লাওয়ালঙের বাঘ – বুদ্ধদেব গুহ
ঋজুদার সঙ্গে সীমারীয়ার ডাকবাংলোয় আজ রাতের মতো এসে উঠেছি। আমরা যাচ্ছিলাম কাড়গুতে, চাতরার রাস্তায়; কিন্তু কলকাতা থেকে একটানা জিপ চালিয়ে এসে গরমে সবাই কাবু হয়ে পড়েছিল বলে রাতের মতো এখানেই থাকা হবে বলে ঠিক করল ঋজুদা।
সবাই বলতে ঋজুদা, অমৃতলাল আর আমি।
এখন রাত আটটা হবে। শুক্লপক্ষ। বাইরে ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। চৌকিদার হ্যারিকেন জ্বালাবার তোড়জোড় করছিল, ঋজুদা বলল, তুমি বাবা আমাদের একটু খিচুড়ি আর ডিমভাজা বানিয়ে দাও। অমৃতলালও গিয়ে বাবুর্চিখানায় জুটেছে। আলুকা ভাত্তা বড়ো ভালো বানায় অমৃতলাল, ওর নানীর কাছ থেকে শিখেছিল। আলুসিদ্ধ, তার মধ্যে ঘি, কুচিকুচি কাঁচা পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে এমন করে রগড়ে রগড়ে মাখত যে, তার নাম শুনলেই আমার জিভে জল আসত।
ঋজুদা ঝাঁকড়া সেগুন গাছের নীচের কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে নিজেই লাটাখাম্বাতে জল তুলে ঝপাং ঝপাং করে বালতি বালতি জল ঢেলে চান করছিল। চাঁদের আলোর বন্যা বয়ে-যাওয়া বারান্দার ইজিচেয়ারে বসেছিলাম আমি একা। ঋজুদা বলেছিল, তোর আর রাতে চান করে দরকার নেই। কোলকাত্তীয়া বাবু, শেষে সর্দি-ফর্দি লাগিয়ে ঝামেলা বাধাবি।
সামনে লালমাটির পথটা চলে গেছে ডাইনে টুটিলাওয়া-বানদাগ হয়ে হাজারিবাগ শহরে। বাঁয়ে কয়েক মাইল এগিয়ে গেলেই বাঘড়া মোড়। সেখান থেকে বাঁ-দিকে গেলে পালামোর চাঁদোয়া—টোড়ি। ডানদিকে গেলে চাতরা। এই সীমারীয়া থেকেই একটা কাঁচা রাস্তা চলে গেছে চাতরাতে। আরও একটা পথ টুটিলাওয়া আর সীমারীয়ার মাঝামাঝি মূল পথ থেকে বেরিয়ে গেছে লাওয়ালঙ।
বাইরে নানারকম রাত-চরা পাখি ডাকছে। সকলের নাম জানি না আমি। ঋজুদা জানে। আমি শুধু টী-টী পাখির ডাক চিনি। আসবার সময় সন্ধে হওয়ার আগে জঙ্গলের মধ্যে যে জায়গাটায় জিপ খারাপ হয়ে গিয়েছিল ঠিক সেখানে একদল চাতক পাখি ফটিক-জল-ফটিক-জল করে ঘুরে ঘুরে একটা পাতা-ঝরা ফুলে-ভরা শিমুল গাছের ওপরে পড়ছিল। ওই শিমুল গাছের সঙ্গে ওদের আত্মীয়তাটা কীসের তা বুঝতে পারিনি। আত্মীয়তা নিশ্চয়ই কিছু ছিল।
এরকম হঠাৎ-থামা, হঠাৎ-থাকা জায়গাগুলোর ভারি একটা আকর্ষণ আছে আমার কাছে। এরা যেন পাওয়ার হিসেবের মধ্যে ছিল না, এরা যেন ঝড়ের আমের মতো; পড়ে-পাওয়া। অথচ কত টুকরো টুকরো ভালোলাগা এই সমস্ত হঠাৎ পাওয়ায়—ঝিনুকের মধ্যে নিটোল সুন্দর মুক্তোর মতো।
একটা হাওয়া ছেড়েছে বনের মধ্যে। শুকনো শালপাতা উড়িয়ে নিয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে নালায়-টিলায়; ঝোপে-ঝাড়ে। দূরের পাহাড়ে দাবানল লেগেছে। আলোর মালা জ্বলছে। অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলে দেখা যায় পাহাড়ে পাহাড়ে মালা বদল হচ্ছে। এমনি করে কি পাহাড়দের বিয়ে হয়? কে জানে?
হওয়ায় হাওয়ায়, ঝরে-যাওয়া পাতায়, না-ঝরা পাতায় কত কী ফিসফিসানি উঠছে, চাঁদের আলোয় আর হাওয়ায় কাঁপা ছায়ায় কত কী নাচ নাচছে এই রাত—সাদা-কালোয়, ছায়া-আলোয়। কত কী গাছ উঠছে। গাছের তো প্রাণ আছে, ওদের গানও আছে, কিন্তু ওদের ভাষা তো আমরা জানি না—কোনো স্কুলে তো ওদের ভাষা শেখায় না। কেন যে শেখায় না! ভারি খারাপ লাগে ভাবলে।
ঋজুদা স্নান করছে তো করছেই। কতক্ষণ ধরে যে স্নান করে ঋজুদাটা! যখন ঋজুদার স্নান প্রায় শেষ হয়ে এসেছে—বাবুর্চিখানা থেকে অমৃতলালের গুরুমুখী গানের নীচু গুনগুনানি ভেসে আসছে খিচুড়ি রান্নার শব্দ ও গন্ধের সঙ্গে, এমন সময় মশাল হাতে একদল লোককে আসতে দেখা গেল টুটিলাওয়ার দিক থেকে। লোকগুলো হাজারিবাগী—টাঁড়োয়া-গাড়োয়া ভাষায় উঁচু গলায় কী সব বলতে বলতে আসছিল।
চেয়ার ছেড়ে ওঠে বারান্দার থামে হেলান দিয়ে, উৎকর্ণ হয়ে ওই দিকে চেয়ে রইলাম।
লোকগুলো যখন বাংলোর সামনাসামনি এল, তখন ঋজুদা বারান্দায় এসে ওদের হিন্দিতে শুধোল, কী হয়েছে ভাই?
ওরা সমস্বরে বলল, বড়কা বাঘোয়া।
ব্যাপারটা শোনা গেল।
বড়ো একটা বাঘ, গোরু চরাতে যাওয়া একটা পনেরো-ষোলো বছরের ছেলেকে ঠিক সন্ধ্যের আগে আগে একটা নালার মধ্যে ধরে নিয়ে গেছে।
গোরুগুলো ভয়ে দৌড়ে গ্রামে ফিরতেই ওরা ব্যাপার বুঝতে পেরে ছেলেটার খোঁজে যায়। গাঁয়ের শিকারি তার গাদা বন্দুক নিয়ে জনাকুড়ি লোক সঙ্গে নিয়ে মশাল জ্বালিয়ে রক্তের দাগ দেখে নালার কাছে যেতেই বাঘটা বিরাট গর্জন করে তেড়ে আসে নালার ভিতর থেকে। তাতে ওই শিকারি গুলি করে। গুলি নাকি লাগেও বাঘের গায়ে—কিন্তু বাঘটা শিকারির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মাথাটা একেবারে তিলের নাড়ুর মতো চিবিয়ে, সকলের সামনে তাকে মেরে ফেলেই সঙ্গেসঙ্গে আবার নালার অন্ধকারে ফিরে যায়।
ওরা বলল, ছেলেটাকে তো এতক্ষণে মেরে ফেলেছেই, খেয়েও ফেলেছে হয়তো। ওরা কী করবে ভেবে না পেয়ে এখানে ফরেস্টারবাবুকে খবর দিতে এসেছে।
ঋজুদা চুপ করে ওদের কথা শুনছিল। জনা-কয় লোক বাংলোর সামনে দাঁড়িয়েছিল, অন্যরা ফরেস্টারবাবুর বাংলোর দিকে চলে গেল।
আমার আর তর সইল না। আমি ঋজুদাকে দেখিয়ে ওদের বলে ফেললাম, কোই ডর নেইি—ঈ বাবু বহত জবরদস্ত শিকারি হ্যায়।
একথা বলতে-না-বলতেই ওদের মধ্যে কিছু লোক ফরেস্ট অফিসে দৌড়ে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ফরেস্টারবাবুকে সঙ্গে করে ফিরে এল সকলে। ওঁরা সকলে মিলে ঋজুদাকে বার বার অনুরোধ করলেন। ছেলেটা গ্রামের মাহাতোর ভাতিজা। মৃতদেহের কিছু অংশ না পেলে দাহ করা যাবে না এবং তাহলে ছেলেটার আত্মা চিরদিন নাকি জঙ্গলে-পাহাড়ে টাঁড়ে-টাঁড়ে ঘুরে বেড়াবে, ভূত হয়ে যাবে।
আমি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। ঋজুদার সঙ্গে এ পর্যন্ত ওড়িশার জঙ্গলে অনেক ঘুরলেও কখনো এমন সদ্য মানুষমারা বাঘের সঙ্গে মোলাকাতের অভিজ্ঞতা হয়নি।
গোলমালটা হল ঋজুদাকে নিয়েই। ঋজুদা বলল রুদ্র, তুমি যাবে না। তুমি আর অমৃতলাল দু-জনেই থাকবে এখানে।
অমৃতলাল বলল, নেহি বাবু, ঈ ঠিক নেই হ্যায়। এক্কেলা যানা নেই চাহিয়ে। দুসরা বন্দুক রহনা জরুরি হ্যায়।
তখন ঋজুদা অধৈর্য গলায় অমৃতলালকে বলল, কিন্তু রুদ্র যে বড়ো ছেলেমানুষ—ওর কিছু হলে ওর বাবা-মাকে কী বলব আমি?
আমি সকলের সামনেই ঋজুদার পা জড়িয়ে ধরে বললাম, ঋজুদা, আমাকে নিয়ে চলো, প্লিজ। তুমি তো সঙ্গেই থাকবে। তোমার যা হবে আমারও তাই হবে।
ঋজুদা কিছুক্ষণ চুপ করে আমার দিকে চেয়ে রইল। বলল, তুই ভারি অবাধ্য হয়েছিস। তারপরই বলল, আচ্ছা চল।
জিপে যে ক-জন লোক ধরে, তাদের নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। লাওয়ালঙের রাস্তায়। অমৃতলাল জিপ চালাচ্ছিল তখন। ঋজুদা ফোরফিফটি-ফোর হানড্রেড দোনলা রাইফেলটা নিয়েছিল। আমার হাতে দোনলা বারো বোরের বন্দুক। দুটো অ্যালফাম্যাকস এল. জি. আর দুটো লেথাল বল নিয়েছি সঙ্গে।
গরমের দিন। জঙ্গল একেবারে পাতলা হয়ে গেছে পাতা ঝরে। বর্ষার শেষে বড়ো বড়ো গাছের নীচে নীচে যেসব আগাছা, ঝোপঝাড়, লতাপাতা গজিয়ে ওঠে এবং শীতে যেগুলো ঘন হয়ে থাকে—যাদের ঋজুদা বলে ‘আণ্ডারগ্রোথ’— সেসব এখন একেবারেই নেই। জিপের আলোর দু-পাশে প্রায় এক-শো আশি ডিগ্রি চোখ চলে এখন।
একটা খরগোশ রাস্তা পেরুলো ডানদিক থেকে বাঁ-দিকে। পর পর দুটো লুমরির জ্বলজ্বলে সবুজ চোখ দেখা গেল। একটু পরেই আমরা পথ ছেড়ে একটা ছোটো পায়ে-চলা পথে ঢুকে গ্রামটাতে এসে পৌঁছোলাম। জিপের আওয়াজ শুনেই লোকজন ঘরের বাইরে এল। জিপটা ওখানেই রেখে দেওয়া হল। তারপর গ্রামের যে মাহাতো, তাকে ঋজুদা বলল পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের।
যে শিকারিকে বাঘ মেরে ফেলেছে, তাকে খাটিয়ার ওপর একটা সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। মাটির দেওয়াল আর খাপরার চালের বাড়িগুলো থেকে মেয়ে ও বাচ্চাদের কান্না শোনা যাচ্ছিল। ঋজুদা সেই মৃতদেহের কাছে গিয়ে চাদর সরিয়ে লণ্ঠন দিয়ে কী যেন দেখল ভালো করে। তারপর ফিরে এসে বলল, চল রুদ্র।
গ্রামের লোকেদের যথাসম্ভব কম কথা বলতে ও আওয়াজ করতে অনুরোধ করে ঋজুদা আর আমি মাহাতোর সঙ্গে এগোলাম। উত্তেজনায় আমার গা দিয়ে তখনই দরদর করে ঘাম বেরুচ্ছিল, হাতের তেলো ঘেমে যাচ্ছিল। বারবার খাকি বুশ শার্টের গায়ে ঘাম মুছে নিচ্ছিলাম।
জঙ্গলের বেশিরভাগই শাল। মাঝে মাঝে আসন, কেঁদ, গনহার এসবও আছে। আমলকি গাছ আছে অনেক। জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে এক এক ফালি চাষের জমি। হয়তো শীতে কিতারী, অড়হর, কুলথী বা গেঁহু লাগিয়েছিল। এখন কোনো চিহ্ন নেই তার। মাটি ফেটে চৌচির হয়ে আছে।
আলো না জ্বালিয়ে, আমরা নি:শব্দে শুকনো পাতা না মাড়িয়ে, পাথর এড়িয়ে হাঁটছি। বন্দুকে গুলি ভরে নিয়েছি। ঋজুদার কথামতো দু-নলেই এল. জি. পুরে নিয়েছি। খুব কাছাকাছি থেকে গুলি করতে হলে নাকি এল. জি.-ই ভালো। ঋজুদাও রাইফেলের দু-ব্যারেলে সফট নোজড বুলেট পুরে নিয়েছে। ঋজুদার রাইফেলের সঙ্গে একটা ক্ল্যাম্পে ছোটো একটা টর্চ লাগানো আছে—ক্ল্যাম্পের সঙ্গে আটকানো একটা লোহার পাতে নিশানা নেবার সময় বাঁ-হাতের আঙুল ছোঁয়ালেই টর্চটা জ্বলে ওঠে। আমার বন্দুকে আলো নেই। এমন জ্যোৎস্না-রাতে বন্দুক ছুড়তে আলো লাগে না। বন্দুক ছোড়া রাইফেল ছোড়ার চেয়ে অনেক সহজ।
কিছুদূরে গিয়ে আমরা একটা উপত্যকায় এসে পৌঁছোলাম। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে শান্ত উদোম উপত্যকা। দূরে পিউ-কাঁহা পিউ-কাঁহা করে রাতের বনে শিহর তুলে পাখি ডাকছে। কী চমৎকার সুন্দর পরিবেশ! ভাবাই যায় না যে, এই আলোর মধ্যে ছায়ার আড়ালে মৃত্যু লুকিয়ে আছে—অমন মর্মান্তিক মৃত্যু। দু-দুজন লোক আজ সন্ধ্যে থেকে এখানে মারা গেছে, বলতে গেলে খুন হয়েছে, অথচ কী সুন্দর পাখি ডাকছে; হাওয়ায় মহুয়া আর করৌনজ ফুলের গন্ধ ভাসছে কী দারুণ!
মাহাতো আঙুল দিয়ে দূরে যে জায়গাটা থেকে বাঘ নালা ছেড়ে উঠে এসে শিকারিকে আক্রমণ করেছিল, সেই জায়গাটা দেখিয়ে দিল। ঋজুদা ফিসফিস করে বলল, সামনে যে পিপুল গাছটা আছে, তাতে তুমি চড়ে বসে থাকো। আমরা ডান দিকে গিয়ে বাঘের যে জায়গায় থাকার সম্ভাবনা, সে-জায়গা থেকে কম করে তিন-শো গজ দূরে নালায় নামব।
তারপর আর কিছু না বলে ঋজুদা এগিয়ে চলল। পরক্ষণেই, দাঁড়িয়ে পড়ে মাহাতোকে বলল, দিনের আলো ফোটার আগেও যদি আমরা না ফিরি, তাহলে অমৃতলালকে ও গাঁয়ের লোকদের নিয়ে আমাদের খুঁজতে এসো।
কথাটা শুনে মাহাতো খুব খুশি হল না, চাঁদের আলোয় তার মুখ দেখেই তা বোঝা গেল।
এরপর ঋজুদা আর আমি সেই চন্দ্রালোকিত উপত্যকায় দু-টি ছায়ার মতো, নি:শব্দে দূরের শুয়ে-থাকা ঘন কালো ছায়ার মতো, নালাটির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।
ঋজুদা শুধু একবার ফিসফিস করে বলল, ভয় পেয়ে পিছন থেকে আমাকে গুলি করিস না যেন। নালায় নেমে আমার পাশে পাশে হাঁটবি—পিছনে নয়। একটুও শব্দ না করে। প্রত্যেকটি পা ফেলার আগে কোথায় পা ফেলছিস, তা দেখে ফেলবি—এক পা এগোবার আগে সামনে ও চারপাশে ভালো করে দেখবি। কান খাড়া রাখবি, নালার মধ্যে চোখের চেয়ে কানের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হবে। নালার মধ্যে হয়তো অন্ধকার থাকবে। তোর বন্দুকে আলো থাকলে ভালো হত।
যাই হোক, তখন আর কিছু করার নেই। আশা করতে লাগলাম, পাতা-ঝরা গাছগুলোর ফাঁকফোঁকর দিয়ে নালার মধ্যে কিছুটা আলো হয়তো চুঁইয়ে আসবে। গুলি খাক আর না খাক, বাঘ যে নালার মধ্যেই থাকবে, এমন কোনো কথা নেই। যদি নালার মধ্যে থাকে, তাহলে নালার কোন জায়গায় থাকবে তারও স্থিরতা নেই। তা ঋজুদা ভালো করে জানে বলেই এত সাবধান হয়ে নালার প্রায় শেষ প্রান্তের দিকে আমরা এগোচ্ছি।
দেখতে দেখতে নালার মুখে চলে এলাম। শুকনো বালি, চাঁদের আলোয় ধবধব করছে। আমাকে হুঁশিয়ার থাকতে বলে ঋজুদা হাঁটু গেড়ে বসে নালার বালি পরীক্ষা করে দেখল। নালা থেকে যে বাঘ বেরিয়ে গেছে তেমন কোনো পায়ের চিহ্ন দেখা গেল না। খুব বড়ো একটা বাঘের পায়ের দাগ ছাড়াও শুয়োর, শজারু, কোটরা হরিণ ইত্যাদির অনেক পায়ের দাগ দেখা গেল। বাঘ ভিতরে ঢুকেছে, কিন্তু এদিক দিয়ে বাইরে বেরোয়নি।
নালায় পৌঁছোনোর আগে অবধি একটা টী-টী পাখি আমাদের মাথার ওপরে ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে টিটির-টি—টি-টি-টি-টি করে ডাকতে ডাকতে সারা বনে আমাদের আগমন বার্তা জানিয়ে দিল। আমার মন বলছিল, বাঘ একেবারে খবর পেয়ে তৈরি হয়েই থাকবে।
এবারে আমরা নালার মধ্যে ঢুকে পড়েছি।
দু-পাশে খাড়া পাড়। কোথাও-বা খোয়াই, পিটিসের ঝোপ, আমলকির পত্রশূন্য ডালে থোকা থোকা আমলকি ধরে আছে। নালার মধ্যে একাট জলের ধারা বয়ে এসেছে ওপাশ থেকে। কোথাও সে-জলে পায়ের পাতা ভেজে—কোথাও বা তাও নয়—শুধু বালি ভিজে রয়েছে।
কোনো সাড়াশব্দ নেই—শুধু একরকম কটকটে ঝিঁঝির একটানা ঝাঁ-ঝাঁ আওয়াজ ছাড়া।
একটা বাঁক নিলাম। ঋজুদা এক-এক গজ পথ যেতে পাঁচ মিনিট করে সময় নিচ্ছে।
যতই এগোতে লাগলাম, ততই জলের ধারাটা গভীর হতে লাগল। কোথাও কোথাও হাঁটু-সমান জল পথের গভীরে জমে আছে, তার মধ্যে ব্যাঙাচি, কালো কালো লম্বা গোঁফওয়ালা জলজ পোকা। আমাদের পায়ের শব্দের অনুকরণে একটা ছোটো ব্যাং জলছড়া দিয়ে দৌড়ে গেল জলের মধ্যে।
যতই এগোচ্ছি ততই নিস্তব্ধতা বাড়ছে। এত জানোয়ারের পায়ের দাগ দেখলাম নালায় ঢোকার সময় বালিতে, কিন্তু কারো সঙ্গে দেখা হল না এ পর্যন্ত। কোনো মন্ত্রবলে তারা যেন সব উধাও হয়ে গেছে!
ঋজুদার কান চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে আছে। ঋজুদার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে বাঘ নালার মধ্যেই আছে। বন্দুকটা শুটিং-পজিশনে ধরে সেফটি-ক্যাচে বুড়ো আঙুল ছুঁইয়েই আছি আমি—যাতে প্রয়োজনে এক মুহূর্তের মধ্যে গুলি করতে পারি।
বোধহয় এক ঘণ্টা হয়ে গেছে আমরা নালাটার মধ্যে ঢুকেছি। এতক্ষণে বেশ অনেকখানি ভিতরে ঢুকে থাকব। নালার মধ্যেটাকে আলো-ছায়ার কাটাকুটি করা একটা ডোরাকাটা শতরঞ্চি বলে মনে হচ্ছে।
হঠাৎ বুকের মধ্যে চমকে দিয়ে কাছ থেকে হুপ-হুপ-হুপ-হুপ করে একসঙ্গে অনেকগুলো হনুমান ডেকে উঠল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে পঁচিশ গজ দূরের একটা বড়ো গাছের উপরের ডালে ডালে হনুমানদের নড়ে-চড়ে বসার আওয়াজ, ডালপালার আওয়াজ শোনা গেল। সঙ্গেসঙ্গে ঋজুদা আমার গায়ে হাত ছুঁইয়ে আমাকে নালার বাঁ-দিকের পাড়ের দিকে সরে আসতে ইশারা করল। আমি সরে আসতেই, আমার সামনে ছায়ার মধ্যে একটা বড়ো পাথরের ওপর বসে, দু-হাঁটুর ওপরে রাইফেলটা রেখে সামনের দিকে চেয়ে রইল ঋজুদা তীক্ষ্ণ চোখে।
নালাটা সামনে একটা বাঁক নিয়েছে।
হনুমানদের হুপ-হাপ আওয়াজ থেমে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে সামনে থেকে জল পড়ার আওয়াজ স্পষ্ট হল। ঝরনার মতো। পাথরের ওপর বোধহয় হাতখানেক উঁচু থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে, তারই শব্দ। শব্দ শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু ঝরনাটা দেখা যাচ্ছিল না। ওটা বোধহয় বাঁকটার ওপাশেই। এদিকে জলের স্রোতও বেশ জোর—প্রায় ছয় আঙুল মতো জল একটা হাত পাঁচেক চওড়া ধারায় বয়ে চলেছে।
এখানে ঋজুদা একেবারে স্থাণুর মতো বসে রইল সামনের দিকে চেয়ে। কী জানি, ওই হনুমানদের হুপ-হাপ শব্দের মধ্যে ঋজুদা কী শুনেছিল—কোন ভাষা। কিন্তু তার হাবভাব দেখে আমার মনে হল, বাঘটা ওই নালার বাঁকেই যেকোনো মুহূর্তে দেখা দিতে পারে।
ওইভাবে কতক্ষণ কেটে গেল মনে নেই। আমার মনে হল, কয়েক ঘণ্টা, কিন্তু আসলে হয়তো পাঁচ মিনিটও নয়।
এখানে কেন বসে আছে, একথা আমি ঋজুদাকে জিজ্ঞেস করব ভাবছি, এমন সময় জলের শব্দ ছাপিয়ে হঠাৎ একটা শব্দ কানে এল। এক মুহূর্ত কান খাড়া করে শুনেই, ভেজা বালিতে হামাগুড়ি দিয়ে নালার বাঁকের দিকে এগোতে লাগল ঋজুদা। শব্দটা আমিও শুনেছিলাম। কুকুরে জল খেলে যেমন চাক-চাক-চাক শব্দ হয় তেমনই শব্দ, কিন্তু অনেক জোর শব্দ।
শব্দটা তখনও হচ্ছিল। বাঘটা নিশ্চয়ই ঝরনার জল খাচ্ছিল।
বাঁকটা তখনও হাত দশেক দূরে। ঋজুদা জোরে এগিয়ে চলেছে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে, রাইফেলটাকে হাতের ওপর নিয়ে। আমার বুকের মধ্যে তখন একটা রেলগাড়ি চলতে শুরু করেছে—এত ধক ধক করছে বুকটা, ঘামে সমস্ত শরীর, মাথার চুল সব ভিজে গেছে। আমার তখন খালি মনে হচ্ছিল, ঋজুদা দেখতে পাওয়ার আগে তার জল খাওয়া শেষ করে চলে যাবে না তো বাঘটা?
হঠাৎ, একেবারেই হঠাৎ, আমার বুকের স্পন্দন থেমে গেল।
আমার সামনে ঋজুদা বালিতে শুয়ে পড়েছে—প্রোন-পজিশনে দু-হাতে রাইফেলটা ধরে নিশানা নিচ্ছে।
ততক্ষণে আমি ঋজুদার পাশে পৌঁছে গেছি। পৌঁছেই যে দৃশ্য দেখলাম তা সারাজীবন চোখে আঁকা থাকবে।
ঝরনাটার ওপরে ডানদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বাঘটা জল খাচ্ছে। চাঁদের আলোয় তার মাথা, বুক সব দেখা যাচ্ছে, কিন্তু পেছনের দিকটা অন্ধকার। তার প্রকান্ড মাথাটা জলের ওপর একটা বিরাট পাথর বলে মনে হচ্ছে। আমিও যেই শুয়ে পড়ে বন্দুকটা কাঁধে তুলতে যাব, ঠিক এমনি সময়ে বুক-পকেটে রাখা বুলেটটার সঙ্গে বন্দুকের কুঁদোয় ঠোকা লাগতেই খুট করে একটু শব্দ হল। তাতেই বাঘ এক ঝটকায় মাথা তুলে এদিকে তাকাল। বাঘটা কানে-তালা-লাগানো গর্জনের সঙ্গেসঙ্গে শরীরটাকে গুটিয়ে যেন একটা বলের মতো করে ফেলল এবং মুহুর্তের মধ্যে সোজা আমাদের দিকে লাফাল। লাফাল না বলে উড়ে এল, বলা ভালো। আমার কানের পাশে ঋজুদার ফোরফিফটি-ফোর হানড্রেড রাইফেলের আওয়াজে মনে হল বাজ পড়ল। বাঘের গর্জন, হনুমানদের চেঁচামেচি, দাপাপাপি, জঙ্গলের গভীরে অদৃশ্য নানা পাখির চেঁচামেচিতে এবং রাইফেলের গুমগুমানিতে যেন আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। দেখলাম, আলো-ছায়ায় মেশা একটা অন্ধকারের স্তূপ উড়ে আসছে আমাদের দিকে শূন্য থেকে, তার সামনে প্রসারিত করা—নখ সমেত প্রকান্ড থাবা দু-টি। বোধহয় ঘোরের মধ্যেই আমি একই সঙ্গে দুটো ট্রিগার টেনে দিয়েছিলাম বন্দুকের। কিন্তু গুলি লাগল কি না লাগল কিছু বোঝা গেল না—বাঘটা জলের মধ্যে ঝপাং করে পড়ল, প্রায় আমাদের নাকের সামনে। আমার মনে হল, থাবাটা একবার তুলে বাঘটা আমার মাথায় এক থাপ্পড় মারল বুঝি। আমি তখনও শুয়েই ছিলাম, দু-হাতে বন্দুকটাকে সামনে ধরে।
যেন ঘুমের মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যে, যেন অনেক দূর থেকে ঋজুদা আমাকে ডাকল, ‘রুদ্র, এই রুদ্র!’
তাকিয়ে দেখলাম, আমার পাশে ঋজুদা বাঘটার ঘাড়ের দিকে রাইফেলের নল ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি উঠে দাঁড়াবার সঙ্গেসঙ্গেই বাঘটাও যেন একবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। সারা-শরীর নড়ে উঠল, জল ছপছপ করে উঠল, ডন দেবার মতো উঠে দাঁড়াতে গেল বাঘটা। ঋজুদা রাইফেলটা কোমরে ধরা অবস্থাতেই বাঁ ব্যারেল থেকে আবার গুলি করল। বাঘটার মাথাটা ঝপাং করে জলে পড়ল।
একটাও কথা না বলে ঋজুদা ঝরনার কাছ দিয়ে নালা পেরিয়ে বাইরের উপত্যকায় এল। এসে ফাঁকা জায়গা দেখে একটা বড়ো পাথরের ওপরে বসে পকেট থেকে পাইপটা বের করে ধরালো। বলল, গাঁয়ের শিকারির নিশানা ফসকে গিয়েছিল। তার গুলি সত্যিই বাঘের পায়ে লেগে থাকলে ব্যাপারটা এত সহজে শেষ হত না। দূরে দেখা গেল—ঝাঁকড়া পিপুল গাছের দিক থেকে একটা লোক আমাদের দিকে জ্যোৎস্নায় ভেসে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসছে। মাহাতো।
হঠাৎ ঋজুদা যেন কেমন উদাস হয়ে গেল।
পিউ-কাঁহা পাখিটা অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আবার ডাকতে লাগল দূর থেকে। বাঘ মরে গেছে—এ-খবরে আনন্দ কী দুঃখপ্রকাশ করল জানি না, কিন্তু চতুর্দিকের বন-পাহাড়ে আবার নানারকম পশুপাখির ডাক শোনা যেতে লাগল।
আমি শুধোলাম, ঋজুদা, ছেলেটা?
ঋজুদা পাইপের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, কিছু করার নেই। ওর বাবা-দাদারা আসবে—যাদের আপনজন, তারাই নিয়ে যাবে। কীই-বা করার আছে আমাদের?
আমি শুধোলাম কোথায় আছে?
ঋজুদা বলল, এমনভাবে বলল, যেন নিজে দেখেছে, ওই ঝরনার ওপাশে, বেশ কিছুটা ওপাশে নালার মধ্যেই পড়ে আছে।
আমিও পাথরটার ওপর বসে পড়ে খুশি গলায় বললাম, যাক, বাঘটাকে মেরেছ ভালোই হয়েছে। বদমাইশ বাঘ।
ঋজুদা শুকনো হাসি হাসল।
বলল, আহা, কী দারুণ বাঘটা! বেচারা!
তারপরই বলল, উপায় ছিল না বলেই হয়তো ও ছেলেটাকে মেরেছিল। জন্তু-জানোয়ারদের ভালোবাসিস, বুঝলি, রুদ্র। মানুষকে মানুষ তো ভালোবাসেই। কিন্তু ওদের ভালোবাসতে পারে, ভালোবাসতে জানে খুবই কম মানুষ।