লাখ এখন নস্যি
একটা টুথপেস্ট, একটা টুথব্রাশ, একটা সাবান। একশো টাকার একটা নোট দিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘এতে হবে তো?’
‘হবে কী! আপনি অনেক ফেরত পাবেন। হঠাৎ এমন ধারণা হল কী করে যে এতে হবে না!’
‘ভাই, কাগজ পড়ে। মাথা থেকে পাঁচ, দশ, কুড়ি, একশো বেরিয়ে গেছে। সব যেন বাসের টিকিট। এখন সেখানে লাখ আর কোটির খেলা।’
গত কয়েক বছর রিজার্ভ ব্যাঙ্কে যত নোট ছাপা হয়েছিল, প্রায় সবই এখন প্রাইভেট কালেকশনে। আমজনতার পকেটে পচিত, গলিত কিছু দুই, পাঁচ, দশ। সেই অহঙ্কারেই দিগ্বিদিক ফাটছে। স্বপ্ন খেলছে, ফ্ল্যাট কিনে ফ্ল্যাট হব, রঙিন কাচে মুম্বইবালাদের ঘাগরার ঘূর্ণন দেখব, উন্মোচিত মধ্যভাগ জরিপ করব, নাভিতে ডুবুরি নামাব। তোমার বড় কষ্ট গো’—একটা ওয়াশিং মেশিন কিনে দেব। ছেলের গলায় ইংরিজি ল্যাঙ্গট বেঁধে, বেস্ট, দি বেস্ট, বেটার বেস্ট ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে মানুষের চেয়ে মানুষ করব। একটা মাইক্রোওভেন কিনব। তার গুণ যে বলে শেষ করা যাবে না, মরা কাবাব জ্যান্ত হয়ে বেরিয়ে আসবে। আচোট দ্রব্যগুণ। জল ছাড়াই স্যুপ। মিনারেল আর ভিটামিনে মাখামাখি। বউ খাচ্ছে, মেয়ে খাচ্ছে, আমি খাচ্ছি, ‘ডাল’ চেহারা ধীরে ধীরে ডাল লেক। শিকারা সুন্দরী। গাল গোলাপি আপেল।
এই সুটকেস খোল। দেখি! দুটো ঝলঝলে ট্যাউজার, কলারে বসে যাওয়া ময়লার রেখা আঁকা গোটা চারেক শার্ট, কিছু ছেঁড়া কাগজ, ন্যাকড়া, টিকটিকির ডিমের মতো ন্যাপথালিন। দেখি ব্যাঙ্কের বই? ব্যালেন্স সাড়ে সাতশো। মারো ব্যাটার ঘাড়ে রদ্দা। ফ্ল্যাট কিনে ফ্ল্যাট করবে চোঁয়ানো আঙুরের রস খেয়ে! শালপাতা চেটে ঘুগনি খাও, মিনি ভাঁড়ে তিন ফুট খাও, সাবেক বাড়ির নোনাধরা দেওয়ালে বিশ্বের মানচিত্র দেখো, স্ত্রী আর কাজের মহিলার স্টিরিও সংকীর্তনে মাইকেল জ্যাকসন খোঁজো। কন্যার অ্যানিমিক মুখে বিশ্বসুন্দরীর মুখোশ ফিট করো।
এ সুটকেস যে ভাই সুখরামের সুটকেস নয়!
অতীতে লাখোপতিকে বলা হত ধনকুবের। চাকরি করে হবে না। কোম্পানির আমলে মুৎসুদ্দি, বেনিয়ানদের হত। ঝাড় ঝুলঝুল বৈঠকখানায় নিকি-আসরুনের নৃত্য। দেবী দুর্গাকে পিরুর দোকানের কাবাব ভোগ। হুইস্কির চরণামৃত। সাহেবদের সঙ্গে কাঁধ ঘষা। কুঁচো জমিদারদের প্রজা দলন। এরপরে এলেন নিউ রিচ। সুপার, মেগা, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। ফিউডাল এজের বুকে লোহা, কয়লা চিমনির ধোঁয়া, চা, কাপড়, চট, কার্পেট। ওভারইনভয়েস, আন্ডারইনভয়েস, ড্রাগস, গোল্ড বিস্কুট, মাফিয়া, মুম্বাই। মেগাস্টার, ফ্লপ স্টার, পালিশ করা নায়িকা, ঢিসুম ঢিসুম দাগাবাজি নাচ, ধামাধামা কালো টাকা। চাওলা থেকে হাওলা।
নেমে এলেন নেতারা। এক হাতে তোষণ এক হাতে পোষণ। তৈরি হল নেকসাস। দাঁতের মতো সাজানো বলদায়ী বুলি বলদদের জন্য। জোড়া জোড়া বলদ। তেরঙা উলটে গেল। জনগণমন-র সুর কেটে গেল। মাঝখানটা সাদা। ধর্মচক্র হয়ে গেল শয়তানের চাকা। বলো বলো সবে, ভারত ভড়ভড়িয়ে ডুবছে পাঁকে।
লাখ এখন নস্যি। কোটি হল ইউনিট অর্বুদপতি হতে গেলে কী করতে হবে? রাজনীতি। মেরে কেটে যে ভাবেই হোক মন্ত্রী হও। একটা পোর্টফোলিও শত ফোলিও হবে। সব নোট বোঝাই। অফিসে নোট নয় কারেন্সি নোটস। নোটের বালিশ, নোটের বিছানা, নোটের কমোড। খড়ের আঁটির মতো নোটের দিক থেকে আরও ষাট সিন্দুক। গোনা যাচ্ছে না স্যার! টাকার সপ্তসিন্ধু!
তা হলে ওজন করো। দেখো ক’কুইন্টাল!
এ টাকা কার?
পার্টির।
পার্টি কি তা হলে চটকল? না কাপড়ের কল? পার্টি কী ইন্ডাস্ট্রি?
অবশ্যই। পেছনে দড়ি ধরে আছে শিল্পপতি, মাফিয়াপতি, অস্ত্রব্যবসায়ী। রাজনীতির বয়লারে বেলচায় করে কয়লা (কালো) টাকা ঠেলছে স্বার্থাণ্বেষী গোষ্ঠী। গলা বন্ধ কোট, লাউয়ের মতো মুখ, সোনালি চশমা, কুমড়োর মতো ভুঁড়ি, সামনে সাতটা স্পিকার, ওই যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র, দেশকো আগে বাড়ানা হোগা, কোণে কোণে মে! হাঁচি-কাশির ট্রিটমেন্টের জন্যেও যেতে হবে লন্ডনে। পাশবালিশ খুঁজতে সোহাতে। ভোট ফর…।
ভোট ফর চুরি। ভোট ফর দু’নম্বরি। ভোট ফর লাউ অ্যান্ড কুমড়ো কম্বাইন্ড।
এ টাকা কার? জনসাধারণের।
এতে আছে রোদে পড়া জলে ভেজা কৃষকের শ্রম। আছে অন্ধকার গর্তের খনি মজুরের কালো ঘাম, আছে দশটা পাঁচটায় হয়রানিতে জেরবার কেরানির দুশ্চিন্তা, আছে রিকশাচালকের পায়ের টান ধরা পেশি। দরিদ্র জনগণকে নিঙড়ে যা বেরিয়েছে তার সঙ্গে ঢুকেছে ব্যবসায়ীদের কাটমানি। তৈরি হয়েছে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট রোমাঞ্চ।
একটা গান ছিল, এত আলো, এত হাসি, গান! সেইটাকে ঢেলে সাজালেই হয়, এত টাকা, এত কালো, এত কেলো!
খাদ্যবস্তু হজমের ভুড়ভুড়ি কাটা অনেক দাওয়াই আছে। টাকা হজমের কী দাওয়াই! সুইস ব্যাঙ্ক সেফ নয়। বিদেশে পলায়নেও পার পাওয়া যাচ্ছে না। মরে যক্ষ হয়ে যাওয়া ছাড়া, আর কী উপায় আছে!
এই সব ভোগী, সুখী, সেন্টেড জনগণমন অধিনায়কদের জন্যে একটি বাতানুকুল চিড়িয়াখানা বানানো হোক। স্বাধীনতার সার্ধশতবর্ষের শ্রেষ্ঠ স্মারক। আগত ও অনাগত প্রজন্মের মানুষ দেখবে, সার সার খাঁচা এক্স-অমুক, এক্স-তমুক। ভারত কাঁপানো ভণ্ডের দল। দেশ আর দশের অতিকাতর গণতন্ত্রের নাবিক, স্লোগানের ভণ্ডামির পাল, লোভের দুরবিন। কোথায়! গোল্লায়।