরীর থেকে আলাদা করে নিজের ভিত লুকিয়ে ফেলতে পারে৷ বেশিক্ষণ সে জলে ডূবে থাকলেই দেহের ভিতরের আত্মা বের করে তার ভিতরে অন্য আত্মা ঢুকিয়ে দেয় সে৷ সে ভেবে নেয় কুয়োর সবুজ জলে বেশিক্ষণ ডুবে থাকার জন্য মেয়েটির আত্মা বদলে গেছে৷ তার দেহে যে উঠে এসেছে সে তার প্রেমিকা নয়, অন্য কেউ৷ আসল আত্মা বন্দি রয়েছে ওঈ সবজে তরলের ভিতরে৷ সেই বন্দি আত্মাকে উদ্ধার করার আর কোনও উপায় খুঁজে পায় না হিরণ্ময়৷ ছেলেবেলার হারানো প্রেম সেই লাজারুসের কুয়োর মধ্যেই বন্দি রয়ে যায়…’

কথাটা বলে আগুনের দিকে আর একটু এগিয়ে বসে মন্দাকিনী৷ তার চুলগুলো ভিজে রয়েছে৷ সেগুলো বুকের উপরে এনেই শুকাতে থাকে সে৷ কমলা আলোর ছটা তার নরম মুখের উপর পড়ে ছিটকে যেতে থাকে৷

‘কিন্তু আপনি এতকিছু করলেন কেন দিদি?’

মন্দাকিনী নরম হাসি হাসে, ‘ওই যে বললাম৷ এক-একটা মানুষের এক-একরকমের অবশেসন থাকে৷ কখনও কখনও দুটো অবশেসন একজায়গায় মিলে যায়খ হিরণ্ময়ের মতো আমারও একটা অবশেসন আছে…’

‘কেমন অবশেসন?’

‘একটা টান পরীক্ষা করার…’

‘টান! কীসের?’

‘দড়ির…’

মাধব কী জিজ্ঞেস করবে ভেবে পায় না৷ ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে মহিলার মুখের দিকে৷

‘আমি যখন ওই সবুজ জলে ডুবে আটকে গেছিলাম, তখন কী হতে পারত বল তো?’

‘কিছুই হত না৷ একটা এঁদো কুয়ো…’

‘সে তো তোমার আমার কাছে৷ হিরণ্ময়ের কাছে ওটাই লাজারুসের কুয়ো… আর তার ভিতরেই চাপা পড়ে আছে ওর প্রেমিকার আত্মা… আমি বেশিক্ষণ ডুবে থাকলে ওই লাজারুস পিটের ভিতর ডুবে থাকা মেয়েটার আত্মা ঢুকে পড়ত আমার শরীরে… হিরণ্ময় আমার বদলে ওর বাকিটা জীবন ওর সেই ছোটোবেলার হারিয়ে ফেলা প্রেমিকার সঙ্গে কাটাতে পারত… ওকে শুধু তোমাকে দেখিয়ে একটু দড়ি টানার অভিনয় করতে হত…’

‘সত্যি টান পড়েছিল তোমার কোমরে?’

মাধবের প্রশ্নটার উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল মন্দাকিনী৷ হঠাৎ করেই পেছনে পায়ের শব্দ শুনে সে থমকে যায়৷

হিরণ্ময় একটা হাত রাখে ওর কাঁধে, ‘অনেক হয়েছে৷ চল এবার উপরে যেতে হবে, আজ রাতটা রেস্ট৷ কাল সকাল থেকে শুরু হবে ফোন কল…’

কথাটা বলে একটা হাত স্ত্রীর দিকে বাড়িয়ে দেয় হিরণ্ময়৷ সে হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে যেতেই বসে পড়ে৷ কোমর চেপে ধরে ককিয়ে ওঠে যন্ত্রণায়৷

‘কী হল আবার?’

‘কোমরে কী সাংঘাতিক ব্যথা গো, আর একটু হলেই ভেঙে যেত কোমরটা… একটু এখানেই বসি না হয়…’

ওর পাশেই বসে পড়ে হিরণ্ময়৷ তারপর মাথাটা টেনে নেয় নিজের কাঁধে৷ দু-জনের শরীর জুড়েই পরম শান্তির রাত নামছে৷ এদিকের কোনও একটা বাড়িতে সন্ধেবেলায় কেউ বাঁশি বাজায়৷ সেই সুরই হাওয়ায় ভেসে আসছে এতটা দূরে৷ সেটা শুনতে শুনতেই শরীরের ক্লান্তি জুড়িয়ে আসে ওদের৷

চোখ বন্ধ করার আগে হিরণ্ময় কেবল চেয়ে দেখে — আগুনের তেজ কমে গেছে৷ জোনাকির ঝাঁক উড়ে আসছে সেই সুযোগে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *