লাক্ষাদ্বীপ

লাক্ষাদ্বীপ

বহু বত্সর পূর্বে আমি মাদ্রাজ শহরে এক বন্ধুর বাড়িতে বাস করতুম। তখন চিনি বড় রেশনড় ছিল। যে-ঘরের বারান্দায় বসেছিলুম সেখানে বন্ধুপত্নী কাগজে মোড়া চিনি একটা বোয়ামে রেখে কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। সেই কাগজের টুকরোটা হাওয়ায় ভেসে ভেসে এসে আমার পায়ের কাছে ঠেকল। আমার চোখ গেল যে, কাগজটাতে আরবি হরফে কী যেন লেখা। আশ্চর্য। এই মাদ্রাজ শহরে চিনির দোকানে আরবি কাগজ এল কোথা থেকে? কৌতূহল হল। কাগজটি তুলে ধরে পড়বার চেষ্টা দিলুম। তখন দেখি আরবি হরফে যেসব ভাষা লেখা হয় এটা তার কোনওটাই নয়, আরবি নয়, ফারসি নয়, উর্দু নয়, সিন্ধি নয় (সিন্ধি আরবি হরফে লেখা হয়), কিছুই নয়। তুর্কি ভাষা আমি জানি না। কিন্তু তুর্কি ভাষা এই মাদ্রাজে এসে পৌঁছবে কী প্রকারে? একটি পাতার তো ব্যাপার; ধৈর্য সহকারে পড়ে যেতে লাগলাম এবং দ্বিতীয় পৃষ্ঠার শেষ শব্দটি দেখি মুদরায়ে অর্থাৎ মদুরা। তা হলে ইটি ভারতীয় ভাষা। তখন ছিন্ন পত্রখানা ফের সযত্নে পড়ে দেখি, খাস আরবি শব্দের সঙ্গে মিশে আছে মালায়লাম ও তামিল শব্দও। হঠাৎ মাথায় খেলল, এটি তা হলে মপলাদের ভাষা। এরা আরব ও মালয়ালমের বর্ণসঙ্কর। পরের দিন বন্ধু যখন কর্মস্থলে গেলেন তখন ছিন্ন পত্রটি তার হাতে দিয়ে আমার অনুমানটি কনফার্ম করিয়ে নিলুম। এবং অনুসন্ধান করে আরও জানলুম, লাক্ষাদ্বীপকে নিয়ে যে দ্বীপপুঞ্জ গঠিত সেগুলোর ভাষাও নাকি মোটামুটি ওই একই।

হালে শ্রীযুক্তা ইন্দিরা গান্ধী এই দ্বীপপুঞ্জটির সফরে গিয়েছিলেন। আমি আশা করেছিলুম, এই সুবাদে আমাদের দেশের ওই অংশটি সম্বন্ধে অনেক-কিছু জানতে পাব। তা জেনেছি নিশ্চয়– এঁদের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে অনেক সাংবাদিক সবিস্তর বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু আমার কৌতূহল ছিল এঁদের প্রাচীন ইতিহাস জানবার। সে-বাবদে যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গেলুম।

প্রথম প্রশ্ন লাক্ষাদ্বীপ কথাটার অর্থ কী? ইংরেজিতে বানান করা হয় Laccadive এবং এর শেষাংশ দীব যে দ্বীপ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আরবি ভাষায় প অক্ষরটি নেই বলে সে স্থলে ব বা ওয়া (অর্থাৎ ইংরেজি v অক্ষর) ব্যবহৃত হয় : তাই দীব বা দীও নিশ্চয়ই দ্বীপ। কিন্তু প্রশ্ন লাক্ষা শব্দের অর্থ কী? পণ্ডিতেরা বলেন, ওটা সংস্কৃত লক্ষ (১,০০,০০০) থেকে এসেছে। অথচ লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জে দ্বীপের সংখ্যা মাত্র চোদ্দটি। এমনকি এই দ্বীপপুঞ্জের সংলগ্ন, মাত্র আশি মাইল দূরে অবস্থিত মালদ্বীপের (এ-এলাকা ভারতের অংশ নয়।)

চতুর্দিকে যে দ্বীপপুঞ্জ আছে তার সংখ্যাও তিন শো (এর মধ্যে মাত্র সতেরোটিতে লোকাবাস আছে এবং এদের ভাষা আরবি মিশ্রিত সিংহলি)। এই তিনশো এবং লাক্ষাদ্বীপে চৌদ্দটি (বসতি আছে সাকুল্যে তা হলে বাইশটি দ্বীপে) নিলেও তাকে লক্ষ সংখ্যায় পরিবর্তিত করতে হলে এদেরকে হাজার হাজার ডবল প্রমোশন দিতে হয়। তবে কি না, কি হিন্দু পুরাণকার কি মুসলমান পর্যটক ঐতিহাসিক গণনা করার (শুমার করার) সময় বেশকিছুটা কল্পনাশক্তির আশ্রয় নিয়ে ১০০ বা ১০০০-র পিছনে গোটা তিনেক শূন্য বসিয়ে দিতে কার্পণ্য করতেন না। এরই একটি উদাহরণ পাওয়া যায় বাঙলা দেশের কেচ্ছাসাহিত্যে : লোক মরে লক্ষ লক্ষ, কাতারে কাতার। শুমার করিয়া দেখি আড়াই হাজার। তবু এ কবিটির কিঞ্চিৎ বিবেক-বুদ্ধি ছিল। উৎসাহের তোড়ে প্রথম ছত্রে লক্ষ লক্ষ বলে শেষটায় মাথা ঠাণ্ডা করে বললেন, না, পরে গুনে দেখি, আড়াই হাজার। অতএব আড়াই হাজার যদি লক্ষ লক্ষ হতে পারে তবে তিনশো দ্বীপকে মাত্র এক লক্ষে পরিণত করতে আর তেমন কি ভয়ঙ্কর অসুবিস্তে! তদুপরি মূল পাণ্ডুলিপির কপি করার সময় নকলনবিসরা শূন্য সংখ্যা বাড়াতে ছিলেন বড়ই উদারচিত্ত।

এতসব যুক্তি থাকা সত্ত্বেও আমি অতিশয় সভয়ে একটি নিতান্ত এমেচারি (ফোক ইটিমলজি) শব্দতাত্ত্বিক গবেষণা পেশ করি।

লাক্ষা শব্দের অর্থ গালা। পলাশ প্রভৃতি বৃক্ষের শাখায় পুঞ্জীভূত কীট-বিশেষের দেহজ রস হইতে ইহা উৎপন্ন হয় (হরিচরণ)। এর রঙ লাল। হিন্দিতে এর নাম লাক এবং ইংরেজি ল্যাক এর থেকে এসেছে।… লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জ নির্মিত হয়েছে এক প্রকারের কীটের রস থেকে। এর নাম প্রবাল এবং এর রঙ লাল গোলাপি, সাদা ইত্যাদি হয়। কিন্তু প্রবাল বলতে সংস্কৃতে সর্বপ্রথম অর্থ : অঙ্কুর, কিসলয়, নবপল্লব– অতএব বৃক্ষের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে।

তাই আমার মনে সন্দেহ জাগে সেই প্রাচীন যুগে যখন লাক্ষাদ্বীপের নামকরণ হয় (এবং আর্যরা ওই প্রথম প্রবালদ্বীপ, কোরাল আইল্যান্ড-এর সংস্পর্শে আসেন। তখন তারা হয়তো লক্ষ সংখ্যার কথা ভাবেননি, তাঁরা এর নামকরণ করেছিলেন লাক্ষার সঙ্গে এর জন্মগত, বর্ণগত, রসাগত রূপ দেখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *